অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
একে তো খেয়ে উঠে একটা সিগারেট নেই, তার ওপর কাল বাসে অপমান হয়ে প্রদীপের মেজাজ খিঁচড়ে আছে । কাল সে নীলুবাবুর সঙ্গে বাসে উঠেছিল, লোকটা তিন-চারটে স্টপ পরেই শুধু নিজের টিকিট করে নেমে গেল । মাসের শেষ দু-একটা দিন, আর পরের মাসের পয়লা, প্রদীপ বরাবরই একটু আগে-আগে বাসস্টপে চলে আসে । ওই সময় তার হাতে একটা পয়সা থাকে না । সে পর-পর বাস ছেড়ে দেয় আর কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দ্যাখে । চেনা কাউকে পেলে তবেই সে বাসে ওঠে । প্রাইভেট বাসের কন্ডাক্টরগুলো তো একেকটা চিল, কিংবা জ্যোতিষী । ওই কটা দিন সিগারেট খাওয়াও পুরোপুরি অদৃষ্টের হাতে । কেউ হয়তো একটা দিল । কখনও সে নিজেই চেয়ে নেয় । বিরক্ত হয়ে দিচ্ছে বুঝেও সে খুব মনোযোগ দিয়ে সিগারেট ধরায় ।
অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে । হিসেবমতো অনেক আগেই তার বেরিয়ে পড়ার কথা । এখনও গেলে হয়তো বাস স্টপে কাউকে পাওয়া যায় । কালকের অপমানে খুব ক্ষেপে আছে, বিরক্তিতে মুখ বেঁকা, সে জুতোর দিকেই গেল না । পাশের ঘরে বাবা ফপ-ফপ করে তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ করছে, প্রদীপ পা টিপে-টিপে বাবার বালিশের পাশ থেকে দুটো বিড়ি তুলে নিল । মাথাটা আজ একটু বেশি কাঁপছে । চোখ বুজে স্তোত্রের তালে-তালে দুলছে, টের পায়নি ।
উনুন থেকে কাগজ জ্বালিয়ে বিড়ি ধরাতে গিয়ে আরেকটু হলেই প্রদীপের গোঁফ পুড়ে যাচ্ছিল । সহদেব কয়লার গামলা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই প্রদীপ গম-গম করে ওঠে, দেশলাই একটা জায়গামতো রাখতে পার না?
সহদেবের আজকাল হাত কাঁপে । চোখেও ভালো দ্যাখে না, ডান চোখে ছানি । একটা ছেলে । হার্টে ছ্যাঁদা । হাসপাতালে পড়ে থাকে । শ্লেষ্মাজড়ানো গলায় বলল, বাবুকে সকালে বিড়ি ধরিয়ে দিয়েছিলুম । ওখানেই রয়ে গেছে ।
অফিসে যাবে না ঠিক করে বিছানায় উঠতে যাচ্ছে, দেখল মেঝেয় একটা দু-টাকার নোট । সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল । এমনিতে তার জীবনে দুর্ভাগ্যে ভরা । কদাচিৎ কখনও সামান্য ভালো কিছু ঘটলে সে খুশি হয় । মাসের ঠিক শেষ দিনটায় একদম ছপ্পর ফুঁড়ে দু-টাকা! নোটটা হাতে নিয়ে এই প্রথম সে দু-টাকার রং ভালো করে দেখল । টেরাকোটা । জানলা দিয়ে উড়ে এল নাকি! একটু দেরি হয়েছে, তা হোক, প্রদীপ তক্ষুনি পায়ে চটি গলিয়ে বাসস্টপে ।
মনে মনে সে দু-টাকার ছোট্ট একটা বাজেট করে ফেলল । যাওয়া-আসা ষাট পয়সা । কাল মাইনে । কাল শুধু যাওয়ার খরচ । তিরিশ পয়সা । হাতে রইল একটাকা দশ । তার মানে আজ এক প্যাকেট সিগারেট… কিংবা টিফিনে ডিম-রুটি, সঙ্গে একটা কলাও হয়ে যাবে ।
টিকিট করার সময় কন্ডাক্টরকে নোটটা দিয়ে বলল, দু-টাকার নোট । দেখে নাও ।
কালকের কন্ডাক্টরকে পেলে ভালো হতো । ঠিক যে, সে মিথ্যে বলেছিল টিকিট হয়ে গেছে, কিন্তু সামান্য তিরিশ পয়সার জন্য— এদিকে যাই রোজ ঝুলে-ঝুলে, কই সেজন্য তো কেউ তার কাছে কোনওদিন ক্ষমা চায়নি!
অফিসে ঢোকবার মুখে সে দশ পয়সা দিয়ে একটা সিগারেট কিনে নিল । অল্প ঘেমেছিল, ড্রয়ারে সিগারেটটা রেখে রুমাল দিয়ে মুখটুখ মুছে বাঁ পাশের টেবিলের সমীরকে বলল, আজ মাইরি একটা একশো টাকার নোট কুড়িয়ে পেলাম । কী করা যায় বলতো?
সমীর কাগজে ছক কেটে একটা অঙ্কের ধাঁধা কষছিল, ঠিক মতো মেলাতে পারলে টিভি সেট পাওয়া যাবে, মুখ না তুলে বলল, একশো টাকায় আজকাল কিছুই করা যায় না ।
সামনের টেবিল থেকে সঞ্জয় বলে উঠল, কুড়িয়ে পেয়েছেন? আমাকে ধার দেবেন? খুব দরকার । কাল রাতে বাবার স্ট্রোক হয়েছে ।
প্রদীপ একটা চিঠি খুলে ফাইল করছিল, সঞ্জয়কে দেখে নিয়ে বলল, যাঃ!
সঞ্জয় টেবিল ছেড়ে উঠে এল, বিশ্বাস করুন । পিজিতে ভর্তি করেছি । আজ শুধু টাকার জন্যই অফিসে এসেছি ।
সঞ্জয়ের বয়েস খুবই কম । মাস-চারেক আগে ঢুকেছে । তার গলার স্বর শুনেই বোঝা যায় সে মিথ্যে বলছে না । প্রদীপকে মুখ নামিয়ে চিঠি পড়তে দেখে সে আবার বলল, টাকাটা পেলে খুব উপকার হয় । কাল মাইনে পেয়ে অর্ধেকটা ফেরত দিতে চেষ্টা করব । না হলে মাসে-মাসে কুড়ি টাকা করে— প্রদীপ লিখতে লিখতে বলল, আমি টাকা ধার দিই না ।
সঞ্জয়ের রোগা ফরসা মুখ কালো হয়ে গেল ।
দাসদা দূর থেকে এই দিকে চেয়েছিলেন, বললেন, এটা কিন্তু এ-জি-এম-এর মতো হল ভায়া! নাও, একটা সিগারেট খাও ।
প্রদীপ বলল, আমার আছে ।
একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে প্রদীপ টের পেল ঘরের অনেকেই তাকে একটু অন্য চোখে দেখছে । ওরকম করে বলাটা ঠিক হয়নি । টাকা নিয়ে ইয়ার্কি করতে যাওয়াই তার ভুল হয়েছে । আসলে দু-টাকার নোটটা পেয়ে তার খুব আরাম লেগেছিল । খুব তৃপ্তি করে পেট ভরে খেলে যেমন হয় । ঢেকুর তোলার মতো একশো টাকার কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে ।
টিফিনের সময় বাইরে যাচ্ছে, ডেসপ্যাচের রত্না ঘোষের সঙ্গে দেখা । কারও হয়ত আসবার কথা, গেটে অপেক্ষা করছে । মুচকি হেসে বলল, খাওয়াচ্ছেন তো? আপনার স্টার খুব ভালো যাচ্ছে । এবার একটা প্রেম-ট্রেম করুন । রাজকন্যে লেগে যেতে পারে ।
প্রদীপ হঠাৎ রেগে গেল, দু-পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে বলল, আমি আপনাকে একটা সিগারেট খাওয়াতে পারি!
রত্নার মুখের ভাব বদলে যায় । একটু হাসবার চেষ্টা করে মুখ ফিরিয়ে নেয় ।
কলা এক জোড়া পঞ্চাশ পয়সা, সেদ্ধডিম একটা পঞ্চাশ । কী খাবে ভাবতে ভাবতে একটু দূরে ফুটপাতের লটারির দোকান চোখে পড়ল । এক টাকা দিয়ে সে একটা হরিয়ানার টিকিট কিনে পকেটে রাখল । মাসের শেষ দিকে কবে আর সে টিফিন করে? তাছাড়া কুড়িয়ে পাওয়া টাকা, হয়ত এটাই তার সৌভাগ্যের সূচনা, দেখা যাক না কী হয় । প্রথম পুরস্কার তিন লাখ টাকা!
বাবার বিড়িটা একেবারে শেষ করে প্রদীপ অফিসে ফেরে । তীর্থঙ্কর আর নুরুল ক্যান্টিনের দরজায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, তীর্থঙ্কর হই-হই করে ওঠে, আজ শালা তোমায় ছাড়ছি না । উঃ, কতদিন মাল খাইনি মাইরি!
প্রদীপ কাছে এসে হাত বাড়ায়, সিগারেট দে—
তীর্থঙ্করের সিগারেট থেকে ধরিয়ে নিয়ে তার মাথার ওপর ধোঁয়া ছাড়ে, তোকে মাল খাওয়াবার লোক অনেক আছে । আমায় নিয়ে আবার টানাটানি কেন বাবা?
— তুই কুড়িটা টাকা বার কর, তোকে টানাটানি করে আর সুখ কী!
প্রদীপ বলতে যাচ্ছিল, একশো টাকার কথাটা বানানো, তার আগেই নুরুল বলল, ওভাবে অন্যের টাকা মেরে দেওয়া আপনার উচিত হয়নি ।
— মেরে দেওয়া? মেরে দিয়েছি মানে?
— যার টাকা তাকে খুঁজে টাকাটা ফেরত দেওয়া উচিত ছিল ।
তীর্থঙ্কর নুরুলের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল, কার টাকা রে? টাকা কি কেউ পেট থেকে পয়দা করে?
প্রদীপ সিগারেট পায়ে মাড়ায়, আপনার মতো কাকা-ফাকা মন্ত্রী থাকলে সবাই ওরকম ভালো-ভালো কথা বলতে পারে ।
প্রবাল একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল । বুকের ওপর দু-হাত ভাঁজ করা । দু-মাস আগে তার বউ আর একমাত্র ছেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে লরির তলায় রিকশাসুদ্ধু পিষে যায়, তারপর থেকে সে একরকম বোবা । প্রদীপ তার পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার দাঁড়াল । প্রবালের চোখ একদম ফাঁকা । এরকম বোবা চোখের দিকে তাকালে বুক শিরশির করে । প্রদীপ একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, রাস্তায় দু-টাকা কুড়িয়ে পেলে আপনি ঠিক কী করতেন?
প্রবাল তার থেকে সাত-আট বছরের বড়, এখন দাড়ি রেখে, লম্বা চুলে, আরও বয়স্ক দেখায়, প্রদীপের কথায় খুব মৃদু এক ধরনের হাসে, আমার তো কিছু করার নেই ভাই ।
নিজের টেবিলে পৌঁছে চেয়ার টেনে বসতে-বসতে প্রদীপ একবার সামনের টেবিলটা দেখে নিল, সঞ্জয় চলে গেছে ।
তাকে দেখে দাসদা উঠে এলেন । তার সামনের চেয়ারে বসে বললেন, কই ভায়া, একটা সিগারেট খাওয়াও তো ।
— নেই ।
— সেকি! এর মধ্যেই ফিক্সড ডিপোজিট করে দিলে নাকি?
ব্যানার্জিবাবু দুটো ফাইল নিয়ে ঘোষসাহেবের ঘরে যাচ্ছিলেন, বললেন, ভালো করেছ প্রদীপ । একশো টাকা পঁচিশ বছরে প্রায় তেরোশোয় গিয়ে দাঁড়াবে ।
প্রদীপ হঠাৎ চেয়ারে হেলান দিয়ে পকেট থেকে চিরুনি বের করে আস্তে আস্তে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে বলল, ভাবছি ফিক্সড ডিপোজিটেই টাকাটা রেখে দেব । সুদে বাড়বে ।
ব্যানার্জিবাবু লাহিড়ীর টেবিলের পায়ায় হোঁচট খেয়ে থেমেছিলেন, ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, আমাকে দু-খিলি ভালো পান খাইয়ো কিন্তু ।
— দাসদা, আপনি টাকাটা পেলে কী করতেন?
— অনেক দিন ফুর্তি-টুর্তি করিনি, যা একখানা বাজার পড়েছে!
দাসদা ঝুঁকে আসেন, সত্যি বলব? আমি হলে ওই টাকায় একদিনে যতটুকু যা হয়— বয়েসও তো হয়েছে, আর কদিনই বা ওসব—
নিরঞ্জনবাবু কোনের টেবিল থেকে ডাকলেন, প্রদীপ মিত্র, টেলিফোন ।
প্রদীপ চেয়ার ঠেলে উঠতে যাচ্ছে, সমীর বলল, এ ঘরে আঠেরোজন তো? আঠেরোটা চিকেন চাওমিন আনিয়ে সবাইকে খাইয়ে দে । একশো টাকায় এর বেশি হয় না ।
সমীর টিফিনের সময় ধাঁধা নিয়ে ডুবে ছিল, একটু আগে কৌটো খুলে মাখন রুটি বের করেছে ।
ফোনের কাছে পৌঁছতেই নিরঞ্জনবাবু বললেন, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে সেকশনসুদ্ধু লোক যা কাণ্ড করছে!
বিমল দত্ত পাশ থেকে বলে উঠলেন, শুধু সেকশন কী বলছেন, সারা অফিসে চাউর হয়ে গেছে । লটারি-টটারি হলে তবু কথা ছিল!
নুরুল মুখ ফিরিয়ে ফ্যানের হাওয়া বাঁচিয়ে সিগারেট ধরায় ।
প্রদীপ কিছু না বলে রিসিভার হাতে নিয়েছে, নিরঞ্জনবাবু বললেন, নোটটা দেখে নিয়েছ তো? আজকাল শুনি জাল নোট-টোট অনেকে রাস্তায় ফেলে দেয় ।
প্রদীপ বলল, হ্যালো?
ওদিক থেকে নারীর গলায় হ্যালো হয়েই লাইন কেটে গেল ।
শ্রাবণী, না ছোট পিসীমা? প্রদীপ ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যালো? হ্যালো?
শুধু ডায়াল টোন শোনা যায় । প্রদীপ চেঁচিয়ে বলল, হ্যালো? কে, শ্রাবণী? হ্যাঁ, প্রদীপ বলছি । কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না, জোরে বলো । অ্যাঁ? কবে? না, আজ পারব না । কাল সকালের ট্রেনে ভেলোরে যাচ্ছি । হ্যাঁ । ডাক্তার বলছে মাথায় একটা অপারেশন করলে বাবা একদম ভালো হয়ে যাবে । তা তো লাগবেই । হাজার দশেকে হয়ে যাবে । দুর! ধার করা আমি ঘেন্না করি । নিশ্চয়ই । আমি ট্রাংক কল করব ।
প্রদীপ জানে আঠেরো জোড়া চোখ তার মুখে সেঁটে আছে খুব চেঁচিয়ে বলল, ও, শোনো! আজ সকালে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়েছি । রাস্তায় কুড়িয়ে পেলাম । বাঃ, লোকেরা লটারি পায় না! অ্যাঁ? বাঃ, পড়ে ছিল, একটু ঝুঁকে, নিচু হয়ে, হাত দিয়ে তুলে নিলাম । অ্যাঁ? নিশ্চয়ই । একটা টিভি দেখে এসেছি, একটা গাড়ি কিনছি, একদম নতুনের মতো, প্রাইমার পদ্মিণী! নিজেই চালাব । ড্রাইভিং আটচল্লিশ ঘণ্টায় শেখা যায় । অ্যাঁ? নিশ্চয়ই । আগে প্লেনে কাশ্মীর । তারপর সতেরো দিনে গোটা ইউরোপ । পঁচিশ হাজার পঁচিশ বছরের ফিক্সড ডিপোজিট রাখছি । তিন লাখ দশ হাজার পাব । অ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই । তাই নাকি? ও হো হো হো হো হা হা হা হা হো হো! প্রদীপ দুহাতে রিসিভার চেপে ধরে হাসতে থাকে । হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরার যোগাড় । প্রাণপণে হাসি থামিয়ে বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছিলাম । হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাকা কেন পাব না! বললাম তো, পঞ্চাশ হাজার । ওই গাড়ি-টাড়ি, ইউরোপ যাওয়া, ফিক্সড ডিপোজিট— ওসব কিছুই করছি না । তোমাকে একটু নাচালুম । অ্যাঁ? মাথা আমার খারাপ হবে কেন? ফেরত দিয়ে দিয়েছি । কাকে আবার? যার টাকা তাকে, রাস্তাকে । আবোল-তাবোল মানে? পাঁচশোটা একশো টাকার নোট নিজের হাতে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে রাস্তার কাদায় ফেলে দিয়েছি ।
ঘটাং করে রিসিভার নামিয়ে রেখে প্রদীপ ঘাম মুছতে মুছতে নিজের সিটে এসে বসল ।
দাসদা বললেন, কী ব্যাপার হে?
নাড়ুবাবু অন্যের ব্যাপারে কখনও মাথা ঘামান না, আলপিন দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন, বললেন, সুযোগ এভাবেই আসে । জীবনটা এবার বদলে নাও প্রদীপ ।
সমীর বলল, আজকাল গাঁজা-টাজা খাচ্ছিস নাকি? দেখি, নাড়ি দেখি! কী সব বকে গেলি—
শিবু হালদার একটু নার্ভাস ধরনের লোক, সব সময়েই ভয়ে মরেন, দুহাত মুঠো করে টেবিলের ওপর ঝুঁকে বললেন, ডাকাতির টাকা নয় তো? কাল পরশু— দুদিনে দুটো ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে গেল । পালাবার সময় ওদেরই একটা বাণ্ডিল পড়ে যায়নি তো?
প্রদীপ কারও কথার উত্তর দিল না । কে একজন গলা তুলে বলল, গুল দিতে হলে এরকমই দিতে হয় । গাটস আছে ।
প্রদীপ তাকাল না, চোখ নামিয়ে রেখে সে পকেট থেকে চিরুনি বের করে অনেকক্ষণ ধরে মাথা আঁচড়াল । তারপর টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে খুঁতখুঁতে মুখ করে চিরুনিটা ভালো করে মুছে বলল, দাসদা, একটা সিগারেট খাওয়ান ।
বাড়ি ফিরে চায়ে চুমুক দিল, চিনি দেয়নি ।
— সহদেব । চায়ে চিনি দিয়ে যাও ।
সহদেব খালি হাতে ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল ।
— চিনি, চিনি, দু চামচে চিনি নিয়ে এসো!
সহদেবের গলায় সারা বছর শ্লেষ্মা, ঘর-ঘর করে বলল, চিনি নেই । পরশু র্যাশন উঠবে ।
সহদেব হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল । প্রদীপ অবাক, তার ঘোলাটে ছানি-পড়া চোখ লাল, দু চোখের তলা ফুলে গেছে । বোঝাই যায়, সারাদিন কেঁদেছে । কী ব্যাপার? বাবার কিছু হয়নি তো? বলল, কাঁদছ কেন?
জুবুথুবু সহদেব গা ঝাঁকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, আমার টাকা হারিয়ে গেছে দাদাবাবু! আজ হাসপাতালে যাবার কথা, বদু আঙুর খেতে চেয়েছিল । একটা দু-টাকার নোট । ঘোষেদের বাড়ির চাঁদুর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম ।
প্রদীপ ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সহদেবের কাঁধে হাত রাখে । তার মন ছি-ছি করে ওঠে । কাল মাইনে পেয়ে টাকাটা ফিরিয়ে দিতে হবে । যদি লটারি ওঠে সবটাই সহদেবের ।
শোক একধরনের সাহস দেয়, সহদেব কাঁদতে কাঁদতেই বলল, এই ঘরেই পড়ে গেছিল, আমি জল দিতে এসেছিলাম । লালচে, নতুন নোট, আপনি দেখেননি?
প্রদীপের মাথার মধ্যে ঝনঝন করে ওঠে । একবার বাসে দশ টাকার নোট দিয়ে প্রদীপ ভাঙানি না নিয়েই ভুল করে নেমে পড়ে, একবার দ্বিগুণ দামে সে দিদির বাচ্চার জন্য বেবিফুড কেনে, তার প্রথম মাসের পুরো মাইনে পকেট মার হয়ে যায়, সেসব তাকে ফেরত দিয়েছে?
প্রদীপ চেয়ারে বসে পড়ে খুব শান্ত গলায় বলল, আমি দেখলে তো কার টাকা তোকেই জিজ্ঞেস করতুম ।
বলে সে খুব আস্তে আস্তে তেতো চায়ে চুমুক দিতে লাগল ।
প্রথম প্রকাশ : অমৃত, আগস্ট ১৯৭৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন