ষষ্ঠ অধিকরণ। প্রকরণ ৯৬-৯৭।
মণ্ডলযোনি নামক ষষ্ঠ অধিকরণের দুটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—
১. প্রকৃতিসম্পদ তথা রাজা, অমাত্য, মিত্র, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য ২. শম ও ব্যয়াম তথা শান্তি ও উদ্যোগ।
এই অধিকরণ থেকেই মূলত ‘আবাপ’ তথা পররাষ্ট্র বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। ইতিপূর্বকার পাঁচটি অধিকরণে ‘তন্ত্র’ তথা স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা প্রাক্কালে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সম্পদ আহরণ, জনহিতকর কার্যাবলিসহ নাগরিক জীবনের যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধিকরণের বিষয়বস্তুর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘মণ্ডলযোনি বা রাজচক্রের ভিত্তি। বিজিগীষু বা বিজয় লিপ্সু রাজা, অরি বা রাজ শত্রু, মধ্যম, ও উদাসীন এই চারটি অবয়ব নিয়ে এই মণ্ডল বা চক্র গঠিত। এই চক্রাবর্তেই আবর্তিত হয় রাজার পররাষ্ট্র বিষয়ক কৃতকর্ম। এই অধ্যায়ে রাজা ও অমাত্যের আবশ্যকীয় গুণাবলি, মিত্রের প্রকৃতি, রাজ্যের নিরাপত্তার নানা দিকসহ রাজার সমৃদ্ধি ও ক্ষয়ের বিষয় আলোচিত হয়েছে।
০৬-০১-০১ রাজা, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, রাজকোষ, সেনা ও মিত্র। এই সাতটি অনুসঙ্গকে বলা হয় প্রকৃতি। রাজা হলেন অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ ও সেনার অধীশ্বর। এক্ষেত্রে যুবরাজও রাজার অন্তর্ভুক্ত। অমাত্যরা হলেন রাজার উপদেষ্টা বা পরামর্শদাতা। একজন রাজার তিন, চার, বারো, ষোল বা বিশজন অমাত্য থাকতে পারে। কোষ হতে পারে—রত্ন, সার, কুপ্য ও ফল্গু প্রকৃতির। সেনাবাহিনী হবে চার প্রকার—রথারোহী, অশ্বারোহী, গজারোহী ও পদাতিক মিত্র তিন প্রকার হতে পারে—বংশপরম্পরাগত মিত্র, শত্রুর শত্রু হিসেবে মিত্র এবং প্রয়োজনের নিরিখে কৃত্রিম মিত্র। প্রকৃতিসমূহের প্রধান হলেন রাজা। এ কারণে প্রজাদের আকৃষ্ট করার জন্য রাজার কিছু অনবদ্য গুণ থাকা আবশ্যক যা আভিগামিক গুণ নামে খ্যাত।
এক্ষেত্রে রাজাকে যে ষোলটি অভিগামিক গুণের অধিকারী হতে হবে তা হলো—রাজাকে হতে হবে মহাকুলীন তথা উচ্চবংশজাত, বিদ্বান, চরিত্রবান ও ঐশ্বর্যযুক্ত। দৈবসম্পন্ন তথা স্বল্প চেষ্টায় কর্ম সম্পাদনে সক্ষম। বুদ্ধিসম্পন্ন তথা সকল কর্মে সম্যক অবহিত। সত্ত্বসম্পন্ন তথা বিপদ-আপদে ধৈর্যশীল। বৃদ্ধদর্শী তথা জ্ঞানবান বৃদ্ধদের সেবক। ধার্মিক তথা ধর্মপরায়ণ। সত্যবাক তথা সর্বদা সত্যবাদী। অবিসংবাদক তথা কথায় ও কর্মে সমরূপসম্পন্ন। কৃতজ্ঞ তথা অপরের উপকার স্বীকারকারী। স্কুললক্ষ্য তথা মহানদাতা। মহোৎসাহী তথা উৎকৃষ্ট কাজে উৎসাহী। অদীর্ঘসূত্রী তথা ত্বরিত কার্য সম্পাদনকারী। সাক্য সামন্তী তথা অন্য নৃপতিদের অবদমনে সক্ষম। অক্ষুদ্রপরিষৎক তথা গুণী অমাত্যের পরিষদযুক্ত এবং বিনয়কাম তথা প্রতিনিয়ত শিক্ষালাভে আগ্রহী।
০৬-০১-০২ এছাড়াও রাজার যে আটটি প্রজ্ঞাগুণ থাকা আবশ্যক তা হলো—শুশ্রূষা তথা শাস্ত্র শ্রবণেচ্ছা। শ্রবণ তথা শ্রুত শব্দের অবহিতি বোধ। ধারণ তথা শ্রুত কথা স্মরণে রাখা। বিজ্ঞান বা কোনো বিষয়ের বিশেষ জ্ঞান। ঊহ বা বিষয় সম্পর্কে বিতার্কিক গুণ। অপোহ বা যুক্তি খণ্ডনের গুণ এবং তত্ত্বাভিনিবেশ বা যৌক্তিক পক্ষের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের সক্ষমতা। রাজার যে চারটি উৎসাহগুণ থাকা আবশ্যক, তা হলো—শৌর্য বা ভীতিহীন বীরত্ব। অমর্ষ বা পাপ কার্যের প্রতি বিরূপতা। শীঘ্রতা বা কর্ম সম্পাদনে গতিশীলতা এবং দাক্ষ্য তথা সর্বকর্মে নিপুণতা।
০৬-০১-০৩ এছাড়াও রাজাকে আত্মসম্পদ হিসেবে বিবেচিত যেসব গুণাবলির অধিকারী হতে হবে তা হলো—তাকে হতে হবে বাগ্মী তথা ভালো বক্তা। প্রগলভ বা সপ্রতিভ স্বরে নিরবচ্ছিন্ন বক্তব্য প্রদানে সক্ষম। স্মৃতিমান বা অতীতের বিষয় স্মরণে সক্ষম। মতিমান বা ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে সমর্থবান। বলবান বা শারীরিকভাবে শক্তিমান। উদগ্র বা উন্নতচিত্তের অধিকারী। স্ববগ্রহ বা আত্ম নিয়ন্ত্রণকারী। কৃতশিল্প বা হাতি, অশ্ব ও রথে আরোহণে এবং অস্ত্রচালনায় পারদর্শী। বসনে দণ্ডনায়ী তথা শত্রু বিনাশে সেনা প্রেরণে দক্ষ ও পরিচালনে সক্ষম। হ্রীমান তথা অপকর্মে লজ্জাশীল ও বিমুখ। আপদে এবং প্রকৃতিতে শস্যের বিতরণ ও বিনিয়োগে সক্ষম। সন্ধিবিভাগী তথা সন্ধি স্থাপনে দক্ষ। বিক্রমবিভাগী তথা যুদ্ধ ঘোষণায় অভিজ্ঞ। ত্যাগবিভাগী তথা উপযুক্ত স্থানে দানকরণে সক্ষম। সংযমবিভাগী তথা আত্মসংযমী। পণবিভাগী তথা ওয়াদা রক্ষাকারী। পরচ্ছিদ্রবিভাগী তথা অন্যের দোষ ত্রুটি চিহ্নিতকরণে সক্ষম। সংবৃত্ত তথা গোপনীয়তা রক্ষায় সমর্থ। অদীনাভিহাসী তথা দুরবস্থায় নিপতিতদের উপহাস না করায় সমর্থ। অজিহ্মভ্রূকুটিক্ষণ তথা বক্রদৃষ্টির পরিবর্তে সাধারণ দৃষ্টিপাতে সক্ষম। গর্ব তথা কাম ক্রোধ লোভ স্তম্ভ বর্জনে সমর্থ। চপলতা পরিহারে সমর্থ, শত্রু বা প্রিয়ভাষী, স্মিতোদগ্রাভিভাষী তথা স্মিতহাস্যে কথা বলায় সক্ষম। বৃদ্ধোপদেশাচার তথা প্রাজ্ঞ বৃদ্ধদের উপদেশ অনুযায়ী কাজ করায় আগ্রহী।
০৬-০১-০৪ জনপদ সম্পর্কিত বিষয়—জনপদের অবস্থান হতে হবে এমনতরো সীমান্ত প্রদেশে যেখানে শক্তিশালী দুর্গের স্থাপনা থাকবে এবং স্বদেশ ও দূরদেশ থেকে আগত জনদের ভরণপোষণের জন্য থাকবে খাদ্য শস্যের পর্যাপ্ত মজুদ। শত্রুর আক্রমণ নিরোধের জন্য সেই স্থান হবে নদী, বন, পর্বত ও দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত। সেই স্থান হবে সহজে ফসল উৎপাদনের আদর্শ ভূমি। সেখানকার জনগণকে হতে হবে রাজার শত্রুর প্রতি দ্বেষযুক্ত। সেখানে সামন্তদের দমন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রাজার জনপদ হবে প্রস্তর, কর্দম, ঊষর, বন্ধুরতা, রাজদ্রোহী, হিংস্র প্রাণী ও চোর ডাকাতের প্রভাব মুক্ত। সে স্থানকে হতে হবে নদী, সরোবর, উর্বর কৃষিভূমি, অরণ্য ও হস্তিবন সমৃদ্ধ মনোরম এলাকা। সে স্থান হবে মানুষ ও প্রাণীর বসবাসের অনুকূল। সেখানকার কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু বর্ষার জলের উপর নির্ভরশীল হবে না, সেখানে সারা বছর জলের যোগান থাকতে হবে।
সে স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থা হতে হবে স্থল ও জলপথ সমৃদ্ধ। ক্রয় বিক্রয়ের জন্য সেখানে বৈচিত্র্যধর্মী পণ্যের সমাহার থাকতে হবে। অপরাধীর জন্য থাকতে হবে প্রয়োজনীয় শাস্তির ব্যবস্থা। সেখানকার কর ব্যবস্থা হবে সহনীয়। সেখানকার কৃষকদের হতে হবে কর্মক্ষম। মুনিবদের হতে হবে বিবেচক। উৎপাদন ও সেবাকর্মের জন্য সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিচকুলের লোকজন বসবাস করবে। অধিবাসীদের হতে হবে রাজভক্ত ও শুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনপদই হবে আদর্শ এবং কাঙ্ক্ষিত জনপদ। এ ধরনের জনপদই রাজ্যের জনপদসম্পদ বলে বিবেচিত হবে।
০৬-০১-০৫ কোষসম্পদ সম্পর্কিত বিষয়—রাজার কোষ পূর্বসূরীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ এবং জনগণের কাছ থেকে বিধিসম্মত উপায়ে কর হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদের ভিত্তিতেই সমৃদ্ধ করা সমীচীন। রাজকোষ হতে হবে নগদ অর্থ এবং বিবিধ রত্ন-অলঙ্কারে সমৃদ্ধ। এছাড়া এই কোষ হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৈচিত্র্যপূর্ণ ধন সম্পদে পরিপূর্ণ। দুর্ভিক্ষ বা যে কোনো আপদকালে যেন কোষের মজুদ দিয়ে বিপদাপন্ন জনগণকে সহায়তা প্রদান করা যায়, সেভাবেই সেখানে অর্থ সম্পদ সংরক্ষণ করতে হবে।
দণ্ড বা সেনা সম্পদ সম্পর্কিত বিষয়—রাজার সেনাবাহিনীর সদস্যরা বংশানুক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত হবে, এর ফলে তারা যেমন রাজানুগত হবে তেমনি হবে সেবাশীল। এদের পরিবার রাজার দ্বারা প্রতিপালিত হয়ে সুরক্ষিত হওয়ায় এরা রাজার প্রতি প্রসন্ন থাকবে। এমনকি যুদ্ধের জন্য দেশের বাহিরে অবস্থানকালেও পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে না। এই সেনাদের হতে হবে কষ্ট সহিষ্ণু, যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ এবং অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। তাদের হতে হবে, ‘রাজার সমৃদ্ধির সাথে তাদের সমৃদ্ধি এবং রাজার ক্ষয়-ক্ষতির সাথে তাদের ক্ষতি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত’ মনোভাবাপন্ন। তাদের হতে হবে রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্বরহিত। পর্যাপ্ত ক্ষত্রিয়ের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী গঠিত হতে হবে।
০৬-০১-০৬ মিত্রসম্পদ সম্পর্কিত বিষয়—পিতামহ বা পিতার সময় থেকে বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ মিত্র হতে পারে। মিত্র হতে পারে বংশগতভাবে। যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে মিত্রতা হতে পারে। সহসা সহায়তার মাধ্যমে বা প্রয়োজনের প্ররিপ্রেক্ষিতেও মিত্রতা হতে পারে।
শত্রুসম্পদ সম্পর্কিত বিষয়—শত্রু কখনো রাজকুলজাত হবে না। তিনি লোভার্ত হীন ব্যক্তিদের পরিবেষ্টনে অবস্থান করবেন। প্রজাবর্গ তার বিরাগভাজন হবে। তিনি শাস্ত্রের বিধিবিধান অমান্য করে কুকর্মে প্রবৃত্ত হবেন। তিনি হবেন, নিষ্ঠাহীন, প্রেরণাহীন উৎসাহশূন্য, অতিমাত্রায় দৈব বিশ্বাসী, বিবেকহীন কর্মে নিপুণ, আশ্রয়হীন-উচ্ছিন্ন, সহায়হীন, ধৈর্যহীন এবং স্বজন ও পরজনের অনিষ্টকারী। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শত্রু অতি সহজেই নিপাতযোগ্য, এদের অনায়াসে উৎপাটন করা যায়।
০৬-০১-০৭ শত্রুসম্পদ ব্যতিরেকে অন্যান্য সম্পদ রাজসম্পদ হিসেবে পরিগণিত। রাজা স্বয়ং আত্মসম্পদসম্পন্ন হলে তার প্রভাবে গুণসম্পদ রহিত অন্যান্য প্রকৃতিও গুণসম্পদে পরিবর্তিত হতে পারে। রাজা নিজে আত্মসম্পদ রহিত হলে গুণসমৃদ্ধ অন্যান্য প্রকৃতিসমূহ বিনষ্ট হয়ে যায়।
০৬-০১-০৮ আত্মসম্পদহীন রাজার প্রকৃতিসমূহ যদি দোষযুক্ত বা কলুষিত হয়ে পড়ে, তাহলে সে রাজা চাতুরন্ত তথা চার সমুদ্র পরিমাণ বিস্তৃত ভূমির অধীশ্বর হয়েও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি অমাত্যদের দ্বারা নিহত হন বা শত্রুদের কব্জায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
কিন্তু আত্মসম্পদে সমৃদ্ধ নীতিবান রাজাকে কখনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় না। তিনি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের অধীশ্বর হয়েও সমগ্র বিশ্বকে জয় করার সক্ষমতা সংরক্ষণ করেন এবং তার কখনো ক্ষয় হয় না।
এই অধ্যায়ে যোগ তথা অপ্রাপ্ত বস্তুর লাভ এবং ক্ষেম তথা প্রাপ্তবস্তু রক্ষার উপায় সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও কীভাবে কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বস্তু লাভ হয়ে থাকে এবং শম তথা শান্তিকালে প্রাপ্তবস্তু নির্বিঘ্নে উপভোগ করা যায়, এসব বিষয়াদিও এখানে আলোচিত হয়েছে।
০৬-০২-০১ কর্মোদ্যোগের মাধ্যমেই অপ্রাপ্ত বস্তু প্রাপ্ত হয় এবং সেই প্রাপ্ত বস্তু শান্তিকালে নিশ্চিন্তে উপভোগ করা যায়। সক্ষম রাজা অপ্রাপ্ত বস্তু লাভ এবং প্রাপ্ত বস্তু রক্ষার উপায় জানার জন্য জ্ঞানার্জন করবেন। কর্মোদ্যোগের মাধ্যমেই বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, স্বদেশে দুর্গসহ অন্যান্য জনহিতকর স্থাপনার সমৃদ্ধি ঘটে, প্রকারান্তরে এসবের সমৃদ্ধিই বস্তুর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে থাকে এবং এসবের উপভোগের নামই শম বা বাসনার পরিতৃপ্তি। শম ও ব্যয়াম তথা শান্তি ও কর্মোদ্যোগের উৎস হলো সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, সংশ্রয় ও দ্বৈধীভাব। এই ছয়গুণের ফলাফল হলো—ক্ষয়, স্থিতাবস্থা এবং বৃদ্ধি।
০৬-০২-০২ দৈবাত্মক এবং মানুষাত্মক কর্মের মাধ্যমেই চালিত হয় এই বিশ্বের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম। এক্ষেত্রে নিয়তির মাধ্যমে সম্পাদিত কর্মই হলো দৈবকর্ম। এই দৈবকর্মের মাধ্যমে যে প্রাপ্তিলাভ হয় তাকে বলা হয় অয় এবং এর মাধ্যমে যে লোকসান বা ক্ষয় হয় তাকে বলা হয় অনয়। দৃশ্যমান সম্পাদিত কর্মকে বলা হয় মানুষ্যকর্ম। এর মাধ্যমে যে প্রাপ্তি হয় তাকে বলা হয় নয় এবং যে ক্ষতি হয় তাকে বলা হয় অপনয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনা করে ভেবে-চিন্তে মানুষাত্মক কর্ম সম্পাদন করা উচিত। দৈবাত্মক কর্ম মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বলে তা নিয়ে চিন্তা করা অনাবশ্যক।
যে রাজা আত্মগুণসম্পন্ন, পাঁচটি দ্রব্য প্রকৃতির গুণযুক্ত এবং উপরোক্ত ‘নয়’র অন্তর্ভুক্ত তিনি বিজিগীষু (ষাড়গুণ্যের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুকে বিজিত করতে অভিলাষী রাজা) তথা বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা হিসেবে পরিচিত। এই প্রকৃতির রাজার কোনো বহিঃশত্রু থাকে না, এদের সঙ্গে প্রতিবেশী রাজারা মিত্রতার সন্ধিতে সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে।
০৬-০২-০৩ শত্রুরাজা যদি শিকার, বিলাসব্যসনে আসক্ত হয় বা তার রাজ্য যদি দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা কর্তৃক সে রাজ্য যাতব্য বা আক্রমণযোগ্য হবে। শত্রুরাজ্য যদি প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে দুর্বল ও মিত্রহীন হয় কিংবা দুর্বল মিত্রের আশ্রয়ে থাকে তাহলেও বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা তাকে উচ্ছেদের জন্য অভিযান পরিচালনা করবে। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে সে রাজ্যে উৎপীড়নমূলক অভিযান চালাতে হবে। শত্রুরাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি মজবুত হয় এবং সে রাজা যদি বলবান মিত্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়, সেক্ষেত্রে সেই রাজ্যের শস্য-সম্পদ শোষণ করে রাজ্যটিকে দুর্বল করে দিতে হবে। এভাবে শত্রুরাজের দুর্বলতা ও সক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা কর্তৃক উপরোক্ত প্রকৃতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শত্রুদেশে অভিযান পরিচালনাকারী রাজার সম্মুখবর্তী পাঁচটি রাজ্যের রাজাকে ক্রমানুসারে বলা হয়—অরি, মিত্র, অরিমিত্র, মিত্রমিত্র এবং অরিমিত্রমিত্র। অনুরূপভাবে পশ্চাদবর্তী চারটি রাজ্যের রাজারা হলেন—পাঞ্চিগ্রাহ, আক্রন্দ, পাঞ্চিগ্রাহাসার এবং আক্রন্দাসার। বিজয়াকাঙ্ক্ষীসহ এই দশটি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় দশরাজমণ্ডল। যুদ্ধের সময় পার্ষিগ্রাহার বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজাকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারে, তাই আক্রন্দের সহায়তায় তাকে নিবৃত করতে হবে। পাঞ্চিগ্রাহাসার এক্ষেত্রে পার্ষিগ্রাহাকে সহায়তা প্রদান করতে পারে তাই আক্রন্দাসারকে দিয়ে আক্রন্দাকে সহায়তা প্রদান করাতে হবে।
রাজার শত্রু তিন ধরনের হতে পারে—নিজ রাজ্য সংলগ্ন রাজ্যের অধিপতি যদি অমিত্র হয়ে থাকে তাহলে সে হবে স্বাভাবিক শত্রু। সমকুলজাত রাজা শত্রু হলে সে হবে সহজ শত্রু। অন্যের মাধ্যমে কারো সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টি হলে সে হবে কৃত্রিম শত্রু।
০৬-০২-০৪ শত্রুর মতো মিত্রও তিন ধরনের হতে পারে—নিজ ভূমি হতে একটি রাজ্যের ব্যবধানে অবস্থিত কোনো রাজ্যের রাজা যদি মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তিনি হবেন প্রকৃতিমিত্র। পিতা, মাতা বা পারিবারিক সম্পর্কযুক্ততার সুবাদে কেউ যদি মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তিনি হবেন সহজ মিত্র। সহায়তা লাভের জন্য বা আত্মরক্ষার স্বার্থে রাজার শরণাপন্ন হয়ে কেউ যদি মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তিনি হবেন কৃত্রিম মিত্র।
যে রাজা শত্রুরাজা এবং বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনে উভয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বা শত্রুতায় জড়াতে পারেন, তিনি হলেন মধ্যম রাজা। যে রাজা দূরত্বে অবস্থান সত্ত্বেও শত্রুরাজা, বিজয়াকাঙ্ক্ষীরাজা এবং মধ্যম রাজার সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়েও প্রয়োজনে সকলের ক্ষতিসাধনে সক্ষম, তিনি হলেন উদাসীন রাজা। এই প্রকৃতির রাজারা রাজমণ্ডলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হিসেবে পরিচিত। এ কারণে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা শত্রুরাজ্য জয়ে সফল হলে মধ্যমকে নিজ অধিকারে আনয়নের চেষ্টা করবেন এবং সে-কাজে কৃতকার্য হলে উদাসীনকেও বশে আনতে সচেষ্ট হবেন।
০৬-০২-০৫ বারো ধরনের রাজা তথা বিজয়াকাঙ্ক্ষী–মিত্র-মিত্রমিত্র, অরি- মিত্র-মিত্রমিত্র, মধ্যম-মিত্র-মিত্রমিত্র এবং উদাসীন-মিত্র-মিত্রমিত্র’র সমন্বয়ে দ্বাদশরাজপ্রকৃতির সৃষ্টি হয়। উক্ত ১২টি রাজপ্রকৃতির প্রতিটির সঙ্গে যখন অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ ও দণ্ড, এই পাঁচটি দ্রব্যপ্রকৃতি যুক্ত হয় তখন সর্বমোট প্রকৃতি হয় ৭২টি।
০৬-০২-০৬ এসব প্রকৃতি থেকে আহরিত সম্পদের মাধ্যমে সুখ উপভোগ ছাড়াও শক্তির মাধ্যমেও সুখ প্রাপ্ত হয়। শক্তি বলতে এখানে সক্ষমতা বা বল বোঝানো হয়েছে। এই শক্তি তিন প্রকার—১. জ্ঞানের মাধ্যমে যোগ ও ক্ষেম সাধনের সামর্থকে বলা হয় মন্ত্রশক্তি ২. কোষ ও দণ্ডের মাধ্যমে যোগ ও ক্ষেম সাধনের সমর্থকে বলা হয় প্রভুশক্তি ৩. বিক্রমের মাধ্যমে যোগ ও ক্ষেম সাধনের সমর্থকে বলা হয় উৎসাহশক্তি। সিদ্ধিও তিন প্রকার—১. রাজার অভিপ্রায় যদি মন্ত্রশক্তির মাধ্যমে সাধিত হয় তাহলে তা হবে মন্ত্রসিদ্ধি ২. তা যদি প্রভুশক্তির মাধ্যমে সাধিত হয় তাহলে তা হবে প্রভুসিদ্ধি ৩. এবং সে সিদ্ধি উৎসাহ শক্তির মাধ্যমে সাধিত হলে তা হবে উৎসাহসিদ্ধি।
০৬-০২-০৭ উপরোক্ত তিন প্রকার শক্তিসম্পন্ন রাজাই উত্তম বলে পরিগণিত হয়ে থাকেন। যার মধ্যে এই তিন প্রকার শক্তির ঘাটতি পরিদৃষ্ট হবে তিনি হবেন অধম রাজা। এ কারণে রাজা তার সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে শক্তি ও সিদ্ধি সমৃদ্ধকরণে সচেষ্ট হবেন। যে রাজা নিজের প্রজ্ঞাবলে শক্তি ও সিদ্ধি বৃদ্ধিতে সক্ষম নন, তিনি অমাত্য, জনপদ, দুর্গে ক্রমানুসারে শক্তি ও সিদ্ধি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবেন। রাজা বিদ্রোহী ও অমিত্রদের মাধ্যমে শত্রুর শক্তি ও সিদ্ধির বিকাশ রুদ্ধ করবেন।
০৬-০২-০৮ শত্রু রাজা যদি তার অমাত্যদের সঙ্গে আশোভন আচরণ করে, শারীরিকভাবে নিপীড়ন করে কিংবা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। শিকার, জুয়া, মদ্যপান ও নারীসম্ভোগে আসক্ত হয়ে থাকেন। তার দেশ যদি সহজেই জয়যোগ্য হয়। বিপর্যস্ত অবস্থায় নিপতিত হয়ে থাকেন। বলবান হওয়া সত্ত্বেও অন্যের সিংহাসনের জন্য হুমকি না হয়ে থাকে। সহায়ক মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকে। তাহলে সে রাজার শক্তি ও সিদ্ধির বিকাশ রুদ্ধকরণের আবশ্যকতা নেই। এক্ষেত্রে বরং তার শক্তি ও সিদ্ধির বিকাশ কামনা করা যেতে পারে।
০৬-০২-০৯ রাজা নানা কৌশলে শক্তি ও সিদ্ধি লাভের মাধ্যমে নিজের অবস্থান পোক্ত করে নিজেকে রাজমণ্ডলের প্রতিভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠিতকরণে সচেষ্ট হবেন। এক্ষেত্রে রাজা ও তার মিত্রদের মধ্যে যদি কোনো বলবানের আবির্ভাব ঘটে, তাহলে তিনি তাকে অবদমনের নিমিত্ত কার্যকর কৌশল অবলম্বন করবেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন