সারাজীবন দাপটের সাথে সাম্রাজ্য পরিচালনা করে মৌর্যদের একটি স্থিতিশীল রাজতন্ত্র উপহার দিয়েও শেষ বয়সে এসে তাঁকে বিব্রতকর, অপমানজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সারাজীবন যিনি নানাবিধ কূটকৌশলে, প্রজ্ঞায়, দুঃসাহসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা, ষড়যন্ত্র, বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সাফল্যের শিখরে উপনীত হয়েছিলেন—জীবন সায়াহ্নে এসে সেই তাঁকেই ষড়যন্ত্রের অক্টোপাশে অবরুদ্ধ হয়ে কোনোপ্রকার প্রতিরোধ কিংবা কৌশল অবলম্বন না করে নিয়তির নির্মম পরিহাসকে বরণ করে অনেকটা অভিমানবশত রাজকার্য পরিত্যাগ করে অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়।
চাণক্যের মৃত্যু সম্পর্কিত সঠিক ইতিহাস আজও অনুদ্ঘাটিতই রয়ে গেছে। বস্তুত কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, সে সম্পর্কিত কোনো স্বতঃসিদ্ধ তথ্যপ্রমাণ নেই। বিদ্যমান তথ্য-উপাত্তের আলোকে বলা হয়ে থাকে, তিনি ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাজকুমার বিন্দুসরা যৌবনে পদার্পণের পর সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত পুত্রের অনুকূলে সিংহাসন পরিত্যাগ করেন এবং জৈন সাধু ভদ্রবাহুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে জৈন মতাবলম্বীদের ঐতিহ্যিক পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিরতিহীন উপবাসের মাধ্যমে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের নিমিত্ত কর্ণাটকের সন্নিকটে সন্ন্যাসব্রতে নিমগ্ন হয়েছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন পরিত্যাগের পরেও কৌটিল্য বিন্দুসরার সাম্রাজ্যে প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্বে বহাল ছিলেন। দীর্ঘসময় ধরে রাজদরবারে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ইতিমধ্যে কিছু ঈর্ষাকাতর শত্রুর উন্মেষ ঘটেছিল। এদেরই একজন ছিলেন সুবান্ধু নামক এক অমাত্য। কোনো প্রণিধানযোগ্য কারণ ছাড়াই এই অমাত্য কৌটিল্যের বিরোধিতায় তৎপর হয়ে ওঠেন এবং বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে সম্রাটের মাতাকে হত্যা করার অভিযোগে কৌটিল্যকে অভিযুক্ত করে সম্রাট বিন্দুসরার মন বিষিয়ে তোলেন। আনীত অভিযোগটি একজন পরিচারিকার দ্বারা সমর্থিত হলে, সম্রাট বিন্দুসরা মাতৃহত্যার কারণে প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে প্রধান অমাত্যের পদ থেকে অপসারণ করেন। কৌটিল্যের তখন হারাবার মতো কিছুই ছিল না। অধিকন্তু তিনি তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ গরিব, অনাথ, বিধবা এবং অসহায়দের মাঝে বিতরণ করে, প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে সসম্মানে সরে দাঁড়ান। অতঃপর শুকনো গোবরের ঢিবিতে স্থিত হয়ে পানাহার পরিত্যাগ করে, নিরবচ্ছিন্ন উপবাসের মাধ্যমে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পথ বেছে নেন।
দায়িত্ব পরিত্যাগের অনতিকাল পরেই বিন্দুসরা মাতৃমৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অবহিত হন এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কৌটিল্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁকে পূর্বপদে ফিরে আসবার জন্য সবিনয় অনুরোধজ্ঞাপন করেন কিন্তু মহাকালদ্ৰষ্টা কৌটিল্য পরিত্যাগকৃত পূর্বপদে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে আর কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে মৃত্যুধ্যানে নিমগ্ন হয়ে গোবরের ঢিবিতে অবস্থান করতে থাকেন। সম্রাট বিন্দুসরা অতঃপর অমাত্য সুবান্ধুর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে কোনো পন্থায় কৌটিল্যকে রাজদরবারে ফিরিয়ে আনবার জন্য কঠোর নির্দেশ প্রদান করেন। সম্রাটের নির্দেশনা প্রাপ্তির পর সুবান্ধু ভেতরে ভেতরে কৌটিল্যর প্রতি বিদ্বেষপোষণ সত্ত্বেও তাঁকে সাড়ম্বরে বরণ করে নেওয়ার জন্য সারা শহর নানা আঙ্গিকে সজ্জিত করেন।
বস্তুত সুবান্ধু জানত যে এই আত্মসম্মানী অভিমানী প্রধানমন্ত্রী কখনোই আর রাজদরবারে প্রত্যাবর্তন করবেন না। তার পরেও তিনি রাজাজ্ঞা প্রতিপালনের জন্য কৌটিল্যকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য নানাধরনের লোক দেখানো আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। এই বরণ প্রস্তুতির এক পর্যায়ে রহস্যজনকভাবে কৌটিল্যের অবস্থানস্থল তথা শুকনো গোবরের ঢিবির চতুর্দিকে কাঠ কয়লার সুপ্ত আগুন ছড়িয়ে দেওয়া হয়, বাতাসের পরশে সেই আগুন চতুর্দিকের শুকনো গোবর প্রজ্বলিত করে ক্রমান্বয়ে পুরো ঢিবিকে ভস্ম করে দেয়—এভাবেই এই নির্মম প্রক্রিয়ায় পুড়ে ছাই হয়ে যান মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধানস্থপতি চাণক্য পণ্ডিত বা ইতিহাসখ্যাত কৌটিল্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন