প্রথম অধিকরণ (সূচনা ও শিক্ষা)

প্রথম অধিকরণ ॥ প্রকরণ ০১-১৮ ॥

পনেরোটি অধিকরণে বিভাজিত অর্থশাস্ত্রের সারবত্তা প্রথম অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রারম্ভিক পর্যায়ে অসুরগুরু, শুক্রাচার্য ও বৃহস্পতির প্রতি নমস্কার জ্ঞাপন করা হয়েছে। শুক্র হলেন অসুরদের গুরু এবং বৃহস্পতি দেবগুরু। অর্থশাস্ত্রের সূচনাকারী আচার্যদের মধ্যে ইনারা দুজন শ্ৰেষ্ঠ তাত্ত্বিক হিসেবে স্বীকৃত। শুক্রের প্রণীত শাস্ত্র ঔশনসশাস্ত্র নামে খ্যাত, তাঁর রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘শুক্র নীতিসার’ হিসেবে পরিচিত। বৃহস্পতি রচিত শাস্ত্রকে বলা হয় বার্হস্পত্য। অর্থশাস্ত্র প্রণয়ন প্রাক্কালে কৌটিল্য কর্তৃক এ সমস্ত আচার্যগণের তত্ত্ব, যুক্তি ও অভিমত ব্যাপক পরিসরে অনুসরণ করা হয়েছে। এ কারণেই গ্রন্থের প্রারম্ভে তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে নমস্কার নিবেদন করেছেন। পৃথিবীস্থ অপ্রাপ্ত ভূমির প্রাপ্ততা এবং প্রাপ্ত ভূমির রক্ষণ বিষয়ে যতগুলো অর্থশাস্ত্র পূর্ববর্তী আচার্য তথা শুক্র, বৃহস্পতি ও বিশালাক্ষ কর্তৃক প্রণয়ন করা হয়েছে সে সবের সমন্বয়েই মূলত অর্থশাস্ত্র রচিত বলে কৌটিল্য কর্তৃক স্বীকার করা হয়েছে। সূচনা পর্যায়ে অর্থশাস্ত্রের পনেরোটি অধিকরণের উপর সার সংক্ষেপ আকারে আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-০১-০১ বিনয়াধিকারিক (শিক্ষা সম্পর্কিত) নামক প্রথম অধিকরণের আঠারোটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. বিদ্যাসমুদ্দেশ তথা হেতুবিদ্যা। ত্রয়ী তথা ধর্মবিষয়ক বিদ্যা। বার্তা তথা কৃষি ও বাণিজ্যিক বিষয়ক বিদ্যা এবং দণ্ড তথা রাজনীতি বা শাসন বিষয়ক বিদ্যা ২. বৃদ্ধসংযোগ তথা প্রাজ্ঞ বৃদ্ধদের সঙ্গে রাজন্যদের জ্ঞানার্জন সম্পর্কীয় সম্পৃক্ততা ৩. ইন্দ্রিয় জয় ৪. অমাত্য নিয়োগ ৫. মন্ত্রী, পুরোহিত ও উপদেষ্টা নিয়োগ ৬. অমাত্যদের শৌচ ও অশৌচ পীরক্ষণ ৭. গুপ্তচর নিয়োগ ৮. গুপ্তচরদের কর্ম বিভাজন ৯. স্বরাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ ১০. পররাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ ১১. মন্ত্রণা তথা পরামর্শকর্ম ১২. দূতিয়ালি কর্ম ১৩. রাজপুত্রগণ হতে রাজার সুরক্ষা ১৪. অবরুদ্ধ রাজকুমারদের প্রতি রাজার করণীয় ১৫. অবরুদ্ধ রাজকুমারদের অপরাধের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থা ১৬. রাজার কর্মপরিধি ১৭. নিশান্ত প্ৰণিধি বা রাজভবন নির্মাণ ১৮. রাজার আত্মরক্ষার কৌশল।

০১-০১-০২ অধ্যক্ষ প্রচার (রাজ্যের শাসনকার্যের নিমিত্ত প্রশাসক নিয়োগ নামক দ্বিতীয় অধিকরণের আটত্রিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. জনপদ নিবেশ বা সৃজন ২. ভূমি সম্পর্কীত বিধান ৩. দুর্গ তথা নগর বা রাজধানী বিনির্মাণ ৪. দুর্গের বা নগরের বিন্যাস ৫. সঞ্চিত ধন-সম্পদের মজুদকরণ ৬. কর সংগ্রহ ব্যবস্থা ৭. অক্ষপটল বা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় ৮. রাজকর্মচারীদের আত্মাসাৎকৃত অর্থের পুনঃযোজন ৯. পরিদর্শকদের দায়িত্বের তত্ত্বাবধান ১০. শাসনাধিকার বা রাজাদেশের লিখনির বিধি বিধান ১১. রাজকোষে রক্ষণযোগ্য মণি-মুক্তাদির পরীক্ষণ ১২. খনি ও কারখানার তত্ত্বাবধান ১৩. অক্ষশালাস্থ সুবর্ণাধ্যক্ষের কর্ম ১৪. সৌবর্ণিকের কর্মপরিধি ১৫. খাদ্য-শস্যের ভাণ্ডার তথা কোষ্ঠাগারের অধ্যক্ষের দায়িত্ব ১৬. বিক্রিত পণ্যদ্রব্যের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের দায়িত্ব ১৭. বৃক্ষজাত পণ্যদ্রব্যের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের বার্যাবলি ১৮. অস্ত্রাগারের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের দায়িত্বাবলি ১৯. তুলামানপৌতব তথা ওজন ও পরিমাপক বিষয়ক প্রশাসকের দায়িত্ব ২০. দেশ-কাল-মান তথা সময় ও কাল পরিমাপকের দায়িত্ব ২১. শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কর্মপরিধি ২২. সূত্রাধ্যক্ষ তথা কার্পাসতন্ত্র বয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষের কার্যপরিধি ২৩. কৃষি ভূমির দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কার্যাবলি ২৪. সুরাধ্যক্ষ তথা মদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসকের দায়িত্বাবলি ২৫. সূনাধ্যক্ষ তথা কসাইখানার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ২৬. গণিকাধ্যক্ষ তথা পতিতালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ২৭. নাবধ্যক্ষ তথা জলযানের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি ২৮. গোহধ্যক্ষ তথা গবাদিপশুর দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি ২৯. অশ্বাধ্যক্ষ তথা অশ্ব প্রতিপালনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ৩০. হস্ত্যাধ্যক্ষ তথা হাতি সংগ্রহ, প্রতিপালন ও সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ৩১. রথাধ্যক্ষ তথা রথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি ৩২. পত্ত্যধ্যক্ষ তথা পদাতিক বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত সেনা অধিনায়কের দায়িত্বাবলি ৩৩. সেনাপতি প্রচার তথা চতুরঙ্গ বাহিনী বা হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বাবলি ৩৪. মুদ্রাধ্যক্ষ তথা রাজার অনুমতিপত্র প্রদানকারী প্রশাসকের দায়িত্বাবলি ৩৫. বিবীতাধ্যক্ষ তথা গোচারণ ভূমির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকের কার্যাবলি ৩৬. সমাহর্তপ্রচার তথা রাজার অর্থ সংগ্রহকারী প্রশাসকের কার্যপরিধি ৩৭. গূঢ়পুরুষ তথা বণিক, সন্ন্যাসীর বেশধারী গুপ্তচরদের কার্যপরিধি ৩৮. নাগরিক প্রণিধি তথা নগরের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিতদের কার্যপরিধি।

০১-০১-০৩ অনন্তর ধর্মস্থীয় (বিচার বিভাগীয়) নামক তৃতীয় অধিকরণের উনিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো: ১. সঙ্গত ও অসঙ্গত আচার আচরণের ব্যবস্থাপনা ২. বিচারিক বিষয়াদি ৩. বিভিন্ন ধরনের বিবাদ বিষয়ক নিষ্পত্তি ৪. দায়বিভাগ তথা পৈত্রিক সম্পত্তি ও তার দায় বিভাজন ৫. বাস্তক তথা গৃহ সম্পর্কিত বিষয় ৬. সময়ভিত্তিক চুক্তি বিষয়ক ৭. ঋণ প্রদান সম্পর্কিত ৮. গচ্ছিত দ্রব্যাদি বিষয়ক ৯. দাস ও শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত ১০. সমবায় ভিত্তিক কার্যারম্ভের বিষয় ১১. ক্রয় ও বিক্রয় সম্পর্কিত বিষয় ১২. দেয় দ্রব্য অপ্রদান বিষয়ক ১৩. অপরের দ্রব্য বিক্রয় সম্পর্কিত ১৪. হারানো দ্রব্যের মালিকানা নির্ণয় ১৫. সাহস তথা সহসাকৃত কর্ম ১৬. বাক্‌পারুষ্য তথা কটুবাক্যের মাধ্যমে আঘাত প্রদান ১৭. দণ্ডপারুষ্য তথা শারীরিকভাবে আঘাত প্রদান ১৮. দ্যূতকার্য তথা অক্ষক্রীড়া বা প্রাণীদের ক্রীড়ার মাধ্যমে বাজি ধরা বিষয়ক ১৯. প্রকীর্ণক তথা উপরোক্ত বিষয় বহির্ভূত আপত্তির নিষ্পত্তি।

০১-০১-০৪ কণ্টকশোধন (ছল, চাতুরি, জালিয়াতি, ঠগবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শাস্তি আরোপণ) নামক চতুর্থ অধিকরণের তেরটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. সুক্ষ্ম কারুশিল্পীদের প্রতারণা হতে সুরক্ষা ২. বণিকদের ঠগবাজি নিরোধকরণ ৩. দৈব-বিপত্তির প্রতিকার ৪. গোপন প্রবঞ্চকদের কবল থেকে সুরক্ষা ৫. গুপ্তচরদের মাধ্যমে দুষ্টুলোক ও রাজদ্রোহীদের চিহ্নিতকরণ ৬. সন্দেহভাজন, আত্মসাৎকারী ও সন্ধিচ্ছেদকারীদের আটক ৭. সদ্যমৃতের মৃত্যুর হেতু উদ্ঘাটন ৮. জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অপরাধের উৎস উদ্‌ঘাটন ৯. সর্বাধিকরণরক্ষণ তথা রাজ কর্মচারীদের উৎপীড়ন হতে রাজা ও প্রজাদের রক্ষাকরণ ১০. একাঙ্গবধনিষ্ক্রয় তথা অপরাধের মানদণ্ডে অপরাধীর অঙ্গহানিকরণ ১১. অপরাধের মানদণ্ডে যন্ত্রণাহীন বা যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরকরণ ১২. নাবালিকার সঙ্গে যৌনাচারকারীর শাস্তি আরোপণ ১৩. শাস্ত্রীয় বিধি বিধান লঙ্ঘনের প্রতিবিধান।

০১-০১-০৫ যোগবৃত্ত (গুপ্তহত্যা) নামক পঞ্চম অধিকরণের সাতটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. দাওকার্মিক তথা অপরাধের মানদণ্ডে গোপনীয় হত্যাযজ্ঞ ২. কোষাভিসংহরণ তথা রাজ কোষের জন্য বাড়তি আয়ের উপায় ৩. ভৃত্যভরণীয় তথা রাজ কর্মচারী ও পরামর্শদাতাদের ভরণপোষণ ৪. অনুজীবীবৃত্তি তথা রাজকীয় সভাসদদের স্বভাব ৫. সময়াচারিক তথা আচার, অনুষ্ঠান ও ব্যবহার সম্পর্কিত বিধি বিধান ৬. রাজ্যপ্রতিসন্ধান তথা রাজার বিপত্তিকালে মন্ত্রী, অমাত্যদের করণীয় কর্তব্য ৭. একৈশ্বর্য তথা রাজ্যের সংহতির স্বার্থে রাজকুমারের একক কর্তৃত্বের অপরিহার্যতা।

০১-০১-০৬ মণ্ডলযোনি নামক ষষ্ঠ অধিকরণের দুটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. প্রকৃতিসম্পদ তথা রাজা, অমাত্য, মিত্র, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য ২. শম ও ব্যয়াম তথা শান্তি ও উদ্যোগ।

০১-০১-০৭ ষাড়গুণ্য (ছয়গুণ) নামক সপ্তম অধিকরণের উনত্রিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. ষাড়গুণ্যসমুদ্দেশ বা ছয়টি গুণ তথা (ক) সন্ধি (শান্তি, মিত্রতা বা চুক্তি) (খ) বিগ্রহ (যুদ্ধ) (গ) আসন (নিরপেক্ষাবস্থা) (ঘ) যান (সেনাভিযান) (ঙ) সংশ্রয় (আশ্রয়) এবং (চ) দ্বৈধীভাব (দ্বৈতনীতি) ক্ষয়স্থানবৃদ্ধিনিশ্চয় তথা শাসনজনিত ক্ষয়ক্ষতি, স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি ৩. সংশয়বৃত্তি তথা তুলনামূলকভাবে অধিক বলশালীর আশ্রয়ে অবস্থান ৪. সমশক্তি, হীনশক্তি ও উচ্চশক্তিসম্পন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ষাড়গুণের প্রয়োগ ৫. হীনশক্তিসম্পন্ন শত্রুর সঙ্গে অর্থ, সৈন্য ও ভূমি প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি স্থাপন ৬. বিগৃহ্যাসন তথা স্বরাজ্যে অবস্থান করে শত্রুর সম্পদ সৃষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টিকরণ ৭. সন্ধায়াসন তথা সংগ্রামে অসমর্থ শত্রুর সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনপূর্বক সহাবস্থান ৮. বিগৃহ্যযান তথা পার্ষিগ্রাহের (পশ্চাদের শত্রু) সাথে মিত্রতা স্থাপনপূর্বক শত্রুর বিরুদ্ধে সমরাভিযান ৯. সন্ধায়যান তথা মিত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সমরাভিযান ১০. সম্ভূয় প্রয়াণ তথা সম, হীন ও উৎকৃষ্ট নৃপতির সঙ্গে সন্ধি স্থাপনপূর্বক শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান ১১. যাতব্য (আক্রমণযোগ্য শত্রু) ও অমিত্র- প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণের আয়োজন ১২. প্রকৃতিবর্গের (রাজা, অমাত্য, মিত্র, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য) অবক্ষয়, লোভ ও বিদ্রোহের কারণ সন্ধান ১৩ সমবায়ভুক্ত বা সম্মিলিত জোটভুক্ত রাজন্যদের গুরুত্ব ও লঘুত্ব সংক্রান্ত মূল্যায়ন ১৪. সংহতিপ্রয়াণিক তথা সন্ধিপূর্বক প্রয়াণ ১৫. পরিপণিত, অপরিপণিত ও অপসৃত সন্ধি ১৬. দ্বৈতভাব সম্বন্ধীয় সন্ধি ও শক্তি প্রদর্শন ১৭. যাতব্যবৃত্তি (আক্রমণীয় শত্রুর বিরুদ্ধে করণীয়) ১৮. অনুগ্রহযোগ্য মিত্র ১৯. মিত্র, অর্থ, ভূমি বা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে কৃত সন্ধি ২০. পগ্ৰিাহ তথা পশ্চাদে অবস্থানকারী শত্রু সম্পর্কিত চিন্তন ২১. হীনশক্তিপূরণ ২২. শক্তিমান শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম ২৩ বলবান শত্রুর প্রতি আয়ত্তীকৃত রাজার করণীয় ২৪. বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আয়ত্তীকৃত শত্রুর প্রতি রাজার করণীয় ২৫. সন্ধিকর্ম ২৬. সন্ধিভঙ্গ ২৭. মধ্যম নৃপতির প্রতি রাজার করণীয় ২৮. উদাসীন নৃপতির প্রতি রাজার করণীয় ২৯. রাজবৃত্তের রাজন্যদের প্রতি রাজার করণীয়।

০১-০১-০৮ ব্যসনাধিকারিক (ব্যসন—কুঅভ্যাস, অনৈতিকতা, দুর্দশাগ্রস্ততা) নামক অষ্টম অধিকরণের আটটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. রাজা ও অমাত্যদের ব্যসনসমূহ ২. রাজা এবং রাজ্যের ব্যসন বিষয়ক চিন্তন ৩. পুরুষের ব্যসনজাত দোষসমূহ ৪. উৎপীড়নসমূহ ৫. স্তম্ভনবর্গ তথা বিঘ্নসূচক উক্তির মাধ্যমে রাজকার্যের উপরোধের কারণ নির্ণয় ৬. কোষসঙ্গবর্গ তথা রাজকোষের প্রাপ্য অর্থের অপ্রাপ্যতা বিষয়ক ৭. সৈন্যদের ব্যসন নির্ণয় ৮. মিত্রবর্গের ব্যসনসমূহ।

০১-০১-০৯ অভিযাৎসকর্ম (অভিযান পরিচালনাকারীর বিবেচ্য বিষয়) নামক নবম অধিকরণের বারোটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. শক্তি, দেশ ও কালের সক্ষমতা সম্পর্কিত জ্ঞান ২. যুদ্ধাভিযানের সময় নির্ধারণ ৩. সৈন্য সমাবেশের আবশ্যকতা ৪. সমর্থতার নিরিখে অভিযানের প্রস্তুতি ৫. শত্রু সৈন্যদের পরাভূত করণের উপযোগী নিজ বাহিনী গঠন ৬. পশ্চাদে অবস্থানকারী শত্রু কর্তৃক আক্রান্তের বিষয়ে চিন্তন ৭. অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিবর্গ কর্তৃক উদ্ভূত বিদ্রোহের প্রতিকার ৮. যুদ্ধাভিযানের লাভ, ক্ষতি ও ব্যয়ের মূল্যায়ন ৯. রাষ্ট্রমুখ্য, অন্তপাল ও অমাত্য-পুরোহিত কর্তৃক উত্থিত বিপত্তির স্বরূপ নির্ণয় ও এর প্রতিবিধান ১০. বিশ্বাসঘাতক ও রাজদ্রোহীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং তার প্রতিবিধান ১১. সম্পদ ও শারীরিক বিপত্তি নিষ্পত্তির উপায় অবলম্বন ১২. উদ্ভূত বিপত্তিসমূহ নিষ্পত্তি তথা নিবারণকল্পে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ।

০১-০১-১০ সাংগ্রামিক (যুদ্ধ সম্পর্কিত) নামক দশম অধিকরণের তেরটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. স্কন্ধাবার তথা সেনাশিবির স্থাপন ২. স্কন্ধাবারপ্রয়াণ তথা সেনা শিবির প্রত্যাহার ৩. বলব্যসন ও অবস্কন্দন কাল তথা অভিযানকালের দুর্ভোগ ও সৈন্যদের সুরক্ষণ ৪. কূটযুদ্ধ তথা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক যুদ্ধ ৫. নিজ সেনাবাহিনীকে উদ্দীপ্তকরণ ৬. শত্রু সেনাদের তুলনায় অনুকূল অবস্থানে নিজ সৈন্যদের সমবেতকরণ ৭. যুদ্ধভূমির গুণাগুণ বিচার ৮. হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর সৈনিকদের করণীয় ৯. পক্ষ, কক্ষ ও উরস্য অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ১০. শৌর্যবান, বিশ্বস্ত ও দুর্বল সৈন্যদের বিভাজন অনুযায়ী পদায়ন ১১. পদাতিক, রথ, অশ্ব ও হস্তি বাহিনীর যুদ্ধ ১২. সরলাকৃতি, সর্পাকৃতি ও বৃত্তাকৃতির বাহিনী বিন্যাস ১৩. পূর্বোক্ত ব্যূহসমূহের প্রতিব্যূহ রচনা

০১-০১-১১ সঙ্ঘবৃত্ত (সম্মিলিত জোট) নামক একাদশ অধিকরণের দুটি আলোচ্য বিষয় হলো—১. রাজার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার্থে জোটভুক্ত পক্ষসমূহে পারস্পরিক বিভাজন বা ভেদ সৃষ্টি ২. উপাংশুদণ্ড তথা গোপনে অন্তর্ঘাতমূলক হত্যাযজ্ঞ।

০১-০১-১২ আবলীয়স (বলবান শত্রু নৃপতির বিরুদ্ধে রাজার করণীয় নামক দ্বাদশ অধিকরণের নয়টি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. দূতদের মাধ্যমে কূটনৈতিক উদ্যোগ ২. মন্ত্রযুদ্ধ তথা প্রজ্ঞাবলে শত্রুকে পরাভূতকরণ ৩. বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সেনাপতি নিধন ৪. আত্মরক্ষার্থে রাষ্ট্রবৃত্তে উদ্দীপনা সৃষ্টি ৫. অস্ত্র, অগ্নি ও বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ পরিচালনা ৬. শত্রুর রসদ সরবরাহ পথে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং সম্পদ আহরণ নস্যাৎকরণ ৭. কপট উপায়ে শত্রুপক্ষকে প্রবঞ্চিতকরণ ৮. সৈন্যদের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে অবদমন ৯. একবিজয় তথা উপরোক্ত উপায়ে বলবান শত্রুকে দুর্বল করত রাজার বিজয় অর্জন।

০১-০১-১৩ দুর্গলম্ভোপায় তথা শত্রুর দুর্গ (নগর) দখলের কৌশল নামক ত্রয়োদশ অধিকরণের ছয়টি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. উপজাত তথা শত্রুপক্ষের বিভেদ সাধন ২. বিভিন্ন ধরনের ছদ্মবেশে শত্রুর নগর হতে নিষ্ক্রমণ ৩. অপসর্গ তথা বিভিন্ন ছদ্মবেশে গুপ্তচরদের শত্রু দেশে অবস্থান ৪. পর্যুপাসনকর্ম তথা সৈন্যদের মাধ্যমে শত্রুর নগর বেষ্টন ৫. অবমর্দ তথা শত্রুর নগর দখল ৬. লব্ধপ্রশমন তথা দখলকৃত নগরে শান্তি স্থাপন

০১-০১-১৪ ঔপনিষধিক (বিষ, ভেষজ, ঔষধি ও মন্ত্র প্রয়োগ) নামক চতুর্দশ অধিকরণের তিনটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—১. পরঘাত প্রয়োগ তথা শত্রু হত্যার জন্য ঔষধি উপাদান প্রয়োগ ২. প্রলম্ভন তথা ঔষধ ও মন্ত্ৰ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুকে প্রবঞ্চিতকরণ ৩. রাজার সৈন্যদের উপর শত্রুপক্ষ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ঔষধ, বিষ ও মন্ত্রের প্রভাব প্রতিকারকরণ।

০১-০১-১৫ তন্ত্রযুক্তি নামক পঞ্চদশ অধিকরণের একটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয়ের বক্তব্য হলো, একটিমাত্র অধ্যায়ে এই অধিকরণের আলোচনা সীমাবদ্ধ। এই গ্রন্থের প্রথম থেকে চতুর্দশ অধিকরণে সমাজ জীবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। শেষোক্ত অধিকরণে উদ্ধৃত হয়েছে অর্থশাস্ত্রের অর্থ নির্ণয়ের উপযোগী যুক্তিসমূহ।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ০১ প্রকরণ ॥

প্রথম অধিকরণের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কৌটিল্য কর্তৃক নির্ধারিত রাজ্য পরিচালনার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিদ্যার উপর আলোকপাত করে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে সেসব বিদ্যা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো।

০১-০২-০১ কৌটিল্যের বিবেচনায় বিদ্যা চার প্রকার। এই চার প্রকার বিদ্যা হলো—(ক) হেতু বা যুক্তিবিদ্যা (খ) ত্রয়ী বা ধর্মবিদ্যা (গ) বার্তা বা কৃষি উৎপাদন, পশুপালন এবং বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা (ঘ) দণ্ডনীতি বা রাজ্য পরিচালনার অনুশাসন বিষয়ক বিদ্যা।

সে-সময় রাজ্য পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় বিদ্যার প্রশ্নে ধর্মীয় পণ্ডিত বা ঋষিদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মতভেদ ছিল। কৌটিল্য এই ক্ষেত্রে ভিন্নতর মতগুলো উপস্থাপন করে যুক্তির মাধ্যমে তা খণ্ডন করে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠা করেন। চিন্তাবিদ মনুর শিষ্যগণ ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতিকেই মুখ্যবিদ্যা হিসেবে গণ্য করতেন। তাদের বিবেচনায় হেতুবিদ্যাকে আলাদা করে বিবেচনা করার আবশ্যকতা নেই। হেতুবিদ্যাকে তারা ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যা হিসেবে মনে করতেন। চিন্তাবিদ বৃহস্পতির অনুসারীগণ বার্তা এবং দণ্ডনীতিকেই প্রকৃত বিদ্যা হিসেবে বিবেচনার পক্ষপাতি ছিলেন। তাদের মতে, ত্রয়ীবিদ্যাকে আলাদা করে বিবেচনার আবশ্যকতা নেই। তারা মনে করতেন, ত্রয়ীবিদ্যা এমনিতেই উপরোক্ত দুটি বিদ্যায় অন্তর্লীন। চিন্তাবিদ শুক্রাচার্যের অনুসারীদের কাছে দণ্ডনীতিই একমাত্র অত্যাবশ্যক বিদ্যা হিসেবে বিবেচ্য। তারা মনে করতেন, এই বিদ্যাতেই অন্যান্য আবশ্যকীয় বিদ্যার উপস্থিতি বিদ্যমান। কৌটিল্য এ সমস্ত বিতর্ক যুক্তির মাধ্যমে খণ্ডন করে স্বীয় মতের চার প্রকারের বিদ্যার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

০১-০২-০২ কৌটিল্যের মতানুসারে—সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়ত বিষয়ক বিদ্যা হেতুবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। ধর্ম এবং অধর্মের প্রতিপাদ্য ত্রয়ীবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। অর্থনীতি এবং উৎপাদন বিষয়ক বিদ্যা বার্তার অন্তর্ভুক্ত। অনুশাসন বিষয়ক নেতিবাচক ও ইতিবাচক অনুষঙ্গ দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত। হেতুবিদ্যার মাধ্যমেই অপরাপর বিদ্যার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যৌক্তিকভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করে।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ০১ প্রকরণ

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন বর্ণের লোকদের উপর আরোপিত দায়িত্ব তথা স্বধর্ম পালনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চারবর্ণের কাঠামোর মধ্যে থেকে প্রত্যেকে যদি স্ব স্ব দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকে, তাহলে সামাজিক ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর থাকবে, এর অন্যথা হলে সামাজিক গতিশীলতা-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। সে আলোকেই কোন বর্ণের লোকেরা কি দায়িত্ব পালন করবে, সে বিষয় এখানে ব্যাখ্যাত হয়েছে।

০১-০৩-০১ এ পর্যায়ে ত্রয়ী তথা ধর্ম বিষয়ক বিদ্যার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সামবেদ, ঋগবেদ ও যজুর্বেদ এই তিনটি শাস্ত্রগ্রন্থকে সমন্বিতভাবে ত্রয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ত্রয়ীর নির্দেশনাক্রমে চার বর্ণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে চার বর্ণের লোকদের স্বধর্ম তথা কর্তব্য প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে।

ক. ব্রাহ্মণদের স্বধর্ম পালন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—তারা নিজেরা ধর্মগ্রন্থ পাঠে নিমগ্ন থাকবে। অন্যকে পাঠদান করবে। অন্যের উপকারার্থে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করবে। অন্যের কাছ থেকে দান-দক্ষিণা গ্রহণ করে জীবন নির্বাহ করবে এবং নিজেরাও দান খয়রাত করবে।

খ. ক্ষত্রিয়দের স্বধর্ম তথা কর্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—তারা অধ্যয়ন করবে। দেব দেবীর উপাসনা করবে। দান করবে। প্রতিরক্ষা পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করবে। সর্বোপরি প্রাণীকুলকে রক্ষার্থে দায়বদ্ধ থেকে দায়িত্ব পালন করবে।

গ. বৈশ্যদের স্বধর্ম তথা দায়িত্ব কর্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—তারা প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন করবে। দেব দেবীর উপাসনা করবে। দান খয়রাত করবে। কৃষি ও পশুপালনের মাধ্যমে উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকবে। একইভাবে সকল প্রকার বাণিজ্যিক কার্যে নিয়োজিত থাকবে।

ঘ. শূদ্রদের স্বধর্ম তথা দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে—তারা ব্রাহ্মণসহ অন্য দু বর্ণের লোকদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে। কৃষি, পশুপালন, পশুচারণ, ব্যবসা বাণিজ্য এবং কারুকার্যে নিয়োজিত থেকে উৎপাদন ও সেবা কর্মের মাধ্যমে স্বধর্ম পালন করবে।

০১-০৩-০২ উপরোক্ত চার বর্ণভুক্ত জনগোষ্ঠী ছাড়াও সমাজে আরও কিছু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি বিদ্যমান। এক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রযোজ্য স্বধর্ম বা দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে ব্রহ্মচারীদের (শিক্ষার্থী) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—সমাবর্তন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকবে। নিয়মিত অগ্নি উপাসনা করবে। ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করবে। আচার্য বা শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্যে অবস্থান করবে। প্রয়োজনে আচার্যের অনুপস্থিতিজনিত কারণে বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞ বৃদ্ধদের সঙ্গে বসবাস করবে। বানপ্রস্থাবলম্বীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে—তারা ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করবে। ভূমিতে শয়ন করবে। জটা ধারণ করবে। দেব দেবীর পূজা করবে। পিতৃলোক ও অতিথিদের সেবা করবে। বনজ ফল ফলাদি আহারের মাধ্যমে জীবনযাপন করবে। পরিব্রাজক ও সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে—তারা ইন্দ্রিয় সংযম সংরক্ষণ করবে। জাগতিক কর্মকাণ্ড হতে বিরত থাকবে। যাবতীয় বস্তুতে, সম্পদে নিজেদের স্বত্ব পরিত্যাগ করবে। জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করবে। নির্জন অরণ্যে বাস করবে এবং সর্বোতভাবে বাহ্যিক ও অন্তরের শুচিতা রক্ষা করবে। স্বধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সকল বর্ণ ও আশ্রমের লোকদের অহিংসাচরণ, সত্যনিষ্ঠা, শুদ্ধতা সংরক্ষণ, বিদ্বেষহীনতা, অনিষ্ঠুরতা এবং ক্ষমা প্রদর্শনের উপর গুরুত্বারোপ করে তা প্রতিপালনার্থে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

০১-০৩-০৩ সকল বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের উপর আরোপিত স্বধর্ম পালনের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে—আরোপিত দায়িত্ব যদি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়, অর্থাৎ যাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করা হয়েছে তা যদি সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয় তাহলে সমাজ ও রাজ্যে সদাচারের নিয়মকানুন বিরাজমান থাকবে, এর ফলে অনন্ত সুখের পরিবেশ বিরাজ করবে। এর অন্যথা হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে প্রজাকুল যাতে করে স্বধর্মের প্রতি প্রতিজ্ঞ থেকে তা প্রতিপালনে সক্রিয় থাকে, স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয়, সে ব্যাপারে রাজাকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে—স্বধর্মচ্যুত সমাজ অচিরেই বিনাশ হয়ে যায়, অন্যদিকে স্বধর্মাশ্রিত সমাজে বিরাজ করে অনাবিল সুখ শান্তি। পরকালের স্বর্গপ্রাপ্তিও হয় সুনিশ্চিত (বর্ণবাদী ব্যবস্থা যদিও আজকের দিনে সমর্থনযোগ্য নয়, তদুপরি সে-সময় বর্ণবাদভিত্তিক যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল তা ছিল আধুনিক কালের Functionalist তাত্ত্বিকদের ধ্যান- ধারণার আদিম সংস্করণ, সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খাইম যেমনটা মনে করতেন, বিভাজিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি যথার্থভাবে কার্যকর না থাকে, তাহলে সমাজে অচলাবস্থা দেখা দেয়, সমাজব্যবস্থায় নৈরাজ্য নেমে আসে। কৌটিল্যও তেমনটি ভেবেছিলেন বর্ণবাদী সমাজের খোলসে—লেখক)

চতুর্থ অধ্যায় ॥ ০১ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে বার্তা তথা কৃষি উৎপাদন, পশুপালন, বাণিজ্য এবং দণ্ডনীতি বা অনুশাসন সম্পর্কিত বিদ্যার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-০৪-০১ কৃষি উৎপাদন, পশুপালন ও বাণিজ্য, বার্তা-বিদ্যার মূল প্রতিপাদ্য। বলা হয়েছে—বাণিজ্যিক কর্মযজ্ঞ এবং উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমেই রাজকোষের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যে কারণে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বার্তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। যে রাজ্যের রাজকোষ যত সমৃদ্ধ হবে সে রাজ্য তত বেশি কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। এ বিদ্যার মাধ্যমে রাজকোষ বৃদ্ধি করে রাজা অনুশাসন বা দণ্ডের দ্বারা বিরূপ পক্ষকে সহজে বশীভূত করতে পারবে।

হেতুবিদ্যা, ত্রয়ী এবং বার্তার কার্যকারিতা নিশ্চিত হয় দণ্ড বা অনুশাসনের মাধ্যমে। দণ্ড বা ফলপ্রসু অনুশাসনের মাধ্যমেই প্রত্যাশিত বস্তু বা সম্পদ অর্জিত হয়, সংরক্ষিত হয় এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ দণ্ডনীতি বা অনুশাসনের উপরই নির্ভর করে আর্থ সামাজিক সমৃদ্ধির সার্বিক দিক। যে কারণে আচার্যগণ মনে করতেন—প্রাণীকুলকে (জনগণ) নিয়ন্ত্রণ করবার একমাত্র মোক্ষম অস্ত্র হলো দণ্ড, এর কোনো বিকল্প নেই।

০১-০৪-০২ আচার্যগণের দণ্ড প্রয়োগের এ ধরনের মতবাদের সঙ্গে কৌটিল্য সহমত পোষণ করেননি। তাঁর মতে—অতিমাত্রায় দণ্ড প্রদানকারী রাজা জনগণের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। অন্যদিকে দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে রাজা শিথিলতা প্রদর্শন করলে জনগণের কাছে দুর্বল শাসক হিসেবে বিবেচিত হন। এক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী যথোপযুক্ত দণ্ড প্রদান করাই উত্তম বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর মতে—অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অপরাধীর বিরুদ্ধে দণ্ড প্রয়োগ না করা হলে মাৎস্যন্যায়ের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায় তেমনি বলবানরা দুর্বলদের গ্রাস করে, উৎপীড়ণ করে, এর ফলে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়। অন্যদিকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দণ্ড প্রযুক্ত হলে জনসমাজ যেমন সুরক্ষিত থাকে তেমনি রাজার অনুশাসনও থাকে যথার্থভাবে কার্যকর।

০১-০৪-০৩ কৌটিল্য মনে করেন—চার বর্ণ এবং অন্যান্য আশ্রমের লোকেরা রাজার অনুশাসনের (দণ্ডের) মাধ্যমে প্রতিপালিত হলে নিজ নিজ ধর্মের এবং কর্মের প্রতি প্রতিজ্ঞ থেকে সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করতে সক্ষম হয়।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ০২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে হেতুবিদ্যা পরিজ্ঞাত জ্ঞানবান বৃদ্ধদের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক, সম্পৃক্ততার উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-০৫-০১ বলা হয়েছে—হেতুবিদ্যা, ত্রয়ী ও বার্তার মূল চালিকাশক্তি দণ্ডনীতিজ্ঞান। এই দণ্ডনীতির মূল গূঢ়ার্থ হলো—শৃঙ্খলা বা শিক্ষা। এক্ষেত্রে প্রচেষ্টার মাধ্যমে যেমন শিক্ষা লাভ করা যায়, তেমনি আবার স্বাভাবিকভাবেও তা অর্জন করা যায়। বলা হয়েছে—শিক্ষা সেই ব্যক্তিকেই শিক্ষিত করতে পারে, যিনি আচার্যের উপদেশ শ্রবণে ইচ্ছুক, শ্ৰুত বিষয়ের সারবত্তা হৃদয়ঙ্গমে সক্ষম, বিষয়বস্তু স্মৃতিতে ধারণে সক্ষম, বিধৃত বিষয় সম্পর্কে পরিজ্ঞাত, অব্যক্ত বিষয় সম্পর্কে অনুমান করতে সক্ষম, অন্যের যুক্তি খণ্ডনে ও পাল্টা যুক্তি প্রদানে সক্ষম, তাত্ত্বিক বিষয়ের স্বরূপ সন্ধানে সক্ষম এবং শুশ্রূষায় সক্ষম। এই আটটি গুণ যার মধ্যে অনুপস্থিত, তিনি শিক্ষা গ্রহণ সত্ত্বেও শিক্ষিত হতে পারেন না।

০১-০৫-০২ আচার্যগণ তাদের নিজ নিজ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করে থাকেন। সে আলোকেই শিক্ষার্থীদের বিদ্যার্জন করতে হয়। এ প্রসঙ্গে রাজপুত্রগণের শিক্ষা লাভের বিষয়ে বলা হয়েছে—তিন বা পাঁচ বছর বয়সে মুণ্ডন সংস্কারের পর রাজপুত্ররা বর্ণমালা ও গণিত বিষয়ক শিক্ষা লাভ করবে। গায়ত্রীর উপদেশ লাভ করার পর তারা অভিজ্ঞ আচার্যগণের কাছে ধর্মবিদ্যা (ত্রয়ী) ও হেতুবিদ্যা বিষয়ক এবং প্রশাসনিক প্রধানগণের কাছে বার্তাবিদ্যা ও দণ্ডনীতি বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করবে।

০১-০৫-০৩ বলা হয়েছে—রাজপুত্ররা ষোল বছর বয়স পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করবে। অতঃপর তারা গো-দান সংস্কার সম্পন্ন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এর পরও শিক্ষার উৎকর্ষের জন্য তারা জ্ঞানবান বৃদ্ধদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। শিক্ষা গ্রহণ প্রাক্কালে রাজকুমারগণ দিনের প্রথম ভাগে হস্তিবিদ্যা, রথবিদ্যা এবং অস্ত্রবিদ্যা সম্পর্কিত শিক্ষা গ্রহণ করবে। দিনের শেষভাগে ইতিহাস বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করবে। শিক্ষা গ্রহণের পর যে বিষয় আত্মস্থ হয়নি, সে বিষয় জ্ঞানবানদের কাছ থেকে পুনঃ পুনঃ শ্রবণ করে তা আত্মস্থ করবে।

০১-০৫-০৪ এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যার্জনের মাধ্যমে রাজকুমারগণ রাজ্য পরিচালনার জন্য নিজেদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলবে এবং সমগ্র পৃথিবী ভোগের নিমিত্ত নিজেদের সক্ষম করে তুলবে।

ষষ্ঠ অধ্যায় ॥ ০৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে কাম, ক্রোধসহ ছয় রিপু বর্জনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় জয়ের কথা আলোচিত হয়েছে। কাম, ক্রোধ তথা ছয় রিপু নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতার কারণে ইতোপূর্বে যে সব রাজা ধ্বংস হয়েছেন, তাদের উদ্ধৃতিক্রমে এ বিষয়ক বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে।

০১-০৬-০১ বলা হয়েছে—কাম, ক্রোধ, লোভ, মান, মদ ও হর্ষ পরিহারের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় জয়করণ অত্যাবশ্যক। এখানে কাম বলতে পরস্ত্রীর প্রতি অভিলিপ্সা, ক্রোধ বলতে ঈর্ষার মাধ্যমে চিত্তের বিকারগ্রস্ততা, লোভ বলতে পরের দ্রব্য গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা, মান বলতে মূর্খতাপ্রসূত নিজেকে উৎকৃষ্টতর মনে করা, মদ বলতে ধনবান বা বিদ্যান হিসেবে আত্মম্ভরিতা এবং হর্ষ বলতে প্রত্যাশিত বস্তু উপভোগের মাধ্যমে উদ্ভূত পরিতৃপ্তির কথা বোঝানো হয়েছে। নিষ্কলুষ জীবনের প্রশ্নে ইন্দ্রিয়জয়ের জন্য এসব রিপু পরিত্যাজ্য হিসেবে চিহ্নিত।

০১-০৬-০২ এ পর্যায়ে ইন্দ্রিয় জয় না করে অসংযত জীবনাচারের কারণে ইতোপূর্বে যারা ধ্বংস হয়েছিল তাদের সম্পর্কে আলোকপাত প্ৰসঙ্গে বলা হয়েছে—

ক. ভোজবংশীয় দাওক্য নামক রাজা এবং বিদেহাধিপতি করাল কামপরবশ হয়ে দুই ব্রাহ্মণকন্যার প্রতি কামভাব প্রদর্শন করায় কন্যাদ্বয়ের পিতা এবং স্বামীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে বন্ধুবর্গসহ রাজ্য সমেত বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিল।

খ. জনমেজয় নামক এক রাজা অশ্বমেধযজ্ঞস্থলে ব্রাহ্মণগণের উপর ক্রোধ প্রকাশ করায় অভিশপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়েছিল। তালজঙ্গ নামক এক রাজা ভৃগুবংশীয়গণের উপর পরাক্রম প্রদর্শনের জন্য অভিশপ্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

গ. লোভের বশবর্তী হয়ে ইলানন্দন এবং সৌবীর রাজ্যের অধিপতি অজবিন্দু ব্রাহ্মণসহ চতুর্বর্ণের লোকদের পীড়ণ করে অতিরিক্ত ধনলিপ্সার কারণে তাদের বিক্ষোভের কোপানলে পড়ে ধ্বংস হয়েছিল।

ঘ. আত্মম্ভরিতার কারণে লঙ্কাধিপতি রাবণ রামপত্নী সীতাকে অপহরণ করে প্রত্যর্পন না করে এবং কৌরব রাজা দূর্যোধন পাণ্ডবগণকে রাজ্যের অংশবিশেষ ফিরিয়ে না দিয়ে ধ্বংস হয়েছিল।

ঙ. মদ বা অহঙ্কার হেতু প্রজাগণকে অবমাননা করে রাজা ডম্বোদ্ভব নরনারায়ণের কাছে পরাস্ত হয়ে এবং হেহয় দেশের রাজা অর্জুন পরশুরামের হাতে বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিল।

চ. বাতাপি নামক এক অসুর হর্ষবশত ঋষি আগস্ত্যকে এবং মহর্ষি দ্বৈপায়নকে অতিমাত্রায় উৎপীড়িত করার কারণে তাদের অভিশাপে ধ্বংস হয়েছিল।

০১-০৬-০৩ এরা ছাড়াও আরও অনেক রাজা ইন্দ্রিয় জয় করতে ব্যর্থ হয়ে স্বজন ও রাজ্যসহ সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল। অন্যদিকে ইন্দ্রিয় জয় করতে সমর্থ হয়ে জামদগ্ন্য, অম্বরীয় এবং নাভাগ রাজা দীর্ঘকাল পৃথিবীকে ভোগ করতে সক্ষম হয়েছিল।

সপ্তম অধ্যায় ॥ ০৩ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রাজন্যদের ইন্দ্রিয় জয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-০৭-০১ এখানে বলা হয়েছে, রাজাগণ ষড়রিপু অবদমনপূর্বক ইন্দ্ৰিয় জয়ে সচেষ্ট থাকবেন। জ্ঞানবান বৃদ্ধদের সংস্পর্শে থেকে নিজ নিজ প্রজ্ঞা বিকাশে মনোনিবেশ করবেন। বিদ্যার উপদেশ শুনে সংযম বিষয়ক শিক্ষা আত্মস্থ করে প্রজাহিতকর কাজে রাজকর্তব্য সম্পাদন করবেন।

০১-০৭-০২ এভাবে জিতেন্দ্রিয় রাজা পরস্ত্রী, পরধন, ঈর্ষা বিদ্বেষ বর্জন করবেন। আলস্য, নিদ্রা, অকারণ চপলতা, মিথ্যাবাদীতা এবং অধর্মীয় সকল কিছু পরিহার করবেন। ধর্ম, অর্থ এবং কামের প্রশ্নে রাজা কখনো সীমালঙ্ঘন করবেন না।

০১-০৭-০৩ রাজা, আচার্য এবং অমাত্যগণকে কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী যথাযথ মর্যাদাপূর্ণ পদে পদায়ন করবেন। একইভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরাও রাজাকে অনাহূত কাজ থেকে নিবৃতকরণে যথার্থভাবে সচেষ্ট থাকবেন। একচাকা দিয়ে যেমন রথ চলে না, তেমনি রাজার একার পক্ষে অমাত্যদের সহযোগিতা ছাড়া রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।

অষ্টম অধ্যায় ॥ ০৪ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজ অমাত্যের ইন্দ্রিয় জয়, গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নিয়োগ সম্পৃক্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-০৮-০১ এই উপ অধ্যায়ে অমাত্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আচার্যগণের মতবাদের উদ্ধৃতি শেষে তা খণ্ডন করে কৌটিল্যের অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আচার্য ভারদ্বাজ বলেন—শুচিতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অভিহিত থাকেন বিধায় রাজা তার সহপাঠিদের মধ্য হতেই অমাত্য নিয়োগ করবেন। আচার্য বিশালাক্ষ এক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—যেহেতু সহপাঠিরা রাজার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই সম্পৃক্ত থাকে, সেহেতু তারা অমাত্য পদে অধিষ্ঠিত হলে রাজার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারেন, এ কারণে সহপাঠিদের মধ্য হতে অমাত্য নিয়োগ সমীচীন নয়। তার মতে—রাজার সঙ্গে গোপনীয় কোনো বিষয়ে সম-মানসিকতা-সম্পন্ন এবং যাদের সম্পর্কে রাজা সম্যক অবহিত, তাদের মধ্য হতেই অমাত্য নিয়োগ আবশ্যক। এক্ষেত্রে যেহেতু রাজা তাদের অন্তরঙ্গ বহু বিষয়ে পরিজ্ঞাত সেহেতু তারা রাজার ভয়ে অপরাধমূলক কোনোকিছু করতে সাহস করবে না। আচার্য পরাশর এই মতের সাথে সহমত প্রদর্শন করেন না। তিনি মনে করেন—এক্ষেত্রে রাজা যেমন অমাত্যদের দুর্বল দিক সম্পর্কে পরিজ্ঞাত, অমাত্যরাও তেমনি রাজার দুর্বলতার ব্যাপারে জ্ঞাত, এ কারণে রাজা অনেক সময় বাধ্য হয়ে অমাত্যদের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপ অনুমোদন করতে পারেন।

০১-০৮-০২ এই বিষয়ে আচার্য পরাশর আরও মনে করেন—যতজন লোকের কাছে রাজা নিজের চারিত্রিক গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করবেন, ততজনের কাছেই তিনি বশীভূত হয়ে থাকবেন। এ কারণে রাজার গোপনীয় বিষয়ে পরিজ্ঞাত অন্তরঙ্গ কাউকে অমাত্য পদে নিয়োগ প্রদান যথাযথ নয়। তার মতে— রাজার প্রাণনাশের শঙ্কার সময় যারা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন, বিশ্বস্ততার সুবাদে তাদের মধ্য হতেই অমাত্য পদে নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। আচার্য পিশুন পরাশরের এই ভাবনা সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—এ ধরনের কাজ রাজভক্তির নামান্তর। এতে বুদ্ধিমত্তার কোনো উপাদান নেই। তার মতে, রাজা যোগ্যতার ভিত্তিতে সেসব লোকদেরই অমাত্য হিসেবে নিয়োগ করবেন, যাদের মাধ্যমে অর্থাগম নিশ্চিত হবে। আচার্য কৌণপদন্ত পিশুনের এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—এ ধরনের লোকেরা অন্যান্য গুণসম্পন্ন নয়, তাদের প্রতিশ্রুতিও রাজার কাছে পরিজ্ঞাত নয়। অতএব রাজা যাদের পূর্বপুরুষের চারিত্রিক সততার বিষয়ে পরিজ্ঞাত, বংশপরম্পরায় যারা পরীক্ষিত, তাদের মধ্য হতেই রাজকার্যের জন্য অমাত্য নিয়োগ করবেন। তিনি মনে করেন—গরুরা যেমন নিজ গোত্র ছাড়া অন্যত্র অবস্থানে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না, সহসাই অপরিচিত গো-দল পরিত্যাগ করে থাকে, তেমনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এ ধরনের অমাত্যরা কখনো রাজাকে পরিত্যাগ করে যায় না।

০১-০৮-০৩ আচার্য বাতব্যাধি কৌণপদন্তের এ ধরনের মতবাদ সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—রাজার কাছে পূর্ব হতে পরিজ্ঞাত যারা তারা অমাত্য হলে রাজার বৈভব করায়ত্ত করে নিজেরাই রাজার মতো আচরণ করবে। এক্ষেত্রে পূর্ব হতে সম্বন্ধ রহিত লোকদেরই অমাত্য হিসেবে নিয়োগ করা সমীচীন, এ ধরনের অপরিচিত অমাত্যরা রাজদণ্ডের ভয়ে ভীত থেকে অপরাধ সংঘটনে কখনো সচেষ্ট হবে না। আচার্য বাহুদন্তীপুত্র বাতব্যাধির উপরোক্ত মতবাদের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে বলেন—অনভিজ্ঞ লোকেরা নীতিশাস্ত্ৰ বিষয়ক কর্ম সম্পাদন প্রাক্কালে অজ্ঞতাজনিত কারণে বিষাদগ্রস্ত হয়ে বিফল হবেন। এক্ষেত্রে অভিষ্ট অর্জনে সফলতার স্বার্থে উচ্চবংশজাত, প্রজ্ঞাবান, চরিত্রবান, উদ্যমী এবং রাজার প্রতি অনুরক্ত লোকদেরই অমাত্য পদে নিয়োগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

০১-০৮-০৪ আলোচিত সকল আচার্যের মতামতকেই কৌটিল্য যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। তাঁর মতে—স্থান কাল পাত্র ভেদে প্রজ্ঞা, শাস্ত্র সংস্কার এবং শক্তি সামর্থের উপর নির্ভর করে সকল কাজের সফলতা। সে মোতাবেক রাজা প্রয়োজনের নিরিখে অমাত্য নিয়োগ করতে পারেন।

নবম অধ্যায় ॥ ০৫ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজ পুরোহিত, অমাত্য এবং মন্ত্রীদের যোগ্যতা ও নিয়োগের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া কোন শ্রেণির অমাত্যদের কোন ক্ষেত্রে পদায়ন করতে হবে, সেসব বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০১-০৯-০১ এই উপ অধ্যায়ে প্রধান অমাত্য বা মন্ত্রীর যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে সম্ভাব্য মন্ত্রীকে—১. রাজার রাজত্বে জন্মগ্রহণকারী হতে হবে ২. হতে হবে অভিজাত ও উচ্চ বংশজাত ৩. রাজাকে ও নিজেকে ভ্রান্তিমূলক কাজ হতে নিবৃতকরণে সমর্থ হতে হবে ৪. হস্তি আরোহন, অশ্বারোহন, রথযুদ্ধ, অস্ত্র চালনা এবং শিল্পবিদ্যায় সক্ষম ও পারদর্শী হতে হবে ৫. অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হবে ৬. প্রজ্ঞাবান হতে হবে ৭. প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে হবে ৮. চটজলদি কর্মসাধনে পটু হতে হবে ৯. মানুষকে সম্মোহিত করার মতো বাগ্মীতার অধিকারী হতে হবে ১০. পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো সাহসিকতা সম্পন্ন হতে হবে ১১. করণীয় সম্পর্কে নিশ্চয়তা দানে সক্ষম হতে হবে ১২. উৎসাহ দেওয়ার মতো প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হবে ১৩. অন্যকে প্রভাবিত করার যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে ১৪. কষ্ট সহিষ্ণু হতে হবে ১৫. বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী হতে হবে ১৬. সকলের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন হতে হবে ১৭. প্রভুর প্রতি অবিচল আস্থাশীল হতে হবে ১৮. আচরণগতভাবে সদাচারী হতে হবে ১৯. দৈহিকভাবে শক্ত সমর্থ হতে হবে ২০. নিরোগ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে ২১. প্রবলভাবে ধৈর্যশীল হতে হবে ২২. নিরহঙ্কারী হতে হবে ২৩. চপলতারহিত হতে হবে ২৪. বাহ্যিকভাবে সৌম্য দর্শনসম্পন্ন হতে হবে ২৫. অচরণগতভাবে বৈরীতা অনুৎপাদক সম্পন্ন হতে হবে। এহেন গুণাবলির পুরোটাই যার মধ্যে পরিদৃষ্ট হবে তিনি হবেন উত্তম শ্রেণির অমাত্য, এর এক চতুর্থাংশ যার মধ্যে ঘাটতি থাকবে তিনি হবেন মধ্যম শ্রেণির অমাত্য, যার মধ্যে অর্ধেক ঘাটতি থাকবে তিনি হবেন অধম শ্রেণির অমাত্য।

০১-০৯-০২ রাজা এই তিন শ্রেণির অমাত্যের গুণাবলি যাচাই করে নিবেন। বিশ্বস্ত গুপ্তচর মারফত তাদের জন্মস্থান ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পরীক্ষণের মাধ্যমে পরিজ্ঞাত হবেন। বিদ্যাবিদগণের মাধ্যমে তাদের হস্তি, অশ্ব ও রথারোহন, যুদ্ধবিদ্যা এবং শিল্পমান সম্পর্কে অবহিত হবেন। কর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের প্রজ্ঞা, ধারণক্ষমতা এবং সার্বিক দক্ষতা যাচাই করাবেন। কাজের সময় আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের বাগ্মিতা, সাহসিকতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতার বিষয় যাচাই করবেন। আপৎকালীন অবস্থায় সাহসিকতা, প্রভাব এবং কষ্টসহিষ্ণুতার বিষয় যাচাই করবেন। সার্বিক আচার আচরণ থেকে শুদ্ধতা, মৈত্রীভাব, প্রভুভক্তি সম্পর্কে অবহিত হবেন। তাদের সঙ্গে বসবাসকারীদের কাছ থেকে চারিত্রিক দিক, শারীরিক সামর্থ, রোগহীনতা, ধৈর্য, আত্মম্ভরিতা এবং অচপলতা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন। প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমে তাদের সৌম্য দর্শনের দিক এবং অন্যের সঙ্গে অবৈরীতা সম্পর্কে জ্ঞাত হবেন।

০১-০৯-০৩ বলা হয়েছে—রাজ কার্য প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও অনুমেয়—এই তিন ধরনের উপায়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কিছু কাজ প্রত্যক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হয়, কিছু কাজ পরোক্ষভাবে অন্যের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয় এবং কিছু কাজ অসম্পাদিত অবস্থায় সম্পন্ন কাজের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। অমাত্য কর্ম বিষয়ক আলোচনার এ পর্যায়ে ইতি টানা হয়েছে।

০১-০৯-০৪ এই উপ অধ্যায়ে পুরোহিত নিয়োগের ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজা উচ্চকুলে জন্মগ্রহণকারী, নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী, ধর্মবিদ্যায় প্রাজ্ঞ, জ্যোতিষশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, দণ্ডনীতিশাস্ত্রে সুশিক্ষিত, মন্ত্ৰ প্রয়োগের মাধ্যমে ও সামদানাদি উপায়ে যিনি দৈব ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপত্তি নিষ্পত্তিতে সক্ষম, তাকেই পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন।

দশম অধ্যায় ॥ ০৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন ছল ছাতুরি ও কলা কৌশলের মাধ্যমে অমাত্যদের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা যাচাইয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। মুখ্যত গুপ্তচরদের মাধ্যমে রাজাকে এ সমস্ত কার্য সম্পাদন করতে হয়। কঠিন যাচাই বাছাইয়ের পর নিষ্কলুষতা প্রমাণ সাপেক্ষে অমাত্যদের নিয়োগ কার্যকর করা হয়ে থাকে।

০১-১০-০১ বলা হয়েছে—রাজা অমাত্যগণকে অগুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করে মন্ত্রী ও পুরোহিতের সহযোগিতায় উপধা বা বিভিন্ন ছলা কলার মাধ্যমে তাদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা যাচাই করে নিবেন। এক্ষেত্রে রাজার নিয়োজিত সত্রি নামক গুপ্তচরেরা লক্ষ্যীভূত (Targated) অমাত্যর কাছে ধর্মহীনতার অভিযোগ উত্থাপন করে রাজার বিরুদ্ধে দ্রোহের আহ্বান জানিয়ে রাজাকে পদচ্যুতকরণের জন্য প্ররোচিত করবে, সংশ্লিষ্ট অমাত্য যদি এতে প্ররোচিত না হয়ে গুপ্তচরের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন, তাহলে তাকে চারিত্রিক সততাসম্পন্ন এবং রাজার প্রতি অনুগত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ধর্ম বিষয়ক অমাত্যের এই পরীক্ষাকে বলা হয় ধর্মোপধা।

০১-১০-০২ একইভাবে রাজা কর্তৃক নিযুক্ত সত্রী নামক গুপ্তচরেরা অমাত্যের আর্থিক লোভ লালসার বিষয়ে পরীক্ষার জন্য অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে রাজাকে বিনাশের ব্যাপারে প্ররোচিত করবে। অমাত্য যদি আর্থিক প্রণোদনায় প্রলুব্ধ না হয়ে রাজার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনে প্রতিজ্ঞ থাকেন, তাহলে তিনি আর্থিক দিক দিয়ে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট পরীক্ষণ বিধায় এই প্রক্রিয়ায় ছলনামূলক পরীক্ষাটিকে অর্থোপধা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

০১-১০-০৩ একই প্রক্রিয়ায় ছল চাতুরির তরিকা অবলম্বন করে গুপ্তচরদের মাধ্যমে রাজা তার অমাত্যের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা পরীক্ষা করাবেন। এক্ষেত্রে রাজপ্রাসাদের কোনো বিশ্বস্ত ভিক্ষুকি গুপ্তচর হিসেবে রাজা কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে লক্ষ্যীভূত অমাত্যকে এই মর্মে প্ররোচিত করবে যে, রাজমহিষী তার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, এ প্রস্তাবে সম্মত হলে তিনি আর্থিকভাবেও লাভবান হবেন। অমাত্য যদি এতে সম্মতি জ্ঞাপন না করে তা প্রত্যাখান করেন, তাহলে তিনি চারিত্রিক দিক দিয়ে নির্মল চরিত্রের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। কাম বিষয়ক পরীক্ষা হেতু এ ধরনের পরীক্ষাকে বলা হয়েছে কামোপধা।

০১-১০-০৪ পরের পরীক্ষাটি ভীতি প্রদর্শনমূলক হেতু সেটিকে বলা হয়েছে ভয়োপধা। এক্ষেত্রে রাজার বিশ্বাসভাজন কোনো এক অমাত্য বিবাহ বা বনভোজন জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে অন্য সকল অমাত্যকে সমবেত করাবেন। অতঃপর কাপটিক নামক গুপ্তচরগণ অমাত্যদের মনোভাব যাচাইয়ের জন্য লক্ষ্যীভূত অমাত্যের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করবে যে, বর্তমান রাজা অসদাচারণকারী, তাকে হত্যা করে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিতকরণ আবশ্যক। এ ব্যাপারে অন্য সকলেই সহমত পোষণ করেছেন। ভীত না হয়ে সংশ্লিষ্ট অমাত্য যদি গুপ্তচরের এই প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ না করে তা প্রত্যাখান করেন, তাহলে তিনি বিশুদ্ধ চিত্তের অমাত্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।

০১-১০-০৫ এই চার প্রকার যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সব অমাত্য ধর্মীয় দিক দিয়ে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিজ্ঞাত হবেন, তাদের ধর্মীয় ও বিচারিক পদে নিযুক্তি প্রদান করতে হবে। অর্থিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে যারা বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিজ্ঞাত হবেন তাদের পদায়ন করতে হবে সম্পদ রক্ষা ও সম্পদ আহরণের দায়িত্বে। কাম ভাবের দিক দিয়ে যারা নির্মল চরিত্রের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন, তাদের উপর অর্পন করতে হবে রাজার স্ত্রীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব। ভীতি উপেক্ষা করে যারা নির্ভীক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন, তাদের উপর অর্পণ করতে হবে রাজাকে রক্ষা করার দায়িত্ব। যারা চার ধরনের যাচাই পরীক্ষাতেই নিষ্কলুষ হিসেবে নিজেদের উপযুক্ততা প্রমাণে সক্ষম হবেন, রাজা তাদের মন্ত্রিত্বের পদে নিযুক্ত করবেন। অন্যদিকে যে সমস্ত অমাত্য এই চারটি যাচাই পরীক্ষায় অশুদ্ধ বা অনুপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন, রাজা তাদের খনিজ দ্রব্য আহরণ, হস্তি লালন পালন ও কারখানাসহ বিভিন্ন শ্রমসাধ্য কর্মক্ষেত্রের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন।

০১-১০-০৬ ধর্ম, অর্থ, কাম ও ভয়—এই চতুর্বিদ যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অমাত্যগণকে নিজ নিজ গুণাগুণ অনুযায়ী রাজকার্যে পদায়নের এই তরিকাটি পূর্ববর্তী আচার্যগণের অভিমত প্রসূত। কৌটিল্য এই প্রক্রিয়ায় অমাত্যগণের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের পক্ষপাতী নন। তিনি মনে করেন—অমাত্যদের চরিত্র পরীক্ষার কাজে রাজা ও রাজ মহিষীগণকে সম্পৃক্তকরণ সমীচীন নয়। এছাড়াও অমাত্যদের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য এভাবে গুপ্তচরের মাধ্যমে প্ররোচিত বা প্রলুব্ধ করাও অনুচিত। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন—কারো দ্বারা প্রলুব্ধ বা প্ররোচিত হয়ে যদি নিষ্কলুষ কোনো অমাত্যের মধ্যে অশুভ চেতনা জাগ্রত হয় তাহলে তাকে অবদমন করা কঠিন হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি পরিহারকল্পে রাজা প্রয়োজনরবাধে সত্রী নামক গুপ্তচরদের মাধ্যমে অমাত্যদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা, অশুদ্ধতা যাচাই করতে সচেষ্ট হবেন।

একাদশ অধ্যায় ॥ ০৭ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রাজা কর্তৃক গুপ্তচর নিয়োগের বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যের সাথে আলোচিত হয়েছে। মূলত কৌটিল্যের নির্দেশিত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গুপ্তচরদেরই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এক কথায়, এদের উপরই অর্পন করা হয়েছে রাজ্যের নিরাপত্তাসহ সার্বিক আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাপনার চাবিকাঠি। জালের মতো বিস্তৃত করা হয়েছে গুপ্তচরদের কর্মকাণ্ডের পরিধি

০১-১১-০১ বলা হয়েছে—পূর্বোক্ত চারটি বিষয়ে অমাত্যদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়ার পর রাজা সার্বক্ষণিকভাবে অমাত্যদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য বিভিন্ন ধরনের গুপ্তচর নিয়োগ করবেন। এক্ষেত্রে রাজা বা প্রধান অমাত্য, ছাত্র ও অধ্যাপকদের ছদ্মবেশধারী ‘কাপটিক’, উদাসীন সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশধারী ‘উদাস্থিত’, গৃহস্থের ছদ্মবেশধারী ‘গৃহপতিক’ বণিকের ছদ্মবেশধারী

বণিকের ছদ্মবেশধারী ‘বৈদেহক’, তপস্বীর ছদ্মবেশধারী ‘তাপসব্যঞ্জন’ নানা শাস্ত্রে অধ্যয়নকারীর ছদ্মবেশধারী ‘সত্রী’, সাহসী শক্তিমান ব্যক্তির ছদ্মবেশধারী ‘তীক্ষ্ণ’, বিষ প্রয়োগে অকুণ্ঠিত ‘রসদ’, এবং দরিদ্র ভিখারিনির ছদ্মবেশধারী গুপ্তচরদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিযুক্ত করবেন। কাপটিক নামধারী গুপ্তচররা রাজা ও প্রধান অমাত্যের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে অপরাপর অমাত্যদের ছিদ্রান্বেষণে নিযুক্ত থাকবে এবং যেসব অনিয়ম, অনুচিত ও অনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবে তা রাজা ও প্রধান অমাত্যকে অবহিত করবে। অন্যান্য গুপ্তচররাও নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্রে অবস্থান করে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহের কাজে নিমগ্ন থেকে দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাজা ও প্রধান অমাত্যের সমীপে সংগৃহীত তথ্য পেশ করবে।

০১-১১-০২ প্রজ্ঞাবান ও বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী সন্ন্যাসচ্যুত ব্যক্তিদের উদাস্থিক নামীয় গুপ্তচর হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে। ধন সম্পদ প্রদান করে এদের দূরবর্তী স্থানে কৃষি, বাণিজ্য বা পশুপালন কাজে প্রেরণ করতে হবে। সন্ন্যাসী বেশের এই গুপ্তচররা বৌদ্ধ, জৈন, পশুপাতসহ অন্যান্য সম্প্রদায়কে বশীভূত করে রাজার প্রতি অনুগত রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

০১-১১-০৩ ইতোপূর্বে সম্পদশালী গৃহস্থ ছিল কিন্তু বর্তমানে সম্বলহীন, এ ধরনের প্রজ্ঞাবান ও আস্থাশীল লোকদেরই গৃহপতিক গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে কৃষিকর্মে নিযুক্ত করাতে হবে। তারা সুনির্দিষ্ট এলাকায় চাষাবাদের কাজে নিয়োজিত থেকে কৃষক সম্প্রদায়কে রাজানুগত রাখার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একইভাবে পূর্বে সফল ব্যবসায়ী ছিল কিন্তু বর্তমানে নিঃস্ব, এ ধরনের আস্থাশীল ও চৌকষ লোকদের বৈদিহক তথা বণিকবেশী গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে রাজানুগত রাখার ব্যবস্থা করাতে হবে।

০১-১১-০৪ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা জটাধারী সন্ন্যাসীদের যারা জীবিকার নিমিত্তে রাজকার্যে নিযুক্ত হতে চায় তাদের তাপসব্যঞ্জক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিয়োজিত করাতে হবে। এরা জ্যোতিষী হিসেবেও সমাজে নিজেদের পরিচিতি জাহির করাবে এবং কৌশলে রাজানুগত্যের ব্যাপারে জনগণকে প্ররোচিত করবে। এদের কাছে কেউ রাজার হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে প্রতিভাত হলে তাকে যেমন পুরস্কৃত ও সম্মানিত করাতে হবে, তেমনি অকারণে কেউ রাজবিদ্বেষী হিসেবে প্রতিভাত হলে তাকে গোপনে হত্যা করাতে হবে।

০১-১১-০৫ এরা ছাড়াও অন্যান্য গুপ্তচরেরা সর্বত্র নিজ নিজ ক্ষেত্রে রাজানুগত ও রাজার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকবে। এক্ষেত্রে যারা রাজার প্রতি অনুগত হিসেবে বিবেচিত হবে তাদের রাজানুগ্রহ প্রদানসহ সম্পদ ও ঐশ্বর্যে পুরস্কৃত ও সন্মানিত করতে হবে। অন্যদিকে যারা অকারণে রাজার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত হবে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে হবে এবং কূটকৌশলে তাদের হত্যা করতে হবে।

দ্বাদশ অধ্যায় ॥ ০৮ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে গুপ্তচরদের কার্যে নিয়োজন এবং তাদের কর্মপরিধির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকৃতির গুপ্তচর কোথায় কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে, কীভাবে রাজদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, ইত্যাকার বিষয় এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০১-১২-০১ এখানে বলা হয়েছে—রাজার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত এবং অবশ্য পোষ্যদের মধ্যে যারা সামুদ্রিক বিদ্যা, শিক্ষার ব্যাকরণ, বেদশাস্ত্র, শুভাশুভ পরিজ্ঞান বিদ্যা, বশীকরণ ও অন্তর্ধান বিদ্যা, ইন্দ্রজাল সম্পর্কিত বিদ্যা, ধর্মশাস্ত্র, শকুনশাস্ত্র, কামশাস্ত্র ও নৃত্যকলা-গীত বিদ্যার অধিকারী তারা সত্রী নামক গুপ্তচর হিসেবে বিবেচিত হবে। যারা সম্পদ লাভের জন্য হাতি, বাঘ বা হিংস্র জন্তুদের সঙ্গে নির্ভীক চিত্তে লড়াই করতে শারীরিকভাবে শক্তি ও সাহসসম্পন্ন, তারা তীক্ষ্ণ নামক গুপ্তচর হিসেবে বিবেচিত হবে। যারা দয়ামায়াহীন, নির্মম প্রকৃতির এবং নিঃশঙ্কচিত্তে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ হত্যায় সিদ্ধহস্ত, তারা রসদ নামক গুপ্তচর হিসেবে অভিহিত হবে।

০১-১২-০২ যে সব বুদ্ধিমতী গরিব বা বিধবা জীবিকা প্রার্থিনী নারী রাজান্তঃপুরের অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে মহামাত্রকুলের গৃহে অবাধে যাতায়াত করতে পারে, সে সব গুপ্তচরদের বলা হয় পরিব্রাজিকা। মুণ্ডিতমস্তকের বৌদ্ধ ভিক্ষুকির বেশধারীদের বলা হয় মুণ্ডা। শূদ্রজাতীয় ছদ্মবেশধারী রমণীদের বলা হয় বৃষলী। সমন্বিতভাবে এদের সঞ্চার নামক গুপ্তচর বলা হয়। সঞ্চার নামক এসব গুপ্তচররা সকল প্রকার প্রশাসনিক প্রধান, সেনাপ্রধান, মন্ত্রী, পুরোহিতদের জীবনাচার অত্যন্ত সন্তর্পণে পর্যবেক্ষণ করে রাজার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।

এছাড়াও তীক্ষ্ণ নামক সঞ্চারেরা আঠারোজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রী বা কর্মকর্তার সান্নিধ্যে থেকে ছদ্মবেশে বিভিন্ন ধরনের সেবাকর্মে নিয়োজিত থাকবে এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে রাজার কাছে প্রেরণ করবে। এ কাজে নিয়োজিতরা একে অপরের পরিচয় সম্পর্কে থাকবে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত।

০১-১২-০৪ ভিক্ষুকির ছদ্মবেশের গুপ্তচররা যদি অন্তঃপুরে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয় তবে তারা সুকৌশলে দ্বার রক্ষীদের ব্যবহার করে অন্তঃপুরের সংবাদ সম্পর্কে অবহিত হবে। এছাড়াও প্রয়োজনে তারা কেশবিন্যাসকারী, রূপচর্চাকারী কিংবা সংগীতশিল্পীর ছদ্মবেশে কৌশলে অন্তঃপুরে প্রবেশের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করবে। ক্ষেত্র বিশেষে গৃহে অগ্নিকাণ্ড কিংবা বিষাক্রান্তজনিত কারণে সৃষ্ট সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্তঃপুরের তথ্য সংগ্রহ করবে।

সর্বক্ষেত্রেই যে কোনো বিষয়ে তিনজন গুপ্তচরের তথ্য এক হলেই, তা সত্য বলে গৃহীত হবে। এর অন্যথা হলে সে তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে গণ্য করতে হবে। যে সব গুপ্তচরের তথ্য পুনঃপুনঃ অগ্রহণযোগ্য বলে প্রতিপন্ন হবে, তাদের এ কাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে পরস্পর বিরোধী তথ্য দাখিলের অপরাধে সংশ্লিষ্ট গুপ্তচরের বিরুদ্ধে বধদণ্ড প্রয়োগ করতে হবে। রাজা শত্রুরাজ্যের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করাবেন। এ ধরনের নিয়োগপ্রাপ্তরা নিজ রাজার কোষাগার থেকে যেমন বেতন গ্রহণ করবেন, তেমনি শত্রু রাজার কোষাগার থেকেও প্রয়োজনীয় বেতন গ্রহণ করবে। এ ঘরানার গুপ্তচররা উভয় বেতনধারী গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচর হিসেবে বিবেচিত হবে।

০১-১২-০৫ এধরনের উভয় বেতনধারী গুপ্তচর নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যক, তাদের বিশুদ্ধতা এবং আস্থার বিষয়ে অবহিত হবার পরই নিয়োগ প্রদান করতে হবে। দেশের বাহিরে পদায়নের জন্য মনোনীত গুপ্তচরদের পরিবার পরিজনকে রাজার নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় রাজা শত্রু, মিত্র, মধ্যম এবং উদাসীন রাজা এবং আঠারো ধরনের মন্ত্রী বা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার উপর প্রয়োজনীয় নজরদারীর জন্য বিভিন্ন ধরনের গুপ্তচর নিয়োগ করবেন। এছাড়াও রাজা সারা দেশব্যাপী নজরদারী জোরদারকরণের জন্য সীমান্ত অঞ্চলসহ সমস্ত কর্মক্ষেত্রে গুপ্তচর নিয়োগ করবেন। অন্য রাজ্যে নিয়োজিত এ সমস্ত গুপ্তচরেরা রাজার সম্ভাব্য শত্রু এবং মিত্রের সন্ধানে ব্যাপৃত থেকে সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট থাকবে।

ত্রয়োদশ অধ্যায় ॥ ০৯ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রাজা নিজ দেশের প্রজাদের ক্রুদ্ধতা, ভীরুতা, লুব্ধতা এবং অন্য দেশের রাজা কর্তৃক যারা প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করা হয়, তাদের সম্পর্কে করনীয়ের বিষয়ের আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-১৩-০১ মন্ত্রী পুরোহিত অমাত্যদের উপর নজরদারী ছাড়াও সাধারণ জনগণ রাজার প্রতি কতটুকু আস্থা বা বিরাগ পোষণ করছে, সে বিষয়ে অবগত হওয়ার জন্য রাজা প্রয়োজনীয় গুপ্তচর নিয়োগ করবেন। এক্ষেত্রে রাজার নিযুক্ত গুপ্তচররা তীর্থস্থানে, সমাবেশস্থলে, পানশালায় কিংবা ভোজনালয়ে উপস্থিত হয়ে পক্ষ বিপক্ষ হয়ে রাজার কুৎসায় বা প্রসংশায় একে অপরের সঙ্গে বিবাদে অবতীর্ণ হবে।

০১-১৩-০২ এই ছল-চাতুরিমূলক প্রক্রিয়ায় রাজার পক্ষ বিপক্ষ অবলম্বন করে গুপ্তচরেরা বিভিন্ন সমাবেশে উপস্থিত লোকদের তাদের বিতর্কে বা বিবাদে সম্পৃক্তকরণের প্রয়াস গ্রহণের মাধ্যমে রাজার প্রতি আস্থাভাজন বা বিরাগভাজন ব্যক্তিদের শনাক্ত করবে। বিরুদ্ধ প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে কি ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করে, সে সম্পর্কেও তারা এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবহিত হবে।

০১-১৩-০৩ এ ক্ষেত্রে যে প্রজারা রাজার প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তথা রাজার বরাদ্দকৃত শস্য, পশু বা অর্থের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, রাজার বিপদের সময় সাহায্যের হাত প্রসারিত করে, রাজার বিরুদ্ধে দ্রোহ নিবৃতকরণে সচেষ্ট থাকে, শত্রুপক্ষ ও অরণ্যপালদের রাজ শত্রুতা থেকে নিবৃতকরণে সচেতন থাকে তাদের সম্পর্কে মুণ্ডিতমস্তকের ছদ্মবেশধারী গুপ্তচরেরা পরিজ্ঞাত হবে।

০১-১৩-০৪ এই প্রক্রিয়ায় গুপ্তচরদের মাধ্যমে রাজা তার প্রতি পরিতুষ্ট এবং অপরিতুষ্টদের সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তার প্রতি আস্থাশীলদের অর্থ ও সম্মানসহ বিবিধভাবে পুরস্কৃত করবেন। বিরাগভাজন তথা অপরিতুষ্টদের আস্থা অর্জনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে সামনীতি অবলম্বনপূর্বক সান্তনা ও প্ররোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ অনুসরণ করবেন, এই পদ্ধতি অকার্যকর হলে, দান-নীতির আলোকে প্রলুব্ধকরণের পন্থা অবলম্বন করে বিদ্বেষকারীদের সন্তুটি বিধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এই পদ্ধতিও অকার্যকর হলে ভেদনীতি অবলম্বন পূর্বক বিদ্বেষ পোষণকারীরা যেন ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সে লক্ষ্যে তাদের বিভাজিত করাবেন এবং গণবিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলবেন। অতঃপর সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে জনরোষের প্রেক্ষাপটে তাদের গোপনে হত্যা করাবেন। ক্ষেত্র বিশেষে বিদ্বেষ পোষণকারীরা যেন শত্রুপক্ষে যোগ দিতে না পারে, তা নিশ্চিতকল্পে পরিবার পরিজনকে নিজের কাছে লুকিয়ে রেখে তাদের খনিজ কাজে নিযুক্ত করাবেন।

০১-১৩-০৫ বলা হয়েছে—যারা বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন, লোভ লালসায় সহজে প্রলুব্ধ হয়, স্বভাবগতভাবে ভীরু প্রকৃতির, কোনো কারণে অপমানিত, তারাই খুব সহজে শত্রুপক্ষের আহ্বানে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে থাকে। এ কারণে এহেন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্নরা যাতে করে শত্রুপক্ষে যোগদান করতে না পারে, সে লক্ষ্যে দৈবজ্ঞানসম্পন্ন ‘কার্তান্তিক’, মনুষ্য চরিত্রের ভালোমন্দ নির্ণয়কারী ‘নৈমিত্তিক’, এবং ত্রিকাল বিশেষজ্ঞ জ্যোতিষীর ছদ্মবেশধারী ‘মৌহূর্তিক’রা সব সময় এদের উপর নজরদারী জারি রাখবে।

এছাড়াও কোনো শ্রেণির প্রজা বা প্রশাসক যেন শত্রুর বশীভূত হয়ে রাজার বিরুদ্ধাচারণ করতে না পারে, সে জন্য সর্বত্র গুপ্তচর নিয়োগ করে এর নিগূঢ় উৎপাটন করে শঙ্কা নিরোধ করতে হবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সাম, দান, ভেদ ও দণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ শত্রুদের সমূলে বিনাশ করতে হবে।

চতুর্দশ অধ্যায় ॥ ১০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে শত্রুরাজ্যে রাজার গোয়েন্দা কর্মপরিধি বিস্তৃতির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ পর্যায়ে কোন প্রকৃতির লোকেরা সহসা শত্রু রাজার বিরুদ্ধাচারণে প্রলুব্ধ, প্ররোচিত বা উৎসাহী হতে পারে সেসব বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০১-১৪-০১ এখানে বলা হয়েছে—স্বপক্ষীয় লোকবলের উপস্থিতি নিশ্চিতকল্পে রাজা নিজ রাজ্যের মতো শত্রু রাজ্যেও গুপ্তচরদের কার্যপরিধি বিস্তৃত করবেন। এক্ষেত্রে শত্রুদেশের যারা বা যিনি নিজ রাজা কর্তৃক অর্থ প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েও প্রবঞ্চিত হয়েছে, কোন হিতকর্ম করেও অভিনন্দিত না হয়ে অপমানিত হয়েছে, রাজার কোনো প্রিয়ভাজন কর্তৃক রাজকুলে নিষিদ্ধ হয়েছে, জুয়াখেলায় প্রলুব্ধ হয়ে নিঃসম্বল হয়েছে, রাজ নির্দেশে দীর্ঘকাল পরবাসী হয়ে বিক্ষুব্ধ হয়েছে, বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও সফল হতে পারেনি, নিজ ধর্মের কৃতকর্ম থেকে রাজা কর্তৃক নিবৃত হয়েছে, ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, উচ্চপদ ও ক্ষমতা বলয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সক্ষমতা অনুযায়ী খ্যাতি অর্জন করতে দেওয়া হয়নি, স্ত্রীকে বলপূর্বক ধর্ষণ করা হয়েছে, যথোপযুক্ত বিচার ব্যতিরেকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে, সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক জীবনযাপন রুদ্ধ করে যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে এবং স্ত্রী পুত্র পরিজনকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। এ ঘরানার লোকেরা ক্রুদ্ধ বা বিক্ষুব্ধবর্গের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচ্য।

০১-১৪-০২ এছাড়াও শত্রুরাজ্যে যারা নিজের বিশুদ্ধতা বিনষ্ট করেছে, যাদের পাপাচার সকলের কাছে প্রকাশিত, নিজের অপরাধের মতো অন্য অপরাধীকে শাস্তি ভোগ করতে দেখে যারা সম্ভাব্য শাস্তির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, রাজ সৈনিকের দ্বারা যারা উৎপীড়িত, যারা অন্যের ভূমি বলপূর্বক অধিকার করেছে, যাদের অকস্মাৎ সম্পদ বৃদ্ধি ঘটেছে, যারা রাজবংশের কারো উপর ভর করেছে, যারা রাজার বিদ্বেষভাজন এবং যারা রাজার প্রতি অসন্তুষ্ট, তারা ভীত লোকের কাতারভুক্ত বলে বিবেচিত।

০১-১৪-০৩ যাদের সমস্ত বৈভব বিনষ্ট হয়েছে, রাজা কর্তৃক কর হিসেবে অত্যাধিক সম্পদ গ্রহণ করা হয়েছে, যারা অতিমাত্রায় কৃপণ, যারা নারীসঙ্গ ও মদ্যপানে আসক্ত, যারা অত্যাধিক ধনার্জনের কাজে ব্যস্ত, তারা লোভী লোকের কাতারভুক্ত হিসেবে বিবেচ্য।

এছাড়াও যারা নিজেদের মহাবিদ্যান মনে করে আত্মশ্লাঘায় অভিভূত, যারা অপরের কাছ থেকে সম্মান প্রত্যাশী, যারা প্রয়োজনে আত্মবিসর্জনে কুণ্ঠিত হয় না, যারা ফলাফল চিন্তা না করেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যারা কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণের পরও পরিতৃপ্ত হয় না। এরা মানিবর্গের কাতারভুক্ত হিসেবে বিবেচিত উপরোক্ত শ্রেণির লোকেরাই শত্রুকর্তৃক সহজে বশীভূত হয়ে থাকে এবং যে কোনো সময়ে রাজার বিরুদ্ধাচারণে প্রবৃত্ত হয়। যে কারণে গুপ্তচরগণ এ ঘরানার লোকদের চিহ্নিত করে স্বার্থ হাসিলের জন্য নির্বাচন করবে এবং এদের মাধ্যমেই শত্রু রাজার বিরুদ্ধে করণীয় বিষয়ের জাল বিস্তার করবে।

০১-১৪-০৪ রাজার প্রতি ক্রুদ্ধ মনোভাবাপন্ন ব্যাক্তিরা যে সব বস্তু লাভের জন্য উদগ্রীব, মুণ্ডিতমস্তক ও জটাবেশধারী গুপ্তচরেরা তাদের সেসব বস্তু প্ৰদান করে স্বপক্ষে আনয়নের প্রয়াস গ্রহণ করবে। অতঃপর রাজার কৃতকর্মের বিরুদ্ধে বিষদাগার করে তাকে প্রজার প্রতিপক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের রাজদ্রোহের জন্য উস্কানি প্রদান করবে।

০১-১৪-০৫ ছদ্মবেশী গুপ্তচররা ভীত ঘরানার বিক্ষুব্ধ লোকদের এই বলে প্ররোচিত করবে যে, সাপ যেমন যার কাছ থেকে ভয়ের আশঙ্কা অনুভব করে তার উপরই বিষ উদ্‌গীরণ করে, তেমনি রাজাও যাদের ভীতিপ্রদ বলে মনে করেন তাদের উপরই খড়গহস্ত হয়ে থাকেন। এ কারণে ভীত ঘরানার লোকদের রাজ কোপানল হতে পরিত্রাণের নিমিত্তে অন্যত্র গমনের জন্য প্ররোচিত করে দ্রোহের জন্য উস্কানি প্রদান করবে।

০১-১৪-০৬ ছদ্মবেশী গুপ্তচরেরা লুব্ধক ঘরানার বিক্ষুব্ধদের প্ররোচিতকরণের জন্য বলবে, চণ্ডালদের গরুর দুধ নিজ সম্প্রদায়ের জন্যই দোহন করা হয়, তা যেমন ব্রাহ্মণদের জন্য দোহন করা হয় না, তেমনি তোমাদের রাজা প্রজ্ঞাহীন মূর্খদেরই রাজানুগ্রহ প্রদান করে থাকেন, তিনি কখনো জ্ঞানবান এবং উপযুক্ত লোকের প্রতি সদয়াচরণ করেন না। অন্যদিকে আমাদের রাজার কৃতকর্ম দেখ, তিনি সব সময় তোমাদের মতো যোগ্যতর লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। এই প্রতিক্রিয়ায় শত্রু রাজার প্রতি অবজ্ঞা ও তার ছিদ্রান্বেষণ করে গুপ্তচররা এ ঘরানার বিক্ষুব্ধদের স্বপক্ষে আনয়নের প্রয়াস গ্রহণ করবে।

০১-১৪-০৭ মানিবর্গের লোকদের গুপ্তচররা এই বলে প্ররোচিত করবে যে, চণ্ডালদের কূপ যেমন নিজেদের কাছে উপভোগ্য তেমনি এই নিচ মানসিকতা- সম্পন্ন রাজাও নিচ লোকদের হিতার্থেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনাদের মতো সুশীল লোকদের সুখ সাধনে এই রাজা মোটেও আগ্রহী নয়। অন্যদিকে অমুক রাজার দিকে দেখুন, তিনি সব সময় আপনাদের মতো ভদ্রজনের প্রাপ্য প্রণোদনা প্রদান করে থাকেন, অতএব এই রাজাকে পরিত্যাগ করে আপনাদের অমুক রাজার কাছেই চলে যাওয়া শ্রেয়তর।

০১-১৪-০৮ এই প্রক্রিয়ায় প্ররোচিত হয়ে যারা নিজ রাজার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করবে, তাদের শপথ গ্রহণ করিয়ে সন্ধির বন্ধনে আবদ্ধ করে উপযুক্তভাবে নিয়োগ প্রদান করতে হবে এবং তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করার জন্য অপসর্গ নামের গুপ্তচরদের নিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ লোকদের যারা সহজেই বশীভূত হবে, তাদের সাম ও দানের মাধ্যমে রাজা কর্তৃক তুষ্ট করতে হবে। অন্যদিকে যাদের সহজে বশীভূত করা যাবে না, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং দণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রু রাজার দোষ ত্রুটি তুলে ধরে মগজ ধোলাই করতে হবে। যাতে করে তারা স্বপক্ষ ত্যাগ করে সহজেই রাজার পক্ষাবলম্বনে সম্মত হয়ে ওঠে।

পঞ্চদশ অধ্যায় ॥ ১১ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজা কর্তৃক কি প্রক্রিয়ায় কর্মের আরম্ভ করতে হবে, মন্ত্ৰণা বা পরামর্শের মাধ্যমে রাজা কি কি কাজের সূচনা করবেন। মন্ত্রণার স্বরূপ এবং অধিকার কি, সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-১৫-০১ নিজ রাজ্যে এবং পররাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর রাজা রাজ্য শাসনের ব্যাপারে মনোনিবেশ করবেন। এক্ষেত্রে রাজাকে সব সময় মন্ত্রণাপূর্বক কাজ আরম্ভ করতে হবে (মন্ত্রণা বলতে এখানে শলা-পরামর্শ বোঝানো হয়েছে– লেখক) মন্ত্রণাকক্ষের কোনো আলোচনা যাতে বাইরে থেকে শোনা না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। বলা হয়েছে—ইতোপূর্বে শুক ও শারিকা পাখি এবং কুকুরের মাধ্যমে মন্ত্রণার বিষয় প্রকাশ পেয়েছিল, যে কারণে মন্ত্রণাকালে কোনো পাখি বা প্রাণীর অবস্থান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক কথায় মন্ত্রণার গোপনীয়তা কঠোরভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। তদুপরি কারো দ্বারা কোনো আলোচনা বা মন্ত্রণা প্রকাশ হয়ে পড়লে তাকে উচ্ছেদ করতে হবে। আকার, ইঙ্গিত বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও যে কোনো সময় গোপনীয়তা ফাঁস হতে পারে যে কারণে দূত, অমাত্য এবং রাজার এহেন আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।

০১-১৫-০২ আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে না, ততক্ষণ তা গোপন রাখতে হবে এবং এ বিষয়ক কোনো ধরনের আকার ইঙ্গিতও প্রদর্শন করা যাবে না। মন্ত্রণায় অংশগ্রহণকারী যে কারো দ্বারা অসাবধানতাবশত, মদ্যপানজনিত বিকারগ্রস্ততার কারণে, নিদ্রিত অবস্থায় প্রলাপজনিত কারণে, ভোগেচ্ছাজনিত কামভাবের কারণে কিংবা আত্মম্ভরিতাজনিত কারণে মন্ত্র বা গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে রাজা কর্তৃক মন্ত্রণায় অংশগ্রহণকারীদের গতিবিধির উপর নজরদারী জারি রাখতে হবে। একই সাথে তাদের নিরাপত্তার দিকেও নজর প্রদান করতে হবে।

এ পর্যায়ে আচার্য ভরদ্বাজের ভাবনা উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে—মন্ত্রীদেরও পরামর্শক থাকে, আলোচকদেরও আলোচক থাকে, যে কারণে সমন্বিতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত কোনো-না-কোনোভাবে প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একান্ত গোপনীয় বিষয়ে রাজা কর্তৃক এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণই সার্বিক দিক দিয়ে নিরাপদ বলে প্রতিভাত।

০১-১৫-০৩ এক্ষেত্রে আচার্য ভারদ্বাজ মনে করেন—বাস্তবায়নের পূর্বে রাজার অভিপ্রেত কাজ সম্পর্কে কেউ যেন জানতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। রাজার সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়ায় কৌটিল্য বিতর্কের অবতারণা করেছেন, এ বিষয়ে তিনি অন্যান্য আচার্যগণকেও বিতর্কে শামিল করেছেন। এক্ষেত্রে আচার্য বিশালাক্ষ মনে করেন—একাকী কারো পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তার মতে, রাজকার্য প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, প্রমাণ সাপেক্ষে এবং অনুমানের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। সকল বিষয় সম্পর্কে সকলে যেহেতু পরিজ্ঞাত নয় সেহেতুে অপরের চিন্তা, ভাবনা, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, অনুমানভিত্তিক জ্ঞানের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য, এ কারণেই রাজা বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করবেন। রাজা কারো প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন না করে সকলেরই মতামত শ্রবণ করবেন। প্রয়োজনে একজন বালকের অর্থবহ পরামর্শও পণ্ডিতগণ প্রসন্ন চিত্তে স্বীকার করে নিবেন।

০১-১৫-০৪ এই বিতর্কে আচার্য পারাশরের মতাবলম্বীগণ মনে করেন— বিশালাক্ষের মত অনুসরণ করা হলে রাজার ভাবনা রাজ্য সমৃদ্ধ হবে কিন্তু এর গোপনীয়তা সংরক্ষিত হবে না। এমতাবস্থায় অভিপ্রেত কার্য সম্পর্কে রাজা অতীতের নজির উদ্ধৃত করে বর্তমানের করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রী অমাত্যগণের মতামত জেনে নিবেন এবং তদানুযায়ী কর্মে প্রবৃত্ত হবেন। এই প্রক্রিয়ায় করণীয় সম্পর্কিত ধারণা যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি গোপনীয়তাও সংরক্ষিত হবে। আচার্য পিশুন পারাশরপন্থীদের এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—এই তরিকায় পরোক্ষভাবে কোনো বিষয় সম্পর্কে মন্ত্রিগণ জিজ্ঞাসিত হলে, তারা বিষয়টির উপর অতটা গুরুত্বারোপ না করে অবজ্ঞাভরে এ বিষয়ক মতামত জ্ঞাপন করতে পারেন এবং বিষয়টি প্রকাশও করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে রাজা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এতে করে রাজা যেমন করণীয় বিষয়ের ব্যাপারে যথার্থভাবে ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবেন, তেমনি বিষয়টির গোপনীয়তাও সংরক্ষিত হবে।

০১-১৫-০৫ কৌটিল্য এ বিষয়ে পিশুনের মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—রাজা যদি এ বিষয়ক অভিজ্ঞ অমাত্য বা মন্ত্রীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তাহলে অভীষ্ট অর্জন বিঘ্নিত হতে পারে। এক্ষেত্রে বহু মন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রণা করার কারণে রাজার সময় অপচয় হবে। অধিকন্তু বাস্তবতার নিরিখে এভাবে মন্ত্রণা বা পরামর্শ করারও তেমন অবকাশ নেই। এ কারণে তিনি মনে করেন, রাজা সুনির্দিষ্ট তিন বা চারজন মন্ত্রীর সঙ্গেই পরামর্শ করবেন। তাঁর মতে—রাজা যদি একজন মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন তাহলে তা সংকটকালীন সময়ে কার্যকর করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে, তিনি যদি দুজন মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন, সেক্ষেত্রে মন্ত্রীদ্বয় জোটবদ্ধ হয়ে রাজাকে বশীভূত করতে পারে এবং এক্ষেত্রে রাজার অভীষ্ট অর্জনও বিঘ্নিত হতে পারে। এ অবস্থায় তিন বা চারজন মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা হলে, তারা জোটবদ্ধ হয়ে রাজাকে বশীভূত করতে পারবে না, বিধায় তিন বা চারজনের সঙ্গে মন্ত্রণা বা শলাপরামর্শ করাটাই সমীচীন। এর অধিক হলে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন অনিশ্চিত হয়ে যায়, তেমনি করণীয় সম্পর্কিত গোপনীয়তা রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়ে

০১-১৫-০৬ পরামর্শের ক্ষেত্রে রাজা স্থান কাল বিবেচনা করে এক বা দুজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন, আবশ্যক মনে করলে তিনি এককভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মন্ত্রণা বা পরামর্শের ক্ষেত্রকে এ পর্যায়ে পাঁচভাবে বিভাজন করা যেতে পারে, যেমন—(ক) কাজ আরম্ভ করবার উপায় (খ) লোকবলের সম্পৃক্ততা এবং সম্ভাব্য ব্যয় (গ) এর সুবিধা অসুবিধার মূল্যায়ন (ঘ) কার্য সম্পাদন প্রাক্কালে সম্ভাব্য বিঘ্নের প্রতিকারের উপায় (ঙ) কার্য সম্পাদন হলে এর সম্ভাব্য ফলাফল বিচার। এক্ষেত্রে রাজা যে কার্যের মাধ্যমে যারা উপকৃত হবেন বলে মনে করবেন, তাদের সঙ্গেও মত বিনিময় করতে পারেন, তবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে অনুমিত হবে, তাদের সঙ্গে রাজা কোনো ধরনের পরামর্শ করবেন না (এক্ষেত্রে রাজা কর্তৃক যে তরিকায় কাজের পরিকল্পনা বা প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তা অনেকটা আজকের দিনের SWOT Domain Analysis এর মাধ্যমে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মতো—লেখক)।

০১-১৫-০৭ এ পর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত প্রাক্কালে বিভিন্ন আচার্যগণের মতবাদের অবতারণা করে এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে। প্রথমেই মনুশিষ্যদের মতবাদ উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে—রাজা দ্বাদশ সংখ্যক সদস্যের সমন্বয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করবেন, এক্ষেত্রে আচার্য বৃহস্পতির শিষ্যগণের মতানুযায়ী ষোলজন অমাত্যের সমন্বয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। শুক্রাচার্যের শিষ্যগণের মতানুযায়ী কুড়ি সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদের কথা বলা হয়েছে।

এ সমস্ত মতবাদ বা প্রস্তাবনা কৌটিল্য কর্তৃক নাকচ করে বলা হয়েছে— মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আবশ্যকতা নেই, রাজা তার অর্থনৈতিক সামর্থ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করতে পারেন। রাজার নিয়োগকৃত মন্ত্রিপরিষদ যে কাজ শুরু করা হয়নি তা শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, যে কাজ শুরু করা হয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য যথাযথভাবে তত্ত্বাবধান করবেন এবং সম্পন্ন কাজের ফলাফল মূল্যায়ন করবেন। এক্ষেত্রে রাজা তার সন্নিকটস্থ মন্ত্রিদের সঙ্গে কাজের ফলাফল নিয়ে যেমন আলোচনা করবেন, তেমনি দূরবর্তী মন্ত্রিদের সঙ্গে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কাজের ফলাফল সম্পর্কে মূল্যায়ন করবেন। এখানে দেবতা ইন্দ্রের মন্ত্রিসভার উদ্ধৃতিক্রমে বলা হয়েছে যে, তার মন্ত্রিসভা সহস্র ঋষির সমন্বয়ে গঠিত ছিল, এই ঋষিরাই ছিলেন ইন্দ্রের চক্ষুস্বরূপ, তাদের মাধ্যমে ইন্দ্র যেমন কার্য সম্পাদন করতেন, রাজাও তেমনি তার মন্ত্রিদের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করবেন।

০১-১৫-০৮ কোনো অত্যাবশ্যকীয় কাজ সম্পন্নকরণ জরুরি হয়ে পড়লে, রাজা মন্ত্রিপরিষদের সভা আহ্বান করে সদস্যগণকে সে বিষয়ে অবহিত করবেন এবং এক্ষেত্রে অধিকাংশ সদস্য যে মতামত জ্ঞাপন করবেন, রাজা সে মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণে প্রবৃত্ত হবেন অথবা রাজার কাছে যা কার্যসিদ্ধির সহায়ক বলে প্রতিভাত হবে, সে অনুযায়ী তিনি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রবৃত্ত হবেন। এ ধরনের পরামর্শের ক্ষেত্রে রাজাকে অবশ্যই কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। শত্রুরা যেন কোনোক্রমেই রাজার করণীয় সম্পর্কে জানতে না পারে, সে ব্যাপারে তাকে সজাগ থাকতে হবে। অধিকন্তু রাজাকে শত্রুর ছিদ্রান্বেষণে হতে হবে তৎপর। নমুনা হিসেবে বলা হয়েছে—কচ্ছপ যেমন নিজের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লুকিয়ে রাখে, রাজাকেও তেমনি তার করণীয় বিষয়াবলি গোপন রাখতে হবে। এছাড়াও রাজার পরামর্শের বিষয়ে বলা হয়েছে, সকলের সব কথা শুনতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বেদজ্ঞানবর্জিত ব্যক্তি যেমন তার কোনো সজ্জনের শ্রাদ্ধ ভোগের যোগ্য নন, তেমনি যে ব্যক্তি অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞাত তিনিও মন্ত্রণা বা আলোচনায় অংশ নেওয়ার যোগ্য নন।

ষোড়শ অধ্যায় ॥ ১২ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে শত্রুরাজ্যে দূত প্রেরণের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কূটনৈতিক কার্যের সফলতাসহ দূতের উপর আরোপিত করণীয় এবং এ সম্পর্কিত দিক নির্দেশনার বিষয়েও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০১-১৬-০১ মন্ত্রণা বা শলা-পরামর্শের মাধ্যমে করণীয় নির্ধারিত হবার পর শত্রুরাজ্যে দূত প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। দূতগণের গুণমান নির্ধারণ: যে সমস্ত দূত সর্বপ্রকার অমাত্য গুণে গুণান্বিত তারা হলেন নিসৃষ্টার্থ। যারা এক চতুর্থাংশ গুণসম্পন্ন তারা পরিমিতার্থ এবং যারা অর্ধেক গুণসম্পন্ন তারা হলেন শাসনহর। শত্রুরাজ্যে প্রবেশ প্রাক্কালে দূতগণ প্রয়োজনীয় পাকি, অশ্ব, সহযোগী লোকবলসহ যথাযথভাবে সুসজ্জিত হয়ে প্রবেশ করবেন। শত্রু রাজার সমীপে নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করবেন, কি ধরনের বক্তব্য পেশ করবেন এবং সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরে কি বলবেন, সেসব বিষয় তারা আগে থেকেই চর্চা করে নিবেন। তিনি বন সংরক্ষক, সীমান্তরক্ষক, মুখ্য পৌর প্রশাসক এবং রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করবেন। শত্রু রাজ্যে সৈন্য সমাবেশের স্থান পর্যবেক্ষণ করে নিজ দেশীয় সৈন্য সমাবেশের সম্ভাব্য স্থান, যুদ্ধের কৌশলগত স্থান এবং প্রয়োজনে সৈন্যগণ সেসব স্থান দিয়ে পিছু হটতে পারবে, সে-সমস্ত স্থান বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়াও তিনি শত্রুরাজার সেনা শিবির, জনপদের বিস্তৃতি, শস্য ও মণিরত্নের সম্ভার, জনসাধারণের জীবন জীবিকার পাথেয়, রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবেন।

তিনি (দূত) যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করে রাজধানীতে প্রবেশ এবং পূর্বানুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে রাজভবনে পদার্পন করবেন। প্রাণ হারানোর আশঙ্কার মুখোমুখি হলেও তিনি নিজ রাজার কথিত বক্তব্য পেশ করবেন। শত্রু রাজের ভয়ে ভীত হয়ে কখনো এর অন্যথা করবেন না। শত্রুরাজা যদি দূতের কথা শুনে সন্তুষ্ট হন, তাহলে তার কথায়, অবয়বে এবং দৃষ্টিতে প্রসন্নভাব পরিদৃষ্ট হবে, তিনি দূতের সমাদর করবেন, তার প্রভুর কুশল জানতে চাইবেন, সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অভিবাদন জানিয়ে নিজের সন্নিকটে বসবার আসন প্রদান করবেন, বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হবেন, উৎসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবেন এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবেন। এ সমস্ত প্রতিক্রিয়া ও কার্যাদির মাধ্যমে দূতের প্রতি রাজার আস্থাশীলতা পরিস্ফুটিত হবে। অন্যদিকে শত্রু রাজা যদি দূতের প্রতি অসন্তুষ্ট হন তাহলে এর বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া পরিদৃষ্ট হবে। শত্রুরাজের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হলে দূত রাজাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন যে, প্রত্যেক রাজাই নিজের বক্তব্য পররাজ্যের রাজার কাছে দূতদের মাধ্যমেই উপস্থাপন করে থাকেন। এক্ষেত্রে দূতের প্রতি অস্ত্র উদ্যত হলেও তাকে রাজা কর্তৃক প্রদত্ত বার্তাই পেশ করতে হয়। অধিকন্তু শুধু ব্রাহ্মণই নন চণ্ডালজাতীয় কেউও যদি দূতের দায়িত্ব পালন করেন তিনিও অবধ্য।

০১-১৬-০২ শত্রুরাজ কর্তৃক বিদায়প্রাপ্ত না হওয়া অবধি তিনি রাজধানীতে অবস্থান করবেন। শত্রুপক্ষের দ্বারা সমাদৃত হয়ে কখনো গর্বিত হবেন না। নিজেকে কখনো শক্তিমান হিসেবে মনে করবেন না। শত্রুপক্ষের কথিত কথা অনভিপ্রেত হলেও কখনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন না। দূতরা সব সময় গোপনীয়তা রক্ষার্থে নারী সঙ্গ, মদ্যপান ও অন্যের সঙ্গে শয়ন পরিহার করবেন (এখানে ইতিহাস থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে মদ্যপান, নারীসঙ্গ ও অন্যের সঙ্গে শয়নজনিত কারণে গোপনীয়তা প্রকাশের ঘটনার উল্লেখ করে এসব পরিহারের যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে)।

শত্রুরাজ্যে অবস্থানকালে দূতরা পূর্ব থেকে নিয়োজিত স্বদেশীয় তপস্বী ও বণিক বেশধারী গুপ্তচরদের মাধ্যমে যাদেরকে স্বপক্ষে বশীভূত করা যায় বলে মনে করবেন, তাদের বশীভূত করবেন। তীক্ষ্ণ এবং রসদ জাতীয় গুপ্তচরদের মাধ্যমে শত্রু দেশের অমাত্যরা নিজ প্রভু সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করেন তা সম্পর্কে অবহিত হবেন এবং তাদের দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন। এ প্রক্রিয়ায় শত্রুরাজ্য সম্পর্কে ধারণার্জন সম্ভব না হলে, তপস্বী, বণিক, চিকিৎসক, পাষণ্ড বেশধারী ও উভয় বেতনধারী গুপ্তচরদের মাধ্যমে শত্রুরাজ্যের সকল বিষয় সম্পর্কে জেনে নিবেন।

এ সকল প্রক্রিয়া, পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য যদি কাঙ্ক্ষিত সুযোগ না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে ভিক্ষুক, মাতাল, উন্মাদ বা ঘুমন্ত লোকদের বিধৃত প্ৰলাপ শুনে প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন। অথবা তীর্থ ও পবিত্র স্থানে অবস্থান করে সন্তর্পণে গুপ্তচরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহুরৈখিক আকার, ইঙ্গিত, সংকেত বা দেয়াল চিত্রের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত তথ্য সংগ্ৰহ করবেন। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ভেদনীতির আলোকে উৎকোচ প্রদানের পন্থা অবলম্বন করবেন। শত্রুরাজা কর্তৃক শত জিজ্ঞাসিত হলেও নিজ রাজ্যের সেনা সামর্থ, রাজ্যের পরিধিসহ আনুষঙ্গিক কোনো বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করবেন না। শত্রুরাজ কর্তৃক প্রশ্নবিদ্ধ হলে তিনি নিজ রাজার কোনো বিষয়েই অভিহিত নন বলে চাতুর্যপূর্ণ জবাব প্রদান করবেন। প্রয়োজনে দৌত্যকার্যের সফলতার স্বার্থে তোষামোদির মাধ্যমে শত্রু রাজার সন্তুষ্ট বিধান করবেন।

০১-১৬-০৩ কার্যসিদ্ধির পরেও যদি শত্রুরাজা কর্তৃক দূতের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অনুমোদিত না হয়, তাকে যদি প্রকারান্তরে আটক করে রাখা হয়, সেক্ষেত্রে তিনি এর সম্ভাব্য হেতু উদ্ঘাটনে সচেষ্ট হবেন। এ-সব হেতুর মধ্যে নিজ প্রভুর বিপদাশঙ্কা, শত্রুরাজের মিত্র কর্তৃক গোলযোগ সৃষ্টির আশঙ্কা, অমাত্যদের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের আশঙ্কা, নিজ প্রভুর কোনো মিত্র রাজাকে হত্যা বা সিংহাসন হতে অপসারণের আশঙ্কা, সৈন্য সমাবেশের জন্য কালক্ষেপণের আশঙ্কা, নিজ রাজপরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কিত সম্বন্ধ স্থাপনের সম্ভাবনা, ইত্যকার নানা বিষয় বিশ্লেষণপূর্বক শত্রুরাজ্যে অবস্থান করবেন। প্রাণ সংশয়ের শঙ্কা অনুভূত হলে প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট দূত শত্রুরাজা কর্তৃক সম্মতি প্রদানের পূর্বেই সেখান থেকে সন্তর্পণে পলায়ন করবেন।

০১-১৬০৪ দূতের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, দূতের কাজ হলো শত্রুরাজাকে নিজ রাজার বার্তা সম্পর্কে অবহিতকরণ এবং শত্রুরাজের বৃত্তান্ত নিজ প্রভুকে জ্ঞাতকরণ। পূর্বের কৃত সন্ধির কার্যকারিতা সংরক্ষণ, নিজ রাজার প্রতাপ প্রতিপত্তি সম্পর্কে শত্রুরাজাকে অবহিতকরণ, মিত্র সংগ্রহ করে নিজ রাজ্যের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, শত্রুরাজ্যের প্রজাদের বশীভূত করা, ভেদনীতি প্রয়োগ করে শত্রুরাজের শক্তি-সংহতি বিনষ্টকরণ, শত্রুপক্ষীয় সৈন্য ও গুপ্তচরদের বিতাড়ন করা, শত্রুরাজের মিত্র ও রত্নসম্ভার অপহরণার্থে কৌশল গ্রহণ, গুপ্তচরদের বিষয়ে জ্ঞাত হওয়া, শত্রুরাজের ছিদ্রান্বেষণ করে নিজ রাজার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, রাজাকুমারদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন। এ সকল কাজ রাজা তার দূতদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাবেন। এছাড়াও শত্রুরাজ্যের প্রেরিত দূতদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে প্রতিদূত বা গুপ্তচরদের মাধ্যমে শত্রুরাজের সমস্ত করণীয় নস্যাৎ করে দিবেন। একই সাথে পররাজ্যের দূত যাতে করে মিত্রতার পরিধি বিস্তৃত করতে না পারে, সে ব্যাপারেও দূতদের সচেষ্ট থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সপ্তদশ অধ্যায় ॥ ১৩ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রাজা তার পুত্রগণের কাছ থেকে কীভাবে আত্মরক্ষা করবেন, কীভাবে তিনি রাজকুমারদের নিষ্ক্রিয় করে রাখবেন, কীভাবে উপযুক্ত উত্তরাধিকার নির্ধারণ করবেন, ইত্যাকার বিষয়ে নির্দেশনা বা রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে।

০১-১৭-০১ আত্মীয়স্বজন এবং শত্রুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হলেই কেবল রাজা তার রাজ্য রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। এক্ষেত্রে প্রথমেই রাজাকে স্ত্রী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। পুত্রদের কবল থেকে রাজা নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবেন, সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করতে গিয়ে বিভিন্ন আচার্য কর্তৃক প্রদত্ত মতামতের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আচার্য ভারদ্বাজের বক্তব্য হলো—জন্মলগ্ন থেকেই রাজাকে রাজকুমারদের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। রাজপুত্রগণকে কাঁকড়ার চারিত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে—কাঁকড়া যেমন জন্মদাতাকে ভক্ষণ করে থাকে, তেমনি রাজকুমাররাও রাজাকে সাবাড় তথা ধ্বংস করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে যেসব রাজকুমার রাজার জন্য হুমকি হিসেবে প্রতিভাত হবে, পিতৃস্নেহ উন্মেষের পূর্বেই প্রয়োজনবোধে রাজা তাদের হত্যা করবেন।

আচার্য বিশালাক্ষের মতানুযায়ী বিনা অপরাধে এভাবে নিষ্পাপ কুমারদের হত্যা করাটা নিষ্ঠুরতার নামান্তর। এতে করে ক্ষত্রিয় বংশের বিনাশ সাধিত হয়ে থাকে। তিনি মনে করেন—রাজকুমারদের এভাবে হত্যা না করে, অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ করে রাখাই শ্রেয়তর। আচার্য পারাশরের মতানুসারীরা মনে করেন— রাজকুমারদের অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ করা হলে তা বিষধর সাপের সঙ্গে বসবাসের মতো ভয়াবহ পরিণতির সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মতে—রাজকুমারদের অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ করে রাখা হলে তাদের মনে এই ভাবনার উদ্রেক হতে পারে যে রাজা জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে তাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে, এ অবস্থায় অবহেলায় লালিত রাজকুমাররা নিজেদের সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত রাজার জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। সুতরাং রাজকুমারদের এভাবে অবরুদ্ধ করে না রেখে বসবাসের জন্য দূরবর্তী সীমান্তরক্ষকের হেফাজতে প্রেরণ করাই মঙ্গলজনক হবে।

০১-১৭-০২ আচার্য পিশুন উপরিউক্ত অভিমত সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—এ পন্থা অবলম্বলন করা হলে তা হবে মেষভয়তুল্য। এক্ষেত্রে দুটি মেষ যেমন পরস্পরকে আক্রমণের জন্য প্রথমে দূরে সরে যায়, অতঃপর প্রবল বিক্রমে ছুটে এসে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে, এক্ষেত্রে দূরবর্তী অবস্থানে থেকে রাজকুমাররাও সে পন্থাই অবলম্বন করবে, তারা সীমান্ত রক্ষকের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে তার সহায়তায় প্রবল বিক্রমে রাজার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। এই প্রেক্ষাপটে আচার্য পিশুন মনে করেন— -দূরবর্তী সীমান্ত অঞ্চলে নয় বরং রাজ্যের অভ্যন্তরস্থ কোনো সামন্তরাজের তত্ত্বাবধানেই রাজকুমারদের লালন পালনের ব্যবস্থা করা শ্রেয়তর।

আচার্য পিশুনের এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আচার্য কৌণপদন্ত (ভীষ্ম) বলেন—এমত পন্থা অবলম্বন করা হলে তা হবে গো শাবককে প্ৰদৰ্শন করে গরুর দুগ্ধ দোহনের সমতুল্য। সামন্তরাজ গরুর দুধ দোহনের মতো রাজকুমারদের লালন পালনের উসিলায় রাজার কাছ থেকে পুনঃ পুনঃ অৰ্থ সম্পদ দোহন করতে থাকবে। এ কারণে রাজকুমারদের মাতৃস্থানীয় আত্মীয়বর্গের নিয়ন্ত্রণাধীনে সমর্পণ করাই শ্রেয়তর বলে তিনি মনে করেন। কৌণপদন্তের এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন আচার্য বাতব্যাধি (উদ্ভব)। তিনি মনে করেন- রাজকুমারদের লালনের ভার মাতৃস্থানীয় আত্মীয়দের উপর অর্পণ করা হলে তারা দেবতার প্রতিকৃতি প্রদর্শনপূর্বক ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত অদিতি এবং সর্পচিহ্ন প্রদর্শনপূর্বক ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত কৌশিকদের ন্যায় রাজকুমারদের প্রদর্শনপূর্বক অর্থ সংগ্রহে মনোনিবেশ করবে। এ কারণে কুমারগণকে অন্য কোথাও না রেখে স্বাভাবিক জীবনের কামভোগ ও বিলাসিতাপূর্ণ পরিবেশে লালন পালনের ব্যবস্থা করাতে হবে। এ ধরনের পরিবেশে বসবাস করানোর কারণে কুমারগণ বিলাসিতা পরিত্যাগ করে কোনো ধরনের দ্রোহাচরণে সচেষ্ট হবে না।

০১-১৭-০৩ কৌটিল্য এ ধরনের মতবাদের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি উত্থাপন করে বলেন—এহেন ভোগ বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন রাজকুমারদের জন্য বেঁচে থেকেও মৃত্যুবরণ তুল্য। তাঁর মতে, ঘুণে পোকায় ভক্ষিত কাঠ যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সামান্য আঘাতেই ভেঙে পড়ে, তেমনি ভোগ বিলাসে নিমজ্জিত রাজকুমাররাও শত্রুর আক্রমণ প্রাক্কালে বিক্রম প্রদর্শনের দুর্বলতা হেতু সহজেই পরাভূত হয়ে পরাস্ত হয়ে থাকে। এ কারণে রাজকুমারদের রাজ্য পরিচালনায় উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার নিমিত্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে রাজমহিষী ঋতুমতি হবার পর সুপুত্র প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি দেবতাদ্বয়ের সমীপে যজ্ঞ প্রদান করতে হবে। মহিষী গর্ভবতী হলে কৌমার ভৃত্য তথা শিশুচিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে তার যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে। সন্তান জন্মলাভের পর পুরোহিতের মাধ্যমে সংস্কার কার্য সম্পন্ন করাতে হবে, অতঃপর শিক্ষা গ্রহণে সমর্থ হওয়ার পর সন্তানকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

০১-১৭-০৪ আম্ভি নামক আচার্যগণ এ পর্যায়ে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা পরীক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন—সত্রী নামক গুপ্তচরদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি শিকার, জুয়া, মদ্যপান, নারী সম্ভোগ এবং পিতার প্রতি শক্তি প্রদর্শনপূর্বক রাজ্য গ্রহণের জন্য কুমারদের প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত করবে। একই সঙ্গে অন্য এক সত্রী তাদের এ ধরনের কর্মযজ্ঞ থেকে নিবৃত করবে। এই মতের সঙ্গে কৌটিল্য দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর মতে—নিষ্কলুষ চিত্তের রাজকুমারদের এভাবে রাজদ্রোহে প্ররোচিতকরণ অনুচিত, এতে করে অঘটন ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে। এক্ষেত্রে মাটির পাত্রে তেল বা কোনো তরল দ্রব্য রাখা হলে পাত্রটি যেমন তার কিছু পরিমাণ শোষণ করে নেয়, তেমনি সহজ সরল রাজকুমারগণও সত্রিদের প্রদত্ত এসব নেতিবাচক উপদেশ শাস্ত্রীয় বিধান হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের হীনকর্ম হতে নিবৃতির জন্য কোনোপ্রকার নেতিবাচক পরামর্শ প্রদান না করে প্রকৃত শাস্ত্রসম্মত ধর্ম ও অর্থশাস্ত্র বিষয়ক উপদেশই প্রদান করা উচিৎ।

এক্ষেত্রে নিষ্কলুষতা সংরক্ষণের জন্য গুপ্তচরেরা সুকৌশলে কুমারদের অভিজাত রমণীর বেশধারী অশুচি নারীদের সান্নিধ্যে এনে এমনভাবে ব্রিত করে তুলবে যাতে করে পরনারীদের প্রতি কুমারদের মনে ঘৃণার ভাব জাগরিত হয় এবং আসক্তির ভাব দূরীভূত হয়। একইভাবে যারা মদ্যপানে আসক্ত, তাদের ভেজাল মদ পরিবেশন করে ক্রমশ মদ্যপানের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে হবে। যারা জুয়া খেলায় আসক্ত তাদের দক্ষ জুয়াড়ির কপটতার মাধ্যমে সর্বশান্ত করে জুয়ার প্রতি বিরূপ করে তুলতে হবে। যারা শিকারের জন্য উদগ্রীব তাদের দস্যুবেশধারী গুপ্তচরদের মাধ্যমে উদ্বিগ্ন করে শিকারের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে হবে। পিতার প্রতি যারা দ্রোহের মনোভাব পোষণ করবে, গুপ্তচরেরা তাদের এই বলে নিবৃত করবে যে-বিদ্রোহ সফল হলেও পিতৃহত্যার দায়ে লোক সমাজে তাদের কলঙ্কের তিলক ধারণ করতে হবে, বিক্ষুব্ধ প্রজা কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে জীবন হারাতে হবে এবং পরকালে নরকে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। অন্যদিকে বিদ্রোহ অসফল হলে রাজা কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জীবন খোয়াতে হবে।

০১-১৭-০৫ একমাত্র পুত্র যদি রাজার বিরাগভাজন হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে রাজা তাকে স্নেহের মাধ্যমে বশীভূত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। আর যদি রাজার একাধিক সন্তান থাকে, তাহলে বিরাগভাজন পুত্রকে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চল বা পররাজ্যের এমন স্থানে নির্বাসিত করবেন যেখানে প্রজা বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকবে না, বেঁচে থাকার পাথেয় সহজলভ্য নয় এবং অত্যন্ত কষ্টকর পন্থায় যেন কুমারকে সেখানে জীবনযাপন করতে হয়। অন্যদিকে যে রাজকুমার উপযুক্ত এবং সদ্গুণসম্পন্ন, রাজা তাকে সেনাপতি বা যুবরাজের পদে অধিষ্ঠিত করবেন। আচরণগতভাবে রাজকুমাররা তিন ভাগে বিভাজিত। আচার্যের উপদেশের মাধ্যমে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে যে রাজকুমার ধর্ম ও অস্ত্রশাস্ত্রে প্রজ্ঞা লাভ করে তদানুযায়ী কাজ করে থাকে, সে বুদ্ধিমান পুত্র হিসেবে বিবেচিত। যে রাজকুমার এ সমস্ত প্রজ্ঞার অধিকারী হয়েও তদানুযায়ী আচরণ করে না, সে আহার্যবুদ্ধি পুত্র। যে পুত্র ধর্ম এবং অর্থশাস্ত্রের প্রতি অনীহ ও বিদ্বেষ পরায়ণ, প্রমোদ লীলায় আসক্ত, সে দুর্বুদ্ধি পুত্র হিসেবে বিবেচিত।

এ ধরনের দুর্বুদ্ধি পুত্র যদি রাজার একমাত্র সন্তান হয়ে থাকে, তাহলে রাজা ওই পুত্রের ঔরশে সুপুত্র উৎপাদনে যত্নবান হবেন বা নিজকন্যার গর্ভজাত পুত্রকে দত্তক প্রদানের শর্তে পাত্রস্থ করবেন। রাজার দুহিতার অবর্তমানে এবং রাজা যদি বৃদ্ধ ও সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজা মাতৃকুলের কোনো আত্মীয়, স্বকুলজাত কোনো গুণবান পুরুষ কিংবা কোনো সামন্তরাজার দ্বারা নিজের স্ত্রীর গর্ভে ক্ষেত্রজ সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে রাজ্যের উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করাবেন। তবুও তিনি অযোগ্য, অশিক্ষিত, দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্রের অনুকূলে রাজ সিংহাসন হস্তান্তর করবেন না।

০১-১৭-০৬ রাজার বহুপুত্রের মধ্যে একজন দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন হলে তাকে দূরবর্তী অঞ্চলে অবরুদ্ধ করে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে পুত্রের পক্ষ থেকে কোনো বিপদাশঙ্কা না থাকলে রাজা তার কল্যাণার্থে যা করণীয় তা করবেন। রাজার একাধিক যোগ্য পুত্র থাকলে রাজ্য ভার জ্যেষ্ঠপুত্রের অনুকূলে অর্পণ করাই সবদিক দিয়ে সমীচীন। অনেক যোগ্য পুত্রের উপস্থিতিতে রাজ্যভার পুত্র সংঘের উপরও অর্পণ করা যেতে পারে বলে কৌটিল্য মনে করেন। এতে করে যেমন রাজসংহতি সংরক্ষিত হয়, তেমনি শত্রুকে মোকাবেলা করাও হয় সহজতর। এ ধরনের সংঘ বিলাসব্যসনে বিপর্যস্ত হয় না বলে প্রজা সাধারণের জন্য কল্যাণকর হয় এবং সে রাজ্য দীর্ঘদিন টিকে থাকার স্থায়ীত্ব লাভ করে।

অষ্টাদশ অধ্যায় ॥ ১৪–১৫ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজার প্রতি অবরুদ্ধ রাজকুমারের আচরণ এবং অবরুদ্ধ রাজকুমারের প্রতি রাজার আচরণসহ এ সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

০১-১৮-০১ অবরুদ্ধ অবস্থায় রাজকুমার নিজের অযোগ্য কোনো কর্মে নিযুক্ত হলেও পিতার অবাধ্য হয়ে কিছু করবে না। কোনো পুণ্য কাজে রাজকুমার নিযুক্ত হলে প্রয়োজনে সে কাজ সম্পাদনের জন্য রাজার কাছ থেকে সহায়ক লোকবল চেয়ে নিবে। কর্মোপলক্ষে প্রাপ্ত উপহার-উপঢৌকন নিজে ভোগ না করে রাজার সমীপে প্রেরণ করবে।

০১-১৮-০২ রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের পরও যদি কোনো রাজা অবরুদ্ধ পুত্রের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন এবং অন্য পুত্র ও মহিষীর প্রতি বিশেষ স্নেহ ভালোবাসায় নিমগ্ন থাকেন, তাহলে অবরুদ্ধ রাজকুমার রাজার অনুমতি সাপেক্ষে বসবাসের জন্য অরণ্যে গমন করবে। এক্ষেত্রে রাজকুমারের যদি পিতা কর্তৃক নিহত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তবে তিনি ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী, ধার্মিক, অপ্রতারক এবং রাজকুমারদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী কোনো সামন্ত নৃপতির কাছে আশ্রয় গ্রহণ করবে। অতঃপর সৈন্য সামন্ত সংগ্রহ করে শক্তিমান হবে, কোনো বীরের কন্যাকে বিয়ে করবে, বনাঞ্চলের অধিকর্তাদের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধন সুদৃঢ় করবে এবং পিতার প্রতি অতুষ্ট অমাত্যদের সঙ্গে সন্ধি করে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

০১-১৮-০৩ এই পদ্ধতিতে যদি রাজকুমারের পক্ষে সহায় সম্পদ বৃদ্ধিকরণ সম্ভব না হয়, তাকে যদি একাকী দিন গুজরান করতে হয়, সেক্ষেত্রে তিনি রসায়ন শাস্ত্রের মাধ্যমে লৌহকে স্বর্ণে পরিণত করার কাজ করবে বা মণি মুক্তা সোনা রূপার খনি ও কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। অথবা বিধর্মীদের সম্পদ, বৌদ্ধদের সংঘের জন্য সংগৃহীত ধন, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের অভোগ্য সাধারণের সম্পদ, বিশ্বাস উৎপাদনের মাধ্যমে ধনিক বিধবার সম্পদ, বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে বা প্রতারণাপূর্বক বণিকের সম্পদ অপহরণ বা আত্মসাৎ করবে। কিংবা মাতৃকুলের আনুকূল্য নিয়ে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবে।

০১-১৮-০৪ পরবর্তী সময়ে রাজকুমার ধাতুশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গায়ক- অভিনেতা, চিকিৎসক কিংবা বিধর্মীর বেশ ধারণ করে গুপ্তচরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ছিদ্রান্বেষণের মাধ্যমে প্রাসাদে প্রবেশ করে অস্ত্রের আঘাতে বা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজাকে হত্যা করে নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করবে এবং এই মর্মে পিতৃ হত্যার যৌক্তিকতা দাঁড় করাবে যে, যে রাজ্য পিতা পুত্রের সমভোগ্য ছিল তা একতরফাভাবে শুধু পিতা ভোগ করছিল, যা গ্রহণযোগ্য নয়। অতঃপর অমাত্যগণকে দ্বিগুণ ভাতা প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে রাজানুগত্য আদায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

০১-১৮-০৫ অন্যদিকে বিদ্রোহীভাবাপন্ন অবরুদ্ধ রাজকুমারকে রাজা কর্তৃক প্রেরিত ছদ্মবেশী অমাত্য পুত্রেরা এই বলে নিবৃতকরণে সচেষ্ট হবে যে পিতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হলে তাকে যৌবরাজ্য প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে পুত্র যদি পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে গুপ্তচরদের মাধ্যমে অস্ত্রের আঘাতে বা বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করাবেন। তাকে পাকড়াও করা যদি কঠিন হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে গুপ্তচররা স্ত্রীলোকের দ্বারা প্রলুব্ধ করে, মদ্যপানের মাধ্যমে মাতাল করে বা মৃগয়ার মাধ্যমে আসক্তকরণের মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করে রাজার সমীপে হাজির করাবে। অতঃপর রাজ্য প্রদানের আশ্বাস প্রদান সত্ত্বেও যদি রাজকুমার অনড় অবস্থানে থাকেন, তাহলে রাজা তাকে কারারুদ্ধ করে রাখবেন। এক্ষেত্রে পুত্র সংখ্যা একাধিক হলে ওই রাজকুমারকে রাজা নির্বাসনে প্রেরণ করবেন।

ঊনবিংশ অধ্যায় ॥ ১৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজার করণীয় এবং রাজকার্যের ব্যাপৃতির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। রাজা কখন কি কাজ করবেন, সে সম্পর্কে এ পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

০১-১৯-০১ রাজা কর্মতৎপর হলে তার অধীনস্থ কর্মচারীরাও কর্মতৎপর হয়ে থাকে। তিনি যদি কর্তব্য পালনে অবহেলা করেন, সেক্ষেত্রে অধীনস্থরাও কর্মে শিথিলতা প্রদর্শন করে থাকে, এতে করে কর্মদক্ষতা হ্রাস পায় এবং কর্মপরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শত্রুনৃপতি কর্তৃক রাজাকে বিপদাপন্ন হতে হয়। এ কারণে রাজাকে সব সময়ের জন্য হতে হবে উদ্যমী এবং কর্মতৎপর। কার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য তিনি রাত ও দিনকে সমান আট ভাগে ভাগ করে নিবেন। নালিকা প্রমাণ অথবা ছায়া প্রমাণের দ্বারা তিনি আট ভাগের একভাগকে দেড় ঘণ্টা হিসেবে ধার্য করে দিনের বারো ঘণ্টা এবং রাতের বারো ঘণ্টাকে কাজ অনুযায়ী ভাগ করে নিবেন।

০১-১৯-০২ দিনের আটভাগের প্রথম ভাগে রাজা বিগত রাতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং বিগত দিনের আয় ব্যয়ের বিবরণী শ্রবণ করবেন। দ্বিতীয়ভাগে নগর এবং জনপদে বসবাসকারীদের কার্যক্রম পরিদর্শন করবেন। তৃতীয়ভাগে স্নান সমাপনান্তে ভোজন করবেন এবং অবশিষ্ট সময় বেদ অধ্যয়ন করবেন। চতুর্থভাগে আহরিত ধন সম্পদ প্রত্যায়ন করবেন এবং অমাত্যগণকে বিশেষ বিশেষ কাজের নির্দেশনা প্রদান করবেন। পঞ্চমভাগে অনুপস্থিত মন্ত্রিগণের কাছে পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে পরামর্শ করবেন এবং গুপ্তচরদের সংগৃহীত তথ্য সম্পর্কে অবহিত হবেন। ষষ্ঠভাগে ইচ্ছে অনুযায়ী ঘুরে বেড়াবেন বা পরামর্শ করবেন। অষ্টমভাগে সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে সমরাস্ত্র পরিদর্শন এবং নিজের সমরশক্তির ব্যাপারে আলোচনা করবেন। একই সাথে দিনের অবসানকালে সান্ধ্যকালীন উপাসনা সম্পন্ন করবেন।

০১-১৯-০৩ এরপর রাতের প্রথম অষ্টমভাগে রাজা গুপ্তচরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। দ্বিতীয়ভাগে স্নান ও রাত্রিকালীন আহার সমাপনান্তে ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ তথা বেদ অধ্যয়ন করবেন। তৃতীয়ভাগে বাদ্য ও সংগীত উপভোগ করবেন। চতুর্থ ও পঞ্চমভাগে ঘুমের জন্য শয্যা গ্রহণ করবেন। ষষ্ঠভাগে তূর্যধ্বনির মাধ্যমে জাগ্রত হয়ে রাজ্যশাসন এবং নিজের করণীয় বিষয়ে চিন্তা করবেন। সপ্তমভাগে শলা-পরামর্শের বিষয়ে চিন্তা করবেন এবং গুপ্তচরগণকে সুনির্দিষ্ট কাজে প্রেরণ করবেন। অষ্টমভাগে তিনি যাগ সম্পাদনকারী ঋত্বিক, বিদ্যাদানকারী আচার্য এবং উপাসনা কাজের পুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে মাঙ্গলিক মন্ত্রোচ্চারণ করে আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন। অতঃপর চিকিৎসক, রন্ধনকাজের জন্য দায়িত্বরত মাহানসিক ও শুভাশুভ গ্রহচিন্তক তথা মৌহূর্তিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে দুগ্ধবতী গাভী ও বৃষভকে প্রদক্ষিণ করে রাজদরবারে প্রবেশ করবেন।

০১-১৯-০৪ রাজাকে যে এই বাঁধা ধরা সূচি মোতাবেক নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ইচ্ছে করলে রাজা নিজের সুবিধামতো রাত ও দিনের সময় বিভাজন করে উপরিউক্ত কার্যাবলি সম্পন্ন করতে পারেন। দরবারে অবস্থানকালে রাজা সকলের জন্য সাক্ষাতের দ্বার উন্মুক্ত রাখবেন। কাজের লোকেরা যাতে বাধাহীনভাবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে তা নিশ্চিত করবেন। কারণ প্রয়োজনীয় লোকেরা রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে, করণীয় বিষয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করণীয় স্থির হলে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে অভীষ্ট অর্জন বিঘ্নিত হতে পারে। এছাড়াও অধস্তনদের মনে ক্ষোভের উদ্রেক হতে পারে এবং তিনি নিজেও শত্রুর বশীভূত হয়ে পড়তে পারেন। এছাড়াও তিনি গণবিচ্ছিন্নতা পরিহারকল্পে দেবতা, আশ্রম, বিধর্মী, বেদজ্ঞ, গবাদিপশু, তীর্থাশ্রম, পবিত্রস্থান পরিদর্শন এবং বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, অনাথ ও নারীদের কার্যাক্রম সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করবেন। এক্ষেত্রে কোনো করণীয় অত্যাবশ্যকীয় বলে প্রতীয়মান হলে নির্ধারিত কর্মসূচির ক্রম লংঘন করে কার্য পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

০১-১৯-০৫ রাজা সব ধরনের কাজের কথা শুনবেন এবং কোনো কাজ অকারণে স্থগিত করবেন না। কারণ, কোনো কাজ সময় মতো সম্পন্ন করা না হলে পরে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে ওঠে। রাজা অগ্নিহোত্রগৃহে গিয়ে পুরোহিত ও আচার্যদের সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় পণ্ডিত ও তপস্বীদের ক্রিয়াকর্ম পরিদর্শন করবেন। মায়াবিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে তপস্বীরা রাজার ক্ষতিসাধন করতে পারে, এ কারণে তিনি কখনো একাকী তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না।

এধরনের সাক্ষাৎ প্রাক্কালে নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি সব সময় ত্রয়ী বিশারদগণকে সঙ্গে রাখবেন। কর্মের প্রতি রাজার আগ্রহ-উদ্যোগ হলো তার ব্রততুল্য। কাজের অনুশাসন হলো তার যজ্ঞানুষ্ঠানের সমতুল্য। শত্রু মিত্রের প্রতি সমব্যবহার হলো রাজার দক্ষিণার মতো। এসব কাজে সদাপ্রবৃত্ত হওয়াই রাজার প্ৰকৃত কর্ম।

প্রজাদের সুখের মাঝেই রাজার সুখ নিহিত। প্রজাদের কল্যাণ হলেই রাজার কল্যাণ সাধিত হয়। রাজার যা প্রিয় তা দিয়ে তার কল্যাণ হয় না, প্রজার যা প্রিয় তা দিয়েই রাজার কল্যাণ হয়। অতএব রাজাকে প্রতিনিয়ত উদ্যোগী হয়ে রাজকার্য পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে উদ্যোগই সকল সফলতার চালিকাশক্তি, অন্যদিকে উদ্যোগহীনতা সকল ব্যর্থতার মূল। আলস্যজনিত উদ্যোগহীনতার কারণে অতীত কর্মের ফলাফল এবং ভবিষ্যতের প্রাপ্তির সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। অন্যদিকে উদ্যমশীলতার সুবাদে যেমন সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত হয় তেমনি কার্য সমৃদ্ধিও নিশ্চিত হয়ে থাকে।

বিংশ অধ্যায় ॥ ১৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজ প্রাসাদ নির্মাণ, এ বিষয়ক বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান, রাজগৃহে রাজার অবস্থান এবং রাজা কখন কীভাবে রাজান্তঃপুরের মহিষীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, সেসব বিষয়ের উপর আলোকপাত করে এ সংক্রান্ত নির্দেশনার নানা দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

০১-২০-০১ স্থাপত্য শৈলীতে অভিজ্ঞজনদের মাধ্যমে রাজা তার বসবাসের জন্য স্বাচ্ছন্দময় পরিবেশে পরিখা পরিবেষ্টিত স্থানে বহুকক্ষ বিশিষ্ট অন্তঃপুর নির্মাণ করাবেন। কোষগৃহ নির্মাণের বিধিবিধান অনুসরণক্রমে রাজান্তঃপুরে নিজের বাসগৃহ নির্মাণ করাবেন। এক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তার নিমিত্ত বাসগৃহে প্রবেশ ও নিমর্গনের জন্য যেমন গোপন সুড়ঙ্গ পথের সংস্থান রাখবেন, তেমনি আপতকালে যাতে আত্মরক্ষা করতে পারেন সেজন্য ভবনের দেয়ালেও নির্গমন পথের সংস্থান রাখবেন। অপরিচিত শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য নির্গমনের পথ দেবতার মূর্তি বা লতাপাতা দিয়ে ঢেকেও রাখতে পারেন। এছাড়াও প্রাসাদে চলাচলের জন্য বহুরৈখিক গুপ্ত সিঁড়িপথ রাখা যেতে পারে। যা প্রয়োজনের সময় তিনি ব্যবহার করবেন। ক্ষেত্র বিশেষে বিশেষ যন্ত্রের উপর এমনভাবে গৃহ নিৰ্মাণ করাবেন যাতে করে তা ভূতল পর্যন্ত নিপতিত করা সম্ভব হয়, এর ফলে বাসগৃহের নিচে শত্রুরা গোপনে অবস্থান করলে তাদের নিপাত করা সম্ভব হবে।

রাজার বাসগৃহ নির্মাণের কলা কৌশল যদি কোনোভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে তবে তিনি নির্মাণ কৌশল পরিবর্তন করে অন্য ধরনের আবাসন নির্মাণ করাবেন।

০১-২০-০২ অন্তঃপুর নির্মাণের পর অগ্নিভীতি পরিহারকল্পে গৃহটিকে অগ্নিনিরোধক করতে হবে। এক্ষেত্রে মৃত মানুষের অস্থি বাঁশের সংমিশ্রণে মথিত করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তার উত্তাপ গৃহের চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে, এতে করে গৃহটি অগ্নিনিরোধক গৃহে পরিণত হবে ( শত্রু কর্তৃক নিহত বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর মরদেহ থেকে এ কাজের জন্য অস্থি সংগ্রহ করতে হবে)। এছাড়াও শিলাবৃষ্টির জলে সিক্ত উঁইপোকার ঢিবির মাটি এবং বজ্রপাতে ভস্মীভূত বৃক্ষের ভস্ম মথিত করে তা দিয়ে বাসগৃহের দেয়াল লেপন করা হলেও তা অগ্নিনিরোধক স্থাপনায় পরিণত হবে এবং ওই অন্তঃপুর কখনো অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এছাড়াও বাসগৃহকে বিষধর সাপ এবং অন্যান্য বিষাক্ত কীটপতঙ্গ থেকে সুরক্ষার জন্য গুডুচী, শ্বেতা, মুষ্কক, পুষ্পবন্দাকা বা আশ্বত্থবৃক্ষের পাতার ধোঁয়া দিয়ে শোধন করাতে হবে। বিড়াল, ময়ুর বেজি সাপ হত্যা করে বিধায় ওদের পালনের মাধ্যমে আন্তঃপুরের সর্প ও অন্যান্য বিষাক্ত প্রাণীর উপস্থিতি নিরোধ করতে হবে। সাপের উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হলে শুষ্ক, শারিকা পাখি চিৎকার করে ক্রন্দন শুরু করে, ক্রৌঞ্চ পাখিরা অস্থিরতা প্রকাশ করে, জীবঞ্জীবক পাখি নির্জীব হয়ে পড়ে, মত্তকোকিল মৃত্যুবরণ করে, চকোরের চোখ স্বাভাবিকতা হারিয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করে, এ কারণে সাপ ও বিষাক্ত প্রাণীর উপস্থিতি সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়ার জন্য এবং ওদের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণের জন্য বাসগৃহে এসব পাখি পালন করতে হবে, এতে করে রাজার সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

০১-২০-০৩ রাজার বাসগৃহের পেছনের দিকে নির্মিত স্বতন্ত্র কক্ষে রাজ মহিষীগণ অবস্থান করবেন। তাদের কক্ষের পেছনে হবে সূতিকাগারের অবস্থান যেখানে তারা গর্ভকালে অবস্থান করবেন। এ কক্ষের পেছনে হবে রুগ্নালয়, মহিষীরা অসুস্থকালে এই রুগালয়ে বাস করবেন, এর পেছনে হবে অনিরাময়যোগ্য রোগীদের আবাসন। মহিষীদের এসব আবাসন এলাকায় উপবন এবং জলাধার বা পুকুর থাকবে। এসব স্থানের বহির্দেশে অবিবাহিত রাজকন্যাদের বসবাসের জন্য থাকবে কন্যাপুর এবং রাজকুমারদের জন্য থাকবে কুমারপুর। রাজ প্রাসাদের সম্মুখভাগের কক্ষগুলো হবে অলঙ্কারে সুসজ্জিত। এখানে থাকবে রাজার মন্ত্রণা কক্ষ, দরবার কক্ষ এবং কুমারদের তত্ত্বাবধায়কদের কক্ষ। অন্যান্য কিছু কক্ষে রাজান্তঃপুরের দেখ ভালের জন্য নিয়োজিত রাজপুরুষদের রক্ষীরা অবস্থান করবে।

০১-২০-০৪ অন্তঃপুরস্থ রাজ মহিষীদের কক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে রাজা কখনো নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে একাকী কোনো রাজ মহিষী বা রানির কক্ষে প্রবেশ করবেন না। কোনো রানির কক্ষে প্রবেশের পূর্বে তিনি বিশ্বস্তা বৃদ্ধা পরিচারিকার মাধ্যমে নিরাপত্তা বিষয়ক নিশ্চয়তা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সেখানে প্রবেশ করবেন। ইচ্ছেমাফিক রানির গৃহে প্রবেশ করলে রাজার জীবন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারেন। ইতিপূর্বে সংঘটিত এ সংক্রান্ত নানা ঘটনার কারণে রাজাকে এ ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এ সংক্রান্ত উদাহরণ—কলিঙ্গরাজ ভদ্রসেনের ভাই বীরসেন সিংহাসন লাভের জন্য রাজাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে রানির কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন, রাজা একাকী রানির কক্ষে প্রবেশ করার পর বীরসেন রাজাকে হত্যা করেছিল।

বজ্র নামক এক রাজকুমার যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পেরে পিতার প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মাতৃ কক্ষের শয্যায় লুকিয়ে থেকে নিজের পিতা তথা কারূষ রাজ্যের নৃপতিকে একাকী পেয়ে হত্যা করেছিল।

রানির অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাশিরাজ মহাসেন বলপূর্বক রানির সঙ্গে সঙ্গত হতে উদ্যত হয়েছিল, এতে করে বিক্ষুব্ধ রানি সুপ্রভা খইয়ের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রাজাকে আপ্যায়নের ছলে হত্যা করেছিল।

বৈরন্ত নামক এক রাজার পত্নী রাজার সম্পর্কে মিথ্যে অপবাদ শ্রবণ করে রাজার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিল, অতঃপর প্রণয়ক্রীড়ার ছলে বিষাক্ত নূপুরের আঘাতে রাজাকে হত্যা করেছিল। সৌবীর দেশের রানি হংসবতী রাজার কটূবাক্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে বিষ মিশ্রিত কোমরের বিছা দিয়ে আঘাতের মাধ্যমে রাজা বীরসেনকে হত্যা করেছিল।

অযোধ্যাপতি রাজা জালুথ অন্যান্য রানিদের সঙ্গে সঙ্গত হতেন কিন্তু ঋতুকালেও রানি রত্নবতির সঙ্গে সঙ্গমের আগ্রহ প্রদর্শন করতেন না, এতে করে রানি অপমানিত হয়ে রাজাকে হত্যার জন্য মুখ দর্শনের আয়নায় বিষ মিশিয়ে রাখতেন, রাজা নির্জন গৃহে ওই আয়নায় মুখ দর্শন করতে গিয়ে বিষাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন।

বৃষ্ণিবংশীয় রাজা বিদূরথ স্ত্রীর ধন অপহরণ করে গণিকাদের পেছনে খরচ করতেন, এতে করে রানি বিন্দুমতি রাজার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করতে মনস্থ করে, অতঃপর নিজ কক্ষে রাজাকে একাকী পেয়ে খোঁপায় লুকায়িত অস্ত্র ব্যবহার করে রাজাকে হত্যা করেন। বিক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ রানিরা এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রাজাকে একাকী পেয়ে হত্যা করেছিল, এসব অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য বিপত্তি পরিহারকল্পে নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে রাজা যখন- তখন রানিদের গৃহে প্রবেশ করবেন না।

০১-২০-০৫ রাজা তার রানিদের সব সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুক, তপস্বী, যাদুবিদ্যা প্রয়োগকারী এবং অপরিচিতা দাসীদের থেকে দূরে রাখবেন। কখনো ওদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিবেন না। আত্মীয়-স্বজনকেও গর্ভাবস্থা বা রুগ্নাবস্থা ব্যতিরেকে অন্য সময়ে রানিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দিবেন না। রূপাজীবীরা স্নানের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হয়ে নূতন বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিধান করে রানিদের পরিচর্যার জন্য হাজির হবে এবং সেবাকার্য করবে। অশীতিপর পুরুষ ও বয়স্কা নারীরা রাজান্তঃপুরের ভৃত্যদের বেশ ধারণ করে নপুংসক সহযোগে অন্দর মহলের রানিদের শৌচ ও অশৌচের বিষয়ে নজরদারী করবে এবং রাজার নিরাপত্তার জন্য নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে।

০১-২০-০৬ রাজার সকল রানি নিজ নিজ নির্ধারিত কক্ষে অবস্থান করবেন, কখনো কেউ নিজ কক্ষ পরিত্যাগ করে অন্যের কক্ষে অবস্থান করবেন না। অন্দরমহলের কোনো রানি কখনো বাহিরের কারো সঙ্গে কোনোপ্রকার সম্পর্ক রাখবেন না। অন্দরমহলের জন্য আনীত এবং অন্দরমহল হতে বাহিরে প্রেরিত সকল প্রকার দ্রব্য ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিবন্ধন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

একবিংশ অধ্যায় ॥ ১৮ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রাজার আত্মরক্ষার বিবিধ উপায়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিধেয় বস্ত্র, খাদ্য এবং দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মে নিয়োজিত থাকার সময় রাজা কীভাবে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন, রাজা কীভাবে কোথায় গমন করবেন, বাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কি ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুসরণ করবেন ইত্যাকার বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০১-২১-০১ সকালের বিছানা ত্যাগের পর রাজা ধনুকধারী নারী দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবেন। দ্বিতীয় কক্ষে প্রবেশের পর তিনি কুর্তাধারী পাগড়ি পরিহিত খোজা দেহরক্ষী এবং রাজার গৃহভৃত্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবেন। তৃতীয় কক্ষে প্রবেশের পর তিনি বামন ও পার্বত্যাঞ্চলের দেহরক্ষীদের সুরক্ষায় পরিবেষ্টিত হয়ে অবস্থান করবেন। চতুর্থ কক্ষে উপস্থিত হলে মন্ত্রী, স্বজন এবং বর্শাধারী দ্বারপালেরা তার সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকবে। বংশপরম্পরায় যারা রাজার নিরাপত্তা বিধানে বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছে, উচ্চবংশের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, যারা রাজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ইতিপূর্বে যারা সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে, রাজা তাদেরই দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন। যাদের ধন দিয়ে তুষ্ট করা হয়নি, সম্মানিত করা হয়নি এমনতর বিদেশি এবং পূর্বে অপকার করার পর বর্তমানে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, এমনতর কোনো স্বদেশিকে রাজা কখনো দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দান করবেন না। অন্তঃপুরের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান পুরুষের অধীনস্থ সৈন্যরা রাজাকে অন্তঃপুরে অবস্থানকালীন নিরাপত্তা প্রদান করবে। রাজার খাদ্যের ব্যাপারে মাহানসিক বা রন্ধনশালার মুখ্য প্রশাসক কোনো গোপনীয় স্থানে রাঁধুনিদের দ্বারা নানা স্বাদের খাদ্য রন্ধন করাবেন। অতঃপর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক নিজে এবং অন্যান্যরা রন্ধনকৃত খাদ্য আস্বাদনের পর রাজার আহারের জন্য পরিবেশন করবে। পরিবেশিত খাদ্যের কিছুটা অগ্নিতে নিক্ষেপ করে ও পাখিদের খেতে দিয়ে খাদ্যের বিষহীনতার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে রাজা খাবার গ্রহণ করবেন।

০১-২১-০২ বিভিন্ন উপায়ে বিষ মিশ্রিত খাদ্য পরীক্ষণ এবং বিষাক্ত খাদ্যের নানা রকম উপসর্গ; বিষমিশ্রিত খাবার আগুনে নিক্ষেপ করা হলে বিষক্রিয়ার ফলে অগ্নিশিখা নীল বর্ণ ধারণ করে, এছাড়াও দাহ প্রাক্কালে চট্ চট্‌ শব্দ শোনা যায়। বিষ মিশ্রিত খাবার খেলে পাখিরা সহসা মৃত্যুবরণ করে থাকে। বিষ মিশ্রিত অন্ন খুব তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয় এবং বিবর্ণ রঙ ধারণ করে। বিষ মিশ্রিত তরকারি সহসা শুষ্ক আকার ধারণ করে, সহজে সেদ্ধ হয় না এবং এর স্বাভাবিক স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ বিনষ্ট হয়। বিষ মিশ্রিত তরল তরকারিতে মানুষের ছায়া স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট বা বড় দেখা যায়। এ ধরনের তরকারি তরল বা ঝোল থেকে আলাদা হয়ে যায়। ঘি, তেল বা গুড় জাতীয় তরল দ্রব্যে বিষ মেশানো হলে এর উপরিভাগে একটি নীল রেখা উদ্ভাসিত হয়। দুধে বিষ মেশানো হলে তাতে তামাটে রেখা পরিদৃষ্ট হয়। বিষ মিশ্রিত মদ ও জলে কাল বর্ণের রেখা ভেসে ওঠে। দধি বিষাক্ত হলে তাতে শ্যামবর্ণ এবং মধু বিষাক্ত হলে তাতে শ্বেতবর্ণের রেখা পরিদৃষ্ট হয়। আম ও ডালিম জাতীয় ফলে বিষ মেশানো হলে তা তাড়াতাড়ি সজীবতা হারায় এবং স্বাভাবিকভাবে পাকতে পারে না, কালো রঙ ধারণ করে। বিষ মিশ্রিত শক্ত খাবার নরম হয়ে যায় এবং নরম খাবার শক্ত আকার ধারণ করে। বিষাক্ত খাবারের পাশে পিপীলিকা এবং অন্যান্য কীট পতঙ্গের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। শয্যার আস্তরণে, পরিধেয় বস্ত্রে বিষ মেশানো হলে এসবের স্থানে স্থানে শ্যামবর্ণের গোলাকার ছাপ ফুটে ওঠে বিষাক্ত বস্ত্র হতে সুতা এবং উল খসে পড়ে। লোহা, স্বর্ণ বা মণি নির্মিত পাত্রে বিষ মেশানো হলে ওসবের স্বাভাবিক শোভা লোপ পায়। ওজন হ্রাস পায়, কার্যসাধনের সক্ষমতাও বিনষ্ট হয়ে যায়।

০১-২১-০৩ বিষ প্রয়োগকারী ব্যক্তির মুখ শুষ্ক হয়ে যায়, কথা বলার সময় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়, শরীর হতে ঘাম নির্গত হয়, হাই ওঠে এবং অস্বাভাবিকভাবে শরীর কাঁপতে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না, অন্য ব্যক্তি কথা বললে উৎকণ্ঠিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নানা শঙ্কায় তার মন আবিষ্ট থাকে ফলে সে স্বাভাবিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। বিষ প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষার্থে এসব উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং অন্যান্য রোগের কবল থেকে সুরক্ষার নিমিত্ত সব সময়ের জন্য রাজার সন্নিকটে অভিজ্ঞ চিকিৎসক উপস্থিত থাকবে। সমস্ত ঔষধ, মদ্য ও পানীয় চিকিৎসক ও প্রস্তুতকারী কর্তৃক আস্বাদনের মাধ্যমে বিশুদ্ধতা প্রমাণের পর রাজার নিকট পরিবেশন করতে হবে।

ক্ষৌরকার এবং রাজার পরিধেয় ও অলঙ্কার পরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ভৃত্যরা নিজেরা স্নানের মাধ্যমে বিশুদ্ধ হয়ে পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করে রাজার সেবায় নিয়োজিত হবে। ক্ষৌরকার যেসব উপকরণ ব্যবহার করবে তা অবশ্যই পরীক্ষিত হতে হবে এবং রাজমোহর যুক্ত হতে হবে। ক্ষৌরকার এ সমস্ত উপকরণ রাজান্তঃপুরের বিশ্বস্ত সেবকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে রাজার ক্ষৌরকার্যে ব্যবহার করবে।

০১-২১-০৪ প্রাসাদের অন্দরমহলে কর্মরত যে সব পরিচারিকার বিশ্বস্ততা পরীক্ষিত হয়েছে শুধু তারাই রাজার স্নান, অঙ্গ মর্দন, শয্যা বিন্যাস, কাপড় ধোয়া, মালা তৈরির মতো স্পর্শকাতর কর্ম সম্পাদনে নিয়োজিত থাকবে। রাজার নিরাপত্তার স্বার্থে এসব কাজে কখনো অপরিচিত কেউ নিয়োজিত হবে না। তদুপরি রাজার ব্যবহারের পূর্বে পরিচারিকারা মাল্য নিজের চোখে স্পর্শ করে এর বিষক্রিয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে রাজাকে পরিধানের জন্য অৰ্পণ করবে। স্নানের বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্য তথা—চন্দন, বকুল ও বহেড়ার নির্যাসসহ ব্যবহার্য অন্যান্য উপকরণ পরিচারিকারা নিজেদের শরীরে মাখিয়ে এর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহারের জন্য রাজার সমীপে অর্পণ করবে। নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো অভিনেতা বা খেলোয়ার কখনো কোনো অস্ত্র বা জীবনহানিকর উপাদান দিয়ে রাজার সমুখে কোনোকিছু প্রদর্শন বা পরিবেশন করবে না। নটনটিদের ব্যবহার্য বাদ্যযন্ত্র রাজমহল থেকেই সরবরাহ করতে হবে। এছাড়াও খেলা দেখাবার অশ্ব, রথ, হাতি এবং প্রয়োজনীয় আলঙ্কারও পরীক্ষা সাপেক্ষে অন্দরমহল হতে সরবরাহ করতে হবে। এ সমস্ত উপাদান বাইরে থেকে আনয়ন করা যাবে না।

০১-২১-০৫ রাজা সব সময় পরীক্ষিত এবং বিশ্বাসী লোকদের দ্বারা চালিত নৌ যান, পাল্কি ও রথে আরোহণ করবেন। তিনি কখনো ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় আরোহণ করবেন না। রাজার নৌ ভ্রমণ প্রাক্কালে অস্ত্র সজ্জিত সৈনিকেরা নদীর পাড়ে পাহারায় নিযুক্ত থাকবে। তিনি মৎস্য ও হিংস্র জলজন্তুরহিত জলাশয়ে অবগাহন করবেন। সর্প এবং হিংস্রজন্তুশূন্য উদ্যানে পরিভ্রমণ করবেন। হিংস্র জীবজন্তুরহিত মৃগবনে শিকারের জন্য গমন করবেন।

০১-২১-০৬ সিদ্ধপুরুষ ও তপস্বীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও রাজা নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্র সজ্জিত সৈনিকদের সঙ্গে রাখবেন। সামন্তরাজার দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রাক্কালে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে রাখবেন। শিরস্ত্রাণ, কবচ ও যুদ্ধের পোষাক পরিধান করে অশ্ব, হস্তি বা রথে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি যুদ্ধের জন্য সজ্জিত সেনা শিবির পরিদর্শন করবেন। রাজা যখন দেশান্তরে গমন করবেন কিংবা বৈদেশিক সফর সমাপ্ত করে নিজ শহরে প্রত্যাবর্তন করবেন তখন সশস্ত্র প্রহরীরা নিরাপত্তা বেষ্টনির মাধ্যমে তার চলাচল সুরক্ষিত করবে। রাজার গমনাগমনের পথ থেকে পূর্বাহ্নেই অস্ত্রধারী, সন্ন্যাসী, অঙ্গহীন ব্যক্তিদের বিতাড়ন করতে হবে। রাজা কখনো জনাকীর্ণ স্থানে পদার্পন করবেন না। রাজা যখন কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে, ইন্দ্রোৎসবে, বসন্তোৎসবে কিংবা বনভোজনে যোগদান করবেন তখন অবশ্যই দশজন সৈন্যসহ সেনা নায়কের দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে সেসব অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। নিরাপত্তার প্রশ্নে কখনো তিনি এসব অনুষ্ঠানে একাকী বা অপর্যাপ্ত সেনা সদস্য নিয়ে যোগদান করবেন না। রাজা যেমন নিজের গুপ্তচরদের দিয়ে অন্য রাজার অনিষ্ট করতে পারে তেমনি অন্য দেশের রাজাও গুপ্তচর দিয়ে তার ক্ষতিসাধন করতে তৎপর থাকতে পারে, এ বিষয়ে রাজাকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন