মাপো আর জপো

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

“যার আছে সে মাপো, যার নেই সে জপো”–শ্রীশ্রীমায়ের কথা। যার আছে অর্থাৎ যার বিষয়-সম্পত্তি জমি-জিরাত আছে সে সারাজীবন কি করে? কত ধানে কত চাল, সারাটা জীবন ঐ করে যায়। কোথায় টাকা খাটালে কত সুদ, তার হিসাব কষে। সিন্দুক-ভর্তি কোম্পানির কাগজ রোজ বার করে। আর রোদ খাওয়ায়। ডিভিডেন্ডের হিসাব কষে।

শ্রীশ্রীমা বলেছেন : “ঈশ্বরের কৃপায় যার বিষয়-সম্পত্তি আছে সে ‘মাপুক’ অর্থাৎ দান করুক।”

আবার এ মানেও হতে পারে, ভিতরে যদি আধ্যাত্মিকতার উন্মেষ হয়ে থাকে তাহলে পরিমাপ কর, রোজই তা বাড়ছে কিনা! মানুষের দু-রকমের চলন। এক চলা বাইরের—কলকাতা থেকে কানপুর চলে গেল। আরেক চলা ভিতরের। মন-পথিক! তুমি কতটা এগোলে? সংসার থেকে তোমার দূরত্ব কতটা বাড়ল! তোমার দেহ থাক তোমার মন কি বেরতে পেরেছে? তুমি কি ‘বাবুর বাড়ির দাসী’র মন পেয়েছ? মুখে বলছে বটে আমার কানু, আমার গোপাল, মন পড়ে আছে দেশের বাড়িতে। সেখানে আছে তার নিজের ছেলেমেয়ে, নিজের সংসার। তোমার মন কি নষ্ট-নারীর মতো হয়েছে? সে কি রকম? হেঁসেলে সব কাজই করছে, মন উসখুস করছে, কখন ভেসে আসবে সেই পরপুরুষ—প্রাণের মানুষটির শিস। তখন আমার ঘরেই থাকা দায়।

‘পড়ে থাক মনের বোঝা ঘরের দ্বারে-
যেমন ওই এক নিমেষে বন্যা এসে
ভাসিয়ে নে যায় পারাবারে।।”

সেইরকম আমিও ভেসে যাই ‘পান্থজনের সখা’র হাত ধরতে। তখন আমি সকলেরই অনেক পর। কে তোমরা? পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা। ঠাকুর বলেছেন, সংসার যদি করতেই হয় তো করবে বাইরে থেকে। ‘বাবুর ফুলবাগানের মালি’র মন নিয়ে। আমার পুকুর, আমার আমগাছ। এই দেখুন কেমন ফুলের বাহার লাগিয়েছি। যেদিন বাবু দূর করে দেবেন ঘাড় ধরে, সেদিন গেট পেরিয়ে এসে নিজের ফেলে যাওয়া পোঁটলাটিও নেবার উপায় থাকবে না। মানুষকে জীবন-বাগানে যিনি বহাল করে গেলেন, তাঁর হাতে কিন্তু ডিসচার্জের ক্ষমতা নেই। এই বাগানের মালিক হলেন মৃত্যু। তাঁর সেরেস্তায় জীবের নিয়োগ-খাতা। চাকরির মেয়াদের হিসাব তিনিই রাখছেন। তিনিই সই করছেন ডিসচার্জ নোটিশ।

ঠাকুর বলছেন, আমি, আমার—এইটি হলো অজ্ঞান। তুমি, তোমার—এই হলো বিজ্ঞান। তাহলে মাপো, সেই জ্ঞান তোমার কতটা হলো! যদি দেখা যায় আসক্তি আছে, তাহলে বুঝতে হবে কষ্টও আছে। ঠাকুর বলছেন, বলদ হাম্বা হাম্বা করে। হাম-বা। আমি, আমি। চাষা তাকে লাঙলে জুতছে, কলু তাকে দিয়ে ঘানি ঘোরাচ্ছে। পিটছে, কষ্ট দিচ্ছে, গাড়ি টানাচ্ছে। বলদ কেবল হাম্বা, হাম্বা করছে। একদিন তার মৃত্যু হলো, নাড়ি-ভুঁড়ি থেকে তৈরি হলো তাঁত। চড়ল গিয়ে সারেঙ্গিতে, একতারাতে। শব্দ বেরল তুঁহু তুঁহু। তখন সে উদ্ধার পেয়ে গেছে। জীব জীবনেই যদি ক্লেশমুক্ত হতে চায় তাহলে তাকে ঐ তুঁহু মন্ত্ৰ নিতে হবে—’তুঝসে হামনে দিলকো লাগায়া, যো কুছ হ্যায়, সো তুহি হ্যায়। সব তুমি। এখন মেপে দেখ, সত্যিই সব ব্যাপারে এই বোধ তোমার পাকা হয়েছে কিনা। মন দেখ! মুখে মানুষ অনেক কথা বলতে পারে। তার কোন মূল্য নেই। নিজেকেই নিজে ফাঁকি দিলে কিছু করার নেই। ঠাকুর বলতেন : “এক- আনা দু-আনা নয়—ষোল আনা বিশ্বাস চাই।” সেই বিশ্বাস তুমি মাপো; যদি দেখ নেই, তাহলে?

সত্যিই কি নেই! ঠাকুর গল্প বলছেন : “মাঝরাতে বাবুর ঘুম ভেঙেছে। ইচ্ছা হয়েছে—একটু তামাক খাবেন। সবই আছে—কল্কে, তামাক, টিকে, ঠিকরে। নেই কেবল চকমকি পাথর। টিকে ধরাবেন কিসে! প্রবল বাসনা, তামাক একটু খেতেই হবে। লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে পড়লেন চকমকি পাথরের সন্ধানে। প্রতিবেশীকে ঠেলে তুললেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কি! চকমকি পাথর! আরে আগুন তোমার হাতে! তোমার লণ্ঠনে।”

এই হলেন গুরু! “যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।” দর্পণে দেখ নিজের মুখ। কাঁচ অপরিষ্কার! ঝাপসা দেখাচ্ছে। তাহলে কাঁচের কাছে মুখ এনে একবার হা কর। তারপর মোছ, সব পরিষ্কার। এই ‘হা’ হলো জীবের হাহাকার। মার্জনা হলো সৎকর্ম। ঠাকুর বলছেন, গীতায় কি আছে? তাগী, তাগী, তাগী। দশবার বললেই গীতা হয়ে গেল। ত্যাগই আসল। বাইরে ত্যাগ নয়, মনে ত্যাগ। তোমার দু-হাত দিয়ে যা ধরে আছ, যা ধরার চেষ্টা করছ, ছেড়ে দাও। তাঁকে ধরতে দাও তোমার হাত। তিনি ধরলে আলের পথে তোমার আর পড়ার ভয় নেই!

শ্রীশ্রীমা বললেন, তুমি জপো। তোমার ঘোলা জলে জপের নির্মলি ফেল। বালতির জলের তলায় একটি স্বর্ণকান্তি মোহর আছে। জল ঘোলা তাই দেখতে পাচ্ছ না। নির্মল হলেই দেখতে পাবে। ছোট ছোট ঢেউ খেলছে, কামনা- বাসনার ঢেউ, তাই বিম্ব ধরা পড়ছে না। তুমি জপো। মন স্থির কর। জপতে জপতে তৈরি হবে জপের শরীর। তখন তুমি সূক্ষ্মকে ধরতে পারবে। সূক্ষ্মেই সেই বিশালের বিচরণ। অবিশ্বাসী সংসারী মানুষ থেকে, বিষয়ীর কাছ থেকে দূরে থাক। বিশ্বাস পাকা হয়ে গেলে আর কোন ভয় থাকে না।

তবে একটা কথা, খুব রোখ চাই। ভোগের নামমাত্র থাকলে তাঁর সঙ্গে যোগ হবে না। জীব ছুঁচ, ঈশ্বর চুম্বক। তিনি টানবেনই; কিন্তু ছুঁচে যদি মাটি লেগে থাকে! চুম্বক টানবে না।

তাহলে জপো। জপে বিশ্বাস। জপে অশ্রু। অশ্রুধারায় নির্মল। কাঠ যতক্ষণ ভিজে ততক্ষণ আগুন জ্বলবে না। সোঁ সোঁ শব্দ, ধোঁয়া। যেই ধরে গেল তখন লকলকে শিখা। জপে সেই সংসার-রস মরবে। আধ্যাত্মিকতায় ঝনঝনে খনখনে হবে।

তাই যার নেই সে জপো। “লাগি লগন মীরা হোগই মগন।।“

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন