অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বুদাই ঘোড়া নিয়ে বেরোতে যাচ্ছে, তার মা মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ঠিক চিলের গলায় চেঁচিয়ে উঠল, মর, মর— ঘোড়ার নাতি খেয়ে মর!
শরীরের মধ্যে আছে বলতে এখন ওই এক গলা । বুদাই অন্য সময় হলে জ্বলে উঠত, তার জীবনটাই এমন যে দিনের মধ্যে ছত্রিশবার তার মাথায় আগুন ধরে যায় । কিন্তু এখন সে ঠাকুরের নাম নিয়ে একটা শুভকাজে বেরোচ্ছে, তার ওপর সকাল থেকে তার খুব ডানহাতের তেলো চুলকোচ্ছে, এক ধরনের ফুরফুরে আশার মধ্যে থেকে সে মায়ের গালি-গালাজ গায়ে মাখল না ।
মাঠের মুখে দাঁড়িয়ে বুদাই বিড়ি ধরায় । ঘোড়াদহে যেতে মাঠের পথই সোজা পথ । দরকারে-অদরকারে বুদাই নিজে সে-পথেই যাওয়া-আসা করে । কিন্তু আজ সে ওই এবড়ো-খেবড়ো পথে ঘোড়াকে হাঁটাবে না ।
মাঠ বাঁয়ে রেখে নতুন সরকারি রাস্তার দিকে যাচ্ছে, একটু এগিয়েই রেললাইনের পাশে থামতে হল । ট্রেন আসছে । সামনেই স্টেশন । সিগন্যাল পড়েনি । গতি কমিয়ে ঘন-ঘন হুইসেল দিতে দিতে এগিয়ে আসছে । থামবে মনে হয় ।
গতি আরেকটু কমতেই চোরা চালের মেয়েরা চালের পুঁটলি বুকে নিয়ে ঝুপ-ঝুপ লাফিয়ে পড়তে লাগল । কেউ কেউ আগে পুঁটলি ছুড়ে দিয়ে হ্যান্ডেল ধরে সরসর করে নেমে এল । কামরার মাথারও অনেকে বেশ কায়দা করে এখানে-ওখানে পা দিয়ে নেমে পড়ল । এরা এই গাঁয়েরই পুরুষ । গাঁয়ে কাজ নেই, ভোর হতেই রোজ দূরের টাউনে যায় জন খাটতে । যায় দল বেঁধে গাড়ির ছাদে চড়ে । কামরায় বসে গেলে চেকারবাবুরা আজকাল ছাড়তে চায় না । সে-যুগ আর নেই যে দু-চার পয়সা ঠেকালেই নিশ্চিন্ত । অল্পে এখন আর কারুরই খাঁই মেটে না । টিকিটের দাম যত বাড়ছে চেকারবাবুদের রেটও তত বাড়ছে ।
ঘোড়াটা এই ফাঁকে ঘাস খেতে শুরু করেছে । দাউদ এখানে নামেনি, তার বাড়ি স্টেশনের ওপারে । ট্রেনের ছাদে বসেই সে বিড়ি ধরিয়েছিল । বুদাইকে দেখে যতটা পারে গলা তুলে বলল, আজ কতটা ছোলা খাইয়েছিস?
বুদাই কাল সন্ধেবেলা আধ সের ছোলা ভিজিয়েছিল, ভোরে উঠে দেখে, হাঁড়ি ফাঁকা । কাছেই ঘরের ভেজা মাটিতে মায়ের দু-পায়ের ছাপ । উবু হয়ে বসেছিল অন্ধকারে, খেতে খেতে হাঁড়ি কাত হয়ে নিশ্চয়ই জল পড়েছে ।
বুদাইয়ের ডান হাতের তোলো ভীষণ সরসর করছে । ছোলার ব্যাপারে রাগ ভুলে সে নিজের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে জোড়ে জোড়ে হাতের তেলো ঘষতে-ঘষতে ওই অবস্থায় যতটা পারল চেঁচাল, বাপকা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া, মুখকা কথা! পুরো একশো নিয়ে আজ ঘরে ফিরব । নইলে বাপের ব্যাটা না!
ট্রেন দাঁড়িয়ে পর-পর টানা হুইসিল দিচ্ছিল, দাউদ ছাদের ওপরেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গোছল করেই ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছি । দেখব আজ কে টাকা নেয়!
সরকারি রাস্তায় একটা বিড়ালছানা চ্যাপ্টা হয়ে আছে । নিশ্চয়ই লরি চাপা পড়েছে । রক্তমাখা এক টুকরো ন্যাকড়ার মতো রাস্তার সঙ্গে একদম সেঁটে আছে । বুদাইয়ের মুখ থুতুতে ভরে গেছে, থুতু ফেলে সে সাবধানে একটু দূর দিয়ে নতুন রাস্তায় উঠল ।
বেশ খানিকটা এগিয়ে অঞ্জনা । সরু খাল, কিন্তু নাকি পনেরো-কুড়ি মাইল লম্বা । অনেক কালের পুরনো খাল । এখানকার লোকে বলে নদী । নাইলে রোগ-ব্যাধি সেরে যায় । মনস্কামনা পূর্ণ হয় ।
ব্রিজ পার হয়ে বুদাই ঘোড়া নিয়ে খালপাড়ে নামল । কোথাও শাঁখ বাজছে । উলু দিচ্ছে । বুদাই নিচু হয়ে খালের জল হাতে নিয়ে প্রথমে ঘোড়ার, তারপর নিজের মাথায় ভালো করে ছিটিয়ে দিল । উঠে আসতে আসতে দেখে, খালপাড়ে একটু দূরে কাদের বিয়ে হচ্ছে । খাল ঘেঁসে পর-পর কতগুলো হোগলার খুপরি । উদ্বাস্তুদের তৈরি । এরা আগে অন্য কোথাও ছিল, এখানে নতুন এসেছে । মেয়েরা খালে মাটির কলসি ভরে-ভরে জল নিচ্ছে, উলু দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে কনেকে চান করাচ্ছে ।
এখনও ঝকঝকে বিকেল । বুদাইয়ের হাতে খানিকটা সময় আছে । তার খুব ইচ্ছে হল সে ওই বিয়ের লোকজনদের আজকের ঘোড়দৌড়ে যেতে বলে । ঘোড়াদহের কাছাকাছি পৌঁছে বুদাই খরখরে দাড়িতে হাত ঘষতে-ঘষতে ভাবল, আজ একশো টাকা জিতলে কালই সে বিয়ে করবে ।
ঘোড়াদহের মাঠে অনেক আগে থেকেই লোক আসতে শুরু করেছে । যাত্রাটাত্রা দেখার মতো আশপাশের গাঁয়ের লোক দুপুর থেকেই এসে মাঠের চারপাশে বসে পড়েছে । অনেকে এখানে-ওখানে জটলা করছে ।
ঘোড়া মোট সাতটা । তার নিজেরটা ধরে । বুদাই প্রায় এক নজরে দেখে ফেলল । শম্ভু গড়াই, অনিল ভূইদাস, ঘোটে চিংড়ি, সুরফ-ফোজো দুভাই, পঞ্চা বারুই, বুড়ো কাদের আলি— এর মধ্যে কোঁদালিয়ার ঘোটে চিংড়িই যা নতুন । এই প্রথম ঘোড়া এনেছে । হাড়ভাঙির নদেরচাঁদ মিঞা এবার আসেনি । তার গুটি বেরিয়েছে । ওদিকটায় এবার বসন্তের শুরুতেই মায়ের দয়ার হাওয়া বইছে । সমর পদ্মরাজের ঘোড়াকে এ-মাঠের অনেকেই ভয় করে । ঘোড়া কিছু আহামরি পক্ষীরাজ নয়, আর সকলের মতোই হাড়-জিরজিরে, ঠেলা টেনে, ধানের বস্তা বয়ে বয়ে ঘাড়ে ঘা । কিন্তু সমরের ছোটাবার কায়দাই আলাদা । যাক, গত মাসে আসেনি, এ-মাসেও এখনও অব্দি দেখা নেই । ছেলেটার যক্ষা নিশ্চয়ই বাড়-বাড়ন্ত । না হলে পর-পর দুবার দৌড় ফেলে ঘরে বসে থাকবার বান্দাই সে নয় ।
বুদাই সামনে পিছনে পালা করে রানের জায়গাগুলো মালিশ করতে করতে মাঝে মাঝে ঘোড়ার গায়েই ডানহাতের তেলো ঘষে । বড্ড হাড় । এবার জিতলে সে ঘোড়াকে রোজ তোয়াজ করবে । নতুন খড়ে ঘর ছাইবে । বিয়ে করবে ।
আরে যা! হাতে যেন শোঁয়া লেগেছে । হাত চুলকোলে শুভ, কে না জানে! মাঠের চারদিকে ভিড়ের মধ্যে সে নোনাগাঁয়ের মালতীকে খোঁজে । ফি মাসে আসে, আসবেই । বলে ঘোড়া ছুটলে ঘরে থাকতে পারি না । বুক উথাল-পাতাল করে । বলে, স্বপ্নেও আমি ঘোড়া দেখি । পিছনের পায়ে ভর দিয়ে হুই আকাশ ফুঁড়ে চিঁহিঁহিঁ ডাক ছাড়ে । উ রে! কী সোন্দর! মালতী রহস্যময় হাসে ।
বুদাই শরৎকালে মালতীর কাছ ঘেঁসতে চেষ্টা করে বলেছিল, আমার ঘোড়াটাকে কখুনো স্বপ্নে দেখোনি?
— তোমার ও হেরো ঘোড়া ।
— তবে কার ঘোড়া?
মালতীর দাঁতে আঁচল । দূরে কাদের আলির সাদা দাড়ির দিকে আঙুল তুলে ঠোঁটটাকে সে অদ্ভুতভাবে নড়িয়েছিল, হুই বুড়োর!
কাকির সঙ্গে বসে আছে । খুব জমকালো শাড়ি । দূর থেকেও টকটকে ডুরে বুদাইয়ের চোখে পড়ল । মেয়েটা ফটফট চোখ ঘুরিয়ে এর-এর ঘোড়া দেখছে । কোলের কাছে গুচ্ছ-গুচ্ছ কলাই গাছ । আসার পথে কারও খেত থেকে উপড়ে এনেছে । চোখ ঘোড়ার গায়ে, হাত কোলের কাছে কলাই ছাড়াচ্ছে । না দেখেই ছুড়ে ছুড়ে মুখে ফেলছে ।
নিমাই গায়েন জোরে জোরে সকলের নাম হাঁকছে, বুদাই শেষবারের মতো সামনের রান ডলে দিচ্ছে, হঠাৎ কাঁধে চাপড় খেয়ে পিছন ফেরে দাউদ! তার মানে আটটা ঘোড়া । ঠিক আছে, দেখা যাবে, কে জেতে! এবার সে মালতীকে বিয়ে করবেই । সমরও প্রথমবার দৌড়ে জিতে বিয়ে করেছিল ।
ফাল্গুন এখনও শেষ হয়নি, এর মধ্যেই চিড়চিড়ে গরম । বেশিরভাগ শিমুল ঝরে গেছে । হাওয়া নেই । বিকেলের রোদে মাঠ ঝমঝম করছে ।
নিমাই অকারণেই বারবার নাম ডাকছে । দাগ বরাবর আটটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে । আটজনই এখন ঘোড়ার পিঠে । ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় উসখুস করছে ।
নিমাই আরেকবার নাম ডাকা শুরু করতেই সুরফের ভাই ফোজো বলে উঠল, ধ্যাত্তেরি, ঘণ্টা মারতে পারো না! হাতে বাত হল নাকি!
দাউদ খিঁচিয়ে উঠল, মস্করা পেয়েছ! বিড়ি শেষ করতে দিল না, শালার নামের নিকুচি করি!
নিমাই গায়েনের হাতে কাঁসর ঘণ্টা । গম্ভীরভাবে ফোজো আর দাউদের দিকে একবারমাত্র তাকিয়ে সে তেমনই দাগ বরাবর প্রত্যেক ঘোড়ার খুরে চোখ রেখে রেখে নাম হাঁকতে লাগল । কারও ঘোড়া দাগের এপারে পা রেখেছে কিনা সেদিকে তার কড়া নজর । সওয়ার পিঠে নিয়ে সবার ঘোড়াই টলমল করছে । পিঠ বেঁকে গেছে । একে তো খাওয়া জোটে না, তার ওপর সওয়ার বওয়ার অভ্যেস নেই । মাসে এই একবারই, শুধু পূর্ণিমার দিন ঘোড়দৌড়ে সওয়ার নিতে হয় । আরও কষ্ট, পেটে গুঁতো খেয়ে ছুটতে হয় ।
নিমাই ডাক থামিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, অ্যাই বুদাই! দাগ ছাড়! ঘোড়া পিছনে নিয়ে যা—
বুদাইয়ের ঘোড়া খুব বেশিরকম এলোমেলো পা ঠুকছিল । পিছনের একটা পা বার-বার বেকায়দায় ছুড়ছে । বুদাই প্রাণপণে ঘোড়াকে দাগের ভেতরে রাখবার চেষ্টা করছিল । যত দেরি হচ্ছে ততই তার মাথায় রাগ চড়ছে । নিমাইয়ের হাঁক শুনে ফেটে পড়ল, মারব এক ঘোড়ার চাট । ঘণ্টা বাজাও!
নিমাই ভয় পেয়ে প্রায় নিজের অজান্তে ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দিল ।
শুরু হল ঘোড়দৌড় । বেশিরভাগই এপাশ-ওপাশ এলোমেলো দৌড়চ্ছে । বুড়ো কাদের আলির ঘোড়া একটু এগিয়েই সোজা বাঁদিকে গোরস্থানের জঙ্গলে ঢুকে গেল । পঞ্চা বারুই একবার দাউদের ঘোড়ার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে । তারপর থেকেই তার ঘোড়া আস্তে আস্তে, প্রায় হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে । মাঝমাঠে ঘোটে চিংড়িকে পিঠ থেকে ছিটকে ফেলে দিয়ে তার ঘোড়া ক্ষেপে গিয়ে মনে হয় নিমাইয়ের দিকেই ছুটে যাচ্ছে, তার নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে উঠছে ।
বুদাইয়ের মাথায় আগুন ধরে গেছে । হাজার গুঁতোতেও তার ঘোড়া দৌড়ই শুরু করছে না । দাগের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে শুধু পিছনের একটা পা অদ্ভুতভাবে ছুড়ছে আর পেটে গুঁতো খেয়ে চিঁহিঁহিঁ করে ডেকে উঠছে ।
অনিলের ঘোড়া অনেক দূরে । প্রায় দিগন্তের কাছে । ওই ছুটে যাচ্ছে । মাঠের পুবদিকে চাষের জমিতে নাটবল্টুর কারখানা উঠছে, সেটাও ছাড়িয়ে গেল । তার পিছনেই দাউদের ঘোড়া । বুদাই তখনও পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে । ঘোড়াকে খিস্তি করে করে তার মুখে ফেনা উঠে গেছে । শম্ভুর ঘোড়াও টলমল করে মাঝমাঠ ছাড়িয়ে গেল দেখে বুদাই গলা চিরে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ছোট শালা, ছুটতেই হবে!
বলে দু-পাশ থেকে দু-পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেটে একসঙ্গে লাথি কষাল ।
ঘোড়া লাফিয়ে উঠে জোরে চিঁহিঁহিঁ করে উঠতেই বুদাই ঘোড়ার পিঠে কোনওরকমে টাল সামলে নিয়ে বলল, আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন!
বলেই আবার পেটের দু-পাশে লাথি । লাথির পর লাথি । ঘোড়া যতই লাফায় ততই আরও লাথি । একবার ছিটকে পড়ে যেতে যেতে বুদাই ঘোড়ার ঘাড়, কেশর ধরে ঝুলে পড়ে ঘোড়ার বুকে জোড়পায়ে প্রচণ্ড এক লাথি মারল ।
অনিল দিগন্তে কালো একটা ফুটকি । তার পিছনে দাউদও ছোট্ট হয়ে আসছে । মাটিতে পড়ে গিয়ে বুদাই এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল । পিছনে একটু দূরে ছেলেদের বাঁশের গোলপোস্ট । বুদাই হ্যাঁচকা টান দিতেই বাঁশ ভেঙে তার হাতে চলে এল ।
বুদাই ঘোড়ার কাছে এসে দাঁড়ায় । তার দু-হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা বাঁশ । ঘোড়াটা মরিয়া হয়ে পিছনের একটা পা দুমড়ে-মুচড়ে এপাশ-ওপাশ টলমল করছে ।
আকাশের একদিকে সূর্য ডুবছে । আরেকদিকে পূর্ণিমার গোল চাঁদ । একসঙ্গে দুটো । সূর্যটাকেও ঠিক চাঁদের মতোই দেখাচ্ছে ।
কপালে মুহুর্মুহু বাড়ি খেয়ে বুদাইয়ের ঘোড়া মাঠের ওপর শুয়ে পড়েছে । চোখ উল্টোনো । থেকে থেকে হিক্কা তুলছে । হঠাৎ পিছনের বাঁপায়ের খুরে চোখ পড়তেই বুদাই বসে পড়ে । খুরের খাঁজে জোঁক! দু-আঙুল লম্বা । খুরের খাঁজ থেকে অনেকটা ওপর অব্দি পায়ের চামড়ার সঙ্গে সেঁটে আছে । রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল ।
বুদাই এসময় কী ভেবে একবার চোখ তুলে আকাশের চাঁদ সূর্য দেখল । তারপর হঠাৎ দু-হাতে মুখ ঢেকে সে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, জোঁক না মেরে আমি তোকে মারলাম!
সূর্য একদম ডুবে গেছে । সব ফাঁকা । জ্যোৎস্নায় দুনিয়া খাঁ-খাঁ করছে ।
বুদাই পাড়া থেকে পরমেশকে ডেকে দিয়ে সেই যে একা একা ঘুরতে গেছে, ফেরার আর নাম নেই । এক মাঠ থেকে আরেক মাঠ, সেখান থেকে একদম অচেনা একটা মাঠে সে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল । কাঁদতে কাঁদতে তার সর্দি ধরে গেছে ।
অনেক রাতে সে যখন তার ঘোড়াটার কাছে ফিরে এল, পরমেশ তখনও ছুরি চালাচ্ছে । পরমেশ কশাই । খুব নিপুণ হাতে ছুরি চালাতে চালাতে সঙ্গের ছেলেটিকে একবার বলল, ফাল্গুন মাসে জোঁক, তাজ্জব!
বুদাই কথা বলল না । ততক্ষণে গোটা আকাশ তারায় ভরে গেছে । এবারের আকাশ আপনা-আপনি বুদাইয়ের চোখে পড়ল । সে তার ঘোড়ার মুণ্ডু থেকে চোখে সরাতে গিয়েছিল ।
পরমেশ কাজ থামিয়ে ভিজে হাতেই একটা আধপোড়া বিড়ি ধরায় । কোমর সোজা করে । বিড়ি শেষ করে থলে থেকে ভারি দেখে অন্য একটা ছুরি বের করে । আঙুলে ধার পরখ করতে করতে সঙ্গের ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে, খাবি-খাওয়া ঘোড়া, দৌড়ের ধকল সইবে কেন!
বুদাই হঠাৎ রেগে ওঠে । তার মাথায় আগুন ধরে গেছে । পাগলা ঘোড়ার মতো প্রবল একটা লাফ মেরে পরমেশের প্রায় গায়ের ওপর পড়ে ঘাস থেকে সে একটা ছুরি তুলে নিল । তারপর হুঙ্কার দিয়ে বলল, আন শালা, কার কত তেজী ঘোড়া আছে, আন! আমি দৌড়বো, কোন শালার ঘোড়া আমার সঙ্গে লড়বি, আয়, চলে আয়!
জ্বলন্ত আকাশের নিচে তার চিৎকার এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে ছুটে যায় । দিগন্তও তার চিৎকারে সাড়া দেয় ।
এত বড় মাঠ, এত বড় আকাশ পেয়ে বুদাইয়ের বাঁধ ভেঙে গেছে । মাঠময় ছুটোছুটি করে সে শুধু চিৎকার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়াদের যুদ্ধে আহ্বান করতে থাকে ।
ভীষণ জ্যোৎস্নায়, ঘোড়াদহের মাঠে, ঠিক একটা ক্ষ্যাপা ঘোড়ার মতো বুদাই চেঁচায়, দৌড়োয় । তার হ্রেস্বায় রাতের মাঠ চিরে যায় ।
প্রথম প্রকাশ : অমৃত, শারদীয় সংখ্যা ১৯৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন