সপ্তম অধিকরণ (ষাড়গুণ্য)

সপ্তম অধিকরণ। প্রকরণ ৯৮–১২৬।

ষাড়গুণ্য (ছয়গুণ) নামক সপ্তম অধিকরণের উনত্রিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—

১. ষাড়গুণ্যসমুদ্দেশ বা ছয়টি গুণ তথা—

ক. সন্ধি (শান্তি, মিত্রতা বা চুক্তি) খ. বিগ্রহ (যুদ্ধ) গ. আসন (নিরপেক্ষাবস্থা) ঘ. যান (সেনাভিযান) ঙ. সংশ্রয় (আশ্রয়) এবং চ. দ্বৈধীভাব (দ্বৈতনীতি) ২. ক্ষয়স্থানবৃদ্ধিনিশ্চয় তথা শাসনজনিত ক্ষয়ক্ষতি, স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি ৩. সংশয়বৃত্তি তথা তুলনামূলকভাবে অধিক বলশালীর আশ্রয়ে অবস্থান ৪. সমশক্তি, হীনশক্তি ও উচ্চশক্তিসম্পন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ষাড়গুণের প্রয়োগ ৫. হীনশক্তি সম্পন্ন শত্রুর সঙ্গে অর্থ, সৈন্য ও ভূমি প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি স্থাপন ৬. বিগৃহ্যাসন তথা স্বরাজ্যে অবস্থান করে শত্রুর সম্পদ সৃষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টিকরণ ৭. সন্ধায়াসন তথা সংগ্রামে অসমর্থ শত্রুর সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনপূর্বক সহাবস্থান ৮. বিগৃহ্য যান তথা পার্ষিগ্রাহের (পশ্চাদের শত্রু) সাথে মিত্রতা স্থাপনপূর্বক শত্রুর বিরুদ্ধে সমরাভিযান ৯. সন্ধায় যান তথা মিত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সমরাভিযান ১০. সম্ভূয় প্রয়াণ তথা সম, হীন ও উৎকৃষ্ট নৃপতির সঙ্গে সন্ধি স্থাপনপূর্বক শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান ১১. যাতব্য (আক্রমণযোগ্য শত্রু) ও অমিত্র-প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণের আয়োজন ১২. প্রকৃতিবর্গের (রাজা, অমাত্য, মিত্র, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য) অবক্ষয়, লোভ ও বিদ্রোহের কারণ সন্ধান ১৩. সমবায়ভুক্ত বা সম্মিলিত জোটভুক্ত রাজন্যদের গুরুত্ব ও লঘুত্ব সংক্রান্ত মূল্যায়ন ১৪. সংহতিপ্রয়াণিক তথা সন্ধিপূর্বক প্রয়াণ ১৫. পরিপণিত, অপরিপণিত ও অপসৃত সন্ধি ১৬. দ্বৈতভাব সম্বন্ধীয় সন্ধি ও শক্তি প্রদর্শন ১৭. যাতব্যবৃত্তি (আক্রমণীয় শত্রুর বিরুদ্ধে করণীয়) ১৮. অনুগ্রহযোগ্য মিত্র ১৯. মিত্র, অর্থ, ভূমি বা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে কৃত সন্ধি ২০ পষ্ণিগ্ৰাহ তথা পশ্চাদে অবস্থানকারী শত্রু সম্পর্কিত চিন্তন ২১. হীনশক্তিপূরণ ২২. শক্তিমান শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম ২৩. বলবান শত্রুর প্রতি আয়ত্তীকৃত রাজার করণীয় ২৪. বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আয়ত্তীকৃত শত্রুর প্রতি রাজার করণীয় ২৫. সন্ধিকৰ্ম ২৬. সন্ধিভঙ্গ ২৭. মধ্যম নৃপতির প্রতি রাজার করণীয় ২৮. উদাসীন নৃপতির প্রতি রাজার করণীয় ২৯. রাজবৃত্তের রাজন্যদের প্রতি রাজার করণীয়।

প্রথম অধ্যায় ॥ ৯৮-৯৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে ষাড়গুণ (ছয়টি গুণ) নীতি, কোষের ক্ষয়, স্থান ও বৃদ্ধির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও রাজা কোন পরিস্থিতিতে সন্ধি স্থাপন করবেন, যুদ্ধ করবেন, নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন, আক্রমণ পরিচালনা করবেন, মিত্রতায় আবদ্ধ হবেন এবং দ্বৈতনীতি অবলম্বন করবেন, ইত্যাকার বিষয়ে এ পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।

০৭-০১-০১ রাজা, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ, সেনা ও মিত্র এই সাতটি প্রকৃতি এবং দ্বাদশ রাজমণ্ডল হলো ছয়টিগুণের ভিত্তি। কৌটিল্যের মতে – সন্ধি তথা শান্তি, বিগ্রহ তথা যুদ্ধ, আসন তথা নিরপেক্ষাবস্থা, যান তথা যুদ্ধাভিযান, সংশ্রয় তথা মিত্রতা এবং দ্বৈধীভাব তথা দ্বৈতনীতি, এই ষাড়গুণ্য তথা ছয়টি গুণই হলো রাজ্যের ছয়টি নীতি বা কৌশল। কিন্তু আচার্য বাতব্যাধি কৌটিল্যের উক্ত মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন না। তার মতে—গুণ ছয়টি নয়, দুটি। তিনি মনে করেন সন্ধি ও বিগ্রহ গুণ দুটির মধ্যেই অন্যান্য গুণ অন্তর্লীন, কাজেই সেগুলোকে আলাদা করে উপস্থাপনের আবশ্যকতা নেই। সন্ধিতে আসন ও সংশ্রয় এবং বিগ্রহে যানসহ অন্যান্য গুণ অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কৌটিল্য মনে করেন—সন্ধি ও বিগ্রহে অন্যান্য গুণ অন্তর্লীন হয়ে থাকলেও অবস্থা ভেদে ছয়টি গুণই বিদ্যমান।

০৭-০১-০২ ভূমি, কোষ, সেনা ইত্যাদি প্রদানের শর্তে সম্পাদিত চুক্তিই সন্ধি বলে খ্যাত। শত্রুর অপকার সাধনের জন্য পরিচালিত যুদ্ধাভিযানই হলো বিগ্রহ বা যুদ্ধ। শত্রুকে উপেক্ষা বা শত্রুতার প্রতি উদাসীনভাব বা নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হলো আসন। শক্তি প্রয়োগের প্রত্যয়ে চালিত অভিযান হলো যান। বলবান রাজার সমীপে নিজের সম্পদ বা আপনজনকে হস্তান্তর হলো সংশ্রয়। একদিকে শান্তি স্থাপন এবং একই সাথে যুদ্ধে জড়িত হওয়াকে বলে দ্বৈধীভাব 1

০৭-০১-০৩ ষাড়গুণ প্রয়োগের ক্ষেত্র—বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা যদি নিজেকে শত্রু রাজ অপেক্ষা দুর্বল মনে করেন, সেক্ষেত্রে তিনি তার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবেন। তিনি যদি যথার্থভাবে সক্ষমতা অর্জন করে থাকেন তাহলে শত্রুর বিরুদ্ধে বিগ্রহ বা লড়াই করবেন। রাজা এবং তার শত্রু উভয়ে যদি সম শক্তিতে বলীয়ান হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি শত্রুকে উপেক্ষা করে নিরপেক্ষতা অবলম্বনপূর্বক নিশ্চুপ থাকবেন। রাজা যদি নিজেকে শত্রু অপেক্ষা অধিক বলবান মনে করেন তাহলে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবেন। তিনি যদি নিজেকে শক্তিহীন মনে করেন, তাহলে কোনো বলবান রাজার শরণাপন্ন হয়ে সংশয় স্বীকার করবেন তথা তার সমীপে নিজেকে সমর্পণ করে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। রাজা যদি কারো সহায়তা গ্রহণ আবশ্যক মনে করেন এবং একই সময় কারো সঙ্গে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন, তাহলে তিনি দ্বৈধীভাব তথা দ্বৈতনীতি অবলম্বন করবেন। এইভাবে রাজা বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ছয়টিগুণ প্রয়োগ করবেন।

০৭-০১-০৪ ছয়টি গুণের যে গুণটি অবলম্বনের মাধ্যমে দুর্গ, বাঁধ, সড়ক, ভূমি, খনি, দ্রব্যবন, হস্তিবন ইত্যাকার স্থাপনা সমৃদ্ধশালী হবে এবং শত্রুর উপরোক্ত স্থাপনাসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতীয়মান হবে রাজা কর্তৃক সেই গুণের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে গুণ অবলম্বন করা হলে নিজের ক্ষতি এবং শত্রুর লাভ হয়, রাজা তা অবলম্বন করবেন না। যে গুণ অবলম্বন করা হলে সাময়িকভাবে নিজের ক্ষতি হলেও মেয়াদান্তে শত্রুর ক্ষতি সাধিত হবে রাজা সেই গুণই অবলম্বন করবেন।

কিন্তু এক্ষেত্রে যদি বাহ্যিকভাবে রাজার সমৃদ্ধি সত্ত্বেও ভবিষ্যতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তিনি তা পরিহার করবেন। একই সঙ্গে যদি নিজের ও শত্রুর সমৃদ্ধি সাধিত হয়, উভয়েই বলবান হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে রাজা শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবেন।

০৭-০১-০৫ যে গুণ অবলম্বন করা হলে নিজের ও শত্রুর সমুদয় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, রাজা তা পরিহার করবেন। নিজের সামান্য ক্ষতিতে যদি দীর্ঘমেয়াদে শত্রুর বিপুল ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে কিংবা নিজের সাময়িক ক্ষতি যদি ভবিষ্যতে সমৃদ্ধি বয়ে আনে এবং শত্রুর ক্ষেত্রে তা উত্তরোত্তর ক্ষতি বয়ে আনে, তাহলে রাজা নিজের এ ধরনের ক্ষতি উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখবেন। কোনো গুণ অবলম্বনের কারণে যদি নিজের এবং শত্রুর সমানুপাতিক হারে ক্ষতি সাধিত হয়, তাহলে রাজা শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবেন।

০৭-০১-০৬ যে গুণ অবলম্বনের মাধ্যমে লাভ বা ক্ষতির কোনোটিই হয় না, রাজা ও শত্রুর মধ্যে স্থিতাবস্থা বজায় থাকে, তাকে বলা হয় স্থান। এ ধরনের স্থিতাবস্থা যদি সাময়িক সময়ের জন্য হয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে তা রাজার সমৃদ্ধির অনুকূল এবং শত্রুর প্রতিকূল হবে বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে রাজা নিজের স্থান উপেক্ষা করবেন। পূর্বের আচার্যদের অভিমত হলো—রাজা ও শত্রুর স্থান একই সময় সংঘটিত হলে এবং সমান ফলযুক্ত হলে, রাজা শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবেন। কিন্তু কৌটিল্য উপরোক্ত আচার্যদের মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না।

০৭-০১-০৭ কৌটিল্য মনে করেন নিম্নোক্ত পরিস্থিতিতে বা প্রেক্ষাপটে রাজা তার শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে পারেন—১. নিজের দুর্গ সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে শত্রুর উন্নতি বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব হলে। নিজ দেশের উৎকৃষ্ট পণ্যদ্রব্য শত্রু দেশে পাঠিয়ে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যমূল্যের অবমূল্যায়ন সম্ভব হলে ২. শত্রুর সমৃদ্ধির সুফল ভোগ করা সম্ভব হলে ৩. শত্রুর আস্থা অর্জন করে গুপ্তচরদের মাধ্যমে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ পরিচালনা সম্ভব হলে ৪. কৃষি উৎপাদনে যুক্ত দক্ষ লোকবলকে নিজ রাজ্যে আনয়নে আকৃষ্টকরণ সম্ভব হলে ৫. বলবান রাজা যদি যুদ্ধে জড়িয়ে ক্ষীণবল এবং সম্পদশূন্য হয়ে পড়ে, বলবানের শত্রুর সঙ্গে রাজা সন্ধি স্থাপন করতে সক্ষম হলে ৬. রাজার শত্রুর শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার জন্য শত্রুর শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করা সম্ভব হলে ৭. রাজার প্রতি বিদ্বেষকারীর সঙ্গে কোনো শত্রুরাজা যুদ্ধে লিপ্ত হলে সে শত্রুরাজের সঙ্গে সন্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি হলে ৮. শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করার ফলে রাজবিদ্বেষী কোনো রাজ্য হস্তগত করা সম্ভব হলে ৯. শত্রু সঙ্কটে নিপতিত হয়ে উন্নয়নের নির্মাণযজ্ঞ বাধাগ্রস্ত করতে অক্ষম হয়ে পড়লে ১০. সঙ্কটে পতিত হয়ে শত্রু রাজা অন্যের সহায়তাতেও উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে অক্ষম হয়ে পড়লে ১১ শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে রাজমণ্ডল ভেদ করা সম্ভব হলে ১২. অথবা শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করে সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে বিভাজিত রাজমণ্ডলকে বশ করা সম্ভব হলে ১৩. শত্রুকে সৈন্য সহায়তা দিয়ে স্ববশে এনে তার মাধ্যমে বিভাজিত রাজমণ্ডলকে করায়ত্ব করা সম্ভব হলে। এবং ১৪. রাজমণ্ডলের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন শত্রুকে রাজমণ্ডলের মাধ্যমে ঘায়েল করার অভিপ্রায়েও শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করা যেতে পারে।

০৭-০১-০৮ নিম্নোক্ত প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে রাজা যুদ্ধ করতে পারেন—১. রাজার কাছে যদি যুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক সশস্ত্র ক্ষত্রিয় যোদ্ধা মজুদ থাকে, তার রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি পাহাড়, নদী ও বনাঞ্চলের দ্বারা সুরক্ষিত এবং শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হয়ে থাকে। তাহলে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন ২. তিনি যদি মনে করেন, সীমান্ত প্রদেশের দুর্ভেদ্য দুর্গে অবস্থান করে তার পক্ষে শত্রুরাজ্যে আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব, তাহলে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন ৩. শত্রুরাজ্য যদি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় এবং শত্রু নৃপতি যদি উৎপীড়িত হয়ে যুদ্ধে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে, তাহলে শত্রুরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যেতে পারে ৪. অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত শত্রু রাজ্যের জনগণকে বশীভূতকরণের জন্যও শত্রু রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যেতে পারে।

০৭-০১-০৯ নিম্নোক্ত প্রেক্ষাপটে আসন আশ্রয় তথা নিরপেক্ষতা অবলম্বনপূর্বক রাজাকে নিশ্চুপ থাকতে হবে—১. যখন শত্রুর অনিষ্ট করার মতো সক্ষমতা থাকবে না কিংবা শত্রুরাজারও পাল্টা অনিষ্ট করার ক্ষমতা থাকবে না। অর্থাৎ উভয়ে সমশক্তিসম্পন্ন হবে, তখন আসন আশ্রয় করতে হবে বা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে নিশ্চুপ থাকতে হবে ২. শত্রু রাজার যদি বিভিন্ন কুঅভ্যাসে আসক্তিজনিত কারণে বিপর্যয় শুরু হয় বা তিনি যদি অন্য কোনো রাজার সঙ্গে কুকুর বা শূকরের মতো লড়াইয়ে লিপ্ত হন, তাহলে রাজা আসন আশ্রয় তথা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এই অবসরে অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করবেন।

০৭-০১-১০ রাজা যদি মনে করেন, তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজ রাজ্য সুরক্ষায় যথার্থভাবেই সক্ষম এবং কেবলমাত্র সেনাভিযানের মাধ্যমে শত্রুরাজ্যের বিনাশ অত্যাবশ্যক, তাহলে তিনি যান আশ্রয় করবেন তথা সেনা অভিযান পরিচালনা করবেন।

০৭-০১-১১ কোনো রাজার যদি শত্রুরাজ্য আক্রমণের সামর্থ না থাকে এবং তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও যদি এমনতর দুর্বল হয় যা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহতকরণে অসমর্থ, তাহলে উক্ত রাজাকে কোনো বলবান রাজার শরণাপন্ন হয়ে তার অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আশ্রিত অবস্থায় নিজের শক্তি সামর্থ বৃদ্ধিকরণে সচেষ্ট হতে হবে।

০৭-০১-১২ কোনো রাজা যদি মনে করেন, তিনি একপক্ষের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে নিজের সমৃদ্ধি সাধনে সক্ষম হবেন এবং একই সাথে অন্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে তার বিনাশ করতে সক্ষম হবেন, তাহলে উক্ত রাজা দ্বৈধীভাব তথা দ্বৈতনীতি গ্রহণের মাধ্যমে নিজের সমৃদ্ধি সাধনে সচেষ্ট হবেন।

০৭-০১-১৩ এইভাবে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা ষাড়গুণ তথা আলোচিত ছয়টিগুণ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনুসরণক্রমে করণীয় সম্পাদনের মাধ্যমে নিজের সমৃদ্ধি সাধনে এবং ক্ষয় বা বিপর্যয় রোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ১০০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে ছয়টি গুণের একটি গুণ, সংশয়বৃত্তি তথা মিত্রতার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা প্রয়োজনকালে কোন প্রকৃতির রাজার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। বিপর্যস্ত অবস্থান হতে কীভাবে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধার করবেন, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-০২-০১ যখন সন্ধি অথবা যুদ্ধের ফলে একই ফলাফল প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিবে তখন রাজা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে না জড়িয়ে সন্ধির পথ বেছে নিবেন। কারণ, যুদ্ধে জড়ালে বিভিন্নভাবে রাজ্যের ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে থাকে। যেখানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে বা সেনাভিযান পরিচালনা করলে একই ফলাফল প্রাপ্ত হবে, সেখানে সেনাভিযানে যুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করাই সমীচীন। একইভাবে দ্বৈতনীতি বা সংশয় তথা আশ্রয় অবলম্বনের মাধ্যমে যদি একই ফলাফল প্রাপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করাই শ্রেয়তর। কারণ আশ্রিত রাজার পক্ষে নিজের সমৃদ্ধি সাধনের জন্য কিছু করা বেশ দুষ্কর।

০৭-০২-০২ আশ্রয় গ্রহণের ক্ষেত্রে আক্রান্ত রাজা আক্রমণকারী অপেক্ষা অধিক বলবান নৃপতির সমীপেই আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। এ ধরনের বলবান রাজার কাছে আশ্রয় গ্রহণ সম্ভব না হলে, আক্রান্ত রাজা প্রতিবেশী কোনো শত্রু রাজের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করবেন, এক্ষেত্রে আশ্রয় গ্রহণকারী রাজা নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আশ্রয়দাতার সান্নিধ্য হতে দূরত্বে অবস্থান করবেন। এ সময় রাজা আক্রমণকারী শত্রুরাজাকে ধন-সম্পদ, সেনা এবং ভূমি প্রদান করে তুষ্ট করার চেষ্টা করবেন। অতঃপর আক্রমণকারী রাজা যখন অধিক বলশালী কোনো রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে তখন আক্রান্ত রাজা বলশালী রাজার আশ্রয়ে শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিবেশী আক্রমণকারী শত্রুকে অবদমন করবেন।

০৭-০২-০৩ রাজা যদি বলশালী শত্রুনৃপতির সমীপে নিজেকে সমর্পণ করে সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাকে প্রসন্ন করতে না পারেন, তাহলে তার কাছে অবনত হয়েই অবস্থান করবেন। আশ্রিত অবস্থায় অবস্থানকালে আশ্রয়দাতা নৃপতি যদি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন বা তিনি যদি অভ্যন্তরীণ কোন্দল তথা অমাত্য, মন্ত্ৰী, পুরোহিত বা সৈন্যদের দ্রোহের কোপানলে নিপতিত হন বা তার মিত্রশূন্যতা দেখা দেয় বা শত্রুবৃদ্ধি ঘটে, তাহলে আশ্রিত রাজা নিজের সমৃদ্ধির স্বার্থে কোনো কঠিন অসুখ বা ধর্মীয় কাজের উসিলায় উক্ত আশ্রয়দাতা নৃপতিকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবেন। অতঃপর রাজা নিজ রাজ্যে অবস্থানকালে আশ্রয়দাতা নৃপতি কর্তৃক আহ্বান জ্ঞাপন সত্ত্বেও ব্যাধি বা ধর্মীয় কাজের ব্যস্ততার ছল করে তার কাছে গমন করবেন না। উপরন্তু তার দুর্বল ক্ষেত্রে পাল্টা আঘাত হানবেন।

০৭-০২-০৪ রাজা যদি দুই শক্তিশালী নৃপতির মধ্যবর্তী অবস্থানে অবস্থান করেন, সেক্ষেত্রে যেপক্ষ বিপদ থেকে রক্ষা করতে সমর্থ বলে বিবেচিত হবে, তিনি সে পক্ষের অধীনেই আশ্রয় গ্রহণ করবেন, অথবা তিনি প্রতিবেশী নৃপতির অধীনে অথবা উভয়ের কাছেই আশ্রয়গ্রহণ করবেন। উভয়কে আশ্রয়কালে তিনি কপাল-সন্ধি করবেন তথা উভয়কে শত্রু কর্তৃক নিজের উচ্ছেদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে রক্ষক হিসেবে সম্বোধন করবেন। উভয়ের আশ্রয়ে অবস্থানকালে আশ্রিত রাজা সুকৌশলে একজনের ক্ষতিসাধন করে তার দায় অন্যজনের উপর চাপিয়ে দিবেন, এভাবে একজনকে অপরজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবেন এবং সুযোগ বুঝে উভয় আশ্রয়দাতা নৃপতিকে গোপনে হত্যা করিয়ে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধার করবেন।

০৭-০২-০৫ অথবা আশ্রিত রাজা যে আশ্রয়দাতা নৃপতির কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা উপলব্ধি করবেন, তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে বিপদের প্রতিকার করবেন। অথবা তিনি দুর্গে অবস্থান করে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে গোপনে সন্ধি ও যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। অথবা মধ্যম ও উদাসীন নৃপতিকে আশ্রয় করবেন এবং তাদের একজনকে দান ও সম্মান প্রদানের মাধ্যমে বশীভূত করে অন্যজনকে উচ্ছেদ করবেন বা উভয়কেই উচ্ছেদ করবেন।

০৭-০২-০৬

০৭-০২-০৭ উপরোক্ত উভয় বলবান নৃপতির দ্বারা আশ্রিত রাজা উচ্ছিন্ন হলে, তিনি ন্যায়ানুমোদিত পথে চালিত নৃপতির অধীনে আশ্রয়গ্রহণ করবেন অথবা যে নৃপতির অমাত্য প্রকৃতি অনুগত, তার অধীনে আশ্রয়গ্রহণ করবেন অথবা যার কাছে অবস্থান করলে তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা থাকবে তার কাছে আশ্রয়গ্রহণ করবেন অথবা এমন নৃপতির অধীনে আশ্রয় করবেন যার সঙ্গে তার পুর্ব পুরুষদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল অথবা এমন নৃপতির অধীনে আশ্রয় করবেন যার প্রচুর মিত্র বিদ্যমান। অথবা অনেকের মধ্যে তিনি যার কাছে প্রিয়জন হিসেবে স্বীকৃত হবেন, তার কাছেই আশ্রয় গ্রহণ করবেন।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ১০১-১০২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সমমান, অধিক বলবান এবং দুর্বল নৃপতিদের সঙ্গে কোনো ষাড়গুণ প্রয়োগ করতে হবে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও রাজা কোন প্রকৃতির শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হবেন, কোন প্রকৃতির শত্রুর সঙ্গে সহাবস্থান করবেন এবং কোন প্রকৃতির শত্রুর সমীপে আত্মসমর্পণ করবেন ইত্যাদি বিষয়সহ পরাভূত রাজা পরাক্রান্ত রাজার সঙ্গে কোন ক্ষেত্রে কোন ধরনের সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন এবং সন্ধিবদ্ধ হয়েও কীভাবে নিজের স্বার্থ রক্ষা করবেন, ইত্যাকার বিষয় আলোচিত হয়েছে।

০৭-০৩-০১ রাজা নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে ষাড়গুণ প্রয়োগ করবেন। তিনি সমশক্তিসম্পন্ন এবং নিজের চেয়ে শক্তিমান নৃপতির সঙ্গে সন্ধি করবেন। নিজের চেয়ে দুর্বল নৃপতির সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। অধিক শক্তিশালীর সঙ্গে যুদ্ধ লিপ্ত হলে হাতির সঙ্গে পদাতিক বাহিনী যুদ্ধ করলে যে পরিণতি হয়, রাজারও সে দুরবস্থা হবে। সমশক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করলে কাঁচা মাটির দুটি পাত্র যেমন ঠোকর লেগে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়, উভয়ের সে পরিণত হবে অর্থাৎ দুপক্ষই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বলশালী রাজা দুর্বল রাজার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে মাটির কলসের সঙ্গে পাথরের সংঘর্ষ হলে কলসের যে পরিণতি হয় দুর্বল শক্তিরও সে পরিণতি হবে।

০৭-০৩-০২ অধিক বলশালী নৃপতি যদি রাজার সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে সম্মত না হন, সেক্ষেত্রে রাজা বলশালী নৃপতির কাছে দূতের মাধ্যমে মূল্যবান উপহারসামগ্রী প্রেরণ করবেন এবং রাজ্যসহ নিজেকে তার সমীপে সমর্পণ করবেন এবং তার সঙ্গে সেবকের মতো আচরণ করবেন। এ ধরনের সন্ধিকে বলা হয় দণ্ডোপনতসন্ধি। সমশক্তি সম্পন্ন কোনো নৃপতি যদি সন্ধি সম্পাদনে সম্মত না হন, তাহলে উক্ত নৃপতির দ্বারা রাজার যতটা ক্ষতিসাধিত হবে তাকে ততটা অপকার প্রত্যর্পণ করতে হবে।

০৭-০৩-০৩ দুর্বল নৃপতি যদি সকল ক্ষেত্রে অবনত থাকে তাহলে তার সঙ্গে সন্ধি করা উচিত। অন্যথায় এক সময় সেই নৃপতি শক্তিসঞ্চয় করে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এছাড়াও এধরনের নৃপতি রাজমণ্ডলের অনুকম্পা বা অনুগ্রহের পাত্রও হতে পারে। বলবান শত্রু নৃপতির সঙ্গে সন্ধিতে আবদ্ধ কোনো রাজার কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে শত্রু নৃপতির অমাত্য ও প্রজারা লোভার্ত স্বভাবের, ভীরু প্রকৃতির এবং নানা অপকর্মে যুক্ত, তাহলে উক্ত শত্রু নৃপতি বলবান হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো যেতে পারে।

০৭-০৩-০৪ অধিক বলশালী হওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো দুর্বল নৃপতির সঙ্গে যুদ্ধকালে দুর্বল নৃপতির অমাত্যাদি ও প্রকৃতি প্রলুব্ধ হয়ে বা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বা চরিত্র খুইয়ে আক্রমণকারী নৃপতির প্রতি সমর্পিত না হয়, তাহলে উক্ত দুর্বল নৃপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে তার সঙ্গে সন্ধি সম্পাদন করাই সমীচীন হবে।

০৭-০৩-০৫ অধিক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও রাজার কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে সন্ধি বা যুদ্ধ করে শত্রুর কোনো ক্ষতি করা যাবে না বা রাজার কোনোকিছু অর্জিত হবে না, সে ক্ষেত্রে আসন গুণকে আশ্রয় করতে হবে তথা রাজাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। হীনশক্তির অধিকারী হয়েও কোনো রাজা যদি শত্রুর অমাত্যদের ক্ষোভ নিবারণের কোনো লক্ষণ না দেখেন, তাহলে তিনি উক্ত রাজ্য আক্রমণের জন্য সেনাভিযান পরিচালনা করতে পারেন।

বলশালী হওয়া সত্ত্বেও কোনো রাজা যদি বিপর্যয়ের আলামত দেখতে পান এবং তা যদি নিরসনের অযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে তিনি সংশয় অবলম্বন করবেন তথা অন্যের আশ্রয়ে নিজেকে হেফাজত করবেন। বলশালী হওয়া সত্ত্বেও কোনো রাজা যদি মনে করেন এক রাজার সঙ্গে সন্ধি এবং অন্য রাজার সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি লাভবান হবেন, তাহলে এক্ষেত্রে তিনি দ্বৈধীভাব বা দ্বৈতনীতি অবলম্বনের মাধ্যমে অভীষ্ট হাসিল করতে পারেন।

০৭-০৩-০৬ বলবান রাজার সৈন্যবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে দুর্বল রাজা তার কোষ, সেনাবাহিনী ও ভূমিসহ আত্মসমর্পণপূর্বক উক্ত রাজার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবেন এবং নিজেকে তার সমীপে সমর্পণ করবেন। এক্ষেত্রে দুর্বল রাজা বলবান রাজা কর্তৃক নির্ধারণকৃত কোষ, সেনা সদস্য ও উপহার সামগ্রী নিয়ে তার সমীপে উপস্থিত হয়ে সেবায় নিযুক্ত হবেন। বলবান রাজার অভিপ্রায় অনুযায়ী সম্পাদিত এ ধরনের সন্ধিকে বলা হয় আত্মামিষ সন্ধি।

০৭-০৩-০৭ নিজেকে সমর্পণের পরিবর্তে সেনাপতি ও রাজকুমারকে বলবান রাজার সেবায় নিযুক্তকরণের শর্তে দুর্বল রাজার সঙ্গে সম্পাদিত সন্ধিকে বলা হয় পুরুষান্তর সন্ধি। নিজেকে সমর্পণ না করে অন্যদের সমর্পণের শর্তে সন্ধি সম্পাদিত হয় বলে এ ধরনের সন্ধিকে আত্মরক্ষণ সন্ধিও বলা হয়ে থাকে। দুর্বল রাজা কর্তৃক বলবান রাজার সমীপে সমর্পিত না হয়ে তার অভিপ্রায় অনুযায়ী পরোক্ষভাবে সেবাকর্মে বা তার নির্দেশিত কাজে ব্যবহৃত হওয়ার শর্তে সন্ধি সম্পাদিত হলে, তাকে বলা হয় অদৃষ্টপুরুষ সন্ধি। উপরোক্ত আত্মামিষ ও পুরুষান্তর সন্ধির ক্ষেত্রে আস্থা অর্জনের স্বার্থে দুর্বল রাজা কর্তৃক স্বীয় কন্যাদের বলবান রাজার সেনাপতি বা রাজকুমারদের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু শেষোক্ত তথা অদৃষ্টপুরুষ সন্ধি সম্পাদনের পর দুর্বল রাজা সুযোগ বুঝে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে বলবান রাজাকে হত্যা করতে সচেষ্ট হবেন।

০৭-০৩-০৮ বলবান রাজার আক্রমণে বিপর্যস্ত হবার পর সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের শর্তে অর্থ-সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে দুর্বল রাজা কর্তৃক যে সন্ধি সম্পাদিত হয়, তাকে বলা হয় পরিক্রয় সন্ধি। এ ধরনের সন্ধির মাধ্যমে অমাত্যদের আত্মসমর্পণের কবল থেকে রক্ষা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সন্ধির শর্তানুযায়ী প্রদেয় অর্থ কিস্তিরভিত্তিতে পরিশোধ করা হলে, তা হবে উপগ্রহ সন্ধি। উপগ্রহ সন্ধিতে যদি প্রদেয় অর্থের কিস্তির পরিমাণ, পরিশোধের সময় ও স্থান নির্ধারণ করা থাকে, তাহলে তা হবে অত্যয় সন্ধি। এ ধরনের সন্ধিতে দুর্বল রাজার উপর তেমন আর্থিক চাপ থাকে না বিধায় কোনো একসময় তা ইতিবাচক পরিণতি লাভ করতে পারে। এ ধরনের সন্ধির পরিপ্রেক্ষিতে উভয় রাজার মধ্যে এক সময় সৌহার্দ্য বৃদ্ধির সুবাদে কন্যাদান তথা বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিক্ততা তিরোহিত হয়ে পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপিত হতে পারে। গলিত স্বর্ণের সাথে গলিত স্বর্ণ মিশ্রণ করতে স্বর্ণকারকে যেমন কসরৎ করতে হয় না, তেমনি এ ধরনের সন্ধির ফলে দুর্বল রাজা খুব সহজেই বলবান রাজার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে সক্ষম হয়, এ কারণে এ ধরনের সন্ধিকে সুবর্ণ সন্ধিও বলা হয়ে থাকে।

০৭-০৩-০৯ সুবর্ণের বিপরীত সন্ধিকে বলা হয় কপাল সন্ধি। এ ধরনের সন্ধির ক্ষেত্রে বলবান রাজা চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রদেয় অর্থের পুরোটাই একসাথে পরিশোধের তাগিদ প্রদান করে থাকেন। এ কারণে এধরনের সন্ধির শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দুর্বল রাজাকে পথের ভিখিরিতে পরিণত হতে হয়। উপরোক্ত সন্ধির বিষয়ে পরামর্শ প্রদান প্রাক্কালে কৌটিল্য বলেন—পরিক্রয় এবং উপগ্রহ সন্ধির ক্ষেত্রে পরাভূত দুর্বল রাজা পরাক্রান্ত রাজাকে ধন-সম্পদ কম দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এক্ষেত্রে দুর্বল রাজা অর্থের পরিবর্তে অসার বস্তু দেওয়ার চেষ্টা করবেন, উন্মাদ বা বিকৃত প্রকৃতির মৃতপ্রায় হাতি ঘোড়া দেওয়ার চেষ্টা করবেন। অত্যয় এবং সুবর্ণ সন্ধির ক্ষেত্রে আয় সংকটের অজুহাতে প্রদেয় অর্থের অর্ধেক প্রদান করবেন। কপাল সন্ধির ক্ষেত্রে একত্রে সমুদয় অর্থ পরিশোধের তাগিদ প্রাপ্তির পর নানা অজুহাতে অর্থ পরিশোধ বিলম্বিত করে দুর্বল রাজা মধ্যম বা উদাসীন রাজার শরণাপন্ন হয়ে অর্থনাশের কবল থেকে পরিত্রাণের প্রচেষ্টা চালাবেন। পরিক্রয়, উপগ্রহ, অত্যয় এবং কপাল সন্ধি কোষ প্রদানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, যে কারণে এ সমস্ত সন্ধিকে বলা হয় কোষোপনত বা সম্পদ হানিকর সন্ধি।

০৭-০৩-১০ দেশের জনপদ, অমাত্য, দুর্গ ও অন্যান্য প্রকৃতি রক্ষার্থে পরাভূত রাজা কর্তৃক ভূমি প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি সম্পাদিত হলে, সে সন্ধিকে বলা হয় আদিষ্ট সন্ধি। এ ধরনের সন্ধি পরাভূত রাজার জন্য অভিপ্রেত। কারণ, সন্ধির শর্তানুযায়ী রাজা কর্তৃক যে ভূমি হস্তান্তরিত হয়, পরবর্তী সময়ে তিনি সেই ভূমিতে গুপ্তচর এবং চোরদের প্রেরণ করে নানা ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক উৎপীড়ন চালাতে পারেন এবং এর ফলশ্রুতিতে এক সময় উক্ত ভূমি পুনরায় তার দখলে আসতে পারে। রাজধানী ব্যতীত সম্পদ আহরণকৃত অন্যান্য অনুর্বর ভূমি প্রদানের মাধ্যমে পরাভূত রাজা কর্তৃক যে সন্ধি সম্পাদিত হয়ে থাকে, তাকে বলা হয় উচ্ছিন্ন সন্ধি। এ ধরনের ভূমি একসময় প্রত্যার্পিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যে কারণে এ জাতীয় সন্ধি পরাভূত রাজার কাছে পূর্বোক্ত সন্ধির মতোই অভিপ্রেত বা ঈপ্সিত I

০৭-০৩-১১ পরাভূত রাজা উৎপাদিত ফসল প্রদানের শর্তে শত্রু কবলিত ভূ-খণ্ড অবমুক্ত করণের জন্য পরাক্রান্ত রাজার সঙ্গে যে সন্ধি সম্পাদন করেন, তাকে বলা হয় অবক্রয় সন্ধি। উৎপাদিত ফসলসহ আরো অধিক বস্তু প্রদানের শর্তে যে সন্ধি সম্পাদিত হয়, তাকে বলা হয় পরদূষণ সন্ধি। এ ধরনের সন্ধির মাধ্যমে বিজয়ী রাজা উৎপাদিত ফসলের সাথে আরও বহুকিছু দাবি করে থাকে। উপরোক্ত সন্ধিসমূহকে বলা হয় দেশোপনত সন্ধি বা দেশের জন্য বিপর্যয়কর সন্ধি। উপরোক্ত আদিষ্ট এবং উচ্ছন্ন সন্ধি বাস্তবায়ন প্রাক্কালে পরাভূত রাজা স্বীয় অপহৃতব্য ভূমি পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশায় সময় ক্ষেপণসহ পরাক্রান্ত রাজার বিপর্যয়ের অপেক্ষা করবেন। অবক্রয় এবং পরদূষণ সন্ধি বাস্তবায়ন প্রাক্কালে পরাভূত রাজা ভূমিতে উৎপাদিত ফসল কৌশলে অপহরণ করে প্রকারান্তরে পরাক্রান্ত রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক আচরণ করবেন। এভাবেই পরাজিত রাজা দণ্ডোপনত, কোষোপনত এবং দেশোপনত প্রকৃতির অবমাননাকর সন্ধি হতে পরিত্রাণের প্রত্যাশায় বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে নিজের বিপর্যয় রোধকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

চতুর্থ অধ্যায় ॥ ১০৩-১০৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে মিত্রতা স্থাপন, শত্রুর সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হওয়ার পর লড়াইয়ে লিপ্ততা, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর সেনাভিযান পরিচালনা, শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করার পর সেনাভিযান পরিচালনা এবং অন্যান্য রাজার সঙ্গে জোট বেঁধে সেনাভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে।

০৭-০৪-০১ শত্রু রাজার সঙ্গে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার সমসক্ষমতাকে বলা হয় আসন। আসনের সমার্থক হলো স্থান ও উপেক্ষণ। আসনের যোগ্য শত্রু অপেক্ষা রাজা শক্তিহীন হলে, সেই রাজা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রতিরোধে অক্ষম হয়, তাহলে সে অবস্থানকে বলা হয় স্থান। সে অবস্থায় নিজের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সমৃদ্ধির সঠিক পন্থা সন্ধান না করাকে বলা হয় উপেক্ষণ। অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন দুজন রাজাই যদি যুদ্ধের মাধ্যমে একে অপরের ক্ষতিসাধন করতে অসমর্থ হয় তাহলে তারা যুদ্ধের পর আসন বা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে পারে। উভয়ে স্বল্প শক্তিধর হলে সন্ধির মাধ্যমে আসন বা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করাই সমীচীন হবে।

০৭-০৪-০২ রাজা যদি মনে করেন—তার সেনাবাহিনী সাহসী, সংহত, সমৃদ্ধশালী এবং তার অমাত্য ও প্রকৃতিবর্গ রাজানুগত ও উৎসাহী, তারা শুধু বিনা বাধায় যুদ্ধাভিযানে সক্ষম নয়, অধিকন্ত শত্রু দেশের কর্মযজ্ঞ বিনাশেও সক্ষম, তাহলে রাজা সমকক্ষ বা তার চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অতঃপর নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবেন।

০৭-০৪-০৩ রাজা যদি মনে করে-

১. শত্রু রাজার জনগণ অত্যাচারিত বা দুর্ভিক্ষ পীড়িত হয়ে স্বীয় রাজার প্রতি বিদ্রোহভাবাপন্ন, অমাত্যরা নিপীড়িত হয়ে ক্ষুব্ধ, লোভার্ত, সৈন্যরা নিগৃহীত হয়ে ব্যথিত এবং এসব কারণে জনগণ বিভাজনযোগ্য। ২. শত্রুর বার্তা তথা পশুপালন, কৃষি উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সম্পদ বিপর্যস্তার কারণে আপামর জনসাধারণ তার প্রতি সহজে সমর্পিত হবে। ৩. শত বিপর্যয়েও শত্রুরাজ্যের লোকেরা কারো প্রতি সমর্পিত হবে না কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের সম্পদ অপহরণ সম্ভব। ৪. শত্রু রাজ্যের উৎপন্ন দ্রব্য স্বদেশে আনীত হলে, নিজেদের উৎপাদন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। ৫. শত্রুরাজা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে হাতি, ঘোড়া ও হাতির দাঁতের মতো মূল্যবান পণ্যদ্রব্য বণিক পথের মাধ্যমে তার হস্তগত হবে। ৬. যুদ্ধে লিপ্ত হবার ফলে শত্রুরাজা তার রাজমণ্ডলের বিশ্বাসঘাতক বা দেশদ্রোহী অমাত্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়বে। ৭. শত্রুরাজা তার বিদ্রোহী অমাত্য, অমিত্র ও অটবিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। ৮. তার মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে শত্রুরাজা স্বল্পসৈন্য এবং স্বল্পসম্পদ ব্যয় করে অল্প সময়ে অধিক সম্পদ অর্জনে সক্ষম হবে। ৯. শত্রুরাজা তাকে উপেক্ষা করে সেনাবাহিনী দিয়ে কোনো উর্বর ভূমি অধিগ্রহণে প্রবৃত্ত হবে।

উপরোক্ত ক্ষেত্রে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা সার্বিক পরিস্থিতি তথা পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে শত্রুরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের পর আসন অবলম্বন করবেন।

০৭-০৪-০৪ এক্ষেত্রে কৌটিল্যের আচার্য মনে করেন—উপরোক্ত উর্বর ভূমির দিকে ধাবিত শত্রুরাজাকে নিবৃতকরণের চেষ্টা করা হলে আখেরে শত্রুর দ্বারা নিজ রাজ্য গ্রাসের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, এ কারণে এহেন কর্মে প্রবৃত্ত না হওয়াই বিধেয়। কৌটিল্য উক্ত আচার্যের অভিমতের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে বলেন—এ ধরনের আগ্রাসী শক্তিকে যদি প্রতিরোধ করা না হয়, তাহলে এক পর্যায়ে তা রাজার জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। এক্ষেত্রে উক্ত শত্রুরাজা বিজিত সম্পদ দিয়ে নিজেকে আরও বলশালী করে একসময় রাজাকে উচ্ছেদ করতে পারে।

০৭-০৪-০৫ শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করে রাজা যখন আসন গ্রহণ করেন, তখন তাকে বলা হয় সন্ধায়াসন। উপরোক্ত যেসব কারণে যুদ্ধের পর রাজা আসন অবলম্বন করবেন, সেসব কারণের বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে সন্ধির পর রাজাকে আসন অবলম্বন করতে হবে। সাধরণ সময়ে রাজা বিবাদ বাধিয়ে শত্রুরাজার বিরুদ্ধে সেনাভিযান পরিচালনা করবেন। কিন্তু শত্রুরাজা যখন তার সর্বশক্তি নিয়ে অন্য শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে, তখন রাজা তার সঙ্গে বিবাদ বাধিয়ে সেনাভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে।

০৭-০৪-০৬ রাজা যখন মনে করবেন—১. শত্রুরাজা দুর্দশায় নিপতিত ২. শত্রুর দোষযুক্ত অমাত্যদের দোষমুক্তকরণ সম্ভব নয় ৩. শত্রুর সৈন্যরা অত্যাচারিত হয়ে যুদ্ধে নিরুৎসাহিত, তাদের মধ্যে অনৈক্য বিরাজিত ৪. আগুন, বন্যা, ব্যাধি মহামারি বা দুর্ভিক্ষের প্রভাবে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তখন রাজা দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে শত্রুরাজার সঙ্গে বিবাদ বাধিয়ে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবেন।

০৭-০৪-০৭ অথবা রাজা যখন মনে করবেন—তার মিত্র সামনের দিকে অরির অন্তস্থিত রাজ্যের অধিপতি ও আক্রন্দ পেছনের দিকে পাগ্রিাহের অন্তস্থিত রাজ্যের অধিপতি এবং সম্মুখবর্তী ও পশ্চাদবর্তী মিত্র রাজারা সমর সক্ষমতায় সমৃদ্ধ, তার প্রতি অনুরক্ত, তাদের অমাত্য প্রকৃতির সহযোগে সমৃদ্ধ এবং শত্রুপক্ষ বিপরীত প্রকৃতিযুক্ত। তার মিত্ররা সম্মুখ ও পশ্চাতের শত্রুদের মোকাবেলায় সক্ষম। তখন রাজা বিবাদ বাধিয়ে শত্রুরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবেন। অথবা রাজা যদি মনে করেন—স্বল্পকালেই তিনি একাকী যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হবেন, সেক্ষেত্রে তিনি শত্রুর মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করবেন। এক্ষেত্রে উপরোক্ত পরিস্থিতি রাজার প্রতিকূল হলে এবং তা শত্রুর অনুকূল হলে, তিনি সন্ধি সম্পাদনের পর সেনাভিযান পরিচালনা করবেন।

০৭-০৪-০৮ (এ পর্যায়ে সম্ভূয়প্রয়াণ তথা যৌথঅভিযান সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে)। রাজার জন্য যদি শত্রুদেশ আক্রমণ করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি যদি এককভাবে উক্ত শত্রুদেশ আক্রমণ করতে সক্ষম না হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি সমশক্তিসম্পন্ন, তার থেকে হীন শক্তিসম্পন্ন এবং অধিক শক্তিসম্পন্ন মিত্রদের সমন্বয়ে যৌথঅভিযান পরিচালনায় প্রবৃত্ত হবেন। এসব ক্ষেত্রে একটি দেশের বিরুদ্ধে যদি আক্রমণ পরিচালিত হয়, তাহলে আক্রমণের পূর্বেই শরিকদের সঙ্গে বিজিত দেশের অধিকৃত সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টি আগাম নির্ধারণ করতে হবে। যদি একাধিক দেশ আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এ ধরনের প্রাক্ ভাগাভাগির বিষয়টি উহ্য থাকতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো মিত্র রাজা সরাসরি যুদ্ধে শরিক হতে অনিচ্ছুক হলে, রাজা উক্ত মিত্ররাজের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সৈনিক সহায়তা গ্রহণ করবেন অথবা প্রয়োজনের সময় মিত্ররাজাকেও অনুরূপ সহায়তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, যুদ্ধে সম্পৃক্ত করাবেন এবং যুদ্ধে বিজয় লাভের পর অধিকৃত ভূমি ও সম্পদ মিত্রদের সঙ্গে কীভাবে বণ্টিত হবে, সে বিষয়ক চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন।

০৭-০৪-০৯ এই ধরনের যৌথ অভিযানের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের পর অধিকৃত ভূমি এবং সম্পদ শরিকগণের ভূমিকা ও বিনিয়োগের অনুপাত অনুসারে বণ্টন করতে হবে। এক্ষেত্রে কে কত সৈন্য যুদ্ধে নিয়োগ করেছে, কে কি পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, উপকরণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে, ইত্যাকার বিষয় বিবেচনা করে অধিকৃত সম্পদ ভাগাভাগি করতে হবে।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ১০৮-১১০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে আক্রমণীয় (যাতব্য) এবং বলবান শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান, অমাত্যসহ প্রকৃতিবর্গের অবক্ষয়ের কারণ, লোভ এবং অনানুগত্যতা তথা বিরাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অবক্ষয় বলতে এখানে হাতি, ঘোড়া, অমাত্য, সেনা তথা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষয়প্রাপ্ততার বিষয় বোঝানো হয়েছে। লোভ বলতে সম্পদের প্রতি অতি আকাঙ্ক্ষা এবং বিরাগ বলতে রাজার প্রতি প্রকৃতিবর্গের বিদ্বেষ পরায়ণতার কথা বোঝানো হয়েছে। কি কারণে উপরোক্ত পরিস্থিতি উদ্ভূত হয় এবং কীভাবে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব, সম্মিলিত অভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে রাজার করণীয়, ইত্যাকার বিষয়েও এ পর্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৭-০৫-০১ আক্রমণীয় এবং বলবান অমিত্র প্রকৃতির দুই প্রতিবেশী রাজ্য বিপর্যয়ে নিপতিত হলে, কার বিরুদ্ধে প্রথমে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে, এই ধরনের সংশয় উদ্ভূত হলে, রাজা প্রথমে বলবান অমিত্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবেন। অতঃপর তিনি সফলতা অর্জন করলে অন্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। কারণ বলবান অমিত্রকে যুদ্ধে পরাভূত করা সম্ভব হলে, আক্রমণীয় অন্য শত্রুরা সহজেই সমর্পিত হবে। এর বৈপরীত্য হলে অর্থাৎ অক্রমণীয় শত্রুকে প্রথমে আক্রমণ করা হলে, বলবান অমিত্র যুদ্ধকালে তার সঙ্গে জোট বেধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

০৭-০৫-০২ দুই শত্রু রাজার মধ্যে একজন যদি অধিক বিপর্যস্ত এবং অন্যজন যদি স্বল্প বিপর্যস্ত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কার বিরুদ্ধে প্রথমে সেনাভিযান পরিচালনা করা সঙ্গত হবে, এ ধরনের সংশয়মূলক পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে কি করণীয়, সে সম্পর্কে কৌটিল্যের আচার্যের মত হলো—এক্ষেত্রে অধিক বিপর্যস্ত শত্রুর বিরুদ্ধে সেনাভিযান পরিচালনা করাই সঙ্গত হবে। কারণ, তাকে খুব সহজেই পরাভূত করা সম্ভব হবে। কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত সমর্থন করেন না, তিনি মনে করেন—এমত প্রেক্ষাপটে প্রথমে স্বল্প বিপর্যস্ত শত্রুর বিরুদ্ধেই আক্রমণ চালাতে হবে, তা না হলে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে শত্রুরাজা নিজের বিপর্যয় কাটিয়ে বলবান হয়ে অধিক বিপর্যস্ত শত্রুর পক্ষাবলম্বন করে রাজার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। অথবা সে শত্রুরাজা পার্ফি বা পশ্চাদবর্তী শত্রুর সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আক্রমণ প্রয়াসী রাজার ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত হতে পারে।

০৭-০৫-০৩ একই সময় তিন প্রকৃতির বিপদাপন্ন শত্রু তথা—সুশাসক বা প্রজাহিতার্থী মহাবিপদাপন্ন শত্রু, প্রজা নিপীড়নকারী স্বল্পবিপদাপন্ন শত্রু কিংবা অমাত্যসহ বিরূপ প্রকৃতিবর্গবেষ্টিত বিপদাপন্ন শত্রুর উপস্থিতি প্রতিভাত হলে, কার বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আক্রমণ পরিচালনা সঙ্গত হবে বিষয়ক সংশয় বা দ্বিধা উদ্ভূত হলে, সেক্ষেত্রে অমাত্যসহ বিরূপ প্রকৃতিবর্গ পরিবেষ্টিত বিপদাপন্ন শত্রুরাজার বিরুদ্ধেই সর্বাগ্রে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।

কারণ, প্রজাহিতার্থী বিপর্যস্ত শত্রুরাজাকে আক্রমণ করা হলে, অনুগত প্রজাগণ রাজার সাহায্যে এগিয়ে এসে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ফলে উক্ত শত্রুরাজকে পরাজিত করা সহজ নাও হতে পারে।

অন্যদিকে প্রজা পীড়নকারী স্বল্পবিপর্যস্ত শত্রুকে আক্রমণ করা হলে তার অপ্রসন্ন প্রজা বা অমাত্যরা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে পারে, ফলে অভ্যন্তরীণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে শত্রুরাজা স্বশক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, যে কারণে তাকে সহজে পরাভূত করা সম্ভব নাও হতে পারে।

কিন্তু অমাত্যসহ বিরূপ প্রকৃতিবর্গ (সেনা, ব্যবসায়ী, সকল শ্রেণির জনগণ) পরিবেষ্টিত শত্রুরাজার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনাকালে কেউই তার সাহায্যার্থে সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করবে না, বরং সকলেই তার অপসারণের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকবে। যে কারণে অতিসহজেই তাকে পরাভূত করা সম্ভব হবে।

০৭-০৫-০৪ যে আক্রমণীয় শত্রুর প্রকৃতিবর্গ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে বিপর্যস্ত অথবা লোভাতুর কিংবা যে শত্রুর প্রকৃতিবর্গ রাজা কর্তৃক অবহেলিত, তিরস্কৃত, চরিত্রহীন বা রাজদ্রোহী প্রকৃতির, তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা আবশ্যক বলে অনুভূত হলে, কার বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আক্রমণ পরিচালনা করা সঙ্গত হবে, সে প্রশ্নে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রথমোক্তের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আক্রমণ চালাতে হবে।

কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমতের সঙ্গে একমত নন, তিনি মনে করেন—দুর্ভিক্ষাক্রান্ত ও লোভার্ত প্রজারা বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও রাজার প্রতি অনুগত হতে পারে, দুঃসময়ে রাজার পাশে দাঁড়াতে পারে এবং তাদের বিভাজিত করাও কঠিন হতে পারে, এ কারণে উক্ত ধরনের শত্রুরাজের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে অভীষ্ট অর্জিত নাও হতে পারে। কিন্তু যে শত্রুর প্রকৃতিবর্গ রাজা কর্তৃক অবহেলিত, তিরস্কৃত, চরিত্রহীন বা রাজদ্রোহী প্রকৃতির, তাদের খুব সহজেই বিভাজিত করা সম্ভব, অনুগত করা সম্ভব, এ কারণে এ ধরনের অক্রমণীয় শত্রুরাজের বিরুদ্ধেই সর্বাগ্রে আক্রমণ পরিচালনা করা সঙ্গত হবে।

০৭-০৫-০৫ অত্যাচারী শত্রু যদি বলবান হয় এবং সুশাসক শত্রুরাজা যদি দুর্বল হয়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কার বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আক্রমণ পরিচালনা করা সঙ্গত হবে, এহেন সমস্যা বা প্রশ্ন যদি উত্থিত হয়, সেক্ষেত্রে অত্যাচারী বলবান আক্রমণীয় শত্রুর বিরুদ্ধেই আক্রমণ পরিচালনা সঙ্গত। কারণ এ ধরনের শত্রুকে আক্রমণ করা হলে অমাত্য, প্রজাবর্গ এবং সেনাবাহিনী সে রাজাকে রক্ষার্থে কোনো সহযোগিতা না করে তাকে বর্জন করে থাকে এবং আক্রমণকারী শক্তিকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য এগিয়ে আসে।

কিন্তু কোনো দুর্বল সুশাসককে আক্রমণ করা হলে, তার অমাত্য, প্রজাবৰ্গ, সেনাবাহিনী উক্ত রাজাকে রক্ষার্থে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যে কারণে এ ধরনের শত্রু দুর্বল হলেও তাদের পরাজিত করা কঠিন হয়ে ওঠে।

০৭-০৫-০৬ প্রকৃতিদের (প্রকৃতি বলতে বোঝানো হয়েছে—রাজা, অমাত্য, রাষ্ট্র, দুর্গ, কোষ ও মিত্র) ক্ষয়, লোভ ও রাজদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণসমূহ—

১. রাজা যদি; সজ্জনদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে নট-নর্তকী ও দুর্জনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। উচিতকর্ম এবং সদাচার পরিত্যাগ করে অমর্ধীয়, অনুচিত ও বিদ্বেষমূলক কাজ করেন। জনহিতকর কর্ম প্রত্যাখান করে অনাচার প্রবর্তন করেন।

২. বাঁধ বা দুর্গ নির্মাণের মতো গঠনমূলক কাজ না করে, অর্থহীন অসার কাজে প্রবৃত্ত হন। প্রাপ্য বেতন হতে কর্মচারীদের বঞ্চিত করেন। প্রজাদের কাছ থেকে বলপূর্বক ধন-সম্পদ অপহরণ করেন। প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে নিরপরাধ লোকদের শাস্তি প্রদান করেন। পরিত্যাজ্য ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে আপন করে নেন এবং বিদ্বান ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের অবজ্ঞা করে দূরে ঠেলে দেন।

৩. প্রজাহিতকর ইতিবাচক উদ্যোগ পরিহার করে ক্ষতিকারক সন্ধি-বিবাদে নিমগ্ন থাকেন। প্রজার নিরাপত্তা উপেক্ষা করে চোরের মতো স্বয়ং সম্পদ লুণ্ঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সুকর্মের সমালোচনা করে কুকর্মের স্বীকৃতি প্রদান করেন। বাঁধ বা দুর্গ নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে দায়িত্বরত প্রশাসকদের অপবাদ দিয়ে নিকৃষ্টকর্মে নিয়োগ করেন। শিক্ষক, পুরোহিত বা ঋত্বিকের মতো মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অবমাননা করেন।

৪. বয়োজ্যেষ্ঠ প্রাজ্ঞজনদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন, অসত্য কথা বলে তাদের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দেন। উপকারীর উপকার না করে অপকার করেন। শিকার বা জুয়ায় মতো বদভ্যাসে আসক্ত হয়ে করণীয় কর্মে শিথিলতা প্রদর্শন করেন। আলস্যজনিত কারণে সম্পদ আহরণে মনোযোগ না দিয়ে সম্পদবিনাশে প্রবৃত্ত হন। তাহলে উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির ক্ষয়জনিত কারণে রাজার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা বিদ্বেষের উন্মেষ ঘটে।

৫. এভাবে নানাদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রকৃতিবর্গ রাজার প্রতি ক্ষুব্ধ বা বিরক্ত হয়ে লোভার্ত হয়ে ওঠে, অতঃপর তারা শত্রুরাজার সহায়তায় অথবা নিজেরাই স্বপ্রোণোদিত হয়ে রাজার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে তাকে হত্যা করে।

০৭-০৫-০৭ এসব কারণে রাজা কখনো অমাত্য ও প্রকৃতিবর্গের ক্ষতিসাধন করবেন না, তাদের লোভার্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন না এবং নিজেকে তাদের বিরাগভাজন করবেন না। এ ধরণের পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার প্রতিকার করবেন। ক্ষতিগ্রস্ত, লোভার্ত এবং বিরক্ত প্রকৃতিদের ক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে পরেরটি অধিক গুরুতর বলে বুঝতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তজনেরা রাজার উৎপীড়নের ভয়ে খুব সহসা সমর্পিত হয় বা পালিয়ে যায়। লোভার্ত জনেরা খুব সহজে শত্রুর প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে রাজার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু বিরক্তজনেরা রাজা আক্রান্ত হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে উচ্ছেদের জন্য আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

০৭-০৫-০৮ অর্থ বা শস্য দিয়ে সহজেই বাহন বা কর্মকারদের ক্ষতির প্রতিবিধান করা যায়, কিন্তু প্রকৃতিজনের অর্থ ও শস্যের ক্ষতিসাধিত হলে সে ক্ষতির প্রতিকার করা কঠিন হয়ে পড়ে। লোভ প্রকৃতিবর্গের সামান্য সংখ্যক মুখ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর উৎস সন্ধান করে লোভের প্রতিকার করতে হবে। শত্রুর সম্পদ লুণ্ঠন করে তা বিতরণের মাধ্যমে প্রকৃতিবর্গের লোভের প্রতিবিধান করা সম্ভব। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে প্রকৃতিবর্গের বিরাগ বা বিদ্বেষের প্রতিবিধান করতে হবে অবদমন বা নিগ্রহের মাধ্যমে।

০৭-০৫-০৯ যৌথঅভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে, সমবায়িক বা যৌথবাহিনীতে অংশগ্রহণকারী রাজাদের মধ্যে যিনি বলবান ও বিশুদ্ধ গুণসম্পন্ন, তাকে নিয়েই রাজা সম্মিলিত অভিযানে প্রবৃত্ত হবেন। পেছনের পার্ষিগ্রাহ শত্রুকে অবদমনে সক্ষম, প্রয়োজনীয় সেনাসহায়তা প্রদানে সমর্থ এবং বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী সহযোগী রাজাদের সম্মিলিত সেনাভিযানই এক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনতে পারে।

০৭-০৫-১০ সম্মিলিতবাহিনীতে অংশগ্রহণকারী রাজশক্তির কেউ যদি অধিক বলবান হয়ে থাকেন, কেউ যদি সমশক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাহলে কোনো পক্ষের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজা অভিযান পরিচালনা করবেন, এ ধরনের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে, সমশক্তিসম্পন্ন দুইজন রাজাকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

কারণ, অধিক বলশালীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হলে, রাজা তার দ্বারা অবমূল্যায়িত হতে পারেন, তাকে তার বশীভূত হয়ে থাকতে হতে পারে, কিন্তু সমশক্তিসম্পন্নদের সঙ্গে অবস্থানকালে উক্তরূপ পরিস্থিতি উদ্ভবের সম্ভাবনা থাকে না। অধিকন্তু তাদের একজনকে অবদমনকরণ আবশ্যক হলে উভয়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে সহজেই তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।

০৭-০৫-১১ সম্মিলিত রাজশক্তির একজন সমশক্তিসম্পন্ন এবং দুইজন হীনশক্তিসম্পন্ন হলে, কোন পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে রাজা অভিযান পরিচালনা করবে, এমত প্রশ্ন উত্থিত হলে, রাজাকে হীনশক্তিসম্পন্নদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কারণ, এক্ষেত্রে তারা রাজার বশীভূত হয়ে তার নিরাপত্তা বিধানকল্পে অগ্র-পশ্চাদে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণ করবে।

সম্মিলিত অভিযানে অংশগ্রহণকারী কোনো বলশালী রাজা যদি সফলতা অর্জনের পর কপটতা অবলম্বন করেন, সেক্ষেত্রে রাজা অন্যদের অগোচরে যে কোনো অজুহাতে উক্ত বলবান রাজাকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবেন। কিন্তু উক্ত বলবান রাজা যদি বিশুদ্ধ চিত্তসম্পন্ন হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজা তাকে কখনো পরিত্যাগ করবেন না।

সম্মিলিত অভিযানের সময় নিরাপত্তার স্বার্থে রাজা কখনো সংকটাকীর্ণ দুর্গে স্বজনসহ তার প্রিয় নারীদের নিয়ে অবস্থান করবেন না। এক্ষেত্রে যুদ্ধে সফলতা অর্জনের পর সমশক্তিসম্পন্ন রাজার তরফ থেকেও বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সমশক্তিসম্পন্ন রাজাও বিজয় অর্জনের পর অতিগর্বে গরীয়ান হয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে।

কারণ, অতি সমৃদ্ধির পুলকেও মানুষের চিত্তের পরিবর্তন ঘটে থাকে। এ ধরনের অভিযান শেষে বলবান রাজার কাছ থেকে অধিকৃত সম্পদের সামান্য অংশ পেলেও রাজা প্রসন্নচিত্তে তা গ্রহণ করবেন। এমনকি কোনো অংশ না পেলেও তিনি প্রতিবাদ না করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন এবং সুযোগ পাওয়ামাত্র নিজের প্রাপ্যতার দ্বিগুণ উসুল করবেন।

সম্মিলিত অভিযানে নেতৃত্বদানকারী রাজা যুদ্ধ সমাপ্তির পর তার সহযোগী মিত্রদের পরিতৃপ্ত করে বিদায় দিবেন। প্রয়োজনে নিজের জন্য অধিকৃত সম্পদের যৎসামান্য রেখে সহযোগিদের মধ্যে পর্যাপ্ত সম্পদ বিতরণ করে দিবেন। এ ধরনের ঔদার্যের সুবাদে রাজা রাজমণ্ডলের প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন, যা আখেরে তার জন্য কল্যাণকর হবে।

ষষ্ঠ অধ্যায় ॥ ১১১-১১২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে যুদ্ধাভিযানে যুক্ত সম্মিলিত শক্তির মধ্যে সম্পাদিতব্য শর্তহীন এবং শর্তযুক্ত চুক্তির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে চুক্তি ভঙ্গ, চুক্তি পুনঃসম্পাদন, সম্মিলিত আক্রমণের প্রকৃতি, যুদ্ধের প্রকৃতি, ইত্যাকার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৭-০৬-০১ রাজা তার সম্মুখবর্তী শত্রু তথা অরির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেও যুদ্ধাভিযানে অবতীর্ণ হতে পারেন। এক্ষেত্রে লব্ধ-সম্পদ ভাগাভাগির শর্তে উভয়ে নিজেদের লক্ষ্যীভূত রাজ্য আক্রমণের জন্য অভিযান চালাবে। এ ধরনের যুদ্ধাভিযানে উভয়ে যদি সমভাবে লাভবান হন, তাহলে রাজা তার অরির সঙ্গে সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন। কিন্তু তিনি যদি অধিক লাভবান হয়ে অরি অপেক্ষা বলবান হয়ে ওঠেন, তাহলে শক্তি প্রদর্শনের প্রত্যয়ে অরির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন।

০৭-০৬-০২ (এই অধিকরণের ৩-৭ অধ্যায়ে তিন ধরনের হীন সন্ধির কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও আরও অন্যান্য সন্ধির বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজনে এখানে পরিপণিত এবং অপরিপণিত সন্ধির বিষয় বিধৃত হয়েছে)। যে সন্ধির মাধ্যমে রাজা কর্তৃক অরির শত্রুদেশ এবং অরি কর্তৃক রাজার শত্রুদেশ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সে সন্ধিকে বলা হয় পরিপণিতদেশসন্ধি।

আক্রমণের সময়সীমা (কতদিন পর্যন্ত যুদ্ধাভিযান চলতে থাকবে) নির্ধারণের শর্তে যে সন্ধি সম্পাদিত হয়ে থাকে তাকে বলা হয় পরিপণিতকালসন্ধি। আক্রমণের বিষয়বস্তু নির্ধারণ সাপেক্ষে যে সন্ধি সম্পাদিত হয়ে থাকে, সে সন্ধিকে বলা হয় পরিপণিতার্থসন্ধি।

০৭-০৬-০৩ রাজা পরিপণিতদেশসন্ধির মাধ্যমে তার প্রতিপক্ষকে এমনতর দেশে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রেরণ করবেন—যে দেশ গিরিদুর্গ, বনদুর্গ এবং জলদুর্গের দ্বারা অতীব সুরক্ষিত, যে দেশ জঙ্গল বেষ্টনির কারণে বিচ্ছিন্ন, যে দেশে অন্যস্থান থেকে ধানসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে যাওয়া অসম্ভব, যে দেশে সহায়ক সেনাদের নিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয়, যে দেশে তৃণ, ঘাস, জ্বালানি ও জল পাওয়া যায় না, যে দেশ অজ্ঞাত এবং দূরবর্তী, যে দেশের জনগণ রাজানুগত নয়, যেখানে সৈনিকদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনার উপযুক্ত স্থান নেই। কিন্তু রাজা নিজে সহজে জয়যোগ্য রাজ্য আক্রমণের জন্য অভিযানে প্রবৃত্ত হবেন।

০৭-০৬-০৪ বিপরীতপক্ষ কর্তৃক অতিবর্ষণপ্রবণ, অতি উষ্ণ, তীব্র শীতার্ত, ব্যাধির প্রকোপযুক্ত, খাদ্য ও ভোগ্যদ্রব্যের সঙ্কটাপন্ন এবং সেনাভিযানের জন্য কষ্টকর এলাকায় অভিযান পরিচালনার সম্মতি প্রদান করা হলে এবং বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজাকে এর বিপরীতধর্মী এলাকায় অভিযান পরিচালনার সুযোগ প্রদান করা হলে, বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা উক্তপক্ষ তথা শত্রুরাজের সঙ্গে পরিপণিতকাল সন্ধি সম্পাদনে সম্মত হবেন।

০৭-০৬-০৫ যখন রাজা মনে করবেন তার শত্রু কর্তৃক কোন দেশে সেনাভিযান পরিচালনা করা হলে–আক্রান্ত দেশের অমাত্য ও প্রকৃতিবর্গের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হবে, সেই অভিযানে বিজয় লাভ প্রলম্বিত হবে, প্রচুর জান মালের ক্ষতি সাধিত হবে, ভবিষ্যতের ফলাফল হবে অত্যন্ত নেতিবাচক, সেই যুদ্ধাভিযান ধর্মীয় মূল্যবোধহীন বলে বিবেচিত হবে, এর ফলে মধ্যম ও উদাসীন রাজারা বিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করবে এবং মিত্র রাজারা উৎপীড়িত হবে, কিন্তু বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার যুদ্ধাভিযান হবে এর বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, তখন তিনি উক্ত শত্রুরাজের সঙ্গে পরিপণিতকার্যসন্ধি সম্পাদন করবেন।

০৭-০৬-০৬ এভাবে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা দেশ ও কাল, কাল ও কার্য এবং দেশ, কাল ও কার্যের সমন্বয়ে আরও চার ধরনের পরিপণিতসন্ধিতে আবদ্ধ হতে পারেন। এ সমস্ত সন্ধির মাধ্যমে রাজা নিজের অভীষ্ট অর্জনে সচেষ্ট হবেন, অতঃপর সন্ধিতে আবদ্ধ শত্রুকে উৎখাতের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

০৭-০৬-০৭ মদ্যপ, জুয়াড়ি, অলস, অবিদ্বান ও বদ খাসিলত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শত্রুকে অবদমনের জন্য রাজা দেশ, কাল বা কার্যের পরিপণিতসন্ধির পন্থা অবলম্বন না করে আস্থা অর্জনের মাধ্যমে তার সঙ্গে মৌখিকভাবে বিনাশর্তের সন্ধি তথা অপরিপণিতসন্ধিতে আবদ্ধ হবেন এবং উক্ত শত্রুর দুর্বল স্থানে আঘাত করে তাকে ধ্বংস করবেন।

০৭-০৬-০৮ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা এক সামন্তরাজের বিরুদ্ধে অপর সামন্তরাজকে লেলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উভয়ের শক্তিক্ষয় করাবেন এবং এই সুযোগে অক্রমণীয় মিত্রদের উচ্ছেদ করে তাদের রাজ্য অপহরণ করে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবেন।

০৭-০৬০৯ প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে সন্ধি চার প্রকার—১. অকৃতচিকীর্ষা ২. কৃতশেষণ ৩. কৃতবিদূষণ এবং ৪. অবশীর্ণক্রিয়া। যে সন্ধি সম্পাদিত হয়নি তা সম্পাদনের অভিপ্রায়কে অথবা যে সন্ধির কোনো সমাপ্তি নেই, সে সন্ধিকে বলা হয় অকৃতচিকীর্ষা। যে সন্ধি শর্তাদির মাধ্যমে সম্পাদিত হয় তাকে বলা হয় কৃতশেষণ। মিথ্যে অভিযোগ উত্থাপনের মাধ্যমে যে সন্ধি ভঙ্গ করা হয়, তাকে বলা হয় কৃতবিদূষণ এবং যে সন্ধি ছিন্ন করার পর পুনরুজ্জীবিত করা হয়, তাকে বলা হয় অবশীর্ণক্রিয়া সন্ধি।

বিগ্রহ বা যুদ্ধের তিন প্রকার বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে—

১. প্রকাশযুদ্ধ তথা প্রকাশ্যে সকলের জ্ঞাতসারে কারো সঙ্গে কারো যুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে। ২. কূটযুদ্ধ তথা আন্তঃরাজ্যের রাজাদের সঙ্গে সংঘটিত কূটনৈতিক যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধ বাদ-প্রতিবাদের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ থাকে। ৩. তৃষ্ণীংযুদ্ধ তথা অন্তর্ঘাতমূলক যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধ গুপ্তচরদের মাধ্যমে সঙ্গোপনে পরিচালিত হয়ে থাকে।

০৭-০৬-১০ পূর্বে কখনো সন্ধি হয়নি, এ ধরনের কারো সঙ্গে সন্ধি সম্পাদন প্রাক্কালে যদি সমশক্তিসম্পন্ন রাজার সঙ্গে সমপরিমাণ উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে সন্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে, হীনশক্তিসম্পন্ন রাজার কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করে সন্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় কিংবা অধিক শক্তিসম্পন্ন রাজাকে উপহার প্রদানের মাধ্যমে সন্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা হবে অকৃতচিকীর্ষাসন্ধির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

০৭-০৬-১১ রাজার সঙ্গে পূর্বে সম্পাদিত সন্ধির আলোকে যদি শর্তসমূহ সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয়, হিতকর আচার পরিদৃষ্ট হয়, নিজ নিজ নিরাপত্তা সংরক্ষিত হয়, তাহলে তা হবে কৃতশেষণসন্ধির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

০৭-০৬-১২ কারো সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনের পর রাজা যদি গুপ্তচরদের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালিয়ে সন্ধির অসারতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়ে উক্ত সন্ধি ভঙ্গ করেন, তাহলে তা হবে কৃতবিদূষণসন্ধির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। সন্ধিতে আবদ্ধ কেউ যদি সন্ধি ভঙ্গ করে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজাকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রত্যাবর্তন করে পুনর্বার একই সন্ধিতে আবদ্ধ হন, তাহলে তা হবে অবশীর্ণক্রিয়াসন্ধির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

০৭-০৬-১৩ উপরোক্ত অবশীর্ণক্রিয়া সন্ধি চারভাবে সম্পাদিত হতে পারে— ১. কোনো রাজা সুনির্দিষ্ট কারণে সন্ধি ভঙ্গ করে চলে যাওয়ার পর পুনরায় কোনো সুনির্দিষ্ট কারণে প্রত্যাবর্তন করে সন্ধিতে আবদ্ধ হতে পারে ২. অকারণে সন্ধি ভঙ্গ করে পুনর্বার কোনো কারণ ছাড়াই সন্ধিতে আবদ্ধ হতে পারে ৩. কোনো কারণে সন্ধি ভঙ্গ করে চলে যাওয়ার পর কোনো কারণ ছাড়াই প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় সন্ধিতে আবদ্ধ হতে পারে ৪. কোনো কারণ ছাড়া সন্ধি ভঙ্গ করে চলে যাবার পর সুনির্দিষ্ট কারণে প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় সন্ধিতে আবদ্ধ হতে পারে।

০৭-০৬-১৪ কেউ যদি রাজার দোষ-ত্রুটির কারণে সন্ধি ভেঙে তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায় এবং পরবর্তী সময়ে তার গুণাবলি পর্যবেক্ষণ করে প্রত্যাবর্তন করে বা শত্রুর গুণাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে আশ্রয়গ্রহণের পর তার দোষদর্শন করে পুনরায় পূর্বের প্রভু বা রাজার কাছে প্রত্যাবর্তন করে, তাহলে এই প্রকৃতির ব্যক্তির সঙ্গে পুনর্বার সন্ধি করা সঙ্গত।

যারা নিজের দোষে সন্ধি ভেঙে রাজাকে পরিত্যাগ করে শত্রুর আশ্রয়ে চলে যায় এবং নিজের দোষেই শত্রুকে পরিত্যাগ করে রাজার কাছে প্রত্যাবর্তন করে। অথবা যারা নিজপ্রভু ও শত্রুর সদ্‌গুণ উপেক্ষা করে তাদের পরিত্যাগ করে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে, তারা চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে, এ ধরনের চঞ্চল বা অস্থিরচিত্তের ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই পুনরায় সন্ধি করা সমীচীন নয়।

০৭-০৬-১৫ যারা নিজ প্রভুর দোষজনিত কারণে তাকে পরিত্যাগ করে শত্রুর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং নিজ ইচ্ছায় শত্রুর কাছ থেকে প্রত্যাগমন করে, তাদের প্রত্যাবর্তনের হেতু ভালোভাবে অনুসন্ধান করে জেনে নিতে হবে। তারা বা তিনি কি পুরানো অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণের অভিপ্রায়ে প্রত্যাবর্তন করেছেন, নিজের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের নিমিত্ত প্রত্যাবর্তন করেছেন, রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত প্রত্যাবর্তন করেছেন, ইত্যাকার বিষয় খতিয়ে দেখার পর তাকে যদি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে রাজা তাকে মর্যাদার সাথে নিজের সান্নিধ্যে অবস্থানের সুযোগ দিবেন। কিন্তু তার প্রত্যাবর্তন যদি সন্দেহজনক বলে প্রতিভাত হয়, তাহলে রাজা তাকে নির্বাসিত করবেন।

০৭-০৬-১৬ একইভাবে কেউ যদি দোষ না থাকা সত্ত্বেও নিজের ইচ্ছায় রাজাকে পরিত্যাগ করে শত্রুর কাছে আশ্রয়গ্রহণের পর শত্রুর দোষের কারণে প্রত্যাবর্তন করে, তাহলে তার ব্যাপারেও বিস্তারিত অনুসন্ধান করতে হবে, অতঃপর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বলে প্রতীয়মান হলে রাজা তাকে মর্যাদার আসনে আসীন করবেন কিন্তু তার উপর সন্দেহের উদ্রেক হলে তিনি তাকে নির্বাসিত করবেন।

০৭-০৬-১৭ কৌটিল্যের আচার্য মনে করেন নিম্নোক্ত কারণে রাজারা অন্যদের দ্বারা পরিত্যক্ত হতে পারেন—১. রাজা কর্তৃক কারো সুকর্ম অস্বীকৃত হলে ২. রাজা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লে ৩. পণ্যমূল্য তুল্য মনে করে রাজা কর্তৃক বিদ্যাকে তুচ্ছ করা হলে ৪. রাজা কর্তৃক কথার বরখেলাপ করা হলে ৫. দেশে যদি মশকের উপদ্রব হয় বা রাজা কর্তৃক অন্য দেশ দখলের লোলুপতা প্ৰদৰ্শিত হলে ৬. রাজা কর্তৃক অধীনস্থদের অবিশ্বাস করা হলে ৭. রাজা কর্তৃক বারবার বলবান শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা হলে, একসময় তিনি পরিত্যক্ত হন। এক্ষেত্রে কৌটিল্যের অভিমত হলো—রাজার প্রতি ভয়, রাজা কর্তৃক অপ্রাপ্তি এবং রাজার ক্রোধের কারণেই সাধারণত তিনি পরিত্যক্ত হয়ে থাকেন।

০৭-০৬-১৮ ভেঙে যাওয়া সন্ধি পুনঃস্থাপন—সন্ধি ভেঙে শত্রুর আশ্রয়ে অবস্থান গ্রহণকারী প্রত্যাবর্তিত ব্যক্তি যদি রাজার উপকার করে থাকে, তাহলে রাজা তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে দূরবর্তী কোনো একস্থানে নিজের আশ্রয়ে পরিপালন করবেন। উক্ত ব্যক্তি যদি নিষ্কলুষ বলে প্রতিভাত হয়, তাহলে রাজা তাকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করবেন। তার দক্ষতা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হলে তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধে প্রেরণ করবেন অথবা তাকে কোনো দূরবর্তী প্রদেশের দায়িত্ব অর্পণ করবেন।

০৭-০৬-১৯ উপরোক্ত প্রত্যাগত ব্যক্তি যদি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাজা তাকে শত্রুদেশে পণ্য বিক্রয়ের জন্য প্রেরণ করবেন, অতঃপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে শত্রুদেশে পণ্য বিক্রির অপরাধে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বা তাকে হত্যা করাবেন।

০৭-০৬-২০ রাজাকে পরিত্যাগের পর শত্রুর সঙ্গে বসবাস করে কেউ যদি পুনরায় রাজার কাছে প্রত্যাবর্তন করে, সেক্ষেত্রে তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করতে হবে। শত্রুর সঙ্গে বসবাস সর্পের সঙ্গে বসবাসতুল্য। এ জন্য এ ধরনের ব্যক্তি সবসময় উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে। অশ্বত্থ বৃক্ষের ফল ভোজনকারী কপোত যেমন শিমূল বৃক্ষের ভীতির কারণ হয়ে থাকে, তেমনি শত্রুর সান্নিধ্যে বসবাসকারী প্রত্যাগত ব্যক্তিও রাজার জন্য সবসময় উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে।

০৭-০৬-২১ কোনো দেশের বিরুদ্ধে যখন প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয়, তখন তাকে বলা হয় প্রকাশযুদ্ধ। স্বল্পসৈনিক দিয়ে যখন প্রতারণার মাধ্যমে অধিকশক্তি প্রদর্শন করা হয়, তখন তা হয় বিভীষণ। নগরে আগুন লাগিয়ে লুণ্ঠনের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালিত হলে তাকে বলা হয় অবস্কন্দ। শত্রুর বিপর্যয়কালে পরিচালিত যুদ্ধ এবং একস্থানে যুদ্ধ করার ছলে অন্যস্থান আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালিত হলে, তাকে বলা হয় কূটযুদ্ধ। গুপ্তচরদের মাধ্যমে অন্তর্ঘাতমূলক আক্রমণ পরিচালিত হলে তাকে বলা হয় তৃষ্ণীংযুদ্ধ।

সপ্তম অধ্যায় ॥ ১১৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সন্ধি এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রে দ্বৈধীভাব তথা দ্বৈতনীতি গ্রহণ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে কখন কোন পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপটে রাজাকে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে সন্ধি তথা শান্তি এবং বিগ্রহ তথা যুদ্ধের পথ অবলম্বন করতে হবে, সে সব বিষয় আলোচিত হয়েছে।

০৭-০৭-০১ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা যদি মনে করেন, আক্রমণীয় রাজ্যে অভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে—প্রতিবেশী সামন্তশত্রু তার বিরুদ্ধে পেছন থেকে আক্রমণ করবে না, উপরন্তু সে পাঞ্চীগ্রহণকারী শত্রুকে আক্রমণ থেকে নিবৃত করবে, আক্রমণীয় শত্রুর পক্ষাবলম্বন করবে না, তার সহায়তার ফলে সৈনিক সমর্থতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে, তার দ্বারা রাজার স্থানীয় সম্পদের ক্ষতিসাধিত হবে না, অধিকন্তু শত্রুর সম্পদ বিনষ্ট হবে, পথিমধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তিনি তা নির্মূল করবেন, শত্রু সৈন্যদের আক্রমণ থেকে রাজার সৈন্যদের সুরক্ষার জন্য দায়িত্ব পালন করবে, বিপদকালে আক্রমণীয় রাজার সঙ্গে সন্ধির আয়োজন করতে সক্ষম হবে এবং অন্যান্য শত্রুকে রাজার প্রতি বিশ্বাসভাজন করে তুলতে সক্ষম হবে। তাহলে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা উক্ত প্রতিবেশী সামন্তশত্রুর সঙ্গে মিলিত হয়ে আক্রমণীয় রাজ্যে অভিযান চালাবেন।

০৭-০৭-০২ রাজা যদি এ ধরনের সমঝোতা করতে সক্ষম না হন, তাহলে তিনি দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে প্রতিবেশী সামন্ত রাজাদের মধ্যে যারা অধিক বলশালী, তাদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সৈন্যসংগ্রহ করবেন এবং সৈন্যের বিনিময়ে অর্থসংগ্রহের অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন।

এক্ষেত্রে অধিক বলশালী রাজাকে বিজিত অর্থ-সম্পদের অধিক লভ্যাংশ, সমশক্তিসম্পন্নকে সমপরিমাণ লভ্যাংশ এবং হীনশক্তিসম্পন্নকে আনুপাতিকহারে কম লভ্যাংশ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করত, তাদের সঙ্গে সন্ধি সম্পাদন করে রাজা আক্রমণীয় শত্রুদেশ আক্রমণ করতে পারেন। এই তিন প্রকার সন্ধিকে বলা হয়—অতিসন্ধি, সমসন্ধি এবং হীনসন্ধি।

০৭-০৭-০৩ উপরোক্ত লাভ তিন ধরনের—বলসম, বলাধিক এবং বলহীন। হীনশক্তিসম্পন্ন বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা অধিকশক্তিসম্পন্ন ভোগবিলাসে আসক্ত ও হানিকর সামন্তরাজের সঙ্গে সন্ধি করার সময় প্রাপ্ত লভ্যাংশ ভাগাভাগির ব্যাপারে দরকষাকষি করবেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দোষে দুষ্ট রাজা যদি কখনো উক্ত বলশালী সামন্তরাজ কর্তৃক নিগ্রহের সম্মুখীন হন, তাহলে তিনি উক্ত রাজার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করবেন বা নিজের দুর্বলতা উৎক্রমণের নিমিত্ত তার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করবেন। এ ধরনের সন্ধিকে বলা হয় বলসমলাভসন্ধি।

এ পর্যায়ে রাজা নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণের স্বার্থে বলশালী রাজাকে অধিক লভ্যাংশ প্রদানের শর্তে তার সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনে সচেষ্ট হবেন। অতঃপর উক্ত বলশালী সামন্তরাজা যদি হীনশক্তিসম্পন্ন বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজাকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে করেন, তাহলে তিনি তাকে অনুগ্রহ করবেন এবং এর বিপরীত মনে করলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এ ধরনের সন্ধিকে বলা হয় বলসমাধিকলাভসন্ধি।

০৭-০৭-০৪ যখন অধিক বলশালী সামন্ত রাজা শিকারের আসক্তিতে মোহগ্রস্থ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন, তার অমাত্য ও প্রকৃতিবর্গ ক্ষুব্ধ-ভীত-লোভার্ত হয়ে পড়ে, তিনি বিপদাপন্ন হয়ে পড়েন, তখন তাকে সুমিত্র হিসেবে গণ্য করে রাজা তার সঙ্গে অল্পলাভের শর্তে সন্ধি করতে পারেন। এ ধরনের সন্ধিকে বলা হয়, বলসমহীনলাভসন্ধি।

০৭-০৭-০৫ অধিক বলশালী সামন্ত রাজা নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হয়েও শত্রু রাজার সেনাবল ও অর্থবলনাশ অথবা নিজের অবাধ্য সৈন্যদের বিনাশ অথবা শত্রুর দ্রোহী সেনাদের কব্জা অথবা পীড়নযোগ্য ও উচ্ছেদযোগ্য শত্রুকে হীনশক্তিসম্পন্ন বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার মাধ্যমে উৎপীড়িত করার অভিপ্রায়ে তার থেকে কমশক্তিসম্পন্ন রাজার সঙ্গে অল্পলভ্যাংশের শর্তে সন্ধি করতে পারেন।

এক্ষেত্রে হীনশক্তিসম্পন্ন রাজা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হলে তাকে আর্থিক সহায়তা ও প্রদান করা যেতে পারে। কিন্তু উক্ত রাজা যদি কূটবুদ্ধিসম্পন্ন হয় তাহলে বলশালী রাজা তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করবেন। এ ধরনের সন্ধিকে বলা হয়, বলাধিকহীনলাভসন্ধি।

০৭-০৭-০৬ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা সমশক্তিসম্পন্ন শত্রুরাজার শুভবুদ্ধি ও অশুভবুদ্ধির দিকগুলো মূল্যায়ন করে তাকে সহায়তা প্রদান করবেন বা তার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করবেন।

০৭-০৭-০৭ সমশক্তিসম্পন্ন রাজা যদি একাই শত্রুর মোকাবেলা করতে সক্ষম হন এবং সম্ভাব্য সহযোগী শক্তি হিসেবে অংশগ্রহণকারী সমবলবান সামন্ত রাজা যদি নানা দোষে আসক্ত হয়ে থাকেন এবং অন্যান্য সামন্ত রাজারা যদি উক্ত রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে, তাহলে তার সঙ্গে হীনলাভ সন্ধি সম্পাদন করা যেতে পারে। অথবা সেই শত্রুরাজা যদি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজাকে আক্রমণ করার মতো সক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যেতে পারে বা পরিস্থিতির আলোকে সন্ধি সম্পাদন করা যেতে পারে।

০৭-০৭-০৮ দোষযুক্ত ও প্রকৃতিবর্গের বিরাগভাজন অধিক বলশালী, সমবলশালী বা কমবলশালী সামন্তরাজের বিনাশসাধনে ইচ্ছুক হলে অথবা তাদের কৃতকর্ম ধ্বংস করতে ইচ্ছুক হলে অথবা অভিযানকালে উক্ত প্রকৃতির সামন্তরাজদের অগ্রসরমান সম্মুখবর্তী সেনাদের আক্রমণ করতে ইচ্ছুক হলে অথবা উক্ত প্রকৃতির সামন্তরাজের আক্রমণীয় শত্রুর কাছে অধিক প্রাপ্তির প্রত্যাশা পোষণ করলে, রাজা তাদের কাছে অধিক অর্থ দাবি করবেন। এভাবে অধিক অর্থ প্রদানের জন্য যাচিত হয়ে উক্ত প্রকার সামন্ত রাজারা যদি নিজেদের সেনা প্রতিরক্ষা সংহতকরণের জন্য অন্য সামন্তদের উপর আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে তারা উক্ত প্রকার দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ করবেন।

০৭-০৭-০৯ হীনবলবান সামন্তের শত্রুকে বিনাশ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে রাজা যদি তাকে বশীভূত করতে ইচ্ছুক হন অথবা তার শত্রুকে উচ্ছেদের পর তাকেও যদি উচ্ছেদ করতে প্রতিজ্ঞ হন অথবা উক্ত সামন্তকে লাভজনক কিছু প্রদানের পর তা যদি অপহরণ করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে বলসমলাভের অধিক লাভের শর্তে রাজা উক্ত সামন্তের সঙ্গে সন্ধি করতে পারেন। এক্ষেত্রে উক্ত হীনবলবান সামন্ত যদি রাজার ক্ষতিসাধনে সমর্থ হন, তাহলে তিনি তার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করবেন এবং শক্তি প্রদর্শনে অসমর্থ হলে সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন।

০৭-০৭-১০ অধিকবলশালী রাজা যদি শিকারে আসক্তজনিত দোষে দোষাবহ হন এবং অমাত্য প্রকৃতির কাছে অপ্রিয় হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি হীনবলবান সামন্তের সঙ্গে বলসমলাভের শর্তে পণবদ্ধ হবেন, উক্ত পণবদ্ধ সামন্ত ক্ষতিসাধনে সক্ষম হলে রাজার উপর শক্তিপ্রদর্শন করবেন অথবা সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন। এর বিপরীত ক্ষেত্রেও একই পন্থা অনুরণীয় হবে।

০৭-০৭-১১ উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় পণকারী এবং পণবদ্ধ উভয়ে এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত হবেন। অতঃপর সন্ধি ও যুদ্ধ, এই উভয়ের ক্ষেত্রে যে পন্থায় অধিক অর্জন সাধিত হবে বলে প্রতীয়মান হবে, তারা সে পন্থাই অবলম্বন করবেন।

অষ্টম অধ্যায় ॥ ১১৪-১১৫ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে আক্রমণীয় শত্রুর প্রতি কি ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে এবং মিত্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী কীভাবে সহায়তা প্রদান করতে হবে, সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত পক্ষের করণীয় সম্পর্কিত বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-০৮-০১ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা কর্তৃক কোনো সামন্তরাজের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করা হলে, আক্রমণীয় উক্ত সামন্তরাজা সম্মিলিত বাহিনীভুক্ত কোনো এক রাজাকে বিজয়লব্ধ প্রাপ্য অর্থের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন। এছাড়াও তার যুদ্ধজনিত ব্যয়ের ক্ষতিপূরণ প্রদান করে উক্ত রাজাকে নিজের পক্ষভুক্ত করে সম্মিলিত বাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করাবেন।

০৭-০৮-০২ (সামরিক জোটভুক্ত কোনো সামন্তরাজা অসময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত রাজ্যের বহুল লোকক্ষয় এবং অর্থহানির অভিলাষ পোষণ করে অথবা শত্রু কর্তৃক তার রাজ্যে আক্রমণ প্রতিহত করতে অথবা প্রতি আক্রমণে ইচ্ছুক হলে, সেক্ষেত্রে করণীয় কি হবে, কোন প্রকৃতির সেনাবাহিনী দিয়ে কোন ধরনের রাজাকে সহায়তা প্রদান করতে হবে, কোন প্রেক্ষাপটে অন্য রাজাকে সেনাসহায়তা প্রদান সমীচীন হবে না, ইত্যাকার বিষয়ে এ পর্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে)।

০৭-০৮-০৩ অভিযানের ক্ষেত্রে মিত্রের উপকার এবং অমিত্রের ক্ষতির সম্ভাবনা অনুমিত হলে, রাজাকে সেই পন্থাই অবলম্বন করতে হবে, অধিক লাভের সম্ভাবনা সত্ত্বেও তিনি এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে অন্যপন্থা অবলম্বন করবেন না। তিনি দোষযুক্ত অমাত্য, শত্রু অথবা নগর উচ্ছেদকারী অধিক শক্তিসম্পন্ন রাজার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত কোনো সামন্তকে কোনোভাবেই লাভক্ষতির মানদণ্ডে সহায়তা প্রদান করবেন না, এমন কি তার সঙ্গে কোনো বিবাহের সম্পর্কেও সম্পর্কিত হবেন না।

০৭-০৮-০৪ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা সন্ধি সম্পাদন সত্ত্বেও তা লঙ্ঘনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে অথবা মিত্র ও অমিত্রের সঙ্গে পূর্বে সম্পাদিত সন্ধির ত্রুটি উত্থাপন করে অথবা শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা ব্যক্ত করে কখনো প্রতিশ্রুত অর্থের চেয়ে অধিক অর্থ দাবি করবেন।

০৭-০৮-০৫ বহুমিত্রের মধ্যে যারা রাজার উপকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন, তারাই হবেন রাজার বিশেষ অনুগ্রহভাজন। এইরূপ ক্ষেত্রে শক্যারম্ভী মিত্ররা রাজার অনুরূপকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন। কল্যারম্ভী মিত্ররা বিতর্কহীন কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন। ভব্যারম্ভী মিত্ররা এমন কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন, যা ভবিষ্যতে কল্যাণ বয়ে আনে। স্থিরকর্মা মিত্ররা কোনো কাজে প্রবৃত্ত হলে তা সমাপ্তির পূর্বে অবসর গ্রহণ করেন না। অনুরক্ত প্রকৃতির মিত্ররা স্বল্পসহায়তা পেয়েও আরোপিত কর্ম সম্পাদনে যত্নবান হয়ে থাকেন। এ ধরনের মিত্রদের কৃতকর্ম রাজার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। এর বিপরীত ধর্মীরা রাজার জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না, যে কারণে তারা রাজানুগ্রহের অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

০৭-০৮-০৬ যদি শত্রু এবং রাজা কর্তৃক এক সাথে কোনো একজনের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শনের আবশ্যকতা অনুভূত হয় এবং এ সংক্রান্ত বিতর্ক যদি উত্থাপিত হয়, তাহলে রাজা তাকেই অনুগ্রহ করবেন, যিনি অমিত্রকে উপেক্ষা করবেন, কারণ—এক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত রাজারও উপকৃত হবার সম্ভাবনা সূচিত হবে।

০৭-০৮-০৭ রাজা ও শত্রু যদি কোনো মধ্যম রাজাকে অনুগ্রহ করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে এক্ষেত্রে যিনি মিত্ররূপী বা মিত্রতররূপী মধ্যম রাজাকে অনুগ্রহ করবেন, তিনিই লাভবান হবেন।

০৭-০৮-০৮ মধ্যম বা উদাসীন রাজাকে সেনাসহায়তা প্রদানের প্রসঙ্গ উত্থিত হলে, যে রাজার সেনারা সাহসী, অস্ত্র চালনায় দক্ষ, কষ্টসহিষ্ণু, রাজানুগত এবং সহায়কশক্তি হিসেবে বিবেচ্য হবে, তাকেই সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রতিহত হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিশেষ অভীষ্ট অর্জনের প্রয়োজনে কোথাও সেনাবাহিনী প্রেরণ আবশ্যক হলে, স্থান কাল বিবেচনায় মৌলবল তথা বংশপরম্পরায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত সেনা, ভূতবল তথা বেতনের বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা, মিত্রবল তথা মিত্ররাজার কাছ থেকে প্রাপ্ত সেনা এবং অটবিবল তথা বনবাসিদের সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনী থেকে বাছাইকৃত উত্তম সেনাদের সেখানে প্রেরণ করতে হবে। দীর্ঘকাল কোথাও অবস্থান আবশ্যক হলে, সেখানে মিত্রসেনা বা অটবিসেনা প্রেরণ করতে হবে।

০৭-০৮-০৯ মধ্যম বা উদাসীন রাজা সম্পর্কে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার মনে যদি এহেন সংশয় জাগ্রত হয় যে কার্যসিদ্ধির পর তার সেনাবাহিনীকে আত্মসাৎ করা হবে অথবা সৈন্যদের অমিত্রের কাছে বা অটবিকদের কাছে বা বাসের অনুপযোগী স্থানে বা বর্ষণমুখর এলাকায় প্রেরণ করা হবে বা যুদ্ধ জয়ের পর প্রাপ্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা হবে। তাহলে তিনি অন্যকাজে সেনাদের ব্যস্ততার অজুহাত তুলে সেনা প্রেরণ থেকে বিরত থাকবেন।

কিন্তু সেনাবাহিনী দিয়ে উক্ত রাজাকে সহায়তা করা কর্তব্য হিসেবে অত্যাবশ্যক বলে অনুমিত হলে রাজা সেনাবাহিনী প্রেরণ করবেন এবং তাদের যথাস্থানে অবস্থান নিশ্চিত করবেন, তাদের দিয়ে যুদ্ধ করাবেন, তাদের ক্ষয়রোধের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে কোনো একসময় ছলনার মাধ্যমে উক্ত সৈন্যদের সরিয়ে আনবেন।

অথবা তিনি বাধ্য হলে, তাদের কাছে দোষযুক্ত, অমিত্র ও অটবিক তথা হীনদক্ষতাসম্পন্ন সৈনিকদের প্রেরণ করবেন। অথবা অক্রমণীয় রাজার সঙ্গে মধ্যম বা উদাসীন রাজার সন্ধি স্থাপন করিয়ে নিজেও অধিকতর লাভবান হবেন।

০৭-০৮-১০ সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সন্ধি স্থাপন যদি লাভজনক বলে বিবেচিত হয়, তাহলে রাজা সন্ধি স্থাপনের পন্থা অবলম্বন করবেন। অন্যথায় হীনশক্তি, সমশক্তি বা অধিকশক্তিসম্পন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই রাজার জন্য সমীচীন হবে।

নবম অধ্যায় ॥ ১১৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে মিত্রতা লাভের সন্ধি এবং অর্থ লাভের সন্ধি সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও কোন প্রকৃতির সহায়তা গ্রহণ রাজার জন্য যৌক্তিক বা অযৌক্তিক হবে এবং কোন প্রকৃতির মিত্রতা গ্রহণীয় বা বর্জনীয় হবে, ইত্যাকার বিতার্কিক বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-০৯-০১ সম্মিলিত অভিযানের মাধ্যমে মিত্রতা, নগদ অর্থ এবং ভূ- সম্পত্তি অর্জিত হলে, ভাগাভাগির সময় মিত্র অপেক্ষা নগদ অর্থ, নগদ অর্থ অপেক্ষা ভূ-সম্পত্তি অধিক লাভজনক বলে বিবেচিত হবে। কারণ ভূ-সম্পত্তি লাভ হলে তা থেকে উৎপন্ন ফসলের মূল্যবাবদ নগদ অর্থ এবং মিত্র সংগ্রহ সম্ভব করা হয়। নগদ অর্থ দিয়েও মিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।

০৭-০৯-০২ বিজয়লব্ধ ধন-সম্পদ সমানুপাতিক হারে বণ্টনের শর্তে সম্পাদিত সন্ধিকে বলা হয় সমসন্ধি। একজন মিত্র লাভ করবে অন্যজন নগদঅর্থ লাভ করবে, এই শর্তযুক্ত সন্ধিবদ্ধতাকে বলা হয় বিষম সন্ধি। সম্পাদিত সন্ধির শর্তাপেক্ষা যদি বিশেষ লাভ অর্জিত হয় বা অতিলাভ অর্জিত হয়, তাহলে তা হবে অতিসন্ধি।

০৭-০৯-০৩ রাজার বিপদকালে স্থায়ী অবশীভূত মিত্র নাকি অস্থায়ী বশীভূত মিত্র বেশি অপরিহার্য, এহেন বিতর্কে কৌটিল্যের আচার্যের মত হলো—এক্ষেত্রে স্থায়ী অবশীভূত মিত্রই অধিকতর প্রত্যাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়, কারণ এ ধরনের স্থায়ী মিত্র অবশীভূত হয়ে কোনো উপকার না করলেও কখনো কোনো অপকারও করবে না।

০৭-০৯-০৪ কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না, তিনি মনে করেন—বশীভূত মিত্র অস্থায়ী হলেও এক্ষেত্রে তিনিই অপরিহার্য, এ ধরনের মিত্র যতক্ষণ সহায়তা প্রদান করেন ততক্ষণই মিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন, উপকার সাধনই মিত্রের আবশ্যিক গুণ।

বশীভূত দুই মিত্রের মধ্যে একজন যদি সাময়িক সময়ের জন্য পর্যাপ্ত সেবা ও সাহায্য প্রদানকারী হয়ে থাকে এবং অন্যজন যদি স্থায়ীভাবে স্বল্প সহায়তা প্রদানকারী হয়ে থাকে, তাহলে কোন জনের সহায়তা গ্রহণ সমীচীন হবে, এহেন প্রসঙ্গে কৌটিল্যের আচার্য মনে করেন—সাময়িকভাবে অধিক সেবা বা সাহায্য প্রদান করার মাধ্যমে এ ধরনের মিত্র রাজাকে বিপুল ব্যয়ের কবল থেকে উদ্ধার করে থাকেন, এ কারণে এক্ষেত্রে তার সহায়তা গ্রহণ করাই অধিকতর শ্রেয়।

০৭-০৯-০৫ কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত মতের সঙ্গে একমত নন। তার মতে–স্থায়ীভাবে যারা স্বল্পসহায়তা প্রদান করে থাকেন, এক্ষেত্রে তারাই অধিক গ্রহণীয়। অধিক সহায়তাকারী মিত্ররা অনেকসময় বিপুল ব্যয় পরিহারের জন্য মিত্রতার বন্ধন ছিন্ন করে থাকে বা মিত্রের কাছেও অনুরূপ সহায়তা কামনা করতে পারে, কিন্তু স্বল্পসহায়তাকারী স্থায়ী মিত্ররা সবসময় মিত্রতার বন্ধন অটুট রাখতে বদ্ধপরিকর থাকে।

০৭-০৯-০৬ দূরদেশে অবস্থানজনিত কারণে বিলম্বে সেনাসহায়তা প্রদানকারী বলশালী মিত্র এবং সন্নিকটে অবস্থানকারী তাৎক্ষণিকভাবে সেনাসহায়তা প্রেরণে সক্ষম দুর্বল মিত্রের মধ্যে কে বেশি কাঙ্ক্ষিত, এই বিতর্কে কৌটিল্যের আচার্যের মত হলো—দূরদেশে অবস্থানকারী বলবান সেনাবাহিনীর সহায়তা অধিক কার্যকর বলে এক্ষেত্রে এ ধরনের সহায়তাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু কৌটিল্য উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন—এক্ষেত্রে সন্নিকটে অবস্থানরত দুর্বল মিত্রের সহায়তাই অধিক কাঙ্ক্ষিত। কারণ, এ ধরনের মিত্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনের সময় তাৎক্ষণিক সহায়তা গ্রহণ সম্ভব হয়, যা দূরবর্তী স্থানে অবস্থানকারীর কাছ থেকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

০৭-০৯-০৭ যে মিত্রের সৈন্যরা অনুগত হওয়া সত্ত্বেও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে এবং যে মিত্রের সৈন্যরা অনুগত না হয়েও সুনির্দিষ্ট স্থানে একীভূত অবস্থায় অবস্থান করে, এই দু ধরনের মিত্রের মধ্যে কোন পক্ষ অধিক কাঙ্ক্ষিত, এ ধরনের বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কৌটিল্যের আচার্য বলেন— যে মিত্রের সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় অবস্থান করা সত্ত্বেও রাজানুগত, তারাই এক্ষেত্রে অধিক কাঙ্ক্ষিত, কারণ তাদের দিয়েই কার্যসিদ্ধি সম্ভব হয়।

কৌটিল্য এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—একস্থানে একীভূত অবস্থায় অবস্থানরত সৈন্যরাই এক্ষেত্রে অধিক কাঙ্ক্ষিত। কারণ, অনানুগত হলেও সাম, দান, ভেদের মাধ্যমে তাদের বশীভূত করা সম্ভব কিন্তু অনুগত হওয়া সত্ত্বেও যারা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে অবস্থান করে, তাদের সমবেত করা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

০৭-০৯-০৮ সেনাসহায়তা দানকারী উপকার সাধকমিত্র এবং অর্থ সহায়তা দানকারী উপকার সাধকমিত্রের মধ্যে তুলনামূলক বিচারে কে অধিকতর শ্রেয়, এহেন বিতর্কিত বিষয়ে কৌটিল্যের আচার্যের অভিমত হলো—এক্ষেত্রে সেনাসহায়ক মিত্ররাই অধিক কাঙ্ক্ষিত। কারণ, এ ধরনের সহায়তার মাধ্যমে শত্রুর প্রতি বিক্রম প্রদর্শন করা সম্ভব হয়, প্রকারান্তরে যা অভীষ্ট অর্জনের সহায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে।

কিন্তু এ বিষয়ে নিজের আচার্যের অভিমতের সঙ্গে কৌটিল্য দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন—সেনা সহায়তার মাধ্যমে কদাচিৎ শুভফল লাভ করা যায়। কিন্তু অর্থ সহায়তা পেলে তা দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব, যে কারণে সেনাসহায়তা অপেক্ষা আর্থিকসহায়তা অধিকতর কাঙ্ক্ষিত।

০৭-০৯-০৯ অর্থ দিয়ে সহায়তাকারী উপকার সাধক মিত্র এবং ভূ-সম্পত্তি দিয়ে সহায়তাকারী উপকার সাধক মিত্রদের মধ্যে কার সহায়তা তুলনামূলক বিচারে অধিকতর শ্রেয়, এহেন বিতার্কিক বিষয়ের উত্তরে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—অর্থ দিয়ে যে কোনো ব্যয় নির্বাহ করা যায়, যে কোনো বিপদ মোকাবেলা করা যায় কিন্তু ভূ-সম্পত্তি স্থির সম্পদ বিধায়, তার কোনো বহুমুখী ব্যবহার নেই, যে কারণে ভূ-সম্পত্তি অপেক্ষা অর্থসহায়তাই এক্ষেত্রে অধিকতর গ্রহণীয়। কৌটিল্য এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—ভূমির মাধ্যমে মিত্র এবং অর্থ অর্জন সম্ভব হয়, যে কারণে অর্থ অপেক্ষা ভূমির সহায়তাই অধিক গ্রহণীয়।

০৭-০৯-১০ একাধিক মিত্র সেনাবল সহায়তা প্রদানে ইচ্ছুক হলে, যে মিত্রের সেনাবাহিনী সাহসী, কষ্টসহিষ্ণু, অনুগত এবং মৌল ও ভূতসেনার সমন্বয়ে গঠিত, তার কাছ থেকেই সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। যদি একাধিক মিত্র সমভাবে অর্থ সহায়তা প্রদানে ইচ্ছুক হয়, তাহলে তার কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করতে হবে যিনি সম্পদে সমৃদ্ধ, কর্ম সাধনে সক্ষম, সৎ এবং সব সময়ের জন্য সহায়তা প্রদানে ইচ্ছুক।

০৭-০৯-১১ মিত্র ছয় গুণবিশিষ্ট হয়ে থাকে, নিত্য তথা প্রতিনিয়ত সহায়তা প্রদানে ইচ্ছুক। বশ্যমিত্র তথা নিয়ন্ত্রণাধীন সহায়ক। উৎসাহী তথা প্ৰয়োজনে সহায়তা প্রদানে আগ্রহী। বংশানুক্রমিক তথা পুর্বপুরুষের সময় হতে সহায়তা প্রদানকারী। মহৎ তথা প্রভুশক্তি ও উৎসাহশক্তিযুক্ত এবং অদ্বৈধ্য তথা অদ্বিধান্বিত। বৈবাহিক সম্পর্কের সুবাদে যে মিত্ররা কোনো আর্থিক লেনদেন ব্যতিরেকে পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা প্রদান করে থাকে, তারা হলেন নিত্যমিত্র।

০৭-০৯-১২ বশ্যমিত্র তিন ধরনের হতে পারে—১. সর্বভোগমিত্ৰ ২. চিত্রভোগমিত্র ৩. মহাভোগমিত্র। যিনি সেনা, অর্থ এবং ভূমি দিয়ে সহায়তা প্রদান করে থাকেন তিনি হলেন সর্বভোগমিত্র। যিনি রত্নসম্ভার ও বনজদ্রব্যসহ অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে সহায়তা প্রদান করেন, তিনি হলেন চিত্রভোগমিত্র। যিনি শুধু সেনাবাহিনী এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা প্রদান করেন, তিনি হলেন মহাভোগমিত্ৰ। এছাড়াও বশ্যমিত্র একতোভোগী, উভয়তোভোগী এবং সর্বতোভোগী হিসেবে তিনভাগে বিভাজিত। এছাড়াও যে মিত্র রাজার বশীভূত নন কিন্তু রাজার শত্রুদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ এবং দুর্গ অটবিতে আত্মরক্ষা করেন, সে মিত্রকে অবশ্য নিত্য মিত্র বলা হয়।

০৭-০৯-১৩ শত্রুর দ্বারা নিগৃহীত হয়ে যিনি রাজার সঙ্গে সন্ধি করেন তাকে বলা হয় অনিত্যবশ্য মিত্র। এ ধরনের মিত্রতা নিজের উপকার লাভকাল পর্যন্ত স্থায়ী থাকে বলে এ জাতীয় মিত্রতাকে অনিত্যবশ্য মিত্র বলা হয়েছে। যে মিত্র রাজার সঙ্গে সমভাবে সুখ, দুঃখ অনুভব করেন, যিনি সদা উপকারী, কখনো উপকার করতে দ্বিধা করেন না, কখনো রাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হন না, সে মিত্রকে বলা হয় অদ্বৈত্য মিত্র।

০৭-০৯-১৪ যে মিত্ররা কখনো রাজা এবং রাজার শত্রুর বিরুদ্ধে অপকারকের ভূমিকায়, কখনো আবার উভয়ের উপকারকের ভূমিকায় এবং নিজের দুর্বলতাজনিত কারণে উভয়ের সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তারা উভয়ভাবী মিত্র বলে গণ্য হয়ে থাকেন। এ প্রকৃতির মিত্ররা রাজার সঙ্গে মিত্রভাব সংরক্ষণের সুবাদে নিত্য এবং শত্রুর সঙ্গেও মিত্রভাব থাকায় অনিত্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। যে মিত্ররা রাজার অনন্তর ভূমিতে অমিত্র, রাজা এবং তার শত্রুর মধ্যবর্তী ভূমিতে অবস্থানকালে উভয়ের মিত্রভূত এবং উপকারী মনোভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও অসমর্থতাজনিত কারণে অনুপকারি হয়ে থাকেন, তারাও উভয়ভাবী মিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

০৭-০৯-১৫ যে মিত্র রাজার শত্রুরও প্রিয়জন, উক্ত শত্রু কর্তৃক নিরাপত্তার বন্ধনে আবদ্ধ, তার সঙ্গে পূজনীয় সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত এবং একইভাবে রাজার জন্যও সহায়ক, তিনিও উভয়ভাবী মিত্রভুক্ত। যে মিত্র বিস্তৃত ভূমির অধিকারী, নিজ অবস্থানে পরিতৃপ্ত, নতুন কিছু অর্জনে নিস্পৃহ, বলশালী হওয়া সত্ত্বেও অলস প্রকৃতির, সে মিত্ররা উদাসীন প্রকৃতির হয়ে থাকে।

০৭-০৯-১৬ যে মিত্ররা নিজের দুর্বলতার কারণে রাজা এবং তার শত্রুর সমৃদ্ধিকে অভিনন্দিত করে উভয়ের সহায়তা প্রার্থনা করে এবং রাজা ও তার শত্রুর কাছে প্রিয় হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে থাকে, তারও উভয়মিত্র তথা উভয়ানুবর্তী মিত্র বলে গণ্য হয়ে থাকে।

যে মিত্র কোনো কারণ ছাড়াই কোনো মিত্রকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করে এবং বিনাকারণে পূর্বোক্ত মিত্রের কাছে এক সময় প্রত্যাবর্তন করে, এ ধরনের মিত্র অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়ে থাকে, এদের যারা বরণ করেন, তারা প্রকারান্তরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।

০৭-০৯-১৭ তাৎক্ষণিক স্বল্পলাভ এবং দীর্ঘমেয়াদে অধিকলাভ, এহেন পরিস্থিতিতে কোন পন্থা অবলম্বন করা সমীচীন, এ ধরনের বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে কৌটিল্যের আচার্যের অভিমত হলো—তাৎক্ষণিক স্বল্পলাভই এক্ষেত্রে গ্রহণীয়, যা তাৎক্ষণিক কার্যসাধনে সহায়ক হয়ে থাকে। উক্ত প্রসঙ্গে কৌটিল্য দ্বিমত পোষণ করে বলেন—দীর্ঘমেয়াদি লাভ ধান্যবীজ রোপনের সমতুল্য, এর ফললাভ সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে, যে কারণে এ ধরনের প্রাপ্যতা অধিক গ্রহণীয়।

০৭-০৯-১৮ উপরোক্তভাবে রাজাকে মিত্র, অর্থ, ভূমি, ইত্যাকার প্রাপ্তির বিষয়ে পরিপূর্ণরূপে পরিজ্ঞাত হয়ে নিজের প্রয়োজনে অভীষ্ট অর্জনের নিমিত্ত সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে হবে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনায় সচেষ্ট হতে হবে।

দশম অধ্যায় ॥ ১১৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে দখলিকৃত ভূমি কীভাবে বণ্টিত হবে, সে বিষয়ক সন্ধির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া এ পর্যায়ে রাজা কোন পরিস্থিতিতে কোন ধরনের ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়াস গ্রহণ করবেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

০৭-১০-০১ উভয় মিত্র কর্তৃক ভূমিলাভের অভিপ্রায়ে যে সন্ধি সম্পাদন করা হয়, তাকে বলা হয় ভূমিসন্ধি। ভূমি জয়ের ক্ষেত্রে যে মিত্র যুদ্ধে অধিক বিনিয়োগ তথা শক্তির যোগান দিবেন, তিনি অধিক লাভবান হবেন বা অধিক অংশ লাভ করবেন। বলশালীর কাছ থেকে ভূমি দখল করা হলে ভূমি অধিগ্রহণকারী কেবল ভূমির অধিকারীই হন না, একই সঙ্গে ভূমি হারিয়ে পরাভূত রাজাও দুর্বল হয়ে পড়েন। দুর্বল রাজার কাছ থেকে ভূমি অধিকৃত হলে তা নিম্নমানের ভূমি বলে গণ্য হয়, কারণ, এতে করে পার্শ্ববর্তী দেশের রাজারা ভূমি দখলকারী রাজার শত্রুতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় মিত্ররাও দখলি শঙ্কায় আশঙ্কিত হয়ে দুর্বলের পক্ষাবলম্বন করে রাজার অমিত্রে পরিণত হয়।

০৭-১০-০২ দুজন সমসক্ষমতাসম্পন্ন শত্রুর মধ্যে যার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্গ, পরিখার দ্বারা অতি সুরক্ষিত, তিনি যে মিত্রের দ্বারা পরাভূত হবেন, সে মিত্র অন্যজন অপেক্ষা অধিক ভূমি লাভ করবেন। দুর্গরহিত দুর্বল প্রতিরক্ষাসম্পন্ন শত্রুকে সহজে পরাভূত করে ভূমি লাভ করা হলে, তা বিশেষ অর্জন হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের দুর্বলের ভূমি কোনো বিশেষ ব্যয় ব্যতিরেকে অধিকৃত হয়ে থাকে এবং তা রাজার সমৃদ্ধির জন্যও সহায়ক। অন্যদিকে সবলের ভূমি অধিগ্রহণ করতে হলে রাজাকে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, এতে করে রাজা আর্থিক এবং সেনাক্ষয়ের দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন।

০৭-১০-০৩ নিত্যশত্রুর কাছ থেকে সমৃদ্ধ তথা উর্বরা ভূমি লাভ এবং অনিত্যশত্রুর কাছ থেকে অনুর্বর ভূমি লাভ, এ দুটির ক্ষেত্রে কোনটি অধিক শ্রেয়তর, এই বিতর্ক প্রসঙ্গে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে নিত্যশত্রুর উর্বরা ভূমি গ্রহণ করাই শ্রেয়তর। কারণ, উর্বরা ভূমির উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে রাজা তার কোষাগার ও সেনাবাহিনী সমৃদ্ধ করতে পারেন।

কিন্তু কৌটিল্য এই অভিমতের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে বলেন— নিত্যশত্রুযুক্ত সমৃদ্ধ ভূমি লাভের ক্ষেত্রে প্রচুর শত্রুর সৃষ্টি হয়, নিত্যশত্রু উপকৃত হলেও শত্রুই থেকে যায়, যে কারণে এ ধরনের ভূমি আখেরে কোনো সুফল প্রদান করে না। অন্যদিকে অনিত্যশত্রু উপকৃত বা অপকৃত হলে নিরব হয়ে যায়। এ কারণে অনিত্যশত্রুযুক্ত ভূমি লাভ করাই সার্বিক বিবেচনায় অধিক গ্রহণীয় (যে ভূমির অবস্থান প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যা অপরাধীদের অভয়াশ্রম হিসেবে ব্যবহার্য, চোর, ম্লেচ্ছ ও বনবাসিদের প্রভাবে প্রভাবিত, তা নিত্যশত্রুযুক্ত ভূমি হিসেবে গণ্য। যে ভূমি এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তা অনিত্য শত্রুযুক্ত ভূমি হিসেবে গণ্য

০৭-১০-০৪ রাজ্য সন্নিকটস্থ স্বল্পপরিমাণ ভূমি এবং দূরাঞ্চলের অধিক পরিমাণ ভূমির মধ্যে কোনটি রাজার জন্য অধিক কাঙ্ক্ষিত হবে, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—রাজ্যের সন্নিকটস্থ ভূমি পরিমাণগত দিকে দিয়ে স্বল্প হলেও তা রাজার কাছে অধিক কাঙ্ক্ষিত হবে। কারণ, এ ধরনের ভূমি সহজে রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য এবং আপতকালে এসব ভূমিতে আশ্রয়গ্রহণও সহজতর হয়।

কিন্তু দূরাঞ্চলের ভূমিতে এ ধরনের সুবিধা লাভ সম্ভব নয়। দূরাঞ্চলে এবং সন্নিকটবর্তী ভূমির মধ্যে শত্রু সৈন্য দ্বারা রক্ষিত ভূমি এবং নিজের সৈন্য দ্বারা রক্ষিত ভূমি, এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি রাজার জন্য অধিক উপকার সাধক হবে, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—নিজ সৈন্য দ্বারা রক্ষিত ভূমিই এক্ষেত্রে অধিক উপকার সাধক বলে গণ্য হবে।

০৭-১০-০৫ মূর্খ শত্রুর কাছ থেকে ভূমি লাভ এবং জ্ঞানবান শত্রুর কাছ থেকে ভূমি লাভ, এই দুয়ের মধ্যে কোনটি রাজার জন্য অধিক উপকার সাধক হবে, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—এক্ষেত্রে মূর্খের কাছ থেকে ভূমি লাভ করাই অধিক উপকারক হবে। কারণ, এ ধরনের ভূমি সহজে রক্ষণযোগ্য হয় এবং কখনো তা প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা থাকে না।

কিন্তু জ্ঞানবান শত্রুর কাছ থেকে ভূমি গ্রহণ করা হলে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রতিভাত হতে পারে। উৎপীড়িত শত্রুর কাছ থেকে এবং উচ্ছেদকৃত শত্রুর কাছ থেকে ভূমি লাভের ক্ষেত্রে কোনটি রাজার জন্য অধিক উপকারক হবে, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—উচ্ছেদকৃত শত্রুর ভূমি অধিগ্রহণই অধিক উপকারক হবে। কারণ, উচ্ছেদকৃত শত্রু তার অমাত্যবর্গ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং প্রতিরোধে অক্ষম হয়ে থাকেন। অন্যদিকে উৎপীড়িত শত্রু সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারেন।

০৭-১০-০৬ নদীদুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত এবং স্থল দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত অমিত্রদের মধ্যে কোনজনের ভূমি গ্রহণ রাজার জন্য অধিক উপকারক হবে, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—স্থলদুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত অমিত্রের ভূমি গ্রহণ রাজার জন্য অধিক উপকারক হবে। কারণ, এ ধরনের অমিত্রকে সহজে অবরোধ, অবদমন বা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়। কিন্তু নদীদুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত অমিত্রের ক্ষেত্রে এর বিপরীত প্রভাব প্রতিভাত হতে পারে।

০৭-১০-০৭ অন্যদিকে নদীদুর্গ এবং পর্বতদুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত অমিত্রের ক্ষেত্রে নদীদুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত অমিত্রের ভূমি গ্রহণই অধিক উপকারক হয়ে থাকে। কারণ, নদীদুর্গ হস্তিবাহিনী, নৌবাহিনী বা কাঠের সেতু নির্মাণ করে সৈন্য চালনার মাধ্যমে সহজে জয়যোগ্য হয়। কিন্তু পর্বতদুর্গ সহজে জয়যোগ্য নয়, এতে যেমন বিপুল লোকক্ষয় হয়, তেমনি বহুরৈখিক প্রতি আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে রাজাকে বিপর্যস্ত হতে হয়। যে কারণে এ ধরনের অমিত্রের ভূমি গ্রহণ অনেক কষ্টকর হয়ে ওঠে।

০৭-১০-০৮ নৌ প্রতিরক্ষা এবং স্থল প্রতিরক্ষাসম্পন্ন অমিত্রদের মধ্যে কোনজনের ভূমি গ্রহণ রাজার জন্য অধিক উপকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—নৌ প্রতিরক্ষা সম্পন্ন অমিত্রদের সহজে পরাভূত করা যায়। কারণ, তারা সর্বক্ষেত্রে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী না হওয়ায় স্বল্প প্রচেষ্টায় তাদের পরাজয় নিশ্চিত করা যায়। এ কারণে এ ধরনের অমিত্রের ভূমি গ্রহণ করা হলে তা রাজার জন্য অধিক উপকারক বলে গণ্য হয়ে থাকে। অন্যদিকে স্থল প্রতিরক্ষায় সমর্থবানরা সর্বত্র যুদ্ধ করতে পারদর্শী হয় বলে, তাদের পরাভূত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

পরিখা খনন করে যারা যুদ্ধ করে এবং যারা খোলা ময়দানে যুদ্ধ করে, এদের মধ্যে কোন প্রকৃতির অমিত্রের ভূমি গ্রহণ করা অধিক উপকারক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—যারা পরিখার প্রতিরক্ষার আশ্রয়ে যুদ্ধ করে থাকে, তাদের সহজে নির্মূল করা যায়। কারণ, এরা বিশেষ সুবিধা তথা পরিখার প্রতিরক্ষা বৃহৎ ব্যতিরেকে যুদ্ধ করতে অক্ষম। অন্যদিকে খোলা পরিবেশে যুদ্ধে অভ্যস্তদের অতি সহজে দমন করা সম্ভব নয়, তারা যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে সমদক্ষতায় যুদ্ধ করতে পারে বলে তাদের অবদমন করাটা অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে

০৭-১০-০৯ উপরোক্তভাবে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা সার্বিক দিক বিবেচনা করে অমিত্রের ভূমি অধিগ্রহণ করবেন এবং নিজের সমৃদ্ধি সাধনে সচেষ্ট হবেন।

একাদশ অধ্যায় ॥ ১১৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে অনিষ্পন্ন ভূমির সন্ধি সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কোন শর্তে কীভাবে ভূমি হস্তান্তর করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় কীভাবে রাজা লাভবান হবেন ইত্যাদি বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-১১-০১ রাজা এবং মিত্র যখন কোনো এক বিরান ভূমিতে জনপদ বিকাশের শর্তে চুক্তিবদ্ধ হয়, তখন সে সন্ধিকে বলা হয় অনির্ধারিত সন্ধি। এ ধরনের সন্ধির ক্ষেত্রে যে রাজা জনপদ বিকাশে অধিক ধন ও জনবল বিনিয়োগে সমর্থ হবে, তিনি তত লাভবান হবেন। এ ধরনের জনপদের যে ভূমিতে চাষাবাদ কেবল বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল, সেই ভূমির তুলনায় ঔদকভূমি তথা যে ভূমিতে নদী, সরোবর বা জলাশয়ের জলে চাষাবাদ সম্ভব, সে ভূমি অধিক গ্রহণীয়। কারণ, এ ধরনের ভূমিতে ফসল উৎপাদনের নিশ্চয়তা থাকে।

০৭-১১-০২ এই ধরনের ঔদকভূমির মধ্যে যেখানে আউস এবং শালি ধান উৎপন্ন হয়, সেই ভূমি অন্যপ্রকার ঔদকভূমির তুলনায় অধিক উন্নত বলে পরিগণিত হয়। এছাড়াও বর্ষণের ফলে ভূমিকর্ষণ সহজ হয় বলে সে প্রকৃতির ভূমি উত্তম বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে ধানের চাষযোগ্য অল্পভূমির তুলনায় ধান চাষের অযোগ্য বিস্তৃত পরিসরের ভূমি বহুলভাবে কাঙ্ক্ষিত। কারণ, বিস্তৃত পরিসরের ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের জলজ ও স্থলজ ফসল ও ঔষধি বৃক্ষের চাষাবাদ যেমন সম্ভব হয়, তেমনি সেখানে বৃহদাকার নগর প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয়। এ ছাড়া ভূমির বিস্তার বিস্তৃত হলে ইচ্ছেমতো সেখানে ধান চাষের ভূমিও প্রস্তুত করা যায়।

০৭-১১-০৩ খনি ভূমির তুলনায় ধানের আবাদযোগ্য ভূমি অধিক উত্তম। কারণ, ধান উৎপাদন একদিকে যেমন রাজ্যের শস্যাগার সমৃদ্ধ করে তেমনি তা রাজকোষের সমৃদ্ধিরও সহায়ক। অন্যদিকে খনিজ হতে আহরিত সম্পদ যদি প্রত্যাশিত মাত্রায় বিক্রয়যোগ্য হয়, তাহলে সে খনিজ ভূমিও উত্তম ভূমি হিসেবে পরিগণিত হয়।

০৭-১১-০৪ দ্রব্যবনভূমি তথা কাষ্ঠ ও বনজ সম্পদ উৎপন্নের ভূমি এবং হস্তিবনভূমির মধ্যে প্রথমোক্তটি জনপদ, নগর, দুর্গ বিকাশের উৎসভূমি হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে, যে কারণে পরেরটির তুলনায় তা অধিক কাঙ্ক্ষিত, কৌটিল্যের আচার্য এমনটিই মনে করে থাকেন।

কিন্তু কৌটিল্য এক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—দ্রব্যবন ব্যতিরেকেও অন্য ভূমিতে বনজ সম্পদ উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু হস্তিবন বিশেষায়িত বন হওয়ায় যত্রতত্র তা সৃজন করা যায় না, উপরোন্তু যুদ্ধের ক্ষেত্রে হস্তির ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যে কারণে দ্রব্যবন অপেক্ষা হস্তিবনই অধিক কাঙ্ক্ষিত I

০৭-১১-০৫ স্থলপথ এবং জলপথের মধ্যে কোনটি শ্রেয়তর, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে হলো—জলপথ স্থায়ীভাবে ব্যবহার্য নয়, কিন্তু স্থলপথ স্থায়ীভাবে ব্যবহার্য, যে কারণে জলপথের তুলনায় স্থলপথই অধিক শ্রেয়। আচার্যদের কেউ কেউ মনে করে থাকেন, যে পথ উৎপাতরহিত সে পথই উত্তম।

যে জনপদে মানুষ পরস্পর একত্রিত হয়ে বসবাস করে এবং যে জনপদে মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে থাকে, এর মধ্যে কোনটি শ্রেয়তর, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—যে স্থানে মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে থাকে তা-ই শ্রেয়তর। কারণ, এ ধরনের বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসরতদের অবদমন করা সহজ, এদের সহজে বিভক্ত করা সম্ভব হয় এবং এদের বশীভূত রাখা বা এদের ভূমি সহজে দখল করাও সম্ভব হয়।

কিন্তু একত্রে শ্রেণিবন্ধ হয়ে যারা বসবাস করে থাকে তাদের যেমন বিভক্ত করা সহজ নয়, তেমনি তাদের বশীভূত করাও কঠিন, অধিকন্তু শ্রেণিবদ্ধ লোকেরা সহজে বিদ্রোহ করতে পারে, এমনকি রাজাকেও উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়।

০৭-১১-০৬ যে এলাকায় পর্যাপ্তসংখ্যক শূদ্র বা গোপালক জাতীয় নিম্নবর্ণের লোকেরা বসবাস করে থাকে, সে এলাকার সর্বক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতাও অধিক, যে কারণে এ ধরনের নিম্নবর্ণ অধ্যুষিত জনপদ শ্রেয়তর। অন্যদিকে ধনিক বণিক শ্রেণির লোকেরা পণ্য ক্রয়, বিক্রয় ও ঋণদানের কাজে সম্পৃক্ত থেকে আর্থিক সমৃদ্ধি সাধনে যুক্ত থাকেন বলে তাদের জনপদও শ্রেয়তর বলে গণ্য হতে পারে।

০৭-১১-০৭ দুর্গদ্বারা সুরক্ষিত নগর এবং জনবহুল নগরের মধ্যে কোনটি অধিক শ্রেয়, এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হলো—জনবহুল নগরই অধিক শ্রেয়। কারণ, একজন রাজা জনশক্তির বদৌলতে সফল হয়ে থাকেন, জনহীননগর অনেকটা দুগ্ধদানে অক্ষম বন্ধ্যা গাভীর মতো। যার দেওয়ার মতো কিছু থাকে না।

যে বিরান ভূমিতে জনপদ সৃজনের জন্য বিপুল লোকক্ষয় এবং সম্পদ ব্যয়ের সম্ভাবনা থাকবে, সে ভূমি অধিগ্রহণে অভিলাষী রাজা তা বিক্রয়ের জন্য দুর্বল, অরাজবংশজাত, নিরুৎসাহী, অসহায়, অন্যায়কারী, শিকার বা জুয়ায় আসক্ত, ভাগ্য বিশ্বাসী এবং হঠকারী প্রকৃতির ক্রেতার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা উক্ত ভূমি ক্রয়ের পর জনপদ সৃজনের জন্য অত্যাধিক ব্যয় ও লোকক্ষয় করে যখন অবসন্ন হয়ে পড়বে তখন রাজার পক্ষে সেই ভূমি পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়া সহজতর হবে।

০৭-১১-০৮ উপরোক্ত ভূমিতে দুর্বল সামন্ত কর্তৃক জনপদ সৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে অধিক লোকক্ষয় এবং অর্থব্যয়ের কারণে তিনি তার সহায়তাকারীদের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন। সেনা সক্ষমতায় সমর্থ কোনো নিরুৎসাহী সামন্ত এ কাজে যুক্ত হলে অধিক লোকক্ষয় ও আর্থিক বিনাশের কারণে নিজেও সেনাবাহিনীসমেত বিনাশপ্রাপ্ত হবেন। কোনো ধনবান মিত্রহীন অসহায় সামন্ত উক্ত কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে লোকক্ষয় ও ধনব্যয়ের পর কারো কাছ থেকে সহায়তা না পেয়ে অভীষ্ট অর্জনে ব্যর্থ হয়ে বিনাশপ্রাপ্ত হবেন। অন্যায়কারী সামন্ত উক্ত ভূমিতে জনপদ সৃজনকালে ইতিপূর্বেকার বসতি স্থাপনকারীদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করবে। ফলে তার পক্ষে নতুন জনপদ সৃজন কঠিন হয়ে পড়বে।

০৭-১১-০৯ উপরোক্ত ক্ষেত্রে ভাগ্যে বিশ্বাসী সামন্ত সহসা নির্মাণ কাজ শুরু করবে না অথবা কাজ শুরু করলেও অচিরেই লোকক্ষয় ও অর্থ ক্ষয়জনিত কারণে অবসন্ন হয়ে বিনাশপ্রাপ্ত হবে। হঠকারী সামন্ত খামখেয়ালিপূর্ণ কাজ করে বলে কোনোপ্রকার সমস্যা উপলব্ধিতে অক্ষম হয়ে থাকে। ফলে সে এহেন কর্মে যুক্ত হয়ে অচিরেই বিনাশপ্রাপ্ত হবে।

০৭-১১-১০ সামন্তদের মধ্য থেকে উপরোক্ত প্রকৃতির আট ধরনের কোনো ক্রেতা পাওয়া না গেলে, শত্রুপক্ষ থেকে অধিক প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নগর পত্তনের ব্যবস্থা গ্রহণার্থে রাজা তাদের সঙ্গে অভিহিতসন্ধি সম্পাদন করবেন। এক্ষেত্রে কোনো বলশালী সামন্ত যদি উত্তম ভূমি ক্রয়ের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, তাহলে রাজা তার কাছে ভবিষ্যতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায়সাপেক্ষে উক্ত ভূমি হস্তান্তরের সন্ধি করবেন। এ সংক্রান্ত সন্ধিকে বলা হয় অনিভূতসন্ধি। এক্ষেত্রে সমশক্তিসম্পন্ন কোনো রাজা যদি উক্ত ভূমি দাবি করেন এবং তা যদি পুনরায় করায়ত্ত করার সম্ভাবনা থাকে বা সেই ভূমি নিজের প্রয়োজনেও ব্যবহার্য থাকে বা এর ফলে কোনো শত্রু বশীভূত হয় বা ভূমি বিক্রিত অর্থ দিয়ে অন্যপ্রকার অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে রাজা উক্ত ভূমি সেই সমশক্তিসম্পন্ন রাজার কাছে বিক্রি করবেন।

০৭-১১-১১ অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে পরিজ্ঞাত বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা এভাবেই মিত্র, সম্পদ এবং ভূখণ্ড অর্জন করে অন্যান্য রাজার তুলনায় অধিক লাভ হবেন।

দ্বাদশ অধ্যায় ॥ ১১৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে কর্ম সম্পাদনের চুক্তি তথা কর্মসন্ধি সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে কোনো প্রকৃতির, দুর্গ, হস্তিবন, পথ, খনি উত্তম বলে বিবেচ্য হতে পারে, সে বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

০৭-১২-০১ দুজন রাজা কোনো দুর্গ বা সেতুবন্ধ তথা বাঁধ নির্মাণের জন্য চুক্তিতে আবদ্ধ হলে, তা হয় কর্মসন্ধি। এ ধরনের চুক্তিবদ্ধ রাজাদ্বয়ের মধ্যে যিনি দুর্গম স্থানে স্বল্পব্যয়ে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধকল্পে অভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করতে পারেন, তিনি তুলনামূলকভাবে অধিক লাভবান হয়ে থাকেন। এ সমস্ত দুর্গের ক্ষেত্রে স্থলদুর্গ অপেক্ষা নদীদুর্গ এবং নদীদুর্গ অপেক্ষা পর্বতদুর্গ অধিকতর ফলদায়ক বলে বিবেচিত হয়।

০৭-১২-০২ একইভাবে সেতুবন্ধ তথা জলসেচ সুবিধার নিমিত্ত বাঁধনির্মাণের ক্ষেত্রে যেখানে শুধু বর্ষাকালে পানির প্রাচুর্য থাকে, তদাপেক্ষা যেখানে সারাবছর পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ সুবিধা প্রদান করা যায়, তা অধিকতর ফলদায়ক। এক্ষেত্রে যে বাঁধের জলাধার থেকে বিপুল শস্যভূমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা যায়, তা শ্রেষ্ঠতর বলে পরিগণিত হয়।

মূল্যবান কাষ্ঠ সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্থলভাগের দ্রব্যবন অপেক্ষা নদীতীরবর্তী দ্রব্যবন অধিক লাভজনক বলে পরিগণিত হয়। কারণ, এ ধরনের দ্রব্যবন যেমন সার্বিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে তেমনি দুর্ভিক্ষ বা বিপর্যয়কালে তা অভাবগ্রস্তদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

০৭-১২-০৩ যে হস্তিবন রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় সৃজিত, যেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক হস্তি এবং অন্যন্য হিংস্রপশু বিচরণ করে, প্রতিবেশীরা দুর্বল, অসংখ্য প্রবেশ এবং নির্গমন পথযুক্ত এবং পার্শ্ববর্তী রাজার জন্য পীড়াদায়ক। সে হস্তিবন অন্যান্য স্থানের হস্তিবন অপেক্ষা উত্তম।

এ ধরনের হস্তিবনের ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক দুর্বল হাতির বন এবং স্বল্পসংখ্যক সবল হাতির বন, এ দুটির মধ্যে কোনটি কাঙ্ক্ষিত, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—স্বল্পসংখ্যক সবল হাতির হস্তিবনই এক্ষেত্রে অধিক কাঙ্ক্ষিত। কারণ, হস্তিবাহিনী হলো যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি, এক্ষেত্রে সবল হাতি সংখ্যায় অল্প হলেও বিপুল সংখ্যক দুর্বল হাতিকে সহজেই ছত্রভঙ্গ করতে এবং শত্রু সৈন্য বিনাশ করতে সক্ষম হয়।

০৭-১২-০৪ কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন—স্বল্পসংখ্যক সবল হাতি অপেক্ষা দুর্বল হলেও অধিকসংখ্যক হাতিই যুদ্ধ ক্ষেত্রে কার্যকর সুফল বয়ে আনতে পারে। কারণ, সংখ্যায় অধিক হলে সংখ্যাধিক্যের প্রভাবে তা যেমন শত্রুদের ভীতি উৎপাদন করতে পারে, তেমনি নিজ যোদ্ধাদেরও উৎসাহিতকরণের সহায়ক হয়। এছাড়াও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুর্বল হাতিদের অতিসহজে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

০৭-১২-০৫ খনির ক্ষেত্রে—যে খনিতে প্রচুর মূল্যবান দ্রব্যের মজুদ থাকে, যে খনির সম্পদ আহরণ স্বল্পব্যয়যুক্ত এবং যেখানকার যাতায়ত পথও সহজ, দুর্গম নয়। সে খনি খনন করাই সার্বিকভাবে লাভজনক। যে খনির সারদ্রব্য বহুমূল্যবান কিন্তু মজুদ অপরিমিত এবং যে খনির সারদ্রব্য কমমূল্যবান কিন্তু মজুদ পর্যাপ্ত। এ দুটি খনির ক্ষেত্রে কোনটি অধিক লাভজনক, এই বিতর্কের সিদ্ধান্তে কৌটিল্যের আচার্য বলেন—এক্ষেত্রে মূল্যবান সারদ্রব্যসমৃদ্ধ খনি অধিক লাভজনক। কারণ, হিরা-মুক্তা-মণির মতো সারদ্রব্য সাধারণ দ্রব্যের চেয়ে সবসময় অধিক মূল্যবান এবং লাভজনক হয়ে থাকে। কিন্তু কৌটিল্যের অবস্থান উপরোক্ত মতের বিপক্ষে। তার মতে—মূল্যবান সারদ্রব্যের ব্যবহারকারী এবং ক্রেতা সবসময় সীমিত। কিন্তু স্বল্পমূল্যের খনিজ দ্রব্যের চাহিদার পরিধি যেমন বিস্তৃত তেমনি তার ভোক্তার সংখ্যাও বিপুল। যে কারণে এ ধরনের খনি অধিক লাভজনক হয়ে থাকে।

০৭-১২-০৬ যোগাযোগের ক্ষেত্রে জলপথ এবং স্থলপথের মধ্যে কৌটিল্যের আচার্যের কাছে জলপথই অধিক সুবিধাজনক বলে প্রতিভাত। তিনি মনে করেন—জলপথ স্বল্পব্যয় ও স্বল্পশ্রমে নির্মিত হতে পারে এবং স্থলপথের তুলনায় জলপথে যে কোনো ধরনের মালামাল সহজে পরিবহন করা সম্ভব হয়। কিন্তু কৌটিল্যের অভিমত তার আচার্যের বিপরীত। তার বিবেচনায় স্থলপথই উত্তম।

তিনি মনে করেন—বন্যার প্রভাবে জলপথ সবদিক দিয়ে অচল হয়ে পড়ে, অতি বর্ষণেও এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে, তুলনামূলকভাবে জলপথ অনেক বেশি বিপদসঙ্কুল এবং বিপর্যয়কালে এর প্রতিকারের কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু স্থলপথ এর বিপরীতধর্মী। যে কারণে স্থলপথই তুলনামূলক বিচারে শ্রেয়তর।

০৭-১২-০৭ জলপথ দু ধরনের হতে পারে। নদীতীরবর্তী জলপথ এবং সমুদ্রপথ। এই দুইয়ের মধ্যে নদীতীরবর্তী জলপথ অধিক সুবিধাজনক। এ পথ যেমন অনেক বন্দরের সাথে যুক্ত হতে পারে, তেমনি তা হতে পারে বিপর্যয় মুক্ত। কিন্তু সমুদ্রপথ সবসময় বিপদশঙ্কুল তথা ঝুঁকিপূর্ণ। কৌটিল্যের আচার্যের মতে— স্থলপথের ক্ষেত্রে দক্ষিণা পথের তুলনায় উত্তরাপথ তথা হিমালয়মুখী পথ উত্তম। কারণ, উক্ত পথে মূল্যবান হাতি, ঘোড়া, কস্তুরি, সুগন্ধি, দাঁত, চামড়া, রূপা ও স্বর্ণনির্মিত দ্রব্য পাওয়া যায়।

কৌটিল্য উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন—উত্তরাপথ অপেক্ষা দক্ষিণের পথ উত্তম। কারণ, সে পথে কম্বল, হরিণের চামড়া ও ঘোড়া ছাড়াও শঙ্খ, হিরা, মণি, মুক্তা এবং স্বর্ণদ্রব্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।

০৭-১২-০৮ দক্ষিণা পথের মধ্যে যে পথ খনি এলাকাযুক্ত, যে পথে মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, যে পথে অল্প পরিশ্রমে কার্যসিদ্ধি হয়, যে পথে পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের সুবিধা থাকে, সে পথও উত্তম পথ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ ধরনের পথের মধ্যে যে পথ বাহন, উট বা গাধা চলাচলের উপযোগী সে পথ মানুষের চলাচল পথ অপেক্ষা উত্তম।

০৭-১২-০৯ শত্রুর সমৃদ্ধিকে রাজার ক্ষতি এবং শত্রুর ক্ষতিকে রাজার সমৃদ্ধি হিসেবে গণ্য করতে হবে। শত্রুর এবং রাজার লাভ-ক্ষতি সমপর্যায়ের হলে তা স্থিতাবস্থা বলে বিবেচিত হবে। রাজার আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে তা ক্ষয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর বৈপরীত্য ঘটলে তা হবে বৃদ্ধি। রাজার আয়-ব্যয় সমান সমান হলে তা হবে স্থান। এভাবে ক্ষয়, বৃদ্ধি এবং স্থান সম্পর্কে সচেতন হলে রাজা দুর্গ ও সেতুবন্ধ নির্মাণের মাধ্যমে শত্রু অপেক্ষা অধিক লাভবান হতে সক্ষম হবেন।

ত্রয়োদশ অধ্যায় ॥ ১১৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে পশ্চাদবর্তী শত্রুর বিরুদ্ধে কোন পরিস্থিতিতে কোন উপায় বা পন্থা অবলম্বন করতে হবে, সে সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে রাজা কীভাবে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবেন, কীভাবে শত্রুপক্ষের লোকদের গোপনে হত্যা করাবেন, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-১৩-০১ রাজা এবং তার মিত্র, দুজন যখন সমঝোতার মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধরত পশ্চাদবর্তী শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা করবেন, তখন যিনি শক্তিমান শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবেন তিনিই অধিক লাভবান হবেন। কারণ, এর ফলে রাজা যেমন শক্তিমান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন, তেমনি তার শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও লোপ পাবে।

দুজন শত্রুরাজের মধ্যে যদি সমশক্তি পরিদৃষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে যিনি ব্যাপক সমর প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন এবং তাকে যিনি পরাভূত করতে সক্ষম হবেন, তিনিই অধিক লাভবান হবেন। কারণ, ব্যাপক প্রস্তুতিসম্পন্ন শত্রু পরাভূত হলে তার আর প্রতিরোধের ক্ষমতা অবিশিষ্ট থাকে না।

০৭-১৩-০২ যুদ্ধকালে দুজন শত্রুরাজার মধ্যে যদি যুদ্ধপোকরণের সমতা পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে যিনি সমগ্র সৈন্যবলসহ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন, তাকে যিনি পরাভূত করতে সক্ষম হবেন, তিনি অধিক লাভবান হবেন। সমগ্র সেনাশক্তি যুদ্ধে নিয়োজিত করার ফলে এ ধরনের পরাস্ত রাজার রাজধানী অরক্ষিত থাকে। যে কারণে তাদের পশ্চাদধাবন করাও সহজ হয়। এ ধরনের রাজার যদি নিজস্ব দুর্গ না থাকে, তাহলে তাদের পরাভূত করা আরও সহজতর হয়। কিন্তু যে রাজা মূল ভূখণ্ড বা রাজধানীর প্রতিরক্ষার জন্য সৈন্য মজুদ রেখে সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তাকে সহজে পরাভূত করা যায় না।

০৭-১৩-০৩ সমসংখ্যক সেনাসম্বলিত দুই সামন্ত রাজার মধ্যে যিনি দুর্গহীন পক্ষকে পরাভূত করতে সক্ষম হবেন, তিনি অধিক লাভবান হবেন। কারণ, দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে নিজেরও অধিক ক্ষতি এবং শত্রু কর্তৃক প্রতি আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়।

০৭-১৩-০৪ দুজন সমশত্রু সামন্তের মধ্যে যিনি ধার্মিক রাজার আক্রমণকারী, তাকে পরাস্ত করা সহজতর। কারণ, এ ধরনের রাজা স্বজন ও শত্রুজনের বিদ্বেষভাজন হয়ে থাকেন এবং এদের সহায়তার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। অন্যদিকে এ ধরনের অধার্মিক নৃপতিকে আক্রমণকারী রাজা আপনজন এবং পরজনের কাছে অতিপ্রিয় হয়ে থাকেন।

০৭-১৩-০৫ মিত্র এবং অমিত্রের প্রতি অভিযোগ উত্থাপনকারী বা আক্রমণকারীর মধ্যে যে রাজা মিত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী শত্রু সামন্তকে আক্রমণ করেন, তিনি বিশেষভাবে লাভবান হন। কারণ, তিনি যুদ্ধের পর মিত্রের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে পশ্চাদ-ধাবনকারীকেও উচ্ছেদে সক্ষম হতে পারেন। মিত্রের সঙ্গে সন্ধি সহজ কিন্তু অমিত্রের সঙ্গে সন্ধি সহজ নয়। এ কারণে মিত্রের সঙ্গে সন্ধি সম্পাদন করাই শ্রেয়তর। মিত্র এবং অমিত্রকে উচ্ছেদকারীর মধ্যে যে সামন্তরাজা অমিত্রের উচ্ছেদকারী সামন্তকে আক্রমণ করবেন, তিনি অধিক লাভবান হবেন।

০৭-১৩-০৬ মিত্র এবং অমিত্রের আক্রমণকারী সামন্তরাজারা যদি কোনো অর্জন ছাড়াই প্রত্যাগমন করেন, তাহলে যে সামন্তরাজ অর্জন থেকে বঞ্চিত হন এবং লোকক্ষয় ও ধনক্ষয়জনিত কারণে বিপর্যস্ত হন, তার পশ্চাদবর্তী শত্রু লাভবান হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উক্ত সামন্ত রাজারা যদি লাভবান হন তাহলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের পশ্চাদবর্তী শত্রুরা লাভবান হবে।

০৭-১৩-০৭ সমান সক্ষমতাসম্পন্ন দুই আক্রমণকারীর মধ্যে যিনি সেনাবাহিনীসহ শত্রুর অবস্থানের কাছাকাছি অবস্থান করেন, তার পক্ষে সহজে সাফল্য তথা বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়। কিন্তু দূরবর্তী অবস্থানে অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধাভিযানে সহজে সফলতা লাভ করা যায় না।

০৭-১৩-০৮ শত্রুর বিরুদ্ধে পশ্চাদধাবনকারীরা তিন ধরনের হতে পারে— শত্রুর সীমান্তবর্তী রাজা, তার পশ্চাদ রাজ্যের রাজা এবং দুপাশের প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা। শত্রু এবং রাজার উপকার বা অপকারে অসমর্থ মধ্যস্থিত দুর্বল রাজাকে বলা হয় অন্তর্ধি রাজা। এ ধরনের দুর্বল রাজা কখনো পশ্চাদবর্তী শত্রু হতে পারে না। কারণ, এরা কখনো কারো দ্বারা আক্রান্ত হলে দুর্গ বা বনে পালিয়ে যান।

০৭-১৩-০৯ রাজা ও শত্রুর মধ্যে যিনি পূর্বোক্ত বৈশিষ্ট্যযুক্ত মধ্যম রাজাকে বশীভূত করার অভিপ্রায়ে তার পশ্চাদধাবন করেন এবং এভাবে কিছু অর্জন করার পর প্রত্যাগমন করে উক্ত মধ্যমকে মিত্র থেকে বিযুক্ত করতে পারেন এবং শত্রুর সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমে মিত্রতা স্থাপন করতে পারেন, তিনি বিশেষভাবে লাভবান হয়ে থাকেন।

০৭-১৩-১০ কৌটিল্যের আচার্যের মতে—পশ্চাদ-ধাবনকারী এবং যুদ্ধাভিযানকারী রাজার চেয়ে যারা সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে গুপ্তচরদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক (বিষ প্রয়োগ, গোপন হত্যা, বিদ্বেষ সৃষ্টি) আক্রমণ পরিচালনা করেন, তারাই অধিক লাভবান হয়ে থাকেন। কারণ সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রচুর আর্থিক ও লোকক্ষয় হয়, ফলে বিজয় অর্জন করেও জয়লাভকারীকে প্রকারান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—লোকক্ষয় এবং সম্পদ নাশ সত্ত্বেও শত্রুবিনাশের ক্ষেত্রে সম্মুখ সমর অধিক ফলদায়ক, যে কারণে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াই সমীচীন।

০৭-১৩-১১ যুদ্ধে জড়িত উভয়পক্ষের ধনক্ষয় এবং লোকক্ষয় সমপরিমাণ পরিদৃষ্ট হলেও যে পক্ষ দোষযুক্ত (অনানুগত, অবিশ্বাসী, বিদ্রোহী) সৈন্যদের প্রথম আক্রমণে পাঠিয়ে শত্রুর মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করিয়ে সেনাবাহিনীকে ত্রুটিমুক্ত করে পরবর্তী পর্যায়ে অনুগত সেনাদের নিয়ে যুদ্ধ করবে, সেই পক্ষ সহজেই লাভবান হবে। এক্ষেত্রে উভয়পক্ষই যদি সমপন্থা অবলম্বন করে থাকে, সেক্ষেত্রে যিনি অতি বলবান এবং অধিক সংখ্যক দোষযুক্ত যোদ্ধাকে এই পন্থায় বিনাশ করাতে সমর্থ হবেন, তিনিই অভীষ্ট অর্জনে সক্ষম হবেন।

০৭-১৩-১২ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা শত্রুর পশ্চাদধাবনকালে, সরাসরি আক্রমণকালে বা আক্রমণীয় রাজ্যে উপনীত হলে, কীভাবে যুদ্ধের নেতৃত্ব প্ৰদান করবেন, সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—আক্রমণ পরিচালনার সময় প্রয়োজনের নিরিখে রাজা তখনই যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পশ্চাদধাবন করবেন, যখন তিনি শত্রুর পশ্চাদে অবস্থানরত মিত্রকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হবেন।

০৭-১৩-১৩

০৭-১৩-১৪ রাজা যদি নিজে আক্রান্তাবস্থায় উপনীত হন, তাহলে তিনি আক্রন্দ নামক মিত্রকে দিয়ে পাগ্ৰিাহ তথা পশ্চাদবর্তী শত্রুকে নিবারিত করবেন। এছাড়াও তিনি আক্রন্দাসার মিত্রকে দিয়ে পার্ষিগ্রাহাসার শত্রুকে প্রতিরোধ করবেন। সম্মুখভাগে অন্য মিত্রকে দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাবেন। এভাবে রাজা মিত্ররাজাদের সহায়তায় নিজের অবস্থান সংহত করবেন।

০৭-১৩-১৫ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা নিজের প্রয়োজনে রাজমণ্ডলের রাজাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত থাকার জন্য সর্বত্র দূত ও গুপ্তচর নিয়োগ করবেন। একই সাথে তিনি শত্রুদের সঙ্গে মিত্রতার ছল করে অত্যন্ত সন্তর্পণে আকার ইঙ্গিতে গুপ্তচরদের দিয়ে একে একে সমস্ত শত্রুকে হত্যা করাবেন। এক্ষেত্রে রাজাকে অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে তার সমস্ত অর্জন বিনষ্ট হয়ে যাবে। মাঝ দরিয়ায় ভেঙে পড়া নৌকা যেমন বিপদাপন্ন হয়, এ ধরনের হত্যার আকার ইঙ্গিত প্রকাশ হয়ে পড়লে রাজাকেও অনুরূপ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়।

চতুর্দশ অধ্যায় ॥ ১১৮ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে হৃতশক্তি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে রাজা সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলে কোন পন্থায় নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, কীভাবে শত্রুজোটে বিভক্তির সৃষ্টি করবেন, নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবেন, ইত্যাকার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৭-১৪-০১ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা যদি সম্মিলিত বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হন এবং উক্তরূপ আক্রমণ প্রতিহতকরণে যদি সমর্থ না হয়ে থাকেন, তাহলে নিজ সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে তিনি আক্রমণকারীদের মধ্যে যিনি অধিক বলশালী এবং ধার্মিক স্বভাবের, তার সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। উক্ত বলশালী যদি লোভার্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে, তাহলে তাকে দ্বিগুণ অর্থসম্পদ প্রদানের লোভ দেখিয়ে ভবিষ্যতে সহায়তার আশ্বাস প্রদান করে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এভাবে আস্থা বা বিশ্বাস উৎপাদন সম্ভব না হলে, মিত্রদের জন্য শক্তি ও ধনক্ষয় করার অসারতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ভবিষ্যতে মিত্রদের দ্বারা উচ্ছেদের শঙ্কা উত্থাপন করে জোটভুক্ত নৃপতিদের মধ্যে সংশয়ের সঞ্চার করে আক্রমণ থেকে তাদের নিবৃতকরণের প্রয়াস গ্রহণ করবেন।

০৭-১৪-০২ উপরোক্ত সাম্যনীতি ব্যর্থ হলে, জোটভুক্ত বলশালী রাজার বিরুদ্ধে ভেদনীতি প্রয়োগ করতে হবে, এক্ষেত্রে রাজা জোটভুক্ত অন্য রাজাদের বলবেন, ‘কোনো অপরাধ ব্যতিরেকে আমি যেমন এই সম্মিলিত বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, সাফল্য অর্জনের পর তুমিও একদিন এভাবে উক্ত রাজাদের দ্বারা আক্রান্ত হবে, অতএব সময় থাকতেই ওদের শক্তি নাশ করে দাও।’

০৭-১৪-০৩ এভাবে ভেদনীতি প্রয়োগ করে রাজা উক্ত বলশালী রাজার সঙ্গে অন্যান্য সমবায়িক বা সহযোগিদের বিবাদ বাঁধিয়ে দিবেন। অথবা দুর্বল সহযোগিদের সঙ্গে জোট বেঁধে তিনি উক্ত বলশালীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করবেন। অথবা বিভাজন সৃষ্টি করে পরিস্থিতির আলোকে ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন।

০৭-১৪-০৪ অথবা সম্মিলিত রাজাদের কাছে আক্রমণে নেতৃত্বদানকারী বলবান নৃপতি যে পরিমাণ ধন লাভ করবে, রাজা অতিগোপনে তাকে তারও অধিক সম্পদ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার মাধ্যমে অন্যান্য সহযোগিদের সঙ্গে নিজের সন্ধির ব্যবস্থা করাবেন। অতঃপর গুপ্তচরদের দিয়ে বলবানের বিরুদ্ধে হীনবলদের প্রতি বঞ্চনা করার অভিযোগ উত্থাপন করাবেন এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভাজন সৃষ্টি করবেন।

০৭-১৪-০৫ যদি এ ধরনের সম্মিলিত জোটে নেতৃত্বদানকারী কোনো বলশালী নৃপতির উপস্থিতি না থাকে। তাহলে রাজা ক্রমানুসারে উক্ত দলভুক্ত নয় প্রকার নৃপতি তথা—১. অন্যদের উৎসাহিতকরণে সক্ষম ২. স্থিরকর্মা বা শত্রুর বিনাশ না হওয়া অবধি যিনি নিরুদ্যম হন না ৩. অমাত্য-প্রকৃতিবর্গ কর্তৃক সমাদৃত ৪. লোভের বশবর্তী হয়ে জোটভুক্ত ৫. অন্যদের ভয়ে ভীত হয়ে জোটভুক্ত ৬. রাজার ভয়ে ভীত হয়ে জোটভুক্ত ৭. নিজ রাজ্যের স্বার্থে জোটে অন্তর্ভুক্ত ৮. পূর্বের মিত্র বিধায় বর্তমানে জোটভুক্ত এবং ৯. দুর্গরহিত নৃপতিদের বশীভূত করতে সচেষ্ট হবেন।

০৭-১৪-০৬ উপরোক্ত নৃপতিদের স্ববশে আনয়নের জন্য তাদের স্বভাব ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রলোভন বা প্রস্তাব প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে প্ৰথমজনকে আত্মসমর্পণের কথা বলে আক্রমণ না করার জন্য অনুরোধ করতে হবে। দ্বিতীয়কে তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে অনুরোধজ্ঞাপন করতে হবে। তৃতীয়কে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব প্রদান করতে হবে। চতুর্থকে প্রচুর অর্থপ্রদানের প্রস্তাব প্রদান করতে হবে। পঞ্চমকে সেনা ও অর্থ সহায়তার প্রস্তাব প্রদান করতে হবে। ষষ্ঠকে পরিপূর্ণ আশ্বাস প্রদান করতে হবে। সপ্তমের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করতে হবে। অষ্টমকে স্ববশে আনয়নের জন্য পূর্বোক্ত সকল দাবি পরিত্যাগ করে মিত্রতার আহ্বান জানাতে হবে এবং নবমকে আস্থা উৎপাদনের মাধ্যমে বশীভূত করতে হবে।

০৭-১৪-০৭ অথবা জোটভুক্ত নৃপতিদের সম্মিলিত আক্রমণ হতে নিজেকে রক্ষার জন্য রাজা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সাম, দান, ভেদ বা দণ্ড প্রয়োগ করে জোটে ফাটল ধরিয়ে আক্রমণকারীদের নিষ্ক্রিয় করবেন এবং নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণে সচেষ্ট হবেন।

০৭-১৪-০৮ রাজা যদি জোটগতভাবে নিজেকে অসহায় মনে করেন, তাহলে তিনি বন্ধু, স্বজন ও মিত্রভাবাপন্নদের সঙ্গে নিয়ে জোট গঠনে সচেষ্ট হবেন এবং দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করাবেন। কারণ, রাজা যদি মিত্র, জোট এবং দুর্গের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংহত করতে সমর্থ হন, তাহলে তিনি স্বপক্ষ এবং পরপক্ষের কাছে পূজিত হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে রাজা যদি অপ্রাজ্ঞ হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অধিক সংখ্যক প্রাজ্ঞজন নিয়োগে মনোনিবেশ করবেন। তিনি বিদ্বান বৃদ্ধদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করবেন এবং তাদের কাছ থেকে নীতিবিদ্যা শিক্ষালাভ করবেন। এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে রাজা স্বীয় সমৃদ্ধি সাধনে সক্ষম হয়ে উঠবেন। রাজা যদি প্রভাব অর্থবলে প্রতিপত্তিহীন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অমাত্য ও প্রকৃতিবর্গের সমৃদ্ধি সাধনে সচেষ্ট হবেন। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য নগর, জনপদের সমৃদ্ধি সাধনে যত্নবান হবেন। সকল প্রকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সারা বছর জলসেচের ব্যবস্থা করণার্থে প্রয়োজনীয় বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করাবেন।

০৭-১৪-০৯ বণিক পথে শত্রুকে প্রবঞ্চিত করা যায়। কারণ এ পথ শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যিক কাজের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয় না, এই পথ দিয়েই সৈন্য প্রেরণ করা হয়, এ পথ ধরেই গুপ্তচররা চলাচল করে থাকে, এ পথ ধরেই অস্ত্রশস্ত্র পরিবাহিত হয় এবং যানবাহন চলাচল করে থাকে।

আহরিত খনিজ সম্পদ তথা লৌহধাতু দিয়ে যুদ্ধের সমরাস্ত্র এবং উপকরণাদি প্রস্তুত করা হয়। দ্রব্যবনের উৎপন্ন বনজ সম্পদ দিয়ে ঘরবাড়ি- অট্টালিকা, আসবাবপত্র, যানবাহন এবং রথনির্মাণ করা হয়। হস্তিবনের মাধ্যমে হস্তির যোগান দেওয়া হয়। চারণভূমির মাধ্যমে হাতি, ঘোড়া, গাধা, উট ও গবাদি পশুর যোগান পাওয়া যায়। কোনো রাজার যদি এ ধরনের উৎস না থাকে তাহলে মিত্রদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে।

০৭-১৪-১০ কোনো রাজা যদি উৎসাহশক্তিহীন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি নিজের প্রয়োজন অনুসারে বলবান পুরুষ, শত্রুনাশক চোর, বনচারী, ম্লেচ্ছ এবং গুপ্তচরদের কলেবর বৃদ্ধি করে উৎসাহশক্তিসম্পন্ন হতে সচেষ্ট হবেন। তিনি শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের মাধ্যমে নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা করবেন। এভাবে রাজা মিত্রপক্ষ, পরামর্শক, দুর্গ, দ্রব্য এবং উৎসাহব্যঞ্জক উপাদান সমৃদ্ধ করে নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান এবং শত্রু দমনে প্রবৃত্ত হবেন।

পঞ্চদশ অধ্যায় ॥ ১১৯-১২০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বলশালী শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম, অধিক বলশালীর অধীনে বা দুর্গে আশ্রয়গ্রহণসহ শত্রু রাজার দ্বারা আক্রান্ত হলে রাজা কীভাবে নিজেকে এবং তার রাজ্যকে রক্ষা করবেন, সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৭-১৫-০১ দুর্বল রাজা বলশালী নৃপতি কর্তৃক আক্রান্ত হলে তিনি আক্রমণকারীর চেয়ে সেনা সমর্থতায় ও মন্ত্র শক্তিতে (মন্ত্রণা বলতে এখানে মন্ত্রী অমাত্যদের প্রজ্ঞা, পরামর্শের গুণাবলির কথা বোঝানো হয়েছে) অধিক বলশালী কোনো রাজার অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। আশ্রয়যোগ্য রাজারা যদি অনেকেই এরূপ গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত রাজা মন্ত্রশক্তিতে সমৃদ্ধ কোনো এক রাজার অধীনে আশ্রয়গ্রহণ করবেন।

এ ধরনের একাধিক রাজার উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হলে হলে, তিনি সেই রাজার কাছে আশ্রয়গ্রহণ করবেন, যিনি বিদ্বান বৃদ্ধদের সংস্পর্শে অবস্থান করেন। যদি আক্রমণকারী অপেক্ষা উপরোক্ত ধরনের অধিক বলশালী রাজার সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে আক্রান্ত রাজা শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত আক্রমণকারী রাজার সমকক্ষ একাধিক রাজার আশ্রয়ে অবস্থান করবেন। সমশক্তি এবং অধিক শক্তিসম্পন্ন একাধিক রাজার উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হলে আক্রান্ত রাজাকে সেই রাজার শরণাপন্ন হতে হবে, যিনি খাদ্য দ্রব্য, অন্যান্য রসদ এবং সামরিক সম্ভারে সমৃদ্ধ।

০৭-১৫-০২ উপরোক্ত প্রকৃতির সহায়ক রাজার অনুপস্থিতি পরিদৃষ্ট হলে নিজের সক্ষমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত রাজাকে কোনো এক বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী, উৎসাহযুক্ত ও আক্রমণকারীর শত্রু হিসেবে বিবেচিত সমশক্তিসম্পন্ন হীনবল রাজার সান্নিধ্যে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে সমশক্তিসম্পন্ন হীনবল রাজাদের মধ্যে তার অধীনেই তিনি আশ্রয়গ্রহণ করবেন, যার আশ্রয়ে তিনি যুদ্ধযোগ্য ভূমি লাভে সক্ষম হবেন।

বহু রাজার কাছ থেকে এরূপ যুদ্ধভূমি লাভের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি তাকেই আশ্রয় করবেন, যার কাছ থেকে যুদ্ধযোগ্য কাল লাভের সম্ভাবনা থাকবে। বহু রাজার কাছ থেকে এরূপ যুদ্ধভূমি এবং যুদ্ধকাল লাভের সম্ভাবনা দেখা দিলে, আক্রান্ত রাজা তার কাছে আশ্রয়গ্রহণ করবেন, যার কাছ থেকে যুদ্ধের জন্য উট, ঘোড়া, বৃষ, অস্ত্র, রক্ষাকবচসহ সমর উপকরণের সহায়তা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকবে।

০৭-১৫-০৩ উপরোক্ত প্রকৃতির আশ্রয়যোগ্য রাজার অনুপস্থিতি অনুভূত হলে আন্তরাজাকে এমনতর দুর্গে আশ্রয়গ্রহণ করতে হবে যে দুর্গ—শত্রু কর্তৃক অভেদ্য, যে দুর্গ প্রয়োজনীয় মনুষ্য খাদ্য, পশু খাদ্য ও জ্বালানি কাঠ সমৃদ্ধ এবং যে দুর্গে আক্রমণ প্রাক্কালে শত্রুপক্ষকে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একাধিক দুর্গেও দুর্গ বিদ্যমান থাকলে রাজাকে এমন দুর্গে আশ্রয়গ্রহণ করতে হবে, যে দুর্গ-তৈল লবণসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্যে সমৃদ্ধ এবং যে দুর্গ বহিগর্মনের সুবিধা সম্বলিত। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, এ ধরনের দুর্গে আশ্রয়গ্রহণ করাই রাজার জন্য সমীচীন। অন্যান্য আচার্যরা এক্ষেত্রে কৌটিল্যের মতের সঙ্গে একমত নন।

০৭-১৫-০৪ নিম্নোক্ত প্রেক্ষাপটের কোনো একটি প্রযোজ্য হলে আক্রান্ত রাজা দুর্গে আশ্রয়গ্রহণ করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন—১. দুর্গে আশ্রয়গ্রহণের মাধ্যমে পশ্চাদশত্রু, সে শত্রুর মিত্র, মধ্যম বা উদাসীন রাজাকে পরাভূত করা সম্ভব বলে প্রতীয়মান হলে ২. আক্রমণকারীর প্রতিবেশী নৃপতি, আটবিক, (বনের সর্দার) শত্রুর বংশোৎপন্ন ব্যক্তি অথবা আক্রমণকারী রাজার অবরুদ্ধ রাজপুত্রকে বশীভূত করে তাদের কারো মাধ্যমে প্রতি আক্ৰমণ পরিচালনা সম্ভব বলে অনুভূত হলে ৩. সাম বা দানের মাধ্যমে শত্রুপক্ষীয় অমাত্যদের বশীভূত করে শত্রু রাজ্যে বিদ্রোহের ব্যবস্থাকরণ সক্ষম হলে ৪. গুপ্তচরদের দিয়ে অস্ত্র, অগ্নি বা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রু রাজাকে হত্যা করা সম্ভব হলে ৫. রাজার ঘাতকদের দিয়ে শত্রুপক্ষের লোকক্ষয়, ধনক্ষয় ও বিবিধ সম্পদ ক্ষয় করা সম্ভব হলে ৬. আক্রমণকারীর মিত্রদের লোকক্ষয়, সম্পদ ক্ষয়ের মাধ্যমে বিভক্তিকরণ সম্ভব হলে ৭. শত্রুর রসদ সরবরাহ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে শত্রুকে উৎপীড়ন করা সম্ভব হলে ৮. গোপনে আক্রমণকারী রাজার সেনাশিবিরে প্রবেশ করে দুর্বল অবস্থান চিহ্নিতকরণ এব পরবর্তী সময়ে ব্যাপক পরিসরে আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হলে ৯. আক্রমণকারীকে প্রতিহত করে ইচ্ছেমতো সন্ধি করার সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা অনুভূত হলে ১০. আক্রমণের কারণে আক্রমণকারী রাজার বিরুদ্ধে অন্যান্য নৃপতিদের ক্ষোভ সঞ্চারণ সম্ভব হলে ১১. আক্রমণকারী রাজার রাজধানীতে রাজা কর্তৃক প্রতিআক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হলে ১২. দুর্গে আশ্রয়গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হলে ১৩. অন্যত্র প্রেরিত সৈন্যদল প্রত্যাবর্তনের পর দুর্গে অবস্থানরত রাজার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনুভূত হলে ১৪. দুর্গে অবস্থানের মাধ্যমে জলযুদ্ধে, পরিখাযুদ্ধে এবং রাত্রিযুদ্ধে সফলতার সম্ভাবনা অনুভূত হলে ১৫. দুর্গে আক্রমণ পরিচালনা শত্রুপক্ষের জন্য প্রতিকূল এবং ব্যাপক লোকক্ষয় ও ধনক্ষয়ের প্রেক্ষিত সূচিত করবে বলে অনুভূত হলে ১৬. শত্রুর জন্য এ ধরনের দুর্গ আক্রমণ ব্যাধিজনিত বিপর্যয়, সৈনিকদের অবস্থানগত বিপর্যয় এবং বিপুল ক্ষতির কারণ হবে বলে রাজার কাছে অনুভূত হলে।

০৭-১৫-০৫ কৌটিল্যের আচার্য মনে করেন—উপরোক্ত হেতুসমূহের ব্যতিক্রম এবং শত্রু সেনাদের প্রাবল্য পরিদৃষ্ট হলে রাজা দুর্গ পরিত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করবেন। তার মতে—এক্ষেত্রে পতঙ্গ যেমন অগ্নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনি রাজা তার নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হলে অগ্নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সমস্ত শক্তি নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে সবসময় যে পরাজিত হতে হয় এমনটা নয়, অনেক পতঙ্গ একত্রে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে অনেক সময় যেমন আগুন নিভে যায়, তেমনি অনন্যোপায় রাজা যখন সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন স্বর্গলাভ ছাড়াও অনেক সময় বিজয়ও সূচিত হয়।

কিন্তু কৌটিল্য তার আচার্যের উপরোক্ত অভিমত সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন—শত্রুর প্রাবল্য পরিদৃষ্ট হলে রাজা কর্তৃক সন্ধি সম্পাদন করাই সমীচীন হবে। সন্ধি করা সম্ভব না হলে রাজা ‘আত্মবিনাশ অথবা শত্রুর পরাজয়’র অভিপ্রায়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন অথবা দুর্গ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবেন।

০৭-১৫-০৬ অথবা তিনি আত্মরক্ষার্থে, সন্ধিতে ইচ্ছুক কোনো ধৰ্ম বিজয়ী বলবান রাজার কাছে দূতের মাধ্যমে সন্ধির প্রস্তাব প্রেরণ করবেন, কিংবা সেই সন্ধি ইচ্ছুক রাজার প্রেরিত দূতকে মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট করে রাজকুমার, রাজমহিষী এবং রাজত্বের সমুদয় ধন সম্পদসহ নিজেকে উক্ত রাজার হেফাজতে সমর্পণের ইচ্ছে ব্যক্ত করে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।

০৭-১৫-০৭ অতঃপর উক্ত নৃপতির অধীনে আশ্রয় লাভ করার পর রাজা তার সঙ্গে সেবকের মতো আচরণ করবেন। তিনি সেই আশ্রয়দাতা রাজার অনুমোদনক্রমে প্রতিরক্ষা দুর্গ নির্মাণ, পুত্র কন্যার বিবাহ, রাজ্যাভিষেক, অশ্বের বিপণন, হস্তি বন্ধন, পূজা-যজ্ঞ, উৎসবানুষ্ঠান, মেলানুষ্ঠান, শিকারে গমন, ইত্যাকার কর্মে প্রবৃত্ত হবেন। একইভাবে আশ্রয়দাতার অনুমোদক্রমে রাজ্যের অমাত্যদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এবং রাজ্য ত্যাগকারী দোষযুক্ত অমাত্যদের শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। রাজার জনপদ ও নগরবাসী যদি দোষযুক্ত হয়, অন্যায়কারী হয়, তাহলে রাজা পিতৃভূমির মায়া পরিত্যাগ করে অন্যত্র বসবাসের জন্য আশ্রদাতার কাছ থেকে বসবাসের জন্য ভূমি চেয়ে নিবেন।

অথবা তিনি উপরোক্ত নগর ও জনপদের অন্যায়কারী বা দোষ্যদের উপর ন্যায়দণ্ড প্রয়োগ করে অন্যায়ের প্রতিকার করবেন।

এক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা যদি রাজার সুগুণসম্পন্ন কোনো মিত্রের ভূমি অপহরণ করে তা রাজাকে প্রদানে ইচ্ছুক হয়, সেক্ষেত্রে রাজা তা গ্রহণে অস্বীকৃত হবেন। আশ্রিত রাজা কখনো নিজ অমাত্যদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করবেন না, সর্বোপরি তিনি এমন কোনো আচরণ করবেন না যা আশ্রয়দাতার অসন্তুষ্টি উৎপাদন করবে। তিনি সর্বদা তার জন্য দেবতার পূজা, স্বস্তিবাচন অনুষ্ঠান এবং কল্যাণ কামনা করবেন।

০৭-১৫-০৮ উপরোক্ত রীতিতে আশ্রিত রাজা আশ্রয়দাতার সমীপে নিজের সেনাবাহিনীসহ সবকিছু সমর্পণ করে তার সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। আশ্রয়দাতার শত্রুদের বিরুদ্ধাচারণ করবেন এবং এভাবেই আক্রমণকারীর কবল থেকে নিজেকে ও রাজ্যকে রক্ষা করবেন।

ষোড়শ অধ্যায় ॥ ১২১ প্রকরণ ॥

আত্মসমর্পণকারী রাজার প্রতি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার আচরণ কেমন হবে সে বিষয়ে এ অধ্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে, কেন রাজা বশ্যতা স্বীকারকারী নৃপতিদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করবেন এবং কোন ক্ষেত্রে তিনি তাদের শাস্তি প্রদান বা হত্যা করবেন, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-১৬০১ সন্ধি স্থাপনের পর কোনো রাজা কর্তৃক প্রতিশ্রুত অর্থপ্রদান না করে রাজার উদ্বেগ উৎপাদন করা হলে, সে দেশে সেনাভিযানের জন্য যদি উপযুক্ত সড়কপথ থাকে, সেনা চলাচল ও প্রশিক্ষণের জন্য যদি পর্যাপ্ত ভূমির অবস্থান থাকে, সে দেশে যদি পর্যাপ্ত খাদ্যের মজুদ থাকে, আক্রমণীয় রাজার আশ্রয়ের জন্য যদি দুর্গের অবস্থান না থাকে, পশ্চাদবর্তী শত্রু ও তাদের মিত্রদের অনুপস্থিতি বিদ্যমান থাকে, তাহলে রাজা উক্ত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবেন।

এর বিপরীত অবস্থা পরিদৃষ্ট হলে এ সবের প্রতিকার সাধনসাপেক্ষে তিনি আক্রমণে প্রবৃত্ত হবেন। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তিনি আক্রমণ হতে বিরত থাকবেন। এই ধরনের যেসব রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান অত্যাবশ্যক বলে অনুভূত হবে, তারা যদি দুর্বল হয়ে থাকে, তাহলে সাম এবং দানের মাধ্যমে তাদের বশীভূত করতে হবে কিন্তু তারা যদি বলশালী প্রকৃতির হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ভেদ ও দণ্ডের মাধ্যমে তাদের পরাভূত করতে হবে।

০৭-১৬-০২ এক্ষেত্রে সামনীতির আলোকে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আক্রমণীয় দুর্বল নৃপতির চিত্ত জয়ের জন্য রাজা তার গ্রাম, জনপদ, গোচারণভূমি, অরণ্যবাসী, বণিকপথ হিসেবে ব্যবহৃত জলপথ-স্থলপথ উৎপীড়নকারীদের পীড়ন থেকে হেফাজত করে তাকে সুরক্ষা প্রদান করবেন। পলাতক দাস, দাসী, অপরাধী ও অপকারকারীদের পাকড়াও করে তার কাছে সমর্পণ করবেন। দাননীতির আলোকে তাকে ভূমিদান করবেন, দ্রব্যদান করবেন, প্রয়োজনে কন্যাদান করবেন, শত্রুর শঙ্কা উপস্থিত হলে নিরাপত্তার অভয় দান করবেন। এভাবে সাম ও দানের মাধ্যমে হৃদয় জয় করে রাজা তাকে বশীভূত করবেন।

০৭-১৬-০৩ বলশালী বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা অবনমিত বা বশ্যতা স্বীকারকারী নৃপতির আটবিক (অরণ্য প্রধান) বা উক্ত নৃপতির জ্ঞাতি বা অবরুদ্ধ পুত্র, এদের কোনো একজনকে স্বপক্ষভুক্ত করে নৃপতির কাছে সেনা ও অর্থ দাবি করে ভেদনীতি প্রয়োগ করবেন। অতঃপর প্রকাশ যুদ্ধ, কূটযুদ্ধ, তূষ্ণীংযুদ্ধ এবং দুর্গলম্ভোপায়ের মাধ্যমে নৃপতিকে বশীভূত করবেন। এ ধরনের বশীভূত নৃপতিদের মধ্যে যারা রাজার যুদ্ধাভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে উৎসাহযুক্ত, উপকার বিধানকারী, সেনাবাহিনী দিয়ে সহায়তাকারী, অর্থ দিয়ে সহায়তাকারী, পরামর্শ দিয়ে সহায়তাকারী এবং ভূমি দিয়ে সহায়তাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, রাজা তাদের নিজ নিজ অবস্থানে বহাল রাখবেন।

০৭-১৬০৪ নৃপতিদের মধ্যে যারা রাজাকে এ ধরনের যুদ্ধাভিযান পরিচালনা প্রাক্কালে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান, গ্রাম, খনি, খনিজজাত রত্ন, সারদ্রব্য, শঙ্খ, বস্ত্র, দ্রব্যবন, হস্তিবন, রথ, বাহন, হাতি ইত্যাকার বহুবিধ দ্রব্য সম্ভার দিয়ে সহায়তা প্রদান করবে, তারা চিত্রভোগ মিত্র। যারা সেনা সহায়তা এবং অর্থ সহায়তা দিয়ে রাজার উপকার সাধন করবে তারা মহাভোগমিত্র। যারা সেনা, অর্থ এবং ভূমি দিয়ে সহায়তা করবে তারা সর্বভোগ মিত্র হিসেবে বিবেচিত হবেন।

০৭-১৬০৫ যে নৃপতিমিত্র রাজার একজন শত্রুর মোকাবেলা করে থাকে, তাকে বলা হয় একতোভোগী মিত্র। আর যিনি রাজার অমিত্র, রাজার শত্রুর মিত্র, রাজার প্রতিবেশী শত্রু এবং আটবিকদের নিরোধ করেন তিনি সর্বোতভোগী মিত্র নামে পরিচিত।

০৭-১৬-০৬ অবনমিত বা বশ্যতা স্বীকারকারী নৃপতিদের মধ্যে যারা রাজার উপকার সাধন করবে এবং রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করবে, রাজা তাদের পূর্বের সকল সুযোগ সুবিধা বহাল রেখে তা ভোগের অধিকার প্রদান করবেন। অবনমিত নৃপতি যদি নেতিবাচক আচরণ প্রদর্শন করে, তাহলে রাজা তাকে গোপনে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে অনুগত থাকতে বাধ্য করবেন। তিনি যদি রাজার উপকারক হয়ে থাকেন, তাহলে রাজাও তাকে প্রতিউপকার করে পরিতৃপ্ত করবেন এবং উপকারের প্রকৃতি মূল্যায়ন করে অর্থ ও সম্মান প্রদান করবেন।

উক্ত নৃপতির বন্ধু-স্বজন বিয়োগজনিত শোকের সময় রাজা তাকে সহায়তা ও সান্তনা প্রদান করবেন। এ ধরনের নৃপতিরা রাজার সমীপে দর্শনের জন্য উপনীত হলে রাজা তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দর্শন ও সাক্ষাৎকার প্রদানে কার্পণ্য করবেন না।

অবনমিত নৃপতিদের প্রতি রাজা কখনো অনাদর প্রদর্শন করবেন না, তাদের কুৎসা রটনা করবেন না, তাদের প্রতি হীনবাক্য প্রয়োগ করবেন না। তারা শঙ্কিত হলে বা বিপদাপন্ন হলে রাজা পিতার মতো তাদের অভয় প্রদান করবেন এবং অনুগ্রহ করবেন। অবনমিত নৃপতিদের কেউ যদি রাজার ক্ষতিসাধন করে, তাহলে রাজা তার ক্ষতির কথা সর্বত্র প্রচার করে তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করবেন। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য আত্মসমর্পিত নৃপতিদের মধ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা সূচিত হলে, রাজা গুপ্তচরদের দিয়ে তাদের হত্যা করাবেন। কিন্তু তিনি তার সিংহাসন, সম্পদ বা পরিজনদের ছিনিয়ে নিবেন না, তার শূন্য সিংহাসনে উপযুক্ত পুত্র বা যোগ্য উত্তরাধিকারীকে অধিষ্ঠিত করবেন। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে উক্ত নৃপতির উত্তরাধিকারীরা বংশপরম্পরায় রাজার প্রতি অনুগত হয়ে থাকবে।

০৭-১৬০৮ যে রাজা অনুগত নৃপতিদের হত্যা করেন, কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখেন, তাদের ধন সম্পদ স্ত্রী পরিজনদের অপহরণ করেন। তার প্রতি অন্যান্য রাজন্যরা (দ্বাদশরাজমণ্ডল) বীতশ্রদ্ধ হয়ে তার বিনাশসাধনে সচেষ্ট হয়ে থাকেন। এ ধরনের রাজার প্রতি অমাত্যরাও ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য রাজার সহায়তায় তাকে উচ্ছেদ করার তরিকা অন্বেষণ করেন এবং কখনো কখনো এরা রাজাকে গ্রাস করেন বা হত্যা করেন। এ কারণে যে রাজা সামনীতি অবলম্বনের মাধ্যমে অবনমিত রাজাদের লালন করবেন, তিনি ও তার রাজ্য যুগযুগান্তর টিকে থাকবে। অন্যদিকে যিনি এর বিপরীত পন্থা অবলম্বন করবেন তিনি অচিরেই রাজ্যসমেত ধ্বংস হয়ে যাবেন।

সপ্তদশ অধ্যায় ॥ ১২২-১২৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সন্ধি সম্পাদন, সংহতকরণ এবং সন্ধি মোচনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সন্ধির প্রকৃতি, সন্ধির সময় কোন প্রকৃতির রাজকুমারকে জামিনে রাখা সঙ্গত, কোন উপায়ে রাজকুমাররা সন্ধিকৃত অবরুদ্ধ অবস্থা হতে পালিয়ে আসবে, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০৭-১৭-০১ এক্ষেত্রে শম, সন্ধি ও সমাধি সমার্থক শব্দরূপে গণ্য হয়ে থাকে। যদ্বারা সন্ধি সম্পাদনকারীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা দৃঢ়মূল হয় তাই শম, সন্ধি বা সমাধি বলে স্বীকৃত। কৌটিল্যের আচার্যের মতে—যে সন্ধি সত্যবচনের মাধ্যমে এবং পিতা বা গুরুজনদের পাদস্পর্শে বা স্বর্ণাদি স্পর্শপূর্বক সম্পাদন করা হয় তাকে চলসন্ধি বলা হয়। যে সন্ধি রাজপুত্র বা অন্য কোনোকিছু জামিন রাখার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়, তাকে বলা হয় স্থাবরসন্ধি।

এক্ষেত্রে কৌটিল্য উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে—সত্যবচন এবং শপথের মাধ্যমে সম্পাদিত সন্ধিই স্থাবর সন্ধি। কারণ, এ ধরনের সন্ধি ভঙ্গ করা হলে ইহকালে যেমন সমাজে নিন্দিত ও ধিকৃত হবার সম্ভাবনা থাকে তেমনি পরকালেও নরক যন্ত্রণা ভোগের ভীতি থাকে। কিন্তু কোনোকিছু জামিন রাখার মাধ্যমে যে সন্ধি সম্পাদিত হয় তা লঙ্ঘিত হলে শুধু ইহজাগতিক নিগ্রহের সম্ভাবনা দেখা দেয়, পরলোকে এর জন্য কোনো খেসারত প্রদান করতে হয় না। যে কারণে এ ধরনের সন্ধি-ই চলসন্ধি বলে বিবেচিত হওয়া সঙ্গত।

০৭-১৭-০২ বলা হয়, পূর্ববর্তী সময়ে রাজা হরিশ্চন্দ্র, নল, যুধিষ্ঠির, প্রমুখেরা সত্যবচনের মাধ্যমে সন্ধি সম্পাদন করতেন। সে-সময় সত্যবচনের মাধ্যমে সম্পাদিত সন্ধি লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা অনুভূত হলে তারা অগ্নি, জল, ভূমি, ইস্টক, হাতির স্কন্ধ, অশ্বপৃষ্ঠ, রথের আসন, অস্ত্র, রত্ন, শালি ধানের বীজ, চন্দন, ঘৃত, স্বর্ণ ও অর্থ, এই চৌদ্দটি উপাদান স্পর্শ করে এই মর্মে শপথের মাধ্যমে সন্ধি সম্পাদন করতেন যে সম্পাদিত সন্ধি যার দ্বারা লঙ্ঘিত হবে তিনি উপরোক্ত উপাদানের অভিসম্পাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবেন। এ ধরনের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সম্পাদিত সন্ধি যদি লঙ্ঘিত হওয়ার সম্ভাবনা অনুভূত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো মহান ব্যক্তি, সাধুপুরুষ বা গ্রাম প্রধানকে জামিনদার করে সন্ধি সম্পাদন করা সঙ্গত হবে। এ ধরনের সন্ধির মাধ্যমে যিনি শত্রু নিগ্রহক উপাদান গ্রহণে সমর্থ হন, তিনি অধিক লাভবান হয়ে থাকেন। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে শত্রুরাজা লাভবান হন।

কোনো স্বজন বা রাজপুরুষকে জামিন রেখে সন্ধি সম্পাদন করা হলে তাকে পতিগ্রহ বলা হয়। পতিগ্রহের মাধ্যমে সন্ধি সম্পাদন প্রাক্কালে যে রাজা দোষযুক্ত পুত্র বা কন্যাকে জামিন রেখে সন্ধি সম্পাদন করবেন তিনি অপরপক্ষ অপেক্ষা অধিক লাভবান হবেন। কারণ, এ ধরনের দোষযুক্ত পুত্র বা কন্যা রাজার কোনো উপকারে আসে না বলে তাদের অনুপস্থিতিতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। অন্যদিকে জামিন গ্রহণকারীও তাদের দিয়ে কোনোকিছু অর্জন করতে পারেন না। পুত্র, কন্যার ক্ষেত্রে যদি কন্যাকে জামিন রেখে সন্ধি করা হয়, তাহলে রাজার কোনো ক্ষতিসাধিত হয় না, তিনি প্রকারান্তরে লাভবান হন। কারণ, কন্যা কখনো পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে বিবেচিত হয় না, সে অপরের (স্বামী) ভোগ্যা হয়ে থাকে, অধিকন্তু পিতাকে ধনাদি ব্যয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। কিন্তু পুত্রের মধ্যে এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হয়, পুত্ররা পিতার সমৃদ্ধির সহায়ক হয়ে থাকে। এ কারণে পুত্রকে জামিন রেখে সন্ধি সম্পাদন করা হলে পিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

০৭-১৭-০৩ রাজা যদি সমজাতীয় পুত্রের মধ্যে যে বিদ্বান, সাহসী, অস্ত্রচালনায় পারদর্শী, বা একমাত্র পুত্রকে জামিন রেখে সন্ধি সম্পাদন করেন, তাহলে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং অপরপক্ষ লাভবান হন। এর বৈপরীত্য হলে রাজা লাভবান হন এবং অপরপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। অজাত্য পুত্ৰ বিদ্বান, সাহসী, যুদ্ধে পারদর্শী হলেও তাকে জামিন রাখা হলে রাজা ক্ষতিগ্রস্ত হন না। কারণ, এ ধরনের পুত্র কখনো সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারে না, এক্ষেত্রে অবিদ্বান, ভীরু ও যুদ্ধে অক্ষম তাজ্যপুত্র অযোগ্য হলেও রাজার জন্য কাঙ্ক্ষিত। কারণ, এ ধরনের পুত্র সিংহাসনে অধিষ্ঠানের অধিকারী হয়ে থাকে। বিধায় এ ধরনের পুত্রকে জামিন রাখা সমীচীন নয়। বহুপুত্রের ক্ষেত্রে কনিষ্ঠকে জামিন রেখে সন্ধি সম্পাদন করা শ্রেয়তর। এতে করে রাজা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। কারণ, এ ধরনের পুত্রের উপর পিতার বা অন্যান্য ভ্রাতার নির্ভরশীরতা কম থাকে।

০৭-১৭-০৪ অজ্ঞকুলীন এবং প্রাজ্ঞঅকুলীন পুত্রের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাধারী হওয়া সত্ত্বেও রাজা সন্ধি সম্পাদনের নিমিত্ত অকুলীন পুত্রকেই জামিনের জন্য নির্বাচন করবেন। কারণ অপ্রাজ্ঞ কুলীন পুত্র রাজৈশ্বর্যের অধিকারী হয়ে বিদ্বান অমাত্যদের সান্নিধ্যে থেকে একসময় প্রজ্ঞার অধিকারী হতে পারবে কিন্তু প্রজ্ঞাধারী হওয়া সত্ত্বেও অকুলীন পুত্র কখনো সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবে না।

সাহসী এবং বিদ্বান পুত্রের ক্ষেত্রে রাজা সাহসী পুত্রকেই জামিনের জন্য মনোনীত করবেন। এতে করে রাজা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, বুদ্ধিমান শিকারি যেমন কৌশল অবলম্বন করে মহাপরাক্রমশালী সিংহকেও বশীভূত করতে পারে, তেমনি সাহসহীন বিদ্বান পুত্র বুদ্ধির মাধ্যমে দুঃসাহসিক অনেক কিছুই লাভ করতে সমর্থ হয়ে থাকে। কিন্তু বুদ্ধিহীন সাহসী পুত্র বিদ্বানের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হতে পারে না।

০৭-১৭-০৫ সাহসী ও অস্ত্রচালনায় পারদর্শী পুত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রে সন্ধির প্রয়োজনে রাজা অস্ত্রচালনায় পারদর্শী পুত্রকেই জামিনের জন্য মনোনীত করবেন। কারণ, সাহসী পুত্র নিজের দুঃসাহসিকতার মাধ্যমে অস্ত্রচালনায় পারদর্শী যে কাউকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়ে থাকে কিন্তু সাহসিকতার অভাব হেতু অস্ত্রচালনায় পারদর্শিতা সত্ত্বেও উক্ত পুত্রের মাধ্যমে দুঃসাহসিক কর্মসাধন সম্ভব হয়ে ওঠে না।

০৭-১৭-০৬ বহুপুত্রযুক্ত ও এক পুত্রযুক্ত রাজার মধ্যে যিনি বহুপুত্রযুক্ত, তিনি তার একটি সন্তানকে জামিন রেখে অন্য সন্তানদের নিয়ে থাকতে পারেন বলে অধিক সুবিধা ভোগকারী হয়ে থাকেন। এক পুত্রযুক্ত রাজার যদি পৌত্র থেকে থাকে তাহলে তিনি উক্ত পুত্রকে সন্ধির জন্য জামিন রাখলেও ক্ষতির শিকার হবেন না, কারণ এক্ষেত্রে পৌত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়ে রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার সহায়ক হয়ে থাকে। দুই পুত্রযুক্ত সন্ধিকারী রাজার দু পুত্রই যদি পুত্রযুক্ত হয় সেক্ষেত্রে যে পুত্র পুনরায় সন্তান উৎপাদনে সক্ষম সে পুত্রের পরিবর্তে অপর পুত্রকে জামিন রাখতে হবে। যে রাজার একটিমাত্র পুত্র থাকবে, কোনো পৌত্র থাকবে না এবং সে রাজা যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে পুত্রের পরিবর্তে উক্ত রাজা নিজেই সন্ধির জন্য জামিন হয়ে সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করবেন। এভাবে সন্ধির মাধ্যমে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা নিজের সমৃদ্ধিসাধন ও অবস্থান সুদৃঢ় করবেন।

০৭-১৭-০৭ এ ধরনের সন্ধির মাধ্যমে নিজেকে সাময়িক সময়ের জন্য রক্ষা করে নৃপতি ক্রমশ নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে জামিন প্রদানকৃত রাজকুমারকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবেন। এক্ষেত্রে তার প্রেরিত গুপ্তচররা কারিগর বা স্বর্ণকারের বেশধারণ করে যানবাহন বা অলঙ্কার নির্মাণের উসিলায় গুপ্তপথ খনন করে রাতের আঁধারে সুড়ঙ্গ পথে রাজকুমারকে উদ্ধার করে আনবে। অথবা তারা কুশীলবের ছদ্মবেশ ধারণ করে নাট্য, গীত, বাদ্য, শ্লোকপাঠ, ক্রীড়া প্ৰদৰ্শন, ইত্যাকার পরিবেশনার অবসরে রাজকুমারকে উদ্ধার করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবে, অথবা জিম্মাকৃত রাজকুমাররা বেশ্যার বেশে বা কুশীলবদের স্ত্রীর বেশে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে কৌশলে অবমুক্ত হয়ে স্বদেশের পথে প্রত্যাবর্তন করবেন।

০৭-১৭-০৮ অথবা উক্ত রাজকুমার কুশীলব বেশধারী গুপ্তচরদের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের বাক্স বা পোষাকের গাট্টির বাহক হিসেবে ভৃত্যবেশে অন্তরীণ অবস্থা থেকে পালিয়ে আসবেন। অথবা রাঁধুনি, বেয়ারা, স্নান সহায়ক, শরীরের অঙ্গ মর্দক, শয্যা বিন্যাসকারী, নরসুন্দর, সাধক বা জলবহনকারীর বেশে প্রাসাদ থেকে প্রস্থান করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। অথবা ভৃত্যের ছদ্মবেশে অসময়ে বা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে প্রাসাদ পরিত্যাগ করবেন, অথবা রাতে ভূতবলিদানের ছল করে সুড়ঙ্গ পথে বাহিরে বের হবেন, অথবা বৈদেশিক বণিকের বেশে গুপ্তচরদের সহায়তায় অবরুদ্ধ প্রাসাদ থেকে বের হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন।

০৭-১৭-০৯ অথবা উক্ত রাজকুমার দেবতার উপহার, খাদ্য বা পানীয়ের সাথে বিষ মিশিয়ে প্রহরীদের খাইয়ে তাদের চেতনানাশ করে এবং অন্য প্রহরীদের অর্থদানের মাধ্যমে বশীভূত করে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে পালিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। অথবা রাত্রিতে নগরীতে অবস্থানের অনুমতিপ্রাপ্ত নগররক্ষী, স্তোত্র পাঠক, চিকিৎসক বা পিঠা বিক্রেতার ছদ্মবেশ ধারণ করে গুপ্তচররা সম্পদশালী ব্যক্তি বা প্রহরীদের গৃহে আগুন লাগিয়ে দিবে, অথবা বণিকের বেশধারী গুপ্তচররা পণ্যাগার বা বিপণন কেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে দিবে, এভাবে অগ্নি প্রজ্বলিত হতে দেখে নগরবাসী ও প্রহরীরা যখন ব্যস্ত হয়ে আগুন নেভানোর কাজে মনোনিবেশ করবে, তখন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে গুপ্তচররা রাজকুমারকে উদ্ধারের কাজে লিপ্ত হবে। অথবা রাজকুমার কোনো একজনের মৃতদেহ নিজের গৃহে নিক্ষেপ করে আগুন লাগিয়ে সুকৌশলে সকলের অগোচরে পালিয়ে আসবে, এতে অন্যরা মনে করবে যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে রাজকুমারের মৃত্যু হয়েছে। এ কারণে কেউ আর তার অন্বেষণ করবে না।

০৭-১৭-১০ অথবা রাজকুমার কাচের দ্রব্য, ঘাস, কাঠ, কলস, অশ্বের উপকরণ বা অন্য কোনো দ্রব্য বহনকারীর ছদ্মবেশে রাত্রিকালে নগর থেকে প্রস্থান করবে অথবা জটাধারী সাধুর গৃহে প্রবেশ করে একইরকম বেশধারণ করে তার সঙ্গে নগর থেকে প্রস্থান করবে অথবা রোগাক্রান্ত বা অরণ্যচারীর বেশধারণ করে নগর থেকে প্রস্থান করবে অথবা মৃতের বেশে গুপ্তচরদের দ্বারা নগরের বাহিরে আনীত হবে। অথবা স্ত্রীর ছদ্মবেশে কোনো শবযাত্রায় শামিল হয়ে নগর থেকে প্রস্থান করে সন্তর্পণে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবে। রাজকুমারদের পলায়নের পর অন্বেষণকারীরা যখন তাদের সন্ধানে ব্যাপৃত হবে তখন বনচরবেশধারী গুপ্তচররা তাদের দিগ্‌ভ্রান্ত করার জন্য অন্যপথ দেখিয়ে কুমারদের পালাবার পথ শঙ্কামুক্ত করবে।

এক্ষেত্রে অন্বেষণকারীরা যদি কুমারদের পলায়ন পথের সন্নিকটে উপস্থিত হয়, তাহলে তারা নিরাপত্তার জন্য পথের গুপ্তস্থানে আশ্রয়গ্রহণ করবে, এ ধরনের গুপ্তস্থান পাওয়া না গেলে কুমাররা পথের দুপাশে অর্থ এবং বিষযুক্ত খাবার ছড়াতে ছড়াতে সম্মুখে অগ্রসর হবে, অতঃপর অন্বেষণকারীরা যখন অর্থ এবং খাদ্য সংগ্রহে ব্যাপৃত হবে, সে সুযোগে কুমাররা নিরাপদ পথ ধরে আড়ালে চলে যাবে। এরপরও যদি রাজকুমাররা অন্বেষণকারীদের দ্বারা ধৃত হয়, তাহলে মিঠা বচনে তুষ্ট করে আটককারীদের কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভে সচেষ্ট হবে অথবা বিষাক্ত খাবার খাইয়ে তাদের চেতনানাশ বা হত্যা করে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়ে গন্তব্যের পথে ধাবিত হবে।

০৭-১৭-১১ অথবা পূর্বোক্ত কায়দায় অন্যের শবদেহসহ গৃহে অগ্নিপ্রজ্বলনের পর নৃপতি কর্তৃক পুত্রের জামিনগ্রহীতা রাজার কাছে এই মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে যে তার কাছে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় তার পুত্র আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, এতে করে উক্ত রাজা পলায়িত কুমারের সন্ধান হতে বিরত হবে এবং কুমার নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হবে। এসমস্ত পদ্ধতির কোনোটিই যদি বাস্তবায়ন বা অনুসরণ করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে অবরুদ্ধ রাজকুমার রাতে প্রহরায় নিয়োজিত রক্ষীদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ করে গুপ্তচরদের মাধ্যমে পূর্বে আয়োজনকৃত দ্রুতগামী বাহনে করে পালিয়ে যাবে।

অষ্টাদশ অধ্যায় ॥ ১২৪-১২৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে মধ্য, উদাসীন ও রাজমণ্ডলের অন্যান্য রাজার প্রতি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার (বিজিগীষু) করণীয় ব্যবহার সম্পর্কে অলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে আক্রান্ত মিত্রকে সহায়তা, মধ্যম রাজাকে প্রতিরোধ, বিভিন্ন ধরনের মিত্রের প্রতি করণীয়, ইত্যাকার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৭-১৮-০১ রাজার মিত্র প্রকৃতি তিনজন, যারা প্রকৃত অর্থে রাজার সহায়ক। এ তিনজন হলেন—১. রাজা স্বয়ং ২. তার মিত্ররূপ তৃতীয় প্রকৃতি এবং ৩. মিত্রমিত্ররূপ পঞ্চম প্রকৃতি। রাজাসহ তার সম্মুখভাগে ছয়জন নৃপতি থাকে এবং পশ্চাদভাগে থাকেন চারজন নৃপতি। এই দশজন নৃপতি বা রাজার সমন্বয়ে গঠিত হয় দশরাজমণ্ডল। সম্মুখ ভাগের রাজারা হলেন—রাজা স্বয়ং, রাজার শত্রু, রাজার মিত্র, রাজার শত্রুর মিত্র, রাজার মিত্রের মিত্র এবং রাজার শত্রুর মিত্রের মিত্র।

অতএব এই রাজমণ্ডলের তৃতীয়স্থানে অবস্থানরত মিত্র এবং পঞ্চম অবস্থানে অবস্থানরত রাজার মিত্রের মিত্র হলেন রাজার মিত্রভুক্ত প্রকৃতি। এক্ষেত্রে রাজার সম্মুখে দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং ষষ্ঠস্থানে যে সব নৃপতির অবস্থান তারা রাজার বিকৃতি বা শত্রুভুক্ত প্রকৃতি। এরা রাজার বিরুদ্ধপক্ষ। এই বিরুদ্ধপক্ষ বা শত্রুরা হলেন—দ্বিতীয় প্রকৃতি তথা রাজার অরি বা প্রতিবেশী শত্রু, চতুর্থ প্রকৃতি বা অরির মিত্র এবং ষষ্ঠ প্রকৃতি তথা অরির মিত্রের মিত্র। মধ্যম নৃপতি যদি এই তিনমিত্র এবং তিনশত্রুর প্রতিই সমান আচরণ প্রদর্শন করেন, সেক্ষেত্রে রাজা তার সঙ্গে ইতিবাচক ব্যবহার করবেন। কিন্তু তিনি যদি এর অন্যথা করেন, তাহলে রাজা শুধু নিজ মিত্রভুক্তদের সঙ্গে ইতিবাচক ব্যবহার করবেন।

০৭-১৮-০২ মধ্যম নৃপতি যদি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার মিত্রদের উৎপীড়িত করতে বা তার প্রতি সমর্পিত করতে সচেষ্ট হন, তাহলে রাজা তার মিত্র এবং মিত্রদের মিত্রকে রক্ষার্থে কার্যকর সহায়তা প্রদান করবেন। অথবা রাজা উক্ত মধ্যম নৃপতির বিরুদ্ধে রাজমণ্ডলের অন্যান্য নৃপতিদের প্ররোচিত করে তাকে অবদমনের ব্যবস্থা করে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবেন। রাজমণ্ডলের নৃপতিরা যদি রাজার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাকে সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকেন, সেক্ষেত্রে রাজা নিজের সেনাবাহিনী এবং অর্থসম্পদ দিয়ে মিত্রদের সহায়তা প্রদান করবেন।

এক্ষেত্রে যে সব নৃপতি মধ্যম নৃপতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য পরস্পর মিলিত হবেন এবং তাদের কোনো একজন যদি রাজা কর্তৃক অনুগৃহীত হলে সকলেই উপকৃত হন, সেক্ষেত্রে রাজা উক্ত নৃপতিকে সহায়তা প্রদান করবেন কিংবা মধ্যম নৃপতি বিদ্বেষী যেসব নৃপতিরা সম্মিলিতভাবে অবস্থান করতে গিয়েও বিভাজনে নিপতিত হবেন, তাদের সাম ও দানের মাধ্যমে নিজের প্রতি অনুগত করাবেন। এভাবে রাজা যতবেশি মিত্র বলয় সৃষ্টিতে সক্ষম হবেন, ততবেশি তিনি বর্ধিত শক্তি নিয়ে মধ্যম নৃপতিকে নিগৃহীত করার সমর্থতা অর্জন করবেন।

০৭-১৮-০৩ অথবা রাজার কাছে যদি এ ধরনের আশঙ্কা অনুভূত হয় যে, সহায়তা প্রদানের পূর্বেই মধ্যম নৃপতি কর্তৃক তার মিত্র উচ্ছেদ হতে পারে, সেক্ষেত্রে রাজা স্বয়ং মধ্যম নৃপতির সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার মিত্রকে সৈন্য ও অর্থ দিয়ে সহায়তা প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে মধ্যম নৃপতি যদি সন্ধি করতে সম্মত না হন, তাহলে তিনি উক্ত নৃপতির দোষযুক্ত অমাত্যদের সহায়তায় সে দেশে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু করবেন এবং নিজেও তার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন।

মধ্যম নৃপতি যদি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার রাজমণ্ডলের তৃতীয় অবস্থানে অবস্থানরত মিত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণে উদ্যত হয়, তাহলে রাজা তাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে অভয়দান করবেন এবং মধ্যম নৃপতি কর্তৃক উক্ত মিত্র আক্রান্ত হয়ে হীনবল হয়ে পড়লে রাজা তাকে উদ্ধার করবেন। রাজার কোনো উচ্ছেদযোগ্য মিত্রকে যদি মধ্যম নৃপতি ক্ষয়িষ্ণু করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে রাজা তার ক্ষয়কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, অতঃপর মধ্যম নৃপতির উচ্ছেদের কোপানল থেকে তার মিত্রকে রক্ষা করবেন। তা না হলে উক্ত মিত্র নৃপতি অধিক শক্তি অর্জনের মাধ্যমে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার জন্যও ভীতিকর হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

০৭-১৮-০৪ রাজা তার উচ্ছেদযোগ্য মিত্রকে রক্ষার্থে সচেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও উক্ত মিত্র যদি বলবান মধ্যম নৃপতি কর্তৃক বিনাশপ্রপ্ত হন, সেক্ষেত্রে রাজা উক্ত মিত্রকে নিজের ভূমি প্রদান করে হলেও নিজের আয়ত্তে রাখবেন, অন্যথায় উক্ত মিত্র শত্রুপক্ষের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে পারে। বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার ক্ষয় ও উচ্ছেদযোগ্য মিত্রের মিত্ররা যদি মধ্যম নৃপতির সহায়তাকারী হয়ে থাকেন এবং তারা যদি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজাকে আক্রমণ করতে সমর্থ হন, সেক্ষেত্রে রাজা নিজের সেনাপ্রধান বা রাজকুমারকে বন্ধক রাখার মাধ্যমে মধ্যম নৃপতির সঙ্গে পুরুষান্তর সন্ধি বা আত্মরক্ষণসন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন অথবা মধ্যম নৃপতি যদি উক্ত রাজার শত্রুকে আক্রমণ করতে ইচ্ছুক হন, সেক্ষেত্রেও বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা নিজের স্বার্থে এবং মধ্যম নৃপতির প্রিয়কার্য সম্পাদনের সুযোগদানের সুবিধার্থে তার সঙ্গে উক্তরূপ সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন।

০৭-১৮-০৫ মধ্যম নৃপতি তার মিত্রভাবী মিত্র তথা বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার শত্রুকে আক্রমণ বা নিজের অধীনস্থ করতে ইচ্ছুক হলে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা উক্ত মধ্যম নৃপতির সঙ্গে পুরুষান্তরসন্ধিতে আবদ্ধ হবেন। এক্ষেত্রে উক্ত প্রকৃতির শত্রুর কাছ থেকে যদি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার কোনো স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে তিনি মধ্যম নৃপতিকে আক্রমণ থেকে বিরতকরণে সচেষ্ট হবেন। মধ্যম নৃপতি যদি নিজ শত্রুর প্রতি আক্রমণে উদ্যত হয়, সেক্ষেত্রে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা উক্ত শত্রুকে অত্যন্ত সন্তর্পণে সৈনাবাহিনী এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা প্রদান করবেন। মধ্যম নৃপতি যদি কোনো উদাসীন রাজাকে আক্রমণ করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকে, তাহলে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা উভয়ের মধ্যে বিদ্বেষ সংরক্ষণের নিমিত্ত তাদের অপেক্ষা অধিক বলবান রাজমণ্ডলের জনপ্রিয় কোনো রাজার কাছে আশ্রয়গ্রহণ করে তাকে সহায়তা প্রদান করবেন।

০৭-১৮-০৬ উপরোক্ত মধ্যম নৃপতির প্রতি বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার কৃত ব্যবহার উদাসীন রাজার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে। তদুপরি উদাসীন রাজা মধ্যম নৃপতিকে আক্রমণ করতে বা অধীনস্থ করতে উদ্যোগী হলে যে পক্ষালম্বনের মাধ্যমে বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা নিজ শত্রুর অপকার করতে সমর্থ হবেন বা নিজ মিত্রের উপকার সাধনে সমর্থ হবেন, সেই পক্ষাবলম্বন করবেন। অথবা যে পক্ষ থেকে সেনা সহায়তার মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, তিনি সে পক্ষে যোগ দিবেন।

০৭-১৮-০৭ উপরোক্ত তরিকায় বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজা মধ্যম ও উদাসীন নৃপতির সঙ্গে কৃত আচরণের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করে অরিপ্রকৃতি তথা শত্রুদের শক্তিনাশ করে তাদের হীনবল করবেন। একই সঙ্গে মিত্র প্রকৃতিকে সামদানের মাধ্যমে নিজের অধীনস্থ করবেন। অরি শব্দের মাধ্যমে যে তিন প্রকৃতির সামন্তকে বোঝানো হয়েছে, তা হলো—১. অরিভাবী সামন্ত ২. মিত্রভাবী সামন্ত এবং ৩. ভৃত্যভাবী সামন্ত বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার রাজ্য সংলগ্ন অরিভাবী সামন্তদের শত্রুতা সমপ্রকৃতির হলেও শত্রুভেদে তারা আট ধরনের—১. অনাত্মবান বা দুষ্টু প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ২. নিত্যাপকারী বা সর্বদা অপকার সাধনকারী ৩. শত্রু বা রাজার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ৪. শত্রুসংহতি বা রাজার অন্য শত্রুর সহায়তাকারী ৫. পগ্ৰিাহ বা পশ্চাদদিক দিয়ে রাজাকে উৎপীড়নকারী ৬. ব্যসনী বা রাজা কর্তৃক কোষাহত ৭. যাতব্য বা আক্রমণযোগ্য এবং ৮. বিপর্যয়কালে রাজাকে আক্রমণকারী।

০৭-১৮-০৮ মিত্রভাবী সামন্তও প্রকৃতি ভেদে যে আট প্রকৃতির, তা হলো— ১. একার্থপ্রয়াস বা রাজার সঙ্গে একই অভীষ্ট অর্জনে নিবিষ্ট ২. পৃথগর্থাভিপ্রয়াস বা পৃথক অভীষ্ট অর্জনের নিমিত্ত রাজার সঙ্গে অভিযানকারী ৩. সম্ভূয়যাত্রিক বা রাজার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধে যাত্রাকারী ৪. সংহতিপ্রয়াণিক বা রাজার সঙ্গে সমঝোতা করে অন্যদিকে যুদ্ধে যাত্রাকারী ৫. স্বার্থাভিপ্রয়াত বা রাজার নিজস্ব স্বার্থে সহায়তাকারী ৬. সামুখায়িক বা রাজার সঙ্গে যৌথভাবে শূন্যস্থানে জনপদ নিবাসকারী ৭. রাজার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে সৈন্য বা সৈন্যের বিনিময়ে অর্থ ক্রয়-বিক্রয়কারী এবং ৮. দ্বৈতনীতি অবলম্বনকারী তথা রাজার সঙ্গে সন্ধি ও অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানকারী।

০৭-১৮-০৯ ভৃত্যভাবী সামন্ত যে ছয় প্রকৃতির, তা হলো—১. বলশালী রাজার প্রতিঘাতকারী ২. অন্তর্ধি বা রাজা ও অরির মধ্যস্থিত দুর্বল সামন্ত ৩. বলশালী নৃপতির প্রতিবেশী সামন্ত ৪. বলশালী নৃপতির পশ্চাদে অবস্থানকারী সামন্ত ৫. বলশালী নৃপতির কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পিত সামন্ত ৬. বলশালী নৃপতি প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আশ্রয়গ্রহণকারী সামন্ত।

০৭-১৮-১০ বিজয়াকাঙ্ক্ষী রাজার রাজ্য সংলগ্ন মিত্রদের মধ্যে যে মিত্র শত্রুর সঙ্গে বিরোধকালে রাজার সঙ্গে একাত্ম হবেন, শত্রু মোকাবেলায় সক্ষম করে গড়ে তোলার জন্য রাজা তাকে অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন। রাজার কোনো মিত্র যদি অন্য মিত্রকে পরাভূত করে বলীয়ান হয়ে ওঠে এবং রাজার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তাহলে রাজা তার সঙ্গে মিত্র বা শত্রুর বিরোধ বাধিয়ে দিবেন অথবা উক্ত সামন্তের কোনো জ্ঞাতি বা অসন্তুষ্ট পুত্রকে দিয়ে তার ভূমি দখল করাবেন অথবা যেভাবে তাকে বশীভূত করা যাবে বলে প্রতীয়মান হবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

০৭-১৮-১১ যে মিত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে রাজার কোনো উপকার করেন না এবং রাজার শত্রুর সঙ্গে সম্পর্কিত হন, রাজা সে মিত্রকে দুর্বল করে রাখবেন, কখনো সমৃদ্ধ হতে সহায়তা করবেন না। অস্থিরচিত্তের কোনো মিত্র নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজার সঙ্গে সন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে সন্ধি ভঙ্গ করে অন্যত্র গমন করলে, রাজা তাকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দিয়ে সন্ধিতে আবদ্ধ করাবেন, যাতে করে পুনর্বার সন্ধিচ্ছেদ করে তিনি কোথাও চলে না যান। কোনো অসৎ মিত্র যদি রাজা এবং রাজার শত্রুর সঙ্গে সমান্তরালভাবে মিত্রতা বজায় রাখে, তাহলে রাজা উক্ত মিত্রের সঙ্গে শত্রুর শত্রুতা সৃষ্টি করিয়ে উভয়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করাবেন, অতঃপর সুযোগ বুঝে তাকে উচ্ছেদ করবেন।

০৭-১৮-১২ রাজা এবং তার শত্রুর ব্যাপারে যে মিত্র উদাসীন থাকবেন, রাজা সে মিত্রকে অন্য সামন্তদের সঙ্গে বিরোধযুক্ত করাবেন এবং উক্ত মিত্রকে এমনভাবে অন্যদের দ্বারা নিগৃহীত করাবেন যাতে করে তিনি বাধ্য হয়ে রাজার অনুগ্রহ লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। কোনো দুর্বল মিত্র যদি একইভাবে রাজা এবং তার শত্রুর পক্ষাবলম্বন করেন, সেক্ষেত্রে রাজা উক্ত মিত্রকে সৈন্যসহায়তাসহ এমনভাবে অন্যান্য সহায়তা প্রদান করবেন, যাতে করে তিনি শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে রাজার পক্ষাবলম্বনকারীতে পরিণত হন।

০৭-১৮-১৩ যে মিত্র রাজার অপকারক এবং সামর্থ সত্ত্বেও আপতকালে উপকার করেন না, সেই মিত্রকে রাজা বিবিধ উপায়ে নিজের প্রতি আস্থাশীল করে করায়ত্ত করবেন, অতঃপর সময়মতো তাকে উচ্ছেদ করবেন। রাজার যে শত্রু তার মিত্রের বিপর্যয়কালের সুযোগ গ্রহণ করে সমৃদ্ধি অর্জন করবেন, সে মিত্রের বিপর্যয় প্রশমিত হবার পর রাজা তার মাধ্যমেই উক্ত শত্রুকে স্বীয় অধীনস্থ করবেন। রাজার যে মিত্র অমিত্রের সৈন্যসম্পদ ক্ষয়জনিত কারণে সমৃদ্ধতর হয়ে তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হবেন, রাজা তাকে উক্ত অমিত্রদের মাধ্যমেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তার প্রতি অনুগত করাবেন। যে রাজা অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকবেন, তিনি সমৃদ্ধি, অবক্ষয়, স্থিরতা, কর্শন (ক্ষয়), উচ্ছেদন এবং সামদানাদির পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে তা যথার্থভাবে প্রয়োগ করবেন। এভাবে যে রাজা ছয়গুণের আলোকে কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ করতে সক্ষম হবেন তিনি অন্যান্য রাজার সঙ্গে রাজমণ্ডলে প্রশান্তিতে বসবাস করতে সমর্থ হবেন।

অষ্টম অধিকরণ ॥ প্রকরণ ১২৭–১৩৪

ব্যসনাধিকারিক (ব্যসন—কু-অভ্যাস, অনৈতিকতা, দুর্দশাগ্রস্ততা) নামক অষ্টম অধিকরণের আটটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—

১. রাজা ও অমাত্যদের ব্যসনসমূহ ২. রাজা এবং রাজ্যের ব্যসন বিষয়ক চিন্তন ৩. পুরুষের ব্যসনজাত দোষসমূহ ৪. উৎপীড়নসমূহ ৫. স্তম্ভনবর্গ তথা বিঘ্নসূচক উক্তির মাধ্যমে রাজকার্যের উপরোধের কারণ নির্ণয় ৬. কোষসঙ্গবর্গ তথা রাজকোষের প্রাপ্য অর্থের অপ্রাপ্যতা ৭. সৈন্যদের ব্যসন নির্ণয় ৮. মিত্রবর্গের ব্যসনসমূহ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন