অনুলোম বিলোম

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

শতমুখে তাঁর শত গুণগান। তিনি এই করেছেন, সেই করেছেন, পাহাড়, নদী, ঝরনা…। মাটির তলায় সোনা পুঁতেছেন, গিরিকন্দরে ডায়মন্ড! বাঘ! তার ছালের কী বাহার! কড়মড়িয়ে তোমাকে ডাঁটার মতো চিবোবে, কিন্তু কী সুন্দর ঘাতক! আবার প্রজাপতি! এক টুকরো নকশি কাগজ, ফুরফুরে আনন্দ যেন!

তাতে তোমার কি হলো! গোটা দুনিয়াটা তাঁর খাস তালুক! বড় মানুষের ঐশ্বর্য বর্ণনায় নিজের ঐশ্বর্য বাড়বে? ব্রাহ্মভক্তদের বিরক্ত হয়ে ঠাকুর বলছেন : “তোমরা কী গো! খালি তাঁর ঐশ্বর্য আর গুণ বর্ণনা! তোমার সূর্য, তোমার চন্দ্র, তুমি কন্দর্প, তুমি স্বরাট, বিরাট!”

আমি তাঁকে চাই। মা, আমি তোমার কোলে বসে ভাত খাব। একটু একটু আমি খাব, একটু একটু তুমি খাবে। আমার পূজা মানে নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ খেলা! তোমার আনন্দে আমার অবস্থান! তুমি ঘটি নও বাটি নও, সোনা নও হীরে নও। তুমি প্রেমিক, আমিও প্রেমিক। কখনো আমি বাঁশি তুমি ফুঁ, কখনো তুমি বাঁশি আমি ফুঁ।

তুমি কে?

শাস্ত্রমন্থনকারী মহাপণ্ডিতদের অনেক ব্যাখ্যা। সেসবে আমার প্রয়োজন নেই। যে-দরজা খোলাই আছে, সে-দরজায় পুটুরপুটুর করে শাস্ত্রের টোকা মারেন কারা? যাঁরা বোকা! জগতের চোখে তাঁরা সুপণ্ডিত, বিদ্যায় দিগ্‌গজ; কিন্তু সে পাণ্ডিত্য কেমন! না, লণ্ঠন-হাতে সূর্যের অন্বেষণ! বিচারের মানে জান? জান না! অহঙ্কার! আমার ঘড়ি ঠিক চলছে। আমি বিরাট, একজন কেউকেটা! আমার বিচারে, তুমি আছ না নেই! আগে আমি, তারপর তুমি! ইন্দ্রিয়ের রঙধরা চশমা পরে খুঁজছ কাকে? ইন্দ্রিয়াতীতকে! আনারস গাছের ফল ছেড়ে খাচ্ছ তুমি পাতা! আধপোয়া খোলে ধরাতে চাইছ এক সেরকে!

দর্শন কাকে বলে? জ্ঞান, বিচার! সে-দর্শন হলো একদল অন্ধের হস্তিদর্শন। একেবারে সবটা দেখতে হবে। সে-দর্শন তোমার বিচারকের দর্শন নয়। ভক্তের দর্শন। অজ্ঞের বিপরীত প্রাজ্ঞ। দুটোতেই ‘জ্ঞান’ শব্দটি রয়েছে। তোমার জ্ঞান, তোমার অজ্ঞান, তোমার খণ্ডজ্ঞান! জ্ঞানাতীতকে জানতে চাও জ্ঞান দিয়ে! দুধ শুনেছি, দুধ দেখেছি, দুধ খেয়েছি। পরোক্ষ জ্ঞান থেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, সেখান থেকে অভিজ্ঞতায়। ‘আমি’ থাকলে বিচার আসবেই। আমি, তুমি। অধিকার আসবে। আমার, তোমার। তুল্যমূল্য বোধ আসবে। আর আশপাশে মৃত্যু এলে ক্ষণিকের ঝটকাদর্শন—তুমি কে, কে তোমার! আবার তেল মাখবে, চুল বাঁধবে, পাতা কাটবে, পান খাবে। তোমার জগৎ তোমাতেই ফিরে আসবে। অনন্তের চৌকাঠে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে আসবে সীমায়। অসীমের জানালায় অহং-এর পর্দা!

আমি বিচারের কথা বলেছি। ‘নেতি নেতি’ বিচার।

ছাড়তে ছাড়তে ওঠ। তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন। সব অনিত্য। যেই নিত্যে পৌঁছলে, যদি পৌঁছাতে পার, তাহলে দেখবে নিচেও নেই, ওপরেও নেই। আবার সবই আছে—তিনিই এইসব হয়েছেন—জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব। দুধ শোনা, দুধ দেখা, দুধ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া। দুধকে দই পেতে মন্থন করে মাখন তুলতে হয়। কিন্তু মাখন তোলা হলে দেখে যে, ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল। খোলেরই মাঝ, মাঝেরই খোল। মাখন হয়েছে তো ঘোলও হয়েছে। মাখনকে ভাবতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে ঘোলকেও ভাবতে হয়, কেননা, ঘোল না থাকলে মাখন হয় না। তাই নিত্যকে মানতে গেলেই লীলাকেও মানতে হয়। অনুলোম ও বিলোম। এ অবস্থা কখন? তখন।

সেই তখনে খণ্ডদর্শনের অবসান। সেই তখনে একেবারে সবটা দেখে। সবটা মানে—ঈশ্বর, মায়া, জীব, জগৎ। তখন সে কি দেখে!

সে দেখে যে, মায়া, বিদ্যা এবং অবিদ্যা দুইই, জীব ও জগৎ আছে অথচ নেই। শোন, যতক্ষণ নিজের ‘আমি’ আছে ততক্ষণ ওরাও আছে। “জ্ঞান অসির দ্বারা কাটলে পরে আর কিছুই নাই! তখন নিজের ‘আমি’ পর্যন্ত বাজিকরের বাজি হয়ে পড়ে। কিরকম জান? যেমন পঁচিশ থাক পাপড়িওয়ালা ফুল। এক চোপে কাটা!”

শোন বাছা, নেচেকুঁদে লাভ নেই কিছু। সাত হাত গীতা পড়েছি, দশ গজ চণ্ডী! স্বভাবের বাঁকা লেজ সোজা হবে না তাতে। মালাও ঘোরাবে আর ছেলের বউকে কুটুসকুটুস কামড়াবে তাতে হবেটা কি! সারাটা রাত দাঁড় বেয়ে দেখলে, যে-ঘাটে ছিলে সেই ঘাটেই রইলে। নৌকার দড়িটাই খোলা হয়নি!

আমি কে? সবার আগে এই বোধটা আসুক না—আমি কেউ না, তুমিই সব ঠেকে শিখবে সবাই, ততদিনে মরণকালে এসে যাবে। লাভ হবে না কিছু। আমি বলছি, এই বিশ্বাসে আগেই সেটা ধরে ফেল! বিদ্যার ‘আমি’ থাকে থাক। তাতে বোধ হবে, আমার ভিতর দিয়েই তাঁর প্রকাশ। তিনি প্রেম দিলে প্রেমিক আমি। তিনি দয়া দিলে তবেই আমি দয়ালু। তিনি দাতা হলে তবেই আমি দান করি। তিনি জ্ঞান হয়ে প্রকাশিত হতে চাইলে তবেই আমি জ্ঞানী। আমি বাঁশি, তিনি ফুঁ। ‘আমি’র লম্ফঝম্প তারপরেও থাকবে। একেবারে শান্ত তখনই হবে যদি সেই আদ্যাশক্তি কৃপা করে তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞান দেন। আমরা তাঁর ‘আন্ডারে’! তাঁকে ছাড়িয়ে থাকার জো নেই।

তা এত কথার পর হলোটা কি! সেই রসুনের গন্ধ। কারণ, বাটিটা যে রসুনের। গিরিশকে বলেছিলেন, তা হোক না, পুড়িয়ে নিলে গন্ধ থাকবে না। পোড়াও জ্ঞানের আগুনে, বিচারের শিখায়। বাজিকরের বাজি, তার মধ্যে আমি তুমি, জগৎ সংসার। এটি বুঝতে গেলে যে ব্রহ্মজ্ঞান চাই, বাবা। বই কপচানো জ্ঞান নয়, বোধে বোধ চাই। বুড়ি ছুঁয়ে খেলা।

জ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে যেতে হবে। জ্ঞানী আর বিজ্ঞানীর পার্থক্য! অনেক। দুই বিপরীত মেরুতে উভয়ের অবস্থান! জ্ঞানী বলবে : “এ-সংসার ধোঁকার টাটি।” বিজ্ঞানী বলবে : “এ-সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি!”

আমি কি বলি জান? আমার কাজ নেই মা জ্ঞান-বিচারে। আমি ছুটে ছুটে মায়ের কাছে যাই। যে যা বলে ‘ভেরিফাই’ করে আসি। মা, তুমি বলে দাও, তুমি আমাকে বোঝাও। আমি শিশুর মতো পড়ে থাকি আমার মায়ের রাঙা পদতলে।

যদি প্রশ্ন কর—মা কে? মন্দিরের মূর্তি?

তাহলে বলি, তিনি আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস!

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন