হাতেখড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

হাতেখড়ি

১৩৮০ বঙ্গাব্দে বাণী-বন্দনার দিন বেলার দিকে সবে আগের রাতের বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, পঞ্চাননের ছোট মেয়ে পর পর হ্যাঁচ্চো দিতে দিতে থেমে থেমে কোনওরকমে বলল, ‘চলো বাবা, এই বেলা বেরিয়ে পড়ি!’

পঞ্চানন এই আশঙ্কাই করছিল । আগের রাতে কোত্থেকে গোছা গোছা মটরশুঁটি গাছ উপড়ে এনেছে, সকাল থেকে বসে বসে মটরশুঁটি বেছে আলাদা করছিল, তিনু সামনে এসে হ্যাঁচ্চো দিতেই তার মন ডেকে উঠল, এবার উপায়! উদ্বেগে মটরশুঁটিলতার জটের মধ্যে না দেখে শোঁপোকার গায়ে সে হাত রেখেছে । বৃষ্টি থেমে যাবে সে ভাবেনি ।

একে মাঘ মাস, তার ওপর রাত থেকে বৃষ্টি । কনকনে শীতে ভোরবেলা চান করে তিনুর বোধহয় সর্দি লেগেছে । একটা হাঁচি সামলে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি বসে থাকো, আবার বৃষ্টি নামুক—’

হাঁচির সঙ্গে অল্প অল্প কাঁপুনি । সর্দিতে চোখ ছলছল করছে । পঞ্চাননের মনে হল, মেয়েটা এবার কেঁদে ফেলবে । আকাশের অবস্থা দেখার ভান করে সে তিনুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘বৃষ্টিকে বিশ্বাস কী?’ মেয়েটার চোখ তার বুকে বিঁধে আছে ।

নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে, তবু কিছুতেই তিনু আঁচল দিয়ে নাক মুছে শাড়ি অপবিত্র করবে না । তার খুব ইচ্ছে ছিল, আজকের দিনটা নতুন শাড়ি পরবে । তাই নিয়ে কাল সারাদিন তার মন খুঁতখুঁত করেছে । শেষ পর্যন্ত মায়ের সাত ছেঁড়া বিয়ের শাড়িটা বাক্স থেকে বের করে সে নিজেকে বুঝ দিয়েছে । শাড়িটা ধোয়াই ছিল, তবু সে নিজে আরেকবার খুব যত্ন করে কেচে নিয়েছে । অত বড় শাড়ি, ঠিকমতো সামলাতে পারেনি, পেটের কাছটা উঁচু হয়ে আছে । পায়ের দিকের শাড়ি সাবধানে তুলে ধরে সে কলতলা থেকে নাকটাক ধুয়ে এসে বলল, ‘তুমি ওঠো তো । আমি বলছি আর বৃষ্টি হবে না’

‘পুজোই হয় কিনা দেখ ।’ পঞ্চানন গলায় জোর পাচ্ছে না, তবু বলল, ‘মাইক-টাইক তো শুনছি না ।’

‘তুমি কি অদ্ভুত কথা বলছ! সরস্বতী পুজোর দিন সরস্বতী পুজো হবে না!’

গলার স্বরে পঞ্চানন ভয় পায় । মেয়েটা তার প্রাণ । এমনিতে অনেক রকম দুঃখকষ্ট সওয়া পঞ্চাননের অভ্যেস, কিন্তু মেয়েটার চোখে জল দেখলে সে আর ঠিক থাকতে পারে না । সেই কালবৈশাখীর সময় থেকে বায়না ধরেছে এবার সরস্বতী পুজোয় তাকে হাতেখড়ি দিতে হবে । বলতে নেই, তাদের বংশে কেউ কখনও এই বয়েসে এতোটা লেখাপড়া শেখেনি । সে নিজে পাঠশালায় যেতে শুরু করে তেরো-চোদ্দ বছর বয়সে । তখন অ-আ-ক-খও চেনে না । সে তুলনায় তিনুর কাণ্ড দেখে অবাক হতে হয় । কোত্থেকে শিখল, কার কাছে শিখল কে জানে, খুদে খুদে হরফের লক্ষ্মীর পাঁচালী সে দুলে দুলে দিব্যি পড়ে যায় । আরও আশ্চর্য, সে ইংরিজি পড়তে পারে । মটরশুঁটি মোট কটা, পঞ্চাননের আগে তিনুই গুনে বলে দেবে । শুধু লিখতে শেখেনি । হাতেখড়ির আগে লেখার নিয়ম নেই । না হলে এতদিনে নিশ্চয়ই লিখতেও পারত । লিখতে পারে না বলে ইস্কুলে ভর্তি হতে পারছে না ।

তিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে পঞ্চাননের বুকের মধ্যেটা খরখর করে ওঠে । কাল দাম করেছিল, একটা শিলেট আজকাল টাকা-দু টাকা । ডানহাতের তেলো কুটকুট করছে, শোঁয়া লেগেছে টের পায়নি, অন্যমনস্কভাবে বাঁহাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে জোরে জোরে জায়গাটা চুলকোতে চুলকোতে পঞ্চানন বলল, ‘আমি বরং একবার দেখে আসি ।’

‘তুমি গেলে আর আসবে নাকি! আমাকে টাকা দাও, আমি খড়ি-শিলেট কিনে আনি । প্যান্ডেলেও অমনি খোঁজ নিয়ে আসব ।’

গোটা বাড়িতেই এখন সর্বসাকুল্যে সতেরোটা পয়সা আছে । লক্ষ্মীর আসনের নিচে সিঁদুরমাখানো কটা তামার পয়সার হিসেব ধরে লাভ নেই । ও-পয়সা আজকাল আর চলে না । পঞ্চানন জোর করে ক্ষীণ একটা ভরসার কথা ভাবে, তিনুর মায়ের কাছে যদি…বলল, ‘দেখি— তোর মা ফিরুক—’

তিনু ঝাঁঝের সঙ্গে কেঁদে ফেলে, ‘মা তো ফিরেছে! রান্নাঘরে বসে বসে কাঁদছে! যাও না, তুমি টাকা এনে দাও ।’

মেঘলায় কুয়াশায় বৃষ্টিতে এক পাতা বড়িও শুকোয়নি, রোদ না পেয়ে পেয়ে টোকো গন্ধ হয়ে গেছে, আজ পাতলা একটু রোদ উঠতেই তিনুর মা বণিকদের বাড়ির ছাদে বড়ি শুকোতে দিতে গিয়েছিল । এ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু বাড়ি । সবার আগে রোদ পায়, রোদ যায়ও সবচেয়ে দেরিতে । ছাদ ভিজে দেখে বড়ির পাতাগুলো কার্নিশে রেখে ছাদের একটা কোণ আঁচল দিয়ে মুছেটুছে উঠে দাঁড়াতেই কার্নিশে চোখ পড়ল, এক পাতা বড়িও নেই! দৌড়ে কার্নিশের কাছে এসে যতটা পারে নিচের দিকে ঝুঁকে দেখল, রাস্তার জলে-কাদায় বড়িগুলো মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে । তিনুর মা প্রথমে বুকফাটা চিৎকার করে উঠেছিল, তারপর অনেকক্ষণ ছাদে বসেই ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদল । অত উঁচু ছাদ, প্রায় আকাশছোঁয়া, কেউ তার কান্না শোনেনি ।

রান্নাঘরের দরজা পঞ্চাননের মাথায় ঠেকে যায় । নিচু হয়ে ভেতরে ঢুকতে আজ আর সাহস হল না । বাইরে দাঁড়িয়ে সামান্য কুঁজো হয়ে সে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করল । তিনুর মা হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।

মাইকে হিন্দি গান শুরু হয়েছে । আর সময় নেই, তিনুর মায়ের ব্যাপারটা পরে দেখা যাবে, পঞ্চানন গলা খাঁকরে বলল, ‘পঞ্চা সাহার দোকানে কাল বড়ি দেবার কথা ছিল না?’

ওদিক থেকে একইরকম ফোঁপানি । পঞ্চানন ভিত্তিটা জবরদস্ত করতে চায় । আরেকটু ঝুঁকে এসে বলল, ‘কাল নিত্য বাঁড়ুজ্যের দোকানে টাকার জন্য গেছিলাম, বললে বড়ি নিয়ে এলেই আগের টাকা মিটিয়ে দেবে ।’

একইসঙ্গে তিন-চারটে গান জড়াজড়ি করে তেড়ে আসছে । সেই আওয়াজেই হয়ত, কান্নাও এখন একটু মৃদু । পঞ্চানন আর দেরি না করে আসল কথাটা বলে ফেলে, ‘তিনুটাকে প্যান্ডেলে হাতেখড়ি করিয়েই আমি যাব । বড়ি দিয়ে একবারে টাকা নিয়ে ফিরব । তোমার কাছে এখন গোটা দুই টাকা আছে নাকি? তিনুর একটা শিলেট-খড়ি—’

কথা শেষ হল না । তার মুখের ওপর দোমড়ানো-মোচড়ানো কাদামাখা কলাপাতার পুঁটলি ছিটকে এসে পড়ল । তখনও থ্যাঁতলানো ভাঙাচোরা কাদালাগা বড়ি লেগে আছে ।

রান্নাঘরের ভেতরে ততক্ষণে মড়াকান্না উঠেছে ।

সংসারের অনেক কিছুই তিনু আগে থেকে বুঝতে পারে । বাবা মায়ের ভরসায় আছে জেনে সে পুরোপুরি নিরাশ হয় । এরপর কী হবে সে জানে । শেষ দেখার অপেক্ষায় না থেকে তিনু জলকাদা ভেঙে বাসরাস্তার দিকে চলে যায় । তার এগারো বছরের জীবনে কী করে যেন টের পেয়ে গেছে, তার জীবন সুখের হবে না । না হলে অ্যাদ্দিনে আর হাতেখড়িটুকু হয় না!

প্যাচপেচে রাস্তাঘাট । কোথাও কোথাও বিঘৎখানেক জল দাঁড়িয়ে গেছে । কোথাও আরও বেশি । একেক জায়গায় মাঠ একদম পুকুর । পুকুরের ওপর মাচা বেঁধে পুজো হচ্ছে । শাড়ি সামলে বাঁশের সরু সাঁকো বেয়ে তিনু কাছে যাবার চেষ্টা করে সাবধানে ফিরে এল । ভয় করে, যদি পড়ে যাই । বাসরাস্তার মুখটাতে প্যান্ডেলে জল ঢুকেছে । একটা টেবিলের ওপর ঠাকুর বসানো হয়েছে । টেবিলের সামনের দিকটা খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে তাতে তুলি বুলিয়ে এখনও পদ্ম আঁকা হচ্ছে ।

তিনু জল এড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের এখানে হাতেখড়ির সময় কি চলে গেছে?’

একটা ছেলে বালতি করে ছাই এনে এনে একটা জায়গা উঁচু করছিল, বলল, ‘শ্লেট-টেট এনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক’ ।

একটু দূরে পাজামা আর হাওয়াই শার্ট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, তিনুকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, ‘তুমি কার হাতেখড়ি দেবে?’

লোকটার চোখ তিনুর মুখ গলা বেয়ে সামান্য নিচে নেমে ছটছট করছে । বয়েসের তুলনায় তিনু একটু বেশি বাড়ন্ত, তার ওপর শাড়ি পরে তাকে আজ বড়-বড়ই দেখাচ্ছে । তিনু খুব আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে বলল, ‘আমার!’

‘তাই বুঝি? কে তোমাকে হাতেখড়ি দিয়ে দেবেন?’

লোকটার চোখের সামনে তিনু জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মনে মনে একদম কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘পুরুৎঠাকুরকে বললে হবে না?’

লোকটা হাতের সিগারেট জলে ছুড়ে দিতেই জল ছ্যাঁক করে উঠল । মুখের মধ্যে ধোঁয়া আটকে রেখেছিল, মাথার ওপর ধোঁয়ার বড় বড় তিনটে শূন্য বানিয়ে বলল, ‘দৌড়ে গিয়ে তুমি শ্লেট নিয়ে এসো, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব ।’

যা বিচ্ছিরি লোকটা! তিনু পালিয়ে বাঁচে । হাতিখড়ির ব্যবস্থা করে দেবে ভেবে আপাতত সে লোকটাকে মনে মনে ক্ষমা করে দিল । এখন একটা শিলেট আর একটা খড়ি হলেই হয় । তিনু হঠাৎ কী করে বুঝতে পেরে গেল, ওই লোকটাকে বললে এ নিশ্চয়ই তাকে খড়ি-শিলেট কিনে দেবে । তাছাড়া আর কোথায়ইবা সে পাবে । দুহাতে শাড়ি সামলে জলকাদার ওপর দিয়ে সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে দম বন্ধ করে তিনু ভাবল, ফিরে গিয়ে বলবে নাকি? লোকটা পিছন থেকে গলা তুলে বলল, ‘ঠিক আসছ তো খুকি?’

শিলেটের কথাটা মুখে বলতে বড় লজ্জা । যদি লিখে জানাতে পারত? তিনু পড়তে পারে, এখনও লিখতে পারে না ।

প্রথম প্রকাশ: যুগান্তর, ১৮ মার্চ ১৯৭৯

সকল অধ্যায়

১. নিমফুলের মধু – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
২. গৃহ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৩. হাতেখড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪. ধুলো – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৫. সন্ন্যাসীর পুঁথি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৬. শেতলের খিদে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৭. ভয় – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৮. শোধ তোলা – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৯. মানুষ-মুনিষ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০. ঠাকুরদার বাড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১১. নৌকোবদল – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১২. হলদী নদীর তীরে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৩. ছোঁ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৪. বুকজলে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৫. ঘোড়াদহের মাঠে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৬. ঘুম – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৭. মন্থরোর মা অথবা রাজধানীর গল্প – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৮. ভাঙন – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন