অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
শেতল চুপি চুপি নিজের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, দেখল কালীপদ পুব-মুখো হয়ে পাশের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে । এত ভোরে পুব-মুখো! শেতলের কাপড়ের নীচে একগোছা ধানের শিস, পেটের কাছটা একটু একটু ফুলে আছে । দাঁড়ালেই কালীপদর চোখে পড়বার ভয়, সেসব ভুলে সে চোখ তীক্ষ্ণ করে কালীপদর মুখ দেখল । যা ভেবেছে, নাক লাল! দিনের প্রথম রোদ লাগাতে উঠে এসেছে । গ্রামের সাঁইতিরিশ জনের চোদ্দ জনই কুষ্ঠরোগী, শেতল আঙুলে গুনে রেখেছে । কালীপদকে নিয়ে পনেরো হল । ভয়ে সে সিঁটিয়ে গেল । কালীপদ তার ঠিক পাশেই থাকে!
শেতলের সবচেয়ে অসহ্য, নিজের মুখভরা বসন্তের দাগ । এমনিতে শুকনো, প্যাকাটির মতো চেহারা, কিন্তু অসুখকে তার খুব ভয় । গ্রামে কুষ্ঠ লাগতে দেখেই সে পালাবে ঠিক করেছিল । তার নিজের বলতে এই একটা মাটির ঘর । সাহস করে ছাড়তে পারেনি ।
ঘরে ঢুকে কাপড়ের তলা থেকে কোমরে-গোঁজা ধানের গোছা নামিয়ে রেখে শেতল গভীরভাবে ভাবতে বসল । ধানে তার আর রুচি নেই । একবার অন্যমনস্কভাবে একটা ছড়া তুলে নিয়ে একটা ধান খুঁটে মুখে দিল । মিষ্টি দুধে ভরা । তখুনি থু-থু করে ফেলে দিল । পাশের বাড়িতে কুষ্ঠ, এখানকার কোনও জিনিস আর মুখে দেওয়া যায় না!
শেষ রাতে বেরিয়েছিল, সকালের হাওয়ায় তার ঘুম পাচ্ছে, বসে বসেই ঢুলতে লাগল । হঠাৎ চিত্তরঞ্জনের কথা মনে পড়ে সে সোজা হয়ে বসে । জায়গাটা ভারি পরিষ্কার, তকতকে রাস্তা, ঝকঝকে ঘরবাড়ি । দু-হাতে চোখ রগড়ে শেতল তখনই চিত্তরঞ্জনের রাস্তা ধরল ।
হাঁটলে ঘাম হয় । তার ভুরু নেই, ঘাম গড়িয়ে চোখে ঢোকে । হাঁটতে হাঁটতে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম চেঁছে ফেলে শেতল জিভ দিয়ে দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের করে চাটতে লাগল । খিদে পেলে সে নিজের মাড়ির রক্ত টেনে বের করে খায় । ভাত-টাতের খিদে তার আজকাল হয়ই না । একবার বর্ধমান স্টেশনে পকেট মারতে গিয়ে সে প্রচণ্ড মার খায় । ঠিক তিনদিন পরে ট্রেন থেকে একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে । পরদিন, সবে সূর্য উঠছে, শেতল তার ঘরে শুয়ে গায়ের ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে দেখল, একটা ভিখিরি নির্জন রাস্তায় তার পোটলা রেখে সামনের ঝোপের মধ্যে পায়খানা করতে বসেছে । একটু পরে দূরে একটা গর্তে বৃষ্টির জল দেখে লোকটা যেই জলের দিকে এগিয়েছে, শেতল ব্যথা ভুলে দৌড়ে গিয়ে পোটলাটা নিয়ে ঘরে ঢুকেই তার মধ্যে যা পেল পেটে ঢুকিয়ে দিল । শুকনো ভাত গলায় আটকে তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, সেই অবস্থায়ও তার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল । ভিখিরিটা তার পোটলা না পেয়ে চিৎকার করে চোরকে গাল দিচ্ছে । আর শাপমন্যি করছে । কয়েকটা গালাগাল আর অভিশাপ এমনকি শেতলও আগে কখনও শোনেনি । লোকটা প্রায় বিকেল পর্যন্ত ওইখানে বসে চিৎকার করল, মাঝে মাঝে গালাগাল থামিয়ে পোটলার জন্য বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদল, তারপর একসময় চলে গেল ।
শেতলের ঘরে দরজা-জানলা নেই । সারা সন্ধে ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, পৃথিবীতে দু-বেলা ভাত জোটানো ভারি শক্ত ব্যাপার । সেই থেকে সে কোনও দিন বন-বাদাড় ঘুরে মরা শালিকের ঝোল খায়, কোনওদিন ডাবের কুঁড়ি সেদ্ধ করে খেয়ে নেয়, যেদিন ধানের ছড়া পায়, চিবোয় । একদিন একটা মরা কাক খেয়ে তিনদিন ধরে বমি করেছিল । আজকাল সে প্রায় কিছুই খায় না, নিজের রক্ত ছাড়া । সারা বছরই তার দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ে, জিভ লাগিয়ে টেনে নিলেই হল । একটু নোনতা নোনতা, ভারি সুস্বাদু । খাবার সময় তার মুখ দেখে মনে হয়, স্বপ্নের ঘোরে সে তার সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটা তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে ।
চিত্তরঞ্জনের বাজারে পৌঁছে শেতল দেখল, পাজামা আর হাওয়াই শার্ট পরা মোটা মতো একটা লোক দু-হাতে বাজার-ভর্তি দুটো থলে নিয়ে থপ থপ করে বেরিয়ে যাচ্ছে । মুখ-গলা ঘামে জ্যাবজেবে । একটা ব্যাগ থেকে রুইয়ের ল্যাজ ঝাঁকুনি খেয়ে নাচছে । শেতলের তখন ভয় করবার সময় নয়, দাঁড়িয়ে ভাববারও তার সময় নেই, ঝাঁ করে সে ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে বলতে যাচ্ছিল, আপনার বাড়িতে কাজের লোক লাগবে? হঠাৎ চোখে পড়ল লোকটার পিছনে, বাঁদিকে ইলিশের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ফরসা টকটকে একজন মেয়েছেলে একটা ইলিশ তার পছন্দ মতো খণ্ড খণ্ড করে কাটিয়ে নিচ্ছে । অপূর্ব সুন্দরী । বাঁ-হাতে শাড়ির কুঁচি অল্প তুলে ধরেছে, ডান-হাত বাড়িয়ে মাছওলাকে নির্দেশ দিচ্ছে, কোথায় কটা টুকরো করতে হবে ।
শেতল মোটা লোকটার পাশ কাটিয়ে মেয়েলোকটার পাশে গিয়ে দম নিয়ে কপালে জোর হাত ঠেকাল, পেন্নাম মাঠাকরুন । তারপর বিড়বিড় করে বলল, বাড়িতে আপনার কাজের লোক রাখবেন?
মহিলা শেতলকে দেখে ভুরু কুঁচকে বাঁ-পাশে এক-পা সরে দাঁড়াল ।
ভিখিরি ভাবল নাকি? মহিলাটি লম্বায় শেতলের মাথা ছাড়িয়ে যায় । শেতল মুখ তুলে প্রাণপণে বলল, আমি ভিখিরি না । সবরকম কাজ জানি ।
শেতলের মুখে দুর্গন্ধ ভকভক করছে । ডানহাতে কোমরের রুমালটা নিয়ে নাক চেপে মহিলাটি বলল, আমার কাজের লোক আছে ।
শেতল নিরাশ হবার চেয়েও বেশি ভয় পেল । এমনিতেই বাজার-টাজারে তার দারুণ ভয় । মনে হয় এই বুঝি কোনও দোকানদার লাফ দিয়ে এসে তাকে চড়ঘুঁষি মারতে আরম্ভ করল । ভিড় দেখলেই শেতল স্পষ্ট দেখতে পায় লোকেরা তাকে তলপেটে লাথি কষাচ্ছে । চুলের মুঠি ধরে তার মুখ আকাশে তুলে ঘুঁষি মেরে তার ভুরু ফাটিয়ে দিচ্ছে । কল্পনাটা এত জীবন্ত হয়ে ওঠে যে শেতল ওইসব সময় হাত দিয়ে ঘন ঘন মুখ মোছে । নাকের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দ্যাখে রক্ত পড়ছে কিনা ।
দায়ে পড়ে খুব সাহস করে সে বাজারে ঢুকেছিল, দূর থেকে মোটা লোকটাকে কষ্ট করে ব্যাগ বইতে দেখে তার আশা হয়েছিল লোকটা তাকে কাজ দেবে, এর মধ্যে এই মেয়েছেলেটাকে দেখে তার কী যে দুর্মতি হল! শেতল হন-হন করে, প্রায় লাফাতে লাফাতে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে দেখল দূরে সেই মোটা লোকটা তখনও থপ থপ করে হেঁটে যাচ্ছে । একবার পায়ের পাতায় একটা ব্যাগ দাঁড় করিয়ে রেখে সে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বোধহয় রিকশা-টিকশা খুঁজল । শেতল জোরে পা চালিয়ে লোকটার সামনে এসে খুব আন্তরিকভাবে হাতজোড় করে বলল, পেন্নাম বাবু ।
মুখে বসন্তের দাগ, ভুরু নেই, নাকের নীচে ঠোঁট ফেটে দু-ভাগ— হাঁফাতে-হাঁফাতে ভদ্রলোকের ভুরু একটু কুঁচকে গেল, একেই বাজারে দেখলাম না? বাড়িতে কাজ চায় শুনে শেতলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে তখুনি তার হাতে ব্যাগ দুটো ধরিয়ে দিয়ে বললেন, দেশ কোথায়?
— বর্ধমানেই, গাঁয়ে ।
— গাঁয়ের নাম?
শেতলের নিজের গ্রামের কুষ্ঠখ্যাতি আছে, সে অন্য একটা নাম বলে দিল ।
চমৎকার একটা দোতলাবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ভদ্রলোক ঘাড় ঘোরালেন, দফায় দফায় দম নিয়ে বললেন, একটা ফটো তুলতে হবে । বিকেলে স্টুডিওয় নিয়ে যাব । তোমার নাম ঠিকানা আর ফটো থানায় রাখতে আপত্তি নেই তো?
শেতলের বুকটা গুড়গুড় করে উঠল, গলায় হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আমি তো চোর-ছ্যাঁচোর নই!
গ্রিলের দরজা ঠেলে ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন, বাঁদিকে ফুলের বাগান । অনেক রকমের গাছ, লাল সাদা গোলাপ ফুটে আছে । শেতল মুগ্ধ । ফুলের গন্ধে সে চুপি চুপি একটা নিশ্বাস টানছিল, ভদ্রলোক বললেন, তবে আর কী! তবে তো তোমার আপত্তি নেই, অ্যাঁ!
বাগানের ধার ঘেঁসে কাঁকর-বেছানো পথ । শেতলের পায়ে জুতো নেই, কাঁকর ফুটছে, ভদ্রলোকের কথায় তার চিনচিনে ভয়ের ভাবটা আবার চাগিয়ে উঠতেই সে চাপা দিয়ে বলল, না, আপত্তি কিসের?
— আমার বাগান পরে দেখাব । বাড়ির পিছনেও আছে । এখন ওপরে চলো, দেখি, কী-কী কাজ জানো ।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শেতল চনচনে খিদে টের পায় । সে শব্দ না করে জিভ দিয়ে বাঁদিকের দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত টেনে নিল ।
সারাদিন শেতলকে চোখে চোখে রেখে সন্ধের দিকে ভদ্রলোক বললেন, ইংলিশ ক্যালেন্ডার মানথের পয়লা তারিখে তিনটে করে করকরে দশ টাকার নোট তুমি পাবে ।
শেতলের কাজের হাত পরিষ্কার । ভদ্রলোক খুশি । আজ যাব, কাল যাব করে ছবি তুলতে আর গেলেনই না । বউকে বললেন, লোকটা সৎ । একটু বোকা । বোকা না হলে কেউ ভালো চাকর হয় নাকি । মনে হচ্ছে, ওর ইহকাল আমাদের কাছে কাটবে ।
থলথলে চেহারা, বিরাট ভুঁড়ি, মাথার মাঝখান দিয়ে লম্বা টাক, অথচ বউটা অনেকটা সেই ইলিশমাছের মেয়েছেলেটার মতো । শেতলকে পেয়ে সেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে মনে হয় । বোঝা যাচ্ছে না ছোট মেয়েটার মনের কথা । এত বয়েসের মেয়েছেলের এতটুকু মেয়ে! বেশি বয়সে বিয়ে হয়েছে, নাকি দেরিতে বিইয়েছে? মেয়েটা একটু বেশি রাগী । এর মধ্যেই একবার শেতলকে বলেছে, এক লাথি মারব ।
দুদিন পরে শেতল বুঝল লাথি মানে মেয়েটা জানে না । কিছু হলেই বলে লাথি মারব, আসলে দুম-দুম করে ঘুঁষি মারে ।
শেতল বিকেলবেলা জুতো পরাচ্ছিল, পায়ে ঢোকাতে গিয়ে একটু ঘষা লেগেছে কি লাগেনি, মেয়েটা আঃ করে উঠেই বলল, এক লাথি মারব! বলেই শেতলের মাথায় দুম করে এক ঘুঁষি । একটুতেই তার রাগ আর কথায় কথায় ওই লাথি মানে ঘুঁষি । যাকগে কর্তাগিন্নি যখন খুশি, একটা পুঁচকে মেয়ে আর তার কী করবে!
সমস্যা একটাই, শেতল একদম খেতে পারে না । এক কাপ চা খেতেও তার ইচ্ছে করে না । অনেক কাল না-খেয়ে ডাল-ভাতে তার রুচি চলে গেছে । ও সব খিদেই আর নেই । এখন তার একটাই খিদে, পেলেই চুপি-চুপি জিভ লাগিয়ে টেনে নেয় । একটু নোনতা-নোনতা, চমৎকার । জিভে আর টাগরায় যতক্ষণ পারে নাড়াচাড়া করে খুব তৃপ্তির সঙ্গে গিলে নেয় । ভাত বড় পানসে ।
ভাত খায় না, বউটা বিরক্ত । দুপুরের শোয়ে সিনেমায় যাবে, বাবু গেছেন আসানসোলে তার মদের দোকানে, তাড়াহুড়োয় খেয়ে উঠে বড় আয়নার সামনে বসেছে । এখন এক ঘণ্টা মুখে এটা-সেটা মাখবে, চোখে কাজল দেবে, চুলে ব্রাশ বোলাবে, ঠোঁটে রং লাগাবে, টিপ পরবে, আরও কী-কী । প্লেটে ভাত ফেলে উঠে গেছে, শেতল সাবধানে একটা-একটা করে প্লেট-টেvট তুলে নিচ্ছে, বউটা ডাকল, শেতল—
শেতল এঁটো হাত পিছনে রেখে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ।
হাতে কাজল লাগাবার তুলির মতো সরু কী একটা, আয়নায় ঝুঁকে এক চোখে লাগাচ্ছিল, শেতলের পায়ের শব্দে সোজা হয়ে বসে বলল, আমার প্লেটে অনেকটা ভাত আছে । নষ্ট কোরো না, তুমি খেয়ে নিও ।
শেতলের মাথায় ঘাড়ের দিকটায় চ্চন করে শব্দ হল, আমি ভাত খাই না ।
— দুপুরেও রোজ রুটি খাও?
— আমার ভাত-রুটির খিদে হয় না ।
বউটা আবার আয়নায় ঝুঁকে ছিল, পিঠ টান করে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, এখানে রোজ তবে কী খাও?
শেতল জিভ সামলায়, ওই যাহোক একটু মুখে দিই, খিদেই হয় না ।
— তোমার কোনও অসুখ আছে না-কি? যা একখানা স্যান্ডো-মার্কা চেহারা বানিয়েছ!
বেরোবার আগে একটা একটা করে সব ঘরে চাবি দিয়ে শেতলকে বলল, ড্রইং, ডাইনিং, কিচেন খোলা রইল । ময়না নাচের স্কুল থেকে ফিরলে দুধ গরম করে দেবে, বিস্কুটে মাখন মাখিয়ে দেবে ।
রাতে বন্ধ জানলার বাইরে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে শেতল শুনল বউটা বাবুকে বলছে, কম খাওয়া ভালোই, খরচ বাঁচবে । গ্রামের লোকগুলো যা খায়! কিষেণ খেতো, মনে আছে— একেক বেলা তিনজনেরটা! মুশকিল হচ্ছে, কম খেয়ে শেষে অসুখে না পড়ে । তা হলেই গেছি বাবা । যা চেহারা, দেখে ভয় করে, টিবি-ফিবি নেই তো?
বিরাট একটা হ্যাঁচ্চো দিয়ে বাবু বললেন, তুমি কি সারারাত আয়নার সামনেই বসে থাকবে? এখন ছাড়ো তো ওসব!
পরদিন দুপুরে খেয়ে উঠেই বাবু রান্না ঘরে ঢুকলেন । শেতল কী একটা ভাবতে-ভাবতে জিভ দিয়ে দাঁতের গোড়া চুষছিল, চোখের তারায় ভাবনার ছায়া চিকচিক করছে । বাবুকে দেখে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল ।
— কই তোর থালা দেখি ।
— আজ্ঞে থালা তো নেই ।
— নেই তো খাস কিসে?
— আমার খিদে হয় না ।
ভেতরের ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বাবু বললেন, মায়া! কিষেণের থালাবাটি একে বের করে দাওনি?
বলতে-বলতে নিজেই নিচু হয়ে মিটসেফের তলা থেকে কলাইয়ের থালাবাটি-মগ বের করে আনলেন, এই তো! ধুলো পড়ে আছে । অ্যাদ্দিন খেলি কিসে?
— ওই একটু-আধটু— মোটে খিদে হয় না, হাতে করেই—
— ভাত-ডাল ঢাল । মাংস নে । চেটে-পুটে খাবি । পেটে না-খেলে কাজ করবি কী করে? আন, ভাত আন!
শেতলের তখন চনচনে খিদে, লোকটার সামনে জিভ নাড়াতে পারছে না, থালায় ভাত তুলতে-তুলতে রাগে তার কাটা ঠোঁটটা তিরতির করে উঠল । এক যুগ পরে ভাত খেয়ে দৌড়ে গিয়ে নীচের পায়খানায় হড়-হড় করে বমি করে দিল ।
বাসন ধোয়ার শব্দে আবার বাবু এলেন, তোর থালা আলাদা ধুচ্ছিস তো? আমাদের প্লেটের সঙ্গে ছোঁয়াসনি যেন ।
— আজ্ঞে, সে আমি জানি ।
বাবু খড়কে দিয়ে দাঁত খুঁটছিলেন, থুঃ করে এক টুকরো মাংস ছিটিয়ে বললেন, একটু গরম জল দে তো, শেভ করব । ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আজ একটু কাজ আছে ।
জল দিয়ে, বাসন তুলতে-তুলতে শেতল মাড়ি থেকে বেশ খানিকটা রক্ত বের করে ফেলল । জিভে নিয়ে খাচ্ছে, বাবুর গলা কানে এল, শেতল! বাথরুম থেকে ডেটলের শিশিটা নিয়ে আয় তো, জলদি ।
শেতল ডেটল নিয়ে ঘরে পা দিতেই তার বুকের মধ্যে কে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল! শিশি হাতে সে ঠিক একটা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে । তার চোখ বাবুর থুতনিতে । জোঁকের মতো এঁটে আছে । রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে । একদম তাজা ।
— রক্ত দেখে তোর মূর্ছা হয় নাকি? ডেটলটা দে ।
শেতল ধাতস্থ হয় । চোখের দৃষ্টি এদিক-ওদিক করে লুকোয় । কাছে এসে ডেটলের শিশিটা টেবিলে রেখে চেষ্টা করেও থুতনি থেকে আর সে চোখ সরাতে পারে না ।
বাবুর গলায় খাঁটি বিরক্তি, তুলো আনিস নি? তুই একটু বেশি বোকা । তুলো ছাড়া লাগানো যায়? ওই ড্রয়ারে আছে, বের কর ।
তুলো ছিঁড়ে শেতল নিজেই ডেটলে ভেজাতে ভেজাতে উত্তেজনা চেপে বলল, আমি লাগিয়ে দিই?
— তাড়াতাড়ি কর ।
শেতলের হাত কাঁপছে । সে ঝুঁকে চট করে মাঝের আঙুলে খানিকটা রক্ত তুলে নিয়ে আঙুলটা মুড়ে তালুর মধ্যে লুকিয়ে ফেলল । তারপর তুলো দিয়ে কাটা জায়গাটা আস্তে-আস্তে মুছে দিল ।
তার গলা কাঁপছে, এটা কি লাগানো থাকবে?
— জ্বলে যাচ্ছে! একেবারে র লাগিয়েছিস । থাক, ছেড়ে দে ।
শেতল সোজা নিজের পায়খানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । ঘুলঘুলি দিয়ে অল্প আলো আসছে । আঙুলের ডগার রক্তটা তখনও শুকোয়নি, শেতল চোখের একদম সামনে নিয়ে রক্তের রং দেখল । নাকের কাছে আঙুল তুলে বড়-বড় নিশ্বাসে গন্ধ শুঁকল । মুখের কাছে নিয়ে একবার মাত্র জিভ ছোঁয়াল । তারপর আঙুলের ডগা চেটে রক্তটুকু সে জিভে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করল, গিলে ফেললে পাছে জিভ থেকে স্বাদটুকু মুছে যায় । খাওয়া হয়ে গেলে সে এমনভাবে আঙুলের ডগাটা চুষতে লাগল যে রক্তের ফিকে দাগটুকুও পরিষ্কার হয়ে তার আঙুলের চামড়া কুঁকড়ে গিয়ে ধপধপ করতে লাগল । অনেকক্ষণ জল ঘাটলে যেমন হয় ।
সারারাত শেতলের ঘুম হল না । নিজের রক্ত সে অনেক খেয়েছে, অন্যের রক্ত এই প্রথম । স্বাদই আলাদা! ঠিক মনে হয় জিভে এখনও লেগে আছে । মাঝরাতে তার খুব খিদে পেল । সে জিভ নাড়ল না । নিজের রক্ততে তার আর রুচি নেই । ভোর পর্যন্ত সে শুধু নতুন রক্তের স্বাদ মনে মনে নাড়াচাড়া করে কাটাল ।
পরদিন সকালে ময়না স্কুলে যাবে, টেবিলে তার খাবার দিয়ে শেতল একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফুটফুটে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ বাবুর অফিসঘরে গিয়ে একটা পিন তুলে নিল । সে তার নিজের পায়ের আওয়াজকেও ভয় পাচ্ছে । লুকিয়ে ময়নার একপাটি জুতো নিয়ে সে নীচের পায়খানায় গেল । ছোট্ট জুতো । তলা থেকে পিন ফুটিয়ে ডগাটা ভেতরের দিকে একটুখানি বের করে রাখতে তার কপাল ঘেমে উঠল ।
ময়নার খাওয়া হয়ে গেছে । কোমরের বেল্ট এঁটে নিয়ে সে গলা তুলে ডাকল, শেতল! শিগগির এসো । আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
শেতল প্রথমে ডানপায়ের জুতো পরিয়ে দিল । খুব নিচু হয়ে ফিতে বাঁধছে, ময়না নিজেই আরেক পাটিতে পা গলিয়ে দিয়ে বলল, আ! মারব এক লাথি । তাড়াতাড়ি করো না ।
সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই জোরে একবার উঃ করে উঠল, তারপর এক ঝটকায় বাঁপায়ের জুতো খুলে ফেলে তার কচি গলা চিরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ও মা, ও বাবাগো!
শেতল চট করে পিনটা খুলে পকেটে পুরল । তারপর, বিছে বিছে, ওই যে পালাচ্ছে, কাঁকড়া বিছে— বলে চেঁচাতে লাগল ।
বাবা বাথরুম থেকে ছুটে এসেছিলেন, মা দৌড়ে এসে ময়নাকে বুকের মধ্যে নিয়ে বললেন, শিগগির ডাক্তারকে ফোন করো ।
শেতল বিছের পিছনে ছুটোছুটি করে হাঁফাচ্ছিল, বলল, আমি বিষ ঝাড়তে জানি । ঝেড়ে দেব?
— যা পারো করো বাবা । এ কী সর্বনাশ হল আমার!
শেতলের জিভ লক-লক করে ওঠে । সে তক্ষুনি হাঁটু গেড়ে বসে ময়নার বাঁ পা দু-হাতে তুলে নিল । টান মেরে মোজা খুলে ফেলতেই পায়ের তলা থেকে টপটপ করে রক্ত । শেতল চোখ বুজে তিনবার বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ার ভান করল, তারপর ঠিক যেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, সেইখানটায় মুখ লাগিয়ে চিৎ হয়ে মেঝেয় শুয়ে পড়ল । সে শব্দ করে-করে জায়গাটা অবিরাম চুষতে লাগল । ময়না এতক্ষণে ব্যথার চেয়ে ভয়েই বেশি কাঁদছে । তার কচি পা শেতলের হাতের মুঠোয় । শেতল মাঝে মাঝেই জোরে চাপ দিয়ে রক্ত বের করে নিচ্ছে । তার মুখ রক্তে ভেজা । গলা দিয়ে গরম সুগন্ধি রক্তের স্রোত নেমে যাচ্ছে । দুধ-ঘি ননী-ছানা খাওয়া শরীর, এর স্বাদই আলাদা!
মিনিট তিনেক পর রক্ত বন্ধ হল । শেতল আরও বারকতক চুষে, কিছু না পেয়ে উঠে পড়ল ।
— মুখটা ধুয়ে ফ্যালো ।
শেতল চলে যেতে যেতে বলল, আর ভয় নেই । বিষ বের করে দিয়েছি ।
ডাক্তার এলেন আরও কিছুক্ষণ পর । সব শুনে সিরিঞ্জ ভরতে ভরতে বললেন, এদেশে ওইসব হাতুড়ের রাজত্বই চলবে ।
ময়নার বাবা এতক্ষণে গায়ে তোয়ালে জড়িয়েছেন, ভুঁড়ি ঢাকেনি, বললেন, যাই হোক, রক্ত পড়া তো বন্ধ হয়েছে ।
সারা দুপুর বৃষ্টি হয়ে সন্ধের দিকে পৃথিবী একটু ঠান্ডা । বাড়ির পিছনে বাগানের মাথায় ঘোলাটে চাঁদ উঠেছে । শেতল চায়ের পেয়ালা-টেয়ালা ধুয়ে রেখে নীচে নেমে এল । তার মনটা আজ ভারি খুশি । আবছা অন্ধকারে ফুলবাগানে ঢুকে সে গাছপালার মধ্যেই ঘুরে বেড়াতে লাগল । ফুলের গন্ধে চারদিক ভরে আছে, শেতল লম্বা নিশ্বাস টানে, ঠিক গরম রক্তের সুগন্ধ । মাথায় একটা নতুন চিন্তা আসছে । পেট ভরা থাকলে মাথা খোলে । একটা গোলাপের পাপড়ি দাঁতে কাটতে সে ছোট্ট একটা ঢেকুর তুলে ভাবল, রোজ ওরকম পাওয়া যায় না? নিজের রক্তে তার আর রুচি নেই । সে জিভ দিয়ে ছোঁয় না । বমি পায় ।
ওপরে ফোন বাজছে । শেতল একা-একা কথা বলে উঠল, আহা, যেন কত্তাল! জ্যোৎস্নায়, ফুলের গন্ধে, টেলিফোনের ঝনঝনে শেতলের আমেজ লাগে । সে উচ্চারণ করে বলল, রোজ এরকম… আঃ, এবার মচ্ছব লেগেছে রে!
মায়া ফোনে কথা শেষ করেই ডাকল, শেতল, ও-শেতল!
শেতল দরজায় এসে দাঁড়াল, আজ্ঞে, মা, আমায় ডাকছিলেন?
— হ্যাঁ বাবা । গোটা-দুই মুরগি পাওয়া যাবে এখন? বাবুর এক বন্ধু রাতে খাবেন, এখুনি ফোন করলেন । বড় মানী লোক ।
শেতল নিজের গুণে সকলের মন জয় করেছে । একা হাতে হাজারটা ঝামেলা সামলায়, মুখে কথাটি নেই । সৎ, বিশ্বাসী । কোনওরকম লোভ নেই । কাজকর্মও ভারি পরিষ্কার । তার সঙ্গে এঁরা আর রেগে কথা বলেন না, এমনকি গলায় স্নেহ লেগে থাকে ।
শেতল মাথা কাত করে বলল, এই দুটো বাড়ি পরেই একটা পোলট্রি আছে, ছাদের ওপর, মুরগি কি কচি দেখে নেব, না একটু বুড়ো?
— সে তুমি যা ভালো বোঝো ।
হাত বাড়িয়ে টাকা নেবার সময় মায়ার হাতে ছোঁয়া লাগাল । এই বয়েসেও মাখন । শেতল তখুনি সন্ধের চিন্তাটা পাকা করে ফেলল, এবার কাচের গেলাস ভেঙে রাখতে হবে । মেঝের রক্ত সে ছাড়া কে পরিষ্কার করবে?
বাগানের কোণে, লেবুগাছটার তলায় মুরগির পালক ছাড়াতে-ছাড়াতে শেতল কাটা ঠোঁট সামান্য বেঁকিয়ে হাসল, ন্যাকড়া নিয়ে খুব কাছেই থাকব, গরম-গরম চাই ।
মুরগি সেদ্ধ হচ্ছে । হাতের তেলোয় নিয়ে মশলার আন্দাজ করা শেতলের অভ্যেস । বাঁ-হাতের তেলোয় রসুনের কোয়ার হিসেব করতে-করতেও সে কান খাড়া করে রেখেছে, বাবুর বন্ধুটি কখন আসেন । নতুন মানুষের জন্য তার এখন খুব লোভ ।
শেষ পর্যন্ত আর এলেন না । শেতল নিরাশ হয় । তবে, যত রাত হবে ভেবেছিল, তার আগেই সব কাজ শেষ । শেতল অন্ধকার ছাদে উঠে গিয়ে বিড়ি ধরিয়ে পা টিপে-টিপে পায়চারি করে, নিচে না আওয়াজ যায়! বিড়ি তেতো । গলায় ধোঁয়া ঢুকে ভেতরটা ধুলো-ধুলো লাগছে । মেঘের আড়াল থেকে ফট করে ঘোলাটে চাঁদটা লাফিয়ে উঠতেই, ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে শেতল টের পেল, তার আর দাঁড়িয়ে থাকারও শক্তি নেই ।
রোজই তার জ্বর হয়, তার ওপর বুক জ্বলে, এতদিন এসব সে আমল দেয়নি । আজ একদম অন্যরকম । তার চোখের সামনে চাঁদ তারা নাচছে ।
শেতল টলতে-টলতে এসে নিজের ঘরের চৌকাঠের ওপর শুয়ে পড়ল । গোঙাতে-গোঙাতে বলল, জল!
মা বাথরুমে । ময়না শুতে যাবার আগে ক্যালেন্ডারের রঙিন পেলিক্যান দেওয়ালে সাঁটছিল, গোঙানি শুনে ঘাড় ফেরাল । তারপর কাছে এসে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে ঝুঁকে শেতলকে দেখল, তোমার জ্বর হয়েছে নাকি?
শেতল যেন ঘুমের ঘোরে কোঁকাচ্ছে । চোখ না খুলেই বলল, জল!
ময়না জল নিয়ে এসে ডাকল, শেতল, জল খাও । ও শেতল!
শেতল চোখ মেলে । টকটকে লাল । তার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে খরখর করছে । ময়নার হাত থেকে গেলাসটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে খালি গেলাস বাড়িয়ে দিয়ে দম নিল, জল!
— আরও খাবে? দাঁড়াও—
ময়না দৌড়ে গিয়ে খাবার ঘর থেকে জল ভরে আনে ।
— আঃ, আস্তে-আস্তে খাও! ঠিক বিষম খাবে । ওর’ম চোঁ-চোঁ করে খাচ্ছ কেন? আর খাবে? একি! কী হয়েছে, কাঁদছ কেন? মা, দেখে যাও, শেতলদার চোখ দিয়ে কীরম বৃষ্টির মতো জল পড়ছে!
প্রথম প্রকাশ : অমৃত, ২০ এপ্রিল ১৯৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন