ধ্রুবতারা

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

কিছু চাইব না। সামান্যতম সুখও আমি চাইব না। ঠাকুর আপনি আমাকে যা দেবেন তাই আমার প্রাপ্য; কারণ আমি জানি না, কি চাইতে হয়! কোন্‌টা আমার শ্রেয় কোন্‌টা আমার প্রেয়। আর চাইবই বা কেন? আপনাতে যখন সমর্পিত আমি, তখন আপনিই তো জানবেন আমার প্রয়োজন। আপনিই তো আমার ভবরোগের বৈদ্য। আমার ওষুধ, আমার পথ্য সবই তো হবে আপনার বিধানে। বিনা অভিযোগে যেন গ্রহণ করতে শিখি। দুঃখ–সেও আপনার দান, সুখ—সেও আপনার দান, এই বোধে আমি যেন অবিচল থাকতে পারি। আমি যেন আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আমি যেন আপনার দর্শন পাই। আমি যেন আপনার স্পর্শ পাই। আমি যেন আপনার পদশব্দ পাই। আমি যেন আপনাকে অনুসরণ করতে পারি। আমার বিশ্বাস যেন টলে না যায়। একটা দানই আমি সকাতরে চাইব—কৃপা। নিরন্তর আমার এই প্রার্থনা—কৃপাকণিকা। কৃপা কি? আপনাকে বিশ্বাস। একটু অহঙ্কারও মিশুক না! কি সেই অহঙ্কার! আমি আপনার সন্তান! রামপ্রসাদের অহঙ্কার-

“এ সংসারে ডরি কারে, রাজা যার মা মহেশ্বরী।
আনন্দে আনন্দময়ীর খাস তালুকে বসত করি।।”

রাজা যার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, তার আবার কিসের ডর! ঠাকুর আপনিও বলতেন, রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না। বলতেন, মা যার আনন্দময়ী সেকি নিরানন্দে থাকে। রামকৃষ্ণের সন্তান আমি, আমার দিন ঠিকই চলে যাবে। প্রলোভন আমি জয় করতে পারব। আপনি বলেছিলেন, সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছের মতো। সেই পাঁকালের পিচ্ছিলতা আমি পাব আপনার কৃপায়। আপনি বলেছিলেন, হনুমান হতে। মহাবীর বুক ফেঁড়ে দেখালেন, রামসীতা। আমার নিষ্ঠায়, আমার বুকেও যেন ঠাকুর আর শ্রীমায়ের আসন পাকা হয়। নিষ্ঠা হলো, বালকের বিশ্বাস। বিশ্বাসে আমি যেন বালক হতে পারি। আপনি সেই জটিল বালকের গল্পটি বলেছিলেন—এক বিধবার একটি ছোট ছেলে ছিল। তার নাম জটিল। জটিল দূরে গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়তে যেত। বিধবা বড় গরিব ছিল। তাঁদের আপন বলতে আর কেউ ছিল না। জটিলকে একটা বনের ভেতর দিয়ে পাঠশালে যেতে হতো। বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে রোজই তার ভয় করত। একদিন মায়ের কাছে কেঁদে সে বলল, ‘মা, একা একা পাঠশালে যেতে আমার বড্ড ভয় করে। আমার সঙ্গে একটি লোক দাও। নইলে আর পাঠশালে যাচ্ছিনে।

জটিলের কথায় মায়ের মনে দুঃখ হলো; বললেন, ‘লোক কোথা পাব, বাছা! বনে তোমার এক দাদা থাকে। তার নাম মধুসূদন। ভয় পেলে তাকে ডেকো। সেই তোমার সঙ্গে যাবে।’ বালক সরল বিশ্বাসে ডাকে—’মধুসূদন দাদা, তুমি কোথায়? এস।’ বালকের ডাকে তিনি এলেন। সত্যিই এলেন, নির্জন বনপথ পার করে দিতে। গুরুমশাইয়ের মায়ের শ্রাদ্ধ। সব ছেলেরাই সবকিছু দিচ্ছে। জটিল কি দেবে! মা বললেন, ‘তোমার মধুসূদন দাদাকে জিজ্ঞেস কর।’ তিনি বললেন, ‘গুরুমশাইকে বলো, তুমি দই দেবে।’ কাজের দিন জটিল ছোট এক ভাঁড় দই নিয়ে হাজির হলো। গুরুমশাই ক্ষিপ্ত—এত নিমন্ত্রিত আর এতটুকু দই। প্রহারে জটিল জ্ঞানহারা। ওদিকে অলৌকিক কাণ্ড, মধুসূদনের ভাণ্ড আর ফুরোয় না। যত ঢালে তত দই। গুরুমশাই বললেন, ‘জটিল, তোমার মধুসূদন দাদাকে একবার দেখাবে!’ বনের প্রান্তে সবাই হাজির। জটিল ডাকছে, ‘মধুসূদন দাদা এস। আমার গুরুমশাই দেখবেন।’

তিনি উত্তর দিলেন—’জটিল, আজ আমি আসতে পারব না। তুমি সরল বিশ্বাসে আমাকে পেয়েছ। তোমার গুরুমশাই ও অন্যান্য ছাত্রদের তোমার মতো বিশ্বাস নেই। তারা আমায় দেখতে পাবে না। তারা চলে গেলেই আমি তোমার কাছে আসব।’

এই সংসার অরণ্যে, ঠাকুর আমি একলা পথিক। কেউ নেই আমার, অর্থ, সামর্থ্য, লোকবল। আপনি আমার মধুসূদন দাদা। বালকের বিশ্বাসে ডাকি, ঠাকুর, ঠাকুর। বিশ্বাসের সুতোয় অবিশ্বাসের সামান্যতম ফেঁসোটি যখন ভক্তিলালায় মসৃণ হয়ে যাবে, তখনই তা রামকৃষ্ণ সূঁচের ছিদ্রে অনায়াসে প্রবিষ্ট হবে।

তবু যদি দুঃখ পাই জ্বালাযন্ত্রণা আসে আসুক। আপনি বলেছেন :

“কি জান, সুখ-দুঃখ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল; তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে। শ্ৰীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুলনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল। একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে; তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না। সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীর দর্শন হলো। কিন্তু কারাগার ঘুচল না।” প্রারব্ধ কর্মের ভোগ আমাকে করে যেতেই হবে। আমার মন তৈয়ার। যে কদিন ভোগ আছে, সেই কদিন দেহধারণ। কিন্তু আমার আনন্দ! আপনিই সেই আনন্দ।

“ওহে ধ্রুবতারাসম হৃদে জ্বলন্ত বিশ্বাস হে,
জ্বালি দিয়ে দীনবন্ধু পুরাও মনের আশ।”

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন