‘সা-রে-মা’তে

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

কথাটা হলো—জীবনের সঙ্গে ধর্ম মেলাব, না ধর্মের সঙ্গে জীবন মেলাব! যদি ধর্মের সঙ্গে জীবন মেলাতে হয় তাহলে সংসার ছাড়তে হবে, সন্ন্যাস নিতে হবে। এদিক ওদিক দু-দিক রাখা চলবে না। সে পেরেছিলেন জনকরাজা। ঠাকুর বলছেন :

“জনক রাজা মহাতেজা তার বা কিসে ছিল ত্রুটি।
সে যে এদিক ওদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি।।”

সংসারে থেকে ঈশ্বরকে পাওয়ার বাধাটা কোথায়! ঠাকুরঘর যদি নাও থাকে একটা কুলঙ্গি তো আছে। সেখানে দেব-দেবীর চিত্রপট। ধূপের সমারোহ। অনেকে আবার স্টিলের আলমারির ওপরের তাকে মূর্তি রাখেন, গণেশ অথবা বাণলিঙ্গ শিব। পুঁচকে ঘণ্টা, হোমিওপ্যাথিক ঘটি, ছোট্ট রেকাবি, মিনি গেলাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চটজলদি পুজো সারেন। টিংটিং ঘণ্টাবাদন, দোপাটির পাপড়ি বর্ষণ, গোটা চারেক নকুলদানার নৈবেদ্য। রাজধানীর স্পিডে স্তোত্রপাঠ, ধূপের ঘূর্ণন, আড়ে আড়ে ঘড়ির দিকে তাকানো, চার্টার্ড বাস ছেড়ে না যায়! পাশের ঘরে ছেলে মানুষ হচ্ছে। ছেলের মা উত্তম-মধ্যম দিচ্ছেন। কচি শিশু জি-তে আটকে আছে, কিছুতেই এইচ-এ যেতে চাইছে না। কেবলই লাফ মেরে চলে যাচ্ছে—এলো, মেলো, পি। এরই মাঝে ‘জবাকুসুমসঙ্কাশং’, ‘তাড়াতাড়ি খেতে দাও’, ‘কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং’, ‘ওকে এইবার ছাড় না, এবার দুজনেই উন্মাদাশ্রমে যাবে’, ‘ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং’, ‘আজ আর বাসটা পেলুম না!’ …

এবপ্রকার ভজনায় ঈশ্বরলাভ কি সম্ভব! মনবিযুক্ত মননে তিনি কি আসবেন! ঠাকুর বলছেন : “সংসারে হবে না কেন? তবে বড় কঠিন। জনকাদি জ্ঞানলাভ করে সংসারে এসেছিলেন। তবুও ভয়! নিষ্কাম সংসারীরও ভয়। ভৈরবীকে দেখে জনক মুখ হেঁট করেছিল, স্ত্রীদর্শনে সঙ্কোচ হয়েছে! ভৈরবী বললে, ‘জনক! তোমার দেখছি এখনো জ্ঞান হয় নাই; তোমার এখনো স্ত্রী-পুরুষ বোধ রয়েছে।’ কাজলের ঘরে যতই সেয়ানা হও না কেন, একটু না একটু কালো দাগ গায়ে লাগবে।”

বলেই বলছেন : “দেখেছি, সংসারী ভক্ত যখন পুজো করছে গরদ পরে তখন বেশ ভাবটি। এমনকি জলযোগ পর্যন্ত এক ভাব। তারপর নিজ মূর্তি, আবার রজঃ তমঃ।”

সংসারে সমস্যাটা কি? ঠাকুর বোঝাচ্ছেন : “সংসার জল আর মনটি যেন দুধ। যদি জলে ফেলে রাখ, তাহলে দুধে-জলে মিশে এক হয়ে যায়, খাঁটি দুধ খুঁজে পাওয়া যায় না।” তারপর বলছেন : “সংসার যেন বিশালাক্ষীর দ, নৌকা দহে একবার পড়লে আর রক্ষা নাই। সেঁকুলকাটার মতো এক ছাড়ে তো আরেকটি জড়ায়। গোলকধান্দায় একবার ঢুকলে বেরুনো মুশকিল। মানুষ যেন ঝলসা পোড়া হয়ে যায়।’

কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। ওর ভিতর অনেকদিন থাকলে হুঁশ চলে যায়—মনে হয় বেশ আছি। মেথর গুয়ের ভাঁড় বয়-বইতে বইতে আর ঘেন্না থাকে না। গুটিপোকার উপমা দিচ্ছেন—কেটে বেরিয়ে আসতে পারে, বেরুবে না, ঐ আবরণেই মৃত্যু হবে। আবার যেন ঘুনির মধ্যে মাছ; যে-পথে ঢুকেছে সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু বেরুবে না। কেমন জলের মিষ্টি শব্দ, অন্য অন্য মাছের সঙ্গে খেলা! একেবারে মশগুল অবস্থা। ছেলেমেয়ের আধ আধ কথাবার্তা যেন জলকল্লোলের মধুর শব্দ! মাছ অর্থাৎ জীব, পরিবারবর্গ। তবে দু-একটা দৌড়ে পালায়, তাদের বলে মুক্ত জীব।

ঠাকুর গান গেয়ে বলছেন :

“এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে।
ব্ৰহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি জানিতে পারে।।
বিল করে ঘুনি পাতে মীন প্রবেশ করে তাতে।
গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে।।”

এই সত্যের ওপর ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের অধিষ্ঠান। জীব চিরটাকাল ধরে সংসারে আসবেই। এছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। সন্ন্যাসীর সংসার থাকে না। সংসারীরই সংসার হয়। মহামায়ার মায়ায় তার বিচরণ। জীবের জৈবধর্ম পালন করতেই তার আসা। অতএব ধর্মের সঙ্গে সব ত্যাগ করে জীবন যোগ করা সকলের পক্ষে সম্ভব হবে না। সে হলো লক্ষে একটি দুটি ঘুড়ি কাটার মতো।

ঠাকুরের কথা হলো, জীবনের সঙ্গে ধর্ম যোগ কর। একের পরে শূন্য বসাও তখন তার মূল্য বাড়বে। এক সরালে শূন্য শূন্যই। খুঁটি ধরে থাকার কথা বলছেন। সব ত্যাগ, বাহ্য ত্যাগ। সে তো উত্তম কথা। “উখার দো মকান, লাগা দো তম্বু, নিয়ে কৌপিন-ঝোলা শ্মশানে চলে গেল ভোলা।” ঠাকুর বলছেন, বহুত আচ্ছা, লেকিন এক বাত, তোমার মন! তার কাছ থেকে পালাবে কেমনে! সেখানে তো একটাই কথা, তিক্ত কথা—

“মনে বাসনা থাকিতে কি হবে বল না জপিলে তুলসীমালা।

চিতে কামনা থাকিলে নাকে তিলক কাটিলে ভোলে কি চিকন কালা।।” গলার কাছে পায়রার মটরদানার মতো সংসার গজগজ করছে, তুমি সন্ন্যাসী হয়ে আত্মপ্রবঞ্চনা করছ! যদি এই তোমার সন্ন্যাস হয় তাহলে তুমি যাও, তোমার মতো সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার কোন প্রসঙ্গ নেই। সংসারী! তুমি এস, “সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছ এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা নাহলে হবে না। এক হাতে কর্ম কর, আরেক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাক। কর্ম শেষ হলে দুই হাতে ঈশ্বরকে ধরবে। মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত।” “তোমাদের সব ত্যাগ করতে হবে কেন? তোমরা রসে-বসে আছ। সা-রে-মাতে। তোমরা বেশ আছ!

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন