কেন

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ঠাকুর সাহস করে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। অসন্তুষ্ট হবেন না। আপনি বললেন : “খুব ব্যাকুল হয়ে কাঁদলে তাঁকে দেখা যায়। মাগ-ছেলের জন্যে লোকে এক ঘটি কাঁদে; টাকার জন্যে লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়; কিন্তু ঈশ্বরের জন্যে কে কেঁদেছে, ডাকার মতো ডাকতে হয়।” আপনি গান ধরলেন : “ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে।” গান শেষে বললেন : “ব্যাকুলতা হলেই অরুণ উদয় হয়। তারপর সূর্য দেখা দেবেন। ব্যাকুলতার পরই ঈশ্বরদর্শন। তিন টান একত্র হলে তবে তিনি দেখা দেন-বিষয়ীর বিষয়ের উপর, মায়ের সন্তানের উপর, আর সতীর পতির উপর টান।” সেইখানেই আমার অভিমান। তিনি আমার মা। শ্যামা মা। নির্জনে বসে আমি মাকে বললুম : “মা, তুমি আমাদের কেমন মা? কতকাল ধরে সেই একই কথা শুনে এলুম—আমি তোকে দুঃখ দোব, জ্বালা-যন্ত্রণা দোব, তোর সবকিছু কেড়ে নোব, কেন? না, তাহলে তুই আমাকে ডাকবি। ‘যে করে আমার আশ, আমি করি তার সর্বনাশ’।” বা, কথা! আমি যদি তোমার ছেলে হই, তাহলে তুমি আমাকে কাছে ডাকবে না কেন! তোমার সামান্য কৃপায় তো আমার মন ঘুরে যেতে পারে। দেহ যখন দিলে, তখন দেহের প্রয়োজনে তো আমাকে জীবিকা খুঁজতেই হবে। হা অন্ন! হা অন্ন! এতো মা তোমারই খেলা। অন্ন-চাহিদা দিয়েই তো পাঠালে। পাশাপাশি পাঠিয়ে দিলে অন্নদাতা। তোমার সৃষ্টির প্রয়োজনেই তুমি পুরে দিলে সংসার-বাসনা। সংসারের প্রয়োজনেই বিবাহ। বিবাহ মানেই সন্তানাদি। আমার ইচ্ছেতে তো কিছু হয়নি মা। সবই তোমার ইচ্ছে। সাধকই তো বলেছেন—আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী। তুমি আমাকে সংসারের চক্রে ফেলবে। দাসত্ব করাবে। হা অন্ন, হা অন্ন করে দিগ্বিদিকে ছোটাবে। তারপর তুমিই আমাকে সংসারবদ্ধ জীব বলে ঘৃণা করবে। সেভাবে তোমাকে ডাকা হলো না বলে সরে থাকবে। এ তোমার কেমন বিচার! আমার জাগতিক মা কি আমাকে দিনান্তে ডেকে ঘরে তুলতেন না! আমার জন্যে ব্যাকুল হতেন না! আমি ভুলে থাকলেও তিনি তো আমাকে ভুলতেন না। আর তুমি জগৎ-মাতা হয়ে এই ব্যবস্থা করলে যে, আমাকে যতরকম বিপদে ফেলে আমাকে দিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদাবে। আমার জীবিকা টলমল হবে, পুত্র-কলত্র অকালে চলে যাবে, মামলা- মোকদ্দমা, চূড়ান্ত অপমান, সবই আমাকে সহ্য করতে হবে। সব হারিয়ে সর্বহারা হয়ে আমি তোমাকে ডাকব। তাতেও তোমার কৃপা হবে কিনা কে জানে! এমনই অনিশ্চিত ব্যাপার। তখন সাধকরা বলবেন—এক জন্মে কি হয় বাবা! কত জন্ম সাধনা করলে তবেই না মাকে পাওয়া যায়! আবার এও শুনলুম, মিনমিনে আস্তিকের চেয়ে নাস্তিক ভাল। শত্রুরূপে ভজনা। কংসের মতো, মহিষাসুরের মতো, রাবণের মতো। আমার বড় অভিমান মা তোমার ওপর। একবারও কি আমার কথা তোমার মনে পড়ে না! তাহলে সাধক কেন বললেন—কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়। আমার জাগতিক মাতা যদি আমার প্রতি উদাসীন হতেন, জগৎ কি তাঁকে ক্ষমা করত। আর তুমি জগৎ- মাতা বলে সবকিছুর ঊর্ধ্বে! তোমার বিধানই বিধান, আর আমার অভিমান ভেসে যাবে? সারাটা জীবন আমি অনাথের মতো ঘুরব? সংসারের খিদমত খেটে যাব। খারাপ যাকিছু হবে, সবই আমাকে ভেবে নিতে হবে, তোমার পরীক্ষা। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতে হবে, মা, সবই তোমার পরীক্ষা, তুমি যা করছ সবই আমার মঙ্গলের জন্যে। সাধক বলবেন—”মাকে হেরবো বলে ভাবনা তোমরা কেউ কর না আর।/সে যে তোমার আমার মা শুধু নয়, জগতের মা সবাকার।/ছেলের মুখে মা, মা বুলি শুনবে বলে শিবরানী/আড়াল থেকে শোনে, পাছে দেখলে যদি না ডাকে আর।” কি সুন্দর! সারা জীবন আমি ছটফট করব, আর তুমি আড়াল থেকে দেখবে। কারণ দর্শনমাত্রই আমার ডাকা বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি একবার দেখা দিয়ে দেখ না, আমার অবস্থাটা কি হয়!

ঠাকুর আপনিই বলুন। আপনারও তো এই একই অভিমান হয়েছিল। রামপ্রসাদকে দেখা দিলি মা, আমাকে দেখা দিলি না বলে, মায়ের হাতের খড়্গা নিয়ে নিজের জীবন বলি দিতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই এক রোকে মায়ের দর্শন পেলেন। তারপর কি হলো আমরা সবাই জানি। টাকা মাটি হলো, মাটি টাকা হলো। আপনি পরমপুরুষ, আমি শুধুই পুরুষ। তাহলে অহৈতুকি কৃপা কথাটা কোথা থেকে এল? বৃষ্টিধারায় পৃথিবী স্নাত হয়, তার জন্যে পৃথিবীকে তো সাধনা করতে হয় না। তার সুন্দর ব্যবস্থা তো তিনিই করে রেখেছেন সৃষ্টিকালে। তিনের চার ভাগ জল করলেন আর একের চার ভাগ স্থল। সূর্যকে এনে বসালেন গ্রহরাজির মাঝখানে। স্থল যেই উত্তপ্ত হলো বাতাস উঠে গেল ওপরে। জলকণা নিয়ে বাতাস ছুটে এল জলভাগ থেকে। জলকণা উড়ে গেল মেঘের পেখম মেলে। ঊর্ধ্বাকাশের শৈত্যে জমে বিদ্যুতের স্পর্শে নেমে এল বারিধারা হয়ে। কাল থেকে কালান্তর এই আবর্তনই চলবে। বিজ্ঞানের হাতে পৃথিবীকে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমাদের জীবন! কৃপাধারা কেন আসে না অযাচিত। আমাদের জীবনও তো সংসার-কটাহে উত্তপ্ত হচ্ছে নিয়ত, মন উড়ে যাচ্ছে বিষয় থেকে। বিষয় মনে হচ্ছে বিষ। অবিরত মন বলছে—মা তুমি কোথায়? বলছে—মন চল নিজ নিকেতনে/সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে।/বিষয়-পঞ্চক আর ভূতগণ সব তোর পর কেউ নয় আপন।” তবু মা আসেন না। ক্ষণিকের তরেও না।

ঠাকুর আপনি বললেন : “বিড়ালের ছানা কেবল মিউ মিউ করে মাকে ডাকতে জানে। মা তাকে যেখানে রাখে, সেইখানেই থাকে—কখনো হেঁসেলে, কখনো মাটির ওপর, কখনো বা বিছানার ওপর রেখে দেয়। তার কষ্ট হলে সে কেবল মিউ মিউ করে ডাকে, আর কিছু জানে না। মা যেখানেই থাকুক, এই মিউ মিউ শব্দ শুনে এসে পড়ে।” তাই যদি হয়, তাহলে আর কবে তিনি আসবেন! অবিরতই তো মিউ মিউ করছি। আপনি বলেছিলেন, ঈশ্বর মন দেখেন। মনে-মুখে এক হতে হবে। সে পরীক্ষাও দিতে রাজি আছি। “আর কবে দেখা দিবি মা! হর মনোরমা! দিন দিন তনুক্ষীণ, ক্রমে আঁখি জ্যোতিহীন।” আরেকটা জীবনও তো চলে গেল।

মা যদি সংসারী জীবকে এলে দেন তাহলে তারা তো আরো নষ্ট হয়ে যাবে। মায়ের সংসারে মা কেন গোছাবেন না! কেন মা আমাকে শাসন করে পথে আনবেন না! জীবনের পর জীবন নষ্ট হতেই থাকবে। তারপর একজীবনে আমি মায়ের দর্শন পাব। আপনি বললেন : “তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয়—তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়। এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়। ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিকে ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়। তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়।”

ঠাকুর, সবটাই আমার দিকে। আমাকে হতে হবে। মা কেন হওয়াবেন না?

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন