দ্বিতীয় অধিকরণ (রাজ্য শাসন)

দ্বিতীয় অধিকরণ ॥ প্রকরণ ১৯-৫৬

অধ্যক্ষ প্রচার (রাজ্যের শাসনকার্যের নিমিত্ত প্রশাসক নিয়োগ) নামক দ্বিতীয় অধিকরণের আটত্রিশটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—

১. জনপদ নিবেশ বা সৃজন ২. ভূমি সম্পর্কীত বিধান ৩. দুর্গ তথা নগর বা রাজধানী বিনির্মাণ ৪. দুর্গের বা নগরের বিন্যাস ৫. সঞ্চিত ধন সম্পদের মজুদকরণ ৬. কর সংগ্রহ ব্যবস্থা ৭. অক্ষপটল বা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় ৮. রাজকর্মচারীদের আত্মাসাৎকৃত অর্থের পুনঃযোজন ৯. পরিদর্শকদের দায়িত্বের তত্ত্বাবধান ১০. শাসনাধিকার বা রাজাদেশের লিখনির বিধি বিধান ১১. রাজকোষে রক্ষণযোগ্য মণি মুক্তাদির পরীক্ষণ ১২. খনি ও কারখানার তত্ত্বাবধান ১৩. অক্ষশালাস্থ সুবর্ণাধ্যক্ষের কর্ম ১৪. সৌবর্ণিকের কর্ম পরিধি ১৫. খাদ্য-শস্যের ভাণ্ডার তথা কোষ্ঠাগারের অধ্যক্ষের দায়িত্ব ১৬. বিক্রেয় পণ্যদ্রব্যের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের দায়িত্ব ১৭. বৃক্ষজাত পণ্যদ্রব্যের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কার্যাবলি ১৮. অস্ত্রাগারের অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের দায়িত্বাবলি ১৯. তুলামানপৌতব তথা ওজন ও পরিমাপক বিষয়ক প্রশাসকের দায়িত্ব ২০. দেশ-কাল-মান তথা সময় ও কাল পরিমাপকের দায়িত্ব ২১. শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কর্ম পরিধি ২২. সূত্রাধ্যক্ষ তথা কার্পাস-তন্ত্র বয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষের কার্যপরিধি ২৩. কৃষিভূমির দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষ তথা প্রশাসকের কার্যাবলি ২৪. সুরাধ্যক্ষ তথা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসকের দায়িত্বাবলি ২৫. সূনাধ্যক্ষ তথা কসাইখানার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ২৬. গণিকাধ্যক্ষ তথা পতিতালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ২৭. নাবধ্যক্ষ তথা জলযানের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি ২৮. গোহধ্যক্ষ তথা গবাদি পশুর দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি ২৯. অশ্বাধ্যক্ষ তথা অশ্ব প্রতিপালনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ৩০. হস্ত্যাধ্যক্ষ তথা হাতি সংগ্রহ, প্রতিপালন ও সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যপরিধি ৩১. রথাধ্যক্ষ তথা রথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকের কার্যাবলি ৩২. পত্ত্যধ্যক্ষ তথা পদাতিক বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত সেনা অধিনায়কের দায়িত্বাবলি ৩৩. সেনাপতি প্রচার তথা চতুরঙ্গবাহিনী বা হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিকবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বাবলি ৩৪. মুদ্রাধ্যক্ষ তথা রাজার অনুমতিপত্র প্রদানকারী প্রশাসকের দায়িত্বাবলি ৩৫. বিবীতাধ্যক্ষ তথা গোচারণ ভূমির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকের কার্যাবলি ৩৬. সমাহর্তপ্রচার তথা রাজার অর্থ সংগ্রহকারী প্রশাসকের কার্যপরিধি ৩৭. গূঢ়পুরুষ তথা বণিক, সন্ন্যাসীর বেশধারী গুপ্তচরদের কার্যপরিধি ৩৮. নাগরিক প্রণিধি তথা নগরের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিতদের কার্যপরিধি।

প্রথম অধ্যায় ॥ ১৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে জনপদ সৃজনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে জনপদের প্রকৃতি, অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা, হাট বাজার, কৃষি ভূমির প্রকৃতি ইত্যাকার বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০২-০১-০১ একটি রাজ্যে পূর্ব থেকেই যেমন জনপদ থাকতে পারে তেমনি আবার রাজা কর্তৃক নতুন জনপদও সৃজিত হতে পারে। অন্য রাজ্যের লোকদের নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজা তার নব সৃষ্ট লোকালয়ে জনবসতি গড়ে তুলতে পারেন। নিজ রাজ্যের কোথাও জনগণের আধিক্য পরিদৃষ্ট হলেও রাজা তথাকার লোকদের অন্যত্র স্থানান্তরের মাধ্যমে নতুন জনবসতির গোড়াপত্তন করতে পারেন। এক্ষেত্রে নতুন গ্রাম গোড়াপত্তনের জন্য রাজা শূদ্র জাতীয় কৃষিজীবীদের আগ্রাধিকার প্রদান করবেন। একটি গ্রামে ন্যূনতম একশটি পরিবার এবং সর্বোচ্চ পাঁচশ পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে। এক গ্রাম থেকে অপর গ্রামের ব্যবধান থাকতে হবে এক ক্রোশ বা দুক্রোশ। এক গ্রাম যেন প্রয়োজনের সময় অপর গ্রামকে সুরক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে পারে, সে ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকতে হবে। নব সৃজিত গ্রামের প্রান্তদেশে যেমন নদী, পাহাড়, বনাঞ্চল, জলাশয় থাকতে হবে, তেমনি সেখানে ঔষধি বৃক্ষ, শালবৃক্ষ এবং বটজাতীয় ক্ষীরবৃক্ষেরও সংস্থান করতে হবে।

আটশ গ্রামের কেন্দ্রভূমিতে জনসাধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের সুবিধার্থে ‘স্থানীয়’ (পরবর্তী সময়ে ‘নিগম’ নামে পরিচিত) নামের মহাগ্রাম বা দুর্গ স্থাপন করতে হবে। এই দুর্গ তথা স্থানীয়-এর চার পাশে দুশ করে আটশ গ্রামের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। পরবর্তী চারশ গ্রামের মধ্যস্থলে ‘দ্রোণমুখ’ নামে ছোট দুর্গ স্থাপন করতে হবে। এর চারপাশে হবে একশটি করে গ্রামের অবস্থান। পরবর্তী দুশ গ্রামের মধ্যস্থলে ‘কর্বট’ নামে যে দুর্গটি হবে, তা হবে দ্রোণমুখ অপেক্ষা ক্ষুদ্র। এর চারপাশে পঞ্চাশটি করে গ্রামের অবস্থান হবে। অতঃপর দশটি গ্রামের সমন্বয়ে ‘সংগ্রহণ’ নামে একটি বড় গ্রাম স্থাপন করতে হবে, এটি হবে কর্বট অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর। এভাবে ‘গ্রাম’কে জনবসতির প্রান্তিক ভিত্তি ধরে সংগ্রহণ, কর্বট, দ্রোণমুখ ও স্থানীয়ের বিকাশের মাধ্যমে জনবসতি স্থাপন করতে হবে। এ সমস্ত গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান তথা প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমেই রাজা কর্তৃক নিয়োজিত প্রশাসকেরা প্রয়োজনীয় শুল্ক আদায় করবেন। (দুর্গ বলতে এখানে শহরেকে বোঝানো হয়েছে— লেখক)

০২-০১-০২ রাজা জনপদের প্রান্ত দেশের চতুর্দিকে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করাবেন, এসব দুর্গে আন্তপাল পদবিধারী প্রশাসকরা অবস্থান করবে। জনপদে বসবাসকারীদের প্রবেশ এবং নির্গমনের জন্য এসব দুর্গে স্বতন্ত্র দ্বার থাকবে। দুর্গগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে ফাঁদ পেতে মৃগ শিকারি বাগুরিক, শূদ্র পুরুষের ঔরসজাত শবর, চণ্ডালের ঔরসে কিরাত রমণীর গর্ভজাত পুলিন্দ, চণ্ডাল এবং বনচারী জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করত জনপদকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। এসব জনপদে রাজা কর্তৃক যাজক, আচার্য, পুরোহিত ও বেদাজ্ঞ ব্রাহ্মণদের অনুকূলে ভূমি বরাদ্দ করতে হবে। বরাদ্দকৃত এ জাতীয় ভূমির জন্য তাদের কোনোপ্রকার জরিমানা বা কর প্রদান করতে হবে না। বরাদ্দপ্রাপ্তরা বংশ পরম্পরায় এসব ভূমি ভোগের অধিকারী হবে। এছাড়াও প্ৰশাসক, সংখ্যায়ক, গোপ তথা গ্রাম তত্ত্বাবধায়ক, স্থানিক তথা নগরকর্তা, অনীকস্থ তথা হস্তি প্রশিক্ষক, চিকিৎসক, অশ্ব প্রশিক্ষক এবং দূতগণকে রাজা দানপূর্বক ভূমি বরাদ্দ করবেন। বরাদ্দপ্রাপ্তরা এসমস্ত ভূমি বংশ পরম্পরায় ভোগ করার অধিকারী হলেও কখনো বিক্রয় বা বন্ধক রাখতে পারবে না।

যে সব কৃষক কর্তৃক রাজাকে নিয়মিত কর প্রদান করা হবে, তাদের মাধ্যমে যদি কোনো পতিত জমি ফসল উৎপাদনের উপযোগী করা হয়, সেক্ষেত্রে রাজা সেসমস্ত ভূমি সংশ্লিষ্ট কৃষকের অনুকুলে এক পুরুষ ভোগের শর্তে বরাদ্দ প্রদান করবেন। কোনো কৃষক যদি ফসল উৎপাদনে অনুপযোগী জমি নিজ চেষ্টায় উৎপাদনযোগ্য করে তোলেন, সেক্ষেত্রে রাজা ওই সমস্ত জমির স্বত্ব কখনো ফিরিয়ে নিবেন না। স্থায়ীভাবে ওই কৃষকদের তিনি তা দান করে দিবেন।

০২-০১-০৩ সম্মত হয়েও যদি কোনো কৃষক জমিতে ফসল উৎপাদন না করে, তাহলে রাজা ওই কৃষকের জমি বাজেয়াপ্ত করে অন্য কৃষককে তা প্রদান করবেন। যদি উপযুক্ত কৃষক না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে রাজা এসমস্ত জমি গ্রামের নাপিত, কামার, কুমার বা বণিকদের দান করে চাষের ব্যবস্থা করাবেন। সম্মতি জ্ঞাপন করেও কেউ যদি কোনো জমিতে ফসল উৎপাদন না করে, সেজন্য যে আর্থিক ক্ষতি সাধিত হবে তা ওই দায়ী ব্যক্তিকেই পূরণ করতে হবে। উপকরণের অভাবে যারা চাষাবাদে অসমর্থ হবে, রাজা তাদের বীজ, গবাদিপশু ও অর্থ ঋণ দিয়ে চাষাবাদের জন্য সহায়তা প্রদান করবেন। ফসল তোলার পর কৃষকেরা সুবিধামতো সময়ে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করবে। প্রয়োজন হলে রাজা অসহায় লোকদের কর রেয়াতি দিবেন, স্বাবলম্বীতার জন্য সহায়তা প্রদান করবেন। এই সহায়তা রাজা কর্তৃক এমনভাবে প্রদান করতে হবে যাতে করে রাজকোষের ক্ষয় না হয়ে পরবর্তীকালে তা বৃদ্ধির সহায়ক হয়। যেসব সহায়তার কারণে রাজকোষের ক্ষয়ের সম্ভাবনা দেখা দিবে রাজা সেসব পরিহার করবেন। কারণ, রাজকোষের ক্ষয় হলে তা পূরণের জন্য করের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং এতে করে প্রজা সাধারণ উৎপীড়িত হতে পারে। নবসৃষ্ট জনপদের লোকদের জন্য রাজা কর ছাড় দিতে পারেন। ছাড়ের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর তা যদি যথার্থভাবে প্রত্যার্পিত হয় তাহলে রাজা প্রত্যর্পণকারীকে পিতার মতো অনুগ্রহ করে উপকার করবেন।

০২-০১-০৪ রাজাকে তার জনপদে খনি, কারখানা, কাঠ সংগ্রহের বন, হস্তি চারণ ক্ষেত্র, পশুচারণ ক্ষেত্র, বণিকের যাতায়াত পথ, নৌ চলাচল পথ এবং পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের হাট বাজারের সুবিধা প্রবর্তন করতে হবে। জনপদে প্রবহমান নদীর উপর সেতু এবং বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। কৃষি কাজের জন্য জল সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব স্থানে জল সরবরাহ নেই সেসব স্থানে বর্ষাকালের বৃষ্টির জল সংরক্ষণার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেচের সুবিধার্থে খাল কেটে জল সংরক্ষণ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজা প্রয়োজন মাফিক ভূমিবরাদ্দ দিবেন এবং জলাশয় বা খাল খননের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা প্রদান করবেন। এছাড়াও দেবালয়, পুণ্যস্থান এবং উদ্যানের জন্য রাজা ভূমি বরাদ্দ করবেন। জলাশয় বা খাল খননের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েও যারা সহায়তা প্রদান করবে না, তাদেরকে একাজের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। অধিকন্তু সেচ সুবিধার মাধ্যমে যে ফসল উৎপন্ন হবে তারা সে ফসলের অংশ থেকে বঞ্চিত হবে। সেচ সুবিধার বদৌলতে জলাশয়ে যেসব মাছ, পাখি ও শাকসব্জি উৎপন্ন হবে তার উপর রাজা ব্যতিরেকে অন্য কারো অধিকার স্বীকৃত হবে না।

০২-০১-০৫ কোনো ভূস্বামীর ভৃত্য, বন্ধকীভূত শ্রমিক, ভ্রাতা বা পুত্র যদি প্রভুর আদেশ অমান্য করে, তাহলে রাজা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন অথবা আদেশ মান্য করতে সম্মত করাবেন। কোনো বালক, বৃদ্ধ, পীড়িত বা বিপদাপন্ন লোক যদি রক্ষকশূন্য হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে রাজা তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। বন্ধ্যা স্ত্রী বা কোনো অপত্যবতীর সন্তানেরা যদি রক্ষকহীন হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে রাজা ওই সমস্ত অসহায় সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কোনো এতিম বালকের সহায় সম্পত্তি কেউ আত্মসাৎ বা গ্রহণ করবে না। বয়োজ্যেষ্ঠরা এতিমের সম্পত্তির দেখভাল করবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে যার সম্পত্তি তার কাছে তা প্রত্যর্পন করবে। দেবালয়ের সম্পত্তি গ্রামের লোকেরা সব সময় বর্জন করবে, কখনোই ভোগ করবে না।

সমর্থ থাকার পরও কেউ যদি পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ভ্রাতা এবং বিধবা বোনের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মত হয়, তাহলে রাজা তাকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে দ্বাদশপণ জরিমানা প্রদানে বাধ্য করবেন। তবে, এক্ষেত্রে যদি উপরি-উক্ত ব্যক্তিরা পাপাচারে লিপ্ত থাকে, চারিত্রিকভাবে ভ্রষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ভরণপোষণ না করলেও কারো উপর কোনো দণ্ড প্রযোজ্য হবে না। তবে, মাতা যদি পতিতাও হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও পুত্রকে তার ভরণপোষণের দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। অন্যথা তার উপর দণ্ড প্রযুক্ত হবে। সন্তান এবং স্ত্রীর ভরণপোষণের বন্দোবস্ত না করে কেউ যদি সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করে এবং স্ত্রীকেও তা করতে বাধ্য করে সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির উপর প্রথম সাহস দণ্ড (২৫০ পণ) প্রযুক্ত হবে। যদি কোনো ব্যক্তির সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা লোপ পায় তাহলে বিচারিক দায়িত্বে নিয়োজিত ধর্মস্থদের অনুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে তিনি প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করতে পারবে, এর অন্যথা হলে তাকে কারারুদ্ধ হতে হবে।

০২-০১-০৬ যারা জনপদে বসবাসের জন্য যোগ্য নয় বলে স্বীকৃত এখানে তাদের প্রসঙ্গে আলোকপাত করে বলা হয়েছে—বানপ্রস্থের উপযুক্ততা ভিন্ন অন্য কোনো সন্ন্যাস গ্রহণকারী, রাজার জন্য কল্যাণকর নয় এমনতর সঙ্ঘের সদস্য, (যেমন, চোর-দস্যুদের সঙ্ঘ) এবং রাজার অনিষ্ট প্রত্যাশী দ্রোহী প্রজা সঙ্ঘের সদস্যরা জনপদে বসবাসের অনুমতি পাবে না। এছাড়াও জনপদে চিত্তবিনোদনের জন্য কোনো উপবন ও নাট্যশালা নির্মাণের অনুমদি দেওয়া হবে না। কারণ, জনপদে এ ধরনের চিত্তবিনোদনের সুবিধা প্রবর্তন করা হলে অভিনেতা, অভিনেত্রী, নর্তকী, গায়ক, বাদক, কথক এবং কুশীলবদের পরিবেশিত নানাবিধ উপাদানের প্রতি সাধারণ লোকেরা মোহাবিষ্ট হয়ে আসক্ত হতে পারে এবং এর প্রভাবে কৃষিকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে, প্রকারান্তরে যা রাজকোষের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। কোনো জনপদে চিত্তবিনোদনের স্থাপনা না থাকলে সেখানকার লোকেরা উৎপাদনের দিকে অধিক মনোযোগী হয়ে রাজকোষের সমৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

০২-০১-০৭ রাজার কোনো জনপদ যদি শত্রুর যড়যন্ত্রে পড়ে বিপর্যস্ত হয়, অরণ্য প্রশাসকের দ্বারা উৎপীড়িত হয় বা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে রাজা প্রজার কল্যাণার্থে ওইসব বিঘ্ন বা অনাচার দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি তার রাজ্যে অনুষ্ঠিত ব্যয়বহুল ক্রীড়া ও প্রমোদানুষ্ঠান বর্জন করবেন। বলপূর্বক শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার ফলে এবং অন্যায়ভাবে কর আদায়ের ফলে যদি কৃষকের উৎপাদন ব্যাহত হয় সেক্ষেত্রে রাজা বিদ্যমান বাধা দূর করে কৃষকদের প্রতি সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করবেন। তিনি চোর, হিংস্ৰজন্তু, বিষ প্রয়োগকারী এবং শিকারিদের কবল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পশুচারণ ক্ষেত্র ও পশুদের আবাসস্থল রক্ষা করবেন। রাজা রাজবল্লভ তথা তার প্রিয় ব্যক্তি, শুল্ক সংগ্রাহক, চোর, সীমান্ত রক্ষাকারী রাজ কর্মচারী এবং ব্র্যাঘ্ৰ জাতীয় হিংস প্রাণীদের অত্যাচার থেকে বণিকদের গমনাগমনের পথ সুরক্ষিত করবেন। এছাড়াও রাজা তার প্রবর্তিত দ্রব্যবন, হস্তিবন, সেতুবন্ধ ও খনিসমূহ রক্ষা করবেন এবং প্রয়োজনের নিরিখে নতুন নতুন দ্রব্যবন সৃজন করাবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ২০ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ের শিরোনাম ভূমিচ্ছিদ্রবিধানম্। এখানে কৃষির অযোগ্য ভূমিকে অন্য কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে বনাঞ্চল সৃষ্টিসহ হাতির সংরক্ষণ সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে।

০২-০২-০১ যে সমস্ত ভূমি বন্ধুর, নুড়ি পাথর, প্রস্তর, বালু বা অন্যান্য উপাদানের আধিক্য হেতু কৃষি কাজের অনুপযুক্ত, রাজা সে-সমস্ত ভূমিতে জল সঞ্চালনের ব্যবস্থা করে তৃণভূমিতে রূপান্তর করাবেন এবং গো-মহিষাদি বিচরণের জন্য উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলবেন। উক্ত প্রকার ভূমির এক বা দুই ক্রোশব্যাপী অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের জন্য অরণ্য সৃজন করাবেন। একই ধরনের ভূমি তপস্বীদের বসবাসের জন্যও উন্নত করে দিবেন। রাজা এ ধরনের ভূমিতে মৃগবনও সৃষ্টি করতে পারেন। এ ধরনের মৃগবনে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য একটি মাত্র দ্বারের সংস্থান রাখতে হবে। বনটিকে হতে হবে পরিখা বেষ্টিত, সেখানে সুস্বাদু ফল বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ফুল বাগিচার প্রাচুর্য থাকবে। মৃগবনটি হবে কণ্টকশূন্য, সেখানকার জলাশয় হবে অগভীর, সেখানে হরিণ ও মহিষ জাতীয় নিরীহ প্রাণীর সাথে দাঁত ও ধারালো নখরহীন, স্বভাবে অক্ষতিকর হিংস্র প্রাণীর উপস্থিতি থাকবে। এই মৃগবনে রাজার মৃগয়ায় সহায়তার জন্য হস্তি, হস্তিনী, ও হস্তি শাবকদের বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। যোগ্য ভূমিপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সীমান্ত অঞ্চলে মৃগবন সৃষ্টি করা যেতে পারে, এতে করে পাশের রাজ্যের চতুষ্পদি প্রাণীরা উপদ্রুত হয়ে ওই বনে এসে বসবাস করতে পারবে।

০২-০২-০২ রাজা পৃথক পৃথক বনাঞ্চল সৃজন করবেন। ওইসব বনে কাষ্ঠভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থান ও বসবাসের ব্যবস্থা করাবেন। জনপদের সীমান্তের ওপারে হাতিদের বসবাসের জন্য নাগবন বা হস্তিবন সৃষ্টি করাবেন। এই বন সুরক্ষার জন্য তিনি অরণ্য প্রশাসক তথা অটবিকদের পদায়ন করবেন। এ ধরনের নাগবনের অবস্থান হবে পর্বতযুক্ত নদীবেষ্টিত স্থানে। সেখানে পর্যাপ্ত সরোবর ও জলাশয় থাকবে। নাগবনের প্রশাসককে বনের পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে হবে এবং তিনি নাগবনের সার্বিক সুরক্ষা প্রদানে সচেষ্ট থাকবেন। কোনো শবর-পুলিন্দ বা শিকারি যদি কোনো হাতিকে হত্যা করে তবে রাজাদেশে নাগবন প্রশাসকেরা সেই শিকারিকে হত্যা করবেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিহত কোনো হাতির আহরিত দাঁত যদি কোনো বনচোর স্বেচ্ছায় রাজভাণ্ডারে জমা প্রদান করে তবে তাকে পারিতোষিক হিসেবে সোয়া চার পণ প্রদান করতে হবে।

০২-০২-০৩ নাগবনের প্রশাসকরা হাতির মাহুতদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নাগবনে ঘোরাঘুরি করে হাতিদের বিচরণ সীমানা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন। প্রশাসকরা হাতিদের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির অনুসরণক্রমে কোন হাতি একাকী বিচরণ করে, কোন হাতি দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে, কোন হাতি দল থেকে বেরিয়ে এসেছে, কোন হাতি দল নেতা, কোন হাতি ক্রুদ্ধ স্বভাবের, কোন হাতি উন্মত্ত, কোন হাতি নাবালক, ইত্যাকার যাবতীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহপূর্বক নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। প্রয়োজনীয় তথ্য-সংগ্রহের পর হস্তি বিশারদদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রশাসকরা যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত হাতি বাছাই করবেন এবং অবরুদ্ধ করবেন। যুদ্ধের কাজে হাতিরাই সবচেয়ে দক্ষ ও কার্যকর বলে গণ্য হয়ে থাকে।

০২-০২-০৪ হাতিদের গুণগত মান; কলিঙ্গ এবং অঙ্গদেশের হাতিরাই সব দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠতর। পূর্বদেশ, চেদি, করূষ, দশার্ণ ও অপরান্ত তথা পশ্চিমাঞ্চলের হাতিরা মধ্যম মানের। সৌরাষ্ট্র ও পঞ্চনদ অঞ্চলের হাতিরা নিকৃষ্ট হাতি হিসেবে চিহ্নিত। তবে এই তিন প্রকৃতির হাতিকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বীর্যবান, তেজোদীপ্ত ও বেগবান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ২১ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে বিভিন্ন ধরনের দুর্গ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়াও এখানে দুর্গের প্রকৃতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সমরাস্ত্রের সংস্থান এবং শত্রুর আগ্রাসন নিরোধকল্পে বিভিন্ন কলাকৌশল ও নগর সৃজন সম্পর্কিত বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০২-০৩-০১ জনপদ সীমান্তের চারিদিকে যুদ্ধের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজাকে দুর্গ নির্মাণ করতে হবে। প্রকার ভেদে দুর্গ চার প্রকার হতে পারে (ক) ঔদক দুর্গ (খ) পার্বত দুর্গ (গ) ধান্বন দুর্গ (ঘ) বন দুর্গ। ঔদক দুর্গ দু প্রকার হতে পারে, প্রথম প্রকার: চারিদিক নদী পরিবেষ্টিত স্থানের উপর স্থাপিত দুর্গ। দ্বিতীয় প্রকার: গভীর সরোবর পরিবেষ্টিত স্থানের উপর স্থাপিত দুর্গ। পার্বত দুর্গও দু ধরনের হতে পারে। পর্বতের শিখরে পর্বত প্রস্তর দ্বারা নির্মিত দুর্গ এবং পর্বতের অভ্যন্তরে গুহা সদৃশ দুর্গ। ধান্বন বা মরু দুর্গও দু ধরনের হতে পারে। জলাশয় ও তৃণাঞ্চলশূন্য দুর্গ এবং বালুকা বেষ্টিত দুর্গ। বন দুর্গও দু ধরনের হতে পারে। পঙ্কিল স্থানস্থিত দুর্গে প্রবেশ প্রাক্কালে যাতে গতি শৈথিল্য ঘটে এবং স্তম্বগহন অর্থাৎ যে দুর্গে প্রবেশ প্রাক্কালে ছোট ছোট ঘন বৃক্ষরাজির বিঘ্ন পেরুতে হয়। এ সমস্ত দুর্গের মধ্যে নদী পরিবেষ্টিত দুর্গ ও পর্বত প্রস্তর দ্বারা নির্মিত দুর্গই অধিক কার্যকর রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত।

০২-০৩-০২ জনপদের কেন্দ্রস্থলে রাজা স্থানীয় নামক নগর নির্মাণ করাবেন। এ সমস্ত স্থানীয়-রাজার সংগ্রহকৃত ধনরাশি সংরক্ষিত হবে। স্থাপত্যকলায় অভিজ্ঞদের দ্বারা রাজা নির্দিষ্ট কোনো নদীর সঙ্গমস্থলে বা সরোবর স্থানে এ সমস্ত স্থাপনা নির্মাণ করাবেন। এই স্থানীয় স্থাপত্যশৈলীর নিয়মানুসারে বৃত্তাকার বা চতুষ্কোণরূপে নির্মিত হবে। বিভিন্ন স্থান হতে সহজে পণ্য আনয়নের জন্য স্থানীয়- সমূহে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়াও সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রবর্তন করতে হবে। স্থানীয় নামক এ সমস্ত নগরের চারিদিকে পর পর তিনটি পরিখা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে একটি থেকে অন্য পরিখার ব্যবধান হতে হবে এক দণ্ড। পরিখা তিনটির বিস্তার হবে চতুর্দশ দণ্ড। পরিখাগুলোর গভীরতা হবে বিস্তারের পরিমাপের তুলনায় এক চতুর্থাংশ কম। পরিখাগুলোর তলদেশ শিলার দ্বারা বদ্ধ করতে হবে। এর ঢাল এবং পাড় পাথর দিয়ে বাঁধাই করতে হবে। এ সমস্ত পরিখা বা ক্যানেল যেমন অন্যত্র থেকে আনীত জল দ্বারা পূর্ণ করতে হবে তেমনি পরিখার জল অন্যত্র নির্গমনেরও ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব পরিখায় জলপদ্ম এবং জলজ প্রাণী বিচরণের সংস্থান করতে হবে।

০২-০৩-০৩ পরিখা খনন প্রাক্কালে যে মৃত্তিকা উত্তোলিত হবে তা দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করাতে হবে। পরিখা থেকে এ ধরনের দেয়ালের ব্যবধান হতে হবে ষোল হাত। এই দেয়াল হবে চব্বিশ হাত উচ্চতাবিশিষ্ট। এ ধরনের মাটির দেয়াল যাতে বৃষ্টির পানিতে বা অন্য কারণে ধ্বসে না পড়ে সেজন্য এর ভিত্তি মজবুত করে নির্মাণ করতে হবে। এ ধরনের দেয়াল তিন প্রকৃতির হতে পারে; (ক) নিচের দিক স্থূল ও উপরাংশ কৃশ (খ) উপর নিচ সমান্তরালভাবে স্থূল বা চওড়া (গ) উপর ও নিম্নভাগ কৃশ এবং মধ্যভাগ চওড়া। দেয়াল নির্মাণের সময় এর গাঁথুনি মজবুত করার জন্য হাতি ও গরুর দ্বারা পদদলিত করে মৃত্তিকা পোক্ত করতে হবে। দেয়ালকে ভিত্তি করে এর উপর প্রাকার নির্মাণ করাতে হবে। এ সমস্ত প্রাকার নির্মাণের ক্ষেত্রে পোড়া ইট ব্যবহার করতে হবে। প্রাকারের উচ্চতা হবে কমপক্ষে ১৩ হাত কিন্তু তা ২৪ হাতের অধিক হবে না।

০২-০৩-০৪ পোড়া ইট ছাড়াও এই নির্মাণ কাজে পাথরও ব্যবহার করা যেতে পারে। এর বিস্তার এমন হতে হবে যাতে করে রথ চালকেরা সহজে রথ নিয়ে চলাচল করতে পারে। প্রাকারের চূড়ায় বানর মস্তকের প্রতিকৃতি খোদাই করে রাখতে হবে। রাজা কখনো কাঠ দিয়ে প্রাকার নির্মাণ করাবেন না, কাঠ সহজে দাহ্য বলে তা অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হতে পারে।

রাজা প্রাকারের উপর রণগৃহ বা সেনা শিবির নির্মাণ করাবেন যাতে করে রাজ সেনারা শত্রুদের আক্রমণ প্রতিরোধকল্পে সেখান থেকে লড়াই করতে পারে। এ সমস্ত রণগৃহে ওঠা নামার জন্য সহজে অপসারণযোগ্য সিঁড়ির যোগান রাখতে হবে। যুদ্ধের সুবিধার্থে প্রাকারের উপর কিছুদূর পর পর রণগৃহ নির্মাণ করাতে হবে। এক্ষেত্রে একটির থেকে অপরটির ব্যবধান হতে হবে ১২০ হাত। এছাড়াও দুটি রণগৃহের মধ্যবর্তী স্থানে একটি করে প্রতোলী বা Tower room নির্মাণ করাতে হবে।

০২-০৩-০৫ রণগৃহ ও প্রতোলীর মধ্যে ন্যূনতম তিনজন ধনুর্ধারীর অবস্থানের জন্য ইন্দ্রকোশ নামে আসনের সংস্থান করতে হবে, যাতে করে ধনুর্ধারীরা শত্রুর আগমন প্রতিহতকল্পে বাণ নিক্ষেপ করতে পারে। রণগৃহ, প্রতোলী ও ইন্দ্রকোশের অন্তরালে দেবপথ নামে একটি গুপ্তপথ নির্মাণ করাতে হবে। শত্রুদের নিক্ষিপ্ত বাণ থেকে পরিত্রাণ এবং শত্রুর দৃষ্টির আড়ালে অবস্থানের জন্য প্রাকারের উপর আচ্ছাদিত বা আবৃত স্থানের সুবিধা সম্বলিত স্থাপনা নির্মাণ করাতে হবে। এছাড়াও শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থে নিন্ধুহদ্বার নামে কোটর নির্মাণ করাতে হবে।

০২-০৩-০৬ পরিখার বহির্দেশ থেকে সম্ভাব্য যে যে পথে শত্রু সৈন্য দুর্গে প্রবেশ করতে পারে বলে অনুমিত হবে, রাজা সে পথগুলোতে প্রতিবন্ধক স্থাপন করাবেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রতিবন্ধক হিসেবে প্রবেশ পথে—(ক) জানুভঞ্জনী বা কাঠ নির্মিত সুঁচালো ফলক পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করবেন (খ) ত্রিশূলপ্রকর বা শক্ত কাঠ এবং লৌহনির্মিত শলাকা পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করাবেন (গ) অন্ধকূপ ঘাস বিচালি দিয়ে আচ্ছাদিত করার ব্যবস্থা করাবেন (ঘ) কূট বা লৌহশলাকা পুঁতে রাখবেন (ঙ) ঘাস দিয়ে বড় গর্ত আড়াল করে রাখবেন (চ) কণ্টকপ্রতিসর বা লৌহনির্মিত কাঁটাযুক্ত রজ্জু পেতে রাখবেন (ছ) অহিপৃষ্ঠ বা সাপের অস্থি সদৃশ প্রতিরোধক পেতে রাখবেন (জ) তালপত্র বা তালপত্রের আকৃতির প্রতিরোধক পেতে রাখবেন (ঝ) শৃঙ্গাটক বা তিন শলাকাযুক্ত প্রতিরোধক পেতে রাখবেন (ঞ) ক্ষুদ্রংষ্ট্রা বা কুকুরের দাঁতাকৃতির প্রতিরোধক পেতে রাখবেন (ট) অৰ্গল বা গর্তের মধ্যে কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ পেতে রাখবেন (ঠ) পদস্খলনের জন্য বন্ধুর ভূমিকে স্বাভাবিক ভূমি হিসেবে সজ্জিতকরণ করাবেন (ড) পদক্ষেপের স্থানে কাঁটাযুক্ত পাদুকা সদৃশ প্রতিবন্ধক স্থাপন করাবেন (ঢ) অম্বরীয় বা অগ্নিপূর্ণ গর্ত তৃণলতা দিয়ে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করাবেন (ণ) উদপানক বা বাহ্যিকভাবে বিশুদ্ধ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দূষিতজলে পুকুর পূর্ণ করে রাখবেন। ইত্যাকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে রাজা শত্রু সেনাদের গতিরোধের প্রয়াস গ্রহণ করবেন।

০২-০৩-০৭

০২-০৩-০৮ প্রাকারস্থ সভাগৃহ বা টাওয়ারের উচ্চতা ১৫ হাত বা ১৮ হাত পর্যন্ত হতে পারে। প্রতোলী তিন তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা যেতে পারে। এক তলায় এর কোনো দেয়াল থাকবে না, শুধু স্তম্ভ থাকবে। এর উপর দুটি তলা থাকবে। প্রথম তলাকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে প্রতি ভাগে একটি করে শালা বা সভাগৃহ নির্মাণ করাতে হবে। শালার পাশে মুখোমুখি দুটি মঞ্চ নির্মাণ করাতে হবে। শালা ও মঞ্চের মধ্যে আণি নামের ক্ষুদ্র দ্বার নির্মাণ করাতে হবে। দ্বিতীয় তলায় প্রথম তলার অর্ধেক উচ্চতাবিশিষ্ট চন্দ্রশালা নামক গৃহ নির্মাণ করাতে হবে। এই চন্দ্রশালাটি নির্মিত হবে পৃথক পৃথক স্তম্ভের উপর এবং ওঠা নামার জন্য এটি সিঁড়ির মাধ্যমে মাটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

০২-০৩-০৯ দুর্গের তোরণটি এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে করে তা যে ভূমির উপর স্থাপিত হবে কবাট দুটি যেন তার পাঁচ ভাগের তিন ভাগ আকৃতির হয়। কপাট বন্ধ করার জন্য এর দু অংশেই অর্গল থাকবে। প্রধান তোরণের সাথে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির পার্শ্ব দরোজারও সংস্থান থাকতে হবে। দ্বার বা তোরণটির বিস্তৃতি ও উচ্চতা এমন পরিমাপের হতে হবে যাতে করে এক সঙ্গে চারটি হাতি প্রবেশ ও প্রস্থান করতে পারে।

০২-০৩-১০ দুর্গের বিস্তৃতি অনুযায়ী এর এক তৃতীয়াংশে গিরগিটি মুখাকৃতির দ্বার নির্মাণ করাতে হবে। দুর্গে পুকুর খনন করে এর প্রবেশ পথে পুষ্করিণী দ্বার নির্মাণ করাতে হবে। ছয়টি গৃহের সমন্বয়ে নির্মিত আবাসনের জন্য একটি কুমারীপুরের দ্বার নির্মাণ করতে হবে। এছাড়াও দ্বিতল এবং এক বাড়ির জন্য স্বতন্ত্র দ্বার নির্মাণ করতে হবে। অস্ত্র এবং অন্যান্য দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণাগার নির্মাণ করতে হবে।

০২-০৩-১১ এসব সংরক্ষণাগারে বাটখারা, কোদাল, কুঠার, বাণ ও বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্রসহ অত্যাবশ্যকীয় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে।

চতুর্থ অধ্যায় ॥ ২২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজান্তঃপুরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনার অবস্থান, অবকাঠামোর বিন্যাস, দুর্গ বা নগরের প্রবেশ ও নির্গমন পথ, অভ্যন্তরীণ চলাচল পথ, বিভিন্ন বাহিনীসহ সৈন্যদের অবস্থান ও নগর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় আলোচিত হয়েছে।

০২-০৪-০১ তিনটি রাজপথ পূর্ব পশ্চিমমুখী এবং তিনটি রাজপথ উত্তর দক্ষিণমুখী করে দুর্গস্থ ভূমির বিন্যাস করতে হবে। এভাবে দুর্গাভ্যন্তরের ভূমি বিন্যাস করা হলে দুর্গটি ষোলটি চতুষ্কোণ ভূমিতে বিভাজিত হবে। এভাবে বিন্যাসিত সড়কের ফলে দুর্গে মোট বারোটি ফটক থাকবে। দুর্গে জল সরবরাহ এবং জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ গোপন সুড়ঙ্গ পথেরও সংস্থান রাখতে হবে।

০২-০৪-০২ দুর্গে উপরোক্ত ছয়টি প্রধান সড়ক ছাড়াও দুর্গাভ্যন্তরে চলাচলের জন্য ১৬ হাত প্রশস্তের আরও অনেক চলাচল পথের সংস্থান রাখতে হবে। এছাড়াও প্রধান সড়কে, নগরকেন্দ্রে, জনপদে, গো চারণ ক্ষেত্রে, হাট বাজারে, সেনা শিবিরে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে এবং শ্মশানভূমিতে যাতায়াতের জন্য ৩২ হাত প্রশস্ততাসম্পন্ন সড়কের সংস্থান রাখতে হবে। সেতু এবং বনাঞ্চলে চলাচলের পথ হতে হবে ১৬ হাত প্রশস্ত। হাতিদের চলাচল এবং কৃষিক্ষেত্রের পার্শ্বস্থ প্রসারিত পথ হবে প্রশস্ততায় আট হাত। এছাড়াও রথ এবং গো মহিষাদি চলাচলের পথ হতে হবে একহাত বিস্তারযুক্ত।

০২-০৪-০৩ দুর্গের সর্বোত্তম কেন্দ্রীয় ভূমিতে রাজার অন্তঃপুর নির্মাণ করতে হবে। উত্তরে নবমভাগ পর্যন্ত সীমায় এই প্রাসাদ বিস্তৃত হবে। স্থাপত্য শৈলীর বিধানানুসারে অন্তঃপুর হবে পূর্বমুখী বা উত্তরমুখী। রাজ অন্তঃপুরের উত্তর পূর্বাংশে আচার্য, পুরোহিতদের যজ্ঞস্থান এবং জল সংরক্ষণাগার নির্মাণ করতে হবে। ওই অঞ্চলেই নির্মাণ করতে হবে মন্ত্রিগণের বসবাসের আবাসন। অন্তঃপুরের পূর্ব দক্ষিণাঞ্চলে নির্মিত হবে রন্ধনশালা, হস্তিশালা এবং কোষাগার। প্রাসাদের বহিরাঙ্গনের পূর্বপ্রান্তে স্থাপন করতে হবে সুগন্ধি, পুষ্প, ধান, ঘৃত ও রসদ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ের বাণিজ্যিক বিতান। মুখ্যশিল্পী এবং ক্ষত্রিয়রা ওই এলাকাতেই বসবাস করবে। দক্ষিণপূর্ব ভাগে নির্মাণ করতে হবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংরক্ষণাগার, হিসাবরক্ষকদের আয় ব্যয়ের নিরূপণ কার্যালয়, সোনা রূপার গহনা ক্রয় বিক্রয়ের বিতান এবং রাজভৃত্যদের বাসস্থান। দক্ষিণ পশ্চিমভাগের নির্দিষ্ট স্থানে নির্মাণ করতে হবে অস্ত্রাগার ও বনজ দ্রব্যের সংরক্ষণাগার। অতঃপর তারও দক্ষিণাংশে ধান্য ক্রয় বিক্রয়ের কর্মচারী, কলকারখানার তত্ত্বাবধায়ক, সেনাধিনায়ক, রন্ধনকৃত খাদ্য বিক্রেতা, শরাব বিক্রেতা, মাংস বিক্রেতা, রূপাজীবী বা বেশ্যা, নট-নর্তকী এবং বৈশ্যদের বসবাসের জন্য আবাসন নির্মাণ করতে হবে। পশ্চিম-দক্ষিণ ভাগে উট, গাধার আস্তাবল, কারাগার, রাজপ্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের কার্যালয় এবং গাধা ও উট ক্রয় বিক্রয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করতে হবে।

০২-০৪-০৪ রাজান্তঃপুরের পশ্চিম উত্তর অংশে পাল্কি এবং রথ রাখার ছাউনি নির্মাণ করতে হবে। তারপর পশ্চিম দিকে পশমি দ্রব্যের শিল্পী, কার্পাস শিল্পী, বাঁশজাত দ্রব্য নির্মাতা, চর্মজাত দ্রব্য নির্মাতা, কবচ নির্মাতা, অস্ত্র নির্মাতা, অস্ত্র রাখার তুণীরাদি নির্মাতা এবং শূদ্রদের বাসস্থান নির্মাণ করতে হবে। উত্তর- পশ্চিম ভাগে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রয় বিক্রয়ের বিতান এবং ঔষধের দোকানের সংস্থান থাকবে। উত্তর-পূর্ব ভাগে ধান সংগ্রহ এবং গো, অশ্বের আস্তাবল থাকবে। অতঃপর পশ্চিম দিকে নগরের প্রধান দেবতা ও রাজ দেবতার মন্দির, কামার, মণিকার এবং ব্রাহ্মণদের বাসস্থান নির্মাণ করতে হবে। এ সমস্ত আবাসনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে রজক, তন্তুবায়, বিদেশ ফেরত বণিকদের জন্য আবাসন নির্মাণ করতে হবে।

০২-০৪-০৫ দুর্গ নগরের মাঝামাঝি স্থানে দুর্গা, বিষ্ণু, ইন্দ্রপুত্র ও ইন্দ্রের মন্দির এবং শিব, লক্ষ্মী ও মদিরা দেবীর মন্দির নির্মাণ করতে হবে। নগরের চারিদিকে বিভিন্ন দেবতার নামে দ্বার নির্মাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে উত্তর দিকে ব্রাহ্ম দ্বার, পূর্ব দিকে ইন্দ্র দ্বার, দক্ষিণ দিকে যাম্য দ্বার, পশ্চিমদিকে সেনাপত্য দ্বার নির্মাণ করতে হবে। এছাড়াও নগরের বহিরাঙ্গনে পরিখা হতে চারশ হাত তফাতে চৈত্য, পুণ্যস্থান, বন ও সেতুবন্ধ স্থাপন করতে হবে এবং দিক্ অনুসারে দিগ্‌দেবতাদের নিবাস নির্মাণ করতে হবে।

০২-০৪-০৬ দুর্গ নগরের উত্তর বা পূর্বাঞ্চলে থাকবে সাধারণ লোকের শ্মশান। দক্ষিণাঞ্চলে নির্মিত হবে ব্রাহ্মণদের শ্মশান। কোনো অবস্থায় এর ব্যত্যয় করা যাবে না, এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় পরিদৃষ্ট হলে দায়ী ব্যক্তির উপর আড়াইশ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। বিধর্মী, কাপালিক, চণ্ডাল ও অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের বাসস্থান এবং শ্মশান নির্মাণ করতে হবে সীমান্ত এলাকায়।

০২-০৪-০৭ দুর্গের অভ্যন্তরে নিম্নবর্ণের লোকদের আবাসন, কারখানা, ফুল, ফল, শাক-সব্জির আবাদভূমি এবং পদ্ম সরোবরের আয়তন—পরিসীমা অমাত্যদের অনুমতি সাপেক্ষে নির্ধারণ করে দিতে হবে। এ ধরনের প্রতি দশ পরিবারের জন্য একটি জলকূপের সংস্থান করতে হবে। দীর্ঘদিন ভোগ ও যোগান প্রাপ্তির জন্য দুর্গ বা নগরের সংরক্ষণাগারে ধান, চিনি, ক্ষারদ্রব্য, লবণ, ঔষধ, শুষ্ক মাংস, পশুখাদ্য, বাঁশ, কাঠ, লোহা, চামড়া, অস্ত্র, অঙ্গার ও প্রস্তর জাতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুদ রাখতে হবে।

০২-০৪-০৮ দুর্গাভ্যন্তরের গজারোহী, অশ্বারোহী, রথারোহী এবং পদাতিক তথা চতুরঙ্গ বাহিনীকে কোনো একক সেনাপতির অধিনায়কত্বে না রেখে স্বতন্ত্র অধিনায়কত্বে ন্যস্ত করতে হবে। এতে করে সেনাধ্যক্ষরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভীত হয়ে কোনো প্রলোভনে বশীভূত হয়ে রাজার অনিষ্ট সাধনে উদ্যোগী হবার সুযোগ পাবে না। জুয়াড়ি, নট, নর্তক, ঠগ বা প্রবঞ্চকরা যেহেতু সাধারণ লোকের স্বাভাবিক জীবনাচারের পরিবেশ বিনষ্ট করে, সেহেতু তারা কখনো দুর্গ বা নগরের অভ্যন্তরে বসবাসের অনুমতি পাবে না। এসব লোকদের যদি আশ্রয় প্রদান করতেই হয়, সেক্ষেত্রে রাজা তাদের জনপদের সীমান্ত এলাকায় বসবাসের অনুমতি প্রদান করবেন এবং তাদের উপর সব ধরনের প্রদেয় কর আরোপ করে তা প্রদানে বাধ্য করবেন।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ২৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজকোষ ও ভাণ্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত সন্নিধাতার দায় দায়িত্বের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া সন্নিধাতা কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের প্রকৃতি কেমন হবে, কোন প্রক্রিয়ায় ভাণ্ডারে গৃহীতব্য পণ্যদ্রব্য যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে, ইত্যাকার বিষয়ও এ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

০২-০৫-০১ রাজকোষ ও ভাণ্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সন্নিধাতা নামক পদ স্থ প্রশাসক স্বর্ণ, রত্ন ও মূল্যবান দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য কোষগৃহ, বিক্রয় দ্রব্যের জন্য পণ্যগৃহ, খাদ্য ও তৈলজাত পণ্য সঞ্চয়ের জন্য কোষ্ঠগৃহ, বনজ দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য কুপ্যগৃহ, অস্ত্রের জন্য অস্ত্রাগার এবং অপরাধীর জন্য কারাগৃহ নির্মাণ করাবেন। কোষগৃহের জন্য তিনি সুরক্ষিত ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ নির্মাণ করাবেন। মজবুত কাঠ, ইট ও পাথরে নির্মিত এই স্থাপনাটি হবে ত্রিতল বিশিষ্ট গৃহ সদৃশ এর মাত্র একটি প্রবেশ দ্বার থাকবে। তবে প্রতি তলায় প্রবেশের জন্য অপসারণ যোগ্য স্বতন্ত্র সোপান থাকবে। সাধারণের প্রবেশ দুর্বোধ্যকরণের জন্য এর প্রবেশ দ্বারটি বিভিন্ন দেব দেবীর অঙ্কিত প্রতিমার মাধ্যমে আড়াল করে রাখতে হবে।

০২-০৫-০২ এই গৃহের উপরিভাগ কোষগৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এর কোনো দরজা বা জানালা থাকবে না। এই গৃহটি অগ্নিপ্রতিরোধক হিসেবে নির্মিত হতে হবে এবং সব দিক দিয়ে হতে হবে সুরক্ষিত, এর প্রবেশ পথ হবে গোপনীয়। এই ধরনের কোষগৃহ ছাড়াও আপতকালীন প্রয়োজনে দীর্ঘসময় ধরে সম্পদ যোগানের জন্য রাজা সীমান্ত দেশে ধন সম্পদে পূর্ণ একটি গোপন প্রাসাদ নির্মাণ করাবেন। এ প্রাসাদের গোপনীয়তা রক্ষার্থে যারা এর নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে নির্মাণ সমাপ্তির পর তাদের হত্যা করতে হবে। এধরনের প্রাসাদ পরিপক্ক ইস্টক দিয়ে নির্মাণ করাতে হবে। এটি অনেক স্তম্ভ এবং কক্ষযুক্ত প্রাসাদ হলেও এর প্রবেশ পথ থাকবে মাত্র একটি। এর অভ্যন্তরে বিভিন্ন দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র কক্ষের সংস্থান থাকবে। প্রশাসক এবং বিচারকদের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের জন্য সুরক্ষিত কারাগার নির্মাণ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্ত নারী পুরুষদের জন্য স্বতন্ত্র কারাগারের ব্যাবস্থা করতে হবে।

০২-০৫-০৩ কোষগৃহগুলো হতে হবে বিভিন্ন সুবিধা ও সুরক্ষা সম্বলিত। এগুলোতে যেমন প্রস্রাবাগার থাকবে তেমনি থাকবে স্নানাগার। এ ছাড়াও এ সমস্ত গৃহে অগ্নি, বিষসহ অন্যান্য বিপদাশঙ্কার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং পূজা নিবেদনের সংস্থান থাকতে হবে। এর সাথে কোষ্ঠাগারে বৃষ্টি পরিমাপের ব্যবস্থাও থাকবে।

০২-০৫-০৩ কোষাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত মুখ্য প্রশাসক অভিজ্ঞ লোকের সহায়তায় দ্রব্যের ভালোমন্দ নতুন পুরাতন গুণমান বিচার করে তা সংগ্রহ করবেন। এক্ষেত্রে কেউ যদি নকল রত্ন, মণিমুক্তা বা চন্দন দ্রব্য সরবরাহ করে, তাহলে তার উপর উত্তম সাহসদণ্ড বা সর্বোচ্চ হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি নকল বনজ দ্রব্যাদি সরবরাহ করে সে-ক্ষেত্রে মধ্যম সাহসদণ্ড বা ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে নকল বা ভেজাল দ্ৰব্য সরবরাহের জন্য দ্রব্য ভেদে অপরাধীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০২-০৫-০৫ মুদ্রা পরীক্ষকের মাধ্যমে ভালোভাবে যাচাইয়ের করত স্বর্ণ ও রজত মুদ্রার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সন্নিধাতা কর্তৃক তা রাজকোষের জন্য গ্রহণ করতে হবে। জাল মুদ্রা চিহ্নিত হলে কেউ যেন তা ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য মুদ্রাগুলো তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট করতে হবে। জাল মুদ্রা ব্যবহারকারীদের উপর পূর্ব সাহসদণ্ড বা আড়াইশ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। ধান সংগ্রহকারী কর্মচারা তুষমুক্ত বিশুদ্ধ ধান সঠিক পরিমাপে সংগ্রহ করবেন। কেউ যদি প্রতারণার মাধ্যমে পরিমাপে কম এবং ভেজাল ধান সরবরাহ করে সেক্ষেত্রে তাকে জরিমানা হিসেবে দ্বিগুণ পরিমাণ ধান বা ধানের মূল্য প্রদান করতে হবে। অস্ত্রসহ অন্যান্য পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও ধানের মতো বিধি বিধান প্রযোজ্য হবে।

০২-০৫-০৬ বিচারালয়সহ রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মচারীদের কেউ যদি দ্রব্য আত্মসাৎ বা ওজনে কারচুপির আশ্রয় গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় তার উপর এক দুই বা চার পণ জরিমানা আরোপিত হবে। একই অপরাধ যদি কোনো কর্মচারী বারবার করতে থাকে সেক্ষেত্রে তার উপর পূর্ব সাহসদণ্ড তথা আড়াইশ পণ, মধ্যম সাহসদণ্ড তথা পাঁচশো পণ এবং উত্তম সাহসদণ্ড তথা হাজার পণ দণ্ড প্রযুক্ত হবে। তার পরও খাসিলত পরিবর্তন না হলে তার উপর বধদণ্ড বা প্রাণদণ্ডাদেশ প্রযুক্ত হবে। রাজ কোষাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত মুখ্য অধীক্ষক যদি কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করে, সেক্ষেত্রে তার উপর বধ দণ্ডাদেশ আরোপিত হবে। অধীনস্থ কর্মচারীরা যদি অর্থ বা দ্রব্য আত্মসাৎ করে, সেক্ষেত্রে তাদের উপর এমন দণ্ড আরোপ করতে হবে যাতে তারা মৃত্যুবরণ না করেও অর্ধমৃত অবস্থায় নিপতিত হয়। অধীক্ষকের আত্মসাতের বিষয়টি যদি অধীনস্থদের অগোচরে সাধিত হয়, সেক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাদের উপর ভৎর্সনা প্রযুক্ত হবে। কেউ যদি দুঃসাহস প্রদর্শনপূর্বক চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে রাজকোষের ধন অপহরণ করে, সেক্ষেত্রে তার উপর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ড প্ৰযুক্ত হবে।

জনপদ এবং নগর থেকে সংগৃহীত আয় সম্পর্কে সন্নিধাতাকে সর্বদা অবহিত থাকতে হবে। এ সম্পর্কে তাকে এতটাই ওয়াকিবহাল ও অভিজ্ঞ হতে হবে যেন শত বছরের আয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলেও তিনি তা অনায়াসে বলে দিতে পারেন। ভাণ্ডারের রক্ষিত দ্রব্যাদি ব্যবহারের পর অবশিষ্ট যা মজুদ থাকবে সে সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা থাকতে হবে, যেন রাজা বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাচিত হলে তিনি সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারেন।

ষষ্ঠ অধ্যায় ॥ ২৪ প্রকরণ ॥

রাজার সমস্ত রাজস্ব আয়ের দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত তিনি হলেন সমাহর্তা। এ অধ্যায়ে সমাহর্তার কার্যপরিধি এবং এ বিষয়ক বিভিন্ন কর্মযজ্ঞের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

০২-০৬-০১ সমাহর্তা দুর্গ, রাষ্ট্র, খনি, সেতু, বন, ব্রজ ও বণিক পথের উপর প্রয়োজনীয় নজরদারি করবেন এবং এ সমস্ত উৎস হতে রাজস্ব সংগ্রহে সচেষ্ট থাকবেন। এ সমস্ত খাত হতে অর্জিত আয় রাজ্যের আয়ের শরীর বা আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য। নিম্নোক্ত বাইশটি উপায়ে দুর্গ বা নগরভিত্তিক আয় অর্জিত হয়ে থাকে। দুর্গভিত্তিক বিধায় এ জাতীয় আয়ের উপায় দুর্গ অভিধায় অভিষিক্ত।

১. পণ্য আমদানি ও রপ্তানি বাবদ শুল্ক আদায় ২. অর্থ জরিমানা বাবদ আয় ৩. বাটখারা পরীক্ষাজনিত আয় ৪. নগরাধ্যক্ষের মাধ্যমে অর্থ জরিমানা বাবদ আয় ৫. টাকশালের প্রশাসকের মাধ্যমে সংগৃহীত আয় ৬. দুর্গে আনীত এবং প্রেরিত দ্রব্যে সিল মোহর দেওয়া বাবদ সংগৃহীত অর্থ ৭. সুরাধ্যক্ষের মাধ্যমে সুরা উৎপাদনে আরোপিত শুল্ক বাবদ সংগৃহীত অর্থ ৮. সূনাধ্যক্ষের মাধ্যমে কসাইখানা হতে সংগৃহীত অর্থ ৯. সূত্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে বস্ত্র উৎপাদন খাত হতে সংগৃহীত অর্থ ১০. তৈল বিক্রয়ের খাত হতে সংগৃহীত অর্থ ১১. ক্ষার জাতীয় দ্রব্য খাত হতে সংগৃহীত অর্থ ১২. ঘৃত বিক্রয়ের খাত হতে সংগৃহীত অর্থ ১৩. স্বর্ণকারদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ ১৪. বিপণি বিতান থেকে শুল্ক বাবদ সংগৃহীত অর্থ ১৫. গণিকাধ্যক্ষের মাধ্যমে পতিতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ ১৬. জুয়া খেলার আসর থেকে আহরিত অর্থ ১৭. স্থপতিদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ ১৮. স্থুলবস্তু নির্মাতা বা কারিগরদের কাছ থেকে আহরিত অর্থ ১৯. সুক্ষ্মবস্তু নির্মাতা বা কারিগরদের কাছ থেকে আহরিত অর্থ ২০. দেবালয়াধ্যক্ষের মাধ্যমে দেবালয় হতে আহরিত অর্থ ২১. দুর্গ বা নগর দ্বারপালের মাধ্যমে আহরিত অর্থ ২২. দুর্গ বা নগরের বহিরাঙ্গন হতে নট, নর্তকিদের নিকট হতে আহরিত অর্থ।

০২-০৬-০২ রাষ্ট্রখাত হতে নিম্নোক্ত তের ধরনের রাজস্ব বা অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে—১. সীতা বা ভূমি প্রশাসকের মাধ্যমে আবাদযোগ্য ভূমি হতে কর বাবদ আহরিত অর্থ ২. ভাগ হিসেবে উৎপন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ গ্রহণের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ ৩. উপহার হিসেবে প্রাপ্ত ধন ৪. ফল ও বৃক্ষাদি হতে আহরিত রাজকর ৫. বণিকদের কাছ থেকে আহরিত অর্থ ৬. নদী তীরস্থ তীর্থক্ষেত্র হতে আহরিত অর্থ ৭. নদী পারাপার বাবদ আহরিত অর্থ ৮. নৌ প্রশাসকের মাধ্যমে আহরিত অর্থ ৯. নদী তীরস্থ ক্ষুদ্র জনপদ হতে আহরিত অর্থ ১০. পশুচারণ ক্ষেত্রের মাধ্যমে আহরিত অর্থ ১১. পরিবৃত স্থান হতে শুল্ক বাবদ আহরিত অর্থ ১২. বিষয়পাল বা জেলা রক্ষকের মাধ্যমে আহরিত অর্থ ১৩. চৌকিদারদের দ্বারা ধৃত চোরদের কাছ থেকে আহরিত অর্থ।

খনি খাত হতে যে বারো ধরনের অর্থাগম হয়ে থাকে, তা হলো—১.

স্বর্ণ ২. রৌপ্য ৩. হীরক ৪. মণি ৫. মুক্তা ৬. প্রবাল ৭. শঙ্খ ৮. লৌহ ৯. লবণ ১০. ভূতল হতে উৎপন্ন ধাতু ১১. পার্বত্যাঞ্চল হতে আহরিত ধাতু ১২. খনিজ তৈল।

সেতু খাতের যে পাঁচটি উৎস হতে আয় আহরিত হয়ে থাকে, তা হলো—১. ফলের বাগান ২. ফুলের বাগান ৩. সব্জিক্ষেত ৪. ধানের বীজ ক্ষেত ৫. আদা, রসুন প্রভৃতি খাত।

বন খাতের যে চারটি ক্ষেত্র হতে আয় আহরিত হয়ে থাকে, তা হলো—১. পশুবন তথা গৃহপালিত পশুদের চারণ ক্ষেত্র ২. মৃগবন তথা হরিণ ও অরণ্য পশুদের বিচরণ ভূমি ৩. দ্রব্যবন তথা কাষ্ঠ, বেত ও বাঁশ উৎপাদনের ক্ষেত্র ৪. হস্তিবন তথা হাতিদের জন্য নির্মিত চারণভূমি।

০২-০৬-০৩ পশু ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে ব্রজ খাত হতে যে আয় আহরিত হয়, তা হলো—১. গরু ২. মহিষ ৩. ছাগল ৪. মেষ ৫. গর্দভ ৬. উট ৭. অশ্ব ৮. খচ্চর। বণিক পথ নামে দুটি ক্ষেত্র থেকে অর্থ আহরিত হয়। এর একটি হলো জলপথ এবং অপরটি হলো স্থলপথ। এভাবে দুর্গ, রাষ্ট্র, খনি, সেতু, বন, ব্ৰজ ও বণিক পথের খাত হতে ৬৭ ধরনের ধন বা অর্থ আহরণ করতে হবে এবং এ খাতগুলোকে আয়ের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এ ছাড়াও নিম্নোক্ত সাতটি খাতকেও আয়ের মুখ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে হবে—১. মূল তথা ধান, ফল বা উৎপন্ন শস্য বিক্রয়লব্ধ আয় ২. ভাগ তথা উৎপন্ন ফসলের প্রদেয় অংশ ৩. ব্যাজী বা রাজভাণ্ডারের জন্য দ্রব্য সংগ্রহকালে ফাও হিসেবে গ্রহণকৃত দ্রব্যাংশ ৪. পরিঘ তথা খেয়া পারাপারলব্ধ আয়, ভিখিরির ভিক্ষালব্ধ আয় হতে গৃহীত অংশ (কৌটিল্যর শাসন ব্যবস্থায় শুল্ক বা কর আদায়ের পরিধি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে-ভিখিরিদেরও আয়ের অংশ রাষ্ট্রকে প্রদান করতে হত—লেখক নগরে প্রবেশকারী বহিরাগতদের কাছ থেকে গৃহীত অর্থ ৫. ক্লপ্ত বা গ্রাম হতে সংগৃহীত ধান্য বা দ্রব্য কর ৬. রূপক বা লবণ বিক্রেতাসহ অন্যান্য দ্রব্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে শতকরা আট ভাগ হিসেবে গ্রহণ ৭. অত্যয় বা বিভিন্ন অপরাধের নিরিখে আরোপিত জরিমানা বাবদ আয়। এ পর্যন্ত রাজার আয়ের উৎসের ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে।

০২-০৬-০৪ রাজ্যের ব্যয় সংক্রান্ত চব্বিশটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো—১. দেবতার পূজার জন্য ব্যয় ২. মৃত পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধের জন্য ব্যয় ৩. বিভিন্ন উৎসবে ব্রাহ্মণ, বৃদ্ধ, আতুর, অনাথদের দান বাবদ ব্যয় ৪. কল্যাণ যজ্ঞে পুরোহিতগণকে দান বাবদ ব্যয় (এই চার প্রকার ব্যয় রাজার ব্যক্তিগত ব্যয় হিসেবে বিবেচ্য) ৫. রানি, রাজকন্যা, রাজপুত্র, রাজার ভগ্নিদের ভরণ- পোষণজনিত আবশ্যকীয় ব্যয় ৬. খাদ্য বাবদ রন্ধনশালার ব্যয় ৭. কূটনৈতিক কাজে নিযুক্ত দূতদের জন্য ব্যয় ৮. ভোজ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য কোষ্ঠাগার নির্মাণ বাবদ ব্যয় ৯. অস্ত্র প্রস্তুতের জন্য কারখানার স্থাপনা নির্মাণ ও তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় ১০. পণ্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় ১১. বনজদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ ও তা রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় ১২. কারখানা নির্মাণ ও কৃষির জন্য ব্যয় ১৩. আকস্মিক প্রয়োজনুজনিত ব্যয় ১৪ পদাতিক বাহিনীর জন্য ব্যয় ১৫. অশ্ব ও অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য ব্যয় ১৬. রথ নির্মাণ ও রক্ষাবেক্ষণের ব্যয় ১৭. হাতি সংগ্রহের জন্য ব্যয় ১৮. গবাদিপশুর জন্য ব্যয় ১৯. পশুপালনের স্থান নির্মাণ বাবদ ব্যয় ২০. হরিণ ও অন্যান্য পশুদের বাসস্থান বাবদ ব্যয় ২১. শুক-সারিকা পাখিদের অভয়ারণ্য নির্মাণ বাবদ ব্যয় ২২. সিংহসহ হিংস্র প্রাণীদের অরণ্য নির্মাণ বাবদ ব্যয় ২৩. কাঠ সংগ্রহের স্থান নির্মাণজনিত ব্যয় ২৪. তৃণজাতীয় দ্রব্যাদির সংগ্রহ স্থান নির্মাণজনিত ব্যয়।

০২-০৬-০৫ রাজার রাজ্যাভিষেকের দিন থেকেই দিন মাস বছরভিত্তিক আয় ব্যয়ের হিসাব নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। রাজার বর্ষ হিসাবকাল তিন ভাগে বিভাজন করে বর্ষা, হেমন্ত ও গ্রীষ্মের ভিত্তিতে নিরূপণ করতে হবে। প্রতি আড়াই বছর পর একটি অতিরিক্ত মাসকে অধিমাস ধরে চন্দ্রমাসের হিসাব ঠিক রাখতে হবে।

কর আদায়ের ক্ষেত্রে সমাহর্তার—১. করণীয় (সারা বছরের আদায়যোগ্য করের পরিমাণ প্রাক্কলন করতে হবে) ২. সিদ্ধ (নির্ধারণকৃত কর আদায় করতে হবে) ৩. শেষ (বকেয়া হিসাব করতে হবে) ৪. আয় (প্রকৃত আয় নিকাশ করতে হবে) ৫. ব্যয় (ব্যয় হিসাব করতে হবে) ৬. নীবী (আয় ব্যয়ের উপর স্থিতিপত্র প্রণয়ন করতে হবে।

০২-০৬-০৬ কর নিরূপণ সম্পর্কীত করণীয় বিষয় ছয়টি ১. সংস্থান তথা কোনো গ্রাম থেকে কি পরিমাণ কর আদায় হবে সে সম্পর্কে অবহিত থাকা ২. প্রচার তথা এক একজন বিভাগীয় প্রধান বা অধীক্ষকের মাধ্যমে কি পরিমাণ কর আদায় হবে সে সম্পর্কে অবহিত থাকা ৩. শরীরাবস্থান তথা জনপদ বা নগরীর আয়ের উৎস সম্পর্কে অবহিত থাকা ৪. আদান তথা সময়মতো কর হিসেবে ফসলের অংশ আদায়ের ব্যাপারে অবহিত থাকা ৫. সর্বসমুদয় পিণ্ড তথা প্ৰতি গ্রাম, প্রতি নগর এবং প্রতি জনপদ হতে আদায়কৃত কর সম্পর্কে অবহিত থাকা ৬. সঞ্জাত তথা আদায়কৃত মোট কর সম্পর্কে অবহিত থাকা। এসব বিষয়ে সমাহর্তা তথা মুখ্য কর সংগ্রাহকের সম্যক ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। এ কারণে বিষয়টি করণীয় অভিধায় অভিষিক্ত।

সিদ্ধ তথা আদায়কৃত কর ছয়ভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে ১. কোষাপিত তথা রাজ কোষাগারে জমাদানকৃত কর ২. রাজাহার তথা রাজা কর্তৃক সমাহর্তার কাছ থেকে গৃহীত অর্থ ৩. পুরব্যয় তথা নগরীর নির্মাণ কাজে ব্যয়িত অর্থ। এই তিন প্রকার অর্থ সঞ্চিত বা পরিশোধিত হিসেবে বিবেচ্য ৪. পরমসংবৎসরানুবৃত্ত তথা বিগত বছরে ব্যয়ের পর উদ্বৃত্ত অর্থ ৫. শাসনমুক্ত তথা রাজার আজ্ঞায় করমুক্ত সম্পত্তি ৬. মুখাজ্ঞপ্ত তথা রাজার মৌখিক নির্দেশে যে অর্থ পরিশোধিত। এই তিন প্রকার অর্থ আপতনীয় হিসেবে বিবেচ্য।

০২-০৬-০৭ অসংগৃহীত বা জরিমানা বাবদ অনাদায়কৃত আয় ‘শেষ’ শব্দের দ্বারা আখ্যায়িত। শেষ ছয় প্রকার ১. সিদ্ধিপ্রকর্মযোগ তথা যে প্রদেয় কর আদায় হয়নি তা আদায়করণ ২. দণ্ডশেষ তথা জরিমানার যে অর্থ আদায় করা হয়নি তা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ ৩. বলাৎকৃতপ্রতিস্তব্ধ তথা রাজার প্রিয়জন কর্তৃক স্পর্ধাবশত প্রদেয় কর পরিশোধ না করা ৪. অবসৃষ্ট তথা স্বেচ্ছাচারবশত নগর প্রধানদের প্রদেয় কর পরিশোধ না করা ৫. অসার তথা বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও ফল লাভের অপ্রাপ্ততা ৬. অল্পসার তথা বিপুল ব্যয়ের পর স্বল্প প্রাপ্তি। এই ছয় প্রকার অপ্রাপ্তিকে শেষ বা Outstanding Revenue বলা হয়। রাজ্যের সার্বিক আয় বর্তমান, পর্যুসিত এবং অন্যজাত, এই তিনভাগে বিভাজিত। যে আয় প্রতিদিন অর্জিত হয় তা বর্তমান আয় হিসেবে বিবেচিত। যে আয় বিগত বছরে অর্জিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু আদায় হয়েছে বর্তমান বছরে, যে আয় শত্রুদের পরাজিত করার পর হাসিল হয়েছে বা বশ্যতা স্বীকারপূর্বক শত্রু কর্তৃক যে আয় প্রদান করা হয়েছে তা পর্যুসিত আয় হিসেবে অভিহিত। অন্যজাত আয় হিসেবে বিবেচিত আয়গুলো হলো—১. নষ্টপ্রস্মৃত বা অনেকদিন বিস্মৃত থাকার পর যে আয়ের কথা মনে পড়ে ২. অয়ুক্তদণ্ড বা মুখ্য প্রশাসকদের মাধ্যমে জরিমানা বাবদ আদায়কৃত আয় ৩. পার্শ্ব বা প্রভুত্বের প্রভাবে আদায়কৃত আয় ৪. পারিহীণিক বা গবাদিপশুর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের জন্য জরিমানা বাবদ সংগৃহীত আয় ৫. ঔপায়নিক বা উপঢৌকন বাবদ সংগৃহীত আয় ৬. ডমরগতকস্ব বা শত্রু সৈনিকদের কলহের সুবাদে প্রাপ্ত আয় ৭. অপুত্রক বা উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতি হেতু মৃত ব্যক্তির সম্পদ অধিগ্রহণ বাবদ আয় ৮. নিধি বা প্রাপ্ত গুপ্তধন হতে সংগৃহীত আয়।

এসমস্ত খাত ছাড়াও ব্যয় প্রত্যয়ের যে তিনটি খাত হতে আয় হতে পারে তা হলো—১. কোনো কাজে সৈনিক নিযুক্তি বাবদ ব্যয়ের পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে সে আয় ২. হাসপাতালের রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত ব্যয়ের অব্যয়িত অর্থ ৩. নির্মাণকাজে বরাদ্দকৃত ব্যয়ের অব্যয়িত অর্থ। এছাড়াও আরও যে পাঁচটি উৎস থেকে অর্থ সংগৃহীত বা আয় হতে পারে তা হলো—১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে বিক্রিত দ্রব্যের অতিরিক্ত আয় ২. উপজা বা কোনো কারণবশত গবাদি পশু বিক্রয়জনিত আয় ৩. দ্রব্যের ওজন বা আকারজনিত তারতম্যের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয় ৪. ব্যাজী বা বিক্রেতার কাছ থেকে ফাও হিসেবে গৃহীত অতিরিক্ত দ্রব্য বা পণ্য বাবদ আয় ৫. প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের কারণে বিক্রিত দ্রব্যের অতিরিক্ত আয়।

০২-০৬-০৮ পূর্বোক্ত ব্যয় খাত ছাড়াও আরও যে চারটি খাতে ব্যয় হতে পারে তা হলো—১. নিত্য বা বাধাধরা দৈনন্দিন দিনের ব্যয় ২. লাভ বা কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতার পাক্ষিক, মাসিক ও বাৎসরিক ব্যয় ৩ ও ৪ নিত্য ব্যয় এবং লাভ ব্যয়ের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় যথাক্রমে নিত্যোৎপাদিক ও লাভোৎপাদিক ব্যয়।

সার্বিক ব্যয় সঙ্কুলানের পর আয়ের যে হিসেব পরিগণনা করা হয় তাকে নীবী বা স্থিতি বলা হয়। নীবী বা স্থিতি দুই প্রকার হতে পারে, যথা—১. প্রাপ্তা বা সার্বিক ব্যয়ের পর রাজকোষে জমাকৃত অবশিষ্টাংশ ২. অনুবৃত্তা বা রাজকোষে অজমাকৃত সংগৃহীত অর্থ। অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা সমাহর্তা সম্ভাব্য ব্যয়ের আলোকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে এবং বিভিন্ন খাত হতে অর্থ সংগ্রহ করবে। এক্ষেত্রে যিনি প্রজাদের পীড়ন না করে আয় বৃদ্ধিতে সফল হবেন এবং বেতনভোগী সৈনিক, কর্মচারী ও ভৃত্যদের অসন্তুষ্ট না করে ব্যয় সাশ্রয়ে সফল হবেন, তিনি প্রাজ্ঞ সমাহর্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন। এছাড়া আয় ব্যয়ের বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে সমাহর্তা তা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

সপ্তম অধ্যায় ॥ ২৫ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে অক্ষপটল তথা মহা হিসাবরক্ষকের কার্যালয়ের কার্যকলাপ এবং আয় ব্যয়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

০২-০৭-০১ মহাগাণনিক তথা মহা হিসাবরক্ষক তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অক্ষপটল নামে একটি হিসাবরক্ষণ কার্যালয় নির্মাণ করাবেন। মাঙ্গলিকত্বের সূচক হিসেবে এই কার্যালয়ের সম্মুখভাগ হতে হবে পূর্ব বা উত্তর অভিমুখী। কর্মচারীদের কাজের সুবিধার্থে এই ভবনটি হবে কয়েকটি ছোট ছোট কক্ষ সম্বলিত। ভবনে হিসেবের যাবতীয় নিবন্ধন পুস্তক সংরক্ষিত থাকবে। এ সমস্ত নিবন্ধন পুস্তকে মহাগাণনিক যে সমস্ত হিসেব লিপিবদ্ধ করবেন তা হলো—

১. অধিকরণের সংখ্যা তথা যেখানে যে দ্রব্য উৎপন্ন হয় সে স্থানের নাম ও উৎপন্ন দ্রব্যের সংখ্যা। প্রচার তথা বিভিন্ন বিভাগের করণীয় সম্পর্কিত বিষয়। সঞ্জাত তথা উৎপন্ন দ্রব্য ও তা থেকে প্রাক্কলিত আয়ের পরিমাণ।

২. কর্মান্ত তথা বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যের বৃদ্ধি বা মুনাফা। ক্ষয় তথা ওজন ও উৎপাদনজনিত ক্ষতি। ব্যয় তথা অর্থের বিনিময়ে ক্রয়জনিত খরচা। প্রযাম তথা অনটনের সময় রন্ধনকৃত খাদ্য ক্রয়ের ব্যয়। ব্যাজী তথা মালামাল ক্রয়কালে ওজনের অতিরিক্ত দ্রব্য ফাও হিসেবে গ্রহণের হিসাব। যোগ তথা আসল ও ভেজাল মিশ্রণজনিত লাভ ক্ষতি। স্থান তথা কোথায় কি পরিমাণ দ্রব্য উৎপন্ন হয়, তার খতিয়ান। বেতন তথা কর্মকারদের মাসিক ও বাৎসরিক মাহিনা। বিষ্টি তথা বলপূর্বক কর্মকারদের মাধ্যমে কৃত কাজের হিসেব। ইত্যাদি হিসেব লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

৩. রত্ন, চন্দন, বস্ত্রাদি, চামড়াজাত পণ্য ও বাঁশজাত পণ্যের মূল্য, বৰ্ণ, গুণ, ওজন ও আয়তনের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে।

৪. দেশ, গ্রাম, জাতি, কুল, ধর্ম, ব্যবহার ও চারিত্রের স্বরূপ লিপিবদ্ধ করতে হবে। ৫. রাজার সেবিকা হিসেবে রূপাজীবী, বাসস্থান, নজরানা প্রদান, করমুক্তি, অশ্বারোহী, গজারোহী, পদাতিক সৈন্যদের খোর-পোষ এবং বেতন ভাতাদির বাবদ ব্যয়িত হিসাব লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

৬. রাজা তার পত্নী ও পুত্রদের জন্য কি কি রত্ন ও ভূমি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

৭. রাজপত্নী ও রাজপুত্রদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ভূমি ও রত্নের অতিরিক্ত ব্যয়, রোগবালাই প্রশমনজনিত ব্যয় এবং অন্যান্য উৎস হতে গৃহীত অর্থ লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

৮. মিত্ররাজকে প্রদত্ত সম্পদ ও শত্রুরাজ থেকে আহরিত সম্পদ নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

০২-০৭-০২ অতঃপর রাজার বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের করণীয় তথা সারা বছর যে রাজস্ব আদায় হতে পারে তার সম্ভাব্য পরিমাণ, সিদ্ধ তথা প্রকৃত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ, শেষ তথা অনাদায়ী রাজস্বের পরিমাণ, আয় ব্যয় এবং নীবী তথা সার্বিক স্থিতিপত্র প্রণয়নের পর সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ, উপস্থান তথা নিজ নিজ কর্ম সম্পাদনের জন্য কর্মচারীদের অক্ষপটলে উপস্থিতি, প্রচার তথা কর্মকরদের কার্যপদ্ধতি, ইত্যাকার বিষয়াদি নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে প্রধান গাণনিক বা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সকলকে অবহিত করবেন। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রধান গাণনিক কর্মকর্তা উত্তম, মধ্যম ও অধম প্রকৃতির কর্মাধ্যক্ষ নিয়োগ করবেন।

এক্ষেত্রে রাজা এমন ধরনের কর্মাধ্যক্ষ নিয়োগ করবেন যাদের কর্মদক্ষতা, কর্মনৈপুণ্য ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাজা অপরাধের জন্য সাজা প্রদান করেও কখনো অনুশোচনা বোধ করবেন না। এ কারণে তিনি কখনো এ সমস্ত পদে ব্রাহ্মণ, মিত্র বা কোনো নিকটাত্মীয়কে নিয়োগ প্রদান করবেন না। সবদিক বিবেচনা করে কোনো কর্মাধ্যক্ষ বা প্রশাসককে নিয়োগ প্রদানের পর যদি তার দ্বারা কোনো অপরাধ বা ক্ষতি সাধিত হয় এবং তিনি যদি সে ক্ষতিপূরণ প্রদানে অপারগ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রশাসকের কুকর্মের সহযোগী, জামিনদার, অধীনস্থ কর্মচারী, পুত্র, ভ্রাতা, ভার্যা, কন্যা ও ভৃত্যরা ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য থাকবে।

০২-০৭-০৩ রাজসরকারের বাৎসরিক কর্মদিবস হবে ৩৫৪ দিন। সে হিসেবেই পরিচালিত হবে রাজ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সে হিসেবেই কে কত দিন কাজ করেছে তা নির্ধারিত হবে এবং সে মোতাবেক বেতন পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ যেন কার্যদিবস গণনায় জোচ্চুরি করতে না পারে সে লক্ষ্যে গুপ্তচরদের মাধ্যমে কর্মচারীদের কাজ নিরীক্ষণ করাতে হবে। গণনাধ্যক্ষের অজ্ঞানতা, অলসতা, অসাবধানতা, ভীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্রোধ, আত্মম্ভরিতা এবং লালসার কারণে রাজার ধন সম্পত্তি তথা রাজকোষের প্রভূত ক্ষতি হতে পারে। এ কারণে গুপ্তচরদের মাধ্যমে গণনাধ্যক্ষের করণীয় কাজ নিরীক্ষণ করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা বা দায়িত্বহীনতা পরিদৃষ্ট হলে, গণনাধ্যক্ষের কর্তব্য অবহেলার কারণে রাজার আর্থিক ক্ষতি সাধিত হলে, তার উপর ক্ষতির প্রকৃতিভেদে জরিমানা বা অর্থদণ্ড আরোপ করতে হবে।

০২-০৭-০৫ বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বা প্রশাসকরা সামগ্রিক আয় ব্যয়ের হিসেব দাখিল করার জন্য আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা দিবসে গণনাধ্যক্ষের কার্যালয়ে হাজির হবেন। উপস্থিত প্রশাসকরা চূড়ান্ত হিসেব দাখিল না করা পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে কোনোপ্রকার আলাপ আলোচনা বা পরামর্শ করতে পারবে না। প্রশাসকরা আয় ব্যয়ের হিসেব দাখিলের পর গণনাধ্যক্ষের কাছ থেকে স্থিতিপত্র বুঝে নিবেন। হিসেব দাখিলের সময় কোনো হেরফের হলে বা আয় কম-বেশি প্রদর্শন করা হলে দায়ী কর্মচারীকে ক্ষেত্রবিশেষে প্রদর্শিত অঙ্কের আটগুণ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। তবে রাজকোষের জন্য ক্ষতিকর নয় এমনতর অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য কোনো জরিমানা আরোপিত হবে না।

০২-০৭-০৬ যে সব হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বা গণনাধ্যক্ষ নির্ধারিত দিনে প্রধান গণনাধ্যক্ষের কার্যালয়ে হাজির হবেন না, বা হাজির হলেও আয় ব্যয়ের খাতাসহ হিসেব দাখিল করতে ব্যর্থ হবেন, তাদেরকে প্রদেয় অর্থের দশগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। প্রধান গণনাধ্যক্ষ নিবন্ধন পুস্তক পরীক্ষার জন্য যথাসময়ে হাজির হওয়ার পরও যদি হিসেবের কাজে নিযুক্ত অধস্তন কর্মচারীরা নিবন্ধন পুস্তক উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে তাদের উপর পূর্ব সাহসদণ্ড বা আড়াইশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে দ্বিগুণ পূর্ব সাহসদণ্ড প্রযুক্ত হবে।

রাজার সকল মহামাত্র তথা মুখ্য প্রশাসক দাখিলকৃত আয় ব্যয়ের স্থিতিপত্র প্রণয়নের পর তা জনপদের লোকদের অবগতির জন্য পাঠ করে শোনাবেন। জনপদের লোকদের অবহিতকরণের সময় কোনো মহামাত্র যদি ভুল বা মিথ্যে হিসেব উপস্থাপন করেন, সেক্ষেত্রে তাকে উত্তম সাহসদণ্ড বা একহাজার পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। যে গণনাকর্মচারী বা হিসাবরক্ষণ কর্মচারী প্রতিদিনকার মাসিক হিসাব প্রস্তুত করতে সমর্থ হবে না, তাকে সে হিসেব প্রস্তুত করার জন্য আরও এক মাস সময় দেওয়া যেতে পারে। সময় বৃদ্ধির পরও যদি তিনি হিসেব দাখিল করতে ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে তাকে প্রতি মাসের বিলম্ব হেতু দুইশত পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। একমাস পরও যদি কোনো মহা হিসাবরক্ষক চূড়ান্ত স্থিতিপত্র প্রণয়নে ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে তাকে হিসেব প্রণয়নের জন্য আরও পাঁচ দিন সময় দেওয়া যেতে পারে, এরপরও হিসেব উপস্থাপনে ব্যর্থ হলে তিনি দণ্ডিত হবেন।

০২-০৭-০৭ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা যখন রাজকোষে অর্থ জমা দিয়ে মহা হিসাবরক্ষকের কাছে হিসেবের স্থিতিপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হাজির হবেন তখন মহা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেব দাখিলের নিয়ম, সংগ্রহের তরিকা, লোকাচার, পূর্বস্থিতি, স্থিতিপত্রের যথার্থতা এবং কার্যনিষ্পত্তির সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। প্রয়োজনে গুপ্তচরদের মাধ্যমে গোপন পরীক্ষণের মাধ্যমে দাখিলকৃত হিসেবের সঠিকতা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন।

হিসাব লেখার সময় এক দিবস, পাঁচ দিবস, এক পক্ষ, এক মাস, চার মাস এবং পুরো বছর—এভাবে বিভাজন করে নিবন্ধন পুস্তকে আয়, ব্যয় ও স্থিতিপত্রের হিসেব লিপিবদ্ধ করবেন। আয়ের হিসেব লিপিবদ্ধ করার সময় বর্ষ- মাস-পক্ষ-দিবস, ঋতুভিত্তিক কাল, আয়ের ক্ষেত্র, শুল্ক বা সুদ, বকেয়া আয়, আয়ের পরিমাণ, অর্থ প্রদানকারী, আদায়কারী কর্মচারী, আয় লিপিবদ্ধকারী এবং আয় গ্রহীতার নাম নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে।

ব্যয়ের হিসেব লিপিবদ্ধকরণের সময়—ব্যয়ের স্থান, ব্যয়ের ক্ষেত্র, লাভ বা কর্মচারীদের বেতন খাতের ব্যয়, ব্যয়ের কারণ, কাউকে প্রদত্ত বস্তুর বিবরণ ও মূল্য, ব্যয়ের পরিমাণ বা অঙ্ক, ব্যয়ের আদেশ দাতার নাম, রাজকোষ থেকে অর্থ উত্তোলনকারী, দ্রব্য সরবরাহকারী ভাণ্ডাররক্ষক এবং ব্রাহ্মণকে দানজনিত ব্যয়, ইত্যাকার বিষয় বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এসব বিষয় সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কি না মহা হিসাবরক্ষক তা যাচাই করে নিবেন।

০২-০৭-০৮ কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী যদি প্রচলিত নিয়মানুযায়ী হিসেব লিপিবদ্ধ না করে মর্জিমাফিক হিসেব লিপিবদ্ধ করে, সেক্ষেত্রে তার উপর প্রথম সাহসদণ্ড বা আড়াই শত পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি উত্তম-মধ্যম- অধম বস্তুর ধারাক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বা একই বস্তুর হিসেব একাধিকবার লিপিবদ্ধ করে রাখে, সেক্ষেত্রে তার উপর দ্বাদশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

যে নিবন্ধনকারী কর্মচারী হিসেবের অর্থ আত্মসাৎ করবে, নট নর্তকীদের অর্থদান করে হিসেব গরমিল করবে, হিসেব সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য প্রদান করবে, তার উপর যথাক্রমে ৯৬ পণ, ৬০ পণ এবং চুরিরতুল্য অপরাধের জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো পর্যায়ে যদি মহাহিসাবরক্ষক তুচ্ছ অপরাধ করেন, তাহলে রাজা তা মার্জনা করবেন। তার প্রচেষ্টায় যদি রাজকোষের আয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে রাজা তাকে অলঙ্কারাদি অর্পণপূর্বক পরিতুষ্ট এবং সম্মানিত করে আজীবন দায়িত্বে বহাল রাখবেন।

অষ্টম অধ্যায় ॥ ২৬ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রাজকোষের বৃদ্ধি, অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্র এবং অপহৃত ধন পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোকপাত করত এ বিষয়ক করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

০২-০৮-০১ অভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধি, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং শাসনকার্যের সকল কার্যক্রমই আর্থিক সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। এ কারণে রাজকোষের সমৃদ্ধি এবং ক্ষয়ের ব্যাপারে রাজাকে সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে যে নয়টি উপায়ে রাজকোষ বৃদ্ধি করা যেতে পারে তা হলো; ১. প্রচার সমৃদ্ধি বা রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজা তার রাজস্ব আহরণের পরিধি বিস্তৃত করতে পারেন ২. চরিত্রানুগ্রহ বা দেশ জাতি কুলের উন্নত মান রক্ষা করা ৩. চোরগ্রহ বা চোর ডাকাতের উপদ্রব নিবারণ, প্রয়োজনে তাদের হত্যা করা ৪. যুক্তপ্রতিষেধ বা প্রশাসকরা যেন রাজকোষের ধন আত্মসাৎ, প্রজা পীড়ন এবং উৎকোচ গ্রহণ করতে না পারে সে দিকে নজর রাখা ৫. শস্যসম্পদ তথা ধানসহ সকল প্রকার শস্য উৎপাদনে সচেষ্ট থাকা ৬. পণ্যবাহুল্য তথা অধিক পরিমাণে জলজ ও স্থলজাত পণ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হওয়া ৭. উপসর্গ-প্রমোক্ষ বা অগ্নি, বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশ ও নিজেকে রক্ষাকরণ ৮. পরিহার ক্ষয় বা অহেতুক কাউকে কর প্রদান থেকে অব্যাহতি না দেওয়া ৯. হিরণ্যোপায়ন বা প্রজাদের কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে অর্থ, স্বর্ণ বা রৌপ্য গ্রহণ। এই নয়টি বিষয়ে যদি রাজা সচেতন থাকেন তাহলে তার রাজকোষ বৃদ্ধি পাবে।

০২-০৮-০২

০২-০৮-০৩ যে আটটি কারণে রাজকোষের ক্ষতি সাধিত হয় তা হলো—

১. প্রতিবন্ধ। প্রতিবন্ধ তিন ধরনের হতে পারে (ক) সিদ্ধি বা কর আদায়ের সময় হওয়া সত্ত্বেও যদি তা যথা সময়ে আদায় করা না হয় (খ) অনবতারণ বা কর প্রদান করা হলেও তা যদি রাজকর্মচারী কর্তৃক গৃহীত না হয় (গ) অপ্ৰবেশন বা কর গ্রহণ সত্ত্বেও যদি তা নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ না করা হয়। এই তিন প্রকার দায়িত্বহীনতার জন্য রাজকোষের যে ক্ষতি সাধিত হবে সেজন্য দায়ী কর্মচারীকে ক্ষতিকৃত অর্থের দশগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

২. প্রয়োগ বা রাজস্ব হিসেবে সংগৃহীত অর্থ রাজকোষে জমা প্রদান না করে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কর্তৃক নিজের মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করা

৩. ব্যবহার বা রাজকোষে জমাযোগ্য পণ্য দিয়ে নিজের মুনাফার জন্য ব্যবসা করা। এক্ষেত্রে অপরাধীকে কৃত ব্যবসায় উপার্জিত অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

৪. অবস্তার। অবস্তার দুই ধরনের হতে পারে (ক) নির্ধারিত সময়ে রাজস্ব প্রদান সত্ত্বেও যদি ঘুষ গ্রহণের জন্য কর্মচারী কর্তৃক জমাকৃত রাজস্বের সময় হেরফের করা হয় (খ) রাজস্ব প্রদানের সময় না হওয়া সত্ত্বেও উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে রাজস্ব ধার্যকরণ। এই দুই কারণে রাজস্বের যে ক্ষতি সাধিত হবে, দায়ী কর্মচারীকে সে ক্ষতির দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

৫. পরিহাপণ বা কোনো কর্মচারী কর্তৃক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নির্ধারিত রাজস্বের হ্রাস-বৃদ্ধিকরণ। এর ফলে রাজস্বের যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হবে দায়ী কর্মচারীকে তার চারগুণ অর্থ জরিমানা বাবদ প্রদান করতে হবে।

৬. উপভোগ বা রাজভাণ্ডারে জমাযোগ্য দ্রব্যের আত্মসাৎ। এ ক্ষেত্রে সাধারণ দ্রব্য আত্মসাৎ করা হলে অপরাধীকে ৫০০ পণ বা দ্রব্যের মূল্যমানের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। রত্নাদি আত্মসাৎ করা হলে অপরাধীকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

৭. পরিবর্তন বা রাজার জন্য প্রদত্ত দ্রব্য পরিবর্তন করে অন্য দ্রব্য প্রদান। এক্ষেত্রে অপরাধীকে উপভোগ দোষের মতো দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

৮. অপহার বা প্রাপ্ত আয় নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ না করা, রাজাদেশ মোতাবেক দানকৃত অর্থ প্রদান না করে লিপিবদ্ধকরণ, প্রাপ্ত অর্থ অপ্রাপ্ত হিসেবে লিপিবদ্ধকরণ। এ সমস্ত কারণে যে ক্ষতি সাধিত হবে সেজন্য অপরাধীকে জরিমানা হিসেবে দ্বাদশ পণ প্রদান করতে হবে।

০২-০৮-০৪ আয় ব্যয়ের হিসাবরক্ষণ কাজে নিযুক্ত কর্মচারীরা নিম্নোক্ত ৪০টি পন্থা অবলম্বন করে রাজদ্রব্য বা অর্থ আত্মসাৎ করতে পারে—

১. পূর্বে উৎপন্ন শস্যকর আদায় করা সত্ত্বেও সময়মতো হিসেবভুক্ত না করে পরবর্তী সময়ে আদায়কৃত রাজস্বের সাথে তা প্রদর্শনপূর্বক আত্মসাৎ। ২. একই তরিকায় ভবিষ্যতে আদায়যোগ্য করের পরিমাণ পূর্ববর্তী হিসেবের সাথে হিসেবভুক্ত করে আদায়তব্য কর আত্মসাৎ।

৩. নির্ধারিত কর আদায় না করে করদাতার কাছ থেকে অবৈধ অর্থ গ্রহণপূর্বক সমঝোতাকরণ।

৪. ভয় ভীতি প্রদর্শনপূর্বক করমুক্ত ক্ষেত্র থেকে অবৈধ পন্থায় কর আদায় করে আত্মসাৎ।

৫. করদাতা কর্তৃক নির্ধারিত কর পরিশোধ সত্ত্বেও নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ না করে বকেয়া দেখিয়ে তা আত্মসাৎ।

৬. অঞ্চলভেদে নির্ধারিত কর আদায় করা সত্ত্বেও নিবন্ধন পুস্তকে অর্ধেক পরিমাণ লিপিবদ্ধ করত অবশিষ্টাংশ পরবর্তী সময়ে আদায় যোগ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করে তা আত্মসাৎ।

৭. ক্ষেত্র বিশেষে সম্পূর্ণ আদায় সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও পূর্ণকর উসুল লিখে ভবিষ্যতের জন্য আত্মসাতের পথ উন্মুক্তকরণ।

৮. বেশি পরিমাণে কর আদায় সত্ত্বেও নিবন্ধন পুস্তকে অল্প পরিমাণ

লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে বাড়তি অর্থ আত্মসাৎ।

৯. প্রাপ্ত রাজস্বের গুণগত মান পরিবর্তনের মাধ্যমে আত্মসাৎ। যেমন— উন্নতজাতের ধান গ্রহণ করে খাতায় নিম্নজাতের ধান লিপিবদ্ধকরণ। ১০. এক ব্যক্তির কর অন্য ব্যক্তির নামে লিখে রেখে আদায়কৃত অর্থ আত্মসাৎ।

১১. রাজা কর্তৃক বরাদ্দকৃত দ্রব্যের হেরফের ঘটিয়ে আত্মসাৎ। এক্ষেত্রে রাজা কর্তৃক কাউকে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ছল চাতুরির মাধ্যমে স্বর্ণ প্রদান না করে অন্য কমমূল্যের দ্রব্য প্রদান করে তা আত্মসাৎ।

১২. কোনো অনুষ্ঠানের জন্য রাজা কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থ বা দ্রব্য সময়মতো সরবরাহ না করে আত্মসাৎ।

১৩. রাজার বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোটা পরিশোধ না করে আংশিক পরিশোধ করে অবশিষ্ট অংশ আত্মসাৎ।

১৪. রাজার বরাদ্দকৃত দ্রব্যের পরিমাণগত হেরফের ঘটিয়ে দ্রব্য আত্মসাৎ। ১৫. রাজা কর্তৃক মূল্যবান দ্রব্য বরাদ্দ সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে কম মূল্যবান দ্রব্য সরবরাহ করে মূল্যবান দ্রব্য আত্মসাৎ।

১৬. একজনের বরাদ্দ অন্যজনের নামে লিখে রেখে আত্মসাৎ।

১৭. রাজার নামে মিথ্যে আদেশপত্র জারির মাধ্যমে বলপূর্বক অর্থ আদায় করত আত্মসাৎ।

১৮. কর আদায় করেও নিবন্ধন পুস্তকে আদায় হয়নি লিপিবদ্ধ করে আদায়কৃত অর্থ আত্মসাৎ।

১৯. বনজ সম্পদ সংগ্রহ প্রাক্কালে ক্রয়কৃত মূল্যের কিয়দংশ পরিশোধ করে সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধিত লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে অবশিষ্ট অর্থ আত্মসাৎ।

২০. অধিক মূল্যে বনজ দ্রব্য ক্রয় করে নিবন্ধন পুস্তকে স্বল্পমূল্য প্রশদনপূর্বক আত্মসাৎ।

২১. পিওকর বা যৌথকর আদায় সত্ত্বেও পৃথক পৃথকভাবে তা নিবন্ধন পুস্তকে প্ৰদৰ্শন।

২২. প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পৃথক পৃথকভাবে কর আদায়যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও যৌথভাবে তা আদায়করণ।

২৩. বাহন ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃতমূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য প্রদর্শনপূর্বক উদ্বৃত্ত অর্থ আত্মসাৎ।

২৪. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে সুলভপণ্য দুর্লভ করে ক্রেতা সাধারণকে অধিক মূল্যের পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করে আয়কৃত উদ্বৃত্ত অর্থ আত্মসাৎ।

২৫. উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পণ্যের নির্ধারিত মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য হাতিয়ে নেওয়া।

২৬. নির্ধারিত পণ্যমূল্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হ্রাস করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির সম্মুখীন করে দরকষাকষির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ২৭. প্রকৃত কর্ম দিবসের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রদেয় মজুরি আত্মসাৎ। ২৮. নির্ধারিত কর্মদিবসের কাজ কম দিনে করিয়ে মজুরির অর্থ আত্মসাৎ। ২৯. বছরের মোট দিবস সংখ্যায় কারচুপি ঘটিয়ে প্রদেয় বেতন ভাতা আত্মসাৎ। ৩০. মাসের দিবস সংখ্যার তারতম্য ঘটিয়ে প্রদেয় বেতন ভাতা আত্মসাৎ।

৩১. কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের সংখ্যার তারতম্য প্রদর্শনপূর্বক ভাতাদি আত্মসাৎ।

৩২. আয়ের উৎসের তারতম্য ঘটিয়ে অর্থ আত্মসাৎ।

৩৩. ব্রাহ্মণ, পুরোহিতদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বৈষম্য ঘটিয়ে আত্মসাৎ।

৩৩. কর আদায়ের ছলে বলপূর্বক অর্থ আদায় করে আত্মসাৎ।

৩৫. যৌথ কর আদায়ের ক্ষেত্রে কাউকে কাউকে অব্যাহতি প্রদান করে তাদের প্রদত্ত কর আত্মসাৎ।

৩৬. নদী পারাপারের মিথ্যে হিসাব বা স্বর্ণে ভেজাল দিয়ে খাঁটি স্বর্ণ আত্মসাৎ।

৩৭. সেনাশিবিরে প্রকৃত সরবরাহের চেয়ে কম দ্রব্য সরবরাহ করে অবিশিষ্ট দব্য আত্মসাৎ।

৩৮. জাল বাটখারার মাধ্যমে ওজনের তারতম্য ঘটিয়ে ক্রয়কৃত বা বিক্রিত দ্রব্যের অংশবিশেষ আত্মসাৎ।

৩৯. বস্ত্রের পরিমাপের তারতম্য ঘটিয়ে আত্মসাৎ।

৪০. রাজার আদেশ মোতাবেক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাত্র (যেমন ঘৃতপাত্র) সরবরাহ না করে কম পাত্র সরবরাহ করে অবশিষ্টাংশ আত্মসাৎ। এই ৪০টি উপায়ে বা পন্থায় হিসেব সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত রাজকর্মচারীদের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজভাণ্ডারের অর্থ ও দ্রব্য আত্মসাৎ করা হয়ে থাকে।

০২-০৮-০৫ বর্ণিত আত্মসাৎ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকার ব্যাপারে কোনো কর্মকর্তার প্রতি সন্দেহের উদ্রেক হলে রাজা সংশ্লিষ্ট কাজে নিযুক্ত কর্মচারী, ভাণ্ডাররক্ষক, হিসাবরক্ষক, অর্থ বা দ্রব্যগ্রহীতা, করদাতা, কর প্রদানে বাধ্যকারী কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের এ বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আত্মসাতের সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিদের কেউ যদি মিথ্যে তথ্য প্রদান করেন, সেক্ষেত্রে তাদেরও অপরাধী কর্মকর্তার সমতুল্য দণ্ড ভোগ করতে হবে। রাজা জনপদে ঢোল পিটিয়ে প্রজাদেরকে উৎপীড়নের ব্যাপারে অভিযোগ দায়েরের আহ্বান জানাবেন। এক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তা যদি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং সেক্ষেত্রে একাধিক অভিযোগের একটি অভিযোগও যদি সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, তাহলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তি আরোপিত হবে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গৃহীত উৎকোচের অর্থ আদায় করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে তা প্রত্যর্পণ করতে হবে। কোনো পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি স্বর্ণ, রৌপ্য বা মূল্যবান দ্রব্য আত্মসাতের অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং এর কিয়দংশও যদি সাক্ষ্য প্রমাণের দ্বারা প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে সমুদয় সম্পদ প্রত্যর্পণ করতে হবে।

০২-০৮-০৬ কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে অর্থ বিষয়ক গরমিল সংঘটিত হলে বিষয়টি গোপন তথ্যদাতার (Informer) মাধ্যমে নিরীক্ষা করাতে হবে। এক্ষেত্রে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটিত হলে উদ্ঘাটনকারী ব্যক্তি পুরস্কার হিসেবে গরমিলকৃত অর্থের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করবেন। যদি কোনো ভৃত্য কোনো কর্মকর্তার আত্মসাৎকৃত অর্থের সন্ধান প্রদান করেন, সেক্ষেত্রে তিনি ওই অর্থের এক দ্বাদশাংশ পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত হবেন। তথ্যদাতা যদি কোনো কর্মকর্তার বহু প্রকার আত্মসাতের সন্ধান প্রদান করেন এবং এর কিয়দংশও যদি প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে তিনি অপহৃত অর্থের এক ষষ্ঠাংশ পুরস্কার হিসেবে লাভ করবেন। কোনো তথ্যদাতা যদি কারো বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ উত্থাপন করেন, তাহলে তার উপর আর্থিক জরিমানা বা শারীরিক শাস্তি প্রযুক্ত হবে। তাকে কোনোভাবেই মার্জনা করা হবে না। তথ্যদাতা ইচ্ছে করলে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কর্মকর্তার চাপের মুখে, উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে বা অন্যভাবে প্রলুব্ধ হয়ে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারবেন না। একবার অভিযোগ উত্থাপন করে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে কেউ যদি অভিযোগ প্রত্যাহারে সচেষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে অভিযোগকারীর উপর বধদণ্ড প্রযুক্ত হবে।

নবম অধ্যায় ॥ ২৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের চারিত্রিক দোষ, বিশ্বস্ততা এবং গুণাবলির উপর আলোকপাত করত এ বিষয়ক নানা দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

০২-০৯-০১ কার্য সম্পাদনের সক্ষমতা এবং গুণাবলি অনুযায়ী কর্মকর্তাদের উপযুক্ত পদে পদায়ন আবশ্যক। রাজা উপযুক্ততার মানদণ্ডে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে পদায়ন করবেন এবং তাদের রাজদ্রোহীতাসহ অন্যান্য দোষ অন্বেষণে সচেষ্ট থাকবেন। আদতে মানুষ হলো অশ্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। শান্ত স্বভাবের হলেও অশ্ব যেমন রথ চালনায় নিযুক্তির পর অস্থির হয়ে ওঠে এবং তাকে চালিত করার জন্য লাগাম টেনে ধরা আবশ্যক হয়ে পড়ে, তেমনি সাধারণ মানুষেরা সুশীল হিসেবে প্রতিভাত সত্ত্বেও কর্মে নিযুক্তির পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে, বিধায় তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ কারণেই কর্মকর্তাদের চারিত্রিক পরীক্ষণ অত্যাবশ্যক। এসব কারণে রাজা তার দ্বারা নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সম্পর্কে, যে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে, পদায়িত স্থান সম্পর্কে, কর্মের ক্ষেত্র সম্পর্কে, পদায়নের কাল সম্পর্কে, আপকালে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে, নির্ধারিত করণীয় সম্পর্কে, প্রদেয় বেতন সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকবেন। তারা যেন একে অপরের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে রাজকার্যের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত হতে না পারে কিংবা একে অপরের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা চরিতার্থ করতে সক্ষম না হয়, সে ব্যাপারে রাজা নজরদারি জারি রাখবেন। তারা কখনোই প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অগ্নিকাণ্ডজনিত আপদকালীন প্রতিকার ছাড়া কোনো কাজই রাজাকে অবহিত না করে সম্পাদন করবেন না। কর্মকর্তাদের মাদকাদোষ বা নারী প্রমাদে লিপ্ততার কারণে যদি রাজকার্যের ক্ষতি সাধিত হয় সেক্ষেত্রে ক্ষতিকৃত অর্থমূল্যের দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। অধিকন্তু কার্যহানিজনিত কারণে ওই দিনের বেতন কর্তন করতে হবে।

০২-০৯-০২ কর্মকর্তাদের যারা রাজার অভিপ্রায় অনুযায়ী নির্দেশিত কর্ম সম্পাদনে সফল হবেন, তারা পদোন্নতি লাভসহ সম্মানিত হবেন। এক্ষেত্রে প্রাচীন আচার্যদের অভিমত এই যে, যারা স্বল্প আয় করে অধিক ব্যয় করেন তারা প্রকারান্তরে রাজা ও প্রজার অর্থ ভক্ষণ করে থাকেন। এর বৈপরীত্য হলে তারা এই দোষে দুষ্ট হন না। এক্ষেত্রে কৌটিল্যের মত হলো রাজা গুপ্তচরদের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের আয় ব্যয়ের অসঙ্গতি সম্পর্কে অবহিত হবেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে যারা রাজকোষের ক্ষতিসাধন করবে তারা দ্বিগুণ, তিনগুণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আরও অধিকগুণ ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য থাকবে।

০২-০৯-০৩ যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক কর আদায় করেন, সে কর্মকর্তা প্রকৃতপক্ষে জনগণকে পীড়ন করে জনপদকে ভক্ষণ করেন। এই প্রকৃতির কর্মকর্তা রাজকোষে অধিক অর্থ জমা প্রদান করলেও তিনি রাজা কর্তৃক স্বীয় কর্মের জন্য নিরুৎসাহিত হবেন। অধিকন্তু তিনি যদি প্রজা পীড়নের মাধ্যমে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ কর সংগ্রহ করেন, সেক্ষেত্রে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়ে শাস্তি ভোগ করবেন। যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় না করে আয় হিসেবে রাজকোষে জমা প্রদান করেন, তিনি প্রকারান্তরে রাজকার্যের ক্ষতিসাধন করেন। যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্দিষ্ট দিনে সম্পন্নেয় কাজ সম্পাদন না করে কর্ম দিবসের হেরফের করে নির্দিষ্ট দিনের বেতন আত্মসাৎ করবেন, তাকে ওই কৃতকর্মের জন্য রাজকার্যের ক্ষতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।

০২-০৯-০৪ যে সব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মূলহর তথা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থনাশ করেন। তাদাত্বিক তথা যিনি প্রতিদিনের আয় অসৎ পথে খরচা করেন এবং কদর্য তথা যিনি ভৃত্যদের ও নিজেকে পীড়ন করে ধন সম্পদ সঞ্চয় করেন। রাজা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন এবং এ সমস্ত কাজ থেকে তাদের নিবৃত্তকরণে সচেষ্ট হবেন। প্রয়োজনে তাদের পদচ্যুত করবেন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তাদের ধন সম্পদ অধিগ্রহণ করবেন।

০২-০৯-০৫ যে সমস্ত কদর্য ব্যক্তি তাদের ধন সম্পদ গোপনীয় স্থানে লুকিয়ে রাখেন, ভবিষ্যতে ভোগের জন্য জনপদের অন্যত্র স্থানান্তর করেন বা শত্রু রাজ্যে প্রেরণ করেন, তাদের সম্পর্কে সত্রী নামের গুপ্তচররা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে রাজাকে অবহিত করবেন। এ ছাড়া যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কদর্যরূপে আহরিত অবৈধ ধন সম্পদ শত্রুরাজ্যে প্রেরণে প্রবৃত্ত হবেন, সত্ৰী নামক গুপ্তচররা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ছলনার মাধ্যমে সুকৌশলে তাদের হত্যা করবে। (সে সময়েও বিদেশে অর্থ পাচারের চল ছিল—লেখক।)

০২-০৯-০৬ রাজার ধন আত্মসাতের অপরাধে মুখ্য কর্মকর্তাকে যাতে শাস্তি ভোগ করতে হয় সেজন্য রাজা হিসাবরক্ষক, মুদ্রা যাচাইকারী, স্থিতিপত্র প্রণয়নকারী, রাজার সেনাবাহিনী সম্পর্কে পরিজ্ঞাত কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে তাদের সাক্ষী রেখে শাস্তি প্রদানে সচেষ্ট হবেন। রাজার অধিকরণ তথা কার্যালয় অনেক মুখ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে পরিচালিত হবে, এতে করে ক্ষমতার ভারসাম্য সংরক্ষিত হবে এবং একে অপরের ভয়ে কোনো অনর্থ সংঘটনে বা অর্থ আত্মসাতের জন্য প্রলুব্ধ হবেন না।

০২-০৯-০৭ কোনো ব্যক্তি যেমন জিহ্বার নিচে মধু বা বিষ রেখে তা আস্বাদন থেকে বিরত থাকতে পারে না, তেমনি রাজার অর্থ রক্ষায় নিযুক্ত কোনো কর্মচারীও শাস্তির ব্যাপারে সম্যক পরিজ্ঞাত হয়েও স্বল্প পরিমাণে হলেও অর্থ আত্মসাৎ না করে স্থির থাকতে পারে না। এছাড়াও মৎস্যরা যেমন পানিতে বিচরণ প্রাক্কালে যে পানি পান করে তা স্থলে বসবাসকারী কারো পক্ষে জানা সম্ভব হয় না, তেমনি অর্থ বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যদি অর্থ অপহরণ বা আত্মসাৎ করে থাকে, তা রাজার পক্ষে জানা সম্ভব হয় না।

০২-০৮-০৮ আকাশে বিচরণশীল পাখিদের গতি প্রকৃতি সম্পর্কেও মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব, কিন্তু অর্থ বিষয়ক দায়িত্বে নিয়োজিত রাজ কর্মচারীরা কোন তরিকায় সন্তর্পণে অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন, রাজার পক্ষে সে-সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়া অসম্ভব। এহেন পরিস্থিতিতে যে সমস্ত কর্মকর্তা অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করবেন, রাজা তাদের সম্পর্কে গুপ্তচরদের মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে আহরিত ধন বলপূর্বক ছিনিয়ে নিবেন এবং তাদের কর্মচ্যুত করবেন বা পদাবনতি ঘটাবেন। এভাবে পদাবনতি করা হলে পদস্থ কর্মকর্তাদের মনে ভীতির সঞ্চার হবে এবং সে-কারণে তারা অপকর্মে নিরুৎসাহিত হবেন। যে সমস্ত কর্মকর্তা সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে রাজার ধন সম্পদ হেফাজতকরণে সচেষ্ট থাকবেন, রাজার সম্পদ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকবেন, রাজা তাদের স্বপদে বহাল রাখবেন এবং কখনো তাদের কর্মের বিপর্যয় ঘটাবেন না।

দশম অধ্যায় ॥ ২৮ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়কে শাসনাধিকার নামে অভিহিত করা হয়েছে। রাজ্য পরিচালনার প্রয়োজনে বিভিন্ন পর্যায়ে রাজাকে বা রাজ প্রশাসনকে চিঠিপত্র লিখতে হয়। এ সমস্ত চিঠি কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে লিখতে হবে সে সম্পর্কে এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

০২-১০-০১ ভূর্জপত্রে এবং তালপত্রে লিখিত রাজার আদেশ নির্দেশ আচার্যগণ কর্তৃক শাসন নামে অভিহিত। রাজাগণ রাজ্য শাসনের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে নির্বাহের জন্য লিখিত আদেশ নির্দেশের উপর বেশি নির্ভরশীল। তারা কখন কোন রাজ্যের সঙ্গে সন্ধি করবেন, কখন কোন রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন ইত্যাকার বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় লিখিত ও প্রেরিত পত্রের আলোকেই নিরূপিত হয়ে থাকে। এ কারণে শাসনের বা পত্র লিখনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম বলে স্বীকৃত। পত্রের এই গুরুত্ব বিবেচনায় শাসনের লেখককে হতে হবে অভিজাত ও অমাত্যের গুণাবলি সম্পন্ন, সব বর্ণের সম্প্রদায় সম্পর্কে সম্যক অবহিত, বাক্য সৃজনে ও গঠনে সক্ষম, সুন্দর হস্তাক্ষরের অধিকারী, সুপঠন যোগ্য লেখক। প্রেরিত পত্রের উত্তরদান প্রাক্কালে পত্র লেখককে পত্রের সংকেত, ইঙ্গিত, উপমা, উপেক্ষার প্রতি সম্যক দৃষ্টি রেখে প্রত্যুত্তর লিখতে হবে, স্থান কাল পাত্র সম্পর্কে উল্লেখ করতে হবে।

০২-১০-০২ রাজকার্য বিষয়ক পত্র লেখার সময় লেখক যার প্রতিনিধিত্ব করবেন, যার সম্পর্কে লেখনি লিখবেন তার সম্পর্কে নিম্নোক্ত ১১ টি বিষয় উদ্ধৃত পূর্বক লেখনি সম্পন্ন করবেন—১. জাতি তথা জাতিবর্ণ ২. কুল ৩. স্থান ৪. যৌবনাদি ৫. বিভিন্ন শাস্ত্রজ্ঞান ৬. কর্ম ৭. ধন সম্পদ ৮. সদাচার ৯. বাসস্থান ১০. কাল ১১. বৈবাহিক অবস্থা। যাদের কাছে পত্র প্রেরিত হবে তাদের মর্যাদার মতো করে পত্রের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হবে।

০২-১০-০৩ পত্র লেখনের বা শাসনের গুণ হলো ছয়টি। পত্র লিখনের সময় এই ছয়টি গুণ আমলে নিয়ে পত্র লিখন আবশ্যক। এই ছয়টি গুণ হলো; ১. অর্থক্রম—পত্র লেখার সময় বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ আবশ্যক ২. সম্বন্ধ—পত্রের সূচনা ও সমাপ্তির সামঞ্জস্য এবং পূর্বলিখিত পত্রের সমাপ্তির সঙ্গে পরবর্তী পত্রের সূচনার ধারাহিকতা সংরক্ষণ ৩. পরিপূর্ণতা—পত্রের বক্তব্যে অক্ষরের অতিরঞ্জন পরিহার। প্রয়োজনীয় শব্দ প্রয়োগ ৪. মাধুর্য—পত্রে সুন্দর ও সুখবোধ্য অর্থবোধক শব্দ প্রয়োগ করতে হবে ৫. ঔদার্য—পত্রে বাহুল্য ও মানহীন শব্দ পরিহার করতে হবে ৬. স্পষ্টত্ব –প্রাঞ্জল ভাষা ও অর্থযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে হবে।

০২-১০-০৪

০২-১০-০৫ লেখায় যে সমস্ত বাক্য ব্যবহার করা হয়, সে-সমস্ত বাক্য কতিপয় পদের সমষ্টি। এ সমস্ত পদ আবার অক্ষরের সৃষ্ট। যে কোনো পত্ৰ ‘ইতি’ দিয়ে সমাপ্ত করতে হবে। অতঃপর আরও বক্তব্য অনুল্লেখ্য বলে বিবেচিত হলে তা পত্র বাহকের মাধ্যমে প্রাপককে জ্ঞাত করাতে হবে।

০২-১০-০৬ নিম্নোক্ত তের প্রকৃতির পত্র হতে পারে—১. নিন্দাপত্র — দোষণীয় বিষয়কে উপজীব্য করে লিখিত ২. প্রশংসাপত্র—গুণাবলিকে উপজীব্য করে লিখিত ৩. পৃচ্ছাপত্র—কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়ে লিখিত ৪. আখ্যানপত্র—পরামর্শ প্রদানপূর্বক লিখিত ৫. অর্থনাপত্র—কোনোকিছু যাচনাপূর্বক লিখিত ৬. প্রত্যাখানপত্র—কোনো আবদার

আবদার নাকচপূর্বক লিখিত ৭, উপালম্ভপত্র-ঔচিত্য সম্পর্কিত লিখিত ৮. প্রতিষেধপত্র—কোনোকিছু করতে নিষেধ করে লিখিত ৯. চোদনাপত্র—যুদ্ধ বা সন্ধি স্থাপনের বিষয়ে লিখিত ১০. সান্তপত্র—সান্তনা প্রদানপূর্বক লিখিত ১১. অভ্যবপত্তিপত্র—ভবিষ্যত সতর্কতা অবলম্বন সম্পর্কিত লিখিত ১২. ভর্ৎসনপত্র—কৃতকর্মের পরিণতি সম্পর্কিত লিখিত ১৩. অনুনয়পত্র—এই প্রকার পত্র তিন ধরনের (ক) অর্থকরণনিমিত্তক যুথবদ্ধভাবে কোনো কাজ করার জন্য অনুরোধ পত্র (খ) অতিক্রমনিমিত্তক- কারো মতানুসারে কাজ না করার পরিপ্রেক্ষিতে উত্থিত ক্ষোভ প্রশমনের জন লিখিত অনুরোধ পত্র (গ) পুরুষাদিব্যসননিমিত্তিক—পিতা, মাতা, পুত্র, ভ্রাতা, অমাত্য বা আপনজনের মৃত্যুতে সময়মতো শোক জ্ঞাপনে অপরাগতা হেতু উদ্ভূত অসন্তুষ্টি নিরসনকল্পে লিখিত পত্র।

০২-১০-০৭ রাজলেখ বা শাসন আট প্রকার; ১. প্রজ্ঞাপন ২. আজ্ঞাপন ৩. পরিদান ৪. পরিহার ৫. নিসৃষ্টি ৬. প্রাবৃত্তিক ৭. প্রতিলেখ ৮. সর্বত্রগ। রাজ্য শাসন বা রাজাদেশ সংক্রান্ত যা ঘোষিত হয় তা প্রজ্ঞাপন হিসেবে খ্যাত।

০২-১০-০৮ যে পত্র কোনো ব্যক্তিকে বিশেষত রাজকর্মচারী বা রাজভৃত্যকে নিগ্রহ বা অনুগ্রহের নিমিত্তে লেখা হয় তা আজ্ঞাপন হিসেবে খ্যাত। যে পত্র কারো গুণ বা সুকীর্তির স্বীকৃতির নিমিত্তে লেখা হয় তা পরিদান পত্র হিসেবে খ্যাত। ব্যক্তি, জনপদ, নগর বা জাতি বিশেষের কর মওকুফের নিমিত্তে যে পত্র লেখা হয় তা পরিহার পত্র হিসেবে খ্যাত।

০২-১০-০৯ যে পত্র কোনো বিশ্বস্ত লোকের প্রামাণ্যের আখ্যান হিসেবে লিখিত তা নিসৃষ্টি লেখ হিসেবে অভিহিত। যে পত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ সম্বলিত তা প্রাবৃত্তিক পত্র। কোনো পত্রের প্রতিউত্তরে যা লেখা হয় তা প্রতিলেখ। যে পত্র দুর্গপাল, রাষ্ট্রপাল, সমাহর্তাদের প্রতি লিখিত তা সৰ্বত্ৰগ।

০২-১০-১০ সন্ধি, বিগ্রহ বা যুদ্ধের বিষয়ে লিখিত পত্র চারটি উপায় বা প্রয়োগ কৌশলের উপর নির্ভরশীল। এ কারণে পত্র লেখককে ওই সব উপায়ের উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন আবশ্যক। উপায়গুলো হলো—১. সাম ২. উপপ্ৰদান ৩. ভেদ ৪. দণ্ড। এসব বিষয়ের মধ্যে সাম পাঁচ প্রকার: ক) গুণসংকীর্তন। খ) সম্বন্ধোপাখ্যান। গ) পরস্পরোপকারসন্দর্শন। ঘ) আয়তি প্রদর্শন। ঙ) আত্মোপনিধান। যে সাম প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুরাজা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের বংশ, শরীর, স্বভাব, সংস্কারের প্রশংসা করে পত্র প্রেরণ করা হয় তা গুণসংকীর্তন নামে অভিহিত।

০২-১০-১১ যে সামপ্রয়োগের মাধ্যমে জ্ঞাতি সম্বন্ধ, বৈবাহিক সম্বন্ধ, মৌখ সম্বন্ধ, সৌবসম্বন্ধ, কুল সম্বন্ধ, হৃদয় সম্বন্ধ, মিত্র সম্বন্ধ উদ্ধৃতিপূর্বক পত্র প্রেরণ করা হয় তা সম্বন্ধোপাখ্যান। যে সামভেদ প্রয়োগের মাধ্যমে পারস্পরিক উপকারের কথা বিধৃত করে পত্র প্রেরণ করা হয় তা পরস্পরোপকারসন্দর্শন। যে সামভেদ প্রয়োগের মাধ্যমে উভয়ের সুফল প্রাপ্তির প্রত্যাশা ব্যক্ত করে পত্র প্রেরণ করা হয় তা আয়তি প্রদর্শন। যে সামভেদ প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের সদিচ্ছা প্রকাশ করে পত্র প্রেরণ করা হয় তা আত্মোপনিধান।

০২-১০-১২ উপপ্রদান হলো কোনো বলশালী বা বিপক্ষীয় রাজাকে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে স্বপক্ষে আনয়ন বা শত্রুতা নিরোধ। ভেদ হলো কোনো শত্রুর মনে শঙ্কার সৃষ্টি করে ক্ষতি করার ভীতি প্রদর্শন। দণ্ড তিনভাবে প্রযুক্ত হতে পারে—(ক) বধ বা হত্যার মাধ্যমে (খ) কারাগারে অবরুদ্ধকরণের মাধ্যমে (গ) অর্থ আদায়ের মাধ্যমে।

০২-১০-১৩

০২-১০-১৪ উৎকৃষ্ট শাসন বা পত্র অবশ্যই ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। যে পাঁচটি দোষে সুপত্র ত্রুটিযুক্ত হতে পারে, তা হলো—১. অকান্তি—লেখা যদি মলিন পত্রে লিখিত হয়, কালি মাখানো পত্রে লিখিত হয়, অক্ষর যদি স্থুল বা অসুন্দর হয় তবে তা হবে অকান্তি দোষে দুষ্ট ২. ব্যাঘাত—ইতিপূর্বে ব্যবহৃত শব্দের সঙ্গে পরবর্তী পত্রে ব্যবহৃত শব্দ যদি সাংঘর্ষিক হয় তবে তা হবে ব্যাঘাত দোষে দুষ্ট ৩. পুনরুক্ত—একই বিশেষণ বা শব্দ যদি কোনো কারণ ছাড়াই অন্য শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে লিখিত হয়, তবে তা হবে পুনরুক্ত দোষে দুষ্ট ৪. অপশব্দ— লিঙ্গ, বচন, কাল ও কারকের যথার্থ প্রয়োগ না হয়ে বিচ্যুত প্রয়োগ পরিদৃষ্ট হলে, তা হবে অপশব্দ দোষে দুষ্ট ৫. সংপ্লব—প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যদি যতি বা বিরাম চিহ্ন প্রয়োগ না করে বাক্য গঠন করা হয়, তবে তা হবে সংপ্লব দোষে দুষ্ট।

একাদশ অধ্যায় ॥ ২৯ প্রকরণ ॥

রাজ কোষাগারে বা সংরক্ষণাগারে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য গুদামজাত, মজুদ বা সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত দ্রব্যের অন্যতম হলো মণি মানিক্য বা রত্ন সম্ভার। এ অধ্যায়ে রাজ কোষাগারে গ্রহণের পূর্বে ওই সমস্ত দ্রব্য বিশেষত মণি মাণিক্য কীভাবে যাচাই বাছাই করে গ্রহণ করতে হবে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

০২-১১-০১ কোষাধ্যক্ষ বা ভাণ্ডার অধিপতি কোষাগারের জন্য সংগৃহীত মণিমুক্তা, রত্ন, চন্দন, বনজদ্রব্য, অস্ত্র, বস্ত্র, ভোগ্যপণ্য ভালোমতো যাচাই বাছাই করে গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে প্রথমেই মুক্তার বিষয় আলোচিত। মুক্তার উৎপত্তি স্থানের ভিত্তিতে মুক্তাকে দশ নামে নামকরণ করা হয়। এই নামের মাধ্যমেই মুক্তার গুণাগুণ এবং উৎপত্তি স্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়। এ ধরনের দশটি মুক্তা হলো—১. তাম্রপর্ণিক—তাম্রপণী নদীর মোহনা হতে আহরিত মুক্তা ২. পাণ্ড্যকবাটক—পাণ্ড্যদেশে মলয়কোটি পর্বতে উৎপন্ন মুক্তা ৩. পাশিক্য— পাটালিপুত্রের পাশে প্রবাহিত পাশিকা নদী হতে আহরিত মুক্তা ৪. কৌলেয়- সিংহলদ্বীপের ময়ূরগ্রামের কুলা নদী হতে আহরিত মুক্তা ৫. চৌর্ণেয়—মুরচি নগরের কাছে প্রবাহিত চূর্ণী নদী হতে আহরিত মুক্তা ৬. মাহেন্দ্ৰ — মহেন্দ্ৰ পর্বতের পাদদেশের সমুদ্র হতে আহরিত মুক্তা ৭. কার্দমিক—পারসিক দেশের কর্দমা নদী হতে আহরিত মুক্তা ৮. স্রৌতসীয়—স্রোতয়ী নদীর মোহনা হতে আহরিত মুক্তা ৯. হ্রাদীয়—সিন্ধুনদের শ্রীঘণ্ট হ্রদ হতে আহরিত মুক্তা ১০. হৈমবত—হিমালয়ে উৎপন্ন মুক্তা।

০২-১১-০২ মুক্তার উৎস তিনটি যথা—১. শঙ্খ ২. ঝিনুক ৩. বিবিধ উৎস তথা হাতির মস্তক, বরাহের দাঁত, তিমি মাছ, সাপের ফনা, বাঁশ ও মেঘ। মানসম্মত মুক্তা আট প্রকার যেমন—১. মোটা ২. গোলাকার ৩. মসৃণ ৪. দীপ্তিমান ৫. শুভ্রবর্ণ ৬. ওজনদার ৭. স্নিগ্ধ ৮. যথার্থভাবে ছিদ্রযুক্ত।

এরই সাথে তের ধরনের নিম্নমানের মুক্তা হলো—১. মশুর ডালের আকৃতি বিশিষ্ট ২. ধান্যাকৃতি ৩. কুর্মাকৃতি ৪. অৰ্দ্ধচন্দ্রাকৃতি ৫. আবরণযুক্ত ৬. জোড়া লাগানো ৭. কর্তিত বা খণ্ডিত ৮. অমসৃণ ৯. বিন্দুযুক্ত ১০. কমণ্ডলু আকৃতি বিশিষ্ট ১১. কপিশবর্ণের ১২. নীলাভ ১৩. বিসদৃশ্যভাবে ছিদ্রযুক্ত।

০২-১১-০৩ পাঁচ প্রকৃতির মুক্তার মালার বৈশিষ্ট্য হলো—১. শীর্ষক— যার মধ্যবর্তী স্থানে একটি বড় মুক্তা এবং দুপাশে ছোট ছোট মুক্তা থাকবে ২. উপশীর্ষক—একটি বড় মুক্তার দুপাশে সমানাকারের দুটি ছোট মুক্তা গাঁথা থাকবে ৩. প্রকাণ্ডক—এ হারের মধ্যস্থলে একটি বড় মুক্তা এবং দুপাশে সমানাকারের দুটি করে ছোট মুক্তা গাঁথা থাকবে ৪. অবঘাটক—মধ্যস্থলে বড় মুক্তা এবং দুপাশে ক্রমশ ছোট মুক্তার সমাহারে গাঁথা মালা ৫. তরলপ্রতিবন্ধ—সমানাকৃতির মুক্তার সমাহারে গাঁথা মালা (এ সমস্ত মালা ছাড়াও হাজার এবং হাজারের অধিক মুক্তার সমাহারে গাঁধা আরও বহু রকমের রত্নাবলি ও মুক্তাহারের কথা বলা হয়েছে)।

০২-১১-০৪ মুক্তার পর মণির প্রসঙ্গ, আকরস্থান ভেদে মণি তিন প্রকার হতে পারে—১. কৌট—মলয়সাগরের কাছাকাছি কোটি নামক স্থানে এ মণির উৎপত্তি ২. মালেয়ক—মলয় দেশের কর্ণীবন পর্বতমালায় এর উৎপত্তি ৩. পারসমুদ্র—সিংহল দ্বীপস্থ রোহণ পর্বতে এর উৎপত্তি। এছাড়াও জাতি হিসেবে যে পাঁচ প্রকার মণি আছে তা হলো—১. সৌগন্ধিক—ঈষৎ নীলাভ রক্তবর্ণ পদ্মের মতো মণি ২. পদ্মরাগ—লাল পদ্মের রঙ বিশিষ্ট মণি ৩. অনবদ্যরাগ—কুমকুমের মতো রঙ বিশিষ্ট মণি ৪. পারিজাতপুষ্পক—পারিজাত ফুলের মতো মণি ৫. বালসূর্যক—উদিত সূর্যের মতো সূর্যবর্ণের মণি। এছাড়াও বৈদুর্য মণি আট ধরনের হতে পারে ১. লাল পদ্মের মতো ২. শিরীষ ফুলের মতো ৩. জলের মতো স্বচ্ছ ৪. বাঁশপাতার বর্ণ বিশিষ্ট ৫. শুকপাখির পেখমের মতো ৬. হলুদাভ ৭. গো- মূত্রের রঙ বিশিষ্ট ৮. গো-রোচনার রঙ বিশিষ্ট।

০২-১১-০৫ ইন্দ্ৰনীল মণি আট প্রকার হতে পারে—১. নীলাবলীয় ২. ইন্দ্ৰনীল ৩. কলায়পুষ্পক ৪. মহানীল ৫. জাম্বভাব ৬. জীমুতপ্রভ ৭. নন্দক ৮. প্রবন্মধ্য। এছাড়া স্ফটিক মণি চার প্রকার— ১. শুদ্ধ স্ফটিক ২. মূলাটবর্ণ ৩. শীতবৃষ্টি ৪. সূর্যকান্ত।

মণির যে একাদশ প্রকার গুণ থাকতে পারে তা হলো—১. ছয় কোণযুক্ত ২. চার কোণ বিশিষ্ট ৩. বৃত্তাকার ৪. ভাস্বর ৫. অলঙ্কারের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ৬. নির্মল ৭. মসৃণ ৮. ওজনদার ৯. দীপ্তিমান ১০. মধ্যভাগ চঞ্চলকান্তি ১১. অন্য বস্তুর উপর প্রভাব বিস্তারকারী।

০২-১১-০৬ মণির যে সাতটি ত্রুটি প্রণিধানযোগ্য তা হলো—১. মন্দরাগ বা ক্ষীণপ্রভা ২. মন্দপ্রভ বা যার দ্যুতি হ্রাস পেয়েছে ৩. সশর্কও বা ক্ষুদ্র দানাযুক্ত ৪. পুষ্পচ্ছিদ্র বা ছোট বিন্দু বিশিষ্ট ৫. খণ্ড বা কাটা দাগ বিশিষ্ট ৬. দুর্বিদ্ধ বা অযোগ্য স্থানে বিদ্ধ ৭. লেখাকীর্ণ বা দাগযুক্ত। এ সমস্ত ত্রুটিযুক্ত মণি ছাড়াও আরও ১৮ জাতীয় অবান্তর মণি আছে।

০২-১১-০৭ উৎপন্ন স্থানের নামানুসারে হীরক যে ছয় ধরনের হয়ে থাকে তা হলো—১. সভারাষ্ট্রক—সভারাষ্ট্র নামক স্থানে উৎপন্ন ২. মধ্যমরাষ্ট্রক—কোশল দেশে উৎপন্ন ৩. কাস্তীররাষ্ট্রক—কাশ্মীর দেশে উৎপন্ন (এ ব্যাপারে বিতর্ক আছে ৪. শ্রী কটনক—কটঙ্গ, কটঙ্গী গ্রামে উৎপন্ন ৫. মণিমন্তক—মণিমন্তক পর্বতে উৎপন্ন ৬. ইন্দ্ৰবানক—কলিঙ্গ দেশের ইন্দ্রবান অঞ্চলে উৎপন্ন। যদিও অন্যান্য অঞ্চলেও হীরক উৎপন্ন হয়ে থাকে তথাপি অঞ্চলের নামানুসারেই হীরকের নামকরণ করা হয়। সাধারণত যে তিনটি উৎস হতে হীরক উৎপন্ন হয়ে থাকে তা হলো—১. খনি ২. নদী বা জল প্রবাহ ৩. হাতির দাঁতের মূল।

হীরকের যে রঙগুলো প্রণিধানযোগ্য তা হলো—১. মার্জারাক্ষক বা বেড়ালের চোখের মতো রঙ বিশিষ্ট ২. শিরীষপুষ্পক বা শিরীষ ফুলের রঙ বিশিষ্ট ৩. গো- মূত্রক বা গো মূত্রের রঙ বিশিষ্ট ৪. গোমেদক বা গো রোচনের রঙ বিশিষ্ট ৫. শুদ্ধস্ফটিক বা স্ফটিকের মতো শুভ্র ৬. মূলাটীপুষ্পকবর্ণ বা মূলাটি পুষ্পের বর্ণ বিশিষ্ট এবং ৭. মুক্তার বিশেষ বিশেষ রঙ বিশিষ্ট।

০২-১১-০৮ হীরক আট ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে—১. স্থুল ২. স্নিগ্ধ ৩. ওজনদার ৪. অভেদ্য ৫. সমকোটিক ৬. ভাজন লেখি ৭. তর্কুভ্ৰামি ৮. অতিশয় দীপ্তিময়। তিন প্রকার নিকৃষ্ট প্রকৃতির হীরা হলো—১. কোণহীন হীরা ২. ধারহীন কোণ বিশিষ্ট ৩. অসামঞ্জস্য পার্শ্ব। প্রবালের উৎপত্তি স্থান দুটি—১. আলকন্দক তথা সিন্ধু নদীর মোহনায় আলকন্দক নামক স্থানের উৎপন্ন প্রবাল ২. বৈবর্ণিক বা যবনদ্বীপে সমুদ্রের একাংশে ববর্ণ নামক স্থানে উৎপন্ন প্রবাল। প্রবাল দু বর্ণের হয়ে থাকে—রক্তলাল ও পদ্মলাল।

০২-১১-০৯ চন্দনের উৎপত্তি স্থান ষোলটি। এর বর্ণ নয়টি, গন্ধ ছয় ধরনের এবং গুণ এগারোটি। উৎপত্তি স্থান, বর্ণ এবং গন্ধগুলো হলো— ১. সাতন দেশে উৎপন্ন চন্দন দেখতে রক্তবর্ণ এবং গন্ধ নবসিক্ত মৃত্তিকার গন্ধতুল্য ২. গোশীর্ষ দেশে উৎপন্ন চন্দনের রঙ কৃষ্ণ-রক্তবর্ণ এবং গন্ধ মৎস্যগন্ধ তুল্য ৩. হরিদেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ শুকপাখির পালকের মতো এবং এর গন্ধ আমের মতো ৪. তৃণসা নদীর তীরে উৎপন্ন চন্দন হরিদেশে উৎপন্ন চন্দনের গুণাগুণ সম্পন্ন ৫. গ্রামেরুক দেশে উৎপন্ন চন্দন রক্তবর্ণ বা রক্ত-কৃষ্ণ বর্ণ হয় এর গন্ধ হয় ছাগলের মূত্র বা কস্তুরীর মতো ৬. দেবসভা নামক স্থানে উৎপন্ন চন্দনের রঙ হয় রক্তবর্ণ এবং এর গন্ধ হয় পদ্মের মতো ৭. জাবক দেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ ও গন্ধ হয় দেবসভায় উৎপন্ন চন্দনের মতো ৮. জোঙ্গ দেশে উৎপন্ন চন্দন হয় রক্ত বা রক্ত- কৃষ্ণ বর্ণের মতো এবং এর গন্ধ পদ্মতুল্য ৯. তুরূপ দেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ ও গন্ধ জোঙ্গ দেশে উৎপন্ন চন্দনের গুণাগুণ সম্পন্ন ১০. মালা পর্বতে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ হয় পাণ্ডু রক্তবর্ণ এবং গন্ধ হয় পদ্মতুল্য ১১. কুচন্দন নামক চন্দন হয় কৃষ্ণবর্ণের মতো এবং এর গন্ধ হয় গো-মূত্রের মতো ১২. কালপর্বত দেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ হয় রুক্ষ, কৃষ্ণ, রক্তাভ এবং এর গন্ধ হয় গো-মূত্রতুল্য ১৩. কোষকার পর্বতজাত চন্দনের বর্ণ হয় কৃষ্ণ বর্ণের এবং এর গন্ধ গো-মূত্রের মতো ১৪. শীতোদকদেশে উৎপন্ন চন্দন হয় ঈষৎ পদ্মের মতো এতে এক প্রকার স্নিগ্ধ ভাব দৃশ্যমান, এর গন্ধ গো-মূত্রের মতো ১৫. নাগপর্বতে উৎপন্ন চন্দন রুক্ষ ও শৈবাল বর্ণের মতো হয় এবং এর গন্ধ হয় গো-মূত্রের মতো ১৬. শাকলদেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ হয় লাল হলুদের মিশ্রণের মতো এবং গন্ধ গো-মূত্রতুল্য।

০২-১১-১০ চন্দন যে সমস্ত গুণে গুণান্বিত তা হলো—১. ওজনে হালকা ২. স্নিগ্ধ ৩. বিলম্বে শুষ্ক হয় ৪. শরীরে মসৃণভাবে লেপন যোগ্য ৫. এর গন্ধ মানুষকে প্রীত করে ৬. শরীরে সুখ সঞ্চারক ৭. ত্বকের সাথে মিশে যায় ৮. লেপনের পরও সুগন্ধ ছড়ায় ৯. সূর্যরশ্মি থেকে ত্বকের উষ্ণতা প্রতিরোধ করে ১০. শরীরের সন্তাপ দূর করে এবং ১১. চন্দনের স্পর্শে শরীরে সুখানুভূতি অনুভূত হয়।

০২-১১-১১ ঘৃতকুমারীর তিন স্থলের উৎপত্তি, বর্ণ ও গন্ধ—১. জোঙ্গক তথা কামরূপ দেশের জোঙ্গ নামক স্থানে উৎপন্ন। এর বর্ণ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ ও শুভ্র মিশ্রিত এবং কৃষ্ণ ও বিন্দুযুক্ত ২. দোঙ্গক তথা কামরূপের দোঙ্গ নামক স্থানে উৎপন্ন। এর বর্ণ শ্যাম ৩. পারসমুদ্র তথা সিংহল দ্বীপাঞ্চলে উৎপন্ন। এর বর্ণ বৈচিত্র্যপূর্ণ। এসব ঘৃতকুমারীর গন্ধ উশীর বা নবমল্লিকার মতো। ঘৃতকুমারীর গুণগুলো হলো—ওজনবিশিষ্ট। মসৃণ। মনোরম গন্ধযুক্ত। বহুদূর প্রসারিত গন্ধগুণ সম্পন্ন। অগ্নিতাপে সহসা নিঃশেষ না হয়ে বহুক্ষণ গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। স্বল্প ঘনত্বের ধোঁয়া যা কাউকে ব্যাকুল করে না। দগ্ধকালে নিঃশেষ কাল পর্যন্ত সমগন্ধ যুক্ত। চূর্ণকালেও গন্ধের অক্ষুন্নতা।

০২-১১-১২ তৈলপর্ণিক’র (চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত চন্দনের মতো এক ধরনের সুগন্ধি) উৎপন্নস্থান ও এর গুণাগুণ—১. অশোকগ্রামে উৎপন্ন তৈলপর্ণিকের বর্ণ হয় হরিণের মাংসের মতো এবং গন্ধ পদ্মতুল্য ২. কামরূপের অন্তর্গত জোঙ্গ এলাকায় উৎপাদিত তৈলকার্ণিকের বর্ণ হয় রক্ত বা পীতের মতো এবং এর গন্ধ গো-মূত্রের গন্ধতুল্য ৩. কামরূপের গ্রামেরুক এলাকার উৎপাদিত তৈলপর্ণিকের বর্ণ হয় রক্ত বা পীত এবং এর গন্ধ গো-মূত্রের গন্ধতুল্য ৪. কামরূপের সুকর্ণকুড্য এলাকায় উৎপাদিত তৈলপর্ণিকের বর্ণ হয় রক্ত ও পীত বর্ণের, এর গন্ধ এক প্রকার লেবুর গন্ধতুল্য ৫. কামরূপের পূর্ণকদ্বীপে উৎপাদিত তৈলপর্ণিকের বর্ণ হয় রক্ত বা পীতের মতো, এর গন্ধ পদ্ম বা নবনীতের গন্ধতুল্য।

০২-১১-১৩ কালেয়ক নামক দু ধরনের সুগন্ধি কাঠের উৎপন্ন স্থান ও গুণাগুণ—১. যে কালেয়ক কাঠ সুবর্ণভূমি তথা সুমাত্রা দ্বীপে উৎপন্ন হয় তা মসৃণ এবং পীত বর্ণযুক্ত ২. যে কালেয়ক উৎপন্ন হয় উত্তর পর্বত বা হিমালয় অঞ্চলে তা হয় রক্ত বা পীতবর্ণযুক্ত। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সুগন্ধি কাঠের উৎপন্ন স্থান ও গুণাগুণ নিরূপিত। ( এতে পেবাঝা যায় সে-আমলে সুমাত্রার সাথে মগধের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল—লেখক)

অতঃপর বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপন্ন বনজ দ্রব্যের চর্ম সম্পর্কিত গুণাগুণ হলো— কান্তনব দেশে এবং প্রৈয় দেশে উৎপাদিত চর্মকে হিমালয়জাত চর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কান্তনাবক চর্মের বর্ণ ময়ূরের গ্রীবার বর্ণের মতো। প্ৰৈয়ক চর্মের বর্ণ নীল-পীত, শ্বেত রেখা ও বিন্দুর দ্বারা বৈচিত্র্যপূর্ণ।

০২-১১-১৪ হিমালয় দেশের দ্বাদশম্লেচ্ছগ্রাম নামক স্থানে উৎপন্ন চর্ম দু প্রকার—বিসী ও মহাবিসী। বিসীর বর্ণ সুনির্দিষ্ট নয় এটি বহুবর্ণের। এর চর্ম লোমযুক্ত এবং চিত্রিত। মহাবিসী খসখসে, এতে শুভ্র বর্ণের আধিক্য উদ্ভাসিত। এগুলোর দৈর্ঘ্য সাকুল্যে বারো আঙুল। হিমালয়ের আরোহ অঞ্চলের চর্ম পাঁচ ধরনের—১. শ্যামিকা ২. কালিকা ৩. কমলী ৪. চন্দ্রোত্তরা ৫. শাকুলা। এগুলো বিভিন্ন বর্ণের ও আকৃতির হয়ে থাকে।

০২-১১-১৫ হিমালয়ের বাহ্লব এলাকায় তিন ধরনের চর্ম উৎপন্ন হয়—১. সামুর ২. চীনসী ৩. সামূলী। এর মধ্যে সামুর হলো দৈর্ঘ্যে ছত্রিশ আঙুল এবং এর বর্ণ কাজলের মতো কালো। চীনসীর বর্ণ রক্তকৃষ্ণ বা পাণ্ডুকৃষ্ণ। সামূলীর রঙ গমের দানার মতো। এসবের দৈর্ঘ্যও ছত্রিশ আঙুল পরিমাণ। এ চামড়াগুলো স্থলচর মূষিক প্রাণীর দেহ হতে আহরিত হয়।

জলচর প্রাণী তথা উদ্রের তিন প্রকার চর্ম ও গুণাগুণ—১. কৃষ্ণ বর্ণের সাতিনা চর্ম ২. নল তৃণের বর্ণ বিশিষ্ট নলতুলা চর্ম ৩. কপিল বর্ণের বৃত্তপুচ্ছা চর্ম। এ ধরনের চামড়ার ত্রিবিধ গুণ—১. কোমল ২. মসৃণ ৩. লোমযুক্ত। এ সমস্ত চামড়া ছাড়াও যদি অন্যান্য স্থানের ভালো চামড়ার যোগান পাওয়া যায়, তবে তা রাজ ভাণ্ডারের জন্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ পর্যন্ত চর্ম সম্পর্কিত বিষয় আলোচিত।

০২-১১-১৬ অবি বা মেষ পশুর পশম দিয়ে চাদর, আবিক বা কম্বল ও অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্য উৎপন্ন করা হয়। এধরনের পশমের কম্বল সম্পূর্ণ লাল বা আংশিক লাল বর্ণের হয়। এ ধরনের পশম দিয়ে চার প্রক্রিয়ায় কম্বল তৈরি করা যেতে পারে—১. সুচিকর্মের মাধ্যমে ২. সুতো দিয়ে ফুল তৈরির মাধ্যমে ৩. খণ্ডিত অংশকে জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে ৪. জালির মতো বয়নের মাধ্যমে। এধরনের কম্বল সাধারণত দশ ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে—১. স্বাভাবিক ব্যবহার ২. কেচলক বা অরণ্যবাসীদের শিরোস্ত্রাণ ৩. কুলমিতিকা বা হাতির পিঠের আস্তরণ ৪. সৌমিতিকা বা হাতির পিঠের কালো বর্ণের আস্তরণ ৫. তুরগাস্তরণ বা ঘোড়ার পিঠের আস্তরণ ৬. বর্ণক বা রঙিন কম্বল ৭. তলিচ্ছক বা শয্যায় বিছানোর কম্বল ৮. বারবাণ বা পরিধেয় কম্বল ৯. পরিস্তোম বা বৈচিত্র্যপূর্ণ কম্বল ১০. সমন্তভদ্রক বা বর্মের প্রান্তভাগে ব্যবহার্য কম্বল। এ সমস্ত কম্বলের মধ্যে যে কম্বল আবিক বা পিচ্ছিল, সুক্ষ্ম ও কোমল, সে কম্বলই শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত।

০২-১১-১৭ আটটি খণ্ডকে জোড়া দিয়ে কালো বর্ণের যে বিশেষ কম্বল তৈরি করা হয় তা ভিঙ্গিসী নামে খ্যাত। এটি দিয়ে শরীর আবৃত করা হলে বৃষ্টির পানি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এছাড়াও মেষের পশমে প্রস্তুত অপসারক নামক আরও এক ধরনের বৃষ্টি নিরোধক কম্বল তৈরি হয়। এই দুই ধরনের বিশেষ কম্বল প্রস্তুত করা হয় নেপালে। এ ছাড়াও পশুর পশম দিয়েও নানা ধরনের বস্ত্র বয়ন করা হয়, এ ধরনের পশমি বস্ত্র ছয় প্রকার হয়ে থাকে—১. সম্পুটিকা বা পরিধেয় জাঙ্গিয়া ২. চতুরশ্রিকা বা পাড়হীন কারুকার্য খচিত বস্ত্র ৩. লম্বরা বা মেয়েদের ওড়না জাতীয় বস্ত্র ৪. কটবানক বা মোটা সুতার বুননে বস্ত্র ৫. প্রাবরক বা পাড় দেওয়া চাদর বিশেষ ৬. সত্তলিকা বা এক ধরনের বিছানার আস্তরণ।

সিল্কবস্ত্র সাধারণত তিন প্রকার হয়ে থাকে—১. বাঙ্গক বা বঙ্গদেশে তৈরি সাদা রঙের মসৃণ সিল্ক ২. পুণ্ড্রদেশের তৈরি দু পাড় শ্যাম বর্ণ বিশিষ্ট মরকত মণির মতো মসৃণ সিল্ক ৩. সুবর্ণকুড্য (কামরূপ, কাশ্মীর বা কর্ণসুবর্ণ) দেশের তৈরি দু পাশে উদিত সূর্যের মতো উদ্ভাসিত সিল্কবস্ত্র। বস্ত্র বুননের প্রক্রিয়া তিন প্রকার—১. মণিস্নিগ্ধোদকবান—সুক্ষ্ম সুতা জলে ভিজিয়ে মণি দিয়ে ঘর্ষণের পর এ ধরনের মসৃণ বস্ত্র বয়ন করা হয় ২. চতুরশ্রবান—একই রঙের চারকোণ বিশিষ্ট বস্ত্র ৩. ব্যামিশ্রবান—এ ধরনের বস্ত্র সুতার সাথে সিল্কের মিশ্রণে অথবা নানা রঙের সুতার মিশ্রণে বয়ন করা হয়।

০২-১১-১৮ কীটের লালা থেকে উৎপন্ন সিল্ক তিন প্রকার—১. মাগধিকা বা মগধ এলাকায় উৎপাদিত সিল্ক ২. পৌণ্ড্রিকা বা পুণ্ড্রদেশে উৎপন্ন সিল্ক ৩. সৌবর্ণকুড্যকা বা সুবর্ণকুড্য দেশে উৎপন্ন সিল্ক। এসব সিল্ক ছাড়াও ঊর্ণা নামে আরও এক ধরনের বহুবর্ণসম্পন্ন সিল্ক চারটি বৃক্ষ হতে উৎপত্তি হয়—১. নাগকেশরবৃক্ষ হতে উৎপন্ন সিল্কের রঙ হয় পীত ২. লিকুচ বৃক্ষ হতে উৎপন্ন সিল্কের রঙ হয় গমের মতো ৩. বকুল গাছ হতে উৎপন্ন সিল্কের রঙ হয় শ্বেত ৪. বট বৃক্ষ হতে উৎপন্ন সিল্কের রঙ হয় মাখনের মতো। এসবের মধ্যে সুবর্ণকুড্য দেশে উৎপন্ন ঊর্ণাই সর্বোৎকৃষ্ট।

০২-১১-১৯ কার্পাস সুতাজাত বস্ত্রের পরিচিতি (Brand) ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কিত বিষয়—যে সাতটি দেশ বা অঞ্চলের কার্পাস গুণগত মানে শ্রেষ্ঠতর বলে স্বীকৃত তা হলো—১. মাধুর বা উত্তর ভারতের মথুরায় উৎপন্ন বস্ত্র ২. আপরান্তক বা কোঙ্ক দেশে উৎপন্ন বস্ত্র ৩. কালিঙ্কক বা কলিঙ্গ দেশে উৎপন্ন বস্ত্র ৪. কাশিক বা কাশীতে উৎপন্ন বস্ত্র ৫. বাঙ্গক বা বঙ্গদেশে উৎপন্ন বস্ত্র ৬. বাসক বা কৌসাম্বী দেশে উৎপন্ন বস্ত্ৰ ৭. মাহিষক বা কুন্তল দেশের রাজধানী মহীশূরে উৎপন্ন বস্ত্ৰ।

এ পর্যন্ত যে সমস্ত রত্নাদি, চর্ম, পশমিবস্ত্র এবং সুতিবস্ত্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো রাজভাণ্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত অধীক্ষককে এসবের উৎপন্ন স্থান, রঙ, গুণগত মান, মূল্য, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন প্রক্রিয়াসহ যাবতীয় বিষয়ে সম্যক অভিহিত হতে হবে।

দ্বাদশ অধ্যায় ॥ ৩০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন খনি, খনিজ দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়, এসবের গুণগত মান, মূল্য, যাচাইকরণের তরিকা, ইত্যাকার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০২-১২-০১ খনির দায়িত্বে নিয়োজিত রাজ প্রশাসককে বলা হয় আকরাধ্যক্ষ। আকরাধ্যক্ষকে শুল্বশাস্ত্র তথা ভূমিপরীক্ষণ, কুপ খনন, তাম্র ও রৌপ্যকে স্বর্ণে রূপান্তর প্রক্রিয়ার বিদ্যা, ধাতুশাস্ত্র, রসবন্ধবিজ্ঞান, মণিরাগ তথা মণিকে বিভিন্ন বর্ণে রূপান্তরের বিদ্যা সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও জ্ঞাত হতে হবে। তিনি এ সম্পর্কিত বিদ্যায় বিদগ্ধগণকে তার সহায়ক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন। আকরাধ্যক্ষ খনিস্থ ধাতুর বর্ণ, গন্ধ, রস, ঘ্রাণ পরীক্ষা করে এর গুণগত মান সম্পর্কে অবহিত হয়ে দ্রব্যের উৎকৃষ্টতা, নিকৃষ্টতা ও মধ্যম সত্তা তথা গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন।

০২-১২-০২ খনির দায়িত্বে নিয়োজিত (আকরাধ্যক্ষ) তত্ত্বাবধায়কদের পূর্ব থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের খনি সম্পর্কিত ভূ-প্রকৃতি, বিল, গুহা, উপত্যকা, লয়ন, গূঢ়খাত তথা খনিজ দ্রব্য প্রাপ্তির উৎস সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হতে হবে। এ সমস্ত উৎসে প্রাপ্ত তরল পদার্থ যদি জলে ডুবে যায়, তেলের মতো পিচ্ছিল হয়, উগ্র গন্ধ-স্বাদযুক্ত হয় এবং এসবের রঙ যদি হয় পীতবর্ণ, ভঙুর অবস্থায় যদি নীল রেখা পরিদৃষ্ট হয়, যদি দীপ্তিময় হয়, উত্তাপে যদি গলে না যায়, উত্তপ্ত অবস্থায় যদি ফেনায়িত ও ধোঁয়াটে হয়। এই তরল যদি মসৃণ হয়, বিশুদ্ধ হয় এবং ওজনে ভারী হয়, তবে বুঝতে হবে এতে স্বর্ণের উপাদান বিদ্যমান।

০২-১২-০৩ উপরি-উক্ত স্বর্ণের ঘনত্বযুক্ত তরলের একপল পরিমাণ যদি শতপল পরিমাণ তামা বা রূপার সাথে দ্রবীভূত করা হয় তাহলে সে তামা বা রূপার তরল আকর স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া এমনতর স্বর্ণের রূপসম্পন্ন তরল যদি স্বর্ণের তরলের মতো অতি গন্ধ ও আস্বাদযুক্ত হয়, তবে বুঝতে হবে যে সেটি স্বর্ণহীন অন্য কোনো ধাতু।

০২-১২-০৪ ভূমি ও প্রস্তর ধাতুও স্বর্ণযুক্ত ধাতু হতে পারে। এই প্রকার ধাতুর রঙ হতে পারে পীতবর্ণ, তাম্রবর্ণ অথবা তাম্র ও পীতবর্ণ। এ ধরনের ধাতু বিদারিত হলে এর মধ্যে নীল রেখা পরিদৃষ্ট হয় অথবা এতে মুগ, মাষকলাই ও তিলের মতো রঙ প্রতিভাত হয়। এ ধরনের ধাতু আগুনের তাপে উত্তপ্ত হলে ভঙুর হয় না বা ফেটে যায় না, ফেনায়িত ও ধুমায়িত হয়। এ জাতীয় ভূমি ধাতু এবং প্রস্তর ধাতু চূর্ণাকারে তামা ও রূপার মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হলে তামা বা রূপা স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়।

০২-১২-০৫ সোনার মতো রূপার খনিজ-জাত পদার্থও সাদা, কর্পূর বা ময়ূরের গ্রীবার রঙ বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এ ধাতুও সীসা মিশ্রিত, দুর্গন্ধযুক্ত ও ভঙুর অবস্থায় বাহিরে সাদা, ভেতরে কালো রেখা ও বিন্দুযুক্ত হয়। এ জাতীয় ধাতুও উত্তপ্ত হলে ফেটে যায় না, বরং ফেনায়িত ও ধুমায়িত হয়।

০২-১২-০৬ উপরি-উক্ত ভূমি, প্রস্তর, সুবর্ণ, রৌপ্য এবং তাম্রযুক্ত আকরের ওজন যত বেশি হবে তার ভেতর ধাতুর পরিমাণও তত বেশি হবে। এসব আকর থেকে ধাতু শোধন করার জন্য তা পশুমূত্র, কলাপাতার ছাইসহ নানা প্রক্রিয়ায় গলাতে হবে এবং আকর থেকে ধাতুর উপাদান পৃথক করতে হবে।

০২-১২-০৭ যব, মাষ, তিল, পলাশ ও পীলুর ছাই অথবা গরু বা ছাগলের দুধের সাথে কলাগাছের মূল ও বজ্রকন্দ মিশ্রিত করে উত্তপ্ত করা হলে যে পদার্থ প্রস্তুত হয় তাতে ধাতুর মৃদুতা উৎপন্ন হয়। অতঃপর গোদন্ত ও গোশৃঙ্গ চূর্ণ করে দ্রবীভূত স্বর্ণের আকরে প্রক্ষেপ করা হলে স্বর্ণের আকরের মৃদুতা বিলুপ্ত হয়ে তা ঘনত্ব সম্পন্ন হয়।

০২-১২-০৮ ভারী মসৃণ, পিঙ্গল, হরিত, নীল, পাটল ও লাল বর্ণের ধাতুতে তাম্রের অস্তিত্ব থাকে। এছাড়া সীসাযুক্ত আকরিকের রঙ হয় কাকের মতো কালো বা গো-রোচনাবর্ণ, সাদা রেখাযুক্ত এবং দুর্গন্ধযুক্ত। ত্রপুর বা টিনের আকর হবে ঈষৎ পাণ্ডুবর্ণ ও পোড়া ইটের মতো। তীক্ষ্ণ ধাতু বা লোহার আকর হবে মসৃণ পাণ্ডু বৰ্ণ বিশিষ্ট।

০২-১২-০৯ যে সমস্ত পাথর স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, প্রভাযুক্ত এবং আগুনে নিক্ষিপ্ত হলে শব্দ উৎপন্ন করে, উত্তপ্ত করার পর সহসাই শীতল হয়ে পড়ে এবং স্বভাবগত ভাবেই শীতল প্রকৃতির, সে-সমস্ত শীতল ও হালকা বর্ণের পাথর মণিধাতুযুক্ত। খনি থেকে এ ধরনের সকল প্রকার ধাতু আহরণের পর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নানা প্রকার পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের নিমিত্ত প্রক্রিয়াজাত করণের জন্য সরাসরি রাজকীয় কারখানায় প্রেরণ করতে হবে।

০২-১২-১০ দায়িত্বপ্রাপ্ত আকরাধ্যক্ষ তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে খনি হতে খনিজদ্রব্য আহরণ করবেন এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে সমস্ত খনিজ দ্রব্য মজুদ করে ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত স্থান ব্যতিরেকে অন্য কোথাও খনিজ দ্রব্যের কেনা বেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (সে-সময় খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে রাজার তথা রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়—লেখক) রাজার অগোচরে কেউ যদি এ ধরনের খনিজ দ্রব্য উৎপাদন, ক্রয় বা বিক্রয়ে প্রবৃত্ত হয় সেক্ষেত্রে তার উপর অপরাধের মাত্রানুযায়ী অত্যয় বা দণ্ড প্রযুক্ত হবে। খনিতে নিয়োজিত কোনো কর্মচারী যদি আহরিত আকর থেকে মূল্যবান ধাতু আত্মসাৎ করে, সেক্ষেত্রে উক্ত কর্মচারীকে আত্মসাৎকৃত দ্রব্যের আটগুণ দ্রব্যমূল্য পরিশোধ করতে হবে। খনির কাজে নিয়োজিত বা অনিয়োজিত কেউ যদি স্বর্ণদ্রব্য চুরি করে বা কৌশলে সংগ্রহ করে বা এসব দ্রব্যের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেক্ষেত্রে তার উপর অর্থ দণ্ড আরোপিত হবে, অর্থ পরিশোধে অক্ষম হলে তার বিরুদ্ধে শারীরিক শাস্তি প্রযুক্ত হবে, শারীরিকভাবে শাস্তি গ্রহণে অক্ষম হলে রাজা তাকে শেকলে আবদ্ধ করে খনির কাজে নিযুক্ত করবেন।

যেসব খনিজ পদার্থ উত্তোলন সহজতর এবং যেখানে অধিক পরিমাণে বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই, আকরাধ্যক্ষ সে-সমস্ত খনি হতে নিজ তত্ত্বাবধানে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করাবেন। কিন্তু যে সমস্ত খনি হতে খনিজ পদার্থ উত্তোলন অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং বহুল শ্রম নির্ভর, সে-সমস্ত খনি হতে খনিজ দ্রব্য উত্তোলনের ক্ষেত্রে অন্যের সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে, এক্ষেত্রে অন্যের বিনিয়োগে বা অংশীদারিত্বেও খনিজ দ্রব্য উত্তোলন করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে রাজকোষের নির্দিষ্ট হিস্যাও নিশ্চিত করতে হবে (এতে প্রমাণিত হয় যে তখনকার দিনেও জয়েন্টভেঞ্চার বা যৌথ বিনিয়োগ প্রথা চালু ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে Public Private Partnership — PPP প্রথা প্রচলিত ছিল—লেখক)

০২-১২-১১ স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যতীত লৌহের তত্ত্বাবধায়ক তথা লোহাধ্যক্ষ তামা, সীসা, টিন ও কাঁসাসহ অন্যান্য ধাতু দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি ও ক্রয় বিক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থাপনা নির্মাণ করবেন এবং এ সমস্ত দ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। লক্ষণাধ্যক্ষ তথা টাকশালের তত্ত্বাবধায়ক রূপা ও তামার মুদ্রা তথা পণ উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত থাকবেন। মুদ্রা সাধারণত আট প্রকার। এর মধ্যে রূপার মুদ্রা চার প্রকার এবং তামার মুদ্রা চার প্রকার। চার প্রকার রৌপ্য মুদ্রা হলো—১. পণ (আজকের দিনের এক টাকার তুল্য) ২. অৰ্দ্ধর্পণ (আধুনিক আধুলি তুল্য) ৩. পাদপণ (আধুনিক সিকি তুল্য) ৪. অষ্টাভাগপণ (বিলুপ্ত দু আনা তুল্য)। এ সমস্ত মুদ্রা বিভিন্ন ওজনের হবে এবং এতে বিভিন্ন ধাতু মিশ্রণ করতে হবে। এছাড়া লক্ষণাধ্যক্ষ রূপার মিশ্রণে বিভিন্ন মানের ও ওজনের তাম্র মুদ্রা তৈরি করাবে।

০২-১২-১২ রূপদর্শক তথা মুদ্রা পরীক্ষক মুদ্রার ব্যবহার যোগ্যতা বিষয়ক প্রত্যায়ণ প্রদান করবেন। উপযুক্ততার মানদণ্ডে রাজকোষে জমাতব্য মুদ্রা সম্পর্কে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন। মুখ্যত তার প্রত্যায়ণ ব্যতিরেকে রাজার খাজাঞ্চিখানায় কোনো মুদ্রা গ্রহণ করা যাবে না। জনপদের লোকেরা ইচ্ছে করলে মুদ্রা প্রস্তুতের খরচ পরিশোধ করে রূপা বা তামা দিয়ে টাকশাল থেকে মুদ্রা তৈরি করিয়ে নিতে পারে, তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই রাজ কর পরিশোধকরণ আবশ্যক। কেউ এর অন্যথা করলে তার উপর পঞ্চবিংশতি পণ জরিমানা আরোপিত হবে। মুদ্রা তৈরির কারিগর, ক্রেতা, বিক্রেতা বা মুদ্রা পরীক্ষক যদি নিজেদের সংগৃহীত তামা বা রূপা দিয়ে কারখানা হতে মুদ্রা তৈরি করিয়ে নেয়, সেক্ষেত্রে তাদের উপর রাজ কর প্রযোজ্য হবে না।

০২-১২-১৩ স্বর্ণ ও অন্যান্য রত্নের অধ্যক্ষ শঙ্খ, হীরা, মণি, মুক্তা, প্রবাল ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদনের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় কারখানা নির্মাণ করাবেন। তিনি এ সমস্ত মূল্যবান ধাতুর প্রয়োজনীয় শোধনসহ নির্মিত সামগ্রী ক্রয় বিক্রয়ের আয়োজন এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। লবণাধ্যক্ষ খনি হতে সংগৃহীত লবণ শোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং প্রযোজ্য কর আদায় করবেন। এছাড়াও তিনি বণিকদের কাছ থেকে লবণ পরীক্ষণের মূল্য আদায়সহ রাজভাণ্ডারের জন্য ব্যাজী তথা ফাও লবণ আদায় করবেন।

বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লবণের উপর মোট মূল্যের এক ষষ্ঠাংশ হারে কর আরোপ করবেন। এক্ষেত্রে প্রদেয় কর পরিশোধ ব্যতীত কেউ আমদানিকৃত লবণ বিক্রি করতে পারবে না। এছাড়াও লবণ আমদানি কারককে শতকরা পাঁচ ভাগ লবণ ব্যাজী বা ফাও হিসেবে প্রদান করতে হবে, লবণ পরীক্ষার জন্য শতকরা আট ভাগ রূপ নামক কর প্রদান করতে হবে এবং শতকরা আট ভাগ হারে রূপিক কর প্রদান করতে হবে। বহিরাগত লবণ ক্রয়কারীকেও নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। বহিরাগত বণিককে রাজভাণ্ডার থেকেই প্রয়োজনীয় শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে লবণ ক্রয় করতে হবে, পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি রাজভাণ্ডার হতে লবণ সংগ্রহ না করে অন্য উৎস হতে তা সংগ্রহ করেন, সেক্ষেত্রে অবিক্রিত হেতু এখাতে রাজার যে ক্ষতি সাধিত হবে উক্ত বণিককে সে ক্ষতি পূরণ করতে হবে (বাজার ব্যবস্থার উপরও রাজার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বহাল ছিল—লেখক

০২-১২-১৪ কেউ লবণের সাথে মাটি মিশিয়ে ভেজাল লবণ বিক্রি করলে তার উপর উত্তম সাহসদণ্ড তথা এক হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ রাজার অনুমতি ব্যতিরেকে লবণ উৎপাদনে যুক্ত হলে এবং এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলে তার ক্ষেত্রেও জরিমানা হিসেবে উত্তম সাহসদণ্ড প্রযুক্ত হবে। তবে—বানপ্রস্থাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এছাড়াও বেদ অধ্যায়ী, তপস্বী এবং বিষ্টি তথা রাজাজ্ঞানুযায়ী শ্রম প্রদানকারীরা নিজেদের ভোগের জন্য লবণ উৎপাদন করতে পারবে, এজন্য কোনো শুল্ক প্রদান করতে হবে না।

০২-১২-১৫ এ সমস্ত প্রক্রিয়ায় আকরাধ্যক্ষ তথা খনিজ সম্পদের দায়িত্বে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক খনি থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের উপর কর, শুল্ক, ব্যাজী, ক্ষতিপূরণ, জরিমানা, পরীক্ষণ বাবদ অর্থ, বৈধকরণ বাবদ অর্থ নির্ধারণ করে আয়ের খাত নির্ধারণ করবেন এবং রাজস্ব খাতের আয় নিশ্চিত করবেন। মুখ্যত খনিজ সম্পদের আয় থেকেই রাজার কোষাগার সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এই খাতের আর্থিক সমৃদ্ধির সুবাদেই রাজা তার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে প্রভুত্ব করার বা শাসন করার সক্ষমতা অর্জন করে থাকেন।

ত্রয়োদশ অধ্যায় ॥ ৩১ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে অক্ষশালা তথা স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, বিভিন্ন প্রকারের ও মানের স্বর্ণ, রৌপ্য, স্বর্ণ-রৌপ্যের অলঙ্কার, ক্রয়-বিক্রয়ের পদ্ধতিসহ এ সংক্রান্ত নানাবিধ বিষয়ে আলোকপাত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-১৩-০১ সুবর্ণাধ্যক্ষ তথা স্বর্ণ ও রৌপ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক স্বর্ণ ও রৌপ্য পরিশোধন এবং অলঙ্কার তৈরির জন্য মানসম্মত কারখানা ভবন নির্মাণ করাবেন। এ ভবনে সাকুল্যে চারটি স্বতন্ত্র কক্ষ থাকবে। কক্ষগুলোর অবস্থান হবে পরস্পর মুখোমুখি এবং সহজে যাতায়াতযোগ্য। ভবনটির সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য এতে মাত্র একটি প্রবেশ ও নির্গমন পথ থাকবে। স্বর্ণ, রৌপ্য এবং অলঙ্কারাদি বিক্রয়ের কাজ করার জন্য সোনা পট্টির বিপণি বিতানগুলোতে সুবর্ণাধ্যক্ষ কর্তৃক বিশ্বস্ত ও সদবংশজাত স্বর্ণকারদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে।

০২-১৩-০২ স্বর্ণ সাকুল্যে পাঁচ প্রকার এবং এই পাঁচ প্রকৃতির স্বর্ণ তিন ভাবে পাওয়া যায়। পাঁচ প্রকার স্বর্ণ হলো—১. মেরু পর্বতের জন্তু নদীতে উৎপন্ন জাম রসের বর্ণ বিশিষ্ট জাম্বুনদ নামের স্বর্ণ ২. শতকুম্ভ পর্বত বা নদীতে প্রাপ্ত পদ্মের পাপড়ির বর্ণ বিশিষ্ট শাতকুম্ভ নামের স্বর্ণ ৩. হাটক নামক অঞ্চলের খনিতে উৎপন্ন কুসুম্ভ ফুলের বর্ণ বিশিষ্ট হাটক নামের স্বর্ণ ৪. বেণু পর্বত বা নদীতে উৎপন্ন কর্ণিকার ফুলের বর্ণ বিশিষ্ট বৈণব নামের স্বর্ণ ৫. সুবর্ণ ভূমিতে উৎপন্ন মনঃশিলার বর্ণ বিশিষ্ট শৃঙ্গিশুক্তিজ নামের স্বর্ণ।

এই পাঁচ ধরনের স্বর্ণ যে তিন অবস্থায় পাওয়া যায় তা হলো—১. জাতরূপ বা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রাপ্ত ২. রসবিদ্ধ তথা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত ৩. আকরোদ্‌গত বা খনির মৃত্তিকায় এবং প্রস্তরখণ্ডে অশুদ্ধ আকর হিসেবে প্রাপ্ত।

০২-১৩-০৩ উৎকর্ষের ক্ষেত্রে যে স্বর্ণ পদ্মের পাপড়ির মতো বর্ণ বিশিষ্ট, কোমল, মসৃণ, শব্দ অনুৎপাদক এবং ভাস্বর, সে স্বর্ণই সর্বোৎকৃষ্ট। যে স্বর্ণের বর্ণ রক্তাভ ও হলুদ তা মধ্যমমানের এবং যে স্বর্ণ রক্তবর্ণ বিশিষ্ট তা নিকৃষ্ট প্রকৃতির স্বর্ণ। বিশুদ্ধতা যাচাই প্রাক্কালে স্বর্ণে যদি শ্বেত বা পাণ্ডু বর্ণ পরিদৃষ্ট হয় তাহলে বুঝতে হবে, তাতে অপদ্রব্যের মিশ্রণ আছে। অতঃপর স্বর্ণে সীসার মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় শোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপদ্রব্য অপসারণ করে উৎকৃষ্ট স্বর্ণের বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

০২-১৩-০৪ খনি হতে আহরিত স্বর্ণ শোধনের সময় যদি সীসার সংমিশ্রণে ফেটে যায় সেক্ষেত্রে কাষ্ঠপাত্রে স্বর্ণ রেখে অন্য কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে চূর্ণ করে এর স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। রৌপ্যের গুণগত মান ও উৎস ভূমির ক্ষেত্রে যে চার ধরনের বিদ্যমানতা স্বীকৃত তা হলো—১. তুথোদ্‌গত তথা তুৰ্থ পর্বতে উৎপন্ন জুঁই ফুলের বর্ণ বিশিষ্ট রৌপ্য ২. গৌড়িক তথা গৌড় দেশে উৎপন্ন টগর ফুলের বর্ণ বিশিষ্ট রৌপ্য ৩. কাম্বুক তথা কম্বু পর্বতে উৎপন্ন কুন্দ ফুলের বর্ণ বিশিষ্ট রৌপ্য ৪. চাক্রবালিক তথা চক্রবাল পর্বতে উৎপন্ন কুন্দ ফুলের বর্ণ বিশিষ্ট রৌপ্য। গুণগত মানের ক্ষেত্রে শ্বেত বর্ণ, স্নিগ্ধ এবং কোমল বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট রৌপ্যই সর্বোৎকৃষ্ট হিসেবে স্বীকৃত। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে অর্থাৎ যদি তা কালো, রুক্ষ ও খরযুক্ত হয় এবং সহজে ভেঙে যায় তাহলে বুঝতে হবে সে রৌপ্য উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন নয়। এক্ষেত্রে রৌপ্যের স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধন আবশ্যক হবে।

০২-১৩-০৫ পরিশোধনকৃত এবং স্বভাবজাত স্বর্ণের বর্ণ যদি হলুদ ভাঙার পর যে রঙ প্রতিভাত হয় তদ্রুপ বর্ণের হয় এবং এক সুবর্ণ হয়, তবে সে জাতীয় বর্ণ ও ওজন বিশিষ্ট স্বর্ণ বর্ণক বা বিশুদ্ধ স্বর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের সতের প্রকার বর্ণক বা বিশুদ্ধ স্বর্ণ হতে পারে (এ প্রসঙ্গে বিশুদ্ধ স্বর্ণ পরীক্ষণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, এরই সাথে স্বর্ণ ক্রয় বিক্রয়কালে সম্ভাব্য ছল চাতুরি এবং অপকৌশল সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।)

০২-১৩-০৬

০২-১৩-০৭ স্বর্ণের পরীক্ষণ প্রাক্কালে কষ্টি পাথরের উপর স্বর্ণের আরোপিত দাগ যদি অনেক কেশরযুক্ত হয়, স্নিগ্ধ হয়, দীপ্তিযুক্ত হয় তবে সে স্বর্ণ উৎকৃষ্ট হিসেবে গণ্য হবে। যে কষ্টি পাথরে স্বর্ণের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হয় সে কষ্টি পাথরই ক্রেতা বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যথাযথ। যে স্বর্ণ ছেদন করার পর ভেতর বাহির সমবর্ণ বিশিষ্ট হবে, মসৃণ ও দীপ্তিমান হবে সে স্বর্ণ যথাযথ মানসম্পন্ন বলে স্বীকৃত হবে। স্বর্ণসহ অন্যান্য ধাতুর ওজন ও পরিমাপণ পৌতবাধ্যক্ষ কর্তৃক নির্ধারণ করতে হবে।

০২-১৩-০৮ অক্ষশালাতে বিনা অনুমতিতে অনাহূত কোনো ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারবে না। নিষেধ সত্ত্বেও কেউ যদি এর অন্যথা করে, সেক্ষেত্রে তার সর্বস্ব হরণযোগ্য হবে। নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী যদি স্বর্ণ বা রৌপ্য নিয়ে অক্ষশালায় প্রবেশ করে সেক্ষেত্রে তার আনীত দ্রব্য দণ্ড হিসেবে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অক্ষশালায় প্রবেশ ও নির্গমনকারী, কাঞ্চনকারু বা স্বর্ণ-রৌপ্যের অলঙ্কারে মুক্তা সংস্থাপনের কারিগর, পৃষতকারু বা ছোট ছোট স্বর্ণ গোলক প্রস্তুতকারী, তৃষ্টকারু বা স্বর্ণপাত্র প্রস্তুতকারী, তপনীয়কারু বা স্বর্ণলঙ্কার প্রস্তুতকারী, ভস্ত্রা বা বাতাস সৃষ্টিকারী, চরক বা পরিচারক এবং ধূলিশোধক, তথা কারখানায় কর্মরত সকল ধরনের কারিগর, শিল্পী ও সহায়ক কর্মচারী পরিধেয় বস্ত্র, হস্ত ও শরীরের গোপনীয় স্থান প্রহরীদের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে অক্ষশালা বা কারখানায় প্রবেশ করবে এবং কাজের শেষে একই প্রক্রিয়ায় কারখানা থেকে প্রস্থান করবে। এক্ষেত্রে কাজের কোনো যন্ত্র বা উপকরণও সঙ্গে বহন করা যাবে না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কারখানাতেই যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অলঙ্কার প্রস্তুতের জন্য কারিগর বা শিল্পীরা প্রয়োজনীয় স্বর্ণ, রৌপ্য লিখিতভাবে ভাণ্ডার থেকে গ্রহণ করবে এবং কর্ম সম্পাদনের পর তা লিখিতভাবে বুঝিয়ে দিবে।

০২-১৩-০৯ স্বর্ণালঙ্কারের উপর তিন ধরনের কাজ হতে পারে—১. কাচ, মণি বা অন্য কোনো উপকরণ বসানো বা যুক্ত করা ২. স্বর্ণে সুতা দিয়ে অলঙ্কারের গুণকর্ম সম্পাদন ৩. পাত্র, তৈজস ও অন্য প্রকার দ্রব্য তৈরির মাধ্যমে ক্ষুদ্রকর্ম সম্পাদন।

০২-১৩-১০-

০২-১৩-১৪ পাত্রাদি তৈরির ক্ষেত্রে রূপার পাত্রে অর্ধ পরিমাণ স্বর্ণের প্রলেপ বা তামার পাত্রে স্বর্ণের পাত সংযোজন করা যেতে পারে। অলঙ্কার প্রস্তুতের সময় বিশুদ্ধ বর্ণের স্বর্ণ বা অশুদ্ধ স্বর্ণকে সীসার দ্বারা পরিশোধন করার পর সিন্ধু মাটির সাথে তাপ দিয়ে নীল, পীত, হরিত বা শ্বেত বর্ণের অলঙ্কার তৈয়ার করা যেতে পারে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় রৌপ্য শুদ্ধ করে তার এক কাকণী পরিমাণ স্বর্ণের সাথে মিশ্রণ করলে স্বর্ণের বর্ণ হবে শ্বেত প্রকৃতির। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বর্ণের স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুত করা যাবে।

০২-১৩-১৫ স্বর্ণালঙ্কারের সংরক্ষণযোগ্য সর্ব স্বীকৃত যে ১৪ প্রকার গুণ থাকতে হবে, তা হলো—১. সমরাগ বা সর্বাবস্থায় একই বর্ণ সম্পন্ন ২. সমদ্বন্দ্ব বা একই আকৃতির দুটি অলঙ্কারের সম ওজন এবং সম বর্ণ ৩. অসক্তপৃষত বা অলঙ্কারে খোদিত গুটিকা পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত হবে না ৪. স্থির বা দীর্ঘকালের জন্য স্থায়ীত্ব সম্পন্ন ৫. সুপ্রসৃষ্ট বা সিন্ধু মৃত্তিকার মাধ্যমে ঔজ্জ্বল্য সম্পন্ন ৬. অসম্পীত বা অতি ঘর্ষণে যেন চাকচিক্যময় করা না হয় ৭. বিভক্ত বা অলঙ্কারের প্রতিটি অংশ বিশেষ যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় ৮. ধারণে সুখ বা পরিধানকালে যেন সুখানুভূতির উদ্রেক হয় ৯. অভিনীত বা অলঙ্কার যেন সুচারুরূপে প্রস্তুত করা হয় ১০. প্রভাযুক্ত বা অলঙ্কার যেন দীপ্তিময় হয় ১১. সংস্থান মধুর বা এর আকৃতি যেন রমণীয় হয় ১২. সমমান বা অলঙ্কারের প্রতিটি অংশ যেন সমমান সম্পন্ন হয় ১৩ ও ১৪ মনোনেত্রাভিরাম বা অলঙ্কারটি যেন মনোহর ও দৃষ্টি গ্রাহ্যভাবে নান্দনিক হিসেবে প্রতিভাত হয়।

চতুর্দশ অধ্যায় ॥ ৩২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সৌবর্ণিক তথা স্বর্ণ ও রৌপ্য শিল্পকর্মে নিযুক্ত স্বর্ণকারদের কার্যক্রম, কার্য পরিধি, দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-১৪-০১ সৌবর্ণিক তার অধীনস্থ কারিগরদের দিয়ে রাজপরিবার, নগর এবং জনপদের বাসিন্দাদের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার বানিয়ে দিবেন। কারিগররা নির্ধারিত পারিশ্রমিক বা বেতনের বিনিময়ে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এসব অলঙ্কার তৈরি করে সরবরাহ করবে। যেক্ষেত্রে কোনো কারিগর প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে অলঙ্কার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবে, সেক্ষেত্রে সে এক চতুর্থাংশ কম বেতনপ্রাপ্ত হবে এবং জরিমানা হিসেবে বেতনের দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এছাড়া কোনো কারিগর যদি গাফিলতি করে চাহিদাকৃত অলঙ্কারের পরিবর্তে অন্য অলঙ্কার তৈরি করে, সে ক্ষেত্রে সে কোনো বেতন বা মজুরি তো পাবেই না, অধিকন্তু তাকে তার বেতনের দ্বিগুণ আর্থিক জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০২-১৪-০২ কারিগররা অলঙ্কার বানাবার জন্য যে প্রকৃতি ও ওজনের স্বর্ণ ও রৌপ্য সৌবর্ণিকের কাছ থেকে গ্রহণ করবে, সে প্রকৃতি ও ওজনের তৈরিকৃত অলঙ্কার সৌবর্ণিক বা গ্রাহককে বুঝিয়ে দিবেন। কোনো কারিগর যদি দীর্ঘ প্রবাস বা মৃত্যুজনিত কারণে সুবর্ণাদি গ্রহণ সত্ত্বেও অলঙ্কার সরবরাহ করতে অক্ষম হয় সেক্ষেত্রে তার পুত্রদের ওই অলঙ্কার সরবরাহ করতে হবে। কারিগররা যেন কোনো কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে অলঙ্কার তৈরির সময় সোনা-রূপা আত্মসাৎ করতে না পারেন, সে বিষয়ে সৌবর্ণিক সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। অলঙ্কার বানাবার সময় প্রক্রিয়াগত কারণে যে পরিমাণ ক্ষয় সাধিত হবে, (ষোল মাষ পরিমাণ সুবর্ণাদির বিপরীতে স্বীকৃত ক্ষয় এক কাকণিক বা মাষের এক চতুর্থাংশ) গ্রাহককে সে পরিমাণ কম ওজনের অলঙ্কার গ্রহণ করতে হবে।

০২-১৪-০৩ গ্রহীতার কাছে অলঙ্কার প্রত্যর্পন প্রাক্কালে যদি উৎকৃষ্ট সুবর্ণের এক মাষ পরিমাণ বিনষ্ট বর্ণের বা নিকৃষ্ট স্বর্ণের অলঙ্কার সরবরাহ করা হয়, সেক্ষেত্রে ওই অসাধু কারিগরের উপর প্রথম সাহসদণ্ড বা আড়াইশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি অলঙ্কার প্রত্যর্পণের সময় ওজনের হেরফের ঘটিয়ে তা সরবরাহ করে, সেক্ষেত্রে সেই অসাধু কারিগরের উপর মধ্যম সাহসদণ্ড বা পাঁচশ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি ওজনের সময় সুকৌশলে দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারার মাধ্যমে জালিয়াতি করে ওজনের তারতম্য ঘটায়, সে ক্ষেত্রে ওই কারিগরের উপর প্রথম সাহসদণ্ড বা হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়া ছল চাতুরির মাধ্যমে অলঙ্কারের পরিবর্তন ঘটালে একই হারে জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

কোনো ব্যক্তি যদি সৌবর্ণিকের অনুমতি বা অনানুমতিক্রমে নির্দিষ্ট কারখানা বা নির্ধারিত বিপণি বহির্ভূত অন্যত্র কোথাও অলঙ্কার তৈয়ার করান, সেক্ষেত্রে দণ্ড হিসেবে তার উপর দ্বাদশ পণ প্রযুক্ত হবে। যে কারিগর এহেন কর্মে নিযুক্ত হবে তাকে দণ্ড হিসেবে ২৪ পণ প্রদান করতে হবে। যেসব কারিগর কণ্টশোধন তথা শাস্তি প্রাপ্তির পরও এ প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারবে না, দণ্ড হিসেবে তাদের ২০০ পণ প্রদান করতে হবে। অথবা তাদের ডান হাতের পাঁচ আঙুলের অগ্রভাগ কর্তন করাতে হবে।

০২-১৪-০৪ সৌবর্ণিক এবং অলঙ্কার তৈরির কারিগররা পৌতবাধ্যক্ষের কাছ থেকে মানসম্মত দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারা ক্রয় করে ব্যবহার করবে। ভিন্ন কোনো উৎস থেকে এগুলো সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হলে দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। স্বর্ণশিল্পী বা কারিগরদের দ্বারা ছয় ধরনের অলঙ্কারিক দ্রব্য তৈরি হতে পারে—১. ঘনত্ব বিশিষ্ট ২. অন্তঃসার শূন্য ৩. স্থুল দ্রব্যে স্বর্ণের সংযোজন ৪. লঘুপত্রে স্বর্ণের প্রলেপ ৫. মূল্যবান স্বর্ণে স্বল্প পরিমাণ অন্যধাতুর মিশ্রণ এবং ৬. রাসানিক প্রক্রিয়ায় স্বর্ণে গিল্টি করা।

০২-১৪-০৫-

০২-১৪-০৯ স্বর্ণের কারিগররা যে পাঁচ উপায়ে প্রতারণার মাধ্যমে স্বর্ণ আত্মসাৎ করতে পারে, তা হলো—

১. তুলাবিষম বা ওজনে জোচ্চুরির মাধ্যমে আত্মসাৎ। এ ধরনের ওজনে জোচ্চুরি আটভাবে হতে পারে। যেমন—(ক) হালকা লোহার তৈরি দাঁড়িপাল্লা বাঁকিয়ে ওজনে হেরফের করা (খ) দাঁড়িপল্লায় ছিদ্র করে তন্মধ্যে লোহার গুড়া বা পারদ ভরে পরিমাপণে প্রতারণা (গ) পাল্লার অগ্রভাগ ছিদ্রযুক্ত করে পরিমাপ প্রাক্কালে বাতাসের প্রভাবে প্রতারণা। (ঘ) পাল্লাকে অনেক গ্রন্থিযুক্ত করে পরিমাপ কালে প্রতারণা (ঙ) নিকৃষ্টমানের পাল্লা ঝোলানোর সুতা ব্যবহার (চ) পাল্লায় নিম্নমানের পাত্র ব্যবহার (ছ) ভারসাম্যহীন পাল্লা ব্যবহার (জ) অস্থির তথা একদিকে হেলানো পাল্লা ব্যবহার

২. অপসারণ বা ওজন প্রাক্কালে আসল দ্রব্য সরিয়ে ভেজাল দ্রব্যের মিশ্রণ দিয়ে আত্মসাৎকরণ। যে চার প্রকার অপকৌশলের মাধ্যমে অপসারণ সাধন করা হয় তা হলো—(ক) আহরিত স্বর্ণ আকরের সাথে দুভাগ রূপা ও এক ভাগ তামার মিশ্রণ মিশিয়ে বিশুদ্ধ স্বর্ণ অপসারণ (খ) বিশুদ্ধ স্বর্ণে তামা মিশিয়ে স্বর্ণ অপসারণ (গ) স্বর্ণের সাথে সমান পরিমাণ লোহা ও রূপা মিশিয়ে স্বর্ণ অপসারণ (ঘ) স্বর্ণের পরিমাণে অর্ধেক তামা মিশিয়ে স্বর্ণ অপসারণ।

৩. বিস্রাবন বা স্বর্ণ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রাক্কালে স্বর্ণ অপহরণ—এক্ষেত্রে কারিগররা স্বর্ণ গলানোর পাত্র ফুটো করে স্বর্ণ অপহরণ করতে পারে। আবর্জনায় লুকিয়ে রেখে স্বর্ণ অপহরণ করতে পারে। ব্যবহৃত সাঁড়াশির মাধ্যমে স্বর্ণ অপহরণ করতে পারে। ফুঁ দেওয়ার চোঙা ব্যবহার করে স্বর্ণ কণা অপহরণ করতে পারে। ব্যবহৃত জলপাত্রে স্বর্ণ লুকিয়ে রেখে অপহরণ করতে পারে। ক্ষার দ্রব্য মিশিয়ে ওজন ঠিক রাখার মাধ্যমে স্বর্ণ অপহরণ করতে পারে। বিশুদ্ধ স্বর্ণের সাথে সুক্ষ্ম বালু মিশিয়ে স্বর্ণ অপহরণ করতে পারে। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বর্ণ অপহরণকে বলা হয় বিস্রাবণ।

৪. পাত মোড়াই প্রাক্কালে বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে স্বর্ণ অপহরণ করাকে বলা হয় পেটক।

৫. পিঙ্ক নামক আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় পাঁচটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় পুরু স্বর্ণ বা অলঙ্কারের ভেতর গালা জাতীয় ধাতু মিশিয়ে ভেজাল দেওয়ার মাধ্যমে বিশুদ্ধ স্বর্ণ অপহরণ করা হয়ে থাকে।

০২-১৪-১০ উপরোক্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সাধিত হরণকার্য-রোধকল্পে সৌবর্ণিককে হীরা, মণি, মুক্তা ও প্রবালের উৎপত্তি স্থান, আকার আকৃতি, বর্ণের বৈচিত্র্য এবং ওজন সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে হবে। এসবের ব্যবহারিক উপযোগিতা এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও তার অবাধ জ্ঞান থাকতে হবে।

০২-১৪-১১–

০২-১৪-১৩ ইতিপূর্বে আলোচিত প্রক্রিয়া পদ্ধতি ছাড়াও সুবর্ণাদি অপহরণের জন্য স্বর্ণকাররা আরও যে সমস্ত আচরণ বা প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে তা হলো—১. নাড়াচাড়া করার সময় হাত সাফাইয়ের মাধ্যমে সুবর্ণ সরিয়ে রেখে আত্মসাৎকরণ ২. ওজনের সময় আসল জিনিস সরিয়ে নকল স্বর্ণ প্রতিস্থাপন ৩. গ্রাহককে ধোঁকা দিয়ে আগুনে সুবর্ণ নিক্ষেপ করা ৪. ছিদ্রযুক্ত কাঠের পাত্রে স্বর্ণ রেখে তা আত্মসাৎকরণ ৫. সুবর্ণ গলানোর পাত্রের মাধ্যমে আত্মসাৎ ৬. স্বর্ণ গলানোর বিশেষ লোহার পাত্র ব্যবহার করে সুবর্ণ আত্মসাৎ ৭. ময়ূরের পুচ্ছ ব্যবহার করে সুবর্ণ সরিয়ে ফেলা ৮. দাঁড়িপাল্লায় তুলার সুতা ব্যবহারের মাধ্যমে ওজনে হেরফের করে সুবর্ণ আত্মসাৎ ৯. বস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে সুবর্ণ সরিয়ে রাখা ১০. ওজন করার সময় গ্রাহককে বিভিন্ন কথা বলে বিভ্রান্তকরণের মাধ্যমে সুবর্ণ সরিয়ে ফেলা ১১. ওজনের সময় মাথা চুলকাতে চুলকাতে কারচুপি করে সুবর্ণ আত্মসাৎ ১২. নাড়াচাড়া করতে করতে শরীরের গোপন স্থানে সুবর্ণ সরিয়ে রাখা ১৩. মাছি তাড়ানোর ভান করে সুবর্ণ হাতিয়ে নেওয়া ১৪. নিজের শরীরের দিকে তাকাতে তাকাতে সুবর্ণ সরিয়ে রাখা ১৫. স্বর্ণ গলানোর কাজে ব্যবহৃত অগ্নিতে বাতাস দেওয়ার ভাণ্ডে সুবর্ণ সরিয়ে রাখা ১৬. জলপাত্রে সুবর্ণ সরিয়ে রাখা ১৭. আগুনে নিক্ষিপ্ত দ্রব্যের সাথে সুবর্ণ নিক্ষেপের মাধ্যমে আত্মসাৎ। এ সমস্ত আচার বা কার্যকলাপ কোনো কারিগরের মধ্যে দৃশ্যমান হলে সৌবর্ণিক বুঝবেন যে ওই কারিগর সুবর্ণ আত্মসাতের সাথে যুক্ত (এ পর্যায়ে আরও যেসব প্রক্রিয়ায় সুবর্ণাদি অপহরণ তথা আত্মসাতের কথা বলা হয়েছে, সেসব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো না—লেখক)।

০২-১৪-১৪ রৌপ্যনির্মিত অলঙ্কার ও দ্রব্য যদি দুর্গন্ধযুক্ত হয়, মলিন প্রকৃতির হয়, অমসৃণ খসখসে হয়, কঠিন প্রকৃতির হয় এবং নিষ্প্রয় হয়, তাহলে বুঝতে হবে, তাতে ভেজাল মেশানো হয়েছে। যে সমস্ত কারিগর এ সমস্ত অপকর্ম করবে তাদের উপর অপরাধের মাত্রানুযায়ী আর্থিক জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

পঞ্চদশ অধ্যায় ॥ ৩৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে দৈনন্দিন ভোগের নিমিত্ত যে সব ভোগ্যপণ্য ও ব্যবহার্য দ্রব্য রাজভাণ্ডারে সংগ্রহ করা আবশ্যক, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই ভাণ্ডার বা গুদামকে বলা হয়েছে কোষ্ঠাগার এবং এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে কোষ্ঠাগারাধ্যক্ষ। কোন প্রক্রিয়ায় কি কি পণ্যদ্রব্য, কেমন গুণগতমানের পণ্যদ্রব্য রাজভাণ্ডারের জন্য সংগ্রহ বা ক্রয় করা বাঞ্ছনীয়, সে ব্যাপারে এ পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।

০২-১৫-০১–

০২-১৫-০২ কোষ্ঠাগারাধ্যক্ষ সীতা তথা কৃষিজাত পণ্য, রাষ্ট্র তথা কর হিসেবে প্রাপ্ত ফসল, ক্রয়িম তথা বাণিজ্যিক পণ্য, পরিবর্তক তথা বিনিময় পণ্য, প্রামিত্যক তথা দাবিদারহীন পণ্য, আপমিত্যক তথা পরিশোধযোগ্য কর্জকৃত পণ্য, সিংহনিকা তথা তৈরি চাল ও তেল, অন্যজাত তথা আকস্মিক রাজস্ব, ব্যয়প্রত্যয় তথা খরচের স্থিতিপত্র এবং উপস্থান তথা বকেয়া রাজস্বের কৃষিজ পণ্যের তত্ত্বাবধান করবেন। কোষ্ঠাগারাধ্যক্ষ সংগ্রহতব্য সকল প্রকার কৃষিজপণ্য তার নিযুক্ত রাজকর্মচারীদের দ্বারা ভালোভাবে যাচাই করে পণ্যের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কোষ্ঠাগারের জন্য সংগ্রহ করবেন। যে কোনো ধরনের কৃষিজাত পণ্য কোষ্ঠাগারের জন্য সংগৃহীত হলে তা সীতা বা কৃষিপণ্য বলে গণ্য হবে।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্র শব্দের মাধ্যমে নিম্নোক্ত রাজস্ব সংশ্লিষ্ট কৃষিপণ্য বোঝানো হয়েছে—(ক) পিণ্ডকর তথা গ্রামীণ জনপদ হতে রাজকীয় কর হিসেবে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি (খ) ষড়ভাগ তথা রাজস্ব হিসেবে প্রাপ্ত ফসলের এক ষষ্ঠাংশ (গ) সেনাভক্ত তথা সেনাভিযানকালে সৈনিকদের ভরণপোষণের জন্য প্রদেয় শস্যের জমাকৃত অংশ (ঘ) বলি তথা এক ষষ্ঠাংশের অতিরিক্ত প্রদেয় কর বা ধর্মীয় কাজে প্রদেয় কর (ঙ) কর তথা ফল বৃক্ষ প্রভৃতি হতে রাজাকে প্রদেয় কর (চ) উৎসঙ্গ তথা রাজপুত্রের জন্মানুষ্ঠান উপলক্ষে দেয় রাজ কর (ছ) পার্শ্ব তথা নির্ধারিত করের অতিরিক্ত আদায় (জ) পারিহীণিক তথা গবাদি পশুর দ্বারা শস্যহানিকালে জরিমানা বাবদ প্রদেয় কর (ঝ) ঔপায়নিক তথা উপঢৌকন হিসেবে প্রদেয় কর (ঞ) কৌষ্ঠেয়ক তথা রাজার প্রতিষ্ঠিত দীঘি বা উদ্যান হতে প্রাপ্ত উৎপন্ন পণ্য।

ক্রয়িম বা ক্রয় তিন প্রকার ১. ধান্যমূল্য—ধান বা ওই জাতীয় শস্য বিক্রয়লব্ধ অর্থ ২. কোষনিহার—রাজকোষের অর্থের মাধ্যমে ক্রয়কৃত শস্য ৩. প্রয়োগপ্রত্যাদান—সুদসমেত আদায়কৃত রাজকীয় শস্য।

০২-১৫-০৩ ব্যয় প্রত্যয়। কোনো নির্ধারিত কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা ব্যয় প্রত্যয়। এ ধরনের ব্যয় প্রত্যয় তিন ধরনের হতে পারে—১. বিক্ষেপশেষ—কোনো কার্য সাধনের জন্য সৈন্যদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের পর যে অবশিষ্টাংশ রয়ে যায় তা বিক্ষেপশেষ ২. ব্যাধিতশেষ— ভেজষশালার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা ব্যাধিতশেষ ৩. অন্তরারম্ভশেষ—দুর্গ প্রাসাদ প্রভৃতি পূর্তকাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা অন্তরারম্ভশেষ। উপস্থান বা বাড়তি আয় যে ছয়ভাবে অর্জিত হতে পারে তা হলো—১. তুলামানভেদ—পরিমাপণের ক্ষেত্রে দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারার তারতম্য হেতু প্রকৃত ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত পণ্য গ্রহণ ২. হস্তপূরণ—কোনো পণ্য পরিমাপের সময় ওজনদার কর্তৃক কৌশলে অতিরিক্ত পণ্য হাতিয়ে নেওয়া ৩ উৎকর—শস্যাদি ওজনের পূর্বাহ্নেই কৌশলে কিছু অংশ সরিয়ে রাখা ৪. ব্যাজী— ওজনের সময় ফাও হিসেবে গৃহীত পণ্য ৫. পর্যুসিত বিগত বছরের বকেয়া পণ্য আদায় ৬. প্রার্জিত—নিজের প্রচেষ্টায় ফুল ও লতা বিশেষ উৎপন্ন।

০২-১৫-০৪ (এ পর্যায়ে ধান, তৈল, ক্ষার ও লবণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ধান সম্পর্কে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে, যে কারণে এখানে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো না—লেখক)। ক্ষার তথা গুড় জাতীয় উৎপন্ন দ্রব্য বলতে আখ হতে উৎপন্ন বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির গুড় বুঝতে হবে। লবণ বলতে বুঝতে হবে—সিন্ধু নদী অঞ্চলে উৎপন্ন সৈন্ধব লবণ। সমুদ্র হতে উৎপন্ন সামুদ্রিক লবণ। সুবচল দেশে উৎপন্ন লবণ এবং ঊষর ভূমি হতে উৎপন্ন উদ্ভেদজ লবণ। এগুলো ছাড়াও মৌমাছির মাধ্যমে সঞ্চিত এবং আঙুর হতে উৎপন্ন দু প্রকার মধুর কথা বলা হয়েছে।

০২-১৫-০৫ এ পর্যায়ে ইক্ষু, জাম ও কাঁঠালের রসসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের রস ও তা সংরক্ষণের প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও তেঁতুল, আম, লেবু, বড় কুল, মিষ্টি কুল ও অন্যান্য আরও কিছু ফলের রস কোষ্ঠাগারে সংরক্ষণের বিষয় আলোচিত হয়েছে।

০২-১৫-০৬ এ পর্যায়ে কোষ্ঠাগারে সংরক্ষণেয় দই, ঘোল, মরিচ, গোল মরিচ, আদা, জিরা, চিরতা, সাদা সর্ষে, মৌরিসহ আরও বহুবিদ মশলার কথা বলা হয়েছে। আরও দেওয়া হয়েছে—শুঁটকি মাছ, শুকনো মাংস, পেঁয়াজসহ অন্যান্য শাকসব্জি সংরক্ষণ বিষয়ক নির্দেশনা। দুর্ভিক্ষ বা আপতকালে জনপদবাসীর চাহিদা পূরণের জন্য এ সমস্ত ভোগ্যপণ্য মজুদ করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আপতকালের সংকট পরিহারের নিমিত্ত নৈমিত্তিক ভোগের পর পুনর্ভরণের মাধ্যমে সব সময়ের জন্য মজুদ পণ্যের অর্ধেক পরিমাণ কোষ্ঠাগারে সংরক্ষণ করতে হবে।

০২-১৫-০৭ বিভিন্ন দ্রব্যের প্রকৃতি অনুযায়ী তা যেন সঠিক পদ্ধতিতে চূর্ণ, ভাজা বা প্রক্রিয়াজাত করা হয় সে ব্যাপারে কোষ্ঠাগারাধ্যক্ষ নজরদারী জারি রাখবেন। কোন জাতের ধান থেকে কি পরিমাণ চাল পাওয়া যাবে, কোন চাল সেদ্ধ করার পর পরিমাণে কতটুকু বৃদ্ধি পাবে, এসব বিষয়সহ এগুলোর সংরক্ষণ প্রক্রিয়া, অবচয় এবং কোন দ্রব্যে কতটুকু সার পদার্থ থাকে সে বিষয়েও তাকে হতে হবে অবহিত ও সচেষ্ট।

০২-১৫-০৮ তিল, যব, মুগ, মাষ ইত্যাকার দ্রব্য চূর্ণ করা হলেও পরিমাণের তারতম্য হয় না। অন্যদিকে গম, ভাজা যব চূর্ণ করা হলে তা পাঁচগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এভাবে বিভিন্ন দ্রব্য ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কি পরিমাণে হ্রাস বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।

০২-১৫-০৯ এ পর্যায়ে চাল সেদ্ধ করার পর কোন ধরনের চাল হতে কি পরিমাণ ভাত পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে— কোদ্ৰব, বরক, উদারক ও প্রিয়ঙ্গুর জাতীয় চাল দিয়ে ভাত রান্না করা হলে সমপরিমাণ চালের তিনগুণ ভাত উৎপন্ন হয়। ব্রীহির চাল হতে চারগুণ এবং শালিধানের চাল হতে পাঁচগুণ ভাত উৎপন্ন হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ধান হতে আহরিত চালে দ্বিগুণ, আড়াইগুণ বা তিনগুণ পরিমাণ ভাত পাওয়া যায়। এছাড়া ব্রীহি ধানের চাল ভাজা হলে এক পঞ্চমাংশ বৃদ্ধি পায়। ছোলা জাতীয় দানাদার শস্য ভাজা হলে তা দ্বিগুণ পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। খই ও বিভিন্ন ডাল ভাজার পর দ্বিগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তেলের ক্ষেত্রে অতসীর বীজ থেকে ছয় ভাগের এক ভাগ তেল নির্গত হয়। নিমবীজ, কুশ, আম ও কপিত্থ থেকে পাঁচ ভাগের এক ভাগ তেল পাওয়া যায়। তিল, কুসুম্ভ, মধুক ও ইঙ্গুদী থেকে চার ভাগের এক ভাগ তেল পাওয়া যায়।

০২-১৫-১০ সুতার ক্ষেত্রে পাঁচ পল কার্পাস এবং পাঁচ পল ক্ষৌম বা শন হতে এক পল পরিমাণ সুতা উৎপন্ন হয়। হস্তিশাবকের ভাত বরাদ্দের ক্ষেত্রে পাঁচ দ্রোণ বা বিশ আঢ়ক পরিমাণ শালিধান হতে প্রাপ্ত বারো আঢ়ক পরিমাণ চালের ভাত হস্তিশাবকের খাবার হিসেবে নির্ধারিত হবে। এভাবে দুষ্টহাতির জন্য একাদশ আঢ়ক চালের ভাত, রাজার বাহনে নিযুক্ত হাতির জন্য দশ আঢ়ক পরিমাণ চালের ভাত, যুদ্ধের জন্য নিযুক্ত হাতির জন্য নয় আঢ়ক চালের ভাত নির্ধারিত। অন্যান্য কাজে নিয়োজিত হাতির জন্য বিভিন্ন পরিমাণের চালের ভাত নির্ধারণ করতে হবে।

০২-১৫-১১ একজন আর্য তথা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের আহারের জন্য দৈনিক যে পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য নির্ধারিত, তা হলো—এক প্রস্থ ভাত, এক প্রস্থের এক চতুর্থাংশ ডাল-তরকারি, ষোলো ভাগের এক ভাগ লবণ, চার ভাগের এক ভাগ ঘি বা তেল। আর্য বালকরা পাবে এর অর্ধেক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য। একজন নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য এই ভোজন দ্রব্যের পরিমাণ হলো—এক প্রস্থ ভাত, ভাতের ষোল ভাগের এক ভাগ ডাল-তরকারি, এর অর্ধেক পরিমাণ তেল বা ঘি এবং লবণ পূর্ববৎ। একজন আর্যপুরুষ অর্থাৎ ভদ্রলোকের জন্য যে পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য নির্ধারিত তার এক চতুর্থাংশ মহিলাদের জন্য নির্ধারিত হবে। নিকৃষ্ট বা অধস্তন মহিলাদের ক্ষেত্রে সম পর্যায়ের পুরুষের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ কম খাবার নির্ধারিত হবে। তাদের সন্তানদের জন্য অর্ধেক পরিমাণ নির্ধারিত হবে। মাংস রন্ধনের ক্ষেত্রে বিশ পল পরিমাণ মাংস রান্নার জন্য প্রয়োজন হবে অর্ধ কুডুব (এক প্রস্থের আট ভাগের এক ভাগ) তেল বা ঘি, এক পল পরিমাণ লবণ, এক পল পরিমাণ গুড়, দুই কুডুব মরিচ ও দই। এভাবে বিভিন্ন পরিমাণের মাংস বন্ধন করতে হবে। শুঁটকি মাছ, শুকনো মাংস, শাক ও অন্যান্য খাদ্য রন্ধনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত মাত্রার মশলাপাতি ব্যবহার করতে হবে।

০২-১৫-১২ ষাঁড়ের খাদ্যের ক্ষেত্রে এক দ্রোণ পরিমাণ মাষকলাই এবং এক দ্রোণ পরিমাণ যব ও আধা সেদ্ধ চালের ভাত বরাদ্দ করতে হবে। অশ্বের ক্ষেত্রেও এমনতর খাবার নির্ধারিত হবে, তবে এক্ষেত্রে এসব খাদ্যের সাথে শুষ্ক তিলের খইল এক তুলা বা একশ পল, অথবা দশ আঢ়ক চালের ভুষি মিশ্রণ করতে হবে। ষাঁড়ের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যের দ্বিগুণ পরিমাণ খাদ্য মহিষ এবং উটের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। গাধা, চিত্রিত হরিণ ও লাল হরিণের জন্য বরাদ্দ হবে ষাঁড়ের জন্য নির্ধারণকৃত খাদ্যে অর্ধেক পরিমাণ। ছাগল ও শুকরের জন্য বরাদ্দ করতে হবে দুই প্রস্থ মাষাদি খাদ্যদ্রব্য। হাঁস, ক্রৌঞ্চ ও ময়ূরদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে দুই কুডুব পরিমাণ খাদ্য। এ সমস্ত জীবজন্তু ছাড়াও অন্যান্য হিংস্র জন্তুদের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন খাবার পর্যবেক্ষণ করে তাদের খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ বা বরাদ্দ করতে হবে।

০২-১৫-১৩ রন্ধন কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত অঙ্গার ও তুষ কামারদের কামারশালায় এবং সাধারণ লোকের গৃহের দেয়াল, ভিত্তি ও মেঝে লেপনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। রান্নার পর চালের খুদ বা গুড়া অবশিষ্ট থাকলে তা কর্মকর, সুপকার ও দাসদের ভোজনের জন্য প্রদান করতে হবে। এরপরও চালের গুড়া অবশিষ্ট থাকলে তা সাধারণ পাচক ও পিঠা প্রস্তুতকারকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। রন্ধনের কাজে সম্পৃক্ত যে সমস্ত উপকরণ ব্যবহার করতে হবে তা হলো—ওজন করবার দাঁড়িপাল্লা। পরিমাপের বাটখারা। দলনযন্ত্র। পেষণের পাথর। কোটার অস্ত্র। ঢেঁকি। ছাঁকনি। কুলা। চালনি। ঝুঁড়ি। ঝাড়ু।

০২-১৫-১৪ রন্ধনশালায় দায়িত্ব পালনকারী কর্মচারীরা হলো—মাৰ্জক তথা মেঝে পরিষ্কার করার ঝাড়ুদার। আরক্ষক তথা পাহারাদার। ধারক তথা দাঁড়িপাল্লার মাপকারী। মায়ক তথা ধান্যাদির (চাউলের) পরিমাপক। মাপক তথা দ্রব্যের পরিমাপকারী। দায়ক তথা রন্ধনের দ্রব্য আনয়নকারী। শলাকাপ্রতিগ্রাহক তথা আনীত দ্রব্যের হিসাবরক্ষক। ক্রীতদাস ও কর্মকর বর্গ। চাল সংরক্ষণের স্থান হতে হবে কিছুটা উঁচুতে। গুড় ও ক্ষার দ্রব্য সংরক্ষণ করতে হবে তৃণাদির দ্বারা নির্মিত নিশ্ছিদ্র ভাণ্ডে। ঘি বা তৈল জাতীয় দ্রব্য সংরক্ষণ করতে হবে মৃৎপাত্র বা কাষ্ঠ পাত্রে। লবণ সংরক্ষণ করতে হবে মৃৎ পাত্রে।

ষোড়ষ অধ্যায় ॥ ৩৪ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে পণ্য দ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ে নিযুক্ত রাজ কর্মচারী তথা পণ্যাধ্যক্ষের কাজের পরিধি, দায়িত্ব, কর্তব্যসহ ক্রয় বিক্রয় তথা বাজার ব্যবস্থার সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর আলোকপাত করে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-১৬-০১ পণ্যাধ্যক্ষ ভূমি এবং জলে উৎপাদিত নানাবিধ পণ্যদ্রব্য সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত থাকবেন। স্থলপথ এবং জলপথে আনীত পণ্যদ্রব্যের মূল্যমান সম্পর্কে জ্ঞাত থাকবেন। এছাড়াও তিনি কোন দ্রব্যের বাজারে চাহিদা কেমন, কোন পণ্যদ্রব্য জনগণের কাছে অধিক প্রত্যাশিত, সে সব বিষয়েও পুরোপুরি অবহিত থাকবেন। এভাবে তিনি চাহিদা ও সরবরাহ নিরূপণের মাধ্যমে কোন পণ্যদ্রব্য কোন অঞ্চলে বিক্রয়ের জন্য প্রেরণ করতে হবে, কোন অঞ্চল হতে বিক্রয়তব্য কোন কোন পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে হবে, ইত্যাকার বিষয়সহ কোন পণ্যদ্রব্য কখন কোথায় বিক্রয় করতে হবে, সেসব ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন এবং প্রয়োজনের নিরিখে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। যেসব পণ্যদ্রব্য পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয়, পণ্যাধ্যক্ষ সেসব পণ্যদ্রব্য একস্থানে সংগ্রহ করে বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধি করবেন। চাহিদার নিরিখে বর্ধিতমূল্যে পণ্যদ্রব্য বিক্রিত হলে পণ্যাধ্যক্ষ সেসব দ্রব্যের মূল্য আরও বৃদ্ধি করবেন।

০২-১৬-০২ পণ্যাধ্যক্ষ রাজকীয় ভূমিতে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য একটি সুনির্দিষ্ট বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। অন্যদেশে উৎপন্ন দ্রব্য তথা আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য একাধিক স্থানে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। স্বদেশি এবং ভিনদেশি উভয় পণ্যদ্রব্যই বিক্রয় প্রাক্কালে ক্রেতার স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রজাপীড়ন না করে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। কোনো পণ্যদ্রব্য বিক্রয়কালে যদি সমূহ মুনাফার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু তা যদি হয় প্রজাদের জন্য পীড়াদায়ক, সেক্ষেত্রে পণ্যাধ্যক্ষ এ ধরনের উচ্চমূল্যের লাভজনক বিপণন পরিহারকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। দুধ, শাক, ফুলসহ অধিক চাহিদাসম্পন্ন পণ্যদ্রব্য যা সহজেই বিক্রয় হয়, তা কখনো মজুদ করে সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না।

০২-১৬-০৩ বণিকরা রাজকীয় পণ্যদ্রব্য বিভিন্ন স্থানে তথা বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করতে পারবে, এ ধরনের বিপণনের ফলে যদি রাজার কোনো আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বণিকরা সে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। এছাড়াও—

(ক) পরিমাপের মাধ্যমে বিক্রিয়তব্য পণ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে বিক্রিত দ্রব্যের ষোল ভাগের একভাগ সারচার্জ বা মানব্যাজী হিসেবে রাজাকে প্ৰদান করতে হবে।

(খ) ওজনের মাধ্যমে বিক্রয়তব্য পণ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে বিক্রিত দ্রব্যের বিশ ভাগের এক ভাগ কর হিসেবে রাজাকে প্রদান করতে হবে।

(গ) সংখ্যা হিসেবে বিক্রয়তব্য পণ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে বিক্রিত দ্রব্যের এগার ভাগের এক ভাগ ব্যাজী হিসেবে রাজাকে প্রদান করতে হবে। যেসব বণিক বা আমদানিকারক বিদেশি পণ্যদ্রব্য আমদানি করবেন তারা যেন অন্তঃপাল তথা সীমান্ত কর্মকর্তা, আটবিক তথা বন কর্মকর্তা এবং রাজবল্লভ তথা রাজকর্মকর্তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার না হন সে ব্যাপারে পণ্যাধ্যক্ষ নজর রাখবেন। আমদানিকারকরা যাতে মুনাফা করতে পারে সে জন্য তাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করতে হবে। বিদেশি বণিকদের বিরুদ্ধে ঋণ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ রাজদরবারে উত্থাপন করা যাবে না। এ ব্যাপারে উদ্ভূত সমস্যা পণ্যাধ্যক্ষই সমাধান করে দিবেন, প্রয়োজনে তাদেরকে পুনরায় ঋণগ্রহণের সুবিধা প্রদান করবেন। কিন্তু কেউ যদি ওই সমস্ত বিদেশি বণিকদের সহায়তাকারী হয়েও ন্যায্য প্রাপ্য হতে বঞ্চিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তারা তাদের বিরুদ্ধে রাজার কাছে নালিশ জানাতে পারবে।

০২-১৬-০৪ রাজকীয় পণ্যদ্রব্যের বিক্রেতারা বিক্রিত দ্রব্যের অর্থ একটি এক ছিদ্র বিশিষ্ট পেটিকাতে সংরক্ষণ করবেন। বিক্রয় সমাপ্ত হলে বিক্রেতারা বিক্রিত পণ্যের অর্থ এবং অবিক্রিত পণ্যদ্রব্য পণ্যাধ্যক্ষকে বুঝিয়ে দিবেন। একই সাথে তারা পণ্যদ্রব্য পরিমাপক ও ওজনের দাঁড়িপাল্লা, প্রস্থ ও কুডুব কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যর্পণ করবে।

০২-১৬-০৫ রাজকীয় পণ্যদ্রব্য বিদেশের বাজারে বিপণন করতে হলে যে সব বিষয়াদি বিবেচনা করতে হবে, তা হলো—বিভিন্ন ধরনের শুল্ক, কর, পরিবহন ব্যয় নির্বাহের পর যদি মুনাফার সম্ভাবনা থাকে তবেই বৈদেশিক বাজারে রাজকীয় পণ্যদ্রব্য প্রেরণ করা যাবে। অন্যদেশে পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের জন্য রফতানি করতে হলে যে সব খাতে ব্যয় হবে তা হলো—বিধিবদ্ধ শুল্ক, প্রদেয় কর, পরিবহন ব্যয়, পণ্যদ্রব্যের নিরাপত্তা খাতের ব্যয়, খেয়া পারাপার ব্যয়, নিযুক্ত লোকবলের বেতন খাতে ব্যয় এবং বৈদেশিক রাজাকে প্রদেয় পণ্যের অংশ। ইত্যাকার খাতে ব্যয় নির্বাহের পর প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে কি না তা পণ্যাধ্যক্ষ ভালোভাবে খতিয়ে দেখবেন। প্রয়োজনে তিনি পণ্য বিনিময়ের দিকটিও খতিয়ে দেখতে পারেন। সার্বিক হিসেবের পর যদি বিদেশে পণ্য প্রেরণ লাভজনক বলে প্রতিভাত হয়, সেক্ষেত্রে পণ্যাধ্যক্ষ সমীক্ষিত মুনাফার এক চতুর্থাংশ ব্যয় করে নিরাপদ তথা বিঘ্নহীন স্থলপথে পণ্যদ্রব্য প্রেরণ করবেন। এক্ষেত্রে যে রাজ কর্মচারী বা বণিককে পণ্যদ্রব্য সমেত বিদেশে প্রেরণ করা হবে তিনি প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জনের জন্য বৈদেশিক রাজ্যের বন কর্মকর্তা, সীমান্ত কর্মকর্তা, নগর প্রধান এবং জনপদ প্রধানের সঙ্গে সখ্য স্থাপনের মাধ্যমে তাদের সহায়তা গ্রহণ করে অধিক পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ে সচেষ্ট থাকবেন।

০২-১৬-০৬ বিদেশে বাণিজ্য করতে গিয়ে কোনো বণিক যদি বিপর্যস্ত হয় বা কোনো দৃষ্কৃতিকারী কর্তৃক আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে তিনি নিজের কাছে রক্ষিত মূল্যবান দ্রব্যসহ সর্বাগ্রে নিজেকে রক্ষা করবে। বিদেশে অবস্থানকালে বণিকরা পররাজ্যের রাজাকে প্রদেয় সকল প্রকার কর বা শুল্ক নিয়মিত পরিশোধ করবে। তারা কখনোই কর ফাঁকি দিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবে না।

বণিকরা যখন বিদেশে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে জলপথে যাত্রা করবে তখন—বিধি মোতাবেক জলযানের ভাড়া, বিদেশি নাবিকদের বেতন, সমুদ্র বা নদী পথে অবস্থানকালীন খাবারের ব্যয়, স্বদেশি ও বিদেশি পণ্যমূল্যের তারতম্য, জলপথে যাত্রার উপযুক্ত সময়, জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতিকারের সম্ভাব্য উপায়, বিদেশের যে বাজারে পণ্য বিক্রয় করা হবে সেখানকার সুবিধা অসুবিধা, ইত্যাকার বিবিধ বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে, সচেতন থেকে, বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এছাড়াও যে দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে গমন করবে সে দেশের রীতিনীতি ও আচার সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হবে। যেখানে মুনাফার সম্ভাবনা বেশি থাকবে বণিকরা সেখানকার বাজারে পণ্যদ্রব্য নিয়ে গমন করবে। যেখানে মুনাফার সম্ভাবনা কম বলে অনুমতি হবে বণিকরা সে এলাকার বাজার পরিহার করবে।

সপ্তদশ অধ্যায় ॥ ৩৫ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বনজ সম্পদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। একই সাথে বনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা তথা কুপ্যাধ্যক্ষ ও অন্যান্য কর্মচারীদের দায়িত্ব ও করণীয়ের ব্যাপারে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা।

০২-১৭-০১ বনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা কুপাধ্যক্ষ বনে দায়িত্বরত রক্ষীদের মাধ্যমে কাঠসহ অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করবেন। তিনি বনের কাঠ দিয়ে বাহন নির্মাণের কারখানা স্থাপন করবেন। বনের বৃক্ষ পরিচর্যাকারীদের বেতন প্রদান করবেন। অনুমতি ব্যতিরেকে বিনা কারণে কেউ বৃক্ষের ক্ষতিসাধন করলে বনরক্ষক তার উপর দণ্ড আরোপ করবেন। বিশেষ প্রয়োজনে কারো দ্বারা বিনা অনুমতিতে বৃক্ষ কর্তিত হলে অবশ্য দণ্ড প্রযোজ্য হবে না।

০২-১৭-০২ বনজ দ্রব্য তথা কাঠ সম্পর্কীয় বিষয়াদি—সেগুন, নেমী, ধনুবৃক্ষ, অর্জুন, তিলক, শাল, শিশু, অরিমেদ, ক্ষীরিকা, শিরীষ, খদির, সরল, তাল, পীতশাল, অশ্বকর্ণ, শ্বেতখদির, লোমশপুচ্ছক, আম, গৌরসর্জ, ধুরন্দর ইত্যাকার বৃক্ষ মজবুত কাঠের বৃক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে।

০২-১৭-০৩ বাঁশ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বৃক্ষগুলো হলো—উটজ বা ছিদ্রযুক্ত বহিরাঙ্গনে ছোট ছোট কাঁটাঅলা বাঁশ। চিমিয় বা বহিরাঙ্গন ছালযুক্ত ছিদ্রহীন বাঁশ। চাপ বা খসখসে বহিরাঙ্গনঅলা স্বল্প ছিদ্রযুক্ত বাঁশ। বেণু বা ধনু নির্মাণের গুণসম্পন্ন কাঁটাহীন বাঁশ। সাতীন বা ছোট আকৃতির বাঁশ। কণ্টক জাতীয় বাঁশ। ভাল্লুক বা বিশাল আকৃতির কাঁটাহীন স্থুল প্রকৃতির বাঁশ। লতাগুল্ম প্রজাতির বনজ সম্পদ হলো—বেত, শীকবল্লী নামক লতা, বাশী বা অর্জুন ফুলের মতো সমান ফুল বিশিষ্ট লতা, শ্যামলতা, নাগলতা। রজ্জু প্রস্তুতের আঁশ বিশিষ্ট তৃণজ সম্পদগুলো হলো—চামেলী, মূর্বা, অর্ক, শণ, গবেণুকা

০২-১৭-০৪ এছাড়াও অন্যান্য বনজ সম্পদের মধ্যে—তালী, তাল ও ভূর্জপত্র হলো লেখনির উপযোগী পত্র। কিংসুক, কুসুম্ভ, কুঙ্কুম জাতীয় ফুল হলো কাপড় রঙ করার উপকরণ। কন্দ, মূল ও আমলকি-হরিতকি হলো বিভিন্ন ঔষধের কাঁচামাল।

০২-১৭-০৫ এসমস্ত বনজ সম্পদ ছাড়াও বিভিন্ন বিষাক্ত প্রকৃতির বৃক্ষ হলো; কালকূট—অশত্থ পাতার আকৃতি বিশিষ্ট পাতা যা থেকে বিষাক্ত নির্যাস নির্গত হয়। বৎসনাভ—যে বিষ বৃক্ষের আশেপাশে কোনো বৃক্ষ জন্মাতে পারে না। হালাহাল—গোস্তনের আকৃতি বিশিষ্ট ফলযুক্ত বৃক্ষ। মেষশৃঙ্গ—পদ্মের মুকুলের মতো আকৃতি বিশিষ্ট ফলযুক্ত বৃক্ষ। মুস্তা—শঙ্খের মতো সাদা বৃক্ষ। কুষ্ঠ—বিষে পরিপূর্ণ ঔষধি গাছ। মহাবিষ—স্তনবৃন্তের মতো ফলযুক্ত বিষাক্ত বৃক্ষ। বেল্লিতক—বিষাক্ত ঔষধি বৃক্ষ। গৌরার্দ্র—কৃষ্ণবর্ণ ঔষধি বৃক্ষ। বালক বিশেষ ঔষধি বৃক্ষ। মার্কট—বানরের লিঙ্গাকৃতির বিশেষ ঔষধি বৃক্ষ। হৈমবত হিমালয়ে উৎপন্ন লম্বা পাতাযুক্ত বিষাক্ত বৃক্ষ। কালিঙ্গক—কলিঙ্গদেশে উৎপন্ন যবাকৃতির ঔষধি বৃক্ষ। দারদ—দারদ দেশে উৎপন্ন বিষাক্ত পাতাঅলা বৃক্ষ। অঙ্কোলসারক—আঁকড় বৃক্ষ এবং উষ্ট্রক—উটের লিঙ্গের মতো মূল বিশিষ্ট বৃক্ষ (এ সমস্ত নানা প্রকারের বিষ বৃক্ষের সাথে বিষাক্ত সাপ এবং কীটের সংযুক্তি করে বনজ সম্পদের বিষ বিষয়ক আলোচনা সমাপ্ত করা হয়েছে)।

০২-১৭-০৬ চর্ম বিষয়ক আলোচনা—গোধা তথা চতুষ্পদ গিরগিটি জাতীয় সরিসৃপ, সেরক তথা সাদা চামড়া বিশিষ্ট গিরগিটি, দ্বীপী তথা চিতা বাঘের চামড়া, শিংশুমার তথা শুশুক জাতীয় জলজ প্রাণীর চামড়া। সিংহ, বাঘ, হাতি, মহিষ, গরু, চমর, হরিণ, গণ্ডার ও অন্যান্য প্রাণীর চামড়া। হিংস্র পশুর হাড়, হাতির দাঁত, পশুর শিং, পাখির পালক, চোখ ইত্যাকার সকল দ্রব্যাদি বন কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিধায় কুপ্যাধ্যক্ষকে এগুলো সংগ্রহ করতে হবে।

০২-১৭-০৭ ভাণ্ড বিষয়ক আলোচনা—ভাণ্ড দুই প্রকার: (১) বাঁশ, বেত, প্রভৃতি দিয়ে তৈরি ঝুড়ি জাতীয় পাত্র বা ভাণ্ড (২) মৃত্তিকার তৈরি জলপাত্র। অঙ্গার, তুষ, ভস্ম, মৃগ, পশু, পাখি, হিংস্র জন্তুদের বিচরণ ভূমি এবং কাঠ ও তৃণ সংগ্রহের স্থান কুপ্যাধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন বিধায় তাকে এগুলোর দেখভাল ও সংগ্রহের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। কুপ্যাধ্যক্ষ নগরীর বাহিরে দ্রব্যবনের সন্নিকটে কারখানা নির্মাণ করে কারিগরদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবহার উপযোগী ভাণ্ড, বাহন, আসবাব, অস্ত্র তৈয়ারির ব্যবস্থা করবেন।

অষ্টাদশ অধ্যায় ॥ ৩৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে অস্ত্রশালার দায়িত্বে নিয়েজিত তত্ত্বাবধায়ক তথা আয়ুধাগারাধ্যক্ষ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অস্ত্রশালার অধ্যক্ষ তার নিয়োজিত অভিজ্ঞ লোকবলের দ্বারা কীভাবে অস্ত্র এবং সামরিক যানবাহন নির্মাণ করাবেন, কীভাবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করবেন সে সম্পর্কে এ পর্যায়ে বিস্তারিত দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-১৮-০১ অস্ত্রাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক অভিজ্ঞ নির্মাতাদের দ্বারা যুদ্ধের জন্য কার্যকর অস্ত্র, শত্রুর দুর্গ ধ্বংসের উপযোগী অস্ত্র এবং নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংহতকরণের উপযোগী অস্ত্র নির্মাণ করাবেন। নির্মিতব্য অস্ত্রের প্রকৃতি ও সংখ্যার ভিত্তিতে তিনি লোকবল নিয়োগ করবেন এবং সে মোতাবেক উৎপাদনের পরিমাণ অনুযায়ী বেতন প্রদান করবেন। উৎপাদিত অস্ত্র তিনি প্রয়োজন অনুপাতে বিভিন্ন সেনা শিবিরে সরবরাহ করবেন। মাঝে মাঝে অস্ত্র স্থানান্তর করবেন। কার্যকারিতা নিশ্চিতকল্পে অস্ত্রগুলোকে রৌদ্র এবং বিশুদ্ধ বাতাসের সান্নিধ্যে রাখার ব্যবস্থা করবেন। এগুলো যেন তাপ, আর্দ্রতা এবং ঘুণে পোকার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন। অস্ত্রের প্রকৃতি অনুযায়ী এগুলোকে উত্তম, মধ্যম, অধম শ্রেণিতে বিভাজিত করে অস্ত্রের কার্যক্ষমতা, আকার আকৃতি, প্রাপ্তিস্থান, সংরক্ষণাগার এবং মূল্যমান সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত থাকবেন।

০২-১৮-০২ এক্ষেত্রে যে দশ ধরনের অস্ত্র স্থিত বা অবহনযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে তা হলো—১. সর্বতোভদ্র—চক্রাকৃতির ঘুর্ণন অস্ত্র, যদ্বারা দূরবর্তী শত্রুর অবস্থানে প্রস্তর নিক্ষেপ করা হয় ২. জামদগ্ন্য—বিরতীহীনভাবে তীর নিক্ষেপের বিশালাকৃতির ধনুর্যন্ত্র ৩. বহুমুখ—দুর্গের অভ্যন্তর থেকে শত্রুর দিকে তীর নিক্ষেপের দেয়াল বিশেষ ৪. বিশ্বাসঘাতী—দুর্গে প্রবেশ পথের পরিখায় সংস্থাপিত কাঠের পাটাতন বিশেষ, শত্রুরা যার উপর আরোহণ করা মাত্র তা ভেঙে পড়বে ৫. সংঘাটি—অগ্নি প্রজ্জ্বলনের লম্বা কাষ্ঠখণ্ডের যন্ত্র বিশেষ যা দিয়ে শত্রুর নগরে বা দুর্গে আগুন লাগানো হয় ৬. যানক—চক্রে সংস্থাপিত শত্রুর প্রতি প্রক্ষেপণযোগ্য কাঠের দণ্ড ৭. পর্জন্যক—আগুন নেভানোর যন্ত্র বিশেষ ৮. বাহুযন্ত্র —যুগল স্তম্ভ বিশিষ্ট শত্রু নিধনের অস্ত্র বিশেষ ৯. ঊর্ধ্ববাহু—উর্ধস্থান হতে শত্রু নিধনের বিশেষ যন্ত্র ১০. অর্ধ্ববাহু—উর্ধ্ববাহুর অর্ধেক আকারের যন্ত্র বিশেষ।

০২-১৮-০৩ স্থিত অস্ত্র ছাড়াও নানা ধরনের বহনযোগ্য এবং স্থানান্তরযোগ্য অস্ত্র হলো—১. পঞ্চালিক—ইস্পাতের তীক্ষ্ণ শলাকাযুক্ত কাষ্ঠ ফলক, শত্রুর গতিরোধ করার জন্য যা দুর্গের বাহিরে জলপূর্ণ পরিখায় স্থাপন করা হয় ২. দেবদণ্ড—দুর্গের প্রাচীরের বাহিরে স্থাপিত ভারী কাষ্ঠ স্তম্ভ ৩. সূকরিকা—আঘাত প্রতিরোধের জন্য চামড়া ও তুলা দিয়ে নির্মিত প্রতিরোধক ৪. মুসলষষ্টি—খয়ের গাছের কাষ্ঠনির্মিত শূলাকৃতির অস্ত্র বিশেষ ৫. হস্তিবারক—হাতির গতিরোধক সুচাগ্র দীর্ঘ দণ্ড ৬. তালবৃন্ত—পাখার মতো চক্রাকার অস্ত্র বিশেষ ৭. শত্রুর প্রতি আঘাত হানার মুগর ৮. দ্রুঘণ—মুগুরের মতো অস্ত্র বিশেষ ৯. শত্রুকে সরাসরি আক্রমণের গদা ১০. ম্পৃক্তলা—কাঁটাযুক্ত গদা ১১. কোদাল ১২. আস্ফোটিম— শত্রুকে ভীতি প্রদর্শনের শব্দ উৎপাদক যন্ত্র বিশেষ ১৩. উদ্ঘাটিম—মুগুর আকৃতির আরেক ধরনের অস্ত্র বিশেষ ১৪. উৎপাটিম—দালানকোঠা ধ্বংস করার বিশেষ অস্ত্র ১৫. শতঘ্নী—দুর্গের প্রাচীরের উপর স্থাপিত চাকাযুক্ত বিশালাকৃতির স্তম্ভ ১৬. শত্রুকে আঘাতের জন্য ত্রিশূল ১৭. শত্রুকে আঘাতযোগ্য চক্র।

০২-১৮-০৪ সরাসরি আঘাত করবার অস্ত্রগুলো হলো—১. শক্তি— হাতলযুক্ত চারহাত লম্বা লৌহনির্মিত অস্ত্র ২. প্রাস—দুই হাতলবিশিষ্ট লোহার আবরণযুক্ত অস্ত্র ৩. কুন্ত—পাঁচ, ছয় বা সাত হাত দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বল্লম বিশেষ ৪. হাটক—তিন ফলকযুক্ত বল্লম বিশেষ ৫. ভিণ্ডিপাল—মোটা ফলকযুক্ত বল্লম বিশেষ ৬. শূল—দীর্ঘ একমুখ বিশিষ্ট অস্ত্র ৭. তোমর—তীরাকৃতির চার পাঁচ হাত দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট অস্ত্র, এ ধরনের অস্ত্র উত্তম, মধ্যম ও অধম, এই তিন প্রকৃতির হতে পারে ৮. বরাহকর্ণ—রবাহের কানের আকৃতির অস্ত্র বিশেষ ৯. কণয় লৌহনির্মিত উভয়-দিকে তিন মুখ বিশিষ্ট অস্ত্র, এগুলোও উত্তম, মধ্যম ও অধম প্রকৃতির হতে পারে ১০. কর্পণ—তোমরের তুলনায় দীর্ঘ হাতে নিক্ষেপণযোগ্য অস্ত্র ১১. ত্রাসিকা—লৌহনির্মিত চূড়াযুক্ত, প্রাসের সমমাপের দীর্ঘ অস্ত্র। ধনু জাতীয় অস্ত্রগুলো হলো—তাল, যা তাল গাছ দিয়ে নির্মিত। চাপ—যা বিশেষ ধরনের বাঁশ দিয়ে নির্মিত। দারব—শক্ত কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত এবং শাঙ্গ—যা শিং দিয়ে নির্মিত ধনু বিশেষ। আকার এবং কার্যকারিতার মানদণ্ডে এই ধনুগুলো কামুক, কোদণ্ড এবং দ্রুণ নামে পরিচিত

০২-১৮-০৫ ধনুতে ব্যবহারের জন্য নিম্নোক্ত দ্রব্য হতে গুণ প্রস্তুত করা যায়—মূর্বা, অর্ক, শন, গবেধু, বাঁশ ও স্নায়ু। তীর যে কয় প্রকৃতির হতে পারে তা হলো—বেণু যা বাঁশ দিয়ে তৈরি। শর, শলাকা যা শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি। দণ্ডাসন যা কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি। নারাচ যা সম্পূর্ণ লোহা দিয়ে তৈরি। এ সমস্ত তীরের অগ্রভাগে লোহা বা কাঠ ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব তীর রক্তপাতহীন প্রকৃতির হতে পারে আবার রক্ত ক্ষরণমূলকও হতে পারে। খড়গ বা তরবারি তিন প্রকৃতির হতে পারে—১. নিষ্ক্রিংশ, যার অগ্রভাগ বাঁকানো ২. মণ্ডলাগ্র, যার অগ্রভাগ বৃত্তাকার ৩. অসিযষ্টি যা দীর্ঘ ও পাতলা আকৃতি বিশিষ্ট।

০২-১৮-০৬ এছাড়াও যুদ্ধে ব্যবহার্য অন্যান্য অস্ত্র হলো—১. পরশু যা পরিপূর্ণ লৌহে প্রস্তুত ২৪ আঙুলের সমান ক্ষুদ্রাস্ত্র ২. পট্টস—যার উভয় পাশ ত্রিশূলের মতো ৩. খনিত্র—যা খন্তার মতো অস্ত্র বিশেষ ৪. কুদ্দাল—কোদাল বিশেষ ৫. ক্রকচ—করাত আকৃতি বিশিষ্ট ৬. কাণ্ডচ্ছেদন—বড় আকৃতির কুঠার। এ সমস্ত অস্ত্র ক্ষুরের মতো ধারালো বিধায় এগুলোকে ক্ষুরকল্প নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এসব অস্ত্র ছাড়াও আরও যা ব্যবহার্য, তা হলো—১. যন্ত্রপাষাণ—এ অস্ত্রের মাধ্যমে প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করা হয় ২. গোষ্পণপাষাণ—যে দীর্ঘ দণ্ড প্রস্তর প্রক্ষেপণে ব্যবহার করা হয় ৩. মুঠিপাষাণ—যে প্রস্তর হস্ত দ্বারা নিক্ষেপ করা হয় ৪. রোচনী—তথা পাথর টুকরো করার যন্ত্র।

০২-১৮-০৭ যুদ্ধে শুধু অস্ত্রের ব্যবহারই নয়, শরীরের প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজন বর্ম বা রক্ষাকবচ। এ সমস্ত শরীরাবরণ হলো—লৌহজাল তথা লৌহনির্মিত আবরণ বিশেষ। লৌহজালিকা তথা মস্তক মোড়ানোর লৌহময় আবরণ। লৌহপট্ট তথা বাহু ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশের লোহার আবরণ। লৌহকবচ—বুক ও পিঠের লোহার আবরণ। সূত্রকঙ্কট—সুতার বস্ত্ৰে নির্মিত শরীরের আবরণ। এছাড়াও শুশুক, ডলফিন, গণ্ডার, গরু, হাতি, ইত্যাকার পশুর চামড়া দিয়েও শরীরের আবরণ নির্মিত হতে পারে। একই সাথে পশুর শিং, খুর দিয়েও দক্ষ কারিগরের মাধ্যমে বর্ম বানানো যায়। এছাড়াও শরীরে ধারণযোগ্য আবরণ বা বর্মগুলো হলো—শিরস্ত্রাণ তথা মস্তকের আবরণ। কণ্ঠস্ত্রাণ তথা কণ্ঠের আবরণ। কূপাস তথা অর্ধ বাহুর আবরণ। কঞ্চুক তথা শরীরের জানু অবধি আবরণ। বারবাণ তথা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা আচ্ছাদন। পট্ট তথা বাহু ব্যতীত শরীরের স্বাভাবিক আবরণ। নাগোদরিকা তথা হাতের আঙুলের আচ্ছাদন। এছাড়াও আঘাত প্রতিরোধের জন্য হস্তে ধারণকৃত যে সমস্ত প্রতিরোধক ব্যবহৃত হয় তা হলো—পেটি বা লতার ঢাল। চর্ম বা চামড়ার ঢাল। হস্তিকর্ণ বা মুখ ঢাকার ফলক। তালমূল বা কাঠের ঢাল। ধমনিকা বা শিঙ্গা। কবাট বা কাঠের তৈরি ফলক। কিটিকা বা বেত ও চামড়ার ঢাল। অপ্রতিহত বা হাত রক্ষার পরিপূর্ণ আবরণ। বলাহকান্ত বা হাত রক্ষার আবরণের লৌহপাতযুক্ত অগ্রভাগ।

০২-১৮-০৮ হাতি, রথ ও ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে ব্যবহৃত কশা, অঙ্কুশ প্রভৃতি ভাণ্ড। এদের অলঙ্করণের কাজে ব্যবহৃত পতাকা, ক্ষুরপ্র, মালা প্রভৃতি দ্রব্য এবং এদের শরীরে আচ্ছাদনের দ্রব্যসমূহ উপকরণ নামে অভিহিত। এছাড়া যুদ্ধের ময়দানে স্বল্প সৈন্যের সমাহারকে ব্যাপক পরিসরে উপস্থাপন এবং অগ্নিহীন এলাকাকে প্রজ্জ্বলিত আকারে প্রদর্শন করাকে বলা হয় ঐন্দ্রজালিক কর্ম। অস্ত্র উৎপাদনের কারখানা নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত আয়ুধাগারাধ্যক্ষকে বিশেষভাবে—অস্ত্র উৎপাদনের কাজে কারখানায় ব্যবহৃত বনজ সম্পদ সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত হতে হবে। রাজা ও রাজকার্য পরিচালনাকারীদের অভিপ্রায় সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হতে হবে। কাজ শুরু করার পর তা পরিসমাপ্তির সময়ের ব্যাপারে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। রাজার অভিপ্রায় অনুযায়ী কার্যসিদ্ধির ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ব্যবহার্য দ্রব্যাদির যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ব্যয় পর্যালোচনার নিরিখে লাভ ক্ষতি নিরূপণে সমর্থ হতে হবে।

উনবিংশ অধ্যায় ॥ ৩৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন দ্রব্যের পরিমাপক ও ওজনের বিষয়ে আলোকপাত করত এতদ্‌বিষয়ে প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং পৌতবাধ্যক্ষ তথা পরিমাপ ও ওজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকের দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

০২-১৯-০১ পৌতবাধ্যক্ষ তথা পরিমাপ ও দ্রব্যের ওজন বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা এবং অন্যান্য পরিমাপক তৈরি ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় কারখানা ভবন নির্মাণ করাবেন। এই কারখানায় তিনি মানসম্মত দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারা তৈরি করাবেন। স্বর্ণের ওজনযন্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দশটি ধানের দানা বা পাঁচটি কুঁচ ফলের ওজনের সমান হবে এক সুবর্ণমাষ, এটি স্বর্ণ পরিমাপের প্রথম পরিমাপক। এরূপে ১৬ মাষক এক কর্ষ, চার কর্ষ সমান এক পল, এরূপেই স্বর্ণের ওজন করতে হবে। রৌপ্যের ওজনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক একক হবে ৮৮টি সাদা সর্ষে দানার সমতুল্য ওজন তথা রূপ্যমাষক। এভাবে ১৬ রূপ্য মাষকে হবে এক ধরন। এই রীতিতেই স্বর্ণ এবং রৌপ্য ওজনের জন্য বাটখারা তৈয়ার করাতে হবে।

০২-১৯-০২ হীরক ওজনের ক্ষেত্রে পরিমাপের একক হবে কুড়িটি ব্রীহিতণ্ডুল তথা বিশটি আউশ ধানের চালের ওজনের সমান বজ্রধরন। উল্লিখিত রীতিতে স্বর্ণ ওজনের জন্য যে চৌদ্দ ধরনের বাটখারা ব্যবহৃত হবে তা হলো- ১. অর্ধ মাষক ২. মাষক ৩. দুই মাষক ৪. চার মাষক ৫. আট মাষক ৬. সুবর্ণ বা ষোল মাষক ৭. দুই সুবর্ণ ৮. চার সুবর্ণ ৯. আট সুবর্ণ ১০. দশ সুবর্ণ ১১. বিশ সুবর্ণ ১২. ত্রিশ সুবর্ণ ১৩. চল্লিশ সুবর্ণ ১৪. শত সুবর্ণ। রৌপ্যের ওজনের ক্ষেত্রে যে ধরনের বাটখারা ব্যবহৃত হবে তা হলো—অর্ধমাষক। মাষক। দুই মাষক। চার মাষক। আট মাষক। ধরন। দুই ধরন। চার ধরন। আট ধরন। বিশ ধরন। চল্লিশ ধরন ও শত ধরন।

এ সমস্ত বাটখারা লৌহ উপাদানে প্রস্তুত হতে পারে। মগধ বা মেকলে দেশের পাথর দিয়ে প্রস্তুত হতে পারে, অথবা শঙ্খ ও শুক্তিসহ এমন সব উপাদান দিয়ে এগুলো প্রস্তুত করতে হবে যাতে করে পানিতে ভিজলে বা আগুনে উত্তপ্ত হলেও যেন বাটখারাগুলোর ওজনের কোনো তারতম্য না হয়।

০২-১৯-০৩ পৌতবাধ্যক্ষ স্বর্ণ ও রৌপ্য ওজনের জন্য দশ প্রকার দাঁড়িপাল্লা প্রস্তুত করাবেন। এক্ষেত্রে প্রথম দাঁড়িপাল্লার বিস্তার হবে ছয় আঙুল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দাঁড়িপাল্লার বিস্তার হবে যথাক্রমে ১৪ ও ২২ আঙুল। এভাবে প্রতি পর্যায়ে দাঁড়িপাল্লার বিস্তার আট আঙুল করে বৃদ্ধি পেয়ে চতুর্থ হবে ৩০ আঙুল, পঞ্চম হবে ৩৮ আঙুল, ষষ্ঠ হবে ৪৬ আঙুল, সপ্তম হবে ৫৪ আঙুল, অষ্টম হবে ৬২ আঙুল, নবম হবে ৭০ আঙুল এবং দশম হবে ৭৮ আঙুল বিস্তার বিশিষ্ট। প্রথম দাঁড়িপাল্লার লৌহনির্মিত অংশের ওজন হবে এক পল। এভাবে দশম দাঁড়িপাল্লা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে এক পল করে বৃদ্ধি পাবে। এসব দাঁড়িপাল্লার এক দিকে থাকবে বাটখারা এবং অন্যদিক দিকে থাকবে পরিমাপেয় স্বর্ণ বা রৌপ্য।

০২-১৯-০৪–

০২-১৯-০৭ এই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য দ্রব্য ওজনের জন্য ৩৫ পল লৌহ দিয়ে বাহাত্তর আঙুল বিস্তার বিশিষ্ট সমবৃত্তা নামক দাঁড়িপাল্লা প্রস্তুত করাবেন। এর মধ্যস্থানে পাঁচ পল পরিমিত আংটা বেঁধে মধ্যস্থল চিহ্নিত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে এর দ্বিগুণ পরিমাণ লৌহ দিয়ে ছিয়ানব্বই আঙুল তথা চার হাত দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট দাঁড়িপাল্লা প্রস্তুত করতে হবে। ১০০ পল মাপের পর ২০, ৫০, ১০০ যুক্ত করে ২০০ পল মাপের চিহ্ন বসাতে হবে। যে সমস্ত দাঁড়িপাল্লার মাধ্যমে রাজকীয় দ্রব্য ওজন করা হবে সে সব ওজন যন্ত্রের নাম হবে আয়মানী। ভৃত্যদের প্রদেয় দ্রব্য ওজনের দাঁড়িপাল্লার নাম হবে ভাজনী। মহারানি ও রাজকুমারদের প্রদেয় দ্রব্য ওজনের দাঁড়িপাল্লার নাম হবে অন্তঃপুরভাজনী। ওজনের ক্ষেত্রে এ সমস্ত দাঁড়িপাল্লায় ৫ থেকে ১৫ পল ওজনের পার্থক্য নির্দেশ করতে হবে।

এ সব বিষয় ছাড়াও এ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকৃতির দাঁড়িপাল্লা, বিভিন্ন উপাদানে প্রস্তুত দাঁড়িপাল্লার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও ধান এবং অন্যান্য শস্য পরিমাপ করার দ্রোণ, আঢ়ক, প্রস্থ, কুডব এবং মদ, ফুল, তুষ, অঙ্গার ও চুন পরিমাপের ব্যাপারে বলা হয়েছে। ভাড়ারে করে দ্রব্য পরিমাপের ক্ষেত্রে যে প্রস্থের কথা বলা হয়েছে, সে প্রস্থের একক হলো কুডুব। চার কুডুবে এক প্রস্থ নিরূপিত। এছাড়া এক কুডুব, অর্ধ কুডুব, এক চতুর্থাংশ কুডুব, এক অষ্টমাংশ কুডুব পরিমাপনের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য (এসব বিষয় এখনকার হিসেবে অতটা প্রাসঙ্গিক নয় বিবেচনায় বিস্তারিত আলোচনা করা হলো না—লেখক)

০২-১৯-০৮ পৌতবাধ্যক্ষ প্রতি চার মাস অন্তর একবার করে ক্রয় বিক্রয়ের কাজে ব্যবহৃত দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারার সঠিকতা যাচাই করবেন। যে ব্যক্তি অমানসম্মত দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারা ব্যবহার করবে তার উপর সোয়া ২৭ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এসব পরিমাপক নিয়মিত পরীক্ষার জন্য ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন এক কাকণিক কর পৌতবাধ্যক্ষকে প্রদান করবে। যে সব দ্রব্য তপ্ত করলে প্রকৃত ওজন কমে যায় বা পরিমাপকালে কিয়দংশ পরিমাপক পাত্রে লেগে থাকে, সেসব দ্রব্য বিক্রয় প্রাক্কালে বিক্রেতারা বিভিন্নভাবে ক্রেতার ক্ষতি পুষিয়ে দিবে। এ ক্ষেত্রে ঘৃত পরিমাপের সময় ৩২ ভাগের এক ভাগ অতিরিক্ত ঘি প্রদান করতে হবে। তেলের ক্ষেত্রে ৬৪ ভাগের এক ভাগ অতিরিক্ত তেল প্রদান করতে হবে এবং এ জাতীয় অন্যান্য তরল বা গলিত দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিক্রেতারা ৫০ ভাগের এক ভাগ অতিরিক্ত দ্রব্য ক্রেতাকে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। ঘি, দধি, তৈল পরিমাপনের জন্য বিভিন্ন কুডুব সম্পন্ন ধারণ ক্ষমতার ঘৃত ঘটিকা, তৈল ঘটিকাও এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিংশ অধ্যায় ॥ ৩৮ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে কীভাবে-কোন তরিকায় সময়, কাল, দিবস, পক্ষ, মাস, বছর, ঋতু এবং যুগ নিরূপণ করতে হয় সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা মানাধ্যক্ষের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কেও এ পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

০২-২০-০১ মানাধ্যক্ষকে ভূমি ও সময়ের হিসেব সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত থাকতে হবে। বলা হয়েছে—রথচক্র দ্বারা উত্থাপিত আট পরমাণু ধূলি চক্ষুগ্রাহ্য ধূলি কণায় পরিণত হলে তা হবে এক বিপ্রুট। অতঃপর আট বিদ্রুটে হবে এক লিক্ষা। আট লিক্ষাতে এক যূকামধ্য। আট যূকামধ্যে হবে এক যবমধ্য। আট যবমধ্যে হবে এক আঙুল।

০২-২০-০২ অতঃপর চার আঙুলে হবে এক ধনুগ্রহ। আট আঙুল বা দুই ধনুগ্রহে হবে এক ধনুর্মুষ্টি। বারো আঙুলে হবে এক বিতস্তি বা ছায়াপৌরুষ। চৌদ্দ আঙুলে হবে এক শম, এক শল, এক পরিরয় বা এক পদ। এভাবে ২৪ আঙুল বা ২ বিতস্তিতে হবে এক অরত্নি বা প্রজাপত্য হস্ত। এই নিয়মে ২৮ আঙুলে হবে কাষ্ঠদ্রব্য ও পশুচারণ ক্ষেত্র পমিাপের এক হস্ত। ৩২ আঙুলের মাপে হবে এক কংস।

০২-২০-০৩ ৪২ আঙুলে নিরূপিত এক হস্ত ব্যবহৃত হবে ছুতারের কাজে। ৩২ আঙুলে নিরূপিত এক হস্ত ব্যবহৃত হবে করাতের ক্ষেত্রে। ৫৪ আঙুলে নিরূপিত এক হস্ত ব্যবহৃত হবে বনজ সম্পদ পরিমাপে। ৮৪ আঙুলে নিরূপিত এক হস্ত ব্যবহৃত হবে রজ্জু ও কূপ পরিমাপের ক্ষেত্রে। ৯৬ আঙুল বা চার অরত্নিতে হবে এক দণ্ড, ধনু, নালিকা বা পৌরুষ। রাস্তা ও দুর্গের দেয়াল পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হবে ১০৮ আঙুলের পরিমাপ বিশিষ্ট গার্হপত্যধনুঃ।

০২-২০-০৪ ছয়কংস, ১৯২ আঙুল বা ৮ হস্তের পরিমাপক দিয়ে ব্রাহ্মণ বা অতিথিকে প্রদত্ত ভূমি পরিমাপ করতে হবে। ১০ দণ্ডে বা ৪০ হস্তে হবে এক রজ্জু। ২ রজ্জু, ৮০ হস্ত বা ২০ দণ্ডে হবে এক পরিদেশ। ৩ রজ্জু, ১২০ হস্ত বা ৩০ দণ্ডে হবে এক নির্বর্তন। ৩০ দণ্ড বা ১২০ হস্তরূপ নিবর্তনের একদিকে ২ দণ্ড বাড়িয়ে ধরলে যে মান দাঁড়াবে তা হবে বাহু। ২০০০ ধনুতে হবে এক গরুত বা ক্রশ। চার গরুতে হবে এক যোজন।

০২-২০-০৫ কালের মান—তুট, লব, নিমেষ, কাষ্ঠা, কলা, নলিকা, মুহূর্ত, দিনের পূর্বভাগ, দিনের পরভাগ, দিবস, রাত্রি, পক্ষ, মাস, ঋতু, অয়ন, সংবৎসর ও যুগ, এই সতের ভাগে বিভাজিত। চোখের পাতা পড়তে যে সময় লাগে তার চার ভাগের এক ভাগ সময়কে বলা হয় তুট, (তুটকে বলা হয় কালের পরমাণু)। ২ তুটে এক লব। ২ লবে এক নিমেষ। ৫ নিমিষে ১ কাষ্ঠা। ৩০ কাষ্ঠায় ১ কলা এবং ৪০ কলায় এক নলিকা বা ঘটিকা হয়। অন্যভাবেও নলিকা পরিমাপ যায়, একটি জলপাত্রে চার সুবর্ণমাষক মাপের ছিদ্র করে তাতে চার আঙুল দীর্ঘ সরু নল লাগিয়ে দিলে সে নল দিয়ে এ আঢ়ক জল নিপতিত হতে যে সময় লাগে তা এক নলিকার সমতুল্য সময়। এভাবে দুই নলিকায় হয় এক মুহূর্ত, পনেরো মুহূর্তে হয় দিন বা রাত্রি (চৈত্র ও আশ্বিন মাসে)। অন্য সময় দিন রাতের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে থাকে।

০২-২০-০৬ ছায়ার মাধ্যমে কাল নিরূপণ—ছায়া ৮ পৌরুষ (৯৬ আঙুলে হয় এক পৌরুষ) দীর্ঘ হলে তা দিনের ১৮ ভাগের এক ভাগ হিসেবে প্রতিভাত হবে। এই প্রক্রিয়ায় ছায়া ৬ পৌরুষ হলে ১৪ ভাগের ১ ভাগ। ৪ পৌরুষ হলে ৮ ভাগের ১ ভাগ। ২ পৌরুষ হলে ৬ ভাগের ১ ভাগ। ১ পৌরুষ হলে ৪ ভাগের ১ ভাগ হিসেবে দিবস প্রতিভাত হবে। এভাবে যখন কোনো ছায়া প্রতিভাত হবে না তখন দিবসের মধ্যাহ্ন হবে। রাত্রির ক্ষেত্রেও অনুরূপ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। সাধারণত আষাঢ় মাসের অন্তের দিনগুলোর মধ্যাহ্ন ছায়াহীন হয়। অতঃপর পৌষ পর্যন্ত ছায়া ২ আঙুল করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাঘ মাস হতে আবার এই ছায়া দু আঙুল করে হ্রাস পেতে থাকে।

০২-২০-০৭ পনেরোটি দিন-রাতের সমন্বয়ে এক পক্ষ হবে। এক্ষেত্রে যে পক্ষে চন্দ্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে তা শুক্লপক্ষ এবং যে পক্ষে চন্দ্র ক্ষয়প্রাপ্ত হবে তা কৃষ্ণপক্ষ বলে অভিহিত হবে। এ ধরনের দু পক্ষের সমন্বয়ে হবে এক মাস। এক্ষেত্রে ত্রিশ দিন ও রাতের সমন্বয়ে যে মাস গণনা করা হবে তা হবে প্রকর্মমাস (এই মাসের হিসেবেই চাকুরিজীবীদের বেতন পরিশোধ করতে হবে)। এভাবে সাড়ে ত্রিশ দিনে সৌরমাস, সাড়ে উনত্রিশ দিনে চন্দ্রমাস, সাতাশ দিনে নক্ষত্রমাস এবং বত্রিশ দিনে মলমাস নিরূপিত হবে। অশ্বপালক এবং হস্তিপালকদের মাস নিরূপিত হবে যথাক্রমে ৩৫ দিনে ও ৪০ দিনে এবং সেভাবেই তাদের বেতন নির্ধারিত হবে।

ঋতুর ক্ষেত্রে চার পক্ষ তথা দুই মাসের সমন্বয়ে হবে এক ঋতু। এই রীতিতে শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বর্ষা, আশ্বিন ও কার্তিকে শরৎ, অগ্রহায়ণ ও পৌষে হেমন্ত, মাঘ ও ফাল্গুনে শীত, চৈত্র ও বৈশাখে বসন্ত এবং জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে হবে গ্রীষ্ম ঋতু। শীত থেকে গ্রীষ্ম পর্যন্ত সময়কে বলা হয় উত্তরায়ণ এবং বর্ষা থেকে হেমন্ত পর্যন্ত ঋতুত্রয়কে বলা হয় দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণের সমন্বয়ে হয় সংবৎসর। পাঁচ সংবৎসরের সমন্বিত কালকে বলা হয় যুগ। অর্থাৎ পাঁচ বৎসরে হবে এক যুগ।

০২-২০-০৮ সূর্য প্রতিটি দিনের ষাট ভাগের এক ভাগকে হরণ করে থাকে, এ কারণে প্রতি ঋতুতে এক দিন করে বৃদ্ধি পায়। একইভাবে চাঁদের কারণেও প্রতি ঋতুতে একদিবস করে বৃদ্ধি পায়, এর ফলে আড়াই বছরে এক মাস বৃদ্ধি পায় যাকে অধিমাস বা মল মাস বলা হয়, প্রথম আড়াই বছরের অধিমাস যুক্ত হবে গ্রীষ্ম ঋতুতে, পাঁচ বছরে এসে দ্বিতীয় অধিমাস যুক্ত হবে বর্ষা ঋতুকে।

একবিংশ অধ্যায় ॥ ৩৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে পণ্য সামগ্রীর শুল্ক আদায় সম্পর্কীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাকে বলা হয় শুল্কাধ্যক্ষ। শুল্কাধ্যক্ষ কোন তরিকায়, কি হারে, পণ্য দ্রব্যের প্রকৃতি অনুযায়ী শুল্ক আদায় করবেন, সে বিষয়ে অধ্যায়টিতে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-২১-০১ শুল্কাধ্যক্ষ শুল্ক আদায়ের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় অফিস ভবন নির্মাণ করাবেন। বণিকগণ সহজেই যেন শুল্ক পরিশোধের স্থান চিহ্নিত করতে পারে সে লক্ষ্যে এই ভবনের উত্তর বা দক্ষিণ দিকের ফটকে শুল্কাধ্যক্ষ কর্তৃক শুল্কবিভাগের পরিচয়খচিত পতাকা ওড়াতে হবে। শুল্ক ভবনে কর্মরত কর্মচারীরা—আগত বণিকদের নাম ও জাতি পরিচয়, যেখান থেকে এসেছেন সে স্থানের নাম, আনীত বিক্রেয় দ্রব্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ, সীমান্ত অতিক্রমকালে প্রদেয় কর পরিশোধ করা হয়েছে কি না সে সম্পর্কিত প্রমাণাদিসহ যাবতীয় তথ্য নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখবে।

০২-২১-০২ যে সমস্ত বণিক সীমান্ত অতিক্রমকালে বিধি মোতাবেক প্রদেয় বর্তনী নামক শুল্ক পরিশোধ ব্যতিরেকে পণ্যদ্রব্য আমদানি করবে, সে-সমস্ত বণিক অপরিশোধিত শুল্কের দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে যারা সীমান্ত শুল্ক প্রদানের জাল সিলমোহরের ছাপ প্রদর্শন করবে তারা প্রদেয় শুল্কের আটগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। যে বণিক আন্তপাল তথা সীমান্ত কর্তার প্রদত্ত সিলমোহরযুক্ত চিহ্ন বিনষ্ট করবে, সে বণিককে কৃত অপরাধের জন্য দণ্ড হিসেবে তিন ঘণ্টাকাল আটক করে রাখতে হবে। যে বণিক পণ্যের উপর প্রদত্ত রাজকীয় মোহর চিহ্ন পরিবর্তন করবে বা আনীত পণ্যের ব্যাপারে মিথ্যে ঘোষণা প্রদান করবে, সে বণিককে জরিমানা বাবদ সোয়া পণ প্রদান করতে হবে।

০২-২১-০৩ বণিকরা শুল্ক ভবনের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে বিক্রেয় পণ্যের পরিমাণ এবং মূল্য বিষয়ক ঘোষণা প্রদান করবেন, তিনবার ঘোষণা প্রদানের পর কেউ যদি ঘোষিত মূল্যে পণ্য ক্রয়ে আগ্রহ প্রদর্শন করে সেক্ষেত্রে বিক্রেতা ওই মূল্যে ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রয় করবে। ঘোষিত মূল্যের ব্যাপারে যদি ক্রেতাদের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, সে পরিস্থিতিতে বিক্রেতা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিবেন। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই অতিরিক্ত মূল্য বিক্রেতা গ্রহণ করতে পারবে না, তাকে তা প্রদত্ত শুল্কের সাথে রাজকোষে জমা প্রদান করতে হবে।

যদি কোনো বণিক শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিপ্রায়ে পণ্যের পরিমাণগত হেরফের করে, সেক্ষেত্রে তাকে প্রদেয় শুল্কের আটগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হবে।

০২-২১-০৪ কেউ যদি নমুনা হিসেবে মানসম্মত পণ্য প্রদর্শন করে হীন পণ্য বিক্রয় করে বা এক ধরনের পণ্য বিক্রির কথা বলে ক্রেতাকে ভিন্নতর পণ্য সরবরাহ করে, সেক্ষেত্রে বিক্রেতাকে প্রদেয় শুল্কের আটগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এক ক্রেতার ভয়ে ভীত হয়ে অপর ক্রেতা যদি বাধ্য হয়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে কোনো পণ্য ক্রয় করে, সেক্ষেত্রে ওই পণ্য বিক্রেতাকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে হবে এবং তাকে প্রদেয় শুল্কের দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। কোনো শুল্ক কর্মকর্তা যদি বণিকের কারচুপি বা অপরাধ জানা সত্ত্বেও তা গোপন করে অথবা অসৎ বণিকের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়, তাহলে ওই শুল্ক কর্মকর্তাকে অপরাধী বণিকের উপর আরোপিত জরিমানার আটগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

০২-২১-০৫ সঠিকভাবে যেন পণ্যদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় হয়, সে-জন্য পণ্যের গুণগত মান, পরিমাণ, ওজন, গণনা ইত্যাদির উপর নজরদারী বহাল রাখতে হবে। যে বণিকরা শুল্ক পরিহারের জন্য শুল্ক ভবনে উপস্থিত না হয়ে কৌশলে পাশ কেটে চলে যেতে প্রবৃত্ত হবে, তাদের উপর প্রদেয় শুল্কের আট-গুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে আরোপিত হবে। রাজা কর্তৃক নিয়োজিত গুপ্তচররা বণিকদের উপর নজরদারী জারি রেখে এ সমস্ত শুল্ক ফাঁকির বিষয় উদ্ঘাটন করবে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।

০২-২১-০৬ যে সমস্ত পণ্যদ্রব্যের উপর শুল্ক আরোপিত হবে না সেগুলো হলো—বৈবাহিক প্রয়োজনে ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য। নবপরিণীতার পিতৃগৃহ হতে আনীত দ্রবাদি। ধর্মীয় কাজে ব্যবহার্য সকল প্রকার পণ্যদ্রব্য। কেউ যদি মিথ্যে ঘোষণা দিয়ে এ সমস্ত পণ্যদ্রব্যের শুল্কসুবিধা গ্রহণ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ প্রযোজ্য হবে এবং সে মোতাবেক শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী শাস্তি প্রযুক্ত হবে। শুল্ক পরিশোধিত পণ্যদ্রব্যের সাথে কেউ যদি শুল্ক অপরিশোধিত পণ্যদ্রব্য পাচার করে, তাহলে উক্ত বণিকের সমুদয় পণ্যের উপর পূর্ণশুল্ক আরোপিত হবে।

০২-২১-০৭ গোবর বা ধানের তুষ পরিবহনের ঘোষণা দিয়ে কেউ যদি মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে শুল্ক ভবনের ফটক অতিক্রমে সচেষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে তার উপর উত্তম সাহসদণ্ড বা সহস্র পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি রফতানি নিষিদ্ধ অস্ত্র, বর্ম, কবচ, লোহা, রথ, রত্ন, ধান ও পশু পাচারের চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে পাচারকারীকে রাজদণ্ড ভোগ করতে হবে এবং তার উপরোক্ত দ্রব্যাদি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অবশ্য এ সমস্ত দ্রব্য কেউ বিদেশ থেকে আমদানি করলে বিনা-শুল্কে নগরের বহিরাঙ্গনে বিক্রয় করতে পারবে।

০২-২১-০৮ অন্তপাল বা সীমান্ত কর্মকর্তাগণ পথের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নির্বাহের নিমিত্ত পণ্যবাহী শকটপ্রতি সোয়া পণ হারে বর্তনী নামক শুল্ক গ্রহণ করবে। এভাবে অশ্বের জন্য এক পণ, গরুর জন্য অর্ধ পণ, মেষ জাতীয় ক্ষুদে পশুর জন্য এক চতুর্থাংশ পণ, পণ্য বহনকারী প্রতি মানুষের জন্য এক মাষ হারে বর্তনী নামের শুল্ক আদায় করবে। বিদেশ থেকে আগত বণিকদের পণ্যদ্রব্য সীমান্ত কর্মকর্তারা ভালোমতো যাচাই করে শুল্ক গ্রহণ করার পর প্রয়োজনীয় মোহরযুক্ত ছাপ দিয়ে তা শুল্কাধ্যক্ষের কাছে প্রেরণ করবে। এ ব্যবস্থার ফলে শুল্কাধ্যক্ষ কর্তৃক বণিকদের পণ্যদ্রব্য আত্মসাৎ করার সম্ভাবনা দূরীভূত হবে।

০২-২১-০৯ বণিকদের পরিবাহিত পণ্যদ্রব্যের ব্যাপারে রাজা তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে পুরোপুরি অবহিত হবেন এবং তিনি তা শুল্কাধ্যক্ষকে অবহিত করবেন। শুল্কাধ্যক্ষ রাজার উদ্ধৃতি দিয়ে বণিকগণকে তাদের আনীত দ্রব্যের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে এই মর্মে জ্ঞাত করবে যে বণিকদের পরিবাহিত পণ্যদ্রব্যের ব্যাপারে রাজা স্বয়ং সম্যক অবহিত আছেন। এতে করে রাজার প্রভাব যেমন প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা তিরোহিত হবে।

০২-২১-১০ কোনো বণিক যদি মণি মুক্তা প্রবালের মতো মূল্যবান দ্রব্যের পরিমাণ গোপন করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অপচেষ্টা করে সেক্ষেত্রে রাজাদেশ বলে ওই সমস্ত দ্রব্য বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিষ ও মদের মতো যে সমস্ত দ্রব্য প্রজাদের জন্য অনিষ্টকর এবং যেসব দ্রব্য রাজার জন্য খুব লাভজনক নয়, সেসব দ্রব্যের আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে, তার পরও এ সমস্ত দ্রব্য আমদানি করা হলে তা বিনষ্ট করতে হবে। অন্যদিকে ধানের বীজ ও ভেষজদ্রব্যসহ যা কিছু সাধারণ প্রজার জন্য হিতকর, সেগুলোর শুল্ক রহিত করে বিনা-শুল্কের আমদানি সুবিধা প্রবর্তন করতে হবে।

দ্বাবিংশ অধ্যায় ॥ ৩৯ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে শুল্কের হার, কোন ধরনের পণ্যদ্রব্যের উপর কি পরিমাণ শুল্ক আরোপ করা বাঞ্ছনীয়, ইত্যাকার বিষয়ের উপর আলোকপাত করত এ সংক্রান্ত নিয়মের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপ এবং প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

০২-২২-০১ শুল্ক তিন ধরনের—১. বাহ্যশুল্ক–নিজ দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রদেয় শুল্ককে বলা হয় বাহ্যশুল্ক ২. আভ্যন্তরশুল্ক–দুর্গ, নগর এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রদেয় শুল্ককে বলা হয় আভ্যন্তরশুল্ক ৩. আতিথ্যশুল্ক, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রদেয় শুল্ককে বলা হয় আতিথ্যশুল্ক। এই তিন ধরনের শুল্ক আবার দুই ভাগে বিভাজিত—১. নিষ্ক্রাম্য শুল্ক—যে পণ্য শহর থেকে জনপদে প্রেরিত হয় এবং জনপদ থেকে দেশের বাহিরে প্রেরিত হয় সে পণ্যের জন্য প্রদেয় শুল্ককে বলা হয় নিষ্ক্রাম্য শুল্ক ২. প্রবেশ্য শুল্ক, বিদেশ থেকে জনপদে আমদানি হয়ে যে পণ্য জনপদ থেকে নগরে আনীত হয়, সে পণ্যের জন্য প্রদেয় শুল্ককে বলা হয় প্রবেশ্যশুল্ক। এক্ষেত্রে জনপদ হয়ে যে সমস্ত আমদানি পণ্য নগরে আনীত হবে তার জন্য পণ্য মূল্যের পাঁচ ভাগের এক ভাগ হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। কিন্তু ফুল, ফল, শাক-সব্জি, ধান, বীজ, শুকনো মাংস জাতীয় দ্রব্যের জন্য এই শুল্কহার হবে পণ্য মূল্যের ছয় ভাগের এক ভাগ।

০২-২২-০২ মণি-মুক্তা ও এ জাতীয় অলঙ্কার বিষয়ক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মাধ্যমে শঙ্খ, হীরা, মণি, মুক্তা, প্রবাল ও মাল্য জাতীয় মূল্যবান দ্রব্য এবং আলঙ্কারের শুল্ক নির্ধারণ করাতে হবে। এ সমস্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা পণ্যের মূল্যমান, অলঙ্কারাদি তৈরির ব্যয় ও আনুষঙ্গিক খরচাপাতি হিসেব করে এ সব পণ্যের শুল্ক নির্ধারণ করবে।

ক্ষৌম তথা পশম থেকে উৎপন্ন মোটা রেশমিসুতা। ক্রিমিতান তথা রেশমগুটি থেকে উৎপন্ন রেশম সুতা। কঙ্কট তথা সুতা থেকে তৈরি কবচ। হরিতাল তথা পারদযুক্ত পীতবর্ণের ধাতব পদার্থ। মনঃশিলা তথা রক্ত বর্ণের পাহাড়িয়া ধাতু বিশেষ। হিঙ্গুলক তথা সিন্দুর। লৌহবর্ণ ও গৈরিকাদি ধাতুসমূহ এবং চন্দন, অগুরু, মশলা, কিন্তুাবর বা মদ্যোপকরণ, তৈল জাতীয় দ্রব্য, মদ্য, গজদন্ত, গালিচা, শয্যা, ছাগল, ভেড়া, ইত্যাকার লোমশ দ্রব্যের উপর এক দশমাংশ ও পনেরো ভাগের এক ভাগ হারে শুল্ক নির্ধারিত হবে।

০২-২২-০৩ বস্ত্র, চতুষ্পদ ও দ্বিপদজন্তু, সুতা, কার্পাস, সুগন্ধি, ওষুধ, কাঠ, বাঁশ, চামড়া, চামড়াজাত দ্রব্য, মৃৎপাত্র, ধান, তৈল জাতীয় দ্রব্য, ক্ষার জাতীয় দ্রব্য, লবণ, মদ্য, রান্না করা খাবার, ইত্যাকার দ্রব্যের উপর দ্রব্য মূল্যের বিশ ভাগের এক ভাগ বা পঁচিশ ভাগের এক ভাগ শুল্ক হিসেবে ধার্য হবে। যে পণ্যের উপর শুল্ক নির্ধারিত হবে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ নগরের দ্বারাধ্যক্ষ সংগ্রহ করবে।

০২-২২-০৪ যে দেশে যে পণ্য উৎপন্ন হয়, সে দেশে সে ধরনের পণ্যের বিপণন করা উচিৎ নয়। খনিতে উৎপন্ন ধাতব পদার্থ এবং খনিজ দ্রব্যের মাধ্যমে উৎপাদিত কোনো পণ্য যদি কেউ রাজার অনুমতি ব্যতিরেকে গ্রহণ করে বা বিক্রি করে তাহলে সে ব্যক্তির উপর জরিমানা হিসেবে ৬০০ পণ প্রযুক্ত হবে। ফুল বাগিচা বা ফলের উদ্যান হতে কেউ যদি রাজানুমতি ব্যতিরেকে ফুল-ফল সংগ্রহ করে বিক্রয়ে প্রবৃত্ত হয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর জরিমানা হিসেবে ৫৪ পণ প্রযুক্ত হবে। রাজানুমতি ব্যতিরেকে কেউ যদি শাক-লতা সংগ্রহ করে তা বিক্রয়ে উদ্যত হয়, তাহলে তার উপর পৌনে ৫২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। রাজানুমতি ব্যতিরেকে কেউ যদি ক্ষেত্র হতে ধানসহ অন্যান্য শস্য সংগ্রহ করে বিক্রয় করে, তাহলে তার উপর ৫৩ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। নতুন ও পুরাতন পণ্য ভেদে নিয়মানুসারে শুল্ক নির্ধারণ করতে হবে এবং ক্ষতিকারক পণ্য বিক্রয় নিরোধ কল্পে দণ্ড প্রয়োগ করতে হবে।

ত্রয়োবিংশ অধ্যায় ॥ ৪০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সুতা ও বস্ত্র বয়ন সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, একই সাথে বয়ন কার্যে নিযুক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা সূত্রাধ্যক্ষ এবং তার অধীনস্ত কর্মচারীদের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

০২-২৩-০১ সূত্রাধ্যক্ষ দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগের মাধ্যমে সুতা উৎপাদন, বস্ত্র বয়ন, রজ্জু প্রস্তুত ও বুননের কাজ করাবেন। তিনি বিধবা, বিকলাঙ্গ, স্বামী পরিত্যক্তা, কারাদণ্ড প্রাপ্তা, রূপরহিত গণিকা, কর্মে অসমর্থ পরিচারিকা, নৃত্যগীতে অক্ষমতা হেতু দেবালয় হতে বহিষ্কৃতা, ইত্যাকার নারীদের দিয়ে মেষলোম, বৃক্ষতন্ত্র, কার্পাস, শিমুল তুলা, শন ও রেশমগুটি থেকে সুতা উৎপাদনের কাজ করাবেন।

০২-২৩-০২ সুতা কাটার দক্ষতা বা পারদর্শিতার মানদণ্ডে সূত্রাধ্যক্ষ প্রস্তুতকৃত সুতার মান বিচার করে উপরোক্ত দক্ষতাসম্পন্ন নারীদের বেতন নির্ধারণ করবেন। যিনি যত বেশি দক্ষতার সাথে সুতা তৈরি করবেন তিনি তত বেশি পুরস্কৃত হবেন। সূত্রাধ্যক্ষ এসব নারী কর্মীদের কর্মে উৎসাহ যোগানোর জন্য এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণীত করার জন্য প্রণোদনা হিসেবে মাথায় ব্যবহারের সুগন্ধি তেল, শরীরের ব্যবহারের নির্যাস প্রদান করবেন। প্রয়োজনে উৎসব পার্বনের কর্মহীন দিনেও তিনি তাদের উপযুক্ত মজুরি ও সম্মান দিয়ে কাজ করিয়ে নিবেন। এক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতায় যাদের মধ্যে শিথিলতা, অদক্ষতা বা গাফিলতি পরিদৃষ্ট হবে তাদেরকে নির্ধারিত বেতন অপেক্ষা কম বেতন প্রদান করতে হবে।

০২-২৩-০৩ সুতার প্রস্তুত প্রক্রিয়া, উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ, উৎপাদনের সময়ের ব্যাপারে পরিজ্ঞাত হয়ে সূত্রাধ্যক্ষ তন্ত্রবায়দের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমেও সুতা প্রস্তুত করাতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি কাজের সুবিধার্থে তন্ত্রবায় বা এ সমস্ত কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্কও গড়ে তুলবেন। ক্ষৌম বা মোটা রেশমিসুতা, দুকূল বা মসৃণ রেশমিসুতা, ক্রিমিতান বা গুটিপোকা থেকে রেশম, রাঙ্কব বা রঙ্কু নামক মৃগের লোমজাত সুতা এবং কার্পাস থেকে সুতা উৎপাদনের জন্য তিনি সুতা কাটা ও কাপড় বয়নের কারখানা নির্মাণ করাবেন। উৎপাদনশীলতার স্বার্থে তিনি গন্ধমাল্য এবং অন্যান্য প্রণোদনামূলক দ্রব্য দান করে কারিগরদের প্রসন্ন রাখবেন এবং ওই সমস্ত কারিগরদের দিয়ে বস্ত্র, গালিচা, আস্তরণ ও শয্যার আচ্ছাদন তৈরি করাবেন। এ সমস্ত দ্রব্য উৎপাদনের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো এবং যন্ত্রাদির প্রয়োজন হবে সূত্রাধ্যক্ষ সে সবের যোগান দিবেন।

০২-২৩-০৪ বিদেশে অবস্থানরত স্বামীদের স্ত্রী, বিকলাঙ্গা নারী, বাড়ির বাহিরে গমন করে না, এমন ধরনের অবিবাহিতা কন্যা, ইত্যাকার জাতীয় নারী—যারা নিজেদের শ্রমের মাধ্যমে জীবন-নির্বাহ করে থাকে, সূত্রাধ্যক্ষ সে ধরনের নারীদের কাজের জন্য অনুপ্রাণীত করবেন এবং যথাযথ সম্মান ও প্রীতি প্রদর্শনপূর্বক কারখানায় সুতা কাটার কাজে নিযুক্ত করবেন। যে সমস্ত নারী গৃহে কর্তিত সুতা বা বয়নকৃত বস্ত্র সূত্রাধ্যক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য অতি প্রত্যুষে দাসীর সঙ্গে কারখানা ভবনে পদার্পণ করবেন, সূত্রাধ্যক্ষ সে-সমস্ত নারীকে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় পাওনা মিটিয়ে দিবেন। অতি প্রত্যুষে আনীত সুতা বা বস্ত্রের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য প্রদীপের আলোর প্রয়োজন হলে সূত্রাধ্যক্ষ ক্ষণকালের জন্য প্রদীপ জ্বালাবেন। আগুন লাগার ভীতি হেতু তিনি বেশিক্ষণ প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবেন না। অধিকন্তু আনীত দ্রব্য পরীক্ষার জন্য যতটুকু আলোর প্রয়োজন, ততটুকু আলোর জন্য প্রদীপ জ্বালাতে হবে, প্রদীপের আলো এতবেশি উদ্ভাসিত করা যাবে না যাতে করে আগত নারীর মুখ দর্শনীয় হয়ে ওঠে।

০২-২৩-০৫ সুতা বা বস্ত্র জমা প্রদান প্রাক্কালে প্রদীপ প্রজ্বলিত অবস্থায় কোনো সূত্রাধ্যক্ষ যদি আগত নারীর মুখাবয়ব দর্শন করে বা প্রকৃত কাজের অতিরিক্ত কোনো বাহুল্য আলাপ করে, সেক্ষেত্রে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং সূত্রাধ্যক্ষ জরিমানা হিসেবে প্রথম সাহস দণ্ড বা আড়াই শত পণ প্ৰদান করতে বাধ্য থাকবে। নারী শ্রমিকদের বেতন প্রদানের কাল অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও যদি যথা সময়ে পাওনা পরিশোধ না করা হয়, সেক্ষেত্রে সূত্রাধ্যক্ষ মধ্যম সাহসদণ্ড বা পাঁচশত পণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। কাজ সমাপ্ত না হওয়া সত্ত্বেও যদি উৎকোচের প্রলোভনে পড়ে কারো পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হয় সেক্ষেত্রেও সূত্রাধ্যক্ষ জরিমানা হিসেবে পাঁচশত পণ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। অগ্রিম পারিশ্রমিক গ্রহণ সত্ত্বেও যদি এ জাতীয় কোনো নারী শ্রমিক নির্ধারিত কর্ম সম্পাদনে ব্যর্থ হয়, তাহলে সূত্রাধ্যক্ষ তার ডান হাতের বৃদ্ধা ও মধ্যমা আঙুলি ছেদন করে শাস্তি প্রদান করবেন। এছাড়াও কেউ যদি বয়নের দ্রব্য আত্মসাৎ করে, সেক্ষেত্রেও তার উপর উপরোক্ত শাস্তি আরোপিত হবে। অধিকন্তু অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী বেতন কর্তনসহ অন্যান্য শাস্তি আরোপিত হবে।

০২-২৩-০৬ যারা দড়ি এবং চামড়াজাত পণ্য তৈরির মাধ্যমে জীবিকা- নির্বাহ করে থাকে, সূত্রাধ্যক্ষ তাদের সঙ্গে সু সম্পর্ক গড়ে তুলবেন এবং তাদের দিয়ে ঘোড়া ও গবাদিপশু বাঁধার দড়ি তৈরি করাবেন। এছাড়াও যুদ্ধের সামগ্রী, রথ, গাড়ি, ইত্যাকার কাজে ব্যবহার্য বিভিন্ন উপকরণ তৈরির ব্যাপারেও সূত্রাধ্যক্ষ সচেষ্ট থাকবেন।

চতুর্বিংশ অধ্যায় ॥ ৪১ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। আলোকপাত করা হয়েছে ভূমির ব্যবহার, উৎপন্ন শস্য, জল সেচ এবং প্রদেয় কর সম্পর্কে। একই সাথে কৃষি প্রশাসক তথা সীতাধ্যক্ষের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয় করণীয় বিষয়েও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-২৪-০১ সীতাধ্যক্ষ বা কৃষির দায়িত্বে নিয়োজিত কৃষি প্রশাসক কৃষি বিজ্ঞান, কৃষি উৎপাদন সম্পৃক্ত ভূমিজল সম্পর্কীয় বিজ্ঞান এবং ঔষধি বৃক্ষ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করে কৃষি কাজের তত্ত্বাবধান করবেন। তিনি সব প্রজাতির ধান, ফুল, ফল, শাক, লতা, লতাজাত সব্জি এবং তুলার বীজ যথা সময়ে সংগ্রহ করে রাখবেন। সীতাধ্যক্ষ রাজকীয় ভূমি যথার্থভাবে কর্ষণ করিয়ে উপরোক্ত বীজ রোপনের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করাবেন। কৃষি উৎপাদনের কাজে তিনি যেমন বেতনভুক শ্রমিক নিয়োগ করবেন তেমনি ক্রীতদাস এবং বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদেরও নিযুক্ত করবেন। এদের দিয়ে সীতাধ্যক্ষ বীজ বপনসহ ফসল উৎপাদনের যাবতীয় শ্রমসাধ্য কাজ করিয়ে নিবেন।

০২-২৪-০২ সীতাধ্যক্ষ কৃষিকাজে নিয়োজিত দাস, শ্রমিক বা কর্মকরদের কখনো কৃষি যন্ত্রপাতি এবং হালচাষের বলদের রক্ষণাবেক্ষণ বা হেফাজদের দায়িত্ব অর্পণ করবেন না। উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত কারিগর, কামার, সূত্রধর, খোদাইকারী, ঝুড়ি নির্মাতা, দড়ি নির্মাতা, সাপুড়িয়া, ইত্যাকার লোকদের সঙ্গে উপরোক্ত কৃষি শ্রমিকদের সম্পর্ক স্থাপন নিরোধ করবেন। উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত কারো দায়িত্বহীনতার কারণে যদি ফসলের ক্ষতি সাধিত হয়, তাহলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষতির পরিমাণ অনুসারে দণ্ড আরোপ করতে হবে।

০২-২৪-০৩ ভূমির প্রকৃতি অনুযায়ী শস্য উৎপাদনের জন্য বৃষ্টির পানির পরিমাণ যে-ভাবে নির্ধারিত তা হলো—মরুময় শুষ্কাঞ্চলে ১৬ দ্রোণ (আজকের দিনের ৩২ ইঞ্চি) পরিমাণ বৃষ্টির পানি সঞ্চিত হলে তা ফসল উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হবে। জলময় অঞ্চলে ২৪ দ্রোণ বৃষ্টির পানি সঞ্চিত হলে তা ফসল উৎপাদনের অনুকূল বলে বিবেচিত হবে। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক বারিপাতের পানির ক্ষেত্রে—আশ্মক প্রদেশে (মহারাষ্ট্র) সাড়ে ১৩ দ্ৰোণ, অবন্তী প্রদেশে (মালবাঞ্চল) তেইশ দ্রোণ পরিমাণ বৃষ্টির পানি প্রাপ্ত হলে তা কৃষি কাজের জন্য পর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া হিমালয়ের সীমান্ত এলাকাসহ যে সমস্ত অঞ্চলে খাল কেটে জল সেচের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন করা হয়, সে- সমস্ত এলাকার জন্য এরূপ বৃষ্টির পানির পরিমাণ নিরূপ্য নয়।

০২-২৪-০৪ বর্ষণ তথা বারিপাতের ক্ষেত্রে—শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসের বর্ষণের ক্ষেত্রে প্রথম দুই মাসে তিনের এক অংশ এবং মাঝের দুই মাসে তিনের দুই অংশ বর্ষণ হলে তা হবে ভারসাম্যমূলক এবং শোভন উৎপাদনের সহায়ক। বর্ষণের পূর্বাভাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—বৃহস্পতির মেষ রাশিতে অবস্থান, অন্য রাশিতে গমন বা স্থানান্তরের ফলে কার্তিক মাসে তুষারপাত হলে ভালো বর্ষণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। শুক্র গ্রহের উদয়, অস্ত ও আষাঢ়ের পঞ্চমী থেকে ত্রয়োদশীতিথিতে তার সঞ্চার, সূর্যের প্রকৃতির বিকার ও জলমণ্ডল দেখা দিলেও ইতিবাচক ফলপ্রাপ্ত হয়। এই সূর্যের সুবাদে শস্যের বীজনিষ্পত্তি, বৃহস্পতি থেকে স্তন্বগুণবর্ধন ও শুক্র থেকে শোভিত বর্ষা হয়।

০২-২৪-০৫ যদি সাত অহোরাত্র বিরতিহীনভাবে তিন বার বৃষ্টিপাত হয়, যদি মেঘ আশিবার নিরবচ্ছিন্নভাবে বারিপাত করে এবং যদি সূর্যালোকযুক্ত মেঘ ষাটবার বারি বর্ষণ করে, তাহলে এসব বৃষ্টিপাত কৃষিকাজের জন্য হিতকর হয়। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অবসরে সূর্যালোক দৃশ্যমান হলে ভূমি কর্ষণের জন্য তা যেমন সহায়ক হয় তেমনি ফসল উৎপাদনের জন্যও শুভ হয়। বর্ষণের এই গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে সীতাধ্যাক্ষ অধিক সিক্ত ও স্বল্প সিক্ত ভূমিতে শস্যের বীজ বুননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

০২-২৪-০৬ শালি, ব্রীহি, কোদ্রব, তিল, প্রিয়ঙ্গু, দারক এবং বরকের বীজ বর্ষার পূর্বভাগেই বপন করতে হবে। মুগ্দ, মাষ ও শিমের বীজ বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে বপন করতে হবে। কুসুম ফুল, মসুর, কুলুখ, যব, গোধূম, কলাই, অতসী ও সর্যপের বীজ বপন করতে হবে বর্ষার শেষ ভাগে। কৃষিকাজের উপযোগী অকর্ষণকৃত ভূমি পতিত থাকলে অর্ধসীতিকেরা বা বর্গাচাষিরা নিজেদের বীজ, লাঙল ও উপকরণ ব্যবহার করে সেসব পতিত ভূমিতে ফসল উৎপাদন করতে পারবে, এক্ষেত্রে ভূস্বামীকে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক প্রদান করতে হবে। যে সব চাষি ভূস্বামীর কাছ থেকে উৎপাদনের বীজ ও অন্যান্য উপকরণ গ্রহণ করে শুধু কায়িক পরিশ্রম প্রদানের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করবে, তারা উৎপাদিত ফসলের চার বা পাঁচ ভাগের একভাগ ফসলের অধিকারী হবে। মালিকানাহীন ভূমিতে ফসল উৎপাদিত হলে উৎপাদক রাজার অভিপ্রায় অনুযায়ী ফসলের অংশ প্রদান করতেও পারে অথবা নাও করতে পারে।

০২-২৪-০৭ স্থলভাগের মতো রাজা হলেন সকল জল ভাগেরও অধীশ্বর, এ কারণে কৃষকরা যদি নিজ ব্যবস্থাপনায়, নিজস্ব উপকরণ ব্যবহার করে কিংবা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে ভূমিতে জলসেচ দেয় তবুও তাদের উৎপাদিত ফসলের পাঁচ বা চার ভাগের এক ভাগ হারে সেচকর প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি খাল বা নালা খননের মাধ্যমে সেচ সুবিধা গ্রহণ করা হয়, তাহলে উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ সেচকর প্রদান করতে হবে। সীতাধ্যক্ষ, কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের প্রাপ্যতা অনুযায়ী বর্ষা, হেমন্ত এবং গ্রীষ্মকালে শস্যের বীজ বুনন ও রোপন করাবেন।

০২-২৪-০৮ সকল ধরনের ফসলের মধ্যে শালি ধানই হলো উত্তম, এটি আহার্য হিসেবে বহুল ব্যবহৃত এবং স্বল্পসময়ে, স্বল্পব্যয়ে সহজে উৎপাদনযোগ্য। কলা ও সুপারি জাতীয় ফসল মধ্যম ধরনের, এগুলোর উৎপাদন প্ৰক্ৰিয়া যেমন স্বল্প ব্যয়যুক্ত তেমনি এর আয়ও স্বল্প, অধিকন্তু এগুলো প্রধান আহার দ্রব্য নয়। ইক্ষু হলো নিকৃষ্ট জাতীয় ফসল, এগুলোর উৎপাদন যেমন সময় সাপেক্ষ ও উপদ্রবযুক্ত তেমনি আখজাত দ্রব্য থেকে উৎপাদনকৃত দ্রব্যের প্রক্রিয়াও কষ্টসাধ্য ও ঝামেলাযুক্ত। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কুমড়া ও লতাজাত ফসল উৎপাদন করতে হবে জলাধারের প্রান্তদেশে। পিপ্পলী, আঙুর ও ইক্ষুর আবাদ করতে হবে নদী অববাহিকায়। শাক ও মূলের আবাদ করতে হবে কূপের নিকটবর্তী আর্দ্রভূমিতে। সব্জির আবাদ করতে হবে জলাভূমির পার্শ্বদেশে। জল পরিবেষ্টিত উচ্চভূমিতে গন্ধ, ভেজষ, উশীর, পিণ্ডালুকের আবাদ করতে হবে। এই নিয়ম অনুসরণপূর্বক ভূমির প্রকৃতি অনুযায়ী ফসল আবাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

০২-২৪-০৯ বপন করার পূর্বে সব ধরনের বীজের সংস্কার আবশ্যক। বপনের পূর্বে ধানের বীজ সাতরাত্রি তুষারের শীতত্বের পরশে এবং সাত দিন সূর্যতাপে রাখতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় মুগ মাষের বীজও তিন বা পাঁচ দিন-রাত সংস্কার করতে হবে। রোপনের পূর্বে আখের কর্তিত অংশের উভয়প্রান্তে মধু, ঘৃত, শুকরের চর্বি ও গোবরের মিশ্রণ মাখাতে হবে। কন্দের ক্ষেত্রে শুধু ঘৃত ও মধু মাখাতে হবে। কার্পাসের বীজে গোবর মাখাতে হবে। আমের চারা রোপনের পূর্বে গর্তে খড়কুটা জ্বালাতে হবে এবং বৃক্ষে মুকুল ফুটলে গাছের গোড়ায় গরুর হাড়ের গুঁড়া ও গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। যে কোনো ধরনের বীজ অঙ্কুরিত হলে আর্দ্র ও ছোট মাছের সাথে যুক্ত করে সুহি নামক ঔষধি রস প্রয়োগ করতে হয়।

০২-২৪-১০ সাপের উপস্থিতি নিরোধকল্পে কার্পাস বীজের সার ও সাপের নির্মোক মিশ্রণ করে আগুনে পোড়াতে হবে। এতে করে যে ধোঁয়ার উদ্‌গীরণ হবে তার প্রভাবে সেখানে সাপ অবস্থান করতে পারবে না। সকল ধরনের বীজ বপনকালে প্রথম এক মুঠো বীজ স্বর্ণ ধৌত জলে ভিজিয়ে যথাযথ মন্ত্ৰ পাঠ করতে হবে। সব্জি বাগানের রক্ষক, গোপালক, দাস এবং কৃষিকর্মীদের পারিশ্রমিক বা বেতন সীতাধ্যক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে। তিনি তাদের সোয়া পণ হারে মাসিক বেতন প্রদান করবেন। এছাড়াও তিনি প্রত্যেকের কাজের মূল্যায়ন করে গুরুত্বানুসারে ভোজন ও বেতনের ব্যবস্থা করবেন। বেদ অধ্যয়নকারী ব্রাহ্মণ ও তপস্বীরা ধর্মীয় কাজের প্রয়োজনে বৃক্ষ থেকে নিপতিত ফুল ও ফল এবং ধান ও যব সংগ্রহ করতে পারবে। উচ্ছিষ্ট সংগ্রহকারীরা ফসল তোলার পর পরিত্যক্ত ফসল বিনা বাধায় সংগ্রহ করতে পারবে।

০২-২৪-১১ বুদ্ধিমান লোকেরা বিধিবদ্ধ সময় অতিক্রম না করে সঠিক সময়ে ফসল আহরণ করে গোলাজাত করবেন। তারা কখনো ফসলের উচ্ছিষ্টাংশ ক্ষেতে ফেলে রাখবেন না, এমনকি ধানের তুষও নয়। ধান সংরক্ষণের গোলা উঁচুস্থানে নির্মাণ করতে হবে। গোলার অগ্রভাগ নির্মাণের ক্ষেত্রে পারস্পারিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ঝড়-বৃষ্টির কোপানল থেকে রক্ষার্থে গোলাঘর মজবুত করে নির্মাণ করতে হবে। ধান মাড়াইয়ের স্থানে বলদ দিয়ে ধান মাড়াই ও ধান ঝাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ধানের খামারে আগুনের ব্যবহার হবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং সেখানে আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পঞ্চবিংশ অধ্যায় ॥ ৪২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে সুরা উৎপাদনের উপাদান, বিপণন, নিয়ন্ত্রণ এবং তৎসম্পর্কিত বিষয়াদির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়াও এ বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা সুরাধ্যক্ষের কর্মপরিধি ও করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-২৫-০১ সুরাধ্যক্ষ তার একক কর্তৃত্বে নগরে, জনপদে এবং সেনানিবাসসহ অন্যান্য স্থানে একটি কেন্দ্রে বা বহু বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে সুরা ও সুরা উৎপাদনের উপকরণ ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। সুরা বেচা-কেনার জন্য নির্ধারিত বিধিবদ্ধ স্থান ব্যতীত অন্যত্র কেউ এ কর্মে প্রবৃত্ত হলে উৎপাদনকারী, ক্রেতা ও বিক্রেতা, এদের সকলের উপর ৬০০ পণ হারে জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো মদ্যপ ব্যক্তি যেন মদমত্ত অবস্থায় এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে, গ্রাম থেকে লোকালয়ে বা জনাকীর্ণ এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সুরাধ্যক্ষকে বিশেষভাবে সজাগ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তা নিরোধ করতে হবে। এরূপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্ৰহণ না করা হলে—১. মদ্যপ ব্যক্তির উৎপাতে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের কাজ বিঘ্নিত হতে পারে ২. মদ্যপ ব্যক্তিদের আনাহূত আচরণ হেতু আর্যজন তথা ভদ্রলোকেরা অসম্মানিত হতে পারেন বা তাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হতে পারে ৩. দুঃসাহসী প্রকৃতির মদ্যপ লোকেরা কোনো কারণ ছাড়াই কাউকে অস্ত্রাঘাত করতে পারে।

০২-২৫-০২ যাদের চারিত্রিক শুচিতা সম্পর্কে সুরাধ্যক্ষ সম্যক অবহিত থাকবেন শুধু তারাই যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুরা তথা এক কুডুবের চার ভাগের এক ভাগ থেকে এক প্রস্থ পরিমাণ সুরা উৎপাদন স্থান বা বিক্রয় কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে। অন্যরা মদ্যপানে ইচ্ছুক হলে নির্ধারিত পানশালায় বসেই তা পান করতে হবে। মদ্য ক্রয় করে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না। কেউ যদি পানশালায় এসে কোনো দ্রব্য উৎপাদনের উপকরণ, বন্ধকী দ্রব্য, চুরির দ্রব্য, মালিকানাহীন দ্রব্য বা বিধিবহির্ভূতভাবে অর্জিত দ্রব্য, সন্দেহজনক দ্রব্য বা মুদ্রার বিনিময়ে মদ্যপানে প্রবৃত্ত হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে সুকৌশলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে সুরাধ্যক্ষের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সমীপে সোপর্দ করতে হবে। পানশালায় যদি এমন ব্যক্তিদের উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হয়, যারা আয় অপেক্ষা মদ্যপানের পেছনে অধিক ব্যয় করে বা ভবিষ্যতের জন্য আয় সঞ্চয় না করে পুরোটাই মদ্যপানে ব্যয় করে দেয়, তবে সেসব সুরা সেবনকারীদেরও সুরাধ্যক্ষ কর্তৃক যথাযথ কর্তৃপক্ষের সমীপে সমর্পণ করতে হবে।

০২-২৫-০৩ সুরা বিক্রেতারা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কমমূল্যে বা বাকিতে (পরে পরিশোধ্য) কোনোপ্রকার উৎকৃষ্ট সুরা কারও কাছে বিক্রয় করতে পারবে না। এক্ষেত্রে হ্রাসকৃত মূল্যে বা বাকিতে নিকৃষ্টমানের সুরা বিক্রি করা যেতে পারে। দাস বা সাধারণ মজুরদের মজুরির পরিবর্তে নিকৃষ্টমানের সুরা সরবরাহ করা যাবে। স্বাচ্ছন্দে সুরা পানের জন্য সুরাধ্যক্ষ এমন ধরনের সুবিধা সম্বলিত পানশালা নির্মাণ করাবেন যেখানে অনেকগুলো কক্ষের ব্যবস্থা থাকবে, পৃথক পৃথক শয়ন কক্ষের ব্যবস্থা থাকবে, পৃথক পৃথক আসনযুক্ত কক্ষ থাকবে। এছাড়াও এ সমস্ত স্থাপনায় সুগন্ধি দ্রব্য, মাল্য এবং প্রয়োজনীয় জল সংরক্ষিত থাকবে। এছাড়াও পানশালাগুলো এমন সুবিধা সম্বলিত হতে হবে যাতে করে তা সব ঋতুতেই সমভাবে সুখকরভাবে ব্যবহার করা যায়।

০২-২৫-০৪ রাজার গুপ্তচররা কর্মচারীদের ছদ্মবেশে পানশালায় অবস্থান করে সুরাপায়ীদের পরিচয়, মদ্যপানে ব্যয়কৃত আয়ের উৎসের বৈধতা-অবৈধতা সম্পর্কে তথ্য তালাশ করবে এবং আগত আগন্তুকের সম্পর্কে অনুসন্ধান করবে। মদ্য ক্রয়কারী বা মদ্য পানের পর যারা অচেতন অবস্থায় পানশালায় পড়ে থাকবে গুপ্তচররা তাদের পরিধেয় বস্ত্র, অলঙ্কার এবং সংরক্ষিত মুদ্রার বিষয়ে পরিজ্ঞাত হবে, এ সমস্ত মদ্যপের কোনোকিছু যদি পানশালায় অবস্থানকালে খোয়া যায় তাহলে মদ্য বিক্রেতা সে সব অপহৃত দ্রব্য বা অর্থ উদ্ধার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিবে এবং ক্ষয়-ক্ষতির সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে রাজাকে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। পানশালার কক্ষগুলোতে যে সমস্ত স্বদেশি ও বিদেশি মদ্যপ অবস্থান করবে তাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে সুরা বিক্রেতার নিয়োগকৃত সুন্দরী সেবিকারা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে।

০২-২৫-০৫ উপকরণ ও উৎকর্ষের মানদণ্ডে সুরা যে ছয় প্রকার হতে পারে তা হলো—মেদক। প্রসন্না। আসব। অরিষ্ট। মৈরেয় এবং মধু। এ সব সুরার প্রস্তুত প্রণালী হলো—১. এক দ্রোণ পরিমাণ পানি, অর্ধেক আঢ়ক পরিমাণ চাউল এবং তিন প্রস্থ পরিমাণ বিশ্বের মিশ্রণে প্রস্তুত হয় মেদক ২. ১২ আঢ়ক পরিমাণ যব বা গমের গুঁড়া, ৫ প্রস্থ পরিমাণ কিন্তু বা পুত্রক নামের গাছের ছালের মিশ্রণে প্রস্তুত হয় প্রসন্না ৩. ১০০ পল পরিমাণ কপিত্থ ফলের সার, ৫০০ পল পরিমাণ কাঁচা আখের রস ও এক প্রস্থ মধুর মিশ্রণে প্রস্তুত হয় আসব। এই মিশ্রণে কপিখের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হলে তা হবে উত্তম এবং কপিখের পরিমাণ হ্রাস করা হলে তা হবে নিকৃষ্ট সুরা ৪. ঔষধি হিসেবে আয়ুর্বেদিকরা যেভাবে অরিষ্ট প্রস্তুত করে থাকে, সে প্রক্রিয়ায় অরিষ্ট প্রস্তুত করতে হবে ৫. মেষশৃঙ্গী নামক গাছের বাকলের রস এবং গুঁড়ের সাথে মরিচ বা ত্রিফলার গুঁড়া মিশিয়ে মৈরেয় প্রস্তুত করা যায় ৬. আঙুরের রস প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে মধু নামক সুরা প্রস্তুত করা হয়। এই মধু নামীয় সুরা যে দেশে উৎপাদিত হয়, সে দেশের নামে তার নামকরণ (ব্রান্ডিং) করা হয়।

০২-২৫-০৬ এক দ্রোণ পরিমাণ মাষকলাইয়ের গুঁড়ার সাথে এক দশমিক তিনের এক অংশ পরিমাণ চালের গুঁড়া মিশিয়ে ওই মিশ্রণের সাথে এক কর্ষ পরিমাণ মূল পুষ্পার লতা মিশিয়ে কিম্বাবন্ধ বা সুরার উপকরণ প্রস্তুত করতে হবে। মেদক ও প্রসন্না নামক সুরার গন্ধ ও বর্ণ আকর্ষণীয় করে উত্তম স্বাদের সুরা প্রস্তুত করতে হলে তাতে অন্বষ্ঠা বৃক্ষের বাকল, লোধ ফুল, গজপিপ্পলী, এলাচি, বালুক সুগন্ধি, যষ্টিমধু, মহুয়া ফুল, আঙুর, কুঙ্কুম, দারু, হলুদ ও মরিচ চূর্ণ করে মিশ্রণ করতে হবে।

০২-২৫-০৭ এক কর্ষ পরিমাণ দারুচিনি, চিত্রক, বিলঙ্গ ও গজপিপুলের সাথে দুই কর্ষ পরিমাণ ক্রমুক, মধুক, মুথা ও লোধ মিশিয়ে আসব সুরার উপকরণ প্রস্তুত করতে হবে। প্রসন্ন সুরা প্রস্তুতের পদ্ধতিতেই প্রস্তুত করতে হবে শ্বেত সুরা। সুরার আরও কয়েকটি প্রকারভেদ হলো—১. সহকার সুরা, এ সুরাতে আখের রস মেশানো হয় ২. রসোত্তরা—এ সুরাতে মিছরি বা তালের গুড় মেশানো হয় ৩. বীজোত্তরা—এ সুরাতে মাত্রাধিক্য বীজদ্রব্য থাকে ৪ সম্ভারিকী—এ সুরাতে বীজ ও সম্ভারের আধিক্য থাকে।

০২-২৫-০৮ (উপরোক্ত সব ধরনের সুরাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু করা যায়। সে সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো না—লেখক) জনপদের লোকেরা বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য শ্বেতসুরা, চিকিৎসার জন্য অরিষ্ট এবং অন্যান্য সুরা প্রস্তুত ও পান করলে তা দোষণীয় বলে বিবেচিত হবে না।

০২-২৫-০৯ জনপদের লোকেরা বসন্ত উৎসবে, বন্ধুজনদের মিলন উৎসবে, দেবতাদের পূজা উপলক্ষে আয়োজিত যাত্রা উৎসবে সুরাধ্যক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে চার দিনের জন্য ইচ্ছেমাফিক সুরা পান করতে পারবে। এক্ষেত্রে কেউ যদি যথাযথ অনুমতি গ্রহণ না করে সুরা পানে প্রবৃত্ত হয়ে থাকে, তাহলে উৎসবের প্রীতিভোজের পর অবৈধভাবে সুরা পানের অপরাধে দায়ী ব্যক্তির কাছ থেকে সুরাধ্যক্ষ প্রতিদিনের হিসেবে যে কয়দিন সুরা পান করেছে, সে কয়দিনের জরিমানা আদায় করবেন। সুরা তৈরির কাজে এমন সব স্ত্রীলোক ও বালক নিয়োগ করতে হবে যারা সুরা পানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। যারা সরকারি পণ্য হিসেবে সুরা প্রস্তুত না করে নিজেরাই বিক্রির জন্য উৎপাদন করবে তাদেরকে সুরা তৈরি ও বিক্রির জন্য বিক্রয়মূল্যের উপর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। সুরাধ্যক্ষ সাধারণ শুল্ক ছাড়াও বণিকদের কাছ থেকে সুরার পরিমাণের উপর ষোল ভাগের এক ভাগ এবং বিক্রিত মূল্যের উপর বিশ ভাগের এক ভাগ হারে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করবেন। তবে সুরাধ্যক্ষ কখনোই নিজের খেয়াল খুশিমতো শুল্ক আরোপ ও আদায় করবেন না, এ কাজ তাকে ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতেই সম্পাদন করতে হবে।

ষড়বিংশ অধ্যায় ॥ ৪৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে পশুপাখির জবেহখানার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই জবেহখানা তথা কসাইখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসককে বলা হয় সূনাধ্যক্ষ। এ পর্যায়ে কসাইখানায় কোন প্রকৃতির পশু পাখি হত্যা এবং কোন প্রকৃতির পশু-পাখির মাংস বিক্রয় করা বৈধ বা অবৈধ, সে বিষয়ে যেমন আলোকপাত করা হয়েছে তেমনি পশু, পাখি ও মৎস্যের উপর উৎপীড়ন নিরোধকল্পে এবং জবেহ নিষিদ্ধ পশু-পাখি হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রদেয় শাস্তির ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সূনাধ্যক্ষ শুধু কসাইখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই নন, তিনি সব ধরনের পশু, পাখি ও মৎস্য সম্পদেরও রক্ষাকর্তা। বলা বাহুল্য কসাইখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সূনাধ্যক্ষেরা হলেন অধম (নিম্ন যোগ্যতাসম্পন্ন) প্রকৃতির রাজ প্রশাসক।

০২-২৬-০১ সূনাধ্যক্ষ শুধু কসাইখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই নন, তিনি যথারীতি পশুপাখির বিচরণ ভূমি তথা অভয়ারণ্যেরও তত্ত্বাবধায়ক। দেশের পশুপাখির নিরাপত্তা বিধানও তার অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের আওতাভুক্ত। এক্ষেত্রে রাজার ফরমান দ্বারা যে সমস্ত অহিংস মৃগ, মহিষ, পাখি ও মৎস্য হত্যা করা নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত, সেসব প্রাণী, পাখি বা মৎস্য কেউ যদি হত্যা করে তাহলে তার বিরুদ্ধে উত্তম সাহসদণ্ড তথা ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। পরিবার-পরিজনের প্রতিপালনের অভিপ্রায়ে কোনো মধ্যবিত্ত গৃহস্থ যদি অভয়ারণ্যে এ সমস্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত পশুপাখি হত্যা করে, তাহলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মধ্যম সাহসদণ্ড তথা ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ধর্মাচার এবং লোকাচার অনুযায়ী যে সমস্ত পাখি ও মৎস্য অবধ্য হিসেবে ঘোষিত হবে, সেসব পাখি বা মৎস্য আটক করলে, হত্যা করলে বা সেগুলোকে পীড়ন করা হলে আইন লংঘনকারীর উপর পৌনে ২৭ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে, একইভাবে সম জাতীয় পশু-পাখির সঙ্গে কেউ উপরোক্ত ধরনের আচরণ করলে অপরাধীকে জরিমানা হিসেবে দ্বিগুণ পণ প্রদান করতে হবে।

০২-২৬-০২ মানুষের প্রতি আক্রমণাত্মক বা মালিকানাহীন কোনো পশুকে জবেহ করা হলে সূনাধ্যক্ষ ওই পশুর ছয় ভাগের এক ভাগ মাংস রাজার প্রাপ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন। একইভাবে পাখি বা মৎস্যের ক্ষেত্রে দশ ভাগের একভাগ গ্রহণ করবেন। বন থেকে শিকার করা জীবন্ত পশু পাখির ছয় ভাগের এক ভাগকে পুনরায় বনে মুক্ত করে দিতে হবে। হাতি, ঘোড়া, মানুষ, বৃষভ এবং গর্দভের আকৃতিধারী বৃহৎ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। হ্রদ, নদী, খাল, বিলের মাছ। ক্রৌঞ্চ, কুবর, জলকাক, হাঁস, চক্রবাক, ভৃঙ্গরাজ, চকোর, মত্তকোকিল, ময়ূর, শুক, তোতা, ময়না, ভুজঙ্গা জাতীয় ক্রীড়াপযোগী এবং মাঙ্গলিক পাখিসহ এ জাতীয় মৎস্য ও পশু-প্রাণীকে যাবতীয় পীড়ন ও হত্যা থেকে সুরক্ষা করতে হবে। এদের রক্ষা করতে এবং নিরাপত্তা প্রদান করতে ব্যর্থ হলে, দায়ী সূনাধ্যক্ষকে প্রথম সাহস দণ্ড তথা ২৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০২-২৬-০৩ সদ্য জবেহকৃত পশুর হাড়বিহীন তাজা মাংস বিক্রয় করা বৈধ বলে গণ্য হবে। হাড়যুক্ত মাংস বিক্রয় প্রাক্কালে হাড়ের সমপরিমাণ মাংস ক্রেতাকে প্রদান করতে হবে। মাংস বিক্রেতা যদি ক্রেতাকে প্রকৃত ওজনের চেয়ে কম মাংস প্রদান করে, তাহলে বিক্রেতা যে পরিমাণ মাংস কম প্রদান করবে তার আট গুণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। জবেহ অনুমোদিত পশুর মধ্যে যদি স্তন্যপায়ী শাবক থাকে, বীর্যসেচনক্ষম বৃষভ থাকে, গর্ভবতী গাভী তথা এ জাতীয় পশু থাকে তবে তা জবেহ করা যাবে না। এর অন্যথা হলে দণ্ড প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে শাবক জবেহ করা হলে ৫০ পণ জরিমানা প্রদেয় হবে। এছাড়াও এ জাতীয় পশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে, হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০২-২৬-০৪ কসাইখানায় অনুমোদিত পশুপাখির মাংস ব্যতীত অন্যত্র জবেহকৃত পশু-পাখির মাংস বিক্রয় করা বিধিসম্মত হবে না। এছাড়াও মাথা, পা, হাড়শূন্য, দুর্গন্ধযুক্ত, রোগাক্রান্ত এবং মৃত পশুপাখির মাংস বিক্রয় করা যাবে না, এর অন্যথা পরিদৃষ্ট হলে, এরূপ মাংস বিক্রেতাকে জরিমানা বাবদ ১২ পণ প্রদান করতে হবে। অভয়ারণ্যে বিচরণকারী কোনো পশু বা জলাশয়ের মাছ যদি হিংস্র হয়ে ওঠে তাহলে তাকে তার বিচরণস্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করে সংরক্ষণ করতে হবে অথবা হত্যা করতে হবে।

সপ্তবিংশ অধ্যায় ॥ ৪৪ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে গণিকাদের প্রকৃতি, সেবার ধরণ, গ্রাহক ও প্রভুর প্রতি তাদের করণীয় সম্পর্কে এবং গণিকালয়ে গমনকারী গ্রাহকদের অধিকার ও অনধিকারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গণিকালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক হলেন গণিকাধ্যক্ষ। তিনি গণিকালয়ের সার্বিক দেখ-ভালের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। কোনো গণিকা বা গ্রাহক বিধি বহির্ভূত কোনো কাজ করলে তিনি যেমন তা নিরোধ করবেন তেমনি গণিকা ও গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেও সচেষ্ট থাকবেন। গণিকালয়ের সার্বিক শৃঙ্খলা সংরক্ষণের স্বার্থে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তিনি শাস্তি ও জরিমানা আরোপ করবেন।

০২-২৭-০১ গণিকা বংশে জন্মগ্রহণকারী, রূপবতী, যৌনাবেদনময়ী এবং কাম-কলায় পারদর্শিনী নারীরা এককালীন বা বার্ষিক হাজার পণ বেতন প্রাপ্তির শর্তে রাজকীয় গণিকারূপে গণিকাধ্যক্ষ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবে। এক্ষেত্রে গণিকাধ্যক্ষ রাজকীয় সেবা প্রদানের নিমিত্ত বাইরে থেকেও প্রতিগণিকা বা সাহায্যকারী গণিকা নিয়োগ প্রদান করতে পারবেন। রাজকীয় সেবায় নিযুক্ত কোনো গণিকা যদি কর্মপরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় বা মৃত্যুবরণ করে, তাহলে তার কন্যা, ভগ্নি বা নিকটাত্মীয় সে দায়িত্ব পালন করবে। অথবা ওই গণিকার মাতা একজন বিকল্প গণিকা সরবরাহ করবে। এ ধরনের কর্মত্যাগী বা মৃত গণিকার বিকল্প পাওয়া না গেলে রাজা উক্ত গণিকার সমুদয় সম্পত্তি অধিগ্রহণ করবেন।

০২-২৭-০২ পুরুষ আকর্ষণের জৌলুস তথা আকর্ষণের দক্ষতা অনুযায়ী গণিকাদের বেতন নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে গণিকাধ্যক্ষ গণিকাদের উত্তম, মধ্যম ও অধম শ্রেণিতে বিভাজিত করে যথাক্রমে ৩০০০, ২০০০ ও ১০০০ পণ বাৎসরিক বেতন প্রদান করবেন। রাজকীয় সৌকর্য উদ্ভাসিতকরণের প্রয়োজনে রূপ যৌবনের মানদণ্ডে গণিকাদের রাজার ছাতা বহনের কাজে, সোনালিপাত্র বহনের কাজে, বাতাস করার পাখা চালনার কাজে, বসবার স্থানে পরিসেবার কাজে, পাল্কিতে আরোহণে সহায়তার কাজে এবং রথে আরোহণে সহায়তার কাজসহ অন্যান্য কাজে নিযুক্ত করতে হবে।

বয়সজনিত কারণে যে গণিকার সৌভাগ্য অবলুপ্ত হবে তাকে পরবর্তী সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত গণিকার মাতৃরূপে নিযুক্ত করতে হবে। দীর্ঘদিন রাজার মনোরঞ্জন ও রাজসেবা প্রদানের কারণে রাজা তাকে পরিত্যাগ না করে অন্যত্র জীবিকার্জনের ব্যবস্থা করে দিবেন। কোনো গণিকা যদি রাজার দাস্যবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাহলে তাকে ২৪ ০০০ পণ মুক্তিমূল্য পরিশোধ করে মুক্ত হতে হবে। গণিকাপুত্র অবমুক্ত হতে ইচ্ছুক হলে ১২ ০০০ পণ মুক্তিমূল্য প্রদান করতে হবে। গণিকাপুত্র যদি মুক্তিমূল্য প্রদানে অক্ষম হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তাকে রাজার কাজে আট বছর শ্রম প্রদান করে মুক্ত হতে হবে।

০২-২৭-০৩ গণিকার যে দাসী নিজেও গণিকা হওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হত, সে ভোগযোগ্য বয়স অতিক্রম করে বৃদ্ধায় পরিণত হলে, গণিকাধ্যক্ষ তাকে ধান মাড়াইয়ের কাজে, রান্নাঘরের সহায়তার কাজে বা কোনো গৃহস্থালি কাজে নিযুক্ত করবেন। এ ধরনের দাসী যদি আগে থেকেই কারো রক্ষিতা হয়ে থাকে বা কারো রক্ষিতা হয়ে থাকতে চায়, তাহলে তাকে মাসিক সোয়া পণ হারে অর্থ রাজাকে প্রদান করতে হবে। গণিকাধ্যক্ষ গণিকাদের সার্বিক আয় ব্যয় ও সম্পত্তির বিবরণ নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন এবং গণিকাদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় নিরোধকল্পে সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন।

০২-২৭-০৪ গণিকারা তাদের ব্যবহার্য আভরণ ও অলঙ্কার প্রয়োজন প্রাক্কালে স্বীয় মাতার কাছে গচ্ছিত রাখবে, কেউ এর অন্যথা করলে বা অন্য কারো কাছে এসব গচ্ছিত রাখলে তাকে সোয়াপণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। গণিকাদের কেউ যদি আভরণ ও অলঙ্কার অন্য কারো কাছে বন্ধক রাখে বা বিক্রি করে দেয় তাহলে তাকে ৫০.২৫ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো গণিকা যদি বাপারুষ্যজনিত অপরাধ করে তথা কারো (গ্রাহক) প্রতি কঠোর, কুৎসিত বা অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে বা কাউকে গালিগালাজ করে তাহলে তার উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। সে যদি দণ্ডপারুষ্যজনিত অপরাধ করে তথা কাউকে যদি হাত, পা বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে তাহলে সে দ্বিগুণ জরিমানা তথা ৪৮ পণ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। গণিকা যদি রাগান্বিত হয়ে কোনো ব্যক্তির কান ছেদন করে, তাহলে তাকে সাড়ে পঞ্চাশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

কোনো পুরুষ যদি গণিকা বা অগণিকা কোনো কুমারীকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলাৎকার করে তাহলে সে পুরুষকে উত্তম সাহসদণ্ড বা ১০০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কুমারীর ইচ্ছে সত্ত্বেও যদি তাকে বলাৎকার করা হয় সেক্ষেত্রে ওই পুরুষের উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০২-২৭-০৫ সম্ভোগে অনিচ্ছুক কোনো গণিকাকে কেউ যদি নিজ গৃহে আটক করে রাখে, তাকে নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যায় বা নখের আঁচড় দিয়ে তার রূপ-লাবণ্য বিনষ্ট করে দেয়, তাহলে ওই ব্যক্তিকে ১০০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এছাড়াও কেউ যদি নখ বা দাঁত দিয়ে গণিকার শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি করে বা অন্য কোনোভাবে শারীরিক ক্ষতিসাধন করে, তাহলে অপরাধের মাত্রানুযায়ী জরিমানার অঙ্ক ১০০০ পণ থেকে ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষেত্র বিশেষে ৪৮ ০০০ পণে উন্নীত হবে। রাজার সেবাকর্মে নিযুক্ত কোনো গণিকাকে হত্যা করা হলে উক্ত হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ৭২ হাজার পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। গণিকা মাতা, গণিকা দুহিতা এবং রূপদাসী বা রূপের বদৌলতে যে দাসীবৃত্তিতে নিযুক্ত হয়েছে, এমন তিন প্রকৃতির কাউকে হত্যা করা হলে হত্যাকারীকে হাজার পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০২-২৭-০৬ উপরোক্ত অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে যে জরিমানার বিধান দেওয়া হয়েছে তা প্রথম অপরাধের জন্য প্রযোজ্য হবে। একই অপরাধ বারংবার কোনো অপরাধীর দ্বারা সংঘটিত হলে তার বিরুদ্ধে আরোপিত জরিমানার অঙ্ক ক্রমশ দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পাবে। চতুর্থবার একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে বিচারকের বিবেচনা অনুযায়ী যথাযথ দণ্ড প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে অপরাধীর সর্বস্ব হরণসহ নির্বাসন দণ্ডও প্রযুক্ত হতে পারে। রাজা আদেশ দেওয়ার পরও যদি কোনো গণিকা ব্যক্তি বিশেষের ভোগের জন্য গমন না করে, তাহলে তাকে শাস্তি হিসেবে হাজার কশাঘাত ভোগ করতে হবে অথবা ৫০০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

সম্ভোগের সঙ্গ দানের নিমিত্ত অগ্রিম অর্থ গ্রহণ সত্ত্বেও কোনো গণিকা যদি সংশ্লিষ্ট পুরুষকে সঙ্গ দান হতে বিরত থাকে, গ্রাহকের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে বা সম্ভোগে অনিচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে উক্ত গণিকাকে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো গণিকা যদি রাত্রিযাপনের শর্তে কারো কাছ থেকে অর্থগ্রহণ সত্ত্বেও শারীরিক সঙ্গ প্রদান না করে ছলে বলে কৌশলে সময় ক্ষেপণ করে রাত পার করে দেয়, তাহলে উক্ত গণিকাকে গৃহীত অর্থের আটগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো গণিকা যদি রোগজনিত কারণে বা পুরুষের পুরুষত্বহীনতাজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট পুরুষের সঙ্গে সম্ভোগে মত্ত হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে থাকে, তাহলে তাকে কোনো ধরনের জরিমানা প্রদান করা যাবে না।

০২-২৭-০৭ সম্ভোগের জন্য আগত কোনো পুরুষকে যদি কোনো গণিকা হত্যা করে, তাহলে সেই গণিকাকে শাস্তি হিসেবে উক্ত ব্যক্তিকে যে চিতায় পোড়ানো হবে, সে চিতায় দগ্ধ করা যেতে পারে অথবা গলায় ভারী পাথর বেঁধে জলে ডুবিয়ে হত্যা করা যেতে পারে। কোনো পুরুষ যদি গণিকার সম্ভোগের পারিতোষিকসহ আভরণ-অলঙ্কারাদি অপহরণ করে বা আত্মসাৎ করে তাহলে তাকে অপহৃত দ্রব্যমূল্যের আটগুণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। গণিকারা গণিকাধ্যক্ষের কাছে সম্ভোগকারী গ্রাহকের নাম, অর্জিত আয় এবং সম্ভাব্য আয় সম্পর্কীত যাবতীয় তথ্য প্রদান করবে। গণিকাধ্যক্ষ এ সমস্ত তথ্য নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।

এ সমস্ত পেশাধারী স্বীকৃত গণিকা ছাড়াও আরও যে এগার ধরনের নারী গণিকাবৃত্তিতে যুক্ত থাকে তারা হলো—১. অভিনয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারী অভিনেত্রী ২. নৃত্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারী নর্তকী ৩. সংগীতের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারী গায়িকা ৪. বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারকারী বাদক ৫. কথ-কথার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারী কথক ৬. নর্তকীদের দিয়ে নৃত্যগীতের মাধ্যমে জীবন নির্বাহকারী কুশীলব ৭. শারীরিক কসরৎ দেখিয়ে জীবন নির্বাহকারী প্লবক ৮. ঐন্দ্রজালের মাধ্যমে জীবন নির্বাহকারী সৌভিক ৯. ঘুরে ঘুরে নাচ গান করে জীবন নির্বাহকারী চারণ ১০. স্ত্রীর রোজগারে জীবন নির্বাহকারী স্ত্রী ব্যবহারকারী ১১. গোপনে ব্যভিচারের মাধ্যমে জীবন নির্বাহকারী গূঢ়াজীবী। পেশাজীবী গণিকাদের ক্ষেত্রে যে সব নিয়ম-নীতি বিধি-বিধান রয়েছে তা গণিকাবৃত্তিতে নিযুক্ত এসব নারীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

০২-২৭-০৮ উপরোক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যে সমস্ত নট, নর্তকী, গায়ক এবং বাদক বিদেশ থেকে আগত হবে তাদেরকে প্রদর্শনীর সময় ৫ পণ করে রাজকর প্রদান করতে হবে। যে সব রূপাজীবী নিজের যৌবন বা রূপ লাবণ্যকে উপজীব্য করে দেহদানের মাধ্যমে উপার্জন করবে তারা তাদের মাসিক আয়ের পনেরো ভাগের এক ভাগ রাজকর হিসেবে রাজাকে প্রদান করবে।

যে সব আচার্য বা শিক্ষক গণিকাবৃত্তি, দাসীবৃত্তি, নাট্যাভিনয়, সংগীত, বাদ্য বাজনা, পড়াশোনা, নৃত্য, অক্ষর লিখন, চিত্রাঙ্কন, মালা গাঁথা, অঙ্গ মর্দন, কামকলা, বংশীবাদন, ইঙ্গিত জ্ঞান, সুগন্ধি প্রস্তুত, আনন্দ দেওয়ার কলা কৌশল, ইত্যাকার বিষয়ে কৃত্যভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন, রাজা তাদের জীবন নির্বাহের জন্য রাজকোষ হতে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।

০২-২৭-০৯ গণিকাপুত্রদের মধ্যে যারা নৃত্যগীত ও রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ে পারদর্শী হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করবে, তারাই এক্ষেত্রের প্রশিক্ষকের পদে নিয়োগযোগ্য হবে। এদের স্ত্রীগণকে রাজা আর্থিক পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে বশীভূত করে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত করে গুপ্তচরের কাজ করাবেন। এদের মাধ্যমে রাজা দুষ্টু লোকদের সন্ধান করবেন এবং প্রয়োজনে এদের দিয়েই দুষ্টু লোক ও বিদেশি গুপ্তচরদের হত্যার কাজ সম্পাদন করাবেন।

অষ্টাবিংশ অধ্যায় ॥ ৪৫ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে নৌ পরিবহন বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য প্রশাসককে বলা হয় নাবধ্যক্ষ। রাজ্যের যাবতীয় নৌ চলাচল, নদী পারাপার, বন্দর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নাবধ্যক্ষের উপর ন্যস্ত। নৌপথের সার্বিক নিরাপত্তা, সমুদ্র, নদী, খাল, হ্রদসহ সকল জলমহাল এবং জলজ সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারেও নাবধ্যক্ষ দায়বদ্ধ। এসব বিষয়েই এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে এবং দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।

০২-২৮-০১ নাবধ্যক্ষ সারা দেশে নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করবেন এবং নৌ চলাচল খেয়া পারাপারসহ এ সংক্রান্ত সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধান করবেন। তিনি নৌ চলাচল খাত হতে আহরিত আয় সংরক্ষণ করবেন। সমুদ্র ও নদীতীরবর্তী এলাকায় বসবাসরতরা জলপথে যাতায়াত ও নদী পারাপারের জন্য নিয়মিত কর প্রদান করবে। জল এলাকায় বসবাসরত ধীবররা মৎস্য শিকারকালে রাজকীয় নৌকা ব্যবহার করলে ধৃত মৎসের ছয় ভাগের এক ভাগ রাজকর হিসেবে প্রদান করবে। নৌবন্দর ও জলপথ ব্যবহারকারী বণিকরা রীতি মোতাবেক পণ্যমূল্যের পাঁচ বা ছয়ভাগ রাজকর হিসেবে শুল্ক প্রদান করবে। রাজকীয় নৌকায় যাতায়াতকারীরা নির্ধারিত হারে নৌকার ভাড়া বা মাঝির পারিশ্রমিক প্রদান করবে। নদী থেকে শঙ্খ বা মুক্তা আহরণকারীরা রাজকীয় নৌযান ব্যবহার করলে প্রচলিত হারে নৌকার ভাড়া প্রদান করবে, এক্ষেত্রে তারা নিজেদের নৌকা ব্যবহার করলে কোনো ভাড়া প্রযোজ্য হবে না। খনি অধ্যক্ষের মতো নাবধ্যক্ষ আহরিত জলজ সম্পদ দিয়ে পণ্য তৈরির নিমিত্ত প্রয়োজনীয় কারখানা নির্মাণ করাবেন এবং সেসব পণ্যদ্রব্য প্রস্তুতের প্রণালী ও বিপণন ব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করবেন।

০২-২৮-০২ নাবধ্যক্ষ নৌবন্দরের দায়িত্ব পালনকারী পত্তনাধ্যক্ষের অনুসৃত নিয়ম-নীতির আদলে হিসাব সংরক্ষণের কর্ম সম্পাদন করবেন। পিতা যেমন পুত্রকে নিরাপত্তা বেষ্টনিতে আগলে রাখেন তেমনি নাবধ্যক্ষও চলাচলের সময় নৌযানগুলোকে বিপরীত বাতাসের ঝাপ্‌টার বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবেন। নৌকায় জল প্রবেশের মাধ্যমে কোনো পণ্য যাতে বিনষ্ট হয়ে না যায়, সে ব্যাপারেও তিনি সতর্কতা অবলম্বন করবেন। কোনো বণিকের পণ্য যদি পরিবহন প্রাক্কালে পানিতে ভিজে বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তিনি উক্ত বণিকের প্রদেয় শুল্ক মওকুফ করে দিবেন বা অবস্থা বিবেচনা করে অর্ধেক শুল্ক আদায় করবেন।

পণ্যবাহী নৌযানের নির্ধারিত যাত্রার সময় হলে তিনি নৌযানগুলো গন্তব্যে প্রেরণের ব্যবস্থা করবেন। সমুদ্রে বা নদীতে চলাচলরত নৌযান গন্তব্য সীমায় উপস্থিত হলে তাদের প্রদেয় শুল্ক চেয়ে নিবেন। যেসব নৌকাতে চোর, দস্যুর উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হবে সেসব নৌকা ধ্বংস করতে হবে। যেসব নৌকা শত্রু দেশের পথে ধাবিত হবে বা শত্রু দেশ থেকে আগত হবে বা নৌ বন্দরের নিয়ম ভেঙে পলায়ন করবে, সেসব নৌকাও ধ্বংস করে দিতে হবে।

০২-২৮-০৩ যেসব নদীতে বারো মাস পানির প্রবাহ থাকবে সেসব নদীতে পাথর ও ভারী পণ্যবাহী বড় নৌকা চালাতে হবে, বড় নৌকা চালনার সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক নাবিক, মাঝি, খালাসি এবং নৌকার পানি সেচক নিয়োগ করতে হবে। যে সব নদীতে শুধু বর্ষাকালে পানির প্রবাহ থাকে, সেসব নৌপথে ক্ষুদ্রাকৃতির নৌকা চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নৌপথে চলাচলরত নৌকাগুলোকে নির্ধারিত ঘাটে নোঙর করতে হবে। এতে করে রাজার অনিষ্টকাঙ্ক্ষীদের চিহ্নিতকরণ যেমন সম্ভব হবে, তেমনি নৌযানগুলোকে পর্যবেক্ষণ করাও সহজ হবে। নিষিদ্ধ সময়ে তথা রাতে এবং অনুমোদিত পারাপারঘাট ছাড়া অন্যস্থান দিয়ে কেউ নদী পার হলে, তার উপর প্রথম সাহসদণ্ড তথা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। অধিকন্তু অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ যদি নির্ধারিত ঘাট দিয়েও নদী পার হয়, তাহলেও তাকে পৌনে ২৭ পণ জরিমানা তথা তরাত্যয় প্রদান করতে হবে।

০২-২৮-০৪ এক্ষেত্রে জেলে, কাষ্ঠপরিবাহক, তৃণপরিবাহক, পুষ্পবাহক মালি, ফলের বাগিচারক্ষক, শাক-সব্জি, কলা, শুপারি বাগানের রক্ষক এবং গবাদি পশুর পালকদের জন্য তরাত্যয় বা পারাপার কর প্রযোজ্য হবে না। এরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো সময় নদী পার হতে পারবে। এছাড়াও সন্দেহভাজন চোরকে অনুসরণকারী, রাজদূতকে অনুসরণকারী, সৈনিকদের ব্যবহার্য দ্রব্য বহনকারী, কর্তব্যরত গুপ্তচর এবং নিজস্ব নৌযান ব্যবহারকারী নদীতীরবর্তী এলাকার লোকজনদের যারা বীজ, ভোজনদ্রব্য, শাক, সব্জি, পুষ্প, মশলা এবং গৃহস্থালি উপকরণ পরিবহনে নিযুক্ত থাকবে, তাদের ক্ষেত্রেও তরাত্যয় প্রযোজ্য হবে না। এরা যে কোনো সময় যে কোনো স্থান থেকে নদী পার হতে পারবে বা নৌকা চালাতে পারবে।

০২-২৮-০৫ ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী, বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, রাজকীয় বার্তাবাহক এবং গর্ভবতী মহিলারা নাবধ্যক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত মুদ্রা (সনদপত্র) প্রদর্শন সাপেক্ষে বিনা ভাড়ায় নদী পার হতে পারবে। বিদেশি বণিকরা রাজার অনুমতি সাপেক্ষে বন্দর দিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে। যাদের অনুমতি নেই সেসব বণিকরা যদি স্থানীয় বণিক সংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তবে রাজার অনুমতি না থাকলেও তারা রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে। বন্দরে দেখামাত্র নাবধ্যক্ষ যাদের গ্রেফতার করবে তারা হলো—অন্যের স্ত্রী, কন্যা বা সম্পদ অপহরণকারী। শঙ্কিত অবয়বে বন্দরে বিচরণকারী। অত্যধিক ভারযুক্ত বোঝা বহনকারী উদ্বিগ্ন ব্যক্তি। মাথার বোঝা দিয়ে অবয়ব আবৃতকারী। সদ্য সন্ন্যাস চিহ্ন ধারণকারী। সদ্য সন্ন্যাস ত্যাগকারী। মিথ্যে ব্যাধিগ্রস্ত হিসেবে উপস্থাপনকারী। বিকারগ্রস্ত মানুষ। গোপনে মূল্যবান রত্ন বহনকারী, গোপনে রাজাদেশ, অস্ত্র, বিষ এবং অগ্নিকাণ্ডের উপকরণ বহনকারী। নাবধ্যক্ষ, মুদ্রাধ্যক্ষ বা অন্তপালের অনুমতি পত্রহীন ব্যক্তি।

০২-২৮-০৬ নদী পারাপারের ভাড়ার ক্ষেত্রে ছাগল এবং ওই জাতীয় ছোট পশু বহনকারীকে পারাপারের জন্য এক মাষক ভাড়া প্রদান করতে হবে। মাথায় এবং কাঁধে ভারবাহী মানুষ, গরু ও অশ্বের জন্য প্রদান করতে হবে দুই মাষক। উট ও মহিষের জন্য প্রদেয় হবে চার মাষক। হাল্কা গাড়ির জন্য প্রদেয় হবে পাঁচ মাষক। গোলিঙ্গ বা গরুর গাড়ির জন্য প্রদেয় হবে ছয় মাষক। বড় আকৃতির গাড়ির জন্য প্রদেয় হবে সাত মাষক। পণ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে ২০ তুলা পরিমাণ দ্রব্যের জন্য মাশুল প্রদেয় হবে এক চতুর্থাংশ পণ। নদী পারাপারের এ সমস্ত ভাড়া বা মাশুল শুধু ছোট নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বৃহৎ নদীর পারাপারের ক্ষেত্রে এ মাশুল হবে দ্বিগুণ। জলময় জনপদের লোকেরা ঘাট পারাপারে নিয়োজিত মাঝিদের খাদ্য ও বেতনের সংস্থান করবে।

০২-২৮-০৭ নাবধ্যক্ষের নিযুক্ত কর্মচারীরা বণিকদের কাছ থেকে পথের নিরাপত্তার শুল্ক এবং অন্তঃপালকে প্রদেয় শুল্ক আদায় করবে। শুল্করহিত কোনো পণ্য পারাপারের জন্য অনীত হলে, অনুমোদিত সময় এবং নির্ধারিত ঘাট ছাড়া অন্যস্থান দিয়ে কোনো মালামাল পারাপার করা হলে রাজ কর্মচারীরা তা বাজেয়াপ্ত করবে। ত্রুটিযুক্ত রাজকীয় নৌকায় মালামাল পরিবহনজনিত কারণে যদি তা বিনষ্ট হয় সেক্ষেত্রে নাবধ্যক্ষ কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্তকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। আষাঢ় ও কার্তিক মাসের পূর্ণিমার পরবর্তী সপ্তাহে মাঝিরা তাদের কাজের ফিরিস্তি এবং আয়ের যৌক্তিক হিসাব নাবধ্যক্ষের কাছে দাখিল করবে।

ঊনত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৪৬ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে গো-সম্পদ তথা গরু, মহিষসহ সকল প্রকার গবাদিপশুর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। গো সম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসককে বলা হয় গোহধ্যক্ষ। তিনি গবাদি পশু লালন-পালনের পরিচর্য্যাগত প্রক্রিয়া, এর ব্যবস্থাপনা এবং এ সংক্রান্ত আইন-কানুন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত। সার্বিকভাবে গো সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং এই বিভাগের উন্নয়ন সম্পৃক্ত সকল বিষয় গোহধ্যক্ষের উপর ন্যস্ত।

০১-২৯-০১ গবাদি পশুর প্রশাসক তথা গোহধ্যক্ষকে যে আট প্রকার কাজের তত্ত্বাবধান করতে হয় তা হলো—১. বেতনোপগ্রাহিক ২. করপ্রতিকর ৩. ভগ্নোৎসৃষ্টক ৪. ভাগানুপ্রবিষ্টক ৫. ব্রজপর্যগ্র ৬. নষ্ট ৭. বিনষ্ট এবং ৮. ক্ষীরঘৃতসঞ্জাত। বেতনোপগ্রাহিক—গো পালনে নিযুক্ত ভৃত্য তথা গোপালক, মহিষপালনে নিযুক্ত ভৃত্য তথা পিণ্ডারক, গরু-মহিষের দুধ দোহনের কাজে নিযুক্ত ভৃত্য তথা দোহক, দধি মন্থনের কাজে নিযুক্ত ভৃত্য তথা মন্থক, হিংস্র জন্তুদের আক্রমণের কবল থেকে গবাদিপশুর রক্ষাকারী তথা লুব্ধক। এই পাঁচ ধরনের ভৃত্য নির্দিষ্ট ধান বা নগদ মজুরির বিনিময়ে গবাদি পশু লালন-পালন ও এতদ্‌সম্পৃক্ত কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত হবে। নগদ মজুরি ব্যতীত এদের মজুরির বিনিময়ে দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য প্রদান করা যাবে না। মজুরি হিসেবে এদের দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য প্রদান করা হলে অধিক দুগ্ধপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় এরা গো শাবকদের প্রয়োজনীয় দুধ পানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে এবং সেগুলোকে রোগাক্রান্ত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবে। মজুরি প্রদানের এই প্রক্রিয়াটি হলো বেতনোপগ্রাহিক।

০২-২৯-০২ করপ্রতিকর—বৃদ্ধ গাই, দুধাল গাই, গর্ভবতী গাই, গর্ভধারণেচ্ছুক গাই এবং স্তনপান ত্যাগকারী গাই, এই পাঁচ শ্রেণি থেকে ২০টি করে গরু নিয়ে ১০০ গরুর সমন্বয়ে একটি গরুর পাল গঠন করতে হবে এবং একজন গোপালককে এগুলো পালনের ভার অর্পণ করতে হবে। এই গোপালক প্রতি বছর তার গরুর পাল থেকে আয় হিসেবে আট বারক তথা ৮৪ কুডুব ঘি, প্রতিটি গরুর জন্য এক পণ হারে ১০০ পণ কর এবং পশুর মৃত্যু হলে রাজ মোহরযুক্ত চামড়া গোহধ্যক্ষকে প্রদান করবে। কর প্রদানের এই প্রক্রিয়াটি হলো করপ্রতিকর। ভগ্নোৎসৃষ্টক—একই প্রক্রিয়ায় পালনযোগ্য সমসংখ্যক ব্যাধিগ্ৰস্থা, অঙ্গবিকলা, একজনের দ্বারা দোহনিয়া, কষ্টকরভাবে দোহনিয়া এবং মৃতবৎসা গাভীর সমন্বয়ে ১০০ গরু পালনকারী গোপালক পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে গোহধ্যক্ষকে উৎপাদিত দুধ ও ঘৃত প্রদান করবে। এ ধরনের অযোগ্য গরুর উৎস থেকে উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ এবং গো রক্ষণ প্রক্রিয়া হলো ভগ্নোৎসৃষ্টক।

০২-২৯-০৩ ভাগানুপ্রবিষ্টক-শত্রুচক্রের ভয়ে ভীত হয়ে কিংবা অরণ্য চোরদের কবল থেকে রক্ষা পাবার অভিপ্রায়ে যে সব গবাদিপশুর মালিক তাদের গরুরপাল রাজার চারণভূমিতে চড়াবেন বা পালন করবেন, তাদের ওই সব পশুর উৎপাদিত দুগ্ধের ও দুগ্ধজাত পণ্যের দশ ভাগের এক ভাগ গোহধ্যক্ষকে প্ৰদান করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার গো-রক্ষণ হলো ভাগানুপ্রবিষ্টক। ব্রজপর্যগ্র—পুরুষ গরু যে ছয় ধরনের হতে পারে তা হলো— (ক) বৎস বা দুগ্ধপানরত শাবক (খ) বৎসতর বা দুগ্ধপান পরিত্যাগকারী শাবক (গ) দম্য বা কৃষিকর্মের প্রশিক্ষণযোগ্য গরু (ঘ) বহিন বা বোঝা বহনে সক্ষম ষাঁড় (ঙ) বৃষ বা গর্ভ সঞ্চারে সক্ষম ষাঁড় এবং (চ) উক্ষা বা হাল চাষে সক্ষম গরু। মহিষ যে চার ধরনের হতে পারে তা হলো—শকটবহনকারী, গর্ভ সঞ্চারকারী, পিঠে ভারবাহী এবং মাংসের জন্য উপযোগী।

গাভী ও মহিষী যে সাত ধরনের হতে পারে তা হলো—(ক) বৎসিকা বা স্তন্যপায়ী (খ) বৎসতরী বা স্তন্যপান পরিত্যাগকারী (গ) পষ্ঠৌহী বা প্রথম বারের মতো গর্ভবতী (ঘ) গর্ভিণী বা গর্ভবতী (ঙ) ধেনু বা দুগ্ধ প্রদানকারী (চ) অপ্রজাতা বা প্রসবনযোগ্য অপ্রাপ্ত বয়স্কা এবং (ছ) বন্ধ্যা বা অপ্রজননযোগ্য। উপরোক্ত প্রকৃতির গো-মহিষাদিকে বিভিন্ন প্রতীকী চিহ্নের মাধ্যমে আলাদা করতে হবে, তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উপযুক্ত কাজে নিযুক্ত বা ব্যবহার করতে হবে এবং সেভাবেই লালন-পালন করতে হবে। এদের বিস্তারিত বিবরণী নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। এই পদ্ধতিতে গো-মহিষাদি লালন-পালন হলো ব্ৰজপর্যগ্র।

০২-২৯-০৪ নষ্ট—তিনভাবে গো সম্পদ নষ্ট বা হারিয়ে যেতে পারে— ১. চোর দ্বারা অপহৃত হতে পারে ২. অন্য পশুদের সঙ্গে চলে যেতে পারে ৩. বনের মধ্যে পথভ্রষ্ট হয়ে নিজ যূথ থেকে বিচ্যুত হতে পারে। বিনষ্ট—গবাদি পশুরা কাদায় নিমজ্জিত হয়ে, গর্তে নিপতিত হয়ে, বার্ধক্য পীড়িত হয়ে, জলস্রোতে পতিত হয়ে, আহার দোষে দুষ্ট হয়ে, বৃক্ষপতনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে, নদী ভাঙনে নিপতিত হয়ে, পতিত পাথরের আঘাতে আহত হয়ে, বজ্রপাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে, হিংস্র জীবজন্তুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কিংবা দাবাগ্নির কোপানলে পড়ে বিনষ্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলার কারণে যদি কোনো পশু বিনষ্ট হয় তাহলে তাকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। গোহধ্যক্ষ এ ধরনের সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি করবেন।

০২-২৯-০৫ যে গোপালক বা গোবাদি পশু পালনকারী কর্মচারী নিজে বা অন্যকে দিয়ে পশু হত্যা করাবে, পশু চুরি করবে বা অন্যকে দিয়ে চুরি করাবে, তার উপর মৃত্যুদণ্ড আরোপিত হবে। কোনো কর্মচারী যদি অন্য কারও গরুর শরীরে রাজকীয় মুদ্রার ছাপ দিয়ে গরুর মালিকানার পরিবর্তন ঘটায় বা নিম্নজাতের পশুর শরীরে উৎকৃষ্টজাতের পশুর চিহ্ন প্রদান করে, সেক্ষেত্রে তার উপর প্রথম সাহসদণ্ড বা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি চুরিকৃত গবাদিপশু প্রকৃত মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ করে, তাহলে তিনি পশুর মালিকের কাছ থেকে পশু প্রতি এক পণ করে লাভ করবে। বিদেশ থেকে কেউ চুরিকৃত পশু উদ্ধার করে মালিককে প্রত্যর্পণ করলে মালিকের কাছ থেকে সে পশুটির মূল্যের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ লাভ করবে।

গোপালকরা পশু শাবক, বৃদ্ধ পশু এবং রোগাক্রান্ত পশুর পরিচর্যা করে তাদের দুরবস্থা প্রশমনে সচেষ্ট হবে। তারা পোষা কুকুরের মাধ্যমে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে গবাদি পশুদের হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে হেফাজত করবে এবং কোন ঋতুতে কোথায় ঘাস পানি পাওয়া যায় সে সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে সে মোতাবেক পশুচারণ করবে। সাপ ও হিংস্র পশুদের মনে ভয় সৃষ্টি এবং পশুদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য গোপালকরা গবাদি পশুর গলায় শব্দ উৎপাদক ঘণ্টা বেঁধে দিবে।

০২-২৯-০৬ গোপালকরা হিংস্র জন্তু জানোয়ার রহিত নিরাপদ জলাশয়ে পশুদের পানি পান করাবে এবং স্নান করাবে। যদি কোনো পশু চোরের দ্বারা অপহৃত হয় কিংবা হিংস্র পশু, সাপ, কুমিরের আক্রমণে মারা যায় বা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে গোপালকরা সে সংবাদ যথাসময়ে গোহধ্যক্ষকে অবহিত করবে, এর অন্যথা হলে তাদের পশুমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। গোপালকরা মৃত পশুর চামড়া, শিং, অস্থি, পিত্ত, অন্ত্র, দাঁত ও খুর আহরণ করে রাজভাণ্ডার তথা কুপ্যগৃহে জমা প্রদান করবে।

০২-২৯-০৭ পালনকৃত কোনো পশু মৃত্যুবরণ করলে সেই মৃত পশুর মাংস শুকিয়ে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত্যুর পূর্বে পীড়িত পশুর দুগ্ধ দোহন করে তা দিয়ে ঘোল তৈরি করে শূকর ও কুকুরকে পান করাতে হবে, এতে করে তারা পোষ মানবে। পশুর দুগ্ধ থেকে উৎপাদিত ছানা সৈনিকদের ভোজ্যবস্তুরূপে ব্যবহারের নিমিত্ত সংগ্রহ করতে হবে। পশু বিক্রেতারা বিক্রিত পশু মূল্যের প্রতি পণের এক চতুর্থাংশ রাজস্ব হিসেবে গোহধ্যক্ষের কাছে জমা প্রদান করবে। গোপালকরা বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত ঋতুতে সকাল সন্ধ্যা গো-মহিষাদির দুগ্ধ দোহন করবে কিন্তু শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে মাত্র একবার দুগ্ধ দোহন করবে।

০২-২৯-০৮ যে এলাকায় এক বেলা দুগ্ধ দোহনের নিয়ম বলবৎ হবে, সে এলাকায় দুইবার দোহন করা হলে শাস্তি হিসেবে দোহনকারীর আঙুল ছেদন করতে হবে। গাভীর এক দ্রোণ পরিমাণ দুধ থেকে ৩২ পল বা এক প্ৰস্থ ঘৃত উৎপন্ন হবে। মহিষীর ক্ষেত্রে এই পরিমাণ পাঁচ ভাগের এক ভাগ অধিক হবে। বিশেষ বিশেষ তৃণভূমি ও জলের তারতম্য হেতু দুগ্ধ উৎপাদন কম বেশি হতে পারে, সেসব বিবেচনা করে গোহধ্যক্ষকে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হতে হবে।

০২-২৯-০৯ কেউ যদি যূথবদ্ধ ষাঁড়দের থেকে প্রজননে সক্ষম ষাঁড় নিয়ে লড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করে, তাহলে তা অপকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এহেন কর্মের জন্য শাস্তি হিসেবে তার উপর মধ্যম সাহসদণ্ড তথা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ ধরনের লড়াইয়ে কোনো ষাঁড় নিহত হলে দায়ী ব্যক্তিকে জরিমানা হিসেবে ১০০০ পণ প্রদান করতে হবে। যূথবদ্ধ পশুগুলোকে বর্ণেরভিত্তিতে বিভাজন করে ১০০টি গরুকে দশ ভাগে বিভক্ত করে প্রতিপালন করতে হবে। এদের বসবাসের স্থান এবং বিচরণের এলাকা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এদের চারণভূমি কতটা বিস্তৃত, আবাসন কতটা সুরক্ষিত এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা সুদৃঢ়, গোহধ্যক্ষকে সেসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কর্মচারীরা ছয় মাস অন্তর পশুর পশম সংগ্রহ করে রাজভাণ্ডারে জমা প্রদান করবে।

০২-২৯-১০ পশুদের খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে—যে সব ষাঁড়ের নাক ছিদ্রযুক্ত, যারা অশ্বের মতো গতিশীল এবং রথ চালনায় সক্ষম, তাদের প্রতিদিনের খাদ্য হিসেবে ১০ তুলা পরিমাণ যব, ২০ তুলা পরিমাণ ঘাস, এক তুলা পরিমাণ ঘোল, ১০ আঢ়ক পরিমাণ চালের কণাযুক্ত ভাতের মাড়, পাঁচ পল পরিমাণ সৈন্ধব লবণ, নাকের মন্থনের জন্য এক কুডুব পরিমাণ তেল, খাওয়ার জন্য এক প্রস্থ পরিমাণ তেল বরাদ্দ করতে হবে। এছাড়াও ওদের প্রতি দিনকার খাদ্য তালিকায় যুক্ত করতে হবে এক তুলা পরিমাণ মাংস, এক আঢ়ক দধি, এক দ্রোণ পরিমাণ মাষ, অর্ধ আঢ়ক সুরা, ১০ পল পরিমাণ গুড়, এক পল আদা। এভাবে খাদ্য দেওয়া হলে পশুদের কাজের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

০২-২৯-১০ ষাঁড় সম্প্রদায়ের জন্য যে খাদ্য বরাদ্দ করা আছে তার এক চতুর্থাংশ কম খাদ্য পাবে খচ্চর, গাভী ও গাধা। কিন্তু উট, মহিষ এবং শটচালনায় যুক্ত ষাঁড়রা প্রথমোক্তদের দ্বিগুণ পরিমাণ খাদ্য পাবে। ষাঁড়দের কাজের সময় বিবেচনা করে এবং গাভীদের দোহনকৃত দুগ্ধের পরিমাণ যাচাই করে প্রয়োজনের নিরিখে খাদ্যের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি পশু যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য এবং পানীয় জল পায় সে ব্যাপারে গোহধ্যক্ষকে সচেতন থাকতে হবে। ১০০টি পশুর সমন্বয়ে এক একটি যূথ বা দল গঠন করতে হবে এবং সে যূথে গর্ভসঞ্চারের জন্য গর্দভ ও অশ্বের ক্ষেত্রে পাঁচটি পুরুষ গর্দভ ও অশ্ব রাখতে হবে, একশ ছাগল ও মেষের জন্য দশটি পুরুষ ছাগল ও মেষ রাখতে হবে, একশ গরু, মহিষ ও উটের জন্য চারটি করে পুরুষ গরু, মহিষ ও উট রাখতে হবে।

ত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৪৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে অশ্বের প্রজাতি, জন্মস্থান, গুণাবলিসহ লালন-পালন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। পরিবহনের ক্ষেত্রে অশ্বরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি যুদ্ধের ক্ষেত্রে অশ্বের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, মূলত অশ্ববাহিনীর সংখ্যা ও দক্ষতার উপর একজন রাজার যুদ্ধের সক্ষমতা নির্ভরশীল। সে কারণে অতীব গুরুত্বের সাথে অশ্বের প্রতিপালন আবশ্যক। এই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক অশ্বাধ্যক্ষ নামে অভিহিত।

০২-৩০-০১ সংখ্যা, প্রজাতি, বয়স, বর্ণ, চিহ্ন, দেশ এবং প্রাপ্তিস্থানের ভিত্তিতে অশ্বাধ্যক্ষ কর্তৃক অশ্বের শ্রেণি বিভাগ করে তা নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও অশ্বাধ্যক্ষ কর্তৃক যে সব অত্যাবশ্যকীয় তথ্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে, তা হলো—১. পণ্যাগারিক বা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত এবং বিক্রয়ের জন্য মজুদ অশ্ব ২. ক্ৰয়োপাগত বা ক্রয়কৃত অশ্ব ৩. আবহলব্ধ বা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পরাজিত শত্রুর অধিকৃত অশ্ব ৪. আজাত বা নিজেদের অশ্ব হতে উৎপন্ন অশ্ব ৫. সাহায্যকাগত বা অন্য রাজত্ব থেকে প্রাপ্ত অশ্ব ৬. পণস্থিত বা অর্থের বিনিময়ে অন্যের কাছ থেকে পণ হিসেবে প্রাপ্ত অশ্ব ৭. যাবৎকালিক বা সাময়িক প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে আনীত অশ্ব। যে সব অশ্ব অস্বাভাবিক, ব্যাধিগ্রস্ত বা বিকলাঙ্গ, অশ্বাধ্যক্ষ সেসব অশ্বের চিকিৎসার ব্যাপারে রাজার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করবেন এবং এ বিষয়ক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অশ্বপালক রাজকোষ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং অশ্বের খাবার সংগ্রহ করে অশ্ব পালনের কাজ করবে।

০২-৩০-০২ অশ্বের আরামদায়ক অবস্থানের জন্য অশ্বাধ্যক্ষ অশ্বের দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণ পরিমাপের, চারিদিকে চারটি দ্বারযুক্ত এবং পর্যাপ্ত উচ্চতাসম্পন্ন অশ্বশালা নির্মাণ করাবেন। অশ্বগুলোকে সাপ এবং বিষের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে অশ্বশালায় ময়ূর, পৃষত, নকুল, চকোর, শুক ও শারিকা পালনের ব্যবস্থা রাখবেন। অশ্বশালাতে অশ্বদের ভোজনের সুবিধা, মল ত্যাগের সুবিধা প্রবর্তন করতে হবে। প্রসূতি, বীর্য সঞ্চালক এবং শিশু অশ্বদের আলাদাভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি অশ্বশালাটির অবস্থান হতে হবে সাধারণ্যের দৃষ্টির আড়ালে।

০২-৩০-০৩ প্রসবের পর অশ্বমাতাকে প্রথম তিন দিন এক প্রস্থ করে ঘৃত খাওয়াতে হবে। এরপর পরবর্তী দশ রাত খাওয়াতে হবে এক প্রস্থ পরিমাণ ছাতু এবং পান করাতে হবে তেলযুক্ত ভেষজ, তারপর খাওয়াতে হবে অধাসেদ্ধ যব, ঘাস ও ঋতুভিত্তিক খাবার। জন্মের পর অশ্ব শাবককে দশ দিন পর্যন্ত এক কুডুব ছাতুর সাথে এক চতুর্থাংশ ঘি মিশিয়ে খাওয়াতে হবে এবং একই সাথে দুগ্ধও পান করাতে হবে। পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত খাওয়াতে হবে এক প্রস্থ পরিমাণ যব, প্রয়োজনে এ খাবার বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। অতঃপর চার বছর পর্যন্ত প্রতিদিন এক দ্রোণ পরিমাণ যব খাওয়াতে হবে। এভাবে পালনের পর পাঁচ বছরে উন্নীত হলে অশ্ব শাবকটি ভারবাহনের উপযুক্ত হিসেবে সক্ষম হয়ে উঠবে 1

০২-৩০-০৪ উত্তম অশ্বের মুখের পরিমিতি হবে ৩২ আঙুল, এর দৈর্ঘ্য হবে ১৬০ আঙুল, জঙ্ঘা হবে ২০ আঙুল এবং উচ্চতা হবে ৭০ আঙুল। এর চেয়ে তিন আঙুল কম হলে তা হবে মধ্যমমানের অশ্ব এবং তার চেয়ে তিন আঙুল কম হলে তা হবে অধম বা নিম্ন প্রকৃতির অশ্ব। উত্তম অশ্বের বিস্তার বা বেড়’র পরিমিতি হবে ১০০ আঙুল। মধ্যম প্রকৃতির অশ্বের বেড় হবে ৮০ আঙুল এবং অধম প্রকৃতির অশ্বের বেড় হবে ৬০ আঙুল।

০২-৩০-০৫ অশ্বের প্রকৃতি অনুযায়ী খাবার নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে উত্তম অশ্বকে দুই দ্রোণ পরিমাণ আধা সেদ্ধ শালি বা আউশ ধানের চাল বা যব অথবা সম পরিমাণ মুগ বা মাষ কলাই খাওয়াতে হবে। আরও খাওয়াতে হবে এক প্রস্থ ঘি বা তেল, পাঁচ পল লবণ, ৫০ পল পরিমাণ মাংস। এ সমস্ত খাদ্য রসালো করার জন্য খাদ্যে মেশাতে হবে এক আঢ়ক মাংসের ঝোল, দুই আঢ়ক দধি, পাঁচ পল গুড়, এক প্রস্থ সুরা এবং দুই প্রস্থ দুধ। পরিশ্রমে ক্লান্ত অশ্বকে অতিরিক্ত খাবার হিসেবে আরও এক প্রস্থ তেলজাতীয় খাবার দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও নাকে ব্যবহারের জন্য অশ্বপ্রতি প্রতিদিন এক কুডুব তেল বরাদ্দ করতে হবে।

০২-৩০-০৬ উত্তম অশ্বের বরাদ্দকৃত খাবারের চেয়ে এক চতুর্থাংশ কম পাবে মধ্যমমানের অশ্ব এবং এর চেয়ে এক চতুর্থাংশ কম পাবে অধমমানের অশ্ব। এই একই পরিমাণ খাবার রথবাহী ও প্রজনন সক্ষম তিন প্রকৃতির অশ্বের জন্যও প্রযোজ্য হবে। অশ্ব খাদ্যের পাচক, পরিচারক এবং চিকিৎসকরা অশ্বখাদ্যের সাথে রাজভাণ্ডার থেকে নিজেদের ভোজন দ্রব্যেরও যোগান পাবে। যেসব অশ্ব যুদ্ধ, রথ চালনা বা ভার বহনে অক্ষম হয়ে পড়বে, রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অথর্ব হয়ে পড়বে, সেসব অশ্বকে উদরপূর্তির নিমিত্ত যতটুকু খাবারের প্রয়োজন ততটুকু ভোজন করাতে হবে। শক্তি থাকা সত্ত্বেও যেসব অশ্ব যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে সেগুলোকে জনপদের অশ্বশালায় প্রজননের কাজে ব্যবহার করতে হবে।

০২-৩০-০৭ কম্বোজ, সিন্ধু, আরট্ট এবং বনায়ু দেশের প্রশিক্ষিত অশ্বগুলোই যুদ্ধের জন্য অতি উপযুক্ত। বাহুলীক (পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মধ্যবর্তী এলাকা), পাপেয় (ধারণা করা হয় উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা), সৌবীর (সিন্ধু নদী তীরবর্তী এলাকা) এবং তিতল (উড়িষ্যার তিতল অঞ্চল) দেশের অশ্বগুলো যুদ্ধের জন্য মধ্যমমানের। অন্যান্য অঞ্চল বা দেশের অশ্বগুলো যুদ্ধের জন্য অধম প্রকৃতির বলে বিবেচ্য। উপরোক্ত অশ্বগুলোর ক্ষীপ্রতা, সাহসিকতা, তেজস্বীভাব বিচার করে যুদ্ধ, রথ, মাল পরিবহন তথা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে।

০২-৩০-০৮ অশ্বের ঔপবাহ্য (Circular movement) পাঁচ প্রকার—বল্পন বা চক্রাকার ঘূর্ণন। নীচৈর্গত বা ধীরগতির ঘূর্ণন। লঙ্ঘন বা লম্ফ প্রদান। ধোরণ বা বহুরৈখিক ধাবমানতা এবং নারোষ্ট্র বা সংকেতানুসারে ধাবিত হওয়া। এর মধ্যে আবার বল্গন ছয় প্রকার—১. ঔপবেণুক বা স্বল্প পরিসরে বৃত্তাকারে ঘোরা ২. বৰ্দ্ধমানক বা এক হাত পরিমিত বৃত্তের উপর দিয়ে ধাবিত হওয়া ৩. যমক বা এক সাথে দুধরনের গতিতে বৃত্তাকারে ঘোরা ৪. আলীঢ়পুত বা এক পা সংকুচিত করে অন্য পায়ে লাফ দিয়ে ঘোরা ৫. পূর্বর্গ বা শরীরের পূর্বভাগের ঘূর্ণন ৬. ত্রিকচালী বা শরীরের পেছনভাগ দিয়ে ঘূর্ণন। মাথা ও কান অনড় রেখে অশ্বের ঘূর্ণন গতির নাম নীচৈর্গত যা মোট ষোল ধরনের—১. প্রকীর্ণক বা বহুমাত্রিক গতি ২. প্রকীর্ণোত্তর বা মিশ্র গতির ঘূর্ণন ৩. নিষণ্ন বা পৃষ্ঠ নিশ্চল রেখে ঘূর্ণন ৪. পার্শ্বানুবৃত্ত বা একমুখী তীর্যক গতির ঘূর্ণন ৫. ঊমিমার্গ বা আনতযুক্ত গতি ৬ শরভক্রীড়িত বা শরভ পশুর মতো ক্রীড়াসুলভ গতি ৭. শরভপুত বা শরভের মতো লম্বযুক্ত গতি ৮. ত্রিতাল বা তিন পায়ে ধাবিত হওয়া ৯. বাহ্যানুবৃত্ত বা দক্ষিণ ও বাম মুখে ধাবিত হওয়া ১০. পঞ্চপাণি বা তিন পা একবার ও চতুর্থ পা দুবার পদক্ষেপ দিয়ে ছোটা ১১. সিংহায়ত বা সিংহের মতো উদ্যত ভঙ্গিতে ছোটা ১২. স্বাধৃত বা হঠাৎ দ্রুত ছোটা ১৩. ক্লিষ্ট বা লাগাম ঢিলা করার সাথে সাথে ছোটা ১৪. শিঙ্গিত বা শরীরের পেছনভাগ অবনত করে দ্রুত গতিতে ছোটা ১৫. বৃংহিত বা অগ্রভাগ উঁচু করে ছোটা ১৬. পুষ্পাভিকীর্ণ বা গোমূত্র নিঃসারণের মতো এলোমেলোভাবে ধাবিত হওয়া।

০২-৩০-০৯ অশ্বের লঙ্ঘন বা লম্ফ সাত ধরনের হতে পারে—১. কপিপুত বা বানরের মতো লম্ফন ২. ভেকপুত বা ব্যাঙের মতো লম্ফন ৩. এণপ্লুত বা হরিণের মতো লম্ফন ৪. একপাদপ্লুত বা তিন পা সঙ্কুচিত করে এক পায়ে লম্ফ ৫. কোকিলসংচারী বা কোকিলের মতো লম্ফন ৬. উরস্য বা চার পা সঙ্কুচিত করে বুক দিয়ে লম্ফন ৭. বকচারী বা ধীর গতিতে হেঁটে হঠাৎ লম্ফ দেওয়া। ধোরণ বা বিবিধ গতি তথা অশ্বরা যে আট ধরনের গতিতে ধাবিত হয়ে থাকে তা হলো—১. কাঙ্ক বা সারস পাখির মতো ছোটা ২. বারিকাঙ্ক বা হাঁসের গতিতে ছোটা ৩. মায়ূর বা ময়ূয়ের গতিতে ছোটা ৪. অর্ধমায়ূর বা ময়ূরের অর্ধগতিতে ছোটা ৫. নাকুল বা নকুলের গতিতে ছোটা ৬. অর্ধনাকুল বা নকুলের অর্ধ গতিতে ছোটা ৭. বারাহ্ বা বরাহের মতো ছোটা ৮. অর্ধবরাহ্ বা বরাহের অর্ধগতিতে ছোটা। প্রশিক্ষণলব্ধ শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে সংকেত মোতাবেক অশ্বের ধাবিত হওয়াকে বলা হয় নারোষ্ট্র।

০২-৩০-১০ রথবাহী অশ্বের ক্ষেত্রে উত্তম, মধ্যম ও অধম অশ্বের চলাচল পথের দূরত্ব নির্ধারিত হবে যথাক্রম দ্বাদশ, নয় ও ছয় যোজন পথ। একইভাবে উত্তম, মধ্যম ও অধম ভারবাহী অশ্বের পথের দূরত্ব নির্ধারিত হবে দশ, সাড়ে সাত ও পাঁচ যোজন। উক্ত তিন প্রকার অশ্বের গতি হয় তিন ধরনের—১. বিক্রম বা ধীরগতিসম্পন্ন ২. ভদ্রাশ্বাস বা মধ্যম গতিসম্পন্ন ৩. ভারবাহ্য বা ভারবাহী মানুষের মতো ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। বিভিন্ন প্রকার অশ্বের পদক্ষেপ যে পাঁচ ধরনের হয় তা হলো—১. বিক্রম বা কদমচাল ২. বল্পিত বা বৃত্তকার পদক্ষেপ ৩. উপকণ্ঠ বা লক্ষযুক্ত গতি ৪. উপজব বা প্রারম্ভে দ্রুতগতি অতঃপর ধীরগতি ৫. জব বা প্রারম্ভে ধীরগতি অতঃপর দ্রুতগতি। রথবাহী ও ভারবাহী অশ্বের মুখ, কণ্ঠ, পৃষ্ঠ প্রভৃতিতে ব্যবহার্য উপকরণের ব্যাপারে প্রশিক্ষকগণ পরামর্শ প্রদান করবেন। সারথিরা রথ ও অশ্বের ব্যবহার্য সাজসজ্জার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করবেন। অশ্বচিকিৎসকরা অশ্বের স্বাস্থ্যরক্ষা এবং ঋতুভিত্তিক খাদ্যের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করবেন।

০২-৩০-১১ সূত্রগাহক বা অশ্বের লাগাম ধারণকারী সহিস, অশ্ববন্ধক বা জিন বন্ধনকারী-অশ্বের সঙ্গে রথের সংযোগ প্রদানকারী, যাবসিক বা ঋতুভিত্তিক ঘাস সংগ্রহকারী, বিধাপাচক বা অশ্বের জন্য খাদ্য রন্ধনকারী, স্থানপাল বা আস্তাবল পরিষ্কারক, কেশকার বা অশ্বের কেশ পরিচর্যাকারী এবং জাঙ্গলিবিদ বা বিষ-বিদ্যায় অভিজ্ঞ অশ্ব চিকিৎসকগণ নিজ নিজ দায়িত্বে অশ্বের পরিচর্যা করবে। এসব কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কর্তব্যে অবহেলা করলে যেদিন দায়িত্বে অবহেলা করবে সেদিনের বেতন কর্তিত হবে। চিকিৎসার জন্য অবসরে রাখা অশ্বকে দিয়ে যদি কেউ ভারবহন করায় তাহলে তাকে দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত কারও গাফিলতির জন্য যদি অশ্বের রোগ বৃদ্ধি পায় তাহলে রোগের প্রতিরোধ কল্পে যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে, দায়ী কর্মচারীকে তার দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি অশ্বের মৃত্যু ঘটে তাহলে দায়ী কর্মচারীকে পত্রমূল্য তথা অশ্বমূল্যের অনুরূপ দণ্ড প্রদান করতে হবে। এই একই বিধান গরু, মহিষ, গর্দভ, ছাগল, উট ও মেষের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

০২-৩০-১২ গ্রীষ্ম এবং শরৎ ঋতুতে যেন অশ্বদের দিনে দুবার স্নান করানো হয়, প্রতিদিন যেন সুগন্ধি মাখানো হয়, মাল্য পরানো হয়, এ ব্যাপারগুলো অশ্বাধ্যক্ষ প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করবেন। এছাড়াও তিনি অশ্বদের সুস্বাস্থ্য কামনার্থে অমাবস্যায় ভূতবলি এবং পূর্ণিমা তিথিতে স্বস্তিবাচনের আয়োজন করবেন। আশ্বিন মাসের নবম দিনে, অসুস্থতার সময়, যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে এবং যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর অশ্বাধ্যক্ষকে অশ্বের নীরাজনা করাতে হবে।

একত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৪৮ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে হস্তি সম্পর্কীয় বিবিধ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। হস্তির প্রকৃতি, পরিচর্যা, লালন-পালন, ব্যবহার ইত্যাকার বিষয়সহ হস্তির দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসক তথা হস্ত্যধ্যক্ষের প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে দেওয়া হয়েছে আবশ্যকীয় নির্দেশনা।

০২-৩১-০১ হস্ত্যধ্যক্ষের অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো হলো—তিনি অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ও পশুর অবাধ প্রবেশ নিরোধের মাধ্যমে গজবন রক্ষা করবেন। বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের নিমিত্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতি, হস্তিনী ও শাবকদের বিশ্রাম, শয়ন ও বিচরণের হস্তিশালা নির্মাণ ও বিচরণভূমি নির্ধারণ করবেন। যুদ্ধের উপযোগী হাতিদের খাদ্যদ্রব্য ও পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। হাতিকে পোষ মানানো ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। হাতি চালনার উপকরণ, সাজ সজ্জা, অলঙ্কার ও বর্মের ব্যবস্থা করবেন। হস্তি চিকিৎসক, প্রশিক্ষক ও পরিচর্যাকারীদের করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদানসহ যাবতীয় কর্ম তত্ত্বাবধান করবেন। হস্তিশালা নির্মাণের ক্ষেত্রে হাতির দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণ হবে এর দৈর্ঘ্য, হাতির সংখ্যানুসারে এর প্রশস্ততা ও উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে। হস্তিনী ও শাবকদের বাসের জন্য পৃথক স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

০২-৩১-০২ হাতিদের মলমূত্র ত্যাগের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করতে হবে এবং বিষ্ঠা ঢেকে রাখবার জন্য কাঠের ফলক পেতে রাখতে হবে। যুদ্ধোপযোগী এবং ভার বহনকারী হাতিদের হস্তিশালা দুর্গের অভ্যন্তরে নির্মাণ করতে হবে। সদ্য শিক্ষাপ্রাপ্ত ও হিংস্র প্রকৃতির হাতিদের অবস্থান স্থান হবে দুর্গের বাহিরের অঙ্গনে। দিনকে আটভাগে বিভাজন করে প্রথম এবং সপ্তমভাগ হাতির স্নানের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। দ্বিতীয় ও অষ্টমভাগ নির্ধারিত থাকবে আহারের জন্য, দিনের পূর্বাহ্ন নির্ধারিত থাকবে কর্মাভ্যাসের জন্য এবং পানি ও গুড় জাতীয় রসালো খাবার আহারের জন্য নির্ধারিত থাকবে অপরাহ্ণ। সমগ্র রাত্রিকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করে এর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ হাতির শয়নের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে এবং শেষ ভাগ থাকবে বিশ্রাম ও উত্থানের জন্য নির্ধারিত।

০২-৩১-০৩ গ্রীষ্মকালে হাতিরা সূর্য তাপের দহনে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জলপানের জন্য জলাশয়ের দিকে ধাবিত হয়, এই দুর্বলতাজনিত কারণে ওদের পাকড়াও করাও সহজ হয়, সে কারণে গ্রীষ্মকালই হলো হাতি ধৃতের উপযুক্ত সময়। বিশ বছর বয়স্ক হাতিই হলো সর্বদিক দিয়ে গ্রহণীয়, এ কারণে এর কম বা বেশি বয়সের হাতি ধরা সমীচীন নয়। মাতৃদুগ্ধ পানকারী শাবক, হস্তিনীর সমান দাঁতবিশিষ্ট হাতি, রোগাক্রান্ত, গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী হাতি কখনোই ধরা উচিৎ নয়। যে হাতি উচ্চতায় সাত আরত্নি বা সাত হাত, দৈর্ঘ্যে নয় হাত এবং দেহের পরিধিতে দশ হাত, সে হাতি যখন ৪০ বছরে উপনীত হবে তখন সে হাতিই উত্তম বলে বিবেচিত হবে। এভাবে ত্রিশ বছর বয়সী হাতি হবে মধ্যম প্রকৃতির এবং ২৫ বছর বয়সী হাতি হবে অধম প্রকৃতির

০২-৩১-০৪ খাবার হিসেবে উত্তম হাতির জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যের এক চতুর্থাংশ কম পাবে মধ্যম হাতি এবং এই বরাদ্দেরও এক চতুর্থাংশ কম পাবে অধম হাতি। একটি উত্তম হাতির প্রতিদিনের খাবার হতে হবে একদ্রোণ চাউল, অর্ধ আঢ়ক তেল, তিন প্রস্থ ঘি, দশপল লবণ, পঞ্চাশ পল মাংস, এক আঢ়ক মাংসের ঝোল, দুই আঢ়ক দধি, দশপল ক্ষার জাতীয় খাদ্য, অপরাহ্ণে পানীয়ের জন্য এক আঢ়ক মদ্য এবং এর দ্বিগুণ দুগ্ধ। এছাড়াও শরীরে মর্দনের জন্য প্রয়োজন এক প্রস্থ তেল, মাথায় মাখাবার জন্য প্রয়োজন আটের এক প্রস্থ তেল। রাতে হস্তিশালায় প্রদীপ জ্বালানোর জন্য প্রয়োজন আটের এক প্রস্থ পরিমাণ তেল। এর পরও যোগান দিতে হবে সোয়া দুই ভার কাঁচা ঘাস এবং আড়াই ভার শুক্‌না ঘাস। এর সাথে যতক্ষণ না পরিতৃপ্ত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত হাতিকে ভোজনের জন্য কড়ঙ্গর দেওয়া যেতে পারে। এর চেয়ে অতিরিক্ত উচ্চতাবিশিষ্ট হাতির জন্য উচ্চতানুপাতে খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।

০২-৩১-০৫ ক্রীড়ার জন্য ধৃত মাতৃস্তন্যপায়ী হাতির শাবককে দুধ ও ঘাস খাইয়ে পরিপালন করতে হবে। সাত পর্যায়ে হাতির সাত ধরনের চেহারা বা শোভা প্রতিভাত হয়। জন্মের কিছুদিন পর যখন শাবকের নতুন অস্থি ও ত্বক দেখা দেয় তখন তাকে দেখায় রক্তবর্ণ, এ অবস্থাকে বলা হয় সংজাত লোহিতা। এরপর যখন মাংস স্ফীত হয়ে অস্থি ঢাকা পড়তে থাকে তখন সে অবস্থাকে বলা হয় প্রতিচ্ছন্না। দেহের দুপাশ মাংসে পূর্ণ হওয়ায় যখন তা মসৃণ দেখায় তখন সে অবস্থাকে বলা হয় সংলিপ্তপক্ষা। দেহের সর্বত্র অতিরিক্ত মাংসের সন্নিবেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সে অবস্থাকে বলা হয় সমকক্ষ্যা। দেহের কোনো অংশ উন্নত ও কোনো অংশ অবনত হয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় ব্যতিকীর্ণমাংসা। পিঠের মাংসপিণ্ড সমতল হয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি করে তাকে বলা হয় সমতল্পতলা। দুই পাশের মাংস স্ফীত হয়ে পিঠের আকার যখন নৌকার মতো হয়ে যায় তখন সে অবস্থাকে বলা হয় জাতদ্রোণিকা। এই সমস্ত পর্যায়ক্রমিক অবস্থার ভিত্তিতে উত্তম, মধ্যম ও অধম হাতিকে যুদ্ধসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

দ্বাত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৪৮ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে হাতির বিভিন্ন কার্য সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া এ পর্যায়ে হাতির প্রকারভেদ, স্বভাবগত নানা বৈশিষ্ট্য এবং কার্যকারিতার ব্যাপারও বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

০২-৩২-০১ কার্যকলাপ অনুযায়ী হাতিরা চার ভাগে বিভাজনযোগ্য। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে প্রকৃতির হাতির স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাদের বলা হয় দম্য। যে প্রকৃতির হাতি যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচ্য, তাদের বলা হয় সান্নাহ্য। যে প্রকৃতির হাতি মানুষ ও ভার বহনের উপযুক্ত, তাদের বলা হয় ঔপবাহ্য এবং যে প্রকৃতির হাতি হিংস্র প্রকৃতির তথা হন্তারক স্বভাবের, তাদের বলা হয় ব্যাল। এদের মধ্যে দম্য প্রকৃতির হাতি পাঁচ প্রকার—১. স্কন্ধগত, এই প্রকৃতির হাতি মাহুত বা সওয়ারিকে স্কন্ধে আসন প্রদানে আপত্তি করে না ২. স্তম্ভগত, এই প্রকৃতির হাতি বন্ধনাবস্থা মেনে নেয় ৩. বারিগত, এই প্রকৃতির হাতি দিয়ে অন্য হাতি ধরা হয় ৪. অবপাতগত, এই প্রকৃতির হাতি তৃণাচ্ছাদিত গর্তে নিপতিত হয় ৫. যূথগত, এই প্রকৃতির হাতি দলবদ্ধভাবে বসবাসে অভ্যস্থ।

এই প্রকৃতির দম্য হাতিদের শিশুদের মতো করে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে এবং দুধ, কাঁচা ঘাস, ইক্ষু, কাণ্ড ইত্যাকার খাবার দিয়ে পরিচর্যা করাতে হবে।

যুদ্ধের জন্য সান্নাহ্য প্রকৃতির হাতিদের সাত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে—১. উপস্থান তথা দেহ উঁচু নিচু করে বা দেহ ঝুঁকিয়ে প্রাচীর ভাঙা, প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ২. সংবর্তন তথা ভূমিতে শয়ন, উপবেশন ও খানাখন্দ অতিক্রম করার প্রশিক্ষণ ৩. সংযান তথা ঋজু, বাঁকা, গো-মূত্রিকা ও বৃত্তাকারে চলাচল বিষয়ক প্রশিক্ষণ ৪. বধাবধ তথা শুঁড়, দাঁত, পা এবং শরীর দিয়ে মানুষ ও পশু হত্যার কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণ ৫. হস্তিযুদ্ধ তথা অন্য হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করার কলা কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণ ৬. নাগরায়ন তথা নগরের প্রাচীর, তোরণ, প্রাসাদ ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ৭. সাংগ্রামিক তথা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ করবার সমর প্রশিক্ষণ।

০২-৩২-০২ ঔপবাহ্য তথা মানুষ ও ভারবাহী হাতি আট প্রকার—১. আচরণ প্রকৃতির হাতি শরীরের অগ্রভাগ ও পেছনের ভাগ উঁচু-নিচু, অবনত করতে পারে ২. কুঞ্জরৌপবাহ্য প্রকৃতির হাতি অন্য হাতিদের সঙ্গে থেকে মানুষ বহনে অভ্যস্ত ৩. ধোরণ প্রকৃতির হাতি একদিক দিয়ে চলতে অভ্যস্ত ৪. আধানগতিক প্রকৃতির হাতি দু তিন প্রকার গতিতে চলতে পারে ৫. যষ্ট্যুপবাহা প্রকৃতির হাতি দণ্ডের ইশারায় চলতে পারে ৬. তোত্রোপবাহ্য প্রকৃতির হাতি অঙ্কুশের আঘাতে চলে ৭. শুদ্ধোপবাহ্য প্রকৃতির হাতি মাহুতের পদাঘাতে চলতে পারে ৮. মার্গয়ুক প্রকৃতির হাতি শিকার ধরতে পারে। এ ধরনের হাতি অতিকৃশ হলে স্কুল করতে হবে, বেশি স্থুল হলে স্বাস্থ্যসম্মত আকৃতির করতে হবে, ক্ষুধাহীন হলে এদের ক্ষুধার রুচি ফেরাতে হবে। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হলে এদের সুস্থ করে তুলতে হবে, প্রশিক্ষণ গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে প্রশিক্ষণের জন্য প্ররোচিত করতে হবে এবং এদেরকে সংকেত বা ইশারা অনুযায়ী কাজ করবার তরিকা শেখাতে হবে।

০২-৩২-০৩ ব্যাল তথা হিংস্র প্রকৃতির হাতির স্বভাব হলো, উৎপীড়ন করা এ জাতীয় হাতি স্বভাবগতভাবে শিক্ষাগ্রহণে অনিচ্ছুক হয়, অদক্ষতার কারণে উপেক্ষিত হয়, স্বেচ্ছাচারী প্রকৃতির হয়, মদদোষে দুষ্ট হয়, আহার দোষে দুষ্ট হয় এবং এরা সর্বদা মদমত্ত অবস্থায় থাকে। এ জাতীয় হাতিকে শৃঙ্খলিত করে বা দণ্ডাঘাতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। হিংস্র প্রকৃতির হাতি সর্বদোষে দুষ্ট। এরা প্রশিক্ষণ এবং যে কোনো কাজের অনুপযুক্ত। এ শ্রেণির হাতির মধ্যে যারা ঘাতক প্রকৃতির, গজশাস্ত্র অনুযায়ী তাদের ১৮ ধরনের দোষ থাকে। যেসব হাতি কাউকে পিঠে বসতে না দিয়ে একাকী চলতে থাকে, গজশাস্ত্র অনুযায়ী সেসব হাতির ১৫ ধরনের দোষ থাকে। যেসব হাতি পিঠের সওয়ারিকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে, গজশাস্ত্র অনুযায়ী তাদের ৩৩ প্রকার দোষ থাকে।

০২-৩২-০৪ হাতিদের বন্ধন কৌশল ও এর উপকরণ সম্পর্কে হস্তি প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে পরিজ্ঞাত হতে হবে। হাতির বন্ধন স্তম্ভ হলো—গ্রীবা বন্ধনের শেকল, বক্ষবন্ধনের রজ্জু, হাতির পিঠে আরোহণের দড়ির সিঁড়ি, হাতির পা বাঁধার শেকল এবং গলা বাঁধার দড়ি। হাতির উপকরণগুলো হলো—অঙ্কুশ, বাঁশ, দাঁত কাটার অস্ত্র ইত্যাদি। হাতির ভূষণ হলো—শরীরের উপর সজ্জিত পতাকা, গলায় পরাবার মালা, পিঠে বিছানোর আস্তরণ। যোদ্ধা হাতির উপকরণ হলো—শরীরের বর্ম, তোমর, শরাবাপ এবং অন্যান্য অস্ত্র।

০২-৩২-০৫ হাতির ঔপস্থায়িকবর্গ বা পরিচর্যাকারীরা হলো—গজবৈদ্য বা চিকিৎসক। অনীকস্থ বা প্রশিক্ষক। আরোহক বা হস্তিশাস্ত্রজ্ঞ আরোহী। আধোরণ বা হাতি সম্পর্কিত জ্ঞাত ব্যক্তি। হস্তিপক বা মাহুত। ঔপচারিক বা অলঙ্কারিক কাজে ন্যাস্ত ব্যক্তি। বিধাবাচক বা হাতির খাবার প্রস্তুতকারক। যাবসিক বা হাতিকে ঘাস প্রদানকারী। পাদ-পাশিক বা হাতির পা বন্ধনকারী। কুটীরক্ষক বা হস্তিশালার পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ঔপশায়িক বা হাতির রাত্রিকালীন সেবক। এ সমস্ত সেবকরা হাতির খাবারের সঙ্গে নিজেদের আহার্যও রাজভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করবে।

০২-৩২-০৬ দীর্ঘপথে যাত্রার সময়, রোগ-ব্যাধির সময়, মানুষ বা মালামাল পরিবহনের সময় এবং বৃদ্ধাবস্থায় হাতির পরিচর্যার জন্য গজ চিকিৎসকরা দায়িত্বে নিযুক্ত থাকবেন। হাতির অবস্থানস্থল অপরিচ্ছন্ন করে রাখলে, নির্ধারিত ভোজনদ্রব্য সময়মতো সরবরাহ না করলে, কঠিন ভূমিতে শয়ন করালে, বেত বা অঙ্কুশ দিয়ে শরীরে আঘাত করলে, অনুপযুক্ত লোককে পিঠে আরোহণ করালে, অসময়ে কাজ করালে, অনুপযুক্ত পথে চালনা করালে, ঘাটহীন জলাশয়ে অবতরণ করালে এবং ঘনবৃক্ষের বনে চালনা করালে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি তথা জরিমানা ভোগ করতে হবে।

০২-৩২-০৭ হাতির বলবৃদ্ধি এবং প্রশান্তির নিমিত্ত আষাঢ়, কার্তিক এবং ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাতে তিনবার নীরাজনা করতে হবে। অমাবশ্যার সময় ভূতবলি এবং কার্তিকে পূজা করতে হবে। নদীচর হাতির দাঁত আড়াই বছর পর এবং পর্বতচর হাতির দাঁত পাঁচ বছর পরপর কেটে দিতে হবে।

ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৪৯-৫০-৫১ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে রথের প্রশাসক তথা রথাধ্যক্ষ, যুদ্ধের অধিনায়ক তথা পত্ত্যধ্যক্ষ এবং সেনাপতিদের সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং তাদের অত্যাবশ্যকীয় করণীয় সম্পর্কেও দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।

০২-৩৩-০১ ইতোপূর্বে আলোচিত অশ্বাধ্যক্ষের ক্ষেত্রে নির্দেশিত করণীয়সমূহ রথাধ্যক্ষের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে। রথাধ্যক্ষ নতুন রথ নির্মাণ এবং পুরাতন রথ মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় কারখানা নির্মাণ করাবেন। পাঁচ হাত উচ্চতা এবং ছয় হাত বিস্তারবিশিষ্ট রথই হলো উত্তম প্রকৃতির রথ। রথসমূহের উচ্চতা এবং বিস্তারের কমবেশি হতে পারে, সে নিরিখে উত্তমরথসহ রথের প্রকারভেদ হতে পারে সাত ধরনের।

০২-৩৩-০২ উপযোগীতার ভিন্নতা অনুযায়ী নিম্নোক্ত প্রকৃতির নানা ধরনের রথ হতে পারে—১. উৎসব পার্বণে যে রথের উপর দেব-প্রতিমা স্থাপন করে সঞ্চার করা হয় তা হলো দেবরথ ২. বিয়ে ও মাঙ্গলিক কাজে ব্যবহার্য রথ হলো পুষ্যরথ ৩. যুদ্ধের জন্য ব্যবহার্য যুদ্ধোপকরণসজ্জিত রথকে বলা হয় সাংগ্ৰামিক রথ ৪. ভ্রমণ-বিনোদনের জন্য ব্যবহার্য রথকে বলা হয় পারিযাণিক ৫. শত্রুর দুর্গ ধ্বংসের কাজে ব্যবহার্য রথকে বলা হয় পরপুরাভিযানিক ৬. অশ্বকে রথ চালনার কাজে প্রশিক্ষণ প্রদানার্থে ব্যবহার্য রথকে বলা হয় বৈনয়িকযোগ্য। রথাধ্যক্ষ রথে ব্যবহার্য বাণ, অস্ত্র, তোমরাদি, আবরণ ও উপকরণ নির্মাণের আয়োজন বা ব্যবস্থা করবেন এবং রথচালক, রথ ব্যবহারকারী ও রথ বহনকারী অশ্বের সক্ষমতা ও দক্ষতার ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে পরিজ্ঞাত থাকবেন। তিনি এ সংক্রান্ত কর্মে নিযুক্ত বিভিন্ন ধরনের বেতনভোগী কর্মকুশীলব ও অতিথি কারিগরদের কাজের বিস্তারিত বিবরণী নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।

০৩-৩৩-০৩ পদাতিক সৈনিকদের অধীক্ষক তথা পত্ত্যধ্যক্ষও রথাধ্যক্ষের অনুরূপ দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি রাজধানীতে পদায়িত সেনাবাহিনী, মিত্র রাজ্যের সেনাবাহিনী, শত্রু রাজ্যের সেনাবাহিনী এবং বন রক্ষায় নিযুক্ত সেনাবাহিনীর সকল প্রকার সক্ষমতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবেন। এছাড়াও পত্ত্যধ্যক্ষ গর্তযুক্ত ভূমি, তৃণযুক্ত জলাশয়, সমতলভূমি, মুখোমুখি লড়াই, কৌশলগত যুদ্ধ, পরিখার যুদ্ধের কৌশল, আকাশযুদ্ধ তথা উচ্চস্থান থেকে আক্রমণের কৌশল, দিন ও রাত্রিকালীন যুদ্ধের কলা-কৌশলের বিষয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ বা শিক্ষালাভ করবেন এবং নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈনিক নিয়োগের ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে পরিজ্ঞাত থাকবেন।

০২-৩৩-০৪ সেনাপতি হলেন হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক তথা চতুরঙ্গ সৈন্যের এবং পূর্বোক্ত আলোচিত মৌলবল, ভূতবল সৈন্যদের সেনানায়ক। সেনানায়ককে সকলপ্রকার যুদ্ধ কৌশল ও যুদ্ধে ব্যবহার্য অস্ত্রের ব্যাপারে প্রশিক্ষিত হতে হবে। এছাড়াও তাকে হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক তথা চতুরঙ্গ সৈন্য পরিচালনায় পারদর্শী হতে হবে। নিজ দেশের সৈন্যদের সম্পর্কে, যুদ্ধের উপযুক্ত সময় সম্পর্কে এবং শত্রুপক্ষের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে সেনানায়কের যথার্থ ধারণা থাকতে হবে। এছাড়াও শত্রু শিবিরে বিভাজন সৃষ্টিতে, নিজ সৈন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাদের একত্রীকরণে, বিচ্ছিন্নকৃত শত্রু সৈন্যদের হত্যাকরণে এবং শত্রুর দুর্গ ধ্বংস করার ব্যাপারে সেনানায়ককে বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তিনি আক্রমণের কৌশল, আক্রমণের সময়, অস্ত্রের ব্যবহার এবং যুদ্ধসম্পৃক্ত বাদ্য, ধ্বনি, পতাকা ও সংকেত সম্পর্কিত বিষয়ে সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন।

চতুম্ব্রিংশ অধ্যায় ॥ ৫২-৫৩ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে দেশ থেকে বিদেশে গমনকারী ও বিদেশ থেকে দেশে আগমনকারীদের অনুমতিদানকারী প্রশাসক তথা মুদ্রাধ্যক্ষ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত অনুমোদিত অনুমতিপত্র যা মুদ্রা হিসেবে পরিচিত, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে (এই বিভাগটি মূলত আজকের দিনের ইমিগ্রেশন বিভাগের অনুরূপ)। অতঃপর এ অধ্যায়ে পশুদের চারণভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। চারণভূমির প্রশাসক হলেন বিবীতাধ্যক্ষ। তিনি রাজত্বের সকল তৃণভূমি তথা পশুচারণ ভূমির অধীক্ষক। এ পর্যায়ে তার করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-৩৪-০১ মুদ্রাধ্যক্ষ বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির শুদ্ধতা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে এক মাষক গ্রহণ সাপেক্ষে মুদ্রা (মোহরযুক্ত অনুমতিপত্র) প্রদানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করবেন। একইভাবে এক মাষক গ্ৰহণ সাপেক্ষে কোনো স্বদেশিকে বিদেশে যাবার অনুমতি প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে কোনো বিদেশি নিয়মের ব্যত্যয় করে অনুমতি গ্রহণ ব্যতিরেকে দেশে প্রবেশ করলে তাকে ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং স্বদেশি কেউ জাল অনুমতিপত্র প্রদর্শন করলে প্রথম সাহসদণ্ড তথা ২৫০ পণ এবং বিদেশি কেউ এ ধরনের প্রতারণা করলে তার বিরুদ্ধে উত্তম সাহসদণ্ড তথা ১০০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে।

০২-৩৫-০২ বিবীতাধ্যক্ষ চোর ও শত্রুর গুপ্তচর চলাচলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তৃণভূমির জন্য স্থান নির্বাচন করবেন এবং রাজানুমতি পরীক্ষা করে উক্ত পথে ব্যক্তির চলাচল তদারকি করবেন। চারণভূমির নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি ও অরণ্যাঞ্চল যেন চোর, হাতি ও হিংস্র শ্বাপদের উৎপাত থেকে মুক্ত থাকে সে ব্যাপারেও তিনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি দেশের জলহীন এলাকার তৃণভূমিতে কৃপ খনন করাবেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণ করাবেন এবং ফুল ও ফলের বাগান সৃজন করাবেন। শত্রুর প্রবেশ নিরোধকল্পে শিকারি ও চণ্ডালদের দিয়ে এলাকা পরিভ্রমণ করাবেন। চারণভূমিতে চোর ও শত্রুর উপস্থিতি পরিদৃষ্ট হলে শিকারি ও চণ্ডালরা গোপনে গাছের শিখরে বসে বা আড়ালে থেকে শঙ্খ ও দুন্দুভি ধ্বনি তথা সংকেতের মাধ্যমে অন্তঃপালকে অবহিত করবে। রাজার শত্রুরা যদি শিকারের নিমিত্ত বনাঞ্চলে প্রবেশ করে, তাহলে বন প্রশাসকগণ প্রশিক্ষিত পায়রার মাধ্যমে রাজার কাছে সতর্ক সংবাদ প্রেরণ করবেন। এছাড়াও দিনেরবেলা হলে ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং রাতেবেলা হলে অগ্নিসংকেতের মাধ্যমে রাজার কাছে এ ধরনের শত্রুর উপস্থিতির ব্যাপারে বার্তা প্রেরণ করবেন। বিবীতাধ্যক্ষরা কুপ্যাধ্যক্ষ এবং হস্ত্যধ্যক্ষের সহযোগিতায় মূল্যবান দ্রব্য উৎপাদনের দ্রব্যবনে এবং হাতি পালনের হস্তিবনে ঘাস উৎপন্নের ব্যবস্থা করবেন। তারা চলাচলের জন্য পথকর, চোরের উৎপাত থেকে রক্ষাকল্পে চোরকর, গবাদিপশু রক্ষার জন্য গোরক্ষ্যকর এবং সার্থাতিবাহ্য তথা বণিকদের যাত্রাপথ সুরক্ষিতকরণের জন্য কর আদায় করবেন।

পঞ্চত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৫৪-৫৫ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে নগর, জনপদ, খনি, বন ইত্যাকার উৎস হতে আহরিত আয় একত্রকারী প্রশাসক তথা সমাহর্তার দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সমাহর্তা হলেন উচ্চপর্যায়ের উত্তম প্রকৃতির অমাত্য। তিনি বিভিন্ন খাত হতে রাজ্যের যে আয় আহরিত হবে, তা সমন্বিতকরণের দায়িত্ব পালন করবেন। আয় খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিভাগের অধীক্ষক তথা প্রশাসকরা মুখ্যত সমাহর্তার নিয়ন্ত্রাণাধীনেই কর্তব্য পালন করবেন।

০২-৩৫-০১ সমাহর্তা জনসংখ্যার অনুপাতে সমগ্র জনপদকে চার ভাগে বিভাজন করবেন। এভাবে বিভাজনের পর গ্রামগুলোকে উত্তম, মধ্যম ও কনিষ্ঠ হিসেবে উপ-বিভাগে বিভক্ত করবেন। অতঃপর কোন গ্রামে কতজন লোক বসবাস করে, কোন গ্রামের লোকেরা কি পরিমাণ কর-রেয়াতি সুবিধা ভোগ করে, কোন গ্রাম থেকে রাজা বছরে কতজন সৈনিকের যোগান পেয়ে থাকেন, কোন গ্রাম কর হিসেবে কি পরিমাণ নগদ অর্থ প্রদান করে, কোন গ্রাম কর হিসেবে কি পরিমাণ ধান প্রদান করে, কোন গ্রাম কর হিসেবে কি পরিমাণ গবাদিপশু প্রদান করে, কোন গ্রাম কর হিসেবে কি পরিমাণ স্বর্ণ প্রদান করে, কোন গ্রাম কর হিসেবে কি পরিমাণ বনজ সম্পদ প্রদান করে, কোন গ্রামের লোকেরা কর হিসেবে কি পরিমাণ শ্রম প্রদান করে থাকে, ইত্যাকার বিষয়সমূহ সমাহর্তা নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। সমাহর্তার নিযুক্ত গ্রাম কর্মকর্তা তথা গোপ পদবিধারী রাজকর্মচারীরা উত্তম গ্রামকে পাঁচভাগে, মধ্যম গ্রামকে ছয়-সাতভাগে এবং কনিষ্ঠ গ্রামকে দশভাগে অঞ্চল হিসেবে বিভাজন করে দায়িত্ব পালন করবেন।

০২-৩৫-০২ গোপগণ প্রতিটি গ্রামের নদী, পাহাড়, সমতল ভূমির অবস্থান ও সীমানার বিস্তারিত বিবরণী নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করবেন। এছাড়াও গ্রামস্থ ভূমির ক্ষেত্রে—কোন ভূমি কর্ষণযোগ্য, ধান বা শস্য উৎপাদনের উপযোগী কোন ভূমি কৃষি কাজের অনুপযোগী। কোন ভূমি উঁচু ও শুষ্ক প্রকৃতির। কোন ভূমি শালিধান তথা উৎকৃষ্ট ধান উৎপাদনের উপযোগী। কোন ভূমি বন বা বাগিচার উপযোগী। কোন ভূমি কলা উৎপাদনের উপযোগী। কোন ভূমি ইক্ষু উৎপাদনের উপযোগী। কোন ভূমি কাঠ উৎপাদনের উপযোগী। ইত্যাকার বিবরণসহ গ্রামের বাস্তভূমি, বৌদ্ধবিহার, দেব মন্দির, জলাশয়, শ্বশানভূমি, অন্নদানশালা, পানীয়শালা, তীর্থস্থান, গোচারণভূমি, রথ-শকট-মানুষের যাতায়াত পথের বিস্তারিত তথ্য নিবন্ধন পুস্তকে লিপিবদ্ধ করবেন। এসব তথ্য উপাত্ত সহকারে গোপগণ গ্রামের নদী, পাহাড় ও চারিদিকের সীমানা নির্ধারণ, অরণ্য, গ্রামে প্রবেশ ও নির্গমন পথ, গ্রামীণ জনগণের ব্যক্তিগত ভূমির পরিমাণ, সম্প্রদানকৃত ভূমির বিবরণী, কৃষকদের প্রদত্ত ঋণ, প্রদত্ত কর রেয়াতির হিসেব, কর প্রদানকারী এবং কর খেলাফির বিষয়ে নিবন্ধণ পুস্তকে বিস্তারিত লিখে রাখবেন।

০২-৩৫-০৫ গ্রামের গৃহগুলোতে কত সংখ্যক ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রজন বসবাস করে থাকে, এদের মধ্যে কত সংখ্যক কৃষক, গোপালক, গোয়ালা, ব্যবসায়ী, কারুশিল্পী-কারিগর, দাস-দাসী, কর্মকর বা শ্রমিক, সাধারণ মানুষ বসবাস করে, কত সংখ্যক পশু-প্রাণী বাস করে এবং সে স্থান থেকে কত পরিমাণ শুল্ক ও জরিমানা আদায় হয়ে থাকে, গোপগণ সেসবের বিস্তারিত বিবরণী লিখে রাখবেন। এছাড়াও তারা গ্রামস্থ পরিবারগুলোতে বসবাসরত স্ত্রী, পুরুষ, বালক ও বৃদ্ধের সংখ্যা, তাদের পেশা, আচার-আচরণ-স্বভাব, কুটুম্ব অপ্যায়ন খাতের ব্যয়ের খতিয়ান লিখে রাখবেন। গোপের অধীনস্থ স্থানীক তথা রাজকর্মচারীরা সার্বিকভাবে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে কর আদায় করবেন এবং অপরাধের মানদণ্ডে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান করবেন।

০২-৩৫-০৪ সমাহর্তা কর্তৃক নিযুক্ত গুপ্তচররা গৃহস্থের ছদ্মবেশে যে গ্রামে পদায়িত হবে, সে গ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে। তারা সে গ্রামস্থ গৃহস্থের সংখ্যা, পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং ভূমির আয়তন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে। কোন ভূমিতে কি ধরনের কি পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হয়, কোন পরিবার হতে কি পরিমাণ কর আদায় হয়, কারা কি পরিমাণ কর রেয়াতি সুবিধা ভোগ করে, কোন কোন পরিবারে কি কি বর্ণের লোক বাস করে, কারা কোন পেশার সাথে যুক্ত, পরিবারগুলোর আয় ও ব্যয় কত, কোন পরিবার কতগুলো গবাদিপশুর অধিকারী, ইত্যাকার যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে গুপ্তচররা তথ্য সংগ্রহ করবে। এছাড়াও কোন পরিবারের কোন সদস্য বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র কোথায় কত দিন অবস্থান করেছে, কি কারণে অন্যত্র অবস্থান করেছে, কার বাড়িতে কে কতদিন অতিথি হিসেবে অবস্থান করেছে, কি কারণে অতিথি হয়েছে ইত্যাদি বিষয়েও গুপ্তচররা তথ্য সংগ্রহ করবে। গ্রামের কারা অন্যত্র বসতি স্থাপনের জন্য চলে গেছে, অন্যস্থান হতে এসে কারা গ্রামে বসতি স্থাপন করেছে, এসব বিষয়সহ বিদেশি গুপ্তচরদের অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়েও গুপ্তচরেরা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে।

০২-৩৫-০৫ গৃহস্থের ছদ্মবেশধারী গুপ্তচরদের মতো বণিকবেশী গুপ্তচররা স্বদেশে উৎপাদিত পণ্য, খনি হতে আহরিত খনিজ দ্রব্য, নদী-সাগর জলাশয়ে উৎপাদিত জলজ সম্পদ, বনে উৎপাদিত বনজ সম্পদ, কারখানায় উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যাদি, নানাবিধ কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ এবং বাজারদর সম্পর্কে খোঁজখবর রাখবেন। এছাড়াও তারা যেসব পণ্যদ্রব্য জলপথে ও স্থলপথে আমদানি হবে তার প্রকৃতি ও পরিমাণ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে আমদানিবাবদ অন্তঃপালকে প্রদত্ত বর্তনীকর, বিবীতাধ্যক্ষকে প্রদত্ত আতিবাহিক কর, নিরাপত্তার জন্য প্রদত্ত গুল্মদেয় কর, প্রদত্ত জল-কর এবং নিযুক্ত কর্মীদের প্রদত্ত বেতন ও পরিশোধিত গুদাম ভাড়ার পরিমাণের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে।

০২-৩৫-০৬ একই পদ্ধতিতে সমাহর্তা কর্তৃক নিযুক্ত তাপসব্যঞ্জন তথা সন্ন্যাসীর বেশধারী গুপ্তচররা কৃষিক্ষেত্র, গো-রক্ষা ক্ষেত্র, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের অধীক্ষক তথা প্রশাসক এবং গ্রাম প্রশাসনে নিযুক্ত গোপদের দায়িত্ব পালনের সততা ও অসততার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করবে। এসমস্ত গুপ্তচরের অধীনস্থ গুপ্তচররা (শিষ্যরা) দাগি চোরের বেশধারণ করে বৌদ্ধবিহার, দেবতালয়, মন্দির, তীর্থস্থান, শূন্যস্থান, জলাশয়, নদী এলাকা, আশ্রম, অরণ্য, পাহাড়, জঙ্গল ইত্যাকার স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে চোর, শত্রু ও শত্রু দেশীয় অমিত্র ও প্রবীর নামক গুপ্তচরদের অবস্থান ও গমনাগমন পর্যবেক্ষণ করবে।

০২-৩৫-০৭ এসব পদ্ধতি ও উদ্যোগের মাধ্যমে সমাহর্তা রাজ্য ও জনপদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এসব গুপ্তচর যাতে সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করে যেজন্য তাদের গুপ্তচরবৃত্তি পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনে স্বতন্ত্র গুপ্তচর বাহিনী নিয়োগ করতে হবে। রাজকর্মচারীর ছদ্মবেশধারী কোনো গুপ্তচর যাতে রাজার অর্থ আত্মসাৎ করতে না পারে, প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে না পারে, সে বিষয়ে প্রতিগুপ্তচরেরা সদা সচেষ্ট থেকে সমাহর্তাকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবে এবং প্রয়োজনে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করবে।

ষট্‌ত্রিংশ অধ্যায় ॥ ৫৬ প্রকরণ ॥

এ অধ্যায়ে নগর প্রশাসন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নগরের অধীক্ষক বা নগর প্রশাসক হলেন নাগরিক। তিনি নগর জীবনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে যেমন দায়িত্ববান, তেমনি নগরের বাসিন্দাদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্যও দায়বদ্ধ। এ পর্যায়ে নাগরিকের করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০২-৩৬-০১ সমাহর্তা যেমন জনপদের জন্য প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন, তেমনি নগরবাসীর জন্য দায়িত্ব পালন করবেন নাগরিক। সমাহর্তা যেমন গোপদের মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করেন, তেমনি নাগরিকও গোপদের মাধ্যমে নগর প্রশাসনের কার্য পরিচালনা করবেন। নাগরিকের অধীনস্থ গোপগণ নগরে বসবাসকারীদের উত্তম, মধ্যম ও অধম শ্রেণিভুক্ত করে যথাক্রমে দশ, বিশ ও চল্লিশ পরিবারের গুচ্ছবদ্ধতার ভিত্তিতে তাদের পুরুষ, স্ত্রী, গোত্র, পেশা, সংখ্যা ও আয় ব্যয়ের বিষয়ে পরিজ্ঞাত হয়ে নিবন্ধন পুস্তকে বিস্তারিত তথ্য লিখে রাখবেন।

০২-৩৬-০২ ধর্মশালার অধিকারীকগণ বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ অন্যান্য পথিকদের সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবহিত হয়ে গোপ ও স্থানীকদের জানিয়ে তাদের ধর্মশালায় অবস্থানের অনুমতি প্রদান করবে। এক্ষেত্রে তপস্বী ও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণগণকে বিশ্বস্ত বলে প্রতীয়মান হলে, অধিকারীকগণ নিজ দায়িত্বে তাদের ধর্মশালায় অবস্থানের অনুমতি প্রদান করতে পারবে। স্থূলকাজের কারিগর এবং সুক্ষ্মকাজের কারিগরগণ নিজ নিজ কর্মস্থলে নিজেদের বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজনকে বসবাসের অনুমতি প্রদান করতে পারবে। বণিকরাও নিজেদের ব্যবসা কেন্দ্রে বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজনকে বাস করার অনুমতি প্রদান করতে পারবে। যে সব ব্যবসায়ী আগন্তুক হিসেবে অনির্ধারিত স্থানে অনির্দিষ্ট সময়ে পণ্য বিক্রয় করে থাকে, তারা কোনো বাণিজ্য কেন্দ্রে বণিকদের সঙ্গে বাস করতে ইচ্ছুক হলে, সেক্ষেত্রে গোপ ও স্থানীকের অনুমতি গ্রহণ আবশ্যক হবে। সুরা বিক্রেতা, রন্ধনকৃত মাংস বিক্রেতা, অন্ন বিক্রেতা এবং গণিকারা তাদের পরিচিত ব্যক্তিদের নিজেদের ব্যবসা কেন্দ্রে অবস্থানের অনুমতি প্রদান করতে পারবে। অতিমাত্রায় ব্যয়কারী ও সুরাপানকারীদের কোথাও অবস্থানের ক্ষেত্রে গোপ ও স্থানীকদের পূর্বানুমতি গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

০২-৩৬০৩ কোনো অপরাধী ক্ষত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলে, চিকিৎসক তার নাম পরিচয় গোপ ও স্থানীককে জ্ঞাত করবেন, অন্যথায় তিনি অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন। যে গৃহে এ ধরনের অপকর্ম করার চেষ্টা করা হবে, সে গৃহস্বামীও গোপ ও স্থানীককে এ বিষয়ে অবহিত করে দায়মুক্ত হবেন, অন্যথায় তিনিও অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন। কোনো গৃহ থেকে কেউ বিদেশে সফরে গেলে বা বিদেশ থেকে আগত কোনো সফরকারী কারও গৃহে অবস্থান করলে উভয়ক্ষেত্রে গৃহস্বামী কর্তৃক এ বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য গোপ ও স্থানীককে অবহিত করতে হবে, অন্যথায় গৃহস্বামী রাত্রিদোষে দুষ্ট হবেন অর্থাৎ ঐ রাতে কোনো চৌর্যবৃত্তি সংঘটিত হলে গৃহস্বামীকে সে দায় বহন করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি কোনো চুরির ঘটনা নাও ঘটে তথাপিও গৃহস্বামীকে তিন পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০২-৩৬-০৪ পথিক তথা রাজমার্গে যাতায়াতকারী বণিকের ছদ্মবেশধারী গুপ্তচররা এবং উৎপথিক তথা গোচারণ ক্ষেত্রের পথে কাঠ ও তৃণ বহনকারী গোপালকের ছদ্মবেশধারী গুপ্তচররা নগরের বহিরাঙ্গন এবং অভ্যন্তরস্থ দেবগৃহ, পুণ্যস্থান, বন ও শ্মশানে কোনো আঘাতপ্রাপ্ত বিক্ষত ব্যক্তির দেখা পেলে, চৌর্যবৃত্তির কাজে ব্যবহার্য অস্ত্রসমেত কোনো ব্যক্তির দেখা পেলে, সামর্থের অতিরিক্ত ভার বহনকারী কোনো ব্যক্তির দেখা পেলে, ভীত বা উদ্বিগ্ন কোনো ব্যক্তির দেখা পেলে, রাত্রি জাগরণজনিত কারণে দিবসে তন্দ্রাচ্ছন্ন কারও দেখা পেলে এবং দীর্ঘপথ অতিক্রম হেতু পরিশ্রান্ত কোনো ব্যক্তির দেখা পেলে তাকে গ্রেফতার করে নগরকর্তার কাছে সোপর্দ করবে। একইভাবে গুপ্তচররা নগরের অভ্যন্তরে শূন্যবাড়িতে, শিল্পশালায়, মদের দোকানে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, রন্ধনকৃত মাংসের দোকানে, জুয়ার আড্ডায়, বৌদ্ধ-জৈনদের আবাসস্থলে উক্ত ধরনের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের উপস্থিতির ব্যাপারে অনুসন্ধান করবে এবং সন্ধান পাওয়া মাত্র তাদের গ্রেফতার করে নগরকর্তার সমীপে সোপর্দ করবে।

নগরের সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ড পরিহারের নিমিত্ত গ্রীষ্ম ঋতুতে দিনের মধ্যম ও চতুর্ভাগে নগরে অগ্নি প্রজ্জ্বলন নিষিদ্ধ করতে হবে। এর অন্যথা পরিদৃষ্ট হলে নগরকর্তা বিধি ভঙ্গকারীর কাছ থেকে অগ্নিদণ্ড হিসেবে আটের এক পণ জরিমানা আদায় করবেন। এক্ষেত্রে রন্ধনের জন্য আগুন জ্বালানোর প্রয়োজন হলে গৃহের বাহিরে নিরাপদ স্থানে আগুন বা চুলা জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

০২-৩৬-০৫ গ্রীষ্মকালে কোনো গৃহস্থ যদি অগ্নিনির্বাপনের কাজে ব্যবহারের নিমিত্ত বসতবাটিতে পাঁচটি জলকুম্ভ তথা জলপূর্ণ বড় ঘড়া সংরক্ষণ না করে, দ্রোণী তথা দারুময় জলাধার না রাখে, উঁচু স্থানে ওঠার সিঁড়ি না রাখে, কাঠ কাটার কুঠার না রাখে, ধোঁয়ার বিস্তৃতি নিবারণের জন্য কুলা না রাখে, অগ্নিকাণ্ডকালে তৃণ অপসারণের আশিযুক্ত দীর্ঘদণ্ড না রাখে, দৃতি বা চামড়ার তৈরি পানি বহনের মশক না রাখে, তাহলে সে গৃহস্থকে চারের এক শতাংশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা রোধকল্পে গ্রীষ্মকালে খড় ও চাটাইয়ে নির্মিত ঘর-বাড়ি নগর হতে অপসারণ করতে হবে। কামার ও স্বর্ণকারের মতো যে সব পেশাজীবী অগ্নি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবিকার্জন করে থাকে, তাদের একটি নিরাপদ স্থানে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গৃহে আগুন লাগলে গৃহস্বামীরা যাতে ত্বরিতগতিতে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারে, সেজন্য তাদের রাত্রিকালে গৃহের সম্মুখভাগে শয়ন করতে হবে। রাত্রে তারা অন্যত্রঘোরা ফেরা করবে না। অগ্নিনির্বাপনের প্রয়োজনে নগরের সড়কে, সড়কের মোড়ে হাজার হাজার কুট্টব্রজ তথা জলপূর্ণ পাত্র সংরক্ষণ করতে হবে। রাজার সমস্ত স্থাপনায় তথা নগরদ্বারে, কোষগৃহে, কুপ্যগৃহে, কোষ্ঠাগারে, পণ্যগৃহে, অস্ত্রাগারে, হস্তিশালায় এবং অশ্বশালাতেও অনুরূপ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

০২-৩৬-০৬ কারও বাড়িতে অগ্নির প্রজ্বলন দেখেও যদি কোনো ব্যক্তি অগ্নিনির্বাপনের জন্য সেদিকে ধাবিত না হয়, তাহলে তাকে দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো ভাড়াটিয়া যদি বাড়িতে আগুন লাগার পর তা নেভানোর জন্য সহযোগিতা না করে, তাহলে তাকে জরিমানা বাবদ ছয় পণ গৃহস্বামীকে প্রদান করতে হবে। নিজের অসাবধানতা হেতু কোনো গৃহস্বামীর বাড়ি যদি পুড়ে যায়, তাহলে সে গৃহস্বামীকে ৫৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি কারও বাড়ি বা সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ করার পর তাৎক্ষণিকভাবে ধৃত হয় তাহলে ঐ ব্যক্তিকে প্রজ্বলিত আগুনে দগ্ধ করে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করতে হবে। এমন কি অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তী সময়েও যদি সে ধৃত হয় তথাপি তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে হবে। রথ বা শকট চলাচলের পথে কেউ যদি ধূলি বা ঐ জাতীয় পদার্থ নিক্ষেপ করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, তাহলে তাকে জরিমানা হিসেবে আটের এক ভাগ পণ প্রদান করতে হবে। কাদামিশ্রিত জলের মাধ্যমে এরূপ পথের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে জরিমানা হিসেবে এক চতুর্থাংশ পণ প্রদান করতে হবে। রাজমার্গ বা প্ৰধান সড়কে এ জাতীয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপরাধে দ্বিগুণ হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০২-৩৬-০৭ রাজপথের পার্শ্বস্থ রাজকীয় ভবন, কৃপাঞ্চল, জলাশয়, পুণ্যস্থান, দেবালয়, কোষাগার, পণ্যগৃহ এবং কোষ্ঠাগার জাতীয় স্থাপনার অঙ্গনে মলত্যাগ করলে, যথাক্রমে পাঁচ থেকে এক পণ বিষ্ঠাদণ্ড হিসেবে জরিমানা প্রদান করতে হবে। অনুরূপভাবে মূত্রত্যাগের জন্য অর্ধেক হারে জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে কেউ যদি বদহজমিজনিত কারণে বা ভীতিজনিত কারণে নিরূপায় হয়ে উপরোক্ত স্থানে বিষ্ঠাত্যাগ করে থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো জরিমানা প্রদান করতে হবে না। কেউ যদি নগরের কোথাও কুকুর, বেজি বা সাপের মৃতদেহ নিক্ষেপ করে, তাহলে তার উপর তিন পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। অনুরূপভাবে গাধা, উট, খচ্চর, ঘোড়া বা অন্যান্য পশুর মৃতদেহ ফেলে রাখলে দণ্ড হিসেবে ছয় পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। মানুষের মৃতদেহ নগরের কোথাও ফেলে রাখলে, অপরাধীকে দণ্ড হিসেবে ৫০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০২-৩৬০৮ নগরীর যে পথ এবং দ্বার শবযাত্রার জন্য নির্দিষ্ট করা থাকবে, তা ব্যবহার না করে অন্যপথে মৃতদেহ বহন করা হলে, অপরাধীকে প্রথম সাহসদণ্ড বা আড়াইশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। অনির্ধারিত দ্বার দিয়ে শব নিষ্ক্রমণ প্রাক্কালে দায়িত্বরত দ্বারপাল কর্তৃক বাধা প্রদান না করা হলে,

দায়ী দ্বারপালকে দায়িত্বহীনতার কারণে ২০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। সুনির্দিষ্ট শ্মশানে শবদাহ বা কবরস্থ না করে অন্যত্র শবের সৎকার করা হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

রাতের প্রথম ও শেষভাগে যথাক্রমে ছয়-নলিকা অতিক্রান্তের পর একবার এবং ছয়-নলিকা অবশিষ্ট থাকতে একবার সড়কে লোক চলাচল নিরোধ করবার জন্য যামতূর্য তথা বাদ্য মারফত ঘোষণা প্রদান করতে হবে। এই সতর্কতা ঘোষিত হবার পরও রাজবাড়ির কাছে লোক চলাচল পরিদৃষ্ট হলে, বিধিভঙ্গের অপরাধে খামাখা ঘোরাঘুরির জন্য অকাল সঞ্চরণদণ্ড তথা সোয়া পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে নগরের বহিরাঙ্গনের জন্য এই জরিমানার হার হবে পাঁচ পণ।

০২-৩৬-০৯ উপদ্রুত এলাকায় চলাচলরত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের, অবগুণ্ঠিত পথচারীদের, পূর্ব থেকে চৌর্যবৃত্তিতে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনবোধে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। বিনা অনুমতিতে কেউ রাজভবন, রাজোদ্যান বা রাজকোষাগারের অঙ্গনে প্রবেশ করলে, নগরের নিরাপত্তা প্রাচীরে আরোহণ করলে তার বিরুদ্ধে মধ্যম সাহসদণ্ড তথা ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। প্রসূতির সেবাকর্মে নিযুক্ত সেবিকারা, চিকিৎসকরা, মৃতদেহ বহনকারীরা, প্রদীপ জ্বালিয়ে চলাচলকারীরা, বিপদ মোকাবেলার জন্য সমবেতকারীরা, নাটক দেখতে যাওয়া দর্শকরা, অগ্নি-নির্বাপনে নিযুক্ত ব্যক্তিরা, রাজানুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা চলাচলের জন্য নিষিদ্ধ সময়েও সড়কে চলাচল করতে পারবে, এ জন্য তাদের কোনো ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না। যেসব পথে রাত্রিতে লোক চলাচল নিষিদ্ধ সত্ত্বেও উৎসব উদযাপনের জন্য চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে, সে পথে কেউ অবগুণ্ঠিত হয়ে চলাচল করলে, নারী বা পুরুষের ছদ্মবেশে চলাচল করলে বা সশস্ত্র অবস্থায় চলাচল করলে, অপরাধের মাত্রানুযায়ী তার বা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রযুক্ত হবে।

০২-৩৬-১০ অনুমোদিত ব্যক্তির চলাচল বিঘ্নিত করলে এবং অননুমোদিত ব্যক্তির চলাচল নির্বিঘ্ন করলে দায়ী রক্ষীদের উপর যথাক্রমে এক পণ ও দুই পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো রক্ষী যদি দাসী জাতীয় কোনো স্ত্রীলোককে বলাৎকারপূর্বক সম্ভোগ করে, সেক্ষেত্রে সে রক্ষীকে আড়াইশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। অদাসী কোনো গণিকা প্রকৃতির নারীকে বলাৎকার করলে ৫০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। দাসী-অদাসী যে কোনো বিবাহিতা নারীকে বলাৎকার করলে, রক্ষীকে ১০০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কিন্তু কোনো কুলবধূ তথা আর্যের স্ত্রীকে বলাৎকার করা হলে রক্ষীর উপর বধদণ্ড তথা শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হবে। কোনো রক্ষী যদি সচেতন বা অবচেতন মনে রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালনে শিথিলতা প্রদর্শন করে বা রাতে মদ্যপ অবস্থায় দায়িত্বরত থাকে, তাহলে তার উপর অপরাধের মাত্রানুযায়ী দণ্ড প্রযুক্ত হবে।

০২-৩৬১১ নদী, কূপ, জলাধার, নগরের প্রবেশ ও প্রস্থান দ্বার, স্থলভূমি, সুড়ঙ্গ পথ, প্রতিরক্ষা বাঁধ, দুর্গ প্রাচীর, অট্টালিকা ও পরিখার পরিদর্শন কর্ম নগররক্ষীদের আধিকারিকের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয় কাজ বলে গণ্য হবে এবং অসাবধানতাবশত কারও ভূষণাদি হারিয়ে গেলে, কেউ তার দ্রব্যের কথা বিস্মৃত হলে, কোনো দ্বিপদ বা চতুষ্পদ প্রাণী নিজে থেকেই অন্যত্র চলে গেলে, এসমস্ত দ্রব্য উদ্ধার করে দেওয়াও হবে রক্ষীদের আধিকারীকের অন্যতম কর্তব্য। রাজার বার্ষিক জন্মনক্ষত্র উৎসবে এবং পূর্ণিমা তিথিতে কারাগারে অবরুদ্ধ বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত এবং অনাথদের মুক্ত করে দিতে হবে। সুস্বভাবযুক্ত ব্যক্তিরা যদি প্রমাদবশত কোনো অপরাধের কারণে কারারুদ্ধ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তারা ভবিষ্যতে পুনর্বার অপরাধ করবে না মর্মে মুচলেকা প্ৰদান করত নিষ্ক্রিয়মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে মুক্তিলাভ করতে পারবে।

০২-৩৬-১২ প্রতিদিন বা সপ্তাহের পঞ্চম দিনে কারারুদ্ধ কয়েদিদের বিশোধনের মাধ্যমে জরিমানা আদায়পূর্বক দোষনিষ্ক্রিয় করে অবমুক্ত করতে হবে। এই বিশোধন প্রক্রিয়া তিন পদ্ধতিতে কার্যকর করা যেতে পারে—১. জরিমানা পরিশোধে অসমর্থ ব্যক্তিরা শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে অপরাধের নিষ্ক্রিয় মূল্য পরিশোধ করতে পারবে ২. শ্রমদানে অক্ষম ব্যক্তিরা শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে অপরাধের নিষ্ক্রিয়মূল্য পরিশোধ করতে পারবে ৩. মূল্যবান সম্পদ বা নগদ অর্থের বিনিময়ে অপরাধীরা নিষ্ক্রিয়মূল্য পরিশোধ করে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে পারবে। এছাড়াও কোনো নতুন দেশ বিজয় উপলক্ষে, যুবরাজের অভিষেক উপলক্ষে বা রাজার পুত্রসন্তান লাভ উপলক্ষে রাজানুগ্রহের মাধ্যমে কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন