মহাভাব

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ভক্তি পাকলে ভাব—তারপর মহাভাব, তারপর প্রেম, তারপর বস্তুলাভ (ঈশ্বরলাভ)। ঠাকুর নবদ্বীপ গোস্বামীকে বোঝাচ্ছেন। এক অবতার আরেক অবতারের অবস্থা বিশ্লেষণ করছেন। ঠাকুর বলছেন : “গৌরাঙ্গের মহাভাব, প্রেম। এই প্রেম হলে জগৎ তো ভুল হয়ে যাবেই। আবার নিজের দেহ যে এত প্রিয় তাও ভুল হয়ে যায়। গৌরাঙ্গের এই প্রেম হয়েছিল। সমুদ্র দেখে যমুনা ভেবে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। জীবের মহাভাব বা প্রেম হয় না—তাদের ভাব পর্যন্ত। আর গৌরাঙ্গের তিনটি অবস্থা হতো। কেমন?”

ঠাকুর প্রশ্ন করছেন নবদ্বীপ গোস্বামীকে। মিলিয়ে নিতে চাইছেন।

নবদ্বীপ গোস্বামী বলছেন : “আজ্ঞা হাঁ। অন্তর্দশা, অর্ধবাহ্যদশা আর বাহ্যদশা।”

ঠাকুর বলছেন : “অন্তর্দশায় তিনি সমাধিস্থ থাকতেন। অর্ধবাহ্যদশায় কেবল নৃত্য করতেন। বাহ্যদশায় নামসঙ্কীর্তন করতেন।”

ঠাকুর বলছেন : “লীলা ধরে ধরে নিত্যে যেতে হয়, যেমন সিঁড়ি ধরে ধরে ছাদে উঠা। নিত্যদর্শনের পর নিত্য থেকে লীলায় এসে থাকতে হয়। ভক্তি-ভক্ত নিয়ে। এইটি পাকা মত। তাঁর নানা রূপ, নানা লীলা।” ঈশ্বরের লীলা কি কি? ঈশ্বরলীলা, দেবলীলা, নরলীলা, জগৎলীলা। ঠাকুর বলছেন : “তিনি মানুষ হয়ে অবতার হয়ে যুগে যুগে আসেন প্রেমভক্তি শিখাবার জন্য। দেখ না চৈতন্যদেব। অবতারের ভিতরেই তাঁর প্রেম-ভক্তি আস্বাদন করা যায়। তাঁর অনন্তলীলা—কিন্তু আমার দরকার প্রেম, ভক্তি। আমার ক্ষীরটুকু দরকার। গাভীর বাঁট দিয়েই ক্ষীর আসে। অবতার গাভীর বাঁট।”

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবান শ্রীচৈতন্যের অবস্থার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে বোঝাতে চাইছেন, অন্যরকম হওয়ার উপায় নেই, যে-লীলার যা-প্রকাশ। শুধু তোমরা মিলিয়ে নাও। বুঝতে পার ভাল। না পার অন্ধকারে ঘুরপাক খেয়ে মর।

ঝামাপুকুরের নকুড়বাবাজী এসেছেন। ঠাকুর নিজের ঘরের পশ্চিমবারান্দায় বসে আছেন। বসে আছেন রাখাল, মাস্টার প্রমুখ ভক্তেরা। একটু আগে ঠাকুর ছিলেন ভবতারিণী মন্দিরে পূজার আসনে। সেইসময় শ্রীমও ছিলেন সঙ্গে। ঠাকুর মায়ের পাদপদ্মে ফুল দিয়েছেন। নিজের মাথায় ফুল রেখে ধ্যানস্থ হয়েছেন। বহুক্ষণের ধ্যান। ভাবে বিভোর। শ্রীম দেখেছেন, তিনি নৃত্য করছেন, আর মুখে মায়ের নাম—”মা, বিপদনাশিনী গো, বিপদনাশিনী!” সেই ভাব নিয়েই এসে বসেছেন পশ্চিমের বারান্দায়। ঠাকুর ভাবাবেশে পর পর কয়েকটি গান গাইলেন। আহারান্তে সামান্য বিশ্রাম। এলেন মনোহরসাঁই গোস্বামী। গোস্বামীজী কীর্তন গাইছেন—পূর্বরাগ।

“ঘরের বাহিরে, দণ্ডে শতবার
তিলে তিলে আসে যায়
কিবা মন উচাটন নিঃশ্বাস সঘন,
কদম্বকাননে চায়।”

শেষ লাইনটি শোনামাত্রই ঠাকুরের মহাভাবের অবস্থা। গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন।

কীর্তনীয়া তখন গাইছেন—

“শীতল তছু অঙ্গ
তনু পরশে, অমনি অবশ অঙ্গ!”

মহাভাবে ঠাকুরের শরীর কাঁপছে। কেদারের দিকে তাকিয়ে কীর্তনের সুরে ঠাকুর বলছেন :

“প্রাণনাথ, হৃদয়বল্লভ তোরা কৃষ্ণ এনে দে;
সুহৃদের তো কাজ বটে;
হয় এনে দে, নাহয় আমায় নিয়ে চল;
তোদের চিরদাসী হব।”

গোস্বামী কীর্তনিয়া ঠাকুরের মহাভাবের অবস্থা দেখে মুগ্ধ। তিনি হাতজোড় করে বলছেন : “আমার বিষয়বুদ্ধি ঘুচিয়ে দিন।”

ঠাকুর হাসতে হাসতে বলছেন : “ “সাধু বাসা পাকড় লিয়া।’ তুমি এত বড় রসিক; তোমার ভিতর থেকে এত মিষ্ট রস বেরুচ্ছে!”

“সাধু বাসা পাকড় লিয়া।” বড় অপূর্ব কথা! তিনি কৃপা করে কাছে টানেন, তাঁর কৃপায় লীলা-দর্শন। মহাভাব সন্দর্শনে নিজের ভাব যদি সামান্যও উথলে ওঠে তাহলেই তো মহাপ্রাপ্তি। সেই তো আমার, ‘বাসা পাকড়ানো।’ চোখের সামনে দেখছি অবতারলীলা-

“হে দেব হে দয়িত হে ভূবনৈকবন্ধো।
হে কৃষ্ণ হে চপল হে করুণৈকসিন্ধো।
হে নাথ হে রমণ হে নয়নাভিরাম
হাহা কদা নু ভবিতাসি পদং দৃশোর্মে।।”

এই ‘হাহা’ ভাবটি যদি সঞ্চারিত হয় অন্তরে হাহাকারের মতো তাহলেই তো “বাসা পাকড় লিয়া।” ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের যা হতো, মহাপ্রভুরও তাই হতো—

“স্তম্ভ কম্পপ্রস্বেদ বৈবর্ণ অশ্রুস্বরভেদ
দেহ হৈল পুলকে ব্যাপিত।
হাসে কান্দে নাচে গায় উঠি ইতি উতি ধায়
ক্ষণে ভূমে পড়িঞা মূর্ছিত।।
মূর্ছায় হৈল সাক্ষাৎকার উঠি করে হুহুঙ্কার
কহে এই আইলা মহাশয়।”

একটু আগেই ঠাকুর ছোকরা ভক্তদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে করতে গাড়িতে আসছিলেন। গন্তব্য পানিহাটি। সেখানে মহোৎসব। সেখানে গাড়ি পৌঁছাল। ঠাকুর গাড়ি থেকে নামলেন। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি। মহাসঙ্কীর্তন। খোলকরতালের শব্দ। হঠাৎ ঠাকুর তীরবেগে ছুটছেন। একা। ভক্তের দল হতবাক। একি ভাবান্তর! কোথায় ঠাকুর! নিমেষে অদৃশ্য।

ঐ তো তিনি! নবদ্বীপ গোস্বামীর সঙ্কীর্তনের দলে দুহাত তুলে নৃত্য করছেন। মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন। পাছে পড়ে যান, গোঁসাইজী তাই ধরে আছেন।

“মত্ত গজ ভাবগণ প্রভুর দেহ ইক্ষুবন
গজযুদ্ধে বনের দলন
প্রভুর হৈল দিব্যোন্মাদ তনুমনে অবসাদ
ভাবাবেশে করে সম্বোধন।।”

“সাধু বাসা পাকড় লিয়া!”

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন