ভয় – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

ভয়

শেষ রাতে একদল লোক হঠাৎ সুর করে হরিনাম শুরু করায় সত্যেনের ঘুম চটে যায় । ভোরের দিকটাই তার গাঢ় ঘুমের সময় । চোখ জ্বালা করছে, মাথা ভার । ট্রেন থেমে আছে । জানলা দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, স্টেশনের নাম পাঠশালা । প্লাটফরমে ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে বহুলোক অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে । দেখেই বোঝা যায়, তাদের কোনও তাড়া নেই । দূরে গ্রাম । আকাশে তখনও তিনটে তারা ।

কীর্তনের দলটা ছাড়া কামরা প্রায় ফাঁকা । সত্যেনের ঠিক সামনের সিটের মহিলা এরই মধ্যে মুখ-টুখ ধুয়ে বোধহয় একটু পাউডারও বুলিয়ে নিয়েছে । মুখটা ঘুমের পর একটু ভার-ভার, দেখতে মন্দ নয় । বাঁ-গালে আবছা মতো কয়েকটা ছিটছিট দাগ, বোধহয় লিভারের গোলমাল, ভুরু কুঁচকে প্লাটফরমের দিকে চেয়ে আছে । ছেলেটা দুহাতে তার মায়ের একটা বাহু জড়িয়ে ধরে কিছু বলছে, কীর্তন ছাপিয়ে শোনা যায় না । মহিলা বিরক্ত হয়ে ভেতরের দিকে মুখ ফেরাতেই সত্যেন চোখ সরিয়ে নেয় ।

সিগারেট মুখে নিয়ে এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে দেশলাই পেল না । হরেরাম হরেকৃষ্ণ পৌঁছেচে, একজন তো দুহাত তুলে বসে-বসেই দুলছে । ওদের কাছে দেশলাই চাওয়া যায় না । অথচ ওদের জন্যই তার ভোরের ঘুম মাটি । ধর্ম সত্যিই বড় অন্ধ ।

মহিলার স্বামী দু-হাতে দু-ভাঁড় চা নিয়ে ঢুকল, ধরো, ধরো, হাত পুড়ে যাচ্ছে ।

— আঃ! হাত ছাড়ো বুবু ।

— আগে বলো, পাঠশালা মানে কী?

মহিলাটি এক হাতে একটা ভাঁড় নিয়ে সিটের ওপর রাখল । তারপর ছেলের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, সোজা হয়ে বসতে পার না? কতদিন বলেছি কুঁজো হয়ে বসবে না ।

ছেলেটা আরও ঘেঁসে মায়ের বাহু টেনে ধরে আরও কুঁজো হয়ে বসল । বলল, বসবো! তুমি আমাকে পাঠশালা মানে বলছ না কেন?

টান লেগে বুকের আঁচল খসে পড়ে । আঁচল তুলে ছেলের দিকে তাকায়, উঃ! এত বিরক্ত কর! কলকাতায় চলো, তোমাকে আমি স্কুল ছাড়িয়ে ঘরে বসিয়ে রাখব!

— আমি স্কুলে যেতে চাই না!

ভদ্রলোকের প্যান্টে চা পড়েছিল, টয়লেট থেকে ধুয়ে এসে রুমাল দিয়ে ভিজে জায়গাটা মুছতে-মুছতে বললেন, কতক্ষণ এখন থাকতে হয় দ্যাখো! পর-পর ফিশপ্লেট খুলে রেখেছে । কতক্ষণে মেরামত হবে কে জানে!

ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দিলেন, এঃ, ঠান্ডা । কীর্তন তুঙ্গে উঠে নতুন করে মন্থর চালে শুরু হয়েছে । ভদ্রলোক সেই দিকে একবার চেয়ে নিয়ে স্ত্রীকে বললেন, তুমি বরং একটু শুয়ে নাও । বসে থেকে কোমর ধরে যাবে । ট্রেন ছাড়লে আর জায়গা পাবে না ।

সত্যেনের মেজাজ পুরোপুরি খিঁচড়ে যায় । তার মানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানেই ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকবে । লাইন রিপেয়ারের কাজ কতক্ষণে শেষ হতে পারে, ভদ্রলোক সে-বিষয়ে কোনও ধারণা পেয়েছেন কিনা, জিজ্ঞেস করতে তার ইচ্ছে হল না । এই তার এক স্বভাব । মেজাজ খারাপ হলে কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না । এইসব সময় কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে কটা বাজে, সে উত্তর দেয় না, চুপ করে থাকে । এমনিতে অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলাই তার পেশা । মেডিকেল স্টোর, গ্রামের হাসপাতাল, এসব জায়গায় কথা বেচেই তাকে খেতে হয় । কিন্তু এখন ট্রেন কতক্ষণে ছাড়বে সেটা জানা তার খুবই দরকার, তবু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না । সামনের ভদ্রলোককে সিগারেট ধরাতে দেখেও সে দেশলাই চাইল না ।

প্ল্যাটফরমে নেমে সে পান-সিগারেটওয়ালার কাছ থেকে দেশলাই কিনল । লোকেরা কেউ-কেউ প্ল্যাটফরম ছাড়িয়ে লাইন পর্যন্ত এগিয়ে গেছে । ইঞ্জিনের কাছেও ভিড় । অনেকে এই সাতসকালেই সিঙাড়া-ডালপুরী খাচ্ছে । ভাব-সাব দেখে বোঝাই যায়, খুব শিগগির ট্রেন ছাড়বার সম্ভাবনা নেই । পাছে বিরক্তি বেড়ে যায়, সত্যেন স্টেশনের লোহার বেড়া ডিঙিয়ে বাইরে ফাঁকা মাঠের মুখে দাঁড়াল ।

মাঠের ওপারে বাঁদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁশঝাড় । ডানদিকে গা-ঘেঁসাঘেঁসি কতগুলো মেটে বাড়ি । এই গ্রাম, তার আসা দূরে থাক, আগে কখনও দেখেইনি । এই রকম করে এই মাঠের ধারে এসে দাঁড়ানোরও তার কথা ছিল না! চারটে পাখি ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে চিংরিক চিংরিক করে ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল, সত্যেন খেয়াল করল, ঠিক এরকম কোনও পাখির ডাক সে আগে শোনেনি । সবটাই তার কাছে একেবারে আনকোরা নতুন । তার ওপর সবে ভোর হয়েছে । ভোরবেলা আচমকা নতুন একটা জায়গা চোখের সামনে পেয়ে গিয়ে সত্যেনের বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ভাব আসে । সে টের পায়, তার মেজাজ ভালো হয়ে যাচ্ছে ।

ভেতরটা ঘুরে দেখে এলে হয় । পিছন ফিরে প্ল্যাটফরমে চোখ বুলোল । লোকজনের তেমনই গা-ছাড়া ভাব । ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ট্রেন নিশ্চয় ছাড়বে না । সুটকেশ আর ব্যাগটা ট্রেনে রয়ে গেছে । ওই মহিলাটি ট্রেন ছেড়ে নামবে মনে হয় না । চুরি হওয়া শক্ত । তবু পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে সে টস করে । হেড পড়লে এগোবে, টেল হলে পেছোবে । আধুলিটা হাত ফসকে কেঁচোর তোলা নরম মাটির স্তূপে কাত হয়ে গেঁথে যায় । চুলোয় যাক । তাছাড়া এখন তার ঝুঁকি নিতেই ভালো লাগছে । পয়সাটা ঘাসে মুছে নিয়ে পকেটে রেখে মাঠের মাঝামাঝি পৌঁছে সত্যেন পরিষ্কার বুঝতে পারল, তার এতদিনের জীবনের সঙ্গে এখন আর তার সম্পর্ক নেই ।

মাঠ পেরিয়ে প্রথম যে বাড়িটা দেখল, তার উঠোনে একটা মেয়ে ছাগল দুইছে । কাছেই সাত-আট বছরের আরেকটা খালি-গা মেয়ে ছাগলটার পিছনের ঠ্যাং দুটো শক্ত করে ধরে আছে । বড় মেয়েটির শাড়ি হাঁটুর ওপর তোলা, দু-হাঁটুর মাঝখানে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি চেপে রেখেছে, সত্যেন পাশ থেকে তার একদিকের স্তনের খানিকটা দেখতে পেল ।

সিগারেট ফেলে সত্যেন মেয়ে-দুটোর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ছাগলটা গলা তুলে ডেকে উঠল । পা ঠুকে-ঠুকে পা ছাড়াবার চেষ্টা করছে ।

— আঃ! শক্ত করে ধর না! এই লক্ষ্মী, ওদিকে কী দেখছিস?

লক্ষ্মী সত্যেনকে দেখছিল । তাদের বাড়ির উঠোনে প্যান্ট-শার্ট পরা লোক, কোমরে চওড়া বেল্ট, পায়ে কীরকম জুতো, লক্ষ্মী অবাক ।

— ইস্টিশন পরে দেখিস । ও ট্রেন আজ আর যাবে নাকি! বলছি না, ঠ্যাং চেপে ধর ।

লক্ষ্মী আস্তে করে মুখ নামিয়ে বলল, দিদি, দ্যাখ—

মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে সত্যেনকে দেখেই বিরক্ত । খুব বিপদে পড়েছে । কাপড়-চোপড় ঠিক নেই, এদিকে পা আটকা । সত্যেন গলা পরিষ্কার করে বলল, ছাগলদুধ তোমরা বিক্রি কর?

মেয়েটা ততক্ষণে দুধের বাটি নামিয়ে রেখে পায়ের পিঠের শাড়ি টানছে, সত্যেনের কথার উত্তর দিল না । গলায় খাঁটি বিরক্তি নিয়ে লক্ষ্মীকে বলল, যা তো, বাবাকে ডেকে নিয়ে আয় ।

ছাড়া পেয়ে ছাগলটা দৌড়ে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল । মেয়েটা এক দৌড়ে গিয়ে ছাগলটার শিং ধরে ফেলল ।

গায়ে কাপড়ের খুট জড়িয়ে লক্ষ্মীর পিছন-পিছন মাঝবয়েসী একটা লোক বেরিয়ে এল । চোখে সন্দেহ । সত্যেন তার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনারা কি অল্প খানিকটা ছাগলদুধ বেচবেন?

লোকটার তখনও সন্দেহ যায় না । সত্যেনকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, তা আপনার আসা হচ্ছে কোত্থেকে?

সত্যেন সিগারেট ধরিয়ে লোকটার দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়, আমাদের ট্রেন এখানে আটকে গেছে । লাইন-টাইন সারিয়ে কখন ছাড়বে ঠিক নেই । আমার পেটের গোলমাল । একটু ছাগলদুধ পেলে—

লোকটা সিগারেট ধরায়, ধোঁয়া ছেড়ে বলল, দাম আজ একটু বেশি পড়বে । ভোর থেকেই তো গ্রামের সব দুধ-ডিম ইস্টিশানে উবে যাচ্ছে ।

— সে ঠিক আছে । কিন্তু দুধ একটু গরম করে দিতে হবে । পোয়াটাক হলেই চলবে ।

মেয়েদুটো ততক্ষণে আবার ছাগল দুইতে লেগেছে । লোকটা বলল, একটু সময় লাগবে । আপনি ততক্ষণ একটু বিশ্রাম করুন ।

নিজেই একটা জলচৌকি এনে দাওয়ায় পেতে দেয়, বসুন ।

লোকটাও কয়েক হাত দূরে মাটিতে উবু হয়ে বসে ।

সত্যেনের অস্বস্তিভাবটা কেটে গেছে । বেশ লাগছে । যেন বিনা চেষ্টায় সে একটা নতুন জীবনে ঢুকে পড়েছে । দূরে বাঁশঝাড়ের মাথায় চিংরিক-চিংরিক শুনে সে কথা খুঁজে পায়, ওটা কী পাখি বলুন তো ।

— আমরা বলি পিরীত-পাখি । জোড়ায়-জোড়ায় ওড়ে । সব সময় ওইরকম শিস দেয় ।

লাভবার্ড-এর চমৎকার বাংলা! সত্যেন নায়কোচিত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক দ্যাখে— আপনাদের এই জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগছে । ধরুন, আমি যদি এখানে থেকে যেতে চাই, একটু জমি কেনার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?

লোকটা সিগারেট টেনে কাশছিল, বসে-বসেই অনেক দূরে, উঠোনের কিনারে খানিকটা কাশ ছুঁড়ে ফেলে বলল, কলকাতায় আপনার বাড়ি নেই?

— তা আছে । আচ্ছা, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করে এখানেই ঘর-বাড়ি তুলে থেকে যেতে পারি না?

বলেই সত্যেন বিব্রত হয় । লোকটা নিশ্চয় তাকে পাগল ঠাওড়াচ্ছে কিংবা বদমাশ-টদমাশ ভাবছে । ভাবুক গে, এই ভাবেই ভালো । স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলার স্বাদই আলাদা । আর এই মাঠের মধ্যে বিয়ে-টিয়ের কথা বললেই বা ক্ষতি কী!

লোকটা কিন্তু একটুও চমকায়নি, দিব্যি শান্ত গলায় বলল, কলকাতায় আপনার বউ নেই?

সত্যেনের ইচ্ছে হল, বলে দেয় যে তার বউ আছে । তার ছেলে পুরুলিয়া সৈনিক স্কুলে পড়ছে । আর তিন বছর পরে দেরাদুন ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে যাবে । আজ, এখানে, তার সব সত্যি কথা বলতে ইচ্ছে করছে । তার মন চাইছে, সত্য বই মিথ্যা বলিব না । একরকম জোর করে সে বলল, বিয়ে আর করা হল কই! অবশ্য আপনার মেয়ের তুলনায় আমার বয়েস একটু বেশি—

সত্যেন টের পায়, তার ভেতরটা কাঁপছে । লোকটা নিশ্চয় তাকে বড়শিতে বিঁধে খেলাচ্ছে । বলল, তাতে আর বাধা কী! সরস্বতীর মা আমার থেকে কুড়ি বছরের ছোট ছিল । তা তিনি আর নেই । এই বুড়ো বয়সে মেয়েদুটোকে আমার কাঁধে চাপিয়ে— কথা থামিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ।

ব্যাপারটা সত্যেনের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে । কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে জানে । তার নেশা চড়ে গেছে, এখন আর থামার মানে হয় না । সে চট করে ভেবে নিল, যদি মেয়েটাকে বিয়ে করে এখানেই বাকি জীবন সে থেকে যায়, সেটা কি সত্যিই অসম্ভব? সঙ্গে সঙ্গে তার একটা দর্শনও তৈরি হয়ে যায় । এটা কি ঠিক নয় যে তার জীবনটা আগাগোড়া ভুল হয়ে গেছে! সে কি সত্যিই অন্তরে-অন্তরে একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ? কোথাকার কোন ওষুধ কোম্পানির স্যামপেলের ব্যাগ নিয়ে হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াতে কি তার জন্ম হয়েছে? এতদিনে তার সেতারের টংকারে দেশ কাঁপানোর কথা ছিল । বড়মামা নিজে ডাক্তার, একবর্ণ সেতার না-বুঝে দিব্যি সুখে জীবন কাটিয়ে গেলেন । ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে তার চাকরিটা জুটিয়ে না দিলে, আজ তার এরকম জীবন হয়? চাকরি হয়েছে, বউ হয়েছে, প্রোমোশান হয়েছে, ভাড়াটে সুদ্ধ একটা বাড়িও সে কিনে ফেলেছে, ছেলে হয়েছে, সবই হয়েছে । কিন্তু তার ওপর যেন অন্য একটা লোকের জীবন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । এই জীবনের কথা সে ষোল বছর বয়েসে কই ভাবেনি তো! সত্যেন একেকটা বয়েসে একেকরকম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছে, আবার যদি সেই স্কুলের জীবন থেকে শুরু করা যেত! সেটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় । কিন্তু সারাজীবন একঘেয়ে একটা ভুল জীবনের জের টেনে চলতে হবে তারই বা মানে কী! পাঠশালা থেকে শুরু করা না যাক, এখন এই পাঠশালা গ্রামে নতুন আরেকটা জীবন কেন ফিরে শুরু করতে পারবে না?

সরস্বতী এক বাটি গরম দুধ তার সামনে রেখে চলে যাচ্ছিল, তার বাবা খেঁকিয়ে উঠল, হাতে দিতে পারিস না? মানী লোককে ওভাবে খেতে দেয়? ধিঙ্গি মেয়ে, এসব আর কবে শিখবি?

মেয়েটা ফিরে এসে দুধের বাটি সত্যেনের হাতে তুলে দেয় । লোকটা হা-হা করে ওঠে, এক হাতে না, এক হাতে না! বাঁ-হাত দিয়ে ও-হাতের কনুই ছুঁয়ে তারপর দে ।

সত্যেন ব্যস্ত হয়, ঠিক আছে, ঠিক আছে । ছেলেমানুষ—

— ছেলেমানুষ কী! কদিন পরে নিজের সংসার হবে, ছেলেমানুষ বললে হয়!

মেয়েটা দুধ দিয়ে চলে যাচ্ছে, একেবারে লাউডগার মতো সজীব । সত্যেন বাপের সামনে জোর করে ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় ।

— তা বাবা, আপনারা শহরের মানুষ, এসব গ্রাম-গাঁ তো আপনার ভালো লাগবে না ।

— আমার লাগবে । জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগছে ।

— সে দু-একদিন । তারপর আর মন টিকবে না ।

— আপনি আমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না । আমি নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই । এইখানেই, এটাই ঠিক জায়গা ।

— তা নয় থাকলেন, পেট চলবে কিসে?

— কলকাতায় আমার বাড়ি আছে । নীচের ভাড়াটে তুলে দিয়ে বাড়িটা বেচতে পারলে ভালো দাম পাব । লাখ-দুয়েকের বেশি ছাড়া কম নয় । মামলা করেছি, রায় আমার পক্ষেই হবে ।

সত্যেন কথাটা এই পর্যন্ত হুবহু সত্যি বলছে, ফলে তার কোনও জড়তা নেই, সে ভাবী শ্বশুরকে তার আর্থিক সঙ্গতির বর্ণনা দেয়, পুরো টাকাটা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিটে রাখলে ব্যাঙ্কই মাসে মাসে এখানে আমাকে টাকা পাঠিয়ে দেবে । মাসে প্রায় দু হাজার ।

লোকটা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁক পাড়ে, ও নকে-সরে, একবার আয়, শিগগির আয় মা—

অনেকক্ষণ সহ্য করেছে, এতক্ষণে বুঝি তার মাথা খারাপ হল । আয়, আয়, শিগগির আয়— বলতে বলতে লোকটা সত্যেনের পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, আপনি সাক্ষাৎ ভগমান!

সত্যেন ভারি বিব্রত হয়ে পা সরিয়ে নেয় । লোকটা মেয়েদের দিকে মুখ তোলে, তার দু-চোখ বেয়ে জল পড়ছে, বাবু চান করবে, জল তুলে দে, শ্যামার বাড়ি থেকে আরও দুধ নিয়ে আয়, পায়েস হবে, ঘরটা ভালো করে নিকিয়ে একপাশে পরিষ্কার একটা বিছানা কর, কাচা কাঁথা-টাথা কী আছে দেখ— ও হো হো হো! তোর মা যদি আজ থাকত ।

লোকটা বালকের মতো কাঁদছে । সত্যেনের হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে আসে, কাঁদতে কাঁদতে শীতলপাটি পেতে দেয়, এ আপনার নিজের বাড়ি । সরস্বতী, হাওয়া কর মা । আমি দেখি, দুমুঠো সরু চাল যদি পাই—

লোকটার পিছন পিছন লক্ষ্মী একটা ঘটি নিয়ে বেরিয়ে গেল । বোধহয় দুধ আনতে ।

সরস্বতী দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাওয়া করছে । ঘরে আর কেউ নেই । সত্যেন খপ করে তার হাত ধরে । ভেতরে ব্লাউজ-টাউজ কিছু নেই, শাড়ির ওপর দিয়ে বুকের ডৌল বোঝা যায়, সত্যেনের শরীরের মধ্যে ঝমঝম করছে…. না ঠিক হবে না, এবার তার অন্য রকম জীবন চাই । মেয়েটা ওই অবস্থায়ও দেওয়ালের দিকে মুখ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । সত্যেন হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, হাওয়া করতে হবে না, বোসো । তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে ।

মেয়েটা আড়ষ্ট, মুখটা শক্ত করে তেমনই দাঁড়িয়ে আছে । সত্যেন এবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । একেবারে মুখোমুখি । হাত নিসপিস করছে । ফস করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, তুমি কাজ কর । আমি একটু গাছপালা আকাশ-টাকাশ দেখে আসি । জায়গাটা ভারি সুন্দর ।

বাইরে এসে একটা পুকুরে তার চোখ আটকে যায় । পরিষ্কার জল, তার মধ্যে আকাশ স্থির হয়ে আছে । অনেক নীচে দুটো চিল, জলের মধ্যে চিৎ হয়ে অতি ধীরে ভেসে বেড়াচ্ছে ।

ঠিক এইখানেই সে বাড়ি তুলবে, এই পুকুরটার কাছে । চার কোণে চারটে, কি আটটা পিলার তুলে তার ওপর কংক্রিটের ছাদ ঢালাই করে তার ওপরে ঘর হবে, যেন মাচার ওপর বাড়ি, নিচটা চারদিক খোলা, সেখানে শুধু ফুলগাছ, মাঝখানে সবুজ ঘাসে ঢাকা বসবার একটু উঁচু মতো জায়গা থাকবে । দোতলায় তার খাওয়া-শোওয়ার ঘর, আর তার ওপরে, একেবারে আকাশ-ছুঁয়ে একটামাত্র ঘর । ওই ঘরে সে রেওয়াজ করবে । রোজ শেষ রাতে আহীরভৈঁরো বাজিয়ে সে সূর্যোদয়ের ঠিক আগে সারা আকাশ রাঙিয়ে দেবে । ভাবতেই তার শরীরে যৌন আনন্দের মতো একটা শিহরণ উঠল ।

বহুদূর থেকে ইঞ্জিনের টানা হুইশিল শুনে প্রথমে সে কিছুই মনে করতে পারল না । পরের মুহূর্তে সে ভীষণ ভয় পেয়ে হঠাৎ মাঠ ভেঙে দৌড়তে লাগল । মাঝ বরাবর এসে সত্যেন দেখল, প্ল্যাটফরম ফাঁকা, সবাই ট্রেনে উঠে পড়েছে । দ্বিতীয় হুইশিল পড়ল । ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তৃতীয় হুইশিলের মাথায় সত্যেন লোহার বেড়া ডিঙোতে গিয়ে প্যান্টের পা ছিঁড়ল । লাফ মেরে সামনের একটা চলন্ত কামরায় উঠে পড়ে হাঁপ নিতে নিতে সত্যেন ভাবল, উঃ, আরেকটু হলে…কাল তার মামলার তারিখ!

এত হাঁপাচ্ছে, এখন পনেরো মিনিট সিগারেট খাওয়া যাবে না ।

প্রথম প্রকাশ : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ এপ্রিল ১৯৭৮

সকল অধ্যায়

১. নিমফুলের মধু – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
২. গৃহ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৩. হাতেখড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪. ধুলো – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৫. সন্ন্যাসীর পুঁথি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৬. শেতলের খিদে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৭. ভয় – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৮. শোধ তোলা – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৯. মানুষ-মুনিষ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০. ঠাকুরদার বাড়ি – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১১. নৌকোবদল – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১২. হলদী নদীর তীরে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৩. ছোঁ – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৪. বুকজলে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৫. ঘোড়াদহের মাঠে – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৬. ঘুম – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৭. মন্থরোর মা অথবা রাজধানীর গল্প – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১৮. ভাঙন – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন