সরষে পেষাই

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ঠাকুর, আপনি বলুন, দুটি দিকের সমন্বয় কিভাবে সম্ভব? ধর্ম আর কর্ম! একালের কর্ম আর কর্মস্থল আপনি জানেন। জানেন সেখানকার পরিবেশ কেমন। একালের মানুষের মানসিকতা আপনার অজানা নয়। চরম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মানুষ রেসের ঘোড়ার মতো ছুটছে। ভোগবাদ চরম আকার ধারণ করেছে। শান্ত, সুস্থ জীবনের ছবি হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে সদ্ভাব আর থাকছে না। সমাজের চালচিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। মানুষের আধ্যাত্মিকতা অবিশ্বাসে তলিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি করব ঠাকুর? আমরা যারা আপনাকে ধরে আছি! আমাদের আঘাত যে বড় প্রবল হয়ে উঠছে!

আপনি বলছেন : “সহ্য কর। যে সয় সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়।” সহ্য করতে করতে আমরা এখন এমন জায়গায় এসে পড়েছি যখন আর নিজেকে সহনশীল বলে মনে হয় না, মনে হয় অত্যাচারিত, নিপীড়িত। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ। আপনি আপনার সাপকে বলেছিলেন, হিংসা করিস না, যাকে তাকে তেড়ে ছোবল মারতে যাসনি। নিরীহ সাপ যখন অত্যাচারিত হতে হতে প্রায় মরো মরো, আপনি তখন বললেন, তোকে তো ফোঁস করতে বারণ করিনি। ‘ফোঁস’ মানে প্রতিবাদ। আমরাও প্রতিবাদের চেষ্টা করে দেখেছি। কোন লাভ নেই। সঙ্ঘবদ্ধ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একক কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। আজকাল ফ্যাসন হয়েছে প্রতিবাদকারীকে ধরাধাম থেকে নির্দ্বিধায় সরিয়ে দেওয়া। সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি হলেও মানুষের জীবনের মূল্য প্রায় নেই বললেই হয়। অখণ্ড হরিনাম সঙ্কীর্তনের মতো অখণ্ড অসভ্যতায় দেশ ভেসে যাচ্ছে। আমরা এখন কি করব ঠাকুর? ফোঁস করলেও যে বিপদ!

আপনি বলেছিলেন : “তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়। তা নাহলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।” ঠাকুর, এখন দেখছি জগৎ-সংসারে অন্য তেলের কারবার চলেছে। তোষামোদের তেল! বড় মানুষ, ক্ষমতাশালী মানুষকে কখনো চাটুকারিতার তেল, কখনো উপঢৌকন দিতে পারলে পঙ্গুও গিরিলঙ্ঘন করতে পারে। বিষয়কে তো আর ‘বিষ’ বলছে না কেউ, বলছে অমৃত। ক্ষমতাশালীকে তৈল মর্দন করতে পারলে বিষয়ামৃত পাওয়া যায়। আত্মার শক্তি, বিদ্যার শক্তি, জ্ঞানের শক্তির চেয়ে দেহের শক্তির ভয়ঙ্কর কদর। বলের মধ্যে পশুবলই শ্রেষ্ঠ বল। সভ্যতার সংজ্ঞা পালটাচ্ছে। অসভ্যতাই সভ্যতা হচ্ছে। ত্যাগের বদলে গ্রহণই হচ্ছে নীতি। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঝাণ্ডাটি কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড় মৃগয়ায়। কে মরল, কে বাঁচল তোমার দেখার দরকার নেই। তুমি নিজে সুখভোগের চেষ্টা কর। এই নীতি যদি তুমি পরিত্যাগ কর, লোকে তোমাকে বোকা-হাঁদা বলবে। পরিবার-পরিজন বলবে অপদার্থ। ঈশ্বরে ভক্তির অর্থ করবে—ভণ্ডামি। মুখের ওপর স্পষ্ট বলবে, সংসারে কেন? সংসার করেছ কেন? সন্ন্যাসী হলেই পারতে। নিজে মরছ মর, আর পাঁচজনকে মারার অধিকার তোমার নেই। আমরা চাই। আধুনিক জীবনের সবরকমের ভোগ-সুখ আমরা চাই। তোমার ঈশ্বর নিয়ে তুমি থাক, আমাদের ঈশ্বর হলেন আধুনিক জীবনের সাজ-সরঞ্জাম। আমাদের ভবিষ্যৎ তোমার ঐ তত্ত্বকথায় নেই, আছে তোমার ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সে। আত্মোপলব্ধির পথে তুমি কতটা এগোলে আমাদের জানার দরকার নেই। আমরা জানতে চাই, চাকরিতে কতটা উন্নতি করলে? ক্ষমতা কতটা বাড়ল। আমাদের বৈষয়িক সুখ তুমি কতটা বাড়াতে পারলে! তোমার জ্ঞান আমরা চাই না। তোমার অর্জিত ঐশ্বর্যই আমরা ভোগ করতে চাই।

ঠাকুর, অতিশয় প্রকট হয়ে উঠেছে আমাদের আত্মিক সংগ্রাম। যারা আপনার ভাবে ভাবিত, সংসার থেকে ক্রমেই তারা আরো দূরে সরে যাচ্ছে। ব্যবধান বাড়ছে। বাড়ছে নিঃসঙ্গতা। মনে হয় ভালই হচ্ছে। আগে ছিল আপনার জন্যে কখনো-সখনো দু-এক ফোঁটা চোখের জল। এখন অহরহ ক্রন্দন। বনের পথে সেই জটিল বালকের মতো—কোথায় আমার মধুসূদন দাদা! তুমি এস। আগে আপনাকে ডাকার মধ্যে হয়তো শৌখিনতা ছিল। অ্যামেচার রামকৃষ্ণানুরাগী! এখন সেই ডাক অনেক আন্তরিক। অনেক কাতর। সেই ডাকে ‘তিন টান’ এক হতে পেরেছে। বুঝেছি চারপাশে যা ঘটছে সবই আপনার ইচ্ছায়। এই পরিস্থিতিতে না পড়লে আমাদের মোহ-নাশ হতো না।

আপনি বলেছিলেন, ‘নাক তেরে কেটে তাক’ বোল মুখে বলা সহজ, হাতে বাজানো কঠিন। সেইরকম ধর্মকথা বলা সোজা, কাজ করা বড় কঠিন। আগে ঠাকুর, আপনাকে সাধতুম মুখে। এখন সাধি অন্তরে। আপনি বলেছিলেন, ঈশ্বর মন দেখেন। আপনি আমাদের মন দেখুন। মন আর মুখ এক হয়েছে কিনা! মুখের বোল মনের আঙুলে ফুটছে কিনা! আপনার অসীম কৃপা আমাদের আজ এই পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছে। মোহনাশ, তমোনাশ! এইতো পেয়েছি সাধন- পরিমণ্ডল। আপনি বলেছিলেন : “দীঘিতে বড় বড় মাছ আছে, চার ফেলতে হয়। দুধেতে মাখন আছে, মন্থন করতে হয়। সরিষার ভিতর তেল আছে, সরিষাকে পিষতে হয়। মেথিতে হাত রাঙা হয়, মেথি বাটতে হয়।” জীবনের ওপর সেই প্রক্রিয়াই চলেছে। কি আনন্দ!

সকল অধ্যায়

১. উট হবে না হাঁস হবে!
২. প্ৰতিধ্বনি
৩. পদ্মলোচনের শাঁখ
৪. একটু চেষ্টা
৫. ঠাকুরের কাছে দরবার
৬. কেন
৭. সেই আবেগে
৮. চিরগুরু
৯. কৃপা
১০. রামকৃষ্ণদাস
১১. স্বামীজীর ধর্ম
১২. গৃহীর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩. হাসছে কেমন!
১৪. “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে”
১৫. পুরুষ সাবধান
১৬. অংশে অংশ মিলে পূর্ণ
১৭. সাধনা
১৮. লজ্জা
১৯. পথ ও পথিক
২০. “ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
২১. ডুডুও খাব টামাকও খাব
২২. কনফুসিয়াস
২৩. “খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”
২৪. দস্তুরমতো পথ
২৫. শয়নে স্বপনে জাগরণে
২৬. আপনি আর আমি
২৭. হনুমান
২৮. চাকা
২৯. সরষে পেষাই
৩০. “চাঁদামামা সকলের মামা”
৩১. রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
৩২. এগিয়ে চল
৩৩. “পাশবদ্ধ জীব পাশমুক্ত শিব”
৩৪. “মন-মত্তকরী”
৩৫. “নরেন শিক্ষে দিবে”
৩৬. দু-ফোঁটা চোখের জল
৩৭. মহাভাব
৩৮. মাপো আর জপো
৩৯. ভাব-ভালবাসা
৪০. বাহাদুর
৪১. আমার কুরুক্ষেত্র
৪২. মুখে বলি ‘হরি’
৪৩. ধর্মকর্ম
৪৪. “আপনাতে আপনি থেকো মন”
৪৫. মূর্ত মহেশ্বর
৪৬. গুরু-চৈতন্য বিজ্ঞান-বিচারী
৪৭. তত্র সর্বাণি তীর্থানি
৪৮. হাঁস
৪৯. হেডমাস্টার
৫০. বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
৫১. “কপটতা ছাড়ো”
৫২. কবে হবে
৫৩. তোমাদের কী হবে
৫৪. বাছুর
৫৫. ‘সা-রে-মা’তে
৫৬. অরূপরতন
৫৭. বাক্সটাকে সাজাও
৫৮. “আধা-ছানার মণ্ডা”
৫৯. “ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”
৬০. নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
৬১. ভবরোগবৈদ্য
৬২. জ্ঞান ও বিজ্ঞান
৬৩. শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু
৬৪. শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
৬৫. ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন
৬৬. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
৬৭. প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
৬৮. আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
৬৯. সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
৭০. কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
৭১. “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো”
৭২. শ্রীরামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ
৭৩. শুধু তোমাকেই চাই
৭৪. সুধাসাগর
৭৫. হাত ধর
৭৬. ব্যাকুলতা
৭৭. দুজনেই মার সখী
৭৮. শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
৭৯. কাতরে কর করুণা
৮০. ধ্রুবতারা
৮১. কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
৮২. প্ৰণাম
৮৩. প্রশ্ন
৮৪. সাবধান
৮৫. কেন চোখের জলে
৮৬. মনের মতো পাগল পেলাম না
৮৭. “যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া”
৮৮. মানুষ
৮৯. অমৃতের সন্ধানে
৯০. শরণাগত
৯১. সাধন দুর্গ
৯২. স্বামীজী আসছেন
৯৩. উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে
৯৪. গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
৯৫. রামকৃষ্ণ মিশন
৯৬. পাথরের দেয়ালে পেরেক
৯৭. সার্জেন সাহেব
৯৮. বসে আছি
৯৯. রামকৃষ্ণ ভগবান
১০০. অঙ্কট-বঙ্কট
১০১. “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”
১০২. ‘আমি’ এক ঢিপি
১০৩. আমার জীবনে ‘উদ্বোধন’
১০৪. অনুলোম বিলোম
১০৫. মন্ত্র
১০৬. বারটা বাজাও
১০৭. চাকর রাখ
১০৮. খানদানী চাষা
১০৯. আত্মার আত্মহত্যা
১১০. শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
১১১. বিবেকের ছাঁকনি
১১২. ‘রামকৃষ্ণ মেল’
১১৩. “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”
১১৪. “আমি দেখব”
১১৫. চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
১১৬. কুরুক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৭. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
১১৮. গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
১১৯. বিদ্রোহী ভগবান
১২০. ইঁদুর
১২১. শরণাগতি
১২২. “আমি খাই-দাই আর থাকি, আর আমার মা সব জানেন”
১২৩. “আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
১২৪. “ভক্ত্যা মামভিজানাতি”
১২৫. প্ৰেম
১২৬. মা
১২৭. কে তুমি বিবেকানন্দ
১২৮. ভগবানের মুখ
১২৯. ‘হলো না’-টাই ‘হলো’
১৩০. সংস্কার
১৩১. রামকৃষ্ণ-শক্তি
১৩২. এক জোড়া জুতো
১৩৩. বেদভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৪. শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
১৩৫. অখণ্ডের ঘরের কথা
১৩৬. “কে মা তুমি?”
১৩৭. নিজেকে দেখ
১৩৮. “আমি জানি তুমি কে”
১৩৯. পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
১৪০. শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক
১৪১. মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
১৪২. ভয়ঙ্কর ঠাকুর
১৪৩. মা জানেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন