ভূমিকা
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি পনরোটি অধিকরণ বা পুস্তক এবং একশত পঞ্চাশটি অধ্যায়ে বিন্যাসিত। এ সমস্ত অধিকরণে রয়েছে একশত আশিটি প্রকরণ বা বিষয়। সাকুল্যে এই গ্রন্থের শ্লোকের সংখ্যা ছয় হাজার। কোনো কোনো লেখক গবেষক অধিকরণকে আলাদা পুস্তক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কেউবা গ্রন্থটি রচনা করেছেন বিষয়বস্তুর নিরিখে। এক্ষেত্রে মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রণীত ‘কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রম’ গ্রন্থের বিষয় বিন্যাসের আদল অনুসরণক্রমে অধিকরণ, অধ্যায়, প্রকরণ এবং উপ- অধ্যায়ের মাধ্যমে গ্রন্থটি উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ গ্রন্থর সূচনা পর্বের প্রথম অধিকরণে অর্থশাস্ত্রের সারবত্তা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রারম্ভিক পর্যায়ে অসুরগুরু, শুক্রাচার্য ও বৃহস্পতির প্রতি নমস্কারজ্ঞাপন করা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের সূচনাকারী আচার্যদের মধ্যে এনারা শ্রেষ্ঠতাত্ত্বিক হিসেবে স্বীকৃত। এ কারণেই গ্রন্থের প্রারম্ভে তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনার্থে নমস্কার নিবেদন করেছেন। পৃথিবীস্থ অপ্রাপ্ত ভূমির প্রাপ্ততা এবং প্রাপ্ত ভূমির রক্ষণ বিষয়ে যতগুলো অর্থশাস্ত্র পূর্ববর্তী আচার্য তথা শুক্র, বৃহস্পতি ও বিশালাক্ষ কর্তৃক প্রনয়ণ করা হয়েছে, সে সবের সমন্বয়েই মূলত অর্থশাস্ত্র রচিত বলে কৌটিল্য কর্তৃক স্বীকৃত।
কৌটিল্য কর্তৃক বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের উপর আরোপিত স্বধর্ম পালনের উপর অত্যন্ত গুরুত্বআরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে—আরোপিত দায়িত্ব যদি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়, অর্থাৎ যাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করা হয়েছে তা যদি সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয়, তাহলে সমাজ ও রাজ্যে সদাচারের নিয়মকানুন বিরাজমান থাকবে এবং এর ফলে অনন্ত সুখের পরিবেশ বিরাজ করবে। এর অন্যথা হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে প্রজাকুল যাতে করে স্বধর্মের প্রতি প্রতিজ্ঞ থেকে তা প্রতিপালনে সক্রিয় থাকে, স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয় সে ব্যাপারে রাজাকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে— স্বধর্মচ্যুত সমাজ অচিরেই বিনাশ হয়ে যায়, অন্যদিকে স্বধর্মাশ্রিত সমাজে বিরাজ করে অনাবিল সুখ শান্তি। পরকালের স্বর্গপ্রাপ্তিও হয় সুনিশ্চিত। কৌটিল্য মনে করেন—চার বর্ণ এবং অন্যান্য আশ্রমের লোকেরা রাজার অনুশাসনের (দণ্ডের) মাধ্যমে প্রতিপালিত হলে নিজ নিজ ধর্মের এবং কর্মের প্রতি প্রতিজ্ঞ থেকে সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করতে সক্ষম হয়।
গ্রন্থের বিনয়াধিকারিক (শিক্ষা সম্পর্কিত) নামক প্রথম অধিকরণের যে আঠারোটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় আলোচিত হয়েছে, তা হলো—বিদ্যাসমুদ্দেশ তথা হেতুবিদ্যা। ত্রয়ী তথা ধর্ম বিষয়ক বিদ্যা। বার্তা তথা কৃষি ও বাণিজ্যিকবিষয়ক বিদ্যা এবং দণ্ড তথা রাজনীতি বা শাসনবিষয়ক বিদ্যা। বৃদ্ধসংযোগ তথা প্রাজ্ঞ বৃদ্ধদের সঙ্গে রাজন্যদের জ্ঞানার্জন সম্পর্কীয় সম্পৃক্ততা। ইন্দ্রিয় জয়। অমাত্য নিয়োগ। মন্ত্ৰী, পুরোহিত ও উপদেষ্টা নিয়োগ। অমাত্যদের শৌচ ও অশৌচ পরীক্ষণ। গুপ্তচর নিয়োগ। গুপ্তচরদের কর্ম বিভাজন। স্বরাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ। পররাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ। মন্ত্রণা তথা পরামর্শকর্ম। দূতিয়ালি কর্ম। রাজপুত্রগণ হতে রাজার সুরক্ষা। অবরুদ্ধ রাজকুমারদের প্রতি রাজার করণীয়। অবরুদ্ধ রাজকুমারদের অপরাধের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থা। রাজার কর্মপরিধি। নিশান্ত প্রণিধি বা রাজভবন নির্মাণ। রাজার আত্মরক্ষার কৌশল।
অধ্যক্ষ প্রচার (রাজ্যের শাসনকার্যের নিমিত্ত প্রশাসক নিয়োগ) নামক দ্বিতীয় অধিকরণের আটত্রিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—জনপদ নিবেশ বা সৃজন। ভূমি সম্পর্কীত বিধান। দুর্গ তথা নগর বা রাজধানী বিনির্মাণ। দুর্গের বা নগরের বিন্যাস। সঞ্চিত ধন সম্পদের মজুদকরণ। কর সংগ্রহ ব্যবস্থা। অক্ষপটল বা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়। রাজকর্মচারীদের আত্মাসাৎকৃত অর্থের পুনঃযোজন। পরিদর্শকদের দায়িত্বের তত্ত্বাবধান। শাসনাধিকার বা রাজাদেশের লিখনির বিধিবিধান। রাজকোষে রক্ষণযোগ্য মণি মুক্তাদির পরীক্ষণ। খনি ও কারখানার তত্ত্বাবধান। অক্ষশালাস্থ সুবর্ণাধ্যক্ষের কর্ম। সৌবর্ণিকের কর্মপরিধি। খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার তথা কোষ্ঠাগারের অধ্যক্ষের দায়িত্ব। বিক্রেয় পণ্যদ্রব্যের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের দায়িত্ব। বৃক্ষজাত পণ্যদ্রব্যের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কার্যাবলি। অস্ত্রাগারের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের দায়িত্বাবলি। তুলামানপৌতব তথা ওজন ও পরিমাপক বিষয়ক প্রশাসকের দায়িত্ব। দেশ-কাল-মান তথা সময় ও কাল পরিমাপকের দায়িত্ব। শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কর্ম পরিধি। সূত্রাধ্যক্ষ তথা কার্পাসতন্ত্র বয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষের কার্যপরিধি। কৃষিভূমির দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কার্যাবলি। সুরাধ্যক্ষ তথা মদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসকের দায়িত্বাবলি। সূনাধ্যক্ষ তথা কসাইখানার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি। গণিকাধ্যক্ষ তথা পতিতালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি। নাবধ্যক্ষ তথা জলযানের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি। গোহধ্যক্ষ তথা গবাদি পশুর দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি। অশ্বাধ্যক্ষ তথা অশ্ব প্রতিপালনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি। হস্ত্যাধ্যক্ষ তথা হাতি সংগ্রহ, প্রতিপালন ও সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি। রথাধ্যক্ষ তথা রথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি। পত্ত্যধ্যক্ষ তথা পদাতিক বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত সেনা অধিনায়কের দায়িত্বাবলি। সেনাপতি প্রচার তথা চতুরঙ্গ বাহিনী বা হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বাবলি। মুদ্রাধ্যক্ষ তথা রাজার অনুমতিপত্র প্রদানকারী প্রশাসকের দায়িত্বাবলি। বিবীতাধ্যক্ষ তথা গোচারণ ভূমির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকের কার্যাবলি। সমাহর্ত্য প্রচার তথা রাজার অর্থ সংগ্রহকারী প্রশাসকের কার্যপরিধি। গূঢ়পুরুষ তথা বণিক, সন্ন্যাসীর বেশধারী গুপ্তচরদের কার্যপরিধি। নাগরিক প্রণিধি তথা নগরের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিতদের কার্যপরিধি।
অনন্তর ধর্মস্থীয় (বিচার বিভাগীয়) নামক তৃতীয় অধিকরণের উনিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—সঙ্গত ও অসঙ্গত আচার-আচরণের ব্যবস্থাপনা। বিচারিক বিষয়াদি। বিভিন্ন ধরনের বিবাদবিষয়ক নিষ্পত্তি। দায়বিভাগ তথা পৈত্রিক সম্পত্তি ও তার দায় বিভাজন। বাস্তক তথা গৃহ সম্পর্কিত বিষয়। সময়ভিত্তিক চুক্তিবিষয়ক। ঋণ প্রদান সম্পর্কিত। গচ্ছিত দ্রব্যাদি বিষয়ক। দাস ও শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত। সমবায়ভিত্তিক কার্যারম্ভের বিষয়। ক্রয় ও বিক্রয় সম্পর্কিত বিষয়। দেয় দ্রব্য অপ্রদান বিষয়ক। অপরের দ্রব্য বিক্রয় সম্পর্কিত। হারানো দ্রব্যের মালিকানা নির্ণয়। সাহস তথা সহসাকৃত কর্ম। বাপারুষ্য তথা কটুবাক্যের মাধ্যমে আঘাত প্রদান। দণ্ডপারুষ্য তথা শারীরিকভাবে আঘাত প্রদান। দ্যূতকার্য তথা অক্ষক্রীড়া বা প্রাণীদের ক্রীড়ার মাধ্যমে বাজি ধরা বিষয়ক। প্রকীর্ণক তথা উপরোক্ত বিষয় বহির্ভূত আপত্তির নিষ্পত্তি।
কণ্টকশোধন (ছল, চাতুরি, জালিয়াতি, ঠগবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শাস্তি আরোপণ) নামক চতুর্থ অধিকরণের তেরটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—সুক্ষ্ম কারুশিল্পীদের প্রতারণা হতে সুরক্ষা। বণিকদের ঠগবাজি নিরোধকরণ। দৈব বিপত্তির প্রতিকার। গোপন প্রবঞ্চকদের কবল থেকে সুরক্ষা। গুপ্তচরদের মাধ্যমে দুষ্টু লোক ও রাজদ্রোহীদের চিহ্নিতকরণ। সন্দেহভাজন, আত্মসাৎকারী ও সন্ধিচ্ছেদকারীদের আটক। সদ্যমৃতের মৃত্যুর হেতু উদ্ঘাটন। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অপরাধের উৎস উদ্ঘাটন। সর্বাধিকরণরক্ষণ তথা রাজকর্মচারীদের উৎপীড়ন হতে রাজা ও প্রজাদের রক্ষাকরণ। একাঙ্গবধনিষ্ক্রয় তথা অপরাধের মানদণ্ডে অপরাধীর অঙ্গহানিকরণ। অপরাধের মানদণ্ডে যন্ত্রণাহীন বা যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরকরণ। নাবালিকার সঙ্গে যৌনাচারকারীর শাস্তি আরোপণ। শাস্ত্রীয় বিধিবিধান লঙ্ঘনের প্রতিবিধান।
যোগবৃত্ত (গুপ্তহত্যা) নামক পঞ্চম অধিকরণের সাতটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—দাওকার্মিক তথা অপরাধের মানদণ্ডে গোপনীয় হত্যাযজ্ঞ। কোষাভিসংহরণ তথা রাজকোষের জন্য বাড়তি আয়ের উপায়। ভৃত্যভরণীয় তথা রাজকর্মচারী ও পরামর্শদাতাদের ভরণপোষণ। অনুজীবীবৃত্তি তথা রাজকীয় সভাসদদের স্বভাব। সময়াচারিক তথা আচার, অনুষ্ঠান ও ব্যবহার সম্পর্কিত বিধি বিধান। রাজ্যপ্রতিসন্ধান তথা রাজার বিপত্তিকালে মন্ত্রী, অমাত্যদের করণীয় কর্তব্য। একৈশ্বর্য তথা রাজ্যের সংহতির স্বার্থে রাজকুমারের একক কর্তৃত্বের অপরিহার্যতা।
মণ্ডলযোনি নামক ষষ্ঠ অধিকরণের দুটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো— প্রকৃতিসম্পদ তথা রাজা, অমাত্য, মিত্র, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য এবং শম ও ব্যয়াম তথা শান্তি ও উদ্যোগ।
ষাড়গুণ্য (ছয়গুণ) নামক সপ্তম অধিকরণের উনত্রিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—ষাড়গুণ্যসমুদ্দেশ বা ছয়টি গুণ তথা (ক) সন্ধি (শান্তি, মিত্রতা বা চুক্তি) (খ) বিগ্রহ (যুদ্ধ) (গ) আসন (নিরপেক্ষাবস্থা) (ঘ) যান (সেনাভিযান) (ঙ) সংশয় (আশ্রয়) এবং (চ) দ্বৈধীভাব (দ্বৈতনীতি) ক্ষয়স্থানবৃদ্ধিনিশ্চয় তথা শাসনজনিত ক্ষয়ক্ষতি, স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি। সংশয়বৃত্তি তথা তুলনামূলকভাবে অধিক বলশালীর আশ্রয়ে অবস্থান। সমশক্তি, হীনশক্তি ও উচ্চশক্তিসম্পন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ষাড়গুণের প্রয়োগ। হীনশক্তিসম্পন্ন শত্রুর সঙ্গে অর্থ, সৈন্য ও ভূমি প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি স্থাপন। বিগৃহ্যাসন তথা স্বরাজ্যে অবস্থান করে শত্রুর সম্পদ সৃষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টিকরণ। সন্ধায়াসন তথা সংগ্রামে অসমর্থ শত্রুর সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনপূর্বক সহাবস্থান। বিগৃহ্য যান তথা পার্ষিগ্রাহের (পশ্চাদের শত্রু) সাথে মিত্রতা স্থাপনপূর্বক শত্রুর বিরুদ্ধে সমরাভিযান। সন্ধায় যান তথা মিত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সমরাভিযান। সম্ভূয় প্ৰয়াণ তথা সম, হীন ও উৎকৃষ্ট নৃপতির সঙ্গে সন্ধিস্থাপনপূর্বক শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান। যাতব্য (আক্রমণযোগ্য শত্রু) ও অমিত্রপ্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণের আয়োজন। প্রকৃতিবর্গের (রাজা, অমাত্য, মিত্র, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য) অবক্ষয়, লোভ ও বিদ্রোহের কারণ সন্ধান। সমবায়ভুক্ত বা সম্মিলিত জোটভুক্ত রাজন্যদের গুরুত্ব ও লঘুত্ব সংক্রান্ত মূল্যায়ন। সংহতিপ্রয়াণিক তথা সন্ধিপূর্বক প্রয়াণ। পরিপণিত, অপরিপণিত ও অপসৃত সন্ধি। দ্বৈতভাব সম্বন্ধীয় সন্ধি ও শক্তি প্রদর্শন। যাতব্যবৃত্তি (আক্রমণীয় শত্রুর বিরুদ্ধে করণীয়)। অনুগ্রহযোগ্য মিত্র। মিত্র, অর্থ, ভূমি বা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে কৃতসন্ধি। পষ্ণিগ্ৰাহ তথা পশ্চাদে অবস্থানকারী শত্রু সম্পর্কিত চিন্তন। হীনশক্তিপূরণ। শক্তিমান শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম। বলবান শত্রুর প্রতি আয়ত্তীকৃত রাজার করণীয়। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আয়ত্তীকৃত শত্রুর প্রতি রাজার করণীয়। সন্ধিকর্ম। সন্ধিভঙ্গ। মধ্যম নৃপতির প্রতি রাজার করণীয়। উদাসীন নৃপতির প্রতি রাজার করণীয়। রাজবৃত্তের রাজন্যদের প্রতি রাজার করণীয়।
ব্যসনাধিকারিক (ব্যসন—কুঅভ্যাস, অনৈতিকতা, দুর্দশাগ্রস্ততা) নামক অষ্টম অধিকরণের আটটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—রাজা ও অমাত্যদের ব্যসনসমূহ। রাজা এবং রাজ্যের ব্যসনবিষয়ক চিন্তন। পুরুষের ব্যসনজাত দোষসমূহ উৎপীড়নসমূহ। স্তম্ভনবর্গ তথা বিঘ্নসূচক উক্তির মাধ্যমে রাজকার্যের উপরোধের কারণ নির্ণয়। কোষসঙ্গবর্গ তথা রাজকোষের প্রাপ্য অর্থের অপ্রাপ্যতা বিষয়ক। সৈন্যদের ব্যসন নির্ণয়। মিত্রবর্গের ব্যসনসমূহ।
অভিযাৎসকর্ম (অভিযান পরিচালনাকারীর বিবেচ্য বিষয়) নামক নবম অধিকরণের বারোটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—শক্তি, দেশ ও কালের সক্ষমতা সম্পর্কিত জ্ঞান। যুদ্ধভিযানের সময় নির্ধারণ। সৈন্য সমাবেশের আবশ্যকতা। সমর্থতার নিরিখে অভিযানের প্রস্তুতি। শত্রু সৈন্যদের পরাভূতকরণের উপযোগী নিজ বাহিনী গঠন। পশ্চাদে অবস্থানকারী শত্রুকর্তৃক আক্রান্তের বিষয়ে চিন্তন। অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিবর্গ কর্তৃক উদ্ভূত বিদ্রোহের প্রতিকার। যুদ্ধাভিযানের লাভ, ক্ষতি ও ব্যয়ের মূল্যায়ন। রাষ্ট্রমুখ্য, অন্তপাল ও অমাত্য পুরোহিত কর্তৃক উত্থিত বিপত্তির স্বরূপ নির্ণয় ও এর প্রতিবিধান। বিশ্বাসঘাতক ও রাজদ্রোহীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং তার প্রতিবিধান। সম্পদ ও শারীরিক বিপত্তি নিষ্পত্তির উপায় অবলম্বন। উদ্ভূত বিপত্তিসমূহ নিষ্পত্তি তথা নিবারণকল্পে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ।
সাংগ্রামিক (যুদ্ধ সম্পর্কিত) নামক দশম অধিকরণের তেরটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—স্কন্ধাবার তথা সেনাশিবির স্থাপন। স্কন্ধাবারপ্রয়াণ তথা সেনাশিবির প্রত্যাহার। বলব্যসন ও অবস্কন্দনকাল তথা অভিযানকালের দুর্ভোগ ও সৈন্যদের সুরক্ষণ। কূটযুদ্ধ তথা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক যুদ্ধ। নিজ সেনাবাহিনীকে উদ্দীপ্তকরণ। শত্রু সেনাদের তুলনায় অনুকূল অবস্থানে নিজ সৈন্যদের সমবেতকরণ। যুদ্ধভূমির গুণাগুণ বিচার। হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর সৈনিকদের করণীয়। পক্ষ, কক্ষ ও উরস্য অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন। শৌর্যবান, বিশ্বস্ত ও দুর্বল সৈন্যদের বিভাজন অনুযায়ী পদায়ন। পদাতিক, রথ, অশ্ব ও হস্তি বাহিনীর যুদ্ধ। সরলাকৃতি, সর্পাকৃতি ও বৃত্তাকৃতির বাহিনী বিন্যাস। পূর্বোক্ত ব্যূহসমূহের প্রতিব্যূহ রচনা
সঙ্ঘবৃত্ত (সম্মিলিত জোট) নামক একাদশ অধিকরণের দুটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—রাজার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার্থে জোটভুক্ত পক্ষসমূহে পারস্পরিক বিভাজন বা ভেদ সৃষ্টি এবং উপাংশুদণ্ড তথা গোপনে অন্তর্ঘাতমূলক হত্যাযজ্ঞ।
আবলীয়স (বলবান শত্রু নৃপতির বিরুদ্ধে রাজার করণীয়) নামক দ্বাদশ অধিকরণের নয়টি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—দূতদের মাধ্যমে কূটনৈতিক উদ্যোগ। মন্ত্রযুদ্ধ তথা প্রজ্ঞাবলে শত্রুকে পরাভূতকরণ। বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সেনাপতি নিধন। আত্মরক্ষার্থে রাষ্ট্রবৃত্তে উদ্দীপনা সৃষ্টি। অস্ত্র, অগ্নি ও বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ পরিচালনা। শত্রুর রসদ সরবরাহ পথে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং সম্পদ আহরণ নস্যাৎকরণ। কপট উপায়ে শত্রুপক্ষকে প্রবঞ্চিতকরণ। সৈন্যদের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে অবদমন। একবিজয় তথা উপরোক্ত উপায়ে বলবান শত্রুকে দুর্বল করত রাজার বিজয় অর্জন।
দুর্গলম্ভোপায় তথা শত্রুর দুর্গ (নগর) দখলের কৌশলনামক ত্রয়োদশ অধিকরণের ছয়টি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—উপজাত তথা শত্রুপক্ষের বিভেদ সাধন। বিভিন্ন ধরনের ছদ্মবেশে শত্রুর নগর হতে নিষ্ক্রমণ। অপসর্গ তথা বিভিন্ন ছদ্মবেশে গুপ্তচরদের শত্রু দেশে অবস্থান। পর্যুপাসনকর্ম তথা সৈন্যদের মাধ্যমে শত্রুর নগর বেষ্টন। অবমর্দ তথা শত্রুর নগর দখল। লব্ধপ্রশমন তথা দখলকৃত নগরে শান্তি স্থাপন।
ঔপনিষধিক (বিষ, ভেষজ, ঔষধি ও মন্ত্র প্রয়োগ) নামক চতুর্দশ অধিকরণের তিনটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—পরঘাত প্রয়োগ তথা শত্রু হত্যার জন্য ঔষধি উপাদান প্রয়োগ। প্রলম্ভন তথা ঔষধ ও মন্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুকে প্রবঞ্চিতকরণ। রাজার সৈন্যদের উপর শত্রুপক্ষ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ঔষধ, বিষ ও মন্ত্রের প্রভাব প্রতিকারকরণ।
তন্ত্রযুক্তি নামক পঞ্চদশ অধিকরণের একটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয়ের বক্তব্য হলো—একটিমাত্র অধ্যায়ে এই অধিকরণের আলোচনা সীমাবদ্ধ। এই গ্রন্থের প্রথম থেকে চতুর্দশ অধিকরণে সমাজ জীবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। শেষোক্ত অধিকরণে উদ্ধৃত হয়েছে অর্থশাস্ত্রের অর্থ নির্ণয়ের উপযোগী যুক্তিসমূহ।
.
এবং অর্থশাস্ত্র
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি আমাদের উপমহাদেশে জ্ঞানের অঙ্গনে ঐতিহ্যের অত্যুজ্জ্বল অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে কেমন ছিল উপমহাদেশের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনধারা, কেমন ছিল রাজ্য পরিচালনার আমলাতন্ত্র, কেমন ছিল বিচার ব্যবস্থা, কেমন ছিল মানুষের খাসিলত, কেমন ছিল রাজধর্ম, আজকের আধুনিক দিনের তুলনায় কতটা পিছিয়ে (!) ছিল সেই আদি সমাজ, আমরা-ই বা কতটুকু এগিয়েছি, ইত্যাকার বিষয়ে জানতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হয় অর্থশাস্ত্রের পাতায়। কৌটিল্য বা চাণক্য নামটিও সকলের কাছে সমধিক পরিচিত। কূটিলতার ক্ষেত্রে এ নামটি যুগপৎ সম্পৃক্ত। বিশেষত নেতিবাচক কলাকৌশলের ক্ষেত্রে উদ্ধৃতি হিসেবে অহরহ ব্যবহৃত হয় এই নাম। বিষ্ণুগুপ্ত নামেও কেউ কেউ তাঁকে অভিহিত করে থাকেন। তাঁর জন্ম সম্পর্কিত সর্বজন স্বীকৃত কোনো তথ্যউপাত্ত না থাকলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, মগধের কাছাকাছি চাণক নামক গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কারো’বা মতানুযায়ী, তিনি জন্মেছিলেন তক্ষশিলায়। বলা হয়ে থাকে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ৮৭ বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দে মৌর্যদের রাজধানী ‘মগধ’ এ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার নাম চাণক ঋষি এবং জন্মস্থানের নাম চণক ছিল বলে কেউ কেউ ধারণা পোষণ করে থাকেন, যে কারণে অনেকে তাঁকে চাণক্য নামেও সম্বোধন করেন। সে-সময় মগধ তথা পাটালিপুত্রের সাথে অন্যান্য নগরের মতো তক্ষশিলা নগরেরও প্রগাঢ় সম্পর্ক বা সামাজিক যোগাযোগ ছিল। মুখ্যত তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে রাজধানী মগধের সাথে এ নগরের সম্পৃক্ততা ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। সেকালে তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল বিশ্বমানের, স্বদেশ ছাড়াও নানা দেশের বিদ্যার্থীরা সেখানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য পদার্পন করত। কৌটিল্যও বিদ্যার্জনের নিমিত্ত সেখানে সুদীর্ঘ সময় অবস্থানের পর, শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
পরবর্তী পর্যায়ে যৌবনের প্রারম্ভে তিনি ক্ষৌরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নন্দবংশের রাজা মহাপদ্ম নন্দের রাজদরবারে চাকুরি গ্রহণ করে উচ্চতর অমাত্যের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজদরবারে তাঁর পক্ষে বেশিদিন অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। দাম্ভিক, অত্যাচারী এবং অত্যন্ত অজনপ্রিয় নন্দরাজের সঙ্গে অচিরেই তাঁর মতদ্বৈততা দেখা দেয় এবং রাজা কর্তৃক অপসৃত হয়ে অপমানজনকভাবে তাঁকে দরবার পরিত্যাগ করতে হয়। বলা হয়ে থাকে, রাজদরবার পরিত্যাগ প্রাক্কালে স্বীয় অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে ক্ষুব্ধচিত্তে তিনি দরবার ত্যাগ করেছিলেন। অতঃপর নন্দরাজের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে পরবর্তী সময় নয় সন্তানসহ রাজাকে সবংশে বিনাশ করে মগধে মৌর্য সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চিত্তের, প্রজ্ঞায় অসাধারণ, দুঃসাহসিক মানসিকতাসম্পন্ন এই চাণক্য, বিষ্ণুগুপ্ত বা কৌটিল্য স্বভাবগতভাবে ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, স্থপতি, সমরবিদ, কূটনীতিক, জ্যোতির্বিদ, বৈদিকশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, গণিতজ্ঞ, ধার্মিক এবং দক্ষ প্রশাসক।
তিনি যে কাল-পর্বের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, সে-সময় ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থা কেমন ছিল সেদিকে দৃকপাত করলে দেখা যায়, সে-সময় ভারতে সর্ব ভারতীয় সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব না থাকলেও রাজতন্ত্রের কাঠামোতে বিকশিত ছিল শাসন ব্যবস্থা। সামরিক শক্তিতে তারা গ্রিকদের তুলনায় কোনো অংশে কম ছিল না। রাজা পুরু আলেকজান্ডারকে প্রতিহত করবার জন্য চার হাজার অশ্বারোহী, তিনশত রথ, দুইশত হাতি এবং তিন হাজার পদাতিক সেনা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলেকজান্ডারের কূটকৌশলের কোপানলে পড়ে রাজা পুরুকে পরাভূত হতে হয়। বলা হয়ে থাকে, রাজা পুরুকে পরাজিত করার পর আলেকজান্ডার চেনাব নদীর তীর-বরাবর পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে সাইত্রিশটি নগর দখল করেছিল। ঐতিহাসিক আরিয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী এ সমস্ত দখলকৃত নগরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট নগরটিতেও সে- সময় বাস করত পাঁচ হাজার অধিবাসী। এসব বর্ণনার মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে সে-সময় উপমহাদেশে নগরকেন্দ্রিক সমৃদ্ধ জীবনব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই বিকশিত অবস্থায় ছিল।
মগধকেন্দ্রিক নন্দদের রাজ্যটিও সে-সময় সমর শক্তিতে ছিল অতীব সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক—Plutarch-এর ভাষ্য অনুযায়ী, সে-সময় নন্দদের অধীনে ছিল দুইলক্ষ পদাতিক সেনা, আশি হাজার অশ্বারোহী সেনা, আট হাজার রথ এবং ছয় হাজার হাতির সমন্বয়ে গঠিত এক বিশাল সামরিক বাহিনী। আলেকজান্ডার এই সমরশক্তি সম্পর্কে অবহিত হবার পর মগধের দিকে অগ্রসর হবার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেছিলেন। তদুপরি সমরশক্তিতে যথার্থভাবে বলীয়ান হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় রাজন্যবর্গ একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ও বিবাদে লিপ্ত থাকায় এবং কেন্দ্রীয় শক্তির অনুপস্থিতিজনিত দুর্বলতার কারণে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের পক্ষে ভারত বিজয় সম্ভব হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এ ক্ষেত্রে কৌটিল্য বরাবরই বৈদেশিক শাসকদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা বহির্দেশীয় রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সবসময় ছিল উজ্জীবিত। যে কারণে নন্দদের উৎখাতের পর তিনি মৌর্যদের মাধ্যমে দখলদার বিদেশি শক্তিকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করে. প্রকারান্তরে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির অবসান ঘটিয়েছিলেন। তাঁরই তৎপরতায় আলেকজান্ডারের নিয়োগকৃত গভর্ণর সেলুকাসকে মুলতানের মায়া ছেড়ে এদেশের পাট চুকিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর দিকনির্দেশনার আলোকে মৌর্য সাম্রাজ্য সমগ্র দাক্ষিণাত্যসহ সুদূর ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। (মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত একটি শিলালিপির মাধ্যমে এ কথার আভাস পাওয়া যায় যে, সে-সময় বাংলাদেশেরও বিস্তৃত অঞ্চল মৌর্যদের পদানত হয়েছিল)। বলা বাহুল্য, এই উপমহাশে কৌটিল্যই প্রথম রাজনৈতিক স্থপতি, যিনি রাজতন্ত্রকে একটি সংহত ও কাঠামোগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক অর্থে তিনিই ছিলেন উপমহাদেশীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবর্তক।
তিনি রাজ্য শাসনের প্রশ্নে রাজাকে প্রজা হিতার্থে দায়বদ্ধ করেছিলেন, প্রজাবৃন্দকে রাজার প্রতি অনুগত্য প্রদর্শনের দীক্ষায় দীক্ষিতকরণের রূপরেখা দিয়েছিলেন। একটি কল্যাণধর্মী সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলেন। রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর কিছু কিছু কূটবুদ্ধির কারণে পাশ্চাত্যের বিদগ্ধজনেরা তাঁকে প্রাচ্যের ম্যাকিয়াভেলি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। বস্তুতপক্ষে কৌটিল্যের প্রজ্ঞার পরিধি ম্যাকিয়াভেলির চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল এবং তিনি ছিলেন একটি সুসংহত কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপকার। এছাড়া ম্যাকিয়াভেলির সঙ্গে তার কালের দূরত্বও ছিল প্রায় হাজার বছর। ম্যাকিয়াভেলি জন্মেছিলেন ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে, অন্যদিকে কৌটিল্য জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দে। ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন অনেকটা আধুনিকতার প্রভাবে প্রভাবিত। তার পরও দুজনের চিন্তাভাবনা তথা রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন যেন এক সূত্রে গাঁথা। এই ক্ষুদ্ৰ পরিসরে দুজনের তুলনামূলক আলোচনার সুযোগ সীমিত, তদুপরি কৌটিল্যকে বোঝার জন্য ম্যাকিয়াভেলির কিছু যুক্তি, বক্তব্য বা উপদেশ এখানে উদ্ধৃত করে কৌটিল্যের সাথে তার সাযুজ্যর বিষয় বয়ান করছি। তৎকালীন আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে রাজার জন্য কি করণীয়, সে-বিষয়ে নিকোলা ম্যাকেয়াভেলি কর্তৃক ইতালির শাসক লরেঞ্জো দ্য মেডিলিকে পত্রাকারে যে সব উপদেশ প্রদান করা হয়েছিল, তা-ই পরবর্তী সময়ে ‘দ্য প্রিন্স’ শিরোনামের পুস্তক আকারে সর্বমহলে সমাদৃত ও সমালোচিত হয়। এক্ষেত্রে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটিও সংহত রাজ্য এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত রাজার করণীয় সম্পর্কে প্রণীত। এখানে কোন রাজাকে উদ্দেশ্য করে গ্রন্থটি রচিত না হলেও তা সকল রাজা তথা শাসকের জন্য প্রযোজ্য করে প্রণীত হয়েছে। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, ‘বংশানুক্রমিক শাসকরা যদি রাজ্যের জনগণকে তেমনভাবে ক্ষুব্ধ না করেন, তাহলে তারা জনগণের শ্রদ্ধার্জনে সমর্থ হয়ে থাকেন। রাজাদের চরিত্র যদি দোষণীয় না হয়, তাহলে সে শ্রদ্ধা সর্বদা অটুট থাকে।’ এ প্রসঙ্গে কৌটিল্যও সংহত রাজ্যের স্বার্থে রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। রাজাকে প্রজা হিতার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠাকল্পে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন। অধিকন্তু চারিত্রিক শুদ্ধতার ব্যাপারে সতর্ক করত রাজাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের গুণাবলিসম্পন্ন হয়ে কাম, ক্রোধ, লোভ, মান, মদ ও হর্ষ পরিহারের তাগিদ দিয়েছেন। ম্যাকিয়াভেলি যেমন, রাজদ্রোহী জনগণকে ভালবেসে গ্রহণ করে নেওয়া অথবা তাদের চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলেছেন। কৌটিল্যও তেমনি সাম বা দাননীতির আলোকে রাজদ্রোহীদের আপন করে নেওয়া অথবা দণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলেছেন। কৌটিল্যও ম্যাকিয়াভেলির মতো রাজাকে বিজিত রাজ্যের জনগণের সুখ দুঃখের অংশীদার হতে পরামর্শ প্রদান করেছেন। এছাড়াও তিনি বিজিত রাজ্যের ধর্মাচার, লোকাচার ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন। উভয়েই রাজাকে সব সময়ের জন্য জনগণের পাশে থাকার পরামর্শ প্রদান করেছেন।
অনুশাসনের ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, ‘বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়করা এমনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, যেন সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত আইনের আবশ্যকতা অনুভব করতে পারে, জনগণ যখন আইন মেনে চলার তাগিদ অনুভব করবে, তখনই তারা শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অবিচল থাকবে।’ একই কথা কৌটিল্য আরও বৃহত্তর অর্থে প্রকাশ করে বলেছেন, “যেখানে দণ্ড নেই, সেখানে রাজ্য নেই।’ ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন, দুষ্টের দমনের স্বার্থে রাষ্ট্রনায়ককে দুষ্টুনীতি বা কূটকৌশল অবলম্বন করতে হবে। রাজ্য রক্ষা করা যেহেতু তার অন্যতম করণীয়, সেহেতু এহেন ক্ষেত্রে দুষ্টুনীতি গ্রহণ করাটা অযৌক্তিক হবে না। কৌটিল্যও বিষয়টি সেভাবেই ভেবেছেন, কৌটিল্যের এ ধরনের ভাবনার তরিকাটা অনেক বেশি নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলেও দুষ্টের দমনের ক্ষেত্রে তিনি সকল ধরনের হীনপন্থা, এমন কি ছল চাতুরি ও প্রতারণার কৌশলও প্রসন্নচিত্তে অনুমোদন করেছেন। রাজা কর্তৃক জনগণের অর্থ আত্মসাতের প্রশ্নে ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, রাষ্ট্রনায়ক কখনো জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। কারণ, মানুষ পিতার মৃত্যুর কথা সহজে বিস্মৃত হলেও সম্পদ হারানোর শোক কখনো ভুলতে পারে না। কৌটিল্যও এ ব্যাপারে রাজাকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি দুষ্যদের সম্পদ অপহরণের জন্য রাজাকে অনুপ্রাণিত করলেও নিষ্কলুষ জনগণের সম্পদ সংরক্ষণার্থে কঠোর তাগিদ প্রদান করেছেন। এমনকি কর আদায়ের ক্ষেত্রেও প্রজারা যাতে উৎপীড়নের শিকার না হয়, রাজকর্মচারীদের দ্বারা কোনোভাবে অত্যাচারিত না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে বলেছেন।
ম্যাকিয়াভেলি রাজাকে সিংহের মতো শৌর্যবান এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হবার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে—জীব জগতের সিংহ ও শৃগাল খুব সহজেই বিপত্তি এড়াতে পারে। এক্ষেত্রে সিংহ তার শক্তি ও সাহসের কারণে সফল হয়ে থাকে এবং শৃগাল সফল হয়ে থাকে তার ধর্তবুদ্ধির মাধ্যমে। এ পর্যায়ে কৌটিল্যও রাজাকে যেমন শৌর্যবীর্যের গুণসম্পন্ন হতে হবে বলে অভিহিত করেছেন, তেমনি তার ধূর্ততা নয় বরং প্রজ্ঞার ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করেছেন। অধিকন্তু শুধু রাজা নয়, রাজ্য পরিচালনায় সম্পৃক্ত সকলের ব্যাপারেই কৌটিল্য প্রজ্ঞার প্রয়োজনীয়তার কথা জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন। এছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষে তিনি রাজাকে এমন সব ধূর্তপন্থা অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন যা শৃগালের জন্যও রীতিমতো ভীতিকর বা লজ্জাজনক। ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রনায়ককে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।… প্রয়োজনে তাকে তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য বা সুহৃদদের সঙ্গে পরামর্শ করার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কৌটিল্যও রাজাকে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক ষড়যন্ত্র হতে সতর্ক থাকার উপদেশ প্রদান করেছেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে তিনি বাহিরের শত্রু অপেক্ষা ঘরের শত্রু তথা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকে অধিক ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিতকরণের কথা বলেছেন। ম্যাকেয়াভেলি মনে করতেন, ‘রাজাকে সর্বতভাবে মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্রে তিনিই সবচাইতে অভিজাত এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।’ তিনি আরও মনে করতেন, ‘রাষ্ট্রনায়কের কোনো কাজই অযৌক্তিক বা নিন্দনীয় হতে পারে না।’ কিন্তু কৌটিল্য রাজাকে এভাবে ভাবতে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি মনে করতেন, ‘রাজার সুখ প্রকৃত সুখ নয়, প্রজাদের সুখের মাঝেই রাজার সুখ নিহিত।’ এছাড়াও যুদ্ধের ময়দানে তিনি রাজার শ্রেষ্ঠত্ব নাশ করে তাকে সাধারণ সৈনিকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তিনি রাজাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এক চাকা দিয়ে যেমন রথ চালনা সম্ভব নয়, তেমনি উপদেষ্টা বা পরামর্শক ব্যতীত রাজাও অচল। সর্বক্ষেত্রে রাজাকে তিনি বিস্তারিত পর্যালোচনাপূর্বক যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। ভুল সিদ্ধান্ত বা ভুল শাস্তি আরোপণের ক্ষেত্রে রাজার জন্যও আর্থিক শাস্তির বিধান প্রযোজ্য করেছেন। এক্ষেত্রে আইনের প্রশ্নে তিনি রাজাকেও আইনের উর্ধ্বে স্থান দেননি।
এই সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনায় এ কথা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে আধুনিক জমানার ঊষালগ্নে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে যেভাবে চিন্তা করেছেন, তা হাজার বছর আগেই প্রচ্যের কৌটিল্য কর্তৃক ভাবা হয়েছিল। বস্তুত আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাচারই আড়াই হাজার বছর আগে কৌটিল্য কর্তৃক চিহ্নিত হয়েছিল। কৌটিল্য কর্তৃক চারটি নীতির আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর প্রথমটি হলো সাম, দ্বিতীয়টি দান, তৃতীয়টি ভেদ এবং চতুর্থটি দণ্ড। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, শাসনকার্যের সুবিধার্থে কৌটিল্যের নির্দেশিত ভেদনীতি তথা Divide & Rule Policy স্থানীয় রাজন্যদের অনুসরণের তাগিদ দেওয়া হলেও উপমহাদেশের শাসকরা এর সারবত্তা কখনো সেভাবে উপলব্ধি করেনি বা করতে পারেনি। ফলে যুগে যুগে এই পলিসির কোপানলে পড়েই এই ভূখণ্ডের শাসকদের পরাভূত হয়ে বৈদেশিক শক্তির কাছে সমর্পিত হয়ে থাকতে হয়েছে। সমাপ্তি পর্বে ব্রিটিশরাও একই নীতির আলোকে দুশ বছর শাসন করে গেছে।
অর্থশাস্ত্রে বিধৃত শাসন কাঠামোর সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, কৌটিল্যের নির্দেশিত রাজ্য অনেকটাই রেজিমেন্টেড সমাজের মতো। তদুপরি সেখানে জনকল্যাণের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাজ্যের অনাথ, অসহায়, অক্ষম, শিশু, বিধবা ইত্যাকার নানা প্রকারের মানুষকে সরকার কর্তৃক প্রতিপালনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়াও সরকারি চাকুরিরত অবস্থায় বা যুদ্ধাবস্থায় কোনো রাজকর্মচারী অথবা সৈনিক মৃত্যুবরণ করলে উক্ত মৃতের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাজাকে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জনগণকে যাতে করে দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। প্রজাকে বিপদগ্রস্থ করে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ বরাবরই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে রাজকোষে অর্থের ঘাটতি দেখা দিলে, ব্যয় সঙ্কোচনের উপর গুরুত্বারোপ করে আর্থিক সংকট সামাল দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আধুনিক যুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মতো অর্থশাস্ত্রেও প্রশাসকদের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধিকল্পে এবং দায়িত্ব পালনের শিথিলতা নিরুৎসাহিতকরণের লক্ষ্যে দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদনে সক্ষম অধীক্ষক বা প্রশাসকদের স্বপদে বহাল, পদোন্নতি এবং অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত বা অনুপ্ৰাণিত করার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে কার্যক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব পালনে অসমর্থদের পদাবনতিসহ কর্মচ্যুত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহীতাসহ কিছু কিছু মারাত্মক অপরাধের ক্ষেত্রে বধদণ্ডও বলবৎ করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রশাসক ও অমাত্যদের দৈনন্দিন কার্যাবলি পর্যবেক্ষণের জন্য জালের মতো বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের কথা বলা হয়েছে। এসব নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রবণতা রোধকরণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির প্রশ্নে কৌটিল্যের যে পর্যবেক্ষণ তা এতটাই বাস্তবসম্মত যে আজকের দিনেও তা নাকচ করে দেওয়ার কোনো উপায় নেই।
আমলা, অমাত্যরা যতই দক্ষতা এবং বিশ্বস্তার পরিচয় দিক না কেনো, সম্পদ আত্মসাতের প্রশ্নে রাজা কখনো তাদের সন্দেহের বাহিরে রাখতেন না। এ বিষয়ে কৌটিল্য মনে করতেন, ‘কোনো ব্যক্তি যেমন নিজ জিহ্বার নিচে মধু বা বিষ রেখে তা আস্বাদন না করে পারেন না, তেমনি রাজার অর্থরক্ষায় নিযুক্ত রাজকর্মচারীরাও সে অর্থের কিয়দংশ আস্বাদন বা আত্মসাৎ না করে থাকতে পারেন না’। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও মনে করতেন, ‘জলে বসবাসকারী মৎস্যকুল যেমন কখন জল গ্রহণ করে তা কেউ দেখতে বা বুঝতে পারেন না, তেমনি আর্থিক বিষয়াদির সাথে সম্পৃক্ত রাজকর্মচারীরা কখন অর্থ আত্মসাৎ করে, তা রাজার পক্ষে কখনো জ্ঞাত হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না’। রাজকর্মচারীদের দুর্নীতির বিষয়ে অতঃপর কৌটিল্য আরও বলেন, ‘আকাশে বিচরণকারী বিহঙ্গদের গতিপ্রকৃতিও হয়তো মানুষের পক্ষে অবগত হওয়া সম্ভব কিন্তু রাজার অর্থবিষয়ক তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত আমলা অমাত্যদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে অবগত হওয়া কখনো সম্ভব নয়’।
কৌটিল্য এক্ষেত্রে ৪০টি উপায় বা পদ্ধতি চিহ্নিত করেছেন, যে সমস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে অমাত্য, আমলা বা রাজকর্মচারীরা রাজ্যের বা রাজার সম্পদ আত্মসাৎ করতে পারে। পরবর্তী সময়ে মহাকবি দণ্ডী তার রচিত ‘দশকুমারচরিত’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, চতুর রাজকর্মচারীরা বুদ্ধি ও কৌশলের মাধ্যমে এই ৪০টি উপায় ছাড়াও সহস্র উপায়ে জনসম্পদ আত্মসাৎ করতে সক্ষম।
অমাত্য, প্রশাসক বা রাজকর্মচারীদের সম্পদ আত্মসাতের প্রবণতা রোধকল্পে রাজা কর্তৃক বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে— রাজার নিযুক্ত গোয়েন্দারা প্রতিটি রাজকর্মচারীর পেছনে ছায়ার মতো লেগে থাকবে, তাদের আয় ব্যয়, জীবনযাপন প্রণালী অবলোকন করবে এবং কোনো বৈসদৃশ্য পরিদৃষ্ট হলে সাথে সাথে তা রাজাকে অবহিত করবে। প্রয়োজনে পতিতারাও বিভিন্ন তরিকায় রাজকর্মচারীদের অর্থ সম্পদের উৎস সন্ধানে নিয়োজিত থেকে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে। কোনো রাজকর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তদন্ত করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে—প্রয়োজনে জনপদে ঢোল পিটিয়ে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে জনগণের মতামত আহ্বান করতে হবে, তদন্তের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং আত্মসাৎকৃত অর্থের পুরোটাই দায়ী কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এ বিষয়ক সার্বিক অবস্থা দৃষ্টে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে কৌটিল্যের জমানায় প্রজাদের স্বার্থ সর্বাগ্রে সংরক্ষিত হত। রাজা বা রাষ্ট্রপক্ষ কখনো অমাত্য বা আমলাদের পক্ষাবলম্বন করে প্রজাদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করত না।
রাজকর্মচারীদের প্রতি এহেন কঠোরতা অবলম্বনের নীতি অনুসৃত হলেও, তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দের ব্যাপারেও রাজাকে সচেষ্ট থাকার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কৌটিল্য মনে করতেন, বাস্তবতার নিরিখে রাজকর্মচারীদের দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বেতন ভাতার সংস্থান রাখা উচিৎ। যাতে করে তারা প্রাপ্ত বেতনের মাধ্যমেই সুখকর জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়। এ কারণে অর্থশাস্ত্রে উচ্চপর্যায়ের অমাত্যদের জন্য বার্ষিক বেতন নির্ধারিত হয়েছে ৪৮০০০ পণ। সে-সময় একজন সাধারণ রাজকর্মীর বার্ষিক বেতন নির্ধারিত ছিল মাত্র ৬০ থেকে ৮০ পণ, সে তুলনায় একজন পদস্থ অমাত্য কতটা উচ্চতর ধাপে বেতন পেতেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
কার্যত কৌটিল্যের মধ্যে বহুমাত্রিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। তদুপরি বিদেশনীতি এবং রাজশত্রু নিপাতের ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশিত পথ অনেক নির্মমতা এবং অমানবিকতায় পরিপূর্ণ ছিল, এহেন পথ ছিল তৎকালীন উপমহাদেশে বিদ্যমান মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিরুদ্ধ শত্রু নিপাতের ক্ষেত্রে তিনি মর্মান্তিক হত্যাসহ নানাবিধ অন্তর্ঘাতমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে রাজাকে প্ররোচিত করেছিলেন এবং সেভাবেই তাঁর গ্রন্থে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করেছেন। তাঁর পলিসি ছিল End Justified The Means এর মতো, যা অনেক সময় ইতিবাচক বলে মেনে নেওয়া দুষ্কর। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত নেহেরুর মূল্যায়ন উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধশাস্ত্রে এবং প্রাচীনকালের পুরাণ-ইতিহাসে দেখি যে বিষাক্ত তীর এবং গুপ্ত অস্ত্রের ব্যবস্থা নিষিদ্ধ ছিল। নিদ্রিত পরাশক্তি কিংবা মরণাগত শত্রুর প্রাণনাশ করা নীতিগর্হিত কাজ বলে বিবেচিত হত, রম্য অট্টালিকাদি ধবংস করাও ছিল নিষিদ্ধ। পরে এই মনোবৃত্তির পরিবর্তন ঘটে, চাণক্যের সময় দেখি যে ছলে বলে কৌশলে শত্রু নিপাত করা যুদ্ধের অন্যতম রীতি বলে স্বীকৃত হয়েছে, শত্রুকে পরাজিত করার জন্য যদি প্রবঞ্চনার দরকার হয়, যদি তার রাজ্য ছারখার করতে হয়, তবে তাই করা উচিৎ, চাণক্যই প্ৰথম এরূপ কথা বলেন।’ আদতেও তাই, একটি কল্যাণমূলক রাজ্য বিনির্মাণের জন্য কৌটিল্য এতবেশি অকল্যাণকর কথা বলেছেন যা তাঁর সততা সম্পর্কে সন্ধিহান করে তোলে। একদিকে তিনি প্রজাদের উপর অতিরিক্ত করারোপ না করার জন্য রাজাকে নসিহত করেছেন, অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের ছল চাতুরি ও প্রতারণার মাধ্যমে রাজার শূন্য রাজকোষ পূর্ণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। একদিকে দুর্বল মিত্রকে সহায়তার জন্য উপদেশ দিয়েছেন, অন্যদিকে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য কঠোর আঘাত হানার নির্দেশনা দিয়েছেন। এত কিছু নেতিবাচক পরামর্শের পরও সাধারণ পশুর প্রতি আঘাত নিরোধ, সমাজের অসহায় দুর্বল মানুষকে রাষ্ট্র কর্তৃক ভরণপোষণসহ সমভাবে আইন প্রয়োগ, প্রজার উৎপীড়কদের অবদমন, জনসাধারণের সামাজিক দায় দায়িত্ব, এবং প্রজা হিতার্থে রাজার করণীয় সম্পর্কে যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সেসব কল্যাণের দিকগুলো বিবেচনা করলে তাঁকে একজন মহান পথপ্রদর্শক হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা অসঙ্গত নয়।
রাজা-প্রজা নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে তিনি আত্মশুদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। নিষ্কলুষ জীবনাচারের ব্যাপারেও আরোপ করেছেন প্রবল তাগিদ। এ কারণেই তিনি তাঁর নীতিশাস্ত্র গ্রন্থে বলেন—One should save his money against hard times, save his wife at the sacrifice of his riches, but invariably one should save his soul even at the sacrifice of his wife and riches. রাজ্য পরিচালনার নানাবিধ বিষয় নিয়ে তিনি যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তা অর্থশাস্ত্র নামে সমধিক পরিচিত। অর্থশাস্ত্র নাম হলেও এ গ্রন্থে শুধু আর্থিক বিষয়াদির উপর আলোকপাত করা হয়নি। একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা যা অত্যাবশ্যকীয়, তখনকার প্রেক্ষাপটে তার পুরোটাই তিনি এ গ্রন্থে সন্নিবেশ করেছেন। মানুষের মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে এবং ধর্মীয় নির্দেশনাসমূহ সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি যে অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন, আজকে আড়াই হাজার বছর পরেও তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নাতীত। বিশেষত অমাত্যদের যোগ্যতা, দক্ষতা এবং জবাবদিহিতার দিকনির্দেশনাসমূহ কোনোদিক দিয়েই ম্যাক্স ওয়েবার, জ্যাক রুশো কিংবা অন্যান্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।
প্রত্যক্ষণ ও অভিজ্ঞতালব্ধজ্ঞান, তৎকালীন চিন্তানায়ক ও তাদের প্রণীত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ, পণ্ডিত ভারদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পরাশর, পিশুণ, কৌণপদন্ত, বাতব্যাধির ভাবনা এবং মনু সংহিতা, বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রের আলোকে তাঁর সামগ্রিক চিন্তা জগৎ আবর্তিত হয়েছে, সে আলোকেই দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাসঙ্গিক দিকনির্দেশনা। তাঁর সামগ্রিক ভাবনা জগৎ ধর্মের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তিনি যুক্তিকেই ধর্মের উপরে স্থান দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন—কখনো যদি ধর্মশাস্ত্রের সাথে ন্যায়শাস্ত্রের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি উদ্ভূত হয় সেক্ষেত্রে ন্যায়শাস্ত্রই অগ্রাধিকার পাবে। গ্রন্থটি ত্রয়ী তথা সামবেদ, ঋগবেদ এবং যজুর্বেদ-এর উপর ভিত্তি করে লেখা হলেও, ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর অনেকটাই গুরুত্বারোপ করা হলেও এবং ধর্মীয় অনেক বিধিবিধান এক্ষেত্রে সন্নিবেশ করা হলেও যুক্তি এবং বাস্তবতাই শেষপর্যন্ত পুস্তকটির মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। জীবনাচারের বৈষয়িক সত্তাকেই করা হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণেই কৌটিল্য বলেন—কোনো কাজ শুরুর জন্য কোন নক্ষত্র অনুকূল, কেউ যদি বারংবার সে সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে, সেক্ষেত্রে সফলতা সেই মূর্খ ব্যক্তিকে অতিক্রম করে চলে যায়। সে ব্যক্তির আর অভীষ্ট অর্জিত হয় না। সকল পর্যায়ে ধন সম্পদই অভীষ্ট অর্জনের চালিকাশক্তি হিসেবে নক্ষত্ররূপে বিবেচিত হওয়া উচিৎ। কারণ, নক্ষত্রের গণনাদির মাধ্যমে কখনো অভীষ্ট অর্জিত হয় না। ধন সম্পদের বিনিয়োগের মাধ্যমেই সফলতা অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে নক্ষত্র বা তারকারাজীর মাধ্যমে কোনো সময় সফলতা লাভ করা যায় না। সম্পদহীন মানুষ শত চেষ্টাতেও সার্থকতা লাভ করতে পারে না। প্রশিক্ষিত হাতি দিয়ে যেমন হাতি সংগ্রহ করা যায়, তেমনি ধন-সম্পদ বিনিয়োগ করেই ধন-সম্পদ অর্জন করা যায়।
আর্থসামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে তাঁর প্রণীত নীতি-নির্দেশনাসমূহ আজকের আধুনিক সমাজেও অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে স্বীকৃত। সুদীর্ঘ চলার পথে তাঁকে বহুবিধ রাষ্ট্রাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছে, করতে হয়েছে কঠিন সংগ্রাম, নন্দদের উৎখাত করতে পারি দিতে হয়েছে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অনিশ্চিত পথ। এ্যরিস্টটল যেমন আলেকজান্ডারের শিক্ষাগুরু ছিলেন, তেমনি তিনিও ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের শিক্ষাগুরু, অধিকন্তু তিনি সরাসরি যুদ্ধ এবং রাজ্য পরিচালনায় সারাজীবনই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি পনেরোটি অধিকরণে বিভক্ত। প্রতিটি অধিকরণে স্বতন্ত্র অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে। বস্তুত তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি আজকের দিনের সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, বাণিজ্যিক, বৈদেশিক নীতিসহ সরকার ব্যবস্থার অন্যান্য বিভাগ উপবিভাগ পরিচালনার ম্যানুয়াল বললে ভুল বলা হবে না। এখানে পারিবারিক জীবনের জন্য যেমন আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে তেমনি দেওয়া আছে বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।
অসাধারণ প্রজ্ঞার কারণে সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তা সমাধানকল্পে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ ছিল অব্যর্থ। সমস্যার শেকড় উৎপাটনে তিনি ছিলেন অতীব দক্ষ। সর্বোপরি জ্ঞানার্জনের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল তাগিদ। মূর্খ, কুলাঙ্গার পুত্রের অনুকূলে সিংহাসনের ভারঅর্পণের প্রশ্নেও তাঁর অবস্থান ছিল অনড়। বিদ্যার্জনের ব্যাপারে তিনি সব সময়ের জন্য ছিলেন অত্যন্ত সচেতন, প্রজ্ঞার প্রশ্নে কোনো ধরনের ছাড় প্রদানের পক্ষপাতি ছিলেন না। বিদ্যার গুরুত্ব ব্যাখ্যাকালে তিনি বলেন—তীরন্দাজের নিক্ষিপ্ত তীর একজন ব্যক্তি বিশেষকে হত্যা করতেও পারে, নাও করতে পারে। কিন্তু একজন প্রাজ্ঞব্যক্তির শত্রুনাশক গৃহীত পদক্ষেপ নিশ্চিতভাবে মাতৃগর্ভস্থ ভ্রূণকেও হত্যা করতে পারে। তিনি দুটি গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং একই সাথে নীতিশাস্ত্র গ্রন্থটিও সমভাবে সমাদৃত। অর্থশাস্ত্র রাজ্যশাসন সম্পর্কিত নির্দেশনামূলক গ্রন্থ। নীতিশাস্ত্ৰ গ্রন্থটি রাজা, প্রজা, যাজক পুরোহিত এবং দৈনন্দিন জীবনাচারের সাথে সম্পৃক্ত নৈতিকতা বিষয়ক হিতপদেশমূলক। এই হিতপদেশে কখন, কার সাথে কি করা উচিত এবং অনুচিত, সুন্দর জীবনাচারের জন্য কি করণীয় এবং বর্জনীয় ইত্যাকার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা সত্ত্বেও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নিয়ে আজও এন্তার বিতর্ক চলছে। এই গ্রন্থ আদৌ কৌটিল্য কর্তৃক লিখিত কি না, সে প্রশ্নেও অনেকের অবস্থান অনড়। অনেকে মনে করেন, গ্রন্থটি কৌটিল্যের মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ের কোনো এক সময় তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে লিখিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই নামে আদৌ কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব মৌর্য জমানায় ছিল না। বিরুদ্ধপক্ষরা কিছু মৌলিক যুক্তি উত্থাপন করে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। যে কারণে এই গ্রন্থের ব্যাপারে কিছু কৌতূহল অনিসন্ধিৎসুদের মনে উঁকি দিয়ে থাকে। যেসব বিষয় এ ঘরানার চিন্তাবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে, তা হলো—অর্থশাস্ত্র চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন গ্রহণের পূর্বে না পরে লিখিত, সে বিষয়টি আজও কোনো প্রামাণিক সূত্রের মাধ্যমে সমর্থিত নয়। বলা হয়ে থাকে, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এবং আলেকজান্ডারের গভর্ণর সেলুকাসের মৈত্রীর বন্ধন শেষপর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। এই বিষয়ক বিস্তারিত বিবরণ জানা না গেলেও একথা জানা যায় যে এর ফলে চন্দ্রগুপ্তের দরবারে রোমান দূত মেগাস্থিনিসের আগমন ঘটেছিল এবং মেগাস্থিনিসের দাবি মোতাবেক তিনি চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবারে কয়েকবার পদার্পণ করেছিলেন, কিন্তু তার বর্ণনার কোথাও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কোনো উদ্ধৃতি নেই, নেই কৌটিল্য বা চাণক্য পণ্ডিতের কোনো উদ্ধৃতি। কারো’বা মতে, সম্রাট অশোকের পূর্বে ভারতবর্ষে লিখিত ভাষার অস্তিত্ব ছিল না, অথচ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন প্রসঙ্গে লিখিত পত্র, নিবন্ধন পুস্তক, অনুমতি পত্র জাতীয় বিবিধ লিখিত ভাষ্যের অবতারণা করা হয়েছে, এতে অনুমিত হয় যে এ গ্রন্থ চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে রচিত নয়। অন্য এক বিতর্কে বলা হয়েছে, চীন নামের দেশটির নামকরণ করা হয়েছে চীন রাজার শাসনামলে, যার উন্মেষ ঘটেছে খ্রিস্টপূর্ব ২২১–২০৭ অব্দে, অথচ এর পূর্বেই অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে দেশটিকে চীন বলে অভিহিত করা হয়েছে। নেপালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দেশ দুটি হতে যথাক্রমে রেশমি এবং পশমি বস্ত্র আমদানি হত বলে অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতেও প্রতীয়মান হয় যে, গ্রন্থটি যে সময়ের বলে দাবি করা হয়, আদৌ সে-সময়ের রচিত নয়। এছাড়া বলা হয়ে থাকে, অর্থশাস্ত্র কৌটিল্যের একান্ত ভাবনার উপর ভিত্তি করে লিখিত নয় এখানে সমসাময়িককালের বা পূর্বকালের অনেক আচার্যের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। মূলত আগে থেকে বিরাজিত চিন্তা চেতনা, আইন, বিধি, মূল্যবোধ, সামাজিক আচারের উপর ভিত্তি করেই পুস্তকটি রচিত হয়েছে। এটি মূলত একটি সংকলিত গ্রন্থ। কোনো ব্যক্তি বিশেষের ভাবনা প্রসূত গ্রন্থ নয়। অনেকের মতে, গ্রন্থটিতে ‘ইতি কৌটিল্য’ বা ‘নেতি কৌটিল্য’ জাতীয় বাক্য অন্তত আশিবার ব্যবহৃত হয়েছে, এতে ধারণা করা হয়, এটি তাঁর শিষ্যদের দ্বারাই পরবর্তী কোনো এক সময় রচিত হয়েছে। এ ছাড়াও কেউ কেউ মনে করেন, গ্রন্থটি কৌটিল্য কর্তৃক লিখিত হলে সে-সময়ের অনেক কিছু এতে প্রকাশ পেত, বিশেষ করে মৌর্য এবং মগধ সম্পর্কিত বিষয় উদ্ধৃত হত। কিন্তু এই গ্রন্থের কোথাও সে সম্পর্কিত কোনো বিষয় উত্থাপিত হয়নি, এতে করে প্রতীয়মান হয় যে পুস্তকটি চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে রচিত হয়নি। এসব বিবিধ যুক্তিতে অনেকে মনে করেন, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি মৌর্য শাসনামলের সূচনাতে রচিত হয়নি। এটি হয়তো পরবর্তী কোনো এক সময়ে কৌটিল্যের অনুসারী বা অনুসারীদের দ্বারা রচিত হয়েছে।
আধুনিক দুনিয়া কৌটিল্যের এ গ্রন্থ সম্পর্কে ব্যাপক পরিসরে অবহিত হয়েছে আর শামাশাস্ত্রীর মাধ্যমে, তিনি ১৯১৫ সালে Kautilya. Arthashastra. নামে গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে কৌটিল্যকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত করেছেন। ‘মহীশূর গভর্ণমেন্ট অরিয়েন্টাল লাইব্রেরিতে রক্ষিত তালপাতায় লিখিত অর্থশাস্ত্রের একটি সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি তথা পুঁথির ভিত্তিতে তিনি গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন। শামাশাস্ত্রী মনে করেন, পুঁথিটি খুব বেশিদিন আগের লিখিত নয়। তাঁর মতে, এটি সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীতে লিখিত হতে পারে। অধিকন্তু এতে কোনো লেখকের নাম নেই। এ ছাড়াও উত্তর গুজরাটের পাটনে জৈন ভাণ্ডারে তালপাতায় লিখিত অর্থশাস্ত্রের খণ্ডিত অংশ পাওয়া গেছে। এটি দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত। ত্রিবান্দ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি সংগ্রহশালায় মালায়লাম ভাষায় অর্থশাস্ত্রের একটি পরিপূর্ণ পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে, যার ভিত্তিতে টি গণপতি শাস্ত্রী অর্থশাস্ত্রের ত্রিবান্দ্রাম সংস্করণ প্রকাশ করেন। এই পাণ্ডুলিপিতেও লেখকের কোনো নাম নেই বা এর রচনার কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ লিপিবদ্ধ নেই। ধারণা করা হয়, এটিও সপ্তম শতকের কোনো এক সময় রচিত হয়েছে।
মাদ্রাজ অরিয়েন্টাল পুঁথি সংগ্রহশালায় দেবনাগরী অক্ষরে অর্থশাস্ত্রের একটি অক্ষত সংস্করণ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি ১৯০৫ সালে মালায়লাম পুঁথি থেকে দেবনাগরী অক্ষরে রপান্তরিত হয়েছিল। এসব দালিলিক উপাদান ছাড়াও বিভিন্ন সময় খণ্ডিত আকারে অর্থশাস্ত্রের অনেক টিকার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু কোথাও এ সংক্রান্ত সন তারিখের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যে কারণে এই গ্রন্থের উৎস সম্পর্কিত সংশয়ের কোনো সুরাহা হয়নি।
অন্যদিকে এ সংক্রান্ত প্রাপ্ত সকল পুঁথি অর্থশাস্ত্র নামেই পাওয়া গেছে। এছাড়াও বৌদ্ধ এবং জৈন রচনাবলিতে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে নন্দরাজার সেনাপতি ভদ্দশালার রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কায় রচিত বৌদ্ধ রচনাবলিতেও চন্দ্রগুপ্ত এবং তার প্রভাবশালী প্রধান অমাত্য কৌটিল্যের কথা উদ্ধৃত হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রাপ্ত পুঁথিটি অর্থশাস্ত্র নামেই উল্লেখিত হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণেও কৌটিল্যের সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি যে মগধরাজ মহাপদ্মনন্দকে নয়পুত্রসহ হত্যা করেছিলেন এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেসব কথাও সে গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে। যে মেগাস্থিনিসের কথা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে, সেই মেগাস্থিনিসের সম্পূর্ণ রচনা আজ অবধি পাওয়া যায়নি। তার পরিপূর্ণ রচনাবলির সন্ধান পাওয়া গেলে হয়তো এ বিষয়ক কোনো তথ্য পাওয়া যেত। এছাড়াও বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন উৎসে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এবং তার প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের কথা বিধৃত হয়েছে। এ সব কারণে এ বিষয়ক অনেক বিতর্ক সত্ত্বেও পণ্ডিতগণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের জমানাতে রচিত বলে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সেভাইে গ্রন্থটি সকলের কাছে একটি প্রাচীন গ্রন্থ হিসেবে আজ অবধি সমাদৃত হয়ে আসছে। এতসব ইতিবাচক নেতিবাচক আলোচনা পর্যালোচনার পরও এ গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে (কিছু কিছু ক্ষেত্র ব্যতিরেকে) সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন