অষ্টম অধিকরণ (ব্যসন)

অষ্টম অধিকরণ

প্রথম অধ্যায় ॥ ১২৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজা, অমাত্য ও অন্যান্য প্রকৃতির দোষ এবং ব্যসন সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে তুলনামূলক বিচারে কোন প্রকৃতির ব্যসনজনিত বিপত্তি অধিক ক্ষতিকারক, সে সম্পর্কিত বিষয়সহ এতদসম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৮-০১-০১ যে ক্ষেত্রে রাজা বিপত্তিমুক্ত এবং শত্রু বিপত্তিযুক্ত থাকেন, সেক্ষেত্রে শত্রুর নিপাত সহজতর হয়, যে কারণে এধরনের পরিস্থিতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রাজার জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু একই সঙ্গে উভয়ে বিপত্তিযুক্ত হলে, বিপত্তির গুরুত্ব ও লঘুত্ব মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সমীচীন। বিপত্তি দুভাবে উদ্ভূত হতে পারে—

১. দৈবসৃষ্ট বিপত্তি।

২. মনুষ্য সৃষ্ট বিপত্তি।

অশুভ-অন্যায় কর্মের কারণে দৈব ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপত্তি উদ্ভূত হয়ে থাকে। বিপত্তি আরো যে পাঁচটি কারণে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তা হলো—

(ক) অভিজাত প্রকৃতির অযৌক্তিক আচার।

(খ) অভিজাত প্রকৃতির অযোগ্যতা।

(গ) শুদ্ধাচার পরিত্যাগ ও ক্রোধের অনুসরণ

(ঘ) জুয়া, নারী, মদ বা শিকারে আসক্তি এবং

(ঙ) শত্রু কর্তৃক উৎপীড়ন।

কৌটিল্যের আচার্যের মতানুযায়ী—রাজা, অমাত্য, জনপদ, নগর (দুর্গ), কোষ, সেনাবাহিনী এবং মিত্র, এই সাতটি বিপত্তির ক্ষেত্রে মিত্রের তুলনায় সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর তুলনায় কোষ, কোষের তুলনায় নগর, নগরের তুলনায় জনপদ, জনপদের তুলনায় অমাত্য এবং অমাত্যের তুলনায় রাজার বিপত্তি অধিক গুরুত্বপূর্ণ তথা বিপর্যয়কর হয়ে থাকে।

০৮-০১-০২ এই বিতর্কে আচার্য ভারদ্বাজ কৌটিল্যের আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—রাজা এবং অমাত্যের বিপত্তি একই সময় উপস্থিত হলে, অমাত্যের বিপত্তিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হবে। কারণ, অমাত্যদের মাধ্যমেই রাজ্য পরিচালনার নীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে, রাজ্যের সকল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়, সম্পদ সংগৃহীত হয়, সৈন্যদের নিয়োগ ও পদায়ন করা হয়, শত্রু ও আটবিকদের প্রতিরোধ করা হয়, প্রজাদের জানমালের হেফাজত করা হয়, উত্তরাধিকার নিয়োগের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ করা হয়।

রাজ্যের এ সমস্ত অবশ্য করণীয় কার্যাবলির দায়িত্বে অমাত্যরাই নিয়োজিত থাকেন এবং তাদের মাধ্যমেই এসব বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এ কারণে অমাত্যদের অবর্তমানে রাজাকে ডানাহীন পাখির মতো বিপর্যস্ত অবস্থায় নিপতিত হতে হয়, এক্ষেত্রে রাজার শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও ঘনীভূত হয়। অমাত্যরা কলুষিত হলে, বিদ্রোহী হলে বা তাদের মধ্যে বিপত্তি দেখা দিলে, রাজার প্রাণনাশেরও সম্ভাবনা দেখা দেয়, কারণ তারা সবসময় রাজার সান্নিধ্যে অবস্থান করেন। এ কারণেই রাজা অপেক্ষা অমাত্যদের বিপত্তি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

০৮-০১-০৩ আচার্য ভদ্বাজের উপরোক্ত মতের সঙ্গে কৌটিল্য একমত নন। তার মতে—অমাত্যদের বিপত্তি দেখা দিলে রাজা তা নিরসন করতে পারেন, তিনি কলুষিত অমাত্যকে পদচ্যুত করতে পারেন, বিপদগামীকে সুপথে চালিত করতে পারেন, অযোগ্যকে তার প্রজ্ঞার প্রভাবে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন। অমাত্যরা সবসময় রাজার আজ্ঞাবহ ও অনুসরণকারী এবং রাজা-ই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এক্ষেত্রে যে রাজা প্রজ্ঞাবান ও সদাচারী, তার অমাত্যরাও তদ্রূপ গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন। এ সব কারণে তিনি মনে করেন, অমাত্য নয় বরং রাজার বিপত্তি-ই অধিক গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

০৮-০১-০৪ এই বিতর্ক প্রসঙ্গে আচার্য বিশালাক্ষের অভিমত এই যে অমাত্য এবং জনপদের বিপত্তির ক্ষেত্রে শেষোক্ত বিপত্তিতেই অধিক ক্ষতিসাধিত হয়। তার মতে—অর্থ, সৈন্য, বনজ সম্পদ, কারিগর, সকল ধরনের বাহন, এবং সকল প্রকার শস্য ও ভোগ্যপণ্য জনপদে উৎপাদিত হয় এবং জনপদ থেকে সংগৃহীত হয়। এক্ষেত্রে জনপদের বিপত্তি হলে উপরোক্ত উৎপাদন ও সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, এতে করে রাজা এবং রাজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, এ কারণে অমাত্যদের বিপত্তি অপেক্ষা জনপদের বিপত্তি অধিক ক্ষতিকারক।

০৮-০১-০৫ এক্ষেত্রে আচার্য বিশালাক্ষের উপরোক্ত অভিমতের সঙ্গে কৌটিল্য দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—–জনপদের সকল কর্মকাণ্ড অমাত্যদের মাধ্যমেই আবর্তিত হয়। অমাত্যদের মাধ্যমে বাঁধনির্মাণের ফলে সেচ সুবিধার সুবাদে কৃষিজাত ফসল উৎপন্ন হয়, স্বদেশ বিদেশ থেকে সম্পদ আহরিত হয়, পণ্যদ্রব্যের বিপত্তি নিরোধ করা হয়, নতুন জনপদ সৃজন করা হয় এবং রাজার সমস্ত ধরনের আয় সংগৃহীত হয়। এ সব কারণে তিনি মনে করেন জনপদের বিপত্তির চেয়ে অমাত্যদের বিপত্তি অনেক বেশি ক্ষতিকারক।

০৮-০১-০৬ এই বিতর্ক প্রসঙ্গে আচার্য পরাশরের শিষ্যরা মনে করেন যে জনপদ অপেক্ষা নগরের (দুর্গ) বিপত্তি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষতিকারক। তাদের মতে—নগরে রাজ্যের সমস্ত সম্পদ সৈন্যদের দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে, নগরেই সেনাবাহিনী সমবেত থাকে, শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে জনপদের লোকেরা নগরেই আশ্রয়গ্রহণ করে থাকে, জনপদে বসবাসকারীদের তুলনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক দিয়ে নগরের লোকেরা অধিক শক্তিশালী, রাজার কাছাকাছি অবস্থানজনিত কারণে তারাই তার সহায়কশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এসব কারণে নগরের বিপত্তি দেখা দিলে রাজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, বিধায় নগরের বিপত্তি জনপদের বিপত্তি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকারক বলে তারা মনে করেন।

০৮-০১-০৭ আচার্য পরাশরের অনুসারীদের উপরোক্ত মতের সঙ্গে কৌটিল্য একমত নন। তিনি মনে করেন—নগরের পত্তন, কোষ বা ধনসম্পদ, সেনাবাহিনী, জলজ সম্পদ, কৃষিজ সম্পদসহ সকল সম্পদের উৎসভূমি হলো জনপদ। তিনি আরো বলেন—শক্তি সমর্থতার অনুষঙ্গ তথা সাহসিকতা, দৃঢ়তা, কর্মনিপুণতা এবং সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে নগরবাসী অপেক্ষা জনপদবাসী অধিক সক্ষম। অধিকন্তু জনপদের অভাব হেতু পর্বত বা অন্তদ্বীপেও আশ্রয়গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এ সমস্ত কারণে নগর অপেক্ষা জনপদের বিপত্তিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষতিকারক।

০৮-০১-০৮ নগরের বিপত্তি এবং কোষের বিপত্তির ক্ষেত্রে কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষতিকারক, এ সংক্রান্ত বিতর্কের ক্ষেত্রে আচার্য পিশুন মনে করেন যে কোষের বিপত্তিই এক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব বহন করে বা ক্ষতিকারক। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন—কোষের মাধ্যমে নগর সৃজন ও সংস্কার করা যায়, জনপদের নিরাপত্তা বিধান করা যায়, সেনাবাহিনী গঠন করা যায়, তাদের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা যায়, মিত্রতা স্থাপন করা যায়, শত্রুদের বিনাশ করা যায় এবং আপতকালে সম্পদ হস্তান্তর করে আত্মরক্ষার্থে পালিয়েও যাওয়া যায়। পলায়নকালে পলায়নপর ব্যক্তি সম্পদ নিয়ে পালাতে পারে কিন্তু নগরকে সঙ্গে নিয়ে কারো পক্ষে পলায়ন করা সম্ভব হয় না। এ সব কারণে নগর অপেক্ষা কোষ বা সম্পদের বিপত্তি অধিক ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০১-০৯ আচার্য পিশুনের উপরোক্ত মতের সঙ্গে কৌটিল্য দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে —নগরের মাধ্যমেই সেনাবাহিনী ও কোষ বা সম্পদ সংরক্ষিত হয়, গুপ্তচরদের দিয়ে শত্রু নিধন সম্ভব হয়, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা এবং মিত্রদের সহায়তা প্রদান সম্ভব হয়, শত্রুসৈন্য এবং আটবিকদের আক্রমণ প্রতিহতকরণ সম্ভব হয়, রাজ্যের সার্বিক সমৃদ্ধি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নগরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নগর বিপর্যস্ত হলে সমুদয় সম্পদ শত্রুর অধিকারে চলে যায়। অন্যদিকে কোষহীন অবস্থায়ও নগর যদি সুরক্ষিত হয়, তাহলে কখনো তা শত্রুর দ্বারা ধ্বংস হয় না, এ কারণে কোষ অপেক্ষা নগরের বিপত্তিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষতিকারক বলে পরিগণিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

০৮-০১-১০ কোষ এবং সেনাবাহিনীর বিপত্তির ক্ষেত্রে কোনটি অধিক ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে আচার্য কৌণপদন্ত বলেন—সেনাবাহিনীর বিপত্তিই এক্ষেত্রে অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই অমিত্রকে অবদমন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়। সেনাবাহিনী ব্যতিরেকে কোষের হেফাজতও সম্ভব হয় না। অধিকন্তু কোষের সংকটকালে সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই বলপূর্বক সম্পদ সংগ্রহ সম্ভব হয়। এছাড়া সৈন্যরাই রাজাকে আপতকালে নিরাপত্তামূলক সহায়তা প্রদান করে থাকে। এ সব কারণে কোষের বিপত্তি অপেক্ষা সেনাবাহিনীর বিপত্তি বা বিপর্যয় অনেক বেশি ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০১-১১ আচার্য কৌণপদন্তের উপরোক্ত অভিমত কৌটিল্য কর্তৃক সমর্থিত নয়। তার মতে—সেনাবাহিনীর বিপত্তি অপেক্ষা কোষের বিপত্তি অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, কোষের মাধ্যমেই সৈন্য সংগৃহীত হয়ে থাকে, অন্য উপায়ে সৈন্য সংগ্রহের সুযোগ নেই। কোষের সংকট হলে সৈন্যরা রাজাকে পরিত্যাগ করে শত্রুর কাছে সমর্পিত হয়। কখনোবা তারা রাজাকে হত্যাও করে থাকে। কোষ দিয়েই সকল চাহিদা পূরণ করা হয়। এমন কি ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের ব্যয়ও কোষ দিয়েই নির্বাহ করা হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কোষ যেমন সেনাবাহিনীকে সংরক্ষণ করে তেমনি সেনাবাহিনীও কোষের সংরক্ষণ করে থাকে, একটি অপরটির পরিপূরক হয়ে থাকে। তদুপরি কোষ দিয়েই সবকিছু অর্জন সম্ভব বলে, কোষের বিপত্তি সেনাবাহিনীর বিপত্তি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০১-১২ সেনাবাহিনীর বিপত্তি এবং মিত্র বিপত্তির ক্ষেত্রে কোনটি অধিক ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে আচার্য বাতব্যাধি মনে করেন—এক্ষেত্রে মিত্রের বিপত্তিই অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, স্বীয় সৈন্যরা রাজার সান্নিধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও বেতন ব্যতিরেকে দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রদর্শন করে থাকে, অন্যদিকে দূরবর্তী অবস্থানে অবস্থান সত্ত্বেও এবং আর্থিক সুবিধা না পেয়েও মিত্ররা রাজাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে থাকেন। প্রয়োজনে বিপদাপন্ন রাজাকে ভূমি ও সেনাসহায়তা দিয়ে উদ্ধার করেন। এ কারণে মিত্রের বিপত্তি সেনাবাহিনীর বিপত্তি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকারক হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

০৮-০১-১৩ বাতব্যাধির উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কৌটিল্য বলেন—যে রাজার সেনাবাহিনী থাকে তার মিত্রও থাকে, এমন কি অমিত্ররাও সে রাজার মিত্রে পরিণত হয়, রাজার সেনাবাহিনী না থাকলে কেউ তার সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে আগ্রহী হন না। তাছাড়া তাৎক্ষণিক প্ৰয়োজনে দূরবর্তী স্থানের মিত্ররা রাজাকে কোনো সহায়তা প্রদানে সক্ষম হয়ে ওঠেন না, রাজাকে নিজের সেনাবাহিনী দিয়েই তাৎক্ষণিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হয়, অধিকন্তু মিত্ররাও অনেক সময় স্বীয় স্বার্থসিদ্ধিতেই অধিক মনোযোগী হয়ে থাকেন। এসব কারণে মিত্র অপেক্ষা সেনাবাহিনীর বিপত্তিই অধিকতর ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

০৮-০১-১৪ রাজার সপ্তপ্রকৃতির অবয়ব থাকে। এক্ষেত্রে রাজপ্রকৃতির অবয়ব যুবরাজ, অমাত্য প্রকৃতির অবয়ব পরামর্শক পরিষদ, জনপদ প্রকৃতির অবয়ব কৃষককারিগর, দুর্গ প্রকৃতির অবয়ব অস্ত্রাগার, কোষ প্রকৃতির অবয়ব রত্নসম্পদ, সেনা প্রকৃতির অবয়ব বেতন এবং মিত্র প্রকৃতির অবয়ব বন্ধুত্ব। এসব অবয়বের বিপত্তির বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ন করে রাজাকে শত্রুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শত্রুর উপরোক্ত প্রকৃতির কোনো অবয়ব যদি দোষযুক্ত হয় এবং রাজার সেই অবয়ব যদি দোষমুক্ত হয়, সেক্ষেত্রে রাজা কর্তৃক শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করা হলে তা ফলপ্রসু হবে।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ১২৮ অধিকরণ।

এই অধ্যায়ে রাজা, রাজার মিত্রবর্গ এবং রাজ্যের বিপত্তি তথা বিপর্যয়ের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও রাজার বিরুদ্ধে কি ধরনের কোপ বা ক্ষোভ সূচিত হতে পারে, বিভিন্ন প্রকৃতির রাজাদের মধ্যে কে শ্রেয়তর, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৮-০২-০১ রাজা, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ, সৈন্য এবং মিত্র, এই সাতটি প্রকৃতি দুই ভাগে বিভাজিত। এর একটি রাজা এবং অপরটি রাজ্য। এই বিভাজনের ভিত্তিতে রাজার বিরুদ্ধে রাজ্য হতে দু ধরনের কোপ উদ্ভূত হতে পারে। এর একটি হলো অভ্যন্তরীণ কোপ এবং অপরটি হলো বাহ্য বা বহিরাঙ্গনের কোপ। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কোপ বাহিরের কোপ অপেক্ষা অতীব ভয়াবহ। এটি সর্পের মতো ভীতিপ্রদ। অভ্যন্তরীণ কোপ আবার দু ধরনের হতে পারে (ক) অন্তরমাত্য কোপ যা রাজার মুখ্য অমাত্য হতে উদ্ভূত (খ) বাহ্যামাত্য কোপ যা অন্যান্য অমাত্য হতে উদ্ভূত। এক্ষেত্রে প্রথমটি দ্বিতীয় কোপ অপেক্ষা অধিক ভীতিপ্রদ। এ ধরনের কোপ পরিহারকল্পে রাজাকে সব সময়ের জন্য কোষ এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখতে হবে।

০৮-০২-০২ যে রাজ্য দুই রাজার মাধ্যমে শাসিত হয় তাকে বলা হয় দ্বৈরাজ্য এবং যে রাজ্য শত্রুরাজ কর্তৃক রাজার পরাজয় বা নিহত হওয়ার মাধ্যমে বিজিত হয়ে শাসিত হয় তাকে বলা হয় বৈরাজ্য। কৌটিল্যের আচার্যের মতানুযায়ী বৈরাজ্য অপেক্ষা দ্বৈরাজ্য অধিক কষ্টকর। কারণ, দ্বৈরাজ্যের রাজাদ্বয় দ্বেষ, ঈর্ষা ও স্বজন পোষণজনিত কারণে সর্বদা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত থেকে নিজেদের সমৃদ্ধিনাশ করে থাকে, যা প্রকারান্তরে প্রজাদের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। অন্যদিকে বৈরাজ্য বা রাজ্য দখলকারী রাজা প্রজাদের পরিতৃপ্তির প্রতি সচেতন থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করেন বলে প্রজাদের জন্য তা হিতকর হয়ে থাকে।

০৮-০২-০৩ কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে বলেন—পিতাপুত্র বা দুভাই যখন দ্বৈরাজ্যে যৌথভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তখন তাদের যৌথ নজরদারীতে অমাত্যরা সংযত থাকে, ফলে রাজকার্য সুচারুরূপে সম্পাদিত হয়, প্রকারান্তরে যা প্রজাদের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। অন্যদিকে দখলদার রাজা বৈরাজ্য শাসনকালে রাজ্যটিকে পররাজ্য হিসেবে বিবেচনা করে প্রজাদের উৎপীড়ন করেন অথবা রাজ্যের সমুদয় সম্পদ অন্যত্র স্থানান্তর করেন অথবা অন্য কারো কাছে রাজ্যটি বিক্রি করে দেন অথবা প্রজাদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবান সম্পদ আত্মসাৎ করে রাজ্যত্যাগ করে অন্যত্র পালিয়ে যান।

০৮-০২-০৪ শাস্ত্রজ্ঞানহীন এবং শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও তা অপ্রতিপালনকারী রাজাদ্বয়ের মধ্যে কে অধিক শ্রেয়, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—যে রাজা শাস্ত্রজ্ঞান রহিত, তিনি অন্যের দ্বারা চালিত হয়ে দুষ্কর্মে লিপ্ত হন এবং রাজ্যকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন, কিন্তু যে রাজা শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন হয়েও শাস্ত্র নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হন, তাকে সহজে সঠিক পথে চালনা করা সম্ভব হয়। এ কারণে অজ্ঞের চেয়ে শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন রাজা-ই শ্রেয়তর।

০৮-০২-০৫ কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে একমত পোষণ না করে বলেন—শাস্ত্রজ্ঞানহীন রাজাকে অমাত্যদের পক্ষে হিতকর পথে চালিত করা সম্ভব হয়। কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন রাজা কখনো কারো দ্বারা চালিত না হয়ে ইচ্ছেমাফিক নিজেকে ধ্বংসাত্মক পথে চালিত করে নিজের এবং রাজ্যের ধ্বংস করে থাকে। এ কারণে এক্ষেত্রে শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ রাজা-ই শাস্ত্রজ্ঞ রাজা অপেক্ষা শ্রেয়তর।

০৮-০২-০৬ রোগাক্রান্ত বৃদ্ধরাজা এবং সদ্যঅভিষিক্ত নবীন রাজার মধ্যে কে অধিক শ্রেয়, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—রোগাক্রান্ত রাজা অমাত্যদের বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণে অসমর্থ হয়ে থাকেন, যে কারণে তিনি অমাত্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষতিকারক কাজে যুক্ত হয়ে রাজ্যের সর্বনাশ করেন। এ ধরনের রাজাকে অমাত্যরা অযোগ্য মনে করে অনেক সময় হত্যাও করে থাকে। কিন্তু নবীন রাজা শাস্ত্রসম্মত রাজধর্মের অনুষ্ঠান, প্রজাদের অর্থ সহায়তা, কর অব্যাহতি, ভূমিদান এবং সম্মান প্রদর্শনসহ বহুবিদ কর্মের মাধ্যমে প্রজা সাধারণকে পরিতৃপ্ত করে থাকেন। এসব কারণে রোগাক্রান্ত বৃদ্ধরাজা অপেক্ষা নবীন রাজা অধিকতর শ্রেয়।

০৮-০২-০৭ কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত সমর্থন করেন না। তার মতে—রোগাক্রান্ত বৃদ্ধরাজা পূর্ব থেকেই রাজকীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করে চলেন। কিন্তু নবীন রাজা তার রাজ্যকে নিজের অর্জিত রাজ্য মনে করে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমাফিক শাসন করেন। ক্ষেত্র বিশেষে তাকে মিত্রদের পীড়নও সহ্য করতে হয়। এছাড়া নবীনত্বের কারণে প্রজাদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাও দৃঢ়মূল হয় না, যে কারণে এ ধরনের রাজা অতি সহজেই শত্রুদের দ্বারা উচ্ছেদিত হয়। এ কারণে নবীন রাজা অপেক্ষা রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ রাজা-ই শ্রেয়তর।

০৮-০২-০৮ নবীন রাজা দুধরনের হতে পারে—অভিজাত তথা উচ্চকুলজাত এবং অনভিজাত তথা নিচকুলজাত। এদের মধ্যে অভিজাত দুর্বল রাজা এবং অনভিজাত সবল রাজার মধ্যে কে অধিক শ্রেয়, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—আভিজাত্য সত্ত্বেও রাজা যদি দুর্বল হয়ে থাকেন, তাহলে অমাত্য এবং প্রজা সাধারণ তার দুর্বলতাকে স্মরণ করে তাকে মান্য করে না। কিন্তু অনভিজাত হয়েও রাজা যদি বলশালী হয়ে থাকেন, তাহলে অমাত্য এবং প্রজারা ক্ষমতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তাকে মান্য করে। এ কারণে অভিজাত দুর্বল রাজা অপেক্ষা অনভিজাত বলশালী রাজাই শ্রেয়তর।

০৮-০২-০৯ কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—অমাত্য এবং প্রজারা সব সময় অভিজাত রাজার সমীপে অবনত হয়ে থাকে। এ ধরনের অভিজাত বংশের রাজারা ঐশ্বর্যশালী হয়ে থাকেন, যে কারণে অনেকে এদের উপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রত্যয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে অমাত্য ও প্রজা সাধারণ অনভিজাত বলশালী রাজাকে সাময়িক সময়ের জন্য মান্য করে থাকে এবং সুযোগ পেলেই এ ধরনের রাজার বিরুদ্ধাচারণে প্রবৃত্ত হয়। এ ধরনের রাজার প্রতি অমাত্যদের কোনো অনুরাগ থাকে না। যে কারণে অনভিজাত সবল রাজার চেয়ে অভিজাত দুর্বল রাজা-ই শ্রেয়তর।

০৮-০২-১০ একমুঠো বীজের তুলনায় উৎপাদিত শস্যের বিনাশ অনেক বেশি ক্ষতিকর হয়ে থাকে। কারণ, উৎপন্ন শস্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে জলসেচসহ অনেক শ্রম। অতিবৃষ্টির তুলনায় অনাবৃষ্টি অনেক বেশি ক্ষতিকর। কারণ, অনাবৃষ্টির ফলে জল নির্ভর জীবন ও জীবিকার সর্বনাশ হয়।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ১২৯ অধিকরণ।

এই অধ্যায়ে ক্ষতিকারক দোষের (কু অভ্যাস) বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও কি কারণে মানুষের মধ্যে দোষের উন্মেষ ঘটে, তুলনামূলক বিচারে কোন ধরনের দোষ অধিক ক্ষতিকারক, দোষ কেন পরিত্যাগ করা আবশ্যক, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৮-০৩-০১ বিদ্যার অভাবজনিত কারণেই মানুষের চরিত্রে দোষের উন্মেষ ঘটে। ক্রোধ থেকে যে তিন ধরনের দোষের উন্মেষ ঘটে, তা হলো— বাপারুষ্য, দণ্ড পারুষ্য এবং অর্থদোষ। কামভাব থেকে যে চার ধরনের দোষের উন্মেষ ঘটে, তা হলো—শিকার, জুয়া, নারীসঙ্গ এবং মদ্যপান। এভাবে মানুষের মধ্যে সাত ধরনের দোষের উন্মেষ ঘটে থাকে। উপরোক্ত দোষবর্গের মধ্যে ক্রোধ সম্পৃক্ত দোষ অধিক প্রভাবশালী। ক্রোধ সর্বব্যাপী, সকল উৎস থেকেই তার উন্মেষ হতে পারে। কিন্তু কামের পরিধি অত্যন্ত সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ। কামের প্রভাবে নিঃস্ব হয়ে অনেকে যেমন রাজ্যহারা হয়ে থাকে তেমনি ক্রোধের কোপানলে নিপতিত হয়ে অনেকসময় অনেক রাজাকে অমাত্য বা জনতা কর্তৃক নিহতও হতে হয়। কৌটিল্যের আচার্য এমনটাই মনে করে থাকেন।

০৮-০৩-০২ আচার্য ভারদ্বাজ উপরোক্ত অভিমত সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—ক্রোধ ও কাম দোষণীয় কিছু নয়। কারণ, ক্রোধের মাধ্যমেই শত্রুদের প্রতিরোধ করা যায়, অবহেলা নিবারণ করা যায় এবং অপরাধীর মনে ভীতি উৎপাদন করা যায়। এছাড়া পাপীকে পাপকর্ম থেকে নিবৃতকরণেও ক্রোধের অপরিহার্যতা অত্যাবশ্যক। অন্যদিকে কামের সুবাদে সুখলাভ হয়ে থাকে। কামজ চেতনার কারণেই মানুষ প্রসন্ন, দানশীল এবং সৌমভাবাপন্ন হয়ে থাকে। নিজের কষ্টের ফল উপভোগের জন্য কামজ চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা অতীব প্রয়োজন।

০৮-০৩-০৩ আচার্য ভারদ্বাজের উপরোক্ত অভিমত কৌটিল্য কর্তৃক সমর্থিত নয়। তিনি মনে করেন—ক্রোধ ও কাম কখনো গুণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ, ক্রোধ থেকেই বিদ্বেষের সৃষ্টি হয় এবং বিদ্বেষের কোপানলে নিপতিত হলে তা যেমন শত্রুতা বৃদ্ধি করে তেমনি দুঃখ ও ভোগান্তি বয়ে আনে। ক্রোধের কারণে এ ধরনের তিনটি দোষের উন্মেষ ঘটে থাকে। ক্রোধের মতো কামের কারণে, পরিভব তথা কামের তাড়নায় কুপথে চালিত হয়ে তিরস্কৃত ও অপমানিত হতে হয়। সম্পদ নাশ তথা কামাসক্তের কারণে অর্থ-সম্পদের নাশ হয় এবং চোর, বাটপার, জুয়াড়ি, শিকারি, গায়ক বাদকের মতো অর্থনাশকারীদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হয়। এ সব কারণে ক্রোধ এবং কাম কখনো কারো গুণ হতে পারে না, দোষ হিসেবে বিবেচিত হওয়াই সঙ্গত।

০৮-০৩-০৪ উপরোক্ত তিন ধরনের ক্রোধ এবং কামের ক্ষেত্রে কামজনিত তিরস্কার ও অপমান অপেক্ষা ক্রোধজনিত বিদ্বেষ অধিকতর ক্ষতিকারক। কারণ, তিরস্কৃত এবং অপমানিত ব্যক্তি একসময় আপনজনদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে কিন্তু দ্বেষযুক্ত বা ঘৃণিত ব্যক্তি কখনো গ্রহণযোগ্য হয় না, এ ধরনের ব্যক্তি উচ্ছেদ বা ধ্বংস হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কামজনিত দ্বিতীয় দোষ তথা সম্পদনাশ অপেক্ষা ক্রোধজনিত দ্বিতীয় দোষ তথা শত্রুতা অধিক পীড়াদায়ক ও ক্ষতিকারক। কারণ, সম্পদের বিনাশ হলে শুধু নিঃস্ব হতে হয়, জীবন সংকটাপন্ন হয় না। কিন্তু শত্রুতার সৃষ্টি হলে তা জীবনের জন্যও হানিকর হয়ে থাকে, এতে জীবননাশের সম্ভাবনা থাকে। তেমনিভাবে কামজনিত তৃতীয় দোষ তথা চোর, জুয়াড়ি প্রকৃতির অর্থনাশকারীর সঙ্গে সংযোগ বা সম্পৃক্ততা অপেক্ষা ক্রোধজনিত তৃতীয় দোষ তথা দুঃখ-ভোগান্তি অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, কামজ ক্ষেত্রে অর্থের বিনাশ হলেও তা সাময়িক সময়ের জন্য সুখানুভূতি প্রদান করে থাকে কিন্তু ক্রোধের কারণে সৃজিত দুঃখ ভোগান্তি দীর্ঘকাল মানুষকে পীড়িত করে দুর্দশাগ্রস্ত করে থাকে, এক্ষেত্রে কখনো প্রীতিকর কিছু প্রাপ্ত হয় না। এসব কারণে কামজ তিনটি দোষ অপেক্ষা ক্রোধজাত তিনটি দোষ অধিক হানিকর বা ক্ষতিকারক।

০৮-০৩-০৫ ক্রোধ থেকে উত্থিত তিনটি দোষ হলো—(ক) বাপারুষ্য তথা কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বা পীড়ন করা (খ) অর্থদূষণ তথা জীবিকা বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং (গ) দণ্ডপারুষ্য বা শারীরিকভাবে ক্ষতিসাধন করা। আচার্য বিশালাক্ষ মনে করেন—কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া এবং আর্থিকভাবে কষ্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়াটাই অধিক হানিকর। কারণ, কথার মাধ্যমে কষ্টপ্রাপ্ত ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং অন্তরের তেজস্বীতা প্রজ্বলিত ও ইন্দ্রিয়সমূহ সচল করে প্রত্যাঘাত করে থাকে।

০৮-০৩-০৬ আচার্য বিশালাক্ষের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত কৌটিল্য কর্তৃক সমর্থিত নয়। তার মতে—কথার চেয়ে আর্থিকভাবে কষ্ট প্রদান করা হলে তা অধিক কষ্টকর হয়ে থাকে। কারণ, অর্থ দিয়েই সবকিছু সম্পাদন করা হয়, অর্থ ব্যতিরেকে কোনোকিছু অর্জিত হয় না। বিধায় অর্থ দূষণই অধিক ক্ষতিকারক। এক্ষেত্রে চারভাবে অর্থ দূষণ সাধিত হয়—(ক) কাজ করিয়ে মজুরি না দেওয়া (খ) দণ্ডের মাধ্যমে অন্যের ধন হরণ (গ) অর্থনাশ দ্বারা দেশের ভোগান্তি সৃষ্টি করা এবং (ঘ) সংরক্ষণযোগ্য অর্থের বিনাশ করা।

০৮-০৩-০৭ আচার্য পরাশরের অনুসারীরা মনে করেন—শারীরিক আঘাত অপেক্ষা আর্থিক আঘাত অধিক পীড়াদায়ক। কারণ, জাগতিক সবকিছু অর্থ নির্ভর। অর্থের মাধ্যমেই সাংসারিক ও দৈনন্দিন কর্মাদি আবর্তিত হয়ে থাকে। যে কারণে শারীরিক আঘাত অপেক্ষা আর্থিক আঘাত অধিক কষ্টদায়ক। পরাশরের অনুসারীদের উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কৌটিল্য বলেন— প্ৰভূত সম্পদের অধিকারী হয়েও কেউ কখনো শারীরিকভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হতে ইচ্ছেপোষণ করেন না বরং নিজেকে রক্ষার্থে আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে দ্বিধা করে না। এ কারণে আর্থিক আঘাত অপেক্ষা শারীরিক আঘাত অনেক বেশি কষ্টদায়ক বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

০৮-০৩-০৮ কামজ দোষের চারটি উপসঙ্গ হলো—(ক) শিকার (খ) জুয়াখেলা (গ) নারীসঙ্গ এবং (ঘ) সুরাপান। এই চারটি দোষের কোনটি অপেক্ষা কোনটি অধিক দোষণীয়, সে প্রসঙ্গে বিতর্ককালে আচার্য পিশুন বলেন- জুয়াখেলা অপেক্ষা শিকার অধিক দোষণীয়। কারণ, শিকারের ক্ষেত্রে চোর, দস্যু, শত্রু ও হিংস্রজন্তু কর্তৃক আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, অধিকন্তু দাবানল, দিগ্‌ভ্রান্ততা, ক্ষুধা, পিপাসা, ইত্যাকার নানা ধরনের বিপর্যয়ে নিপতিত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে শিকারির জীবনও বিপন্ন হতে পারে। অন্যদিকে জুয়া খেলায় সব সময় অর্থনাশ হয় না, অনেক সময় বিচক্ষণতার সুবাদে প্রাপ্তিও ঘটে থাকে। যেমন নলের বিরুদ্ধে জয়ৎসেন এবং যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে দুর্যোধন জয়লাভ করেছিল।

০৮-০৩-০৯ আচার্য পিশুনের উপরোক্ত অভিমত কৌটিল্য কর্তৃক সমর্থিত নয়। তিনি মনে করেন—পাশা খেলার মতো দ্যূতক্রীড়ায় একপক্ষের হার হয় এবং একপক্ষের জিত হয়। যেমন নল ও যুধিষ্ঠির পরাজিত হয়েছিলেন। জুয়ায় বিজিত দ্রব্যাদি বিজেতার ভোগ্যপণ্যে পরিণত হয়, এতে করে বিজেতার প্রতি পরাজিতের শত্রুতার জন্ম হয় এবং কষ্টার্জিত সম্পদ অপখাতে খরচা হয়। জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত ধন অশুদ্ধ উপায়ে অর্জিত হয়, ক্ষেত্র বিশেষে অর্জিত ধন ভোগের পূর্বেই জুয়ায় পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যায়। এছাড়া দীর্ঘ সময়ব্যাপী খেলায় মত্ত থাকার কারণে পানাহার, মলমূত্র ত্যাগ বিঘ্নিত হয়, এর ফলে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হতে পারে। এসব-ই জুয়া খেলার কুফল। অন্যদিকে শিকারে প্রবৃত্ত হলে তা শারীরিক ব্যয়াম হিসেবে হিতকর হয়, এতে করে সর্দি-কাশি, পিত্ত সমস্যা, মেদ ও ঘর্মাক্ততা হতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। শিকার কার্যের মাধ্যমে গতিশীলতা, স্থিরতা ও লক্ষ্য নির্ধারণের শিক্ষা অর্জিত হয়। হিংস্রপশুদের আক্রমণের আশঙ্কা থেকে এ বিষয়ক বাস্তব ধারণা অর্জিত হয়। শিকারের এসব ইতিবাচক কারণে শিকার অপেক্ষা জুয়াজাত দোষ অধিকতর ক্ষতিকারক।

০৮-০৩-১০ নারীসঙ্গ (লাম্পট্য) এবং দ্যূতিদোষের মধ্যে কোনটি অধিক ক্ষতিকারক এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আচার্য কৌণপদন্ত বলেন—নারীসঙ্গ অপেক্ষা দ্যূতিদোষ তথা জুয়াখেলা অধিক দোষণীয় বা ক্ষতিকারক। কারণ, জুয়াড়িরা জুয়া খেলায় এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে দিনের আলো তিরোহিত হলেও রাত্রিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে খেলা চালিয়ে যায়, এমনকি মাতার মৃত্যু হলেও তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিহার করে খেলায় নিমগ্ন থাকে, সঙ্কটে নিপতিত অবস্থায় কোনো প্রশ্ন করা হলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এ সবই দ্যূতিদোষ যুক্ত।

অন্যদিকে নারীসঙ্গ দোষযুক্ত রাজাকে স্নানকালে, প্রসাধন গ্রহণকালে এমনকি ভোজনকালেও ধর্ম ও অর্থ শাস্ত্র বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়, এসব বিষয়ে তাকে বোঝানোও যায়। যে নারীর প্রতি রাজা আসক্ত হয়ে থাকেন তিনি কল্যাণকর হলে অমাত্যরা তাকে সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত করতে পারেন, তিনি ক্ষতিকারক হলে গোপনে তাকে হত্যা করতে পারেন বা অন্যত্র সরিয়ে দিতে পারেন। এ সবই নারী সঙ্গের ইতিবাচক দিক, যে কারণে জুয়াজাত দোষ অপেক্ষা নারীসঙ্গ অনেক কম ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৩-১১ আচার্য কৌণপদন্তের উপরোক্ত অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কৌটিল্য বলেন—দ্যূতক্রিয়ায় বা জুয়ায় সম্পদনাশ হলে পুনর্বার খেলার মাধ্যমে তা ফেরত পাবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু নারীদোষে ধনাদি নাশ হলে তা ফেরত পাবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এছাড়া নারীসঙ্গে আসক্ত রাজার সঙ্গে অমাত্যরা প্রয়োজনের সময় সাক্ষাৎ করতে পারেন না, এতে করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অভাবে অনেক সময় অনেক অঘটন ঘটে যায়। ফলে, নারী আসক্ত রাজার প্রতি অমাত্যরা ক্রমশ অনুৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং প্রকারান্তরে তা রাজত্বের জন্য হয় হানিকর হয়। এছাড়া রমণীরতিতে আসক্ত রাজা মদ্যপানেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এসব কারণে জুয়াজাত দোষ অপেক্ষা নারীদোষ অনেক বেশি ক্ষতিকারক।

০৮-০৩-১২ নারীসঙ্গ এবং মদ্যপানের আসক্তিজনিত দোষের মধ্যে কোনটি অধিক ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত প্রদান প্রাক্কালে আচার্য বাতব্যাধি বলেন—পানাভ্যাসের চেয়ে নারীসঙ্গ অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, নারীসঙ্গের কারণে অনেক সময় জীবন বিপন্ন হতে পারে। এছাড়া নারীর মূর্খতাজনিত কারণে নারীতে আসক্তকারীকে আরো বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মদ্যপানের আসক্তিতে তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। উপরন্ত পানের প্রভাবে শ্রান্তি দূরীভূত হয়, চিত্তে প্রশান্তি অনুভূত হয় এবং অবসাদের অবসান ঘটে।

০৮-০৩-১৩ কৌটিল্যের মতানুযায়ী বাতব্যাধির উপরোক্ত অভিমত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তার মতে—বিবাহিতা পতিব্রতা স্ত্রীর প্রতি রাজা আসক্ত হলে ক্ষতি নেই, এতে করে যেমন সন্তানাদি জন্ম দেওয়া যায়, তেমনি আপতকালে স্ত্রীর সহায়তায় আত্মরক্ষা করাও সম্ভব হয়। তবে, পতিতা নারীতে আসক্ত হলে এর বিপরীত ফল হতে পারে। আবার সম্ভ্রান্ত নারীতে আসক্তি জন্মালে প্রাণনাশেরও সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের আসক্তির সাথে পানদোষ ও যুক্ত হয়। অন্যদিকে পানাসক্তির কারণে জীবনাচারের স্বাভাবিকতা লোপ পায়, মানুষ উন্মত্তের মতো হয়ে যায়, মৃতের মতো নিস্তেজ হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে প্রকাশ্যে শরীরের গুপ্তাঙ্গ প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হয়। মদ্যপের শাস্ত্রজ্ঞান লোপ পায়, প্রাজ্ঞ লোকদের সঙ্গে সংশ্রব ছিন্ন হয় এবং অর্থনাশকারী গায়ক, বাদক, কুশীলবদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে নারী আসক্তির দোষ অপেক্ষা পানদোষ অধিক ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৩-১৪ কোনো কোনো আচার্য মনে করেন—জুয়া এবং মদ্য পানের মধ্যে জুয়াজাত দোষ-ই অধিক কষ্টদায়ক বা ক্ষতিকারক। কারণ, এক্ষেত্রে জুয়ায় লাভকারী ও ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে পারস্পারিক শত্রুতার সৃষ্টি হয় এবং একের বিরুদ্ধে অপরের ক্রোধ উৎপন্ন হয়, ক্ষেত্র বিশেষে মিত্র রাজাদের ঐক্য বিপর্যস্ত হয়, অনেক ক্ষেত্রে জুয়াক্রান্ত রাজা কর্তৃক অসৎ ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এসব কারণে জুয়াজাত দোষ-ই সর্বদিক দিয়ে অন্যান্য দোষ অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকারক।

০৮-০৩-১৫ সার্বিক বিচারে কাম ও ক্রোধ উভয় দোষের প্রভাবেই অসৎ ব্যক্তিদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় এবং সদাচারী ব্যক্তিরা নিগৃহীত হয়ে থাকে। যে কারণে উভয় দোষকেই ক্ষতিকারক বলে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। এসব ক্ষতিকারক দোষের প্রভাব বিবেচনা করে আত্মবান রাজা বৃদ্ধসেবী ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে সকল প্রকার ক্ষতিকারক এবং পীড়াদায়ক ক্রোধ ও কাম সম্পৃক্ত দোষ (কু- অভ্যাস) পরিত্যাগ করবেন।

চতুর্থ অধিকরণ। ১৩০-১৩১-১৩২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে দৈব ও মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়জনিত পীড়ন, রাজার মুখ্য অমাত্যদের মাধ্যমে রাজকোষের ক্ষতি এবং রাজাকে প্রদত্ত প্রজার কর রাজার খাজাঞ্চিখানায় জমা না করা সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও কোন প্রকৃতির বিপত্তি তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিকারক, কোন ধরনের বিহারে কি ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়, কোন পীড়নকারী সহজে দমনযোগ্য, রাজার সম্পদ সংগ্রহ কীভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৮-০৪-০১ দৈবী বিপত্তি পাঁচ ধরনের—(ক) অগ্নি (খ) বন্যা (গ) ব্যাধি (ঘ) দুর্ভিক্ষ এবং (ঙ) মহামারী। এ সমস্ত বিপত্তির মধ্যে অগ্নি ও বন্যার মধ্যে কোন বিপত্তি অধিক ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে আগুনের বিপত্তি অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, আগুন প্রতিকারহীন এবং সবকিছু পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। অন্যদিকে বন্যার বিপত্তিকালে নৌকা ব্যবহার করে তার প্রতিকার করা যায়।

নিজ আচার্য তথা শিক্ষকের উপরোক্ত অভিমত কৌটিল্য কর্তৃক সমর্থিত নয়। তার মতে—অগ্নির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট জনপদ বা জনপদের অংশ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে কিন্তু বন্যার প্রভাবে সমগ্র জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শত শত গ্রাম বন্যার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে স্থবির হয়ে পড়ে। যে কারণে তিনি মনে করেন, আগুন অপেক্ষা বন্যা অধিক ক্ষতিকারক।

০৮-০৪-০২ ব্যাধি ও দুর্ভিক্ষের প্রভাবের ক্ষেত্রে কৌটিল্যের আচার্যের অভিমত হলো—দুর্ভিক্ষ অপেক্ষা ব্যাধি অধিক পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক। কারণ, ব্যাধির কারণে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, উৎপাদন বিঘ্নিত হয়, এতে করে প্রজাদের কর পরিশোধের সমর্থতা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু দুর্ভিক্ষে মানুষের কর্মক্ষমতা বিনষ্ট হয় না, ফসলের পরিবর্তে প্রজারা নগদ অর্থে বা পশু প্রদানের মাধ্যমে কর পরিশোধ করতে পারে।

কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে বলেন—ব্যাধি দেশের বিশেষ এলাকায় বিপত্তির সৃষ্টি করে, তাছাড়া সঠিক চিকিৎসা ও ঔষধ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাধির প্রতিকার করা যায়। অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের কোপানলে নিপতিত হলে দেশের সমস্ত মানুষ ও প্রাণীর জীবন বিপদাপন্ন হয়। একইভাবে মহামারীতে ব্যাপক প্রাণহানির শঙ্কা থাকায় তা দুর্ভিক্ষের তুলনায় অধিক পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক।

০৮-০৪-০৩ সাধারণ কর্মকার ও মুখ্য প্রশাসকদের কৃত ক্ষতির প্রসঙ্গে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—সাধারণ রাজকর্মচারীদের কর্মদোষে বড় কাজের ক্ষতি না হলেও সাধারণ কাজ পণ্ড হয় এবং এতে করে সাধারণ লোকের ভোগান্তি বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে মুখ্য প্রশাসকদের কর্মদোষে ছোট কাজের তেমন ক্ষতি হয় না, সার্বিকভাবে ক্ষতিও সাধিত হয় অতি সামান্য। এক্ষেত্রে কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন, ছোট কর্মকরদের কৃত ক্ষতি অতি সহজেই অপরের সহায়তায় নিবারণ যোগ্য হয়ে থাকে। কিন্তু মুখ্যদের কৃতক্ষতি সহজে নিবারণযোগ্য নয়। কারণ, একজন মুখ্যের অধীনে সহস্রজন কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো মুখ্যের কর্মদোষে ক্ষতি সাধিত হলে তা ব্যাপক পরিসরে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, ফলে তা সহজে নিবারণ করা যায় না। এ কারণে, সাধারণ কারিকর বা কর্মচারীদের কর্মদোষে সাধিত ক্ষতি অপেক্ষা মুখ্য প্রশাসকদের কর্মদোষে সাধিত ক্ষতির বিস্তৃতি ও প্রভাব অনেক বেশি।

০৮-০৪-০৪ এ পর্যায়ে মানুষের সৃষ্ট পীড়ন সম্পর্কে আলোকপাত প্রাক্কালে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—শত্রু সেনা অপেক্ষা নিজ দেশীয় সেনারা দণ্ড প্রয়োগ এবং কর আদায়কালে জনগণের উপর অধিক অত্যাচার করে থাকে এবং তার কোনো প্রতিকার করাও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে পরদেশি সেনাদের অত্যাচার প্রতিযুদ্ধের মাধ্যমে বা শত্রু রাজার সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমে নিবারিত হতে পারে। কিন্তু দেশীয় সেনাদের নিবৃত্তকরণ কোনো তরিকায় সম্ভব হয় না।

উপরোক্ত প্রসঙ্গে কৌটিল্য তার আচার্যের অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—এক্ষেত্রে পীড়নকার্যে সহায়তাকারী অমাত্যদের শুভ চেতনার উদ্রেক বা পীড়নকারীদের হত্যার মাধ্যমে প্রজাপীড়ন রোধকরণ সম্ভব। এছাড়া স্বদেশের সেনারা সম্পদশালী সীমিত প্রদেশ বা জনপদে এ ধরনের অত্যাচার করে থাকে কিন্তু বিদেশি সেনারা সারা দেশজুড়ে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও জনপদ ধ্বংসের মাধ্যমে সাধারণ প্রজাদের অত্যাচার করে সারা দেশকে বিপদাপন্ন করে থাকে। এসব কারণে, স্বদেশি সৈন্য অপেক্ষা বিদেশি সৈন্যদের অত্যাচার বা পীড়ন অধিক কষ্টদায়ক বা ক্ষতিকর হয়ে থাকে।

০৮-০৪-০৫ অমাত্যবর্গের বা প্রজাদের বিবাদ এবং রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মধ্যে কোনটি অধিক ক্ষতিকারক বা বিপদজনক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অপেক্ষা অমাত্যবর্গের বিবাদ অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, অমাত্যদের বিবাদের কারণে প্রজাদের বিভাজন বৃদ্ধি পায় এবং বহিঃশত্রুরা আক্রমণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। অন্যদিকে রাজ পরিবারের দ্বন্দ্বের কারণে উপরোক্ত ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না, উপরোন্ত ক্ষমতাগ্রহণে অভিলিপ্সু রাজপুরুষ কর্তৃক অমাত্যদের প্রলুব্ধ করার জন্য দ্বিগুণ হারে খাদ্য, বেতন ও কর রেয়াতি সুবিধা প্রদান করা হয়, এতে করে অমাত্যরা উপকৃত হয়।

কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন না। তার মতে, প্রকৃতিবর্গের মুখ্যদের নিবৃতকরণ ও বিবাদের মূলোৎপাটন করে এ ধরনের বিবাদ নিষ্পন্ন করা যায়। এছাড়া অমাত্যরা পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পরোক্ষভাবে রাজা ও রাজ্যের কল্যাণ সাধন করে থাকে। কিন্তু রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে প্রজাদের হয়রানির শিকার হতে হয়, উচ্ছেদ হতে হয় এবং অমাত্যদের বিবাদ নিষ্পন্নের তুলনায় দ্বিগুণ খেসারত প্রদান করতে হয়। এসব কারণে অমাত্যবর্গের বিবাদ অপেক্ষা রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ বিবাদ অনেক বেশি ক্ষতিকারক।

০৮-০৪-০৬ রাজন্য এবং প্রজা সাধারণের আমোদ-প্রমোদ-ক্রীড়াদির ক্ষেত্রে কারটি অধিক ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—প্ৰজা সাধারণের আমোদ প্রমোদের কারণে অধিক ক্ষতিসাধিত হয়। কারণ, এর ফলে অতীতে সম্পাদিত, বর্তমানে করণীয় এবং ভবিষতে করণীয় কাজ তথা উৎপাদন ব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে রাজ বিহারের মাধ্যমে কারুশিল্পী, স্বর্ণকার, নাট্যাভিনেতা, কুশীলব, বাদক, স্তুতিপাঠক, বেশ্যা এবং সুগন্ধিমাল্য বিক্রেতারা উপকৃত হয়, তারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হয়ে থাকে।

কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন— প্রজা সাধারণ পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি দূরীকরণের অভিপ্রায়ে স্বল্পসময়ের জন্য আমোদ-প্রমোদ ক্রীড়াদিতে মত্ত হয় এবং চিত্ত বিনোদনের মাধ্যমে কর্মস্পৃহা অর্জন করে থাকে। এতে করে কারো ক্ষতিসাধিত হয় না। কিন্তু রাজবিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য জনপদের লোকদের কাছ থেকে ধন গ্রহণ করা হয়, বিশেষ কর গ্রহণ করা হয়, পানশালাতে অত্যধিক ব্যয় করা হয় এবং এ সমস্ত ব্যয়ের দায়ভার শেষ পর্যন্ত প্রজা সাধারণকেই বহন করতে হয়, এসব কারণে প্রজা সাধারণের বিহার অপেক্ষা রাজপরিবারের বিহার বা আমোদ, প্রমোদ ও ক্রীড়াদি রাজ্যের জন্য অধিক ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৪-০৭ সৌভাগ্যবতী রাজরানির বিহার এবং রাজকুমারের বিহারের মধ্যে কোনটি অধিক ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে রাজকুমারের বিহার অধিক পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে। কারণ, রাজকুমার তার দলবল নিয়ে বিহারে মত্ত হয় এবং এ ধরনের ব্যয় নির্বাহের জন্য জনসাধারণের উপর অধিক হারে করারোপ আবশ্যক হয়ে পড়ে, যা প্রকারান্তরে প্রজা সাধারণের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে থাকে। কিন্তু রাজরানির বিহারে সুগন্ধি ও মাল্য বাবদ যৎসামান্য ব্যয় আবশ্যক হয়, যে কারণে প্রজা সাধারণের উপর অধিক আর্থিক দায় চাপানোর প্রয়োজন পড়ে না।

উপরোক্ত অভিমত কৌটিল্য কর্তৃক সমর্থিত নয়। তার মতে—এক্ষেত্রে মন্ত্রী বা পুরোহিতের সহায়তায় রাজকুমারকে অধিক ব্যয়জনিত প্রজাপীড়ন থেকে নিবৃতকরণ সম্ভব। কিন্তু সৌভাগ্যবতী রাজরানিকে নারীত্ব ও মূর্খতার কারণে গায়ক-বাদক-কুশীলব খাতের ব্যয় হতে নিবৃতকরণ সম্ভব হয় না। যে কারণে রাজকুমারের বিহার অপেক্ষা রাজরানির আনন্দবিহার অধিক পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৪-০৮ দলবদ্ধ পীড়নকারী এবং একক (দলনেতা) পীড়নকারীর মধ্যে কোনটি অধিক পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে দলবদ্ধ পীড়নকারীদের পীড়ন-ই অধিক ক্ষতিকারক কারণ, সংখ্যায় অধিক হওয়ায় এ ধরনের পীড়নকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তি বা বলপূর্বক পরধন অপহরণের মাধ্যমে দলবদ্ধ পীড়নকারীরা প্রজা সাধারণকে উৎপীড়িত করে থাকে। কিন্তু একক পীড়নকারী উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে কার্যসম্পন্ন করে এবং উৎকোচ না পেলেও স্বল্পমাত্রায় পীড়ন করে।

কৌটিল্য উপরোক্ত মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—দলবদ্ধ পীড়নকারীদের গ্রেফতার করে বা তাদের নেতৃত্বকে বশীভূত করে সহজেই অপরাধ থেকে নিবৃত করা সম্ভব হয় কিন্তু নেতৃস্থানীয় একক পীড়নকারীকে সহজে নিবৃত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ ধরনের গর্বান্বিত ব্যক্তি অপরের জীবন ও সম্পদ হরণ করে থাকে। এ কারণে দলবদ্ধ পীড়নকারী অপেক্ষা নেতৃস্থানীয় একক পীড়নকারী অধিক পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে। (পীড়নকারী বলতে এখানে অত্যচারী বা শোষনকারীকে বোঝানো হয়েছে—লেখক )

০৮-০৪-০৯ সমাহর্তা তথা রাজস্ব আদায়কারী প্রশাসক এবং সন্নিধাতা তথা ভাণ্ডার অধীক্ষকের মধ্যে কে অধিক অত্যাচারী বা ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে সন্নিধাতার দ্বারা সংঘটিত উৎপীড়ন অধিক ক্ষতিকারক। কারণ, সন্নিধাতা প্রজাদের কাজের ত্রুটি সন্ধান করে শাস্তি বা জরিমানা আরোপের মাধ্যমে তাদের অত্যাচার করে থাকে। অন্যদিকে সমাহর্তার কর্ম পরিধি হিসাবরক্ষকদের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তাকে নিয়মিত বেতন গ্রহণ করেই তুষ্ট থাকতে হয়।

কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—সন্নিধাতা অন্যান্য রাজকর্মচারীদের প্রত্যয়ন সাপেক্ষে রাজভাণ্ডারের দ্রব্যসামগ্রী গ্রহণ করে থাকে। যে কারণে তার পক্ষে অন্যকে উৎপীড়ন করার সুযোগ খুব সীমিত। কিন্তু সমাহর্তা রাজস্ব সংগ্রহকালে নানাভাবে প্রজাদের উৎপীড়িত করতে পারে, উৎকোচ গ্রহণ করতে পারে, এমনকি রাজস্ব আত্মসাত্ত করতে পারে। এ সব কারণে সন্নিধাতা অপেক্ষা সমাহর্তা অধিক পীড়নকারী বা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৪-১০ বণিক এবং অন্তপাল তথা সীমান্ত রক্ষকের মধ্যে কে অধিক পীড়া উৎপাদক বা ক্ষতিকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে অন্তপালরা অধিক উৎপীড়ক, তাদের মাধ্যমেই অধিক ক্ষতি সাধিত হয়। কারণ, অন্তপালরা কিছু চোরকে চৌর্যকর্মে উৎসাহিত করে এবং বণিকদের কাছে অধিক হারে বর্তনী কর আদায় করে তাদের উৎপীড়িত করে। অন্যদিকে বণিকরা স্বদেশের পণ্যদ্রব্য বহির্দেশে বিক্রি করে এবং বিনিময়ে বিদেশি পণ্যদ্রব্য স্বদেশে আমদানি করে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বণিক পথের সমৃদ্ধি সাধন করে থাকে।

কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত যৌক্তিক বলে মনে করেন না। তার মতে—অন্তপালরা আনীত পণ্যদ্রব্যের উপর বর্তনী কর আদায়ের মাধ্যমে বণিক পথের উন্নতি বিধান করেন। কিন্তু বণিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে কমমূল্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে অধিকমূল্যে বিক্রি করে অস্বাভাবিক হারে মুনাফা অর্জন করে প্রজা সাধারণকে উৎপীড়িত করে থাকে। এসব কারণে অন্তপালদের তুলনায় বণিকরা অধিক উৎপীড়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৪-১১ অভিজাত ব্যক্তির মালিকানাধীন ভূমি এবং পশুচারণের জন্য সংরক্ষিত তৃণ ভূমির মধ্যে কোনটি অধিক প্রত্যাশিত, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে অভিজাত ব্যক্তির মালিকানাধীন ভূমি অধিক প্রত্যাশিত। ভূমির মালিক যদি এ ধরনের ভূমিতে উৎপাদিত শস্যে পালনকৃত সৈন্যদের রাজাকে সহায়তার জন্য নিয়োজিত করতে ইচ্ছুক থাকেন, তাহলে রাজা কখনো উক্ত প্রকৃতির ভূমি বাজেয়াপ্ত করবেন না। এতে করে রাজার বিপদকালে সৈন্য সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু পশুপালনের ভূমি যদি শস্য উৎপাদনের উপযোগী হয়ে থাকে, তাহলে রাজা তা বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। কৌটিল্য উপরোক্ত যুক্তির সঙ্গে একমত নন। তার মতে—অভিজাত ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমির মাধ্যমে প্রভূত সেনা সরবরাহ সম্ভব হলেও উক্ত প্রকৃতির ভূমি রাজা কর্তৃক বাজেয়াপ্তযোগ্য। তা না হলে উক্ত ভূমি অন্য অভিজাত কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাজার জন্য বিপত্তির কারণ হতে পারে। অন্যদিকে পশুচারণ ভূমির মাধ্যমে রাজা পশু, দুগ্ধ, পশুজাত সম্পদের যোগান পেয়ে থাকেন যা তার রাজকোষ সমৃদ্ধির সহায়ক, এ কারণে উক্তরূপ ভূমি রাজা কর্তৃক বাজেয়াপ্ত না করাই সমীচীন। ক্ষেত্র বিশেষে এ ধরনের ভূমি যদি পার্শ্ববর্তী ভূমিতে শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বলে বিবেচিত হয় তাহলে তা বাজেয়াপ্তযোগ্য হতে পারে।

০৮-০৪-১২ বনচারী এবং দস্যুদের উৎপীড়নের ক্ষেত্রে দস্যুরাই অধিক উৎপীড়ক বলে কৌটিল্যের আচার্য মনে করেন। এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন— দস্যুরা রাত্রে দস্যুতা করে, দিবালোকে নিজেদের আড়াল করে রাখে। তারা গোপনস্থানে অবস্থান করে অসহায় ব্যক্তিদের আক্রমণ করে হাজার পণ ছিনিয়ে নেয়, তারা সব সময় বিপত্তির সৃষ্টি করে, প্রশাসকদের উৎকণ্ঠিত করে রাখে এবং রাজ্যের মুখ্যদের হত্যা করে। কিন্তু বনচারীরা জনপদ থেকে বহুদূরের প্রান্ত দেশে সর্দারের অধীনে অবস্থান করে সীমিত পরিসরে অপকর্মে লিপ্ত থাকে। তারা সকলের পরিচিত পরিমণ্ডলে অবস্থান করে। সকলের সম্মুখে চলাফেরা করে। এসব কারণে বনচারী অপেক্ষা দস্যুরা অধিক উৎপীড়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে কৌটিল্যের অবস্থান উপরোক্ত মতের বিপক্ষে। তার মতে—দস্যুরা স্বল্প সংখ্যক ধনবানের ধন লুণ্ঠন করে থাকে। তারা দুর্বল প্রকৃতির হয় এবং সংখ্যা স্বল্পতার কারণে অতিসহজে গ্রেফতারও হয়ে থাকে। কিন্তু বনচারীরা নিজ অবস্থান এলাকায় অত্যন্ত বলবান হিসেবে বসবাস করে, সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের সহজে আটকও করা যায় না। তারা স্বীয় শক্তিবলে শত্রু দেশের মতো আচরণ করে, রাজার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং প্রজা সাধারণের ধন-প্রাণ অপহরণ করে। এসব কারণে দস্যুদের চেয়ে বনচারী তথা আটবিকরা অধিক উৎপীড়ক এবং ক্ষতিকারক।

০৮-০৪-১৩ মৃগবন ও হস্তি বনের তুলনায়, হস্তিবন অধিক উৎপীড়ক এবং ক্ষতিকারক। কারণ, হস্তির তুলনায় মৃগরা সংখ্যায় অধিক, যে কারণে তাদের মাধ্যমে প্রচুর মাংস ও চামড়া পেয়ে প্রজা সাধারণ উপকৃত হয়, তারা স্বল্পাহারী এবং সহজেই শিকারযোগ্য। অন্যদিকে হস্তিবনের ক্ষেত্রে এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হয়। হস্তিরা সংখ্যায় অল্প, যে কারণে এদের থেকে অল্প মাংস ও চামড়া পেয়ে প্রজা সাধারণ কিঞ্চিৎ উপকৃত হয়, অধিকন্তু এরা প্রচুর খাদ্যগ্রহণ করে বিপত্তির সৃষ্টি করে এবং দুর্দান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে। এমন কি ধৃত হস্তিরা বেয়াড়া হলে অনেক সময় সাধারণ মানুষকেও হত্যা করে থাকে।

নিজ রাজ্যের ‘স্থানীয়’ (আটশত গ্রামের প্রশাসনিক কেন্দ্র) নামক মফস্বল শহর এবং পররাজ্যের স্থানীয়ের মধ্যে রাজা কর্তৃক প্রথমটির পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে তা অধিক ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। কারণ, এতে করে নগরে ধান, চাল, গবাদি পশু, বনজ দ্রব্যসহ নানাবিধ পণ্যদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়, যার ফলে প্রকারান্তরে নগরের লোকেরা সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে এবং দুর্ভিক্ষ ও আপতকালে এই সমৃদ্ধি তাদের জন্য জীবনধারণের সহায়ক হয়। অন্যদিকে রাজা কর্তৃক পররাজ্যের স্থানীয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে এর বৈপরীত্য ঘটে। এক্ষেত্রে অন্যের (শত্রুর) সমৃদ্ধি রাজার জন্য পীড়াদায়ক বা প্রকারান্তরে ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

০৮-০৪-১৪ রাজার কোষ প্রাপ্তি কীভাবে বিঘ্নিত হতে পারে, সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দু-ভাবে রাজার কোষ প্রাপ্তি বিঘ্নিত হতে পারে। এর একটি হলো আভ্যন্তরীণ বিঘ্ন যা মুখ্য প্রশাসকদের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হয় এবং অপরটি হলো বাহ্য বিঘ্ন যা অমিত্র ও আটবিকদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে কোষ উৎপীড়িত হলে বা বাধাগ্রস্ত হলে রাজকোষে কাঙ্ক্ষিত সম্পদ সঞ্চিত হয় না। রাজার আর্থিক অনটন বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও রাজার অমাত্যরা যদি সংগৃহীত কর ঠিকমতো জমা প্রদান না করে আত্মসাৎ করে, সংগ্রহীতব্য করের ক্ষেত্রে যদি ছাড় প্রদান করা হয়, সংগৃহীত কর যদি বিক্ষিপ্ত প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত হয়, আদায়যোগ্য কর যদি কম হারে আদায় করা হয় এবং আটবিক ও পার্শ্ববতী সামন্ত নৃপতি কর্তৃক যদি রাজসম্পদ অপহৃত হয়, তাহলেও কোষসঙ্গ তথা কোষের সংকট দেখা দিতে পারে।

০৮-০৪-১৫ স্বদেশের সমৃদ্ধির স্বার্থে রাজা উপরোক্ত পীড়নসমূহ নিবৃতকরণে সচেষ্ট থাকবেন এবং ইতিমধ্যে যেসব ক্ষেত্র উৎপীড়িত বলে বিবেচিত হবে, তার মূলোৎপাটন করবেন। একই সাথে তিনি কোষবৃদ্ধির ব্যাপারে যত্নবান হবেন এবং এ সংক্রান্ত বাধা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ১৩৩-১৩৪ প্রকরণ

এই অধ্যায়ে সেনাবাহিনী এবং মিত্রদের ব্যসন তথা দোষ বা বিপত্তি সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও কোন পরিস্থিতিতে বা কি কারণে সৈনিকরা যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হয়ে থাকে, কখন অনিচ্ছুক সৈন্যরা যুদ্ধ করতে সম্মত হয়, কোন প্রকৃতির মিত্রদের অনেক কসরত করে অনুকূলিত করতে হয়, কোন প্রকৃতির মিত্ররা সহজে বশযোগ্য, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৮-০৫-০১ সৈনিকরা—১. প্রাপ্য সম্মান হতে বঞ্চিত হলে বা অপমানিত হলে ২. তিরস্কৃত হলে ৩. সময়মতো বেতন না পেলে ৪. ব্যাধিগ্রস্ত হলে ৫. সৈন্যদলে সদ্য নিয়োজিত হলে ৬. দূরদেশ হতে আগত হলে ৭. পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লে ৮. শক্তিহীন হয়ে পড়লে ৯. যুদ্ধক্ষেত্র হতে বিতাড়িত হলে ১০. প্রথমযুদ্ধে বিপর্যস্ত হলে ১১. অসময়ে যুদ্ধযাত্রা করে বিপর্যস্ত হলে ১২. প্রতিকূল ভূমিতে যুদ্ধে লিপ্ত হলে ১৩. আশাহত হলে ১৪. নেতৃত্বহীন হয়ে পরিত্যক্ত হলে ১৫. সৈন্যদলে নারীর উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হলে ১৬. বিশ্বাসঘাতকতার প্রবণতা উদ্ভূত হলে ১৭. সৈন্যদলের মূল অংশ বিদ্রোহী ভাবাপন্ন হলে ১৮. দলগতভাবে বিভাজিত হলে ১৯. পরাজিত হয়ে পলায়িত হলে ২০. বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান করলে ২১. শত্রু সেনাদের সন্নিকটে শিবির স্থাপন করলে ২২. অন্য সৈন্যদলে আত্মীকৃত হলে ২৩. একদিক দিয়ে অবরুদ্ধ হলে ২৪. চারিদিক দিয়ে অবরুদ্ধ হলে ২৫. খাদ্যশস্যের সংকটে নিপতিত হলে ২৬. তেল ঘি জাতীয় ভোগ্যদ্রব্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে ২৭. নিজ ভূমি হতে বিচ্ছিন্ন হলে ২৮. মিত্র ভূমিতে বিচ্ছিন্ন হলে ২৯. বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা চালিত হলে ৩০. অবস্থান স্থলের পশ্চাদভাগ শত্রুযুক্ত হলে ৩১. সৈন্যদলের কেন্দ্রভূমি দুর্বল হলে ৩২. সেনাদল রাজা বা অধিনায়কহীন হলে ৩৩. অধিনায়ক বিনষ্ট হলে এবং ৩৪. অধিনায়ক বা যুদ্ধের নির্দেশনা দানকারী উপদেষ্টা শত্রু সম্পর্কে অজ্ঞ হলে, এই চৌত্রিশটি কারণে দায়িত্বপালন তথা যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হতে পারে বা রাজার জন্য প্রতিকূল হিসেবে প্রতিভাত হতে পারে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে বিপত্তিগ্রস্ত বা দোষযুক্ত সৈন্যরা রাজার হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সম্মত হতে পারে।

০৮-০৫-০২ অসম্মানিত এবং তিরস্কৃত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, অসম্মানিত সৈন্যদের পরবর্তী সময়ে অর্থ ও মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করা হলে তারা রাজার পক্ষে যুদ্ধ করতে সম্মত হয়। কিন্তু তিরস্কৃত সৈন্যরা হৃদয়ে পোষণকৃত ক্ষোভজনিত কারণে কখনো যুদ্ধে যেতে সম্মত হয় না।

বেতন অপ্রাপ্ত এবং ব্যাধিগ্রস্ত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, বেতন অপ্রাপ্ত সৈনিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হলে তারা যুদ্ধে যেত সম্মত হয়ে থাকে কিন্তু ব্যধিগ্রস্ত সৈন্যরা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ায় যুদ্ধে যেতে পারে না।

সৈন্যদলে সদ্য যোগদানকারী এবং দূরদেশ হতে আগত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, সদ্যযোগদানকারী সৈন্যরা পুরোনো অভিজ্ঞ সৈনিকদের কাছে দেশের অবস্থা, যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে অভিজ্ঞ সৈনিকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধে যোগদান করতে পারে কিন্তু দূরদেশ হতে আগত সৈন্যরা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আগমনজনিত কারণে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে, ফলে যুদ্ধে যেতে পারে না।

০৮-০৫-০৩ পরিশ্রান্ত এবং শক্তিহীন সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্ৰাক্কালে দেখা যায়, স্নান, ভোজন, নিদ্রা এবং বিশ্রামের মাধ্যমে পরিশ্রান্ত সৈনিকের ব্যাধিজনিত, অনাহারজনিত বা যাতায়াতজনিত ক্লান্তি দূরীভূত করা হলে তারা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়। কিন্তু অন্যত্র যুদ্ধ করার পর যে যোদ্ধা শক্তিহীন হয়ে পড়ে, সে আর নতুন করে যুদ্ধে জড়াতে চায় না।

যুদ্ধে বিতাড়িত তথা প্রতিহত এবং প্রথমযুদ্ধে বিপর্যস্ত তথা হতাগ্রবেগ সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, যুদ্ধের শুরুতেই ছত্রভঙ্গ বা বিতাড়িত হওয়ার পরও এ ধরনের সৈন্যরা যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধ করতে সম্মত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথম যুদ্ধেই যে সৈন্যরা সেনাপতির মৃত্যুজনিত কারণে বা অন্যকোন কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তারা পুনর্বার যুদ্ধে সামিল হতে উৎসাহী হয় না।

অসময়ে যুদ্ধে যাত্রাকারী বা অনৃতপ্রাপ্ত এবং প্রতিকূল ভূমিতে যুদ্ধে যোগদানকারী বা অভূমিপ্রাপ্ত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, অসময়ে যুদ্ধে যাত্রাকারী বিপর্যস্ত সৈনিককে পশু, অস্ত্র, কবচ দিয়ে সহায়তা করা হলে পুনর্বার সে উপযুক্ত সময়ে যুদ্ধে যাত্রা করতে সম্মত হয়। কিন্তু অভূমিপ্রাপ্ত সৈনিকরা যুদ্ধের অনুকূল ভূমির অভাব হেতু যুদ্ধ করতে পারে না।

০৮-০৫-০৪ আশাহত তথা আশানির্বেদী এবং নেতৃত্বহীন তথা পরিসৃত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, আশাহত সৈনিকদের প্রত্যাশিত প্রত্যাশা যদি পূরণ করা হয়, তাহলে তারা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়ে থাকে। কিন্তু সেনাপতির অধিনায়কত্ব ব্যতিরেকে সৈন্যরা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয় না।

নারীর উপস্থিতি সম্পৃক্ত সেনাদল তথা কলত্রগর্ভী এবং বিশ্বাসঘাতকতার প্রবণতাসম্পন্ন সেনা তথা অন্তঃশল্য সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, নারীর আসক্তি হতে বিমুক্ত করণার্থে সেনাদল হতে নারীদের দূরীভূত করা হলে প্রথমোক্ত প্রকৃতির সৈন্যরা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা প্রভাবিত সৈন্যরা উৎপীড়িত হওয়ার ভয়ে কখনো যুদ্ধে যেতে সাহস প্ৰদৰ্শন করে না।

সৈন্যদলের মূল অংশ বিদ্রোহী ভাবাপন্ন তথা কুপিতমূল এবং দলগতভাবে বিভাজিত তথা ভিন্নগর্ভ সৈন্যদের দোষ পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, বিদ্ৰোহী ভাবাপন্ন সৈন্যদের ক্ষোভ সামদানের মাধ্যমে প্রশমিত করা হলে তারা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়ে থাকে। কিন্তু দলগতভাবে বিভাজিত বা ভেদপ্রাপ্ত সৈন্যরা যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক হয় না।

০৮-০৫-০৫ পরাজিত হয়ে পলায়িত তথা অপসৃত এবং বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানরত তথা অতিক্ষিপ্ত সৈন্যদের দোষ পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, পলায়িত হয়ে অন্য রাজ্যে আশ্রয়গ্রহণ করে নিগৃহীত হলেও মিত্র রাজার অধীনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এ ধরনের সৈন্যরা যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়ে থাকে। কিন্তু বহুস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৈন্যরা বহুভাবে পীড়ন অনুভব করার কারণে যুদ্ধে যেতে সম্মত হয় না।

শত্রু সেনাদের সন্নিকটে শিবির স্থাপনকারী তথা উপনিবিষ্ট এবং অন্য সৈন্যদলে আত্মীকৃত তথা সমাপ্ত সৈন্যদের দোষ পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, শত্রু সেনাদের সন্নিকটে শিবির স্থাপনকারী সৈনিকরা নিজেদের যান এবং স্থান অবলম্বন করে শত্রুদের প্রতারিত করে যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়। কিন্তু অন্যদলে আত্মীকৃতরা যান ও স্থান অবলম্বন করতে সমর্থ হয় না বলে যুদ্ধে যেতে পারেন না।

এক দিক দিয়ে অবরুদ্ধ তথা উপরুদ্ধ এবং চারিদিক দিয়ে অবরুদ্ধ তথা পরিক্ষিপ্ত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, এক দিক দিয়ে অবরুদ্ধ সৈন্যরা অন্যদিক দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু চারিদিক দিয়ে অবরুদ্ধ সৈন্যরা কোন উপায়ে বের হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয় না।

০৮-০৫-০৬ খাদ্যশস্যের সরবরাহ বিঘ্নিত তথা ছিন্নধান্য এবং তেল ঘি জাতীয় ভোগ্যদ্রব্যের সরবরাহ বিঘ্নিত তথা ছিন্নপুরুষবীবধ সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, প্রথমোক্তরা খাদ্য-শস্যের সরবরাহে বিঘ্নতা সত্ত্বেও অন্য রাজ্য থেকে খাদ্য-শস্য আমদানি করে, পশু শিকার করে, বৃক্ষের ফলমূল আহার করে খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয়োক্তরা ভোগ্য দ্রব্যের সরবরাহে বিঘ্নতাজনিত কারণে অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়ে যুদ্ধের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

নিজ ভূমিতে বিচ্ছিন্ন তথা স্ববিক্ষিপ্ত এবং মিত্র ভূমিতে বিচ্ছিন্ন তথা মিত্রবিক্ষিপ্ত সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, নিজভূমিতে বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত সৈন্যদের কোনো-না-কোনোভাবে সমবেত করা সম্ভব হয়, ফলে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দূরবর্তী দেশে মিত্রকে সহায়তার নিমিত্ত মিত্রভূমির বিভিন্নস্থানে পদায়িত সৈন্যদের সহজে একত্রিত করা সম্ভব হয় না, ফলে তারা যুদ্ধে যোগদান করতে পারে না।

বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা চালিত দুষ্যযুক্ত এবং অবস্থান স্থলের পশ্চাদভাগ শত্রুযুক্ত দুষ্টুপাগ্ৰিাহ সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, প্রথমোক্তরা বিশ্বস্ত অমাত্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুষ্যচক্র ভেদ করে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। কিন্তু পেছনে শত্রু সেনাদের উপস্থিতিযুক্ত সৈন্যরা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হবার ভয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হতে ইচ্ছুক হয় না।

০৮-০৫-০৭ কেন্দ্রভূমির দুর্বলতা তথা শূন্যমূল এবং নেতৃত্বহীন সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, অন্যত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থাকার কারণে কেন্দ্রভূমি বা রাজধানীতে কোনো সৈন্যের উপস্থিতি না থাকলেও নগরের লোকজন তাদের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে রাজার হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে কিন্তু নেতৃত্বহীন সৈন্যরা কখনো নিজ দায়িত্বে যুদ্ধ করতে উৎসাহী হয় না।

বিনষ্ট অধিনায়ক তথা ভিন্নকূট এবং শত্রু সম্পর্কে অজ্ঞ সেনা নেতৃত্বাধীন তথা অন্ধ সৈন্যদের বিপত্তি পর্যালোচনা প্রাক্কালে দেখা যায়, বিনষ্ট সেনাধিনায়কের পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে বিশুদ্ধ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হলে অধীনস্ত সৈন্যরা যুদ্ধ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে কিন্তু শত্রু সম্পর্কে অজ্ঞ সেনা উপদেষ্টা বা অধিনায়কের অধীনে সৈন্যরা যুদ্ধ করতে উৎসাহী হয় না। এভাবে উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে রাজা তার সৈন্যদের বিপত্তি নিষ্পত্তিতে সচেষ্ট হবেন, শত্রুর কবল থেকে তাদের রক্ষা করবেন, প্রয়োজনে নতুন সৈন্য নিয়োগ করবেন, কূটকৌশল অবলম্বন করবেন এবং শত্রুপক্ষের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন।

০৮-০৫-০৮ এ পর্যায়ে সম্পর্কচ্যুত বিদ্বেষভাবাপন্ন মিত্রদের স্বপক্ষে আনয়নের বিষয়ে আলোকপাত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, নিম্নোক্ত কারণে বিদ্বেষভাবাপন্ন মিত্রদের অতিকষ্টে, ক্লেশ স্বীকার করে স্বপক্ষভুক্ত করতে রাজাকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়।

১. যে মিত্র নিজের স্বার্থে, অন্যদলের স্বার্থে অথবা অন্য কোনো মিত্রের স্বার্থে শত্রুপক্ষে যোগদান করেন। যে মিত্র শক্তিহীনতার কারণে, শত্রুর কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণের লোভজনিত কারণে, রাজার দোষের কারণে অথবা শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে রাজা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে থাকেন, সেসব মিত্রকে স্বপক্ষভুক্ত করণার্থে রাজাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয় বা ক্লেশ স্বীকার করতে হয়।

২. রাজার কোনো শত্রুর সঙ্গে কোনো মিত্রের যুদ্ধকালে রাজা যদি উক্ত মিত্রের প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত না করে নিজেকে গুটিয়ে রেখে উক্ত মিত্রকে বিপর্যস্ত করেন বা পরাজিত হতে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেন এবং কোনো মিত্ৰ যদি দ্বৈতনীতি অবলম্বনের কারণে পরিত্যক্ত হয়ে রাজার প্রতি বিরূপ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজাকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে এরূপ মিত্রদের অনুকূলিত করতে হয়।

৩. শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েও রাজা যদি শর্ত ভঙ্গ করে মিত্রের শত্রুকে প্রচ্ছন্নভাবে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মিত্রকে বঞ্চিত করেন বা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন অথবা কোনো মিত্র যদি রাজা কর্তৃক উপেক্ষিত হন, বিপত্তিতে নিপতিত হয়ে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও রাজা কর্তৃক সুরক্ষিত বা উদ্ধার লাভ করতে ব্যর্থ হন এবং এসব কারণে রাজার প্রতি বিরূপ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজাকে অনেক ক্লেশ স্বীকার করে এ ধরনের মিত্রকে অনুকূলিত বা আয়ত্তাধীন করতে হয়।

৪. মিত্র যদি স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস গ্রহণকালে রাজা কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন অথবা রাজা কর্তৃক নিহত বা আটক হবার আশঙ্কায় দূরবর্তী ভূমিতে নির্বাসিত হন অথবা তার ধন-সম্পদ যদি রাজা কর্তৃক বলপূর্বক অপহৃত হয় অথবা দাতব্য দ্রব্য প্রদান সত্ত্বেও তিনি যদি অপমানিত হন এবং ইত্যাকার কারণে রাজার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজাকে যথেষ্ট ক্লেশ স্বীকার করে উপরোক্ত প্রকৃতির মিত্রকে অনুকূলিত বা আয়ত্তাধীন করতে হয়।

৫. কোনো মিত্রের ধন-সম্পদ যদি রাজা বা রাজার প্ররোচণায় অন্য কারো দ্বারা অপহৃত হয় অথবা কোনো মিত্র যদি রাজা কর্তৃক কোনো ক্লেশদায়ক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে হতোদ্যম হয়ে রাজার প্রতি বিরূপতা পোষণ করে শত্রুপক্ষে যোগদান করেন, সেক্ষেত্রে রাজাকে অনেক কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপরোক্ত ধরনের মিত্রকে অনুকূলিত বা আয়ত্তাধীন করতে হয়।

৬. কোনো মিত্র যদি নিজের অসমর্থতাজনিত কারণে রাজা কর্তৃক উপেক্ষিত হন অথবা উপেক্ষিত হয়েও আনুকূল্য প্রার্থনা সত্ত্বেও যদি রাজা কর্তৃক বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে উক্ত প্রকৃতির মিত্রকে অনুকূলিত বা আয়ত্তাধীন করতে হয়। তদুপরি উপরোক্ত প্রকৃতির মিত্ররা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বা উপায়ে রাজার দ্বারা অনুকূলিত হলেও অতি সহসা তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন।

০৮-০৫-০৯ সহজে বশযোগ্য মিত্র সম্পর্কিত বিষয়—

১. যে মিত্র শ্রমসাধ্য যুদ্ধে সহায়তা প্রদান সত্ত্বেও প্রমাদবশত রাজা কর্তৃক যথাযতভাবে সমাদৃত হন না অথবা যে মিত্র রাজার সহায়ক হয়েও নিজের অবদানের স্বীকৃত লাভে ব্যর্থ হন অথবা যে মিত্র রাজার প্রতি ভক্তিজনিত কারণে শত্রু কর্তৃক নিগৃহীত হন অথবা যে মিত্র রাজা কর্তৃক অন্য মিত্রের প্রতি উৎপীড়ন দেখে সন্ত্রস্ত হন অথবা যে মিত্র রাজার প্রেরিত গুপ্তচরদের মাধ্যমে ভেদপ্রাপ্ত হন, এরা সকলেই খুব সহজে রাজা কর্তৃক অনুকূলিত হন বা রাজার আয়ত্তাধীন হয়ে থাকেন। এ ধরনের অনুকূলিত বা বশীভূত মিত্ররা কখনো মিত্রচ্যুত হন না

২. এসব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে রাজা কখনো মিত্রদের বিপত্তি বা দোষ উৎপাদনের মতো কোনোকিছু করবেন না। মিত্রদের মধ্যে কোনো কারণে এ ধরনের বিপত্তির উন্মেষ হলে রাজা নিজ দক্ষতায় তা প্রশমনের জন্য সচেষ্ট হবেন এবং তার প্রতিকার করবেন।

৩. রাজার কারণে অমাত্য প্রকৃতিতে যে সমস্ত বিপত্তি বা দোষ উদ্ভূত হবে, সূচনাতেই তিনি সে সবের মুলোৎপাটন করবেন এবং এসব বিষয়ে তিনি সব সময়ের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করবেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন