চতুর্থ অধিকরণ (কণ্টকশোধন)

চতুর্থ অধিকরণ। প্রকরণ ৭৬–৮৮।

কণ্টকশোধন (ছল, চাতুরি, জালিয়াতি, ঠগবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শাস্তি আরোপণ) নামক চতুর্থ অধিকরণের তেরটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় হলো—

১. সুক্ষ্ম কারুশিল্পীদের প্রতারণা হতে সুরক্ষা ২. বণিকদের ঠগবাজি নিরোধকরণ ৩. দৈব বিপত্তির প্রতিকার ৪. গোপন প্রবঞ্চকদের কবল থেকে সুরক্ষা ৫. গুপ্তচরদের মাধ্যমে দুষ্টু লোক ও রাজদ্রোহীদের চিহ্নিতকরণ ৬. সন্দেহভাজন, আত্মসাৎকারী ও সন্ধিচ্ছেদকারীদের আটক ৭. সদ্যমৃতের মৃত্যুর হেতু উদ্ঘাটন ৮. জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অপরাধের উৎস উদ্ঘাটন ৯. সর্বাধিকরণরক্ষণ তথা রাজ কর্মচারীদের উৎপীড়ন হতে রাজা ও প্রজাদের রক্ষাকরণ ১০. একাঙ্গবধনিষ্ক্রয় তথা অপরাধের মানদণ্ডে অপরাধীর অঙ্গহানিকরণ ১১. অপরাধের মানদণ্ডে যন্ত্রণাহীন বা যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরকরণ ১২. নাবালিকার সঙ্গে যৌনাচারকারীর শাস্তি আরোপণ ১৩. শাস্ত্রীয় বিধি বিধান লঙ্ঘনের প্রতিবিধান।

প্রথম অধ্যায় ॥ ৭৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে কণ্টকশোধনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে—শিল্পী, কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই প্রজাদের পীড়ন করে থাকে। এ ধরনের নিপীড়কদের কাঁটার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে—এরা কণ্টকতুল্য। এদের পীড়ন তথা শোষণ থেকে প্রজাদের নিষ্কৃতি প্রদানের জন্য কণ্টকশোধনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। চোর, দস্যু, হত্যাকারীরা যেমন—সামাজিক জীবনের সুখ থেকে প্রজাদের বঞ্চিত করে থাকে, তেমনি শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীরাও প্রজা নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রজাদের প্রভূত ক্ষতি করে থাকে, এ কারণে তাদের কার্যকলাপ নিরোধকরণের জন্য কণ্টকশোধন আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে আচার্য মনুর উক্তি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘কণ্টকশোধনের মাধ্যমে যে রাজা সদাচারী লোকদের রক্ষা করেন, প্রজাপালনকারী হিসেবে সে রাজাই স্বর্গে গমন করেন।

০৪-০১-০১ রাজার নিযুক্ত তিনজন মহামাত্র তথা বিচারক কণ্টকশোধনের দায়িত্ব পালন করবেন। তারা প্রজা পীড়নকারী কারিগর, ব্যবসায়ী, দস্যু, চোর, ইত্যাকার নিপীড়কদের কবল থেকে প্রজাকুলকে রক্ষার্থে বিচারের ব্যবস্থা করবেন। যে সব কারুশিল্পী তথা স্বর্ণকার অপরের গচ্ছিত দ্রব্য হারিয়ে ফেললেও পুনরুদ্ধারে সক্ষম বা নিজের সম্পদ থেকে সে ক্ষতিপূরণ প্রদানে সমর্থবান, আস্থাভাজন ও সৎ অথবা যারা সংঘবদ্ধভাবে অলঙ্কার তৈয়ারির কাজ করে থাকে, তারাই অলঙ্কার তৈয়ারির জন্য স্বর্ণ রৌপ্য গ্রহণের উপযুক্ত স্বর্ণকার বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে সংঘের কোনো কর্মকর মৃত্যুমুখে পতিত হলে বা দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কারণে গচ্ছিত সম্পদ ফেরত প্রদানে অক্ষম হলে, উক্ত স্বর্ণকারের পুত্র বা সংঘের অন্যান্য সদস্যদের মাধ্যমে তা পূরণীয় হবে বা ফেরত প্রদান করতে হবে।

০৪-০১-০২ কারিগররা কাজের প্রকৃতি, সরবরাহের সময়, ইত্যাকার বিষয়ে সম্যক অবহিত হয়ে কাজ গ্রহণ করবে এবং ফরমায়েশ মোতাবেক তা প্রস্তুত করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রাহককে সরবরাহ করবে। কোনো কারিগর যদি প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে কার্য সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার মজুরির এক চতুর্থাংশ কর্তন করা যেতে পারে। একই সাথে তার উপর মজুরির দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে কোনো হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা অগ্নিকাণ্ডের কারণে যদি কাজ বিঘ্নিত হয়, তাহলে কোনো শাস্তি বা জরিমানা প্রযোজ্য হবে না। এ সব কারণ ব্যতিরেকে অন্য কোনো কারণে বা উক্ত কাজ না করে অন্যের কাজ করার কারণে যদি নির্ধারিত কাজ বিলম্বিত হয়, তাহলে উপরোক্ত দণ্ড প্রযুক্ত হবে।

০৪-০১-০৩ বস্ত্র বয়নের জন্য যদি ১০ পল সুতা প্রদান করা হয়ে থাকে তাহলে তাঁতিগণ তার সাথে রঙ ও মাড় মিশ্রণজনিত কারণে ১১ পল ওজনের বস্ত্র সরবরাহ করবে। এর অন্যথা হলে যতটুকু কম ওজনের বস্ত্র সরবরাহ করা হবে, তার দ্বিগুণ অর্থ দণ্ড হিসেবে জরিমানা প্রদান করতে হবে। সুতা দিয়ে বস্ত্ৰ বয়নের মজুরি হবে সুতার মূল্যের সমান। কিন্তু পট্ট বা রেশম বস্ত্র বয়নের ক্ষেত্রে এই মজুরি হবে দেড়গুণ। পত্রোর্ণা, কম্বল এবং দু-কূলের জন্য বয়নের মজুরি হবে সুতার মূল্যের দ্বিগুণ।

০৪-০১-০৪ যে পরিমাণ বস্ত্র বয়ন করে দেওয়ার কথা, তাঁতি যদি তা থেকে কম পরিমাণ বস্ত্র বয়ন করে সরবরাহ করে, তাহলে যতটুকু বস্ত্ৰ কম বয়ন করা হবে সে অনুপাতে তার মজুরি কর্তিত হবে এবং যে পরিমাণ বস্ত্র কম প্রদান করা হবে, তার দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা বাবদ আরোপিত হবে। বস্ত্ৰ যদি প্রকৃত ওজনের চেয়ে কম দেওয়া হয়, তাহলে যতটুকু কম দেওয়া হবে তার চারগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। তাঁতি যদি উত্তম প্রকৃতির সুতা গ্রহণ করে নিম্নমানের সুতা দিয়ে বস্ত্র বয়ন করে সরবরাহ করে, তাহলে উক্ত তাঁতিকে উত্তম সুতার দ্বিগুণ মূল্য জরিমানা বাবদ পরিশোধ করতে হবে। জোড়া কাপড় বুননের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম ও শাস্তি বা জরিমানা প্রযোজ্য হবে।

০৪-০১-০৫ একশ পল উল ধুনাইয়ের জন্য পাঁচ পল উল হ্রাস পেতে পারে। অর্থাৎ ধুনাইকালে শতকরা পাঁচভাগ উল কমে যেতে পারে যা বিধিসম্মত। অতঃপর বয়ন প্রাক্কালে আরো পাঁচ পল হ্রাস পেতে পারে, এ কারণে একশ পল উল দিয়ে কোনোকিছু বয়ন করা হলে তার প্রকৃত ওজন হবে ৯০ পল। এর ব্যতিক্রম হলে (কম হলে) তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধোপাগণ কাঠের পাটাতনে বা মসৃণ পাথরের উপর কাপড় আছড়িয়ে ধোলাই করবে, এর অন্যথা করে যদি শক্ত কিছুর উপর কাপড় আছড়িয়ে ধোলাই করে এবং সেজন্য যদি কাপড়ের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে ধোপারা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণসহ ছয় পণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।

০৪-০১-০৬ ধোপাগণ তাদের জন্য নির্ধারণকৃত মুগর ও গদা চিহ্নবিশিষ্ট পরিধেয় ব্যতীত অন্য ধরনের পোষাক পরিধান করলে তাদের উপর তিন পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ধোলাইয়ের জন্য প্রদত্ত কাপড় যদি ধোপা কর্তৃক বিক্রি করা হয়, ভাড়া দেওয়া হয় বা বন্ধক দেওয়া হয় তাহলে দায়ী ব্যক্তির উপর ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। তারা যদি ধোলাইয়ের জন্য গৃহীত কাপড়ের পরিবর্তে অন্য ধরনের কাপড় ফেরত প্রদান করে, তাহলে প্রকৃত কাপড় ফিরিয়ে দেওয়াসহ কাপড়ের দ্বিগুণ মূল্য জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে। তারা ফুলের মুকুলের মতো মসৃণ সাদা বর্ণের কাপড় এক দিনের মধ্যে ধোলাই করে গ্রাহককে ফেরত প্রদান করবে। শিলাপাটের মতো স্বচ্ছ কাপড় দুই দিনে ধোলাই করবে, সাদা কাপড় তিন দিনে ধোলাই করবে এবং ধবধবে সাদা কাপড় চার দিনে ধোলাই করে গ্রাহককে ফেরত প্রদান করবে। এর অন্যথা হলে ধোপারা জরিমানা প্রদানে বাধ্য থাকবে।

০৪-০১-০৭ রঙ করার কাজে নিযুক্ত রঞ্জকরা কাপড়ে হালকা রঙ করার জন্য পাঁচ দিন সময় পাবে। কেশর, পলাশ, পারিজাত, কুসুম্ভ, শেফালি, ইত্যাকার পুষ্প দিয়ে কাপড় রাঙাতে তারা সময় পাবে ছয় দিন এবং যেসব মূল্যবান কাপড় রঙকরণ অত্যন্ত শ্রমবহুল ও সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক, সেসব কাপড় সাত দিনের মধ্যে রঙ করে ফেরত প্রদান করতে হবে। এই বিধিবদ্ধ সময়ের মধ্যে কাপড় রঙ করে সরবরাহ করা না হলে আনুপাতিক হারে তাদের মজুরি হ্রাস পাবে।

০৪-০১-০৮ কাপড় রঙ করা নিয়ে কোনো বিবাদ দেখা দিলে পরস্পরের বিশ্বাসভাজন এবং এ বিষয়ক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রশস্ততর কাপড় রঙ করার জন্য এক পণ, মধ্যম প্রকৃতির কাপড় রঙ করার জন্য অর্ধপণ এবং অধম প্রকৃতির কাপড় রঙ করার জন্য চারের এক পণ মজুরি নির্ধারিত হতে পারে। স্থূল প্রকৃতির কাপড় রঙ করাবার জন্য এক বা দুই মাষ মজুরি নির্ধারিত হতে পারে। কোনো রঙ করা কাপড় পুনর্বার রঙ করা হলে মজুরি হবে পূর্বের দ্বিগুণ। কোনো কাপড় প্রথমবার ধোলাই করা হলে, তার মূল্যমান প্রকৃত মূল্যের অর্ধেকে হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়বার ধোলাই করার পর তা পূর্ববর্তী মূল্যের পাঁচের একভাগ হ্রাস পাবে, এভাবে যতবার কাপড় ধোলাই করা হবে, ততবারই তার মূল্য হ্রাস পেতে থাকবে (এ ব্যবস্থা আধুনিককালের অবচয়মূল্যের মতো বলে প্রতীয়মান হয়—লেখক)

০৪-০১-০৯ সৌবর্ণিক তথা স্বর্ণালঙ্কারের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের অবহিত না করে কেউ যদি কোনো অবৈধ বিক্রেতার কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার ক্রয় করে, তাহলে উক্ত ক্রেতার বিরুদ্ধে দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। যারা স্বর্ণালঙ্কার বিনষ্ট করে তথা গলিয়ে ক্রয় করবে তাদের বিরুদ্ধে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং যারা চোরদের কাছ থেকে স্বর্ণ বা রৌপ্য ক্রয় করবে তাদের জরিমানা হিসেবে ৪৮ পণ প্রদান করতে হবে। অন্যদিকে স্বর্ণকাররা যদি গোপনে স্বর্ণ গলিয়ে স্বল্পমূল্যে অন্যের কাছ থেকে ক্রয় করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির জন্য প্রযোজ্য দণ্ড আরোপিত হবে। অলঙ্কারে খাদ মিশিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করা হলেও একইভাবে দণ্ড আরোপিত হবে।

০৪-০১-১০ কোনো স্বর্ণকার কর্তৃক একটি সুবর্ণ (স্বর্ণ ওজনের পরিমাপক বা স্বর্ণমুদ্রা) থেকে এক মাষক (১৬ মাষকে এক সুবর্ণ) স্বর্ণ অপহরণ করা হলে তার উপর ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। রৌপ্যের ক্ষেত্রে এক মাষক রৌপ্য অপহৃত হলে ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে অপহরণের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে আনুপাতিক হারে জরিমানার অঙ্কও তত বৃদ্ধি পাবে। কোনো স্বর্ণকার কর্তৃক নিম্নমানের স্বর্ণ বা রৌপ্যের উপর কৃত্রিম উজ্জ্বলতা আরোপ করত তা উৎকৃষ্ট স্বর্ণ বা রৌপ্য হিসেবে বিক্রির অপচেষ্টা করা হলে, তার বিরুদ্ধে ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-০১-১১ রৌপ্য ওজনের বাটখারা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারিত হবে এক মাষ এবং স্বর্ণ ওজনের বাটখারা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রদেয় মজুরি হবে দুই মাষ। এক্ষেত্রে স্বর্ণকারের কর্মদক্ষতা বা শৈল্পিক নৈপুণ্যের কারণে তার মজুরি দ্বিগুণ করা যেতে পারে। তামা, কাঁসা, পিতল, বৈকৃন্তক এবং ইস্পাত, এই পাঁচ প্রকৃতির ধাতুজাত দ্রব্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের শতকরা পাঁচভাগ হারে মজুরি নির্ধারিত হবে। এ সমস্ত ধাতু দিয়ে কোনোকিছু প্রস্তুত প্রাক্কালে দশ ভাগের এক ভাগ ধাতু ক্ষয় হতে পারে, এর বেশি ক্ষয় হলে কর্মকারকে ক্ষতির অনুপাতে দ্বিগুণ হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০৪-০১-১২ সিসা ও টিনের পিণ্ড দিয়ে কোনোকিছু প্রস্তুত প্রাক্কালে ২০ ভাগের এক ভাগ ধাতু ক্ষয় হতে পারে। লোহার ক্ষেত্রে এই ক্ষয় হবে পাঁচ ভাগের এক ভাগ। সীসা ও টিন দিয়ে কোনোকিছু প্রস্তুত করাতে হলে প্ৰতি পল ওজনের জন্য এক কাকণী মজুরি প্রদেয় হবে। লৌহজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে এই মজুরি হবে পল প্রতি দুই কাকণী।

০৪-০১-১৩ মুদ্রা পরীক্ষক যদি সচল মুদ্রার ত্রুটি সন্ধানে ব্যাপৃত হন এবং অচল বা ত্রুটিপূর্ণ মুদ্রা চালানোর প্রয়াস গ্রহণ করেন, তাহলে এহেন কৃতকর্মের জন্য তার উপর দণ্ড হিসেবে ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কারো দ্বারা তৈরি মুদ্রা বাজারে চালাতে হলে পাঁচ পণ হারে ব্যাজী (শুল্ক) প্রদান করতে হবে। লক্ষণাধ্যক্ষ তথা মুদ্রার অধীক্ষক যদি উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে রূপা বা তামার মুদ্রা চালানোর অনুমতি প্রদান করেন, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে যদি গোপনে আরও অধিক উৎকোচ গ্রহণ করা হয়, তাহলে দণ্ড বা জরিমানার পরিমাণও সেই হারে বৃদ্ধি পাবে।

০৪-০১-১৪ কেউ যদি জাল মুদ্রা প্রস্তুত করে বা এ ধরনের মুদ্রা বাজারে চালাবার চেষ্টা করে, তাহলে তার উপর হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ ধরনের জাল মুদ্রা কেউ যদি রাজকোষে সংরক্ষিত আসল মুদ্রার সাথে মিশ্রিত করে, তাহলে শাস্তি হিসেবে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। খনিতে রত্নের সন্ধানে কাজ করার সময় রত্ন সম্পৃক্ত ধূলিকণা ধৌতকালে কেউ যদি রত্নকণা জাতীয় মূল্যবান দ্রব্যের সন্ধান লাভ করে, তাহলে উক্ত শ্রমিক প্রাপ্ত দ্রব্যের এক তৃতীয়াংশের অধিকারী হবে। অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশের অধিকারী হবে রাজা। এক্ষেত্রে যদি উৎকৃষ্ট কোনো রত্নের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে রাজা এককভাবে তার অধিকারী হবেন। রত্ন অনুসন্ধানকালে কেউ যদি প্রাপ্ত রত্ন আত্মসাৎ করে, তাহলে তার উপর হাজার পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০১-১৫ খনি বা ভূগর্ভের আধার থেকে রত্ন লাভ করে কেউ যদি তা রাজার সমীপে সমর্পণ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি তার পারিতোষিক হিসেবে প্রাপ্ত রত্নের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করবে। কিন্তু উক্ত ব্যক্তি যদি রাজভৃত্য হয়ে থাকেন তাহলে তিনি প্রাপ্ত রত্নের বারো ভাগের এক ভাগ পাবেন। প্রাপ্ত রত্নের মূল্য একশ হাজার পল বা তার অধিক হলে এর পুরোটাই রাজার অধিকারে যাবে। কোনো সৎ ব্যক্তি কর্তৃক গুপ্তধনের সন্ধান লাভের পর সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে তা যদি তার পূর্বপুরুষদের সম্পদ বলে প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে উক্ত গুপ্তধনে রাজার কোনো অধিকার থাকবে না, এমনকি সেই গুপ্তধনের মূল্য একশ হাজার পণের অধিক হলেও রাজা কর্তৃক তা অধিকৃত হবে না। এক্ষেত্রে ধনের সন্ধান লাভকারী যদি কোনো প্রমাণাদি ছাড়াই তাতে স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস গ্রহণ করে, তাহলে তার উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ ধরনের গুপ্তধন গোপনে আত্মসাতের চেষ্টা করা হলে, শত পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-০১-১৬ প্রাণনাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও কোনো বৈদ্য যদি রাজ কার্যালয়কে অবহিত না করে উক্ত প্রকৃতির রোগীর চিকিৎসা করেন এবং চিকিৎসাকালে ঐ রোগী যদি মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহলে উক্ত বৈদ্যকে জরিমানা বাবদ ৫০০ পণ প্রদান করতে হবে। বৈদ্যের চিকিৎসা কর্মের গাফিলতির কারণে যদি উক্ত রোগীর মৃত্যু ঘটে, তাহলে তাকে জরিমানা বাবদ প্রদান করতে হবে ৫০০ পণ। শল্য চিকিৎসাকালে রোগীর যদি কোনো অঙ্গ বৈকল্য ঘটে তাহলে বৈদ্যকে সমুচিত শাস্তি ভোগ করতে হবে। কুশীলব তথা নট-নটি-নর্তকীরা বর্ষা ঋতুতে রাত্রিকালে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে অবস্থান করবে। তারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে ঘুরে নৃত্য-গীতে নিযুক্ত থাকবে না। এরূপ করা হলে নৃত্য-গীতে আসক্তি হেতু কৃষিকাজের প্রতি কৃষকেরা মনোযোগী হতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি কর্তৃক প্রীতিবশত কুশীলবদের কিছু দেওয়া হলে তারা তা বর্জন করবে এবং কেউ তাদের অতিমাত্রায় স্তুতি করলে তারা তা প্রত্যাখান করবে। এসব নিয়ম অমান্য করা হলে তারা ১২ পণ জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। কুশীলবরা তাদের নৃত্য-গীত-অভিনয় পরিবেশন প্রাক্কালে দেশ, জাতি, গোত্র ও চরণের উপহাস-বিদ্রূপ ব্যতিরেকে এবং যৌনতা সম্পৃক্ত বিষয় পরিহার করে ইচ্ছেমতো দর্শকদের চিত্তবিনোদনমূলক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে পারবে। উপরোক্ত বিধি বিধান চারণ ও ভিক্ষুকদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

০৪-০১-১৭ কুশীলবদের পরিবেশিত কোনো রঙ্গতামাশার কারণে কেউ যদি মানসিকভাবে আহত হয়, তাহলে উক্ত অপরাধের জন্য বিচারকরা শাস্তি হিসেবে যত পণ জরিমানা আরোপ করবেন সে মোতাবেক তারা ততটি বেত্রাঘাতও প্ৰাপ্ত হবে। কুশীলবরা নিজেদের কাজের অতিরিক্ত কোনো কাজ করে থাকলে সে মোতাবেক তারা মজুরির অধিকারী হবে।

০৪-০১-১৮ চোর না হয়েও উপরোক্ত উপায়ে যে সমস্ত বণিক, কারিগর, স্বর্ণকার, তন্ত্রবায়, কুশীলব জাতীয় লোকরা চৌর্য কর্মাদির দ্বারা প্রজাসাধারণকে উৎপীড়িত করবে, রাজা তাদের দণ্ড তথা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে নিরোধ করত প্রজার স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায় ॥ ৭৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বণিক সম্প্রদায় কর্তৃক প্রজা পীড়নের নানাদিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বণিকদের প্রজা উৎপীড়নের অন্যতম হোতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাদের প্রবঞ্চণা থেকে প্রজাদের কি উপায়ে রক্ষা করা আবশ্যক, সেসব বিষয়সহ প্রযোজ্য শাস্তি আরোপণের ব্যাপারে এ পর্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-০২-০১ সংস্থাধ্যক্ষ নামক রাজ কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত পণ্য সংস্থা বা বাজারের দোকানে পণ্যদ্রব্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণার্থে সংস্থাধ্যক্ষ বিক্রয় কেন্দ্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের পরিমাপক তথা শস্যের ওজন যন্ত্রের দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা এবং তৈলাক্ত দ্রব্য পরিমাপের দ্রোণ, আঢ়ক জাতীয় পাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে এসবের সঠিকতা নিশ্চিত করবেন।

০৪-০২-০২ বিভিন্ন ধরনের শস্য ওজনের জন্য ব্যবহৃত পরিমাণী নামক তুলাদণ্ড এবং ধান পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত দ্রোণ দিয়ে পরিমাপ প্রাক্কালে ওজনে অর্ধ পল তারতম্য হলে তা নির্দোষ বলে গণ্য হবে। কিন্তু এর অধিক তথা ওজনে এক পল তারতম্য পরিলক্ষিত হলে তা দোষণীয় বলে গণ্য হবে এবং এজন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১২ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এরও অধিক তারতম্য পরিদৃষ্ট হলে ওজনে হ্রাস বৃদ্ধির মাত্রানুযায়ী আনুপাতিক হারে জরিমানার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। ওজনের ক্ষেত্রে ১০০ পল বা ১ তুলাতে এক কর্ষ তথা এক পলের চার ভাগের এক ভাগ ওজন কম বেশি হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু ২ কর্ষ ওজন কম-বেশি হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৬ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে যে হারে ওজনের হ্রাস বৃদ্ধি হবে সে হারে জরিমানার পরিমাণও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বা হ্রাস পাবে।

০৪-০২-০৩ আঢ়ক দিয়ে পরিমাপ প্রাক্কালে ওজনের অর্ধবর্ষ পরিমাণ হ্রাস বৃদ্ধি হলে তা দোষণীয় হবে না। কিন্তু এর অধিক তথা এক কর্ষ পরিমাণ তারতম্য হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এ জন্য দণ্ড হিসেবে ৬ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এভাবে ওজনের তারতম্য অনুযায়ী আনুপাতিক হারে জরিমানার পরিমাণও হ্রাস বা বৃদ্ধি পাবে।

০৪-০২-০৪ কোনো বণিক যদি পণ্য ক্রয়কালে প্রতারণাপূর্বক বড় ভাণ্ড বা অধিক ওজনের বাটখারা ব্যবহার করে পণ্য ক্রয় করে, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং বিক্রয়কালে যদি কম ওজনসম্পন্ন বাটখারা বা ভাণ্ড ব্যবহার করে পণ্য বিক্রয় করে, তাহলে তাকে তার কৃত অপরাধের জন্য দ্বিগুণ দণ্ড হিসেবে ২৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। গণনার মাধ্যমে বিক্রিত পণ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে কোনো বণিক যদি সুকৌশলে ক্রেতাকে আটের একভাগ পণ্য কম প্রদান করে, তাহলে তার উপর ৯৬ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো বণিক যদি কাঠ, লোহা, মণি, দড়ি, চামড়া, মাটি, সুতা, পশম, ইত্যাকার উপাদানে প্রস্তুতকৃত কোনো নিকৃষ্ট পণ্যকে উৎকৃষ্ট পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে বিপণনে ব্রতী হয়, তাহলে কৃত অপরাধের জন্য দণ্ড হিসেবে তার উপর পণ্য মূল্যের আটগুণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০২-০৫ কোনো বণিক যদি কমমূল্যের নিকৃষ্ট পণ্যকে উচ্চমূল্যের উৎকৃষ্ট পণ্য বলে বিক্রির জন্য প্রদর্শন করে, এক দেশে উৎপন্ন স্বল্পমূল্যের পণ্যকে অন্য দেশে উৎপন্ন অধিকমূল্যের পণ্য বলে প্রচার করে, নিম্নমূল্যের কৃত্রিম মুক্তাকে অধিকমূল্যের অকৃত্রিম মুক্তা বলে প্রচার করে, উৎকৃষ্ট পণ্য দেখিয়ে ক্রেতাকে নিকৃষ্ট পণ্য গছিয়ে দেয়, তাহলে সে বণিককে প্রতারণাপূর্ণ বিপণনের অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে দণ্ড হিসেবে ৫৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। উক্ত বণিক যদি এ ধরনের মানহীন কোনো পণ্য এক পণে বিক্রি করে তাহলে তার উপর দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ ধরনের পণ্য যদি দুই পণ মূল্যে বিক্রি করা হয় তাহলে ২০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এরও অধিক মূল্যে এ ধরনের পণ্য বিক্রি করা হলে, আনুপাতিক হারে জরিমানাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।

০৪-০২-০৬ যদি কারিগর এবং শিল্পীরা পরস্পরের যোগসাজসে নির্মিতব্য কোনোকিছুর গুণগত মান বিনষ্ট করে তথা চাহিদামাফিক প্রতিশ্রুত মানসম্পন্ন পণ্যদ্রব্য প্রস্তুত না করে মানহীন দ্রব্য প্রস্তুত করে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে উচিৎ মজুরির চেয়ে অতিরিক্ত মজুরি গ্রহণ করে, কিংবা অতিরিক্ত মূল্যে দ্রব্য বিক্রয় করে ক্রেতার ক্ষতি করে বা কমমূল্যে দ্রব্য ক্রয় করে বিক্রেতার ক্ষতিসাধন করে, তাহলে এসব কাজে যুক্ত প্রত্যেকের উপর ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। বণিকরা যদি পরস্পর সংঘটিত হয়ে পণ্যদ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত মালামাল গুদামজাত করে রেখে অনুচিত মূল্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ে সচেষ্ট হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের উপর দণ্ড হিসেবে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০২-০৭ মালামাল পরিমাপকারীরা যদি হাতের কৌশলে ওজনের ক্ষেত্রে জালিয়াতি করে এবং ক্রেতা বিক্রেতার ক্রয়কৃত বা বিক্রিত দ্রব্যের আটের এক ভাগ ক্ষতিসাধন করে তাহলে তাদের উপর ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে জালিয়াতির পরিমাণ যত বেশি হবে দণ্ড হিসেবে প্রদেয় জরিমানার পরিমাণও আনুপাতিক হারে তত বেশি হবে।

০৪-০২-০৮ ধান, তেল, ঘৃত, গুড়, লবণ, চন্দন এবং ভেষজ দ্রব্যের সাথে একই ধরনের অন্য কোনো নিম্নমানের দ্রব্য ভেজাল দিয়ে বিক্রি করা হলে, অপরাধী বণিকের উপর দণ্ড হিসেবে ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০২-০৯ বণিকগণ প্রতিদিনের লভ্যাংশ খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখবেন এবং জীবন-যাপনের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন লভ্যাংশ থেকে সে পরিমাণ অর্থ ভোগ করার অধিকারী হবেন, এর অতিরিক্ত লভ্যাংশের উপর বণিকদের কোনো অধিকার থাকবে না, লভ্যাংশের অবশিষ্ট অংশ রাজকোষে জমা দান করতে হবে। বণিকরা বাণিজ্যিক তত্ত্বাবধায়ক তথা পণ্যাধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে ধানসহ অন্যান্য পণ্য সংগ্রহ করবে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে বণিকরা যদি কোনো ধরনের পণ্য সংগ্রহ করে, তাহলে তা বাজেয়াপ্তযোগ্য হবে। সংগ্রহকৃত পণ্য বিক্রয় প্রাক্কালে সাধারণ প্রজাদের স্বার্থ সংরক্ষণ সাপেক্ষে তা বিক্রয় করতে হবে এবং পণ্যাধ্যক্ষ সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

০৪-০২-১০ বণিকরা পণ্য বিক্রয়কালে স্বদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে শতকরা পাঁচ ভাগ মুনাফা অর্জন করতে পারবে এবং বিদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে এই মুনাফার হার হবে শতকরা দশ ভাগ। এ নিয়ম লঙ্ঘন করে অনুমোদিত হারের অধিক মুনাফা হাসিল করা হলে, অপরাধী বণিকের বিরুদ্ধে দণ্ড হিসেবে ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়াও যে হারে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা হবে, সে অনুপাতে জরিমানার হারও উত্তরোত্তর বর্ধিত হবে।

০৪-০২-১১ সংঘবদ্ধ বণিকরা পণ্যাধ্যক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে গুদামজাত করার পর সেসব পণ্য বিক্রয় না হওয়া পর্যন্ত পুনরায় কোনো পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারবে না। জল, অগ্নি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বণিকদের পণ্য সম্ভার বিনষ্ট হলে, পণ্যাধ্যক্ষ ক্ষতিগ্ৰস্ত বণিকদের প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভার যোগান দিয়ে সহায়তা প্রদান করবেন। রাজভাণ্ডারে পণ্যের মজুদ বৃদ্ধি পেলে পণ্যাধ্যক্ষ সেসব পণ্য একস্থান থেকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করাবেন। এক্ষেত্রে যেসব পণ্য অবিক্রিত থাকবে অন্য বণিকরা সে জাতীয় পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারবে না।

০৪-০২-১২ অন্যদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য এবং অনেক পূর্বে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য বিক্রয় প্রাক্কালে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে সেসব দ্রব্যের আমদানি ও উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেব করে পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

তৃতীয় অধ্যায় ॥ ৭৮ প্রকরণ

প্রজাদের প্রতি দুইভাবে উপদ্রব বা উৎপীড়ন আবির্ভূত হতে পারে। প্রথমত, মানুষের অন্যায় কৃতকর্মের মাধ্যমে উপদ্রব আবির্ভূত হতে পারে, দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত কারণেও তা হতে পারে। এ অধ্যায়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা দৈব দুর্বিপাকজনিত উৎপীড়ন বা উপদ্রবের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-০৩-০১ দৈব তথা দেবতা কর্তৃক কৃত উপদ্রব আট প্রকার—অগ্নি, জল, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, মুষিক, প্রাণীর হিংস্রতা, সর্প এবং রাক্ষস। রাজা এসব উপদ্রব থেকে প্রজা সাধারণকে রক্ষা করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন। অগ্নি হতে পরিত্রাণের প্রত্যাশায় গ্রামের লোকেরা গ্রীষ্ম ঋতুতে বাড়ির বাইরে চুল্লি স্থাপন করে রান্নার ব্যবস্থা করবে। অথবা দশ গৃহের রক্ষক তথা গোপের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রামের গৃহস্থরা নিরাপদ স্থানে রান্নার চুল্লি নির্মাণ করবে।

০৪-০৩-০২ অগ্নি থেকে নাজাত পাবার জন্য শুভ তিথিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন উৎসবে রাজা ভূতবলি, রক্ষাহোম এবং স্বস্তিবাচনের মাধ্যমে অগ্নিপূজার ব্যবস্থা করাবেন। বর্ষাকালীন রাত্রিতে নদী এবং জলাঞ্চলের অধিবাসীরা প্লাবন এলাকার অবস্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে বসবাস করবে। তারা বন্যার কোপানল থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাঁশের ভেলা, নৌকা ইত্যাকার নৌযান সংগ্রহ করে রাখবে।

০৪-০৩-০৩ বন্যায় আক্রান্ত তথা জলবন্দি লোকজনকে লাউ, চামড়ার থলে, গাছের গুঁড়ি, ভেলা, নারকেলের দড়ি ব্যবহার করে উদ্ধার করতে হবে। যারা এসব উপকরণ নিয়ে বন্যাক্রান্তদের বাঁচাতে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবে না, তাদের প্রত্যেকের ১২ পণ করে জরিমানা হবে। কিন্তু যাদের উদ্ধারের উপকরণ নেই তারা উদ্ধার-কার্যে এগিয়ে না এলেও তা দোষণীয় হবে না। অমাবশ্যার সময় রাজা জলের উৎপীড়ন প্রশমনের জন্য নদীপূজার ব্যবস্থা করাবেন। অতিবৃষ্টির অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মায়াযোগজ্ঞানী শৈবমান্ত্রিক এবং বেদপণ্ডিতরা জপহোমাদির দ্বারা অভিচার ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করবে। বর্ষার পরিবর্তে খরার আবির্ভাব হলে রাজা কর্তৃক ইন্দ্র, গঙ্গা, পর্বত এবং সমুদ্রের পূজা করতে হবে।

০৪-০৩-০৪ ব্যাধি কৃত্রিম এবং অকৃত্রিম প্রকৃতির হতে পারে। কৃত্রিম ব্যাধি মনুষ্য সৃষ্ট। এ ব্যাধি বিষধূম, বিষপান ইত্যাকার দোষ থেকে উৎসারিত। অকৃত্রিম ব্যাধি ধাতুর দোষ থেকে উৎসারিত। ঔপনিষদিক প্রকরণে নির্দেশিত বিধানের আলোকে কৃত্রিম ব্যাধিভয় প্রশমিত করতে হবে। অন্যদিকে অকৃত্রিম বা সাধারণ ব্যাধির উপদ্রব দূরীভূত করতে হবে বৈদ্যের ঔষধ, সিদ্ধ তাপসের জপহোমাদি শান্তিকর্ম এবং প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে। দেশে মহামারি বা মড়ক শুরু হলে তা থেকে নিষ্কৃতির নিমিত্ত রাজা তার প্রজাদের গঙ্গায় তীর্থস্নান, সমুদ্রে পূজা, শ্মশানে গো দোহন, শ্মশানে দাহ এবং বিশেষ স্থানে রাত্রিজাগরণপূর্বক দেবার্চণা করাবেন।

০৪-০৩-০৫ পশুদের মধ্যে মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তাদের নিরাপদ আস্তানায় স্থানান্তর করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে নিরাজনাসহ পশুদের নিজ নিজ দেবতার পূজা করাতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হাতির জন্য তার দেবতা সুব্রহ্মণ্য, অশ্বের দেবতা অশ্বিনী দ্বয়, গরুর দেবতা পশুপতি, মহিষের দেবতা বরুণ, খচ্চর ও গাধার দেবতা বায়ু এবং ছাগলের দেবতা অগ্নির পূজার্চনা করাতে হবে। দুর্ভিক্ষকালে রাজা তার প্রজাদের প্রতি সহায়তা প্রদানের জন্য ফসলের বীজ ও খাদ্যের যোগান দিয়ে সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করবেন। অথবা তিনি খাদ্য ক্রয়ের জন্য প্রজাদের ভাতা প্রদান করে তাদের দিয়ে নির্মাণকাজ ও কৃষিকাজ করিয়ে নিবেন। এ ধরনের কর্মে নিযুক্তকরণ সম্ভব না হলে তিনি প্রজাদের খাদ্য বা ভাতা প্রদান করবেন। অথবা তিনি ক্রান্তিকাল অতিক্রান্ত হলে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে দুর্ভিক্ষ পীড়িত লোকদের সাময়িক সময়ের জন্য কাছাকাছি দূরত্বের কোনো মিত্র দেশে পাঠিয়ে দিবেন। অথবা তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে কার্যকর সহায়তা প্রদানের জন্য আর্থিকভাবে সক্ষম মিত্র রাজাদের অনুরোধ জানাবেন। প্রয়োজনবোধে তিনি অনাবশ্যক প্রজাদের দূর দেশে পাঠিয়ে দিয়ে প্রজা ভার লাঘব করবেন। আবশ্যক মনে করলে ধনিক প্রজাদের উপর অধিকহারে করারোপ করবেন এবং বলপূর্বক ধন আদায় করে তা দিয়ে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সহায়তা প্রদান করবেন।

০৪-০৩-০৬ আবশ্যক মনে করলে রাজা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শস্য সমৃদ্ধ দূরদেশে বসবাসের জন্য গমন করবেন। অথবা জনগণ যেন মৎস্য, জলজ জন্তু বা পাখি ভক্ষণ করে জীবন-ধারণ করতে পারে, সে অভিপ্রায়ে সমুদ্র, নদী বা সরোবরের সন্নিকটস্থ এলাকায় বসবাসের এন্তেজাম করবেন। কৃষিভূমিতে জল সঞ্চালনের ব্যবস্থা করে শাক-সব্জি ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করাবেন। অথবা পশুপাখি জীবজন্তু শিকারের মাধ্যমে জীবন-নির্বাহের ব্যবস্থা করাবেন।

০৪-০৩-০৭ ইঁদুরের উৎপাত নিরোধকল্পে জনপদে বিড়াল ও বেজি লালন- পালন করতে হবে। এ ধরনের বিড়াল বা বেজির উপর কেউ চড়াও হলে তাকে দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। কোনো গৃহপালিত কুকুর যদি উৎপীড়ন করে এবং গৃহস্বামী কর্তৃক তা যদি নিরোধ করা না হয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর দ্বাদশ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। তবে, বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাতের জন্য কাউকে দণ্ডিত হতে হবে না।

০৪-০৩-০৮ ইঁদুরের উৎপাত নিরোধকল্পে তাদের বিনাশের জন্য সুহিবৃক্ষের ক্ষীর বা ঔষধ মিশ্রিত ধান ছিটিয়ে রাখতে হবে, এ ধরনের খাদ্য ভক্ষনের পর ইঁদুরের বংশনাশ হবে। এক্ষেত্রে রাজা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক মৃত ইঁদুর জমা প্রদানের জন্য গৃহস্থদের উপর ইঁদুর কর প্রবর্তন করবেন। এছাড়াও ইঁদুরের উৎপাত নিপাত করার জন্য রাজা পূর্ণিমাসহ বিভিন্ন পর্বে মুষিকপূজার ব্যবস্থা করবেন।

০৪-০৩-০৯ হিংস্র পশুর উৎপাত পরিদৃষ্ট হলে তাদের নিরোধ করার জন্য বিষমিশ্রিত মৃত পশুকে খাদ্য হিসেবে বন জঙ্গলে রেখে আসতে হবে, যাতে করে ঐ সব বিষমিশ্রিত খাদ্য ভক্ষণের পর অত্যাচারী পশুরা মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। এছাড়াও কুকুরের মাধ্যমে শিকার কার্য করে যেসব শিকারী চণ্ডাল জীবিকা-নির্বাহ করে তাদের সহায়তায় প্রতারণার ফাঁদ পেতে অত্যাচারী হিংস্র পশুদের আটক করে হত্যা করতে হবে। হিংস্র পশুদের দ্বারা কাউকে আক্রান্ত হতে দেখেও যদি শিকারি চণ্ডালেরা আক্রান্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য অগ্রসর না হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের উপর ১২ পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো শিকারি চণ্ডাল কর্তৃক হিংস্র পশু হত্যা করা হলে তাকে পারিতোষিক হিসেবে ১২ পণ প্রদান করা হবে। এছাড়াও হিংস্র জানোয়ারদের আক্রমণ থেকে প্রজাদের পরিত্রাণ প্রদানে জন্য রাজা অমাবশ্যা তিথিতে পর্বত পূজার ব্যবস্থা করাবেন।

০৪-০৩-১০ সর্পের উৎপাত শুরু হলে বিষ বিষয়ক বৈদ্যগণ গারুড়াদি মন্ত্র এবং বিষনাশক ঔষধের মাধ্যমে এর নিরোধ করবেন। নগরের লোকরা দৃষ্টিগ্রাহ্য সাপগুলোকে হত্যা করবে। অভিচার মন্ত্রে পরিজ্ঞাত পণ্ডিতগণ মন্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে সর্প নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সর্পের নিগ্রহ হতে প্রজাকুলকে রক্ষার্থে রাজা সর্প পূজার ব্যবস্থা করাবেন।

০৪-০৩-১১ রাক্ষসের আক্রমণ এবং ভীতি উপস্থিত হলে অভিচার কর্মনিপুণ অর্থ বেদজ্ঞরা অথবা মায়াযোগবিদগণ রাক্ষসনাশক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মন্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে রাক্ষসদের বিনাশকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়াও রাজা নানা অনুষ্ঠান পর্বে বিভিন্ন আচার পালনসহ ছাগল বলিদান করে শ্মশানে রাক্ষস পূজার আয়োজন করবেন। রাজা তার প্রজাদের সকল প্রকার উপদ্রব ও ভয়-ভীতি হতে রক্ষা করার জন্য পিতার মতো নিরাপত্তা বিধানার্থে সচেষ্ট থাকবেন।

চতুর্থ অধ্যায় ॥ ৭৯ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে দুষ্টের দমন ও সৃষ্টের পালন সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যে সমস্ত অপরাধী বিভিন্ন ধরনের বেশধারণ করে গোপনে অপরাধ কর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকে সমাজে বসবাস করে থাকে, তাদেরও কণ্টকের সঙ্গে তুলনা করে ইতিবাচক সমাজ জীবনের প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পর্যায়ে এদের নিপাতকল্পে অনুসরণীয় বিভিন্ন পদ্ধতির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-০৪-০১ সমাজে বসবাসরত গূঢ়াজীবী তথা বিভিন্নভাবে গোপনে প্ৰজা উৎপীড়নকারীদের বিনাশকল্পে সমাহর্তা তথা কণ্টকশোধনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসকগণ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এ জন্য তারা বিভিন্ন পেশার বেশধারী গুপ্তচর নিয়োগ করবেন এবং তাদের তপস্বী, সন্ন্যাসী, নিরন্তর ভ্রমণকারী, গো যানচালক, ভাঁড়, নর্তকী, অভিনেতা, জাদুকর, জ্যোতিষী, চিকিৎসক, উন্মাদ, বোবা, বধির, অন্ধ, নির্বোধ, ব্যবসায়ী, কারিগর, কারুশিল্পী, পতিতালয়ের রক্ষক, সুরা বিক্রেতা, মিষ্টান্ন বিক্রেতা, ভাত-মাংস বিক্রেতা, ইত্যাকার কর্মজীবী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে পদায়ন করে অপরাধীদের শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করবেন।

০৪-০৪-০২ এ সমস্ত গুপ্তচররা গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে গ্রাম আধিকারিক বা প্রধানের রাজানুগত্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে এবং তারা রাজার প্রতি কতটা অনুগত বা অনানুগত সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে রাজাকে অবহিত করবে। কোনো বিচারকের সততার ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক হলে, সত্রী নামক সর্ববিদ্যায় পরিজ্ঞাত এ সব গুপ্তচররা নানা প্রকার কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এ বিষয়ক তথ্য তালাশ করবে, এক্ষেত্রে সন্দেহভাজন বিচারকের অসততা প্ৰমাণিত হলে রাজার আদেশ বলে তাকে নির্বাসিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

০৪-০৪-০৩ সত্রীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে সন্দেহজনক গ্রাম আধিকারিকদের অসততা পরীক্ষা করবে। এক্ষেত্রে যদি তাদের সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে তারা রাজার কাছে এ বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করবে। রাজা সে মোতাবেক উক্ত আধিকারিককে উৎকোচ গ্রহণের দায়ে অভিযুক্ত করে নির্বাসিত করবেন।

০৪-০৪-০৪ মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানকারীদের শনাক্তকরণের জন্য এই গুপ্তচররা কৌশল অবলম্বন করে সন্দেহভাজন সাক্ষ্য প্রদানকারীদের দ্বারস্থ হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানার্থে প্রলুব্ধ করবে, এতে করে সন্দেজভাজন ব্যক্তিরা সাক্ষ্য প্রদানে সম্মত হলে গুপ্তচররা তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে রাজার কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং রাজা সে মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা হিসেবে দেশ নির্বাসিত করবেন।

০৪-০৪-০৫ কোনো তন্ত্রযোগীর বশীকরণজনিত অপকর্ম সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হলে গুপ্তচররা কৌশলে তার শরণাপন্ন হয়ে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী, কন্যা বা পুত্রবধূর প্রতি কামভাব প্রদর্শন করত তার সহায়তা কামনা করবে, এক্ষেত্রে উক্ত তন্ত্রযোগী সহায়তা প্রদানে সম্মত হলে, গুপ্তচররা তার কৃতকর্ম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে রাজার সমীপে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে, অতঃপর রাজা শাস্তি হিসেবে উক্ত তান্ত্রিককে দেশ হতে নির্বাসিত করবেন।

০৪-০৪-০৬ গুপ্তচররা কাউকে বিষ বিক্রেতা, বিষ প্রস্তুতকারী কিংবা ক্ষতিকারক ঔষধি রস প্রস্তুতকারী হিসেবে সন্দেহ করলে তারা তার শরণাপন্ন হয়ে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো এক শত্রুকে হত্যা করাবার জন্য অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করবে, সন্দেহভাজন ব্যক্তি যদি এতে সম্মতি-জ্ঞাপন করে তাহলে তাকে বিষ প্রয়োগকারী হিসেবে চিহ্নিত করে গুপ্তচরেরা তার ব্যাপারে রাজাকে অবহিত করবে, রাজা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে উক্ত প্রজা উৎপীড়ককে দেশ থেকে বহিষ্কার করবেন।

০৪-০৪-০৭ কোনো কর্মকার বা কামারকে জাল মুদ্রা প্রস্তুতকারী হিসেবে সন্দেহ হলে গুপ্তচররা সুকৌশলে উক্ত জালমুদ্রা প্রস্তুতকারীর আস্থা অর্জন করে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করবে, অতঃপর এক সঙ্গে অবস্থান প্রাক্কালে তার কৃতকর্ম সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে রাজাকে অভিহিত করবে, রাজা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে উক্ত অপরাধীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন। নকল স্বর্ণ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও একই প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

০৪-০৪-০৮ এভাবে গুপ্তচরদের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে দুর্নীতিবাজ ও প্রজা পীড়ক বিচারক, প্রশাসক, গ্রাম প্রশাসক, গ্রাম প্রধান, মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানকারী, মিথ্যে শ্রাবক, বশীকরণ কার্যে নিযুক্ত তান্ত্রিক, কৃত্যাশীল, অভিচারশীল, বিষ প্রয়োগকারী, বিষাক্ত ঔষধ প্রয়োগকারী, জালমুদ্রা প্রস্তুতকারী ও স্বর্ণ ভেজালকারীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি আরোপের ব্যবস্থা করতে হবে।

পঞ্চম অধ্যায় ॥ ৮০ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে গুপ্তচরদের মাধ্যমে দুষ্টু যুবকদের চিহ্নিত করত তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও এ পর্যায়ে যে সমস্ত চোর বিভিন্ন কপট পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে প্রজাদের উৎপীড়ন করে থাকে, বিভিন্ন কৌশলে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে শাস্তি প্রদান সম্পর্কিত বিষয়েও বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-০৫-০১ রাজা কর্তৃক নিয়োজিত গুপ্তচররা সাধু মানুষের বেশধারণ করে পরস্ত্রীতে গমনকারী দুশ্চরিত্রবান ব্যক্তিদের শনাক্ত করবে, এছাড়াও তারা সন্মোহনী বিদ্যার মাধ্যমে প্রলোভন প্রদানকারী ও মন্ত্র ব্যবহারকারী চোরসহ এ জাতীয় প্রজা উপদ্রবকারীদের বিভিন্ন কৌশলে শনাক্ত করবে এবং সমাজ থেকে তাদের উচ্ছেদের নিমিত্ত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

০৪-০৫-০২ সাধু মানুষের (বিশুদ্ধ মানুষ) ছদ্মবেশধারী গুপ্তচররা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব থেকে আয়োজনকৃত কোনো ঘরের বন্ধ (আসলে দরজা খোলাই থাকবে) দরজা মন্ত্রের মাধ্যমে উন্মোচন করবে, এভাবে তারা সন্মোহনীর মাধ্যমে পাহারাদারদের অতিক্রম করবে এবং পরস্ত্রীকে বশীকরণ করে ছলনামূলক সম্ভোগ সুখ উপভোগ করার অভিনয় করবে, এ সবই কৌশলের মাধ্যমে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক করা হবে এবং এভাবে তারা নিজেদের কৃতকর্মের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আস্থা অর্জন করে তাদের নিগূঢ় উৎপাটন করবে।

০৪-০৫-০৩ অতঃপর সাধুর ছদ্মবেশধারী এসব গুপ্তচর পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক কোনো গৃহস্থের বাড়িতে চিহ্নযুক্ত প্রামাণিক বস্তু রেখে চোরদের দিয়ে মন্ত্রের মাধ্যমে দরজা খুলিয়ে তা চুরি করাবে। এরপর চুরিকৃত দ্রব্য বিক্রয় প্রাক্কালে বা চোরেরা যখন মদ্যপ অবস্থায় মাতাল থাকবে, তখন তাদের চুরির মালামালসহ আটক করবে এবং চৌর্যবৃত্তি তথা দুষ্কর্মের বিষয়ে ও তাদের সঙ্গীদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

০৪-০৫-০৪ কখনো বা পুরনো চোর হিসেবে পরিচিত গুপ্তচররা প্রকৃত চোরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্বোক্ত আয়োজন মোতাবেক নির্ধারিত গৃহস্থের বাড়িতে চুরি করাবে, অতঃপর প্রমাণযুক্ত চোরাই মালামালসহ চোরদের আটক বা গ্রেফতার করবে। এভাবে কৌশলের মাধ্যমে চোরদের পাকড়াও করার পর প্রশাসকরা উক্ত চোরদের এলাকার জনগণের সম্মুখে হাজির করে এই মর্মে ঘোষণা প্রদান করবেন যে, রাজা চোর ধরার মন্ত্রের ব্যাপারে পরিজ্ঞাত আছেন এবং তার সে মন্ত্রের মাধ্যমে এসব চোরকে পাকড়াও করা হয়েছে, অতঃপর জনগণকে রাজার চোর ধরার সক্ষমতা তথা মন্ত্র সম্পর্কিত প্রজ্ঞার ব্যাপারে অবহিত করবে এবং চৌর্যবৃত্তি হতে নিবৃত হতে আহ্বান জানাবে।

০৪-০৫-০৫ নগরে চুরিকৃত ষাঁড় বাঁধার খুঁটি, ঘোড়ার জিন বা গরু খেদানের লাঠির মতো স্বল্পমূল্যের দ্রব্য চোরদেরও গুপ্তচরদের মাধ্যমে শনাক্ত করে গ্রেফতারের পর জনসম্মুখে হাজির করে প্রশাসকরা এই মর্মে ঘোষণা প্ৰদান করবেন যে, ছোটখাট সকল চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কেই রাজা তার মন্ত্রজ্ঞান বলে সর্বদা পরিজ্ঞাত থাকেন, এ ধরনের চোর ধৃতকরণ রাজার সে মহাত্ম্যেরই বহিঃপ্ৰকাশ। এভাবে সতর্কতা বার্তা প্রচারপূর্বক রাজার প্রশাসকরা সাধারণ লোকদের চৌর্যবৃত্তিতে নিরুৎসাহিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

০৪-০৫-০৬ পুরানো চোর, গোপালক, শিকারি ও চণ্ডালের বেশ ধারণ করে গুপ্তচররা বনচোর ও বনরক্ষকদের দলে অনুপ্রবেশ করে তাদের আস্থা অর্জন করবে। অতঃপর জাল মুদ্রা প্রদান করে তাদের চুরির কাজে প্ররোচিত করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া মাত্র গুপ্ত সৈনিক এবং বিষপ্রয়োগকারী গুপ্তচরদের দিয়ে ঐ বনচোর ও বনরক্ষীদের হত্যা করাবে। কখনো বা গুপ্তচররা বন চোরদের চুরিকৃত দ্রব্য নিয়ে পালিয়ে যাবার অনুমতি প্রদান করবে, অতঃপর চোরেরা পালিয়ে যাবার দীর্ঘপথ পারি দেওয়ার সময় ক্লান্ত হয়ে কোথাও ঘুমিয়ে পড়লে বা খাদ্য গ্রহণের পর গুপ্তচরদের নিয়োজিত লোকদের দ্বারা মদ্যপানের পর মাতাল হয়ে পড়লে, তাদের গ্রেফতার করাবে।

০৪-০৫-০৭ সমাহর্তা তথা মুখ্য প্রশাসকরা পূর্বোক্ত চোরদের জনসমক্ষে উপস্থাপনের তরিকায় এ সমস্ত বনচোরদেরও সর্বসাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করাবে এবং রাজার চোর ধরার প্রজ্ঞা-দক্ষতা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে এ ধরনের কাজ হতে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানাবে।

ষষ্ঠ অধ্যায় ॥ ৮১ প্রকরণ ॥

চুরিকৃত দ্রব্য এবং চুরি যাওয়া প্রামাণিক দ্রব্য দিয়ে চোর ধরার ব্যাপারে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরও কি কি উপায়ে চোরকে শনাক্ত করা যায় এবং মানুষের আচরণে কোন কোন উপসর্গ পরিদৃষ্ট হলে চোর সন্দেহে কাউকে আটক করা যাবে, এ পর্যায়ে সেসব বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-০৬-০১

০৪-০৬-০২ সাধু পুরুষের ছদ্মবেশে চুরিকৃত দ্রব্যের প্রামাণিক চিহ্ন দিয়ে চোরদের শনাক্ত করার পরও আরও বিভিন্ন উপায়ে চোরদের শনাক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে মানুষের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতেও সন্দেহপোষণ করত যে কাউকে চোর হিসেবে আটক করা যেতে পারে। এ ছাড়াও আরও বিবিধ কারণে সন্দেহজনক যে কাউকে গ্রেফতার করা যেতে পারে। এ পর্যায়ে কারো যদি কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য কারণ ছাড়া পৈতৃক বা কৃষিজাত সম্পত্তি হ্রাস পায়, পরিবার পরিচালনার মতো পর্যাপ্ত আয় না থাকে, কেউ যদি নিজের দেশ, জাতি, বৰ্ণ, গোত্র, নাম বা কর্ম সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলে অন্যকে বঞ্চিত করে, কারো জীবিকা যদি অনুজ্ঞাত থাকে, কেউ যদি মাংস, সুগন্ধি মাল্য, মদ্য বস্ত্র, অলঙ্কারাদিতে আসক্ত থাকে, কেউ যদি একটানা দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করে বা ঘন ঘন বিদেশে গমন করে, কেউ যদি অজ্ঞাত স্থানে গমন করে, কেউ যদি সময় অসময়ে নির্জন স্থানে বিচরণ করে, কেউ যদি ধনবানদের গৃহের সন্নিকটে গিয়ে বারংবার অন্যের সঙ্গে শলাপরামর্শের জন্য মিলিত হয়, কেউ যদি গোপনে শরীরের ক্ষতের চিকিৎসা করায়, কেউ যদি সর্বদা গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করে, কেউ যদি কারো সম্মুখে উপস্থিত হয়ে হঠাৎ সেখান থেকে তিরোহিত হয়, কেউ যদি অন্যের স্ত্রী পরিবার সম্পর্কে জানতে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে, কেউ যদি গর্হিত কর্মে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র সম্পর্কে অবহিত থাকে, কেউ যদি মধ্যরাতে বা নিষিদ্ধ সময়ে দেয়ালের ছায়ায় গোপনে চলাচল করে, কেউ যদি বিনষ্ট দ্রব্য অনুচিত সময়ে বিক্রয় নিষিদ্ধ স্থানে বিক্রয় করে, কেউ যদি বৈরীভাবাপন্ন হয়, কেউ যদি পেশায় ও জাতিতে হীন হয়, কেউ যদি নিজের স্বরূপ অন্যের কাছে গোপন করে, কেউ যদি সাধু বা ব্রহ্মচারী না হয়েও তাদের পরিচিতি চিহ্ন ব্যবহার করে, কেউ যদি পূর্ব থেকেই চৌর্যকার্যে দক্ষ হয়ে থাকে, কেউ যদি পূর্ব থেকেই গর্হিত কৃতকর্মের কারণে কুখ্যাতি অর্জন করে থাকে, কেউ যদি অপরাধ করেও ধরা না পড়ে থাকে, কেউ যদি রাজ রক্ষীদের দেখে নিজেকে আড়াল করে বা পালিয়ে যায় বা ভীত হয়ে পড়ে বা তার চোখমুখ বিবর্ণ আকার ধারণ করে, কেউ যদি অস্ত্রধারী কাউকে দেখামাত্র সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে এরা হিংসক, চোর, সম্পদ আত্মসাতকারী, আমানতের খেয়ানতকারী, অপহরণকারী, শত্রু দেশের গুপ্তচর বা কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে এ ধরনের লোকেরা বিনাপ্রশ্নে গ্রেফতারযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।

০৪-০৬-০৩ কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো দ্রব্য পাওয়া গেলে তিনি যদি তার উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাকে চুরির অপরাধে গ্রেফতার করা যাবে। কারো কোনো দ্রব্য হারিয়ে গেলে বা অপহৃত হলে উক্ত দ্রব্যের ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের অবহিত করে রাখতে হবে। ব্যবসায়ীরা যদি কারো কাছ থেকে উক্ত দ্রব্য পেয়েও তা গোপন রাখে তাহলে তাদের চুরির সহায়তাকারী হিসেবে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ব্যবসায়ী যদি অজ্ঞাত থাকে, তাহলে তাকে দণ্ডিত হতে হবে না। সংস্থাধ্যক্ষ বা পণ্য প্রশাসককে না জানিয়ে কোনো ব্যবসায়ী পুরনো দ্রব্য বন্ধক গ্রহণ বা বিক্রয় করতে পারবে না।

০৪-০৬-০৪ কারো হারানো দ্রব্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির জন্য আনীত হলে তিনি উক্ত দ্রব্যের প্রাপ্তির উৎস, এর ওজন, পরিচিতি চিহ্ন ও মূল্যসহ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে দ্রব্যটির মালিকানা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হবেন, এক্ষেত্রে যদি এ সম্পর্কিত সন্তোষজনক জবাব পাওয়া না যায়, তাহলে দ্রব্য আনয়নকারী ব্যক্তির উপর চুরির অভিযোগ প্রযোজ্য হবে এবং সে মোতাবেক তার বিরুদ্ধে জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-০৬-০৫ কোনো হারিয়ে যাওয়া দ্রব্য যদি প্রকৃত মালিক কর্তৃক যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে শনাক্ত করা হয়, তাহলে তিনি তা পুনঃপ্রাপ্তির অধিকারী হবেন। তিনি যদি এ ধরনের মালিকানা দাবি করার পর মালিকানা স্বত্বের সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার উপর প্রযোজ্য জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০৬-০৬ কোনো হারিয়ে যাওয়া দ্রব্য যদি তৃতীয় পক্ষের কাছে পাওয়া যায় এবং তিনি যদি দ্রব্যটির প্রাপ্তির উৎস সম্পর্কে ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হন এবং তদন্তে যদি এ বিষয়ক ব্যাখ্যা সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর কোনো শাস্তি আরোপিত হবে না।

০৪-০৬-০৭ কোনো ব্যক্তির যদি পোষাক পরিচ্ছদ খোয়া যায়, যূথবদ্ধ গো মহিষাদি খোয়া যায় বা কর্মস্থান থেকে দাস দাসী পালিয়ে যায় এবং এ সম্পর্কে তিনি যদি স্থান কাল ও হারানো দ্রব্য, পশু বা দাস-দাসী সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিবেদন করতে সক্ষম হন, তাহলে তাতে তার মালিকানা সম্পর্কে সন্দেহ থাকবে না। কিন্তু তিনি যদি এ বিষয়ক প্রমাণ দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েও অভিযোগ দায়ের করেন, সেক্ষেত্রে তার উপর চুরির জন্য প্রযোজ্য শাস্তি আরোপিত হবে।

০৪-০৬-০৮ কারো বাড়িতে চুরি হবার পর যদি দেখা যায়—চুরির কাজে বাড়ির পেছনের দরজা ব্যবহার করা হয়েছে, অথবা সিঁদকাটা হয়েছে, দরজা ভাঙা হয়েছে, ছাদ ভাঙা হয়েছে, জানালা কাটা হয়েছে, দেয়ালের ইট খুলে ফেলা হয়েছে বা প্রাচীরে গর্ত করা হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে সেই চৌর্যকার্জ নিজস্ব লোকদের সহায়তায় সংঘটিত হয়েছে। লক্ষণগুলোর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে বুঝতে হবে, এ চুরি বাইরের চোরদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু যদি সিঁদ কাটা ও দেয়াল কাটার চিহ্ন, দেয়ালের পরিত্যক্ত খোয়া ও সিঁদকাটার উপকরণ গৃহের ভেতরে ও বাহিরে পরিদৃষ্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে, চুরির কর্মটি ভেতরের ও বাহিরের লোকের সমন্বয়ে সম্পাদিত হয়েছে।

০৪-০৬-০৯ যদি আশঙ্কা করা হয়, গৃহের লোকদের দ্বারা চুরি সম্পাদিত হয়েছে, তাহলে ঐ বাড়িতে পাশা খেলা বা মাকদাসক্ত ব্যক্তি আছে কি না, পরপুরুষে আসক্ত নীচ বংশীয় স্ত্রীলোক আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়াও চুরির পরদিন উক্ত পরিবারে দিনে নিদ্রাযাপনকারী, পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত ব্যক্তি, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি, ভীত ব্যক্তি, অস্থির চিত্তের ব্যক্তি, প্রলাপকারী ব্যক্তি, ছিন্ন বস্ত্রের ব্যক্তি, উচ্চস্থানে আরোহণ কালে পা ফুলে যাওয়া ব্যক্তি, হাত পায়ে ক্ষতযুক্ত ব্যক্তি, বিবর্ণ চুল ও নখের ব্যক্তি, সদ্য স্নানকরা সুগন্ধি লেপনকারী ব্যক্তি, হাত পা ধৌতকারী ব্যক্তির উপস্থিতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে অনুসন্ধান চালাতে হবে এবং এভাবেই চোর বা পরস্ত্রীতে গমনকারীকে চিহ্নিত করতে হবে।

০৪-০৬-১০ এক্ষেত্রে চুরিটি যদি বাইরের চোরের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ফৌজদারী বিভাগের প্রধান বিচারক গ্রামের আধিকারিক ও নগর প্রশাসকের সহায়তায় চোর সন্ধানের পূর্বোক্ত নিয়ম অবলম্বনের মাধ্যমে চোরকে পাকড়াও করবার জন্য অনুসন্ধান চালাবেন।

সপ্তম অধ্যায় ॥ ৮২ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে মানুষের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্ত মৃতদেহ পরীক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে কোন ধরনের মৃত্যুতে কি কি উপসর্গ পরিদৃষ্ট হতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান প্রাক্কালে কি কি বিষয় বিবেচনা করতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-০৭-০১ আকস্মিকভাবে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার শরীরের ক্ষত পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে হবে। মৃত্যুকালে যদি কারো মূত্র এবং মল নির্গত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, উদর ও ত্বক ফুলে ওঠে, হাত পা স্ফীত হয়, চোখ খোলা থাকে, গলায় আঘাতের চিহ্ন পরিদৃষ্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তিটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। উপরোক্ত লক্ষণযুক্ত ব্যক্তির যদি হাত ও উরু সঙ্কুচিত অবস্থায় পরিদৃষ্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

০৪-০৭-০২ যদি মৃত ব্যক্তির হাত পা ও উদর ফুলে যায়, চোখ কোটরাগত হয়, নাভি ফুলে ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে, উক্ত ব্যক্তিকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। যদি মৃত ব্যক্তির গুদ ও চোখ কঠিন আকার ধারণ করে, জিহ্বা কামড়ানো অবস্থায় থাকে এবং উদর স্ফীত অবস্থায় থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, তাকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যদি মৃত ব্যক্তির শরীর রক্তাক্ত অবস্থায় থাকে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যক্তিকে কাষ্ঠের আঘাতে বা দড়ির আঘাতে হত্যা করা হয়েছে। যদি মৃত ব্যক্তির শরীর খুব বেশি পরিমাণে ভেঙে যায় বা ফেটে যায়, তাহলে বুঝতে হবে তাকে প্রাসাদের উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছে।

০৪-০৭-০৩ যদি মৃত ব্যক্তির হাত, পা, দাঁত, নখ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে, শরীরের মাংস, চামড়া, লোম শিথিল হয়ে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা নির্গত হয়, তাহলে বুঝতে হবে মৃত ব্যক্তিকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। উপরোক্ত লক্ষণযুক্ত মৃতের শরীরের কোনো ক্ষতস্থান থেকে যদি রক্ত নির্গত হতে দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে সাপ বা বিষাক্ত পতঙ্গের কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। যদি মৃতের শরীরের কাপড় এলোমেলো অবস্থায় থাকে, শরীরের অঙ্গ- প্রতঙ্গ অবিন্যাসিত অবস্থায় থাকে, বমি ও মল মূত্রের নির্গমন পরিদৃষ্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে তাকে ধুতুরার রস পান করিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

উপরোক্ত উপসর্গগুলো পর্যবেক্ষণ করে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে হবে। এসব উপসর্গের আলোকেই আত্মহত্যা বা অন্যের মাধ্যমে হত্যার বিষয়টিও উদ্ঘাটন করতে হবে।

০৪-০৭-০৪ বিষাক্রান্ত হয়ে যার মৃত্যু হবে, তার অভুক্ত ভোজন দ্রব্যের অংশ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় খাদ্যে বিষ মিশ্রণের বিষয়টি পরীক্ষা করতে হবে। সে খাদ্য পাখিদের খেতে দিয়ে বিষ পরীক্ষা করতে হবে (খাদ্যে বিষ থাকলে পাখি তা খাওয়ার পর মারা যাবে) খাদ্য আগুনে নিক্ষেপ করে বিষ পরীক্ষা করতে হবে (খাদ্য বিষ মিশ্রিত হলে আগুনের ধোঁয়ায় রঙধনু উদ্ভাসিত হবে)। এছাড়াও মৃতদেহ পোড়ানোর পরও যদি হৃৎপিণ্ড অদগ্ধ রয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে, নিহত লোকটিকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। বিষাক্রান্তে নিহত ব্যক্তির পরিচর্যকরা মুনিবের দ্বারা কথায় বা শারীরিকভাবে নিপীড়িত হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে তথ্য তালাশ করতে হবে, কারণ অনেক সময় নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেককে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মনিবের খাবারে বিষ প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। বা কোনো স্ত্রীলোক তার দ্বারা ব্যথিত হয়ে এ কর্ম করেছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে, কারণ প্রেমিকাদের অনেক সময় ব্যথিত হয়ে এহেন কর্ম করতে দেখা গেছে। অথবা উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুতে কোনো নিকটাত্মীয় সম্পত্তিগত দিক দিয়ে লাভবান হবে কি না তাও অনুসন্ধান করে দেখতে হবে, এহেন কারণেও অনেক বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকে। অথবা মৃত ব্যক্তির স্ত্রীকে ভোগের নিমিত্ত হাসিল করার জন্য বন্ধু সম্পৰ্কীয় কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে, এ ধরনের সম্ভাবনাও নাকচ করা যাবে না।

০৪-০৭-০৫ কোনো ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে কি কারণে সে আত্মহত্যা করেছে, অনুসন্ধান করে তার ইতিবৃত্ত উদ্ঘাটন করতে হবে। সাধারণত নিম্নোক্ত কারণে একজনের উপর অন্যজনের ক্ষোভ জন্মাতে পারে, যে কারণে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে—নারীঘটিত ক্ষোভ, সম্পত্তির উত্তরাধিকারী সম্পৃক্ত লোভ, চাকুরি বা পেশা সম্পর্কিত ঈর্ষা, প্রতিপক্ষের প্রতি দ্বেষ, বাণিজ্যিক লেনদেন বিষয়ক দ্বন্দ্ব, সংঘে প্রাধান্য বিস্তারজনিত ক্ষোভ, ইত্যাকার কারণে একের উপর অপরের ক্ষোভ জন্মাতে পারে যা প্রকারান্তরে হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

০৪-০৭-০৬ অনেক সময় অনেকে চেহারাগত সাযুজ্যের কারণে ভুলক্রমে অন্যের হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়ে থাকে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কারণ উন্মোচনের জন্য উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কারা ওঠাবসা করত, হত্যার সময় সে ব্যক্তি কার দ্বারা আহূত হয়েছিল, তখন তার সঙ্গে কে বা কারা উপস্থিত ছিল, তার সঙ্গে কে বা কারা গিয়েছিল, কে বা কারা তাকে হত্যাকাণ্ডের স্থানে নিয়ে এসেছিল, এ সব বিষয় জানার জন্য হত্যাকাণ্ডের আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে এবং হত্যার কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে।

০৪-০৭-০৭ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যেসব আত্মীয়স্বজন সম্পৃক্ত থাকবে, তারা মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকারী হবে না। তারা স্বজন হিসেবে পরিত্যক্ত বলে গণ্য হবে। এ ধরনের পতিত ব্যক্তির সঙ্গে সকল ধরনের যাজন, অধ্যাপনা, বিবাহাদি সম্পর্কিত সম্পর্ক এক বছরের মধ্যে পতিত বলে গণ্য হবে।

অষ্টম অধ্যায় ॥ ৮৩ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং উৎপীড়নের মাধ্যমে অপরাধীর স্বীকারোক্তি আদায়পূর্বক ঘটনা উদ্‌ঘাটনের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণের বিষয়ে আলোচিত হয়েছে। এ পর্যায়ে বিচারাধীন অপরাধীকে কখন দণ্ড প্রদান করা সমীচীন হবে এবং বিভিন্ন অপরাধের মানদণ্ডে কোন বর্ণের অপরাধীর জন্য কি ধরনের শাস্তি প্রযুক্ত হবে, সেসব বিষয়েও করা হয়েছে আবশ্যকীয় আলোকপাত।

০৪-০৮-০১ যে ব্যক্তির মালামাল চুরি বা লুণ্ঠিত হবে তার সম্মুখেই সন্দেহজনক অপরাধীকে জেরা করতে হবে। জেরার সময় তার দেশ, জাতি, গোত্র, নাম, পেশা, সম্পত্তি, সহকারী এবং আবাসস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হবে এবং তার জবাবের সাথে সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য মিলিয়ে দেখতে হবে, তার গ্রেফতার কালের পূর্বের অবস্থানগুলো যাচাই করতে হবে, সাক্ষ্য প্রমাণে যদি সন্দেহভাজন ব্যক্তি নিরাপরাধী বলে প্রতিপন্ন হয়, তাহলে তাকে মুক্ত করে দিতে হবে। আর যদি সে অপরাধী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, তাহলে তার উপর শাস্তি প্রযুক্ত হবে।

০৪-০৮-০২ তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেলে ঘটনা বিস্মৃতির কারণে সন্দেহভাজন কারো উপর চুরির অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না বা তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। কিন্তু তিন দিন পরও চুরির উপকরণ কারো কাছে পাওয়া গেলে তাকে আটক করা যাবে। কোনো রাজকর্মচারী যদি অচোরকে চোর হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে, তাহলে সেই রাজকর্মচারীকে চোরের জন্য প্রযোজ্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। কেউ যদি কোনো চোরকে নিজের গৃহে লুকিয়ে রাখে, তাহলে তাকে চোরের সমান শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনো চোর যদি বিদ্বেষবশত কোনো ব্যক্তিকে চোর হিসেবে সন্দেহপোষণ করে এবং সে যদি এর সত্যতা প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তি নিরাপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো রাজকর্মচারী যদি আটককৃত নিরাপরাধ ব্যক্তিকে মুক্ত করে না দেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০৮-০৩ সন্দেহভাজন চোরকে চুরি, মন্ত্রণাদাতা, সহায়ক লোকবল এবং চোরাই মালামাল সম্পর্কিত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এছাড়াও তাকে কে কে চুরিকর্মে সহায়তা প্রদান করেছে, কি কি দ্রব্য চুরি করা হয়েছে, চুরির অংশ কে কতটা পেয়েছে ইত্যাদি বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এভাবে প্রশ্নের মাধ্যমে চোরের জবাব শুনে অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করতে হবে এবং তদানুযায়ী শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

০৪-০৮-০৪ কারো চোরত্ব যদি সাক্ষ্য প্রমাণাদি দ্বারা সমর্থিত না হয়, কিন্তু সে যদি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এলোমেলো কথা বলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে এমনতরো ব্যক্তিকে অচোর বলেই গণ্য করতে হবে। কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে চোর হিসেবে প্রতিপন্ন করার আগে সাক্ষ্য প্রমাণের দ্বারা ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া আবশ্যক। দেখা যায়, অনেক সময় অনেকে রাস্তায় হাঁটার সময় চোরদের সাথে গ্রেফতার হয়ে যায়, অনেকে চোরের মতো বেশভূষায় থাকায় বা চুরিকৃত মালামালের কাছে অবস্থান করায় চোরদের সমগোত্রীয় হিসেবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অতঃপর আটকাবস্থায় রাজরক্ষীদের শারীরিক অত্যাচারের ভয়ে নিজেকে চোর হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এসব কারণে শাস্তির অনুপযুক্ত সাধারণ লোকেরা যাতে শাস্তির শিকার না হয় সে লক্ষ্যে ভালোভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে অপরাধী এবং নিরাপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তি প্রদান করতে হবে।

০৪-০৮-০৫ সামান্য অপরাধের জন্য নাবালক, বয়স্ক, রোগাক্রান্ত, নেশাগ্রস্ত, উন্মত্ত, ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ক্লান্ত পথিক, অধিক ভোজনকারী এবং দুর্বল লোকদের কষ্টদায়ক শাস্তি দেওয়া যাবে না। একই চরিত্রের অধিকারী পতিতা, পথিককে জল প্রদানকারী, উপদেশ দানকারী, বাসস্থানের যোগানদাতা ও ভোজন দাতারা গুপ্তচরের কাজ করবে এবং কৌশলে চোরদের মালামাল রাখার স্থান ও অবস্থান শনাক্ত করবে।

০৪-০৮-০৬ সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরই অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে গর্ভবতী ও এক মাসের কম সময়ের প্রসূতি মাতাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করা যাবে না। কোনো অপরাধের আলোকে পুরুষের জন্য যে শাস্তি প্রযোজ্য হবে, নারীদের ক্ষেত্রে একই অপরাধে সেই শাস্তি হবে অর্ধেক, কোনো কারণে সেই অর্ধেক শাস্তিও যদি প্রদান করা সম্ভব না হয় তাহলে তাদের শব্দ প্রয়োগ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ এবং তপস্বীগণকে গুপ্তচরদের মাধ্যমে এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করিয়ে কষ্টকর পরিভ্রমণ সম্পৃক্ত শাস্তি প্রদান করতে হবে। কোনো রাজকর্মচারী যদি বিধিবদ্ধ শাস্তির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ইচ্ছেমতো শাস্তি প্রদান করে এবং এতে যদি কারো মৃত্যু ঘটে, তাহলে তার উপর উত্তম সাহসদণ্ড তথা ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০৮-০৭ চৌর্যবৃত্তির অপরাধে চার ধরনের শাস্তির বিধান নির্দিষ্ট করা আছে—১. ছয়টি লাঠির ঘা ২. সাতটি বেত্রাঘাত ৩. দুই হাত পিঠমোড়া করে বন্ধন এবং সাথে মস্তক বন্ধন ৪. নাকে লবণযুক্ত জল সঞ্চালন। অপরাধ অধিক হলে এই শাস্তি যে চোদ্দ ধরনের হতে পারে তা হলো—১. নয় হাত দীর্ঘ বেত্র দিয়ে বারোটি আঘাত ২. দড়ি দিয়ে দুই উরু বন্ধন ৩. উরুর সাথে মস্তক বন্ধন ৪. করঞ্জ লতা দিয়ে কুড়িটি প্রহার ৫. বত্রিশবার চপেটাঘাত ৬. বাঁ হাত পিঠের দিকে নিয়ে বাঁ পায়ের সাথে বন্ধন ৭. ডান হাত পিঠের দিকে নিয়ে ডান পায়ের সাথে বন্ধন ৮. দুই হাত উপরের দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া ৯. দুই পা উপরের দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া ১০. হাতের নখে সুঁচ প্রবিষ্ট করা ১১. জইয়ের মণ্ড পান করিয়ে প্রসাব অবরুদ্ধ করে রাখা ১২. আগুনের তাপে আঙুলের এক কর পর্যন্ত দগ্ধ করানো ১৩. তেল ও ঘি জাতীয় দ্রব্য পান করিয়ে পূর্ণদিন সূর্যের তাপে অবস্থান করানো ১৪. শীতকালে বল্বজা ঘাসের সুঁচালো অংশ দিয়ে প্রস্তুতকৃত ভেজা শয্যায় শোয়ানো।

০৪-০৮-০৮ দণ্ডিত লোকদের দিয়ে এক একদিন এক এক ধরনের পরিশ্রমসাধ্য কাজ করিয়ে নিতে হবে। যে ব্যক্তি আগের থেকেই চুরির কাজে লিপ্ত, যে ব্যক্তি প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে চুরি করবে, চুরিকৃত দ্রব্যের অংশবিশেষ যার কাছে পাওয়া যাবে, যে চুরি করে পালাবার সময় মালামাল সমেত ধরা পড়বে, যে ব্যক্তি রাজার ধন লুকাবার সময় ধরা পড়বে, যে ব্যক্তি হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করবে, সেসব ব্যক্তিকে রাজার নির্দেশ অনুসারে প্রতিটি শাস্তিই একবার করে ভোগ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের উপর বার বার শাস্তি আরোপ করতে হবে।

০৪-০৮-০৯ অপরাধ যতই গুরুতর হোক না কেন ব্রাহ্মণদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করা যাবে না। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণরা যাতে করে সমাজের কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে না পারে এবং সমাজের কোনো ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করতে না পারে, তজ্জন্য তাদের কপালে কৃত অপরাধের চিহ্ন এঁকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে নগদ অর্থ চুরির জন্য কপালে কুকুরের চিহ্ন, মানুষ হত্যার জন্য কপালে কবন্ধ চিহ্ন, গুরুর স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করলে কপালে স্ত্রীযোনির চিহ্ন এবং মদ্যপানের জন্য মদ্যপতাকার চিহ্ন কপালে এঁকে দিতে হবে। অতঃপর এ ধরনের পাপাচারীকে রাজা দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন অথবা বসবাসের জন্য খনি এলাকায় পাঠিয়ে দিবেন।

নবম অধ্যায় ॥ ৮৪ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে রাজার সকল বিভাগের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। একই সাথে এ পর্যায়ে রাজসম্পত্তি বা অর্থ আত্মসাৎ করা হলে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তার উপর কি ধরনের শাস্তি ও জরিমানা আরোপিত হবে সে সব বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৪-০৯-০১ কোনো রাজকর্মচারী যদি খনি হতে রত্ন সংগ্রহের সময় বা কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় মূল্যবান কোনো রত্নসম্ভার আত্মসাৎ করে, তাহলে শাস্তি হিসেবে তার উপর শুদ্ধবদ দণ্ড প্রযুক্ত হবে অর্থাৎ তাকে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হবে। কোনো রাজকর্মচারী যদি কারখানা থেকে স্বল্পমূল্যমানের কার্পাস বস্তু, কাষ্ঠের আসবাব বা এ জাতীয় পণ্যদ্রব্য আত্মসাৎ করে, তাহলে তার উপর পূর্ব সাহসদণ্ড তথা ২৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-০৯-০২ উৎপাদন স্থল থেকে কেউ যদি সরকারি পণ্যের এক মাষ মূল্য থেকে চার মাষ মূল্যমানের কোনো পণ্য আত্মসাৎ করে, তাহলে দায়ী ব্যক্তির উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে চার মাষ মূল্য থেকে আট মাষ মূল্যের কোনো পণ্য আত্মসাৎ করা হলে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। আত্মসাৎকৃত পণ্যের মূল্য আট থেকে বারো মাষ হলে ৩৬ পণ জরিমানা প্রদেয় হবে। পণ্যমূল্য ১ থেকে ২ পণ হলে ২৫০ পণ জরিমানা প্রদেয় হবে। এই মূল্য দুই থেকে চার পণ হলে প্রদেয় জরিমানা হবে ৫০০ পণ। পণ্য মূল্য চার থেকে আট পণ হলে এই জরিমানা হবে ১০০০ পণ এবং আত্মসাৎকৃত সরকারি পণ্যদ্রব্যের মূল্যমান যদি আট থেকে দশ পণ হয়, তাহলে উক্ত অপরাধীকে কৃত অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।

০৪-০৯-০৩ সরকারি ধান মজুদের কোষ্ঠাগার, পণ্য মজুদের পণ্যাগার, বনজাত দ্রব্য মজুদের কুপ্যাগার, অস্ত্র মজুদের আয়ুধাগার থেকে কোনো দ্রব্য অপহরণ করা হলে পূর্বোক্ত মূল্যমানের নিরিখেই জরিমানা আরোপিত হবে। সরকারি কোষাগার, ভাণ্ডার, রত্নালঙ্কার তৈরির অক্ষশালা থেকে চারের এক মাষ বা এক কাকণী থেকে এক মাষ মূল্যমানের কোনো পণ্যদ্রব্য অপহরণ করা হলে দায়ী কর্মচারীর বিরুদ্ধে পূর্বোক্ত জরিমানার দ্বিগুণ আরোপিত হবে। যদি কোনো রাজকর্মচারী নিজে কোনোকিছু আত্মসাৎ করে অন্যের উপর তার দায় চাপিয়ে দেয় বা অন্যজনকে চোর সাব্যস্ত করে, তাহলে উক্ত রাজকর্মচারীর উপর দণ্ড হিসেবে চিত্রঘাত বা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ড আরোপিত হবে।

০৪-০৯-০৪ কোনো রাজকর্মচারী কর্তৃক যদি নগর বহির্ভূত এলাকায় দিনের বেলায় গোপন পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে শস্য মাড়ানো ভূমি, বাড়ি বা দোকান হতে ১ থেকে ৪ মাষ মূল্যের বনজদ্রব্য, আসবাবপত্র বা প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি উপকরণ অপহরণ করা হয়, তাহলে কৃত অপরাধের জন্য তার উপর দণ্ড হিসেবে ৩ পণ জরিমানা আরোপিত হবে অথবা উক্ত অপরাধীর শরীরে গোবর লেপন করে বিকট শব্দের বাদ্য বাজিয়ে নগরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করাতে হবে। অপহরণকৃত ওইসব দ্রব্যের মূল্য ৫ থেকে ৮ মাষ হলে অপরাধীর উপর ৬ পণ জরিমানা আরোপিত হবে অথবা উক্ত অপরাধীর শরীরে গোবর ও ছাইভস্ম লেপন করে বাদ্য বাজিয়ে তার চৌর্যবৃত্তির কথা ঘোষণা করতে করতে সারা নগর প্রদক্ষিণ করাতে হবে। অপহরণকৃত দ্রব্যের মূল্য ৯ থেকে ১২ মাষ হলে তার উপর ৯ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে অথবা একই তরিকায় সারা নগরে ঘোরাতে হবে। দ্রব্যমূল্য ১৩ থেকে ১৬ মাষ হলে ১২ মাষ জরিমানা প্রযুক্ত হবে অথবা মস্তকমুণ্ডন করে উক্ত অপরাধীকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে হবে। অপহরণকৃত দ্রব্যের মূল্য ১৭ থেকে ৩২ মাষ হলে অপরাধীর উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে অথবা মস্তকমুণ্ডন করে ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। ৪ পণ বা ৬৪ মাষ পর্যন্ত মূল্যমানের দ্রব্য অপহরণ করা হলে অপরাধীকে ৩৬ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। ৫ পণ মূল্যের দ্রব্য অপহরণ করা হলে প্রদেয় জরিমানা হবে ৪৮ পণ। অপহরণকৃত দ্রব্যের মূল্য ১০ পণ, ২০ পণ এবং ৩০ পণ হলে আরোপিত জরিমানা হবে যথাক্রমে ২৫০ পণ, ৫০০ পণ এবং ১০০০ পণ। ৫০ পণ পর্যন্ত মূল্যমানের দ্রব্যাদি অপহরণ করলে অপরাধীর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।

০৪-০৯-০৫ কেউ যদি দিন বা রাত্রির নিষিদ্ধ সময়ে বলপূর্বক কারো কাছে গচ্ছিত কোনো দ্রব্য অপহরণ করে, তাহলে অপহৃত দ্রব্যের মূল্য পূর্বে বর্ণিত দ্রব্যমূল্যের অর্ধেক হলেও তার উপর দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হবে। রাতে সশস্ত্র অবস্থায় এ ধরনের কাজ করলে দ্রব্যমূল্য পূর্বের চেয়ে চারের এক ভাগ হলেও অপরাধীর উপর দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি কোনো গৃহস্বামীর সনদ বা সীলমোহর জাল করে, তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। রাজকীয় প্রশাসক ও সমাহর্তা বা মুখ্য প্রশাসকের সনদ কিংবা সীলমোহর জাল করা হলে অপরাধীর উপর যথাক্রমে ৫০০ এবং ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে কেউ যদি রাজার সনদ বা সীলমোহর জাল করে তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

০৪-০৯-০৬ বিচারকার্যের সময় কোনো বিচারক যদি বিবাদী পক্ষের কাউকে অঙ্গুলি উঁচিয়ে ভীতিপ্রদর্শন করেন, কঠোর বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে ভর্ৎসনা করেন, বিচারালয় থেকে তাড়িয়ে দেন বা উৎকোচ নিয়ে বিপর্যস্ত করেন, তাহলে উক্ত বিচারকের উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়াও বিচারক যদি বাদী বা বিবাদীদের কাউকে গালিগালাজ করেন বা অপশব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে অপদস্থ করেন, তাহলে তার উপর দ্বিগুণ দণ্ড তথা ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-০৯-০৭ বিচার চলাকালে বিচারক যদি উপযুক্ত সাক্ষীকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেন, জিজ্ঞাসার অযোগ্য সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, কাউকে জেরা করা সত্ত্বেও যদি বক্তব্য শ্রবণ না করে অব্যাহতি প্রদান করেন, সাক্ষীকে যদি জবাব শিখিয়ে দেন, ভুলে যাওয়া কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তাহলে এ ধরনের বিচারকের উপর দণ্ড হিসেবে ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। যেসব বিচারক বিচার্য ঘটনা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে অজ্ঞাত কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সত্যবাদী সাক্ষীকে চাতুর্যের মাধ্যমে মিথ্যেবাদী বলে প্রতিপন্ন করেন, অনর্থ কালক্ষেপণ করে সাক্ষীদের হয়রানি করেন, সঠিক বক্তব্যকে ব্যতিক্রমী বক্তব্য হিসেবে গণ্য করেন, সাক্ষীদের পরামর্শ প্রদান করেন, নিষ্পত্তিকৃত বিষয় পুনর্বার বিচারের জন্য উপস্থাপন করেন, সেসব বিচারকের উপর দণ্ড হিসেবে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। একবার এ ধরনের অপরাধ করে দণ্ডিত হবার পরেও কোনো বিচারক পুনর্বার একই অপরাধে অভিযুক্ত হলে তার উপর দ্বিগুণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে এবং তাকে বিচারকের পদ হতে পদচ্যুত করতে হবে।

০৪-০৯-০৮ বিচারালয়ে কর্মরত কোনো করণিক যদি প্রয়োজনীয় বক্তব্য লিপিবদ্ধ না করে অপ্রয়োজনীয় কথা লিপিবদ্ধ করে, না বলা কথা লিপিবদ্ধ করে, প্রদত্ত বক্তব্য হুবহু না লিখে সংশোধন করে লিপিবদ্ধ করে, সত্য বক্তব্য বিকৃত করে লিপিবদ্ধ করে, ইচ্ছেমাফিক কাল্পনিক বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে, তাহলে উক্ত করণিকের উপর দণ্ড হিসেবে ২৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-০৯-০৯ কোনো বিচারক যদি নিরাপরাধ ব্যক্তির উপর জরিমানা আরোপ করেন, তাহলে উক্ত বিচারককে কৃত অপরাধের জন্য জরিমানাকৃত অর্থের দ্বিগুণ অর্থদণ্ড হিসেবে প্রদান করতে হবে। কোনো বিচারক যদি অপরাধীকে অপরাধের মাত্রানুযায়ী যথাযথ জরিমানা আরোপ না করে কম বা বেশি জরিমানা আরোপ করেন, তাহলে তিনি যে পরিমাণ কম বা বেশি জরিমানা আরোপ করবেন তার আটগুণ জরিমানা তার উপর আরোপিত হবে।

শাস্তির অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে যদি শারীরিক শাস্তি প্রদান করা হয়, তাহলে শাস্তির আদেশদাতা বিচারককেও অনুরূপ শারীরিক শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনো বিচারক যদি মামলার বিজিত পক্ষকে প্রাপ্য অর্থ প্রদান না করেন, তাহলে তাকে উক্ত পরিমাণ অর্থের আটগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

০৪-০৯-১০ হাজতখানায় অবস্থানকালে কোনো কর্মচারী যদি হাজতির ঘুম, ভোজন ও মলমূত্র ত্যাগের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে বা অন্যায়ভাবে বন্দিকে বেঁধে রাখে তাহলে উক্ত কর্মচারীর উপর উত্তরোত্তর তিন পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো কর্মচারী যদি বিচারকের হাজতখানা থেকে কোনো অভিযুক্তকে মুক্ত করে দেয় বা বন্দিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে তাহলে উক্ত কর্মচারীর উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে, একই সাথে পলায়িত অপরাধীর প্রদেয় জরিমানাও উক্ত কর্মচারীকে পরিশোধ করতে হবে। কোনো কর্মচারী যদি কারাবন্দি কোনো অপরাধীকে মুক্ত করে দেয় বা কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে, তাহলে রাজা তার সর্বস্ব হরণ করবেন এবং তাকে তার কৃত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবেন।

০৪-০৯-১১ বিচারককে অবহিত না করে কোনো কারাধ্যক্ষ যদি কোনো করেদিকে কারাগারের বাইরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেন তাহলে উক্ত কারাধ্যক্ষের উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কারাধ্যক্ষ যদি কয়েদিদের দিয়ে কোনো কাজ করান বা তাদের উপর নিপীড়ন করেন, তাহলে তার উপর দ্বিগুণ তথা ৪৮ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। তিনি যদি কোনো কয়েদিকে স্থানান্তরিত করেন, খানাপিনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেন, তাহলে তাকে ৯৬ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে। তিনি যদি কয়েদিকে উৎপীড়ন করেন বা উৎকোচ প্রদানে বাধ্য করেন, তাহলে তার উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কারাধ্যক্ষ কর্তৃক কোনো কয়েদিকে হত্যা করা হলে দণ্ড হিসেবে তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-০৯-১২ কোনো কারারক্ষী যদি বিবাহিতা, বিক্রিত বা বন্ধকী দাসী কয়েদির উপর ব্যাভিচার করে, তাহলে উক্ত কারারক্ষীর উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। চোর বা রাজদ্রোহীর স্ত্রী কারাগারে অবরুদ্ধ থাকাকালে কোনো কারাকর্মী যদি তার উপর ব্যাভিচার করে, তাহলে উক্ত অপরাধীর উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কারাগারে অবরুদ্ধ কোনো আর্যা বা সম্ভ্রান্ত নারীর উপর ব্যাভিচার করা হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। কারাগারে অবরুদ্ধ কোনো পুরুষ কয়েদি যদি উপরোক্ত নারী কয়েদিদের কারো সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে কারাগারের অভ্যন্তরেই উক্ত অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। কারাধ্যক্ষ যদি অবরুদ্ধা কোনো দাসীর উপর ব্যাভিচার করেন, তাহলে তার উপর প্রথম সাহসদণ্ড তথা ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে কিন্তু তিনি যদি কোনো আর্যা তথা সম্ভ্রান্ত নারীর উপর ব্যাভিচার করেন, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

০৪-০৯-১৩ বিচারকের হাজতখানা না ভেঙে বাইরের কেউ যদি কোনো অবরুদ্ধ আসামিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে, তাহলে তার উপর মধ্যম সাহসদণ্ড তথা ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যদি হাজতখানা ভেঙে আসামিকে পালিয়ে যেতে সাহায়তা করে, তাহলে তার উপর মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হবে। বিচারক কর্তৃক নিযুক্ত কোনো কারারক্ষী যদি এ ধরনের কাজে সহায়তা করে, তাহলে তার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে তার উপর বধদণ্ড তথা মৃত্যুদণ্ড আরোপিত হবে। এইভাবে অপরাধের মাত্রানুযায়ী শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে রাজা তার অধীনস্থ প্রশাসক ও রাজ কর্মচারীদের দোষত্রুটি, অসততা উৎপাটন করে তাদের নিষ্কলুষ করবেন তথা তাদের কণ্টকশোধন করবেন, অতঃপর ওই নিষ্কলুষ রাজকর্মচারীরা দণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে নগর ও জনপদে সংঘটিত অপরাধ নির্মূল করবে তথা কণ্টক শোধন করবে।

দশম অধ্যায় ॥ ৮৫ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বিবিধ অপরাধের মাত্রানুযায়ী শাস্তি হিসেবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ছেদন সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। শাস্তি হতে পরিত্রাণের জন্য প্রদেয় নিষ্ক্রিয়মূল্য সম্পর্কেও করা হয়েছে বিস্তারিত আলোচনা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীকে পীড়ন করা হলে বা হত্যা করা হলে কি ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে প্রাসঙ্গিকভাবে সেসব বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

০৪-১০-০১ যারা কোনো তীর্থক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত উৎসবাদিতে আগত লোকদের বস্ত্রাদি চুরি করবে, সিঁদকেটে কারো বাড়িতে চুরি করবে এবং বাড়ির ছাদ ভেঙে চৌর্যকার্য করবে, শাস্তি হিসেবে এই তিন প্রকৃতির চোরের শরীর থেকে সাঁড়াশি দিয়ে মাংস তুলে নিতে হবে অথবা এদের হাতের কনিষ্ঠা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিতে হবে অথবা ৫৪ পণ জরিমানা তথা নিষ্ক্রিয়মূল্য গ্রহণ সাপেক্ষে এদের অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।

এ ধরনের চোরেরা যদি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করে, তাহলে এদের হাতের সমস্ত আঙুল কেটে দিতে হবে অথবা এদের উপর নিষ্ক্রিয়রূপে ১০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। এরা যদি তৃতীয়বারের মতো একই অপরাধে অপরাধী হয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে এদের ডান হাত কর্তনযোগ্য হবে অথবা নিষ্ক্রিয়রূপে এদের উপর ৪০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। চতুর্থবারের মতো একই ধরনের অপরাধ প্রবণতা পরিদৃষ্ট হলে, এদের উপর প্রশান্তির মৃত্যু বা চিত্রঘাত তথা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর শাস্তি আরোপ করতে হবে।

০৪-১০-০২ কেউ অনধিক ২৫ পণ মূল্যমানের মুরগি, বেজি, বিড়াল, কুকুর এবং শূকর চুরি বা হত্যা করলে, তার উপর ৫৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে, জরিমানা প্রদানে অক্ষম হলে অপরাধীর নাক ছেদন করতে হবে। কিন্তু চণ্ডাল বা অরণ্যচারীরা এসব প্রাণীর স্বত্বাধিকারী হলে উপরোক্ত অপরাধের জন্য অপরাধীর উপর অর্ধেক দণ্ড প্ৰযুক্ত হবে।

০৪-১০-০৩ ফাঁদ পেতে, জাল পেতে বা প্রতারণার মাধ্যমে গর্তে নিপতিত করে কোনো হরিণ, হিংস্ৰজন্তু বা জলজ প্রাণীকে যদি চুরির নিমিত্ত আটক করা হয়, তাহলে উক্ত চোরের উপর চুরিকৃত পশুর সমমূল্যের অর্থ জরিমানা আরোপিত হবে। মৃগবন ও দ্রব্যবন তথা চন্দনবৃক্ষের অরণ্য থেকে কোনো পশু বা বনজদ্রব্য চুরি করা হলে, চোরের উপর ১০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। বিচিত্র বর্ণের গিরগিটি জাতীয় প্রাণী, ক্রীড়ারত মৃগ এবং শুকপাখি চুরি বা হত্যা করা হলে, অপরাধী চোরের উপর দ্বিগুণ তথা ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১০-০৪ কারুশিল্পী, সূক্ষ্মকারুকার্যের শিল্পী, কুশীলব এবং তপস্বীদের কোনো ক্ষুদ্র দ্রব্য চুরি করা হলে, চোরের উপর ১০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে চোর কর্তৃক উক্ত প্রকৃতির লোকদের বড় কিছু চুরি করা হলে, চোরের উপর দ্বিগুণ তথা ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এদের কৃষিকার্যে ব্যবহার্য উপকরণ চুরি করা হলে, চোরের উপর একই ধরনের তথা ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি অনুমতি ব্যতিরেকে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অথবা দুর্গে অবস্থানরত কেউ যদি তার কাছে রক্ষিত অন্যের গচ্ছিত আমানত নিয়ে দেয়ালের ছিদ্র বা গলিপথ ধরে পালিয়ে যায়, তাহলে শাস্তি হিসেবে তার দুপায়ের পেছনের রগ কর্তন করতে হবে (কন্ধরা বধদণ্ড) অথবা তার উপর ২০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-১০-০৫ নৌকা, শকট বা চতুষ্পদি জন্তু চুরি করলে, শাস্তি হিসেবে চোরের এক পা কেটে ফেলতে হবে অথবা চোরের উপর ৩০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। জুয়া খেলার সময় কেউ যদি কড়ি, পাশা, জুয়ার পাত্র এবং শলাকা তথা খেলার কোনো উপকরণ চাতুরির সঙ্গে ব্যবহার করে, খেলোয়াড়দের ধোঁকা দিয়ে কৌশলে প্রতারণামূলক কড়ির চাল দেয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে তার একটি হাত কেটে ফেলতে হবে অথবা কৃত অপরাধের জন্য তার উপর ৪০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১০-০৬ কোনো নারী কর্তৃক চুরির কাজে বা ব্যাভিচারের কাজে কাউকে সহায়তা করা হলে, কৃত অপরাধের শাস্তি হিসেবে উক্ত নারীর নাক ও কান কর্তন করতে হবে অথবা তার উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। এহে সহায়তাকারী যদি পুরুষ হয়ে থাকে তাহলে কৃত অপরাধের শাস্তি হিসেবে তার নাক কান কর্তন করতে হবে অথবা তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। কেউ যদি গরু, মহিষ বা অশ্ব জাতীয় মহাপশু চুরি করে বা দাস দাসীকে অপহরণ করে বা মৃত ব্যক্তির বস্ত্র ও ব্যবহৃত দ্রব্য চুরি করে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে উক্ত অপরাধীর দুই চরণ কর্তন করতে হবে অথবা তার উপর ৬০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে।

০৪-১০-০৭ কেউ যদি নিজ অপেক্ষা উচ্চবর্ণের কোনো ব্যক্তিকে বা গুরুজনকে হাত বা পা দিয়ে আঘাত করে, রাজার শকটে বা ঘোড়ার গাড়িতে আরোহণ করে, তাহলে কৃত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির একটি হাত ও একটি পা কর্তন করতে হবে। অথবা এর পরিবর্তে অপরাধীকে ৭০০ পণ জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। কোনো শূদ্র যদি নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসেবে ঘোষণা দেয়, কেউ যদি দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত দ্রব্য লুকিয়ে অপহরণ করে, কোনো দৈবজ্ঞ যদি রাজার ভবিষ্যত সম্পর্কে অশুভ মন্তব্য করে, কোনো বৈদ্য যদি ভুল চিকিৎসা করে কারো চোখ বিনষ্ট করে দেয়, তাহলে কৃত অপরাধের জন্য এসব ব্যক্তির দুটি চোখ বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে বিনষ্ট করে দিতে হবে। অথবা এই শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেতে হলে অপরাধীদের ৮০০ পণ জরিমানা পরিশোধ করতে হবে।

০৪-১০-০৮ কেউ যদি আটককৃত কোনো পরস্ত্রীগামী লম্পট বা চোরকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়, কেউ যদি রাজার আদেশ কমিয়ে বা বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করে, কেউ যদি কোনো দাসী বা কন্যাকে অলঙ্কারসহ অপহরণ করে, কেউ যদি প্রতারণামূলক লেনদেন করে এবং কেউ যদি ভক্ষণ নিষিদ্ধ শৃগালের মাংস বিক্রয় করে, তাহলে এমনতরো অপরাধীর বাম হাত এবং দুটি পা কর্তন করতে হবে। অথবা তৎপরিবর্তে তার উপর নিষ্ক্রিয় দণ্ড হিসেবে ৯০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। কেউ যদি মানুষের মাংস বিক্রি করে তাহলে তার উপর মৃত্যুদণ্ড আরোপিত হবে।

০৪-১০-০৯ কেউ যদি দেবতার সাথে সম্পর্কিত পশু, দেব প্রতিমা, মন্দির সম্পৃক্ত দাস দাসী, দেব সম্পর্কিত ভূমি ও ফসল, মন্দির সংলগ্ন গৃহ, দেবতাকে উৎসর্গকৃত অর্থ বা অলঙ্কার আত্মসাৎ বা অপহরণ করে, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে অথবা তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। শাস্তি তথা দণ্ড প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত বিচারক, প্রশাসক ও রাজ অমাত্যরা অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধের কারণ ও অপরাধের গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক স্থান কাল পাত্র ভেদে অপরাধীর শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ করে প্রথম সাহস-দণ্ড, মধ্যম সাহস-দণ্ড ও উত্তম সাহস-দণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।

একাদশ অধ্যায় ॥ ৮৬ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কিত বিষয় আলোচিত হয়েছে। অপরাধের মাত্রানুযায়ী অপরাধীর যন্ত্রণামূলক মৃত্যুদণ্ড হতে পারে আবার যন্ত্রণাহীন মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। কোনো অপরাধের জন্য কি ধরনের মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হবে, সেসব বিষয়েও এ পর্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

০৪-১১-০১ কলহ বিবাদকালে কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করা হলে, শাস্তি হিসেবে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে চিত্রঘাত তথা উৎপীড়নমূলক বধদণ্ডাদেশ আরোপিত হবে। বিবাদকালে কাউকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হলে, আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি সাতদিন পর মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে শুদ্ধঘাত তথা বিনা উৎপীড়নের মৃত্যদণ্ডাদেশ আরোপিত হবে। উক্ত আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির যদি পনেরো দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটে, তাহলে আঘাতকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। আহত ব্যক্তি এক মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলে অপরাধীর বিরুদ্ধে ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং চিকিৎসাকালীন অবস্থায় সমস্ত ব্যয় আঘাতকারীকে বহন করতে হবে। অস্ত্রের দ্বারা কাউকে আঘাত করা হলে শাস্তি হিসেবে আঘাতকারীর উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। কেউ যদি দাম্ভিক-দর্পে কাউকে প্রহার করে, তাহলে শাস্তি হিসেবে প্রহারকারীর হাত কর্তন করতে হবে। ভ্রম বা আবেগের বশবর্তী হয়ে কেউ কাউকে প্রহার করলে প্রহারকারীর বিরুদ্ধে ২০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে, এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড আরোপিত হবে। প্রহারের মাধ্যমে স্ত্রীলোকের গর্ভপাত ঘটালে অপরাধীর উপর ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো নারীর গর্ভনাশ করা হলে অপরাধীর উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কষ্টকর কর্মানুষ্ঠানে কাজ করিয়ে যদি কারো গর্ভপাত ঘটানো হয়, তাহলে অপরাধীর উপর ২৫০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-১১-০২ যারা বল প্রয়োগ করে কোনো নারী বা পুরুষকে হত্যা করবে, বলপূর্বক কোনো নারীকে অপহরণ করবে, জোর করে কারো নাক বা কান কেটে নিবে, দম্ভের সঙ্গে চুরি বা হত্যা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করবে, নগর বা গ্রাম থেকে জোর করে দ্রব্য অপহরণ করবে, সিঁদ-কেটে বাড়ির ভেতর চুরি করবে, পথের পার্শ্বস্থ পান্থশালা বা পানীয়শালায় চুরি করবে, রাজার হাতি বা রথের ক্ষতিসাধন করবে, তাদের উপর শাস্তি হিসেবে বধদণ্ড প্রযুক্ত হবে তথা এ জাতীয় অপরাধীদের শূলে চড়িয়ে হত্যা করতে হবে।

০৪-১১-০৩ এ সমস্ত শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার পর কেউ যদি তাদের শূল থেকে অপসারিত করে বা মৃতদেহ দাহ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকেও অনুরূপভাবে শূলে চড়িয়ে হত্যা করতে হবে বা তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা আরোপ করতে হবে। খুনি ও চোরকে যে বা যারা আশ্রয় প্রদান করবে, ভোজন করাবে, অপরাধের উপকরণ যোগান দিবে, পরামর্শ প্রদান করবে বা সহায়তা প্রদান করবে, তার বা তাদের উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। অজ্ঞতাবশত কেউ যদি চোর বা খুনিকে ভোজন করায় তার ক্ষেত্রে উপরোক্ত শাস্তি প্রযোজ্য হবে না, তবে তিনি তিরস্কৃত হবেন। খুনি ও চোরের স্ত্রী, সন্তানেরা যদি অপরাধকর্ম সম্পাদনার্থে অপরাধীকে প্ররোচিত না করে, তাহলে তারা নিরপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু তারা যদি মন্ত্রণা বা পরামর্শ দিয়ে হত্যা বা চুরিকর্মে মদদ জোগায়, তাহলে তাদের গ্রেফতার করে সমুচিত শাস্তি প্ৰদান করতে হবে।

০৪-১১-০৪ যারা রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারে ব্রতী হবে, রাজান্তঃপুর আক্রমণে উদ্যত হবে, রাজার শত্রুদের উস্কানি প্রদান করবে, নগর বা জনপদের লোকজনের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ ছড়াবে, রাজার বিরুদ্ধে রাজসেনাদের বিদ্রোহী করে তুলবে, শাস্তি হিসেবে মাথা ও হাতের তালুতে আগুন রেখে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। কোনো ব্রাহ্মণ যদি রাজ তখত্রে দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে তথা সিংহাসনে আসীন হতে উৎসুক হয়, তাহলে তার বহির্বিচরণ নিষিদ্ধ করে তাকে অন্ধকার কুঠুরিতে আবদ্ধ করে রাখতে হবে।

০৪-১১-০৫ কেউ যদি বাবা, মা, ভাই, বোন, সন্তান, আচার্য বা তপস্বীকে হত্যা করে তাহলে অপরাধের শাস্তি হিসেবে হত্যাকারীর মাথা থেকে চামড়া খুলে নিয়ে মাথায় আগুন রেখে তাকে হত্যা করতে হবে। পিতা মাতার নিন্দা করলে বা তাদের গালমন্দ করলে শাস্তি হিসেবে অপরাধীর জিহ্বা কর্তন করতে হবে। শরীরের যে অঙ্গ দিয়ে পিতা মাতার শরীর বিক্ষত করা হবে, শাস্তি হিসেবে সন্তানের সে অঙ্গ কর্তন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অকস্মাৎ অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে বা পশুর পাল (১০টি পশু) অপহরণ করা হলে, উক্ত অপরাধীকে উৎপীড়নহীন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে।

০৪-১১-০৬ কেউ যদি জলে পরিপূর্ণ কোনো বাঁধ বিনষ্ট করে বা ভেঙে দেয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে উক্ত ব্যক্তিকে ওই জলাশয়ের পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করতে হবে। জলহীন বাঁধের ক্ষতিসাধন করলে অপরাধীর উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। আগের থেকে জীর্ণ কোনো বাঁধের ক্ষতিসাধন করা হলে অপরাধীর উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কেউ যদি অন্য কাউকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে বা কোনো অগর্ভবতী নারী যদি কোনো পুরুষকে হত্যা করে, তাহলে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করতে হবে। স্বামী, শিক্ষক ও সন্তানকে যে নারী হত্যা করবে, যে নারী পরের ঘরে আগুন লাগাবে, যে নারী বিষ প্রয়োগ করে কাউকে হত্যা করবে বা যে নারী সিঁধকেটে পরের ঘরে চুরি করবে, শাস্তি হিসেবে সে নারীকে গরুর পদাঘাতের মাধ্যমে হত্যা করতে হবে।

০৪-১১-০৭ যে ব্যক্তি কর্তৃক গোচারণ ভূমিতে, ফসলের ক্ষেতে, ধান মাড়াইয়ের স্থানে, কারো বাসগৃহে, বনজ সম্পদের অরণ্যে এবং হস্তির চারণভূমিতে আগুন লাগানো হবে, শাস্তি হিসেবে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে হবে। যে ব্যক্তি রাজার প্রতি নিন্দাজ্ঞাপন করবে, রাজার সঙ্গে কৃত আলোচিত বিষয় ফাঁস করবে, রাজার মৃত্যু বা অনিষ্ট বার্তা প্রচার করবে, ব্রাহ্মণের রন্ধনশালা থেকে খাদ্য চুরি করে ভোজন করবে, শাস্তি হিসেবে উক্ত ব্যক্তির জিহ্বা উৎপাটন করতে হবে বা কেটে দিতে হবে। কোনো অসৈনিক যদি কারো হাতিয়ার বা সৈনিকের রক্ষাকবচ চুরি করে, তাহলে শাস্তি হিসেবে তাকে তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে। কিন্তু কোনো সৈনিক যদি এ ধরনের দ্রব্য চুরি করে, তাহলে তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১১-০৮ কেউ যদি কারো জননেন্দ্রিয় কর্তন করে রতির সক্ষমতা বিনষ্ট করে, তাহলে কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে উক্ত অপরাধীরও উপরোক্ত অঙ্গ কর্তন করতে হবে। কেউ যদি কারো নাসিকা কর্তন করে গন্ধ গ্রহণক্ষমতা বিনষ্ট করে, তাহলে শাস্তি হিসেবে উক্ত অপরাধীর আঙুল কেটে ফেলতে হবে। কৌটিল্যের পূর্ববর্তী শাস্ত্রকারেরা এ ধরনের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিরই বিধান দিয়েছেন। তদুপরি ক্ষুদ্র অপরাধের জন্য যন্ত্রণাহীন মৃত্যুদণ্ডই ধর্মসম্মত বলে স্বীকৃত।

দ্বাদশ অধ্যায় ॥ ৮৭ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে নারীদের শ্লীলতাহানি সম্পর্কিত শাস্তির ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া কুমারীত্ব হরণের প্রকৃতি অনুযায়ী কি ধরনের শাস্তি আরোপিত হবে, বিভিন্ন প্রকৃতির ব্যাভিচারের জন্য কি ধরনের শাস্তি প্রযুক্ত হবে, পরনারী সম্ভোগের ক্ষেত্রে কি ধরনের শাস্তি প্রযুক্ত হবে, কোন ক্ষেত্রে পরনারী সম্ভোগ দোষণীয় হবে না, ইত্যাকার বিষয়ের আলোকে আলোচনা করা হয়েছে।

০৪-১২-০১ কোনো পুরুষ যদি সমবর্ণের কোনো অরজস্বলা কুমারীর শ্লীলতাহানি করে তথা যোনি বিক্ষত করে, তাহলে উক্ত অপরাধীর হাত কেটে দিতে হবে অথবা তার উপর ৪০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ ধরনের উৎপীড়নের ফলে উপরোক্ত প্রকৃতির নারী যদি মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহলে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। একইভাবে কোনো সাবালিকা নারীর শ্লীলতাহানি করা হলে অপরাধী পুরুষটির একহাত বা দুই হাতের মধ্যমা ও তর্জনী-আঙুল কর্তন করতে হবে অথবা অপরাধীর উপর ২০০ পণ জরিমান আরোপ করতে হবে। এছাড়াও উক্ত অপরাধী কৃত অপরাধের জন্য কন্যার পিতাকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।

০৪-১২-০২ কোনো নারী কামনারহিত হলে তার সঙ্গে কোনো পুরুষ সঙ্গম করতে পারবে না বা তাকে বিয়ে করতে পারবে না। এমনকি কামভাবাপন্ন কোনো নারীর সম্মতিক্রমেও যদি কোনো পুরুষ তার সঙ্গে অবৈধভাবে সঙ্গম করে, তাহলে উক্ত পুরুষের উপর ৫৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং উক্ত নারীর উপর অর্ধেক তথা ২৭ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। অন্য পুরুষের কাছে শুল্ক গ্রহণকারী তথা বাগদত্তা নারীর সঙ্গে কেউ সঙ্গম করলে উক্ত অপরাধীর হাত কর্তন করতে হবে অথবা তার উপর ৪০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়াও উক্ত নারী যে পরিমাণ শুল্ক গ্রহণ করে কাউকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবে, সঙ্গমকারী পুরুষ ওই পরিমাণ অর্থ উক্ত নারীকে দান করতে বাধ্য থাকবে। সাতটি ঋতুকাল অতিক্রান্ত সত্ত্বেও যদি কোনো বাগদত্তা নারী তার সম্ভাব্য স্বামীর কাছে বিয়ের মাধ্যমে হস্তান্তরিত না হয়, তাহলে ঋতুকাল বিনাশের অপরাধে উক্ত কন্যার উপর পিতার পিতৃত্বের অধিকার রহিত হবে এবং উক্ত নারীকে তার সম্ভাব্য স্বামী ইচ্ছেমতো সম্ভোগের অধিকার লাভ করবে। তজ্জন্য তাকে কন্যার পিতাকে কোনোপ্রকার ক্ষতিপূরণও প্রদান করতে হবে না।

০৪-১২-০৩ তিন বছরের মধ্যেও যদি কোনো ঋতুবতী কন্যার বিয়ে না হয়, তাহলে তার সঙ্গে সমজাতীয় কোনো পুরুষের সঙ্গম অবৈধ হবে না। তিন বছর অতিক্রান্তের পর উক্ত প্রকৃতির কন্যা যদি অসবর্ণের কোনো পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমে মত্ত হয়, তাহলেও তা দোষণীয় হবে না। এক্ষেত্রে উক্ত কন্যা পিতৃপ্রদত্ত অলঙ্কারের অধিকারী হতে পারবে না। নীচুবর্ণের পুরুষ যদি কন্যার পিতৃপ্রদত্ত অলঙ্কারসহ উক্ত কন্যাকে গ্রহণ করে, তাহলে সে চৌর্যবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হবে। অন্যের বিবাহের জন্য সংরক্ষিতা কন্যাকে কেউ যদি প্রতারণাপূর্বক উক্ত ব্যক্তিরূপে উপস্থাপন করে বিবাহ করে, তাহলে উক্ত মিথ্যেবাদীর উপর ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কিন্তু সংরক্ষিতা কন্যা যদি যার জন্য সংরক্ষিত, তাকে পছন্দ না করে তাহলে ওই কন্যার উপর উক্ত ব্যক্তির কোনো অধিকার থাকবে না। এক কন্যাকে দেখিয়ে যদি বরের সঙ্গে অন্য কন্যার বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কন্যাদানকারীর উপর ১০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়াও সমবর্ণের কন্যা দেখিয়ে যদি নীচুবর্ণের কন্যাকে বিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অপরাধীকে দ্বিগুণ তথা ২০০ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০৪-১২-০৪ বিবাহের পর যদি স্ত্রীর অসতীত্ব প্রমাণিত হয় বা কোনো বধূ যদি ক্ষত যোনিবিশিষ্ট বলে শনাক্ত হয়, তাহলে তার উপর ৫৪ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে বরের বিবাহ শুল্ক প্রত্যর্পণ করতে হবে এবং পুনর্বিবাহের যাবতীয় ব্যয়ভার দায়ী কন্যাপক্ষকে নির্বাহ করতে হবে এবং এ ধরনের কন্যার পুনরায় বিবাহ দেওয়া হলে দ্বিগুণ জরিমানা তথা ১০৪ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। কোনো বধূ যদি অন্য উৎস হতে রক্ত সংগ্রহ করে নিজের ক্ষতযোনিত্ব প্রমাণের প্রয়াস গ্রহণের মাধ্যমে প্রতারণামূলকভাবে নিজেকে কুমারী হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে তার উপর ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়াও এক্ষেত্রে কন্যাপক্ষ বিয়ের শুল্ক এবং ব্যয়িত অর্থ বরপক্ষকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। অন্যদিকে কোনো পুরুষ যদি তার নিষ্কলুষ বধূকে অসতী বলে প্রতিপন্ন করার প্রয়াস গ্রহণ করে, তাহলে তার উপর একইভাবে ২০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো বধূ কর্তৃক বরকে পছন্দ না করা হলে উক্ত বর ঐ বধূর সঙ্গে মিলিত হতে পারবে না এবং উক্ত নারী অন্যত্র বিয়ে করার স্বাধীনতা লাভ করবে।

০৪-১২-০৫ কোনো নারী যদি স্বেচ্ছায় সমবর্ণের কারো সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজের সতীত্ব বিনাশ করে, তাহলে তার উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে কোনো নারী যদি আঙুল সঞ্চালনের মাধ্যমে অন্য নারীর কুমারীত্ব নাশ করে, তাহলে উক্ত নারীর উপর দ্বিগুণ দণ্ড তথা ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো পুরুষের অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনো কামাসক্তা নারী যদি সাময়িক পরিতৃপ্তির প্রত্যাশায় উক্ত পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে তার উপর ১০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে এবং উক্ত পুরুষকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। কোনো নারী যদি অঙুলি প্রক্ষেপণের মাধ্যমে নিজেই নিজের কুমারীত্ব নাশ করে অথবা স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো পুরুষকে দিয়ে তা করায়, তাহলে তাকে রাজার দাসী হতে হবে। গ্রামের বাহিরের নির্জন এলাকায় কোনো নারী যদি পুরুষের সঙ্গে সঙ্গত হয়ে যোনিত্বের বিনাশ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক্ষেত্রে উক্ত পুরুষ যদি যোনিত্ব বিনাশের কথা অস্বীকার করে, তাহলে তার উপর দ্বিগুণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-১২-০৬ কোনো কন্যাকে জোর করে অপহরণ করা হলে, অপরাধীর উপর ২০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে, কন্যাটি যদি অলঙ্কার সজ্জিত হয়, তাহলে প্রদেয় জরিমানা হবে ১০০০ পণ। অনেকে মিলিতভাবে কোনো কন্যাকে অপহরণ করলে, প্রত্যেক সদস্যের উপর উপরোক্ত হারে জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো পুরুষ যদি বলপূর্বক কোনো গণিকা কন্যার সঙ্গে সঙ্গম করে, তাহলে তাকে ৫৪ পণ জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং উক্ত ব্যক্তি কন্যার মাতাকে ভোগমূল্যের ষোল গুণ শুল্ক প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।

০৪-১২-০৭ দাস বা দাসীর অদাসীকন্যাকে কেউ জোর করে সম্ভোগ করলে উক্ত ব্যক্তির উপর ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এছাড়াও সম্ভোগকারী উক্ত কন্যাকে শুল্ক বা যৌতুক এবং অলঙ্কারাদি প্রদানে বাধ্য থাকবে। কেউ যদি নিষ্ক্রিয়মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে কোনো দাসীকে মুক্ত করার পর তার সঙ্গে ব্যভিচার করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি ১২ পণ জরিমানা পরিশোধ করত সেই দাসীকে বস্ত্র ও অলঙ্কার প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। বলাৎকারের ক্ষেত্রে স্থান ও সহায়তা দানকারীকেও বলাৎকারকারীর অনুরূপ দণ্ড ভোগ করতে হবে।

০৪-১২-০৮ স্বামীর প্রবাসকালে কোনো নারী যদি পর পুরুষের সঙ্গে সম্ভোগে মত্ত হয়, তাহলে পতির ভ্রাতা, ভৃত্য বা আত্মীয় স্বজনেরা উক্ত নারী এবং পর পুরুষটিকে অবরুদ্ধ করে রাখবে। এইভাবে উক্ত নারী স্বামীর প্রত্যাগমনকাল পর্যন্ত সুরক্ষিতা হয়ে অবরুদ্ধাবস্থায় অপেক্ষমান থাকবে। প্রত্যাবর্তনের পর স্বামী যদি স্ত্রীর কৃতকর্ম ক্ষমা করে দেয়, তাহলে উভয়ে মুক্তিলাভ করবে। কিন্তু স্বামী যদি কৃত অপরাধ মার্জনা না করে, তাহলে ব্যভিচারী স্ত্রীর নাক কান কর্তন করতে হবে এবং পর পুরুষটির উপর মৃত্যুদণ্ড আরোপিত হবে। কেউ যদি উক্ত সম্ভোগকারী পর পুরুষকে রক্ষার জন্য চোর সাব্যস্ত করে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তার উপর ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। কোনো রাজরক্ষী যদি উৎকোচ গ্রহণ করে উক্ত অপরাধীকে মুক্ত করে দেয়, তাহলে সেই রক্ষীকে গৃহীত উৎকোচের আটগুণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

০৪-১২-০৯ চুলের বিন্যাস, সুগন্ধি তথা চন্দন বা কস্তুরিকা, শরীরের ক্ষতচিহ্ন, বাক্যালাপ, ইত্যাকার লক্ষণের মাধ্যমে সম্ভোগকারীদের শনাক্ত করা যায়। শত্রু সৈন্যদের কাছ থেকে উদ্ধার প্রাপ্তা, অরণ্য থেকে উদ্ধার প্রাপ্তা, নদীর প্রবাহ থেকে উদ্ধার প্রাপ্তা, রোগজনিত কারণে মৃত হিসেবে পরিত্যক্তা নারীরা অন্যের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সম্মতি সাপেক্ষে উদ্ধারকারী ব্যক্তি, তাদের ভার্যা বা দাসীরূপে সম্ভোগ করতে পারবে। কিন্তু উক্ত নারী যদি উচ্চকুলজাত হয়, সন্তান সম্ভবা হয় এবং সম্ভোগে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে উদ্ধারকারী ব্যক্তি উদ্ধারজনিত পারিশ্রমিক গ্রহণ সাপেক্ষে উক্ত নারীকে তার স্বামীর কাছে প্রত্যর্পণ করবে।

০৪-১২-১০ একইভাবে চোরের হাত থেকে উদ্ধারকৃত, দুর্ভিক্ষপীড়িত, দেশের বিগ্রহজনিত কারণে তাড়িত বা মৃত হিসেবে পরিত্যক্ত পর-নারীকে উদ্ধারকারী ব্যক্তি সম্মতি সাপেক্ষে সম্ভোগ করতে পারবে কিন্তু উক্ত নারী যদি রাজ কোপানলে পড়ে স্বজন পরিত্যক্তা হয়, সে যদি উচ্চকুলজাত হয়, সন্তানের মা হয় বা কামরহিত নারী হয়, তাহলে তাকে উদ্ধারকর্তা সম্ভোগ করতে পারবে না। অধিকন্তু উদ্ধারের পারিশ্রমিক গ্রহণ করে উক্ত নারীকে স্বামীর গৃহে পাঠিয়ে দিতে হবে।

ত্রয়োদশ অধ্যায় ॥ ৮৮ প্রকরণ ॥

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন প্রকার আচার, প্রথা, নিয়ম-কানুনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধি বহির্ভূত আচরণ বা কাজের জন্য কি ধরনের দণ্ড প্রযোজ্য হবে, সে সম্পর্কেও আলোকপাত করে এ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

০৪-১৩-০১ কেউ যদি কোনো ব্রাহ্মণকে অপেয় পানি পান করায় বা ভক্ষণ নিষিদ্ধ উপাদান দিয়ে ভোজন করায়, তাহলে তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করা হলে ৫০০ পণ, বৈশ্যের সঙ্গে এরূপ করা হলে ২৫০ পণ এবং শূদ্রের সঙ্গে এরূপ করা হলে অপরাধী ব্যক্তির উপর ৫৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় কুলজাত কেউ যদি কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়েও স্বপ্রণোদিত হয়ে অপেয় পানীয় পান করে বা নিষিদ্ধ খাদ্যগ্রহণ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে দেশ থেকে বহিষ্কারাদেশের দণ্ড প্রযুক্ত হবে।

কেউ যদি অনুমতি বা আমন্ত্রণ ব্যতিরেকে দিবালোকে অন্যের গৃহে প্রবেশ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে, রাতে এ ধরনের কৃত অপরাধের জন্য ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে এবং দিনে বা রাতে যদি সশস্ত্র অবস্থায় কেউ এ ধরনের অনুপ্রবেশ করে, তাহলে তার উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

০৪-১৩০২ এক্ষেত্রে কোনো বৌদ্ধভিক্ষু, সন্ন্যাসী, ভিখারি, ফেরিওয়ালা, মাতাল, পাগল, বিপদগ্রস্ত প্রতিবেশী বা সৌহার্যবশত কেউ যদি কারো বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করে, তাহলে তার বা তাদের উপর কোনো শাস্তি আরোপিত হবে না। তবে এ ধরনের প্রবেশাধিকার যদি গৃহকর্তা কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে অনধিকার প্রবেশের জন্য তাদের উপর প্রযোজ্য শাস্তি প্রযুক্ত হবে।

কেউ যদি মধ্যরাতে নিজ বাড়ির প্রাচীরের উপর আরোহণ করে, তাহলে তার উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এভাবে অপরের প্রাচীরে আরোহণ করলে ৫০০ পণ জরিমানা এবং গ্রাম বা বাগানবাড়ির বেড়া ভাঙলে অপরাধীর উপর একই জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১৩-০৩ বিদেশগামী বণিকরা পথিমধ্যে কোনো গ্রামে অবস্থান করতে ইচ্ছুক হলে, মূল্যবান দ্রব্য সম্পর্কে গ্রাম প্রধানকে অবহিত করে বাস করতে পারবে। গ্রামে অবস্থানকালে রাত্রিতে যদি কোনো বণিকের মূল্যবান সম্পদ খোয়া যায় এবং তা যদি গ্রামের বাইরে পাচার না হয়ে থাকে, তাহলে গ্রাম প্রধান তা উদ্ধার করে দিবেন। এ ধরনের ঘটনা গ্রামের সীমান্তে সংঘটিত হলে সীমান্ত প্রশাসক তা উদ্ধার করে দিবেন।

যদি চুরিকৃত দ্রব্য সীমান্ত প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার বাইরে পাচার হয়ে যায়, তাহলে চোর ধরার দায়িত্বে নিয়োজিত চোর রজ্জুকেরা তা উদ্ধার করে দিবেন। তার পরও চুরিকৃত দ্রব্য উদ্ধার করা সম্ভব না হলে রাজরক্ষীরা সীমান্ত অবরোধ করে তল্লাশি চালাবে। অতঃপরও অপহৃত সম্পদ উদ্ধার করা সম্ভব না হলে পাঁচ বা দশ গ্রামের অধিবাসীরা সমন্বিতভাবে বণিকদের অপহৃত দ্রব্যের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে।

০৪-১৩-০৪ বাড়ির নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে, ত্রুটিপূর্ণ শকটের কারণে, আবরণহীন অস্ত্র বহনের কারণে, কারো দ্বারা খননকৃত গর্তপূরণ না করার কারণে, হাতি ধরার জন্য খননকৃত গর্তপূরণ না করার কারণে, কেউ যদি চলাচল পথে আহত হয়, তাহলে দায়ী ব্যক্তিরা দণ্ডপারুষ্য বা শারীরিক ক্ষতি করার অপরাধে অপরাধী হয়ে দণ্ডিত হবে।

গাছ কাটার সময়, পশুদের প্রশিক্ষণ প্রদান প্রাক্কালে, পশুর নাকের দড়ি অপসারণকালে, পশুদের পিঠে আরোহণকালে, পারস্পারিক কোলাহলের সময় পাথর, মাটির ঢেলা, কাঠ, লাঠি নিক্ষেপকালে, বাহনে করে যাত্রাকালে যদি কাউকে আঘাত করা হয়, তাহলে অপরাধীর উপর দণ্ড প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে যদি পূর্ব থেকেই সতর্ক করা হয়ে থাকে, তাহলে আঘাতকারীর উপর কোনো শাস্তি আরোপিত হবে না।

০৪-১৩-০৫ কোনো ব্যক্তি যদি আত্মহননের অভিপ্রায়ে হাতির গমন পথে শয়ন করে হাতিকে উত্তেজিত করত তার পদপিষ্টে পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে মৃতের স্বজনেরা উক্ত হাতির জন্য এক দ্রোণ পরিমাণ ভাত, মদ্য, মাল্য, শরীরে লেপনের সুগন্ধি এবং দত্ত পরিমার্জনের জন্য একখণ্ড বস্ত্ৰ দান করবে। হাতির পায়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে অশ্বমেধযজ্ঞ শেষে কৃত পবিত্র স্নানের মতো পুণ্যলাভ হয়, এ কারণে হত্যাকারী হাতির পাদপ্রক্ষালনরূপ পূজা করতে হয়।

কোনো সাধারণ মানুষ যদি হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে হস্তিচালকের বিরুদ্ধে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো ব্যক্তি যদি শিংঅলা গরু অথবা কোনো কুকুর অথবা কোনো দাঁতযুক্ত পশুর দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং এক্ষেত্রে যদি পশুর মালিক আক্রান্তকে রক্ষার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে উক্ত পশুর মালিকের উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। অধিকন্তু অনুরোধ করা সত্ত্বেও যদি পশুর মালিক আক্রান্তকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে না আসে, তাহলে তার উপর দ্বিগুণ তথা ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১৩-০৬ শিংঅলা বা দাঁতাল পশু একে অপরকে আক্রমণ করে হত্যা করার প্রাক্কালে পশুর মালিক কর্তৃক যদি তা নিবৃত্ত করা না হয়, তাহলে হত্যাকারী পশুর মালিক নিহত পশুর মালিককে পশু মূল্যের সম পরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করবে।

দেবতা বা দেবতালয়ের জন্য উৎসর্গকৃত পশু, কৃষিকাজের ব্যবহার্য ষাঁড়, গাভীর গর্ভ সঞ্চারণের জন্য সংরক্ষিত ষাঁড় বা কুমারী গাভীকে কেউ যদি বাহন হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে উক্ত অপরাধীর উপর ৫০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এ জাতীয় পশু হত্যা করা হলে হত্যাকারীর উপর ১০০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে। পশমঅলা, দুগ্ধদানকারী, বাহনের উপযোগী এবং প্রজননে সক্ষম জাতীয় উপকারী পশু চুরি করলে, চোরের উপর চুরিকৃত পশুর সমমূল্যের জরিমানা আরোপিত হবে। ধর্মীয় বা পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পর্কিত বিষয় ব্যতীত এদের হত্যা করা হলে, হত্যাকারীর উপর একইভাবে জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১৩-০৭ চলন্ত অবস্থায় চাকাঅলা গাড়ির বাহক তথা বলদের নাকের দড়ি যদি ছিঁড়ে যায়, গাড়ির জোয়াল যদি ভেঙে যায়, গাড়ি যদি তীর্যকভাবে ধাবিত হয়, পেছনের দিকে ধাবিত হয় এবং মানুষ বা পশুদের বিশৃঙ্খলভাবে চলাচলের ফলে যদি গাড়ির বাহক বলদেরা সংশয়াপন্ন হয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং এ কারণে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনায় যদি মানুষ বা পশু নিহত হয়, তাহলে গাড়ি চালকের উপর কোনো শাস্তি আরোপযোগ্য হবে না। এ সমস্ত কারণ ব্যতীত অন্য কোনো কারণজনিত দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে, রাজা কর্তৃক চালকের উপর যথাযথ শাস্তি প্রযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় যদি কোনো ক্ষুদ্র পশু নিহত হয়, তাহলে চালককে নিহত পশুর মূল্যতুল্য জরিমানা প্রদান করতে হবে।

০৪-১৩-০৮ নাবালককে দিয়ে শকট চালনার ফলে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এবং মানুষ বা প্রাণী নিহত হয়, তাহলে উক্ত অপরাধের জন্য শকটে আসীন শকটের মালিক অপরাধী বলে গণ্য হবে এবং প্রযোজ্য দণ্ড ভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে শকটে যদি মালিক আসীন না থাকে, তাহলে উক্ত শকটের প্রকৃত চালক অপরাধী হবে। এ ধরনের নাবালক চালক দিয়ে শকট চালানো হলে রাজা তার ক্ষমতাবলে উক্ত শকট বাজেয়াপ্ত করবেন। কেউ যদি কৃত্যা এবং অভিচার তথা কুমন্ত্রবলে অন্যের ক্ষতিসাধন করে, অন্যকে বিপন্ন করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকেও একইভাবে বিপন্ন করতে হবে।

০৪-১৩-০৯ পত্নীর কামভাব জাগ্রত না হলে তার পতি, পতির কামভাব জাগ্রত না হলে তার পত্নী এবং কন্যার কামভাব জাগ্রত না হলে তার পাণিপ্রার্থী, পরস্পর পরস্পরের উপর বশীকরণমন্ত্র প্রয়োগ করতে পারবে। এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যতিরেকে কেউ যদি কারো উপর বশীকরণমন্ত্র প্রয়োগের প্রয়াস গ্রহণ করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর বিরুদ্ধে ৫০০ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

কেউ যদি মাতা, মাসি, মামি, পিসি, গুরুপত্নী, পুত্রবধূ, কন্যা বা বোনের সঙ্গে কোনোপ্রকার ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়, তাহলে শিশ্ন ও অণ্ডকোষ কর্তনসহ উক্ত অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। এর বৈপরীত্য হলে দুই স্তন ও ভগাঙ্কুর কর্তনসহ অপরাধী নারীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। কামভাবের বশবর্তী হয়ে কোনো নারী যদি দাস, পরিচর্যক বা বন্ধকী পুরুষের সঙ্গে সম্ভোগে মত্ত হয়, তাহলে উক্ত নারীর ক্ষেত্রেও উপরোক্ত ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

০৪-১৩-১০ একাকী বসবাসকারী কোনো ব্রাহ্মণ নারীর সঙ্গে ক্ষত্রিয় কুলের কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে, অপরাধীর বিরুদ্ধে ১০০০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। একই অপরাধ কোনো বৈশ্যের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধীর সর্বস্ব হরণ করতে হবে। যদি এ ধরনের অপরাধ কোনো শূদ্রের দ্বারা সংঘটিত হয়, তাহলে অপরাধীর সর্বাঙ্গে শুকনো ঘাস বা তুষ লেপন করে অগ্নিদগ্ধাবস্থায় নগর প্রদক্ষিণ করাতে হবে এবং এভাবেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে।

রাজার পত্নীর সঙ্গে যে কোনো জাতি কুলের কেউ এ ধরনের ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হলে শাস্তি হিসেবে উক্ত অপরাধীকে উত্তপ্ত কড়াইয়ে রেখে হত্যা করতে হবে। জাতিকুল থেকে বহিষ্কৃতা নারীর সঙ্গে কোনো শুদ্র পুরুষ সঙ্গমে মত্ত হলে, অপরাধীর মুণ্ডিত মস্তকে কবন্ধ চিহ্ন অঙ্কন করে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে হবে অথবা তাকে জাতিচ্যুত করতে হবে। কোনো জাতিচ্যুত ব্যক্তি যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের কামুক প্রকৃতির পত্নীর সঙ্গে সঙ্গমে মত্ত হয়, তাহলে উক্ত অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে এবং মহিলার নাক কান কর্তন করতে হবে।

০৪-১৩-১১ সংসারত্যাগী কোনো সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে কেউ যৌনাচারে নিমগ্ন হলে যৌনাচারী পুরুষের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে ২৪ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এর বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হলে উক্ত সন্ন্যাসিনীর উপর একই হারে জরিমানা প্রযুক্ত হবে। পেশাদারী পতিতাকে বলপূর্বক সম্ভোগ করলে, সম্ভোগকারী অপরাধীর উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। এক নারীকে যদি বহু পুরুষ উপভোগ করে, তাহলে প্রত্যেক পুরুষের উপরই ২৪ পণ করে জরিমানা আরোপিত হবে। যোনি ব্যাতিরেকে স্ত্রীলোকের অন্য কোনো অঙ্গে পুরুষের লিঙ্গের সঞ্চালন করা হলে অপরাধীর উপর ২৫০ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। কোনো পুরুষের সঙ্গে এহেন অসদাচরণ করা হলে দায়ী মহিলার উপর একই হারে জরিমানা আরোপিত হবে।

০৪-১৩-১২ গবাদি পশুর যোনিতে মৈথুনকারী নির্বোধের উপর ১২ পণ জরিমানা আরোপিত হবে। একইভাবে কেউ যদি কোনো দেব প্রতিমার উপর কামচেতনা প্রয়োগ করে, তাহলে তার উপর ২৪ পণ জরিমানা প্রযুক্ত হবে।

রাজা যদি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ করেন, তাহলে তিনি নিজেই সেই জরিমানার ত্রিশগুণ জরিমানা প্রদান করবেন। রাজার জরিমানার অর্থ বরুণ দেবকে তুষ্টির নিমিত্ত জলে নিক্ষেপ করতে হবে, অতঃপর সেই অর্থ ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। নিরপরাধ লোকের উপর জরিমানা আরোপের কারণে রাজার যে পাপ হবে, এই প্রক্রিয়াতে সেই পাপমোচন হবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন