অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
মন্থরোর মা লাঠি ঠুকে ঠুকে এসে আমাদের বারান্দায় বসে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কলকেতা থেকে নাতি আসবে বলেছেল, এলোনি, ইদিকে সাঁঝ নাগতে নেগেছে, ভাবলুম পাখি কটা তবে খোকাকেই দে’আসি । দাও বাবা, চার আনা পয়সা দাও ।
বলে চারটে তিতির পাখি আমার সামনে নামিয়ে রেখে মন্থরোর মা হাত পাতল । পাখিগুলির একটার সঙ্গে আরেকটার পা সুতলি দিয়ে বাঁধা, সেই অবস্থায় তারা ডানা ফরফর করে মাঝে মাঝে ওড়ার চেষ্টা করছে, হাঁপিয়ে গিয়ে দম নেবার চেষ্টায় তাদের ছোট্ট পেট ফুলে ফুলে উঠছে ।
আমি বেশ মুশকিলে পড়লাম । একে তো, মন্থরোর মা জানে না, বেশ কিছুদিন হল আমি আমিষ ছেড়ে দিয়েছি । তার ওপর যদিবা তিতিরগুলো কিনে নিয়ে পরে উড়িয়েও দিই, তার দাম মাত্র চার আনা?
জোর করে বেশি দাম দিতে গেলে সে কিছুতেই নেবে না । বোঝাতে গেলে বা বেশি জোর করলে সে এই বলে কাঁদতে বসবে— খোকাও আমায় ভিখিরি ভাবলি বাবা! এ আমি আগেও অনেকবার দেখেছি । বছর কয়েক আগে, যে-বছর ইন্দিরা গান্ধি নিহত হলেন, দিল্লি একেবারে অসহ্য লাগাতে সপ্তাহ কয়েকের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছি, মন্থরোর মা দুটো নারকেল নিয়ে এসে এক টাকা চাইল । বাজারে দুটো নারকেলের দাম তখনই সাত-আট টাকার কম নয়, কিন্তু সেকথা বোঝায় কে! শেষ পর্যন্ত তাকে সাহস করে একটা দু টাকার নোট দিলাম । চোখে তো প্রায় দ্যাখেই না, একটাকা আর দু-টাকার নোটে নিশ্চয়ই তফাত করতে পারবে না । মন্থরোর মা নোটটার ওপর ঝুঁকে পড়ে আঙুল দিয়ে প্রথমে তার ধারগুলো ও পরে জমি ও তারপরে দুটোই একসঙ্গে পরীক্ষা করতে করতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল— তুমিও আমায় ভিখিরি ভাবলে বাবা! তোর দরজায় আমি কি ভিখিরি এয়েছি, খোকা!
আমার দিক থেকে সাড়া না পেয়ে মন্থরোর মা অধৈর্য হয়ে বলল, দাও বাবা, চার আনা পয়সার জন্যি আর বোস থাকতি পারি না । অ্যাতটা আস্তা, ঘরে ফিরতি আত হয়ে যাবে ।
আমি একটু নির্দয় হয়ে বললুম, মাছ-মাংস আমি ছেড়ে দিয়েছি দাদিমা ।
আমি যখন এই বাড়িতে হামাগুড়ি দিই তখন থেকেই (পরে শুনেছি, তারও আগে থেকে) মন্থরোর মা আমাদের বাড়িতে ডিম, দুধ, নারকেল এইসব দিয়ে যেত । কথা বলতে শিখে মন্থরোর মাকে আমি দাদিমা বলে ডাকতাম । আমার মা কিংবা বাবাই শিখিয়েছিলেন ।
— তুমি কি নিমাই সন্নিসি হবে নাকি? কচি বয়েস, মাংস না খেলি চলে? এখনও বে-শাদিও করলে নি!
একথায় আমার সত্যিই হাসি পেয়ে গেল । চাকরি করে মাথার চুল প্রায় সাদা হয়ে এসেছে, বছর পাঁচেক পরে রিটায়ার করব— কচিই বটে! বে-শাদির বয়েসই বটে!
আসলে মন্থরোর মার সঙ্গে আজকাল আমার বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হয় না । থাকি দিল্লিতে, কালে-ভদ্রে ছুটি নিয়ে দু-চার দিন আসি, এবার একটু ঘন ঘন এলাম । তার কারণ, রিটায়ার করে শেষ অব্দি হয়তো এখানে এসেই থিতু হব । ছোটবেলা থেকেই গাছপালা আর লেখাপড়ার শখ, ওই দুটো নিয়ে থাকার ইচ্ছে । সেইভাবে এই বাড়িটা কোনদিকে কতটা অদল-বদল করা যায়, কিছুদিন ধরে নানাভাবে ভাবছি ।
— কই বাবা?
অগত্যা ঘর থেকে একটা সিকি এনে মন্থরোর মার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার কাজকম্ম কেমন চলছে, দাদিমা?
মন্থরোর মা সিকিটা আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে সামনের দিকে বৃথা খানিক চেয়ে থেকে বলল, দিন আর কাটে না বাবা । ওজ সূয্যি উঠতিছে, ওজ সূয্যি ডুবতিছে, কিন্তু মনি হয় ঝ্যানো সূয্যি উঠতিছেও না, ডুবতিছেও না ।
মন্থরোর মার আসল নাম কী কেউ জানে না । আদপেই তার কোনও নাম আছে বা ছিল কিনা, জানার দরকারই হয় না । এ বিষয়ে কেউ কখনও কিছু ভাবেও না । পাড়ার কেউ মন্থরোর মার উঠোনে দাঁড়িয়ে মন্থরোকেই জিজ্ঞেস করে, মন্থরোর মা মাঠ থেকে ফিরেছে রে, মন্থরো?
দাঁত খোঁটা মন্থরোর আযৌবন অভ্যেস, দাঁত খুঁটতে খুঁটতে সেও জবাব দেবে, মন্থরোর মা কি তোমার ঝ্যামন-ত্যামন বংশের মেয়েছেলে নাকি গো, বেলা তিনটেতেও মাঠে-ঘাটে ঘুরে মরবে? কী, বিছের ওষুধ নিতে এয়েছো, না কাছিমের ডিম?
বা হয়তো বলে (বিশেষ করে সন্ধেবেলা কেউ এসে ডাকলে), মন্থরোর মা কি তোমার জন্যি ডুমুরের মধু নিয়ে বসে ওয়েছে যে অ্যাগবারে হত্যে দিয়ে পড়লে?
শুধু মন্থরোই না, মন্থরোর মাও তার আব্বাকে লতায়-পাতায় মুর্শিদাবাদের নবাবের বংশধর বলে বিশ্বাস করে ।
মন্থরোর মা’র আব্বা ভাতের সন্ধানে মুর্শিদাবাদের পৈতৃক ভিটে আর পিতৃপুরুষের কবরের মায়া ত্যাগ করে ঘুরতে ঘুরতে বারুইপুরের এই পশ্চিম সীমানায় এসে যখন ডেরা বাঁধে তখন এখানকার এইসব গ্রামে ছিল বলতে শুধু বন-জঙ্গল । জঙ্গলের শেষে জলা । মন্থরোর মা’র আব্বা জঙ্গল কেটে প্রথমে নিজের চাষ-বাস ও পরে ক্রমশ আরও পাঁচজনের চাষ-বাসের ব্যবস্থা করে । তার শাদিও হয় এই নতুন বসতি করা ঘরের মেয়ের সঙ্গে । মাটিও নিল এখানেই । তারপর মন্থরোর মা’র শাদি হল, সেও এই গাঁয়েরই ছেলের সঙ্গে । বছর চোদ্দ-পনেরো পরে সে-মানুষটাও মরে গেল । মন্থরোর মা’র ছোট মেয়ে তখন পেটে । সেই থেকে মন্থরোর মা-ই সংসার চালায় । সেই মেয়ের শাদি হল যেবারে, তখনও বারুইপুরে ইলেক্ট্রিক ট্রেন হয়নি । বছর কয়েক পর তার তালাকের সময় সবে ইলেক্ট্রিক ট্রেনের তার খাটানোর কাজ শুরু হয়েছে । তখনও এখানকার প্রবীণ হিন্দুরা বলাবলি করত, পশ্চিমের শুকনো খালটা আসলে আদিগঙ্গা । ভেলায় সাপে-কাটা লখিন্দরের শব নিয়ে বেউলা এখান দ্যেই গেছিল ।
ডুমুরের মধু মানে অবশ্য চোলাই মদ । মন্থরোর মা নিজে চোলাই করে না, শুধু ছাপ্লাই দেয় ।
তা সেই এক-দেড় কুড়ি বয়েস থেকে আজ এই চার কুড়ি পেরনো বয়স অব্দি মন্থরোর মাকে করতে হয়নি এমন কাজ পৃথিবীতে বোধহয় বেশি নেই । তাছাড়া উপায় কী, বাপ-মরা অতগুলো ছানাপোনা নিয়ে বিধবা হওয়া— উদয়-অস্তে তা ধরো গে তোমার এক কুড়ি পেট । মজার কথা, মন্থরোও বুড়ো হত চলল, তবু আজও সে মাকে খাওয়ানো দূরের কথা, মা না হলে তাকেই আধপেটা খেয়ে থাকতে হত ।
মন্থরোর নিজের চার ছেলে সেয়ানা হয়ে কে কোথায় ছিটকে-ছড়িয়ে গেছে মন্থরো জানে না । ছোট ছেলেটাও মাঝে মাঝে চলে যায় । রাজমিস্ত্রির সঙ্গে যোগাড় দেয়, জনমজুর খাটে, মাটি কাটে । তখন চুলে খুব তেল দিয়ে টেরি বাগায় । তারপর চুলে ধুলো পড়লে বাড়ি ফিরে আসে । তখন রোজ রোজ শাক ভাতে কি গুগলির ঝোলে বিরক্ত হয়ে কোনওদিন একমুঠো কাছিমের ডিম, কোনওদিন কয়েকটা পাখিটাখি খুঁজে আনে ।
মন্থরোর ছেলেরাই শুধু নয়, মন্থরোর মার মেয়েদের ছেলেমেয়েরাও কে কোথায় আছে, কে কে বেঁচে আছে, কাদের শাদি হয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে— এসব হিসাবও মন্থরোর মা’র ভারি গোলমাল হয়ে যায় । একটা সময় ছিল যখন আশপাশের দু-চার গাঁয়ের সিকিভাগ ছেলেমেয়েই মন্থরোর মা’র নাতিপুতি । তারাও বেশিরভাগ অন্তত বছরে কোনও না কোনও সময় মন্থরোর মা’র বাড়িতে এসে থেকে যেত । মন্থরোর ছেলেরাও তখন বাড়িতেই থাকত । মন্থরোর মা তখন লোকের বাড়ি-বাড়ি দুধ বেচত, ডিম বেচত, ছালা ভরা নারকেল বয়ে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসত । তখনও যেটুকু জায়গা-জমি ছিল তাতে শশা ফলাত, বরবটি চিচিঙ্গিা ফলাত । পালং মটর বুনত । কাজের তার শেষ ছিল না । তার কারণ মন্থরোর মা’র সারা জীবনে একটাই কাজ— যেভাবে হোক সংসারের দুটো ভাত যোগাড় করা ।
কার্তিক মাস শেষ হতে চলল, সন্ধের মুখে এখনই ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে । মন্থরোর মা এই বয়েসে, এই কুয়াশায়, ঝাপসা অন্ধকারে লাঠি ঠুকে ঠুকে চলে যাচ্ছে, কোমর থেকে শরীরটা ভেঙে রাস্তার হাত দুয়েক ওপরে প্রায় রাস্তার সমান্তরালে তার হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে হঠাৎই মনের মধ্যে কী রকম একটা অস্পষ্ট বিষণ্ণতা টের পেলাম । মন্থরোটা একেবারে অপদার্থ । প্রথম থেকেই হাবা-গোবা তো ছিলই, তার ওপর বয়স হবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে যেন ক্রমশ আরও অপদার্থ হয়ে পড়েছে । মন্থরোর মা’র ছোট ছেলে দুটি বেঁচে থাকলে এই বয়সে তাকে হয়তো এত কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত না । মারা যাবার সময় ওদের কত আর বয়স । জন্মেছিল এক বছরের ব্যবধানে, মরল একই বছরে । তার মধ্যেই দুজনে নিজেদের সাধ্যমতো পয়সা এনে মাকে দিয়েছে । ফোজোর ছিল বন-জঙ্গল ঘুরে হরেক পাখি ধরে কলকাতায় নিয়ে বিক্রির ব্যবসা । পাখির বাসা থেকেও ছানা বের করে আনত । ঘরে রেখে তারপর খাইয়ে-দাইয়ে একটু বড় করে বিক্রি করে দিত । দু-তিন বছরেই এই কাজে সে দিব্যি হাত পাকিয়ে ফেলেছিল । একবার চৈত্রমাসে আমলকী গাছের কোটরে হাত গলিয়ে সাপের ছোবল খেয়ে গাছ থেকেই মাটিতে পড়ে যায় । মন্থরোর মা-ই প্রথম খবর পেয়ে দৌড়ে এসে ছেলেকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যায় । উঠোনে মরা ছেলেকে বুকে নিয়ে সে নাকি সারাদিন শুধু কেঁদেছে । সে তো তখন জানত না মাস কয়েক পরে তাকে আবার এভাবেই কাঁদতে হবে!
এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাকে দেখতে হয়নি, মার চিঠিতে জেনেছিলাম । তখন আমি দিল্লিতে ছিলাম । এরই মাস কয়েক পরে, মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধি সেবার প্রধানমন্ত্রী হলেন, আমি বোনের বিয়ের জন্য সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসে মন্থরোর মার বাড়ি গিয়ে দেখি সে উঠোনে বসে একমনে বেতের ঝুড়ি বুনছে ।
ক’মাস আগে ফোজো মারা গেছে, কী বলা যায় ভেবে না পেয়ে খানিকক্ষণ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আমি বললাম, দাদিমা কি আজকাল বেতের কাজও করছ নাকি?
একটু দূরে, কোনাকুনি দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এতক্ষণ দেখতে পায়নি । গলার স্বর শুনে মন্থরোর মা মুখ তুলে আমাকে দেখে বলল, কবে এলে বাবা? ক’দিন আর তোমাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি । ফোজো নেই, পাখির ছানা ধরতে গে’— বলতে বলতে মন্থরোর মা মাথা নামিয়ে আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকা দিল ।
তারপর চোখ মুছে মাত্র মিনিটখানেক পরেই মুখ তুলে আবার হাতের কাজ করতে করতে বলল, দাউদ ফিরবে সাঁঝের বেলা ব্যাঙ নে’ । থলেয় ভরে নে’ আসে । তা ফড়েদের আসবার তো কোনও টাইম নেই । আতেও আসটি পারে, কাল ভোরেও আসটি পারে । থলের মধ্যি গাদাগাদি ব্যাঙ কি অতক্ষণ বাঁচে? ঝুড়ি চাপা দে রাখলি নিশ্চিন্দি । মরা ব্যাঙ ফড়েরা আঙুল দে তুলে হুই বাদায় ফেলে দেবে ।
কথা বলতে বলতে ওরই মধ্যে শক্ত দেখে একটা ঝুড়ি আমার সামনে উপুড় করে দিয়ে বলল, দ্যেঁইড়ে কেন বাবা, বোসো । এর উপরিই বোসো । হ্যাঁ বাবা, বিদেশ-বিভুঁয়ে চাকরি করো, সেখানকার সাহেবরা নাকি ব্যাঙের ঠ্যাং খেতে ভালোবাসে? ফড়েদের মহাজন নাকি বরফ চাপা দে সে-দেশে ওজ এলগাড়িতে ব্যাঙের ঠ্যাং পাঠাচ্ছে?
আমি হুঁ-হাঁ করে উত্তর দিয়ে বললাম, তোমার বড় ছেলে কাজকম্ম কিছু ধরেছে?
— ওই দ্যাখো না, কদমতলায় গামছা পেতে শুয়ে শুয়ে দাঁত খুঁটতিছে ।
সেবার আমি কর্মস্থলে ফিরে যাবার আগেই দাউদ মারা গেল ব্যাঙ ধরতে গিয়ে, সেও সাপের বিষে ।
কলকাতার নাতি মানে ফোজোর ছেলে । ফোজোর অপঘাত মৃত্যুর সময় একেবারে শিশু ছিল । ছেলেটা কিছুদিন আমাদের বাড়িতে মায়ের ফাইফরমাশ খেটেছিল । বাগানের কাজকর্ম করত । আমি দুয়েকবার ছুটিতে এসে ওকে একটু লেখাপড়াও শিখিয়েছিলাম । তারপর সেও একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল । এখন নাকি কলকাতায় কোন অফিসের গাড়ি চালায় । শুনেছি বিয়ে-টিয়ে করে সুখেই আছে ।
মন্থরোর মা তার জন্যেই আজ তিতির রাঁধবে ভেবেছিল । ছেলেটা নাকি তিতিরের মাংস খুব ভালোবাসে । নাতি না আসায় পাখিকটা আমাকে গছিয়ে গেল ।
মন্থরোর মা’র জীবন ছেলেবেলা থেকে আমি যতটুকু দেখেছি, মা-বাবার কাছে যতটুকু শুনেছি, তা হল দরিদ্র থেকে আরও দারিদ্র্যের মুখে ধাবমান একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা । এর মধ্যে যা কিনা চরম বিস্ময়ের, প্রায় অবিশ্বাস্য, তা হল তার অদ্ভুত সততা আর আত্মমর্যাদা বোধ । সে তার সংসারের দুমুঠো ভাতের জন্য কী না করে, তারপরও হয়তো উপোস করে, কিন্তু কখনও মুখ ফুটে দুটো পয়সা চাইবে না । কাউকে ঠকানো তার স্বভাবেই নেই, বরং নিজেই ঠকবার জন্য স্বভাবটিকে বাগিয়ে রেখেছে । আমার মা মারা যাবার পর মন্থরোর মা দুধ ডিম নারকেলের দাম নেওয়া ছেড়ে দিল । মনে আছে, বাবা বহু চেষ্টাতেও ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুটা রেগে গিয়েছিলেন ।
— শোনো মন্থরোর মা, তুমি যখন দাম নেবে না, কাল থেকে আর আমাদের দুধ-ডিমও তুমি দেবে না ।
— তা বললি হয়! তোমরা না নিলি, গরিব নোক, না খেতি পে মারা যাব বাবা!
— সে তো তুমি টাকা না নিলেও না খেতে পেয়ে মরে যাবে ।
— টাকা নিই কী করে বাবা! মা-নখ্যি গত মাসে দু’কুড়ি টাকা দেছেলো, বললি, দুখানা কম্বল কিনে নাও মন্থরোর মা, যা শীত! — তিনি আর নেই, দুধ ডিম নারকেল দে সে টাকা শোধ করতি হবে না?
মা-নখ্যি মানে আমার মা । এই ছিল মন্থরোর মা ।
আমার চোখের সামনে সন্ধ্যা গাঢ় হতে হতে ক্রমশ রাত নামছে । বারান্দায় পায়চারি করতে করতে দেখতে পাচ্ছি লেবু গাছগুলোর মাথায় ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি । মহীবাবুদের বাড়ির পোষা তক্ষকের ডাকও কানে এল । তিতিরগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো, বিশেষ সাড়াশব্দ নেই । ঘর থেকে গোঁপ-ছাঁটা কাঁচি এনে পাখিগুলোর পায়ের সুতলি কাটার চেষ্টা করতেই একসঙ্গে চারটি পাখিই প্রবল ডানা ঝাপটাতে লাগল । বাঁধন কাটাও দেখছি বেশ কঠিন ব্যাপার । যার বাঁধন সে যদি নিজের ভালো না বোঝে তাহলে ভারি মুশকিল ।
রিটায়ার করে আমার এই জন্মগাঁয়ে এসে যখন পাকাপাকিভাবে থাকব, তখন পুরো দক্ষিণ জুড়ে একটা পক্ষীরালয় করলে কেমন হয়? এখনই যা গাছ আছে তার সঙ্গে আরও কিছু গাছ লাগালে বাড়িতে বসেই চমৎকার একটা অরণ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে । পাখির ডাকে রোজ ঘুম ভাঙবে, চেনা শিস শুনে দিন শুরু হবে, ভাবলে এই বয়েসেও আমার আনন্দ হয় । সত্যিকারের পাখির ডাকের চেয়ে ভালো ওয়েক-আপ কল আর আছে নাকি?
শনিবার ঘুম ভেঙেই মনে পড়ল, আজ রাজধানী এক্সপ্রেস ধরতে হবে । সোমবার থেকে আবার অফিস ।
সকালে দিঘিতে স্নান করতে গেলাম । আসলে দিঘিটা দেখতেও ইচ্ছে হল । দিঘিতে যাবার পথে কিছুটা ঘুরে মন্থরোর মার বাড়ি গেলাম । মন্থরোর মা বাড়ি নেই । উঠোনেও নেই, ঘরেও নেই ।
ফিরে আসতে আসতে ঝোপঝাড়ের এদিকে-ওদিকে তাকালাম, যদি কোথাও উবু হয়ে বসে শাকপাতা কাটে কী আর কিছু করে । চোখে পড়ল না ।
আরও খানিক এগোতেই দেখা হল মন্থরোর সঙ্গে । কোত্থেকে ফিরছে । মাথায় কাপড়ের টুপি, হাতে একটা গাছের ডাল— লাঠির মতো ধরে আছে ।
আমাকে দেখেই বলল, ফিরি যাচ্ছ খোকা?
— মন্থরোর মাকে দেখলাম না —
— তার কি কাজের কামাই আছে? তার বসি থাকলি চলে?
আমি একটু বিরক্তি চাপবার চেষ্টা করে বললাম, তা বুড়ো মাকে এবার ছুটি দিয়ে নিজে কিছু করলেও তো পারো?
— আমি ফকির হয়িছি । বলে মন্থরো দাঁত বের করে একগাল হেসে হাত বাড়াল — একটা সিগ্রেট দাও দিকি খোকা ।
— চান করতে যাচ্ছি, সিগারেট কোথায় পাব? একটু বিরক্ত হয়েই বললাম ।
— তা’লি দশ নয়া দে যাও ।
মন্থরোর বয়েস এখন কত হবে? ঠিক ঠিক হিসেব করা আমার পক্ষে মুশকিল । আমার থেকে বোধহয় দশ-পনেরো বছরের বড়ই হবে । ছিল নিষ্কর্মা, হল ফকির!
দিঘিটা বছর-বছর ছোট হয়ে আসছে । জলও আগের মতো তেমন টলটলে নেই । তার ওপর কার্তিক-শেষের ঠান্ডা । তাছাড়া আমার সময়ও সংক্ষেপ । ১টা ২৩-এর বারুইপুর লোকালে না গেলে হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরা কঠিন ।
স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম বারুইপুর লোকাল প্ল্যাটফর্ম বদলে শিয়ালদামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ফাঁকা ট্রেন । জানলার ধারে বসে আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছি, কানে এল — দুটো পয়সা দে যাও বাবা । আল্লা তোমার ভালো করবে, গরিবকে দুটো পয়সা দে যাও বাবা —
জানলা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে তাকিয়ে দেখি, মন্থরোর মা কোমর থেকে প্ল্যাটফর্মের সমান্তরালে ঝুঁকে লাঠিতে ভর দিয়ে কোনওক্রমে তার সাদা মাথা তুলে আশপাশের লোকেদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে ।
এক দম্পতি বোধহয় তাদের ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, ভদ্রলোকটি ভুরু কুঁচকে মন্থরোর মার বাড়ানো হাতে ছোট কোনও একটি মুদ্রা ফেলে দিল । মন্থরোর মা হাতের লাঠিটা গলা আর কাঁধের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে খুব যত্ন করে পয়সাটা আঁচলে বাঁধল । তারপর লাঠি ঠুকে ঠুকে আরেক দলের কাছে গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল — দুটো পয়সা দে যাও বাবা —
ঢং ঢং করে ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা বাজল ।
আমি পার্স থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে মন্থরোর মাকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলাম । মন্থরোর মা যাদের কাছে ভিক্ষে চাইছিল সেখানে কিছু না পেয়ে পাশের লোকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি ডাকলাম — দাদিমা! এই নাও— এদিকে, এই যে, ট্রেনের জানলায় —
মন্থরোর মা মাথা এদিকে ওদিক ঘুরিয়েই আমাকে দেখতে পেল । অথবা আমার গলা শুনে আন্দাজে তাকাল ।
— এস তাড়াতাড়ি । ট্রেন ছেড়ে দেবে ।
মন্থরোর মা লাঠি ঠুকে এগিয়ে এল— খোকা! কবে এলি বাবা?
পাঁচ-ছদিন আগেই দেখা হয়েছে । এর মধ্যেই ভুলে গেল?
এলাম কী গো, যাচ্ছি । দিল্লি যাচ্ছি । তুমি তিতির দিয়ে এলে মনে নেই?
— তিতির ভালো নেগেছে তো খোকা? বর্ষায় এয়ো, কাছিমের ডিম দেব । ভাদ্দর অব্দি থাকলি তালের আঁটির ফোঁপরা দেব ।
শেষবার ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল । ঘণ্টাধ্বনির মধ্যেই আমি একটু চেঁচিয়ে বললাম, গোটাকতক গন্ধলেবুর গাছ রেখো আমার জন্য, এবার এসে লাগাব ।
বলে আমি নোট-সুদ্ধু হাতটা জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিলাম ।
মন্থরোর মা নোটটা দেখে নিমেষের জন্য থমকে গেল, আমি জানলার বাইরে আরও ঝুঁকে টাকাটা তার হাতে গুঁজে দিলাম— ধরো, ধরো ।
মন্থরোর মা টাকাটা নিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে (ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে, আমি পিছনদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম) অদ্ভুত এক হাসিতে সারা মুখ ঢেকে ফেলেছে ।
হাসির মধ্যে একসঙ্গে মানুষের মুখে কতরকম ভাব ফোটে, কত পরস্পর-বিরোধী ভাবও নিমেষে আনাগোনা করে, মন্থরোর মার হাসিটি না দেখলে আমার জানা হত না ।
প্রথম প্রকাশ : শারদীয় আজকাল, ১৩৯৬
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন