অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
রাখালের মা দরজা খুলে দিয়েই রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেল । কুকার সিটি দিচ্ছে ।
ঘরে ঢুকে দেখি, বাবা ডিভানে বসে আছেন । কোলে দাবার ছক ।
নিচু বেতের চেয়ারটায় বসে জুতো খুলতে খুলতে বললাম, কার সঙ্গে খেলছিলে? হঠাৎ দাবা যে?
হ্যাঁ অনেকদিন পর— একা একাই খেলছি । তা বছর বারো হল বোধহয় ।
বেশি । শেষ খেলেছিলাম ১৯৬৮তে । আমার মনে আছে ।
আমি, বাবা একসঙ্গে দেওয়ালে মায়ের ফটোর দিকে তাকালাম ।
বাবার কথার সঙ্গে হাসি মিশে গিয়ে বাবাকে ভারি সুন্দর লাগে । হাসি নিয়েই বাবা বললেন, খেলাটা শেষ পর্যন্ত হলে তোকে চেকমেট করে দিতাম ।
সে খেলাটা শেষ হয়নি, মা এসে বোর্ড তুলে নিয়েছিলেন । সেই আমাদের দাবা খেলার ইতি ।
আমি বললাম, এই বোর্ড-ঘুঁটি তুমি পেলে কী করে? ছিল কোথায়?
তোর দিদির বিয়ের ডালা-কুলো থলের মধ্যে বাঁধা থাকে না? সেই থলের ভেতর পিঁড়ির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল ।
আমি চেয়ারটা বাবার সামনে টেনে এনে আধখেলা বোর্ডের ওপর ঝুঁকে বললাম, তুমি মনে হচ্ছে একটু সাদার দিকে টেনে খেলছ । কার চাল— সাদার, না কালোর?
কালোর!
আমি কালো নিচ্ছি ।
খেলিস যদি বরং গোড়া থেকে—
দেখা যাক না । দাঁড়াও, একটু ভাবতে হবে ।
চা-টা খেলি না । হাত-মুখ ধুয়ে খাবার-টাবার খেয়ে তারপর না হয়— রাখালের মাকে বল, তোকে চা করে দিক । আর যদি চা বাদ দিতে পারিস, ভালো কালোজাম আছে— বোধহয় ফ্রিজে রেখে গেছে— চমৎকার জাম ।
ওই যাঃ! তোমার জন্য আমলকী কিনেছিলাম, গাড়িতে ফেলে এসেছি!
এখন আমলকী?
শিয়ালদার জ্যামে আটকে ছিলাম, হঠাৎ ফুটপাতে আমলকী দেখে, প্রথমটাতো চিনতে পারিনি, আমলকীর চেহারা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম—
তোর আর দোষ কী । কোথায় আর সেসব ফলমূল । এই যে আমাদের ফলমূল থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি এটা কিন্তু খুব ভয়ের কথা । কত ফল আর চোখেই দেখি না । তুই জাম-কটা খেয়ে আয় ।
আমি উঠতে উঠতে বললাম, আচ্ছা বাবা, ফলসা কোন সময়টায় পাওয়া যায়?
ফলসা আর কোথায় পাবি? ফলসা, গোলাপ জাম, দিশি খেজুর— এসব গ্রীষ্মের ফল ।
জামের বাটি নিয়ে এসে বাবার সামনেই আবার বসলাম । বাবা সিগারেট ধরিয়েছেন । এভাবে ফিরে আসব ভাবেননি । বাবার সিগারেট খাওয়া নিয়ে আমার কড়াকড়িতে আজকাল আমার সামনে খুব কমই সিগারেট ধরান । এখন ধরা পড়ে গিয়ে খুব সহজভাবে সিগারেটে টান দেবার চেষ্টা করছেন । যেন কোটার বাইরে যাননি ।
চেহারা দেখে বোঝা না গেলেও— সোজা হয়ে বসেন, চশমা ছাড়া রোজ তিনটে কাগজ পড়েন, দু-বেলা দিব্যি তিনতলা সিঁড়ি ভাঙেন, হলে হবে কী, বাবা পঁচাত্তর ছাড়িয়েছেন তাও বছর তিনেক হল । বয়েসের কথা ভেবেই আমি সিগারেটের ব্যাপারে বাবাকে একটু শাসনে রাখতে চাই । বাবার সেটা মনঃপূত নয় । আমার ছেলেকে বলেন, তোর বাবা রোজ ক-প্যাকেট সিগারেট খায় একটু নজর রাখিস তো! আমার বলে আশি বছর বয়স হতে চলল—
আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে সরাসরি তো কিছু বলতে পারেন না, আমার ছেলেকে বলেন, বাবাকে বলিস অত সিগারেট খাওয়া ভালো না! আজকের হিন্দুতে একটা লেখা বেরিয়েছে, পেজ ফোরটিনে, আমি দাগ দিয়ে রেখেছি, তোর বাবাকে দেখাস ।
বাবা হয়ত সহজ হবার জন্যই বললেন, ভালো না? পাকা জামের স্বাদই আলাদা ।
আমি একটা আঁটি চুষতে চুষতে বললাম, তোমার এটা আজ ক-নম্বর?
বাবা একটু ক্ষুণ্ণ হলেন । ছাই ঝেড়ে বললেন, আজকাল আর পাঁচ-ছটার বেশি খাই কোথায়?—
একটু পরে আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কাগজে একটা বইয়ের বিষয়ে পড়লাম, বাংলার নানান ফলের খাদ্যগুণ নিয়ে ভালো লিখেছে নাকি— রুমাকে বলেছি যদি পায় নিয়ে আসে যেন ।
এসে থেকে দেখছি না তো! গেছে কোথায়?
রঞ্জু-মঞ্জুকে নিয়ে বইমেলায় গেছে ।
যাঃ! একটা তালিকা করে রেখেছিলাম—
রুমাকে বলে রাখলেই পারতি । ও জানে না?
উঁহু । তাছাড়া রঞ্জু-মঞ্জুকে এই সময় কয়েকটা অন্য ধরনের বই পড়াব ভেবেছিলাম ।
তুই একদিন ঘুরে আয় না । মেলায় দেখবি মানসিক বিশ্রাম হয়ে যাবে ।
আমি আর সময় পাচ্ছি কোথায়?
ওরই মধ্যে করে নিতে হবে । ব্যস্ততা তো থাকবেই, তোর এখন ব্যস্ত থাকারই বয়েস । তবে শ্রমের সঙ্গে বিশ্রামের অনুপাতটাও ঠিক রাখা চাই ।
বাবা নতুন করে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন— কী নিবি? সাদা, না কালো?— ভালো কথা, কদিন ধরে আমার একটা ইচ্ছে হচ্ছে, এই ঘরে এই যত গাছ আছে তার কয়েকটা গাছের নাম-ধাম, ফল-ফুল, বংশপরিচয় কিছুই জানি না । প্রথম সারির মাঝেরটা । দ্বিতীয় সারির প্রথম দুটো । আর ওই রাবার প্ল্যান্টের ডানদিকে যেটা ।
বাবা আঙুল তুলে জানলার পটীর গাছগুলো দেখালেন ।
সব কটাই বিদেশি । ইন্ডোর প্ল্যান্টের ওপর ভালো বিদেশি বই পাস যদি একটু খোঁজ করিস । খুব জানতে ইচ্ছে করে ।
বাবা বোর্ড সাজিয়ে তৈরি । সেই খেলাটায় তোর সাদা ছিল না?
আমি একটু আসছি ।
টিভিটা চালিয়ে দিয়ে যা তো । যদি ভালো কিছু থাকে । ততক্ষণ দেখি—
কী ব্যাপার? এরকম বসে বসে কাউকে নির্দেশ দেবার লোক তো বাবা নয়! বৃষ্টির ছাঁট আসছে, জানলাটা বন্ধ করে দে— বাবা এরকম কখনও বলেন না । নিজে উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করাই বাবার স্বভাব ।
আরও আশ্চর্য, এতক্ষণ আমার চোখে পড়েনি, বাবা আজ সামনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে, প্রায় কুঁজো হয়ে বসেছেন । সারা জীবন বাবাকে মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে দেখাই আমার অভ্যেস । এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার!
আমি বললাম, তোমার শরীর খারাপ নাকি? এরকম করে বসেছ?
শরীর ঠিক আছে । একটা সমস্যা হচ্ছে— দুপুর থেকে শুতে পারছি না । শুলেই বুকে কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে । এই যেভাবে বসে আছি— এতে আরাম পাচ্ছি ।
এ তো ভালো কথা নয় । এতক্ষণ বলোনি, আশ্চর্য!
বাবা মৃদু হাসলেন— ভয়ের কিছু নেই । রাতে নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে ।
বুকে কোনওরকম ব্যথা হচ্ছে না তো?
না না, সেসব কিছু নয় । এক ধরনের রেস্টলেসনেস বলতে পারিস । বসে আছি, এখন কিছু নেই ।
বুকের বাঁদিকে কি?
মাঝখানে ।
আমি ডাক্তারকে ফোন করছি—
না না, ডাক্তার ডাকার মতো ব্যাপার নয় । কোথায় যাচ্ছিলি, সেরে আয়, এক হাত খেলা যাক ।
টিভিতে হাল্কা মিউজিকের সঙ্গে লেখা— অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত ।
বাবা সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন— দুঃখ প্রকাশে আমাদের আর লজ্জা নেই ।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল, বাবা টিভিতে প্রথমে সাত নম্বর চ্যানেল ধরেন । ছেড়ে-আসা দেশের গাছপালাও বাবার ভারি প্রিয় ।
আমি চ্যানেল ঘুরিয়ে বাংলাদেশ ধরলাম ।
সিগারেট শেষ করে ফিরে এসে দেখি, বাংলাদেশের এক গ্রামে চাষীদের সঙ্গে এরশাদ কথা বলছেন— চারদিকের গাছপালা, খেত-খামার, খাল-বিলের ওপর দিয়ে মাঝে-মধ্যেই ক্যামেরা ঘুরে যাচ্ছে । বাবা তন্ময় হয়ে দেখছেন ।
আমি টিভির দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললাম, প্লেনে কলকাতা থেকে ঢাকা চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের পথ । তুমি দু-চার দিন বাংলাদেশে ঘুরে আসতে পারো! ছেলেবেলার স্মৃতি বলে কথা! আমার তো মাঝে মাঝে বারুইপুরের জন্য মন কাঁদে । কলকাতা থেকে বোধহয় কুড়ি-বাইশ কিলোমিটার— তবু মনে হয় কত দূরে ফেলে এসেছি!
বাবা টিভিতে চোখ রেখেই বললেন, ছেলেবেলার দেশ কি আর বাইরে পাওয়া যায়? ও থাকে মনের মধ্যে । ঘরে বসে সিনেমার মতো দেখছি, এই বেশ ।
আচ্ছা বাবা, তুমি দেশ ছেড়েছ কত বছর বয়েসে?
১৯৩০ । তার মানে তখন আমার ঠিক তেইশ বছর বয়স ।
তুমি একবার ঘুরে এসো । বলো তো আমি সব ব্যবস্থা করে দিই । তোমার ছেলেবেলার গ্রাম তোমার খুব ভালো লাগবে ।
পারলে তুই একবার যাস ।
আমার তো ওটা দেশ নয় । আমি গেলে বারুইপুরে যাব । গাছপালার মধ্যে দিয়ে কী আশ্চর্য রেললাইন! একটা চলে গেছে লক্ষ্মীকান্তপুরে, আরেকটা ডায়মন্ডহারবার । আমি বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়তাম । বাঁদিকের রেললাইন ধরে যেতাম শাসন পর্যন্ত । ডানদিকে যেতাম কল্যাণপুর পর্যন্ত । তুমি অফিস থেকে ফেরার অনেক আগে আমি ফিরে আসতাম । তুমি টের পেতে না ।
বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার গল্প শুনছিলেন । হেসে বললেন, টের পেতাম না? আবদুলকে তোর মনে আছে? আমাদের বাড়ির গাছ-টাছ দেখাশোনা করত— আবার নতুন ঘর-টর মেরামতির কাজে রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজও করত— তোকে গাছপালা চেনাবার ভারও আমি ওকেই দিয়েছিলাম— ওর বাড়ি ছিল শাসনে, তোকে একা একা রেললাইন ধরে ঘুরতে দেখে ওর খুব চিন্তা হত । এসে বলত, আপনি বাবু, অমরকে একটু বকে দেবেন । বর্ষাকালে সুতির বাদায় তুই সুরজ-ফোজোদের সঙ্গে তালের ডোঙা চড়তিস, ওর পছন্দ হত না ।
আমি এসব করতুম তোমাকে-মাকে লুকিয়ে । তুমি তো এসব নিয়ে কখনও কিছু বলেছ বলে মনে পড়ছে না ।
তোর মা খুব দুশ্চিন্তা করত, আমিই তাকে বোঝাতাম । ওই বয়েসে আমি যা নদী-নালা মাঠ-ঘাট ভেঙেছি তার কাছে এতো কিছুই না! বারুইপুরে সেসব আর তুই পাচ্ছিস কোথায়? ওই বর্ষাকালেই যা একটু— আর ওই রেললাইন ।
বারুইপুরের কথায় মনে পড়ল— তখন তুমি শীতকালে উঠোনে রোদে বসে কাগজ পড়তে, আমি দাঁত ব্রাশ করতে করতে একদিন তোমার কাছে জানতে চাইলাম— ব্রাশ কি জোরে জোরে চালাতে হয়? তুমি কাগজ পড়তে পড়তে শুধু হুঁ বললে । কাগজ নিয়ে বসলে তুমি আর সব ভুলে যাও, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু হুঁ-হাঁ-ই বলতে । সেদিন তোমার হুঁ শুনে আমার খুব অভিমান হয়েছিল । আমার সমস্যাটায় তুমি মোটেই মন দাওনি । ‘জোরে জোরে’ বলতে তুমি কি ‘চেপে চেপে’ বুঝেছ, না ‘দ্রুত’ বুঝেছ? ‘হুঁ’ বলে তুমি কোনটা বোঝালে? তোমার মোড়ার চারপাশের ঘাস শিশিরে চিক-চিক করছিল, আমার এখনও মনে আছে । বাবা হাসলেন, তোর তো বেশ প্রখর স্মৃতি । আমার কিছু মনে পড়ছে না ।
তোমার শালের ওপর পেয়ারাগাছ থেকে এক ফোঁটা শিশির পড়েছিল ।
বারুইপুর বাবার দ্বিতীয় দেশ । আমার প্রথম । বাবা অনেক খুঁজে-পেতে বারুইপুর পছন্দ করেছিলেন । তখনকার গাছপালায় ভরা, শান্ত, নির্জন বারুইপুরের স্মৃতিকথায় বাবার মনটা ভারি খুশি হয়ে উঠেছে বোঝা যায় । উত্তেজনায় প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট পুরোপুরি বের করার পর হঠাৎই আমার উপস্থিতি খেয়াল করে সিগারেটটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন ।
আমি বললাম, আমাদের সেই পেয়ারাগাছটা এখনও আছে কিনা কে জানে!
বাড়ি যারা কিনেছে তারাই জানে! গাছ বড় অসহায় । জমির মালিক রাখলে রাখে, কাটলে কাটে । এ এক দুঃসহ অবস্থা ।
তোমার বুকে এখন আর কোনও অস্বস্তি নেই তো?
মনোযোগ দেবার মতো কিছু নয় । বিজ্ঞাপন শুরু হল । বাংলাদেশেও একই বিজ্ঞাপন! আয়, এক হাত খেলা যাক ।
আমি রাজার সামনের বোড়ে দু-ঘর দিলাম । বাবা মারলেন না । ঘোড়া তুলে নিজের বোড়েটার পাহারার ব্যবস্থা করলেন ।
আমি ঘোড়া তুলব, না গজ বার করব, ভাবতে ভাবতে বললাম, এক কাপ চা হলে কেমন হয়?
হ্যাঁ, এখন খেতে পারিস । রাখালের মা, দাদাকে এক পেয়ালা চা করে দাও । আমাকে আধ পেয়ালা ।
চা বাবার অতি প্রিয় । পারলে সারাদিনই চা খান, কেবল অসুস্থ থাকলে চায়ে বাবার রুচি থাকে না । সুস্থতা পরীক্ষা করবার জন্যই আমি চায়ের কথা তুললাম ।
বাবা অনেক সময় নিয়ে আস্তে আস্তে চা খাচ্ছেন । একটা করে চাল দিয়ে এক চুমুক । আমি চা শেষ করে বললাম, তুমি ভাব । আমি আসছি ।
কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, বাবা ঠিকই বুঝেছেন । পাশের ঘরে এসে সিগারেট ধরিয়ে কান খাড়া করে রাখলাম— না বাবা আমার অনুপস্থিতি সত্বেও সিগারেট ধরালেন না ।
ফিরে এসে দেখি, মন্ত্রীর দিকের গজ ছুঁয়ে বাবা এক মনে চিন্তা করছেন ।
চাল দাওনি?
এই দিই ।
গজ এগিয়ে দিয়ে বাবা বললেন— দুপুরে শুইনি তো, বসে বসে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে ।
একটু শুয়ে নাও না ।
আরেকটু বসি । বোর্ডটা শেষ করা যাক ।
এবার চালটা দিলাম খুব একটা না ভেবেই ।
বাবা ভাবতে বসলেন । ভাবছেন তো ভাবছেন, চাল আর দেন না । হঠাৎ দেখলাম, বাবার চোখ ঘুমে বুজে আসছে ।
খেলা থাক । একটু ঘুমিয়ে নাও । আমি খাবার সময় ডেকে দেব ।
বাবা চোখ খুলে কিছুটা লাজুক কিছুটা বিষণ্ণ হেসে বললেন, বড্ড ঘুম পেয়ে গেছে দেখছি । চাল দিইনি বুঝি? এই নে?— ঘোড়া সামলা!
আমি সোজা পাশের ঘরে গিয়ে আমাদের চেনা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে ফোন করলাম— একবার যদি আসেন । বাবার বুকে— না না ব্যথা-ট্যথা নেই । শুধু শুলে বুকে একটা অস্বস্তি হচ্ছে ।
অস্বস্তিটা কি নিশ্বাসের কষ্ট?
জিজ্ঞেস করছি । ফোনের মুখ চেপে ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললাম, বাবা, শুয়ে কি তোমার নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল?
বাবা সামনে বসে কথা বলার মতো বললেন, ওই আর কি ।
আমার উত্তর শুনে ডাক্তার বললেন, বাড়িতে একোনাইট ২০০ আছে? এখনই এক ডোজ দিয়ে দিন । আর ডিজিটালিস ৩০ আনিয়ে রাখুন । আমি আসছি ।
এ ঘরে আসতেই বাবা বললেন, তুই কি ডাক্তার ডাকছিস নাকি? তুই বড় অল্পে অধৈর্য হোস ।
আমার গলায় একটু হয়ত রাগ এসে গেছে, বললাম— তোমার মতো ধৈর্য তো আমার নেই । নিশ্বাসের কষ্ট— এতক্ষণ বলোনি কেন? দেখি, হাঁ করো ।
ওষুধটা খেয়ে নিয়ে বাবা হাসলেন— ধৈর্য তো জীবনে চাই-ই রে! একটা বয়েসে দেখবি ধৈর্য ছাড়া আর কিছুই শেখবার নেই ।
নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, অথচ তুমি গা-ই করছ না, এও তো এক ধরনের গ্রাম্যতা!
তুই রেগে যাচ্ছিস । রাগ আসে ক্ষতিবোধ থেকে । আমার এটা সে ধরনের কিছু নয় ।
আমি আর কিছু না বলে শুধু বললাম, আমি একটু আসছি ।
কোথায় যাচ্ছিস?
একটা ওষুধ এনে রাখি, শোবার সময় যদি দরকার হয়—
আমার মনে হয়, একটা সিগারেট খেয়ে দেখা যেতে পারে ।
না না, এ অবস্থায় আজ আর সিগারেট না খাওয়াই ভালো ।
যদি ডাক্তার আনিস, দাড়িটা একবার কামাতে হবে ।
আমি বাবার মুখের দিকে তাকালাম, দাড়ি তো আজ কামিয়েছ ।
সে কোন সকালে । এতক্ষণে আবার গজিয়ে গেছে ।
তোমার মুখ একদম পরিষ্কার ।
ওষুধ নিয়ে ফিরে এসে দেখি ডাক্তার ব্যানার্জির সঙ্গে বাবা দিব্যি গল্প জুড়েছেন ।
আমাকে দেখেই ডাক্তার বললেন, পিঠে কয়েকটা বালিশ এনে দিন । শুতে যখন পারছেন না, অন্তত আধশোয়া অবস্থায় থাকুন । ওঁর এখন শোওয়াটা খুব দরকার ।
‘এভাবে শুলে অসুস্থের মতো দেখায় ।’ বলতে বলতে আমাদের দুজনের পীড়াপীড়িতে, নিতান্ত অনিচ্ছায় বাবা বালিশ হেলান দিলেন ।
দুয়েক মিনিট কারও মুখেই কথা নেই । বাবার চোখ বোজা, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন ।
হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, আমি উঠে বসি । দুপুরের সেই অস্বস্তিটা ফিরে আসছে ।
ডাক্তার ব্যানার্জি আমার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে বললেন, আরেকটু শুয়ে থাকুন । ওষুধ দিচ্ছি, ঘুমোবার চেষ্টা করুন ।
চেষ্টা করব কী, ঘুমে তো শরীর ভেঙে আসছে । এত ঘুম পেয়েছে— নিজেরই অবাক লাগছে । অথচ শুয়ে থাকতে পারছি না ।
পারবেন । ওষুধটা চিবোবেন না, চুষে চুষে খান ।
ডাক্তার চলে যাবার পর বাবা উঠে বসে বললেন, তোর মায়ের তো ইচ্ছে ছিল না আমরা দাবা খেলি । আজও শেষ হল না । তুলে রাখ । বড্ড ঘুম পেয়ে গেছে ।
বোর্ড যেমন ছিল পড়ে রইল । আমি পাশের ঘরে এসে এমার্জেন্সি ডক্টর সার্ভিসে ফোন করে অক্সিজেন নিয়ে আসতে বললাম ।
এ ঘরে এসে বাবাকে বললাম, দ্যাখো বাবা, যারা পাহাড়ে ওঠে, ওই যারা অভিযান-টভিযান করে আর কি, নিশ্বাসের কষ্টের জন্য পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যায়, জানো তো? তোমারও শুলে নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, তোমাকেও অক্সিজেন দিয়ে দিই কী বলো? অক্সিজেন নিলে কষ্টটা কেটে যাবে, তুমিও আরামে ঘুমোতে পারবে ।
বাবা তিন-চার সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন । তারপর বললেন, অক্সিজেন আজকাল বাড়িতে আনা যায় নাকি? খরচও নিশ্চয়ই কম না?
আমি বললাম, খরচ সামান্য । ফোন করে দিলেই বাড়িতে সিলিন্ডার নিয়ে চলে আসে । আমার কাছে ওদের ফোন নম্বর আছে ।
এরপর মিথ্যে করে বললাম, দাঁড়াও ফোনটা আগে করে আসি ।
ডিভানের পাশে ঝুঁকে অল্পবয়েসী ডাক্তার অক্সিজেনের সাজসরঞ্জাম ঠিক করতে করতে বাবাকে বললেন, আপনাকে যে এবার একটু চিৎ হয়ে শুতে হবে ।
বাবা বললেন— কঠিন । দেখি চেষ্টা করে ।
বাবা চিৎ হয়ে শুলেন । অক্সিজেনের নল নাকে নিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন— না, এতে হচ্ছে না । আচ্ছা আর একটু ধৈর্য ধরে দেখি, যদি ঘুমনো যায় ।
বাবা উঠে বসলেন । ডাক্তার ও তাঁর সহযোগীরা সাজসরঞ্জাম নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু ঘুমের জন্য এত উদ্যোগ আয়োজন— তোর নিশ্চয়ই তিন-চারশো খরচ হয়ে গেল!
বাবার মুখে সেই লাজুক হাসি । ওই হাসির মধ্যেই বললেন, কিন্তু আর তো না ঘুমিয়ে পারা যাচ্ছে না । একটু চেষ্টা করা যাক ।
আশ্চর্য, বাবা এবার অনায়াসে, কারও সাহায্য ছাড়া, ডিভানে শুয়ে পড়লেন ।
একটু পরেই বেল বাজার শব্দে আমি দরজা খুলে দেখি— আমার স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে । তিনজনের হাতেই বড় বড় বইয়ের প্যাকেট ।
রঞ্জু ঘরে ঢুকে ডিভানে দাদাকে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে ‘দাদা, দ্যাখো দ্যাখো’ বলে বইয়ের প্যাকেট হাতে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমি ওকে ধরে ফেলে, আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে খুব আস্তে আস্তে বললাম, চুপ, চুপ, দাদা ঘুমিয়েছে ।
রুমা নিচু চেয়ারটায় বসে পড়ে কোলের ওপর নিজের প্যাকেটটা নিয়ে খুলতে খুলতে বলল, মানে? না খেয়ে ঘুমোলেন কী রকম?
আমি বললাম, ঘুমের জন্য একেবারে কাঙাল হয়ে পড়েছিলেন । খুব আস্তে কথা বলো ।
সে কী!
আঃ, আস্তে!
দুঘণ্টা পর টেবিলে খাবার দিয়ে রুমা বাবার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করতে গিয়ে আচমকা অদ্ভুত স্বরে কেঁদে উঠল ।
দৌড়ে এসে দেখি বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন ।
প্রথম প্রকাশ : যুগান্তর, শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৫
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন