সাবধান

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন এদের থেকে খুব সাবধান, যেমন “প্রথম, বড় মানুষ। টাকা লোকজন অনেক, মনে করলে তোমার অনিষ্ট করতে পারে। তাদের কাছে সাবধানে কথা কইতে হয়। হয়তো যা বলে সায় দিয়ে যেতে হয়।” খাঁটি কথা। আরেকজন সন্তও এইকথা বলে গেছেন—”হাঁ জী, হাঁ জী করতে রহিয়ে; বৈঠিয়ে আপনা ঠাম।” প্রতিবাদ করেছ কি অকারণ ঝামেলায় জড়িয়ে মরেছ। তা বড় মানুষ মানেই কর্মস্থলের বড়কর্তা। তিনি হলেন গিয়ে অন্নদাতা। তাঁর কৃপাতেই আমাদের লপচপানি। বউয়ের টাঙ্গাইল শাড়ি, ছেলের ইংলিশ এডুকেশন, খানায় মুরগীর ঠ্যাঙ, চোখে গগলস, পরনে চোস্ত পাজামা পাঞ্জাবি। তাঁর ঘরে যখন সভা বসে তখন মনের নোটিস বোর্ডের দিকে একবার তাকাতেই হয়—সাবধান বড় মানুষ, প্রভূত ক্ষমতা রে ভাই। এক টুসকিতে তোমার হাঁড়ি শিকেতে তুলে দিতে পারেন, পায়ের তলা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন তোমার বিচরণভূমি। তিনি যা বলেন তাই সত্য। হাঁ জী, হাঁ জী। কে না জানে, তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট। তিনি সন্তুষ্ট হলে জগতের কল্যাণ। আমার জগৎ তো আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নয়। বড় জগৎ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার জগৎ আমার পরিবারটুকু। সেই পরিবারের কল্যাণে মাসের শেষে এক গোছা কারেন্সি নোট চাই। বড়কর্তার তালে তাল দিতে পারলে কেয়াবাত। ফ্যামিলিতে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলবে। মেয়ের বিয়েতে জোড়া সানাই বাজবে। জীবিকাই তো আমাদের ডিফেন্স-ড্যান্স। তালে লয়ে নাচতে হবে। বড়কর্তা গোঁ ধরবেন, আর আমরা নেচে যাব মিস্টার ঘোষ, মিস্টার বোস, মিস্টার মিত্তির। কেউ বুঝতেই পারে না, এক একসময় আমরা কেমন অক্লেশে বাঁদরের ভূমিকায় নেমে আসি তিনি খেলান আর আমরা খেলি। তিনি মনে করেন—বাঃ এই বাঁদরটা বেশ ভাল নাচে, দাও ওটাকে প্রমোশন দিয়ে। সেই বাঁদরটা অমনি ম্যানেজার হয়ে গেল। গোছায় গোছা যোগ হলো। মানে নোটের গোছায়। পরিবারের সুখ বাড়ল। আরেকজন বিদ্যের জাহাজ। সে ঐ বড় মানুষটির প্রতিবাদ করেছিল, “আজ্ঞে না, আপনি যা বলছেন, তা আমি মানতেই রাজি নই। আপনি জানেন না।’ বড়কর্তার মুখ একটু লালচে হয়েই কালো হয়ে গেল। তিনি একবার হাঁ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। সেই বিশ্বরূপ দর্শন হলো প্রভুর মুখগহ্বরে। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কর্মচারি আর তাদের পরিবারবর্গ। তিনি চিউইংগামের মতো চিবোতে লাগলেন। চোয়ালের হাড় বারকয়েক উঁচু নিচু হলো। বোঝা গেল কি হতে চলেছে সেই অবোধ প্রতিবাদকারীর। ধীরে ধীরে তাকে ‘অফ’ করে দেওয়া হবে। চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে টুল দেওয়া হবে। তখন ঘর ছেড়ে তার বারান্দায় অবস্থান। মডার্ন ম্যানেজমেন্টের ভাষায় একে বলে, ‘করিডর সার্ভিস’। হয় ছাড়পত্র দিয়ে মালপত্র নিয়ে মানে মানে বিদেয় হও, নয়তো বসে বসে অপমান হজম কর। প্রভু, আমরা কলম ব্যবহার করি কলম হিসেবে। আপনার কলম হলো ‘বেয়নেট’। এক খোঁচায় বিদ্যের জাহাজের ভরাডুবি। বিদ্যের জাহাজ যদি সংসার অর্ণব পাড়ি দিতে না পারে, তখন জাহাজের কি প্রয়োজন। তাই প্ৰভু, আর কিছু চাই না, তোমার কৃপায় রাঙঝাল একটু দাও, ফুটোফাটা বন্ধ করে অন্তত একটু ভেসে থাকি। থেকে থেকে ভোঁ মারি। বেঁচে থাকার ভোঁ।

সংসারে আমাদের স্ত্রীরাও খুব বড় মানুষ। সেখানেও হাঁ জী, হাঁ জী, চালাতে না পারলে অস্তিত্ব বিপন্ন। তুমি যন্ত্রী দেবী, আমি যন্ত্র। স্ত্রী যদি বলে, ‘তোমার মতো গর্দভ দুনিয়ায় দুটো নেই।’ ‘ঠিক বলেছ ম্যাডাম।’ পরেরটা উহ্য, ‘তা নাহলে তোমার কাছে ধরা দিই।’ ফ্রয়েডকে প্রশ্ন করা হলো—আপনি তো মানব- মনস্তত্ত্বের একজন দিগ্‌গজ পণ্ডিত, আপনার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর কোনদিন মনোমালিন্য হয়েছিল?

ফ্রয়েড বললেন, জীবনে একদিন। শোবার ঘরের মাথার কাছে একটা জানালা খোলা নিয়ে! স্ত্রী বলেন খুলব, আমি বলি খুলো না, মাথায় ঠাণ্ডা লেগে যাবে। মাঝরাতে হাতাহাতি হয় আর কি। শেষে বাঁচিয়ে দিলে একটা টুপি।

টুপি?

হ্যাঁ, যে টুপি মানুষ অন্যকে পরায় সে টুপি নয়, সত্যিকারের একটা উলের টুপি। টুপিটা মাথায় পরে সুখের নিদ্রা।

তা আপনার সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্যটা কি?

অতি সহজ, হাঁ জী, হাঁ জী, করতে রহিয়ে।

ঠাকুর রামকৃষ্ণের পরবর্তী সাবধান বাণী—কুকুর। কুকুর হইতে সাবধান যখন কুকুর তেড়ে আসে কি ঘেউ ঘেউ করে তখন দাঁড়িয়ে মুখের আওয়াজ করে তাকে ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর ষাঁড়। গুঁতোতে এলে, তাকেও মুখের আওয়াজ করে ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও, তাহলে বলবে তোর চোদ্দ পুরুষ, তোর হেনতেন, বলে গালাগালি দেবে। তাকে বলতে হয় কি খুড়ো কেমন আছ? তাহলে খুব খুশি হবে, তোমার কাছে বসে তামাক খাবে।

সাবধান! কাদের থেকে সাবধান—বড়মানুষ, কুকুর, ষাঁড় আর মাতাল। সব এক গোত্রের।

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন