মিরজাফর থেকে মনমোহন

ইমানুল হক

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর যখন মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’-এর শেষ ৯টি অধ্যায় অনুসরণ করে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ লিখছেন তখন তিনিও সিরাজের প্রতি সুবিচার করেননি। যদিও অন্ধকূপ হত্যা মিথ্যা জেনে তিনি তা বর্জন করেন। ব্রিটিশ কোম্পানির একজন কর্মচারীর পক্ষে এটা যথেষ্ট সাহসের কথা। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর ভাবতেও পারেননি স্বাধীন ভারতের কথা। তবু তিনি আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিলেন। পোশাকে, চিন্তায়, চর্চায়। তিতুমিরের বিদ্রোহকালীন সময়ে বিদ্যাসাগর ১১ বছরের বালকমাত্র। দূরদর্শন নেই, নেই নিয়মিত সংবাদপত্র—থাকলেও ব্রিটিশের পক্ষেই সে লিখত বা বলত। কারণ, বাংলার প্রথম সৈনিক সংবাদপত্র ‘দৈনিক প্রভাকর’ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা সিপাহি মহাবিদ্রোহের সময় ব্রিটিশভজনা করেছিল। ঈশ্বর গুপ্ত শিষ্য গদ্যকার অক্ষয়কুমার দত্ত, ‘তত্ত্ববোধিনী’ সম্পাদক, দুটি পদ্য লিখেছিলেন ব্রিটিশের জয় চেয়ে—

কৃপা কর কৃপাদৃষ্টি কর একবার
রক্ষা রক্ষা কর বাঁচিনেকো আর।

১৮৩১-এর ১৯ নভেম্বর নিহত হন বীর তিতুমির। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে। তাঁকে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহিদের মর্যাদা আমরা দিই নি। ১৭৭৮-এ ক্যারেল ব্লুম বাংলাদেশে প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। সেই নীলচাষ যাতে জাঁকিয়ে বসে তার জন্য রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর—একজনের নামের আগে ‘রাজা’, অন্যজনের নামের আগে ‘প্রিন্স’—তাঁরা, নীলকররা যাতে বাংলায় জমি কিনে চাষ করতে পারে, তার জন্য বিলেতে গণস্বাক্ষর পাঠান। একইসঙ্গে টাউন হলে সভা ডাকেন। তার ফল কী হয়, সবার জানা। নীলবিদ্রোহের সংগ্রামীদেরও আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামী বলতে কুণ্ঠিত। সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কদের স্মরণে আমরা হুল উৎসব করছি। ‘দিকু’ থেকে সাঁওতালপ্রেমী হয়েছি। ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের মঙ্গল পাণ্ডে অন্তত আমীর খানের সৌজন্যে তাঁর ফাঁসির ২৫০ বছরে খানিকটা প্রচার পেলেন। কিন্তু বিদ্যা ও সমাজচর্চার বৃহত্তর প্রাঙ্গণে তাঁর ঠাঁই হল না।

ক্ষুদিরাম বসু অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এবং প্রফুল্ল চাকী ব্যর্থ হন। ক্ষুদিরামের ফাঁসির শতবর্ষ পালিত হল আড়ম্বরে। ভালো। খুবই ভালো। সেটা দরকারও ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের সবচেয়ে বড়ো ধরনের যে রাজপুরুষকে বিপ্লবীরা হত্যা করতে পেরেছেন তাঁদের প্রধানতম—ভাইসরয় তথা বড়লাট লর্ড মেয়ো। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ইতিহাসের কোনো পাঠ্যবইয়ে এ তথ্য লেখা হয় না। বিপ্লবী শের আলির নাম কজন পাঠক জানেন, সংশয় হয়। আমরা প্রায় কেউই তাঁর সম্পর্কে বিশদ জানি না। শুধু জানি এই বিপ্লবী পাঠান মুজাহিদ বিপ্লবী কাজে অংশ নেওয়ার জন্য আন্দামানে কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন। বিপ্লবী পাঠান মুজাহিদদের শাস্তি বিধানের জন্যই কার্যত আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে দ্বীপান্তর ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। শের আলি, লর্ড মেয়োকে হত্যা করেন আন্দামানে বন্দি অবস্থায়। শের আলিরও ফাঁসি হয়। ক্ষুদিরাম বসু-র অনেক আগেই। কিন্তু সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি—সবই নীরবে? কারণ কী? সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা? কে জানে?

আজ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কোনও প্রধান বিচারপতি কি খুন হয়েছেন বিপ্লবীদের হাতে, কলকাতায় আদালতের সিঁড়িতেই? মাথা চুলকোতে হবে। খুন হয়েছিলেন জন প্যাক্সটন নরম্যান। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ২১ সেপ্টেম্বর। কী নাম সেই বিপ্লবীর? তাঁর নাম আবদুল্লাহ। শুধু এটুকু জানি, তিনি একজন বিপ্লবী পাঠান মুজাহিদ।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ‘স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়’। ইতিহাস আজ মানে, সিরাজ অত্যাচারী ছিলেন না, ছিলেন না লম্পট, কলঙ্কিত পুরুষ। কিন্তু সিরাজের পরাজয়ের ২৫০ বছর পর বাংলা জুড়ে কি কোনও বড় কর্মকাণ্ড, প্রচার অভিযান লক্ষ্য করা গেল? দু’একটি সংগঠন যাঁদের শীর্ষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ ছোটো করে আয়োজন করলেন আলোচনাসভার। আচ্ছা, সিরাজউদৌল্লা কি মুসলিম? নাকি ক্ষুদিরাম হিন্দু? তাঁরা তো দেশের জন্য জাতির জন্য প্রাণ দিয়েছেন? তবে জাতির এই বৈষম্য কেন?

পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পতুর্গিজরা প্রথম বাংলার সপ্তগ্রামে বাণিজ্যের জন্য ঘাঁটি তৈরি করে। পর্তুগিজ ভাষায়, সপ্তগ্রাম, পোর্টোপিকোরেনো। যার বাংলা অর্থ, গঙ্গার ছোট বন্দর। মনে রাখা দরকার, সপ্তগ্রাম ষোড়শ শতকে বিপুল গৌরবের অধিকারী। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা মোগল সম্রাটের কাছ থেকে সপ্তগ্রাম এবং হুগলিতে গুদাম ও বসবাসের অনুমতি পায়। পতুর্গিজ পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সপ্তগ্রাম বন্দরে দেখেছিলেন দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫টি জাহাজ ভিড় করছে চাল, কাপড়, চিনি—প্রভৃতি পণ্য সম্ভারের জন্য। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে হুগলি সপ্তগ্রামের স্থান নিল। সপ্তগ্রাম ছিল সিজার ফ্রেডরিকের ভাষায় ‘ফেয়ারি সিটি’—স্বপ্ননগরী। পর্তুগিজরা সনদ প্রাপ্ত হয়ে ভারতে বাণিজ্য করতে আসেনি, কিন্তু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য করতে আসে সনদ নিয়ে। যদিও তারা প্রথমে অনুমতি পায়নি। সতেরো শতকের শুরুতে ভারতের সুরাটে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রধান দপ্তর স্থাপন করে। পরে মছলিপট্টম, মাদ্রাজ, হুগলি, ঢাকায় স্থাপন করে আড়ং বা কারখানা। টমাস রো সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে অবাধ বাণিজ্যের প্রার্থনা জানান। এবং বিফল হন। টমাস রো তাঁর চিঠিতেই জানান, বাংলার রেশম তথা সিল্ক আগ্রার থেকে ভালো এবং সস্তা।

টমাস রো ব্যর্থ হলেন। তাঁর ব্যর্থতা পূরণ করলেন একজন ইংরেজ চিকিৎসক, ডাক্তার বাউটন। স্টুয়ার্টের লেখা ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ বই-এ এ বিষয়ে একটি কাহিনি আছে। সম্রাট শাহজাহানের দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালীন সময়ে তাঁর কন্যা অগ্নিদগ্ধ হন। ওমরাহ আসাদ খানের পরামর্শ মতো সম্রাট সুরাটের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কাছে ইওরোপিয় চিকিৎসক প্রেরণের অনুরোধ জানান। এই সুযোগকে কাজে লাগায় ধান্দাবাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পেশায় চিকিৎসক, আদতে কূটনীতিজ্ঞ, ডাক্তার গ্যাব্রিয়েল বাউটনকে পাঠায়। বাউটনের চিকিৎসায় শাহজাহান কন্যা বিপদমুক্ত হলেও বাংলার সর্বনাশের সূচনা হল। পারিশ্রমিক এবং পুরস্কারের জন্য অনুরুদ্ধ ডাক্তার বাউটন চাইলেন ইংরেজদের জন্য ভারত তথা বাংলায় শুল্কহীন বাণিজ্যের অধিকার। তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হল আবেদন। ইংরেজরা পেল ফরমান। ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ২ ফেব্রুয়ারি। পর্তুগিজদের পরে ইংরেজদের কারখানা স্থাপিত হল হুগলিতে। বাংলার সূতি বস্ত্র ও মসলিন বস্ত্র নিয়ে বাণিজ্যের অধিকারে ইওরোপিয় বণিকদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। সেই দ্বন্দ্বে ইংরেজ অন্যান্যদের চেয়ে এগিয়ে গেল বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়ে। শাহজাহানের অধিকার আরও প্রসারিত হল তাঁর পুত্র শাহ সুজার আনুকূল্যে। শাহ সুজা তখন বাংলার সুবেদার। শাহ সুজার অন্দরমহলে এক মহিলাকে তুষ্ট করার পুরস্কার স্বরূপ শাহ সুজা বিনা শুল্কে বাণিজ্যের সঙ্গে অন্যান্য বাধাগুলি অপসারিত করলেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাউটনের চিকিৎসায় উপকৃত বাংলার তৎকালীন সুবেদার মিরজুমলার আনুকূল্যও পেল ইংরেজ বণিকরা।

হুগলি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে সস্তার পণ্য সংগ্রহের কেন্দ্র। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ডাক্তার বাউটন তাঁর হোপওয়েল জাহাজ নিয়ে ওড়িশার বালাশোর বন্দর হয়ে হুগলি বন্দরে প্রবেশ করেন। হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজদের কারখানা। ঢাকার কারখানা স্থাপিত হয় ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে। ঐতিহাসিক ল্যাকি ‘হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড’ বইয়ে লিখেছেন, ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানি তাঁর স্বামীর সঙ্গে ভারত ভ্রমণে আসেন। পরিচিত হন পূর্ব ভারতের প্রস্তুত সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্রের সঙ্গে। তাঁর মাধ্যমেই বাংলার মসলিন বস্ত্র প্রসিদ্ধ লাভ করে ইংল্যান্ডে। মসলিন বস্ত্রে বিপুল চাহিদা বৃদ্ধি পায় ইংরেজ সমাজে। এতে প্রমাদ গোনে ম্যাঞ্চেস্টার চেম্বার অব কমার্স। ‘মসলিন যুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ে প্রশান্ত ঘোষ এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘বাংলায় বস্ত্রশিল্প যেভাবে সারা বিশ্বে গৌরবান্বিত হয়েছে তদনুরূপ ইংল্যান্ডে উৎপাদকরাও যাতে অগ্রসর হতে পারে এবং নিজেদের নৈপুণ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতিসম্পন্ন হয় সেই বিষয়ে ম্যাঞ্চেস্টার চেম্বার অব কমার্স এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে প্রচুর আলোচনা চলে। এই কাজে সফলতা না পাওয়ায় ইংরেজ কোম্পানি ঢাকার মসলিন বস্ত্র উৎপাদক তাঁত শিল্প ও তাঁত শ্রমিকদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে শুরু করে। যাতে শিল্পটি জাহান্নমে যায়। বাংলার মাটি থেকে মসলিন নিশ্চিহ্ন হয়’।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের প্রধানতম কারণ কিন্তু তাদের অবাধ বাণিজ্যের অধিকার ও তজ্জনিত কারণে দুর্নীতি, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচার।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসন আমলেই ‘সিরাজউদৌল্লা’ (ঐতিহাসিক চিত্র) নামে একখানি গবেষণামূলক বই প্রকাশ করেন। মনে রাখা দরকার, তখনই ভারতে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদী সমাজে সেভাবে প্রকাশিত হয়নি। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগে পর্যন্ত মূলত আবেদন-নিবেদনে ব্যস্ত ছিল। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও একই বছরে মুদ্রণ আইনের মারফৎ ইংরেজ বিরোধী লেখায় সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সামান্য ইংরেজ সরকার বিরোধী রচনা প্রকাশিত হলেই তাঁর টেকা ও বাঁচা দুর্দায় ছিল। সেই সময় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র সিরাজদৌল্লাকে নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ লেখা যথেষ্ট সাহসের পরিচয়। ইংল্যান্ডে সংসদের বিচার চলাকালীন নিজেদের বাঁচাতে ক্লাইভ ও তাঁর দলবল সিরাজের বিরুদ্ধে কুরুচিকর কাহিনি রচনা ও প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। (বিচারে ক্লাইভ অব্যাহতি পেলেও তাঁকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হয়েছিল)। ইংরেজ তোষণায় ব্যস্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কথাকেই ধ্রুবসত্য জ্ঞান করে সিরাজ নিন্দায় ও ইংরেজ তোষণে ব্যস্ত ছিল। আজও এমন লোকের ও লেখকের দেখা মেলে।

১০

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন—’বাল্যকাল হইতে সিরাজউদৌল্লা ইংরেজদিগকে দু’চক্ষে দেখিতে পারিতেন না। তিনি মনের ভাব গোপন না করিয়া, সময়ে সময়ে ইংরেজ বিদ্বেষের কথা নবাব-দরবারে প্রকাশ করতেও ইতস্তত করতেন না। কালে ইংরেজের হাতে সোনার বাংলা রাজ্য যে ক্রীড়ার-পুতুলের মতো উচ্চমূল্যে বিক্রিত হইবে তাহা যেন সূচনাতেই সিরাজউদৌল্লা বুঝতে পারিয়াছিলেন। সেইজন্য ইংরেজদিগের বাণিজ্য বিস্তৃতি এবং পদোন্নতি দেখিয়া তিনি ঈর্ষা-কষায়িত লোচনে তীব্র প্রতিবাদ করিতেন।

সিরাজ বাল্যকাল হইতেই ইংরেজ-চরিত্র অধ্যয়ন করিবার অবসর পাইয়াছিলেন। সেকালের নবাব-দরবারে ইংরেজ-প্রতিনিধির যাতায়াত ছিল। নগর ও উপকণ্ঠে বাণিজ্যালয় স্থাপন করিয়া, কাশিমবাজারের ইংরেজগণও সর্বদাই ইতস্তত বিচরণ করিতেন। ইহাদের কার্যকলাপ দেখিয়া সিরাজের ইংরাজ-বিদ্বেষ দূর হইল না, বরং ইহাদের প্রত্যেক কার্যের মধ্যেই গূঢ় অভিসন্ধি দেখিয়া, সিরাজউদৌল্লা মনে মনে ইংরেজদিগকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা করিলেন। বাল্য-সংস্কার সহজে দূর হইবার নহে; বয়োবৃদ্ধি সহকারে সিরাজের সেই বাল্য-সংস্কার ক্রমেই ঘনীভূত হইতে লাগিল।

হীরা ঝিলের প্রমোদ ভবন নির্মিত হইবার সময় হইতে সিরাজউদৌল্লার সেই স্থানে নিজ নামানুসারে ‘মনসুরগঞ্জ’ নামে একটি গঞ্জ স্থাপিত করিয়াছিলেন। সেই গঞ্জের সমুদয় আয় তাঁর করায়ত্ত ছিল; সুতরাং কিসে সেই গঞ্জের উন্নতি ও আয়বৃদ্ধি হইবে, তাহার জন্য সিরাজউদৌল্লা সর্বদাই চেষ্টা করিতেন। দেশি বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি না হইলে, গঞ্জের শ্রীবৃদ্ধি হইতে পারে না। ইংরেজদিগের প্রকাশ্য ও গুপ্ত বাণিজ্যে দেশীয় ব্যবসায়ীদিগের ক্ষতি করিয়া বিদেশিয়দিগের লাভের পথ যতই বিস্তৃত হইতে লাগিল, সিরাজউদৌল্লা বিদেশি বণিকদিগের উপর ততই অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। ফরাসি, দিনমার, ওলন্দাজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকদিগের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিবার অধিকার ছিল না; সুতরাং তাহাদের প্রতিযোগিতায় দেশের লোকের বিশেষ ক্ষতি হইত না। কিন্তু ইংরেজগণ বিনা শুল্কে জলে, স্থলে বাণিজ্য করিবার আদেশে—বাদশাহের ফরম্যান পাইয়া নিঃসম্বল দেশীয় বণিকদের লাভের পথে কাঁটা দিয়েছে বলিয়া, ইংরেজদিগের উপরেই তাহার বিদ্বেষ বদ্ধমূল হইয়াছিল। বাদশাহের ফরম্যান পাইয়া কেবল যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিত তাহা নহে; কোম্পানির কর্মচারীর আত্মীয়স্বজনরাও এদেশে আসিয়া গোপনে গোপনে স্বাধীন বাণিজ্য করিতেন; এবং কোম্পানির কর্মচারীদিগের নিকট হইতে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার পরোয়ানা লইয়া তাহারাও যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিতেন। জন উড নামক এইরূপ একজন ইংরেজ বণিক কোম্পানির নিকট বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার পরোয়ানা চাহিয়া নিজ আবেদন পত্রে স্পষ্টই লিখিয়াছিলেন যে, স্বাধীন ইংরেজ বণিককেও কোম্পানির ন্যায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার জন্য পরোয়ানা না দিলে সর্বনাশ হইবে। বাদশাহের ফরম্যান অমান্য করিবার উপায় নাই। যতদিন ইংরাজ থাকিবে ততদিন তাহারা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবে; সুতরাং ইংরেজদিগকে তাড়াইয়া দিতে না পারিলে দেশীয় বাণিজ্যে কখনই শ্রীবৃদ্ধি হইবে না; বোধহয়, সেইজন্যেই বালক সিরাজউদৌল্লা ইংরেজদিগকে তাড়াইয়া দেবার সুযোগ অনুসন্ধান করিতেন। সেনাপতি মুস্তাফা খাঁ থাকিতে তিনি সিরাজের প্রস্তাবে সমর্থন করিতেন; কিন্তু আলীবর্দীর ভয়ে তিনিও ইংরেজ তাড়াইবার আয়োজন করিতে পারিতেন না। প্রস্তাব উঠিলেই আলীবর্দী বলিতেন। ”মুস্তাফা যুদ্ধ ব্যবসায়ী; যুদ্ধ বাধিলেই তাহার লাভ। তোমরা তাহার কথা কর্ণপাত করিও না।”

আলিবর্দী মহারাষ্ট্র-দমনে বিব্রত হইয়া ইংরাজদিগের অত্যাচারের কথা জানিয়া শুনিয়াও প্রতিকার করিবার চেষ্টা করিতেন না। বরং সিরাজদৌল্লার ইংরাজ বিদ্বেষের পরিচয় পাইয়া সময় সময় স্পষ্টই বলিতেন, ”দুর্দান্ত সিরাজ ইংরাজদিগের সঙ্গে শীঘ্রই কলহ-বিবাদে লিপ্ত হইবে এবং তা হইতে কালে সিরাজের রাজ্য ইংরাজের করতলগত হইবে।” সিরাজদৌল্লা সেকথায় কর্ণপাত করতেন না। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, সামান্য একটু তাড়া দিলেই বাণিজ্যের খাতাপত্র এবং মাল গুদামে ফেলিয়া ইংরাজ-বণিক প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার পথ পাইবে না। সিরাজ একবার ইংরাজদিগকে তাড়াইয়া দিবার জন্য সত্য সত্যই নবাবের অনুমতি চাহিয়াছিলেন। নবাব প্রত্যুত্তরে এইমাত্র বলিয়াছিলেন যে, ”মহারাষ্ট্র-সেনা স্থলপথে যে যুদ্ধানল জ্বালিয়া দিয়াছে, তাহাই নির্বাণ করিতে পারি না, এ সময় ইংরাজের রণতরী যদি সমুদ্রে অগ্নিবর্ষণ করে, তা হইলে সে বাড়বানল কেমন করিয়া নির্বাণ করিবে?”

সেই সিরাজদৌল্লা যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন শুনিয়া ইংরাজদিগের মধ্যে মহা আতঙ্ক উপস্থিত হইল। ইংরাজ তখন কৃপা ভিখারি বণিক মাত্র, নবাব-দরবারে তাঁহাদের পদগৌরব ছিল না।’

১১

ইংরেজের অপরাধ অনেক।

১। বিনা শুল্কে বাণিজ্য ও তজ্জনিত ফরমানের অপব্যবহার। ইংরেজ কর্মচারীও দত্তকের অপব্যবহার করত। কর ফাঁকি দিত। দেশীয় তাঁতি ও বণিকদের নির্যাতন করত।

২। সিরাজের আদেশ অমান্য করে কাশিমবাজারে দুর্গ নির্মাণ, সেখানে বন্দুক-কামান সমৃদ্ধ তোপখানা নির্মাণ। কাশিমবাজারে নদীর দিকে প্রাচীরে ২২টি কামান, ৪টি বুরুজে ১০টি কামান পাতা, এবং দুর্গ রক্ষার জন্য লেফটেন্যান্ট ইলিয়টের অধীনে গোলন্দাজ সৈন্যে দুর্গে কুচকাওয়াজ। সবই করে বিনা অনুমতিতে।

৩। বাগবাজারের কাছে ইংরেজ পেরিং সাহেবের দুর্গ প্রাকার রচনা।

৪। ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম, কাশিমবাজার, বাগবাজার—কোথাও কোনও দুর্গ গড়ার ও সৈন্য সমাবেশে অনুমতি কিন্তু মোগল সম্রাট বা বাংলার কোনও নবাব দেননি। প্রসঙ্গত, মুর্শিদাবাদ শহরে কোনও দুর্গও ছিল না।

৫। কলকাতা থেকে সিরাজদৌল্লার দূত সম্ভ্রান্ত খোজা ওয়াজিদকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া।

৬। রাজবল্লভের দুষ্কৃতকারী পুত্র কৃষ্ণদাসকে সিরাজের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কলকাতায় আশ্রয় দান। কৃষ্ণদাস সেকালে ৫৩ লাখ টাকার ধনরত্ন নিয়ে ইংরেজদের শরণ নেন।

৭। খোজা ওয়াজিদের পর চরাধিপতি রামসিংহের ভাই রাজদূত হিসেবে ইংরেজদের কাছে যান। তাকেও অপমান করে তাড়ায় ইংরেজরা।

৮। ইংরেজরা কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান সহ বিভিন্ন কাজের মধ্যে সিরাজের শত্রুপক্ষের সঙ্গে তাঁদের প্রকাশ্য মিত্রতা জ্ঞাপন করতে থাকেন।

৯। নবাবের কলকাতাস্থিত প্রতিনিধি গৃহ আক্রমণ ও লুণ্ঠন।

১২

একালেও কোনও-কোনও ঐতিহাসিক ইংরেজ বন্দনায় মুখর। পলাশি যুদ্ধের কারণ হিসাবে তাঁরা ইংরেজদের নয় সিরাজের দোষ দেখেন। অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজের ধামাধারী এই ঐতিহাসিককুল দেশের কলঙ্ক।

ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী ‘নবাবের আমলে মুর্শিদাবাদ’ গ্রন্থে পরিষ্কার দেখিয়েছেন কীভাবে ইংরেজরা বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড তুলে নেওয়ার জন্য পলাশির যুদ্ধ বাধিয়েছিল। পলাশি পর্যন্ত ক্লাইভ পৌঁছলেন কেন? তাঁর তো কলকাতায় থাকার কথা। কাটোয়া দখল করেছিলেন কেন? পলাশির যুদ্ধ হয় ২৩ জুন ১৭৫৭। ওই বছরের জানুয়ারি মাসে ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ করে। ৯ এপ্রিল ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালেসকে স্ক্র্যাফটন লিখেছেন—

ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগোতে হবে।…মিঃ ওয়াটসকে এ ব্যাপারে একটি ইঙ্গিত কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন…এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাকে আমার প্রিয় পুরোনো পরিকল্পনাটি (মাই ফেভারিট স্কিম) সফল হতে পারে।

১৮ই এপ্রিল ১৭৫৭ ইয়ার লতিফ খানকে নবাব বানাবার জন্য ওয়াটসকে প্রস্তাব দিলেন স্ক্র্যাফটন।

২৩ এপ্রিল ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়ামে সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজকে সরিয়ে অন্য কাউকে নবাব বানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

২৮ এপ্রিল ১৭৫৭ সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভকে পরবর্তী নবাব বাদশাহ সন্ধানের দায়িত্ব দান।

২ মে ১৭৫৭ মিরজাফরকে আশ্বাস দান তিনি নবাব হবেন। আর ইংরেজরা সিরাজকে দেশ থেকে তাড়াতে সমর্থ।

১৩ জুন ১৭৫৭ ক্লাইভের সসৈন্য মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা।

১৯ জুন ১৭৫৭ কাটোয়ায় ইংরেজ সৈন্য

২২ জুন ১৭৫৭ পলাশিতে ইংরেজ সৈন্যের শিবির স্থাপন

২৩ জুন ১৭৫৭ পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহ দখল করে নিয়েছে ইংরেজ। মুর্শিদাবাদ দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী ইংরেজ সৈন্যদের বাধা দিতে সিরাজের পলাশি যুদ্ধ।

১৩

ইংরেজ সৈন্য সেদিন পলাশিতে মিরজাফরের নবাবের প্রতি অসহযোগিতা সত্ত্বেও জেতেনি। নবাবের সৈন্য প্রধানমন্ত্রী মোহনলাল, মির মহম্মদ কাজিম, খাজা আবদুল হাদি, মিরমদন, নবসিংহ হাজারি, সাঁফ্রে-র নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ চালিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের হতবল করে দেন। ‘লজ মেমোয়ার’ গ্রন্থে হিল জন উড নামে এক ইংরেজ সৈনিকের বিবরণ উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল যাতে অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়া যায়। (সূত্র নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদ, সুশীল চৌধুরী, পৃ. ৮২)। সেনাপতি মিরমদানের (মিরমদন বলে অধিক পরিচিত) গোলার আঘাতে মৃত্যুতে সিরাজ হতবুদ্ধি না হয়ে যদি মিরজাফরের পরামর্শে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করতেন তাহলে পলাশি যুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হত। সুশীল চৌধুরী লিখছেন :

‘মিরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওই দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মিরমদনের মৃত্যুর পর মোহনলাল মূল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেনাপতিদের সকলেই প্রথমে নবাবের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন। এই যুক্তিতে যে ওই সময় পিছু হটে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। কিন্তু সিরাজের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। ইউসুফ আলি লিখেছেন, ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য নবাবের অন্যতম সেনাপতি মির মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে ভৎর্সনা করতেও দ্বিধা করেননি।

সিরাজদৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পলাশির তথাকথিত যুদ্ধ শেষ। পলাশি যুদ্ধের সাক্ষী ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে কোনোরকমে মুখোমুখি বা আক্রমণ ছাড়াই এমন একটি ‘গ্রেট অ্যান্ড ডিসাইসিভ’ যুদ্ধের নিষ্পত্তি এবং তার সঙ্গে একটি রাজ্য জয়ও হয়ে গেল। সন্ধ্যা ৬টায় ক্লাইভ মিরজাফরের অভিনন্দন সূচক বার্তা পেলেন—’আপনার পরিকল্পনা সফল হওয়ায় অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মিরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন, ‘আপনার (অর্থাৎ ইংরেজদের পরিকল্পনা)’। ক্লাইভ পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফটন মারফৎ দায়ুদপুর থেকে মিরজাফরকে চিঠি পাঠালেন ‘এই জয় আপনার। আমার নয়। অতি সত্ত্বর আমার সঙ্গে মিলিত হলে খুশি হব। আপনাকে নিয়ে কালই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করব। আশা করি আপনাকে নবাব বলে ঘোষণা করার সম্মান আমি পাব।’ ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে মিরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় নবাবের মুকুট পরিয়ে দেন।’

সিরাজ সম্পর্কে বদনাম দেওয়া হয়েছে অনেক। কিন্তু তার বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু। প্রায় সব রাজপুরুষই সেকালে মদ্য পান করতেন। ইংরেজ স্ক্র্যাফটন লিখেছেন, ১৫ বছর বয়সে সিরাজ দাদু আলীবর্দির পা ছুঁয়ে মদ্য পান না করার প্রতিজ্ঞা করেন। আমৃত্যু সে প্রতিজ্ঞা রাখেন। বহু নারীসঙ্গ অভিযোগ মিথ্যা। নামমাত্র একটি বিয়ে হয়েছিল কৈশোরে। প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী লুৎফার গর্ভেই জন্ম হয়েছিল কন্যা জহুরার। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় জানাচ্ছেন, খুব বড় যোদ্ধা ও সমরকুশলী সেনানায়ক ছিলেন সিরাজ। বর্গি হাঙ্গামার সময় সে দক্ষতা প্রমাণিত। বিনা রক্তপাতে কাশিমবাজার কুঠি জয়ও তার সাক্ষ্য দেয়।

১৪

১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান শহরে বসে মোঘল রাজপুত্র আজিম উস সান কলকাতা, সুতানটি, গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটি অধিকার তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে। পরে মোঘল সম্রাটদের উৎখাত করে ইংরেজরা। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সালিম আবাহন হয়েছিল বাংলায়, হয়নি সেভাবে। বাঁচোয়া। কিন্তু ২০০৭-এর ৩ আগস্ট যে চুক্তি করলেন ‘দিল্লিশ্বর’ মনমোহন সিং তার ‘প্রায়শ্চিত্ত’ কতদিন ধরে করতে হবে ভারতবাসীকে কে জানে? ইরাক যুদ্ধের সময় ‘আনন্দবাজার’ ২০০৩-এর ৯ মার্চ একটি সংবাদ ছেপেছিল। যার শিরোনাম ছিল, ভারতে সামরিক ঘাঁটি বানাতে চায় আমেরিকা। ১৯৯১-এর ইরাক যুদ্ধে মার্কিন বিমান তেল ভরেছিল ভারতের মাটিতে। ২০০৩-এ বিশাখাপত্তনমে নেমেছিল মার্কিন সেনা। ২০০৬-এ হল ভারত মার্কিন যৌথ সামরিক মহড়া। কিন্তু কোনও লিখিত পড়িত চুক্তি ছিল না। ২০০৭-এর ৩ আগস্ট ইউ এস ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট থেকে ১২৩ চুক্তির যে অনুলিপি সাংবাদিকদের উদ্দেশে আন্তর্জালে দেওয়া হয়েছে তাতে পরিষ্কার লেখা হয়েছে

ডিজারাস অফ ষ্ট্রেংদেনিং দি স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ বিটুইন দেম। ‘বিটুইন দেম’ মানে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

১৫

চায়ের দোকানের পাঁচুগোপাল ভারি ভদ্রলোক, সৎ, সবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক, বেশি কথা বলে না। শোনে বেশি, ফাটা কেষ্ট মার্কা হেবু-র সঙ্গে যেমন সম্পর্ক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গেও তেমনি। তো এরকম লোকই তো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য। মনমোহনের সঙ্গে ভারি মিল।

মনোমোহন কেম্ব্রিজ গেলেন, উপাধি নিলেন, ব্রিটিশ রাজত্বের প্রশংসায় গদগদ হলেন। আমরা ক্ষমা করে দিলাম, আহা ভালোমানুষ। টাকা পূর্ণরূপান্তরযোগ্য করে ১৫ টাকার ডলার থেকে ৪৫ টাকায় তুলে দিলেন, আমরা ঐতিহাসিক অর্থনীতির সাথী হলাম। মিরজাফরও সেদিন বর্গির হাঙ্গামা রুখতে গিয়ে মেদিনীপুরে আলিবর্দির বিরোধিতা করেছিলেন, পরে মাফও পেয়েছিলেন, আহা ভালোমানুষ।

মিরজাফরও ভালোমানুষ। মনমোহনও।

১৬

চাকরি করে মাত্র সাড়ে সাত কোটি টাকা আয় পাকিস্তান থেকে কপর্দকহীন অবস্থায় উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষটির।

১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি যে চুক্তি করেছিলেন দিল্লির সম্রাট ২০০৭-এর ৩ আগস্টে দিল্লিশ্বর মনমোহনের সেই চুক্তিও সমান বিপজ্জনক।

১৭

বিশ্বাসঘাতকতার ২৫০ বছর!

মিরজাফর থেকে মনমোহন।

ভারতের সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্র্য বিসর্জনের।

মনমোহনের আমলে যে টুকু ছিল, মোদির আমলে তা নিমজ্জিত।

করোনা চিকিৎসায় দেশে উৎপাদিত হাইড্রোক্সিক্লোরিন সহ ২৪টি ওষুধ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি। এরপর ট্রাম্পের হুমকিতে সুড়সুড় করে আদেশ প্রত্যাহার।

মনমোহন নরসিংহ রাওয়ের আমলে উদার অর্থনীতির জন্ম দেন। তার হাত ধরে আবার অনুপ্রবেশ করে বিদেশি বণিক সরাসরি। স্বাধীনতার পর আর্থিক বিকাশের লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গড়া ও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেয় নেহেরু, ইন্দিরা সরকার। রাজীব জমানায় ভিন্ন সুর শোনা যায়। কিন্তু গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করেননি। চটকল অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার নীতিতে। পাটজাত সামগ্রী বা চটের বদলে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের সেই শুরু। সার আমদানিও শুরু হয়। আবার তথ্যপ্রযুক্তিতে এল বিপ্লব। কমপিউটার ব্যবহারের সেই ব্যাপক শুরু। ১৯৯১-এর পর মনমোহনি অর্থনীতি। উদারিকরণের শুরু। একদিকে চাকরি করা লোকের বেতন বাড়ল অন্যদিকে সমস্যা আরম্ভ হল। বেসরকারিকরণের ভাবনা এল। ডলারের নিরিখে টাকার দাম কমল। টাকা পূর্ণরূপান্তরযোগ্য করায়। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সর্বনাশ হল বাজপেয়ী জমানায়। বেসরকারিকরণের দিকে ধাবিত হল দেশ আরও বেগে। কাটমানি ও কমিশন খেয়ে বিক্রি করা হতে লাগল সরকারি সম্পত্তি। একটা দপ্তরই খুলে ফেলা হল বিলগ্নিকরণ দপ্তর। অরুণ শৌরি মন্ত্রী। অথচ বিজেপি অতীতে স্বদেশি অর্থনীতির কথা বলত। কে আর মালকানি, গোবিন্দাচার্যরা পিছনে চলে গেলেন। ত্যাজ্য হলেন আর এস এসের স্বদেশি অর্থনীতির প্রবক্তারা। বেচে দেওয়া হল মুম্বাইয়ের সেন্টুর হোটেল। জলের দামে। চার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ১৩১ কোটিতে। দমদম বিমান বন্দরের অশোক হোটেল ১১ কোটিতে। আসল দাম হওয়ার কথা ৪০০ কোটি টাকা। সরকারি সংস্থা বি এস এন এল-কে টাটার কাছে ১১০০ কোটি টাকায় আংশিক বেচা হল। বলা হল, টাটা প্রযুক্তিগত উন্নতিতে সহায়তা করবে। কাঁচকলা। ভি এস এন এল-এর নাম বদলে হল বি এস এন এল। রুগ্ন হল। আর মোদি জমানায় অম্বানির রিলায়েন্স ও জিও-র স্বার্থে তা এখন মৃতপ্রায়। মাইনে দিতে পারছে না।

ভারতের অন্যতম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী সময়ে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দিতে পারবে না, জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়েছিল।

নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার—এই স্বপ্ন কিন্তু দেখিয়ে গিয়েছিলেন, দ্বারকানাথ এবং রবীন্দ্রনাথ।

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন