অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
দিলু দুপুরে হরিণের মাংস খেয়েছে, ভালোমতো হজম হয়নি, পেটটাও একটু ভুটভাট করছে, ডাঁও করে একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, অলি খবরদার! তুই যাবি না ।
অলি, যার ভালো নাম অঞ্জলি, এই গাঁয়ের সবচেয়ে সুন্দর তো বটেই, সবচেয়ে লম্বা মেয়ে । গোসাবা যাবে বলে ড্রেস দিয়ে শাড়ি পরেছে । পিঠে লম্বা বিনুনি । নদীর উঁচু বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল । বাঁধের কাছেই একটা বাইন গাছের ডালে নৌকো বাঁধা । জামাইবাবুর কথায় শুকনো এঁটেলমাটিতে ঠপ ঠপ করে পা ঠুকতে ঠুকতে বলল, যাবই, আমি যাবই । ইস, আমি কোথাও যাব না, না!
তার মাথার পিছনেই সূর্য অস্ত যাচ্ছে । ঠিক মনে হয় আকাশে আগুন ধরে গেছে ।
দিলু নীচ থেকেই মুখ তুলে সাংঘাতিক চোখে তাকিয়ে বলল, তোর নাচ আমি বার করছি— গিয়ে দ্যাখ!
অঞ্জলি ভয়ও পেয়েছে, আবার দুঃসাহসও ছাড়তে পারছে না, সে বোধহয় নৌকোর দিকেই তরতর করে নেমে যাচ্ছিল, গোসাবার মানুষ বোঝাই দিয়ে বড় একটা নৌকোকে এদিকেই আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল । গিরিকে সে প্রথমেই দেখতে পেয়েছে । আর তার গোসাবায় যাবার দরকার নেই ।
দিলু নীলকণ্ঠকে তাগাদা দিল, তোমার কী মতলব বলো তো? সন্ধে লেগে যাচ্ছে, এরপর আর লক্ষ্মণকে পাবে? একবার নেশায় বসে গেলে তখন হাজার টানাটানিতেও নড়বে না ।
মাঠে বিকেল থেকেই লোক আসতে লেগেছে । আশপাশের গাঁয়ের মানুষ তো বটেই, দূর-দূর গাঁ থেকেও লোক আসছে । ওপারের দ্বীপ থেকে নৌকো বোঝাই করে মেয়ে-পুরুষ, বাচ্চা-বুড়ো আসছে । এই সময় দোকান ফেলে ওঠা নীলকণ্ঠের পক্ষে প্রায় অসম্ভব । সারা বছর তার বাড়িতেই তার দোকান । সামান্য টুকটাক বেচাকেনা । বছরে এই দুয়েকাবরই যা বড়মাপের দোকানদারি । গ্রামে এরকম যাত্রাগানের আসর-টাসর বসলে সে মাঠে দোকান দেয় । বড় ছেলেকে ক্যানিং পাঠিয়েছে, সিগ্রেট, পাউরুটি, কেক-বিস্কুট আনত । বিকেলের লঞ্চের সময় পার হয়ে গেল, এখনও ছেলে ফিরল না । সেই এক দুশ্চিন্তা, তার ওপর অন্যের হাতে দোকান ফেলে যাবার ভয় । নীলকণ্ঠ খদ্দেরের পানে খয়ের লাগাচ্ছিল, বিরক্তি নিয়ে বলল, শরীর বুঝে খেতে পারে না! ও বুড়োকে দেখেই আমার খটকা লেগেছিল । বাঁশি বাজাতে বুকের দম লাগে! হাভাতে মড়া, পেট ঠেসে হরিণ খেয়ে এখন চিত্তির!
নীলকণ্ঠ নিজে বৈষ্ণব । বাড়ি থেকে কখনও ডিম বিক্রি করে না । মাঠে, যাত্রার আসরে অন্য কথা । আগুন আগুন তিনটে মুরগির ডিম ছাড়িয়ে দিয়ে খুচরো পয়সা গুনে রাখতে দিলুর দিকে মুখ তোলে, তোমাদেরও বলিহারি! দেশে আর যাত্রার দল পেলে না!
দিলু ডাঁও করে ঢেঁকুর তোলে, মাংস তো আমরাও খেয়েছি!
— তখন থেকে গুব-গুব ঢেঁকুর তুলছ! আসলে যাত্রা দলের বাঁশি-বাজিয়ে লোকটার ওপর নীলকণ্ঠ চটে আছে । লোকটা শেষবেলায় লোভের বশে ভুরিভোজ করে বার বার দাস্ত-বমি করে বিছানা নিয়েছে । ওই বুড়োর জন্যই এখন তাকে গোসাবায় ছুটতে হবে । লক্ষ্মণকে ধরে আনতে হবে । বুড়োর বদলে সেই বাঁশি বাজাবে । এ-তল্লাটে লক্ষ্মণের মতো বাঁশি-বাজিয়ে আর কে আছে! তার বাঁশির কাছে পাখিরাও হার মানবে । নৌকো বিকেল থেকেই তৈরি । দিলু যাবে, মোহন যাবে, নীলকণ্ঠকে তো যেতেই হবে । আরও কিছুক্ষণ জোয়ার থাকার কথা । গুণ টানতে হতে পারে । তরমুজকেও তাই দলে নেওয়া হয়েছে । গুন টানায় ওস্তাদ । এক ধামা মুড়ি পেলেই হল । সবাই তৈরি । শুধু নীলকণ্ঠ না গেলে লক্ষ্মণ কিছুতেই আসবে না । এ গ্রামে ইহজীবনে তার আর পা দেবার কথা নয় । নীলকণ্ঠই তাকে ওই কড়ার করিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল । এখন তাকেই গিয়ে সাধাসাধি করতে হবে । তার ওপর ভয়, সন্ধেবেলা একবার নেশার জিনিস নিয়ে বসলে আর তাকে তোলা যাবে না ।
ইস্কুলবাড়িতে নট-নটীদের সাজগোজ চলছে পুরোদমে । প্রত্যেকটা জানলায় ভিড় । গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে । জানলা দিয়ে চোখ বড় বড় করে সাজসজ্জা দেখছে ।
তরমুজ একবার সাজঘরের জানলায় গিয়ে উঁকি দিচ্ছে, একবার বাঁধের কাছে নীলকণ্ঠের দোকানে এসে দাঁড়াচ্ছে । সে একটু উত্তেজিত । স্বয়ং অধিকারী এসে নীলকণ্ঠদের তাগাদা দিয়ে গেল । যে বাঁশি বাজাবে তার সঙ্গে একবার মহড়া না দিলেই নয় । তার নিজের লোক যে তাকে এভাবে পথে বসাবে কে জানত! পায়ের কেডসের নিচে সিগ্রেটের টুকরোটা ডলে দিতে দিতে বলল, ফিরে গিয়ে এই অপদার্থটার আর আমি মুখ দেখব ভেবেছেন!
নীলকণ্ঠ টাকাপয়সার হিসেব নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে । মিনিটে-মিনিটে এটা-ওটার দাম গুনে নিচ্ছে, গুনে-গুনে খুচরো ফেরত দিচ্ছে । প্রতি মুহূর্তে সাবধান থাকা দরকার । বড়ছেলেও এখনও ফিরল না । অধিকারীর কথায় সে ঝেঁঝে উঠল, অধিকারী ওমনি-ওমনি হওয়া যায় না! দরকার হলে আড়বাঁশিও মুখে নিতে হবে, আবার গানও ধরতে হবে!
নীলকণ্ঠ যৌবনে যাত্রা করত । দলও করেছিল একবার । অভাবে পড়ে দল ভেঙে যায় । যাত্রা ছিল তার প্রাণ । তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান । কোনও দিন পান-তামাকও সে ছোঁয়নি । নেশা বলতে ওই যাত্রাই । ওটাই ছিল তার একমাত্র সাধ-আহ্লাদ ।
সেটা মিটল না দেখে নীলকণ্ঠ তার নেশাটা বদলে নিল । যাত্রা-টাত্রা ছেড়ে সে খুব মন দিয়ে টাকা-পয়সা করতে লাগল । সে যে কিসের ব্যবসা করে না, চট করে বলা মুস্কিল । অন্যদিন এতক্ষণে সে ভাত খেয়ে ঘুমোতে গেছে । প্রথম রাতটা ঘুমিয়ে নিয়ে রাত দশটা বাজতে-না-বাজতেই সে রোজ উঠে পড়ে । সারারাত জেগে বসে থাকে । টাকাপয়সা পাহারা দেয় । বাইরে একটা খরগোশের পায়ের শব্দ হলেও চেঁচিয়ে ওঠে, কে যায়?
এদিকে বাঁশির লোক না পাওয়া গেলে যাত্রাই হয়ত বন্ধ । রাতভর তার বিক্রি-বাটা হবার কথা । সব শিকেয় উঠবে । মাঠে ভিড় বাড়ছে । নৌকো ভরে ভরে লোক আসছে । ছেলেটার টাকা-পয়সা মার যায়নি তো? পরের লঞ্চ রাত ন-টায় ।
নীলকণ্ঠ একবার শেষ চেষ্টা করে । অধিকারী তার খোঁচা হজম করে ফিরে গিয়েছিল । দোকানে যে-লোকটা জিলিপি ভাজছিল, নীলকণ্ঠ তাকে হাঁক দিয়ে বলল, বেশ লাল দেখে চারখানা দিলুকে দে । দুটো পয়সা তুমি কম দিও দিলু!
দিলু চটে ওঠে, জিলিপি কে খাবে? তুমি থাকো! আমরা যাচ্ছি! লক্ষ্মণ না আসতে চাইলে বেঁধে আনব! মেরে অজ্ঞান করে নিয়ে আসব! চল, তরমুজ! এসো মোহনদা ।
কী অদ্ভুত জেল্লাদার একেকজনের সাজ! তরমুজ এসব ছেড়ে এখন আর যেতে পারে না । এর মধ্যেই সে একবার বাঁধের ওদিকে নেমে নদীর স্রোত ছুঁয়ে পরীক্ষা করে এসেছে । গলা খাঁকরে বলল, এখুনি জোয়ার নেবে যাবে । ভাঁটা শুরু হবে । আমি জল ছুঁয়ে দেখেছি । নৌকো ছন-ছন করে ছুটবে । গুন টানার দরকার হবে না ।
দিলু নিজেকে সামলাতে না পেরে ঠাস করে তরমুজের গালে এক চড় কষাল! অন্য যে কেউ হলে মাথা ঘুরে পড়ত । তরমুজ ফিক করে হেসে ফেলে ডানহাত বাড়াল ।
এর একটা ইতিহাস আছে । তরমুজের মা-বাপ, বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি, কিচ্ছু নেই । থাকার মধ্যে এক সাংঘাতিক খিদে । খাবার জন্য তার ফন্দি-ফিকিরের শেষ নেই । অসম্ভব দুষ্টু বুদ্ধি । প্রায়ই তার ফন্দিফিকির ছল-চাতুরি ধরা পড়ে গিয়ে সে গ্রামের লোকের হাতে মার খায় । তার মা ছিল এদিককার বিশ-পঁচিশটা গ্রামের জগজ্জননী । সকলের বরাভয় । দিন নেই, রাত নেই, সবসময়ই কোনও না কোনও গ্রামে কারও না কারও সেবা করে বেড়াচ্ছে । গ্রামে রোগ-ব্যাধির শেষ নেই । তরমুজের মায়ের সেবা-কাজেরও ক্ষান্তি নেই । মরবার দিন পর্যন্ত অন্য মানুষের শিয়রে কাটিয়েছে । লতাপাতা শেকড়বাকড় বেটে ওষুধ খাইয়েছে । মাথায় জল দিয়েছে । কারও বুকে হাত বুলিয়ে দিয়েছে । ওই মায়ের এই ছেলে! এবাড়ি-ওবাড়ি, এখেত-ওখেত ঘুরে চুরি করে খেতে গিয়ে মার খায় । মা-ই কি কম মেরেছে! মারা যাবার সময় বিশ গ্রামের মানুষ ভিড় করে দেখতে এসেছে, তরমুজের মা এর-ওর যতজনের পারল হাত ধরে ধরে অনুনয় করল, আমার ছেলেটার খিদে আমি সইতে পারি না । মরে গিয়েও শান্তি পাব না । তোমরা ওকে মেরো, দোষ করলে মারবে বইকি, কিন্তু তার পর ওকে খেতে দিও । পেট ভরে খাইও । ও যেন ভরা পেটে মরে ।
সেই থেকে গ্রামে নিয়ম হয়ে গেছে, তরমুজকে কেউ মারলে সে ওকে তখনকার মতো খেতে দেবে । পেটপুরে খাওয়া । যতক্ষণ না ও নিজে থামবে, ততক্ষণ খাবারের যোগান দিয়ে যেতে হবে । গতবছর সুন্দরবনের এইসব গ্রামে প্রচুর তরমুজ ফলেছিল । বিরাম দাসের হাতের বাঘথাবড়া খেয়ে তরমুজ বিরাম দাসের খেতের চুরাশিটা তরমুজ শেষ করে । সেই থেকে তার তরমুজ নাম । আগে তার নাম ছিল বাঁকাচাঁদ । মা ডাকত বাঁকা । গত এক বছর কেউ আর তাকে ও-নামে ডাকে না ।
তরমুজকে চড় মেরেই দিলু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল । হাত বাড়াতে দেখে সে হঠাৎই চিৎকার করে উঠল, খবরদার, কাঁদবি না! গলা টিপে শেষ করে দেব!
তরমুজকে যত জোরেই মারো, সে কাঁদবে না । ফিক করে হেসে ডান হাত বাড়িয়ে দেবে । তখন কেউ যদি তাকে খেতে না দেয় বা ওই ধরনের কিছু বলে, সে আকাশ ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে । বর্শাবেঁধা বুনো জন্তুর মতো কাঁদে । মুখে খাবার না যাওয়া পর্যন্ত সে ওইরকম কেঁদে যাবে ।
তরমুজের মুখে তখনও হাসি । মনে হয়, এই বুঝি হাসি মুছে ফেলে কেঁদে উঠবে । ডান হাত তেমনই বাড়ানো ।
নীলণ্ঠ তখনও চেষ্টা ছাড়েনি । সে ভেবেছিল দিলুকে জিলিপি খাইয়ে তাকে পাঠিয়ে অধিকারীকে ডেকে আনবে । তার আর আশা নেই । সে হালুইকরকে জিলিপির কড়াই নামিয়ে রেখে দোকানে এসে বসতে বলল । বার-বার করে বুঝিয়ে দিল, কাউকে একটা বিড়িও বেচবি না । আমি না আসা পর্যন্ত বেচাকেনা বন্ধ । খেয়াল রাখিস!
অধিকারী তার বাঁশি-বাজিয়েকে গেলাস-গেলাস বাতাসা-জল খাওয়াচ্ছে । কপালে-মুখে জলের ছিটে দিচ্ছে । যদি উঠে বসে । যদি এ যাত্রা বিপদটা কাটিয়ে দেয় । নীলকণ্ঠের মনে হল, ইহজীবনে এই লোক আর বাঁশি বাজাবে না ।
নীলকণ্ঠ একটু দূরে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, তা, আপনার দলে আর কেউ বাঁশি বাজাতে পারে না?
অধিকারী চোখ তুলে নীলকণ্ঠকে একবার দেখল । তারপর তাকে নিয়ে ঘরের বাইরে এসে বলল, হ্যাঁ, কী বলছিলেন?
নীলকণ্ঠ প্রশ্নটা আরেকবার শোনাল ।
অধিকারী মস্ত এক টিপ নস্যি দু-নাকে সমান-সমান ভাগ করে দিয়ে নাক মুছে বলল, একজন আছে, সে তো মহিষাসুর! সে কখন বাঁশি বাজাবে?
নীলকণ্ঠের বুকের মধ্যে ঝমঝম শব্দ হল । মেদিনীপুরের কাঁথিতে সে যৌবনে মহিষাসুর-বধ করেছিল । সে নিজে হয়েছিল মহিষাসুর । মিনিটখানেক তার চোখের সামনে থেকে এই যাত্রার আয়োজন, এই দোকানদারি, এই সুন্দরবন একদম মুছে গেল । শুধু কাঁথির সেই আসরটা আট-দশটা হ্যাজাক হয়ে জ্বলছে । কানে তার নিজেরই গলা । যৌবনের গমগমে মহিষাসুর স্বরলহরী ।
নীলকণ্ঠ ঘোর কাটিয়ে হাল্কা হাসল, তাহলে একজন মহিষাসুর পেলেও আপনার চলে যায়, কী বলেন? হয় বাঁশি, নয় মহিষাসুর!
— না, সে হয় না । একটু থেমেই আবার বলল, তা মহিষাসুরই বা পাচ্ছি কোথায়?
— শক্ত, আরও শক্ত । মহিষাসুর তো আর যে-সে হতে পারে না ।
নীলকণ্ঠ ফিরে যাচ্ছিল, মাঝমাঠ থেকে আবার অধিকারীর কাছে গিয়ে বলল, বাঁশি বাজাবার ভালো লোক পাবেন, কুড়িটা টাকা খরচ করতে হবে ।
— কুড়ি টাকা?
— তা তো লাগবেই । বাঁশি-বাজিয়ে তো আমাদের দেবার কথা না— কী বলেন?
— বাঁশি ছাড়াই আমি পালা নামাব! অধিকারী নস্যি নেয় । তারপর কী ভেবে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে দিল, ঠিক আছে, একটু তাড়াতাড়ি করুন । একটা মহড়া দিতে হবে ।
তরমুজের গলাচেরা কান্না শুরু হয়েছে । দিলুর ঊরু দুটো দু-হাত দিয়ে প্রাণপণে জাপটে ধরে সে চিৎকার করে কাঁদছে । নীলকণ্ঠ দোকানে এসে গোটা ছয়েক জিবেগজা নিয়ে তরমুজের মুখের হাঁয়ের মধ্যে গুঁজে দিতেই কান্না বন্ধ ।
— চলো দিলু, লক্ষ্মণকে নিয়ে আসি ।
সে নিজের ফতুয়ার পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে নিজেরই দোকানের ক্যাশ বাস্কের মধ্যে রাখতে রাখতে তার হালুইকরকে বলল, তরমুজের জন্য দশ টাকা দিয়ে গেলাম । মুড়ি দিস বেশি করে । জিলিপির গরম রস দিস । জগজ্জনীর ছেলে । জলকষ্ট দিস না ।
যাবার সময় তরমুজের পিঠে হাত বোলায়, একটু আস্তে আস্তে খাস আর নাদুর দিকে একটু নজর রাখিস— পয়সা-টয়সা না সরায় ।
কথাটা নাদু, অর্থাৎ সেই হালুইকরের সামনেই বলল ।
দিলুর হাঁটুর কাছে তরমুজের নখ বসে গিয়ে অনেকক্ষণ জ্বলছিল । সে অবাক হয়ে নীলকণ্ঠর কাণ্ড দেখছে । নীলকণ্ঠ সেটা লক্ষ করে বলল, বাঁশি বাজিয়ের খরচ, অধিকারী টাকাটা দিল । তাই দিয়ে আমি তোমায় দায়মুক্ত করলাম । না কী বলো?
তরমুজ জোয়ার-ভাঁটার হিসেব সত্যিই বোঝে । ভাঁটার টানে নৌকো চলেছে তরতর করে । দিলু-মোহন দাঁড়ে বসেছে । নীলকণ্ঠ ধরেছে হাল । তবে নৌকোয় ভার একটু কম চাপলে আরও জোরে যেত । তারা তিনজন ছাড়াও, এ গ্রামের আরও কয়েকজন নৌকোয় উঠে বসেছে । তারাও অন্য কাজে গোসাবায় যাবে । বা ওদিককারই কোনও গ্রামে । নৌকো যাচ্ছে দেখে উঠে পড়েছে ।
সূর্য একটু আগেও নদীর জল, আকাশ সব লাল করে রেখেছিল । সেই আগুন মুছে গিয়ে আকাশে দ্রুত অঙ্গারের রং ধরছে । দু-দিন পর অমাবস্যা । আজকাল সন্ধের মুখেই জানান দিচ্ছে ।
দিলু দাঁড় মারতে মারতে তাড়া লাগায়, চড়ায় ঠেকে যাবে নীলুদা! সাবধান!
নীলকণ্ঠর মুঠোয় হাল একটু ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নড়ছে, তার অনেক রকম চিন্তা । দিলুর তাড়া খেয়ে জোরে জোরে মোচড় দিয়ে হাল ঘোরায় । অনেকক্ষণ থেকে তার বুকের মধ্যে যেন একটা খিঁচ লেগেছে । পেরেক ফুটছে । নীলকণ্ঠ মুঠোয় জোর পায় না ।
উল্টোদিক থেকে একটা নৌকো আসছে । অন্ধকারে আলোর দুলুনি দেখে মোহন হাঁক পাড়ে, কে যায়? কার নৌকো?
ঢেউ, হাওয়া, অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে উত্তর ভেসে আসে, আমি লক্ষ্মণ! তোমরা কে?
দিলু পিছনে যতটা পারে ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলল, নৌকো ভেড়াও । আমরা নীলকণ্ঠ, দিলু, মোহন । অন্ধকারে তার ঢেঁকুর শোনা গেল ।
নীলকণ্ঠর মাথা বেয়ে ঘাম নামছে । কপাল মুখ ঘামে ভেজা । হাতে একদম জোর পাচ্ছে না । হাঁটুর জোর খুলে গেল নাকি? বুকে অসম্ভব কষ্ট!
লক্ষ্মণের গলা সে শুনেছে কিনা বোঝা গেল না । ফ্যাসফেসে গলায় বলল, দিলু হাল ধর । বলেই সে হাল ছেড়ে দিল । লোকের ভিড়ে তাদের পায়ের কাছে ফাঁক-ফাঁক পাটাতনের ওপর কোনওরকমে শুয়ে পড়ল ।
দিলু দাঁড় ছেড়ে ওঠার আগেই বদু হাল ধরল ।
দিলু দাঁড়ে বসে বসেই বলল, কী হল তোমার, নীলুদা?
সাড়া না পেয়ে আবার হাঁক পাড়ল— লক্ষ্মণ, নৌকো ভেড়াও । আমরা আসছি, নৌকো ভেড়াও ।
লক্ষ্মণ গাঢ় গলায় কথা ছুড়ে দেয়— নৌকোয় আমার বাবা আছে । সময় নেই, এখন ভেড়াতে পারব না ।
মোহনও কথা ছুড়ে দেয়— তোকে বাঁশি বাজাতে হবে । কুসুমখালিতে । দাঁড়া, আমরা যাচ্ছি ।
ওদিকের নৌকো থেকে এবার অন্য কেউ কথা বলল, লক্ষ্মণের বাবাকে নিয়ে আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি ।
একটু পরে দুদিকের দুটো নৌকো কাছাকাছি হয় । লক্ষ্মণদের নৌকোয় চারদিক ঘিরে দশ-বারোজন লোক বসে আছে । মাঝখানে লম্বালম্বি বিছানা । লক্ষ্মণের বাবা বুকে দু-হাত রেখে শুয়ে আছে । চোখ খোলা, মাথা ফিরিয়ে দিলুদের কথা শুনছে । নৌকোর একধারে হাঁড়ি-কড়া, নানা মাপের কৌটো । চালের টিন । কদিন থাকতে হয় কে জানে, একেবারে সংসার সাজিয়ে নিয়েছে ।
যদু হাল ঘুরিয়ে নৌকো দুটোকে গায়ে গায়ে লাগিয়ে দিয়েছিল । দিলু সাবধানে, লক্ষ্মণদের নৌকো একদম না দুলিয়ে এদের নৌকোয় উঠে এসে লক্ষ্মণের বাবার কপালে হাত রাখল । তারপর লক্ষ্মণের দিকে চোখ তুলে বলল, কী রকম অবস্থা? তুমি আমাদের ওখানে একটু নামতে পারবে না?
লক্ষ্মণের মুখ-চোখ বসে গেছে । বাবার অসুখ নিয়ে আজ সারাদিনই তার ওপর খুব ধকল যাচ্ছে, বোঝা যায় । সে শুধু বলল, তুমি পাগলের মতো কথা বলছ! কাল রাত থেকে আমরা ঘুমোইনি । এক মিনিট এখন নষ্ট করতে পারব না ।
লক্ষ্মণের মার মুখ ঘোমটায় ঢাকা । ডান হাতে ঘোমটা একটু সরিয়ে বলল, লক্ষ্মণের বাপের এই অবস্থা, এখন কি বাঁশি বাজাবার সময়?
দিলু কথা বদলে বলল, নীলুদারও কী হল । দিব্যি হাল ধরেছিল, হঠাৎ শুয়ে পড়েছে ।
লক্ষ্মণের বাবা পাশের নৌকোর দিকে অনেকখানি ঘাড় ঘোরাবার চেষ্টা করল । তার চোখ পিট-পিট করছে ।
মোহন ঝুঁকে ঝুঁকে নদীর জল নিয়ে নীলকণ্ঠর মুখে মাথায় ছিটিয়ে দিচ্ছিল । লক্ষ্মণকে শুনিয়ে বলল, একদম হুঁশ নেই । অজ্ঞান হয়ে গেছে ।
কুসুমখালিতে সবাই অপেক্ষা করে আছে । অধিকারী আবার বাঁশিবাজিয়ের টাকাও দিয়ে দিয়েছে । দিলু নিমেষে সব দুর্বÇলতা ঝেড়ে ফেলে মরিয়া হয়ে লক্ষ্মণকে বলল, তোমাকে কুসুমখালিতে নামিয়ে দিয়ে আমি এই নৌকোতেই থেকে যাচ্ছি । আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব । বাসন্তীতে তো?
লক্ষ্মণ কিছু বলবার আগেই তার বাবা মৃদু কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, তুমি যাও লক্ষ্মণ! আমি ভালো হয়ে গেছি । কাল সকালে তুমি বাসন্তী চলে এসো ।
আজই পাঠানখালি থেকে লক্ষ্মণের দিদিকে আনা হয়েছে । তারও কেমন মনে হল, বাবার বিপদ কেটে গেছে । নৌকোর একধারে সে কেরোসিনের স্টোভে আদা দিয়ে চা বানাচ্ছিল, এদিক ফিরে বলল, আমি সকালে দেখেই বুঝেছি লক্ষ্মণ মিছিমিছি অত ভয় পাচ্ছে । তুমি আসলে বাবা আমাকে দেখতে চেয়েছিলে । তুমি ঠিকই জানতে একেবারে মরবার মতো ব্যামো তোমার এটা নয় ।
অদ্ভূত ব্যাপার, লক্ষ্মণের বাবার মুখে খুব ক্ষীণ, খুব লাজুক, খুব ছেলেমানুষী একটা হাসি ফুটল ।
লক্ষ্মণ পাশের নৌকোয় গিয়ে নীলকণ্ঠকে পরীক্ষা করে বলল, ও নৌকোয় নিতে হবে । গা ঠান্ডা, অবস্থা ভালো নয় ।
সবাই মিলে ধরাধরি করে নীলকণ্ঠকে লক্ষ্মণদের নৌকোয় তোলা হলে বিছানা দুপাশে যেটুকু গুটিয়ে রাখা হয়েছিল, মেলে দিয়ে সেইখানে তাকে শোওয়ানো হল । লক্ষ্মণের বাবা ডানদিকে একটু সরে গেল । দুজনেই সমান মাপের । নদীর বুকে নৌকোর ওপর একচিলতে বিছানা দুজনে সমানভাগে ভাগ করে নিল ।
দিলুদের নৌকোয় যারা নিজেদের কাজে গোসাবা যাচ্ছিল তাদের ওইখানেই ডাঙা ধরিয়ে দিয়ে নৌকো কুসুমখালির দিকে ফিরল ।
দুটো নৌকো কুসুমখালিতে নোঙর করতে কয়েকজন অল্প জলে লাফিয়ে নেমে পড়ল । দিলুদের নৌকোর সবাই নেমে গেল । নীলকণ্ঠ তো আগেই লক্ষ্মণদের নৌকোয় চলে এসেছে ।
লক্ষ্মণের সঙ্গে গোসাবার আরও অনেকেই কুসুমখালিতে নেমেছে । রোগী একটু সুস্থ হতেই সকলের মন থেকে ভার নেমে গেছে । তারা এবার যাত্রা দেখবে ।
লক্ষ্মণ কাদা ভেঙে বাঁধের দিকে এগোচ্ছে, তাদের নৌকো থেকে তার দিদি বলে উঠল, দাঁড়া রে লক্ষ্মণ, আমিও আজ পালাটা দেখব ।
আগেই সে বাবাকে বুঝিয়েছে ।
ছেলে চলে গেল, মেয়ে চলে গেল, লক্ষ্মণের বাপ তার নৌকোর বাকি আত্মীয়দের একজনকে কাছে ডেকে বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি । একটু ধরাধরি করে আসরের একধারে আমাকে শুইয়ে দাও । কাল সকালে বাসন্তী গেলেই হবে ।
লক্ষ্মণ দিলু মোহনদের আবার নৌকোয় ডাকা হল । সকলে মিলে অনেক বোঝানো সত্বেও লক্ষ্মণের বাপের মত পাল্টাল না । লক্ষ্মণের মা ঘোমটার মধ্যে থেকেই বলে উঠল, ওই জেদ নিয়েই তুমি একদিন শেষ হবে!
তাকেও নেমে পড়তে হল । নৌকোয় রইল শুধু নীলকণ্ঠ আর মোহন আর লক্ষ্মণদের নৌকোরই দুজন । তারা নীলকণ্ঠকে নিয়ে বাসন্তী যাবে ডাক্তার দেখাতে ।
সেই দুজন দাঁড় মারতেই নীলকণ্ঠর শরীর ঝাঁকুনি খেল । সে এখন অন্যের নৌকোয় শুয়ে দোল খাচ্ছে ।
নীলকণ্ঠর নিজের নৌকো ডাঙায় তুলে দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে । ক্রমে সেটা ছোট হয়ে আসছে । অন্ধকারে তার নৌকো কখন বদলে গেছে সে একদম টের পায়নি ।
প্রথম প্রকাশ : যুগান্তর, ১৯৮০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন