বসে আছি

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ঠিক আছে! স্বস্তি না পাই, অপরিসীম এই অস্বস্তিটা তো পেয়েছি ঠাকুর! ধরা দিলেন না, কৃপা করলেন না। হয়নি, হচ্ছে না। যেভাবে ডাকলে সাড়া দিতেন, সেভাবে ডাকতে পারিনি। ফাঁক থেকেছে, ফাঁকি দিয়েছি। আয়োজনের ত্রুটি ছিল না। পট, মালা, আসন, ঘণ্টা, ফুল, চন্দন, ধূপ, বাতি, গ্ৰন্থ! আসনে বসেছি, মালা জপেছি। তন্মনস্ক হতে পারিনি। মন বসেনি। চোখে জল আসেনি। হৃদয় কাঁপেনি। আসনে জোর করে নিজেকে বসিয়ে রেখেছি। জপের সংখ্যা কোনরকমে শেষ করে ছুটে পালিয়েছি। জপ হয়েছে শাস্তি! ধ্যান হয়েছে বিষয়-আশয়! স্বাদ পাইনি। আপনি বলেছিলেন, নিবাত, নিষ্কম্প দীপশিখায় মনকে আরোপ করতেন। আমিও করেছি, কিন্তু নিষ্কম্প করতে পারিনি; এলোমেলো বাতাসে কেঁপেছে, কেবলই কেঁপেছে, শেষে দপ করে নিভে গিয়ে শান্তি দিয়েছে! আপনাকে হৃদয়ে বসাব কি ভ্রমধ্যে—এই দোটানায় আপনি অবশেষে বসার আসন না পেয়ে বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন।

মন যেন হড়হড়ে তালশাঁস। চেপে ধরতে গেলেই পিছলে পালায়। পদ্মপাতায় জলের মতো। যেই স্থির করতে যাই, টলমল করে শেষে ঝরেই যায়। মনকে শাসন করব কি, মনই আমাকে শাসন করে! ধ্যান মানে লড়াই। সবাই আসে, আপনি কিন্তু আসেন না। আপনাকে ভাবতে বসলেই অন্য সব ভাবনা ভিড় করে আসে। অথচ আকাঙ্ক্ষা কি বিরাট—স্বামীজীর মতো ধ্যানসিদ্ধ হব! তিন কথায় বিশ্ব কাঁপাব! দেহ থেকে জ্যোতি ঠিকরে বেরবে! ইষ্টের সঙ্গে সেলুলার ফোনে কথা হবে! বাকসিদ্ধ হব!

মালা ছিঁড়ে গেল, হাজার টাকার ধূপ পুড়ে গেল, গোটাকতক ফুলের বাগান শেষ হয়ে গেল। তবু আঁধার ঘরে আলো আর জ্বলল না। পাখি দাঁড়ে বসে ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলে, বেড়ালে ধরলেই ‘ক্যাঁ ক্যা”। জ্ঞানের ফুলঝুরি, আসলে অজ্ঞান। মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনাকে টপকে চলে গেছি! ভামির শেষ নেই!

দেখতে দেখতে দিন চলে গেল, বিষণ্নতার অন্ধকারে একা বসে আছি, পরাজিত। ছুঁচে সুতো পরাতে পারিনি। ভক্তির লালাতে মসৃণ করতে পারিনি ফেঁসো। নিজের গৌরব বাড়াতে আপনার শত কথা বলেছি, নিজের জীবনে অনুশীলন করিনি। মুখস্থ করেছি, মনস্থ করিনি। কী হবে আমার!

প্রশ্নের উত্তরে নিজেই বলি—কী আবার হবে, এবারটাও গেল! তিনি বলেছিলেন : “চৈতন্য হও।” শোনাই সার। ‘চৈতন্য’ কাকে বলে—সেইটাই পরিষ্কার হলো না। আমি কে? একটা নাম। দোকানের গায়ে ঝোলানো সাইনবোর্ডের মতো। লেনা আর দেনা। নিজেকে বাজারে বিকানো। তাকের ওপর লাল গণেশ। মোবাইল পূজারী গঙ্গাজল ছিটায়, ফুল ছুঁড়ে দেয়। মাসিক বরাদ্দ বাঁধা। কপালে টিপ পরায়। সন্ধ্যাবেলা টুনিলাইট জ্বলে। ধূপের ধোঁয়ার পাক মেরে ধূপাধারে গুঁজে দেওয়া। ‘চৈতন্য’ কে চায় প্রভু! শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাই!

আপনি বলেছিলেন : “বিচার কর, টাকায় কি হয়!”

বিচারে বসে এই পেলাম—টাকাতেই সব হয়। টাকা হলো নেশা। যত পাই তত চাই। বেশ একটা ‘সুখ সুখ’ ভাব আসে মনে! শ্রেষ্ঠত্বের একটা অভিমান। অদ্ভুত একটা রাজসিকতা। বিত্ত-বৈভবে কি শান্তি আসে! আপনি চিলের উপমা দিয়েছিলেন—যতক্ষণ ঠোঁটে মাছ ততক্ষণ কাকের তাড়া। ফেলে দিলেই শান্তি। পড়েছি, কিন্তু সংস্কারে গ্রহণ করিনি। চিল হয়েই বসে আছি। কাকের অত্যাচারে অহঙ্কার স্ফীত হয়! আমি চিল। স্বভাবে চিল। অভাবে কাক। এখন কী করি ঠাকুর!

হাজার বছরের এই অন্ধকার ঘরে কবে হবে সেই দীপসংযোগ। কবে বয়ে যাবে মলয়ের বাতাস! বলেছিলেন : “রোখ চাই। ম্যাদামারা হলে হবে না।” ভিজে দেশলাইয়ে কাঠি ঘষছি। কোথায় স্ফুলিঙ্গ! একের পর এক কাঠিই নষ্ট। আপনার প্রখর কিরণে কবে আমার বারুদ শুকনো হবে! আমার অবস্থাটা আপনাকে আমি জানাচ্ছি। আমার ভবরোগের কথা। এইবার আপনি কি ব্যবস্থা করবেন সে আপনিই জানেন। আপনিই জানেন, আমি আপনার ঘরের লোক কিনা!

আমার ভক্তি কাঁচা ভক্তি। আপনি বলেছেন : “যার কাঁচা ভক্তি, সে ঈশ্বরের কথা, উপদেশ ধারণা করতে পারে না। পাকা ভক্তি হলে ধারণা করতে পারে। ফটোগ্রাফের ‘কাচে যদি কালি (Silver Nitrate) মাখানো থাকে, তাহলে যা ছবি পড়ে তা রয়ে যায়। কিন্তু শুধু কাঁচের ওপর হাজার ছবি পড়ুক একটাও থাকে না—একটু সরে গেলেই যেমন কাঁচ তেমনি কাঁচ। ঈশ্বরের ওপর ভালবাসা না থাকলে উপদেশ ধারণা হয় না।”

এই অনুরাগ, এই প্রেম, এই পাকা ভক্তি পাই কোথায়! আমার দোকানে নেই!

নেই যখন, তখন কাতর হচ্ছ কেন?

আমি যে আপনাকে ভালবাসি। যোগ্য নই, তবু মনে হয় চেষ্টা করে দেখি, যদি আপনার কৃপাকটাক্ষে মনের কাঁচে সিলভার নাইট্রেটের প্রলেপ লাগে!

তাহলে কর, যা বলছি তাই কর—মনের ময়লা চোখের জলে ধুয়ে ফেল। “কাম-কাঞ্চনে মন মলিন হয়ে আছে, মনে ময়লা পড়ে আছে। ছুঁচ কাদা দিয়ে ঢাকা থাকলে আর চুম্বক টানে না।” বল, “হে ঈশ্বর, আর অমন করব না।” অনুতাপে কাঁদ। ময়লাটা ধুয়ে যাক। তখন ঈশ্বররূপ চুম্বক মনরূপ ছুঁচকে টেনে নেবে। তখন লগ্ন হবে, মগ্ন হবে, আনন্দে আনন্দসাগর উথলিবে। বিষয় আলুনি লাগবে। স্বাদ আসবে। ‘টং’ হয়ে যাবে। কী ছার সংসার, ছিবড়ে কাম-কাঞ্চন! কৃপা! চিৎকার করলেই কৃপা? কৃপা কি সহজে হয়! কতকগুলো শর্ত আছে। ‘অহঙ্কার একেবারে ত্যাগ করতে হবে।’ ‘আমি কর্তা’—এ-বোধ থাকলে ঈশ্বরদর্শন হয় না। ভাঁড়ারে একজন আছে, তখন বাড়ির কর্তাকে যদি কেউ বলে, ‘মহাশয়, আপনি এসে জিনিস বার করে দিন।’ তখন কর্তাটি বলে, ‘ভাঁড়ারে একজন রয়েছে, আমি আর গিয়ে কি করব!’ পারবে কি অহঙ্কার একেবারে ত্যাগ করতে? একেবারে পরিষ্কার কথা—”যে নিজে কর্তা হয়ে বসেছে তার হৃদয়মধ্যে ঈশ্বর সহজে আসেন না!” কোন্ হাতুড়িতে অহঙ্কার ভাঙা যায়? “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল!”

লেংটি ইঁদুরের মতো ‘আমি’টাকে দূর করা যায় কেমনে? সে যে কুরে কুরে সব খেয়ে ফেললে। কোন্ কলে ধরব আমি তাকে?

এইখানেই গোল হলো, আমি দিয়ে কি ধরা যায় না। তাই “থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”

“ম্যায় গুলাম, তু দেওয়ান।” বসে থাকি ঠাকুর তোমার নাম নিয়ে। পাওয়ার স্বস্তি যদি নাই জোটে বরাতে, না পাওয়ার অস্বস্তিটাই বরং থাক।

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন