হাত ধর

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সমর্পণ। তাঁর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দাও। আর কোন ভাবনা নেই। এইবার আমি বেড়ালছানা। মা বিছানায় তুলবেন তো আমি বিছানায়। মা যখন ছাইয়ের গাদায় ফেলছেন, আমি তখন ছাইয়ের গাদায়। মা আমার হাত ধরেছেন। ঠাকুর বলছেন, বাপ যখন ছেলের হাত ধরে আলের ওপর দিয়ে নিয়ে যান সে হাত খুলে ছেলের পড়ে যাবার ভয় থাকে না। আর ছেলে যদি বাপের হাত ধরে, ভয় আছে। অন্যমনস্ক হলেই পতন। মা, তুমি আমার হাত ধর।

তিনি ধরবেন কেন? কেনই বা ধরবেন না! আমি যে বলেছি। কিভাবে বলেছি? মুখে বলিনি। মনে বলেছি। মন আমার কেঁদেছে। ঠাকুর বলছেন, খুব কাঁদ। কেঁদে কেঁদে বল। একটিই অস্ত্র—কান্না। কান্না মানেটা কি? ব্যাকুলতা। জগৎসংসারে আমার কেউ নেই। আমি বড় একা। সংসার—বিদেশে বিদেশীর বেশে ঘুরছি অকারণে। “বিষয় পঞ্চক আর ভূতগণ সব তোর পর, কেহ নয় আপন।” এই বোধই আমার ব্যাকুলতার কারণ। মা আমাকে পুতুল দিয়েছিলেন, মাকে ভুলে থাকার জন্য। হঠাৎ মনে হয়েছে—এ তো পুতুল! আমি মায়ের কাছে যাব। আমি আমার মাকে চাই। তাই আমার তারস্বরে কান্না। সব কাজ ফেলে মাকে ছুটে আসতে হবেই।

আচ্ছা, এই বিশ্বাসটাই বা আমার এল কোথা থেকে? ঠাকুর বলেছেন। বললেই হবে? না, তিনি করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমার গুরু। গুরুবাক্য অভ্রান্ত। গুরু বললেন, এই কাগজের মোড়কটা হাতে নিয়ে নদীর ধারে যা। নৌকা নেই তো কি হয়েছে, জলের ওপর দিয়ে নির্ভয়ে হেঁটে যা। শিষ্য সত্যিই হেঁটে পার হয়ে গেল নদী—বিশ্বাসের এত জোর। যার বিশ্বাসের তেমন জোর ছিল না, সে নদীর মাঝ বরাবর এসে মোড়কটা খুলে দেখলে। লেখা আছে শুধু একটি কথা—রাম। রামনামের কি এত জোর! যাঁহাতক মনে হওয়া ডুবে গেল ভুড়ভুড় করে।

বিশ্বাসে অবিশ্বাস পথ পায় কেমন করে? ঢুকিয়ে দেয়, ইঞ্জেকশন করে দেয় অবিশ্বাসী, বিষয়ী মানুষেরা। ঠাকুর বলছেন, বিষয়ী, অবিশ্বাসী মানুষদের এড়িয়ে চলবি। নিবাত, নিষ্কম্প দীপশিখায় তারা ফুঁ মেরে চঞ্চল করে দেরে। যুক্তিজাল বিস্তার করে বলবে—কিছু নেই। ও-তে কিছু নেই, সব আছে এ-তে। জন্ম- ভোগ-মৃত্যু, এই হলো তিন সত্য। তা, তোমার কথা মানব কেন? তুমি কে? কাম-কাঞ্চনের দাস। তুমি এক লেজ-কাটা শৃগাল। সকলের লেজই কাটতে চাও। বিষয়ীর শেষ অবস্থা তো দেখেছি আমি। অনুভূতিশূন্য পশুর মতো। এক তিল শান্তি নেই জীবনে। জ্বলন্ত লোভ-পিণ্ড। পড়ে আছে বিছানায়। একটু পরেই মরবে। বউ বলছে, তুমি তো বেশ চললে, আমার জন্যে কি রেখে গেলে! ছেলে এসে বালিশের তলায় সিন্দুকের চাবি খুঁজছে। আমি জানি, তখনো তোমার চৈতন্য হবে না। তুমি এদিকে ও-দিকে তাকিয়ে বলবে, ওরে! দু-একটা আলো নেবা। তেল বেশি পুড়ছে।

দর্শন, বিচার, বিশ্বাস! দর্শন কোন বই নয়। জীবনদর্শন। যে জীবনে আছি সেই জীবনকে দর্শন। চলচঞ্চল, অস্থির এক অস্তিত্ব। আজ একরকম তো কাল একরকম। আজ যে আছে, কাল সে নেই। কোন কিছুই ধরে রাখা যায় না। জীবন, যৌবন, ধন, মান! আমার ছেলে বলে যিনি বুকে জড়িয়ে ধরতেন, তুমি রইলে বলে তিনি চলে গেলেন। ‘সখা আমার’, ‘প্রিয় আমার’ বলে যাকে আঁকড়ে ধরতাম, মহাকাল তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলেন। আর প্রতিদিন নিজের অজ্ঞাতেই জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে একটি করে দিন। জন্মদিন মানে বেঁচে থাকার একটি দিন নয়। হিসেবটা উলটো, মৃত্যুর দিকে একটি দিন এগুনো। আমার বয়স পঞ্চান্ন, মানে মৃত্যুর দিকে পঞ্চান্ন বছর এগিয়েছে জীবন। আর হয়তো পড়ে আছে পাঁচ কি দশ বছরের পথ। জীবনের হাত ধরে মৃত্যুই হাঁটছে। আমি বসে পড়লেও সে বসছে না। আমাকে কোলে করেই এগিয়ে চলেছে। ক্ষণকাল গিয়ে মিলবে মহাকালে।

‘জনম-মরণ জীবনের দুটি দ্বারে
উদয় অস্ত আসে যায় বারে বারে।
হেথা আশা সেথা নিরাশার শুধু বাণী,
পথিকেরে লয়ে দুই পথে টানাটানি
এ যদি বাঁধেগো জীবনের বীণা
ও ছেঁড়ে বীণার তার।।”

ঠাকুর বলছেন, মৃত্যুকে সবসময় স্মরণে রাখবে। মৃত্যু-স্মরণ। না, ভয় নয়। সব ছেড়ে একদিন চলে যে যেতেই হবে, এই কথাটি স্মরণে রেখে সব কাজ করবে। বাবুর বাগানের মালী আমি। বলছি, আমার পুকুর, আমার আম গাছ। বাবু যদি বিদায় করে দেন তা আমার আমকাঠের সিন্দুকটি লয়ে যাবারও ক্ষমতা থাকবে না। মৃত্যু-স্মরণ হলে ইহ-সংসারে পরের বাড়ির দাসীর মতো থাকা সম্ভব হবে। মুখে বলছি, আমার গোপাল, আমার রাখাল, মনে জানি এরা আমার কেউ নয়। আসল যারা, তারা সব আছে দেশের বাড়িতে, নিজ নিকেতনে। মন চল নিজ নিকেতনে। ঠাকুর বলছেন, সংসারে ভাব দেখাবে যেন কতই তুমি ওদের—স্ত্রী, পুত্র পরিবারের। কত ভাব, কত ভালবাসা, মনে মনে জানবে ওরা তোমার কেউ নয়। ওরা ওরাই। আসল যিনি, তিনি আছেন আড়ালে।

এই দর্শনের পরেই নিত্য-অনিত্যের বিচার। কেউ বলে দিলে হবে না। ওতে বিশ্বাস হবে না। ধাক্কা খাব, হোঁচট খাব। বিচার করব। নিজের সঙ্গে নিজের বিচার। ঠাকুর বলছেন, বিচার করবে। সংসারের এক একটা জিনিস ধরবে। খুঁজবে, তার মধ্যে সত্য আছে কি? টাকা? টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, পরিধানের বস্ত্র হয়, একটা বাসস্থান হয়। এর বেশি তো কিছু হয় না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ—অপচয়। পাঁচ ভূত সাবড়ে দেয়। ঠাকুর বলছেন, তুমি সংসারী–পঞ্চিও নও, দরবেশও নও, ওদের সঞ্চয়ের প্রয়োজন নেই; কিন্তু নীড়ের পাখি সঞ্চয় করে তার শাবকের জন্যে, যতদিন না তার ডানায় জোর আসছে, যতদিন না সে উড়তে পারছে ততদিন। তোমারও সেই পথ। ততটুকুই উপার্জন করবে, যতটুকু প্রয়োজন। তার বেশি নয়। যত বেশি টাকা, তত বেশি অশান্তি। তাহলে কাঁচ আর কাঞ্চনে কোন তফাত নেই।

সংসার! সেই একই ব্যাপার। একটা মায়া। বিরাগ আনার জন্যে ঠাকুর নির্দেশিত বিচারের পথটি আরো নির্মম। আধেয় বস্তুর ক্রম-বিশ্লেষণ। ঠাকুর বলছেন, আচ্ছা, পুরোপুরি ত্যাগ, সম্পূর্ণ বিরাগ, তুমি সংসারী হয়তো পারবে না। সংস্কার দোষ। বহুকালের অনুসৃত অভ্যাস। সংসারেই থাক। নাহয় ইন্দ্ৰিয় সুখভোগ হলো, কিন্তু সেই ফকিরের মতো পরস্ত্রী বা পরপুরুষ যতই লোভ দেখাক নির্মম প্রত্যয়—প্রাতঃকৃত্যের সময় যে গাড়ুটির কাছে লজ্জা সমৰ্পণ করেছি, সেই গাড়ুটি ছাড়া, অন্যে প্রয়োজন নেই।

বিচারেই অনিত্যের প্রকাশ। হাতে রইল বিশ্বাস। মা, তুমি ছাড়া যে আমার কেউ নেই। তুমি আমার হাত ধর।

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন