সেই আবেগে

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

কি করে কি হয়। ঠাকুর বলছেন : “প্রথমটা একটু উঠে পড়ে লাগতে হয়। তারপর আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।” এই উঠেপড়ে লাগাটা কি রকম! ঠাকুরই দিয়েছেন পথের নির্দেশ। তার মতে, কাম-কাঞ্চনের ঝড়-তুফানগুলো কাটিয়ে গেলে তখন শান্তি। কাম-কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। কিসের সঙ্গে যোগ? তাঁর সঙ্গে যোগ। তিনি কে? তাঁর বিশেষণ আমরা জানি। তাঁকে আমরা জানি না। বিশেষণ হলো—সৎ-চিৎ-আনন্দ। তিনি সচ্চিদানন্দ। সেই যোগে মানুষ সৎ হবে। নিজের সঙ্গে নিজের যোগ হবে। চিৎকে, চৈতন্যকে সে খুঁজে পাবে। স্বরূপের দর্শন পাবে। ফলে সে আনন্দের সন্ধান পাবে। মানুষের সমস্ত নিরানন্দের কারণ আসক্তি। আসক্তি তার ভয়ঙ্কর দুটি বস্তুতে—কাম আর কাঞ্চন। দুটি বস্তু গাঁট ছড়ায় বাঁধা। কামের জন্য প্রয়োজন কাঞ্চনের। আবার কাঞ্চন এলে আসবে কাম। এই দুই বস্তু মানুষের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অস্বীকার করার উপায় নেই। এ আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। উঠেপড়ে লাগা মানে, কাম-কাঞ্চনের মোহ থেকে দূরে থাকা। দূরে থাকা মানে মন থেকে দূর করা। মন থেকে তাড়াতে না পারলে মন ছোঁক ছোঁক করবে। ঠাকুর বলছেন : “মনই সব জানবে। জ্ঞানই বলো আর অজ্ঞানই বলো, সবই মনের অবস্থা। মানুষ মনেই বদ্ধ ও মনেই মুক্ত, মনেই সাধু এবং মনেই অসাধু, মনেই পাপী ও মনেই পুণ্যবান। তার মানে পথ হলো সুদৃঢ় ইচ্ছা, বাহন হলো মন।” মাঝি গোপীদের বলেছিলেন—এক মন না হলে আমি যমুনা পার করি না। গোপীরা ভাবলেন, মাঝি বুঝি ওজনের কথা বলছে। না, ওজন নয়, মাঝি বলছেন মনের কথা। এক মন, এক কৃষ্ণ। মনে কৃষ্ণ ভিন্ন আর কেউ ঢুকে থাকলে কৃষ্ণ পাওয়া যায় না। এক কৃষ্ণ, এক রাধা। মনকে রাধা করতে না পারলে, কৃষ্ণ-সাধা হবে না। ভড়ং হবে, ভণ্ডামি হবে আর মনে বজবজ করবে দুই ‘ক’-এর আসক্তি। পথ বড় কঠিন। উপনিষদ্ বলছেন :

“ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।”

—যাঁরা জানেন, যাঁরা বিবেকবান তাঁরা বলেন, ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমণীয়, আত্মজ্ঞান লাভের পথও সেইরকম দুর্গম। তাহলে কি হবে? উপনিষদ্ বলছেন :

“উত্তিষ্ঠত জাগ্ৰত প্ৰাপ্য বরান্ নিবোধত।”

–তোমরা ওঠো। আত্মজ্ঞানের সন্ধান কর। সন্ধান পাবে কোথায়? শ্রেষ্ঠ আচার্যের সঙ্গ কর। তিনি তোমাকে আত্মজ্ঞানের সন্ধান দেবেন। তিনি বলবেন, বাসনার লেশমাত্র থাকতে ভগবান লাভ হয় না। যেমন সুতোতে একটু ফেঁসো বেরিয়ে থাকলে ছুঁচের ভিতর যায় না। মন যখন বাসনা-রহিত হয়ে শুদ্ধ হয়, তখনই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়।

এই বাসনাহীন মন কেমন? ঠাকুর বলছেন : “যেন শুকনো দেশলাই— একবার ঘসলে দপ করে জ্বলে ওঠে। আর ভিজে হলে ঘসতে ঘসতে কাঠি ভেঙে গেলেও জ্বলে না। সেই মতো সরল, সত্যনিষ্ঠ, নির্মল-স্বভাব লোককে একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিকে শত শতবার উপদেশ করলেও কিছু হয় না। “

পথের নির্দেশ তাহলে পাওয়া গেল ঠাকুরের কথায়—প্রথম সাধুসঙ্গ। সদ্গুরু চাই জীবনে। গুরুকে চাইবার আগে নিজের মানসিক প্রস্তুতি চাই। যেমন, আমরা স্নান করি দেহশুদ্ধির জন্যে, সেইরকম মানস-শুদ্ধির জন্যে প্রয়োজন সঙ্কল্প-স্নানের। সেই স্নানে মন হবে সরল, হবে সত্য-নিষ্ঠ, হবে নির্মল। এই তিন গুণ নিয়ে যেতে হবে গুরুর কাছে। কারণ এমন আকাঙ্ক্ষীকেই একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। অনুরাগের উদয় হলো, তবু বাকি রয়ে গেল অনেক পথ। অনুরাগ মানে রুচি। নামে রুচি। অন্য কথা, বিষয়কথা ভাল লাগছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, মনে বনে কোণে নির্জনে কিছু ভাবি। সংসারের সব কাজই করছি বড় লোকের দাসীর মতো। আমার আমার করছি বটে; কিন্তু বেশ একটা বোধ ক্রমেই জন্মাচ্ছে, এর কিছুই আমার নয়। অনুরাগ থেকে আসবে বিরাগ—বৈরাগ্য। বড়লোকের দাসীর মন পড়ে থাকে নিজের বাড়ির দিকে। সেই নিজের বাড়ি হলো, নিজের ভিতর। আলোকিত, মোহমুক্ত, নির্ভার এক অবস্থা। বাইরে থেকে ভিতরে আসতে হলে চাই অনাসক্তি। তুলসীদাসজীর কথা : “সব ছোড়য়ে সব পাওয়ে।” বৈরাগ্য থেকে আসবে অভাববোধ। তৃপ্তি নেই কোন কিছুতেই। শঙ্কর যেমন বলেছেন : “ন যোগে, ন ভোগে, ন বাজিমেধে।” ভোগ, যোগ, বিষয়কর্ম, কোন কিছুই আর ভাল লাগছে না। ভীষণ এক শূন্যতা। এই অবস্থা হলো বিরহের অবস্থা। সর্ব শরীর জ্বলে যাচ্ছে। শ্রীমতীর অবস্থা। কৃষ্ণ-বিরহে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। শীতল শিলায় শয়ন করলে পাথর পুড়ে যাচ্ছে। মহাপ্রভুর অবস্থা। ঠাকুর বলছেন—পাওয়া যায় তাঁকে; কিন্তু সেই আকুতি চাই—কি রকম? গুরু শিষ্যকে জলে চুবিয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ রেখেই ছেড়ে দিলেন। শিষ্য বাতাসের আশায় ছটফটিয়ে মাথা জলের ওপর তুললো। গুরু বললেনঃ “কি বুঝলে? যা বুঝলে সেই বোঝা লাগাও ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে। ঠিক ওই রকমটি হলে তবেই তাঁকে পাওয়া যায়।”

এইবার আমার প্রশ্ন আমার কাছে—পারবে ওই ছটফটানি আনতে? অ্যামেচার সাধক, সারা জীবন ‘সেয়ান পাগল কুঁচকি বগল’ হয়েই কাটবে নাকি? কৃপা করুন, কৃপাময়।

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন