নবম অধিকরণ (যুদ্ধাভিযান)

নবম অধিকরণ। প্রকরণ ১৩৫-১৪৬।

অভিযাসকর্ম (অভিযান পরিচালনাকারীর বিবেচ্য বিষয়) নামক নবম অধিকরণের বারোটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—

১. শক্তি, দেশ ও কালের সক্ষমতা সম্পর্কিত জ্ঞান ২. যুদ্ধভিযানের সময় নির্ধারণ ৩. সৈন্য সমাবেশের আবশ্যকতা ৪. সমর্থতার নিরিখে অভিযানের প্রস্তুতি ৫. শত্রু সৈন্যদের পরাভূত করণের উপযোগী নিজ বাহিনী গঠন ৬. পশ্চাদে অবস্থানকারী শত্রু কর্তৃক আক্রান্তের বিষয়ে চিন্তন ৭. অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিবর্গ কর্তৃক উদ্ভূত বিদ্রোহের প্রতিকার ৮. যুদ্ধাভিযানের লাভ, ক্ষতি ও ব্যয়ের মূল্যায়ন ৯. রাষ্ট্রমুখ্য, অন্তপাল ও অমাত্য-পুরোহিত কর্তৃক উত্থিত বিপত্তির স্বরূপ নির্ণয় ও এর প্রতিবিধান ১০. বিশ্বাসঘাতক ও রাজদ্রোহীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং তার প্রতিবিধান ১১. সম্পদ ও শারীরিক বিপত্তি নিষ্পত্তির উপায় অবলম্বন ১২. উদ্ভূত বিপত্তিসমূহ নিষ্পত্তি তথা নিবারণকল্পে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ

প্রথম অধ্যায় ॥ ১৩৫-১৩৬ প্রকরণ ॥

নবম অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ে যুদ্ধারম্ভের প্রাক্কালে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার যুদ্ধের প্রস্তুতি, সাবধানতা, শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়া এ পর্যায়ে উৎসাহশক্তি, প্রভাবশক্তি ও মন্ত্রশক্তির মধ্যে কোনটি অধিক কার্যকর হবে, কোন ঋতুতে কোন প্রকৃতির অভিযান যুক্তিযুক্ত হবে, যুদ্ধের অনুকূল সময় কখন, কখন কোন প্রকৃতির বাহিনী নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, ইত্যাকার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৯-০১-০১ রাজা নিজের ও শত্রুর সমর সক্ষমতা এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কিত বিস্তারিত বিষয় পর্যালোচনাপূর্বক যুদ্ধাভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তিনি যুদ্ধে যাবার পূর্বে নিজের এবং শত্রুর সমর প্রস্তুতি, সমর সক্ষমতা, আক্রমণীয় রাজ্যের ভূ প্রকৃতি, যুদ্ধকালীন ঋতুর বৈশিষ্ট্য, অভিযানের সহায়ক সময়, সৈন্য সমর্থতা, সৈন্যদের যোগ্যতা-দক্ষতা, পশ্চাদভূমি থেকে প্রতি আক্রমণের সম্ভাবনা, সৈন্য ও সম্পদ ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাণ, অর্জনের পরিমাণ, সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ, সম্ভাব্য ঝুঁকিগত দিকসহ যুদ্ধ সম্পৃক্ত সকল বিষয়ের অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করবেন। অতঃপর যুদ্ধাভিযান তার জন্য লাভজনক বলে বিবেচিত হলে শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হবেন এবং এর বৈপরীত্য প্রতীয়মান হলে তিনি যুদ্ধ হতে বিরত থাকবেন।

০৯-০১-০২ এ পর্যায়ে উৎসাহশক্তি তথা সাহস, শক্তি ও অরোগ্যতা, প্রভাবশক্তি তথা অর্থ ও সেনা সক্ষমতা এবং মন্ত্রশক্তি তথা মন্ত্রণার উৎকর্ষ ও বিবেচনাবোধ সম্পর্কে আলাচনা প্রাক্কালে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—প্রভাবশক্তি অপেক্ষা উৎসাহশক্তি অধিকতর যুদ্ধ সহায়ক। কারণ, রাজা নিজে সাহসী, বলবান, অরোগ্য এবং অস্ত্রচালনায় পারদর্শী হলে অন্যের সহায়তা ব্যতিরেকে উৎসাহশক্তির মাধ্যমে অর্থ ও সেনাবাহিনীর দিক দিয়ে শক্তিশালী শত্রুকে পরাভূত করতে সক্ষম হতে পারেন। অধিকন্তু উৎসাহশক্তিসম্পন্ন রাজা স্বল্প সৈন্য নিয়েও নিজের বিক্রমবলে জয়ী হতে সক্ষম হন। কিন্তু প্রভাবশক্তিসম্পন্ন রাজা যদি উৎসাহশক্তি রহিত হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি আর্থিক ও সেনা সক্ষমতায় বলবান হওয়া সত্ত্বেও সহজেই বিপর্যস্ত হয়ে বিনাশপ্রাপ্ত হন।

০৯-০১-০৩ এক্ষেত্রে কৌটিল্য কর্তৃক তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত সমর্থিত নয়। তিনি মনে করেন—প্রভাবশক্তিসম্পন্ন রাজা তার প্রভাবের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট প্রকৃতির অন্য রাজাকে নিজপক্ষভুক্ত করে সহায়তা গ্রহণ করতে পারেন, অর্থ দিয়ে বলবান যোদ্ধাদের বশীভূত করতে পারেন এবং অর্থ সম্পদের মাধ্যমে উৎসাহশক্তি সম্পন্ন রাজাদের অতিক্রম করতে পারেন। এছাড়া এ ধরনের প্রভাবশক্তিসম্পন্ন রাজারা হস্তি, অশ্ব, রথ এবং অন্যান্য সামরিক উপকরণের দিক দিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিচরণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে কোনো নারী, নাবালক, পঙ্গু বা অন্ধ রাজাও রাজত্ব পরিচালনাকালে শুধু অর্থের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উৎসাহশক্তি সম্পন্ন যোদ্ধাদের ব্যবহার করে যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়ে থাকেন।

০৯-০১-০৪ প্রভাবশক্তি এবং মন্ত্রশক্তির মধ্যে প্রভাবশক্তি-ই অধিক প্রত্যাশিত, এমনটা মনে করেন কৌটিল্যের আচার্য। তার মতে–মন্ত্রশক্তিতে উৎকৃষ্ট হয়েও রাজা যদি প্রভাবশক্তি তথা অর্থ ও সেনা সক্ষমতার দিক দিয়ে দুর্বল হন, তাহলে তিনি অসার বৃদ্ধিসম্পন্ন হয়ে পড়েন, বৃষ্টিহীনতা যেমন প্রোথিত ধানের বীজ বিনষ্ট করে দেয় তেমনি প্রভাবশক্তির অভাব হেতু মন্ত্রণার উকর্ষতাও বিনষ্ট তথা অসার বলে প্রতিপন্ন হয়।

০৯-০১-০৫ নিজ আচার্যের উপরোক্ত মতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কৌটিল্য বলেন—প্রভাবশক্তি অপেক্ষা মন্ত্রশক্তি (পরামর্শ বিষয়ক প্রজ্ঞা) অধিক কার্যকর। কারণ, প্রজ্ঞা হলো শাস্ত্রের (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) চক্ষুস্বরূপ। মন্ত্রশক্তির মাধ্যমে রাজা অল্প পরিশ্রমে প্রভাবশক্তিসম্পন্ন কাজ সম্পাদনে সমর্থ হয়ে থাকেন, এছাড়া মন্ত্রশক্তিসম্পন্ন রাজন্যরা উৎসাহ ও প্রভাবশক্তি সম্পন্ন রাজাদের সাম’র মাধ্যমে যেমন বশীভূত করতে পারে তেমনি গুপ্তচরদের দিয়ে বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কার্য পরিচালনার মাধ্যমে উৎপীড়িত করতে পারেন। এভাবে মন্ত্রশক্তিসম্পন্ন রাজা উপরোক্ত দু প্রকৃতির শক্তিসম্পন্ন রাজাদের মন্ত্রশক্তি তথা প্রজ্ঞাবলে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়ে থাকেন।

০৯-০১-০৬ এ পর্যায়ে দেশ সম্পর্কে আলোচনা প্রাক্কালে দেশ বলতে ধরিত্রীকে বোঝানো হয়েছে এবং ধরিত্রী বলতে ভারতবর্ষকে বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে তীর্যকভাবে পূর্ব পশ্চিমের এক হাজার যোজন বিস্তৃতিসহ উত্তরের হিমালয় হতে দক্ষিণের সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডকে বলা হয়েছে চক্রবর্তীক্ষেত্র। এই সীমানায় চক্রবর্তী বা সার্বভৌম রাজার অখণ্ড শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় বলে এই ভূখণ্ডকে এ নামে অভিহিত করা হয়েছে। অরণ্যভূমি, জলাভূমি, পাহাড়িভূমি, সমতলভূমি, বন্ধুরভূমি, স্থলভূমিসহ সকল প্রকৃতির ভূমি এই সার্বভৌম ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

এ সমস্ত বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে রাজা যেন তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সে প্রত্যয়েই তিনি শত্রুদের পরাস্ত করবেন। এসব ভূখণ্ডের যে এলাকা সৈন্যদের জন্য কৌশলগত আক্রমণের দিক দিয়ে অনুকূল বলে প্রতিভাত, সে এলাকা উত্তম দেশ, এর বিপরীত ভূমি অধম দেশ এবং যেসব এলাকা শত্রু মিত্ৰ উভয়ের সৈন্যদের কাছে কৌশলগত আক্রমণের দিক দিয়ে সমভাবে সুবিধা ও অসুবিধাজনক বলে প্রতিভাত, তা মধ্যম দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

০৯-০১-০৭ এ পর্যায়ে বিভাজনকালে কালকে—শীত (পৌষ, মাঘ), গ্রীষ্ম (বৈশাখ, জ্যেষ্ঠ) ও বর্ষা (আষাঢ়, শ্রাবণ), এই তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এছাড়া কালের বিশেষ বিশেষ বিভাজন হলো—দিন, রাত্রি, পক্ষ, মাস, ঋতু (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত), অয়ন (ছয় মাস, বছরের ছয় মাস উত্তরায়ণ এবং ছয় মাস দক্ষিণায়ন), সংবৎসর (বারো মাস) এবং যুগ (সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি)। এসব বিশেষ বিশেষ কালে বা সময়ে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধিকল্পে রাজাকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যে সময় রাজার সৈন্যদের অনুশীলনের জন্য অনুকূল এবং শত্রুর সৈন্যদের জন্য প্রতিকূল, তা রাজার জন্য হবে উত্তমকাল। এর বিপরীত সময় হবে অধমকাল এবং মাঝামাঝি পর্যায়ের সময় হবে মধ্যমকাল।

০৯-০১-০৮ শক্তি, দেশ ও কালের তুলনামূলক গুরুত্ব পর্যালোচনাকালে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—দেশ ও কালের তুলনায় শক্তি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শক্তিমান রাজা স্থল ও জলাভূমিতে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীভূতকরণে সমর্থ হয়ে থাকেন। কোনো কোনো আচার্য মনে করেন, দেশ, শক্তি ও কালের গুরুত্ব বিবেচনায় দেশই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে–স্থলে অবস্থানকালে কুকুর যেমন জলের কুমিরকে উপরে টেনে আনতে পারে তেমনি জলাশয়ে অবস্থানকালে কুমিরও কুকুরকে টেনে জলে নামাতে পারে (এর মাধ্যমে এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে দেশের অবস্থান রাজার জন্য অনুকূল হলে তিনি যে কোনো শত্রুকে দমন করতে পারে) এক্ষেত্রে কোনো কোনো আচার্য মনে করেন—দেশ ও শক্তি অপেক্ষা কাল-ই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কালের প্রভাবেই দিনের বেলা কাক পেঁচাকে এবং রাতেরবেলা পেঁচা- কাককে আক্রমণ করতে সমর্থ হয়। অর্থাৎ কাল বা সময় অনুকূল হলে যে কেউ তার শত্রুকে ঘাতিত করতে সক্ষম হয়। কৌটিল্য উপরোক্ত তিনটি মতের কোনটিই সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—শক্তি, দেশ ও কাল এই তিনটিই কার্যসাধনের জন্য সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি অপরটির পরিপূরক। সুতরাং এই তিনটির গুরুত্ব সমভাবে অনস্বীকার্য।

০৯-০১-০৯ শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পর্যালোচনা—শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় রাজা তার সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশকে রাজধানী, রাজ্যের পশ্চাদভূমি, সীমান্ত প্রদেশ এবং অরণ্য প্রদেশের সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত করে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে অমিত্র বা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যাত্রা করবেন। এ সময়ে যুদ্ধাভিযানের যৌক্তিকতা হলো—(ক) সে-সময় শত্রুর সঞ্চিত খাদ্যশস্যের মজুদ নিঃশেষ হয়ে যায় (খ) নতুন করে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা তখন সম্ভব হয় না এবং (গ) শত্রুর পক্ষে তৃণ, কাষ্ঠ ও জলের অভাব হেতু দুর্গ সংস্কার সম্ভব হয় না। এছাড়া সে- সময় শত্রু রাজ্যের আহরণতব্য ফসল ও বপনকৃত বীজ ধ্বংস করা সম্ভব হয়।

এছাড়া শত্রু রাজ্যের বসন্তকালের পরিপক্ক ফসলের বিনাশ করতে হলে বীজ বপনকালে অর্থাৎ চৈত্র মাসে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করতে হবে। এভাবে রাজা ফসলের বীজ বুননকালে বা ফসল আহরণের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তার খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং যোগান ধ্বংস করবেন।

০৯-০১-১০ আক্রমণীয় দেশে আক্রমণের অনুকূল সময় সম্পর্কিত পর্যালোচনা—যে দেশের আবহাওয়া উত্তপ্ত, যে দেশে পশু খাদ্যের সংকট বিরাজমান এবং কাষ্ঠ, পানির যোগান অপ্রতুল, সে দেশে সহনীয় তাপমাত্রা, স্বল্পপরিসরে পশুখাদ্য, কাষ্ঠ ও পানি প্রাপ্যতার নিরিখে হেমন্তকালে আক্রমণ চালাতে হবে। যে দেশ একটানা তুষারপাতের ফলে দুর্দশাগ্রস্ত, গভীর জলাশয়যুক্ত এবং লতাগুল্ম-তৃণ-বৃক্ষে জঙ্গলাকীর্ণ। তুষারপাত ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা পরিহারকল্পে সে দেশে গ্রীষ্মকালে অভিযান চালাতে হবে। সাধারণভাবে বর্ষাকালে কোন দেশে আক্রমণ পরিচালনা করা যুক্তিযুক্ত নয়। তবে, সে দেশ যদি রাজার সৈন্যদের জন্য কৌশলগত দিক দিয়ে আক্রমণের অনুকূল এবং শত্রু সৈন্যর জন্য প্রতিকূল হয়ে থাকে, তাহলে বর্ষাকালেও সে দেশে অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে।

দীর্ঘকালীন যুদ্ধাভিযানের জন্য অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাস অনুকূল সময়। এ সময় যাত্রাকালে পথে তেমন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা থাকে না। চৈত্রী অভিযান চালাতে হবে চৈত্র ও বৈশাখ মাসের মধ্যে, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে স্বল্পকালীন অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে, এ সময়ের অভিযান প্রলম্বিত করা অনুচিৎ, এতে করে বর্ষাজনিত বিপর্যয়ে নিপতিত হতে হয়। স্বল্পকালীন অভিযানে রাজা শত্রু দেশে ঝটিকা আক্রমণ করে নগর জনপদে আগুন লাগিয়ে এবং অন্যান্য প্রকার উৎপীড়ন সম্পন্ন করে অতিসত্বর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। এছাড়া শত্রুর বিপত্তি উপস্থিত হলে উপরোক্ত সময় বিধি অনুসরণ না করে, কালক্ষেপণ পরিহার করে যে কোনো সময় আক্রমণ চালানো যেতে পারে।

০৯-০১-১১ কৌটিল্যের আচার্য এই মর্মে পরামর্শ প্রদান করেন যে শত্রু বিপদাপন্ন হলে যে কোনো সময় রাজা তার বিরুদ্ধে আক্রমণে প্রবৃত্ত হবেন। কিন্তু কৌটিল্য কর্তৃক তার শিক্ষকের উপরোক্ত মত সমর্থিত নয়। তিনি মনে করেন—কখন শত্রুর বিপত্তি উপস্থিত হবে বা শত্রু বিপদাপন্ন হবে তা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না, যে কারণে শত্রুর বিপত্তির অপেক্ষায় না থেকে আক্রমণে সক্ষমতা অর্জনের পর রাজা শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে পারেন। অথবা রাজা যখন শত্রুকে পরাস্ত করতে সক্ষম বলে মনে করবেন তখনই যুদ্ধাভিযানে অগ্রসর হবেন।

কখন কি ধরনের সৈন্যসমেত অভিযান চালাতে হবে সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—গ্রীষ্ম অতিক্রান্তের পর অভিযানকালে পর্যাপ্তসংখ্যক হস্তি সৈন্যের সহযোগে অভিযান চালাতে হবে। কারণ সে-সময় পানির পর্যাপ্ততা থাকে যা হস্তির সুস্থতার জন্য সহায়ক। হস্তিরা গরমে কাতর হলে, জলের অভাবে ঘামের নিসৃতি রুদ্ধ হলে তাদের ত্বকে কুষ্ঠরোগ দানা বাঁধে, তারা অন্ধত্বের শিকার হয় এবং হীনবল হয়ে পড়ে। এ কারণে গ্রীষ্মের পর পর্যাপ্ত পানি প্রাপ্যতার সুবাধে হস্তিদের স্নানের সুবিধা নিশ্চিত হয়, যে কারণে সে-সময় হস্তিবাহিনী সহযোগে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা শ্রেয়তর। এর বিপরীত পরিবেশ পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাধা, উট এবং অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে অভিযান চালাতে হবে। এছাড়াও বৃষ্টিজনিত স্বল্পপঙ্কিলযুক্ত মরূ দেশে হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনী তথা চতুরঙ্গের সহযোগে আক্রমণ চালানো যেতে পারে।

০৯-০১-১২ যুদ্ধাভিযানকালে রাজাকে যাত্রাপথের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে হবে। পথের সমতলতা, বন্ধুরতা, জলমগ্নতা, রুক্ষতা, স্থলতা এবং দূরত্বসহ সকল ধরনের সুবিধা অসুবিধার দিক বিবেচনা করে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবে যাত্রাপথের ভূ-প্রকৃতিগত প্রতিবন্ধকতা যা-ই থাকুক না কেন আক্রমণের গুরুত্বানুসারে রাজাকে স্বল্পকালীন বা দীর্ঘকালীন অভিযান পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজনে বর্ষাকালেও পররাজ্যে অবস্থান করতে হবে।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ১৩৭-১৩৮-১৩৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সৈন্য নিয়োগের সময়, যুদ্ধের অত্যাবশ্যক উপরকনাদি এবং শত্রু সেনার বিরুদ্ধে সৈন্য বিন্যাসের প্রকৃতি সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া কখন কোন প্রকৃতির সৈন্য কোথায় পদায়ন করতে হবে, অমিত্র সেনাদের কীভাবে অকার্যকর করতে হবে, কীভাবে সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৯-০২-০১ এই অধ্যায়ে ছয় প্রকৃতি সৈন্য যথা—১. মৌলবল তথা বংশপরম্পরায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত সৈন্য ২. ভূতকবল তথা বেতনভুক্ত বা ভাড়াটে সৈন্য ৩. শ্রেণিবল তথা কোনো অধিনায়কের অধীনস্ত সৈন্য ৪. মিত্রবল তথা মিত্র দেশের সৈন্য ৫. অমিত্রবল তথা শত্রু দেশের সৈন্য এবং ৬. অটবিবল তথা বনচারী সৈন্যদের রণাঙ্গনে পদায়ন সম্পর্কিত বিষয় আলোচিত হয়েছে।

১. মৌলবল সেনাদের পদায়ন—(ক) রাজধানীকে রক্ষার্থে পদায়নের পর যদি অতিরিক্ত সৈন্য মজুদ থাকে (খ) যদি রাজধানীতে বিদ্রোহের আশঙ্কা অনুভূত হলে (গ) শত্রুপক্ষ যদি পর্যাপ্ত মৌলবল ও বলশালী উৎকৃষ্ট যোদ্ধা নিয়ে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হয় (ঘ) দূরদেশে যদি দীর্ঘদিনব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধের আবশ্যকতা অনুভূত হয় (ঙ) শত্রুরাজার গুপ্তচরদের মাধ্যমে আন্তর্ঘাতমূলক আক্রমণের আশঙ্কা ও বিভেদ সৃষ্টির শঙ্কা যদি অনুভূত হয়। এবং (চ) রণক্ষেত্রে যদি বেতনভুক্ত সৈন্যরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাহলে রাজা মৌলবল তথা বংশপরম্পরায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত বিশ্বস্ত ও জাত যোদ্ধাদের প্রযোজ্য ক্ষেত্রের রণাঙ্গনে পদায়ন করবেন।

০৯-০২-০২ ২. ভূতকবল পদায়নের ক্ষেত্রে—(ক) বেতনভুক সৈন্যদের আধিক্য (খ) শত্রুর মৌল সৈন্যের স্বল্পতা (গ) শত্রুর বেতনভুক সৈন্যের দুর্বলতা (ঘ) স্বল্পশ্রমে গুপ্তযুদ্ধের আবশ্যকতা (ঙ) নিকটবর্তী রণক্ষেত্রে স্বল্পকালীন যুদ্ধের আবশ্যকতা (চ) বিভেদহীন সৈনিকদের বিশ্বস্ততা এবং (ছ) স্বল্পশক্তিতে শত্রুর অগ্রাভিযান প্রতিরোধ। এমতবস্থা বা পরিস্থিতর প্রেক্ষাপটে রাজা ভূতকবল বা বেতনভুক সৈন্যদের রণাঙ্গনে পদায়ন করবেন।

০৯-০২-০৩ ৩. শ্রেণিবল পদায়নের ক্ষেত্রে—(ক) যদি রাজার কাছে এ ধরনের পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য মজুদ থাকে (খ) যদি স্বল্প দূরত্বে ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় (গ) শত্রুসেনারা যদি শ্রেণিবলযুক্ত হয় (ঘ) শত্রু যদি রাজার বিরুদ্ধে গুপ্তযুদ্ধ বা প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অভিলাষী হয় (ঙ) শত্রু সৈন্যরা যদি ভীত হয়ে অন্য নৃপতির আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তাহলে বা সেক্ষেত্রে রাজা রণক্ষেত্রে শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে শ্রেণিবল প্রকৃতির সেনাবাহিনী পদায়ন করবেন।

০৯-০২-০৪ ৪. মিত্রবল পদায়নের ক্ষেত্রে—(ক) মিত্রসেনার সংখ্যা যদি রাজধানী ও রণক্ষেত্রে পদায়নের জন্য পর্যাপ্ত হয় (খ) আক্রমণীয় দেশের দূরত্ব যদি অল্প হয় এবং যুদ্ধ যদি ক্ষণস্থায়ী হয় (গ) কূটনৈতিক যুদ্ধাপেক্ষা সরাসরি যুদ্ধ য’। ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত হয় (ঘ) নিজ সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ করানোর পূর্বে যদি শত্রুর বিরুদ্ধে মিত্রসেনা ব্যবহারের আবশ্যকতা অনুভূত হয় (ঙ) রাজা ও শত্রুর যুদ্ধ বিষয়ক স্বার্থ সমপর্যায়ের হলে (চ) রাজার অভীষ্ট অর্জন যদি মিত্রের উপর নির্ভরশীল হয় (ছ) মিত্র যদি রাজার ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন এবং (জ) রাজার বিশ্বাসঘাতক সৈন্যদের যদি মিত্র সেনাদের মাধ্যমে অবদমন করা সম্ভব হয়। তবে রাজা উপরোক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মিত্রবল সেনা পদায়ন করবেন।

০৯-০২-০৫ (৫) অমিত্রবল পদায়নের ক্ষেত্রে—(ক) শত্রু সেনাদের সংখ্যাধিক্যের প্রেক্ষাপটে অমিত্র সেনাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে উভয়ের ক্ষতিসাধন সম্ভব হলে। অর্থাৎ কুকুর এবং শূকর ভোজনকারী চণ্ডালরা যেমন উভয়ের মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে যে কেউ ঘাতিত হলেও লাভবান হয়, স্বার্থ সিদ্ধির এরূপ পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে (খ) কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো শত্রু সৈন্য দিয়ে শত্রু সৈন্যের বিনাশ আবশ্যক হলে (গ) রাজার বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের দ্রোহ নিয়ন্ত্রণের জন্য অমিত্র সেনাদের কাছাকাছি রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে (ঘ) রাজার শত্রু সেনাদের সঙ্গে তাদের শত্রু সেনার যুদ্ধ সমাপ্তির পর পুনরায় যুদ্ধের সময় উপস্থিত হলে, রাজা অমিত্র সেনাদের প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পদায়ন করবেন।

০৯-০২-০৬ ৬. অটবি সেনা পদায়নের ক্ষেত্রে—(ক) রাজা যদি মনে করেন, তারা শত্রুদেশে অভিযানকালে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে, শত্রুরাজ্যে হাতি, অশ্ব বা রথ ব্যবহারে পারদর্শী হবে, নিযুক্তির পূর্ব থেকেই তারা যদি শত্রুর প্রতিপক্ষ হয়ে থাকে, শত্রুর অটবি সেনাদের যদি রাজার অটবি সেনা দিয়ে হত্যা করা সম্ভব হয়, (খ) শত্রুর তৃণ কাষ্ঠাদির পরিবহন যদি তাদের দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব হয়। তাহলে রাজা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অটবি সেনাদের রণাঙ্গনে পদায়ন করবেন।

০৯-০২-০৭ উপরোক্ত ছয় প্রকৃতির সৈন্য ব্যতীত ঔৎসাহিক সেনা নামে আরও এক ধরনের সৈন্য আছে। এরা নিজেদের তাগিদে উৎসাহিত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বলে এদের ঔৎসাহিক নামে অভিহিত করা হয়েছে। এরা একক অধিনায়করহিত অর্থাৎ নেতৃত্বহীন, এরা এক অঞ্চল বা বহু অঞ্চল হতে এসে সমবেত হয়, কারো দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বা নির্দেশিত না হয়েও এরা স্ব-উদ্যোগে শত্রু রাজ্য লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হয়। এরা যদি দৈনিক ভাতা হিসেবে ভাত এবং মাসিক ভাতা হিসেবে নগদ টাকা না পেয়ে থাকে, শুধু শত্রুদেশ লুণ্ঠনকারী হয়, নগরের শ্রমিক কর্মচারী হয়ে থাকে, তাহলে এরা খুব সহজে শত্রুর দ্বারা ভেদ্য হয়। কিন্তু এরা যদি একই অঞ্চল থেকে এসে থাকে, একই জাতি-গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে থাকে, একই পেশার লোকবল হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এরা হয় শত্রু কর্তৃক অভেদ্য।

০৯-০২-০৮ অমিত্র সেনার বিশেষ বিষয়ে রাজার করণীয়—শত্রু নৃপতির যদি যুদ্ধের জন্য সেনা সংগ্রহের আবশ্যকতা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে রাজা তার উদ্যোগ ব্যাহত করবেন বা শত্রু সেনাদের স্ব-পক্ষভুক্তকরণে সচেষ্ট হবেন অথবা সুকৌশলে অমিত্র সেনাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিবেন অথবা প্রতিশ্রুত সহায়তা স্থগিত করে শত্রু নৃপতির প্রচেষ্টা বানচাল করে দিবেন অথবা অমিত্র সেনাদের খণ্ডিত করে নানাস্থানে ছড়িয়ে দিবেন অথবা শত্রু নৃপতির প্রয়োজন সমাপ্ত হলে অমিত্র সেনাদের মুক্ত করে দিবেন অথবা শত্রু নৃপতির এ ধরনের প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে নিজের সেনা সংগ্রহ কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন।

০৯-০২-০৯ মৌল, ভূতক, শ্রেণি, মিত্র, অমিত্র, অটবি এবং ঔৎসাহিক, এই সাত প্রকৃতির সৈন্যের মধ্যে নিম্ন ক্রমানুসারে প্রথমটি অপেক্ষা পরেরটি যুদ্ধের জন্য অধিকতর যোগ্য ও শ্রেয়তর।

১. ভূতবলের তুলনায় মৌলবল অধিকর শ্রেয়। কারণ, এ ধরনের সৈন্যরা সব সময়ের জন্য রাজানুগত ও রাজার প্রতি যত্নবান হয়ে থাকে, এরা বংশপরম্পরায় রাজকীয় বাহিনীতে নিযুক্ত হওয়ায় রাজার মনোভাব উপলব্ধিতে সক্ষম হয়ে নির্দেশাদি প্রতিপালনে তৎপর থাকে।

২. শ্রেণিবলের তুলনায় ভূতবল অধিকতর শ্রেয়। কারণ, ভূতবল তথা বেতনভুক বা ভাড়াটে সেনারা সব সময়ের জন্য রাজার সান্নিধ্যে অবস্থান করে, এদের যে কোনো সময় যুদ্ধের জন্য রণক্ষেত্রে প্রেরণ করা যায়, এরা রাজার নিয়ন্ত্রণাধীনে অবস্থান করে।

৩. মিত্রবলের তুলনায় শ্রেণিবল অধিকতর শ্রেয়। কারণ, এরা রাজার জনপদে অবস্থান করে, এরা রাজার প্রয়োজনকালে সহায়তার জন্য উপস্থিত হয়, এরা শত্রুর প্রতি রাজার মতো স্পর্ধা ও বিক্রম প্রদর্শন করে থাকে।

৪. অমিত্রবলের তুলনায় মিত্রবল অধিকতর শ্রেয়। কারণ, সমস্বার্থ বিশিষ্ট হওয়ায় মিত্র সেনারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে রাজাকে সহায়তা প্রদান করে থাকে এবং সহযোগী হয়ে রণক্ষেত্রে লড়াই করে।

৫. একইভাবে অটবিবলের তুলনায় অমিত্রবল অধিকতর শ্রেয়। কারণ, এরা যোগ্যতাসম্পন্ন অধিনায়কত্বে পরিচালিত হয়। কিন্তু অটবিবল সদ্‌গুণসম্পন্ন যোগ্যতর নেতার নেতৃত্বে চালিত হয় না। এই উভয় প্রকৃতির সৈন্যদলই শত্রুরাজ্যে লুণ্ঠনের কাজে মত্ত হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের সময় এদের উভয়কে পদায়ন করা হলে এরা রাজার লোকবলের মধ্যে ভয়াবহ আন্তঃকলহ বাধাতে পারে, রাজার জন্য যা সপতুল্য সর্বনাশের নামান্তর (অটবিবল ও ঔৎসাহিকবলের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়নি)

০৯-০২-১০ এ পর্যায়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সেনাদের তেজস্বান সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কৌটিল্যের আচার্য বলেন— এক্ষেত্রে নিম্নক্রম অনুসারে প্রথম বর্ণগোষ্ঠী অপেক্ষা পরেরটি কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে অধিকতর তেজস্বান।

কৌটিল্য তার শিক্ষকের উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—এক্ষেত্রে শত্রুপক্ষরা ব্রাহ্মণ সৈন্যদের প্রণিপাতের (মাটিতে লুটিয়ে অভিবাদন জ্ঞাপন) মাধ্যমে সহজেই স্বপক্ষভুক্ত করে রাজাকে পরাস্ত করতে পারে। অপরপক্ষে ক্ষত্রিয় সেনাদের এভাবে পক্ষচ্যুতকরণ সম্ভব হয় না। যে কারণে শাস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত অস্ত্রচালনায় পারদর্শী ক্ষত্রিয় যোদ্ধারাই অধিক তেজস্বান। ক্ষেত্র বিশেষে বীরত্বের মানদণ্ডে বৈশ্য এবং শূদ্র সৈন্যরাও তেজস্বী হতে পারে। অতএব সে আলোকেই রাজাকে যুদ্ধের সময় সৈন্য সমাবেশ করতে হবে।

০৯-০২-১১ এ পর্যায়ে হস্তি সেনার বিষয়ে আলোচনাকালে বলা হয়েছে, শত্রুর হস্তি বাহিনীকে প্রতিরোধকল্পে রাজাকেও হাতিবাহিনী পদায়ন করতে হবে এবং এই বাহিনীতে থাকবে হাতিযন্ত্র, যা হাতির পিঠ থেকে শত্রু বাহিনীর হাতির প্রতি নিক্ষেপযোগ্য। এর সাথে থাকবে শট, কুন্ত বা ৫-৭ হাত দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট নিক্ষেপযোগ্য বর্শা, প্রাস বা লোহার আবরণযুক্ত কাষ্ঠহাতল বিশিষ্ট অস্ত্র, বাঁশ এবং লৌহ শলাকা। এসমস্ত অস্ত্রপ্রয়োগ করে হাতিকে ঘায়েল করতে হবে। রথসেনাদের বিরুদ্ধে উপরোক্ত হস্তিযন্ত্র ছাড়াও থাকবে পাথর, হস্তগদা, প্রতিরক্ষা কবচাদি, অঙ্কুশ এবং কচগ্রহণী বা বাঁশের শীর্ষে লোহার চিরুনি বিশিষ্ট অস্ত্র।

০৯-০২-১২ হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক, এই চতুরঙ্গ সেনার প্রতিটির বিরুদ্ধে প্রতিসেনা পদায়ন করতে হবে, হাতি বাহিনীর বিরুদ্ধে বর্মসজ্জিত হাতি বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে বর্মসজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনী, রথারোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে কবচ সজ্জিত রথারোহী বাহিনী এবং পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত পদাতিকবাহিনী পদায়ন করতে হবে। এইভাবে সমর সজ্জার বিষয়ে সম্যক অবগত হয়ে রাজা তার প্রস্তুতিসম্পন্ন করে চতুরঙ্গ বাহিনী নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ১৪০-১৪১ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজ্যের পশ্চাদভাগ হতে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হবার আশঙ্কা, আভ্যন্তরীণ এবং বাইরের বিদ্রোহের প্রকৃতি, তা নিরসনের উপায়, রাজদ্রোহীদের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থা, বিদ্রোহ দমনে গুপ্তচরদের ভূমিকা, রাজার নিরাপত্তা, রাজ্যরক্ষা ও ষড়যন্ত্র রোধকরণ ইত্যাকার বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

০৯-০৩-০১ সম্মুখে অভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে রাজার রাজ্য যদি পেছন থেকে আক্রান্ত হয় এবং সে আক্রমণের বাহ্যিক ক্ষতি যদি সম্মুখে অভিযানলব্ধ প্রাপ্তির তুলনায় তুচ্ছও হয়, তথাপিও রাজা ভবিষ্যতে ক্ষতির আশঙ্কা বিবেচনা করে সম্মুখবর্তী অভিযান হতে বিরত হয়ে পেছনের শত্রুকে অবদমনের জন্য মনোনিবেশ করবেন। কারণ, পেছনের শত্রুকে তুচ্ছ করা হলে এক সময় তা বিস্তৃত হয়ে ব্যাপক পরিসরে জনগণ, জনপদ এবং অমাত্যদের উৎপীড়িত করে পুরো রাজ্যকে গ্রাস করতে পারে। যে কারণে ভবিষ্যতের বিপর্যয় প্রতিরোধকল্পে এহেন পরিস্থিতিতে রাজার জন্য লাভজনক সম্মুখবর্তী অগ্রাভিযান পরিত্যাগ করে পেছনের শত্রুকে নিবৃতকরণ সমীচীন হবে।

০৯-০৩-০২ পশ্চাদবর্তী শত্রু কর্তৃক উৎপীড়িত হবার আশঙ্কা উদ্ভূত হলে তা প্রতিরোধকল্পে রাজা স্বয়ং অগ্রসর না হয়ে সাম, দান, ভেদ বা দণ্ড প্রয়োগ করে তা উপশমের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। এ সময় সম্মুখবর্তী যুদ্ধাভিযান রাজার জন্য লাভজনক বলে প্রতীয়মান হলে সেনাপতি বা যুবরাজের নেতৃত্বে তিনি তা সম্পাদন করাবেন। কিন্তু রাজা যদি সেনাবাহিনীর দিক দিয়ে শক্তিমান হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি সেনাবাহিনীর একাংশকে পশ্চাদের শত্রুকে অবদমনের জন্য প্রেরণ করে স্বয়ং সম্মুখবর্তী অভিযানের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দ্রোহের আশঙ্কা অনুভূত হলে, অভিযানকালে সন্দেহভাজন মন্ত্ৰী, অমাত্য, পুরোহিত, সেনাপতি এবং যুবরাজদের দলভুক্ত করবেন। এতে করে তারা বিদ্রোহ করতে আর সাহসী হবে না। এছাড়াও রাষ্ট্রমুখ্য, অন্তপাল বা আটবিকদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহের সম্ভাবনা অনুভূত হলে, সন্দেহজনকদের স্ত্রী পুত্রকে মৌলসেনাদের প্রহরায় অন্তরীণ করে যুদ্ধে যাত্রা করবেন, এক্ষেত্রে বিদ্রোহ প্রশমনে অসমর্থ হলে রাজা যুদ্ধযাত্রা বাতিল করে রাজধানীতেই অবস্থান করবেন।

০৯-০৩-০৩ মন্ত্রী, পুরোহিত, সেনাপতি এবং যুবরাজ কর্তৃক সংঘটিত বিদ্রোহকে অভ্যন্তরীণ কোপ বলা হয়। এক্ষেত্রে রাজা যদি মনে করেন, তার নিজের দোষে এ ধরনের বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে, তাহলে তিনি নিজের কৃত উক্ত প্রকার কার্যকলাপ পরিহার করে বিদ্রোহ প্রশমনে উদ্যোগী হবেন। কিন্তু এ ধরনের বিদ্রোহ যদি অন্যের প্ররোচনায় উত্থিত হয়, সেক্ষেত্রে তিনি অপরাধীকে অপরাধের মাত্রানুযায়ী শাস্তি প্রদান করে বা প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে বিদ্রোহের প্রতিকার করবেন।

তবে, এ ধরনের রাজদ্রোহের অপরাধে কোনো পুরোহিত যদি অপরাধী হিসেবে শনাক্ত হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মণত্বের কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত না করে কারারুদ্ধ করতে হবে বা দেশ থেকে নির্বাসনে প্রেরণ করতে হবে (কৌটিল্যের উপদেশ বা নির্দেশনা মতে কোনো ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বধদণ্ড অনুমোদিত নয়—লেখক) কোনো রাজকুমার যদি এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে শাস্তি হিসেবে তার কারাবাস হবে বা তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে, এক্ষেত্রে রাজার যদি অন্য কোনো গুণবান পুত্র না থাকে, তাহলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের স্বার্থে উক্ত যুবরাজকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না। একইভাবে সেনাপতি এবং মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও বিদ্রোহের অপরাধে সমপ্রকৃতির শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

০৯-০৩-০৪ অন্যান্য প্রকৃতির কোপ বা দ্রোহ সম্পর্কে বলা হয়েছে— কোনো রাজপুত্র, রাজভ্রাতা বা রাজকুলজাত ব্যক্তি যদি রাজার রাজ্য অধিকার করতে অভিলাষী হন, তাহলে রাজা তাকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে পদায়িত করে সন্তুষ্টকরণের মাধ্যমে বশীভূত করবেন। এভাবে তুষ্ট করা সম্ভব না হলে, উক্ত ব্যক্তি যাতে শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারেন, সে লক্ষ্যে ভূমি ভোগের অধিকার প্রদানসহ সন্ধি সম্পাদনের মাধ্যমে তাকে অনুকূলিত করবেন অথবা তাকেসহ তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীকে আটক করবার জন্য অধিক শক্তিসম্পন্ন সেনাবাহিনী প্রেরণ করবেন অথবা তার বিরুদ্ধে তার চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আটবিকদের প্রেরণ করবেন অথবা শক্তিশালী সেনাবাহিনী, সামন্ত ও আটবিকদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী পাঠিয়ে উক্ত বিদ্রোহী আটক করে বশীভূত করবেন। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ দ্রোহ ছাড়াও অন্যান্য অমাত্য প্ৰকৃতি হতে উদ্ভূত দ্রোহকে বলা হয় অন্তরমাত্যকোপ, রাজা উক্ত প্রকৃতির বিদ্রোহও একই পদ্ধতিতে প্রশমিত করবেন।

০৯-০৩-০৫ অন্যপ্রকার দ্রোহ সম্পর্কে বলা হয়েছে—রাষ্ট্রমুখ্য বা রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি (স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান), অন্তপাল বা সীমান্তরক্ষক, আটবিক বা বন্য সর্দার, দণ্ডোপনত বা রাজা কর্তৃক অবদমিত ব্যক্তি, এই চার প্রকৃতির ব্যক্তিদের মধ্যে সংঘটিত দ্রোহকে বলা হয় বাহ্যকোপ বা বাহিরের দ্রোহ। এ ধরনের ব্যক্তিদের কারো দ্বারা বিদ্রোহ সংঘটিত হলে রাজা একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে বিদ্রোহের উপশম করাবেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রমুখ্য বিদ্রোহ করলে অন্তপালকে দিয়ে তাকে অবদমিত করাবেন। এদের মধ্যে কেউ অভেদ্য দুর্গের মাধ্যমে সুরক্ষিত হলে, রাজার কোনো সামন্ত, আটবিক বা রাজপুরুষের মাধ্যমে তাকে অবরুদ্ধ করে আটক করাবেন অথবা উক্ত বিদ্রোহী যাতে রাজার কোনো শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারে সে লক্ষ্যে রাজা তার মিত্রকে দিয়ে বিদ্রোহীর সঙ্গে সন্ধি করিয়ে তাকে বশীভূত বা বিদ্রোহ হতে নিবৃত করাবেন।

০৯-০৩-০৬ বিদ্রোহী কেউ যেন রাজার শত্রুর সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে না পারে, সে লক্ষ্যে রাজা তার সত্রী নামক গুপ্তচরদের মাধ্যমে উক্ত বিদ্রোহীকে নিরোধকল্পে সচেষ্ট হবেন। এক্ষেত্রে সত্রীরা উক্ত বিদ্রোহীকে এই মর্মে সতর্ক করবেন যে, শত্রুনৃপতি তাকে রাজার গুপ্তচর হিসেবে গণ্য করে তার প্রভুর বিরুদ্ধেই তাকে শক্তি প্রদর্শনের কাজে ব্যবহার করবে অথবা স্বার্থহাসিলের পর তাকে দূরবর্তী অঞ্চলে কষ্টকর যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করবে অথবা তাকে স্ত্রী পুত্রের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেশের প্রান্তসীমায় বাস করতে প্রেরণ করবে অথবা পূর্বোক্ত প্রভুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপনের জন্য তাকে পণ হিসেবে ব্যবহার করবে অথবা পূর্বোক্ত প্রভুর কোনো মিত্রের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য তাকে পণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

এ ধরনের বহুবিধ বিপত্তির কথা উদ্ধৃত করে গুপ্তচররা উক্ত বিদ্রোহীকে রাজার শত্রুর সঙ্গে সঙ্গত হওয়া থেকে নিরোধকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। অতঃপর উক্ত বিদ্রোহী গুপ্তচরদের ভেদোপদেশ অনুযায়ী রাজার শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত হলে, গুপ্তচররা তাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করবে। কিন্তু উক্ত তিনি যদি বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেন অর্থাৎ রাজার শত্রুর সঙ্গে সঙ্গত হওয়ার প্রশ্নে অনড় থাকেন, সেক্ষেত্রে গুপ্তচররা তার সম্ভাব্য আশ্রয়দাতাকে এই বলে ভেদ সৃষ্টি করাবে যে আশ্রয় প্রার্থী ব্যক্তিটি আদতে রাজা কর্তৃক নিয়োজিত গুপ্তচর।

০৯-০৩-০৭ এছাড়া গুপ্তচররা রাজার শত্রুর সঙ্গে মিলনিচ্ছুক বিদ্রোহীকে কৌশলে ঘাতিত করার উদ্দেশ্যে, উক্ত বিদ্রোহী বা আশ্রয়প্রার্থী যে রাজা কর্তৃক নিয়োগকৃত আশ্রয়দাতার হত্যাকারী তার স্বপক্ষে জাল আদেশনামা সম্ভাব্য আশ্ৰয় প্রদানকারীর সমীপে প্রদর্শন করবে, এতে করে সম্ভাব্য আশ্রয়দাতার মনে উক্ত বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে ক্রোধ সঞ্চারিত হবে এবং তিনি তাকে হত্যা করবেন। অথবা তীক্ষ্ণ নামের গুপ্তচররা সুকৌশলে উক্ত বিদ্রোহীকে হত্যা করবে। উক্ত বিদ্রোহীর সঙ্গে যেসব সৈন্য রাজার শত্রুর আশ্রয় প্রার্থনা করবে গুপ্তচররা তাদেরও বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে, এক্ষেত্রে গুপ্তচররা ব্যর্থ হলে উপরোক্ত সৈন্যদের হত্যাকারী হিসেবে প্রতিপন্ন করে আশ্রয়দাতার মনে তাদের বিরুদ্ধে ক্রোধ উৎপাদন করিয়ে তার মাধ্যমেই সৈন্যদের ঘাতিত করাবে। এভাবে রাজা উক্ত প্রকার বিদ্রোহীদের তার শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে নিবৃতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়া যে ব্যক্তি বিদ্রোহ সৃষ্টিতে এবং তা প্রশমনে সক্ষম তার সঙ্গে অন্যের বিভাজন সৃষ্টি করা উচিৎ। যে ব্যক্তি বিশ্বাসী, উপকারী ও বিপত্তি প্রতিকারে সমর্থ তার প্রতি প্রতিজাপ করণীয়। এক্ষেত্রে তিনি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাকি প্রতারক প্রকৃতির তাও বিবেচনা করতে হবে।

০৯-০৩-০৮

০৯-০৩-১০ বিদ্রোহ সংঘটনে এবং তা প্রশমনে যে ব্যক্তিরা অতিশয় পারদর্শী তাদের সঙ্গে অন্যদের বিভেদ সবসময় জিয়ন্ত রাখা উচিৎ। চতুরবুদ্ধিসম্পন্ন বহিঃশত্রুকে দিয়ে অভ্যন্তরীণ শত্রুদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা সম্ভব, এ কারণে প্রয়োজনের সময় তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। একই প্রক্রিয়ায় চতুরবুদ্ধিসম্পন্ন অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারীদের বাইরের ষড়যন্ত্রকারীদের অবদমনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ সমস্ত তরিকা অবলম্বনের মাধ্যমে রাজা যেমন নিজেকে রক্ষা করবেন, তেমনি তার স্বজন ও রাজ্যকেও রক্ষা করবেন এবং এ বিষয়ক গোপনীয়তা কখনো কারো কাছে প্রকাশ করবেন না।

চতুর্থ অধ্যায় ॥ ১৪২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে লোকবল ও সম্পদের লাভ-ক্ষতির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। লোকবলের ক্ষয় বলতে এখানে বিভিন্ন ধরনের বাহনচালক এবং কর্মকুশীলব তথা কর্মকরদের প্রাণহানি বোঝানো হয়েছে। সম্পদের ক্ষয় বলতে বোঝানো হয়েছে নগদঅর্থ ও শস্যের ক্ষতি। লাভ বলতে বোঝানো হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্তি।

০৯-০৪-০১ হাতি, ঘোড়া, রথ, ইত্যাকার বাহন চালনার প্রশিক্ষিত লোকবল এবং বিভিন্ন বাহনসহ যুদ্ধোপকরণের নির্মাণকর্মে নিযুক্ত কারিগর শ্রেণির প্রাণহানিকে ক্ষয় বলা হয়। নগদ অর্থ, স্বর্ণ, ধান ও শস্যের ক্ষতিকে বলা হয় ব্যয়। এই ক্ষয় এবং ব্যয়ের বিপরীতে বারো প্রকার লাভের সম্ভাবনা থাকলে রাজা যুদ্ধাভিযানে প্রবৃত্ত হবেন, এর বৈপরীত্য অনুমিত হলে যুদ্ধ পরিহার করবেন। যে বারো ধরনের লাভের কথা উদ্ধৃত হয়েছে তা হলো— ১. আদেয় ২. প্রত্যাদেয় ৩. প্রসাদক ৪. প্রকোপক ৫.হ্রস্বকাল ৬. তনুক্ষয় ৭. অল্পব্যয় ৮. মহান ৯. বৃদ্ধ্যুদয় ১০. কল্য ১১. ধর্ম এবং ১২. পুরোগ।

০৯-০৪-০২ যে লাভ সহজেই প্রাপ্ত হয়, প্রাপ্তির পর সহজে রক্ষা করা যায় এবং ভবিষ্যতে শত্রুকর্তৃক অপহৃত হয় না, সে লাভকে বলা হয় আদেয়। এর বৈপরীত্য প্রতিভাত হলে অর্থাৎ যে লাভ প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তা রক্ষা করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় এবং যা শত্রু কর্তৃক পুনরায় অধিকৃত হয়, সে লাভকে বলা হয় প্রত্যাদেয়। এ ধরনের প্রত্যাদেয় লাভের প্রত্যাশায় যে রাজা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন, চূড়ান্ত বিচারে তিনি নিজের সর্বনাশের বীজ বপন করেন।

কিন্তু এক্ষেত্রে রাজা যদি মনে করেন যে এ ধরনের লাভের মাধ্যমে তিনি— (ক) শত্রুর সম্পদ, সৈনা, শস্য ও দুর্গের ক্ষতিসাধনে সক্ষম হবেন (খ) শত্রু রাজ্যের খনি, দ্রব্যবন, হস্তিবন, জলবাঁধ, বণিকপথ ধ্বংস করতে সক্ষম হবেন (গ) শত্রুর অমাত্যসহ প্রকৃতিবর্গকে নিঃশেষ করতে সক্ষম হবেন (ঘ) সহজপথে শত্রুর অমাত্যবর্গকে বশীভূত করতে সক্ষম হবেন (ঙ) দখলকৃত ভূমি শত্রুর কাছে বিক্রয় করতে সক্ষম হবেন (চ) শত্রুর মিত্রকে দখলিকৃত ভূমিতে পুনর্বাসনে সক্ষম হবেন (ছ) উক্ত ভূমিতে অবস্থান করে নিজ দেশীয় চোর ও শত্রুকে শায়েস্তা করতে সক্ষম হবেন (জ) লব্ধভূমিতে অবস্থান করে শত্রুর মিত্র মধ্যমরাজাকে শত্রুর দোষত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করতে সক্ষম হবেন (ঝ) কন্যাদানের মাধ্যমে লব্ধভূমি প্রত্যর্পণ করে শত্রুর সঙ্গে স্থায়ী মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে সমর্থ হবেন। সেক্ষেত্রে তিনি প্রত্যাদেয় লাভও গ্রহণ করতে পারেন।

০৯-০৪-০৩ প্রসাদক ও প্রকোপক বিষয়ক লাভ—অধার্মিক রাজার কাছ থেকে প্রাপ্ত লাভ যদি ধার্মিক রাজা, তার স্বপক্ষীয় ও অন্যপক্ষীয় লোকদের পরিতৃপ্ত করতে পারে, তাহলে তা হবে প্রসাদক লাভ। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে তথা ধার্মিক রাজার কাছ থেকে প্রাপ্ত লাভ যদি অধার্মিক রাজা, তার পক্ষীয় ও অন্যপক্ষীয় লোকদের বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, তাহলে তা হবে প্রকোপক লাভ।

০৯-০৪-০৪ অন্যন্য লাভের বিষয়—যে লাভ মন্ত্রণার মাধ্যমে স্বল্পসময়ের মধ্যে সহজে অর্জিত হয়, তা হ্রস্বকাল লাভ। যে লাভ স্বল্প সময়ের যুদ্ধে অর্জিত হয়, তা তনুক্ষয় লাভ। যে লাভ আর্থিক বিনিয়োগ ব্যতিরেকে অন্ন দিয়ে পরিতৃপ্তকরণের মাধ্যমে সৈন্যদের সহায়তায় অর্জিত হয়, তা অল্পব্যয় লাভ। তাৎক্ষণিকভাবে যে বিপুল লাভ অর্জিত হয়, তা মহান লাভ। যে লাভ বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োজন পূরণে সহায়ক, তা বৃদ্ধ্যুদয় লাভ। যে লাভ ভবিষ্যতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে না, তা কল্য বা নিরাপদ লাভ। যে লাভ প্রকাশ্য যুদ্ধের মাধ্যমে বা ন্যায্যভাবে অর্জিত হয়, তা ধর্ম বা ন্যায়সঙ্গত লাভ। যে লাভ সমবায়িক বা সম্মিলিত অভিযানের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তা পুরোগ বা প্রকৃষ্ট লাভ।

০৯-০৪-০৫ দুটি যুদ্ধাভিযানে সমলাভ অর্জিত হলে, তুলনামূলক বিচারে যে লাভ বহুবিধ গুণসম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে রাজা সে লাভ গ্রহণ করবেন। তদুপরি দেশ কালের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিবর্গশক্তি এবং চতুবর্গ উপায়ের মধ্যে কোনটির সহজতর প্রয়োগের মাধ্যমে লাভ অর্জিত হয়েছে, তা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে লাভটি গ্রহণ করতে হবে। বহুগুণ বিশিষ্ট লাভ বলতে এখানে অসার দ্রব্য অপেক্ষা আর্থিক লাভ, বিলম্বিত লাভ অপেক্ষা তাৎক্ষণিক লাভ, দূরস্থিত অপেক্ষা সন্নিকটস্থ লাভ, ক্ষণস্থায়ী অপেক্ষা স্থায়ী লাভ এবং অল্প অপেক্ষা অধিক লাভ বোঝানো হয়েছে।

০৯-০৪-০৬ এই লাভ তথা অর্জনের প্রতিবন্ধকতা বা বিঘ্নসমূহ হলো– কাম তথা নারী সঙ্গ, যদ্বারা অর্জন বা লাভ বিঘ্নিত হয়। কোপ তথা ক্রোধ, যার প্রভাবে লাভ প্রাপ্তি লঙ্ঘিত হয়। সাধ্বস বা স্নায়ুবিক দুর্বলতায় লাভ প্রাপ্তির বিনাশ হয়। কারুণ্য বা সহানুভূতি প্রদর্শনের কারণে বহুপ্রাণের নাশ হয়, ফলে লাভের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। হ্রী বা লজ্জার কারণে শত্রুর আকুতির প্রতি সদয় হয়ে রাজা কর্তৃক শত্রু দমন বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে লাভ প্রাপ্তি বিঘ্নিত হয়। অনাৰ্যভাব বা অনাহূত ক্রুদ্ধতা নৃশংসভাবে শত্রুনাশের জন্য প্ররোচিত করে, ফলে লাভ প্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয়। মান বা অহঙ্কার প্রদর্শনের ফলে সহায়ক যোদ্ধারা বিচ্যুত হয়ে পড়ে ফলে কাঙ্ক্ষিত লাভ প্রাপ্তি সম্ভব হয় না। সানুক্রোশতা বা উপঢৌকন গ্রহণের মাধ্যমে শত্রুকে ছাড় দেওয়া হয়, ফলে প্রত্যাশিত লাভ প্রাপ্তি সম্ভব হয় না। পরলোকাপেক্ষা তথা পরকালের পাপের ভয়ে ভীত হয়ে রণক্ষেত্রে হত্যা— অগ্নিসংযোগের মতো নিষ্ঠুর কর্ম হতে বিরত হলে লাভ প্রাপ্তি বিঘ্নিত হয়। দাম্ভিকত্ব তথা দম্ভ প্রদর্শন করা হলে বিশ্বস্ত সহযোগিরা সহযোগিতা প্রদান থেকে বিরত থাকে, ফলে লাভ প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ হয়। ধার্মিকত্ব তথা ধর্মভীরুতার কারণে রণক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক উদ্যোগ হতে বিরত হলে লাভ প্রাপ্তি সম্ভব হয় না।

অত্যাশিত্ব বা ন্যায়ের পথে থেকে লাভ প্রত্যাশা করলে তা অর্জিত হয় না। দৈন্য বা অধম ব্যক্তির কাছে সহানুভূতি প্রার্থনা করা হলে, লাভ প্রাপ্তি বিঘ্নিত হয়। অসূয়া তথা ঈর্ষান্বিত বা অসহিষ্ণু হয়ে অমাত্যাদির ছিদ্রান্বেষণে প্রবৃত্ত হলে রাজার প্রত্যাশিত লাভ প্রাপ্তি বিঘ্নিত হয়। হস্তগতবমান তথা প্রাপ্ত কোনোকিছুর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হলে, লাভ প্রাপ্তির সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। দৌরাত্মিক তথা ভালো-মন্দ বিচার না করে সকলের উপর উৎপীড়ন করা হলে, লাভ প্রাপ্তির সম্ভাবনা দূরীভূত হয়। অবিশ্বাস তথা বিশ্বাসীদের প্রতি সন্দেহপোষণ করা হলে, লাভ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা উদ্ভূত হয়। আক্ষম্য তথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের প্রকোপ সহ্য করবার মতো ক্ষমতা না থাকলে লাভ প্রাপ্তির সম্ভাবনা সমাধিস্থ হয়। শুভ তিথির জন্য অপেক্ষমান থাকলে লাভ প্রাপ্তির সময় বিঘ্নিত হয়। এভাবে উপরোক্ত কারণে রাজার যুদ্ধজয় এবং এতসঙ্গে লাভ প্রাপ্তি বিঘ্নিত হয়ে থাকে।

০৯-০৪-০৭ কোনো কাজ শুরুর জন্য কোন নক্ষত্র অনুকূল, কেউ যদি বারংবার সে সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে, সেক্ষেত্রে সফলতা সেই মূর্খ ব্যক্তিকে অতিক্রম করে চলে যায়। সে ব্যক্তির আর অভীষ্ট অর্জিত হয় না। সকল পর্যায়ে ধন সম্পদই অভীষ্ট অর্জনের চালিকাশক্তি হিসেবে নক্ষত্ররূপে বিবেচিত হওয়া উচিৎ। কারণ, নক্ষত্রের গণনাদির মাধ্যমে কখনো অভীষ্ট অর্জিত হয় না। ধন-সম্পদের বিনিয়োগের মাধ্যমেই সফলতা অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে নক্ষত্র বা তারকারাজির মাধ্যমে কোনো সময় সফলতা লাভ করা যায় না। সম্পদহীন মানুষ শতত চেষ্টাতেও সার্থকতা লাভ করতে পারে না। প্রশিক্ষিত হাতি দিয়ে যেমন হাতি সংগ্রহ করা যায় তেমনি ধন-সম্পদ বিনিয়োগ করেই ধন-সম্পদ অর্জন করা যায়।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ১৪৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে অভ্যন্তর এবং বহিরাঙ্গন হতে উদ্ভূত বিপত্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সে আলোকে কতভাবে বিপত্তির উৎপত্তি হতে পারে এবং কোন তরিকায় কোন প্রকৃতির বিপত্তির স্রষ্টা তথা ষড়যন্ত্রকারীকে বশীভূত ও নিরস্তকরণ আবশ্যক, ইত্যাকার বিষয়েও এ পর্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৯-০৫-০১ সন্ধি তথা শান্তি-সমঝোতা, বিগ্রহ তথা যুদ্ধ, যান তথা সেনাভিযান, আসন তথা নিরপেক্ষ অবস্থান, সংশ্রয় তথা আশ্রয় এবং দ্বৈধীভাব তথা দ্বৈতনীতি, এই ছয়টি ক্ষেত্রে যদি ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় বা এক্ষেত্রে যদি ভ্রান্তনীতি গ্রহণ করা হয় (অপনয়) তাহলে রাজার বিরুদ্ধে বিপত্তি উৎপত্তির সম্ভাবনা দেখা দেয়। দুভাবে অভ্যন্তরীণ এবং দুভাবে বহিরাঙ্গনের বিপত্তি উদ্ভূত হতে পারে। সে নিরিখে বিপত্তির প্রকৃতি চার প্রকার—

(ক) শত্রু রাজ্যের অমাত্যদের প্ররোচণায় নিজ রাজ্যের অমাত্যরা দুষ্কর্ম করে যে বিপত্তির সৃষ্টি করে, তা প্রথম প্রকার বিপত্তি।

(খ) নিজ দেশের অমাত্যদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রমুখ্যরা যে বিপত্তির সৃষ্টি করে, তা দ্বিতীয় প্রকৃতির বিপত্তি।

(গ) একশত্রু অন্য শত্রুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে যে বিপত্তির সৃষ্টি করে, তা তৃতীয় প্রকৃতির বিপত্তি এবং

(ঘ) নিজের অমাত্যদের একাংশ অন্যদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে যে বিপত্তির সৃষ্টি করে, তা চতুর্থ প্রকৃতির বিপত্তি

০৯-০৫-০২ প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকৃতির বিপত্তিজনিত উদ্ভূত সমস্যা তথা ষড়যন্ত্র সাম ও দানের মাধ্যমে সমাধান বা নিরস্ত করাই সঙ্গত। এক্ষেত্রে বিপত্তি সৃষ্টিকারী আপনজনদের ধন-সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে আস্থায় এনে বশীভূত করা যায়, কিন্তু বাইরের বিপত্তি সৃষ্টিকারীদের সহজে বশীভূত করা যায় না।

০৯-০৫-০২ নিজের মন্ত্রী পুরোহিতদের দ্বারা বিপত্তি উদ্ভূত হলে রাজা সাম ও দানের মাধ্যমে তাদের বশীভূত করে বিপত্তির নিষ্পত্তি করবেন অর্থাৎ উদ্ভূত ষড়যন্ত্রের উপশম করবেন। প্রয়োজনে বশীভূত করার নিমিত্ত রাজা তাদের সম্মানিত করবেন, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন করবেন, সম্পদ অর্জনে সহায়তা করবেন, কর সুবিধা প্রদান করবেন।

০৯-০৫-০৪ রাষ্ট্রমুখ্য এবং অন্তপালদের দ্বারা উদ্ভূত বিপত্তি তথা ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য রাজা তাদের বিরুদ্ধে ভেদ এবং দণ্ডনীতি প্রয়োগ করবেন। ভেদ সৃষ্টির নিমিত্ত রাজার নিয়োজিত গুপ্তচররা রাষ্ট্রমুখ্য এবং অন্তপালদের আস্থা অর্জন করে ষড়ন্ত্রকারী মন্ত্রী-অমাত্যদের ব্যাপারে সতর্ক করবে। এক্ষেত্রে তারা ছলনার আশ্রয় নিয়ে এ কথা বলবে যে, ষড়যন্ত্রকারী মন্ত্রী-অমাত্যরা রাজার নির্দেশেই তাদের হত্যা করার অভিপ্রায়ে এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। এভাবে তারা রাষ্ট্রমুখ্য এবং অন্তপালদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী বা বিপত্তি সৃষ্টিকারী মন্ত্রী-অমাত্যদের সম্পর্ক বিনষ্ট করতে সচেষ্ট হবে। অথবা ওইসব বিপত্তি সৃষ্টিকারী রাজদ্রোহীদের সঙ্গে গুপ্তচররা ছলনার মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং এক সময় সুকৌশলে বিষ প্রয়োগ করে বা অস্ত্রাঘাতে তাদের হত্যা করবে।

০৯-০৫-০৭ ষড়যন্ত্রকারীদের বশীভূত বা নিরস্তকরণের মাধ্যমই হলো বিপত্তি প্রতিকারের সর্বোত্তম পন্থা। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারীদের যেমন সাম ও দানের মাধ্যমে নিস্পৃহ বা বশীভূত করা বাঞ্ছনীয়, তেমনি বাহিরের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ভেদ ও দণ্ডনীতি প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে ভেদ প্রয়োগের মাধ্যমে অভীষ্ট অর্জন ব্যর্থ হলে গুপ্তচরদের মাধ্যমে সুকৌশলে তাদের হত্যা করে উদ্ভূত বিপত্তির মূলোৎপাটন করতে হবে।

০৯-০৫-০৮ এ ধরনের চার প্রকৃতির বিপত্তি তথা ষড়যন্ত্র নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে রাজাকে সব সময় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ বিপত্তির নিষ্পত্তি করতে হবে। কারণ বাহিরের শত্রু অপেক্ষা ঘরের শত্রু সব সময় অতীব ভয়াবহ হয়ে থাকে। এ ধরনের শত্রু সাপের সমতুল্য।

ষষ্ঠ অধ্যায় ॥ ১৪৪ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজদ্রোহী এবং শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কোন প্রকৃতির গণবিদ্রোহ কোন পদ্ধতিতে দমন করতে হবে, কীভাবে রাজা জোটবদ্ধ শত্রুর সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিহত করবে, কোন প্রেক্ষাপটের আলোকে সাম, দান, ভেদ বা দণ্ডনীতি প্রয়োগ করতে হবে, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৯-০৬-০১ সমাজে দু প্রকৃতির বিশুদ্ধ মানুষ বসবাস করে। প্রথম প্রকৃতির বিশুদ্ধ মানুষ রাজদ্রোহীদের সম্পৃক্ততা হতে নিজেদের বিযুক্ত রাখে এবং দ্বিতীয় প্রকৃতির বিশুদ্ধ মানুষ রাজার শত্রুর সংস্পর্শ হতে নিজেদের নিরস্ত রাখে। প্রথম প্রকৃতির বিশুদ্ধ জনগণ কর্তৃক যদি জনপদে বা নগরে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, সেক্ষেত্রে রাজা তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার বল প্রয়োগমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না। তিনি সাম, দান ও ভেদের মাধ্যমে উক্তরূপ বিদ্রোহ বা বিপত্তির নিষ্পত্তি করবেন।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো বলপ্রয়োগমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন নয়, এতে করে রাজার প্রতি সাধারণ জনগণের বিরূপ মনোভাবের উন্মেষ ঘটতে পারে। এছাড়া এক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করা হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে এবং এতে করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। তবে সাম, দান ও ভেদের মাধ্যমে যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গুপ্তচর দিয়ে গোপনে হত্যা করিয়ে বিদ্রোহীদের নিস্পৃহ করাতে হবে।

০৯-০৬-০২ দ্বিতীয় প্রকৃতির বিশুদ্ধ জনগণ কর্তৃক বিপত্তি বা বিদ্ৰোহ সংঘটিত হলে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী সামন্ত, মন্ত্রী বা অমাত্যদের সাম ও দানের মাধ্যমে বশীভূত করে নিরস্তকরণের মাধ্যমে বিপত্তির নিষ্পত্তি করতে হবে।

০৯-০৬-০৩ সাম প্রয়োগ প্রসঙ্গ—যে বিপত্তি রাজদ্রোহী এবং সাধারণ বিশুদ্ধ জনগণের সমন্বয়ে উদ্ভূত হয়, তা মিশ্র প্রকৃতির বিপত্তি। এ ধরনের বিপত্তির উৎপত্তি হলে সাম দানের মাধ্যমে বিশুদ্ধ লোকদের অনুকূলিত করে তা প্রশমিত করতে হবে। এই পন্থা অনুসৃত হলে প্রকৃত রাজদ্রোহীরা বিদ্রোহের সহায়ক অবলম্বন হারিয়ে নিজে থেকেই স্তিমিত হয়ে পড়বে এবং বিপত্তিও আপনা আপনি দূরীভূত হবে। এছাড়াও এ ক্ষেত্রে পরমিশ্রা বা শত্রুমিশ্রিতা নামে মিত্র ও অমিত্রের ঐক্যের মাধ্যমে আরও এক ধরনের বিপত্তির উৎপত্তি হতে পারে। এ ধরনের বিপত্তি উদ্ভূত হলে মিত্রদের সামদানের মাধ্যমে অনুকুলিত করে তা প্রশমিত করতে হবে। মিত্রের সঙ্গেই সর্বদা অনুকুলিত করণের সন্ধি সম্পাদন করতে হবে, কারণ শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।

০৯-০৬-০৪ এক্ষেত্রে মিত্র যদি সন্ধি সম্পাদনে অনীহা প্রদর্শন করেন, তাহলে রাজা কর্তৃক প্রতিনিয়ত তাকে সন্ধি সম্পাদনের জন্য প্ররোচিত করতে হবে। প্রয়োজনে গুপ্তচরদের দিয়ে উক্ত মিত্রকে শত্রুর সম্পৃক্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্ববশে আনতে হবে। অথবা শত্রু ও মিত্র রাজ্যের মধ্যবর্তী কোনো নৃপতিকে স্বপক্ষভুক্ত করতে হবে। এভাবে শত্রু-মিত্রের মধ্যবর্তী রাজ্যের নৃপতিকে স্বপক্ষভুক্ত করা সম্ভব হলে, সুবিধার অভাবহেতু বিপত্তি সৃষ্টিকারী শত্রু- মিত্রের ঐক্যের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে, তারা আর ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। এছাড়াও উপযুক্ত উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে উপরোক্ত পক্ষের সঙ্গে তাদের সহায়তাকারীর ভেদ সৃষ্টি করে আশ্রয়লাভ বা সাহায্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্র রুদ্ধ করে তাদের নিরস্ত্র করতে হবে।।

০৯-০৬-০৫ বিপত্তি যদি কোনো ধার্মিক নৃপতি কর্তৃক উদ্ভূত হয়, সেক্ষেত্রে রাজা সামনীতির আলোকে তা নিবৃত করবেন। তিনি উক্ত ধার্মিক নৃপতির জাত, কুল, প্রজ্ঞা, আচার, মর্যাদা, বিশুদ্ধতা ও শাস্ত্র বিশারদত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে এবং পূর্বকালে তাদের পরিবারের সঙ্গে যে উক্ত রাজপরিবারের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার হৃদয় জয় করতে সচেষ্ট হবেন। প্রয়োজনে সর্ব সময়ে তার উপকার ও অনপকারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে তাকে প্রশান্ত করবেন। এছাড়াও উৎসাহহীন, দীর্ঘকালীন যুদ্ধজনিত কারণে পরিশ্রান্ত, নিজ শত্রুর প্রতি সাম প্রয়োগে ব্যর্থ, ক্ষতিগ্রস্ত (সেনা ও সম্পদে), দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে প্রবাস হতে প্রত্যাগত হয়ে ক্লান্ত, বিশুদ্ধ মননে মিত্রের প্রত্যাশী, মিত্র রাজার প্রতি অবিশ্বাসী, সর্বদা মিত্র ভাবাপন্ন, সকলের বন্ধুত্ব প্রত্যাশী এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নৃপতিদের দ্বারা বিপত্তি সৃষ্টি হলে রাজাকে সামনীতির অলোকে উদ্ভূত বিপত্তির নিষ্পত্তি করে তাদের প্রশান্ত করতে হবে।

০৯-০৬-০৬ দান প্রদান তথা দান পদ্ধতি প্রয়োগের প্রসঙ্গ—বিপত্তি উৎপত্তিকারী কোনো নৃপতি যদি লোভী কিংবা সম্পদহীন হন, সেক্ষেত্রে তপস্বী ও মুখ্যব্যক্তিদের সাক্ষী রেখে তাকে অর্থসম্পদ দান করে বশীভূত করতে হবে। এ ধরনের দান (এক্ষেত্রে সহায়তা) পাঁচ প্রকৃতির হতে পারে—(ক) রাজাকে দেয় কর হতে অব্যাহতি প্রদান (খ) রাজার পূর্বপুরুষ কর্তৃক অধিকৃত ভূমি ভোগের অনুমতি প্রদান (গ) রাজা কর্তৃক অধিকৃত ভূমি-সম্পদ প্রত্যর্পণ (ঘ) পূর্বের অফেরতকৃত দ্রব্য প্রত্যর্পণ এবং (ঙ) শত্রু দেশ হতে লুণ্ঠিত সম্পদ গ্রহণের অধিকার প্রদান।

০৯-০৬-০৭ ভেদ প্রয়োগের প্রসঙ্গ—কয়েকজন নৃপতি যদি সম্মিলিতভাবে রাজার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে উদ্যত হয় এবং এই জোটভুক্ত নৃপতিদের কোনো দুজন নৃপতি যদি পরস্পর বিদ্বেষ ও বৈরীভাবাপন্ন হয়ে ভূমি হারানোর ভয়ে শঙ্কিত থাকেন। সেক্ষেত্রে রাজা উপরোক্ত দুজনের যে কোনো একজনের সমীপে সমর্পিত হয়ে তার সঙ্গে অন্যজনের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাবেন। এদের মধ্যে যে নৃপতি অধিকতর ভীরু, তাকে প্রতি আক্রমণের ভীতি প্রদর্শন করে সম্মিলিত জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করাবেন।

জোটভুক্ত নৃপতিদের মধ্যে যিনি অধিক শক্তিধর তাকে জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তার ভাণ্ডারে সংরক্ষণের নিমিত্ত অন্যদেশ বা নিজ দেশ থেকে যেসব পণ্যদ্রব্য আনীত হবে, সে সব পণ্যদ্রব্য রাজা কর্তৃক প্রেরিত বলে রাজার নিযুক্ত গুপ্তচররা অপ্রপ্রচার চালাবে এবং অন্য নৃপতিদের এর স্বপক্ষে জাল দালিলিক প্রমাণ তথা কূটশাসন প্রদর্শন করবে, এ ধরনের জালপত্রে লেখা থাকবে, আমি তোমার সমীপে যৎকিঞ্চিৎ উপহার পাঠালাম, আমাকে রক্ষার্থে তোমার জোটভুক্ত নৃপতিদের আক্রমণ করো অথবা জোট থেকে নিজেকে নিবৃত করো, কার্য সম্পাদনের পর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অবশিষ্ট পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’ এভাবে জোটভুক্ত অন্যান্য নৃপতিরা এ ধরনের পত্র দেখে উক্ত নৃপতির প্রতি সন্দিহান হয়ে তার সান্নিধ্য পরিত্যাগ করবে।

০৯-০৬-০৮ জোটভুক্ত শরিকদের ঐক্যে ফাটল ধরাবার জন্য আরও বহুবিধ উপায়ে ভেদনীতি প্রয়োগ করতে হবে। জোটভুক্ত কোনো শক্তিমান নৃপতির অজ্ঞাতসারে গুপ্তচরদের মাধ্যমে রাজা তার মূল্যবান রত্নাদি হস্তগত করবেন। অতঃপর ঐ রত্নাদি রাজা কর্তৃক নিয়োজিত বণিকের ছদ্মবেশধারী গুপ্তচররা জোটভুক্ত কোনো নৃপতির কাছে বিক্রয়ের নিমিত্ত প্রেরণ করবে এবং সত্রী নামক গুপ্তচররা রাজার সঙ্গে জোটভুক্ত নৃপতির গোপন সমঝোতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠাকল্পে এ কথা প্রচার করবে যে, রত্নটি জোটভুক্ত নৃপতি কর্তৃক রাজার কাছে বিক্রয়ের জন্য হস্তান্তরিত হয়েছে। এতে করে জোটভুক্ত অন্যান্য শরিকরা উক্ত নৃপতির প্রতি সন্দিহান হয়ে জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করবে। এভাবে রাজার বিরুদ্ধে গঠিত জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।

অথবা রাজ্যের যে সমস্ত অমাত্য বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত, রাজা তাদের অর্থ-সম্পদ ও সম্মান প্রদানের মাধ্যমে বশীভূত করবেন এবং কৌশলে বিষপ্রয়োগ, অস্ত্রাঘাত বা অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে শত্রু নৃপতিকে হত্যা করার জন্য প্রেরণ করবেন। অতঃপর উক্ত প্রকৃতির অমাত্যরা শত্রু সমীপে উপস্থিত হলে তার বা তাদের সম্পর্কে শত্রু নৃপতির মনের সন্দেহ দূরীভূতকরণের জন্য গুপ্তচররা একথা সর্বত্র প্রচার করবে যে নিরাপত্তা হেফাজতে অবস্থানকালে উক্ত অমাত্যের পরিবার পরিজন রাজা কর্তৃক নিহত হয়েছে। এভাবে শত্রু নৃপতির কাছে আস্থাভাজন হওয়ার পর প্রেরিত অমাত্যরা জালপত্র প্রদর্শন করে উক্ত নৃপতিকে জোটভুক্ত বলবান নৃপতির কোপানল হতে নিজেকে রক্ষার্থে জোট হতে নিবৃতকরণে প্ররোচিত করবেন অথবা উক্ত নৃপতিকে কৌশলে বিষপ্রয়োগ করে বা অস্ত্রের আঘাতে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবে। এ ধরনের দায়িত্বে নিয়োজিত অমাত্যরা কার্যসিদ্ধিতে ব্যর্থ হলে রাজা কর্তৃক নিয়োজিত উভয়বেতন নামক গুপ্তচররা (রাজার কাছে এবং শত্রু নৃপতির কাছে বেতন গ্রহণকারী গুপ্তচর) তাদের উপর নৃপতিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আরোপ করে গ্রেফতার করাবেন।

০৯-০৬-০৯ অথবা সত্রী নামের গুপ্তচররা জোটভুক্ত কোনো নৃপতির সেনা শিবির, ভূমির ফসল কিংবা সুহৃৎ বলের আগম বাধাগ্রস্থ বা ধ্বংস করিয়ে এর দায় জোটভুক্ত অন্য নৃপতিদের উপর চাপিয়ে দিবে। অতঃপর উক্ত নৃপতিকে জোটভুক্তদের দ্বারা নিহত হবার আশঙ্কা ব্যক্ত করে সতর্ক করত জোট পরিত্যাগ করার জন্য প্ররোচিত করবে।

০৯-০৬-১০ অথবা কোনো নৃপতির হাতি, ঘোড়া যদি স্বাভাবিক কারণে মৃত্যুবরণ করে থাকে, সে মৃত্যুর দায়ও সত্রী নামক গুপ্তচররা জোটভুক্ত কোনো এক শরিকের উপর বর্তিয়ে জোটভুক্তদের মধ্যে বিভাজনের বীজরোপন করবে। এক্ষেত্রে কখনোবা সত্রীরা স্ব-উদ্যোগে গোপনে হাতি, ঘোড়া হত্যা করে সে হত্যার দায় উপরোক্তভাবে অন্য নৃপতিদের উপর চাপিয়ে দিবে। অতঃপর যে নৃপতির উপর এ ধরনের অভিযোগ আরোপিত হবে সত্রীরা তার কাছে, ‘পুনর্বার এ ধরনের হত্যা সম্পাদিত হলে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধ করা হবে’ এরূপ বক্তব্য সম্বলিত রাজার স্বাক্ষরযুক্ত একটি কূটশাসন বা জালপত্র প্রেরণ করবে এবং উভয় বেতন নামক গুপ্তচররা সেই পত্র উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে হস্তগত করে তা জোটভুক্ত অন্যান্য নৃপতির কাছে প্রদর্শন করবে। এভাবে পরস্পরের আস্থা বিনষ্ট করে রাজা তার বিরুদ্ধে গঠিত জোটকে নিষ্ক্রিয় করবেন।

এই একই প্রক্রিয়ায় সেনাধ্যক্ষ, রাজকুমার এবং বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা অধিনায়কদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে রাজা তাদের নিষ্ক্রিয় করবেন।

০৯-০৬-১১ দণ্ডবিধি ও তার প্রয়োগ—অতি ক্রোধান্বিত, বলশালী, কুপ্রবৃত্তিতে আসক্ত এবং দুর্গে অবস্থানকারী শত্রুকে রাজা কর্তৃক নিয়োজিত গুপ্তচররা বিষপ্রয়োগ করে, অস্ত্রের আঘাতে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবে। এক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ নামক সর্ববিধ উপায়ে হত্যায় পারঙ্গম গুপ্তচররা উপরোক্ত প্রকৃতির শত্রুদের নিজেদের সুবিধামতো স্থানে ও সময়ে হত্যা করবে।

০৯-০৬-১২ উপরোক্ত উপায়ে শত্রুকে নিরোধকরণের ক্ষেত্রে সামনীতি একক গুণসম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। কারণ এ পর্যায়ে শুধু সামপ্রয়োগের মাধ্যমেই শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দাননীতি দ্বিগুণ বিশিষ্ট। কারণ, এ পর্যায়ে সাম ও দানের সমন্বয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ভেদনীতি ত্রিগুণ বিশিষ্ট। কারণ, এ পর্যায়ে সাম ও দানের পর ভেদ প্রযুক্ত হয় এবং শেষোক্তটি তথা দণ্ডনীতি চতুর্গুণ বিশিষ্ট। কারণ সাম, দান ও ভেদের পর দণ্ড প্রযুক্ত হয়ে থাকে।

রাজার বিরুদ্ধে আক্রমণে প্রতিজ্ঞ জোটবদ্ধ নৃপতিরা যদি আক্রমণের জন্য অগ্রসর না হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে শিবির স্থাপন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে, সেক্ষেত্রেও রাজা কর্তৃক উপরোক্ত চারটি পদ্ধতি সমভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে রাজা কিছু বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, সম্মিলিত জোটের নৃপতিরা রাজার বিরুদ্ধে আক্রমণের পূর্বে নিজ ভূমিতে অবস্থান প্রাক্কালে রাজা কোনো এক নৃপতির কাছে তার সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত দূতকে মূল্যবান উপহারসামগ্রী দিয়ে সন্ধি সম্পাদনার্থে প্রেরণ করবেন। একবারের প্রচেষ্টায় সফল না হলে, তিনি বারবার সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে এ ধরনের দূত প্রেরণ অব্যাহত রাখবেন। অতঃপর সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখাত হলে গুপ্তচররা উক্ত নৃপতির সঙ্গে রাজার সন্ধি সম্পাদিত হয়েছে বলে মিথ্যে প্রচারণা চালাবে এবং উভয়বেতনভোগী গুপ্তচররা এই প্রচারণার সূত্র ধরে উক্ত নৃপতিকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে জোটের শরিকদের বিরাগভাজনে পরিণতকরণের মাধ্যমে জোটচ্যুত করাবে।

০৯-০৬-১৩ অথবা কোনো নৃপতির যদি জোটভুক্ত অন্য নৃপতির পক্ষ থেকে ভীতি, বৈরীতা বা বিদ্বেষ উন্মেষের সম্ভাবনা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে রাজার গুপ্তচররা উক্ত ভীত নৃপতিকে এ কথা বলে আরও সন্ত্রস্ত করবে যে, উক্ত ভীতি উৎপাদনকারী নৃপতি শত্রুর সঙ্গে সন্ধি সম্পাদন করে তার উপর আক্রমণ চালাবে। অথবা রাজা জোটভুক্ত কোনো নৃপতির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন এবং এভাবে উপরোক্ত তরিকায় জোটভুক্ত নৃপতিদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেকে সুরক্ষিতকরণে সচেষ্ট হবেন।

০৯-০৬-১৪ এছাড়াও রাজা তার অধীনস্থ সামন্ত, অরণ্যচারী, নিজবংশের বিশ্বস্ত ব্যক্তি এবং অবরুদ্ধ রাজপুত্রদের দিয়ে বহুরৈখিক অন্তর্ঘাতমূলক আক্রমণ চালিয়ে জোটভুক্ত রাজাদের জনপদের ক্ষতি করাবেন। তাদের বণিক পথ বিনষ্ট করাবে, দ্রব্যবন বিনষ্ট করাবে, হস্তিবন ধ্বংস করাবে, সৈন্যদের হত্যা করাবে, জোটবদ্ধ নৃপতিদের দুর্বল স্থানে আঘাত করাবে। তীক্ষ্ণ নামক গুপ্তচরদের দিয়ে বিষপ্রয়োগ, অস্ত্রাঘাত এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাবে। জোটযুক্ত শত্রুদের সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাজা পাখি ধরার ফাঁদের মতো ফাঁদ পেতে শত্রুকে বিভ্রান্ত করবেন এবং শঠতা ও কপটতার মাধ্যমে বিশ্বাস উৎপাদন করে তাদের অবদমন করবেন।

সপ্তম অধ্যায় ॥ ১৪৫-১৪৬ প্রকরণ

এই অধ্যায়ে অর্থ, অনর্থ এবং সংশয়’র বিষয় আলোচিত হয়েছে। অর্থ বলতে এ পর্যায়ে ভূমি, নগদ অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ বোঝানো হয়েছে। অনর্থ বলতে উপরোক্ত সম্পদের বিনাশ এবং সংশয় বলতে অর্থ লাভ ও অর্থনাশের সম্ভাবনা বোঝানো হয়েছে।

০৯-০৭-০১ কামদোষ তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মান, মদ ও হর্ষের প্রভাবে রাজার প্রকৃতিবর্গ (রাজা, অমাত্য, মিত্র, রাজকোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও দণ্ডনীতি বিকারগ্রস্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। অপনয় তথা সন্ধি ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভ্রান্তনীতি প্রয়োগ করা হলে রাষ্ট্রমুখ্য, অন্তপাল ও অন্যদের মধ্যে ক্রোধের উন্মেষ ঘটে। এই দুই প্রকৃতির দোষকে বলা হয় অসুরীবৃত্তি। রাজাকে অবশ্যই এসব ক্ষতিকারক দোষ বর্জন করতে হবে। এসব দোষের প্রভাবে নিজের ক্ষয় এবং শত্রুর সমৃদ্ধি অর্জনের পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে, তা আপদ বলে পরিগণিত হবে। এই আপদ অর্থমূলক, অনর্থমূলক এবং সংশয়মূলক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

০৯-০৭-০১ এক্ষেত্রে যে অর্থ রাজার উপেক্ষার কারণে শত্রুর হস্তগত হয়ে তার সমৃদ্ধি সাধনের সহায়ক হয়, তা প্রথম প্রকারের আপদ অর্থ। যে অর্থ রাজার হস্তগত হবার পরও শত্রুর কাছে প্রত্যর্পিত হয়, তা দ্বিতীয় প্রকারের আপদঅর্থ। যে অর্থ হাসিলের জন্য রাজাকে বিপুল ক্ষতি স্বীকার করতে হয়, তা তৃতীয় প্রকৃতির আপদ অর্থ। আপদ অর্থ এই তিন প্রকৃতির হয়ে থাকে।

আপদ অর্থের উদাহরণ—১. কোনো সামন্ত যদি নিজ দোষের কারণে অর্জিত সম্পদ রক্ষার্থে ব্যর্থ হয় এবং তা যদি অন্যদের ভোগ্যভূত হয়ে পড়ে তা হলে তা এক ধরনের আপদ অর্থ ২. কোনো কসরৎ ছাড়াই শত্রু কর্তৃক যদি কোনো সম্পদ অর্জিত হয় তাহলেও তা আপদ অর্থ বলে বিবেচিত হবে (গ) সম্মুখবর্তী রাজ্য হতে প্রাপ্ত সম্পদের ভোগ যদি পশ্চাদবর্তী শত্রুর মাধ্যমে বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলেও তা আপদ অর্থ বলে গণ্য হবে এবং রাজমণ্ডলের রাজাদের অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে সন্ধি ভঙ্গের মাধ্যমে যে সম্পদ লাভ হয় তাও আপদ অর্থ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

০৯-০৭-০৩ কারো কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের কারণে যদি ভীতির উদ্রেক হয় তাহলে তা হবে অনর্থমূলক বিপদ। উপরোক্ত অর্থ ও অনর্থ বিষয়ক সংশয় উদ্ভূত হলে তা হবে সংশয়মূলক আপদ। এ ধরনের সংশয়মূলক আপদ চারভাবে উদ্ভূত হতে পারে—১. অর্থের ভাব ও অভাব ২. অনর্থের ভাব ও অনর্থের অভাব ৩. অর্থ অথবা অনর্থ এবং ৪. অনর্থ বা অর্থ বিষয়ক সংশয়। শত্রুর মিত্রকে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার জন্য উৎসাহিত করা হলে প্রথম প্রকার সংশয় উপস্থিত হতে পারে। কারণ, এক্ষেত্রে শত্রু ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উক্ত মিত্র রাজার বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে। শত্রুর সৈন্যদের ভূমি, নগদ অর্থ বা অন্যান্য সম্পদ দান করে সম্মানিতকরণের মাধ্যমে স্বপক্ষভুক্ত করার আহ্বান জানানো হলে, দ্বিতীয় প্রকার সংশয় উপস্থিত হতে পারে। বলশালী সামন্তের ভূমি অধিকার করতে প্রবৃত্ত হলে তৃতীয় প্রকার সংশয় উপস্থিত হতে পারে এবং নিজের চেয়ে অধিকবলশালী নৃপতির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলে চতুর্থ প্রকার সংশয় উপস্থিত হতে পারে। উপরোক্ত চার প্রকার সংশয়ের মধ্যে যা অনর্থরহিত রাজাকে তা-ই অবলম্বন করতে হবে।

০৯-০৭-০৪ প্রতিটি অর্থ এবং অনর্থের সাথে অনুবন্ধের যোগ ও অযোগজনিত ছয় প্রকারের ভেদ হতে পারে। যাকে বলা হয় অনুবন্ধষড়বর্গ। এই অনুবন্ধষড়বর্গ বা ছয়টি অনুবন্ধ হলো—১. অর্থের অনুবন্ধযুক্ত অর্থ ২. অর্থের অনুবন্ধরহিত অর্থ ৩. অনর্থের অনুবন্ধযুক্ত অর্থ ৪. অর্থের অনুবন্ধযুক্ত অনৰ্থ ৫. অর্থের অনুবন্ধরহিত অনর্থ এবং ৬. অনর্থের অনুবন্ধরহিত অনর্থ।

০৯-০৭-০৫ অনুবন্ধষড়বর্গের উদাহরণ—সম্মুখের শত্রুকে বিনাশ করে পশ্চাদবর্তী শত্রুকে বশীভূত করা হলে তা হবে অর্থানুবন্ধ অর্থ। সম্পদের বিনিময়ে উদাসীন রাজাকে সেনাসহায়তা দিয়ে সহায়তা করা হলে তা হবে নিরনুবন্ধ অর্থ। শত্রু ও রাজার মধ্যস্থিত নৃপতিকে উচ্ছেদ করা হলে তা হবে অনর্থানুবন্ধ অর্থ। সম্পদ ও সৈন্য দিয়ে শত্রুর প্রতিবেশী নৃপতিকে সহায়তা করা হলে তা হবে অর্থানুবন্ধ অনর্থ। হীনবলসম্পন্ন কোনো নৃপতিকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে উৎসাহিত করে পিছুটান দেওয়াকে বলে নিরনুবন্ধ অনর্থ। নিজের চেয়ে অধিক বলশালী নৃপতিকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে সহায়তা না করা হলে তা হবে অনর্থানুবন্ধ অনর্থ। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীর চেয়ে পূর্বেরটি শ্রেয়তর বা অধিক ফলদায়ক।

০৯-০৭-০৬ যদি সম্মুখে, পশ্চাতে, পার্শ্বে তথা সকল দিক দিয়ে যুগপৎভাবে অর্থোৎপত্তি ঘটে, তাহলে তা হবে সর্বদিকের অর্থাপৎ (বিপদ)। এ ধরনের সর্বদিকের অর্থাপৎ যদি পশ্চাদভাগের শত্রু কর্তৃক বিরোধিত হয় তাহলে তা হবে, সর্বদিকের অর্থসংশয়াপৎ। উপরোক্ত ধরনের সর্বদিক হতে আপদ উদ্ভূত হলে আক্রন্দের (রাজার পশ্চাদবর্তী মিত্র) সহায়তা গ্রহণ করে তার প্রতিকার করতে হবে। চারিদিকের শত্রু কর্তৃক ভীতি উৎপাদিত হলে তাকে বলা হয় সর্বদিকের অনর্থাপৎ। এ ধরনের অনর্থাপৎ যদি মিত্রদ্বারা বিরোধিত হয় তবে তা হবে সর্বদিকের অনর্থসংশয়াপ‍। এই দুই ধরনের আপদের প্রতিকারকল্পে রাজাকে দুর্গরহিত শত্রু এবং আক্রন্দের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে।

০৯-০৭-০৭ উভয়দিক হতে লাভ অর্জনের সম্ভাবনা সম্পৃক্ত সংশয় উদ্ভূত হলে, (কোনটি গ্রহণ করবেন এবং কোনটি বর্জন করবেন) তাকে বলা হয় উভয়ত অর্থাপদ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে দিক হতে ১. আদেয় ২. প্রত্যাদেয় ৩. প্রসাদক ৪. প্রকোপক ৫. হ্রস্বকাল ৬. তনুক্ষয় ৭. অল্পব্যয় ৮. মহান ৯. বৃদ্ধ্যুদয় ১০. কল্য ১১. ধর্ম এবং ১২. পুরোগ লাভের আলোকে অধিক লাভের সম্ভাবনা থাকবে, রাজা সেদিকেই সেনাভিযানে প্রবৃত্ত হবেন। উভয়দিক হতে সমভাবে অনর্থ উৎপত্তির সম্ভাবনা দেখা দিলে, তাকে বলা হয় উভয়ত অনর্থাপদ। এক্ষেত্রে রাজা তার মিত্রদের সহায়তায় এ ধরনের অনর্থের প্রতিকার করবেন।

০৯-০৭-০৮ এ পর্যায়ে যদি মিত্রদের সহায়তা পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে রাজা নিজ প্রকৃতিবর্গ তথা অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ, দণ্ড ও মিত্রের মধ্যে যেটি অধিক অগুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবেন, সেটি ত্যাগ করে যেদিকের ক্ষতি তুলনামূলক বিচারে অধিক বলে অনুমিত হবে সে দিকের আপদ প্রতিকারের জন্য মনোনিবেশ করবেন। উভয়দিক সামাল দেওয়া আবশ্যক হলে, রাজা গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতি ত্যাগের মাধ্যমে উভয়দিকের অনর্থ প্রতিকারের পদক্ষেপ গ্ৰহণ করবেন। রাজধানী পরিত্যাগের প্রয়োজন হলে তিনি তা-ই করবেন। এমনকি বিরাজিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনে রাজা তার সর্বস্ব পরিত্যাগ করে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করবেন। কারণ, রাজা যদি সর্বস্ব ত্যাগ করেও নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে পুনরায় তিনি নিজেকে পূর্ববস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হতে পারবেন। ইতিহাসে এ ধরনের বহু নজির আছে। যেমন রাজা সুযাত্র ও বৎসরাজ উদয়ন রাজ্য হারিয়ে পুনরায় স্বরাজ্য পুনরুদ্ধারে সমর্থ হয়েছিলেন।

০৯-০৭-০৯ একদিকে আক্রমণের মাধ্যমে লাভ এবং অন্যদিকে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা উদ্ভূত হলে তাকে বলা হয় উভয়ত অর্থানর্থাপদ। এক্ষেত্রে লাভ গ্রহণের মাধ্যমে যদি শত্রুর প্রতিকার সম্ভব হয়, তাহলে রাজা সে পন্থাই অবলম্বন করবেন। এর অন্যথা হলে অর্থাৎ লাভার্জনের মাধ্যমে যদি শত্রুর প্রতিকার করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে রাজা লাভের প্রত্যাশা পরিত্যাগ করে রাজ্য রক্ষার্থে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহতকরণে সচেষ্ট হবেন।

০৯-০৭-১০ যদি একদিক থেকে অর্থ নিশ্চিত হয় এবং অন্যদিক থেকে অনর্থসংশয় উদ্ভূত হয়, তাহলে তা হবে উভয়ত অর্থানর্থসংশয়াপদ। এ ধরনের আপদ উপস্থিত হলে রাজা প্রথমে অনর্থের প্রতিকারে সচেষ্ট হবেন এবং তা সিদ্ধ হলে অর্থসংশয়ের প্রতিকার করবেন। এক্ষেত্রে আপদ প্রতিকারের জন্য তিনি অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ, দণ্ড ও মিত্র এই প্রকৃতিবর্গের প্রথমটিকে পরেরটির চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে অনর্থসংশয় দূর করবেন।

০৯-০৭-১১ প্রকৃতি দুধরনের হতে পারে ১. পুরুষ প্রকৃতি এবং ২. বস্তু প্রকৃতি। উভয়প্রকার প্রকৃতির আপদ যদি দূরীকরণ সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে রাজা উত্তেজক ও লোভার্ত ব্যক্তিদের পরিহার করে যারা সংখ্যায় অধিক ও অনুরক্ত, তাদের অনর্থসংশয় দূরীকরণে তথা তাদের রক্ষার্থে সচেষ্ট হবেন এবং বস্তু প্রকৃতির মধ্যে যেগুলো মূল্যবান ও উপকার সাধক, সেগুলোকে রক্ষার্থে সচেষ্ট হবেন। ক্ষয়, স্থান ও বৃদ্ধি এই তিনটির মধ্যে রাজা প্রথমটি অপেক্ষা পরেরটির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করবেন। তবে, ভবিষ্যতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা প্রতিভাত হলে এর বৈপরীত্যের উপরও গুরুত্বারোপ করতে পারেন।

০৯-০৭-১২ যুদ্ধাভিযানের সূচনায় যদি অর্থ, অনর্থ ও সংশয় একত্রে উদ্ভূত হয়, সেক্ষেত্রে অর্থগ্রহণ করাই হবে সবদিক দিয়ে কল্যাণকর। কারণ, অর্থের মাধ্যমেই পশ্চাদশত্রু (পার্ষিগ্রাহ) ও পশ্চাদশক্রর মিত্রকে (পার্ষিগ্রাহের মিত্রকে পাল্টা আঘাত করা সম্ভব হয় এবং অর্থের মাধ্যমেই বাহন ও লোকবলের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, যুদ্ধজনিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয়, দূরপথের যাত্রার ক্লেশ লাঘব হয়, প্রত্যাদেয় সম্পদের ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয় এবং রাজধানীর নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে অনর্থ বা সংশয় অবলম্বিত হলে ভবিষ্যতে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থেকে যাবে।

০৯-০৭-১৩ যুদ্ধাভিযানের সমাপ্তিতে কর্শনীয় শত্রুকে কর্শনের মাধ্যমে দুর্বল করে এবং উচ্ছেদযোগ্য শত্রুকে উচ্ছেদকরণের মাধ্যমে অর্থহাসিল করাটাই শ্রেয়তর হবে। এর অন্যথা হলে উভয় প্রকৃতির শত্রুর পক্ষ থেকে প্রতি আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যাবে। এক্ষেত্রে জোটবদ্ধ নৃপতিদের মধ্যে যিনি অপ্রধান, তাকে আক্রমণের মধ্য ও সমাপ্তি পর্যায়ে অনর্থ ও সংশয়ের প্রতিকার অত্যাবশ্যক, অন্যথায় তিনি অন্যত্র চলে যেতে পারেন।

০৯-০৭-১৪ অর্থ, ধর্ম ও কাম, এই তিনটি অর্থত্রিবর্গ হিসেবে অভিহিত। এ তিনটির ক্রমানুসারে পরেরটি অপেক্ষা পূর্বেরটি অধিক কাঙ্ক্ষিত। অর্থাৎ কাম অপেক্ষা ধর্ম এবং ধর্ম অপেক্ষা অর্থ অধিকতর কাঙ্ক্ষিত। অনর্থ, অধর্ম ও শোক, এই তিনটি হলো অনর্থত্রিবর্গ। এগুলো ক্রমানুসারে অনাকাঙ্ক্ষিত। এক্ষেত্রে পরেরটি অপেক্ষা পূর্বেরটির প্রতিকার অধিকতর শ্রেয়। অর্থ না অনৰ্থ, ধৰ্ম না অধর্ম এবং কাম না শোক? এই তিনটি সংশয়াত্মক জোড় হলো সংশয়ত্রিবর্গ। এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে, পরেরটির প্রতিকার সাধিত হলে, পূর্বটির প্রাপ্তির চেষ্টা শ্রেয়তর। অর্থাৎ অনর্থ, অধর্ম ও শোকের প্রতিকার সম্ভব হলে অর্থ, ধর্ম ও কামের প্রাপ্তি উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে।

০৯-০৭-১৫ আপদ প্রতিকারের ক্ষেত্রে সাম নীতির প্রয়োগ—পুত্র, ভ্রাতা ও স্বজনদের আপদ প্রতিকারার্থে সামনীতির প্রয়োগই সমীচীন। অনুরাগজনিত কারণে এদের বিরুদ্ধে অন্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত নয়। নগর, জনপদ, সৈন্য ও রাষ্ট্রমুখ্য, এই চারটি ক্ষেত্র হতে আপদ উত্থিত হলে দান ও ভেদের মাধ্যমে তার প্রতিকার করা যুক্তিযুক্ত হবে। এদের সঙ্গে স্নেহের সম্পর্কের অভাব হেতু সামপ্রয়োগ সমুচিত নয়। সামন্ত ও আটবিকদের পক্ষ থেকে আপদ উত্থিত হলে ভেদ ও দণ্ডের মাধ্যমেই তার প্রতিকার করা সমুচিত। রাজবিরোধী বিধায় এদের জন্য সাম ও দান প্রয়োগের আবশ্যকতা নেই। উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী সামনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সফলতা অর্জিত হলে তা হবে স্বাভাবিক পদ্ধতি (অনুলোমসিদ্ধি) এবং এর বৈপরীত্য ঘটলে তা হবে অস্বাভাবিক পদ্ধতি (প্রতিলোমসিদ্ধি)।

এক্ষেত্রে পুত্র বা ভ্রাতারা যদি বিদ্রোহমূলক প্রতিকূল আচরণ করে তাহলে তাদের উপর বধদণ্ড প্রযুক্ত হতে পারে, আবার আটবিক বা সামন্তরা যদি গৌরবময় আচরণ করে তাহলে তাদের উপর সাম ও দাননীতি প্রয়োগ প্রযোজ্য হতে পারে। মিত্র এবং অমিত্র নৃপতিদের আপদ প্রতিকারকল্পে চারটি নীতির যে কোনো একটি প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। শত্রু কর্তৃক শঙ্কিত অমাত্যরা যদি মনে করেন, ক্রোধবশত এ ধরনের শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সামের মাধ্যমে তার প্রতিকার সম্ভব হলে অন্য নীতি প্রয়োগের আবশ্যকতা থাকে না। অন্যদিকে শত্রুর দোষযুক্ত অমাত্যদের দানের মাধ্যমে বশীভূত করা সম্ভব হলে অন্য নীতি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। তবে, শত্রুর অমাত্যরা যদি জোটবদ্ধ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ভেদনীতি প্রয়োগ করা হলে অন্য নীতি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না কিন্তু তারা যদি উৎসাহ শক্তিযুক্ত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের উপর দণ্ড (বল) প্রয়োগ করাই বিধেয়।

০৯-০৭-১৬ আপদসমূহের গুরুত্ব, লঘুত্ব ও তাৎপর্য পর্যালোচনা করেই নিয়ম, বিকল্প ও সমুচ্চয় প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। একটি উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে আপদের প্রতিকার করা হলে তা হবে নিয়োগ। একটির বিকল্প উপায়ে আপদের প্রতিকার করা হলে তা হবে বিকল্প এবং বহুবিধ উপায়ের মাধ্যমে আপদের প্রতিকার করা হলে তা হবে সমুচ্চ। সাম, দান, ভেদ ও দণ্ড এই চারটি উপায় বা নীতি পৃথক পৃথকভাবে প্রযুক্ত হলে চার প্রকার ভেদ পাওয়া যায়।

যেমন—শুধু সাম, শুধু দান, শুধু ভেদ এবং শুধু দণ্ড। এগুলোর মধ্যে তিনটি উপায় যুক্ত করে প্রয়োগ করলেও চার প্রকার ভেদ পাওয়া যায়। যেমন—সাম- দান-ভেদ, সাম-দান-দণ্ড, সাম-ভেদ-দণ্ড এবং দান-ভেদ-দণ্ড। আবার দুটি উপায়কে একত্র করে পৃথকভাবে প্রয়োগ করা হলে ছয় প্রকার ভেদ পাওয়া যায়, যেমন; সাম-দান, সাম-ভেদ, সাম-দণ্ড, দান-ভেদ, দান-দণ্ড এবং ভেদ-দণ্ড। আবার চারটি উপায়কেই একত্রে প্রয়োগ করা হলে এক রকমের ভেদ পাওয়া যায়। যেমন, সাম-দান-ভেদ-দণ্ড। এভাবে উপায়গুলোর সর্বমোট ১৫ প্রকার অনুলোম ভেদ পাওয়া যায়। আবার একইভাবে ১৫ প্রকার প্রতিলোম ভেদও পাওয়া যায়।

০৯-০৭-১৭ উপরোক্ত উপায়সমূহের একটি উপায়ের মাধ্যমে আপদের প্রতিকার করা সম্ভব হলে তাকে বলা হয় একসিদ্ধি, দুটি উপায়ের মাধ্যমে আপদের প্রতিকার করা হলে তা হবে দ্বিসিদ্ধি, তিনটি উপায়ের মাধ্যমে আপদের প্রতিকার করা হলে তা হবে ত্রিসিদ্ধি এবং চারটি উপায়ের মাধ্যমে আপদের প্রতিকার করা হলে তা হবে চতুর্সিদ্ধি।

অর্থের মাধ্যমেই ধর্মার্জন হয়, অর্থই কামভোগের সাধক, এ কারণে অর্থই ধর্ম ও কামভোগের নিয়ামক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এজন্য অর্থ সিদ্ধিকে বলা হয় সর্বসিদ্ধি। অগ্নি, বন্যা, ব্যাধি, মরক, রাষ্ট্রবিপ্লব, দুর্ভিক্ষ এবং ইঁদুরের সৃষ্ট উৎপাতকে বলা হয় দৈব আপদ। এ ধরনের আপদের পতিকার মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। যে কারণে এ ধরনের আপদ হতে অবমুক্তির জন্য উপশম দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের প্রতি প্রণাম নিবেদন অত্যাবশ্যক।

দশম অধিকরণ। প্রকরণ ১৪৭-১৫৯।

সাংগ্রামিক (যুদ্ধ সম্পর্কিত) নামক দশম অধিকরণের তেরটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—

১. স্কন্ধাবার তথা সেনাশিবির স্থাপন ২. স্কন্ধাবারপ্রয়াণ তথা সেনা শিবির প্রত্যাহার ৩. বলব্যসন ও অবস্কন্দন কাল তথা অভিযানকালের দুর্ভোগ ও সৈন্যদের সুরক্ষণ ৪. কূটযুদ্ধ তথা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক যুদ্ধ ৫. নিজ সেনাবাহিনীকে উদ্দীপ্তকরণ ৬. শত্রু সেনাদের তুলনায় অনুকূল অবস্থানে নিজ সৈন্যদের সমবেতকরণ ৭. যুদ্ধভূমির গুণাগুণ বিচার ৮. হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর সৈনিকদের করণীয় ৯. পক্ষ, কক্ষ ও উরস্য অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ১০. শৌর্যবান, বিশ্বস্ত ও দুর্বল সৈন্যদের বিভাজন অনুযায়ী পদায়ন ১১. পদাতিক, রথ, অশ্ব ও হস্তি বাহিনীর যুদ্ধ ১২. সরলাকৃতি, সর্পাকৃতি ও বৃত্তাকৃতির বাহিনী বিন্যাস ১৩. পূর্বোক্ত ব্যূহসমূহের প্রতিব্যূহ রচনা

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন