অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সুদেব সকলের বড় । তার কান্নার ধরনও আলাদা । বুক চাপড়াচ্ছে, নিজের চুল ধরে টানছে, একবার একটানে পট-পট করে জামার সব বোতামই ছিঁড়ে ফেলল ।
দুপুরে ধুতির ওপর শার্ট চড়িয়ে বি-ডি-ওর অফিসে গিয়েছিল সারের তদ্বিরে । ফেরার পথে সন্ধেবেলা ময়নাদের বাড়ি সবে তাস নিয়ে বসেছে, তাস বাঁটা হচ্ছে, সেও ওই ফাঁকেই একবার উঠে গিয়ে নেবুতলায় ময়নাকে গালটাল টিপে এসেছে, এসে ময়নার বাপের কাশি আর রোজকার সেই একশিশি মধুর জন্য কাঙালপনা শুনতে শুনতে নিজের ভাগের তাসে চোখ রেখেছে, এমন সময় পলাই কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বড়দাদাবাবু, আপনার মা মরে গেছে গো!
তার তাস ভালোই পড়েছিল, ময়নাকে রাতে নেবুতলায় আরেকবার পাবারও কথা ছিল, সব মাথায় উঠল ।
সুদেবের গলা শুনে অনেক দূর থেকেও চেনা-আধচেনা লোকজন ছুটে এসেছে । সুদেব কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যেকের চোখে একবার করে চোখ রাখছে । যেন সকলের কাছে পালা করে জানতে চাইছে, কেন, কেন, কেন আমার মা মরে গেল?
সুদেবের বউ সুদেবকে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সেই যে একবার কেঁদে উঠেছিল, তারপর আর কাঁদেনি । সে সমানে সুদেবকে গাল পাড়ছে । সুদেব যত কাঁদে, সেও ততই তাকে গালাগাল দেয় । সুদেব কাঁদতে কাঁদতে পুকুরের দিকে দৌড়ে যেতেই তার বউ পিছন থেকে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে দুম-দুম করে পিঠে কিল মারতে লাগল ।
সুদেবের পরের ভাই ভূদেব পাশের গাঁয়ে নতুন ইটখোলা করেছে । ভোরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত করে । ইটখোলার কাছেই একটা মদ-গাঁজার দোকানে সন্ধে থেকে নেশা করে সাত-আট মাইল রাস্তা সে ঠিক সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসে । তখন দূর থেকে তার খোলা গলায় শ্যামাসঙ্গীত শোনা যাবেই । কোনও কোনও দিন বাড়ি ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যায় । আজ একজন মুনিষ গেছে তাকে খবর দিতে ।
ভূদেবের পর জয়দেব । সে কখনও সন্ধেবেলা বাড়ি থাকে না । ঝড়জলের দিনেও সে ঠিক বেরোবে । কোমর সোজা করতে পারে না । হাঁটবার সময় হাত দুটো সামনের দিকে ঝলঝল করে । একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় চার পায়ে হাঁটছে । নিজেদের বাগানের ফলমূল, পুকুরের মাছ-কাছিম চুরি করাই তার পেশা । শীতকাল কপি-বেগুন । গ্রীষ্মকালে আম-কাঁঠাল, শশা-তরমুজ । যখন যেমন । কাঁঠাল, আনারস চুরি করে সে বাগানের মধ্যেই গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখে । ওপরে ডালপালা, পাতাটাতা বিছিয়ে দেয় । মাঝে মাঝে চুরি করে ধরা পড়ে গিয়ে দাদাদের হাতে তো মার খায়ই, ছোট ভাইরাও তার গায়ে হাত তোলে । যতই মার খাক, সন্ধে হলেই সব ব্যথা-ট্যথা ভুলে এক ফাঁকে সে বেরিয়ে পড়ে । মাটির ওপর ঝুঁকে, প্রায় উবুড় হয়ে হাঁটে । হাত-দুটো সামনের দিকে ঝোলে । ঠিক একটা মার-খাওয়া ধূর্ত শেয়ালের মতো সে অন্ধকারে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় । ফল পাড়ে । কোঁচে গিঁথে মাছ মারে । তারপর বাজারে গিয়ে বেচে দেয় । বাজারের কাছেই একটা খোলার ঘরে তার বউ আছে । সন্ধে থেকে সার বেঁধে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে সেও সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে । জয়দেব বউয়ের জন্য ঠোঙা ভরা গরম সিঙাড়া ফুলুরি-বেগুনি কিনে নিয়ে যায় । বাকি টাকার সবটাই বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে, সে হাসে । ওই একটা সময় সে পিছনের দিকে ঘাড় ভেঙে মাথা তুলতে চায় । আজ সে বেরিয়ে যাবার ঠিক পরেই তার মা মারা গেছে । কাছাকাছি থাকলে নিশ্চয়ই বড়দার বীভৎস কান্না শুনতে পেত! একমাত্র তাকেই কেউ খবর দিতে যায়নি ।
বারান্দার কোণে বর্শাটা নেই । মহাদেবের ঘরের কুলুঙ্গিতে পাঁচ শেলের টর্চটাও নেই । সহদেব আর মহাদেব গেছে খরগোশ শিকারে । এদিককার বন-জঙ্গলের সব খরগোশ শেষ, আজকাল প্রায়ই তারা দূরের ঝোপঝাড়ে যায় । আজ কোনদিকে গেছে, কখন ফিরবে, কেউ জানে না । তাদের খবর দিতে তিনদিকে তিনজন মুনিষ পাঠানো হয়েছে । মা হঠাৎ চোখ বুজবে, কেউ ভাবেনি!
যেসব মুনিষ তেঁতুলতলার পুকুরে পাটগাছের আঁশ ছাড়াচ্ছিল, তারা সুদেবের আকাশ-ফাটানো কান্না শুনে ছুটে এসেছে । দুজন অল্পবয়সী মুনিষ মাঠ থেকে ফিরেই গোয়ালে ঢুকে ভাগাভাগি করে সাতটা গরু দোয়াচ্ছিল, তারা প্রথমে মেজবউয়ের কান্না শুনে ভেবেছিল মেজদাবাবু আজ হয়ত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে । এখন বড়দাবাবুর চিৎকার কানে যেতে উঠোনে এসে তাদের মুখ হাঁ হয়ে গেছে ।
সুদেব একবার দাওয়ায় উঠে মায়ের মৃতদেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, একবার উঁচু দাওয়া থেকে লাফ মেরে উঠোনে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে ।
মুনিষদের কারও চোখের পাতা পড়ছে না । সুদেবকে তারা এভাবে কাঁদতে দেখবে কেউ কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি । মুনিষরা দম বন্ধ করে দেখল, বড়দাবাবু কাঁদতে-কাঁদতে খুব কাতরভাবে তাদের চোখে একবার চোখ রাখছে ।
পলাই বিকেল থেকে কাঁঠালতলায় সারের জন্য গোবর জড়ো করছিল, হাতে-পায়ে গোবর নিয়েই সে সুদেবের খোঁজে দৌড়েছিল, তার হাতের কনুই পর্যন্ত গোবর শুকিয়ে খরখর করছে, ওই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুদেবের কান্না দেখতে লাগল ।
বউদের মধ্যে বেশি কাঁদছে মেজবউ । আরও অনেকেই কাঁদছে । সুদেবের তুলনায় আর সকলের কান্নাই বেশ ঢিমে । কেউ ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে । কেউ কাঁদছে ইনিয়ে-বিনিয়ে । সুদেব একদম আলাদা । মনে হচ্ছে শুধু তারই মা মারা গেছে ।
বর্ষার শেষেও আজকাল যখন-তখন হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে । একটু আগেও লেবুবাগানে, সজনে গাছে জোনাকির ঝাঁক টরটর করছিল, চিড়বিড়িয়ে বৃষ্টি নামতেই সব অদৃশ্য । বড়-বড় ফোঁটা সোজা গায়ে এসে বেঁধে । প্রতিবেশীদের অধিকাংশই যে যার ভিটের দিকে দৌড় লাগাল । কেউ কেউ উঠোনের চারপাশে এ-চালায় ও-চালায় মাথা গুঁজেছে । মুনিষরা তেমনই এক ঠাঁই দাঁড়িয়ে । তারা জানে, আজ তাদের রাত কাটবে শ্মশানে ।
মৃতহেদ উঁচু দাওয়ায় শোয়ানো ছিল । মায়ের মুখে-টুখে জলের ঝাপটা লাগছে, সুদেব বিছানাসুদ্ধ সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, তার কাকা বলল, থাক, একটু জুড়োক ।
এই সময় দেখা গেল, দূর থেকে একটা শেয়াল বা কুকুর বৃষ্টির মধ্যে খলবল খলবল করতে করতে ছুটে আসছে । উঠোনের কাছাকাছি এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল । তার ঝলঝলে দু-হাতে দুটো তাল । ভূদেবের বউ তাকে দেখতে পেয়ে নতুন করে ডুকরে উঠে বলল, জয়দেব রে! তোমাদের মা আর নেই!
ভূদেবের বউয়ের কান্নার আওয়াজ কম, কিন্তু মর্মান্তিক । এত বড় বাড়িতে একমাত্র শাশুড়িই তাকে মাতাল ভূদেবের হাত থেকে বাঁচাতে পারত । এই বয়েসেও রাতে শাশুড়ির বুকের কাছে শুতে পেলে সে আর কিছু চায় না ।
জয়দেবের ওপর তার একটু বিশেষ মায়া । বিশেষ করে সব ভায়েরা মিলে যখন ওই পঙ্গু ছেলেটাকে ধরে মারে, তার সহ্য হয় না । সে বুক নিঙরে দিয়ে বলল, মরবার সময় মা তোমায় বড্ড কাছে চেয়েছিল গো!
এসব মায়া-মমতার কথা শুনেও জয়দেবের এখন আর এগোবার উপায় নেই । তাল নিয়ে সে কিছুতেই বড়দার সামনে যেতে পারে না । উঠোনের বাইরে বৃষ্টির মধ্যে দু-এক মুহূর্ত থমকে থেকে সে ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে নিল, তারপর বাঁদিকের বনবাদাড়ে ঢুকে মিলিয়ে গেল ।
বাড়ির ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা তালপাতার ডোঙা-মাথায় উঠোনে এসে জড়ো হয়েছে । আশপাশের বাড়ির মেয়ে-বউরা এসে তাদের নিয়ে যাচ্ছে । আজ তারা সেখানেই খাবে । আজ বাড়িতে উনুন জ্বলবে না । বড়রা কেউ খাবেও না ।
যাদের কেউই এসে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে না, সুদেবের বউ তাদের একেকজন মুনিষ দিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করছে । নিজের তিন ছেলে এক মেয়েকে এতক্ষণ কারও সঙ্গে যেতে দেয়নি । একজন মুনিষকে দিয়ে এদের খগেন জ্যাঠার বাড়ি পাঠিয়ে দিল । যাবার সময় সঙ্গের লোকটাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, বলিস— ঘি দিয়ে মুগের ডাল খেতে এরা ভালোবাসে ।
এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে আঁচলের তলা থেকে একটা চকচকে বেগুন বের করে দিয়ে বলল, একটু ছাঁকা তেলে ভেজে দিতে বলিস ।
খগেন জ্যাঠার কাছে খুব গোপনে তার কিছু টাকা রাখা আছে!
বৃষ্টি থেমে গিয়ে ফের ঘোলাটে চাঁদ উঠেছে । প্রতিবেশী পুরুষরা বেশ যত্ন করে খাটিয়া বানাচ্ছে । ছ-সাত ক্রোশ রাস্তা, বাঁধন-বুনোন মজবুত না হলে চলবে কেন!
সুদেব তখনও কাঁদছে । মাঝে একটু ঝিমুনি এসেছিল, আবার নতুন করে শুরু করেছে । এর মধ্যে এক ফাঁকে সে একজন মুনিষকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছে খই আনতে । আলাদা একটা দশ টাকার নোট দিয়েছে, পয়সায় ভাঙিয়ে আনতে । নাদুকে নোটটা দিয়ে বলে দিয়েছে, এক নয়া আজকাল আর পাওয়া যায় না । তবে দু-পয়সার বেশি নিবি না । প্রথমে সবটা এক টাকা করে নিস । তারপর দরকার হলে দশ দোকানে ঘুরে খুচরো করবি ।
এখন তার কান্নার মধ্যে একটা কথাই ফিরে ফিরে আসছে । মা নেই, এবার সংসার কে দেখবে? সংসার এবার ভেসে যাবে ।
কাঁদতে কাঁদতেই সে দূর থেকে ভূদেবের গান শুনে একটু ঢিমে দিল । মাঠ থেকে হঠাৎ-হঠাৎ উলটো-পালটা হাওয়া আসছে । ভূদেবের দরাজ গলার গান স্পষ্ট শোনা যায়— এত খেয়েও সাধ মেটে না, এবার কালী তোমায় খাব । তুমি খাবে লেজ-মুণ্ডু মা, আমি পাঁঠার মাংস খাব ।
ভূদেবের বউ শোকের মধ্যেও ভুরু কোঁচকাল । অন্যদিন মানুষটা ঠিক-ঠিক শ্যামাসঙ্গীতই গায় । বেসুরো হলেও কথা ঠিক থাকে । কীসব মাথা-মুণ্ডু বকছে ।
ভূদেবের বউয়ের আর শান্তি নেই । সব সময় সে ভয়ে কাঁপে । তার জীবনে আরও কী খারাপ ঘটতে পারে ভেবে সারাক্ষণই সে সিঁটিয়ে থাকে । ভিজে হাওয়ায় ভূদেবের প্রলাপ শুনতে শুনতে সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, তার এবারের জীবন এইভাবেই একদিন শেষ হয়ে যাবে ।
ভূদেব গান বদলেছে । এবারও মনগড়া কথা মিশিয়ে গাইছে । একটু পরে তার সাইকেলের শব্দ শোনা গেল । ওই তো আসছে । দু-চাকা কাদায় মাখামাখি । চোখ লাল । সাইকেল থেকে নেমে, দাঁড়াতে পারছে না । পা টলোমলো । সামনে খাটিয়া পেয়ে তার ওপর ধপাস করে বসে পড়ল ।
সুদেবের বউ কাকি দিদি হা-হা করে দৌড়ে এল । দিদি বলল নাম, নাম— নেমে আয়! এক ফোঁটা জ্ঞানগম্যি হল না তোর!
সুদেবের কাকি জামার কলার ধরে টানতে-টানতে তাকে তুলে দিয়ে বলল, মড়ার খাটিয়ায় কেউ বসে!
ভূদেব একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, সে হতভাগী কই? শ্মশানে নিয়ে গেছে?
দিদি কিছু বলতে গিয়ে এবার কেঁদে ফেলল ।
ভূদেব বড় একটা হাই তুলে বলল, যখন বেঁচে ছিল আমায় জ্বালিয়েছে— এবার মরে গিয়ে জ্বালাবে ।
সুদেব প্রায় লাফ মেরে তার কাছে এসে হুঙ্কার দিয়ে বলল, থাবড়িয়ে মুখ ভেঙে দেব বাঁদর! আর একটা কুকথা বলবি তো মেরে শেষ করে দেব শুয়োর!
ভূদেবের দু-চোখ দু-টুকরো আগুনের মতো জ্বলছে । রাগে তার নেশা প্রায় কেটে গেছে । সে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে দু-হাতে সুদেবের গলা টিপে ধরে তাকে ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বলল, বড্ড মায়া! অ্যাঁ, বড্ড মায়া! আজ ওই ছেনালির সঙ্গে সহমরণে পাঠিয়ে তবে ছাড়ব! তবে আমার নাম ভূদেব বিশ্বাস!
লোকজন ছুটে এসে কোনওরকমে ভূদেবের হাত না ছাড়িয়ে দিলে কী হত বলা যায় না । সবাই মিলে দুজনকে দুদিকে টেনে নিয়ে গেল । ছোটকাকা ভূদেবকে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল ভূদু? নিজের মাকে নিয়ে কেউ ওরকম বলে? শত্তুর মরলেও তো কেউ ওরকম করে বলে না । হাজার মাথা খুঁড়লেও ইহজীবনে আর কি মাকে পাবি?
তার গলা বুজে আসছিল । ছোটবেলা থেকে ওই বৌদিই তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে ।
ভূদেব হঠাৎ সব বুঝতে পারে । ছোটকাকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, কাকা! আমার মা মরে গেছে? আমি ভেবেছিলাম— ও! হো হো হো!
ভূদেব হাউ হাউ করে কাঁদে ।
আর রাত করা ঠিক হবে না । পথ কম নয় । তার ওপর বৃষ্টি-বাদলার কথা জোর করে কিছু বলা যায় না । সহদেব-মহাদেবের জন্য আর কত অপেক্ষা করা যায়! যে-তিনজন তাদের খোঁজে গিয়েছিল, একে-একে সকলেই ফিরে এসেছে । চেনা-অচেনা মাঠে বনে খেতে খুঁজেছে, দেখা পায়নি । দু-ভাই আজ খরগোশ মারতে কোন দুনিয়ায় গেছে কে জানে ।
বিনোদ বৈরাগী সন্ধে থেকে বসে-বসে তামাক খাচ্ছিল, মুখের সামনে থেকে হুঁকোটা সরিয়ে বলল, সবার ভাগ্যে থাকে না । ছাই হবার আগে বাপ-মাকে একবার চোখের দেখা দেখবার ভাগ্যি সবার হয় না ।
সুদেব ভূদেব দু-জনেই কাঁধ দিয়েছে । পায়ের দিকটা কাঁধে নিয়েছে দু-জন জ্ঞাতি । ছোটকাকা চলেছে আগে-আগে । তার হাতে খইয়ের ধামা আর খুচরো পয়সা ।
শবযাত্রীরা উঠোন পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে চলেছে । পিছন পিছন যাচ্ছে চোদ্দজন মুনিষ । অন্যদিন ভোর থেকে কাজ করে সন্ধেবেলা তারা যে যার ঘরে ফিরে যায় । আজ আর তাদের বাড়ি যাওয়া নেই । কেউ তাদের কিছু বলেনি, তারা নিজে থেকেই জানে, আজ তাদের শ্মশানে যেতে হবে ।
পদ্মপুকুর ছাড়াতেই বাঁদিকের ঝোপ-জঙ্গল থেকে ভূদেবের মুখের ওপর টর্চের আলো এসে পড়ল । তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে । সারা গা ঘামে ভেজা । কাকা পিছনে মুখ ফিরিয়ে বলল, সহদেব-মহাদেব আসছে ।
বাহক ও মুনিষরা এবার একটু জোরে বলল, বল হরি হরি বোল । সুদেব ভূদেব দুজনেই গলা মেলাতে গিয়ে কেঁদে ফেলল ।
চাঁদ এখন অনেক স্পষ্ট । মাঠভরা জোনাকি । সহদেব মহাদেব বাঁদিক থেকে টর্চ মারতে মারতে ঝোপঝাড় ভেঙে রাস্তায় উঠেই দাঁড়িয়ে গেল । সহদেব হাতের টর্চ নেভাতে ভুলে গেছে । তার বাঁহাতে দুটো খরগোশ । একসঙ্গে ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে নিয়েছে । একটার কান দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে । আরেকটার মাথা দু-ফাঁক হয়ে রক্তে মাখামাখি । মহাদেবের হাতে বর্শা ।
সহদেবের টর্চ এর-ওর মুখে ছটফট করতে করতে তার মায়ের মাথায় স্থির হয়ে গেল । অন্ধকারে ঝোপের মধ্যে খরগোশ দেখলে দূর থেকে সে ঠিক এমনি করে খরগোশের চোখে পাঁচ শেলের টর্চ ফ্যালে । খরগোশ আর নড়তে পারে না । মহাদেবের হাতে বর্শা দুলে ওঠে । তার টিপ ফস্কায় না ।
জঙ্গলে জ্যোৎস্নায় নিঝুম গ্রামের পথে নতুন করে রোদন শুরু হয় । সহদেব কাঁদে— মা রে, এ তুই কোথায় চললি?
খাটিয়া নামানো হয়েছিল । মহাদেব তার মায়ের মুখের ওপর ঝুঁকে দু-হাতে মায়ের মুখ ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে ডাকে, ও মা, মা রে!
মহাদেব বর্শা ফেলে দিয়েছে । সহদেবের হাতে তখনও খরগোশ-দুটো ধরা । এবার তারা কাঁধ দেবে ।
সহদেব পাশের ঝোপে খরগোশ দুটো ছুঁড়ে দিতে যাচ্ছিল, কাকা বলল, ফেলিস না । ওই মুনিষদের দে । ওদের তো আর অশৌচ নেই । গরিব মানুষ, তৃপ্তি করে খাবে । তোর মায়ের আত্মারও তাতে কল্যাণ ।
সহদেব কাছেই তুঁতেকে পেয়ে খরগোশ তার হাতে দিতে গেল ।
কাকা বলল, যা, দৌড়ে গিয়ে তোর বাড়িতে রেখে আয় । কাল সকলে মিলে ভাগ করে খাস ।
তুঁতে এক পা পিছিয়ে গিয়েছিল । আমতা-আমতা করে বলল, আমার ঘরে রোজ শেয়াল ঢোকে ।
সহদেব পলাইয়ের দিকে খরগোশ-দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নিয়ে যা ।
পলাই হাত বাড়ায় না । সে নেবু, ভূধর, কনুদের দিকে তাকিয়ে অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করে ।
— কী হল রে! ধর—
পলাই তবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ।
এত শোকের মধ্যেও সুদেব হঠাৎ অসম্ভব গম্ভীর গলায় হুঙ্কার দিল, পলাই!
মুনিষদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে । তার মধ্যে থেকে নাদু গলা তুলে বলে উঠল, ও-খরগোশ আমরা কেউ খাব না বাবু, ওতে পেত্নী লেগেছে!
সহদেব রাগের চোটে খরগোশ-দুটোকে খুব জোরে ছুড়ে দিল । গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে সে-দুটো সোজা পদ্মপুকুরে পড়ে ঝুপুস করে শব্দ হল ।
খাটিয়া আবার কাঁধে উঠেছে । এবার চারকোণে চার ছেলে । কাকা খই আর পয়সা ছড়াতে ছড়াতে এগোচ্ছে । পিছনে শব-বাহকের দল ।
তুঁতে আর পলাই বিড়ি খাবে বলে ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়েছিল । নাদুও দাঁড়াল । থক করে খানিকটা শ্লেষ্মা ফেলে বলল, বুড়ি বেঁচে থাকতে কোনওদিন একটা মাছের কাঁটা পাতে দিল না, সে মরেছে বলে খরগোশের ভোজ! থুঃ!
পলাই পর পর কটা লম্বা টান দিয়ে বিড়িটা তুঁতের হাতে দিয়ে বলল, যা হাড়কিপটে বুড়ি! আমরা খরগোশ ছুঁলে ঠিক পেত্নী হয়ে ঘাড় মটকাতো!
সবে কয়েক পা এগিয়েছে, এমন সময় তিনজনেই একসঙ্গে শুনল, পিছনের পদ্মপুকুরে ঝপাস করে কী-একটা লাফিয়ে পড়ল । হয়ত সেই শেয়াল বা কুকুরটা । খরগোশ দুটোর লোভে নয় তো?
হরিধ্বনি অনেক দূর চলে গেছে । তারা জোরে পা চালাল । প্রায় দৌড়চ্ছে ।
প্রথম প্রকাশ : অমৃত, ১৯৭৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন