বাহাদুর

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

যত দিন যাচ্ছে ততই শ্রীরামকৃষ্ণকে মনে হচ্ছে, ঠাকুর আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না। কারণটা কি? শুধু ধর্ম, ঈশ্বর, মুক্তি, মা ভবতারিণী, যাবতীয় অলৌকিকপ্রাপ্তি? অনেক ভেবে দেখলুম, সবচেয়ে বড় কারণ, ঠাকুর ছিলেন এমন এক চাবি, যে-চাবি দিয়ে সব তালা খোলা যায়। এমন এক বন্ধু, যাঁকে সবকথা বলা যায়। এমন এক শাসক, যাঁর সামনে সামান্য বেচাল হলেই অপরাধী বালকের মতো বসে থাকতে হয়। পালাবার উপায় নেই। কারণ, তিনি কান ধরে টেনে আনবেন। এমন এক পিতা, হাত ধরলে যিনি ছেড়ে দেবেন না—আঁচড়ালে, কামড়ালেও নয়। তাঁর নিজের কথাতেই, তিনি ছিলেন ‘গোখরো সাপ’। কেন গোখরো সাপ? বলছেন : “ঝাউতলা থেকে ফিরছি, দেখি সাপে ব্যাঙ ধরেছে। ব্যাঙটা ভয়ঙ্কর ডাকছে।” উঁকি মেরে দেখলেন তিনি। দেখে মনে মনে হাসলেন—”ঢেঁাড়ায় ধরেছে। তাই এত যন্ত্রণা। গিলতেও পারছে না, ওগরাতেও পারছে না। গোখরোয় ধরলে এমন হতো না। ধরা মাত্রই ব্যাঙ শেষ।” ঠাকুর গোখরো ছিলেন। ধরলে বিষয়লীলা, সংসার-যন্ত্রণা, তামসিকতা, মানুষের ভেকমূর্তি, ব্যাঙের আধুলির নাড়াচাড়া, মতুয়াগিরি—সব শেষ। এমন বিষ ঢেলে দেবেন, ব্যাঙবাবু, ব্যাঙ্কবাবু, ইনসিওরেন্সবাবু, ডাক্তারবাবু, মি লর্ডবাবু, হ্যাট-ম্যাট -গ্যাটবাবু সকলেরই মনে হবে—বিষয় বিষ। তখন মীরার মতো মন বলবে-

‘মোহে লাগি লগন গুরু-চরণন কী।
চরণ বিনা মোহে কছু নহী ভাবৈ।।
জগমায়া সব সপলন কী।
ভবসাগর সব সুখ গয়ো হ্যায়।
ফিকর নহী মোহে তরলন কী।”

ঠাকুর, আপনার চরণই আমার একমাত্র আশ্রয়। আপনি ছাড়া আমার আর কোন চিন্তা নেই। জগতে সবই মায়া সবই স্বপ্ন। কোন সুখ নেই ঠাকুর। আমাকে উদ্ধার করুন।

সেই উদ্ধার কেমন উদ্ধার? আমাকে তিনি লেংটি পরিয়ে, হাতে চিমটে দিয়ে হিমালয়ে পাঠিয়ে দেবেন না। তাঁর প্রেসক্রিপশন ছিল অন্যরকম। ঠাকুর অভিজ্ঞ জননী। পেট বুঝে মাছ পরিবেশন। ভাজা, ঝাল, ঝোল, অম্বল। সবাই তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে পারবে না। সে বড় কঠিন ব্রত! তাহলে? সত্ত্বগুণী সংসারী হও। শিবের সংসার কর। ঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বলছেন : “ভবনাথ কেমন সরল! বিবাহ করে এসে আমায় বলছে, স্ত্রীর উপর আমার এত স্নেহ হচ্ছে কেন? আহা! সে ভারী সরল! তা স্ত্রীর ওপর ভালবাসা হবে না? এটি জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া। স্ত্রীকে বোধ হয় যে পৃথিবীতে অমন আপনার লোক আর হবে না। আপনার লোক, জীবনে-মরণে, ইহকালে, পরকালে।”

এই হলেন ঠাকুর। তাঁর সঙ্গে সব কথা চলে। ভীষণ র‍্যাশনাল। ভীষণ বুঝদার। সংসার যে তাঁর। সৃষ্টির সাজঘর থেকে উঠে এসেছিলেন বলেই মানুষকে এমন চিনেছিলেন। সংসারের সব খবরই রাখতেন অথচ নিজে সংসার করেননি। তা নাহলে কেমন করে বলেন—ভবনাথের প্রসঙ্গেই বলছেন : “এই স্ত্রী নিয়ে মানুষ কি না দুঃখভোগ করছে, তবু মনে করে যে এমন আত্মীয় আর কেউ নেই। কি দুরবস্থা! কুড়ি টাকা মাইনে—তিনটে ছেলে হয়েছে—তাদের ভাল করে খাওয়াবার শক্তি নেই, বাড়ির ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, মেরামত করবার পয়সা নেই—ছেলের নতুন বই কিনে দিতে পারে না—ছেলের পৈতে দিতে পারে না—এর কাছে আট আনা, ওর কাছে চার আনা ভিক্ষে করে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ যখন এই চিত্রটি তুলে ধরেন, কিছু না, শুধু ছবিটি আঁকলেন অক্ষরমালায়! চেতনায় এক চাবুক। এই সংসার! নিমেষে যেন বেরিয়ে এলুম সংসারের বাইরে। এই প্রশ্ন নিয়ে—আশার ছলনে ভুলে ওর মধ্যে প্রবেশ করেছি। কেন করেছি? ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, উপায় কী! ও যে জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া। স্বয়ং অবতারও আত্মবিস্মৃত হন। সেই কাহিনী জান না—”হিরণ্যাক্ষকে বধ করে বরাহ অবতার ছানা-পোনা নিয়ে ছিলেন আত্মবিস্মৃত হয়ে তাদের মাই দিচ্ছিলেন। দেবতারা পরামর্শ করে শিবকে পাঠিয়ে দিলেন। শিব শূলের আঘাতে বরাহের দেহ ভেঙে দিলেন। তবে তিনি স্বধামে চলে গেলেন। শিব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি আত্মবিস্মৃত হয়ে আছ কেন? “ তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বেশ আছি।” কি জান—”পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।” “গোপীরা কাত্যায়নীপূজা করেছিলেন। সকলেই সেই মহামায়া আদ্যাশক্তির অধীনে। অবতার আদি পর্যন্ত মায়া আশ্রয় করে তবে লীলা করেন। তাই তাঁরা আদ্যাশক্তির পূজা করেন। দেখ না, রাম সীতার জন্য কত কেঁদেছেন।”

তুমি সাধারণ জীব, তোমাকে তো মায়া আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবেনই। তপস্বী গেলেন ধর্মব্যাধের কাছে উপদেশ নিতে। গিয়ে দেখলেন, ব্যাধ পশুর মাংস বিক্রি করছেন। তপস্বী ভাবলেন, একে ব্যাধ, তায় সংসারী। আমায় কি ব্রহ্মজ্ঞান দেবেন! কিন্তু সেই ব্যাধ পূর্ণজ্ঞানী। তপস্বী জিজ্ঞেস করলেন, এ কি রহস্য! আপনার দুটো জীবন কেন? তিনি বললেন, একটা আমার প্রারব্ধ, আরেকটা আমার অর্জিত। সংসারে থাক-প্রারব্ধ ক্ষয় কর—জ্ঞান অর্জন কর।

ঠাকুর না হলে কে এমন বলতে পারেন?

“সংসারে থেকে যে তাঁকে ডাকে সে বীরভক্ত। ভগবান বলেন, যে সংসার ছেড়ে দিয়েছে সে তো আমায় ডাকবেই, আমার সেবা করবেই, তার আর বাহাদুরি কি? সে যদি আমায় না ডাকে সকলে ছি ছি করবে। আর যে সংসারে থেকে আমায় ডাকে—বিশ মণ পাথর ঠেলে যে আমায় দেখে সেই-ই ধন্য, সেই-ই বাহাদুর, সেই-ই বীর পুরুষ।”

ঠাকুর সংসারকে—আমাকে নস্যাৎ করেননি, উপেক্ষা করেননি। স্নেহের চোখে শান্ত কণ্ঠে বলেছেন, সংসার কর। অবিদ্যা মায়াকে বিদ্যা মায়ায় রূপান্তরিত করে সংসার কর। এক হাত রাখ সংসারে, এক হাত তাঁর শ্রীচরণে, কর্তব্য শেষে দুহাত রাখ তাঁর চরণে। তাই তো ঠাকুর আমার অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। অনন্য।

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন