নিমফুলের মধু – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

নিমফুলে এ-বছর কম মৌমাছি বসছে । লিচুগাছেও গতবারের চেয়ে কম । নকুল একটু এগিয়ে, ঝুঁকে তৃতীয় খুপরিটা দেখে নিয়ে পিঠ টান করল, দাও দিকি একটা বিড়ি ।

শিবু অন্য সময়ে হলে বলে দিত, নেই রে, কিন্তু এখন তার নিজের দায় । ট্যাঁক থেকে আস্ত একটা বিড়ি নিয়ে নকুলের হাতে তুলে দিতে তার মনটা একটু খচ-খচ করে । যাক গে, অন্যভাবে সে এর পাঁচগুণ পুষিয়ে নেবে ।

সে নিজেও একটা বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে, বড় দু-শিশি নেব, একটু সস্তা করে দিস ।

নকুল হা-হা করে ওঠে, করো কী, করো কী! বাইরে চলো । ধোঁয়ার গন্ধে এক্ষুনি সব খেপে উঠবে!

রাস্তায় পা দিয়ে সে নিজের বিড়ি ধরায়, নিমের মধু দিতে পারব না । দেখলে না খুপরি খাঁ-খাঁ করছে!

—ওকথা বললে চলে! তোর ঘরে নেই?

নকুল চেপে যায় । ঘরে এক শিশি আছে । দত্তবাবু শনিবারদিন তিন টাকা দিয়ে বায়না করে গেছেন । নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করে বলল, গরিবের ঘরে মধু কি আর পড়ে থাকে!

—এক শিশি নাহয় দে । বৌদির বোনেরা এসেছে কলকাতা থেকে । বৌদি খুব গল্প করেছে তোর নিমের মধুর । আরেকটা মেয়েছেলে এসেছে মাইরি ওদের সঙ্গে, ওদের বন্ধু, তোর চোখ ট্যারা হয়ে যাবে ।

নকুলের এখন এতো কথা শোনবার সময় নেই । একবার বাজারে যেতে হবে । তার আগে পদু সাহার বাড়ি গিয়ে টাকার তাগাদা দিতে হবে । হাত একদম ফাঁকা । সন্ধে হয়ে আসছে । চাল আর কেরাসিন না নিয়ে বাড়ি ফেরার উপায় নেই । বেড়ার গা থেকে সাইকেলটা টেনে নিয়ে বলল, নেবে তো টাকা বের করো । বাজারটা একবার ঘুরে এসে মধু বাড়িতে দিয়ে আসব ।

—এক শিশি অন্তত নিমের দিবি তো? আরেকটা নাহয়—

—কলকাতার মেয়ে, আমের মধু নিমের মধু— অতো কি বুঝবে গো?

—বৌদি অতো করে বলে দিল!

নকুল গলা খাঁকরে শ্লেষ্মা ঝাড়ল, থাকলে দিতুম না? ফাল্গুন থেকেই আমের বউলে কীরম মৌমাছি লেগেছে দেখোনি?

সে বোঁ করে চলে যায় । ঝরঝরে সাইকেল । তার বিয়ের যৌতুক । সারা রাস্তা ঝনখট ঝনখট আওয়াজ করে ।

সাইকেলের শব্দে আগে থেকেই পদু সাহার বউ বেরিয়ে আসে, কে, নকুল?

হ্যাঁরে, বাবুকে দেখলি রাস্তায়?

—বাবু তো ঘরে বসে সিগ্রেট খাচ্ছেন ।

—দূর! দুপুরের ট্রেনে কলকাতা গেলেন । বলে গেলেন সন্ধের আগেই ফিরবেন । দোকানে হিসেব-টিসেব নিয়ে কী একটা দরকারি কাজ পড়েছে—

নকুলের বাঁ পায়ে একটা মশা, ঝুঁকে চটাস করে চাঁটি মেরে বলল, তবে তো আপনাদের ঘরে আগুন লেগেছে গো! জানলার ফাঁক দিয়ে যা ধোঁয়া বেরোচ্ছে!

—ওমা, তাই নাকি!

বউটা চলে যাচ্ছে, নকুল গলা তুলে বলল, আমার সাত টাকা নিয়ে আসবেন ।

—আমার কাছে কি টাকা থাকে? দেখি যদি এক-আধ টাকা পাওয়া যায় ।

কেরাসিন হল না, চাল আর তিরিশ পয়সায় অল্প একটু লটে মাছ নিয়ে নকুল বাড়ি ফিরছে, ঘোষেদের জানালায় তার চোখ আটকে গেল । ভেতরে টিভিতে নাচ হচ্ছে । নাচ শেষ হতে না হতেই ফাইটিং । জানলার বাইরে অনেকেই ভিড় করে দেখছে । নকুল একটা নারকেল গাছে বাঁ হাত রেখে সাইকেলে বসে বসেই পুরো সিনেমাটা দেখল ।

বাড়ি পৌঁছে নকুলের মাথায় রক্ত চড়ে যায় । ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি লাগিয়েছে । পান্নার নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, চুনীর ইজের ছিঁড়ে ফালি-ফালি, তার হাতের মুঠোয় হীরের লম্বা একগোছা চুল উঠে এসেছে ।

চাল আর মাছের ঠোঙা মাটিতে নামিয়ে রেখে নকুল ছেলেমেয়েদের এলোপাথাড়ি চড় ঘুষি লাথি কষাল । হীরে চুনী পান্না মার খেয়ে কে কোথায় সেঁধাল, সাড়া পাওয়া গেল না ।

চণ্ডী পাশের ঘরে মাটিতে আঁচল বিছিয়ে ঘুমোচ্ছিল । মারামারিতে তার ঘুম ভাঙেনি । নকুলের চড়-ঘুষিও তার কানে যায়নি । সব যখন চুপচাপ, নকুল সন্ধেয় কেনা ছটা বিড়ির প্রথমটা সবে ধরিয়ে ওঘরে ঢুকেছে, চণ্ডী ধড়ফড় করে উঠে বসল । এক মুহূর্ত অদ্ভুত চোখে নকুলের দিকে চেয়ে থেকে তার ঘোর ভাঙল, বাব্বা! যা একখানা স্বপ্ন দেখছিলুম!

কে বলবে নকুল একটু আগেই নিজের ছেলেমেয়েদের মারধর করেছে, বিড়িতে ছোট একটা টান দিয়ে বলল, কী?

—দেখলুম ভাত পুড়ে যাচ্ছে । চাল এনেছো?

—অনেকদিন পর লটে মাছ পেলুম । বেশ ঝাল দিয়ে রাঁধোতো গিয়ে ।

দু-ঘরের মাঝখানে একটা মাত্র কুপি । তেল কমে গিয়ে দপ-দপ করছে । চণ্ডী সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল, তেল ভরতে হবে । কেরাসিন এনেছো?

নকুলের বিড়ি নিভে গিয়েছিল, নিচু হয়ে কুপি থেকে ধরিয়ে নিয়ে বলল, একটু পড়েই চাঁদ উঠবে । আজ ওতেই একরকম চলে যাবে । কাল কেরাসিন আনব ।

মেয়েদুটো আর চুনী খেতে বসে বাপের কিলচড় ভুলে কোঁদল শুরু করেছিল, এক ধমক খেয়ে চুপ । জ্যোৎস্নায় দাওয়ায় বসে সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, খাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই, হঠাৎ ছোট মেয়েটা ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল, আমায় মোটে একটুখানি মাছের ঝোল দিয়েছে, আমার কত রক্ত পড়েছে নাক দিয়ে!

নকুলের চোখে ঘোষেদের বাড়ির জানলা ভাসছিল, হঠাৎ কান্না শুনে মুখে ভাত নিয়েই সে খুব বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল, মারব এক থাবড়া!

চণ্ডী নিজের ভাগ থেকে খানিকটা ঝোল পান্নার থালায় তুলে দিয়ে বলল, সব সময় খালি মারব, মারব! জিবে নিমের পাতা বেটে দিয়েছ নাকি, অ্যাঁ?

খেয়ে উঠে বিড়ি ধরাবার উপায় নেই, কুপি অনেকক্ষণ নিভে গেছে । উনুনের পোড়া কাঠ-পাতায় জল ঢালা । নকুল বিড়িহাতে চণ্ডীর পিছনে এসে দাঁড়ায়, ঘরে দেশলাই নেই?

—জোছনায় ধরাও গিয়ে!

একটু পরে হাত ধুয়ে এসে একটা দেশলাই এনে নকুলের পায়ের কাছে ছুড়ে দেয় ।

তিনটে মাত্র কাঠি । নকুল সাবধানে বিড়ি ধরায় ।

চাঁদ গাবগাছ ছেড়ে সুপুরিবনের দিকে যাচ্ছে । দাওয়ায় বসে চণ্ডীর থালাবাটি ধোওয়ার শব্দ আর তার গোঙানি শুনতে শুনতে নকুল বিড়ির আগুন থেকে আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে ঘন-ঘন টানতে থাকে ।

চণ্ডীর হাতের হাজা ছাই-জল লেগে জ্বলছে, তার ওপর অন্ধকারে একটা ভাঙা বাটির কানায় লেগে তার হাত কেটে গেছে, সে কোঁকাতে-কোঁকাতে দাওয়ায় এসে দাঁড়াতেই নকুল খিঁচিয়ে উঠল, আঃ, তাড়াতাড়ি সার না ঘরামীর মেয়ে!

‘ঘরামীর মেয়ে’ নকুল রেগে আর আদর করে— দু-অবস্থায়ই বলে । ঘরে ঢুকে চণ্ডীকে নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে এবার নকুল অন্যরকম গলায় বলল, ঘরামীর মেয়ে! ছাগল দুধে কালোজামের মধু মেরে তোকে খাওয়াব, দেখিস ।

একটা গাছের ডালকে শাড়ি জড়ালে যেমন হয় চণ্ডী প্রায় সেইরকম । গায়ে মাংস নেই, শুধু হাড় । কোঁকাতে-কোঁকাতেও সে ঝেঁঝে উঠল, রোজ ওই এক কথা । শুনে শুনে কান পচে গেল! মিথ্যুক ঠগ! কই, একদিনও তো—

নকুল এক ঝটকায় তাকে বিছানায় ফেলে দাঁত কিড়মিড় করল, চোপ ঘরামীর মেয়ে!

শেষ রাতে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে নকুলের ঘুম ভেঙে গেল । চণ্ডী বিছানায় নেই । পাশের ঘরে ছেলেমেয়ে তিনটে গুঁটিসুঁটি মেরে ঘুমোচ্ছে । একটা ফোঁকর দিয়ে জলের ছাঁট এসে হীরের পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল, নকুল দরমাটা টেনে দিতে দিতে দেখল দাওয়ার দিকের দরজায় খিড়কি নেই, অল্প ফাঁক হয়ে আছে ।

পাল্লা ঠেলে নকুল দাওয়ায় এসে দেখল চণ্ডী দেওয়াল ঘেঁসে বসে থালায় কী মাখছে । নকুল সাবধানে পাশ থেকে উঁকি দিল । এক থালা আটায় অনেকটা মধু ঢেলে জল দিয়ে চটকাচ্ছে । সে একহাতে চণ্ডীর চুলের মুঠি আরেক হাতে থালার ওপর ঘটি-শিশি নিয়ে সোজা নিজের ঘরে । তারপর চণ্ডীর মুখে কাপড় গুঁজে বেদম মার ।

সকালে বেরোবার সময় নকুল মধুর সবকটা শিশি একটা ব্যাগে পুরে সেটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিল । শুধু নিমের এক শিশি ঘরে রইল, দত্তবাবুর বায়না করা । শিশিটা মাচার এককোণে লুকিয়ে রাখল, দত্তবাবুর কাছে বেশি দাম পাওয়া যায় ।

গোলাপজামের খুপরিতে কাঠের ফাঁক চুইয়ে বৃষ্টির জল ঢুকেছে, নকুল একটা আধলা ইট নিয়ে খুপরির ছাদের তক্তা তিনটে ঠুকে ঠুকে একদম মিলিয়ে দিল । রাস্তার ওপাশেই তিনটে গোলাপজাম গাছ । ওখান থেকেই বাগানের শুরু । এক ঝাঁক মৌমাছি গোলাপজামের বড় বড় ফুল কালো করে বসে মধু খাচ্ছে, এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ওড়াউড়ি করছে, তারা হঠাৎ উড়ে এসে নকুলের মাথার চারপাশে ঘুরে ঘুরে চক্কর দিতে লাগল ।

মুনসেফ কোর্টের কাছে তিনটে দোকান নকুলের খদ্দের । ঝনখট ঝনখট শব্দ তুলে নকুল সাইকেল চালায় । ব্যাগের শিশিগুলোতে ঠোকাঠুকি লাগছে । তার মাথার চারপাশে কয়েকশো মৌমাছি তোবড়ানো বৃত্তের মতো চক্কর দিতে দিতে চলেছে ।

এই দৃশ্য এখানকার লোকের চোখসওয়া । এক ঝাঁক মৌমাছি মাথার চারপাশে নিয়ে নকুল ঝনখট ঝনখট সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে দেখে শিবু দূর থেকে চিৎকার করে ডাকল, নকুল, নকুল গো—

নকুল ফট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সাইকেলের মুখ ঘোরাল । শিবুর সঙ্গে তিনটে মেয়ে ।

নকুল কাছে আসতেই মেয়ে তিনটে ঠিক একসঙ্গে ‘বাবা গো!’ বলে হাতের পাতায় মুখ ঢাকল । তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে ।

শিবু বলল, মৌমাছি দেখে ভয় পেয়েছেন । সামলে রাখিস ।

নকুল সাইকেল থেকে নামতে তার মাথার সঙ্গে মৌমাছির ঝাঁকও আরও নেমে এসে পাক খেতে লাগল । নমিতা-শমিতা লাফ মেরে পিছিয়ে গেল আর লীনা লজ্জা-টজ্জা ভুলে রাস্তার ওপর উবু হয়ে বসে পড়ে দু-হাতে মুখ-মাথা ঢেকে চেঁচিয়ে উঠল, সরে যেতে বলো, উঃ, শিবু, সরে যেতে বলো না!

নকুল হাসতে হাসতে বলল, ভয় নেই । আপনারা ভয় পাবেন না । এরা হুল ফোটাবে না । আপনাদের কাছেই যাবে না ।

নকুলের মাথা ছেড়ে একটা মৌমাছিও এদিক-ওদিক যাচ্ছে না দেখে নমিতারা আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয় । নকুলকেও তো কই হুল ফোটাচ্ছে না! লীনা সাহস করে উঠে দাঁড়িয়ে মৌমাছির চক্কর খাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে । মাঝে মাঝে অজ্ঞাতে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায় ।

শরীরে হাড়গোড় নেই নাকি? নকুল জীবনে এরকম সুন্দর মেয়ে দেখেনি । শুধু জোছনা আর ননী দিয়ে তৈরি । মধুমাখা গলা আর কাকে বলে । নকুলের খেয়াল নেই সে অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে । তার চোখ ঘুরেঘুরে বসে পড়া মেয়েটার মুখের ওপর বসছে । নকুলের মুখ হা । ধরা পড়ে গেলে খুব চোখ পিটপিট করতে করতে সে মুখ সরিয়ে নিচ্ছে ।

শিবু ভারি বিব্রত, নকুল! এনারা তোর মধু কিনতে এসেছেন!

নকুল চোখ পিটপিট করে ।

শমিতা বলল, দিদি, মৌচাক দেখবি না?

নমিতা লীনার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায়, ওকে জিজ্ঞেস কর!

নকুলের খুব উৎসাহ । ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটা খুপরি ওদের দেখায়, এইটা সজনেফুলের । এইটা আমের বউলের । এদিকে আসুন, এটা কালোজামের ।

মেয়েদের ভয় ভেঙে গেছে । একেকটা বাঁশের খুঁটির ওপর আলাদা একেকটা কাঠের বাক্স । শিবু রাস্তার ওপারে একটা গোলাপজাম গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে । এরা নকুলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে যত দেখছে ততই অবাক ।

লীনা একটা বাক্স, দেখিয়ে বলল, এটা কী ফুলের মধু?

—ঘাসফুলের ।

নমিতা বলল, তুমি কী করে বোঝ কোনটা কোন ফুলের?

—আজ্ঞে একদল মৌমাছি এক ঋতুতে শুধু এক রকম ফুলেরই মধু খায় । ওই খুপরিটা দেখছেন, ওই চাকের মৌমাছিরা এবছর লিচুগাছে বসছে ।

শমিতা সাহস করে একটা খুপরির মধ্যে উঁকি মেরে বলল, কী ছোট্ট চাক । এটা কোন ফুলের?

—নিমফুলের । নিমফুলে এবার খুব কম মৌমাছি বসছে ।

—নিমের মধু! কী আশ্চর্য, নারে, লীনা!

নমিতা নিচু হয়ে শাড়ির চোরকাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, নিমফুলের মধুর কথা খুব শুনেছি । আছে তোমার কাছে?

দুমাস পরে দিতে পারব । এবছর দুয়েক শিশির বেশি হবে না ।

—এখন তোমার কাছে কী কী পাওয়া যাবে?

নকুল ব্যাগের থেকে একটা একটা করে শিশিগুলো বের করে নাম বলে ।

শিবু বিড়ি শেষ করে বকের মতো লম্বা ঠ্যাঙে এগিয়ে আসে ।

নকুল দাম বলতে যাচ্ছে, শিবু চোখ টিপে দিয়ে বলল, কলকাতা থেকে এয়েছেন, ল্যায্য দাম ধরিস ।

নকুল ভুরু কোঁচকায় । বেশ বিরক্ত । ন্যায্য দামের চেয়েও কমে সে সবকটা শিশি দিয়ে দেয় । একটায় মধু একটু কম, শেষরাতে চণ্ডী ঢেলে নিয়েছিল, সেটা সে ফাউ দিয়ে দিল ।

অনেকগুলো টাকা হাতে পেয়ে নকুল পাঁচ কেজি চাল ছাড়াও পুরো নশো গ্রামের একটা শোল মাছ নিয়ে নিল । সঙ্গে এটাসেটা । মশলাপাতি । দু-বাণ্ডিল বিড়ি । দেশলাই কিনল দুটো ।

দুবেলা পেট ভরে খেয়ে সে দাওয়ায় বসে চাঁদের আলোয় পর পর অনেকগুলো বিড়ি শেষ করে শুতে গেল । গাবগাছের মাথায় চাঁদ । জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকতে আসছে । নকুল অনেকক্ষণ বউয়ের রোগা মুখটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অনেক বছর আগের তার সুশ্রী চোখ-নাক খুঁজে পেল ।

মাঝরাতে সামান্য ঠুকঠাক শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখল, চণ্ডী মাচার নিমফুলের মধু নামিয়ে আটা মেখে গবগব করে খাচ্ছে ।

পা টিপে টিপে সে তার বউয়ের পিছনে এসে পিঠে হাত রাখতেই চণ্ডী তাকাল । তার মুখ মড়ার মতো ।

নকুল হেসে ফেলে বলল, তোমার বাপু রাক্ষসের খিদে ।

চণ্ডী এতক্ষণে হাসে, কখনও বাচ্চা পেটে ধরনি তো!

নকুল শিশি থেকে আরও খানিকটা মধু ঢেলে দিতে দিতে বলল, এমন শুকনো শুকনো খাচ্ছিস, দম আটকে মরবি নাকি গো ঘরামীর মেয়ে!

প্রথম প্রকাশ : যুগান্তর, ২৭ অগাস্ট ১৯৭৮

অধ্যায় ১ / ১৮

সকল অধ্যায়

১. নিমফুলের মধু – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
২. গৃহ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৩. হাতেখড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪. ধুলো – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৫. সন্ন্যাসীর পুঁথি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৬. শেতলের খিদে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৭. ভয় – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৮. শোধ তোলা – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৯. মানুষ-মুনিষ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০. ঠাকুরদার বাড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১১. নৌকোবদল – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১২. হলদী নদীর তীরে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৩. ছোঁ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৪. বুকজলে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৫. ঘোড়াদহের মাঠে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৬. ঘুম – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৭. মন্থরোর মা অথবা রাজধানীর গল্প – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৮. ভাঙন – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন