দশম অধিকরণ (যুদ্ধ)

দশম অধিকরণ

প্রথম অধ্যায় ॥ ১৪৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজা কোন পরিস্থিতিতে যুদ্ধযাত্রায় প্রবৃত্ত হবেন, যুদ্ধাভিযানকালে কি কি বিষয় বিবেচনায় এনে সেনাবাহিনী পদায়ন করবেন, কোথায় সেনাশিবির স্থাপন করবেন, সেনাশিবিরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে, শিবিরের কোন স্থানে কার আবাসন নির্মিত হবে, শত্রু আগমনের পথে কীভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন, ইত্যাকার বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

১০-০১-০১ স্থাপত্যবিদ্যায় বিদগ্ধ স্থপতি, সেনাধ্যক্ষ এবং গৃহনির্মাণের শুভক্ষণ নির্ণায়ক মৌহূর্তিক, এই তিনজনের পরামর্শক্রমে রাজা সেনাশিবির নির্মাণ করাবেন। এই সেনাশিবির বৃত্তাকৃতির হতে পারে, চতুষ্কোণ বিশিষ্ট হতে পারে কিংবা দীর্ঘতর হতে পারে। অথবা ভূমির অবস্থান অনুযায়ী সুবিধাজনক আকৃতির হতে পারে। সৈন্যদের আগমন-নির্গমনের সুবিধার্থে নির্মিতব্য শিবিরের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে চারটি দ্বারের সংস্থান রাখতে হবে। এছাড়াও পূর্ব- পশ্চিমে এবং উত্তর-দক্ষিণে আয়ত তিনটি চলাচল পথ থাকবে এবং শিবিরটি হতে হবে নয়ভাগে বিভাজিত। শত্রু কর্তৃক আক্রমণের ভীতি প্রতিভাত হলে কিংবা দীর্ঘকাল শিবিরে অবস্থান আবশ্যক বলে প্রতীয়মান হলে, শিবিরটিকে পরিখা অথবা দেয়াল বেষ্টনির মাধ্যমে সুরক্ষিত করতে হবে এবং এর সাথে পর্যবেক্ষণ বেদি নির্মাণ করাতে হবে।

১০-০১-০২ সেনা শিবিরের মধ্যস্থলের নবমাংশের উত্তরদিকে রাজার আবাসন নির্মাণ করতে হবে। এই আবাসনের দৈর্ঘ্যের পরিমিতি হবে একশ ধনু (এক ধনুতে প্রায় দুই মিটার) এবং এর প্রস্থ হবে পঞ্চাশ ধনু পরিমিতিসম্পন্ন। আবাসনের পশ্চিম দিকে নির্মিত হবে স্ত্রীগণের অন্তঃপুর, এর সন্নিকটে হবে অন্তঃপুরের রক্ষীদের আবাসন, সম্মুখভাবে নির্মিত হবে রাজার দর্শনার্থীদের জন্য বৈঠকখানা, দক্ষিণের দিকে নির্মিত হবে রাজকোষ, রাজাদেশ লিখন ও প্রেরণের কার্যালয় এবং শিবির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত লোকবলের আবাস।

আবাসনের বামদিকে রাজাকে বহনকারী হস্তি, অশ্ব ও রথ রাখার স্থাপনা থাকবে, বাহন স্থানের পর একশত ধনুর ব্যবধানে পরপর চারটি পরিবেষ্টন স্থান থাকবে, যার প্রথমটি হবে শকট দ্বারা পরিবেষ্টিত, দ্বিতীয়টি হবে কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ শাখার দ্বারা পরিবেষ্টিত, তৃতীয়টি হবে দারুময় স্তম্ভ দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং চতুর্থটি হবে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত স্থান। এই পরিবেষ্টিত স্থানের প্রথমটির সম্মুখে নির্মিত হবে মন্ত্রী ও পুরোহিতদের আবাসন, এর দক্ষিণে কোষ্ঠাগার ও রন্ধনশালা এবং বামদিকে বনজ দ্রব্যের সংরক্ষণাগার ও অস্ত্রাগার। দ্বিতীয়টির সম্মুখে নির্মিত হবে মৌল (বংশপরম্পরায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত সৈন্য), বেতনভুক সৈন্য, রথবাহিনী, অশ্ববাহিনী এবং সেনাপতির অবস্থানের স্থাপনা। তৃতীয়টির সম্মুখে নির্মিত হবে হস্তিবাহিনী, শ্রেণিবল এবং প্রশাস্তা নামের শিবির তত্ত্বাবধায়কের স্থাপনা। চতুর্থটির সম্মুখে নির্মিত হবে কর্মকর, দশ সেনাপতির প্রধান এবং নিজ নিজ অধিনায়কের অধীনস্থ মিত্রবল, অমিত্রবল ও অটবিলের অবস্থানের স্থাপনা। বণিক ও বেশ্যাদের জন্য আবাসন নির্মাণ করাতে হবে পথের পাশে। শিকারি, সৈন্যদের আগমনবার্তা প্রচারকারী ঢোল বাদক এবং ছদ্মবেশী রক্ষকদের আবাসন নির্মাণ করাতে হবে সেনাশিবিরের বহিরাঙ্গনে।

১০-০১-০৩ রাজা কর্তৃক অনুমিত শত্রু আগমনের সম্ভাব্য পথে তৃণাচ্ছাদিত গভীর গর্ত এবং কাঁটাযুক্ত ফলক স্থাপন করতে হবে। শত্রুরা যেন কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সে লক্ষ্যে রাজা শিবিরস্থ অষ্টাদশ বর্গ তথা, মন্ত্রী, পুরোহিত, কোষ্ঠাগার, রন্ধনশালা, বনজ দ্রব্যের সংরক্ষণাগার, মৌল সৈন্য, ভূতক সৈন্য, অশ্ব-রথ, সেনাপতি, হাতি, শ্রেণিবল সৈন্য, শিবির তত্ত্বাবধায়ক, মিত্র সেনা, অমিত্র সেনা, অটবি সেনা, বণিক, বেশ্যা এবং শিকারিদের আবাসন তথা অবস্থানস্থলের রদবদল ঘটাবেন।

শত্রু কর্তৃক নিয়োজিত গুপ্তচরদের অপতৎপরতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকার জন্য রাজা দিনের বেলাতেও শিবির পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তিনি শিবিরে অবস্থানরত সৈন্যদের পারস্পরিক বিবাদ, জুয়াখেলা, মদ্যপান ও কৌতুকপূর্ণ আড্ডাবাজি হতে নিবৃত করবেন। অনুমতিপত্র (গেটপাশ) ব্যতিরেকে সাধারণ জনতার শিবিরে প্রবেশ ও নির্গমন নিরোধ করাবেন। বিনা অনুমতিতে কোনো সৈনিক যদি যুদ্ধাভিযান হতে প্রত্যাবর্তন করে, তাহলে রাজা তাকে অবরুদ্ধ করাবেন। রাজা সপরিবারে কোথাও গমনের পূর্বেই শিবির তত্ত্বাবধায়ক যাত্রাপথের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং রাজার অবস্থান স্থানের যাবতীয় সুবিধাদিসহ জল সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ১৪৮–১৪৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজার সেনানিবাস অভিমুখে যাত্রা, দীর্ঘপথের যুদ্ধাভিযান, সৈন্যদের পথের ক্লান্তি, ক্লান্তি নিরসনের উপায়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও খাদ্য ও যুদ্ধোপকরণ পরিবহন, সেনাভিযানের বিন্যাস, অভিযানের দ্রুততা, ধীরগতি, নদী পারাপার, রাজসেনাদের হেফাজত, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

১০-০২-০১ যুদ্ধাভিযানে অগ্রসরকালে পথিমধ্যে গ্রাম ও অরণ্য এলাকার যেখানে সাময়িক অবস্থান গ্রহণ আবশ্যক হবে, রাজাকে পূর্বাহ্নেই সে এলাকার তৃণভূমি, জ্বালানির যোগান এবং পানি প্রাপ্যতার বিষয়ে অবহিত হতে হবে, অতঃপর সে-পথে যাত্রা করতে হবে। অভিযানকালে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও উপকরণের দ্বিগুণ পরিমাণ মজুদ সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করতে হবে। এসব খাদ্য ও উপকরণ বৃষাদির মাধ্যমে বহন করাতে হবে, তাদের দিয়ে এসব পরিবহন করা সম্ভব না হলে সৈনিকদের দিয়ে তা বহন করাতে হবে অথবা যাত্রাপথের বিরতিস্থানে আগে থেকেই সেসব প্রয়োজনীয় খাদ্য ও উপকরণ মজুদ রাখতে হবে।

১০-০২-০২ যুদ্ধাভিযানকালে—অগ্রভাগে অবস্থান করবে নায়ক বা দশজন সেনাপতির অধিনায়ক, মধ্যভাগে অবস্থান করবে রাজা ও তার পরিজন, পার্শ্ব আঘাত প্রতিহতকল্পে রাজার দুপাশে থাকবে অশ্বারোহী সৈন্য, সেনাবাহিনীর পশ্চাদভাগে থাকবে হস্তিবাহিনী, চতুর্দিকে থাকবে বহুল পরিমাণ পশুখাদ্য তথা তৃণ ও ধানের খড়। অভিযানকালে স্বদেশ হতে সরবরাহকৃত খাদ্যকে বলা হয় বীবধ, এই বীবধ সব সময় অভিযানকারীদের সঙ্গে পরিবাহিত হবে। মিত্র সেনার নাম আসার এবং রাজমহিষীদের অবস্থানের নাম অপসার, এরা উভয়ে অভিযানকালে সুরক্ষিতভাবে সঙ্গে গমন করবে। পেছনের দিকে পর্যায়ক্রমে সেনাদের পশ্চাদে তাদের সেনাপতিরা থাকবে।

১০-০২-০৩ সম্মুখদিক হতে শত্রুবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হবার আশঙ্কা অনুভূত হলে রাজাকে কুমিরাকৃতির সেনা-বিন্যাস নিয়ে অগ্রসর হতে হবে, পশ্চাদ দিক হতে এ ধরনের আক্রমণের আশঙ্কা অনুভূত হলে রথবাহিনীর মাধ্যমে ব্যূহ রচনা করে অগ্রসর হতে হবে, দু-পাশ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা থাকলে বজ্রব্যূহ, সর্বদিক হতে আক্রান্ত হবার ক্ষেত্রে সর্বতোভদ্র ব্যূহ এবং এক একজন শত্রু কর্তৃক আক্রান্তের ক্ষেত্রে সূচীব্যূহ রচনা করে অগ্রসর হতে হবে।

অভিযানকালে পথিমধ্যে যদি বহুপথজনিত কারণে সঠিক যাত্রাপথের প্রশ্নে সংশয়ের উদ্রেক হয়, সেক্ষেত্রে হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর জন্য যে পথ অনুকূল বলে প্রতীয়মান হবে, রাজাকে সেপথ ধরেই অগ্রসর হতে হবে। কারণ, অনুকূল পথে যাত্রাকালে শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। অভিযানকালে প্রতিদিন এক যোজন (প্রায় ১০ কিলোমিটার) পথ অতিক্রম করা সম্ভব হলে, তা হবে নিম্নগতির যাত্রা। দেড় যোজন পথ অতিক্রম করা সম্ভব হলে, তা হবে মধ্যমগতি এবং দুই যোজন পথ অতিক্রম করা সম্ভব হলে তা হবে উত্তমগতির যাত্রা। প্রয়োজনে পরিবেশ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এর চেয়ে অধিক গতিতেও রাজা তার সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে পারেন।

১০-০২-০৪ অভিযান প্রাক্কালের দ্রুতগতি ও ধীরগতির পরিপ্রেক্ষিত, রাজা যখন মনে করবেন–নিজের সুবিধার্থে অন্য কোনো নৃপতির কাছে আশ্রয়গ্রহণ আবশ্যক। শত্রুর ধন-সম্পদের বিনাশসাধন আবশ্যক। নিজের পশ্চাদশত্রু, মিত্রবল, মধ্যম ও উদাসীন নৃপতিকে অবদমনকরণ আবশ্যক। নিজের কোষ, সেনাবাহিনী, মিত্রসেনা, অমিত্রসেনা, অটবি সেনা, কর্মকর সংগ্রহের জন্য বা যুদ্ধের উপযুক্ত ঋতুর জন্য সময় ক্ষেপণ আবশ্যক। ভাড়াটে সেনা বা মিত্ৰ সেনারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। যুদ্ধ ছাড়াই শত্রু নৃপতি আত্মসমর্পণ করতে পারে। তখন রাজা দ্রুতগতিতে অগ্রসর না হয়ে আক্রমণের জন্য ধীরগতিতে অগ্রসর হবেন। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে, তাকে দ্রুতগতিতে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হতে হবে।

১০-০২-০৫ সৈন্যদের নদী পারাপার—অভিযানকালে নদী পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হলে, হাতি ও নৌকার সাহায্যে, সাঁকো নির্মাণ করে, বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে চলাচল পথ সৃষ্টি করে, বাঁশ, চামড়া কিংবা কাঠের ভেলার মাধ্যমে সৈন্যদের পারাপারের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীর পারাপার ঘাট যদি শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে রাত্রিতে অতি সন্তর্পণে অঘাট দিয়ে হাতি ও অশ্বের সাহায্যে সৈন্যদের নদী পার করাতে হবে। জলহীন এলাকা দিয়ে অভিযানের সময় গন্তব্যের দূরত্ব বিবেচনা করে বাহন ক্ষমতার নিরিখে জল বহন করাতে হবে।

১০-০২-০৬ রাজার কাছে যখন প্রতীয়মান হবে—তার সৈন্যদের দীর্ঘ দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে, পানিহীন পথে অগ্রসর হতে হবে, তৃণ ও জ্বালানিহীন পথে অগ্রসর হতে হবে অথবা সৈন্যরা শত্রুর আক্রমণে অবসন্ন হয়ে পড়েছে, ক্ষুধা পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছে, পথশ্রমে পরিশ্রান্ত হয়েছে অথবা তারা গভীর জলপথ পারি দিতে ব্যাপৃত, পাহাড়ি বন্ধুর পথে আরোহণ বা অবরোহণে ব্যাপৃত অথবা তারা নিরাপত্তা আবরণরহিত হয়ে পড়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সমবেত হয়েছে অথবা তারা ভোজনে বা নিদ্রায় নিমগ্ন, ব্যাধি বা মড়ক পীড়িত অথবা তার হস্তি বা অশ্বরা রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, সৈন্যরা প্রতিকূল ভূমিতে অবস্থান করছে, তখন তিনি নিজ সৈন্যদের রক্ষার্থে কার্যকর প্রয়াস গ্রহণ করবেন। অন্যদিকে শত্রুসৈন্যরা এ ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিপতিত হলে তিনি তাদের উপর আঘাত হানবেন।

১০-০২-০৭ শত্রুর সৈন্যসংখ্যা নিরূপণ ও পলায়ন সুবিধা—শত্রুর সৈন্যরা যখন এক এক করে সংকীর্ণ পথ ধরে অগ্রসর হবে, তখন তাদের গণনা করে মোট সংখ্যা সম্পর্কে রাজা পরিজ্ঞাত হবেন। এছাড়াও তিনি হাতির ভোজ্যসংখ্যা, যোদ্ধাদের আহার সংখ্যা, শয্যাসংখ্যা, রন্ধন চুল্লির সংখ্যা এবং সমরাস্ত্রের সংখ্যা সম্পর্কে অবহিত হয়ে শত্রুর সমর প্রস্তুতির বিষয়ে সম্যক অবহিত হবেন। এছাড়াও প্রয়োজনের সময় নিজ সৈন্যরা যেন নিরাপদে পালাতে পারে বা পেছনের পর্বত কিংবা বনদুর্গে আশ্রয় লাভ করতে পারে, সেসব বিবেচনায় রেখে রাজাকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হবে।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ১৫০-১৫১-১৫২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে শত্রুর বিরুদ্ধে কপট যুদ্ধ, প্রকাশ্য যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে উৎসাহদান এবং শত্রু সৈন্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কৌশলগত ব্যূহ রচনার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে কোন অবস্থায় শত্রুকে আঘাত হানতে হবে, রাজার ওত্ পেতে থাকা, আকস্মিক আক্রমণ, সৈন্যদের উৎসাহিতকরণ, ভূমির প্রকৃতি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর পদায়ন, পরাভূত শত্রুর সঙ্গে সন্ধির প্রকৃতি, ইত্যাকার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

১০-০৩-০১ রাজা যখন শত্রুর তুলনায় অধিক সংখ্যক যুদ্ধে পারদর্শী সাহসী সৈন্যের অধিকারী হবেন, শত্রু শিবির আক্রমণের সক্ষমতা অর্জন করবেন এবং ঋতু যখন তার অনুকূলে থাকবে, তখন তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাকাশ্যযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে প্রকাশ্যযুদ্ধ পরিহার করে তিনি কূট বা গোপনযুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন। শত্রুর শক্তি ক্ষয় হলে, দীর্ঘপথ পরিক্রমায় শত্রু সৈন্যরা পরিশ্রান্ত হলে, তারা জল সংকটে নিপতিত হলে, প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান করলে, রাজা অনুকূল অবস্থানে থেকে শত্রুর উপর আঘাত হানবেন।

অথবা তিনি তার বিশ্বাসঘাতক, অমিত্র ও অটবি সেনাদের যুদ্ধে প্রেরণ করে বাহ্যিকভাবে পরাজয় বরণের ভান করবেন, অতঃপর গোপন অবস্থান থেকে বেরিয়ে শত্রুর উপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরাভূত করবেন।

১০-০৩-০২ আক্রান্ত হবার পর শত্রু সেনারা যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়বে, তখন রাজা তার সংহত সৈন্যদের নিয়ে তাদের উপর আঘাত হানবেন। সম্মুখভাগে আক্রান্ত হয়ে শত্রু সেনারা যখন পশ্চাদদিকে পলায়ন করতে উদ্যত হবে তখন হস্তি ও অশ্বারোহী বাহিনী দিয়ে রাজা তাদের ঘাতিত করাবেন এবং পশ্চাদদিক হতে আক্রান্ত হয়ে তারা যখন সম্মুখভাগ দিয়ে পলায়ন করতে উদ্যত হবেন, তখন বলবান সেনাদের দিয়ে তাদের হত্যা করাবেন। দুপাশে পলায়নপর সেনাদেরও একই কায়দায় হত্যা করাবেন।

আক্রমণের সময় যেদিকে শত্রুর বিশ্বাসঘাতক ও দুর্বল সৈন্যরা পদায়িত থাকবে সে দিকেই রাজাকে প্রথমে আঘাত হানতে হবে। শত্রু সেনাদের সম্মুখে যদি বন্ধুর ভূমি থাকে সেক্ষেত্রে পেছন থেকে এবং পেছনে যদি বন্ধুর ভূমির অবস্থান থাকে, সেক্ষেত্রে সম্মুখ থেকে রাজা কর্তৃক তাদের উপর আক্রমণ চালাতে হবে। পার্শ্বদেশে আঘাতের ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

১০-০৩-০৩ যুদ্ধের সময় রাজা তার সন্দেহভাজন, অমিত্র এবং অটবি সেনাদের দিয়ে যুদ্ধ করিয়ে শত্রু সেনাদের পরিশ্রান্ত করাবেন, অতঃপর নিজে অশ্রান্ত থেকে তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানবেন অথবা কৌশলে নিজের বিশ্বাসঘাতক সেনাদের শত্রু কর্তৃক পরাভূত করিয়ে শত্রুর বাহ্যিক জয় নিশ্চিত করাবেন এবং শত্রু সেনারা যখন বিজয় উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে পড়বে তখন রাজা তার গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে হঠাৎ শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের বিপর্যস্ত করবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব শত্রুসেনা নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে লুণ্ঠনকার্যে উন্মত্ত হবে, রাজা ঠাণ্ডা মাথায় তাদের হত্যা করবেন। রাজা তার সাহসী সেনাদের সঙ্গে নিয়ে শত্রু সেনাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদের বীরযোদ্ধাদের হত্যা করবেন অথবা হিংস্রজন্তু শিকার করার জন্য শত্রুপক্ষের বীরযোদ্ধাদের প্রলুব্ধ করবেন এবং তারা যখন শিকারে মত্ত হবে তখন লুকায়িত স্থান থেকে বেরিয়ে তিনি তাদের হত্যা করবেন।

১০-০৩-০৪ রাজা রাত্রিকালে শিবিরে অকস্মাৎ আক্রমণ করে শত্রু সেনাদের রাত্রি জাগরণে বাধ্য করবেন, অতঃপর দিনে যখন তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে সমবেত হবে অথবা বীররা যখন দিবা নিদ্ৰায় নিমগ্ন থাকবে তখন তিনি তাদের আক্রমণ করে হত্যা করবেন এবং পদতলে চামড়ার আচ্ছাদনযুক্ত হাতিদের দিয়ে ঘুমন্ত বীরদের পদদলিত করিয়ে হত্যা করাবেন। দিনের পূর্বাহ্নে অস্ত্রাদি বহন করে যেসব সৈন্য পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে তাদের তিনি অপরাহ্নে আক্রমণ করে হত্যা করবেন। তিনি গোলাকার পাথরে পরিপূর্ণ চামড়ার বস্তা গরু-মহিষ-উটের পিঠে চাপিয়ে শত্রু বাহিনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করাবেন, অতঃপর পাথরের ঘর্ষণজনিত আওয়াজে শত্রুপক্ষের অশ্ব ও হাতিরা যখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকবে তখন বিশৃঙ্খলাজনিত কারণে শত্রুনৃপতি আর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে সাহসী হবে না, এই সুযোগে রাজা শত্রুর শক্তিনাশ করবেন। প্রচণ্ড গরমে কিংবা ঝড়ো হাওয়াতেও রাজা শত্রু সেনাদের বিনাশ করতে প্রবৃত্ত হবেন।

১০-০৩-০৫ কৌশলে শত্রু নিধনের নিমিত্ত রাজা মরুস্থানে, লতাগুল্মে কণ্টকিত দুষ্প্রবেশ্য স্থানে, কর্দমাক্ত প্রবেশপথযুক্ত আস্তানায়, পাহাড়ি এলাকায়, জলাভূমিতে, কুয়াশাচ্ছন্ন স্থানে অথবা নৌকায়, শকটে কিংবা রাতের অন্ধকারে সন্তর্পণে ওত্ পেতে থাকবেন। এ ধরনের লুকায়িত অবস্থানের আবশ্যকতা কূট বা গুপ্তযুদ্ধ প্রাক্কালে অধিক প্রয়োজন হয়। প্রকাশ্যযুদ্ধ সুনির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে, এ কারণে এ ধরনের যুদ্ধ ধর্মনিষ্ঠ বলে পরিগণিত হয়।

১০-০৩-০৬ যুদ্ধকালে রাজা তার সৈনিকদের এ কথা বলে উদ্দীপ্ত করবেন যে তিনিও তাদের মতো একজন বেতনভোগী সামান্য যোদ্ধা, যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলে সমবেতভাবে সকলে তার সুফল ভোগ করবে, অতএব সকলের সমন্বয়ে নির্দিষ্ট শত্রুর বিনাশ করতে হবে। এছাড়াও মন্ত্রী পুরোহিতরাও রাজার হয়ে যোদ্ধাদের অনুপ্রাণীত করার জন্য ধর্মগ্রন্থ বেদ’র উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা প্রচার করবেন যে যজ্ঞের সমাপ্তিতে বীরগণের যেমন স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে, যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলে তারাও তদ্রূপ স্বর্গলাভ করবে এবং রাজার অন্নে প্রতিপালিত হয়ে যারা রাজার কল্যাণের জন্য যুদ্ধ না করে যুদ্ধ হতে বিরত থাকবে পরকালে তারা নরকে গমন করবে।

১০-০৩-০৭ এছাড়াও রাজার দৈবজ্ঞরা সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণীত করার জন্য বিভিন্ন তরিকায় উৎসাহ প্রদান করবে এবং শত্রু সৈন্যদের মনে ভীতি ও শঙ্কা উৎপাদন করাবে। যুদ্ধের দিনক্ষণের ব্যাপারে নিশ্চিত হলে, যুদ্ধের পূর্বদিনে রাজা উপবাস করবেন এবং অস্ত্র ও শটের সান্নিধ্যে রাত্রিতে শয়ন করবেন। তিনি শত্রুনাশকারী মন্ত্রের মাধ্যমে যজ্ঞ করবেন এবং বিজয় লাভ অথবা মৃত্যুতে স্বর্গপ্রাপ্তি, এই প্রত্যয়ে নিজেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সমীপে সমৰ্পণ করবেন।

১০-০৩-০৮ শৌর্য, দক্ষতা, আভিজাত্য ও আনুগত্য গুণসম্পন্ন যে সমস্ত সৈন্য রাজা কর্তৃক সম্মানিত ও দানপ্রাপ্ত হয়ে পরিতৃপ্ত, রাজা তার নিরাপত্তার জন্য সেসব আস্থাভাজন মহাসৈন্যের নিরাপত্তা বলয়ে অবস্থান করবেন। রাজার অবস্থানস্থল হতে হবে বংশপরম্পরায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত বিশ্বস্ত সেনা, পুত্র ও ভ্রাতার সশস্ত্র প্রহরাধীন। রাজাকে যেন শত্রুরা সহজে চিহ্নিত করতে না পারে সে জন্য তার অবস্থান স্থলের সেনা সদস্যরা হবে মস্তকভূষণ বা শিরোস্ত্রাণরহিত। তিনি যেন সহজে হস্তি বা রথ ব্যবহার করতে পারেন সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকন্তু শত্রুর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য সেনা সমাবেশের সর্বোৎকৃষ্ট স্থানে রাজার পরিবর্তে অন্য কোনো রাজপুরুষকে অবস্থান করাতে হবে।

১০-০৩-০৯ পুরাণবিদ, ইতিহাসবিদ এবং মাগধ তথা স্তুতি পাঠকগণ যুদ্ধকালে বীরদের জন্য স্বর্গপ্রাপ্তি এবং ভীরুদের জন্য নরকপ্রাপ্তির কথা প্রচার করবে। তারা যোদ্ধাদের জাতি, সংঘ, কুল, কর্ম ও আচরণ-সম্পর্কিত গুণাবলির কীর্তন করে যুদ্ধের জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করবে। পুরোহিতগণ শত্রু হিংসিনী দেবতার কাছে রাজশত্রু নিপাতের যজ্ঞ করে তা রাজাকে অবহিত করবেন। যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাঠমিস্ত্রী, কর্মকর, শিল্পী এবং যুদ্ধের মুহূর্ত নির্ণায়ক তথা মৌহূর্তিকগণ নিজ নিজ কাজের অগ্রগতি এবং শত্রুদের অনুরূপ কাজের অধঃগতির কথা রাজার সমীপে প্রতিনিয়ত নিবেদন করবে।

১০-০৩-১০ এছাড়াও রাজার সেনাপতি সাধারণ সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করার জন্য এরূপ ঘোষণা দিয়ে উৎসাহিত করবেন যে, যে সৈনিক শত্রুনৃপতিকে হত্যা করবেন তিনি পুরস্কার হিসেবে লাভ করবেন লক্ষ পণ, শত্রুর কুমারকে হত্যার ক্ষেত্রে লাভ করবেন ৫০ হাজার পণ, শত্রুর কোনো বীরযোদ্ধাকে হত্যা করলে লাভ করবেন ১০ হাজার পণ, শত্রুর হাতি বা রথ ধ্বংস করতে পারলে লাভ করবেন পাঁচ হাজার পণ, অশ্ব হত্যা করলে লাভ করবেন এক হাজার পণ, পদাতিক বাহিনীর কোনো অধিনায়ককে হত্যা করলে লাভ করবেন একশত পণ, কোনো সাধারণ সৈনিকের মস্তক কর্তন করলে লাভ করবেন বিশ পণ।

যে সৈনিক যুদ্ধকালে উপরোক্ত কর্মের যে কোনো একটি সম্পাদনে সক্ষম হবেন তিনি ঘোষিত পুরস্কার ছাড়াও প্রাপ্য খাদ্য ও বেতনের দ্বিগুণ লাভ করবেন এবং বিজিত দেশের লুণ্ঠিত সম্পদের অধিকারী হবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ, ঔষধ ও ক্ষতস্থান নিরাময়ের বস্ত্রসমেত সর্বদা উপস্থিত থাকবেন। খাদ্য পরিবেশনকারী সেবিকারা পর্যাপ্ত পরিমাণে সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয় নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের পশ্চাদে অবস্থান করবে এবং হর্ষধ্বনি প্রদান করে লড়াইয়ের ময়দানে সৈন্যদের উৎসাহিত করবে।

১০-০৩-১১ যুদ্ধকালে রাজা তার সেনা সদস্যদের এমনভাবে যুদ্ধের ময়দানে পদায়িত করবেন যেন তাদের মুখ দক্ষিণ দিকে না থাকে। কারণ, দক্ষিণে মুখ করে অবস্থান করলে সৈনিকরা সূর্যরশ্মির প্রভাবে উৎপীড়িত হতে পারে, এছাড়া তাদের এমনভাবে পদায়িত করতে হবে যাতে করে বাতাস অনুকূলে প্রবাহিত হয়। শত্রুনৃপতির সেনা সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য রাজা তার অশ্বসমূহকে শত্রু শিবিরের দিকে ধাবিত করিয়ে শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করাবেন।

যে এলাকা দীর্ঘকালীন অবস্থান এবং দ্রুতকার্য সিদ্ধির জন্য অনুকূল নয়, সে এলাকায় অবস্থাকালে রাজা শত্রুনৃপতি কর্তৃক পরাজিত হতে পারেন। কিন্তু এর বৈপরীত্য ঘটলে রাজা বিজয় লাভে সক্ষম হবেন। এ কারণে রাজাকে যুদ্ধের সময় অনুকূল ভূমিতে সেনা শিবির স্থাপন করতে হবে।

সেনা সমাবেশকালে তিন প্রকৃতির ভূমি হতে পারে—১. সমতল ভূমি ২. অসমতল বা বন্ধুর ভূমি এবং ৩. মিশ্রভূমি। এ ধরনের ভূমির কোনটির অবস্থান পশ্চাদে, সম্মুখ বা পার্শ্বে তা সুচারুরূপে নির্ণয় করতে হবে। ভূমির অবস্থান অনুযায়ী সমতল ভূমিতে দণ্ডাকার বা সরল রেখার মতো ব্যূহ বা বৃত্তাকৃতির ব্যূহ, বন্ধুর ভূমির ক্ষেত্রে সর্পাকৃতির বা চারিদিক ব্যাপৃত ছড়ানো ছিটানো আকৃতির ব্যূহ এবং মিশ্রভূমির ক্ষেত্রে মিশ্র প্রকৃতির ব্যূহরচিত হতে পারে।

শত্রুর বিপর্যস্ত অবস্থায় রাজার করণীয়—অধিক বলশালী শত্রুকে পরাভূত করার পর রাজা স্ব-উদ্যোগে তার সঙ্গে সন্ধিতে আবদ্ধ হবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন। সমশক্তিসম্পন্ন শত্রু পরাভূত হলে পরাজিত শত্রু কর্তৃক যাচিত হয়ে রাজা তার সঙ্গে সন্ধি সম্পাদন করবেন, এরূপ ক্ষেত্রে রাজা উপযাচক হয়ে সন্ধি সম্পাদনে আগ্রহ প্রদর্শন করবেন না। হীন শক্তিসম্পন্ন শত্রু পরাভূত হলে রাজা তাকে উপর্যপুরি আক্রমণে নিঃশেষ করে দিবেন, যাতে করে সেই শত্রু আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু এ ধরনের শত্রুনৃপতি যদি রাজার কাছে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক হন, সেক্ষেত্রে রাজা তাকে ধ্বংস করা হতে বিরত থাকবেন।

১০-০৩-১২ অনেক সময় দুর্বলশত্রুরা জীবন সম্পর্কে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পুনরায় লড়াইয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করে থাকেন কিন্তু এক্ষেত্রে তারা আর যুদ্ধ করার মতো অবস্থানে থাকেন না, এ কারণে এ ধরনের শত্রুদের রাজা পুনরায় আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করবেন না।

চতুর্থ অধ্যায় ॥ ১৫৩–১৫৪ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে যুদ্ধের উপযোগী ভূমি। পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী এবং গজারোহী বাহিনীর অনুকূল ভূমি এবং যুদ্ধকালীন অবস্থায় এ সমস্ত বাহিনীর করণীয় সম্পর্কিত বিষয় আলোচিত হয়েছে।

১০-০৪-০১ যুদ্ধের সময় পদাতিক, রথারোহী, অশ্বারোহী এবং গজারোহী বাহিনীর জন্য সমতল ভূমিই প্রত্যাশিত। মরুভূমি, বনভূমি, জলাভূমি ও স্থল প্রকৃতির ভূমি খনকযোদ্ধা, আকাশ যোদ্ধা, দিন ও রাত্রির যোদ্ধাদের জন্য অনুকূল হতে পারে। রথ বাহিনীর চলাচলের জন্য সমতল ভূমি আবশ্যক। এ ধরনের ভূমি হতে হবে সুদৃঢ় এবং বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, কাদা, বালি, ঢিবি, গর্ত ও ফাটল রহিত, যাতে করে চলাচলের সময় রথের ঢাকা বা অশ্বের খুর মাটিত প্রোথিত না হয়।

১০-০৪-০২ যে ভূমি নুড়ি পাথরযুক্ত, বৃক্ষ সজ্জিত, অতিক্রমযোগ্য ক্ষুদ্র গর্তবিশিষ্ট এবং স্বল্পফাটলযুক্ত সে ভূমি অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য অনুকূল বলে বিবেচিত হবে। যে ভূমি পাথর, বৃক্ষ, লতা, গুল্ম ও পিঁপড়ের ঢিবিতে বিস্তৃত, সে ভূমি পদাতিক বাহিনীর জন্য অনুকূল হতে পারে। যে ভূমির পর্বত, জলাশয় ও বন্ধুর এবং হাতির জন্য সহজগম্য, সেই ভূমি হাতি চলাচলের অনুকূল ভূমি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

১০-০৪-০৩ যে প্রকৃতির ভূমি প্রতিবন্ধকতাহীন, নিম্নাঞ্চলরহিত এবং পশ্চাদপসরণের জন্য সুবিধাজনক, সে প্রকৃতির ভূমি পদাতিক সেনাদের জন্য উত্তম ভূমি হিসেবে বিবেচিত। যে ভূমির সম্মুখে পশ্চাদে সহজে চলাচল করা যায়, যে ভূমি বৃক্ষের শেকড়, কাদা, জল ও পাথরযুক্ত মৃত্তিকা রহিত, সেই ভূমি অশ্ব চলাচলের জন্য উত্তম। যে ভূমি ধূলি, কাদা, বৃক্ষের ডালপালা ও নলখাগড়া রহিত, সেই ভূমি হস্তি চলাচলের জন্য উত্তম। যে ভূমি স্নানযোগ্য জলাধারযুক্ত, বিশ্রাম নেওয়ার যোগ্য, ভাঙনরহিত, কাদারহিত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চলাচলের উপযুক্ত, সেই ভূমি রথের জন্য উত্তম হিসেবে বিবেচ্য

১০-০৪-০৪ যুদ্ধকালে চতুরঙ্গ বাহিনীর ভূমিকা বিচার, অশ্বারোহী বাহিনীর ভূমিকা বা করণীয়—

১. অশ্বারোহী সেনারা স্বদেশে শত্রু সেনার অনুপ্রবেশ রোধ করবে এবং প্রয়োজনে অরণ্যময় প্রদেশের চোর ডাকাতের উপদ্রবের প্রতিকার করবে ২. শত্রুর জলাধার, পারাপার ঘাট, বায়ু প্রবাহের স্থান এবং সূর্যালোকের অনুকূল স্থান চিহ্নিত করে তা দখল করবে ৩. শত্রু সেনাদের খাদ্য ও সৈন্য সরবরাহের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে এবং নিজেদের সৈন্য ও খাদ্য সরবরাহ পথের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে ৪. যুদ্ধক্ষেত্রের আহত যোদ্ধাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে প্রেরণ করবে ৫. শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিধি বিস্তৃত করবে ৬. শত্রু সৈন্যর বিরুদ্ধে পার্শ্ব আঘাত হানবে ৭. শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে ঝটিকা আক্রমণ চালাবে ৮. নানাভাবে শত্রু সেনাদের উপর উৎপীড়ন অব্যাহত রাখবে ৯. শত্রুর সৈন্য সমাবেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের বিশৃঙ্খল করবে ১০. নিজ সৈন্যরা অবসন্ন হয়ে পড়লে তাদের উৎসাহিত করবে ১১. শত্রু সেনাদের আটক করবে ১২. শত্রু কর্তৃক আটককৃত নিজ সৈন্যদের ছিনিয়ে আনবে ১৩. নিজ সৈন্যদের অনুসরণরত শত্রু সেনাদের প্রতিরোধ করবে ১৪. শত্রুর সম্পদ লুণ্ঠন ও রাজকুমারকে অপহরণ করবে ১৫. শত্রু সেনাদের পশ্চাদদেশে ও সম্মুখভাগে আক্রমণ করবে ১৬. দুর্বল শত্রু সেনাদের ধাওয়া করে তাদের নির্মূল করবে ১৭. স্ব-পক্ষীয় পদাতিক সেনাদের নিরাপত্তা বিধান করবে এবং ১৮. যুদ্ধের ময়দানে স্বপক্ষীয় বিক্ষিপ্ত সেনাদের একত্রিত করাবে।

১০-০৫-০৫ যুদ্ধক্ষেত্রে হস্তি বাহিনীর ভূমিকা

১. হস্তিবাহিনী সেনাভিযানের অগ্রভাগে গমন করবে ২. প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট, আবাসনসহ সার্বিক নির্মাণ কাজে সহায়তা করবে ৩. শত্রু সেনাদের বিতাড়ন করবে ৪. নদী পারাপার এবং পানিতে অবতরণে সহায়তা করবে ৫. সারিবদ্ধভাবে আক্রমণার্থে শত্রুর দিকে ধাবিত হবে ৬. তৃণ-গুল্মাদি আচ্ছাদিত দুষ্প্রবেশ্য ও জনবহুল শত্রুর অবস্থানে প্রবেশ করবে ৭. শত্রু শিবিরে অগ্নি নিক্ষেপণ ও নিজ শিবিরের অগ্নিনির্বাপণের কাজে সহায়তা করবে ৮. অন্যের সহায়তা ব্যতিরেকে শুধু হস্তিবাহিনী নিয়ে বিজয় লাভে প্রবৃত্ত হবে ৯. বিচ্ছিন্ন সৈন্যদের একত্রীকরণে সহায়তা করবে ১০. সংঘবদ্ধ শত্রু সেনাদের বিচ্ছিন্ন করবে ১১. শত্রুর আক্রমণ ও অন্যান্য বিপদ নিরোধ করবে ১২. শত্রু সেনাদের হত্যা করবে ১৩. শত্রু সেনাদের মনে ভীতি উৎপাদন করবে ১৪. যুদ্ধ ক্ষেত্রে ত্রাস সঞ্চার করবে ১৫. নিজ সৈন্যদের মনে বলবান হিসেবে অহমিকার বিকাশ ঘটাবে ১৬. শত্রু সৈন্য আটক করবে ১৭. নিজ সৈন্যদের শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করবে ১৮. শত্রুর দুর্গের দেয়াল, ফটক ও ভবনাদি বিধ্বস্ত করবে এবং ১৯. নিজ রাজার রাজকোষ হেফাজত ও শত্রু রাজার অপহৃত কোষ বহন করবে।

১০-০৪-০৬ রথবাহিনীর ভূমিকা—

১. রথবাহিনী নিজ সৈন্যদের সুরক্ষা প্রদান করবে। ২. শত্রুপক্ষের চতুরঙ্গ বাহিনীর সমাবেশ বিঘ্নিত করবে। ৩. শত্রু সেনাদের আটক বা বন্দি করবে। ৪. শত্রুর বন্দিদশা থেকে নিজ সৈন্যদের উদ্ধার করবে। ৫. যুদ্ধক্ষেত্রের বিচ্ছিন্ন সেনাদের একত্রিত করবে। ৬. শত্রু সেনাদের সঙ্ঘবদ্ধতা বিনাশ করবে। ৭. শত্রু সেনাদের মনে ত্রাস উৎপাদন করবে। ৮. নিজ সৈন্যদের মনে গরিমার সঞ্চার করবে এবং ৯. যুদ্ধক্ষেত্রে ভীতিকর ধ্বনি উৎপাদন করবে।

পদাতিক বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধের ময়দানে স্থান-কালভেদে অস্ত্রধারণ করে শত্রুর বিরুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনপূর্বক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। যুদ্ধের সময় বেসামরিক সহায়ক লোকবলের ভূমিকা—১. তারা সেনাশিবির, রাস্তাঘাট, জলবাঁধ, জলাধারসহ যাবতীয় অবকাঠামো সচল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে ২. যুদ্ধ সহায়ক যন্ত্রপাতি, অস্ত্র, আভরণ এবং খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় বহন করবে ৩. যুদ্ধক্ষেত্রের পরিত্যক্ত অস্ত্র, আভরণ ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করবে এবং আহত যোদ্ধাদের নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্রে আনয়ন করবে।

১০-০৪-০৭ রাজার অশ্বের যোগান অল্প হলে তিনি রথচালনার কাজে অশ্বের সঙ্গে ষাঁড় ব্যবহার করবেন। পর্যাপ্ত হাতির অনুপস্থিতিতে অধিকহারে গাধা ও উট ব্যবহার করে হাতির ঘাটতি পূরণ করবেন।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ১৫৫-১৫৬–১৫৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে পক্ষ তথা সেনাসমাবেশের সম্মুখভাগের দুইপার্শ্ব, কক্ষ তথা সেনাসমাবেশের পশ্চাদভাগের দুই পার্শ্ব এবং উরস্য তথা সেনাসমাবেশের মধ্যভাগে সেনা সদস্যদের সংখ্যানুপাতে ব্যূহ রচনা, শক্তিমান ও দুর্বল সেনাদের বিভাজন এবং হস্তি, রথ, অশ্ব ও পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

১০-০৫-০১ রাজাকে যুদ্ধস্থান হতে পাঁচশ ধনু (এক ধনু চার হাত দূরত্বের সমপরিমাণ) দূরত্বে শিবির স্থান করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হবে। ভূমির প্রকৃতি অনুযায়ী এই দূরত্বের হেরফের হতে পারে। মুখ্য সৈনিকগণকে বিভিন্ন স্তরে পদায়ন করে সেনা ব্যূহ রচনা করতে হবে। সেনা মোতায়েনকালে এক পদাতিক সেনা হতে অন্য পদাতিক সেনার অবস্থানগত ব্যবধান হবে এক শম (এক শমে চৌদ্দ আঙুলের সমপরিমাণ দূরত্ব)। এক্ষেত্রে দুটি রথ এবং দুটি হস্তির অবস্থানগত ব্যবধান হবে পাঁচ শম। ভূ-প্রকৃতির অবস্থা-ভেদে এই ব্যবধানের হেরফের হতে পারে। এভাবে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে সৈন্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।

১০-০৫-০২ রাজা কর্তৃক ধনুকধারী সৈন্যদের পাঁচ আরত্নি (পাঁচ হাত পরিমিতি) ব্যবধানে অবস্থান গ্রহণ করাতে হবে। অশ্বসেনারা অবস্থান করবে পনেরো হাত ব্যবধানে, পঁচিশ হাত ব্যবধানে অবস্থান করবে রথ ও হস্তিবাহিনীর সেনাসদস্যরা। দুটিপক্ষ, দুটিকক্ষ এবং উরস্য, এই পাঁচটি অবস্থানের ব্যবধান হবে পঁচিশ হাত পরিমিত। অশ্বারোহী সৈন্যের সম্মুখে তিনজন করে প্রতিযোদ্ধা অবস্থান করবে। রথ ও হস্তিসেনার সম্মুখে পনেরোজন করে প্রতিযোদ্ধা অবস্থান করবে এবং সাথে পাঁচজন করে অশ্বারোহী যোদ্ধাও অবস্থান করবে। অশ্ব, রথ ও হস্তিসেনাদের সেবাকার্যের জন্য যথাক্রমে তিনজন এবং পনেরোজন করে পাদগোপ বা সেবক উপস্থিত থাকবে। উরস্য বা সেনাসমাবেশের মধ্যভাগে তিন কাতারে তিনজন করে নয়জন রথসেনা পদায়িত থাকবে। একইভাবে সেনা বিন্যাসের অগ্রভাগের দুপাশে এবং পশ্চাদের দুপাশে নয়জন করে রথসেনা পদায়িত থাকবে। এই পদ্ধতিতে একটি রথ সেনা ব্যূহের পাঁচটি অবস্থানে নয়জন করে মোট ৪৫ জন রথ সেনাকে পদায়ন করাতে হবে।

১০-০৫-০৩ প্রত্যেক রথের অগ্রভাগে পাঁচজন করে অশ্বারোহী সেনা অবস্থান করায় একটি রথব্যূহে বা বিন্যাসে মোট ৪৫ x ৫ = ২২৫ জন অশ্বসেনা অবস্থান করবে। অন্যদিকে প্রতিটি রথের অগ্রভাগে পনেরোজন করে প্রতিযোদ্ধার উপস্থিতিতে মোট প্রতিযোদ্ধার সংখ্যা হবে, ৪৫ x ১৫ = ৬৭৫ জন। এভাবে প্রতি অশ্বারোহী সেনার সঙ্গে তিনজন হিসেবে ২২৫ জনের জন্য মোট ৬৭৫ জন পাদগোপ অবস্থান করবে। অনুরূপভাবে রথ ও হস্তিসেনাদের সঙ্গে সে অনুপাতে পাদগোপ বা সেবকরা অবস্থান করবে।

এ ধরনের ব্যূহ বা রথসেনা বিন্যাসকে সমব্যূহ বলা হয়। তিন কাতারে নয়জন করে মোট পাঁচটি অবস্থানে ৪৫ জন রথসেনা পদায়িত হয়ে থাকে বিধায় এই বিন্যাসকে সমবিন্যাস বলা হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে রথসেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে এই বিন্যাসকে দশ প্রকার সমবিন্যাসে উন্নীত করা যেতে পারে। রথবিন্যাসের ক্ষেত্রে যদি উপরোক্ত পদ্ধতিতে সমানুপাতিক হার অনুসৃত না হয়, এক্ষেত্রে যদি বিন্যাসের অগ্রভাগের দুপাশে, পশ্চাদভাগের দুপাশে এবং মধ্যভাগে বিভিন্ন সংখ্যার রথসেনা পদায়িত হয়, তাহলে তা হবে বিষমব্যূহ বা বিষম বিন্যাস। এ প্রকৃতির বিন্যাসও দশ প্রকারে উন্নীত করা যেতে পারে।

১০-০৫-০৪ উপরোক্ত সম বা বিষম বিন্যাসের পরেও যদি অতিরিক্ত সৈন্য অবশিষ্ট থেকে যায়, সেক্ষেত্রে তাদের ব্যূহের বিভিন্ন অবস্থানে পদায়িত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাজা অবশিষ্ট সৈন্যদের তিনভাগে বিভাজিত করে অগ্রভাগে, পশ্চাদভাগে এবং মধ্যভাগে পদায়ন করবেন। হস্তি এবং অশ্ব বিন্যাসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে যাতে সেনা বিন্যাসে সৈনিকের আধিক্য না ঘটে সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। সৈন্যের আধিক্য হেতু অতিরিক্ত সৈন্যদের সেনা বিন্যাসে যুক্ত করে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করাকে বলা হয় আবাপ। পদাতিক সেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের বৃদ্ধিকে বলা হয় প্রত্যাবাপ। অশ্ব, রথ ও অশ্ব সেনার ক্ষেত্রে এমত বৃদ্ধি ঘটলে তা হয় অন্বাবাপ। এক্ষেত্রে রাজ বিরোধী অতিরিক্ত সেনাদের মাধ্যমে সেনা বিন্যাসে সৈনিক সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তা হবে অত্যাবাপ। এহেন পরিস্থিতিতে শত্রুর সেনাবাহিনীতে যে সংখ্যক আবাপ, প্রত্যাবাপ বা অন্বাবাপের উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হবে রাজা কর্তৃক সেনা বিন্যাসের সময় তা অপেক্ষা চারগুণ হতে আটগুণ পর্যন্ত এ ধরনের সৈন্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

১০-০৫-০৫ এভাবে রথ, হস্তি, অশ্ব ও পদাতিক সেনাদের একক বিন্যাস ছাড়াও হস্তি, রথ ও অশ্ব সেনার সমন্বয়ে ব্যামিশ্রব্যূহ রচনা করা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যামিশ্র ব্যূহের অন্তে হস্তিসেনা, অগ্রভাগে অশ্বসেনা এবং মধ্যভাগে রথসেনা পদায়ন করতে হবে। এ ধরনের বিন্যাস অন্যভাবেও গঠিত হতে পারে অর্থাৎ অন্তে অশ্বসেনা বা রথসেনা, অগ্রভাগে রথসেনা বা অশ্বসেনা এবং মধ্যভাগে অশ্বসেনা বা হস্তিসেনার সমন্বয়ে সেনাব্যূহ রচনা করা যেতে পারে।

কেবল হস্তিসেনার সমন্বয়ে গঠিত বিন্যাস বা ব্যূহকে বলা হয় শুদ্ধব্যূহ। এ ধরনের ব্যূহের মধ্যভাগে অবস্থান করবে যুদ্ধযোগ্য হস্তি, পশ্চাদভাগের দুপাশে অবস্থান করবে রাজার বাহনযোগ্য হস্তি এবং অগ্রভাগের দুপাশে অবস্থান করবে দুষ্টু প্রকৃতির হস্তি।

১০-০৫-০৬ শুদ্ধ অশ্বব্যূহের ক্ষেত্রে মধ্যভাগে অবস্থান করবে কবচধারী অশ্ব এবং অগ্র ও অন্তভাগের দুপাশে থাকবে বর্মহীন অশ্ব। মিশ্রব্যূহ গঠনের ক্ষেত্রে অগ্রভাগের দুপাশে থাকবে পদাতিক সৈন্য, অন্তের দুপাশে থাকবে অশ্বরোহী সৈন্য, পশ্চাদে হস্তি এবং সম্মুখে থাকবে রথ। অথবা শত্রুকে আঘাতের উপযোগী করে এই বিন্যাসের রদবদল করা যেতে পারে।

১০-০৫-০৭ হস্তি ও অশ্ব যদি উচ্চকুল ও জাতসম্পন্ন, ধৈর্যশীল, কর্মক্ষম বয়সসম্পন্ন, শারীরিক বলসম্পন্ন, উচ্চতাবিশিষ্ট, বেগবান ও তেজস্বী প্রকৃতির, প্রশিক্ষিত, স্থৈর্য, উদগ্রতা, বাধ্যগত এবং সদাচরণ গুণবিশিষ্ট হয়ে থাকে তাহলে তারা হবে মানসম্পন্ন। রাজা তার উচ্চ মানসম্পন্ন সৈন্য, হাতি, অশ্ব ও রথের এক তৃতীয়াংশকে ব্যূহের মধ্যভাগে পদায়িত করাবেন। অবশিষ্টদের অগ্র ও অন্তের দুপাশে পদায়িত করাবেন। কিঞ্চিৎ হীনমানদের পশ্চাদে পদায়ন করাবেন এবং অধিক হীনবলদের ব্যূহের অগ্রভাগে পদায়িত করাবেন। এ পদ্ধতিতে তিনি সকল প্রকৃতির সৈন্যকে যুদ্ধের ময়দানে সমবেত করাবেন।

১০-০৫-০৮ দুর্বল সৈন্যদের পশ্চাদে পদায়ন করিয়ে যুদ্ধ করালে আক্রমণকারী শত্রুর গতিবেগ এমনিতেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। ব্যূহ রচনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতর সেনাদের অগ্রভাগে এবং তুলনামূলক বিচারে দ্বিতীয় প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সেনাদের অন্তেও পদায়ন করা যায়। এছাড়াও শ্রেষ্ঠতার মানদণ্ডে তৃতীয় প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সেনাদের অগ্রভাগের দুপাশে এবং দুর্বল সেনাদের মধ্যভাগে পদায়ন করেও ব্যূহ রচনা করা যায়। এ ধরনের ব্যূহের বা প্রতিরক্ষা বিন্যাসের ফলে রাজার সৈন্যরা শত্রুর আক্রমণের ভয়ে সহসা বিচলিত হয়ে পড়ে না।

১০-০৫-০৯ এভাবে পাঁচটি অবস্থানে (অগ্রভাগের দুপাশ, অন্তভাগের দু- পাশ এবং মধ্যমভাগ) সৈন্য পদায়নের মাধ্যমে রাজা ব্যূহ রচনা করে তার একটি বা দুটি অংশকে দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে অক্রমণ পরিচালনা করাবে এবং অবশিষ্ট অংশকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিয়োজিত রাখবেন। শত্রুর সেনা নিবেশের যে অংশ দুর্বল সৈন্যসম্পন্ন, অশ্বারোহী বা হস্তি বাহিনীরহিত, বিশ্বাসঘাতক অমাত্য প্রভাবিত বা ভেদসম্পন্ন, সেই অংশে রাজা তার সাহসী সৈন্যদের দিয়ে আক্রমণ করাবে। রাজা তার দুর্বল সেনাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সংখ্যক সবল সেনা যুক্ত করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করাবেন। যুদ্ধক্ষেত্রের যেদিকে শত্রুপক্ষ অধিকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা যেদিক থেকে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা অনুভূত হবে, রাজা সেই দিকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করবেন।

১০-০৫-১০ যুদ্ধে চতুরঙ্গ বাহিনীর ভূমিকা—যুদ্ধকালে অশ্বারোহীবাহিনী নিম্নোক্ত তেরটি ক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন করবে, ১. অভিসরণ অর্থাৎ অক্রমণার্থে শত্রুবাহিনীর দিকে ধাবিত হবে ২. পরিসরণ অর্থাৎ বৃত্তাকারে শত্রুর অবস্থানের উপর আঘাত হানবে ৩. অতিসরণ অর্থাৎ সুঁচের মতো শত্রুর ব্যূহ ভেদ করে আক্রমণার্থে অগ্রসর হবে ৪. অপসরণ অর্থাৎ সুঁচের মতো ব্যূহভেদ করে আক্রমণ শেষে একই তরিকায় প্রত্যাবর্তন করবে ৫. উন্মুথ্যাবধান অর্থাৎ অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বহুসংখ্যক আক্রমণ শেষে পুনরায় একত্রিত হবে ৬. বলয় অর্থাৎ শত্রুব্যূহের দুপাশে সাঁড়াশি আক্রমণ পরিচালনা করবে ৭. গোমূত্রিকা অর্থাৎ গোমূত্র নিসৃতির আদলে শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানবে ৮. মণ্ডল অর্থাৎ আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুব্যূহের একাংশকে বিচ্ছিন্ন করে পরিবেষ্টনের মাধ্যমে আক্রমণ করবে ৯. প্রকীর্ণিকা অর্থাৎ একযোগে পুরোবাহিনী নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করবে ১০. ব্যবৃত্তপৃষ্ঠ অর্থাৎ প্রত্যাবর্তনের পর পুনরায় আক্রমণে প্রবৃত্ত হবে ১১. অনুবংশ অর্থাৎ শত্রুর দিকে ধাবিত পদাতিক সেনাদের অনুসরণ করে কার্যকর সহায়তা প্রদান করবে ১২. শত্রুর আক্রমণে নিজস্ব সেনারা ছত্রভঙ্গ হলে চতুর্দিক থেকে তাদের সুরক্ষা প্রদান করবে এবং ১৩. ভগ্নানুপাত অর্থাৎ বিপন্ন বা পলায়নপর শত্রু সেনাদের পেছনে ধাবিত হয়ে তাদের বিনাশ করবে।

হস্তিবাহিনী নিম্নোক্তভাবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে—১. প্রকীর্ণিকা ব্যতীত অশ্বারোহী বাহিনীর মতো সর্বপ্রকার আক্রমণে প্রবৃত্ত হবে এবং যুদ্ধে সহায়তা প্রদান করবে ২. শত্রু সেনার চতুরঙ্গ বাহিনীকে ধ্বংস করবে ৩. শত্রুসেনার ব্যূহ নাশ করবে ৪. শত্রু সমাবেশের দুর্বল স্থানে আঘাত হেনে তাদের বিপর্যস্ত করবে এবং ৫. শত্রুর সুপ্ত সেনাদের পদদলিত করবে।

রথবাহিনী নিম্নোক্তভাবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে—১. উন্মুথ্যাবধান ব্যতীত সর্বক্ষেত্রে অশ্ব ও হস্তি বাহিনীর মতো যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে ২. নিজের অবস্থান থেকে অগ্রসর হয়ে শত্রুর অবস্থানের উপর আক্রমণ করবে ৩. শত্রু সৈন্যদের পরাভূত করে অপসরণ করবে এবং ৪. নির্দিষ্ট অবস্থানে স্থির থেকে শত্রুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাবে। পদাতিক যোদ্ধারা দেশ কাল স্থানভেদে অস্ত্রের সাহায্যে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবে এবং গোপন যুদ্ধে শত্রু সৈন্যের বিনাশসাধন করবে।

১০-০৫-১১ উপরোক্তভাবে রাজা যুগ্ম এবং অযুগ্ম ব্যূহর মাধ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। শত্রুর চতুরঙ্গ বাহিনীর ব্যূহের মতো করে তিনিও তার প্রতিরক্ষা ব্যূহ সমৃদ্ধ করবেন। যুদ্ধের সময় রাজা সেনাব্যূহ হতে দুইশত ধনু পশ্চাদে অবস্থান করবেন। এতে করে সৈন্যরা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হলেও তার পক্ষে পুনসংগঠিতকরণ সম্ভব হবে। সেনাব্যূহের পশ্চাদে অবস্থান ব্যতিরেকে রাজা কখনো যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন না।

ষষ্ঠ অধ্যায় ॥ ১৫৮–১৫৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে শত্রুপক্ষের বিপরীতে দণ্ডব্যূহ তথা দণ্ডের ন্যায় দীর্ঘ, ভোগব্যূহ তথা সর্পের ন্যায় সর্পিলাকার, মণ্ডলব্যূহ তথা বৃত্তাকার এবং অসংহত তথা অগোছালো প্রকৃতির ব্যূহ রচনা বা সেনাবিন্যাসের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

১০-০৬-০১ ব্যূহ রচনার ক্ষেত্রে আচার্য শুক্রাচার্যের মতে– অগ্রভাগের দুপাশ, মধ্যভাগ এবং পশ্চাদভাগ, এই চার অবয়বযুক্ত ব্যূহ হতে পারে। আচার্য বৃহস্পতি মনে করেন—অগ্রভাগের দুভাগ, পশ্চাদভাগের দুভাগ, মধ্যভাগ এবং পৃষ্ঠভাগের সমন্বয়ে ছয় অবয়বযুক্ত ব্যূহ গঠিত হতে পারে। আচার্য শুক্র ও বৃহস্পতির মতানুযায়ী—পক্ষ, (অগ্রভাগের দুপাশ) কক্ষ (পশ্চাদভাগের দুভাগ) এবং উরস্য (মধ্যভাগ) এর বিভাজনভিত্তিক দণ্ড, ভোগ, মণ্ডল ও অসংহত নামের চার প্রকার ব্যূহ হতে পারে এবং এই ব্যূহভেদগুলো প্রকৃতিব্যূহ নামে অভিহিত হতে পারে। এ ব্যূহগুলোর মধ্যে যেটি তির্যকভাবে সংস্থাপিত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণার্থে এবং শত্রুর আক্রমণ প্রতিহতকল্পে ব্যবহৃত হয়, সেটিকে বলা হয় দণ্ডব্যূহ। উপরোক্ত ব্যূহের অবয়বসমূহের একটির পেছনে অন্যটি সর্পিলাকারে সংস্থাপিত হলে তা হবে ভোগব্যূহ। বৃত্তাকারে এই বৃহৎ রচিত হলে তা হবে মণ্ডলব্যূহ। শত্রুর বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক অবয়বের মাধ্যমে বৃহৎ রচিত হলে তা হবে অসংহতব্যূহ।

১০-০৬-০২ দণ্ডব্যূহাদির নিরূপণ—পক্ষদ্বয়, কক্ষদ্বয় এবং উরস্য অবয়ব যখন সরলরেখায় অবস্থান করে একত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে ধাবিত হয় এবং প্রতি আক্রমণ প্রতিহতকল্পে ব্যবহৃত হয়, তখন তা হয় দণ্ডব্যূহ। দণ্ডব্যূহে যখন পক্ষদ্বয় বা অগ্রভাগের দুপাশের অবয়ব এবং মধ্যস্থ অবয়ব শত্রুর আক্রমণ প্রতিহতকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে এবং কক্ষদ্বয় বা পশ্চাদের দুপাশের অবয়ব শত্রুর বিরুদ্ধে অক্রমণার্থে নিয়োজিত হয়, তখন তা দণ্ডব্যূহের বিকার প্রদর নামে অভিহিত হয়। কক্ষাভিমুখে ধাবিত শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করা হলে তা হবে দৃঢ়ক বিকার। যখন উক্ত দণ্ডব্যূহ পক্ষদ্বয় দীর্ঘসময় অতিক্রম করে আক্রমণার্থে অগ্রসর হবে তখন তা হবে অসহ্য বিকার। পক্ষদ্বয়কে স্বস্থানে সংস্থাপিত করে উরস্যের মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হলে তা হবে শ্যেন। উপরোক্ত প্রদরাদি চার প্রকার ব্যূহের বিপরীতে চার প্রকার ব্যূহ হতে পারে, যেমন—১. চাপব্যূহ ২. চাপকুক্ষিব্যূহ ৩. প্রতিষ্ঠব্যূহ এবং ৪. সুপ্রতিষ্ঠব্যূহ। কক্ষদ্বয়ের মাধ্যমে প্রতিক্রান্ত হলে তা হবে চাপব্যূহ। পক্ষদ্বয়ের মাধ্যমে প্রতিক্রান্ত হলে তা হবে চাপকুক্ষিব্যূহ। পক্ষদ্বয়ের মাধ্যমে প্ৰতিক্রান্ত হলে তা হবে প্রতিষ্ঠব্যূহ এবং পক্ষদ্বয় ও উরস্যের মাধ্যমে প্রতিক্রান্ত হলে তা হবে সুপ্রতিষ্ঠব্যূহ। এ পদ্ধতিতে দণ্ডব্যূহের আট প্রকার বিকার নির্ণিত।

যে দণ্ডব্যূহের পক্ষদ্বয় চাপের আকারপ্রাপ্ত হয়, তা সঞ্জয়ব্যূহ। যে দণ্ডব্যূহ উরস্য অবয়বের মাধ্যমে অতিক্রান্ত হয়, তা বিজয়ব্যূহ। যে দণ্ডব্যূহের পক্ষদ্বয় স্থুলকানের আকারধারণ করে, তা স্কুলকর্ণব্যূহ। বিজয়ব্যূহের তুলনায় যে ব্যূহের পক্ষদ্বয় দ্বিগুণ স্থুল হয়, তা বিশালবিজয়ব্যূহ। যে ব্যূহের পক্ষদ্বয় দুই কক্ষ ও উরস্যের সম পর্যায়ে বর্ধিত হয়, তা চমূমুখব্যূহ। যে ব্যূহের কক্ষদ্বয় দুই পক্ষ এবং উরস্যের সমপর্যায়ে বর্ধিত হয়, তা ঝষাস্যব্যূহ। যে দণ্ডব্যূহে পক্ষদ্বয়, কক্ষদ্বয় এবং উরস্যের সকল অবয়ব একত্রে সরলরেখায় অবস্থান করে শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়, তা সূচীব্যূহ। যে ব্যূহের কক্ষদ্বয়, পক্ষদ্বয় এবং উরস্যস্থানে দুটি দণ্ডব্যূহকে তির্যকভাবে স্থাপিত করা হয়, তা বলয়ব্যূহ। কোনো স্থানে এভাবে চারটি দণ্ডব্যূহ স্থাপিত হলে তা হবে দুর্জয়ব্যূহ। এভাবে দণ্ড-প্রদর-দৃঢ়ক- অসহ্য-শ্যেন-চাপ-চাপকুক্ষি-প্রতিষ্ঠ-সুপ্রতিষ্ঠ-সঞ্জয়-বিজয়-স্কুলকর্ণ-বিশালবিজয়- চমূমুখ-ঝষাস্য-সূচি-বলয়-দুর্জয় নির্ণিত।

১০-০৬-০৩ ভোগব্যূহের নিরূপণ—পক্ষদ্বয়, কক্ষদ্বয় এবং উরস্য, এই পাঁচটি অবয়ব সর্পিলাকারে শত্রুর দিকে ধাবিত হলে তা হবে ভোগব্যূহ। এই ভোগব্যূহ সাপের মতো সর্পিল বা গোমূত্রের মতো ভিন্নমাত্রিক হতে পারে। ভোগব্যূহের উরস্য বিভাজিত দণ্ডাকৃতি এবং পক্ষদ্বয়ের প্রতিটি অবিভাজিত দণ্ডাকৃতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলে তা হবে শকটব্যূহ। এর বৈপরীত্য হলে অর্থাৎ ব্যূহের উরস্য দণ্ডাকৃতি এবং পক্ষদ্বয়ের আকৃতি বিভাজিত দণ্ডাকৃতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলে তা হবে মকরব্যূহ। শকটব্যূহের সঙ্গে হস্তি, অশ্ব ও রথ সমন্বিত হলে, তা হবে পারিপতন্তকব্যূহ।

মণ্ডলব্যূহের নিরূপণ—ব্যূহের পক্ষদ্বয়, কক্ষদ্বয় এবং উরস্য শত্রুর বিরুদ্ধে বৃত্তাকারে আক্রমণের নিমিত্ত একীভূত হলে, তা হয় মণ্ডলব্যূহ। এই ব্যূহ সর্বতোভদ্র ও দুর্জয় নামে বিভাজিত। বৃত্তাকারভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রাক্কালে এই ব্যূহ সর্বতোভদ্র নামে অভিহিত এবং যখন দুই উরস্য, দুই পক্ষ এবং চার কক্ষের মাধ্যমে আট ভাগে বিভক্ত হয়ে এই ব্যূহ শত্রুর বিরুদ্ধে ধাবিত হয় তখন তা হয় দুর্জয় বা অষ্টানিকব্যূহ।

১০-০৬-০৪ পক্ষদ্বয়, কক্ষদ্বয় এবং উরস্য, এই পাঁচ অবয়বের সৈন্যরা অসংহতভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে ধাবিত হলে তা হবে অসংহতব্যূহ। এই ব্যূহ বজ্রব্যূহ এবং গোধাব্যূহ নামে বিভাজিত। উপরোক্ত পাঁচ অবয়বের সৈন্যকর্তৃক বজ্রাকৃতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালিত হলে তা হবে বজ্রব্যূহ এবং গোধা তথা গিরগিটির আকৃতিতে এই আক্রমণ পরিচালিত হলে তা হবে গোধাব্যূহ। এক্ষেত্রে পক্ষদ্বয়, উরস্য এবং প্রতিগ্রহ (পশ্চাদভাগ) এর সমন্বয়ে আক্রমণ পরিচালিত হলে তা হবে উদ্যানকব্যূহ বা কাকপদীব্যূহ। পক্ষদ্বয়, উরস্য এবং প্রতিগ্রহের যে কোনো তিনটি অবয়বের মাধ্যমে আক্রমণ পরিচালিত হলে তা হবে অর্ধচন্দ্রিকাব্যূহ বা কর্কটশৃঙ্গীব্যূহ। ব্যূহের উরস্যে রথ, কক্ষদ্বয়ে হস্তি এবং পৃষ্ঠদেশে অশ্ব সন্নিবেশিত হলে তা হবে অরিষ্টব্যূহ। ব্যূহে পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী এবং গজারোহী সৈন্য ক্রমানুসারে সন্নিবেশিত হলে তা হবে অচলব্যূহ। অপরদিকে ব্যূহে হস্তিসেনা, অশ্বসেনা, রথসেনা এবং পদাতিক সেনা ক্রমানুসারে সন্নিবেশিত হলে তা হবে অপ্রতিব্যূহসেনা।

১০-০৬-০৫ প্রতি আক্রমণের ক্ষেত্রে রাজাকে শত্রুর প্রদর ব্যূহের বিরুদ্ধে দৃঢ়ক ব্যূহ, দৃঢ়ক ব্যূহের বিরুদ্ধে অসহ্য ব্যূহ, শ্যেনব্যূহের বিরুদ্ধে চাপব্যূহ, প্রতিষ্ঠব্যূহের বিরুদ্ধে সুপ্রতিষ্টব্যূহ, সঞ্জয়ব্যূহের বিরুদ্ধে বিজয়ব্যূহ, স্কুলকর্ণব্যূহের বিরুদ্ধে বিশালবিজয়ব্যূহ এবং পারিপতন্তকব্যূহের বিরুদ্ধে সর্বতোভদ্রব্যূহ প্রেরণ করতে হবে। সর্বপ্রকার ব্যূহের প্রতিরোধে সক্ষম দুর্জয়ব্যূহের মাধ্যমে রাজা সকল প্রকার ব্যূহের বিরুদ্ধে প্রতিঘাত করবেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক, অশ্ব, রথ ও হস্তি বাহিনীকে আঘাত করার ক্ষেত্রে রাজাকে ক্রমানুযায়ী পরেরটি দিয়ে প্রথমটিকে প্রতিঘাত করতে হবে। অর্থাৎ তিনি পদাতিক সেনাদের অশ্বারোহী সেনাদের মাধ্যমে, অশ্বারোহী সেনাদের রথারোহী সেনাদের মাধ্যমে এবং রাথারোহী সেনাদের গজারোহী সেনাদের মাধ্যমে প্রতিঘাত করবেন। হীনবল শত্রু সৈন্যদের নিজের বলবান সৈন্য দিয়ে আঘাত হানাবেন।

একটি রথ বা হস্তি, ৫টি অশ্ব এবং ৩০ জন পদাতিক সৈন্যের সমন্বয়ে একটি সেনাঙ্গ গঠন করতে হবে। প্রতিটি সেনাঙ্গের অধিনায়কত্ব করবেন একজন পদিক। দশজন পদিকের অধিকর্তা বা অধিনায়ক হবেন একজন সেনাপতি এবং ১০ জন সেনাপতির অধিনায়কত্ব করবেন একজন নায়ক। এই নায়কই প্রকারান্তরে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃত। তিনি সেনাবাহিনীর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন, সেনাভিযান এবং প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্ব প্ৰদান করবেন, আক্রমণের আদেশ প্রদান করবেন, রণবাদ্য ও পতাকা প্রদর্শনের নির্দেশনা প্রদান করবেন এবং যুদ্ধ যাত্রার সংকেত প্রদান করবেন। তার নেতৃত্বেই যুদ্ধের সার্বিক কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হবে।

স্বপক্ষ এবং শত্রুপক্ষের ব্যূহ বা সেনাবিন্যাস সমশক্তিসম্পন্ন হলে, স্থান, কাল এবং শৌর্যের উৎকর্ষের নিরিখে যুদ্ধের সফলতা অর্জিত হয়ে থাকে।

১০-০৬-০৬ যুদ্ধের সময় রাজা শত্রুপক্ষের উদ্বেগ বৃদ্ধিকল্পে যন্ত্র প্রয়োগ করবেন, বিষ প্রয়োগ করবেন, গুপ্তচরদের মাধ্যমে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। ইন্দ্রজাল ও দৈব বিপত্তির কথা প্রচার করাবেন। শত্রুর বিরোধিতাকারী অমাত্যদের ক্ষোভের উদ্রেক করাবেন। শত্রু শিবিরে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টিকল্পে গবাদিপশুদের বিভ্রান্ত করে যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করাবেন। শত্রু শিবিরে অগ্নি প্রজ্বলন ও অসময়ে শত্রু শিবিরে আচমকা আক্রমণ করাবেন। গুপ্তচরদের দিয়ে শত্রুর দুর্গের অগ্নিকাণ্ড, দুর্গ দখল বা রাজবিদ্রোহের বিষয়ে অপপ্রচারণা চালাবেন। এভাবে শত্রুকে উদ্বিগ্নকরণে কৃতকার্য হলে রাজার বিজয়ের পথ প্রসারিত হবে।

যুদ্ধ অপেক্ষা প্রজ্ঞার মাধ্যমেই রাজন্যগণ সহজে অভীষ্ট অর্জনে সক্ষম হয়ে থাকেন। কারণ, সার্বিক বিবেচনায় বল অপেক্ষা বিদ্যা সর্বক্ষেত্রে অধিক শক্তিশালী। একজন তীরন্দাজের নিক্ষিপ্ত তীর নিশ্চিতভাবে কাউকে হত্যা করতেও পারে, নাও করতে পারে। কিন্তু বিদ্বান বা প্রজ্ঞাবানের প্রয়োগকৃত বুদ্ধির প্রভাবে মাতৃগর্ভস্থ শিশুও নিশ্চিতভাবে ঘাতিত হয়ে থাকে।

বিভিন্ন প্রকার বূহ্যের নমুনা—

বূহ্যের নমুনা
বূহ্যের নমুনা

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন