বাংলাদেশের কবিতা সংকলন প্রসঙ্গে

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

‘বাংলাদেশের কবিতা’ সংকলন প্রসঙ্গে

একটা সময়ে দেখতাম মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল— বাংলাবাজার থেকে সম্পাদিত হয়ে বেরুতো। সম্পাদক হিশেবে যাদের নাম ছাপা হতো তারা সবাই সাহিত্যের অধ্যাপক। তাদের টিউটোরিয়ালের নোটকে ভূমিকা হিশেবে ছেপে দ্যাখা যেতো অমুক সম্পাদিত ‘সোনার তরী’ বাজারে প্রদর্শিত ও বিক্রিত হচ্ছে। সময়টি বড়োই গ্লানিকর ছিলো। হাল সংবাদ অবশ্য জানি না।

তবে ইতিমধ্যে নোতুন আর একটি উপসর্গ দ্যাখা দিয়েছে। কিছু কিছু প্রকাশকের অর্থানুকূল্যে অজ্ঞাতকুলশীল কিছু ব্যক্তি সম্পাদিত কবিতা প্রকাশ কোরে চলেছেন। মূলত তারা সংগ্রাহকের দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। কবিতা বা কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা কী সব মূল প্রতিপাদ্য হিশেবে ধরেন, তাঁদের ভূমিকায় কদাচিৎ তা জানা যায়।

সর্বোপরি যে কবির কবিতা সংকলনে ছাপানো হয়েছে তার সম্মানীর তো প্রশ্নই ওঠে না, সৌজন্যমূলক এক কপি বইও তাঁকে দেয়া হয় না (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে)। সম্পাদিত কোরে এই সব সম্পাদক(!)গন কবিদের কৃতার্থ করেন। এই রকম আইয়ামে জাহেলিয়তের মধ্যে মুক্তধারা-র মতো একটি অতিকায় প্রকাশনী যখন ‘বাংলাদেশের কবিতা’ শীর্ষক একটি সংকলনের সম্পাদক হিশেবে মুহম্মদ নূরুল হুদাকে নির্বাচিত করেছিলেন, তখন সঙ্গত কারনে কাব্যকর্মীগন সকলেই আশা করেছিলেন হুদা বাংলাদেশের কবিতার একটি নির্ভরযোগ্য সংকলন সম্পাদনা করবেন। সে আশা পূরন হয়নি। কেন হয়নি? পর্যায়ক্রমে তারই বয়ান করছি।

বাংলা কবিতা এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের বাংলায় রচিত কবিতা— দীর্ঘদিন থেকে ব্যাপারটি তালগোল পাকানো অবস্থায় চলছিলো। ‘বাংলাদেশের কবিতা’ এই শিরোনামের জন্যে হুদা যে সীমারেখা টেনেছেন, আমার কাছে তা যথার্থ মনে হয়েছে। যদি জীবনানন্দ দাশ এই সংকলনের প্রথম কবি হতেন তবে অতুলনীয় হতো। কিন্তু তা বোধহয় হবার নয়।

ভূমিকায় হুদা বাংলাদেশের (পূর্ব বঙ্গের) কবিতার চরিত্র নির্ধারন করেছেন এই ভাবে— ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র সম্বলিত এক উন্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্যও এখানেই নিহিত। কোনো কলাকৈবল্যবাদী আন্দোলনের নান্দনিক ছত্রছায়ায় নয়, বরং দেশ-সমাজ-রাজনীতির প্রবল প্রবাহজাত স্পন্দনই বাংলাদেশের কবিতায় যুক্ত করেছে এক নির্ণায়ক মাত্রা, যার ফলে বাংলাদেশের গত সাড়ে তিন দশকের কবিতাকে সমগ্র বাংলা কবিতার আবহে বিষয়- বৈচিত্রের কারণে সম্পূর্ণ আলাদা ভুবন রূপে চিহ্নিত করা সম্ভবপর।”

সঠিক তারটিতেই হাত হাত রেখেছেন হুদা। বাংলাদেশের কবিতা সম্পর্কে বেশির ভাগ লেখাই বিভ্রান্তিকর এবং সেগুলো সঠিক চরিত্র উন্মোচনে ব্যর্থ। খুব সহজে ও অল্প কথায় হুদা বাংলাদেশের কবিতার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। কাজটি গুরুত্বপূর্ন। সম্পাদক তাঁর কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে চারটি প্রধান বিবেচনাকে গ্রহন করেছেন তার দুটি বিবেচনা (খ ও গ) এখানে উল্লেখ করছি—

(খ) বিষয়গত বিচারে এ কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য : ভাষা-আন্দোলন-ভিত্তিক, দেশজ চেতনা-নির্ভর, জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক চেতনা-মুক্ত ও প্ৰগতিবাদী।

(গ) প্রাকরণিক বিচারে এ কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য : (১) তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার সাথে সম্পৃক্ত (২) ভাষা ব্যবহারে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও দেশীয় শব্দের প্রাচুর্য (৩) আবেগ-বাহিত বক্তব্য প্রকাশে ঋজুরেখ সারল্য।

চমৎকার! হুদা যে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কলাকৈবল্যবাদীদের কুয়াশা-সানগ্লাস চোখে পরেনি, এ জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ। অবশ্য তা তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিলো না। কবিতার ইতিহাস তাঁর অজানা নয়।

ভূমিকায় হুদা কবি বা কবিতার তুলনামূলক আলোচনা করেননি। তবে মূল স্রোতের বা মূল ধারার বর্ননা করেছেন। চিনিয়ে দিয়েছেন ধারাটিকে তার চরিত্র উন্মোচন কোরে। ভূমিকাটি থেকে অবশ্য সতর্ক নিরীক্ষনেও কবি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায় না। কিন্তু কবিতার সংখ্যা কম-বেশি বা অধিক জায়গা ও স্বল্প জায়গা জুড়ে লেখা ছাপানো থেকে একটি জিনিশ আমি ধ’রে নিতে পারি যে, সম্পাদকের বিচারে বিগত চার দশকের মধ্যে তারাই গুরুত্বপূর্ন, উল্লেখযোগ্য বা প্রধান কবি, যারা অধিক সংখ্যায় এবং অধিক পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়েছেন।

এরপর, কবিতা নির্বাচনের জন্যে সম্পাদকের প্রধান বিবেচনাকে সামনে রেখে সংকলনভুক্ত কবিদের তাবৎ লেখার পৃষ্ঠা উল্টাতে চাই আমি। পাঠকও আমার সঙ্গে আসুন।

সংকলনটি শুরু হয়েছে জসীমউদ্দীন-এর কবিতা দিয়ে এবং শেষ হয়েছে তসলিমা নাসরিন-এ। উভয়েরই একটি কোরে কবিতা ছাপা হয়েছে। তাহলে আমরা দুজনকে সমান গুরুত্বের কবি মনে করতে পারি। কিন্তু ব্যাপারটা কি আদৌ সে রকম?

প্রথমে ষাটপূর্ব কবিদের প্রসঙ্গে আসা যাক। সম্পাদক এই পর্বে যাঁদের গুরুত্ব দিয়েছেন তারা হলেন— শামসুর রাহমান

[ অসমাপ্ত ]

সকল অধ্যায়

১. মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)
২. রচনাকাল : ১৯৭৪
৩. এক গ্লাস অন্ধকার (১৯৯২)
৪. উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)
৫. ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম (১৯৮১)
৬. মানুষের মানচিত্র (১৯৮৪)
৭. ছোবল (১৯৮৬)
৮. গল্প (১৯৮৭)
৯. দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮)
১০. আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
১১. দিন গ্যালো দিন গ্যালো রে
১২. আমরা পাড়ি দেবো
১৩. ছিঁড়িতে না পারি দড়াদড়ি
১৪. ঢোলক বাজাও দোতারা বাজাও
১৫. মাঠে কিষান সুর তুলেছে
১৬. শৃংখল মুক্তির জন্যে কবিতা আজ
১৭. নূর হোসেনের রক্তে লেখা
১৮. ভাঙাচোরা মন, বল
১৯. যদি চোখে আর চোখ রাখা না-ই হয়
২০. ইতর
২১. সোনালি শিশির
২২. উপন্যাসের খসড়া
২৩. নিজস্ব লড়াই
২৪. নিসঙ্গতা
২৫. কৃষ্ণচুড়ার মৃতদেহে একখানি রঙিন ইনভেলাপ
২৬. যেখানে নরকে গোলাপ
২৭. সিগারেট এবং কতিপয় ব্যক্তিগত স্কেচ
২৮. শিরোনামহীন (অসম্পূর্ণ গল্প)
২৯. চলচ্চিত্র কাহিনী
৩০. চিত্রনাট্য
৩১. সম্পাদকীয়-১
৩২. সম্পাদকীয়-২ : উপলিকা সম্পর্কিত উপস্থাপনা
৩৩. সম্পাদকীয়-৩ : প্রবেশক
৩৪. এক দশকের কবিতা
৩৫. সাহিত্যচিন্তা
৩৬. নব্য জসীমিজম ও বহমান লোককাব্যধারা
৩৭. প্রতিক্রিয়া
৩৮. জাতীয় কবিতা পরিষদের ভূমিকা
৩৯. ভিন্নস্বর অন্যমত
৪০. বাংলাদেশের কবিতা সংকলন প্রসঙ্গে
৪১. কাফের লেখকদের সম্পর্কে
৪২. অগ্রদূত ক্রীড়া চক্র : ঘোষনাপত্র
৪৩. অন্যান্য গদ্য
৪৪. উপদ্রুত উপকূল গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে স্বাগত ভাষন
৪৫. নবীন বরন উপলক্ষে
৪৬. শুভেচ্ছা বক্তব্য
৪৭. সাক্ষাৎকার-১
৪৮. সাক্ষাৎকার-২
৪৯. সাক্ষাৎকার-৩
৫০. সাক্ষাৎকার-৪
৫১. সাক্ষাৎকার-৫
৫২. সাক্ষাৎকার-৬
৫৩. সাক্ষাৎকার-৭
৫৪. সাক্ষাৎকার-৮
৫৫. পত্র-০১
৫৬. পত্র-০২
৫৭. পত্র-০৩
৫৮. পত্র-০৪
৫৯. পত্র-০৫
৬০. পত্র-০৬
৬১. পত্র-০৭
৬২. পত্র-০৮
৬৩. পত্ৰ-০৯
৬৪. পত্র-১০
৬৫. পত্র-১১
৬৬. পত্র-১২
৬৭. পত্র-১৩
৬৮. পত্র-১৪
৬৯. পত্র-১৫
৭০. পত্র-১৬
৭১. পত্ৰ-১৭
৭২. প্রস্তুতি পর্বের রচনা (কবিতা)
৭৩. প্রস্তুতি পর্বের রচনা (গল্প)
৭৪. প্রস্তুতি পর্বের রচনা (গদ্য)
৭৫. রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : জীবনপঞ্জি
৭৬. রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : গ্রন্থপঞ্জি
৭৭. গ্রন্থ ও রচনাপরিচয়
৭৮. রুদ্র বিষয়ক রচনাপঞ্জি
৭৯. প্রস্তুতি পর্বের রচনা (নাটিকা)
৮০. খুটিনাটি খুনশুটি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯১)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন