খানদানী চাষা

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ঈশ্বর স্বয়ং আনন্দস্বরূপ। তারার চুমকি বসানো রাতের আকাশে তাঁর হাসি। চাঁদভাঙা নদীর স্রোতে তাঁর হাসি। প্রভাত সূর্যের গাছের পাতায় পাতায় তাঁর ঝিলমিল হাসি। তাঁর বিশ্বরচনার সর্বত্র তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন সুন্দরতম করে। মানুষেও তাঁর সেই প্রকাশ। এখন মানুষ যদি নিজেকে নষ্ট করে তাহলে তো কিছু করার নেই।

আনন্দের উপাসনা না করে কেন দুঃখের উপাসনা! মুক্তির আরাধনা না করে কেন বন্ধন, আরো বন্ধনের অভিপ্রায়! ঠাকুর শ্যামপুকুর বাটীতে। দুরারোগ্য ব্যাধির সবে সূত্রপাত, কিন্তু আনন্দে আছেন। সকলকে আনন্দে ভরপুর করে রেখেছেন।—সংসার কেমন জানিস! এই বাউলের দল। এল, একখানে জড়ো হলো। গাইলে, নাচলে, হাসলে, তারপর হাট ভেঙে দিয়ে চলে গেল। পড়ে রইল শূন্য মাঠ, উনুনের ছাই, ভাঙা হাঁড়ি, কলসি। আবার একদল আসবে কোনদিন। তাহলে আনন্দস্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দী মন্ত্র কি? রোগ জানুক আর দেহ জানুক, মন তুমি আনন্দে থাক।

ডাক্তার সরকার এসেছেন। ঠাকুর অল্প অল্প কাশছেন। গলায় ব্যথা, ঢোক গিলতে অসুবিধা। শ্রীশ্রীমা কখনো গলা ভাত, কখনো সুজির পায়েস খাওয়াবার চেষ্টা করছেন। ডাক্তার জিজ্ঞেস করছেন : “আবার কাশি হয়েছে?” তারপর সহাস্যে বলছেন : “তা কাশীতে যাওয়া তো ভাল!”

অন্য ভক্তরাও হাসছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলছেন : “তাতে তো মুক্তি গো! আমি মুক্তি চাই না, ভক্তি চাই।”

আমি ভক্ত হওয়ার জন্য বাঁচতে চাই, বারে বারে আসতে চাই। তোমাকে সাজাব ফুলসাজে, অভ্র-চন্দনে। তোমাকে নিবেদন করব, তোমাকে গান শোনাব, তোমার জন্য কাঁদব। তোমা থেকে আমি বিচ্ছিন্ন—বেদনার এই হাহাকারেই আমার আনন্দ। আগে এই জ্ঞান পাকা করব যে, তুমি আছ। তারপর নিজের কাঁচা ‘আমি’টাকে পাকা করব। তারপর তুমি—’তুমি’, আমি— তোমার ‘ভক্ত আমি’। ভক্তির আমি-কে সাবধানে লালন করাটাই সাধনা। জ্ঞানবিচারে কাজ নেই।

“যতনে হৃদয়ে রেখ, আদরিণী শ্যামা মাকে;
(মন) তুই দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দ্যাখে।
কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি,
রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন ‘মা’ বলে ডাকে।।”

জ্ঞানবিচার চাই না। দক্ষিণেশ্বরে সাধক-জীবনের প্রথমদিকে রাতের অন্ধকারে রামকৃষ্ণ কেঁদে কেঁদে বেড়িয়েছেন আর বলেছেন, মা, আমার জ্ঞানবিচার ধ্বংস করে দাও। আমি ভক্ত আর ভগবানকে নিয়ে থাকতে চাই!

“(আমায়) দে মা পাগল করে (ব্রহ্মময়ী)
(আর) কাজ নাই মা জ্ঞানবিচারে।”

ভগবানের আর সব আছে। ষড়ৈশ্বর্যশালী। কিন্তু তাঁর একটি জিনিস নেই, সেটি হলো ভক্তি। ভক্তি জীবের সম্পদ। তুমি ত্রিভুবনেশ্বর, কিন্তু “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে?” তোমার বিরহে কে কাঁদবে? কে নিশিভোর প্রদীপ জ্বেলে বসে থাকবে দুয়ারে? কোথায় পাবে তুমি মাতা যশোদাকে? ঘরসংসার ফেলে বাঁশি শুনে গোপীরাই আসবে ছুটে আর কেউ নয়। তোমার বিরহে নদের নিমাই ছাড়া কে ঝাঁপ দেবে নীল সফেন সাগরে? ভক্ত আছে বলেই না তুমি মন্দিরে ভগবান!

ভাবস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তার সরকারকে বলছেন : “মহীন্দ্রবাবু, কি টাকা টাকা করছ!… মান, মান করছ! ওসব এখন ছেড়ে দিয়ে, একচিত্ত হয়ে ঈশ্বরেতে মন দাও।—ঐ আনন্দ ভোগ কর।”

ভক্ত হব বললেই তো আর হওয়া যায় না। সহজ, অথচ বড় কঠিন পথ। পুজো করা, কি অসংখ্য জপ করা যায়। কিন্তু চোখে জল আসে কই! তাঁর নাম করামাত্রেই নয়ন ঝরে—এমন অবস্থা হয় কই! বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞেস করছেন :

“মহাশয়, ভক্তি কেমন করে হয়?”

ঠাকুর বলছেন : “ব্যাকুলতা। ছেলে যেমন মার জন্য। মাকে দেখতে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে কাঁদে, সেইরকম ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাঁদলে ঈশ্বরকে পর্যন্ত লাভ করা যায়।”

এইবার আমাদের প্রশ্ন হলো—”ব্যাকুলতা আসবে কি করে?”

নিজের ব্যাকুলতা সম্পর্কে ঠাকুর বলছেন : “যখন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরবাড়িতে সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠত তখন আমি গঙ্গার ধারে গিয়ে মাকে কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলতুম, ‘মা, দিন তো গেল, কৈ এখনো তোমার দেখা পেলুম না।’”

এমন ব্যাকুলতা আসবে কি আমাদের! আমাদের ধারাটা হলো—হলো হলো, না হলো না হলো, দিন গেল তো কি হলো! এইবার খেয়েদেয়ে পাখা চালিয়ে ভোঁস ভোঁস। সকাল হলেই নিত্যদিনের পৃথিবী ক্যাক করে ধরবে!

কিন্তু ভুলেও যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে ছুঁয়েছেন তাঁদের ঘুম গেছে। রামকৃষ্ণ রয়্যাল বেঙ্গল। আবার তাঁরই উপমা–বিড়াল দুভাবে ধরে। তার ইঁদুর ধরাটা একরকমের ধরা। আবার নিজের বাচ্চাকে যখন ঘাড়ে ধরেছে, সে-ধরাটা আরেক রকম। বাচ্চাটি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ স্থানে। যেখানে হুলোর আক্রমণ নেই।

বাঘরূপী শ্রীরামকৃষ্ণ টানতে টানতে নিয়ে যাবেন স্থির সরোবরের কিনারায় নিজেকে দেখ। জলদর্পণে স্ববিম্ব। স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, অর্থ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি অস্থায়ী বাষ্প আমি মুছে দিই। এইবার দেখ তোমার মুখ। নিজের মুখচ্ছবি দেখে সন্তুষ্ট হতে পারছ?

না ঠাকুর।

কি কি সংশোধনের দরকার?

হাসি নেই।

কেন নেই?

বেঁচে থাকার আতঙ্কে।

আতঙ্ক কেন? চার্বাক-দর্শন অনুসরণ করলে ক্ষতি কি? “যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।”

ঐ দর্পণের পাশে যে আপনি এসে দাঁড়িয়েছেন! রামকৃষ্ণানুভূতিতে সংসার তলিয়ে যেতে চায়।

তার মানে আমি বটের আঠা! বটপাতার আঠার মতো জড়িয়ে ধরেছি!

হয়তো তাই। কেবলি মনে হয়—হচ্ছে না, হলো না। স্বরূপ ভুলে ঘুরছি কেন? আনন্দময়ীর পুত্র আমি, সদানন্দের বদলে সদানিরানন্দ। কুকুরের লেজে কে একটা সংসারের টিন বেঁধে দিয়েছে, যত দৌড়াই তত ঠ্যাংঠ্যাং শব্দ, যত ঠ্যাংঠ্যাং শব্দ তত দৌড়। মানুষের ভিতরে একটা সদসৎ প্রশ্ন থাকে, প্রশ্নকারী থাকে, যার নাম বিবেক। আমার বিবেকের নাম—শ্রীরামকৃষ্ণ।

তাহলে বলি শোন —”খানদানী চাষা হও। যারা খানদানী চাষা তারা বার বৎসর অনাবৃষ্টি হলেও চাষ দিতে ছাড়ে না; আর যারা ঠিক চাষা নয়, চাষের কাজে বড় লাভ শুনে কারবার করতে আসে, তারাই এক বৎসর বৃষ্টি না হলেই চাষ ছেড়ে দিয়ে পালায়; তেমনি যারা ঠিক ঠিক ভক্ত ও বিশ্বাসী, তারা সমস্ত জীবন তাঁর দর্শন না পেলেও তাঁর নাম-গুণকীর্তন করতে ছাড়ে না।”

আমাকে বিশ্বাস কর, রোজ চোখ বুজে এই দেহটাকে একবার দেখ।

“হরিসে লাগি রহরে ভাই,
(তেরা) বনত বনত বনি যাই
(তেরা) বিগড়ী বাত বনি যাই।।”

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন