অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
ছটা নারকেলগাছে জ্যোৎস্না ঘাই দিচ্ছে । আমার ঠাকুরদার বাড়ির এই জ্যোৎস্না আমি চিনি । ষোল বছর বয়েস পর্যন্ত বছর-ভর এই এক পূর্ণিমাই আমি দেখেছি ।
জ্যোৎস্নায় চকচকে পিতলের গাড়ুটা দোতলার চৌবাচ্চার গা-ঘেঁসে তেমনই আছে । আমার ঠাকুরদার শেষ রাতের নিত্যসঙ্গী । শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস ।
বড় জ্যাঠাবাবুর গাড়ু গোলগাল । এখন বৈদ্যবাটিতে তাঁর নিজের বাড়িতে । যদিও তিনি বা তাঁর ছেলেরা আর গাড়ু নেন না, বাথরুমে জলের ট্যাপ আছে । তাঁর পাঁচটিই ছেলে । একজন বিদেশে, একজন হলদিয়ায়, একজন পুণায় ক্যামেরা ঘোরানো শেখে । বাকি দুজন এখনও বউ নিয়ে পৈতৃক ভিটেয় ।
মেজো জ্যাঠা চন্দননগরে বাড়ি করে উঠে গেছেন ।
আমি সেজোজনের একমাত্র ছেলে । গোল পার্কে ওয়ান বেডরুমের ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে নির্জনবাস করি । বাবা-মা উত্তরপাড়ায় একতলা ভাড়া দিয়ে অর্ধেক-তোলা দোতলায় আকাশ ধরে ঝুলে আছেন ।
নকাকা যাত্রার পার্ট করতেন । ঠাকুরদা মারা গেলে কাকা-জ্যাঠারা আজ ইনি কাল উনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান । নকাকা প্রৌঢ় বয়েসে কাকিমা ও তিন মেয়ে নিয়ে বর্ধমানে এক প্রাক্তন জমিদারের পুকুর-জমি তদারকির কাজ জুটিয়ে চলে গেছেন ।
রাঙাকাকা স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক । শ্রীরামপুরেই রেললাইনের ওপারে বাড়ি তুলেছেন । বিরাট বৈঠকখানা । তাতে একসঙ্গে অনেক ছাত্র পড়ানোর সুবিধে ।
নতুন কাকাকে আমার ছেলেবেলায় পুজো-প্যান্ডেলে আফ্রিকা ও পৃথিবী আবৃত্তি করতে শুনেছি । তারপর রেলের চাকরি । ঠাকুরদার পরে খালি ঘরে তালা দিয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে যান ।
একুশ বছর পর আমি শ্রীরামপুরে এসেছি । ছেলেবেলার বাড়িতে । ছেলেবেলার বাড়ি মানে আমার ঠাকুরদা ও তাঁর আট ছেলের বাড়ি । ঠাকুরদার লম্বাটে গড়নের গাড়ুটা দেখলাম মণিকাকা ব্যবহার করছেন । পোস্ট-অফিসের কেরানি, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পৈতৃক বাড়িতেই রয়ে গেছেন ।
বড় জ্যাঠাবাবুদের পাশাপাশি দুটো ঘরেও তালা । ঝুল বারান্দায় মরা মাধবীলতার শুকনো শিরা-উপশিরা আজও দড়ি বেঁধে টেনে রাখা আছে ।
সাত ঘর ছোঁয়া রাজপথের মতো যে বিরাট বারান্দায় আমরা আঠেরো-কুড়িটি বালক-বালিকা দুবেলা পাঠশালা জুড়তাম, সেটার কোণে-কোণে এখন মাকড়শা-আরশোলার কলোনি । ওয়্যারিং ঝুলে গেছে । সন্ধে থেকে অন্ধকার ।
একতলার বারান্দায়, ঠিক এটারই নীচে, একসঙ্গে আঠাশ-তিরিশটা পাত পড়ত । এখন একটা মাত্র জিরো পাওয়ার টিম-টিম করে, না-হলে ঘরের দরজা খুঁজে পাওয়া যায় না ।
এক পাশে ঝুনো নারকেলের স্তূপ । ছটা গাছের সারা বছরের নারকেল! বাগদিপাড়ার গয়ানাথ এসে নিয়ে যাবে । নারকেল-বেচা টাকা থেকে নিজেদের দু-ভাগ কেটে রেখে মণিকাকা ছ-ভাইয়ের নামে-নামে মনি অর্ডার পাঠাবেন । প্রতি বছর পাঠান ।
কিছু নারকেল আর কিছু জ্যোৎস্না নিয়ে ওই গাছকটাই যা আগের মতো । আর সব বদলেছে । এই বাড়ি কি সেই বাড়ি? বাসিন্দার সংখ্যাও সাড়ে তিন । মণিকাকা, ছোটকাকা, তাঁর স্ত্রী ও একটি মেয়ে । অত বড় বাড়িতে একটি মাত্র শিশু!
আমার ঠাকুরদার নাম সূর্যকান্ত কাব্যতীর্থ । আসল পদবী চক্রবর্তী । ও-রকম শুদ্ধউচ্চারণ স্বাস্থ্যবান হেড পণ্ডিত আমি দ্বিতীয় দেখিনি । সৎ হয়েও তিনি স্কুল থেকে রিটায়ার করে একতলাকে দোতলা করেছেন । সকাল থেকে সন্ধে নিজে মিস্ত্রিদের সঙ্গে থেকেছেন, এক মুঠো বালি থেকে এক কণা সিমেন্ট খসতে দেননি ।
শুধু বাড়ি তৈরির ব্যাপারেই নয়, বাড়ির সব কাজেই তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান সুপারভাইজার । সবদিকে তাঁর নজর । তাঁর শাসনে তাঁর পুত্রবধুরা একটি সরষেদানার অপচয়েও সন্ত্রস্ত থাকতেন । তিলেক অপচয় তিনি সহ্য করতে পারতেন না ।
ঠাকুরদার একটা জেদ ছিল । তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কোনও ছেলের আলাদা বাড়ি তো দূরের কথা, আলাদা হেঁসেলও চলবে না । যৌথ পরিবারের লোকবলের দিকটা তাঁর কাছে খুব বড় ব্যাপার ছিল । তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্ররা বংশানুক্রমে এই বাড়িতেই জীবন কাটাবে । কোন প্রতিবেশীর বাড়িতে কোন ছেলে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে শুনলে দীর্ঘ বারান্দায় তাঁর খড়ম পায়ে পায়চারি শোনা যেত অনেকক্ষণ । তিনি তিনতলার ভিত দিয়েছিলেন ।
ঠাকুমার শ্রাদ্ধে ধূপধুনোর ধোঁয়ার মধ্যে আমার বাবা-জ্যাঠাদের আটটি মুণ্ডিত মস্তককে উদ্দেশ্য করে ঠাকুরদা বলেছিলেন, আমার শ্রাদ্ধেও আমি পরলোক থেকে তোমাদের এই রকম একত্রিত দেখতে চাই । লোকবলই শ্রেষ্ঠ বল ।
বলে তিনি পুত্রবধূদের দিকে একবার বিরূপ চোখে তাকিয়েছিলেন ।
ভোরবেলা গরু বের করা ছিল মণিকাকার কাজ । গোয়ালঘর থেকে বাইরের চাতালে । বাতাবিতলায় । ভোরে ঠাকুরদার সংস্কৃত মন্ত্রের সঙ্গে হাম্বা-হাম্বা আমার এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল যে জামাইষষ্ঠীতে এক রাতের জন্যও মামার বাড়িতে থাকতে আমার একটু অসুবিধে হত ।
মণিকাকা নিজে খড় কাটতেন, খোল ভেজাতেন । চাতালের বাঁধানো মাটির গামলায় গরুর জাবনা দিয়ে দাঁতন মুখে সোজা গঙ্গায় । তারপর বড় জ্যাঠাইমার রান্না ভাত ডাল মাছের ঝোল ও মেজজ্যাঠাইমার সাজা পান খেয়ে পোস্টঅফিসে ।
বড়দের আপিশ, ছোটদের ইস্কুল, অতএব রান্না শুরু হত শেষরাতে । বড় জ্যাঠাইমা উনুনে ভাত চড়িয়ে রান্নাঘরের মেঝেয় আঁচল বিছিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতেন । ভাত ফোটার শব্দে ঠিক তাঁর ঘুম ভেঙে যেত ।
আলো ফুটলে তিনি রাঙাকাকার হাতে বাজারের থলে ধরিয়ে কানে ফর্দ পড়িয়ে দিতেন । রাঙাকাকা ঠাকুরদার কাছ থেকে বরাদ্দ টাকা নিয়ে বাজারে যেতেন । বাজার এলে অন্য বউয়েরা শিল-নোড়া নিয়ে বসে যেতেন । গয়লা এসে গরু দুইয়ে দিত ।
জলখাবার, আপিশের ভাত, ইস্কুলের ভাত, ছেলেদের টিফিন, নিজেদের খাওয়া— সবশেষ হতে বেলা আড়াইটে-তিনটে ।
ওবেলার রান্নার দায়িত্ব একেক দিন একেক জনের পালা করে । তখন বড় জ্যাঠাইমার ছুটি । সন্ধে হতেই তিনি আমাদের আঠেরো-কুড়িজনকে ডেকে নিয়ে পড়াতে বসতেন বারান্দায় । আমার ছোট দু-কাকাকে তিনিই কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন । আমার মা আমাদের সকলকে ছবি আঁকা শেখাতেন, তাঁর আঁকার হাত ছিল চমৎকার । হাতের লেখা সুন্দর করতে আমরা তাঁর কাছেই শিখেছি । আমার, বড়দার (বড় জ্যাঠাবাবুর বড় ছেলে) ও কেতকীর (মেজো জ্যাঠার মেয়ে) হাতের লেখা দেখিয়ে আমার মা তাঁর জায়েদের কাছে গর্ব করতেন ।
অসুখ-বিসুখে সেবা করতে ন-কাকিমার জুড়ি ছিল না । শুধু তাঁর সেবা-যত্নের লোভে আমি ছেলেবেলায় অনেক দিন মনে মনে জ্বর চেয়েছি । ন-কাকার চাকরি ভাল লাগত না, তিনি তিনবার চাকরি ছেড়েছেন । যাত্রা করতেন বলে কাকিমাকে অনেক দুঃখ সইতে হত । বিশেষ করে ঠাকুরদাকে লুকিয়ে রিষড়ায় কি ভদ্রেশ্বরে সারারাত যাত্রা করে এসে যেদিন তিনি ভোরে ঠাকুরদার কাছে ধরা পড়ে যেতেন, সেদিন তাঁর ও কাকিমার লাঞ্ছনার শেষ থাকত না । ঠাকুরদার বকুনি তো মেঘগর্জন, শুনে আমরা ছোটর দল যে যার বিছানায় ঘুম ভেঙে ভয়ে ও উত্তেজনায় উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম । ঠাকুরদা কাকিমাকেও বকতেন, কেন তিনি আগেই ঠাকুরদাকে জানিয়ে দেননি ।
একদিন, সেও ভোরবেলা, ঠাকুরদা প্রাতঃকৃত্য সেরে, শুচি বসনে, পুবমুখো আসনে, উদাত্ত স্বরে স্তোত্র পাঠ করছেন, এমন সময় নীচে আরও উদাত্ত, আরও জলদ কাবুলির গলার শোনা গেল । নীলকান্তবাবুকে ডাকছে । নীলকান্ত ন-কাকার নাম ।
ঠাকুরদা পড়েই চলেছেন, তবে খুব দ্রুত, কাবুলিটাও উত্তরোত্তর গলা চড়াচ্ছে, হঠাৎ খিড়কির দরজা দিয়ে ন-কাকাকে পালাতে দেখে স্তোত্র পাঠ থেমে যায় । পঁচাত্তর বছরের ঠাকুরদা সাত লাফে সিঁড়ি ভেঙে বাঘের থাবায় ন-কাকার ঘাড় ধরলেন ।
— বাড়িতে কাবলি কেন?
ন-কাকা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চোখে ঠাকুরদার দিকে শুধু চেয়ে আছেন ।
— টাকা নিয়ে কী করেছিস? টাকার তোর দরকার পড়ল কিসে?
ন-কাকার মুখে কথা নেই ।
— তোর বাবা বেঁচে নেই? রোজগেরে দাদারা নেই? তুই গেছিস কাবলির কাছে টাকা নিতে!
বাঁ হাতে চুলের মুঠি ধরে ডান হাতে তিনি ন-কাকার গালে ঠাস-ঠাস চড় কষাতে লাগলেন । সেদিন বড় জ্যাঠাবাবু, মেজ জ্যাঠা, আমার বাবা ও রাঙাকাকাও ঠাকুরদার চড়-ঘুঁষি খেয়েছিলেন । তাঁরা ন-কাকাকে বাঁচাতে এসেছিলেন । মণিকাকা গরুর জাবনা মাখা হাতে ছুটে এসেছিলেন, ঠাকুরদার চড় থেকে মুখ বাঁচাতে তাঁর সারা মুখে খোল-ভূষি লেপে যায় ।
ন-কাকা কাকিমাকে রুপোর মল কিনে দিয়েছিলেন । সে দায়িত্ব তাঁর নয় ।
এমার্জেন্সি ভাণ্ডার থেকে ঠাকুরদা সেদিন কাবলির টাকা মিটিয়ে দিয়েছিলেন ।
নানা খাতে ঠাকুরদা আলাদা-আলাদা টাকা রাখতেন । ওষুধ-ডাক্তার, অতিথি-অভ্যাগত, রোববারের মাংস ও বাড়তি বাজার ইত্যাদি । সংসার খরচের জন্য তিনি শুধুমাত্র রোজগেরে ছেলেদের কাছ থেকে তাদের আয়ের মাত্র ২৫ শতাংশ নিতেন । তাছাড়া প্রত্যেক মাসে মাথাপিছু পাঁচ টাকা নিয়ে পোস্টঅফিসের ক্যাশ সার্টিফিকেট কিনে রাখতেন, ভবিষ্যতে কোনও নাতনির বিয়ের খরচ কম পড়লে ওই টাকা থেকে কাজ চালানো যাবে । তাঁর নিজের শ্রাদ্ধের খরচ পোস্টঅফিসে সুদে বাড়ছিল ।
রোববার বা যে-কোনও ছুটির দিনে খাবার বারান্দাকে মনে হত নেমন্তন্ন বাড়ি । সেদিন বাড়ির সব বউ একসঙ্গে পরিবেশন করতেন । বড় জ্যাঠাইমা রান্নাঘরে বসে গামলায় একেকটি পদ তুলে দিতেন, আর মাছি তাড়াতেন । রাঙাকাকিমার তেমন কাজে খ্যাতি ছিল না । একটু কুঁড়েও ছিলেন । সাজতে খুব ভালোবাসতেন । তাঁর গানের গলা ছিল । বিয়ের আগে নাকি দুয়েকবার রেডিওয় অতুলপ্রসাদ গেয়েছিলেন । তিনি শুধু লেবুটা নুনটা দিয়ে যেতেন । খুব বেশি হলে, জলের জগ । নতুন কাকা একদিন খাবার পাতে কচি, রসহীন লেবু পেয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে যান । খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর খুব খুঁতখুঁতুনি ছিল । পরে একদিন ওই রাঙাকাকিমার হাতেই তাঁর সঞ্চয়িতার পাতা ছিঁড়ে যাওয়ায় তিনি রাঙাকাকিমাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলেন । সেই থেকে রাঙা-কাকাদের সঙ্গে তাঁর কথা বন্ধ । যেদিন রেলের চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন, আমি তাঁর ব্যাগ, সুটকেশ রিকশায় তুলে দিচ্ছি, রাঙাকাকিমা তাঁর জানলা থেকে আমাকে হাতছানি দিলেন, কাছে যেতে বললেন, ও কোথায় যাচ্ছে রে?
— তুমি জানো না?
— আমাকে কিছু বলে, না জানায়! সুটকেশ-টুটকেশ নিয়ে কোথায় চলল?
— রেলের চাকরি পেয়েছে, শিলিগুড়ি যাচ্ছে ।
ততদিনে আরও অনেকেই বাড়ি ছেড়েছেন । বড় জ্যাঠাবাবু বৈদ্যবাটিতে ।
মেজো চন্দননগরে । আমার বাবা উত্তরপাড়ায় জানলা বসাচ্ছেন । তখনও ঠাকুরদার শ্রাদ্ধের পর বছর ঘোরেনি ।
নতুনকাকা পরের বছর এসে বউ-ছেলেকে নিয়ে যান ।
এই নতুনকাকাই যেদিন কাগজে তাঁর আই এস সির রেজাল্ট দেখে এসে ছোট বৈঠকখানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠেছিলেন, সেদিন তাঁর সব বৌদি মিলে যেভাবে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন তার কোনও তুলনা হয় না । অনেকটা রামায়ণ-মহাভারতের যুগের মতো । ঠাকুরদা তাঁর এই আদরের ছেলেটিকে বেকার অবস্থায় বিয়ে দিয়েছিলেন, হাত খরচের টাকাও বরাদ্দ করেছিলেন, কিন্তু নতুন বউয়ের মনে বেকার স্বামীর জন্য কোনও গ্লানি জমতে দেননি তাঁর বৌদিরাই । কোনও ইন্টারভিউয়ের পর বাড়িতে পিওন এলে সবাই লাফিয়ে উঠেছেন, বুঝি নতুন ঠাকুরপোর চাকরি হল ।
সেই মন, সেই যুগ একদিন ঝরে যায় । ঠাকুরদার শেষ ক-বছর ভাইয়ে-ভাইয়ে, বউয়ে-বউয়ে তিক্ততা, হাজারও খিটিমিটি রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।
সামান্য দুধের ভাগ নিয়েও ঈর্ষা দেখেছি । মেজো নিশ্চয়ই ওর ছেলের জন্য আজ এক পো দুধ বেশি সরিয়েছে!— এই সন্দেহও শুনেছি । আমি কি সারা জীবন শুধু হেঁসেল নিয়েই পড়ে থাকব! কেন, মেজো কি একদিন উনুন ধরাতেও পারে না? একবেলা বাসন মাজলে সেজোর কি ছবি আঁকার আঙুল নষ্ট হয়ে যাবে? রাঙা কী অত গানের গলা দেখায়! দিনভর ছেলেদের পিছনে এমন গলা ফাটাতে হলে দেখা যেত! বড়রই বা অত গুমর কিসের? বাবা তো দেখছি সব চাবিই একে-একে ওর আঁচলেই বাঁধছেন! ভিমরতি!
তারপর শুরু হয় এঘরে হরলিকস, ওঘরে মাখন, সেঘরে জ্যাম-জেলি— আলাদা আলাদা বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা ।
ও কেন এত কম টাকা দেবে? সে কেন বসে বসে খাবে? ও কেন সারা রাত আলো জ্বেলে রাখে? সে কেন সারা সন্ধে বন্ধু নিয়ে বৈঠকখানা আটকে রাখে? ও কেন অত ভোরে বেরোয়, সে কেন অত রাত করে ফেরে, আমার বউয়ের অন্য কাজ নেই? এক ধরনের হীনতায় বাড়ি ম-ম করে । অশান্তিতে বাড়ি থম মেরে থাকে ।
বড় জ্যাঠাবাবু একদিন ঠাকুরদাকে বললেন, আপনি এসব বুঝতে চান না, কিন্তু ছেলেরা বড় হয়েছে, রোজ রোজ এত অশান্তি ওরা সহ্য করবে কেন?
রাঙাকাকা একদিন বললেন, আপনি চোখ বুজে থাকেন কিন্তু এরকম পরিবেশে মেয়েদের মানুষ করা শক্ত!
নতুনকাকা বললেন, বাবা! আপনি যদি সম্মতি দেন, আমি রেণুকে নিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিই, বাড়ির সবাই যখন তাই চাইছে!
ছোটকাকা অনার্সে গোল্ড মেডেল পেয়ে সংস্কৃতে এম-এ পড়ছিলেন, বললেন, বস্তিতে থেকে সংস্কৃত চর্চা হয় না । তার চেয়ে পড়াশুনো ছেড়ে দোকানে খাতা লেখাও ভালো । বড়দা মেজদারাও তো চায়, পড়া ছেড়ে যাহোক একটা চাকরি করি । লেখাপড়া তো শুধু ওদের ছেলেদের জন্য । বেশ, তাই হবে!
শেষদিকে ঠাকুরদাও আর তেমন দাবাথাপা ছিলেন না । তাঁর পেশী শিথিল, মন ঝিমনো, বেশিরভাগ সময় একা চুপচাপ বসে বসে শুধু ভাবেন । কখনও খড়মের খট খট শোনা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা । আগের মতোই শেষ রাতে ওঠেন, কাপড়ের খুট গায়ে দিয়ে পায়খানা যান, শুচি বসনে পুবমুখো হয়ে সংস্কৃত স্তোত্র পড়েন, বাজারের টাকা বের করে দেন । কারও বাড়ি ফিরতে দেরি হলে যথারীতি বার বার উঠে এসে খোঁজ নেন, ফিরেছে কিনা ।
তাঁর ঘুম কমে গিয়েছিল । মাঝরাতে তাঁর ঘরের সামনের জ্যোৎস্না ভেঙে চৌবাচ্চার দিকে যেতে যেতে আমি অনেক দিন শুনেছি, তিনি একা ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছেন । অত রাতে, একা কার সঙ্গে? ঠাকুমার সঙ্গে কি?
ছেলেদের অনুনয় করেন, আমি বেঁচে থাকতে তোরা আলাদা হোসনি । আর তো কদিন ।
তারপর খড়মের খট-খট ।
মারা যাবার আগে তিনি উইল করে যান, বাড়ির কোনও অংশ ভাড়া দেওয়া যাবে না । পার্টিশান তোলা যাবে না ।
সময়ের উলটো স্রোতে তিনি তাঁর স্বপ্নের খেয়া বইতে চেয়েছিলেন । ভেবেছিলেন এইসব শর্তের দড়ি-দড়ায় ছেলেদের এক জায়গায় বেঁধে রাখবেন ।
ওই সময়টা ঠাকুরদা ঘন ঘন নস্যি নিতেন । ওটিই তাঁর বড় নেশা, আর দু-বেলা দু-খিলি পান । শেষ দিকে দাঁত ছিল না, নতুন কাকিমা পান থেঁতো করে দিতেন ।
বাড়িতে চা হত কোনও অতিথি, কি বাড়ির কোনও জামাই এলে । সারা বাড়িতে অতজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, আমি কোনওদিন কাউকে সিগারেট খেতে দেখিনি ।
আমরা ছোটরা একদিন সিগারেট খেয়ে মণিকাকার কাছে শাস্তি পাই । দল বেঁধে মাহেশে রথের মেলায় গিয়েছিলাম, সেখানে স্কুলের কালীচরণের প্ররোচনায় দুটো কাঁচি কিনে আমরা আঠেরোজন একটা করে টান দিয়ে খুব কেশেছিলাম । বড়দের চেনা-জানা কেউ দেখে থাকবে, বাড়ি ফিরতেই মণিকাকার মুখোমুখি । তিনি ওত পেতে ছিলেন । শাস্তি ঠিক হয়, পরদিন স্কুল থেকে ফিরে ছাদে আমাদের বলখেলা বন্ধ ।
গরুর চাতালের বাতাবি লেবু দিয়ে ছাদে ফুটবল খেলা আমাদের বিকেলের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল । এখন মনে হয়, বিকেলের বিরাট ছাদটাই ছিল আসল আকর্ষণ । এই ছাদ থেকে কতদিন রামধনু দেখেছি । ছাদের এক কোণে মঞ্চ বেঁধে আমরা বাড়ির ছেলেরা অবাক জলপান, লক্ষ্মণের শক্তিশেল করেছি । বুড়োরা আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন । কাকি-জ্যেঠিরা আমাদের সাজিয়ে দিয়েছেন । ন’কাকা হতেন প্রম্পটার ।
ছাদ বলতে, সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে পৌষসংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো । শ্রীরামপুরে ওটাই ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর বড়দিন । আকাশ ঘুড়িতে-ঘুড়িতে ছেয়ে যেত । ঘুড়ি ওড়ানোয় বাড়ির বড়দের উৎসাহ ছোটদের চেয়েও বেশি ছিল । ঘুড়ি ওড়ানো, প্যাঁচ খেলা, ঘুড়ি দিয়ে কাটা-ঘুড়ি লটকে আনার রীতি-পদ্ধতি নিয়ে তাঁদের চিন্তা, গাম্ভীর্য, নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ পুরো ব্যাপারটাকে আমাদের চোখে বেশ মর্যাদাবান করে তুলত ।
পৌষসংক্রান্তির কদিন আগে থেকে বাড়িতে লাটাই পালিশ করা, ঘুড়ি বানানো, সুতো কেনার হিড়িক পড়ে যেত । তার ওপর ছিল ছাদজোড়া সুতো মাঞ্জা দেওয়ার উত্তেজনা । সবুজ বোতল গুঁড়িয়ে মিহি করা, শিরীষ ভেজানো, এইসব আয়োজনে বড়দের সঙ্গে সারাক্ষণ আমরা সেঁটে থাকতাম । সে এক রোমাঞ্চ!
তারপর পৌষের শেষ দিনটিতে ভোর থেকে আমরা পাখি হয়ে সারা আকাশ চক্কর দিয়ে ফিরতাম । মাঝে মাঝে নিচে নেমে নলেন গুড় দিয়ে গরম গরম চিতুই পিঠে খেয়ে আবার আকাশে । কখনও পুলিপিঠে, কখনও পাটিসাপটাও ব্যস্ত ছোঁয়ে তুলে নিয়েছি ।
মা-কাকি-জ্যাঠাইমাদের সেদিন চুলে চিরুনি বোলাবার সময় হত না । আগের রাত থেকেই শুরু হয়ে যেত চাল বাটা, নারকেল কোরানো, রাঙা আলু সেদ্ধ করা, হরেক কাজ ।
সারাদিন খড়মের খট খট তুলে সকলের পিঠে খাওয়া তদারক করে বেড়াতেন ঠাকুরদা ।
খড়মের খট খট শব্দে আরেকটা বার্ষিক আনন্দের কথা মনে পড়ে । খড়ম সেখানে হরিষে বিষাদ ডেকে আনতো । আমাদের বাড়িতে কালীপুজোয় বাজি পোড়ানো হত ধুম করে । বাজি মানে শুধু তুবড়ি । কাকারা প্রতি বছর তুবড়ির আরও ভালো ফর্মুলা বার করতেন । বসন তুবড়ি, উড়ন তুবড়িতে তাঁদের হাত-যশ অন্য পাড়াতেও রটেছিল । মুস্কিল বাধত ছুঁচোবাজি নিয়ে । ঠাকুরদার কড়া নিষেধ ছিল, ছুঁচোবাজি বানানো চলবে না । কাকারা লুকিয়ে বানাতেন । আমাদের কাজ ছিল, খড়মের খট খট শুনলেই খবরের কাগজ দিয়ে ছুঁচোর মশলা ঢেকে গা দিয়ে আড়াল করে বসা । ছুঁচো পোড়ানোও হত লুকিয়ে-চুরিয়ে ।
সন্ধে হতেই বাড়ির উঠোনে, ছাদে পর পর অনেকগুলো তুবড়ি জ্বালানো হত । চারদিক আলোয় অলঙ্কৃত হয়ে উঠত । তারপর কাকারা ব্যাগে বাছাই করা তুবড়ি নিয়ে আশপাশের প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্বালাতেন । আমরা ছোটরাও সঙ্গে যেতাম! সেই আলোর ফুলকি আমি এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই । বুকের চামড়ায় ছ্যাঁকা দেয় ।
ভোররাতে স্তোত্র পড়তে পড়তে ঠাকুরদা হঠাৎ থেমে যান । বাড়ির সবাই জেগে উঠে দেখেন, তাঁর মাথা পুবমুখো প্রণামের ভঙ্গিতে মাটিতে ঠুকে রয়েছে । গা ঠান্ডা ।
তাঁর আট ছেলেকে এক ছাদের নিচে থাকার দায় থেকে মুক্তি দিয়ে ওই শেষবার তিনি আটটি মুণ্ডিত মস্তক একত্রিত দেখেছিলেন ।
ধূপধুনোর ধোঁয়ায় ছোটকাকার চোখে জল এসেছিল, পুরোহিতের উচ্চারণ শুধরে দিয়ে বললেন, আমার বাবার শ্রাদ্ধে ভুল সংস্কৃত আমি সহ্য করতে পারব না । সময় নিয়ে মন্ত্র পড়ূন!
ছোটকাকা এখন ওখানকার সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যালয়ে সংস্কৃতের প্রধান শিক্ষক । কানাডায় অধ্যাপনার ডাক এসেছিল, তিনি যাননি । পৈতৃক বাড়ির বেশিটাই জরা ও উইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে ছোট একটা অংশে তাঁরা দুভাই থাকেন । তিনি, তাঁর স্ত্রী ও এক মেয়ে । ঠাকুরদার ঘরে চিরকুমার মণিকাকা । দুজনেরই সামান্য আয়, বাড়ি সারানোর স্বপ্ন দেখা ছেড়েছেন । আর কেউ তো খোঁজ নেন না ।
আমি এসেছিলাম আমার মেয়েটাকে দেখাশোনা করার যদি একটা লোক পাওয়া যায় । আশপাশের চেনা-জানা কাউকে পেলে ভালো । বিশ্বাসী, নিজের লোকের মতো থাকবে । মেয়ে দেখবে । বাড়ি পাহারা দেবে । আমার স্ত্রী সামনের মাস থেকে কলকাতা টি ভিতে খবর পড়ার কাজ পেয়েছেন । একা বাড়িতে বাচ্চা রেখে কাজে যাওয়া সম্ভব নয়, আবার এই দুর্মূল্যের বাজারে একার আয়ে সংসার চালানোও অসম্ভব ।
ছোটকাকা বললেন, এখানে চলে আয় ।
— তাই কি হয়?
বলে আমি বাইরে এসে সিগারেট ধরাই । কাকাদের সামনে অনেকক্ষণ সিগারেট খেতে পারিনি ।
প্রথম প্রকাশ : অমৃত, ৫ আগস্ট, ১৯৭৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন