তৃতীয় অধিকরণ। প্রকরণ ৫৭-৭৫।
অনন্তর ধর্মস্থীয় (বিচার বিভাগীয়) নামক তৃতীয় অধিকরণের উনিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—
১. সঙ্গত ও অসঙ্গত আচার আচরণের ব্যবস্থাপনা ২. বিচারিক বিষয়াদি ৩. বিভিন্ন ধরনের বিবাদ বিষয়ক নিষ্পত্তি ৪. দায়বিভাগ তথা পৈত্রিক সম্পত্তি ও তার দায় বিভাজন ৫. বাস্তক তথা গৃহ সম্পর্কিত বিষয় ৬. সময়ভিত্তিক চুক্তি বিষয়ক ৭. ঋণ প্রদান সম্পর্কিত ৮. গচ্ছিত দ্রব্যাদি বিষয়ক ৯. দাস ও শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত ১০. সমবায়ভিত্তিক কার্যারম্ভের বিষয় ১১. ক্রয় ও বিক্রয় সম্পর্কিত বিষয় ১২. দেয় দ্ৰব্য অপ্রদান বিষয়ক ১৩. অপরের দ্রব্য বিক্রয় সম্পর্কিত ১৪. হারানো দ্রব্যের মালিকানা নির্ণয় ১৫. সাহস তথা সহসাকৃত কর্ম ১৬. বাপারুষ্য তথা কটূবাক্যের মাধ্যমে আঘাত প্রদান ১৭. দণ্ডপারুষ্য তথা শারীরিকভাবে আঘাত প্রদান ১৮. দ্যূতকার্য তথা অক্ষক্রীড়া বা প্রাণীদের ক্রীড়ার মাধ্যমে বাজি ধরা বিষয়ক ১৯. প্রকীর্ণক তথা উপরোক্ত বিষয় বহির্ভূত আপত্তির নিষ্পত্তি
এই অধ্যায়ে বিচার বিভাগীয় কার্যপ্রণালী এবং বিচার সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয় বিচারের আওতাভুক্ত, বিচারালয়ের স্তরবিন্যাস, অপরাধের মানদণ্ডে আরোপিত জরিমানা বা শাস্তি, ইত্যাকার বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমকে এক্ষেত্রে বলা হয়েছে ধৰ্মস্থীয়।
০৩-০১-০১ যথাযথ গুণসম্পন্ন পরীক্ষিত অমাত্যগণ বিচারকের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনজন বিচারক এবং তিনজন অমাত্যের সমন্বয়ে গঠিত বিচারকমণ্ডলী দুই জনপদের সঙ্গমস্থলে তথা অন্তঃপাল দুর্গে, সংগ্ৰহণ তথা দশটি গ্রামের কেন্দ্রস্থলে, দ্রোণমুখে তথা চারশ গ্রামের কেন্দ্রস্থলে এবং স্থানীয়ে তথা আটশ গ্রামের কেন্দ্রস্থলে বিচারিক কার্য সম্পাদনের নিমিত্ত কার্যালয় স্থাপন করে অর্থদান, ঋণগ্রহণ, ইত্যাকার দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করবেন। বিচার কার্য পরিচালনার সময় বিচারকগণ বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করবেন এবং যেসব লেন-দেনের চুক্তি অস্পষ্ট, যে সব চুক্তি অন্যের অগোচরে গৃহের অভ্যন্তরে সম্পাদিত, যে সব লেন-দেনের চুক্তি রাতে সম্পাদিত, নির্জন অরণ্যে সম্পাদিত, ছলনার মাধ্যমে সম্পাদিত, সাক্ষ্যহীনভাবে গোপনে সম্পাদিত বলে প্রমাণিত হবে তা বাতিলযোগ্য বলে রায় প্রদান করবেন। সচেতনভাবে যারা এ ধরনের অবৈধ চুক্তি সম্পাদন করবে তাদের উপর যথাযথ শাস্তি তথা প্রথম ও মধ্যম সাহস দণ্ড প্রযুক্ত হবে। তবে অসচেতনভাবে কোনো সজ্জন ব্যক্তি এধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হলে তার উপর কোনো দণ্ড প্রযুক্ত হবে না, এক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতির দায় তার উপরই অর্পিত হবে।
০৩-০১-০২ নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচ্য সত্ত্বেও স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে যদি ঋণগ্রহণ করা হয় এবং তা যদি লোক সমাজে নিন্দনীয় হিসেবে প্রতিভাত না হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের চুক্তি বৈধ হিসেবে পরিগণিত হবে। গৃহের বাহিরে যে সব নারী গমন করে না বা যে সব পুরুষ রোগগ্রস্ততার কারণে বাহিরে বেরুতে অক্ষম, তারা গৃহাভ্যন্তরে লোক চক্ষুর আড়ালে চুক্তি সম্পাদন করলে সেক্ষেত্রে তা বৈধ বলে স্বীকৃত হবে। যেসব চুক্তি বলপূর্বক পরধন লুণ্ঠন সম্পর্কিত, পরের সম্পদ স্বগৃহে আনয়ন সম্পর্কিত, বিবাহ সম্পর্কিত, রাজাজ্ঞা প্রতিপালন সম্পর্কিত, রূপাজীবী ও মাতাল সম্পৃক্ত, তা রাত্রিকালে সম্পাদিত অবৈধ চুক্তির আওতাভুক্ত না হয়ে বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে। লোক চক্ষুর অন্তরালে অরণ্যাঞ্চলে সম্পাদিত চুক্তি অবৈধ হিসেবে পরিগণিত হলেও বণিক সংঘ, গোপালক, আশ্রমবাসী, গুপ্তচর এবং অরণ্যে বসবাসকারী অন্যান্যদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বৈধ চুক্তি হিসেবে স্বীকৃত হবে।
০৩-০১-০৩ অন্যান্য ক্ষেত্রে অবৈধ হিসেবে গণ্য হলেও গুপ্তচর বৃত্তির স্বার্থে সম্পাদিত প্রতারণা বা ছলানাপূর্ণ চুক্তি বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে। একইভাবে গান্ধর্ব বিবাহের চুক্তি সাক্ষীবিহীন অবস্থায় গোপনে সম্পাদিত হলেও তা বৈধতার স্বীকৃতি পাবে। এ সমস্ত ব্যতিক্রম ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে এ ধরনের সাক্ষীহীন, অসময়ে, গোপনে সম্পাদিত যে কোনো চুক্তি অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। যারা অন্যের আশ্রয়ে পালিত ও অক্ষম, তাদের দ্বারা সম্পাদিত কোনো চুক্তি বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে না। এক্ষেত্রে—১. পিতার বর্তমানে তার আশ্রিত পুত্রের দ্বারা সম্পাদিত কোনো চুক্তি বৈধ বলে স্বীকৃত হবে না ২. সমর্থ পুত্রের বর্তমানে অক্ষম পিতার দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ৩. কুলত্যাগী ভ্রাতার দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ৪. অবিভাজিত পরিবারের দায়হীন কনিষ্ঠপুত্রের দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ৫. সমর্থ পতি ও পুত্রের বর্তমানে স্ত্রীলোকের দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না ৬. প্রভুর অধীনস্থ দাস ও বন্ধকী ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে স্বীকৃত হবে না ৭. অপ্রাপ্ত বয়স্ক নাবালক এবং অতিবয়স্ক ব্যক্তির দ্বারা কৃত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ৮. সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দ্বারা কৃত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ৯. সন্ন্যাসী বা প্রবজিত ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ১০. মূক ও বধির ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হবে না ১১. নারীর সঙ্গদোষে দুষ্ট, জুয়াড়ি ও নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত চুক্তিও বৈধ বলে গণ্য হবে না। এসব ক্ষেত্রে রাজার অনুমতিক্রমে কেউ যদি চুক্তি সম্পাদন করে থাকে, তাহলে তা বৈধ বলে পরিগণিত হবে।
০৩-০১-০৪ এ ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে, দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে, নেশায় উন্মত্ত হয়ে, অপ্রকৃতিস্থ হয়ে, দণ্ডিত হয়ে কোনো চুক্তি সম্পাদন করা হলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে এবং এ ধরনের অবৈধ চুক্তিকারী ও সাক্ষীর উপর দণ্ড হিসেবে জরিমানা প্রযুক্ত হবে। নিজ দেশে বসবাসকারী একই জাতিভুক্ত, একই কর্মে নিয়োজিত, একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে পারস্পারিক সমোঝতার ভিত্তিতে শর্তযুক্ত চুক্তি সম্পাদিত হলে তা বৈধ বলে পরিগণিত হবে। পূর্বে কোনো চুক্তি সম্পাদনের পর পুনর্বার যদি একই বিষয়ে চুক্তি সম্পাদিত হয় সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে সম্পাদিত চুক্তিটিই কার্যকর বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে চুক্তিটি যদি দ্রব্য বিনিময় বা ক্রয় বিক্রয় সম্পর্কিত চুক্তি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে পূর্বে সম্পাদিত চুক্তিটিই বহাল থাকবে এবং বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
০৩-০১-০৫ বাদী কর্তৃক অভিযোগ দায়েরের পর বিচারক সংশ্লিষ্ট বাদী ও বিবাদীর দেশ, গ্রাম, জাতি, গোত্র, নাম ও পেশা সম্পর্কিত তথ্য নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করবেন। একই সাথে তিনি গৃহীত ঋণের পরিমাণ, ঋণগ্রহণের সময় তথা বছর, ঋতু, মাস, পক্ষ, দিবস, ইত্যাকার তথ্য লিপিবদ্ধ করবেন। অতঃপর বাদীর অভিযোগ ও বাদী-বিবাদীর প্রদত্ত তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন।
০৩-০১-০৬ বিচার কার্যের সময় কোনো অভিযোগকারীর যে সমস্ত বিচ্যুতি পরিদৃষ্ট হলে তার পরাজয় ঘটবে, তা হলো—১. যে বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করা হবে তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যদি অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয় ২. পূর্বে এক ধরনের বক্তব্য প্রদান করে পরবর্তী সময়ে যদি অন্য বক্তব্য প্রদান করা হয় ৩. প্রতিপক্ষের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে যদি নিজের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারে ৪. সাক্ষীর কথা বলা সত্ত্বেও যদি সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয় ৫. যদি মিথ্যে সাক্ষী বা সাক্ষী হিসেবে নিকটাত্মীয়কে হাজির করা হয় ৬. সাক্ষী হিসেবে একজনের নাম বলে যদি অন্যজনকে হাজির করা হয় ৭. উপস্থিত সাক্ষী যদি যথোপযুক্ত সাক্ষ্য প্রদান করতে ব্যর্থ হয় ৮. সাক্ষীর সাক্ষ্য যদি বাদীর দ্বারা অননোমোদিত হয় ৯. সাক্ষী যদি বিধি বহির্ভূত স্থানে গোপনে শলা-পরামর্শ করে। এ সমস্ত লক্ষণ পরিদৃষ্ট হলে বিচারক কর্তৃক বাদীর অভিযোগ আমলযোগ্য নয় বলে ঘোষিত হবে।
০৩-০১-০৭ এক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য উপস্থাপনের কারণে মামলায় পরাজয় বরণকারীর উপর প্রদেয় অর্থ ছাড়াও দণ্ড হিসেবে প্রদেয় অর্থের পাঁচ ভাগের একভাগ অতিরিক্ত জরিমানা প্রযুক্ত হবে। সাক্ষী উপস্থাপন ব্যতীত যে ব্যক্তি নিজেই নিজের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে পরাজিত হবেন, তাকে প্রদেয় অর্থের দশগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। বিপরীত বক্তব্য প্রদানের কারণে যিনি মামলায় পরাজিত হবেন তাকে আদালতের মামলা নির্বাহের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হবে।
০৩-০১-০৮ অভিযোগ নিষ্পত্তি না পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবে না। তবে এক্ষেত্রে বলপূর্বক অপহরণ বা বণিক সংঘের বিষয়ে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। এক ব্যক্তির উপর কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে অন্য কেউ একই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপন করতে পারবে না। যদি কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগকারীর অভিযোগের আলোকে যথাযথ প্রত্যুত্তর প্রদানে ব্যর্থ হন তবে তিনি দোষী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
০৩-০১-০৯ আনীত অভিযোগের আলোকে অভিযুক্ত ব্যক্তি একই দিনে স্বপক্ষ সমর্থনের জবাব প্রদানে ব্যর্থ হলে তাকে তিন থেকে সাত দিন সময় দেওয়া যেতে পারে। উক্ত সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি জবাব প্রদানে ব্যর্থ হলে তার উপর তিন থেকে বারো পণ জরিমানা আরোপিত হবে। অতঃপর ৪৫ দিনের মধ্যেও যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগের উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে বিচারক তার উপর পঞ্চবন্ধ বা দশবন্ধ (প্রদেয় জরিমানার অতিরিক্ত এক পঞ্চমাংশ ও এক দশমাংশ) দণ্ড আরোপ করবেন। এছাড়াও অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগকারীকে তার ভাণ্ডার হতে ধান সোনা গহনা লোহা, ইত্যাকার সম্পদ সমর্পণ করবেন। সাক্ষ্য প্রদানের পর যদি কোনো সাক্ষী দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সেক্ষেত্রে সাক্ষীর সাক্ষ্য অসার বলে গণ্য হবে। মামলায় পরাজিত ব্যক্তি জরিমানা বা ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যর্থ হলে, বিচারক তাকে দিয়ে যে কোনো ধরনের কায়িক শ্রমের কাজ করিয়ে নেয়ার আদেশ প্রদান করতে পারবেন, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি ব্রাহ্মণ হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে এধরনের আদেশ কার্যকর করা যাবে না।
০৩-০১-১০ বিচারকগণ রাজধর্ম চতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রমের লোকদের সামাজিক আচার প্রথা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। প্রতিটি বিবাদের সাথে ধর্মের বিধি বিধান, শাস্ত্রের বিধান, দেশজ লোকাচার এবং রাজ্য শাসনের অনুশাসন সম্পৃক্ত থাকে। এসবের মধ্যে রাজানুশাসনই চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে শিরোধার্য এক্ষেত্রে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত থাকে সত্যে, ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত থাকে সাক্ষীদের মধ্যে, চরিত্র প্রতিষ্ঠিত দেশাচারের উপর এবং শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে রাজাজ্ঞায়।
০৩-০১-১০ ধর্মের বিধানানুসারে যে রাজা প্রজাদের সুরক্ষায় আত্মনিয়োগ করে থাকেন, তিনি ইহধ্যাম ত্যাগের পর স্বর্গলোকে গমন করেন এবং যিনি প্রজা পীড়নে ন্যস্ত থাকেন তিনি নরকে গমন করেন। রাজা যদি তার পুত্র ও শত্রুর বিরুদ্ধে অপরাধের মাত্রানুযায়ী সম শাস্তি প্রয়োগ করেন, তাহলে তিনি ইহলোকে এবং পরলোকে সুরক্ষিত হবেন।
যে রাজা ন্যায়সঙ্গতভাবে ধর্মশাস্ত্রের বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক রাজ্য শাসন করেন তিনি সার্বভৌম অধীশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হন। অনুশাসনের ক্ষেত্রে ধর্মশাস্ত্রের সাথে অন্য শাস্ত্র বা বিদ্যমান বিধি-বিধানের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ধর্মশাস্ত্রই অনুসরণীয় বলে স্বীকৃত হবে। তবে কখনো যদি ধর্মশাস্ত্রের সাথে ন্যায় শাস্ত্রের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়, সেক্ষেত্রে ন্যায় শাস্ত্রই অগ্রাধিকার পাবে বিচার্য বিষয়ের ক্ষেত্রে দোষ প্রমাণের জন্য উপযুক্ত প্রমাণ, স্বীকারোক্তি, উত্থাপিত প্রশ্নের সরল উত্তর, আপত্তির যৌক্তিক ব্যাখ্যা এবং শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষী প্রদান করা হলে বিচার নিষ্পত্তি সহজতর হয়। বিচারের সময় বাদী বা বিবাদী পক্ষের কেউ যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, অসার সাক্ষীর মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রদান করান, কারাগার থেকে পলায়ন করেন, সেক্ষেত্রে তিনি বিচারক কর্তৃক অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
এই অধ্যায়ে বিবাহ সম্পর্কিত আচার-বিধি’র বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিবাহের প্রকারভেদ বৈধতা, অবৈধতা, স্ত্রীর সম্পত্তি, পুনর্বিবাহের ক্ষতিপূরণ ও স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেওয়ার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে এবং দেওয়া হয়েছে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।
০৩-০২-০১ সামাজিক জীবন তথা পারিবারিক জীবনের ভিত্তি হলো বিবাহ। মূলত বিয়ের পর থেকেই একজন ব্যক্তির সাংসারিক তথা গার্হস্থ জীবনের সূচনা হয়ে থাকে। বিবাহ আট প্রকার—১. যে বিয়েতে কন্যাকে অলঙ্কারে সজ্জিত করে পাত্রের হাতে সমর্পণ করা হয় সে বিয়েকে বলা হয় ব্রাহ্ম বিবাহ। এ বিয়েকে সর্বোৎকৃষ্ট বিয়ে হিসেবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে সন্তানহীনা অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে পতি তার মৃত স্ত্রীর সমুদয় সম্পদের অধিকারী হয়ে থাকে ২. বর ও কন্যার একত্রে ধর্মাচারণের প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার মাধ্যমে যে বিয়ে সম্পাদিত হয় তাকে বলা হয় প্রাজাপাত্য বিবাহ ৩. যে বিবাহে বরের কাছ থেকে গো যুগল গ্রহণের মাধ্যমে কন্যা সমর্পণ করা হয়, সে বিয়েকে বলা হয় আর্য বিবাহ। এ ধরনের বিয়েতে একটি গাভী, একটি বৃষ বা দুটি গাভী, দুটি বৃষ প্রদান করা হয়ে থাকে ৪. যে বিবাহে যজ্ঞবেদির মধ্যে ঋত্বিকের কাছে অলকৃতা কন্যা সমর্পিত হয়, সে বিয়েকে বলা হয় দৈব বিয়ে ৫. যে বিবাহ মাতা পিতা গুরুজনের অনুমতি ব্যতিরেকে বর কন্যার পারস্পরিক অনুরাগের আলোকে সম্পাদিত হয়, সে বিয়েকে বলা হয় গান্ধর্ব বিবাহ ৬. বর বা বরের অভিভাবকের কাছ থেকে শুল্কপণ হাসিলপূর্বক যে বিয়ে সম্পন্ন হয়, তাকে বলা হয় অসুর বিবাহ ৭. যে বিয়ে বর কর্তৃক বলপূর্বক সম্পাদিত হয় অর্থাৎ কন্যাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিয়ে করা হয়, সে বিয়েকে বলা হয় রাক্ষস বিবাহ। এছাড়াও যুদ্ধে অপহৃত কন্যাকে বিয়ে করাকেও রাক্ষস বিয়ে বলা হয় ৮. মাতাল অবস্থায় অথবা ছলনা বা প্রতারণার মাধ্যমে যে বিবাহ সম্পাদিত হয়, সে বিয়েকে বলা হয় পৈশাচ বিবাহ।
০৩-০২-০২ এধরনের বিবাহের প্রথম চার প্রকার বিবাহ অভিভাবকের অনুমতিক্রমে সম্পন্ন হয় বলে সেসব বিয়েকে ধর্মসম্মত বিবাহ বলা হয়। বিয়েতে পিতা মাতাকে অতিরিক্ত যে শুল্ক প্রদান করা হবে অথবা প্রীতি বশত নববধূকে অলঙ্কারাদিসহ যে সব উপহার প্রদান করা হবে, তা বধূর একান্ত সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে।
০৩-০২-০৩ বধূর প্রাপ্য স্ত্রীধন দু প্রকার হতে পারে—১. জীবনযাপনের উপযোগী ভূমি বা অর্থ ২. শরীর অলকৃত করবার ভূষণাদি। কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর প্রবাস গমনের কারণে সংকটে নিপতিত হয়ে পুত্র এবং পুত্রবধূর প্রতিপালনের জন্য স্ত্রীধন ভোগ করে তাহলে তা দোষণীয় হবে না। দস্যু বা তস্করের কোপানলে পড়ে জীবন বাঁচাবার জন্য কোনো স্বামী যদি স্ত্রীর অলঙ্কারাদি দস্যুদের কাছে সমর্পণ করে, চিকিৎসার জন্য স্ত্রীর সম্পদ ব্যয় করে, দুর্ভিক্ষের কারণে স্ত্রীর সম্পদ ব্যয় করে, সংকটে পড়ে স্ত্রীর ধন ব্যয় করে, ধর্মীয় কারণে স্ত্রীর ধন ব্যয় করে কিংবা ভীতি পরিহারের নিমিত্ত স্ত্রীর ধন ব্যয় করে, সেক্ষেত্রে পতির কোনো দোষ হবে না। দুটি সন্তান জন্ম দেওয়ার পর স্বামী স্ত্রী যদি যৌথভাবে তিন বছরকাল স্ত্রীর ধন ভোগ করে তাহলে কোনো পক্ষ কর্তৃক কোনো অনুযোগ উত্থাপন করা যাবে না। এ নিয়ম অবশ্য শুধু ধর্ম সম্মত বিবাহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। গান্ধর্ব ও অসুর বিবাহের ক্ষেত্রে এভাবে স্ত্রীধন ভোগ করা যাবে না, এর অন্যথা হলে সুদসহ ব্যয়িত স্ত্রীধন ফেরত প্রদান করতে হবে। রাক্ষস ও পৈশাচিক পদ্ধতিতে বিবাহিত স্বামীরা স্ত্রীর ধন ব্যয় করতে পারবে না, এর অন্যথা হলে তাদের চুরির অপরাধজনিত শাস্তি ভোগ করতে হবে।
০৩-০২-০৪ স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো নারী যদি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে বিধবার জীবনযাপনে আগ্রহী হয়, সেক্ষেত্রে তিনি স্বীয় ভূষণ এবং উপভোগের পর অবশিষ্ট যে সম্পদ থাকবে তার অধিকারী হবে। কিন্তু ঐ বিধবা স্ত্রী যদি দ্বিতীয় পতি গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে তিনি তার সমুদয় সম্পদ নিজ পিতার কাছে সুদ সমেত প্রত্যর্পন করবেন। পতির মৃত্যুর পর স্ত্রী যদি সন্তান লাভের বাসনায় শ্বশুরের অনুমতিক্রমে দ্বিতীয় পতি গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে তিনি স্ত্রী ধনের অধিকারী থাকবেন। কিন্তু কোনো বিধবা যদি শ্বশুরের অনুমতির তোয়াক্কা না করে পুনর্বিবাহ করেন সেক্ষেত্রে তিনি পূর্ববর্তী স্বামীর সম্পত্তি ভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন এবং পূর্বোক্ত স্বামীর আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সম্ভার ফিরিয়ে দিবেন।
০৩-০২-০৫ কোনো নারী যদি বহু সংখ্যক স্বামীর দ্বারা বহু সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে যে স্বামীর কাছ থেকে তিনি যে ধরনের স্ত্রীধন প্রাপ্ত হবেন তা তদীয় পুত্রের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে হবে।
০৩-০২-০৬ কোনো নারী যদি পুত্রহীন অবস্থায় মৃত স্বামীর প্রতি অনুরক্ত থেকে আজীবনের জন্য বৈধব্যকে বরণ করে নেন, সেক্ষেত্রে তিনি গুরুজনদের সাথে অবস্থান কালে আমৃত্যু স্ত্রীধন ভোগের অধিকারী হবেন। এ ধরনের বিধবার মৃত্যু হলে স্বামীর সপিণ্ডগণ তার সম্পদের অধিকারী হবে। স্বামীর জীবিতাবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে, পুত্ররা মাতৃ সম্পদের অধিকারী হবে, পুত্রের অনুপস্থিতিতে কন্যারা হবে মাতৃ সম্পদের অধিকারী, পুত্র কন্যা না থাকলে ঐ মৃত নারীর সম্পত্তির অধিকারী হবেন তার স্বামী। তবে অধার্মিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্বামীরা এ ধরনের স্ত্রীসম্পদের অধিকারী হবে না। এক্ষেত্রে মৃত স্ত্রীর সম্পদ বন্ধু বান্ধব ও অত্মীয় বর্গের মধ্যে বণ্টিত হবে।
০৩-০২-০৭ দ্বিতীয়বার স্ত্রী গ্রহণকালে প্রথম স্ত্রীকে প্রদেয় ধনের ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি একবার সন্তান জন্মদানের পর পুনর্বার আর গর্ভ ধারণ না করে, স্ত্রী যদি পুত্র সন্তানের জন্ম না দেয় এবং স্ত্রী যদি সন্তান জন্ম দানে অক্ষম তথা বন্ধ্যা হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের স্ত্রীর স্বামীগণ সন্তানের জন্য আট বছর অপেক্ষা করবে অতঃপরও স্ত্রী সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হলে স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারবে। এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বারংবার মৃত সন্তান প্রসব করতে থাকে তাহলে স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহের জন্য দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। স্ত্রী যদি শুধু কন্যা সন্তানই প্রসব করতে থাকে, সেক্ষেত্রে স্বামীকে পুত্র সন্তান লাভের নিমিত্ত দ্বিতীয় বিয়ের জন্য বারো বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ সমস্ত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেউ যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে সেক্ষেত্রে উক্ত স্বামী প্রথম স্ত্রীকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য থাকবে এবং রাজদণ্ড হিসেবে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করবে। এছাড়াও স্বামীগণ স্ত্রীধন প্রত্যর্পনসহ উপযুক্ত ভরণ পোষণ প্রদান সাপেক্ষে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম প্রথম স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে পুত্র সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষায় একাদিক্রমে বহু পত্নী গ্রহণ করতে পারবে। যে হেতু পুত্র সন্তানের জন্যই স্ত্রী গ্রহণ করা হয়, সেহেতু পুত্র সন্তান লাভের অভিপ্রায়ে সন্তানহীনা স্ত্রীকে উপেক্ষা করে অন্যস্ত্রী গ্রহণ নিন্দনীয় নয়।
০৩-০২-০৮ কোনো স্বামীর একাধিক স্ত্রী যদি একই সময়ে ঋতুবতী হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে ঐ স্বামী স্ত্রীদের উচ্চবর্ণের ক্রমানুযায়ী তাদের সঙ্গে সঙ্গত হবে অথবা বিবাহের ক্রমানুসারে সঙ্গত হবে কিংবা যে স্ত্রী পুত্র সন্তানের অধিকারী তার সঙ্গেই প্রথমে সঙ্গম করবে। কোনো স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় তার ঋতুকাল গোপন করে এবং স্ত্রীর ঋতুকাল সম্পর্কে অবহিত হয়েও কোনো স্বামী যদি সঙ্গম হতে নিজেকে বিরত রাখে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্বামী স্ত্রী রাজদণ্ড হিসেবে ৯৬ পণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। স্বামী কামপরায়ণ হলেও পুত্রবতী স্ত্রী, ধর্মপরায়ণ স্ত্রী, বন্ধ্যা স্ত্রী, মৃত সন্তান প্রসবকারী স্ত্রী এবং নীরজস্কা স্ত্রীদের সদিচ্ছা ব্যতিরেকে তাদের কাছে সঙ্গমের জন্য গমন করবে না। অন্যদিকে স্বামী যদি অক্ষম হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রকৃতির স্ত্রীরা সকামা হলেও স্বামী তাদের সঙ্গে সঙ্গমের জন্য উদ্যত হবে না। যে স্ত্রী কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত কিংবা উন্মাদ তার সঙ্গে সঙ্গম করা চলবে না। কিন্তু স্বামীরা কুষ্ঠরোগগ্রস্থ বা উন্মাদ হলেও স্ত্রীরা পুত্ৰ সন্তান লাভের প্রত্যাশায় তাদের সঙ্গে সঙ্গম করতে পারবে। স্বামী যদি নিচু-চরিত্রের হয়ে থাকে, যদি প্রবাসে অবস্থান করে থাকে, যদি রাজদ্রোহী হয়ে থাকে, যদি হত্যাকারী হয়ে থাকে, যদি জাতিচ্যুত বা ধর্মচ্যুত হয়ে থাকে, যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে স্ত্রীরা উক্তরূপ স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারবে।
এই অধ্যায়ে স্ত্রীর কর্তব্যপরায়ণতা, স্ত্রীর ভরণপোষণ, স্ত্রীদের প্রতি নির্দয়তা, স্বামী-স্ত্রীর দ্বেষ, স্ত্রীদের শাস্ত্রের বিধান লঙ্ঘন, অন্যদের প্রতি স্ত্রীদের সহমর্মিতা এবং নিষিদ্ধ ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করত এতদ্বিষয়ক অনুসরণীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-০৩-০১ বারো বছর বয়সসন্ধিকালে নারীরা প্রাপ্ত বয়স্কা হিসেবে পরিগণিত হবে এবং স্বামীগৃহের সেবাকর্মের জন্য দায়িত্বভার গ্রহণের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। পুরুষরা ষোল বছর বয়সে সাবালকত্ব অর্জন করবে। এই বয়সকালে নারীরা যদি বিবাহত্তোর সেবাকর্মে নিযুক্ত হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের উপর দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং পুরুষরা একইভাবে ব্যর্থ হলে তাদের উপর দ্বিগুণ হারে তথা ২৪ পণ জরিমানা অরোপিত হবে।
০৩-০৩-০২ স্ত্রী স্বামীর থেকে পৃথক হয়ে গেলে স্বামী অন্য নির্ভরশীলদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যেভাবে ব্যয়ভার নির্বাহ করবে, তেমনিভাবে পৃথকীকৃত স্ত্রীর প্রয়োজন অনুযায়ী ভরণপোষণের জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করবে। প্রয়োজনে উদারতা প্রদর্শনপূর্বক অধিকহারে ভরণপোষণের জন্য খরচা প্রদান করবে। এক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সমঝোতামূলক চুক্তি করতে পারে। বিচ্ছেদ প্রাক্কালে স্ত্রী যদি তার প্রাপ্য শুল্ক, স্ত্রীধন ও আধিবেদনিক (স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহজনিত কারণে প্রথম স্ত্রীকে প্রদেয় পারিতোষিক) গ্রহণ না করে থাকে, সেক্ষেত্রে স্বামী উক্ত স্ত্রীকে নিয়মিত খাওয়া পরার যোগান দিবে এবং এ বিষয়ে তার সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করবে। স্বামীর থেকে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত হয়ে কোনো স্ত্রী যদি স্বীয় দেবরকে বিবাহ করে শ্বশুরকুলেই অবস্থান করতে থাকে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রী পূর্বোক্ত স্বামীর কাছে ভরণপোষণের জন্য কোনোকিছু দাবি করতে পারবে না।
০৩-০৩-০৩ স্ত্রীদের অর্ধনগ্ন, উলঙ্গ, অঙ্গহীন, পিতৃহীন, মাতৃহীন, ইত্যাকার শব্দ প্রয়োগ করে সদাচার-বিষয়ক শিক্ষাপ্রদান করা যাবে না, এসব শব্দের পরিবর্তে অন্যান্য ভর্ৎসনাসূচক শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সদাচার শিক্ষাপ্রদান করতে হবে। উপরোক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করেও যদি স্ত্রীকে সদাচার তথা বিনয়মূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে বাঁশের লাঠি, দড়ি বা হাত দিয়ে স্ত্রীর পিঠে তিন বার আঘাত করা যাবে। এর অন্যথা করে স্বামী যদি স্ত্রীকে সদাচার শিক্ষা দেওয়ার জন্য অকথ্য শব্দ প্রয়োগ করে, তিন বারের অধিক আঘাত করে কিংবা পিঠের পরিবর্তে মাথায় মুখে বা অন্যান্য অঙ্গে আঘাত করে, তাহলে উক্ত স্বামীকে শাস্তি হিসেবে বক্ষ্যমাণ বাপারুষ্য ও দণ্ডপারুষ্যের অর্ধদণ্ড ভোগ করতে হবে। কোনো নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পতিব্রতা স্ত্রীর স্বামী যদি গণিকাতে আসক্ত হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রী তার স্বামীকে শাসন করার জন্য বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করতে পারবে। এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি সীমা অতিক্রম করে অর্থাৎ স্বামীকে অধিক প্রহার করে বা অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে, সেক্ষেত্রে তাকেও পূর্বোক্ত অপরাধী স্বামীর মতো দণ্ডভোগ করতে হবে।
০৩-০৩-০৪ কোনো স্ত্রী যদি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে সাত ঋতুকাল পর্যন্ত স্বামীকে সঙ্গ প্রদানে বিরত থাকে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রী বিবাহের সময় প্রাপ্ত স্ত্রীধন স্বামীকে ফেরত প্রদানে এবং অন্য নারীর সঙ্গে শয়নের অনুমতি প্রদানে বাধ্য থাকবে। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষপোষণ করার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো স্ত্রী যদি শুদ্ধ চরিত্রের ভিক্ষুণী, স্ত্রীধনরক্ষাকারী ব্যক্তি বা জ্ঞাতিকুলের আশ্রয়ে অবস্থান করে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্বামী নিজ কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়ে স্ত্রীর কাছে গমন করতে পারবে। অন্য নারীর সঙ্গে সঙ্গত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও যদি কোনো স্বামী তা অস্বীকার করে, অপর নারীর সঙ্গে সঙ্গত হওয়ার বিষয়টি যদি কোনো গুপ্তচর বা স্বজনের সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় এবং উক্ত স্বামী যদি মিথ্যাবাদী হিসেবে স্বীকৃত হয়, সেক্ষেত্রে তার উপর দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
০৩-০৩-০৫ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একজন অপরের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হলে তালাক নেওয়া যাবে না। স্ত্রী যদি পতিকে পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক না হয় সেক্ষেত্রে পতি স্ত্রীর প্রতি যতই বিদ্বেষপোষণ করুক না কেন বিচ্ছেদ গ্রহণ করতে পারবে না। একইভাবে পতি যদি স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক না হয় সেক্ষেত্রে স্ত্রী ইচ্ছে করলেও স্বামীকে পরিত্যাগ (তালাক) করতে পারবে না। উভয়ের সম্মতিক্রমেই শুধু বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত হবে। স্ত্রীর অপরাধের কারণে স্বামী যদি তালাক প্রদান করতে ইচ্ছুক হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে গৃহীত সকল প্রকার দ্রব্য প্রত্যর্পণসাপেক্ষে স্ত্রীকে তালাক প্রদান করতে পারবে। অন্যদিকে পুরুষের দোষজনিত কারণে স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক প্রদানে ইচ্ছুক হয়, সেক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত দ্রব্য ফেরত না দিয়েও উক্ত স্ত্রী তালাক প্রদান করতে পারবে। তবে ধর্মসম্মত বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ অনুমোদিত নয়।
০৩-০৩-০৬ স্বামী কর্তৃক বারণ করা সত্ত্বেও কোনো স্ত্রী যদি দেমাগবশত, অভিমানবশত বা ধৃষ্টতাবশত সুরাপান করে বা ক্রীড়ায় মত্ত হয়, তাহলে তার উপর তিন পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কোনো স্ত্রী যদি দিবালোকে নারীদের দ্বারা প্রদর্শিত নাটক-দর্শনের জন্য গমন করে বা ক্রীড়ার উদ্দেশ্যে উদ্যানে গমন করে, তাহলে তার উপর ছয় পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে কোনো স্ত্রী যদি পুরুষ প্রদর্শিত নাটক-দর্শনের জন্য গমন করে তাহলে তাকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। রাত্রিকালে এধরনের নিষিদ্ধ কাজে যুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট স্ত্রীকে দ্বিগুণ হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে। দিনের বেলায় স্বামী মত্ত অবস্থায় থাকাকালে কোনো স্ত্রী যদি তাকে সে অবস্থায় রেখে স্ব-গৃহ পরিত্যাগ করে বাহিরে বের হয় অথবা রাত্রিতে পতি প্রত্যাবর্তনের সময় স্ত্রী যদি গৃহের দ্বার উন্মোচন না করে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীর উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। অন্যদিকে স্ত্রী যদি রাত্রিকালে বাড়ির বাহিরে গমন করে বা পতিকে গৃহ হতে বিতাড়িত করে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীর উপর ২৪ পণ জরিমানা অরোপিত হবে।
০৩-০৩-০৭ কোনো নারী পুরুষ যদি অবৈধভাবে যৌনাচারের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে এবং তাদের এ সংক্রান্ত গর্হিত বাক্যালাপ যদি শ্রুত হয়, তাহলে উক্ত নারীকে ২৪ পণ এবং পুরুষটিকে ৪৮ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। তারা একে অপরের কেশ গ্রহণ করলে, দন্তক্ষত বা নখক্ষত করলে নারীর উপর ২৫০ পণ এবং পুরুষের উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। নির্জন স্থানে নারী পুরুষ অসংলগ্ন অবস্থায় অবস্থান করলে তাদের বেত্রাঘাত করা যেতে পারে। গ্রামের অভ্যন্তরে এহেন অবস্থা পরিদৃষ্ট হলে জনসমক্ষে উক্ত নারীর দেহের দু পাশে চণ্ডালকে দিয়ে পাঁচটি করে বেত্রাঘাত করা যেতে পারে, এক্ষেত্রে প্রতিটি আঘাতের জন্য এক পণ হারে জরিমানা প্রদান করা হলে উক্ত শাস্তি হতে অব্যাহতি দেওয়া যাবে।
০৩-০৩-০৮ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যদি কোনো নারী ও পুরুষ পরস্পর পরস্পরের উপকারার্থে চন্দনাদি, গন্ধদ্রব্য প্রদান করে তাহলে নারীর উপর ১২ পণ এবং পুরুষের উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে বস্ত্রাদি প্রদান করা হলে নারীর উপর ২৪ পণ, পুরুষের উপর ৪৮ পণ প্রযুক্ত হবে, স্বর্ণ বা নগদ অর্থপ্রদান করা হলে নারীর উপর ৫৪ পণ ও পুরুষের উপর তার দ্বিগুণ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ভ্রাতা-ভগ্নির মতো অগম্য নারী পুরুষের মধ্যে এরূপ লেনদেন পরিদৃষ্ট হলে অর্ধেক হারে জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে নারী পুরুষের জন্য যে দণ্ড বিহিত করা আছে সমকামী পুরুষদের জন্যও তা সমহারে প্রযোজ্য হবে। কোনো স্ত্রী কর্তৃক রাজার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হলে, দম্ভ প্রকাশ করা হলে, মদ্যপান বা উদ্যান ক্রীড়াদিতে নিমগ্ন হলে এবং স্বামীর কাছ থেকে পলায়ন করা হলে, সে স্ত্রীর পিতৃগৃহ হতে প্রাপ্ত উপহারে ও স্ত্রীধনে কোনো অধিকার, স্বত্ব থাকবে না।
এই অধ্যায়ে স্ত্রীদের স্বামীগৃহ ত্যাগ করে ভবঘুরে হয়ে যাওয়া, পর পুরুষের সঙ্গে চলে যাওয়া, সাময়িক সময়ের জন্য গৃহে অনুপস্থিত থাকা, ইত্যাকার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপযোগ্য শাস্তির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
০৩-০৪-০১ সাবালিকা স্ত্রী যদি কোনো কারণ ছাড়াই স্বামীগৃহ পরিত্যাগ করে, সেক্ষেত্রে তার উপর ছয় পণ জরিমানা অরোপিত হবে। কিন্তু কোনো স্ত্রী যদি স্বামী কর্তৃক অপমানিত বা নির্যাতিত হয়ে স্বামীগৃহ পরিত্যাগে উদ্যত হয় সেক্ষেত্রে উপরোক্ত শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। স্ত্রী যদি স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও গৃহত্যাগ করে, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা অরোপিত হবে। পতিগৃহ পরিত্যাগ করে স্ত্রী যদি কোনো প্রতিবেশীর গৃহে বসবাস করে, তাহলে তাকে ছয় পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।
গৃহত্যাগী স্ত্রীকে যদি কোনো প্রতিবেশী নিজের বাড়িতে আশ্রয় দান করে, কোনো সন্ন্যাসী যদি তাকে খাদ্য দান করে কিংবা কোনো বণিক যদি তাকে পণ্যদ্রব্য দিয়ে সহায়তা করে, সেক্ষেত্রে তাদের সকলের উপর ১২ পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে। বারণ করা সত্ত্বেও যদি তারা গৃহত্যাগী কোনো স্ত্রীকে উপরোক্তভাবে সহায়তা করে, সেক্ষেত্রে তাদের উপর আরও অধিকহারে জরিমানা তথা পূর্ব সাহাসদণ্ড বা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। বিবাহিত নারী যদি কাছাকাছি এলাকার গৃহ অতিক্রম করে দূরবর্তী স্থানের কোনো অপরিচিত ব্যক্তির গৃহে আশ্রয়গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে তাকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।
০৩-০৪-০২ কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অপরিচিত অন্যের স্ত্রীকে স্বগৃহে আশ্রয় প্রদান করা হলে তার উপর ১০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কিন্তু বিপদাপন্ন কোনো স্ত্রীলোককে এভাবে আশ্রয় প্রদান করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। নিষেধ করা সত্ত্বেও যদি কোনো অপরিচিত স্ত্রীলোক কারও গৃহে প্রবেশ করে, সেক্ষেত্রেও গৃহকর্তাকে অপরাধী হতে হবে না।
স্বামীর দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত বা ধিকৃত হয়ে কোনো সাধ্বী যদি স্বামীর কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে, গ্রাম প্রধান, স্ত্রীধনের রক্ষক, তপস্বিনী বা বান্ধবীদের পুরুষহীন গৃহে বসবাস করে, তাহলে সে স্ত্রীর এহেন কৃতকর্ম অপরাধ বলে গণ্য হবে না। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী আচার্যগণ এমনটাই মনে করতেন। কিন্তু কৌটিল্য মনে করেন—পতির দ্বারা অপমানিত বা নিগৃহীত হয়ে কোনো স্ত্রী পুরুষ সদস্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও নিজ বা স্বামীর আত্মীয়ের পরিবারে বসবাস করতে পারে। তিনি মনে করেন—কোনো সাধ্বী স্ত্রীর পক্ষে কখনো কারও সঙ্গে ব্যাভিচার করা সম্ভব নয়, এ ধরনের কিছু ঘটে থাকলেও তা সহসাই প্রকাশ হয়ে পড়ে।
০৩-০৪-০৩ মৃত্যু, ব্যাধি, বিপদ বা প্রসবজনিত কারণে যে কোনো স্ত্রীলোক নিজের বা স্বামীর আত্মীয়ের বাড়িতে গমন করতে পারবে। এক্ষেত্রে কোনো স্বামী যদি উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে স্ত্রীকে আত্মীয়ের বাড়িতে গমন করতে না দেয়, তাহলে উক্ত স্বামীর উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কারও স্ত্রী যদি ছলনার আশ্রয়গ্রহণ করে গোপনে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করে, সেক্ষেত্রে সে স্ত্রী স্বীয় স্ত্রীধন হতে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে আত্মীয়েরা যদি প্রতারণাপূর্বক কারও স্ত্রীকে নিজেদের গৃহে লুকিয়ে রাখে, সেক্ষেত্রে তারা জ্ঞাতিদের প্রাপ্য বিবাহশুল্ক হতে বঞ্চিত হবে।
০৩-০৪-০৪ স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ যদি গ্রামান্তরে গমন করে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে, অধিকন্তু উক্ত স্ত্রী সঞ্চিত ধন, আভরণ এবং বিবাহের সময় প্রাপ্ত স্ত্রীধনের অধিকার হতে বঞ্চিত হবে। এক্ষেত্রে কারও স্ত্রী যদি সঙ্গমে অনুমোদনযোগ্য কোনো পুরুষের সঙ্গে গ্রামান্তরে গমন করে, সেক্ষেত্রে সেই স্ত্রীকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং একই সাথে পতির সঙ্গে তার সকল ধরনের শাস্ত্রীয় সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটবে। তবে এক্ষেত্রে স্বামীর বিদেশে অবস্থানজনিত কারণে কোনো স্ত্রী যদি ভরণ-পোষণের প্রয়োজনে এবং ঋতুকালে সঙ্গমের তাগিদ হেতু অনুমোদিত ব্যক্তির সঙ্গে গ্রামান্তরে গমন করে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তি অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামান্তরে গমন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, এক্ষেত্রে উক্ত পুরুষ যদি স্ত্রীর সমপর্যায়ের বা উচ্চতর বর্ণের হয়ে থাকে তাহলে তাকে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে, পুরুষটি যদি স্ত্রীর চেয়ে হীনজাতির হয়, তাহলে তার উপর ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। অন্যদিকে পুরুষটি যদি স্ত্রীর আত্মীয় বা বন্ধু হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো দণ্ড প্রযোজ্য হবে না, তবে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত এহেন কর্ম করা হলে, অর্ধাংশ হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে।
০৩-০৪-০৫ চলতি পথে কোনো স্ত্রীলোক যদি যৌনাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থের নিমিত্ত পথচ্যুত হয়ে দূরবর্তী স্থানে বা গোপনস্থানে গমন করে, কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে অভিগমন করে বা স্বামী কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত ব্যক্তির সহচার্যে গমন করে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রী ও সহগামী পুরুষকে স্ত্রীসংগ্রহণোক্ত দণ্ডবিধি মোতাবেক দণ্ডভোগ করতে হবে। নায়ক, চারণ, গায়ক, ধীবর সম্প্রদায়, শিকারি, গো পালক, সুরা বিক্রেতা জাতীয় লোকেরা স্ত্রীসমেত পথে চললে তাদের সঙ্গে অন্যান্য স্ত্রীরা গমন করতে পারবে, তা দোষণীয় হবে না। এ সমস্ত লোকদের স্ত্রীদের নিয়ে কেউ যদি অন্যত্র গমন করে বা এদের স্ত্রীরা যদি স্বেচ্ছায় অন্য পুরুষের সঙ্গে গমন করে, সেক্ষেত্রে উভয়ের উপর অর্ধাংশ হারে দণ্ড প্রযুক্ত হবে।
০৩-০৪-০৬ সহসা প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি প্রদান সত্ত্বেও কেউ যদি বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক স্ত্রীর কাছে প্রত্যাবর্তন না করে, সেক্ষেত্রে শূদ্রের স্ত্রীরা এক বছর, বৈশ্যের স্ত্রীরা দুই বছর, ক্ষত্রিয়ের স্ত্রীরা তিন বছর এবং ব্রাহ্মণের স্ত্রীরা চার বছর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে। উক্ত স্ত্রীরা যদি সন্তানের মা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে উপরোক্ত সময়ের দ্বিগুণ সময় অপেক্ষা করবে। এক্ষেত্রে স্বামীরা যদি স্ত্রীদের যথাযথ ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে থাকে, তাহলে এই অপেক্ষাকাল সন্তানহীন ও সন্তানযুক্তাদের ক্ষেত্রে উপরোক্ত সময়ের দ্বিগুণ হবে।
পতি কর্তৃক যে সমস্ত স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে না, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব অর্পিত হবে সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিদের উপর। অথবা জ্ঞাতি গোষ্ঠীরা চার বা আট বছর পর্যন্ত উপরোক্ত স্ত্রীদের ভরণপোষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এর পরও যদি স্ত্রীর পতি প্রত্যাবর্তন না করে থাকে, তাহলে জ্ঞাতি গোষ্ঠীর লোকেরা সংশ্লিষ্ট স্ত্রীর কাছ থেকে বিবাহেপ্রাপ্ত স্ত্রীধন ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বিবাহের জন্য তাদের মুক্ত করে দিতে পারে।
০৩-০৪-০৭ বিদ্যার্জনের জন্য বিদেশে অবস্থানকারী ব্রাহ্মণের স্ত্রীরা সন্তানহীনা হলে দশ বছর এবং সন্তানযুক্তা হলে বারো বছর স্বামীর প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করবে। রাজকার্যে বিদেশে গমনকারী ব্যক্তির স্ত্রী স্বামীর প্রত্যাগমনের জন্য আমৃত্যু অপেক্ষা করবে। এক্ষেত্রে রাজকার্যে বিদেশে অবস্থানরত কোনো রাজপুরুষের স্ত্রী যদি সমজাতীয় কোনো পুরুষের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেয়, তাহলে তা নিন্দনীয় বা দণ্ডনীয় হবে না। এছাড়াও আত্মীয়দের ভরণপোষণের অসমর্থতাহেতু কোনো বিপন্না স্ত্রী বেঁচে থাকার প্রয়োজনে স্বীয় ইচ্ছানুসারে কোনো পুরুষকে পতি হিসেবে বরণ করতে পারবে।
০৩-০৪-০৮ শাস্ত্রসম্মতভাবে বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গত না হয়েই কোনো স্বামী যদি অক্ষতযোনির স্ত্রীকে রেখে অজ্ঞাতসারে বিদেশে গমন করে এবং সে স্ত্রী যদি স্বামীর অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রী সাত ঋতুকাল পর্যন্ত স্বামীর প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করবে, উক্ত স্ত্রী যদি স্বামীর অবস্থান সম্পর্কে পরিজ্ঞাত থাকে, সেক্ষেত্রে তার অপেক্ষাকাল হবে এক বছর। স্বামী যদি স্ত্রীকে অবহিত করে বিয়ের পর বিদেশে গমন করে থাকে, সেক্ষেত্রে উক্ত কুমারী স্ত্রী পাঁচ ঋতুকাল পর্যন্ত স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে, স্ত্রী যদি স্বামীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত থাকে, সেক্ষেত্রে অপেক্ষার সময় হবে দশ ঋতুকাল। বিবাহকালে স্বামী যদি প্রদেয় শুল্কের একাংশ পরিশোধ করে বিদেশে গমন করে, তাহলে স্ত্রী তিন ঋতুকাল পর্যন্ত পতির প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকবে, এরূপ পতির ব্যাপারে পরিজ্ঞাত থাকলে স্ত্রীকে সাত ঋতুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সম্পূর্ণ শুল্ক পরিশোধকারী বিদেশে অবস্থানরত পতির অবস্থান অজ্ঞাত হলে স্ত্রীর অপেক্ষার সময় হবে পাঁচ ঋতুকাল, পতির অবস্থান সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হলে এই অপেক্ষার সময় হবে দশ ঋতুকাল। এ সমস্ত অপেক্ষার কাল অতিক্রান্তের পরও পতি যদি প্রত্যাবর্তন না করে, তাহলে উক্ত প্রকৃতির স্ত্রীরা বিচারকের অনুমতি সাপেক্ষে ইচ্ছানুসারে পুনর্বিবাহ করতে পারবে। এক্ষেত্রে কৌটিল্য মনে করেন—প্রজননে সক্ষম স্ত্রীদের ঋতুকাল ব্যর্থ করে দেওয়া ধর্ম নাশের নামন্তর।
০৩-০৪-০৯ স্বামী দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রবাসী হলে, সন্ন্যাস গ্রহণ করলে বা মৃত্যুবরণ করলে নিঃসন্তান স্ত্রী সাত ঋতুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এবং সন্তানবতী হলে এক বছর অপেক্ষা করবে। অতঃপর উক্ত স্ত্রী পুত্র সন্তান লাভের নিমিত্ত স্বামীর সহোদরকে পতি হিসেবে বরণ করবে। মৃত স্বামীর একাধিক ভ্ৰাতা থাকলে স্বামীর পরবর্তী ভ্রাতাকে বা ভরণপোষণে সমর্থ ভ্রাতাকে বা সর্বকনিষ্ঠ অবিবাহিত ভ্রাতাকে পতিরূপে গ্রহণ করতে পারবে। মৃত পতির আপন সহোদরের অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট বিধবা স্ত্রী বৈমাত্রেয় ভ্রাতা, সপিণ্ড বা একই কুলের কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে। এই সব নিয়মনীতি অনুসরণ না করে কোনো স্ত্রী যদি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে সঙ্গত হয়, তাহলে উক্ত স্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট পুরুষ ব্যক্তিটি স্ত্রী সংগ্রহণ বিহিত দণ্ডের আলোকে শাস্তি ভোগ করবে।
এই অধ্যায়কে বলা হয়েছে দায় বিভাগ এবং দায়ক্রম। এ অধ্যায়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও বিভাজন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
০৩-০৫-০১ পরিবারভুক্ত পুত্ররা পিতা মাতার জীবিতাবস্থায় সম্পত্তির অংশের মালিকানার অধিকার পাবে না। পিতা মাতার মৃত্যুর পর পুত্ররা পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হবে। পুত্রদের মধ্যে কেউ যদি নিজ প্রচেষ্টায় সম্পত্তি অর্জন করে থাকে, সেই সম্পত্তিতে ভ্রাতাদের অধিকার স্বীকৃত হবে না। শুধু পিতার অর্থে অর্জিত সম্পত্তিই পুত্রদের মধ্যে বিভাজিত হবে। পিণ্ড চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত কার্যকর থাকে বিধায় পুত্র এবং পৌত্ররা চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত সম্পত্তি বিভাজন না করে তার অংশ লাভের অধিকারী থাকবে। অতঃপর জীবিত সদস্যরা সমানুপাতিক হারে সম্পত্তি বিভাজন করবে।
০৩-০৫-০২ কোনো পরিবারের সম্পত্তি যদি পূর্বেই বিভাজিত হয়ে থাকে এবং তারা যদি একান্নবর্তী পরিবারভুক্ত থাকে, সেক্ষেত্রে পৈত্রিক সম্পত্তি পুনর্বার বিভাজন করা যাবে। মৃত্যুর পর একান্নবর্তী পরিবারভুক্ত অপুত্রক ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকারী হবে সহোদর ভ্রাতারা। তবে উক্ত অপুত্রক ব্যক্তির কন্যারা বিবাহের ব্যয়নির্বাহের জন্য সম্পদের অংশবিশেষ লাভ করবে। পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের অধিকারই স্বীকৃত। পুত্রের অবর্তমানে শাস্ত্রসম্মত বিয়ের মাধ্যমে আবদ্ধ স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যারা হবে পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, পুত্র কন্যার অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির জীবিত পিতা হবে উত্তরাধিকারী, এক্ষেত্রে পিতাও যদি না থাকে তাহলে সহোদর ভ্রাতা এবং ভ্রাতুষ্পুত্রগণ সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।
০৩-০৫-০৩ একাধিক ভ্রাতা এবং পিতৃহীন ভ্রাতুষ্পুত্র থাকলে তারা সমভাবে পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ করে নিবে। কোনো ব্যক্তি আত্মীয়স্বজনদের ভরণপোষণের জন্য ঋণগ্রস্ত হয়ে যদি মৃত্যুবরণ করে এবং তার পিতা, ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্ররা যদি জীবিত থাকে, সেক্ষেত্রে ঋণদাতারা পূর্বজনের পরিবর্তে পরবর্তী জনকে ঋণ পরিশোধের জন্য দায়ী করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ঋণ শোধনের জন্য প্রথমে পিতা, পরে ভ্রাতা এবং তারপর ভাতুষ্পুত্ররা ঋণ পরিশোধের জন্য দায়বদ্ধ হবে। ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠজন জীবিত থাকাবস্থায় কনিষ্ঠজনকে দায়বদ্ধ করা যাবে না।
০৩-০৫-০৪ পিতার জীবিতাবস্থায় সম্পত্তি বিভাজন প্রাক্কালে সমভাবে তা বিভাজন করতে হবে। এক্ষেত্রে কাউকে অধিক বা কাউকে কম সম্পত্তি দেওয়া যাবে না। বিশেষ কারণ ছাড়া পিতা কোনো পুত্রকে সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। উত্তরাধিকারীরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে সম্পত্তি বিভাজন করা যাবে। সাবালকত্ব অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং প্রবাসী পুত্রের সম্পত্তি মাতৃসুহৃদ বা গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের হেফাজতে সংরক্ষণ করতে হবে।
০৩-০৫-০৫ ভাগ বাটোয়ারার সময় বিবাহিত পুত্রদের বিবাহ বাবদ ব্যয়িত অর্থের সমপরিমাণ অর্থ অবিবাহিত পুত্রদের জন্য আলাদা করে সংরক্ষণ করতে হবে। অবিবাহিতা কন্যাদের বিবাহের ব্যয় নির্বাহেরও সংস্থান রাখতে হবে। পিতার ঋণ এবং সম্পত্তি তার মৃত্যুর পর পুত্রদের মধ্যে সমভাবে বিভাজিত হবে। পূর্বের আচার্যদের মতানুযায়ী দরিদ্র পিতার সন্তানরা মৃৎপাত্রের জলাধারা সমভাবে বণ্টন করে নিবে। কৌটিল্য এক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে বলেন— এভাবে ভাবাটা ঠিক না। কারণ, সম্পত্তি থাকলে তা বিভাজনের প্রশ্ন ওঠে, সম্পত্তি না থাকলে তা বিভাজনের প্রশ্ন উত্থাপন করাটা অর্থহীন।
সম্পত্তি বিভাজনের সময় তা যদি সঠিকভাবে বণ্টন না করা হয়ে থাকে, বিভাজ্য সম্পত্তি যদি অপহৃত হয়ে থাকে, সম্পত্তি যদি অজ্ঞাত থাকে এবং পরবর্তী সময়ে তার সন্ধান পাওয়া যায়, এসব ক্ষেত্রে সম্পত্তি পুনর্বার বণ্টন করতে হবে। যে সম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকার পাওয়া যাবে না, সে সম্পত্তি রাজা কর্তৃক অধিকৃত হবে। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সৎকার বা তার স্ত্রীর জীবনযাপনের জন্য যে সম্পত্তি সংরক্ষিত থাকবে, সে সম্পত্তি রাজা অধিগ্রহণ করবেন না। এছাড়াও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষিত সম্পত্তিও রাজা অধিগ্রহণ করবেন না, এসব সম্পত্তি তিনি ত্রিবেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দিবেন।
০৩-০৫-০৬ জাতিচ্যুত পতিত ব্যক্তি, তার সন্তান এবং নপুংসক ব্যক্তিরা কোনো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। এছাড়াও মূর্খ, উন্মাদ, অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিরা যদি বিবাহিত হয়ে থাকে এবং তাদের সন্তানেরা যদি পিতার মতো রোগাক্রান্ত না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সেই সন্তানরা গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্ত সম্পত্তির অংশের উত্তরাধিকারী হতে পারবে। এই প্রকৃতির লোকেরা যদি স্ত্রী গ্রহণের পর প্রজনন রহিত হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে তারা বন্ধুদের মাধ্যমে স্বীয় পত্নীর গর্ভে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করাতে পারবে, এ ধরনের ক্ষেত্রজ পুত্রগণ বিষয় সম্পত্তির অংশ বিশেষ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হবে।
এই অধ্যায়ে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পুত্রদের মধ্যে কোন তরিকায় সম্পত্তি বণ্টিত হবে, সেইসব বিষয়সহ বিভিন্ন বর্ণের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের বিধিবিধানের ব্যাপারে আলোকপাত করত, এ সম্পর্কিত করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-০৬-০১ এক স্ত্রীর একাধিক পুত্র সন্তান বিদ্যমান হলে জ্যেষ্ঠ পুত্রের অংশপ্রাপ্তির ব্যাপারে যা অনুসরণ করতে হবে, তা হলো—ব্রাহ্মণের জ্যেষ্ঠ পুত্র যজ্ঞের উপযোগী ছাগলের অধিকারী হবে, ক্ষত্রিয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র যুদ্ধের উপযোগী অশ্বের অধিকারী হবে, বৈশ্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র বাণিজ্যের উপযোগী গরুর অধিকারী হবে এবং শূদ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃষিকাজের উপযোগী মেষ লাভ করবে। এই পশুগুলোর মধ্যে যেগুলো বিকলাঙ্গ সেগুলোর অধিকারী হবে মধ্যম পুত্র এবং বিচিত্রবর্ণের পশুগুলোর অধিকারী হবে ব্রাহ্মণের কনিষ্ঠ পুত্ররা। এ ধরনের চতুষ্পদ জন্তুর অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পুত্ররা মূল্যবান রত্নাদি ব্যতীত অন্যান্য সম্পত্তির সমভাগের এক দশমাংশ অধিক পাবে। যেহেতু জ্যেষ্ঠ পুত্রের মাধ্যমে পিতার সৎকারসহ অন্যান্য ধর্মীয় আচার সম্পন্ন হয়ে থাকে, সেহেতু তার আর্থিক সক্ষমতার প্রয়োজনে অধিক সম্পত্তি প্রদান করাটা যৌক্তিক বলে এ ধরনের ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।
০৩-০৬-০২ এছাড়াও মৃত পিতার সম্পত্তি বিভাজনের সময় জ্যেষ্ঠ পুত্ররা উত্তম প্রকৃতির শকট ও আভরণের অধিকারী হবে, মধ্যম পুত্ররা পিতার ব্যবহৃত শয্যা, আসন ও ভোজনে ব্যবহার্য পাত্রের অধিকারী হবে, কনিষ্ঠ পুত্ররা ধান, লোহা, গৃহের ব্যবহার্য দ্রব্য এবং গরুর গাড়ির অধিকারী হবে। এসব সম্পত্তি ছাড়াও পিতার অন্যান্য দ্রব্য সমভাবে পুত্রদের মধ্যে বিভাজিত হবে। কন্যারা মৃত পিতার সম্পত্তির ভাগীদার হবে না, কিন্তু তারা মাতৃ ব্যবহার্য থালা-বাটি ও আভরণের অধিকারী হবে।
০৩-০৬-০৩ প্রজননে অক্ষম জ্যেষ্ঠ পুত্ররা প্রকৃত প্রাপ্যতার তিন ভাগের এক ভাগ পৈত্রিক সম্পত্তি লাভ করবে। এছাড়াও জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি নিন্দনীয় পেশার মাধ্যমে জীবিকার্জনে নিযুক্ত থাকে এবং ধর্মকর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সে প্রকৃত প্রাপ্যতার মাত্র এক চতুর্থাংশ সম্পত্তির অধিকারী হবে এবং সে যদি স্বেচ্ছাচারী হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো ধরনের পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হবে না। উপরোক্ত পদ্ধতিতে এক স্ত্রীর গর্ভজাত একাধিক সন্তানের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পত্তি বিভাজিত হবে।
একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রদের মধ্যে যে পুত্র প্রথম জন্মগ্রহণ করবে সে পুত্রই জ্যেষ্ঠ হিসেবে গণ্য হবে। তবে বিবাহের ক্ষেত্রে আট প্রকার বিয়ের প্রথম চার ধরনের বিয়ের মাধ্যমে গৃহীত স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান শেষোক্ত চার ধরনের বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র অপেক্ষা জ্যেষ্ঠতর বলে গণ্য হবে। একইভাবে অক্ষত যোনির গর্ভজাত পুত্ররা ক্ষতযোনিসম্পন্ন স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র অপেক্ষা জ্যেষ্ঠ বলে স্বীকৃত হবে। যমজ পুত্রের ক্ষেত্রে প্রথমে যে জন্মগ্রহণ করবে সে পুত্ৰই জ্যেষ্ঠ বলে স্বীকৃত হবে।
০৩-০৬-০৪ ক্ষত্রিয়ের ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত পুত্র তথা সূত, বৈশ্যের ঔরসে ক্ষত্রিয় নারীর গর্ভজাত পুত্র তথা মাগধ, ব্রাহ্মণের ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত সন্তান তথা ব্রাত্য এবং রথ নির্মাতাদের ঔরসজাত বিভিন্ন নারীতে প্রসূত পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষতাসম্পন্ন পুত্রটিই পিতার সমুদয় সমম্পত্তির অধিকারী হবে এবং অন্যান্য পুত্ররা ঐ ঐশ্বর্যবান ভ্রাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করবে। এক্ষেত্রে কোনো পুত্রই যদি দক্ষতাসম্পন্ন না হয়, তাহলে সকল পুত্র পৈত্রিক সম্পদের সমঅংশীদার বলে বিবেচিত হবে। কোনো ব্রাহ্মণের যদি চার বর্ণের চারটি স্ত্রী থাকে, সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পুত্র তার অংশ প্রাপ্তির পর অবশিষ্ট সম্পত্তি সমান দশ ভাগে বিভাজন করে ব্রাহ্মণীর পুত্রকে চার অংশ, ক্ষত্রিয়ার পুত্রকে তিন অংশ, বৈশ্যার পুত্রকে দুই অংশ এবং শূদ্রার পুত্রকে এক অংশ প্ৰদান করতে হবে অর্থাৎ এভাবে তারা পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হবে। একইভাবে ক্ষত্রিয়ের তিন স্ত্রী এবং বৈশ্যের দুই স্ত্রীর পুত্ররা বর্ণক্রম অনুসারে তিন, দুই ও এক অংশ এবং দুই ও এক অংশ হারে পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হবে।
০৩-০৬-০৫ ব্রাহ্মণের ঔরসজাত ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্র জ্যেষ্ঠ পুত্রের অংশ বাদে ব্রাহ্মণীপুত্রের সমপরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হবে। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে গর্ভজাত পুত্ররা তাদের সবর্ণা স্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্রদের প্রাপ্যতার অর্ধেক সম্পত্তির অধিকারী হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে পুত্ররা যদি পৌরষগুণসম্পন্ন হয়, তাহলে তারা সবর্ণজাত পুত্রদের সমপরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হবে। কোনো পুরুষের সবর্ণা ও অসবর্ণা স্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে একজনের পুত্র সন্তান থাকলে সে পুত্র সমুদয় পিতৃধনের অধিকারী হবে এবং সে পিতার আত্মীয়দের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
ব্রাহ্মণের পারশর পুত্র তথা শূদ্র নারীর গর্ভে উৎপন্ন ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসজাত সন্তান একমাত্র সন্তান হলেও সে সমুদয় পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী না হয়ে এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তির অধিকারী হবে। পৈত্রিক সম্পত্তির অবশিষ্ট দুই অংশ লাভ করবে সপিণ্ড উত্তরাধিকারীগণ, এ ধরনের উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে উক্ত সম্পত্তির অধিকারী হবে পিতৃকুলের পুত্ররা। শেষোক্ত দু ধরনের উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে উক্ত পিতৃ সম্পত্তির অধিকারী হবে পিতার আচার্য বা ছাত্রগণ। উপরোক্ত প্রকার উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে সন্তান জন্মদানে অক্ষম ব্রাহ্মণরা মাতৃপক্ষের আত্মীয় বা সগোত্রীয় পুরুষ নিয়োগের মাধ্যমে স্বীয় স্ত্রীর গর্ভে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করাবে এবং উক্ত ক্ষেত্রজ সন্তানকেই পিতার সমুদয় সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করবে।
দায় বিভাগের এই অধ্যায়ে বর্ণ কুলানুযায়ী সম্পত্তির বিভাজনের উপর আলোকপাত করত, করণীয় সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-০৭-০১ পূর্বের আচার্যগণের অভিমত এই যে ক্ষেত্রজ পুত্ররা অন্যের ঔরসজাত সন্তান হলেও তারা জন্মদাতার পুত্র বলে স্বীকৃত হবে না, তারা যথার্থভাবেই উক্ত নারীর স্বামীর পুত্র বলে স্বীকৃত হবে। এক্ষেত্রে অন্য আচার্যদের অভিমত এই যে মাতা শুধু চামড়ার আধারের মতো গর্ভধারক মাত্র যা তাৎপর্যপূর্ণ নয়, যে কারণে যার বীর্য সঞ্চারণে গর্ভে সন্তানের উৎপত্তি হয় তিনিই উক্ত সন্তানের পিতা, এক্ষেত্রে ঐ নারীর স্বামী ক্ষেত্রজ পুত্রের পিতা হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে কৌটিল্য মনে করেন—এ ধরনের পুত্রের পিতা দুজনেই, কারণ সন্তান উৎপাদনের জন্য যেমন বীর্যের আবশ্যকতা আছে তেমনি ক্ষেত্রের আবশ্যকতাও অনস্বীকার্য
পতি কর্তৃক স্ত্রীর গর্ভে উৎপন্ন পুত্রকে বলা হয় ঔরসজাত পুত্র। কন্যাদান প্রাক্কালে কোনো কন্যার গর্ভজাত সন্তানকে নিজ পুত্র বলে দাবি করা হলে, সে পুত্রকে বলা হয় পুত্রিকাপুত্র। নিজ স্ত্রীর গর্ভে অন্যের বীর্য সেচনের মাধ্যমে পুত্র উৎপাদন করিয়ে নিলে, সে পুত্রকে বলা হয় ক্ষেত্রজ পুত্র। কোনো ব্যক্তির ঔরসজাত পুত্র না থাকলে এই ক্ষেত্রজ পুত্রই পিণ্ডদানকারী এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো স্ত্রী কর্তৃক বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়িতে সঙ্গোপনে পর পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমের মাধ্যমে গর্ভবতী হয়ে পুত্র সন্তান প্রসব করা হলে, সে পুত্র গূঢ়জ পুত্র হিসেবে খ্যাত হবে এবং সে পুত্র ক্ষেত্রজ পুত্রতুল্য হবে। পিতা-মাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত পুত্র কারো দ্বারা উপনয়নের মাধ্যমে সংস্কৃত হলে, সে পুত্র অপবিদ্ধ পুত্র হিসেবে খ্যাত হবে। কুমারী মাতার গর্ভজাত সন্তানকে বলা হয় কানীন। প্রাক গর্ভবতী নারীর বিবাহের পর প্রসবিত পুত্রকে বলা হয় সহোঢ়। পুনর্বিবাহিতা নারীর প্রসবিত পুত্রকে বলা হয় পৌনর্ভব।
০৩-০৭-০২ পিতার ঔরসজাত পুত্র পৈত্রিক সম্পত্তি এবং পিতার উত্তরাধিকারহীন আত্মীয়দের সম্পত্তির অধিকারী হবে। কিন্তু অন্যজাত পরজাত পুত্রদের সে অধিকার নেই। মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে যে পুত্রকে অন্যের কাছে হস্তান্তর করা হয় তাকে দত্তক পুত্র বলা হয়, এ ধরনের দত্তক পুত্র ঔরসজাত পুত্রতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। স্বপ্রণোদিত হয়ে যে পুত্র অন্য পিতা-মাতার সমীপে সমর্পিত হয়ে থাকে, তাকে উপগত পুত্র বলা হয়। পিতা কর্তৃক বন্ধুদের সমীপে সমর্পিত পুত্রকেও উপগত পুত্র বলা হয়ে থাকে। আবার কোনো পিতা- মাতা যখন অন্যের কোনো পুত্রকে নিজেদের পুত্র হিসেবে বরণ করে নেয়, তখন সে পুত্রকে বলা হয় কৃতক পুত্র। বিনিময় মূল্যে কোনো পুত্রকে ক্রয় করা হলে, সে পুত্রকে বলা হয় ক্রীত পুত্ৰ।
০৩-০৭-০৩ উপরোক্ত পুত্রের উপস্থিতিতে যদি ঔরসজাত পুত্রের জন্ম হয় সেক্ষেত্রে সে পুত্র পৈত্রিক সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশের অধিকারী হবে এবং অন্য পুত্ররা এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তির অধিকারী হবে। এ অবস্থায় পিতার অসবর্ণা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্ররা শুধু ভোজন ও বসনের অধিকারী হবে। ব্রাহ্মণ পুরুষের ক্ষত্রিয়া স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র এবং ক্ষত্রিয় পুরুষের বৈশ্যা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র সবর্ণপুত্র বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ব্রাহ্মণ পুরুষের বৈশ্যা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান এবং ক্ষত্রিয় পুরুষের শূদ্র স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র অসবর্ণ পুত্র বলে বিবেচিত হবে। ব্রাহ্মণ স্বামীর বৈশ্যা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানকে বলা হয় অন্বষ্ঠ এবং শূদ্র স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্ৰকে বলা হয় নিষাদ বা পারশব। ক্ষত্রিয় পতির শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানকে বলা হয় উগ্র। বৈশ্য পতির শূদ্র স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রকে বলা হয় শূদ্র। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের সমবর্ণের স্ত্রীদের গর্ভজাত পুত্ররা উপনয়নাদি সংস্কার ব্যতিরেকে বিবাহ করলে তারা ব্রাত্য নামে পরিচিত হয় (এ পর্যন্ত উচ্চবর্ণের স্বামীদের ঔরসে নিম্নবর্ণের নারীদের গর্ভে পুত্র উৎপাদনের বিষয়ে আলোচিত হলো)।
০৩-০৭-০৪ এ পর্যায়ে প্রতিলোম বিবাহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। শূদ্র পতির বৈশ্যা পত্নীর গর্ভজাত পুত্রকে বলা হয় আয়োগব, ক্ষত্ৰিয়া পত্নীর গর্ভজাত পুত্রকে বলা হয় ক্ষত্ত এবং ব্রাহ্মণী পত্নীর গর্ভজাত পুত্ৰকে বলা হয় চণ্ডাল। বৈশ্যা পতির ক্ষত্রিয়া পত্নীর গর্ভজাত পুত্রকে বলা হয় মাগধ এবং ব্রাহ্মণী পত্নীর গর্ভজাত পুত্রকে বলা হয় বৈদেহক। ক্ষত্রিয় পতির ব্রাহ্মণী পত্নীর গর্ভজাত পুত্রকে বলা হয় সূত। রাজা যখন স্বধর্ম রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে থাকেন তখন এ ধরনের অসবর্ণ বিবাহ তথা প্রতিলোম পুত্রের উৎপন্ন হয়ে থাকে। উগ্রপতির নিষাদীর গর্ভজাত সন্তানকে কুক্কুটক বলা হয়, এর বৈপরীত্য হলে তাকে বলা হয় পুল্কস। আন্বষ্ঠ পতির বৈদেহিকার গর্ভজাত সন্তানকে বলা হয় বৈণ এর বৈপরীত্যকে বলা হয় কুশীলব। উগ্রপতির ক্ষত্তা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানকে বলা হয় শ্বপাক। এসমস্ত মিশ্র বর্ণের প্রজন্ম থেকেই ক্রমশ শঙ্কর জাতি উদ্ভূত হয়।
০৩-০৭-০৫ এভাবে সৃষ্ট বেণ জনগোষ্ঠীর লোকরা রথনির্মাণের কর্মে নিযুক্ত হবে এবং তারা সবর্ণে বিবাহ করবে। শঙ্কর জাতির লোকেরা স্ববর্ণে বিবাহ করবে এবং চণ্ডাল ব্যতীত এ জাতীয় লোকরা শূদ্রের মতো ধর্মপালন করবে। রাজা যদি ব্যাভিচার পরিহারকল্পে উপরোক্ত বিধিবিধানের আলোকে বিবাহাদি প্রতিপালনে সক্ষম হন, তাহলে তিনি স্বর্গে গমন করবেন এবং এর অন্যথা হলে নরকে নিপতিত হবেন। সঙ্কর জাতির পৈত্রিক সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে সমভাবে বিভাজিত হবে। দেশ জাতি সংঘ বা গ্রামের যে সব ধর্ম পারম্পার্যসিদ্ধ বলে স্বীকৃত সে অনুসারেই পৈত্রিক সম্পত্তির বিভাজন নিষ্পন্ন করতে হবে।
এই অধ্যায়ে বাস্তসহ বাসগৃহের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। একই সাথে এর নির্মাণশৈলী, প্রকৃতি, অবস্থান, রক্ষণাবেক্ষণসহ গৃহ সম্পর্কিত সামগ্রিক বিষয়ের উপর প্রদান করা হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।
০৩-০৮-০১ বাস্ত সম্পর্কিত বিবাদ প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য প্রমাণেরভিত্তিতে নিষ্পন্নযোগ্য হবে। বাস্ত বা স্থির সম্পত্তি বলতে বোঝাবে—গৃহ, ক্ষেত, উপবন, উদ্যান, বাঁধ, জলাধার, ইত্যাকার স্থাপনা। প্রতিগৃহের কোণস্থ স্তম্ভের সাথে লোহার তার দিয়ে সীমানা নির্ধারণী বাঁধ বা বেড়া স্থাপন করতে হবে। পূর্ব থেকে এধরনের সীমানা নির্ণায়ক সেতু নির্ধারণ করা না থাকলে প্রতিবেশীর প্রাচীর থেকে দুই আরত্নি দূরত্বে এমনভাবে সেতু নির্মাণ করতে হবে যাতে করে প্রতিবেশীর কোনো অসুবিধা না হয়। বাসগৃহ নির্মাণের সময় প্রতিবেশীর অসুবিধা না করে নিজ গৃহের সীমানা সংস্থাপন করতে হবে। একইভাবে প্রতিবেশীর যাতে অসুবিধা না হয় সে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে মলমূত্র বিসর্জনের স্থান, গোবর রাখার স্থান, জল নির্গমনের নালা নির্মাণ করতে হবে, জলের জন্য কূপ খনন করতে হবে, প্রসূতির গৃহ এবং তথাস্থ জল নির্গমনের পথ আলাদাভাবে অস্থায়ী স্থাপনা হিসেবে নির্মাণ করতে হবে। এ নিয়মের অন্যথা হলে অপরাধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্ৰথম সাহসদণ্ড তথা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
০৩-০২-০৮ প্রসূতি গৃহের মতো বিবাহসহ বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে একইভাবে কাঠ কাটা, আগুন জ্বালানো ও জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে এবং উৎসব সমাপ্তির পর এসব অপসারণ করতে হবে। প্রতিবেশীর দেয়াল থেকে দেড় আরত্নি (দেড় হাত) দূরত্বে গৃহের ব্যবহৃত কলুষিত জল নিষ্কাশনের নালা নির্মাণ করতে হবে। এর অন্যথা হলে দণ্ড হিসেবে ৫৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। প্রতিবেশীর বসতভিটার দেয়াল থেকে এক আরত্নি দূরত্বে শকট রাখার স্থান, হাতি অশ্ব ঘোড়া বাঁধার স্থান, রন্ধনের চুলার স্থান, জলপাত্র রাখার স্থান, আটা পেষণের স্থান, ধান কোটার স্থাপনা স্থাপন করতে হবে, এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে জরিমানা হিসেবে দায়ী ব্যক্তির উপর ২৪ পণ প্রযুক্ত হবে।
০৩-০৮-০৩ উপরিউক্ত সকল প্রকার স্থাপনার অন্তবর্তী স্থানের মধ্যে এক হাত আট আঙুল পরিমাণ ফারাক থাকতে হবে। দুটি গৃহের ছাদের মধ্যে ফারাক থাকতে পারে বা তা একত্রিতও হতে পারে। প্রয়োজনীয় মেরামতের জন্য দুটি গৃহের মধ্যবর্তী স্থানে এক কিছু বা এক হাত আট আঙুল পরিধির গলিপথের সংস্থান রাখতে হবে। আলো সঞ্চালনের জন্য গৃহের উপরিভাগের কিছু অংশ খোলা রাখা যেতে পারে। বাসগৃহের প্রবেশ পথে পর্দার আবরণ দেওয়া যেতে পারে, সর্বোপরি এমনভাবে, এমন স্থানে বাসগৃহ নির্মাণ করতে হবে যাতে করে অন্যের কোনো অনিষ্টের সৃষ্টি না হয়।
০৩-০৮-০৪ বৃষ্টিজনিত বিড়ম্বনা পরিহারের নিমিত্ত গৃহের বারান্দা ও বারান্দা সংযুক্ত দেয়ালের উপরিভাগে তৃণের আচ্ছাদন স্থাপন করতে হবে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম করা হলে ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। সংকীর্ণ সড়কের উপর গৃহ নির্মাণের সময় কেউ যদি অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করে গৃহের দরজা জানালা নির্মাণ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে, তবে প্রশস্ত সড়কের পাশে এধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হলে, কোনো দণ্ড প্রযুক্ত হবে না। কোনো ব্যক্তি যদি অপরের অসুবিধা সৃষ্টি করে নিজের সুবিধার্থে বাড়িতে গর্ত করে, সিঁড়ি, নালা, শৌচালয় নির্মাণ করে, তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। কোনো ব্যক্তি যদি জলসিঞ্চনের মাধ্যমে প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়ালের ক্ষতিসাধন করে, সেক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তির উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। উক্ত দেয়াল যদি মল বা মূত্র দিয়ে কলুষিত করা হয়, সে ক্ষেত্রে দ্বিগুণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।
০৩-০৮-০৫ বর্ষণ প্রাক্কালে গৃহের উপর নিপতিত জল নির্গমনের পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে, অন্যথায় গৃহকর্তাকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়ের পরও যদি ভাড়াটিয়া গৃহস্বামীর বাড়ি ছেড়ে না যায়, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। অন্যদিকে বাড়িঅলা যদি অবৈধভাবে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে উদ্যত হয়, সেক্ষেত্রে তার উপরও ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কিন্তু ভাড়াটিয়া যদি গালমন্দ করে, বিবাদ করে, চুরি করে, জবরদস্তি করে, ব্যাভিচার করে, পরস্ত্রীতে গমন করে, মিথ্যাচার করে, সেক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। ভাড়াটিয়া যদি ভাড়া পরিশোধের পর নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই গৃহত্যাগ করে, সেক্ষেত্রে বাড়িঅলা ভাড়ার অবশিষ্টাংশ ফেরত প্রদানে বাধ্য থাকবে।
সর্বসাধারণের ব্যবহার্য স্থাপনা নির্মাণে কেউ সহযোগিতা না করলে বা কোনো ব্যক্তির দ্বারা উক্ত স্থাপনার ব্যবহার বিঘ্নিত হলে দায়ী ব্যক্তিকে দণ্ড ‘হিসেবে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। সাধারণ গৃহের কোনো ক্ষতি করা হলে দায়ী ব্যক্তিকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। যে বাড়িতে অনেক অংশীদার বসবাস করে থাকে সে বাড়ির গৃহদ্বার, শকট রাখার স্থান, গো-মহিষের জলপানের স্থান, বাড়ির উঠান, মলমূত্র ত্যাগের স্থান, আবর্জনা রাখার স্থান, রন্ধনশালা, কোটা বাছার স্থান এবং বাড়ির উন্মুক্ত স্থান সকলে সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করবে।
এই অধ্যায়ে স্থাবর সম্পত্তির বিক্রয়, ক্ষেত্র সীমা সম্পর্কিত উদ্ভূত আপত্তির নিষ্পত্তি, সীমানা জবরদখলের প্রতিকারসহ বাস্তভিটা ও ভূমি সংশ্লিষ্ট নানাবিধ বিষয়ের উপর আলোকপাত করত, করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
০৩-০৯-০১ প্রথমত—জ্ঞাতি, দ্বিতীয়ত—প্রতিবেশী এবং তৃতীয়ত—ঋণ প্রদানকারীগণ ভূ-সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। এদের অবর্তমানে বাহিরের লোকরা উক্ত ভূমি ক্রয়ের অধিকারী হবে। বিক্রেতা চল্লিশজন প্রতিবেশীর উপস্থিতিতে নিজ বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে বাড়ি বিক্রয়ের ঘোষণা প্রদান করবে। জমি, বাঁধ, পুকুর এবং জলাধার বিক্রয় প্রাক্কালে বিক্রেতা ওই সমস্ত স্থাপনার আয়তন, সীমানা ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতিতে বিক্রেয় স্থাপনার মূল্য ঘোষণা করবে। তিনবার মূল্য ঘোষণার পর যদি কোনো প্রতিযোগী আবির্ভূত না হয়, তাহলে বিক্রেতার ঘোষিত মূল্যে উপযুক্ত ক্রেতা উক্ত সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবে।
০৩-০৯-০২ সম্পত্তি বিক্রয় প্রাক্কালে ক্রেতাদের মধ্যে যদি প্রতিযোগিতা উদ্ভূত হয় এবং উক্ত সম্পত্তি যদি বিক্রেতার ঘোষিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে বিক্রিত হয়, সেক্ষেত্রে বিক্রিত সম্পত্তির বর্ধিত অর্থ শুল্ক সমেত রাজকোষে জমা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে যিনি সর্বোচ্চ মূল্য প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করবেন তিনি সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকারী হবেন এবং প্রদেয় শুল্ক প্রদানে বাধ্য থাকবেন। সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী না হয়েও কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সম্পত্তি বিক্রয়ের ঘোষণা প্রদান করেন, সেক্ষেত্রে তার উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে নিলামের মাধ্যমে ক্রয়কৃত জমির দখলিস্বত্ব সাত দিনের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ভূস্বামী সেই সম্পত্তি অন্যত্র বিক্রি করতে পারবেন। সম্পত্তির মালিককে পাশ কাটিয়ে তার সম্পত্তি বিক্রয়ের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। মালিককে উপেক্ষা করে শকট বা অন্য দ্রব্য বিক্রয়ের চেষ্টা করা হলে অপরাধীকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।
০৩-০৯-০৩ দুই গ্রামের মধ্যে সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ উপস্থিত হলে নিকটবর্তী পাঁচগ্রাম ও দশ গ্রামের অভিজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে পাহাড়, অরণ্য, নদী বা অঙ্গারের মাধ্যমে বিরোধপূর্ণ গ্রামের সীমা নির্ধারণ করে দিবেন। দুই গ্রামের সীমানা নির্ধারণের জন্য যদি উক্ত প্রকৃতির অভিজ্ঞ লোকদের পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে ইতিপূর্বে যারা উক্ত এলাকার ভূমি ব্যবহার করেছে এবং যাদের মধ্যে উক্ত ভূমি সম্পর্কিত ধারণা বিদ্যমান, সে ধরনের বহু সংখ্যক বৃদ্ধ কৃষক ও গোপালক অথবা তাদের মধ্য হতে কোনো একজন নারী বা অন্য কোনো ছদ্মবেশ ধারণ করে দ্বন্দ্বপূর্ণ এলাকার প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন। সীমানা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হলে সীমানা নির্ধারণকারীর বিরুদ্ধে হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে। সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর কেউ যদি তা লঙ্ঘন করে বা সীমানা চিহ্ন উৎপাটন করে, সেক্ষেত্রে তার জন্যও হাজার পণ জরিমানা আরোপন প্রযোজ্য হবে। যেসব ভূমির সীমানা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বা যেসব ভূমির সীমানা অজ্ঞাত থাকবে, প্রজা সাধারণের কল্যাণের দিকটি বিবেচনা করে রাজা যেসব ভূমির সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন ।
০৩-০৯-০৪ ভূমি সম্পর্কিত আপত্তি বা বিরোধ উত্থাপিত হলে গ্রামের বৃদ্ধরাই তার নিষ্পত্তি করবেন। বিরোধ মীমাংসা নিষ্পত্তিতে অচলাবস্থা দেখা দিলে যে পক্ষে অধিক সংখ্যক বিজ্ঞ ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির সন্নিবেশ হবে, সে পক্ষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অতঃপরও বিরোধ অনিষ্পন্ন থেকে গেলে রাজা বিরোধ নিষ্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবেন, এক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণ সম্ভব না হলে, রাজা তা অধিগ্রহণ করবেন অথবা সেই সম্পত্তি তিনি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিলি বণ্টন করে দিবেন। গায়ের জোরে কেউ যদি অপরের ভূমি অধিগ্রহণ করে, তাহলে তার উপর চৌর্যবৃত্তির জন্য প্রযোজ্য অপরাধের শাস্তি আরোপিত হবে। ঋণগ্রস্ততার কারণে কারও ভূমি যদি ঋণদাতা কর্তৃক অধিকৃত হয়, সেক্ষেত্রে ঋণদাতা উৎপন্ন ফসলের জন্য প্রদেয় শ্রমমূল্য এবং ফসলের মূল্যমান নিরূপণ করে ভূস্বামীকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিবেন। কেউ যদি অন্যের ভূমি আত্মসাতের মাধ্যমে নিজের ভূমিতে অন্তর্ভুক্ত করে ভূমির সীমানা বর্ধিত করে, তাহলে তার উপর প্রথম সাহসদণ্ড বা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ভূমির সীমানা চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করা হলে, দায়ী ব্যক্তিকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। উপরোক্তভাবে তপোবন, গোচারণভূমি, মহাপথ, শ্মশান, মন্দিরের ভূমি, যজ্ঞভূমি এবং তীর্থস্থানের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে।
০৩-০৯-০৫ এ ধরনের সকল প্রকার বিরোধ প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে। গোচারণভূমি, স্থলভূমি, শালিধানের ক্ষেত, কলা বাগান, ধান মাড়াইয়ের স্থান, বসতবাটি, পরিবহন কাজে ব্যবহৃত গরু-ঘোড়ার আবাসস্থান নিয়ে বিরোধ উপস্থিত হলে, ক্রমানুযায়ী পূর্বেরটি পূর্বাহ্নে নিষ্পত্তিযোগ্য হবে। বেদ পাঠের অরণ্যভূমি, সোমযজ্ঞের স্থান, দেব স্থান, যজ্ঞাদির স্থান এবং পুণ্যস্থান ব্যতীত অন্যান্য স্থান স্থলভাগ হিসেবে পরিগণিত হবে। কেউ যদি অন্যের ফসলের ক্ষতিসাধন করে নিজের চাষাবাদের স্বার্থে জলাশয়, জলপ্রণালী এবং শালিধানের ক্ষেত ব্যবহার করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। কারো জলাভূমি, উদ্যান বা বাঁধের কারণে যদি তৎসংলগ্ন অন্যের ভূমির বা স্থাপনার ক্ষতি সাধিত হয়, সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রকৃত ক্ষতির দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
০৩-০৯-০৬ উচ্চভূমিতে সেচকৃত জল দিয়ে নিম্নভূমির সেচ সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না। নিম্নভূমির জল সেচনের উৎস যদি একটানা তিন বছরকাল অকার্যকর থাকে, সেক্ষেত্রে উচ্চভূমি উৎস থেকে প্রবাহিত জলধারা নিরোধ করা যাবে না। এর অন্যথা হলে অপরাধীর উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং তার জল উৎসটি শূন্য করে দেওয়া হবে। পাঁচ বছর যাবৎ কোনো কৃষিভূমি পতিত রাখা হলে উক্ত ভূমিতে মালিকের মালিকানাস্বত্ব লুপ্ত হবে, তবে কোনো সমস্যাজনিত কারণে তা অব্যবহৃত রাখা হলে এরূপ বিধান কার্যকর হবে না। নতুন জলাধার ও আবাদযোগ্য কৃষিভূমি সৃজন করা হলে, ঊষর বা পরিত্যক্ত জলাধার ও কৃষিভূমি উৎপাদনের উপযোগী করে উন্নত করা হলে, আগাছা উচ্ছেদ করে কোনো ভূমিকে আবাদযোগ্য করা হলে এবং বিদ্যমান কৃষিভূমির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হলে, ভূস্বামীরা ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথাক্রমে পাঁচ বছর, চার বছর, তিন বছর ও দুই বছরের জন্য কর রেয়াতি সুবিধার অধিকারী হবে, এমন কি তারা এ সমস্ত আবাদি জমি বন্ধক রাখা বা বিক্রি করবারও অধিকার লাভ করবে।
০৩-০৯-০৭ খননকৃত খালের জল, নদীর জল, বাঁধের সংরক্ষিত জল অথবা পুকুরের জল সে-সমস্ত কৃষকদের জমিতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে—যারা অধিক ফসল উৎপাদন করবে এবং অধিক হারে কর প্রদান করবে। যে সমস্ত কৃষক ভূমি ভাড়া নিয়ে ফসল উৎপাদন করবে, চুক্তির ভিত্তিতে অন্যের ভূমিতে ফসল উৎপাদন করবে, কোনোকিছু বন্ধকের বিনিময়ে ফসল উৎপাদন করবে, ভূস্বামীকে ফসলের নির্দিষ্ট অংশ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাষাবাদ করবে, তাদের মাধ্যমে জল উৎসের কোনো ক্ষতি সাধিত হলে তারা তা পূরণে বাধ্য থাকবে। এ ধরনের উপভোক্তা কর্তৃক ভূমির ক্ষতি সাধিত হলে তারা যদি তার প্রতিবিধান না করে, তাহলে তারা ক্ষয়-ক্ষতির দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। কেউ যদি জল-প্রাপ্যতার নির্ধারণকৃত সময়ের পূর্বেই সেচনের জল ব্যবহার করে বা অন্যের সেচকার্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ছয় পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
এই অধ্যায়ে গোচারণভূমি, চাষাবাদের ভূমি, ক্ষেত্র পথ, চুক্তির বরখেলাপ, জলাধারের প্রতিবন্ধকতা এবং শস্যহানির বিষয়ে আলোকপাত করত, এ বিষয়ক বিবিধ করণীয় ও প্রযোজ্য শাস্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
০৩-১০-০১ কেউ যদি সেচকার্যের জল সরবরাহ পথে কোনোপ্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে চাষাবাদের ক্ষতিসাধন করে, তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। অন্যের ভূমিতে বাঁধ, কূপ, চৈত্য, পুণ্যস্থান বা মন্দির নির্মাণ করা হলে দায়ী ব্যক্তির উপর মধ্যম সাহসদণ্ড তথা ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। কেউ যদি পূর্বপুরুষদের দ্বারা নির্মিত ধর্মীয় কাজে ব্যবহার্য বাঁধ, কূপ বা পুকুর অন্যের কাছে বন্ধক রাখে বা বিক্রয় করে দেয়, তাহলে তার উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এসব ব্যাপারে যারা সাক্ষ্য প্রদান করবে তাদের উপর সহস্র পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কিন্তু এ সমস্ত স্থাপনা যদি ব্যবহারের অনুপযোগী বা অব্যবহৃত অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়, সেক্ষেত্রে বন্ধক বা বিক্রি করা হলে কাউকে দণ্ড ভোগ করতে হবে না। এ সমস্ত স্থাপনার যদি কোনো মালিকানা না থাকে, সেক্ষেত্রে গ্রামের লোকজন এবং দূরবর্তী এলাকায় বসবাসরত পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরা এর সংস্কার করাতে পারবে।
০৩-১০-০২ ক্ষুদ্র পশু এবং মানুষের চলাচল পথ অবরোধ করা হলে অবরোধকারীর ১২ পণ জরিমানা হবে। গরু ও মহিষ জাতীয় মহাপশুদের চলাচল পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। হাতিদের যাতায়াত পথ এবং কৃষিভূমির চলাচল পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হলে ৫৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। বাঁধ ও বনের পথ অবরোধ করলে ৬০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। শ্মশান ও গ্রামের পথে অবরোধ সৃষ্টি করা হলে ২০০ পণ জরিমানা হবে। দ্রোণমুখ তথা চারশ গ্রামের প্রশাসনিক কার্যালয়ে গমনাগমনের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হলে ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। স্থানীয় তথা আটশ গ্রামের প্রশাসনিক কার্যালয়ে গমনাগমনের পথ, জনপদের পথ এবং গোচারণ ভূমির পথ অবরোধ করা হলে ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এ সমস্ত পথের এক পাশ বিনষ্ট করে এর প্রশস্ততা হ্রাস করা হলে অবরোধজনিত দণ্ডের চার ভাগের একভাগ দণ্ড তথা জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এ সব পথের উপর কারো দ্বারা কৃষিকাজ করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে পূর্ববৎ দণ্ড প্রযুক্ত হবে।
০৩-১০-০৩ বীজ বুননের সময় ভূ-স্বামী কর্তৃক যদি স্বীয় ভূমি চাষাবাদের জন্য কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করা না হয় অথবা বীজ বপনের জন্য প্রতিজ্ঞ হয়েও যদি উক্ত ভূমি পতিত রাখা হয়, তাহলে এই উভয় প্রকার অপরাধের জন্য ভূ- স্বামীকে দণ্ড হিসেবে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কিন্তু রোগ, মহামারী, চোরের উপদ্রব বা অন্য কোনো সঙ্গত কারণে যদি ভূমি পতিত রাখা হয়, সেক্ষেত্রে ভূ-স্বামীর বিরুদ্ধে উপরোক্ত দণ্ড আরোপ প্রযোজ্য হবে না। করদাতাগণ শুধু করদাতাদের কাছেই নিজের জমি বন্ধক রাখতে পারবে বা বিক্রি করতে পারবে। ব্রাহ্মণদের দেয় করমুক্ত ভূমি শুধু অনুরূপ ব্যক্তির কাছে বন্ধক বা বিক্রি করা যাবে। এ সব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভূমি বন্ধক রাখা হলে বা বিক্রি করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। করদাতাদের গ্রামে যদি কোনো করদাতা ব্যক্তি কারও বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকে, তাহলে ঐ ভাড়াকৃত ঘর ছাড়া অন্য কিছুতে উক্ত ভাড়াটিয়ার কোনোপ্রকার স্বত্ব স্বীকৃত হবে না।
০৩-১০-০৪ কোনো ভূ-স্বামী যদি নিজের জমিতে কৃষিকাজ না করে তা পতিত অবস্থায় রাখে, তাহলে ভূস্বামী কর্তৃক নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি উক্ত ভূমি পাঁচ বছর পর্যন্ত ভোগ তথা চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে ভূমির উর্বরতা সংরক্ষণার্থে যে অর্থ ব্যয় হবে ভূমি ফেরত প্রদানকালে ভূস্বামীকে তা প্রদান করতে হবে। গ্রাম প্রধানগণ যখন কোনো কাজের নিমিত্ত গ্রামান্তরে গমন করবেন তখন গ্রামের লোকেরা পর্যায়ক্রমে তার সঙ্গে অনুগমন করবে, যারা তা করবে না তাদের উপর যোজন প্রতি দেড় পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। গ্রাম প্রধান কর্তৃক চোর এবং পরস্ত্রীগামী ব্যতীত অন্য কাউকে গ্রাম থেকে বিতাড়ন করা যাবে না, এমনটি করা হলে গ্রাম প্রধানের বিরুদ্ধে ২৪ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। গ্রামের লোকেরা এরূপ কর্মে সম্পৃক্ত হলে তাদের উপর এক হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
০৩-১০-০৫ উপরোক্ত অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি হিসেবে কাউকে গ্রাম থেকে বিতাড়ন করা হলে সে যদি পুনর্বার গ্রামে অনুপ্রবেশ করে, তাহলে তাকে পরগৃহে প্রবেশের অপরাধে অপরাধী হয়ে প্রযোজ্য দণ্ড ভোগ করতে হবে। গ্রাম থেকে একশ ধনুঃ তথা চারশ হাত দূরে পাথর বা কাঠ দিয়ে গ্রামের বেষ্টনী দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। কোনো গ্রামের বনভূমি বা তৃণভূমি সেই গ্রামের আপামর জনসাধারণ পশুচারণের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে তৃণভূমি ব্যবহারকারীদের প্রতিটি গরু, ঘোড়া ও গাধার জন্য আটের এক শতাংশ পণ এবং প্রতিটি ছোট পশুর জন্য ষোল’র এক শতাংশ পণ কর হিসেবে বিবীতাধ্যক্ষকে পরিশোধ করতে হবে।
০৩-১০-০৬ প্রয়োজনীয় তৃণ ভক্ষণের পরেও যদি উপরোক্ত পশুগুলো তৃণভূমি পরিত্যাগ না করে সেখানে অবস্থান করে, সেক্ষেত্রে ঐ সব পশুর স্বত্বাধিকারীদের প্রদেয় করের দ্বিগুণ কর বা জরিমানা প্রদান করতে হবে, এক্ষেত্রে পশুগুলো যদি রাতেও তৃণভূমিতে অবস্থান করে তাহলে চারগুণ হারে কর বা জরিমানা প্রদান করতে হবে। গ্রাম দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত ষাঁড়, দশদিন অতিক্রান্ত হয়নি এমনতর প্রসূতা গাভী, বয়স্ক বৃষভ, প্রজননের কাজে ব্যবহার্য ষাঁড় যদি উপরোক্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে তৃণ ভূমিতে অবস্থান করতে থাকে সেক্ষেত্রে পশুর স্বত্বাধিকারীকে কোনো ধরনের জরিমানা বা কর প্রদান করতে হবে না।
গরু, মহিষ বা কোনো পশু যদি অন্য লোকের ক্ষেতের ফসল ভক্ষণ করে বা ফসলের ক্ষতিসাধন করে, সেক্ষেত্রে উক্ত পশুর মালিককে ক্ষতিকৃত ফসলের দ্বিগুণ মূল্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে। ক্ষেতের মালিকের বিনা অনুমতিতে তার ভূমিতে পশুচারণ করা হলে, অপরাধী ব্যক্তি ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। অন্যের ক্ষেতে কেউ যদি অবাধে চারণের জন্য পশু ছেড়ে দেয়, তাহলে অপরাধী ব্যক্তি ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। পশু পালকদের দ্বারা এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে তাদের উপর উপরোক্ত পরিমাণের অর্ধেক জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো পশু কর্তৃক কারো কলাবাগানের কলাগাছ ভক্ষণ করা হলে শস্য ভক্ষণের জন্য যে দণ্ডের বিধান বিহিত করা আছে সেই দণ্ড পশুর মালিকের উপর প্রযুক্ত হবে। গোলায় রক্ষিত ধান কোনো পশু কর্তৃক ভক্ষিত হলে উপরোক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ড প্রযুক্ত হবে। অভয়ারণ্যের কোনো পশু যদি কারো ক্ষেতের ফসল ভক্ষণাবস্থায় ধৃত হয়, তাহলে তাদের এমনভাবে তাড়িয়ে দিতে হবে যেন পশুগুলো নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। দলছুট ও অপরের শস্যভক্ষণে উদ্যত পশুদের দড়ির চাবুক বা বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শাসন করতে হবে। অন্য তরিকায় তাদের আঘাত করা হলে অপরাধীকে দণ্ডপারুষ্য ভোগ করতে হবে। আক্রমণে উদ্যত বা পূর্ব থেকে স্বভাবগতভাবে হিংস্র প্রকৃতির পশুদের সর্ববিধ উপায়ে বন্ধনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
০৩-১০-০৭ সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কোনো কার্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে কেউ যদি তাতে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর যে জরিমানা আরোপিত হবে সে জরিমানার অর্থ গ্রামের সাধারণ কোষাগারে জমা হবে, উক্ত ধরনের অর্থ রাজকোষে জমা করতে হবে না। সমন্বিত কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে অর্থ ধার্য করা হবে প্রতিশ্রুতি প্রদানের পরেও কেউ যদি তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে ধার্যকৃত অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। সামাজিক ভোজন উৎসবের জন্য যে ব্যক্তি যেই পরিমাণ খাদ্য ও পানীয়ের যোগান দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে, সে ব্যক্তি যদি তা দিতে অসমর্থ হয়, তাহলে তাকে প্রদেয় দ্রব্যের দ্বিগুণ পরিমাণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।
০৩-১০-০৮ গ্রামে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী বা নাট্যানুষ্ঠানের জন্য ধার্যকৃত অর্থ কেউ যদি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে সে বা তার পরিবার উক্ত অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে না। কেউ যদি গোপনে লুকিয়ে এধরনের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে প্রবৃত্ত হয়, তাহলে তাকে ধার্যকৃত অর্থের দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা বাবদ প্রদান করতে হবে। এছাড়া কেউ যদি সকলের হিতার্থে করণীয় কোনো কাজের জন্য ধার্যকৃত অর্থ পরিশোধ না করে বা উক্ত কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, তাহলে তাকে দণ্ড হিসেবে প্রদেয় অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। গ্রামের কেউ যদি সকলের হিতার্থে কোনো উপদেশ প্রদান করে, তাহলে তা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয় বলে গণ্য হবে, কেউ এর অন্যথা করলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ ধরনের সর্বজন হিতকারী ব্যক্তিকে কোনোপক্ষ কর্তৃক আক্রমণ করা হলে, আক্রমণকারী প্রতিটি সদস্যের উপর ২৪ পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তিকে কেউ জখম করলে তার উপর কঠোর দণ্ড আরোপিত হবে। বর্ণক্রমের ভিত্তিতে গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারীদের জ্যেষ্ঠতা এবং প্রাধিকার নিরূপিত হবে।
০৩-১০-০৯ বিভিন্ন উৎসবে বা প্রীতিভোজের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণরা অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হলেও তারা তাদের জন্য নির্ধারিত প্রদেয় অর্থ প্রদান করতে পারবে। যেসব গ্রামের মানুষ জনহিতার্থে বাঁধ বা সেতু জাতীয় স্থাপনা নির্মাণসহ শোভা বর্ধনের নিমিত্ত বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টিশীল কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করবে, প্রজা হিতকর ঐ ধরনের কাজ সম্পন্নকরণের জন্য রাজা তাদের কার্যকর সহায়তা প্রদান করবেন।
এই অধ্যায়ে ঋণগ্রহণ, ঋণ পরিশোধ, ঋণের প্রকৃতি, ঋণ হতে অব্যাহতিসহ এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-১১-০১ শত পণ ঋণের বিপরীতে সোয়াপণ হারে মাসিক সুদ প্ৰদান করাই সঙ্গত বলে স্বীকৃত। কোনোকিছু বন্ধক রেখে ঋণগ্রহণ করা হলেও এই হারেই সুদ প্রদান করতে হবে। পণ্য ক্রয় বিক্রয় তথা ব্যবসার জন্য ঋণগ্রহণ করা হলে শতকরা পাঁচ পণ হারে মাসিক সুদ প্রদেয় হবে। যেসব বণিক দুর্গম পথ দিয়ে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন করবে তাদের ক্ষেত্রে গৃহীত ঋণের মাসিক সুদের হার হবে শতকরা দশ পণ। সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনকারী বণিকদের ক্ষেত্রে এই সুদের হার হবে ২০ শতাংশ। এর অতিরিক্ত সুদ গ্রহণ করা হলে দায়ী ব্যক্তিকে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং এ ধরনের নিয়ম বহির্ভূত সুদারোপের যারা সাক্ষী হবে, তাদের উপর ১২৫ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। রাজ প্রশাসকরা ঋণগ্রহীতা ও ঋণ দাতার লেনদেন সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। তারা ব্যর্থ হলে বিচারকগণ প্রচলিত রীতির আলোকে এ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন।
০৩-১১-০২ ঋণ হিসেবে ধান গ্রহণ করা হলে ফসল তোলার পর সুদ হিসেবে গৃহীত ধানের অর্ধেক প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ ধান রোপিত হবার পূর্বে এক মন ধান কর্জ নেয়া হলে ধান কাটার পর দেড় মন ফেরত প্রদান করতে হবে। পরিমাণ মতো ধান ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে অর্থমূল্যে তা পরিশোধ করা যাবে। সময়মতো ধান ফেরত না দিয়ে কেউ যদি তা মজুদ করে রাখে এবং মজুদকৃত ধানের যদি মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, সেক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতাকে বর্ধিত মূল্যের অর্ধেক অর্থ ঋণদাতাকে প্রদান করতে হবে। দীর্ঘকাল প্রবাসে বসবাসের কারণে বা ঔদ্ধত্যবশত কেউ যদি সময়মতো গৃহীত ধানের প্রদেয় সুদ বা অর্থমূল্য পরিশোধ না করে, তাহলে তাকে জরিমানা হিসেবে ঋণকৃত ধানের দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হবে। সঠিকভাবে সুদ নির্ধারণ না করে কেউ যদি দ্রব্যাদি ধার দেয়, স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলে পরবর্তী সময়ে অধিক সুদ দাবি করে বা আসলকে সুদের সাথে যুক্ত করে আসল ঋণ নিরূপণ করে সাক্ষীদের সমর্থন নিয়ে তা দাবি করে, তাহলে অপরাধীকে মূলধনের চারগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। স্বল্প ঋণ প্রদান করে কেউ যদি অধিক ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং সাক্ষীদের সহযোগিতায় তা আদায় করে, তাহলে অপরাধীকে মিথ্যা ঘোষিত ঋণের চারগুণ অর্থ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এই জরিমানার তিনভাগ প্রদান করবে মূল দায়ী ব্যক্তি এবং এক ভাগ প্রদান করবে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারী।
০৩-১১-০৩ দীর্ঘসময় যজ্ঞে নিযুক্ত ব্যক্তি, গুরুগৃহে ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নকারী, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বা অসচ্ছল ব্যক্তি কর্তৃক ঋণ গৃহীত হলে তা সুদযোগ্য হবে না। ঋণদাতা যদি সম্পূর্ণ পরিশোধ্য অর্থ গ্রহণে অস্বীকৃত হয়, তাহলে তাকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। ঋণদাতা যদি অসৎ অভিপ্রায়ে ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধিত হয়েছে ঘোষণা দিয়ে কারও ঋণ পরিশোধের অর্থ গ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে উক্ত ঋণের অর্থ সুদহীন অবস্থায় কোনো বিশ্বাসভাজন ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রাখা যেতে পারে। কোনো ঋণদাতা যদি দশ বছরকাল প্রদত্ত ঋণের ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করে থাকে, তাহলে তা আর আদায়যোগ্য হবে না। কিন্তু ঋণগ্রহীতা যদি বালক, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, বৃদ্ধ, সংকটাপন্ন ব্যক্তি, দেশত্যাগী বা রাজ্য বিভ্রমে নিপতিত ব্যক্তি হয়, সেক্ষেত্রে তার জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এক্ষেত্রে দশ বছর অতিক্রান্ত হলেও ঋণ আদায়যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
০৩-১১-০৪ ঋণগ্রহীতা মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র বা তার সম্পত্তি লাভের উত্তরাধিকারী বা সহঋণগৃহীতা সদস্যরা বা জমিনদার সেই ঋণ পরিশোধ করবে। ঋণের ব্যাপারে নাবালকের জামিনদারিত্ব আইনত অগ্ৰাহ্যযোগ্য। যে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো স্থান কাল নির্ধারণ করা হবে না, সে ঋণ পরিশোধ করবে মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা। এ ক্ষেত্রে জামিনদারের পুত্র, পৌত্র ও উত্তরাধিকারীরাও ঋণ পরিশোধের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।
০৩-১১-০৫ অনেক ঋণগ্রহীতা একত্রে অনেকের কাছে ঋণগ্রহণ করলে দুজন ঋণগ্রহীতা একই সময় একজন ঋণগ্রহীতার উপর অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবে না। কিন্তু এরূপ ঋণগ্রহীতাদের কেউ যদি দেশত্যাগে উদ্যত হয়, তাহলে দুজন ঋণদাতা তার উপর একই সময় অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবে। বহু প্রকার ঋণগ্রহণ করা হলে গ্রহীতা তা ক্রমানুসারে পরিশোধ করবে। কিন্তু রাজা ও ব্রাহ্মণের কাছ থেকে ঋণগ্রহণ করা হলে তা সর্বাগ্রে পরিশোধ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র এবং অবিভক্ত ভ্রাতাদের মধ্যে পরস্পর গৃহীত ঋণ বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তিযোগ্য নয়। কৃষক এবং রাজপুরুষগণকে (রাজকীয় কর্মচারী) ঋণ খেলাপির দায়ে কর্তব্যরত অবস্থায় আটক করা যাবে না। স্ত্রী যদি মৃত পতির ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকার করে তাহলে তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। তবে গো-পালক ও ভূমি বর্গাদানকারীর স্ত্রী মৃত পতির ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃত হলে তাদের আটক বা গ্রেফতার করা যাবে।
০৩-১১-০৬ যে পতি তার পত্নীর ভরণ-পোষণের সংস্থান না করে প্রবাসে চলে যাবে, সেই পত্নী কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য স্বামী গ্রেফতারযোগ্য হবে। ঋণগ্রহণ করে স্বীকার করাই এ বিষয়ক আপত্তি নিষ্পত্তির উত্তম উপায়। ঋণগ্রহণের পর অস্বীকার করা হলে সাক্ষীর মাধ্যমেই তা নিষ্পত্তি করতে হবে। এক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রদানকারীকে হতে হবে বিশ্বস্ত, বিশুদ্ধ এবং দু-পক্ষের কাছে সমভাবে গ্রহণীয়, সাক্ষীর সংখ্যা ন্যূনতম তিন জন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে দুজন
সাক্ষীর সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে কিন্তু একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য কখনো প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাদী বিবাদীর শ্যালক, সহায়ক, আশ্রিত, ঋণদাতা, ঋণগ্রহীতা, শত্রু, বিকলাঙ্গ ও দণ্ডপ্রাপ্তরা অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। একইভাবে ইতিপূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিতরা, রাজা, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ, গ্রাম সেবক, কুষ্ঠরোগী, ক্ষত ব্যক্তি, ধর্মভ্রষ্ট পতিত, চণ্ডাল, কদাচার ব্যক্তি, অন্ধ, বধির, অহংবাদী, স্ত্রীলোক এবং রাজকর্মচারীরা সাক্ষীর জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে এরা নিজেদের মধ্যে উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করতে পারবে।
০৩-১১-০৭ তবে মারামারি, গালাগালি, চুরি এবং পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যাভিচার সংক্রান্ত বিচারকার্যে শত্রু, শ্যালক ও সহায়ক ব্যতীত অন্যরা সাক্ষ্য প্রদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। প্রত্যক্ষদর্শী স্ত্রী বা স্বামী এককভাবে গোপন মামলার সাক্ষ্য প্রদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে কিন্তু রাজা বা তপস্বীরা এ ধরনের মামলার সাক্ষী হতে পারবে না। নিগৃহীত হবার আশঙ্কা না থাকলে মালিক ভৃত্যের পক্ষে, গুরু শিষ্যের পক্ষে এবং পিতা-মাতা পুত্রের পক্ষে সাক্ষ্য দান করতে পারবে। অনুরূপভাবে ভৃত্য, শিষ্য এবং পুত্র যথাক্রমে মালিক, গুরু ও পিতা-মাতার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করতে পারবে। এদের পরস্পরের মধ্যে অভিযোগ উত্থাপিত হলে যদি মালিক বা গুরু পরাজিত হয়, তাহলে যে অর্থের ব্যাপারে মামলা হবে তার দশগুণ অর্থ শিষ্য বা ভৃত্যকে পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে ভৃত্য বা শিষ্য পরাজিত হলে পাঁচ গুণ অর্থ মালিক বা গুরুকে পরিশোধ করতে হবে।
০৩-১১-০৮ বিচারকরা সাক্ষীগণকে ব্রাহ্মণ, অগ্নি এবং জলপাত্রের সম্মুখে হাজির করে জেরা করবেন। সাক্ষী যদি ব্রাহ্মণ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বিচারক তাকে সত্য কথা বলতে বলবেন, সাক্ষী যদি ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বিচারক তাকে এই মর্মে সতর্ক করে সাক্ষ্য প্রদান করতে বলবেন যে, সে যদি সত্য কথা না বলে তাহলে তার ইষ্ট ও যজ্ঞাদির ফল সিদ্ধ হবে না, তাকে ভিক্ষাপাত্র হাতে শত্রুর দ্বারস্থ হতে হবে। সাক্ষী যদি শূদ্র হয়ে থাকে তাহলে বিচারক তাকে এই বলে সতর্ক করে সাক্ষ্য প্রদান করতে বলবেন যে, সে যদি সত্য কথা না বলে তাহলে তার অর্জিত সমুদয় পুণ্য রাজার মধ্যে সঞ্চারিত হবে, সে কোনো পুণ্যের ফল ভোগ করতে পারবে না এবং রাজার সমস্ত পাপ তার মধ্যে সঞ্চারিত হবে, তার দ্বারা কোনোকিছু গোপন করা হলে তা ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবেই, বিধায় সত্য বলাই তার জন্য কল্যাণকর। সাতদিন সময় দেওয়ার পরও যদি সাক্ষীদের দ্বারা সত্য উদ্ঘাটিত না হয়, তাহলে অষ্টম দিবস থেকে তাদের উপর দিন প্রতি ১২ পণ হারে জরিমানা আরোপিত হবে এবং ৪৫ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সাক্ষীদের অসহযোগিতার কারণে বিবাদ অনিষ্পন্ন থেকে যায়, সেক্ষেত্রে সাক্ষীরা জরিমানা বাবদ বিবাদ সম্পৃক্ত অর্থমূল্যের সম পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
০৩-১১-০৯ স্বাক্ষীদের সাক্ষ্যে স্ববিরোধিতা বা বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে যে পক্ষে অধিক সংখ্যক বিশুদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য সাক্ষী থাকবে বিচারক সে পক্ষের অনুকূলে রায় প্রদান করবেন। উভয় পক্ষের যুক্তি সমানভাবে জোরালো হলে বিচারক উভয় পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে রায় প্রদান করবেন। মামলা অনিষ্পন্নের অবস্থায় উপনীত হলে বিবাদ সম্পৃক্ত সমুদয় সম্পদ রাজার অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অভিযোগ প্রাক্কালে যদি প্রকৃত সম্পদের তারতম্য ঘটিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়, তাহলে রাজা কর্তৃক অতিরিক্ত সম্পদ বা তার অংশ বিশেষ হরণযোগ্য হবে। অভিযোগকারীর অজ্ঞতা বা মূর্খতার কারণে যদি প্রকৃত সম্পদের চেয়ে অধিক লেখা হয়, শ্রুতি ত্রুটির কারণে যদি সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ করা না হয়, স্বজনের মৃত্যুজনিত চিত্তবৈকল্যের কারণে যদি সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ করা না হয়, তাহলে এ সকল বিষয় পর্যালোচনাপূর্বক সাক্ষীদের সাক্ষ্যর আলোকে অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে হবে।
আচার্য উশনার বা শুক্রাচার্যের মতাবলম্বীদের মতানুযায়ী—সাক্ষীদের প্রশ্নকালে যদি দেশ, কাল ও কার্যসম্পর্কীয় বক্তব্যে বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রথম, মধ্যম ও উত্তম সাহসদণ্ড তথা ২৫০, ৫০০ বা ১০০০ পণ জরিমানা আরোপযোগ্য হবে। মনুর মতাবলম্বীরা মনে করেন—মিথ্যুক সাক্ষীরা যদি অর্থ সম্পর্কিত বিষয়ে অসত্যকে সত্য বলে প্রমাণের প্রয়াস গ্রহণ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দশগুণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। বৃহস্পতির অনুসারীরা মনে করেন—মূর্খতাবশত সাক্ষ্য প্রদানের কারণে যদি বিচারকার্যে অসংগতি বা অচলাবস্থা উদ্ভূত হয়, সেক্ষেত্রে সাক্ষীদের উৎপীড়িত করে হত্যা
করতে হবে।
০৩-১১-১০ কোটিল্য উপরোক্ত আচার্য বা তাদের অনুসারীদের মতামত সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—যেসব সাক্ষী সত্য কথা বলবে তাদের বক্তব্য আদালতের শ্রবণ করা উচিৎ। সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আহ্বান সত্ত্বেও যারা সাক্ষ্য প্রদানের জন্য বিচারালয়ে উপস্থিত হবে না, তাদের উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে এবং যারা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করবে, তাদের উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। সন্নিকটস্থ লোকদেরই সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো সমীচীন। যারা সুদূরে বাস করে এবং সাক্ষীর জন্য হাজির হতে ইচ্ছুক নয়, সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালতের মাধ্যমে তাদের তলব করা যেতে পারে।
এই অধ্যায়ে কারও কাছে কোনোকিছু গচ্ছিত রাখার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোন ব্যক্তির কাছে কোনোকিছু গচ্ছিত রাখাকে বলা হয়েছে উপনিধি। কোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গচ্ছিত দ্রব্য বিনষ্ট হলে তা দাবি করা যাবে না, গচ্ছিত দ্রব্য অপহৃত হলে কি ধরনের শাস্তি আরোপিত হবে, মালিকের অনুমতি ব্যতিরেকে গচ্ছিত দ্রব্য ব্যবহার করা হলে তৎপ্রেক্ষিতে কি ধরনের শাস্তি আরোপিত হবে, কীভাবে স্বর্ণকারদের সততা পরীক্ষা করা হবে, অসৎ স্বর্ণকারদের বিরুদ্ধে কি ধরনের শাস্তি আরোপিত হবে, ইত্যাকার বিবিধ বিষয়ে প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে এই অধ্যায়ে আলোকপাত করত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-১২-০১ উপনিধির ক্ষেত্রেও ঋণ পরিশোধ সম্পর্কিত নিয়মাবলি সমভাবে প্রযোজ্য হবে। মূল্যবান দ্রব্য গচ্ছিত রাখার সময় তা সীলমোহর করে সুরক্ষিত অবস্থায় গচ্ছিত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে শত্রুরাজ্য দ্বারা আক্রান্তের কারণে, দস্যুদের লুণ্ঠনের কারণে, বণিক সংঘ বিলুপ্তির কারণে, চক্রযুক্ত গাড়ির চাকা বিনষ্টজনিত কারণে, অগ্নিকাণ্ডের কারণে বা বন্যার কারণে যদি গচ্ছিত দ্রব্য নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব না হয় অথবা নৌকায় পরিবহন প্রাক্কালে জলমগ্নতার কারণে দ্রব্যের হেফাজতকারী ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও যদি গচ্ছিত দ্রব্য বিনষ্ট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে তা প্রত্যর্পণ করায় বাধ্যবাধকতা থাকবে না। উপনিধির স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ব্যতিরেকে যদি কোনো দ্রব্য হেফাজতকারী কর্তৃক ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাকে দ্রব্যটির ব্যবহার মূল্য ছাড়াও দণ্ড হিসেবে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। গচ্ছিত দ্রব্যটি বিনষ্ট হলে বা হারিয়ে গেলে হেফাজতকারী তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। দ্রব্য রক্ষকের মৃত্যু হলে বা সে বিপদাপন্ন হলে গচ্ছিত দ্রব্যের জন্য উত্থাপিত অভিযোগ গ্রহণ যোগ্য হবে না।
০৩-১২-০২ উপনিধির রক্ষক যদি দ্রব্যটি অন্যত্র স্থানান্তর করে, বিক্রয় করে বা আত্মসাৎ করে, তাহলে তাকে দ্রব্যটির চারগুণ অর্থমূল্য প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং একই সাথে পাঁচ চতুর্থাংশ জরিমানা প্রদান করতে হবে। বন্ধকের ক্ষেত্রেও উপরোক্ত উপনিধি বিষয়ক নিয়ম সমভাবে প্রযোজ্য হবে। বন্ধকীদ্রব্য ভোগ্য হলে তা বন্ধক গ্রহীতা কর্তৃক ভোগ করা যাবে কিন্তু কোনো অবস্থাতে তা বিনষ্ট করা যাবে না। যেমন গরু বন্ধক রাখা হলে বন্ধক গ্রহীতা তার দুগ্ধ ভোগ করতে পারবে। বন্ধকীদ্রব্যের উপর প্রদেয় সুদ বৃদ্ধি করা যাবে না, তবে নির্ধারিত সময়ে তা অবমুক্ত করা না হলে প্রযোজ্য সুদ বৃদ্ধি করা যাবে।
০৩-১২০৩ বন্ধকী দ্রব্যের অর্থ পরিশোধ করা হলে দ্রব্যটি তাৎক্ষণিক ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি তা বন্ধকগ্রহীতা কর্তৃক সময়মতো ফিরিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে তাকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। বন্ধকগ্রহীতা গৃহে অনুপস্থিত থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গ্রাম্য মুরুব্বিদের কাছে বন্ধকী দ্রব্যের নিষ্ক্রিয় মূল্য জমা রেখে দ্রব্যটি ফিরিয়ে নিতে পারবে। বন্ধককারী ইচ্ছে করলে দ্রব্যটি গচ্ছিতকারীর কাছে বিক্রি করতে পারে। বন্ধকী দ্রব্যটি যথাসময়ে ফেরত না পেলে ঋণগ্রহীতা প্রদেয় সুদ প্রদান বন্ধ করতে পারে বা দ্রব্যটি বন্ধক গ্রহীতার হেফাজতে রাখতে পারে। বন্ধকী দ্রব্যটি বিনষ্টের সম্ভাবনা দেখা দিলে ঋণগ্রহীতা বন্ধক গ্রহীতার অনুপস্থিতিতে বিচারক অথবা রাজকর্মচারীর আস্থাগ্রহণ সাপেক্ষে তা বিক্রয় করে দিতে পারে।
০৩-১২-০৪ ভূমি বা বৃক্ষ জাতীয় নিশ্চল সম্পত্তির বন্ধক গ্রহণকারীরা এ সমস্ত সম্পত্তিতে নিজ শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত ফসল ভোগের অধিকারী হবে, বন্ধকী ভূমিতে নির্মিত বাড়ির ভাড়া ভোগ করতে পারবে, এক্ষেত্রে প্রদেয় সুদ থেকে বাড়িভাড়া বাবদ প্রাপ্তঅর্থ বাদ দিতে হবে। ঋণগ্রহীতার অনুমতি ব্যতিরেকে বন্ধক গ্রহীতা বন্ধকী দ্রব্যের মাধ্যমে যা আয় করবে, তার লভ্যাংশ ঋণগ্রহীতাকে প্রদান করবে এবং লাভের একাংশ জরিমানা বাবদ রাজকোষে জমা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।
০৩-১২-০৫ কোনোকিছু কারও কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশকে বলা হয় আদেশ। কারও কাছে কিছু গচ্ছিত রেখে কিছুদিন পর অন্য লোকের মাধ্যমে তা ফেরত চাওয়াকে বলা হয় অন্বাধি। অন্বাধি বহনকারী ব্যক্তি যদি বণিকদের সঙ্গে গমন প্রাক্কালে দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারে বা সেই অন্বাধি যদি পথিমধ্যে দস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়, তাহলে তা প্রত্যর্পণ যোগ্য নাও হতে পারে। অম্বাধি বহনকারী কোনো ব্যক্তি যদি পথিমধ্যে প্রাণত্যাগ করে, তাহলে তার উত্তরাধিকারীরা তা প্রত্যর্পণে বাধ্য থাকবে না। ধার বা ভাড়া হিসেবে গৃহীত কোনোকিছু যে অবস্থায় গ্রহণ করা হবে অনুরূপভাবে তা ফেরত প্রদান করতে হবে। যদি কোনো গ্রহণকৃত দ্রব্য সময়ের ব্যবধানের কারণে, পশুর আক্রমণের কারণে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তা মালিককে প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এক্ষেত্রে উপনিধি বিধানের নিয়মাবলি সমভাবে প্রযোজ্য হবে।
০৩-১২-০৬ খুচরা পণ্য বিক্রেতারা বিক্রিত পণ্যের পণ্যমূল্য লভ্যাংশসহ মহাজন বা বণিকগণকে বুঝিয়ে দিবেন। স্থান কাল ভেদে যদি খুচরা বিক্রেতাদের কমমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হয়, তাহলে তারা সে অনুসারেই মহাজনকে পণ্যমূল্য ও মুনাফা বুঝিয়ে দিবেন। মহাজন কর্তৃক মূল্য নির্ধারণকৃত পণ্য বিক্রয় করে যদি অধিক মুনাফা অর্জিত হয়, তাহলে সে মুনাফা শুধু বিক্রেতাই গ্রহণ করবে এবং মহাজনকে শুধু তার পণ্যমূল্য প্রত্যর্পণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পণ্যটির বাজারমূল্য যদি হ্রাস পায়, তাহলে মহাজন উক্ত পণ্যের জন্য কম মূল্যই প্রাপ্য হবে।
০৩-১২-০৭ যারা বিশ্বস্ততার সাথে অন্যের মালামাল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে, তাদের মালামাল যদি পশুর আক্রমণজনিত কারণে বা আকস্মিক দুর্বিপাকের কারণে বিনষ্ট হয়, তাহলে সেসবের মূল্য মহাজনকে ফেরত প্রদান করতে হবে না। কোনো পণ্য দেশান্তরে বিক্রয় করা হলে আনুষঙ্গিক খরচাপাতি বাদ দিয়ে যে অতিরিক্ত লভ্যাংশ অবশিষ্ট থাকবে তার অংশ মহাজনকে প্রদান করতে হবে। কোনো খুচরা বিক্রেতা কর্তৃক এক সাথে অনেক ধরনের পণ্য বিক্রয় করা হলে সেক্ষেত্রে মহাজনকে পৃথক পৃথক পণ্যের মুনাফা বুঝিয়ে দিতে হবে।
০৩-১২-০৮ অলঙ্কার তৈরির নিমিত্ত স্বর্ণকারকে সোনা রূপা দেওয়াকে বলা হয় নিক্ষেপ। স্বর্ণালঙ্কার তৈরির নিমিত্ত প্রদত্ত সোনা রূপা যদি স্বর্ণকার কর্তৃক কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এ ধরণের নিক্ষিপ্ত দ্রব্য আত্মসাৎ করা হলে স্বর্ণকারের চারিত্রিক দিক বিশ্লেষণ করত সোনা রূপা প্রদানকারীর উপস্থাপিত প্রমাণের দ্বারা অভিযোগের বিহিত করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাররা সাধারণত অসৎ প্রকৃতির হয়ে থাকে, এরা গৃহীত দ্রব্যের প্রমাণ বা সাক্ষী রাখে না। যে কারণে দ্রব্য প্রদানকারীকে উপযুক্ত প্রমাণের মাধ্যমে স্বীয় অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়। এক্ষেত্রে গোপনে সাক্ষী রেখে বা মদ্যপানের উৎসবে কোনো এক অবসরে সুকৌশলে সাক্ষীদের মাধ্যমে কর্মকারের স্বীকারোক্তি আদায় করা যেতে পারে।
০৩-১২-০৯ অথবা কর্মকারের সততা পরীক্ষার জন্য এক নির্জন স্থানে কোনো এক বণিকের বিশেষ চিহ্নযুক্ত দ্রব্য কর্মকারের কাছে হস্তান্তর করে কিছুদিন পর ঐ বণিককে মৃত ঘোষণা করত তার পুত্র বা ভ্রাতার মাধ্যমে গচ্ছিত দ্রব্যটি ফেরত চাইতে হবে, কর্মকার যদি বণিকের বিশেষ চিহ্নযুক্ত দ্রব্যটি ফেরত প্রদান করে, তাহলে সে সৎ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। কর্মকার যদি সেটি ফেরত প্রদানে অস্বীকৃত হয়, তাহলে সে অসৎ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং চৌর্যবৃত্তির অপরাধে প্রযোজ্য শাস্তি ভোগ করবে।
০৩-১২-১০ অথবা কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছলনার আশ্রয় নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে বিশেষ চিহ্ন সম্বলিত কোনো দ্রব্য নিক্ষেপণরূপে উক্ত কর্মকারের কাছে গচ্ছিত রেখে অন্যত্র গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। অতঃপর কিছুকাল পর প্রত্যাবর্তন করে গচ্ছিত দ্রব্যটি তার কাছে ফেরত চাইবে, এ অবস্থায় কর্মকার কর্তৃক গচ্ছিত দ্রব্যটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যার্পিত হলে তার সততা পরীক্ষিত হবে এবং সে সৎ ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত হবে। কিন্তু সে যদি দ্রব্যটি ফেরত প্রদানে গড়িমসি করে বা অস্বীকৃত হয় এবং তল্লাশীর পর দ্রব্যটি যদি তার ঘরে খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সে অসৎ হিসেবে চিহ্নিত হবে, এক্ষেত্রে তাকে আটক করে চৌর্যবৃত্তির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড প্রদান করতে হবে। অথবা কোনো মূর্খের বেশধারী ব্যক্তি রাজপুরুষের মাধ্যমে আটক হবার আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে কোনো মূল্যবান দ্রব্য কর্মকারের কাছে গচ্ছিত রেখে গা ঢাকা দিবে এবং পরবর্তী সময়ে কারাগারে আটকাবস্থায় তার গচ্ছিত ধন ফেরত চাইবে, কর্মকার যদি গচ্ছিত দ্রব্যটি ফেরত প্রদান করে তাহলে সে সৎ বলে স্বীকৃত হবে, অন্যথায় তার বিরুদ্ধে উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় চৌর্যবৃত্তির শাস্তি আরোপিত হবে।
০৩-১২-১১ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশধারী ব্যক্তির জমাকৃত দ্রব্য যদি মৃত কর্মকারের পুত্র কর্তৃক প্রত্যর্পণ করা না হয়, তাহলে উক্ত পুত্রের বিরুদ্ধেও পূর্বোক্ত দণ্ডের মতো চৌর্যবৃত্তির শাস্তি আরোপিত হবে। কর্মকারের কাছে গচ্ছিত দ্রব্যাদির ব্যাপারে বিচারক অনুসন্ধান করবেন, তাদের সামর্থ বিশ্লেষণ করবেন এবং গচ্ছিত দ্রব্যের উৎস তালাশ করবেন, অতঃপর এ ব্যাপারে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এনে প্রত্যেকেই উপযুক্ত সাক্ষী সাবুদ রেখে সকল প্রকার দ্রব্যাদি গচ্ছিত রাখবে বা এতদ্সংক্রান্ত লেন-দেন করবে।
এ অধ্যায়ে দাসদের সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। কারা দাসের যোগ্য, কাদের দাস হিসেবে বিক্রয় বা ব্যবহার করা যাবে না, কীভাবে দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, দাসদের দিয়ে কি ধরনের কাজ করানো যাবে না, ইত্যাকার বিষয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
০৩-১৩-০১ যে শূদ্র অন্নের বিনিময়ে অন্যের দাসত্ব স্বীকার করবে, তাকে ছাড়া অন্য কোনো আর্য বা নাবালক শূদ্রকে দাস হিসেবে বিক্রি করা বা বন্ধক রাখা যাবে না, কেউ এরূপ অপরাধ করলে দণ্ড হিসেবে তার উপর ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এ ধরনের আর্য ও বৈশ্যকে কোনো স্বজন কর্তৃক বিক্রি করা হলে বা বন্ধক রাখা হলে তার উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ক্ষত্রিয়ের ক্ষেত্রে এ জরিমানা হবে ৩৬ পণ। ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে জরিমানা হবে ৪৮ পণ। আত্মীয় ব্যতীত অন্য কেউ যদি নাবালক শূদ্র বালককে দাস হিসেবে বিক্রির অবৈধ প্রয়াস গ্রহণ করে, তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। নাবালক বৈশ্যের ক্ষেত্রে এরূপ প্রয়াস গ্রহণ করা হলে ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং কেউ যদি নাবালক ব্রাহ্মণকে দাস হিসেবে বিক্রির অপপ্রয়াস গ্রহণ করে তাহলে তার উপর বধদণ্ড প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে ক্রেতা এবং সাক্ষীদানকারীদের উপরও সমহারে দণ্ড প্রযুক্ত হবে। কিন্তু ম্লেচ্ছ ব্যক্তি কর্তৃক সন্তানকে বিক্রি করা হলে বা বন্ধক রাখা হলে কোনো শাস্তি প্ৰযুক্ত হবে না। কোনো অবস্থাতেই কোনো আর্যকে দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না।
০৩-১৩-১৪ প্রয়োজনে বিপদকালীন অবস্থায় আর্যজনকে বণিকের কাছে বন্ধক রাখা যেতে পারে এবং আর্থিক সক্ষমতার পর তাকে বন্ধক মুক্ত করা যেতে পারে কিন্তু দাস হিসেবে কখনো বিক্রি করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি আর্থিক অনটনের কারণে বণিকের কাছে ধন গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে বন্ধক রাখার পর গৃহীত ধন ফেরত প্রদানের মাধ্যমে মুক্ত হলে সে আর দাস বৈশিষ্ট্যাপন্ন থাকবে না। এরূপ বন্ধককৃত ব্যক্তি যদি পলায়ন করে তাহলে সে মুক্ত বলে বিবেচিত হবে। স্বেচ্ছায় দাসত্বে নিবন্ধিত ব্যক্তি যদি একবার পলায়ন করে, তাহলে তাকে চিরতরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে হবে। অন্যের কাছে নিজেকে বন্ধককারী এবং যে অন্যলোক কর্তৃক বন্ধকী হবে, তারা যদি ভিন দেশে গমন করে তাহলে উভয়েই দণ্ডিত হবে। কোনো ব্যক্তি যদি বিত্ত হরণকারী দাসের আর্যত্ব হরণ করে তাহলে সে পূর্বে বর্ণিত দণ্ডের অর্ধেক দণ্ড ভোগ করবে। পলাতক, মৃত বা সংকটগ্রস্ত দাসের মূল্য গ্রহীতারা দাসমূল্য ফেরত প্রদান করবে।
০৩-১৩-০৩ বন্ধকী দাসদের দিয়ে কেউ যদি মৃতদেহ বহন করায়, বিষ্ঠা বা মলমূত্র পরিষ্কার করায় এবং এধরনের দাসীদের দিয়ে কেউ যদি নগ্ন পুরুষকে স্নান করায় বা তাদের শালীনতা হানি করে, তাহলে সে দাসরক্ষকের প্রদত্ত দাসমূল্য নাশ হবে অর্থাৎ সে আর দাসের বন্ধকী মূল্যের অধিকারী থাকবে না। একইভাবে কেউ যদি বন্ধকী ধাত্রী, সেবিকা, পরিচারিকা বা উপ পরিচারিকাদের দিয়ে অনুরূপ কাজ করায় তাহলে তারা মুক্ত হবার অধিকারী হবে অর্থাৎ তাদের উপর বন্ধক গ্রহীতার অধিকার অবলুপ্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে। কোনো বন্ধকী দাসীর গর্ভে যদি বন্ধকী দাস কর্তৃক সন্তান উৎপাদিত হয়, তাহলে সেই দাস তার নির্ধারিত কর্মক্ষেত্র থেকে অপসারিত হবে। কোনো রক্ষক যদি বন্ধকী দাসীকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বশে এনে তার সাথে ব্যাভিচার করে, তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। যে ধাত্রী রক্ষকের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত তার সাথে অনুরূপ ব্যাভিচার করা হলে দায়ী ব্যক্তিকে ৫০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো রক্ষক যদি নিজে বা অন্যের দ্বারা কোনো বন্ধকী কুমারী দাসীর কুমারিত্ব হরণ করে তাহলে সে তার বন্ধকী মূল্য ফেরত পাবে না, উপরোন্ত ঐ কুমারীকে অর্থ দণ্ড প্রদান করতে হবে এবং কুমারীকে প্রদেয় অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা রাজকোষে প্রদান করতে হবে।
০৩-১৩-০৪ কোনো ব্যক্তি নিজেকে দাস হিসেবে বিক্রয় প্রাক্কালে তার যদি সন্তান থেকে থাকে তাহলে সেসব সন্তান আগের মতোই পরিচিতি বহন করবে, অর্থাৎ বাবার দাসত্ব গ্রহণের কারণে সন্তানরা দাস বলে অভিহিত হবে না। আত্মবিক্রিত দাসরা মনিবের কাজে বিঘ্ন না ঘটিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করলে বা পৈত্রিক সূত্রে ধন-সম্পদের অধিকারী হলে সেসব ধন- সম্পদের উপর মুনিবের কোনো অধিকার স্বীকৃত হবে না। অধিকন্তু দাসত্বমূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে উক্ত দাসরা দাসত্বের শৃঙ্খল হতে অবমুক্ত হতে পারবে। বন্ধকী বা আত্মবিক্রয়কারী দাসরা দাসমূল্য পরিশোধ করে যে কোনো সময় মুক্ত হতে পারবে। শাস্তি হিসেবে কারও উপর আর্থিক জরিমানা আরোপিত হলে সে যদি তা পরিশোধ করতে অক্ষম হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি জরিমানার অর্থ সমন্বয় করতে পারবে।
১৩-০৩-১৩ কোনো ব্যক্তি তার গৃহের দাসীর গর্ভে জন্ম নেয়া, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, উপহার হিসেবে প্রাপ্ত, ক্রয়কৃত বা আত্মীয়-স্বজনহীন অনধিক আট বছর বয়সের কোনো দাসকে যদি ইচ্ছের বিরুদ্ধে হীনকর্মে নিযুক্ত করে, বিদেশে বিক্রি করে বা অন্যের কাছে বন্ধক রাখে, তাহলে উক্ত রক্ষককে দণ্ড হিসেবে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং কোনো রক্ষক যদি স্বীয় গৃহের গর্ভবতী দাসীর শুশ্রুষার জন্য পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা না করে তাকে বিক্রি করে দেয় বা অন্যের কাছে বন্ধক রাখে তাহলেও তাকে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। যারা এধরনের দাস-দাসী ক্রয় করবে বা এ ব্যাপারে সাক্ষী থাকবে তাদের উপরও একই হারে জরিমানা আরোপিত হবে। নিষ্ক্রিয় মূল্য বা মুক্তিপণ পরিশোধের পরও যদি কোনো রক্ষক তার দাসকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে না দেয়, তাহলে তাকে দণ্ড হিসেবে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। অকারণে কোনো দাসকে অবরুদ্ধ করে রাখা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই হারে জরিমানা আরোপিত হবে। দাসের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে দাসের মুনিব তার সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে।
০৩-১৩-০৬ মুনিবের বীর্য সঞ্চারণে দাসীর গর্ভে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে দাসী ও সন্তান উভয়েই মুক্ত বলে গণ্য হবে। কোনো দাসী যদি মুনিবের সন্তান জন্ম দিয়ে সংসারের দেখ-ভালের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে একই মুনিবের অধীনস্থ ঐ দাসীর মাতা, ভগ্নি ও ভ্রাতা দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করবে। কোনো দাস বা দাসী নিষ্ক্রিয় মূল্যের বিনিময়ে মুক্তি লাভ করার পর কেউ যদি তাকে পুনর্বার বিক্রি করে বা বন্ধক রাখে, তাহলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এরূপ দায়ী ব্যক্তিকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। তবে নিষ্ক্রিয় মূল্যের পরিবর্তে কেউ যদি স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
০৩-১৩-০৭ প্রতিবেশীরা কৃষক, গোপালক ও অন্যান্য কর্মকারদের কাজ ও বেতন বা মজুরির ব্যাপারে পরিজ্ঞাত থাকবে। কর্মকররা কাজের ধরন অনুযায়ী চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত বেতন বা মজুরি গ্রহণ করবে। কোনো কাজের বেতন যদি পূর্বেই নির্ধারিত না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কর্ম সম্পাদনের পর কৃষিকাজে নিয়োজিতরা উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ প্রাপ্য হবে, গোপালকরা উৎপাদিত দই বা ঘৃতের এক দশমাংশ প্রাপ্য হবে এবং বিপণন কর্মীরা বিক্রিত পণ্য মূল্যের এক দশমাংশ বেতন হিসেবে প্রাপ্য হবে।
০৩-১৩-০৮ বিভিন্ন শ্রেণির কারিগর, কুশীলব, গায়ক, অভিনেতা, চিকিৎসক, কথক, পরিচারক এবং অন্যান্য পেশার লোকরা সম্মানজনক হারে যে বেতনের প্রত্যাশায় কাজ করবে, সে রূপ হারে তাদের বেতন নির্ধারণ করতে হবে। অথবা এক্ষেত্রে অভিজ্ঞজনেরা যে বেতন নির্ধারণ করে দিবেন তারা সে পরিমাণ বেতন গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে বেতন সংক্রান্ত কোনো ধরনের মতদ্বৈততা উদ্ভূত হলে সাক্ষীদের সহায়তায় তা নিষ্পত্তিযোগ্য হবে, সাক্ষীদের অভাব হলে রাজকর্মচারীরা কাজের প্রকৃতি মূল্যায়ন করে এ সংক্রান্ত আপত্তি নিষ্পত্তি করে দিবেন। কাজ সমাপ্তির পর নির্ধারিত বেতন যদি পরিশোধ করা না হয়, সেক্ষেত্রে বেতনদাতাকে ছয় পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। যথার্থভাবে বেতন গ্রহণের পর তা অস্বীকার করা হলে বেতন গ্রহীতাকে ১২ পণ জরিমানা পরিশোধ করতে হবে।
০৩-১৩-০৯ বন্যা, অগ্নি, তস্কর বা কোনো হিংস্র জন্তুর কোপানলে পড়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে কেউ যদি নিজের সর্বস্বসহ স্ত্রী, পুত্র ও নিজেকে দাস হিসেবে আবদ্ধ রাখার প্রতিজ্ঞবদ্ধ হয়ে নিষ্কৃতির প্রত্যাশা ব্যক্ত করে কারও দ্বারা উদ্ধার লাভ করে, তাহলে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারীকে বিশিষ্টজন কর্তৃক ধার্যকৃত বেতন পরিশোধ করতে হবে। কোনো পতিতা বা রক্ষিতার উপর কেউ যদি উপগত হয় এবং তা যদি কোনো আলামতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, তাহলে উক্ত পতিতা বা রক্ষিতা উপভোগকারীর কাছ থেকে ভোগমূল্য তথা ভোগের জন্য প্রযোজ্য পারিশ্রমিক তথা বেতন লাভ করবে। এক্ষেত্রে উক্ত পতিতা কর্তৃক অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হলে তা নাকচ হয়ে যাবে এবং তজ্জন্য তাকে দণ্ডিত হতে হবে।
এই অধ্যায়ে মজুর এবং সংঘবদ্ধ শ্রমজীবীদের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মজুররা মজুরি গ্রহণ সত্ত্বেও কাজ না করলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের শাস্তি আরোপিত হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মজুর বা সংঘবদ্ধ শ্রমজীবীদের উপর দণ্ড প্রযুক্ত হবে না, ইত্যাকার বিষয়ে আলোকপাত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-১৪-০১ মজুরি গ্রহণ সত্ত্বেও কোনো মজুর যদি কার্য সম্পাদন না করে, তাহলে তাকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে কার্য সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মজুরকে অবরুদ্ধ করা যাবে। মজুর যদি যে কাজের জন্য মজুরি গ্রহণ করেছে তা সম্পাদন করতে অক্ষম হয়, সে কাজ যদি হীন প্রকৃতির হয়, সে মজুর যদি ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হয়, স্বজনের মৃত্যুজনিত কারণে বিপদাপন্ন হয়, তাহলে সে কাজ না করলেও অপরাধী হবে না, অথবা এ ক্ষেত্রে ঐ মজুর তার করণীয় কাজটি অন্য কারও দ্বারা সম্পাদন করাতে পারবে।
০৩-১৪-০২ কোনো কাজের ব্যাপারে মুনিবের সঙ্গে যদি ভৃত্যের পারস্পরিক সমঝোতামূলক চুক্তি হয়ে থাকে, অতঃপর মুনিব যদি ভৃত্যকে দিয়ে কাজ না করায় বা ভৃত্য যদি মনিবের কাজ না করে, সেক্ষেত্রে উভয়ের বিরুদ্ধে ১২ পণ হারে জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে মজুর যদি কারও কাছ থেকে অগ্রিম গ্রহণ করে থাকে সেক্ষেত্রেও তাকে আগে চুক্তিবদ্ধ মুনিবের কর্ম সম্পাদন করতে হবে অতঃপর অন্যের কাজে সে নিযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে পূর্বের আচার্যদের অভিমত এই যে, কাজের জন্য কোনো মজুর উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও মুনিব যদি তাকে দিয়ে কাজ না করায়, তাহলে কাজটি ঐ মজুরের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কৌটিল্য মনে করেন—এ ধরনের যুক্তি মানা যায় না, তার যুক্তিতে কাজের জন্যই মজুরি প্রদান করা হয়ে থাকে, কাজ না করলে মজুরি প্রদান করা যায় না। মুনিব যদি কোনো কাজের অংশ বিশেষ করিয়ে আর কাজ না করায় সেক্ষেত্রে ভৃত্যকে পূর্ণ মজুরিই প্রদান করতে হবে। ভৃত্য যদি নির্ধারিত সময়ে, নির্ধারিত স্থানে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে করণীয় কাজটি সম্পন্ন না করে, তাহলে মুনিব ঐ কাজটি তার পছন্দ মাফিক হয়নি বলে বাতিল করে দিতে পারে। ভৃত্য যদি নির্ধারিত কাজের অধিক কাজ সম্পাদন করে, সেক্ষেত্রে মুনিব কর্তৃক তা অবমূল্যায়িত হবে না, এক্ষেত্রে মনিব ভৃত্যকে বাড়তি কাজের জন্য উপযুক্ত মজুরি প্রদান করবে।
০৩-১৪-০৩ সঙ্ঘভুক্ত শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রেও উপরোক্ত নিয়মাবলি প্রযোজ্য হবে। সঙ্ঘভুক্ত মজুরের কাজের মেয়াদ সাতদিন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, সাতদিন পর মজুর পরিবর্তন করে নতুন মজুর নিয়োগ করতে হবে। সঙ্ঘপ্রধানকে অবহিত না করে সঙ্ঘভুক্ত কোনো মজুরকে কর্মচ্যুত করা যাবে না এবং সঙ্ঘে কোনো নতুন মজুরকেও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এ নিয়ম কারও দ্বারা লঙ্ঘিত হলে তাকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। সঙ্ঘ প্রধানকে অবহিত না করে কেউ সঙ্ঘ পরিত্যাগ করলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।
০৩-১৪-০৪ সঙ্ঘভুক্ত মজুররা চুক্তি মোতাবেক মজুরি গ্রহণ করবে, অথবা গৃহীত মজুরি সকলে সমভাবে ভাগ করে নিবে। ফসল উৎপাদন থেকে এর বিপণন কাল পর্যন্ত কার্যে নিযুক্ত থাকাকালে কোনো মজুর যদি অসুস্থতাজনিত কারণে কর্ম থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে উক্ত মজুর যে সময় পর্যন্ত কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকবে সে-সময় পর্যন্ত সে তার মজুরি প্রাপ্য হবে। অসুস্থ ব্যক্তির কাজ যদি অন্য কেউ করে দেয় তাহলে সে ব্যক্তি সেই অতিরিক্ত কাজের মজুরি পাবে। এরূপ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কর্মে পণ্যের লাভ লোকসান যা-ই হোক না কেন, মজুরের মজুরির কোনো তারতম্য হবে না।
০৩-১৪-০৫ সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কেউ যদি সুস্থাবস্থায় কর্ম পরিত্যাগ করে চলে যায়, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। সঙ্ঘবদ্ধ কোনো মজুরের সঙ্ঘ পরিত্যাগ করে চলে যাবার অধিকার অনুমোদনযোগ্য নয়। কোনো মজুর তার করণীয় কর্মের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করলে, প্রাথমিক অবস্থায় তাকে অভয় প্রদর্শন করত তার কর্মকৃত মজুরির সম্ভাব্য অংশপ্রদানের আশ্বাস প্রদান করে কর্মে মনোযোগী করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, দ্বিতীয়বার কর্মে ফাঁকি দিলে বা কর্মস্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলে উক্ত মজুরকে সঙ্ঘচ্যুত করতে হবে। ঐ মজুরের অপরাধ যদি গুরুতর হয়, তাহলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকের মতো ব্যবহার করতে হবে।
০৩-১৪-০৬ যজ্ঞসম্পাদনকারী যাজকরা নিজ নিজ মজুরি ছাড়াও গৃহস্থের প্রদত্ত দ্রব্যাদি সমভাবে বণ্টন করে নিবেন। অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞে দীক্ষার কাজ সমাপ্তির পর কোনো যাজক যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে তিনি প্রাপ্ত দক্ষিণার এক পঞ্চমাংশ ভাগ পাবেন। সোম বিক্রয়ের পরবর্তী যজ্ঞ সমাপ্তির পর অসুস্থ হলে তিনি প্রাপ্ত দক্ষিণার এক চতুর্থাংশ পাবেন। মধ্যমোপসদের প্রবর্গোদ্বাসন নামীয় যজ্ঞ সমাপ্তির পর অসুস্থ হলে যাজক তার অংশের তিনের একভাগ দক্ষিণা পাবে। এভাবে অসুস্থ যাজকরা বিভিন্ন যজ্ঞের জন্য দক্ষিণার বিভিন্ন অংশ প্রাপ্যতা অনুযায়ী লাভ করবেন।
০৩-১৪-০৭ যজ্ঞ অসমাপ্ত অবস্থায় যাজকরা অসুস্থ হলে বা ব্যাধিগ্রস্ত হলে অন্য বিশ্বাসী যাজকরা বা ঋত্বিকরা অবশিষ্ট দক্ষিণা গ্রহণ করে অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে দিবেন। যজ্ঞ অসমাপ্ত অবস্থায় পরিত্যক্ত হলে দায়ী যাজক বা যাজ্যকে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। তবে আবশ্যকীয় কারণে যজ্ঞ পরিত্যক্ত হলে কেউ দোষী সাব্যস্ত হবেন না। শত সংখ্যক গো-সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যে ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র করেন না, সহস্র গো-সম্পদের অধিকারী হয়েও যে ব্রাহ্মণ যজ্ঞ করেন না, যে ব্রাহ্মণ মদ্যপ, যে ব্রাহ্মণ শূদ্র নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন, যে ব্রাহ্মণ হত্যাকারী, যে ব্রাহ্মণ গুরু পত্নীর সঙ্গে ব্যাভিচার করে, যে ব্রাহ্মণ পাপিষ্ঠ ব্যক্তির কাছ থেকে নিষিদ্ধ দ্রব্য গ্রহণে আসক্ত, যে যাজ্য নিজে চোর এবং যে যাজক নিন্দিত যাজ্যের পক্ষে যজন করে, এ ধরনের যাজক বা যাজ্য যজ্ঞকালে যজ্ঞ অসমাপ্ত রেখে একে অপরকে পরিত্যাগ করলে তা কখনো দোষণীয় হবে না।
এই অধ্যায়ে পণ্য দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিক্রিত পণ্য ক্রেতাকে সময়মতো হস্তান্তর করা না হলে, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য সরবরাহ করা হলে কি প্রকার শাস্তি প্রযুক্ত হবে, ইত্যাকার বিষয়ে এ পর্যায়ে আলোচনা ও করণীয় সম্পর্কিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-১৫-০১ বিক্রয় করার পর কোনো বিক্রেতা যদি ক্রেতাকে তার ক্রয়কৃত পণ্য সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। তবে পণ্যটি যদি ত্রুটিযুক্ত হয়, ক্ষতিকারক হয় বা ব্যবহার অনুপযোগী বলে প্রতীয়মান হয়, সে ক্ষেত্রে তা সরবরাহ না করলেও বিক্রেতার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি প্রযুক্ত হবে না। কোনো পণ্য স্বাভাবিকভাবে ত্রুটিযুক্ত হলে তা দোষ হিসেবে বিবেচ্য হবে। যে সব পণ্য দণ্ড হিসেবে রাজকোষে জমাকৃত, চোরের দ্বারা অপহৃত হবার শঙ্কাযুক্ত, আগুন বা প্লাবনে বিনষ্ট হবার শঙ্কাযুক্ত, সে সব পণ্যকে উপনিপাত বলা হয়। যেসব পণ্যের গুণগত মানের আধিক্য কম এবং যেসব পণ্য অসুস্থ লোকের দ্বারা প্রস্তুত, সেসব পণ্যকে বলা হয় অবিষহ্য।
পণ্য বিক্রেতা বণিকদের সঙ্গে এ সমস্ত ত্রুটিপূর্ণ পণ্য নিয়ে আপত্তি উত্থাপিত হলে একদিনের মধ্যেই তার নিষ্পত্তি করতে হবে, কৃষকদের সঙ্গে এই নিষ্পত্তি কাল হবে তিন দিন, রাখালদের ক্ষেত্রে এর মেয়াদকাল হবে পাঁচদিন, শঙ্করজাতি ও উচ্চবর্ণের উচ্চপেশায় নিযুক্তদের সঙ্গে বেচাকেনা প্রাক্কালে এ ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হলে তার নিষ্পত্তি কাল হবে সাতদিন। সাত দিন অতিবাহিত হলে যেসব পণ্য বিনষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে, বিক্রি করা সম্ভব হবে না, সেসব পণ্যদ্রব্যের বাছাই ও প্রত্যাহার কাল স্থির করতে হবে, এর অন্যথা হলে দায়ী ব্যক্তিকে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে বা পণ্যটির বিক্রয় মূল্যের দশের এক ভাগ জরিমানা প্রদান করতে হবে।
০৩-১৫-০২ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের বিবাহের সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণের পরও পাণিগ্রহণের পূর্বে তা প্রত্যাহার করা যাবে। শূদ্রের ক্ষেত্রে বাসর রাতের আগ পর্যন্ত তথা স্বামী স্ত্রীর সঙ্গমের পূর্ব পর্যন্ত বিবাহ প্রত্যাহার বা বাতিল করা যাবে। স্বামীর যৌন অক্ষমতা পরিলক্ষিত হলে বা স্ত্রীর বিক্ষতযোনি পরিলক্ষিত হলে স্বামী স্ত্রীর প্রথম মিলনের পূর্বে উপরোক্ত তিন বর্ণের ক্ষেত্রেও বিবাহ বাতিল হতে পারে। সন্তান লাভের পর এহেন অবস্থা পরিলক্ষিত হলে বিবাহ বাতিল সমীচীন হবে না।
০৩-১৫-০৩ যৌন অক্ষমতার বিষয়টি গোপন রেখে কোনো কন্যার বিয়ে দেওয়া হলে দায়ী কন্যার পিতাকে ৯৬ পণ জরিমানাসহ বিবাহশুল্ক ও স্ত্রীধন প্রত্যর্পণ করতে হবে। একই অপরাধে পুরুষের দণ্ড হবে দ্বিগুণ এবং তার বিবাহ শুল্ক ও স্ত্রীধনের দাবি নাকচ হয়ে যাবে।
০৩-১৫-০৩ কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কুষ্ঠরোগাক্রান্ত দাস-দাসী ও গবাদিপশু বিক্রয় করা হলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। বিক্রয়ের তিন সপ্তাহের মধ্যে এ ধরনের আলামত পরিদৃষ্ট হলে বিক্রিত গবাদি পশু ফিরিয়ে নিতে হবে। দাস-দাসীর ক্ষেত্রে এর মেয়াদ হবে এক বছর অর্থাৎ বিক্রি করার এক বছরের মধ্যে রোগের আলামত পরিদৃষ্ট হলে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
এই অধ্যায়ে প্রতিশ্রুত বস্তু প্রদান না করা, অনুপযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে দান ফেরত গ্রহণ, জামিনদার মৃত পিতার দায়-দেনা পরিশোধ, ইত্যাকার বিবিধ বিষয়ের উপর আলোকপাত করত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-১৬-০১ প্রতিশ্রুত কোনো দ্রব্য প্রতিশ্রুতি মোতাবেক প্রত্যর্পণ না করা হলে তা ঋণের সমতুল্য বলে বিবেচিত হবে। প্রদেয় বস্তুটি যদি ব্যবহারের উপযোগী না হয় এবং এ ব্যাপারে যদি কোনো ধরনের দ্বিধা দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তাহলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো একজন উপযুক্ত ব্যক্তির হেফাজতে তা সংরক্ষণ করতে হবে। কেউ যদি নিজের সর্বস্ব, পুত্র, স্ত্রী এবং নিজেকে অন্যের সমীপে দান হিসেবে সমর্পণ করার পর প্রত্যাহৃত হতে চায়, সেক্ষেত্রে বিচারক ঐ ব্যক্তির সবকিছু প্রত্যাহার করার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করবেন।
কাউকে বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী মনে করে যদি ধর্মীয় কার্য সম্পাদনের জন্য কিছু দান করা হয়, অতঃপর যদি উক্ত ব্যক্তি অসাধু বলে পরিজ্ঞাত হয় অথবা দানকৃত অর্থ কোনো অর্থনাশকারী ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়েছে বলে যদি জানা যায়, তাহলে সে অর্থ বিচারক কর্তৃক ফেরত গ্রহণ করত অর্থদাতার কাছে প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে। যে ব্যক্তি কারও উপকার না করে অপকার করে, সে ব্যক্তিকে অর্থদানের পরে তা যদি পরিজ্ঞাত হয় এবং এ সংক্রান্ত আপত্তি উত্থাপিত হয়, তাহলে তা বিচারক কর্তৃক ফেরত গ্রহণ করত উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রাখা যেতে পারে বা অর্থদাতার কাছে প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে। অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত মনে করে কেউ যদি প্রেম বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোনোকিছু দান করে এবং পরবর্তী সময়ে যদি তার ভুল ভাঙে তাহলে বিচারক কর্তৃক প্রদত্ত বস্তু প্রত্যাহৃত হতে পারে। এক্ষেত্রে বিচারকগণ দান প্রত্যাহারের ব্যাপারে এমনভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যাতে করে দাতা এবং দান গ্রহীতার কেউই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
০৩-১৬-০২ শাস্তি, নিন্দা এবং বিপত্তির ভয় দেখিয়ে কেউ যদি দান গ্রহণ করে তাহলে তাকে চৌর্যবৃত্তির জন্য প্রযোজ্য শাস্তি ভোগ করতে হবে, এ ধরনের কাজে সহায়তাকারীদেরও একই ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হবে। অন্যের ক্ষতিসাধনার্থে বা অন্যকে হত্যা করার জন্য রোষদান প্রদান করা হলে দাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই স্তেয়দণ্ড বা চৌর্যবৃত্তির জন্য নির্ধারণকৃত দণ্ড ভোগ করতে হবে। কেউ যদি দর্পদান করে তথা আত্মগরিমার বশবর্তী হয়ে রাজা কর্তৃক দানকৃত বস্তুর তুলনায় অধিক মূল্যবান বস্তু দান করে, তাহলে দাতা এবং দান গ্রহীতা উভয়কেই শাস্তি ভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তির উপর আরোপিত হবে উত্তম সাহসদণ্ড বা ১০০০ পণ জরিমানা। কোনো জামিনদারের মৃত্যু হলে তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী পুত্ররা পিতার জামিনকৃত অর্থ, জামিনকৃত শুল্ক, জুয়ার দায় দেনা, সুরাপানজনিত বকেয়া, নট-নর্তকীদের প্রতিশ্রুত বকেয়ার ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকবে না, পুত্ররা এধরনের দায়-দেনা ইচ্ছে হলে পরিশোধ করতে পারে, ইচ্ছুক না হলে পরিশোধ নাও করতে পারে। এ ধরনের দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
০৩-১৬-০৩ কারও হারিয়ে যাওয়া বস্তু যদি অন্যের কাছে পাওয়া যায়, তাহলে সেই বস্তুর মালিক বিচারকের সহায়তায় উক্ত অপরাধীকে ধরিয়ে দিবে। স্থান এবং সময়ের অসুবিধাজনিত কারণে বিচারককে বিষয়টি অবহিত করা সম্ভব না হলে দ্রব্যের মালিক স্বয়ং এরূপ ব্যক্তিকে আটক করে বিচারকের সম্মুখে দাঁড় করাতে পারে। এরূপ আটক ব্যক্তিকে বিচারক কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদকালে যদি কথিত বস্তু সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া না যায় তাহলে তাকে দণ্ডিত হতে হবে কিংবা জিজ্ঞাসাবাদকালে যদি উক্ত আটক ব্যক্তি বস্তুটির প্রাপ্তির উৎস সম্পর্কে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হয় এবং এক্ষেত্রে যদি তার অপরাধ প্রমাণিত না হয়, তাহলে বিচারক বস্তুটি প্রকৃত মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ করে আটক ব্যক্তিকে মুক্ত করে দিবেন।
০৩-১৬-০৪ কোনো হারানো বস্তু স্বত্বাধিকারীর সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে তিনি তা ফেরত পাবেন। উপযুক্ত প্রমাণ ব্যতিরেকে এ ধরনের দাবি পেশ করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রব্যটির প্রকৃতমূল্যের পাঁচ ভাগের একভাগ জরিমানা আরোপিত হবে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজা দ্রব্যটির অধিকারী হবেন। আদালতের অনুমতি গ্রহণ না করে কেউ যদি তার অপহৃত দ্রব্যটি কারো কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, তাহলে তাকে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। হারানো বা অপহৃত কোনো দ্রব্য উদ্ধারপ্রাপ্ত হলে তা শুল্ক আদায়ের অফিস ঘরে জমা রাখতে হবে, দেড় মাসের মধ্যে দ্রব্যটির স্বত্বের প্রমাণ দাখিল করে এর মালিক তা গ্রহণ করতে পারবে, এ সময়ের মধ্যে দ্রব্যটির সন্ধানে কেউ হাজির না হলে রাজা কর্তৃক তা অধিকৃত হবে।
০৩-১৬-০৫ একইভাবে শুল্ক অফিসে আনীত কোনো উদ্ধারকৃত দাস-দাসীর মালিকানা স্বত্ব প্রমাণ করতে পারলে মুনিব কর্তৃক পাঁচ পণ নিষ্ক্রিয় মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে তা ফেরত নেয়া যাবে। একই তরিকায় প্রমাণ দাখিল সাপেক্ষে মালিক কর্তৃক অশ্ব ও গর্দভের জন্য চার পণ, গরু ও মহিষের জন্য দুই পণ, ভেড়া ও ছাগলের জন্য চারের এক পণ এবং অন্যান্য মূল্যবান ও বনজ সম্পদের জন্য পাঁচ পণ নিষ্ক্রিয় মূল্য পরিশোধ করে উদ্ধারকৃত জীবজন্তু বা দ্রব্যাদি ফেরত নেয়া যাবে। শত্রুপক্ষ বা অরণ্যবাসীদের দ্বারা অপহৃত কোনো দ্রব্য উদ্ধার করা হলে, রাজার প্রত্যয়ন সাপেক্ষে তা প্রকৃত মালিকের কাছে প্রত্যর্পিত হবে। চোর বা অন্য কারো দ্বারা অপহৃত কোনো দ্রব্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে রাজা তার রাজকোষ থেকে ঐ জাতীয় দ্রব্য বা দ্রব্যের সমমূল্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্ৰদান করবেন। কোনো রাজপুরুষের মাধ্যমে অনুরূপ চুরিকৃত দ্রব্য উদ্ধারপ্রাপ্ত হলে, রাজা তা প্রকৃত স্বত্বাধিকারীকে ফিরিয়ে দিবেন। কোনো দুঃসাহসিক ব্যক্তি কর্তৃক পররাজ্য থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করে আনীত হলে, রাজা তাকে সে সম্পদ ভোগের অনুমতি প্রদান করবেন। একইভাবে কোনো সদ্গুণসম্পন্ন আর্য, ব্ৰাহ্মণ বা তপস্বীর ধন সম্পদ লুণ্ঠন করা হলে, তা ভোগ যোগ্য হবে না, তা তাদের অভোগ্য অবস্থায় ফেরত প্রদান করতে হবে।
০৩-১৬-০৬ কোনো দ্রব্যের স্বত্ব নির্ণয়ের জন্য যদি দাবিদার পাওয়া না যায়, তাহলে যিনি অবিচ্ছিন্নভাবে দ্রব্যটি ভোগ করতে থাকবেন তিনিই তার অধিকারী হবেন। কারো কোনোকিছু যদি দশ বছর অন্যের হেফাজতে থাকে এবং তার মালিকানার দিকটি যদি মালিক কর্তৃক উপেক্ষিত হয় তাহলে তা উক্ত হেফাজতকারী বা ব্যবহারকারীর মালিকানায় চলে যাবে। কিন্তু বালক, বৃদ্ধ, রোগগ্রস্থ, বিপদগ্রস্থ, প্রবাসী, কোনো কারণবশত দেশত্যাগকারী বা রাজনৈতিক কারণে নিপতিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। দশ বছর অতিক্রান্ত হলেও সম্পদের উপর এদের মালিকানা স্বত্ব বহাল থাকবে।
যদি কারো বাস্তভিটা বিশ বছরকাল অন্যের দ্বারা অধিকৃত থাকে এবং মালিক কর্তৃক মালিকানা স্বত্ব উপেক্ষা করা হয়, তাহলে উক্ত বাস্তভিটার উপর প্রকৃত মালিকের কোনো মালিকানা স্বত্ব বহাল থাকবে না। তবে মালিকের আত্মীয়, বেদ অধ্যয়নকারী ব্রাহ্মণ এবং অন্য ধর্মাবলম্বী বা পাষণ্ডরা অন্যের বাস্তভিটায় এভাবে অবস্থান সত্ত্বেও ওতে তাদের মালিকানার স্বত্ব অস্বীকৃত হবে না। এছাড়াও কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে কারো রক্ষিত আমানত, বন্ধকী সম্পদ, অলঙ্কার তৈরির জন্য প্রদত্ত সোনা রূপা, অন্যের স্ত্রী, ভূমির সীমানা, রাজদ্রব্য এবং বেদ অধ্যয়নকারীর দ্রব্য ভোগ করা হলেও তাতে তার কোনো মালিকানা স্বত্বের অধিকার স্বীকৃত হবে না।
০৩-১৬-০৭ আশ্রমবাসী এবং বিধর্মীরা একে অপরের অসুবিধা সৃষ্টি না করে বিস্তৃত এলাকায় বসবাস করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুরাতন অধিবাসীরা নবাগতদের বসবাসের জন্য আংশিক স্থান ছেড়ে দিবেন। পুরাতন অধিবাসীদের কেউ স্থান পরিত্যাগে অস্বীকৃত হলে বহিষ্কৃত হতে হবে। বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাসী, যতি বা ইন্দ্ৰিয় বশে রাখতে সমর্থ সংসারত্যাগী বা আশ্রমে বেদাধ্যায়ীদের মৃত্যু হলে তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাদের গুরু, শিষ্য, ধর্মভাই অথবা গুরুকুলবাসী।
০৩-১৬-০৮ উপরোক্ত ধরনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে বানপ্রস্থাদি ব্যক্তিদের মধ্যে বিবাদ সূচিত হলে যত পণ দণ্ড আরোপিত হবে তার আলোকে তারা রাজার কল্যাণ কামনায় তত রাত্রিব্যাপী উপবাস, স্নান, অগ্নিকার্য ও মহাকৃচ্ছ্রবর্ধন ব্রত করবেন। যেসব বিধর্মী এবং সাধুজন সম্পত্তির বিবাদজনিত কারণে দণ্ডিত হয়ে অর্থের অভাবে আরোপিত জরিমানা পরিশোধে অক্ষম হবে তারাও রাজার কল্যাণ কামনায় উপরোক্ত ব্রতচরণের মাধ্যমে নিজেদের দায়মুক্ত করবে। কিন্তু তারা যদি পরস্পর হানাহানি করে, চৌর্যবৃত্তিতে যুক্ত হয় বা ব্যাভিচারে ব্যাপ্ত হয় তাহলে তারা শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাবে না, তাদের আরোপিত দণ্ড ভোগ করতেই হবে। রাজা প্রয়োজনীয় দণ্ড বিধানের মাধ্যমে মিথ্যাচারী কপট সন্ন্যাস গ্রহণকারী ব্যক্তিদের কার্যকলাপ প্রতিরোধ করবেন। কারণ ধর্ম যদি অধর্মের প্রভাবে উপদ্রুত হয় বা উপেক্ষিত হয় তাহলে শাসনকারী রাজাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন।
এই অধ্যায়ে সাহস বা বলপূর্বক দ্রব্য অপহরণের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন ধরনের দ্রব্য অপহৃত হলে কি ধরনের শাস্তি বা দণ্ড প্রযুক্ত হবে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
০৩-১৭-০১ সর্ব সমক্ষে বলপূর্বক কোনোকিছু অধিকার করাকে সাহস বলা হয়। বলপূর্বক দ্রব্য অপহরণের পর তা অস্বীকার করা হলে তাকে বলা হয় স্তেয় বা চৌর্য। মনুর শিষ্যদের মতানুযায়ী—রত্নালঙ্কার, মূল্যবান দ্রব্য এবং অল্প মূল্যমানের দ্রব্য অপহরণ করা হলে অপহরণকারীকে সেসব দ্রব্যের মূল্যমানের সম পরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। শুক্রাচার্যের অনুসারীদের অভিমত হলো—উপরোক্ত অপহরণের জন্য শাস্তি হিসেবে দ্রব্য মূল্যের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে কৌটিল্যের অভিমত হলো—অপরাধের মানদণ্ডে শাস্তি আরোপিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ফুল, ফল, শাক, মূল, কন্দ, ভাত, চামড়াজাত দ্রব্য, বাঁশের দ্রব্য এবং মৃৎপাত্র জাতীয় স্বল্পমূল্যের দ্রব্যাদি বলপূর্বক ছিনতাই করা হলে অপরাধীর উপর ১২ থেকে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
০৩-১৭-০২ লোহা, কাঠ ও রজ্জুজাত দ্রব্য। ক্ষুদ্র পশু তথা ভেড়া, ছাগল, বস্ত্রাদি এবং এ জাতীয় স্থুল দ্রব্যাদি বলপূর্বক অপহরণ বা ছিনতাই করা হলে অপহরণকারীর উপর ন্যূনতম ২৪ পণ এবং সর্বোচ্চ ৪৮ পণ জরিমানা অরোপণ প্রযোজ্য হবে। তামা, ইস্পাত, কাঁসা, কাচ বা হাতির দাঁতের তৈরি স্থুল দ্রব্যাদি বলপূর্বক অপহরণ বা ছিনতাই করা হলে ন্যূনতম ৪৮ পণ এবং সর্বোচ্চ ৯৬ পণ জরিমানা আরোপযোগ্য হবে। গো-মহিষ জাতীয় মহাপশু, মানুষ, ভূমি, গৃহ, নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার এবং সূক্ষ্মবস্ত্রাদি জাতীয় কিছু অপহৃত বা ছিনতাই করা হলে ন্যূনতম ২০০ পণ এবং সর্বোচ্চ ৫০০ পণ জরিমানা আরোপযোগ্য হবে।
০৩-১৭-০৩ কৌটিল্যের পূর্বকালের আচার্যদের মতানুযায়ী—বলপূর্বক নারী বা পুরুষকে জিম্মি করলে বা কারো দ্বারা জিম্মি করালে বা জিম্মি করার পর মুক্ত করা হলে, এহেন কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকবে তাদের উপর ন্যূনতম ৫০০ পণ এবং সর্বোচ্চ ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। আচার্য বৃহস্পতির অনুসারীদের মতানুযায়ী—যে ব্যক্তি অপহরণের ঘোষণা দিয়ে দৃঢ়তার সাথে পরদ্রব্য অপহরণের কাজে মত্ত হবে, তাকে অপহৃত দ্রব্যের দ্বিগুণ দণ্ড প্রদান করতে হবে। যে ব্যক্তি অন্যকে অর্থের প্রলোভন দিয়ে অপহরণ কার্যে প্ররোচিত করবে, তার উপর অপহৃত দ্রব্যের চতুর্গুণ দণ্ড আরোপিত হবে। যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রলোভন দিয়ে অন্যকে অপহরণ কর্ম সম্পাদনের জন্য প্ররোচিত করবে, তার উপর ঐ পরিমাণ অর্থ এবং আরও অতিরিক্ত জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে কৌটিল্যের অভিমত এই যে, অপহরণকারী ব্যক্তি যদি ক্রোধ, উন্মত্ততা বা চিত্তবিভ্রমের কারণে অপহরণ কার্য করে থাকে তাহলে তার উপর উপরোক্ত শাস্তিই আরোপিত হবে।
০৩-১৭-০৪ দণ্ড হিসেবে আরোপিত শত পণের অধিক সব ধরনের আর্থিক জরিমানার ক্ষেত্রেই প্রতি একশ পণে আট পণ হারে রূপ নামক অতিরিক্ত জরিমানা যুক্ত হবে এবং শত পণের কম জরিমানা প্রযুক্ত হলে ব্যাজী নামক এই অতিরিক্ত আদায়ের হার হবে শতকরা পাঁচ ভাগ। জরিমানা আদায়ের সময় ইচ্ছেমতো রূপ ও ব্যাজী আদায় করা যাবে না। সর্বক্ষেত্রে শাস্ত্র নির্ধারিত দণ্ড তথা জরিমানা আরোপণ ধর্মসঙ্গত বলে বিবেচিত হবে।
ব্যক্তি বিশেষের অঙ্গ বৈকল্য উল্লেখপূর্বক গালমন্দ করাকে বলা হয় উপবাদ, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত বা উম্মাদ বলে গালমন্দ করাকে বলা হয় কুসন এবং হত্যার ভীতি প্রদর্শন করে গালিগালাজ করাকে বলা হয় অভির্ভৎসন এবং এভাবে কাউকে কটুবাক্য দ্বারা আক্রমণ করাকে বলা হয় বাপারুষ্য। এই অধ্যায়ে এসব বিষয়ের উপর আলোকপাত করত এতদসংক্রান্ত শাস্তির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
০৩-১৮-০১ শরীর, প্রকৃতি, বংশ, শাস্ত্রজ্ঞান, পেশা এবং জন্মস্থান বাপারুষ্যের বিষয়বস্তু হতে পারে। কেউ যদি কোনো প্রতিবন্ধী বোবা বা অন্ধকে তার প্রকৃত নাম ধরে সম্বোধন না করে কানা, আন্ধা বা বোবা বলে সম্বোধন করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে কৃত অপরাধের জন্য তিন পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে এরূপ বিদ্রুপাত্মকভাবে সম্বোধন করা হলে দায়ী ব্যক্তিকে ছয় পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কেউ যদি কোনো অন্ধ ব্যক্তিকে সুন্দর চোখের অধিকারী বলে প্রকারান্তরে উপহাস করে, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তিকে কেউ কুষ্ঠরোগাক্রান্ত, উন্মাদ বা ক্লীব বলে গালমন্দ করলে তাকেও একই হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে।
০৩-১৮-০২ সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কেউ যদি একে অপরকে কোনো ধরনের দেহ বৈকল্যের উদ্ধৃতি দিয়ে নিন্দাজ্ঞাপন করে, তাহলে উক্ত নিন্দাকারীকে উত্তরোত্তর দশ পণ করে বর্ধিত হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে। নিজের তুলনায় অধিক মর্যাদাসম্পন্ন কারো প্রতি এরূপ ব্যবহার করা হলে আরোপযোগ্য জরিমানা দ্বিগুণ হারে বর্ধিত হবে। নিজের তুলনায় কম মর্যাদাসম্পন্ন কারো প্রতি এহেন বিরূপতা প্রদর্শন করা হলে অর্ধেক হারে জরিমানা আরোপিত হবে। পরের স্ত্রীর প্রতি এ ধরনের আচরণ করা হলে দ্বিগুণ হারে জরিমানা প্রযুক্ত হবে কিন্তু মদ্যপ অবস্থায় বা প্রমাদবশত তা করা হলে জরিমানা অর্ধেক হারে আরোপযোগ্য হবে। কুষ্ঠরোগ এবং উন্মাদগ্রস্ততার বিষয়ে শুধু চিকিৎসকগণই প্রমাণ প্ৰদান করবেন। ক্লীবত্ব তথা যৌন অক্ষমতার ক্ষেত্রে নারীদের সাক্ষ্য এবং মূত্রের ফেনা ও জলে বিষ্ঠার নিমজ্জন প্রমাণক হিসেবে আমলযোগ্য হবে।
০৩-১৮-০৩ চারবর্ণের লোকেরা উচ্চ ক্রমানুসারে পূর্ববর্তী বর্ণের লোকদের নিন্দাজ্ঞাপন করলে বা গালাগাল করলে ক্রমানুযায়ী যথাক্রমে ৩, ৬, ৯ ও ১২ পণ হারে জরিমানা প্রযুক্ত হবে। আবার নিম্ন ক্রমানুসারে তথা ব্রাহ্মণ কর্তৃক ক্ষত্রিয়কে, ক্ষত্রিয় কর্তৃক বৈশ্যকে, বৈশ্য কর্তৃক শূদ্রকে এবং শূদ্র কর্তৃক চণ্ডালকে নিন্দাজ্ঞাপন বা গালাগাল করা হলে দুই পণ করে হ্রাসকৃত হারে তথা ৮, ৬, ৪ ও ২ পণ হারে জরিমানা আরোপিত হবে। একই বিধান মোতাবেক বাগ্জীবী, শিল্পী, কুশীলব ও এ জাতীয় পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও এ সংক্রান্ত দণ্ড আরোপিত হবে।
০৩-১৮-০৪ কেউ যদি কাউকে হাত পা ভেঙে দেওয়ার বা শারীরিকভাবে হেনস্থা করার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও কার্যক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন না করে কথার আক্রমণেই স্থির থাকে, তাহলে তার উপর উক্ত অপরাধের জন্য প্রযোজ্য শাস্তির অর্ধেক আরোপিত হবে। নিজের শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও কেউ যদি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এ ধরনের মৌখিক আক্রমণ করে থাকে তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। শত্রুতার বশবর্তী হয়ে কেউ যদি কারো হাত পা ভেঙে দেওয়ার মতো সমর্থ সম্পন্ন হয়ে এ ধরনের হুমকি প্রদান করে থাকে তাহলে তাকে আজীবন ঐ লক্ষ্যীভূত ব্যক্তির নিরাপত্তার জামিনদার হতে হবে এবং তার নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। নিজের দেশ বা গ্রামের নিন্দাজ্ঞাপন করলে অথবা নিজের দেশ বা গ্রামকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে, এক্ষেত্রে জাতি বা সংঘের নিন্দা করা হলে ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং দেবতা, চৈত্য বা দেবমন্দিরের নিন্দা করা হলে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
এই অধ্যায়ে হাত, পা, লাঠি বা অন্য কোনোভাবে কাউকে আঘাত করা হলে বা ভীতি প্রদর্শন করা হলে, একইভাবে অকারণে পশুদের আঘাত করা হলে, বৃক্ষের ডাল বা পাতা কর্তন করা হলে কি ধরনের দণ্ড তথা শাস্তি ভোগ করতে হবে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এ ধরনের শারীরিক আক্রমণকে বলা হয়েছে দণ্ড পারুষ্য।
০৩-১৯-০১ দণ্ড পারুষ্য তিন প্রকার—১. ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে স্পর্শ করা ২. আঘাত করার জন্য কারো উপর হাত তোলা ৩. কাউকে সরাসরি আঘাত করা। কারও শরীরের নাভির নিম্নভাগে হাত, পা, ছাই বা ধূলি দিয়ে আঘাত করা হলে আঘাতকারী অপরাধী বলে গণ্য হবে এবং এই অপরাধের জন্য তার উপর তিন পণ জরিমানা আরোপিত হবে। একইভাবে নোংরা হাত বা পা দিয়ে উক্ত স্থান স্পর্শ করলে কিংবা ওখানে থুতু নিক্ষেপ করা হলে দায়ী ব্যক্তির উপর ছয় পণ জরিমানা আরোপিত হবে। একই স্থানে বমি, মল বা মূত্র নিক্ষেপ করা হলে দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। নাভির উপরিভাগে এভাবে আঘাত বা স্পর্শ করা হলে আরোপ্য জরিমানা দ্বিগুণ হবে। মাথায় এভাবে আঘাত বা স্পর্শ করা হলে আরোপ্য জরিমানা হবে চতুর্গুণ। এ সমস্ত বিধি বিধান সমমর্যাদাসম্পন্ন অপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অধিক মর্যাদাসম্পন্ন কারো প্রতি এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীর শাস্তির মাত্রা হবে দ্বিগুণ। এক্ষেত্রে মদ্যপ অবস্থায় বা প্রমাদবশত কেউ যদি এ ধরনের অপরাধ করে থাকে, সেক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা হবে অর্ধেক
০৩-১৯-০২ কারো পা, কাপড়, হাত ও চুল ধরে টানাহ্যাঁচড়া করা হলে শাস্তি ক্রমশ ছয় পণ হারে বৃদ্ধি করে ৬, ১২, ১৮ ও ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। অন্যকে নিপীড়ন করা হলে, জাপ্টে ধরা হলে, মুখমণ্ডলে কালি লেপন করা কিংবা ভূমিতে নিপতিত করে তার উপর উপবেশন করা হলে অপরাধীর উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কাউকে মাটিতে নিপতিত করে কেউ যদি পালিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে ১২৫ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। শূদ্র জাতীয় কারো দ্বারা ব্রাহ্মণের কোনো অঙ্গ স্পর্শিত হলে শূদ্রের অনুরূপ অঙ্গ ছেদন করতে হবে। হস্ত উত্তোলনের মাধ্যমে কোনো ব্রাহ্মণকে ভীতি প্রদর্শন করা হলে অপরাধীকে বিশেষ পরিমাণ অর্থ খেসারত দিয়ে মুক্তিপণের বিহিত করতে হবে। উত্তলিত হস্ত দ্বারা কোনো ব্ৰাহ্মণকে স্পর্শ করা হলে উপরোক্ত মুক্তিপণের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। এহেন বিধান হীনশ্রেণির লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কাউকে হাত তুলে ভীতি প্রদর্শন করা হলে অপরাধীর ন্যূনতম তিন পণ এবং সর্বোচ্চ ১২ পণ জরিমানা হবে, এক্ষেত্রে পা তুলে ভীতি প্রদর্শন করা হলে জরিমানার হার দ্বিগুণ হবে। পীড়াদায়ক কোনোকিছু দিয়ে ভীতি প্রদর্শন করা হলে ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। প্রাণহানি ঘটতে পারে এমন জাতীয় কোনোকিছু দিয়ে ভীতি প্রদর্শন করা হলে ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
০৩-১৯-০৩ কেউ যদি কাউকে কাঠ, মাটির ঢেলা, পাথর, লৌহদণ্ড বা দড়ি জাতীয় কোনোকিছু দিয়ে আঘাতের মাধ্যমে রক্তপাত না ঘটিয়ে ব্যথিত করে, তাহলে উক্ত অপরাধীকে দণ্ড হিসেবে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এ ধরনের আঘাতের ফলে যদি রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে অপরাধীকে দ্বিগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। তবে এ ধরনের আঘাতকালে কারো শরীরের কুষ্ঠ বা ব্যাধিগ্রস্ত স্থান হতে যদি রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে উপরোক্ত দ্বিগুণ জরিমানার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না। রক্ত না ঝরিয়েও কেউ যদি কাউকে আঘাতের মাধ্যমে আধমরা করে দেয় বা মোচড়িয়ে হাত পা বাঁকিয়ে দেয়, তাহলে উক্ত অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রথম সাহসদণ্ড বা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। আঘাতের মাধ্যমে হাত, পা, দাঁত ভেঙে দিলে, নাক, কান ছেদন করলে বা ব্রণ বিক্ষত করলে একই হারে অপরাধীর অনুকূলে জরিমানা প্রযুক্ত হবে। আঘাতের মাধ্যমে কারো উরু, গ্রীবা ভেঙে দিলে, চোখ বিদীর্ণ করলে, কিংবা কথা বলা, চলাফেরা ও খাদ্য গ্রহণ বিঘ্নিত করলে, অপরাধীর বিরুদ্ধে মধ্যম সাহসদণ্ড বা ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং এ সমস্ত ক্ষত পরিপূর্ণভাবে ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপরাধীকে চিকিৎসার সমুদয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় আহতাবস্থায় কেউ মৃত্যুমুখে নিপতিত হলে ফৌজদারি মামলা দায়েরের মাধ্যমে অপরাধীর বিচার করতে হবে।
০৩-১৯-০৪ কাউকে যদি গণপিটুনি দেওয়া হয়, তাহলে প্রহারকার্যে নিযুক্ত প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে পিটুনির দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রযোজ্য জরিমানার দ্বিগুণ হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে। পূর্বের আচার্যগণের অভিমত এই যে, বহুপূর্বে সংঘটিত কলহ এবং এর সাথে অন্যদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আমলে নেয়া অনাবশ্যক। কিন্তু কৌটিল্য মনে করেন—অপরাধ পূর্বকালে না বর্তমানকালে সংঘটিত হয়েছে তা বিবেচ্য নয়, অপরাধী কোনো অবস্থাতেই নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে না। স্থান কাল ভেদে অপরাধীর বিরুদ্ধে যে কোনো সময়ই অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে। পূর্বের আচার্যদের মতানুযায়ী—বিবাদ, বিসম্বাদ সংঘটনের পর যিনি রাজদ্বারে প্রথম পদার্পণ করবেন তিনিই জয়লাভ করবেন, এক্ষেত্রে যিনি প্রথম রাজদ্বারে অভিযোগ দায়ের করবেন ধরে নেয়া হবে তিনি নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে একান্ত নিরূপায় হয়েই নিষ্কৃতির প্রত্যাশায় রাজার শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু কৌটিল্য এ ধরনের মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন—কে প্রারম্ভে অভিযোগ দায়ের করেছে আর কে বিলম্বে অভিযোগ দায়ের করার জন্য রাজার শরণাপন্ন হয়েছে তা মুখ্য নয়। সাক্ষ্য প্রমাণ, কলহে লিপ্তদের ক্ষত চিহ্ন, ইত্যাকার বহুবিদ প্রামাণিক বিষয়ের নিরিখেই বিবাদের বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
০৩-১৯-০৫ দুজনের কলহ প্রাক্কালে তৃতীয় কেউ তাদের কারো কোনো দ্রব্য অপহরণ করলে অপহরণকারীর বিরুদ্ধে দশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কলহকালে কোনো কলহকারীর দ্বারা ফুলসহ অন্যকোনো দ্রব্য বিনষ্ট হলে দায়ী ব্যক্তি বিনষ্ট দ্রব্যের মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি সাধিত হলে দায়ী ব্যক্তি কর্তৃক ক্ষতিকৃত দ্রব্যের দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। এছাড়াও কলহকালে কোনো পক্ষ কর্তৃক বস্ত্র, আভরণ, নগদ অর্থ, স্বর্ণপাত্রসহ মূল্যবান সামগ্রী বিনষ্ট করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে এর ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ দায়ী ব্যক্তিকে প্রথম সাহসদণ্ড ভোগ করতে হবে। বিবাদকালে কেউ যদি কারো গৃহের দেয়ালের ক্ষতিসাধন করে তাহলে অপরাধীর বিরুদ্ধে তিন পণ জরিমানা আরোপিত হবে। আঘাতের কারণে যদি দেয়ালে ফাটল ধরে, তাহলে আঘাতকারীকে ১২ পণ জরিমানা প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেয়াল মেরামত করে দিতে হবে।
০৩-১৯-০৬ কেউ যদি কারো গৃহের অভ্যন্তরে বিড়ম্বনাকর কোনো বস্তু নিক্ষেপ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে প্রাণনাশ করার মতো কোনোকিছু নিক্ষেপ করা হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কাষ্ঠদণ্ড দিয়ে কেউ কোনো ক্ষুদ্ৰ পশুকে আঘাতের মাধ্যমে ব্যথিত করলে, উক্ত আঘাতকারীর বিরুদ্ধে দণ্ড হিসেবে দুই পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এরূপ আঘাতের মাধ্যমে যদি পশুর রক্তক্ষরণ হয় সেক্ষেত্রে দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হবে। বড় পশুদের এভাবে আঘাত করা হলে, অপরাধীকে দ্বিগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং পশুটি যদি আঘাতের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে আঘাতকারীকে পশুটিকে সুস্থ করে তোলার চিকিৎসার ব্যয়ভারও বহন করতে হবে।
০৩-১৯-০৭ নগরের উপবনস্থ পুষ্প-বৃক্ষ, ফলজবৃক্ষ এবং ছায়াবান বৃক্ষের পাতা ছিন্ন করা হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। বনবৃক্ষের ছোট ডাল-পালা ভাঙা হলে ১২ পণ এবং বড় ডাল কাটা হলে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ সব বৃক্ষের গোড়া কর্তন করা হলে ২৫০ পণ এবং সমূলে বৃক্ষের বিনাশ করা হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। একই ধরনের ফল ফুলের ছায়াগুল্ম ও লতাপাতা ছিন্ন করা হলে পূর্বোক্ত হারের অর্ধেক হারে জরিমানা আরোপিত হবে। পুণ্যস্থান, তপোবন ও শ্মশানস্থ বৃক্ষের পাতা ছেঁড়া হলে একইভাবে অর্ধহারে জরিমানা আরোপিত হবে। সীমানা নির্ধারণকারী বৃক্ষ, চৈত্যস্থিত বৃক্ষ, রাজমোহরযুক্ত বৃক্ষ এবং রাজার উদ্যানস্থ বৃক্ষের ক্ষেত্রে অনুরূপ আচরণ করা হলে, অপরাধীর উপর দণ্ড হিসেবে প্রযোজ্য জরিমানার দ্বিগুণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।
এই অধ্যায়ে জুয়াখেলা, পাশাখেলা এবং বিভিন্ন ধরনের পশুর ক্রীড়া সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জুয়া খেলার বিধিবদ্ধ স্থান, এ বিষয়ক শাস্তি এবং রাজকর্মচারীদের করণীয়সহ বিবিধ বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়েছে। ০৩-২০-০১ তত্ত্বাবধানের সুবিধার্থে দ্যুতাধ্যক্ষ কর্তৃক এক দরজা বিশিষ্ট কক্ষে জুয়া খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। অনুমোদিত অক্ষশালা ব্যতীত অন্য কোথাও জুয়া খেলার অনুমতি দেওয়া যাবে না, এর অন্যথা হলে অপরাধীর উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। নির্দিষ্ট স্থানে জুয়ার আসরের ব্যবস্থা করা হলে, রাজার লোকদের মাধ্যমে আসরে আগত চোর ছিনতাকরীসহ সমাজের দাসী অপরাধীদের শনাক্তকরণ সহজতর হয়। পূর্ববর্তী আচার্যগণের অভিমত এই যে, জুয়া খেলা নিয়ে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে বিজিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ন্যূনতম ৪৮ পণ এবং সর্বোচ্চ ৯৬ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। একই সাথে মূর্খতাজনিত কারণে হার সত্ত্বেও তা মেনে নিতে অস্বীকৃত হওয়ায় পরাজিত খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ২০০ পণ এবং সর্বোচ্চ ৫০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। কৌটিল্য আচার্যগণের এ ধরনের অভিমতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। তিনি মনে করেন—পরাজিত জুয়াড়িদের জন্য এত অধিক হারে জরিমানার বিধান রাখা হলে, অন্যায়ভাবে পরাজিত হলেও কোনো খেলোয়াড় ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রাজার দ্বারস্থ হবে না। সাধারণত জুয়াড়িরা সব সময় খেলার সময় কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে, এ কারণে অক্ষশালার তত্ত্বাবধায়করা জুয়া খেলার সময় সকল ব্যাপারে কঠোর নজরদারি জারি রাখবেন। তারা খেলার সমস্ত উপাদান পরীক্ষা করে এর সঠিকতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকবেন।
০৩-২০-০২ কেউ যদি জুয়া খেলার উপকরণ নিয়ে জালিয়াতি করে বা তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃক সরবরাহকৃত ও স্থাপনকৃত কপর্দক বা পাশা সুকৌশলে রদবদল করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে বারো পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। খেলার সময় কেউ যদি কোনো ধরনের ছলা-কলার আশ্রয় গ্রহণ করে তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং তার জিতকৃত সমুদয় অর্থ কেড়ে নিতে হবে। এ ধরনের খেলায় রেখা টানার সময় কেউ যদি চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে চুরির দণ্ড প্রযুক্ত হবে এবং ২৫০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। রাজা কর্তৃক নিয়োজিত একজন তত্ত্বাবধায়ক জুয়ার আসরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। তিনি প্রতিটি বিজিত জুয়াড়ির কাছ থেকে কর হিসেবে শতকরা পাঁচ ভাগ হারে পণ আদায় করবেন। এছাড়াও তিনি জুয়ার আসরে সরবরাহকৃত কপর্দক, পাশা, পাশা চালার ক্ষেত্র ও শলাকা জাতীয় উপকরণ এবং জল ও স্থান ব্যবহারের জন্য আলাদাভাবে ভাড়া আদায় করবেন। তিনি জুয়ার আসরে বিভিন্ন দ্রব্য বন্ধক রাখবেন এবং খেলা চলাকালীন অবস্থায় সব ধরনের ছল-চাতুরি নিরোধ করতে সচেষ্ট থাকবেন। এ কাজ সম্পাদনে তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে চতুর জুয়াড়ির বিরুদ্ধে যে হারে জরিমানা আরোপিত হয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে তা দ্বিগুণ হারে আরোপ করতে হবে। ষাঁড়, মেষ এবং মুরগির লড়াই সম্পৃক্ত জুয়া খেলার ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য হবে।
০৩-২০-০৩ কোনো ব্যক্তি যদি কারো কাছ থেকে নগদ টাকা গ্রহণ করে, কোনোকিছু ভাড়া হিসেবে গ্রহণ করে, বন্ধক গ্রহণ করে বা কারো কিছু গচ্ছিত রাখে বা কারো কিছু তৈয়ার করে দেওয়ার জন্য কোনো দ্রব্য গ্রহণ করে সময়মতো তা ফেরত প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে বারো পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি রাত্রি বা দিনের কোনো নির্ধারিত সময়ে কারো কিছু ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা সময়মতো ফেরত প্রদান না করে, তাহলেও তার বিরুদ্ধে দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। চৌকিদারের চৌকি অতিক্রমকালে বা নদী পারাপারকালে যদি কোনো ব্রাহ্মণের কাছ থেকে অর্থ বা ভাড়া গ্রহণ করা হয়, তাহলে ঐ অর্থ আদায়কারীর বিরুদ্ধে দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। গৃহের সম্মুখে এবং পার্শ্বে অবস্থানরত শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণকে অতিক্রম করে অন্য কাউকে নিমন্ত্রণ করা হলে, উক্ত নিমন্ত্রণকারীর বিরুদ্ধে বারো পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে।
প্রতিশ্রুতি মোতাবেক প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদান না করা হলে, ভাইয়ের স্ত্রীকে হাত ধরে টেনে অপদস্থ করা হলে, অন্যের রক্ষিতার সান্নিধ্যে গমন করা হলে, আরেকজনের ক্রয়তব্য কোনো দ্রব্য ক্রয় করা হলে, সিলমোহরকৃত গচ্ছিত দ্রব্য উন্মোচন করা হলে, পাশাপাশি বসবাসরত ৪০ গৃহের কারো ক্ষতিসাধন করা হলে, এসব কৃতকর্ম অন্যায় কাজ বলে গণ্য হবে এবং দণ্ড হিসেবে অপরাধীর বিরুদ্ধে ৪৮ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।
২০-০৩-০৪ উত্তরাধিকারীদের জন্য সংরক্ষিত সম্পত্তি আত্মসাৎ করা হলে, কামরহিত বিধবার উপর বলপূর্বক উপগত হলে, চণ্ডাল হয়ে আর্য রমণীকে স্পর্শ করা হলে, বিপন্ন ব্যক্তির প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত না করা হলে, অকারণে অন্যকে উপদ্রব করা হলে এবং দেবপূজায় বা পিতৃশ্রাদ্ধে বৌদ্ধ, আজীবক, শূদ্র বা প্রব্রজ্যাধর্ম গ্রহণকারীদের ভোজন করানো হলে, এ সমস্ত কৃতকর্ম নিয়মবহির্ভূত বলে বিবেচিত হবে এবং এসব কাজে যুক্তদের বিরুদ্ধে দণ্ড হিসেবে একশত পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। বিচারকের অনুমতি ব্যতিরেকে সাক্ষীদের জেরা করা হলে, উপযাচক হয়ে রাজপুরুষের কর্মে যুক্ত হলে, ক্ষুদ্ৰ পশু ও বৃষভের প্রজনন-ক্ষমতা বিনষ্ট করা হলে, ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে দাসীদের গর্ভপাত করানো হলে, এসব অপকর্ম অপরাধমূলক কাজ বলে গণ্য হবে এবং এজন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে দণ্ড হিসেবে ২৫০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে।
০৩-২০-০৫ পিতা ও পুত্র, স্বামী ও স্ত্রী, ভ্রাতা ও ভগ্নি, মাতুল ও ভাগিনেয়, শিষ্য ও আচার্য, এদের মধ্যে কেউ বর্ণচ্যুত না হলে একজন অপরজনকে পরিত্যাগ করতে পারবে না, এক্ষেত্রে কোনো একজন অপরজনকে পরিত্যাগ করলে তার বিরুদ্ধে ২৫০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। বণিকদলের সঙ্গে গমনকারী কোনো ব্যক্তিকে অসুস্থতার অজুহাতে পরিত্যাগ করা যাবে না, কারো প্রতি এরূপ আচরণ করা হলে বণিক দলের প্রত্যেকের উপর ২৫০ পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে দুর্গম অরণ্যে যদি কোনো বণিকদল কর্তৃক কাউকে পরিত্যাগ করা হয়, তাহলে উক্ত দলের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৫০০ পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে দলের উক্ত সদস্যকে যদি কারো দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তাহলে উক্ত অপরাধীর বিরুদ্ধে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং দলের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে অর্ধেক হারে জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটকিয়ে রাখে বা অন্য কাউকে দিয়ে আটক করায়, আটককৃত ব্যক্তিকে মুক্ত করে দেয়, অপ্রাপ্ত বয়স্ক নাবালককে আটক করে বা কাউকে দিয়ে আটক করায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি এবং তাকে সহায়তাকারী প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এক হাজার পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে।
০৩-২০-০৬ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধানের কাছে তপস্বী, ব্যাধিগ্রস্ত, ক্ষুধা পিপাসায় কাতর, পরিশ্রান্ত পথিক, বিদেশাগত, বহুবার শাস্তি ভোগকারী এবং নির্ধন ব্যক্তিরা অনুগ্রহের পাত্র বলে বিবেচিত হবে। তপস্বী, ব্রাহ্মণ, স্ত্রীলোক, নাবালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত এবং অনাথ জাতীয় লোকেরা রাজ বিচারালয়ে গমনে অসমর্থ হলে বা অনিচ্ছুক হলে বিচারকগণ স্বয়ং তাদের কাছে উপস্থিত হবেন। কেউ কখনো ছলনা বা প্রতারণার মাধ্যমে এ ধরনের লোকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পারবে না। আদালতে সাক্ষীর অভাব হলে উপস্থিত লোকদের মধ্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, বংশ এবং কর্মের দিক দিয়ে উৎকৃষ্টতর লোকরা বিচারকদের কাছে সাক্ষী হিসেবে পূজ্য বলে বিবেচিত হবেন। রাজার নিযুক্ত বিচারকরা কোনোপ্রকার ছলচাতুরি না করে নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করলে, সকলের কাছে বিশ্বাসভাজন এবং প্রীতির পাত্র হতে পারবেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন