কৌটিল্য সম্পর্কিত কিছু কিংবদন্তি

ইতিহাসখ্যাত এই মহামানব সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। জানা যায়, পরিপূর্ণ দন্তসারি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল বলে বিদ্যমান শাস্ত্র-সংস্কারের প্রেক্ষিতে অনেকে আশঙ্কা করেছিল যে, এ ছেলে বড় হয়ে রাজা হবে, কিন্তু সে জমানায় সনাতন ধর্মীয় বিধান অনুয়ায়ী একজন ব্রাহ্মণের জন্য রাজাসন গ্রহণ করা শাস্ত্রসম্মত ছিল না, যে কারণে এই শিশু যেন কখনো রাজা হতে না পারে, সেই অভিপ্রায়ে জন্মের অব্যবহিত পরেই পাথরের আঘাতে তার দন্তসারি ভেঙে দেওয়া হয়। এই কিংবদন্তির সারবত্ত্বা মোতাবেক সত্য মিথ্যে, ঘটনা যা-ই ঘটে থাকুক না কেন বাস্তবতা হলো, এই ছেলে যৌবনের প্রারম্ভে রাজানন্দের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়ে নন্দবংশের বিনাশসাধন করে রাজার ঔরসজাত দাসীপুত্র তথা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দীর্ঘকাল মৌর্য রাজদরবারে দাপটের সাথে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পদবিতে প্রধানমন্ত্রী হলেও বস্তুত চন্দ্র গুপ্তের মৌর্য সাম্রাজ্যের তিনিই ছিলেন প্রকৃত অধীশ্বর।

বলা হয়ে থাকে, তিনি অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। থমাস আর ট্রুম্যান কৌটিল্য সম্পর্কিত বেশ কিছু চমকপ্রদ উপাখ্যান বা কিংবদন্তির বর্ণনা দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত অনেক কিংবদন্তির একটি হলো—একদিন চলতি পথে একটি বৃক্ষের কাঁটা তাঁর পায়ে বিদ্ধ হয়, এতে তিনি বৃক্ষটির উপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে সেটিকে সমূলে উৎপাটনের পরিকল্পনা করেন, অতঃপর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বৃক্ষটির মূলে কুঠারাঘাত না করে, সেটিকে সমূলে উৎপাটনের জন্য এর গোড়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণে মাঠা ঢেলে দেন, পরবর্তী পর্যায়ে মাঠা ভক্ষণের লোভে পিঁপড়ারা দলবেধে গাছের গোড়ায় উপস্থিত হয়ে মাঠা ভক্ষণে মনোনিবেশ করে, এ প্রক্রিয়াতে একপর্যায়ে পিঁপড়ার দল গাছের গোড়াশুদ্ধ শেকড় বাকড় সাবাড় করে দেয়। ফলশ্রুতিতে তরতাজা বৃক্ষটি অচিরেই মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং এর অস্তিত্ব চিরতরে সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কন্টকবৃক্ষ সমূলে উৎপাটনের এই তরিকা তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনাকালে শত্রুবিনাশের ক্ষেত্রেও নিপুণতার সাথে প্রয়োগ করতেন। তাঁর গৃহীত কৌশলের কারণে শত্রুপক্ষ চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, ধীর-স্থির এবং সুপরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শত্রুবিনাশের এই ধরনের অভিনব কৌশল গ্রহণের প্রজ্ঞাই কৌটিল্যকে স্বতন্ত্রধারার চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

রাজানন্দের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা প্রাক্কালে প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁকে ব্যর্থ হয়ে পশ্চাদপসারণ করতে হয়েছিল। সূচনাতেই স্বল্পসামর্থ নিয়ে তিনি সরাসরি রাজ্যের কেন্দ্রে আঘাত করেছিলেন, এক্ষেত্রে রাজশক্তি ছিল তাঁর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ফলে তাঁর পক্ষে রাজতন্ত্রের ভিত নাড়ানো একেবারেই সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে তিনি যখন পুনর্বার আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন, তখন একদিন চলতি পথে একটি ঘটনা প্রত্যক্ষণ করেন। তিনি দেখেছিলেন, একটি ক্ষুধার্ত বালক খাবারের থালার মধ্যভাগ থেকে গরম খাবার মুখে তুলছিল এবং ছেলেটির মা তাকে পাত্রের মধ্যভাগ থেকে গরম খাবার গ্রহণে নিবৃত্তকরণ প্রাক্কালে, কৌটিল্য কর্তৃক সরাসরি রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করার মতো বোকামি না করার জন্য উপদেশ প্রদান করত, এ প্রক্রিয়ায় খাবার মুখে তোলা হলে গরম খাবারের উত্তাপে মুখ পুড়ে যাবার আশঙ্কার কথা বলে পাত্রের চারিধারে ছড়িয়ে থাকা ঠাণ্ডা খাবার গ্রহণের উপদেশ দিচ্ছিলেন। এ ঘটনা প্রত্যক্ষণের পর কৌটিল্যের দিব্যদৃষ্টি উন্মোচিত হয়, তিনি বুঝতে পারেন গরম খাবার যেমন পাত্রের মধ্যস্থল হতে গ্রহণ করা হলে মুখ পুড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে, তেমনি স্বল্পশক্তি নিয়ে নন্দরাজার কেন্দ্র তথা রাজধানীতে সরাসরি আক্রমণ করা হলে নিজেদের ক্ষতির সম্ভাবনাই অধিক। এ ঘটনার পর তাঁর চিন্তাজগতে একটি গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয় এবং সে মোতাবেক তিনি পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে আক্রমণের কৌশল পরিবর্তন করেন। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে তিনি রাজার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের জন্য প্রান্তদেশ থেকে আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে ক্রমশ শক্তিসঞ্চয় করে কেন্দ্রের দিকে অগ্রসরের কৌশল অবলম্বন করেন এবং এভাবেই অভীষ্ট অর্জনে সক্ষম হন।

রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রায়শ তাঁকে আত্মরক্ষার্থে তাঁর বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে বেড়াতে হত। কখনো কখনো রাজসৈন্যদের কোপানল থেকে নিজেদের রক্ষার্থে, গোপনস্থানেও লুকিয়ে থাকতে হত। আত্মগোপনকালের এক সময় তিনি দলবলসহ একটি গুহায় অভুক্ত অবস্থায় লুকিয়েছিলেন। রাজ সৈনিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে এভাবে আত্ম গোপনে থাকা অবস্থায় অকস্মাৎ তিনি একটি পিঁপড়াকে ভাতের দানা মুখে ধারণ করে গুহার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেন। এ অবস্থা দর্শন করে তাঁর মনে এরূপ ধারণার উন্মেষ হয় যে, আশপাশে নিশ্চয় কোথাও মানুষের উপস্থিতি আছে এবং খাদ্য রন্ধন হচ্ছে—যেখান থেকে পিঁপড়াটি ভাতের দানা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। অতঃপর অনুসন্ধান করে দেখা যায়, তাঁরা যে গুহাতে আত্মগোপন করেছিল তার উপরিভাগেই অবস্থান করছিল রাজার সৈন্যদল। এরপর রাজসৈনিকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সন্তর্পণে পালিয়ে গিয়ে জীবনরক্ষা করতে সক্ষম হন। এ ধরনের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বদৌলতেই তাঁর পক্ষে সেদিন জীবনরক্ষা করা সম্ভব হয়।

নিজ শত্রুর, শত্রুর সঙ্গে সন্ধিস্থাপনের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয়ের তরিকা ছিল তাঁর গৃহীত কৌশলের অন্যতম একটি দিক। যে কারণে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি হিমালয়ের পাদদেশস্থ রাজাপার্বতার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, এক পর্যায়ে মৈত্রীর বন্ধন নিজ স্বার্থের পরিপন্থী হওয়াতে তাঁকে সে বন্ধন ছিন্ন করতে হয়েছিল এবং শক্তিসামর্থ বৃদ্ধির জন্য দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতার পথ অবলম্বন করতে হয়। এভাবে রাজানন্দের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনার জন্য তিনি নৈতিকতার প্রশ্নটি উহ্য রেখে সম্ভাব্য সকল ধরনের বন্ধুত্ব এবং মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। একই সাথে বৈদেশিক রাজনৈতিক প্রভাব নস্যাৎ করবার জন্য তিনি দখলদার আলেকজান্ডারের নিয়োজিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধেও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলে বৈদেশিক শক্তির প্রভাব নস্যাৎ করেছিলেন।

নন্দদের রাজ্য নিপাতের পর তাঁর কাছে একটি সুসংহত রাজ্যগঠনের অপরিহার্যতা অনুভূত হয়েছিল। একই সাথে আকৃতিতেও রাজ্যের কলেবর বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশলে পাশ্ববর্তী দুর্বল রাজ্যসমূহ একে একে গ্রাস করা হয়েছিল। আর এভাবেই মৌর্যরাজ্য একটি ক্ষুদ্ররাজ্য থেকে সুবিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এবং সুসংহত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পেরেছিল। এভাবেই এ উপমহাদেশে মৌর্যসাম্রাজ্য প্রথম ভারতীয় সাম্রাজ্য হিসেবে বিকশিত হয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।

নতুন সাম্রাজ্যে সম্রাটের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও তাঁর ছিল যথেষ্ট সচেতনতা। প্রশাসনিক নিরাপত্তা বলয় ছাড়াও সম্রাটের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনও নিরাপত্তার বলয়ভুক্ত ছিল, এমনকি সম্রাজ্ঞীর গৃহে পদার্পণের ক্ষেত্রেও মেনে চলতে হত নিরাপত্তার বিধি-বিধান। যখন তখন সম্রাজ্ঞীর কাছে সম্রাটের প্রবেশাধিকার ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এছাড়াও সম্রাটকে কেউ যেন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে শরীরের বিষক্রিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে তিনি সম্রাটের অজান্তেই দৈনন্দিন খাদ্যের সাথে কিছু বিষ মিশিয়ে দিতেন, এভাবে দিনের পর দিন খাদ্যে বিষের পরিমাণ বাড়িয়ে বিষ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অজ্ঞতাবশত, সম্রাটের বিষমিশ্রিত খাবার খেয়ে একদিন মহারানি দুর্ধকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। মহারানি যখন বিষাক্ত খাদ্য খেয়ে মৃত্যুমুখে নিপতিত হন, তখন তিনি ছিলেন সন্তান সম্ভবা। এহেন আকস্মিক বিপর্যয় দেখে কৌটিল্য কালবিলম্ব না করে মহরানির পেট চিড়ে গর্ভস্থ সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। এই সন্তানই পরবর্তী পর্যায়ে রাজততে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং ইনিই ছিলেন ইতিহাসখ্যাত সম্রাট অশোকের পিতা বিন্দুসরা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন