অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
মা আজ কোন পুকুরে
— ভাদ্দর শেষ । এখনও আমনের শিষ ধরল না, চারাগুলোকে তো ন্যাবায় ধরেছে । অঘ্রাণে ধান উঠবে? ছাই । এ বছরটা ছাই খেয়ে থাকিস ।
খেতের ধারে উবু হয়ে বসে বাবা তামাক খায়, যেন হুঁকোটার ওপর রাগে গরগর করছে ।
আমার মাথায় উত্তর ফুটতে থাকে, হ্যাঁ গত সনে তো রোজ গরম ভাতে ঘি খেয়েছি!
— চোপ । যে শালা শুধু যাত্রার পালা বাঁধে, তার মুখে আবার গরম ভাতের বাক্যি! তোমার ওই লেখাপড়ার মুখে লাথি । দু-দুটো পাশ দিয়ে চাকরি করে কত বস্তা বস্তা টাকা আনছো । চাষীর ব্যাটা দু প্যাকেট কীটনাশক গুঁড়ো যোগাড় করতে পারিস না? সরকারে লেখালেখি করে একটা শ্যালো বসাতে পারলে গতবার খেতের ধান অমন খেতে জ্বলে যায়!
একটা মানুষ কত বছর আশায়-আশায় দিন কাটাতে পারে? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল, এখনও শেয়াল-শকুন চেনে না । মহাজন যেন জন্মে দেখেনি । তবু কি কিছু শিক্ষা হল! নিজের জীবনটা মাটি, এখন আমার ভবিষ্যৎ মাটি না করে ক্ষান্তি দেবে না ।
আমি পায়ের চাপে চাপে তালের ডোঙায় জল সেঁচতে থাকি । ন মাসের পোয়াতির ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া, আর খিদেয় গর্তে ঢোকা পেট নিয়ে খেতে জল সেঁচা একই কথা । কপালের নোনা ঘাম আমার গাল বেয়ে মুখে ঢুকছিল । সারা গা জ্যাবজেবে, কালঘাম, কোথায় যেন পড়েছি, এই?
হুঁকো রেখে বাবা আবার লাঙল তুলে নেয় । কলাই বুনবে । ল্যাজে পাক দিয়ে বলদের পাছায় জোর চাপড় মারে, আর মুখে তো সুমুন্দির পো লেগেই আছে । আমাকেই বলে— আর এ তো কেনা বলদ ।
নালির কাছ দিয়ে ঘোরবার মুখে বাবা গলা নামায়, জোরে পা চালা বাপ! শ্রমের অন্ন । শ্রম-ভেন্ন কে কবে পায়?
বাবা সেই ন্যালা-ক্যাবলাই রয়ে গেল । তোমার গতর দিয়ে ফলানো ধান তুমি খাও? তোমার পরিবার খায়? তোমার ছেলেমেয়ের শরীরে গত্তি লাগে? এসব কথা পুলিনের । একবারে খাঁটি কথা । জন্ম থেকে তো দেখছি ।
কোঁচ-বেঁধা শোল মাছের মতো পেটের নাড়িভুড়ি উলটোচ্ছে । মা আজ কোন পুকুরে কে জানে । কদিন আগেও যেত পদ্মপুকুরে । এক পুকুরে কত আর শাপলা-কলমি গজাবে । গেঁড়ি তুলতে হয় হাঁস তাড়িয়ে । আর মাও কিছু একা নয় । এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে অনেক বউ-ঝি যায় পদ্মপুকুরে গেঁড়ি তুলতে । বিশ্বেস বাড়ির হাঁসের পাল তো আছেই ।
বাবা আরেক চক্কর মেরে, আমার কাছ দিয়ে যাবার সময় খিঁচিয়ে ওঠে— মুতছিস নাকি? এই জলে মাটি ভিজবে? জোরে জোরে দাপাতে পারিস না?
— মূর্খের মতো কথা বোল না! রেল চালাতেও কয়লা লাগে । কাল থেকে পেটে একটাও দানা পড়েছে, যে জোরে দাপাতে বলো?
— বাপকে মুখখু বলিস!
বেশ দমে গেছে । আর কোনও কথা না বলে হেই-হেট হেই-হেট করতে করতে বাবা ঘুরতে থাকে ।
শায়ার নিচে পাঁপড়
গোলাপী বাড়ির দিকে যাচ্ছিল । আমি ডাকতে গিয়ে দেখি, ও-ও এদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছে । ওর কাছে নিশ্চয়ই পাঁপড় আছে । অন্য দিন ফেরে সন্ধে পেরিয়ে । টাউন থেকে বাসে লক্ষ্মীপুর । সেখান থেকে এক ক্রোশ হাঁটাপথ ।
— আজ যে তাড়াতাড়ি ফিরলি?
— মালিকের বাপ মরল খানিক আগে ।
— পাঁপড় আনিসনি?
বাড়ি গিয়ে সেঁকে পদ্মকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব ।
গোলাপী আমার থেকে দু-বছরের ছোট । পদ্ম চার বছরের । পদ্ম মুখে রোজ হলুদ বাটা মাখে । সকাল থেকে মেখে বসে থাকে, চানের সময় গামছা দিয়ে মুখ ঘষে । মার মুখঝামটা খায় ।
বাবা মাঝমাঠে । আমি চেঁচিয়ে বললুম, আমি ঘরে যাচ্ছি ।
হেই-হেট, হেই-হেট । আমার কথার উত্তর নেই ।
— জানিস ভরত, বাবার বুকের ব্যামো হয়েছে । গয়েরে ছিট-ছিট রক্ত দেখেছি । টাউন থেকে পরশু হোমিওপ্যাথি এনে দিয়েছিলাম, খায়নি । পুকুরে ফেলে দিয়েছে ।
— আমার, তোর, পদ্মর, দিদির, মার সকলেরই হবে ।
— কী অলুক্ষণে কথা ।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি গোলাপীর পেটের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করি— কটা রে?
— আজ বেশি সরাতে পারিনি । বুড়ো মরেছে, মেয়ে-জামাইয়ের দল ভিড় করে দেখতে এসেছে ।
— একটা বার কর । আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে গেল ।
— কাঁচা খাবি?
— ইঁদুর-আরশোলা তো নয় । একদিন মানুষকে তাও খেতে হবে । যেভাবে চলছে । দেখিস ।
বাঁহাতে শায়ার দড়ি টেনে ধরে ডানহাত ভেতরে ঢুকিয়ে গোলাপী সবে কাগজে মোড়া পাঁপড় বার করছে, সামনে বিশ্বেসবাড়ির মুকুলকে আসতে দেখে হাত বার করে আনল । মুকুল আমাদের কাছাকাছি এসে এক পা মাটিতে রেখে সাইকেলে হেলে বসে থেকে বলল, সন্ধেবেলা বাড়িতে নামগান হবে । হরির লুটের পেসাদ নিতে সবাই মিলে যাস ।
গোলাপীর দিকে তাকিয়ে প্যাডেলে পা তুলে দিল ।
— বদমাশের ধাড়ি । সেদিন, জানিস ভরত, লক্ষ্মীপুরের রাস্তায় আমাকে বলে এতটা হাঁটবি কেন, সাইকেলে ওঠ, বাড়ি পৌঁছে দেব ।
কাঁচা পাঁপড় দাঁতে সেঁটে যায় । চিবোতে চিবোতে আমি বলি, তুই কী করলি?
— মুখে ঝামা ঘষে দিলুম । বললুম, আপনার শ্বশুরের সাইকেল, আপনিই চড়ুন । সিগ্রেট খাচ্ছিল, বললে, তুই সিগ্রেট খাস? খা না একটা । বেশ্যাপাড়ায় যায়, ওদের দ্যাখে তো । আমি চলে আসছি, সন্ধেবেলা ওই রাস্তাটা কীরকম ফাঁকা থাকে জানিস তো, বদমাশটা পিছন থেকে এসে খপ করে আমার কাঁধ ধরে বললে, চড়ে বসে সামনের হ্যান্ডেল দুটো ধারে থাক, দশ মিনিটে গাঁয়ে পৌঁছে যাবি । নাক দিয়ে ফস ফস করে নিশ্বাস ফেলছে । এমন ঝটকা মেরেছি, সাইকেল সুদ্ধু বাবু কাত ।
গোলাপীর বলবার ভঙ্গি দেখে আমার হাসি পেয়ে যায় । আমার তিন বোনের মধ্যে ওর সঙ্গেই আমার যা একটু সুখ-দুঃখের কথা হয় । পদ্ম তো সারাদিন গায়ের রং ফরসা করতেই ব্যস্ত । সাজগোজের দিকে ওর খুব ঝোঁক । আর দিদি কেমন যেন হাবাগোবা । বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসে । ওর শাশুড়ি ওর বাঁহাত ভেঙে দিয়েছে, গাছের ডালের মতো হাতটা সবসময় বেঁকে থাকে ।
একটা কাক আমার হাতের পাঁপড় ছোঁ মেরে নিয়ে গেল ।
গোলাপী হঠাৎ হাসতে হাসতে কোমর ভেঙে হাসির ধকল সামলাতে চেষ্টা করে ।
— খেতে খেতেও তুই পালা বাঁধিস নাকি রে? কাকে এসে হাত থেকে পাঁপড় নিয়ে যায়, কীরকম ব্যাটাছেলেরে বাবা! হিহিহি— হিহি—
আমড়া গাছে বসে কাকটা একবার পাঁপড় ঠোকরায় আর একবার ঘাড় বেঁকিয়ে আমাদের দিকে তাকায় ।
গোলাপী ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে কাকটার দিকে ছোড়ে । ঢিল অনেক নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেল । কাক ঘাড় ঘুরিয়ে লক্ষ করে । দুবার কা-কা করে । আমড়া গাছের মাথায় আকাশের একটা কোণ কালো হয়ে আসছে । হাওয়া না দিলে বিকেল নাগাদ বৃষ্টি হবে । বাঁচা যায় ।
রহিমচাচার সংসার
রহিমচাচা তার ছেলেমেয়ে বিবি নিয়ে ইস্টিশানের দিকে যাচ্ছিল । হাতে-হাতে পোঁটলা-পুঁটলি, ছেঁড়া মাদুর, মাটির হাঁড়ি, গরিবের যাকিছু সম্বল ।
— ও রহিমচাচা, চললে কোথায় গো?
গোলাপীর কথায় চাচি ঘোমটা সরিয়ে তাকায় । চোখে মৃত্যুশোক । কোনওরকমে কান্না চেপে আছে ।
ছোট ছেলে শকলু মাথায় তাদের রান্নাঘরের দরমার বেড়াটা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, রহিমচাচা ডাক দেয়— একটু আস্তে আস্তে চ, বাপ ।
আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, কলকাতায় একটা চাকরির বেবস্থা হয়েছে । সোডা-আইসক্রিমের কলে ।
— মিছে কথা! আমরা কলকাতা যাচ্ছি ভিক্ষে করতে । আম্মা, আব্বাজান, আমি, শকলু আস্তায় আস্তায় ভিখ মেগে বেড়াব । এতক্ষণে বুঝলে ভরতদা!
সাকিনা এমন ফটফট করে কথা বলতে শিখল কবে? খুব তেল দিয়ে টেনে চুল বেঁধে লম্বা বিনুনি ঝুলিয়েছে । শাড়িটা ছেঁড়া-ফাটা, কিন্তু জেল্লাদার । ওর মার শাদির নিশ্চয়ই । এই ক-মাস আগেও মেয়েটা ইজের পরে খালি গায়ে ঘুরত । একবার পদ্মপুকুরে পায়ে শাপলা জড়িয়ে ডুবে যাচ্ছিল, আমি ঝাঁপিয়ে পাড়ে টেনে তুলি ।
গাঁয়ের কেউ কেউ কলকাতায় কল-কারখানার কাজ নিয়ে চলে গেছে ঠিকই । কারখানা মানেই শোষণ, পুলিন বেশ বুঝিয়ে বলতে পারে, তা হোক, তবু দু-মুঠো খেতে তো পায় । পরের জমিতে উদয়াস্ত খেটে বছরভর দু-বেলা অন্ন জোটে? লজ্জায় রহিমচাচা আইসক্রিম কলের গল্প বানাল । আমি সাকিনার কথা যেন বিশ্বাস করিনি, রহিমচাচাকে বললুম, লাঙল-বলদ তবে বেচে দিলে?
— কী করি? কলকাতা শহরের চাকরি, ওসব দিয়ে আর কী করব?
— তোমার বিঘে-কতক নিজের ছিল না?
— ছেল তো কত বিঘেই!
কলকাতায় গিয়েই কি ওরা খেতে পাবে? লোকেরা তো সব নিরন্নের জন্য থালায় থালায় গরম ভাত বেড়ে বসে আছে! গোলাপীকে ফিস-ফিস করে বললুম, কখানা পাঁপড় দিয়ে দিবি? এক গাঁয়েরই তো লোক!
গোলাপী বিরক্ত হয় । আমার দিকে রুক্ষ চোখে তাকিয়ে বলে, তোর আবার সব তাতেই আদিখ্যেতা!
চাচি একবার পিছনের দিকে তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল । ঘোমটার ফাঁকে একবার আমাকে দেখল, একবার গোলাপীকে দেখল, একবার এই গাছটা, একবার ওই গাছটা, একবার আকাশটা দেখল । তারপর ঘোমটায় মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠল ।
শকলু পিছন ফিরে হাঁক পাড়ে, তোমরা কি দেঁইড়েই থাকবে নাকি?
রহিমচাচাও তাড়া লাগায়, চ, চ । এটু পা চালা । পানি হতে পারে ।
ভয় রাগ দুঃখ মায়া
গোলাপী পাঁপড় বের করে গুনতে গুনতে হাঁটছিল । গোনা শেষ করে বলল, তুই যে বড় খেত ছেড়ে ঘরে চললি?
— আমার কিছু ভালো লাগে না । শোন গোলাপী, একটা কথা আমার মনে লাগছে । আমাদেরও একদিন ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে গিয়ে ভিক্ষে করতে হবে । দেখিস ।
— তোর শুধু অলুক্ষণে কথা । একটা চাকরি পেলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে । বাবা চাষকাজ নিয়ে আছে, আমি কাজ করছি, তুই চাকরি করবি, মা, দিদি, পদ্ম ঘরের কাজ করবে । ধান মাড়াই করা, ধান সেদ্ধ করা, ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া । তারপর সবাই মিলে উলু দিয়ে ঘরে বউ আনব । বউ এসে গাই দুইবে, ঘুঁটে দেবে ।
গোলাপী হাসে । ওর চোখে কৌতুক । আমার মনে ভয়, রাগ, দুঃখ, আনন্দ, মায়া, ভালোবাসা, কতরকম ভাব যে মেশামেশি হয়ে লেপটে যায় । এই একরকম, এই আরেক রকম । একই সঙ্গে কত রকম । আমি নিজেই দিশে পাই না । অনেক কথা আমার মনে আসে । সেসব আমার লিখতে ইচ্ছে করে । আমি গুছিয়ে লিখতে পারি না । কখনও কখনও লিখতে চেষ্টা করি । তখন খুব উত্তেজনা লাগে, মনে হয়, এবার পারছি । খানিক লিখে দেখি, দূর! হল না, কিছুই হল না । আমি ইস্টিশানের বিপিন দাসের পত্রিকা-স্টলে নানা রকমের পত্রিকা পড়ি । একেকবার একেকজনের কোনও একটা গল্পের মতো লিখতে যাই । হয় না । আমার জ্যাঠা ‘অভিশাপমালা’ নামে একটা পুঁথি লিখেছিল । প্রায় হাজার পাতা । আমার জন্মের আগেই মানুষটা সন্ন্যাসী হয়ে চলে যায় । সেই পুঁথি আমার মুখস্থ । আমি সেরকমও লিখতে পারি না ।
আমার জামাইবাবুকে আমি ঘেন্না করি । ওর কথা লিখতে ইচ্ছে করে । আমার দিদির অনেক দুঃখ । হাবাগোবা বলে সবটা বোঝে না । বাবা সারা জীবন কিছু পায়নি, শুধু আশায় আশায় থাকে । আমার মা কী সুন্দর আলপনা দিত । লক্ষ্মীপুজোয় । তখন বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হত । উঠোন থেকে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত মা লক্ষ্মীর পা আঁকত । ছোটবেলায় মার মুখে সবসময় ঘোমটা । কলসি-কাঁধে পুকুরে জল আনতে যেত বুক অব্দি ঘোমটা টেনে । কথা বলত আস্তে আস্তে, মিষ্টি গলায় । মুখখানা পদ্মপাতার মতো । এখন মার হাতের শিরাগুলোয় চোখ পড়লে কষ্টে আমার দম আটকে আসে । গালে গর্ত, সারা শরীরের হাড় খরখরে চামড়ায় ঢাকা । তার ওপর শতছিন্ন একটা ন্যাতা কোনওরকমে জড়ানো ।
সাবান নিয়ে চিতেয় উঠিস
আমি আর গোলাপী বাড়ি ঢুকছি, দেখি উল্টোদিকের পথ দিয়ে মা আসছে । ভিজে কাপড় । গায়ে লেপটে আছে । এক হাতে কচুপাতায় শামুক গেঁড়ি, ফাঁক দিয়ে একটা কাঁকড়া দাঁড়া বেঁকাচ্ছে, নিশ্চয়ই মার আঙুল খুঁজছে, শোধ তুলতে চায় । কাঁকড়া মা আমার পাতেই দেবে, আমি জানি । তার ওপর শাড়ির খুঁটে চাল বাঁধা । আজ তাহলে একমুঠো হোক, আধমুঠো হোক, গরম ভাত কপালে নাচছে । কিন্তু চাল মা জোটাল কোত্থেকে? না বলে পারলুম না— চাল কোথায় পেলে?
মা আমার কথার উত্তর দিল না । গোলাপী বলল, ওই কটা চাল কার মুখে দেবে? বাজারে কিনলে নাকি?
— হ্যাঁ, তোরা তো কত টাকা ঘরে আনছিস!
গোলাপী ভুরু কোঁচকায়, তুমিও কি বিশ্বেসবাড়ি মুড়ি ভাজতে যাচ্ছ নাকি?
মার নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছিল । বাঁহাতে নাক ঝেড়ে বলল, কোন চুলোয় যেতে আর বাকি রাখলাম! পেটে ধরেছি, মরি-বাঁচি, দু-মুঠো ভাতের চেষ্টা তো করতে হবে । তোদের বাপ তো ওই একফালি জমি চষেই জীবন কাটাবে ।
দিদি এক মনে দেওয়াল নিকোচ্ছিল । ওর ওই এক স্বভাব । যখন যেটা করবে, তন্ময় হয়ে । মাটি আর গোবব-গোলা জলের হাঁড়ি ন্যাতা-ধরা হাতেই টেনে-টেনে নিয়ে এগোয়, বাঁহাতে জোর পায় না । দেওয়ালের একটা দিক শুকিয়ে সাদা ফুটফুট করছে । ভিজে দিকটা কাদা-কাদা । একবার বসে, একবার দাঁড়িয়ে দিদি দেওয়াল লেপছিল । বোধহয় হাঁড়ির জল ফুরিয়েছে, দাওয়া থেকে নেমে হাঁড়িটা নিয়ে পুকুরের দিকে গেল । আমরা ঘরে ফিরছি, ওর চোখেই পড়ল না ।
পদ্ম চান করে ফিরছিল প্রায় দৌড়তে-দৌড়তে, দিদির মুখোমুখি হতেই হঠাৎ ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, ও দিদি, আমার সাবান পুকুরে পড়ে গেছে!
পদ্ম সাঁতার জানে না । দিদি ডুব সাঁতারে পুকুরের ওপারে গিয়ে ওঠে । ভাঙা হাতে এখনও চিৎ সাঁতার দেয়, যেন আলগা ভেসে আছে । পদ্মকে শান্ত গলায় বলল, চ দেখি ।
মা পিছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, এই পদ্ম! পুকুরে যাবি না । কাপড় ছেড়ে উনুন ধরা এসে ।
দিদির কিছু কানে যায় না, এগিয়ে যায় । পদ্ম ফিরে দাঁড়ায় । কয়েক পা পিছিয়ে এসে বলে, সাবানটা পড়ে গেছে । দিদিকে জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েই আসছি ।
— না, যাবি না । গেরস্ত ঘরের মেয়ে, দিন-রাত শুধু সাবান, হলুদ-বাটা, পাউডার । এত বড় ধিঙ্গি, একদিন দুটো নুড়ো জ্বেলে ভাত ফোটাতে পারিস না!
মা গজগজ করে । পদ্ম ভিজে কাপড়েই জ্বলে ওঠে, আগুনের সামনে আমি বসতে পারব না ।
— কেন পারবি না? রোজ তোকে কে রেঁধে খাওয়াবে । কানীর আজ শরীর খারাপ, ও পারবে না ।
কানী মানে কামিনী । দিদির ডাকনাম ।
দিদি অনেকটা এগিয়ে গেছে । পদ্ম সেইদিকে একবার তাকিয়ে গোলাপীকে দেখিয়ে মাকে বলল, ও তো এসে গেছে ।
মা ঝেঁঝে ওঠে, ও কি পাড়া বেড়িয়ে এল? দূর হয়ে যা, পাজি, পোড়ারমুখী, যমের অরুচি!
মা প্রায় মারতে ওঠে, পদ্ম কাপড় সপসপিয়ে পুকুরের দিকে দৌড়োয় ।
মা পিছন থেকে দাঁতে দাঁত ঘষে, মর, মর, মর, হারামজাদি! মর! ওই সাবান নিয়ে চিতেয় উঠিস ।
হলদে পোস্টকার্ড
গোলাপী ঘরে ঢুকে শাড়ি বদলে চাল ধুতে যায় । বাইরের ব্লাউজটাও বদলে এসেছে । মা আঁচল খুলে চাল দেবার সময় মাটিতে কয়েকটা দানা পড়ে গিয়েছিল, উবু হয়ে বসে খুঁটে-খুঁটে চাল তোলে । কাঠকুটো জড়ো করে উনুনের কাছে গিয়ে আমাকে বলল, দে তো ভরত, তোর দেশলাইটা ।
আমি দেশলাই বার করে দিয়ে গোলাপীর পাঁপড়গুলো চাটাই পেতে রোদে দিই । একটা পাঁপড় নিয়ে একটু একটু করে দাঁতে কাটি আর বসে বসে পাখি তাড়াই । উঠোনে সজনে গাছের গোড়ায় একটা পোস্টকার্ড পড়ে আছে । নিশ্চয়ই পিওন ফেলে গেছে । লোকটা গরিব-গুরবোদের বাড়ি ঢোকে না, রাস্তা থেকে চিঠি ছুড়ে দিয়ে চলে যায় । খোদ সরকারের পিওন তো! আর দিদির যা খেয়াল, তুলে নিয়ে ঘরে রাখবে? বাড়িতে চিঠি এসেছে, সে-খবরই ও রাখে না ।
বিকাশের চিঠি । ১৬ তারিখে এখানে আসবে লিখেছে । বেড়াতে । খাবে কী? তক্ষুনি আমার দুশ্চিন্তা শুরু হল । এক যদি টাকা-পয়সা সঙ্গে আনে । তা নিশ্চয়ই আনবে । ওদের তো আর আমাদের মতো অবস্থা নয় । ওর বাবা টাউনে বি ডি ও ছিল । বিকাশ-প্রকাশ দুই যমজ ভাই আমাদের ইশকুলে পড়ত । দুজনেরই ফর্সা টকটকে রঙ, সুন্দর স্বাস্থ্য । বিকাশ পড়তো আমার ক্লাসে, প্রকাশ ফেল করে এক ক্লাস নিচুতে । ওদের বাবা ঘুষ খেয়েছিল না কী করেছিল, সাসপেন্ড হয়ে কলকাতায় চলে যায় । ওরাও আমাদের স্কুল ছাড়ে ।
চিঠি পড়ছি, সেই সুযোগে তিনটে চড়ুই পাঁপড় ঠোকরাতে লেগেছে । আমি পোস্টকার্ড দিয়েই তাড়া লাগাই ।
বাবার দিনপঞ্জি
কলাইয়ের থালার ফুটো দিয়ে গেঁড়ির ঝোল গড়িয়ে দাওয়ায় ভিজে গোল দাগ ফোটে । চোখ পড়তেই আমি থালার নীচে একটা মাটির ঢেলা গুঁজে দিয়ে ফুটোর দিকটা উঁচু করে দিই । ভাত থেকে ধোঁয়া উঠে রোদের ফালিতে লেগে ফালির আকারে নাচতে থাকে । গরম ভাতে জিভ জ্বলে যায় আমি তবু হাত পুড়িয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকি । কাঁকড়ার নরম ঘিলু ঠোঁটে জিভ লাগিয়ে টেনে নিই ।
মা আরেকটা থালা আমার পাশে ঠক করে নামিয়ে রেখে বলল, খেয়ে নিয়ে মাঠে দিয়ে আসিস । উপোসে ধুঁকছে, তবু নিজে একবার ভাতের খোঁজে আসবে!
ভাতে গর্ত করে গেঁড়ির ঝোল ঢেলে দিয়েছে । ওপরে কাঁকড়ার দুটো দাঁড়া । দাঁড়ার শাঁস খুব সুস্বাদু, মা আজ বাবাকে দিয়েছে । এক পাশে রোদে-সেঁকা চারখানা পাঁপড়, নুন, কাঁচালঙ্কা ।
দিদি পাতাসুদ্ধ জলপদ্ম এনেছিল, গোপালের পুজোয় লাগে । গোপাল মানে পুরনো ক্যালেন্ডারের গোপ-বালক কৃষ্ণ । আমি পদ্মপাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে বাবার থালা ঢেকে মাঠের পথ ধরি । এক হাতে পাতা চেপে রাখি । কাককে বিশ্বাস কী?
মাঠের কাছে এসে দেখি একটা লোক বাবার সঙ্গে কী সব কথা বলছে । প্যান্ট-শার্ট পরা । নিশ্চয়ই কলকাতার লোক । বাবাকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে একটা ধরাল । কী মতলব কে জানে ।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, কোথা থেকে আসছেন?
আমাকে এক পলক দেখে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার । ওনার মুখ থেকে ওনার জীবনের কথা শুনব বলে কলকাতা থেকে এসেছি ।
— বাবাকে আপনি চিনতেন?
— না, না । আমি ঘণ্টাতিনেক আগে ট্রেন থেকে নেমেছি । একজন প্রবীণ কৃষকের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । ওঁকে লাঙল দিতে দেখে—
বাবা বলল, ভাত নামিয়ে রাখ । কথাবার্তা সেরে খাব ।
আমি বললাম, আপনি কী জানতে চান?
— তুই থাম ।
সিগ্রেটে টান দিয়ে বাবা লোকটাকে বলল, তা বলেন, কী জানতে চান ।
— আপনি কখন দিন শুরু করেন?
— তা ধরুন সূয্যি উঠলে আর বসে থাকার উপায় নাই ।
— ভোর থেকে রোজ আপনি কীভাবে কাটান?
— ভোরের বেলা ঘুম থেকে উঠে গরু-বাছুরকে খেতে দিই ।
— আপনি খাওয়াদাওয়া করেন কখন?
— ধরুন বারোটাও হয়, একটাও হয়, দুটোও হয় ।
কতদিন যে কিছুই জোটে না বাবা সেকথা বলল না । বাবা লাজুক ধরনের, অভাব-অনটন বাইরের লোকের কাছে ভাঙতে পারছে না । লোকটা খসখস করে বাবার কথাগুলো লিখে নিচ্ছিল, বলল, দুপুরে খাওয়ার পর আবার কাজ করেন, না বিশ্রাম নেন?
বাবা আবার মিথ্যে বলল, যেন দুপুরে বিশ্রাম করাটা বেশ একটা মান-মর্যাদার ব্যাপার, বলল, এই ধরুন, ঘণ্টা-দুই বিশ্রাম নি ।
— সন্ধেবেলা বাড়িতে কিসের আলো জ্বলে?
— আলো খুব একটা দরকার হয় না । ওই দরকারে-টরকারে কেরোসিন কুপি-টুপি জ্বলে ।
— অন্ধকারে খারাপ লাগে না?
— সবই অভ্যেস হয়ে যায় ।
— আপনার কটি ছেলেমেয়ে?
বাবা আমাকে দেখিয়ে বলল, ছেলে ওই একটিই আর তিন মেয়ে ।
অল্প দামের জামা-চাদর
লোকটা লিখতে লিখতে আমার দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কী নাম?
আমি উত্তর দিলাম না । বাবা বলল, ভরত পদ্মরাজ ।
— মেয়েদের বিয়ে হয়েছে?
— বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি । আর দুজনারও বিয়ের বয়েস হয়েছে ।
— বিয়ে দিচ্ছেন না কেন? উপযুক্ত ছেলের অভাব, না টাকা-কড়ির অভাব?
— হ্যাঁ, তা সেরম যুগ্যি ছেলে পাই কোথায়! পয়সা-কড়িরও এট্টু অভাব ।
— আপনার ছেলের বয়েস কত?
— ভরতের, তা পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে ।
— আপনার ছেলেমেয়েরা কেউ স্কুলে পড়েছে?
— ভরত সেকেন্ডারি পাশ দিয়ে সদরে প্রি-ইউ পাশ দিয়েছে ।
— আপনি বিয়ে করেছিলেন কত বছর বয়েসে?
— তা কুড়ি-বাইশ হবে । ধরুন আমাদের বিয়েতে তখন কনেকে পণ দিয়ে তবে ঘরে আনতে হত । এখন ছেলেকে পণ না দিলে মেয়ের বিয়েই হয় না ।
— পণ দেওয়া-নেওয়া নিয়ে আপনার কী মনে হয়?
— আমি আর কী মনে করব? লোকে তো শোনে না ।
— আপনি এখানে কত বছর চাষ করছেন?
— এই ধরুন, রায়েটের কিছু আগে থেকে । ওই যেবার হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হল ।
— তার মানে তিরিশ বছরেরও বেশি আপনি নিজের হাতে ফসল ফলাচ্ছেন । আপনার, আর আপনার পরিবারের সকলের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন?
— আগে হত । এখন আর হয় কই?
— এর কী কারণ?
— আগে প্রকৃতির জলে চাষ হত । মাটিও ভালো ছিল । এখন সেচের জল, সার, বীজ, পোকামারা ওষুধ— সবই তো পয়সার ব্যাপার ।
— আপনার গ্রামে অঘ্রাণে এখনও নবান্ন হয়?
— যে পারে, করে । করাটাই নিয়ম । তবে না পারলে আর কী করবে । এখনকার অনেকে আবার ওসব মানে না ।
— আপনি জামা গায়ে দেন না?
— গরমের দিন তো । জামাটামা লাগে না ।
— শীতকালে?
— আমাদের এই সাদামাটা অল্প দামের জামা-চাদর ।
— আপনার স্ত্রী, বাড়ির মেয়েরা সাজগোজ করেন না?
ঘোড়ার লাথি
লোকটার কথা শুনে কেন জানি না রাগে আমার মাথা দপদপ করতে থাকে । বাবার আদিখ্যেতা আরও অসহ্য । এসব কথা বলে লাভ কী?
বাবা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, আমি লোকটার দিকে ফিরে বললুম, গাঁয়ের মানুষ খেতে না পেয়ে হাল-বলদ বেচে কলকাতা গিয়ে ভিক্ষে করছে— সেসব তো কই আপনারা খবরের কাগজে লেখেন না । বাবাকে নিয়ে তো দেখছি তামাশা করছেন ।
লেখা থামিয়ে লোকটা ধীরে-সুস্থে সিগারেট বার করতে করতে বলল, একজন চাষীর সারাদিন কীভাবে কাটে, আমি সেটাই লিখতে এসেছি । লোকের এ বিষয়ে কৌতূহল থাকা তুমি কি দোষের মনে কর?
— নিশ্চয়ই না । চাষীর জীবন জানতে চান তো একটা বছর এখানে থাকুন । জোতদার মহাজনদের দেখুন । কত ধানে কত চাল হয়, কটা দানা চাষীর পেটে যায়— এসব নিজের চোখে দেখে, ঠিকমতো জেনে সত্যি কথা লিখুন, তবে আপনাদের হিম্মৎ বুঝি । আপনি তো ইয়ার্কি করছেন ।
— তুই যা, যা তো এখান থেকে । আপনি কিছু মনে নেবেন না । ও একটু মাথাগরম ছেলে, কী বলতে কী বলে বসে । হ্যাঁ, তা কী বলছিলেন, হ্যাঁ— তা মেয়েরা সাজগোজ আর কী করবে? সংসারের কাজকর্ম করে, ওই সাধারণ শাড়িটাড়ি পরে আর কি । ছোট মেয়েটার একটু সাজগোজের শখ । তা কী আর দিতে পারি!
— কলকাতায় যাননি কখনও?
— ওই একদিন গিয়েছিলাম ।
— কবে?
— তা ধরুন দশ-বারো বছর হবে । পার্টির মিটিঙে একজন নিয়ে গিয়েছিল । বললে, রেলে টিকিট লাগবে না । বিখ্যাত জায়গা, দেখা-টেখা হবে । গেলাম । তা ঘোড়ার লাথি খেয়ে চলে এলাম । গড়ের মাঠে মিটিং হচ্ছিল । একটা লোক, তার মাথায় পাগড়ি, ঘোড়ার পিঠে বসে ঘোড়ার মাথায় চাটি মারে আর ঘোড়াও ক্ষেপে গিয়ে আমাদের লাথি ঝাড়ে । লোকেরা যে-যেদিকে পারে দৌড়চ্ছে, পুলিশের বন্দুক ফুটছে, বলাই পাল বলছে, তোমরা কেউ ভয় করবে না, ও ফাঁকা আওয়াজ । গায়ে গুলি লাগবে না । তা কলকাতা জায়গা ভালো । তবে ওই অবস্থায় কী আর দেখব । বড্ড চোখ জ্বলছিল, চোখ দিয়ে অনেকক্ষণ জল পড়ছিল ।
বনে শেয়াল যেমন
লোকটা বকতেও পারে । যেন নেশা ধরে গেছে । ফস করে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে বলল, যখন হাতে কোনও কাজ থাকে না কীভাবে সময় কাটান?
— ওই, পাঁচটা লোক এলে গপ্পো করি ।
— কী গপ্পো করেন?
— এই আমাদের মাঠঘাট । কীভাবে আবাদ করতে হবে । ছেলেমেয়েদের কীভাবে বাঁচাব । এইসব সুখ-দুঃখের কথা ।
— বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আপনি কখনও কোথাও বেড়াতে যাননি?
— না, না । আমাদের চাষকাজ, সময়ই হয় না । তাছাড়া পয়সা না থাকলে মানুষ গাঁয়ের বাইরে যায় কী করে?
— আপনার তো সারা জীবনটা মাঠে কেটে গেল । সাধ-আহ্লাদ করলেন না, আরাম-আয়েস করলেন না, এই গ্রামের বাইরে পৃথিবীর কিচ্ছু দেখলেন না, এসব ভেবে কখনও দুঃখ হয় না? রেগে ওঠেন না?
— তা কী আর হবে ।
— সারা জীবন মানুষের অন্ন যোগাচ্ছেন, অথচ নিজেরা পেট ভরে খেতে পান না, ভেবে আপনি কখনও অবাক হননি?
বাবা আমার দিকে তাকায় ।
— আজকাল একটু একটু ভাবি । আমি বলি শুনুন । আমার মনে কোনও হিংসা অহংকারের কথা নাই । বনে শেয়াল যেমন বাস করে, আমরাও ওইরকমই । আমাদের কথা শুনে আর কী করবেন? তা, আপনার খাওয়া-দাওয়া তো হয় নাই । আপনারে এট্টু যে আপ্যায়ন করব—
— না, না । আমি খেয়ে এসেছি । আপনি বরং খেয়ে নিন ।
লোকটা যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বাবা বলে উঠল, আপনার আরেকটা সিগ্রেট দেন ।
— হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ।
সিগারেট দিয়ে লোকটা চলে গেল ।
সোনার সিগ্রেট
লম্বা সিগারেট, পিছনে ফিল্টার লাগানো । বাবা এদিক-ওদিক খুঁজে একটা কচুগাছের পাতায় আলতো করে সিগ্রেটটা রেখে ভাতের থালা টেনে নিল । পদ্মপাতা রোদে নেতিয়ে পড়েছে, ধারগুলো কোঁকড়ানো । ভাত শুকিয়ে খরখরে । ঝোল টেনে গেছে । গেঁড়িগুলো যেন মাঠ বেয়ে ভাতের গায়ে উঠে চুপ করে বসে আছে ।
খাওয়া শেষ করে বাবা সিগ্রেট ধরায় । রয়েসয়ে আয়েস করে টান দেয় । গন্ধটা ভারি সুন্দর । ধোঁয়াটাও অনেক বেশি মিহি । হালকা, নীলচে । ছোট-ছোট গাছের ডালে-পাতায় ধোঁয়াটা বেশ খানিকক্ষণ জড়িয়ে থাকে । বাবা চোখ বুজে একটা সুখটান দিয়ে নিজের মনে কথা বলতে থাকে, তা মান দিয়ে কথা বলতে জানে । আমায় মুখখু ভাবলে অত কথা শুধাতো!
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট । মূর্খ বলেছিলাম তো, সেই কষ্ট ভুলতে পারেনি । তবে সেই ঝাঁঝ আর নেই । কলকাতার লোকটা এসে কাটিয়ে দিয়ে গেছে । বাবার ওপর হঠাৎ আমার কেমন মায়া হয় । ওই যে বলল, ছেলেমেয়েদের কীভাবে বাঁচাবে, তাই নিয়ে ভাবনা হয়, আলোচনা করে । আমাদের কথা বাবা তাহলে সত্যিই ভাবে । ভেবে কষ্ট পায় । উপায় খোঁজে ।
মাঠে এই ছায়া, এই আলো । এমনই করতে করতেই আজ সূর্যাস্ত হবে । হাওয়া নেই । আমড়া গাছের মাথায় মেঘ আরও কালো । লক্ষণ ভালো । বাবা যে মনে মনে একপশলা বৃষ্টি আশা করছে, বোঝা যায় । একবার আকাশ দেখছে, একবার জমির সীমানায় চোখ বোলাচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক ভাব । সিগ্রেট শেষ হয়ে ফিল্টারে ঠেকেছে, বাবা টান দিতে গিয়ে ধোঁয়া না পেয়ে সিগ্রেটটার দিকে তাকায় ।
— সোনার মতো সরু ফিতে দিয়ে বাঁধন দিয়েছে দেখেছিস । ঠিক মনে হয় সোনা ।
— বড়লোকদের সবই হয়, সবই ওইরকম ।
ফিল্টারের গোল সোনালি রেখাটা আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বাবা মুখ না তুলেই বলে, তা তো হবেই ।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকে । হঠাৎ বাবার স্বরে উত্তেজনা, এটা সোনা নয় তো রে?
আমার একই সঙ্গে রাগ ও মায়া হয় । আমি রাগ চাপবার চেষ্টা করে বললাম, ধান-কলাই না বুনে আমরা সারা বছর ফুলের চাষ করতে পারি না? কলকাতায় বেচে তবু কিছু নগদ টাকা হাতে আসে । সরসীর শালা থাকে কল্যাণীতে, ফুল বেচে পাকা বাড়ি তুলেছে ।
বাবা জ্বলে ওঠে, আমরা ধানচাষী, আমাদের বংশে কেউ ফুলের চাষ করে না । ফুল হল গিয়ে শখ-সৌখিনতার জিনিস, অন্ন মানুষের প্রাণ ।
— পেটের ভাত না জুটলে প্রাণ বাঁচবে? ধানচাষ করে লাভ কী? হাতে টাকা থাকলে চাল কিনে খাওয়া যায় । সারা দুনিয়ার মানুষ জমি চষে পেটের ভাত জোটায় না ।
উপোসের খোঁটা দিয়েছি তো, বাবা একটু ঝিমিয়ে যায়, বলে, যার যা কাজ ।
ফিল্টারের টুকরোটা ট্যাঁকে গুঁজে বাবা উঠে পড়ে । গরুর কাঁধে লাঙল জুতে হেই-হেট হেই-হেট করতে করতে এগিয়ে যায় ।
আমি মাঠ ছেড়ে পথে নামি । ফুলচাষের কথাটা কদিন ধরেই ভাবছি । আমি এটা বুঝতে পেরেছি, কেউ আমাকে চাকরি দেবে না । কিছু একটা করতে হবে । যেভাবে চলছে, সেভাবে আর চলে না । আমার কেমন মনে হল, বাবারও আর বেশি বাকি নেই । শুধু আশায়-আশায় থেকে শরীরপাত করছে । আশা করতে-করতেই বাবা একদিন চোখ বুজবে । গোলাপী যা বলছে, তা যদি সত্যি হয়, কাশির সঙ্গে রক্তের ছিটে মানেই তো যক্ষ্মা, আমি কী করে বাবাকে বাঁচাব । গোলাপীও সারাজীবন পাঁপড় বানিয়ে আর পাঁপড় চুরি করে আমাদের নড়বড়ে সংসারটা খাড়া রাখতে গিয়ে নিজেই একদিন নড়বড়ে হয়ে যাবে । নয় তো নষ্ট হয়ে যাবে । পদ্মর কথা ভেবে আমার ভয় হয় । একটা শাড়ি, একটু সাবান, একটু সুখের জন্য ও বোধহয় সব করতে পারে । ওর জন্য আমার দুঃখ হয় । কে ওর বিয়ে দেবে? জমি থেকে আমাদের পেটই চলে না, তা আবার বিয়ে । দিদিরই বা কী হবে? অথচ দিদির মতো মেয়ে হয় না । আমার একেক সময় মনে হয়, জামাইবাবুকে আমি নিজে গিয়ে অবস্থাটা বোঝাই । না বুঝলে গলা টিপে শেষ করে দিই লোকটাকে । আমার অমন দিদির জীবন নষ্ট করে তুমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে, তাই কি হয়?
ভালো লাগে না, কিছুই ভালো লাগে না । চারদিক যেন কেমন হয়ে আছে । মেঘলা আকাশ আমাকে আরও মনমরা করে দেয় । এত বড় পৃথিবীতে আমার কিছু করার নেই ।
লুবাইয়ের কবর
— ও ভরত, আমের একটা পল্লব পেড়ে দিবি বাবা?
মুখ তুলে দেখি আমগাছের নিচু ডালে দাঁড়িয়ে সুজলাবৌদি । জলাদার বউ । সুজলাবৌদির নামের একটা ইতিহাস আছে । আসল নাম সুকুমারী । স্বামীর নাম জলধর হালদার । আমরা বলি জলাদা । ওই জলাদার সঙ্গে বৌদির নামের আদ্য অক্ষর জুড়ে জেলেপাড়ার ক্ষিতীশ ওকে সুজলাবৌদি বলে ডাকে । শুনতে এত ভালো লাগে, আমিও ওই নামেই ডাকি ।
সুজলাবৌদির সঙ্গে দেখা হলেই আমি চুরি করে ওর চোখ দেখি । চেয়ে থাকতে লজ্জা হয়, আবার না দেখলেও মনটা খচখচ করে । সবসময় নাকছাবি পরে থাকে, তাতেই আরও সুন্দর লাগে । জেলেপাড়ায় বৌদির রূপের খ্যাতি আছে । মন্দ লোকেরা, বিশেষ করে মেয়ে-বউরা ওকে নিয়ে অনেক গাল-গল্প বানায় । আসল কথা হিংসে । বৌদি খাগড়ার কাঁসারিপাড়ার মেয়ে । একসময় ওদের বাড়ির অবস্থা খুবই সচ্ছল ছিল । বছর দশেক আগে সরকার কন্ট্রোলে রাং, তামার পাত দেওয়া বন্ধ করে দিয়েই ওদের পথে বসায় । শুধু সুজলাবৌদির বাবা-কাকাই নয়, গোটা কাঁসারিপাড়া সেই থেকে ধুঁকছে । অনেকেই সাতপুরুষের কাঁসারের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে । কেউ লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চানাচুর, চিড়ের মোয়া, গুড়ের খাজা ফেরি করে । কেউ রেলের কয়লা চুরি করে স্টেশনের কয়লার ডিপোয় বেচে দেয় । কেউ মুদির দোকানে, চায়ের দোকানে ফাই-ফরমাস খাটে । কেউবা মহাজনের রিকশা চালায় । কেউ কেউ ভিটেমাটির মায়া কাটিয়ে চাকরির আশায় এদিক-ওদিক চলে গেছে । গতবছর বৌদির বাবার অসুখে আমি বৌদিকে পৌঁছে দিতে গিয়ে তিনদিন ছিলাম । জলাদার বিয়ের বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিলাম, তারপর ওই দ্বিতীয়বার । দশ-বারো বছরে কাঁসারিপাড়ার চেহারাই বদলে গেছে । বিয়ের দিনও সারা রাত সারা পাড়ায় ঠনঠন শুনেছি । একে তো বিয়েবাড়ির হইচই, তার ওপর আমরা গাঁয়ের ছেলে, রাতে দুয়েকটা নিশাচর পাখি-পেঁচার ডাক ছাড়া কোথাও কোনও সাড়া থাকে না । কাঁসারিপাড়ার কাজের আওয়াজে সেবার আমি ঘুমোতে পারিনি । গত বছর দেখলাম, দিনের বেলাই খাঁ-খাঁ । কাঁসারের কারখানা প্রায় চোখেই পড়ল না । তিনশো সাড়ে-তিনশো কাঁসারির মধ্যে সর্বসাকুল্যে বারো-চোদ্দজন কাঁসারের কাজ করে । তাও বেশিরভাগই টুকটাক মেরামতির কাজ । কেউ কেউ পুরনো ভাঙা বাসন গালিয়ে নতুন বাসন বানাচ্ছে ।
সুজলাবৌদির বাপের বাড়ির অবস্থা যখন ভালো ছিল, কাঁসারিপাড়া থেকে পুজোয়-পার্বণে মেলা জিনিস পাঠাত ওর বাবা । আজ একজোড়া ভারি জামবাটি, কাল একটা পিতলের হাঁড়ি, কখনও বাটি-গেলাস, কাজ করা রেকাব । বৌদির যখন ছেলে হল, ঠিক সোনার মতো দেখতে দুধ খাওয়ার ঝকঝকে ঝিনুক-বাটি নিয়ে ওর বাবা নাতির মুখ দেখতে এসেছিল ।
ওইসব দেখে তখন জেলেপাড়ার বউ-ঝিরা হিংসেয় পুড়ত । তারপর বৌদির বাপের বাড়ির অবস্থা পড়ে এল । জিনিস আসা বন্ধ হল । জলাদাও পর-পর তিন বছর পদ্মায় মাছ না পেয়ে একে-একে ওই সব বাসন-কোসন বেচতে লাগল । তখন পাড়ার মেয়েরা শোধ তুলতে উঠে পড়ে লাগল । জলাদা দশ-কুড়ি দিনের জন্য পদ্মায় গেলেই তারা সুজলাবৌদির নামে কুৎসা রটায় ।
সুজলাবৌদি লক্ষ্মীবারের পল্লব নিতে এদিকে এসেছিল । হাত পাচ্ছে না, তাই আমাকে দেখে ডাকল ।
বৌদির গাছে চড়াটা আমার ভালো লাগেনি । এমনিতেই এদিকটা নির্জন, বন-জঙ্গলময়, সন্ধে না হতেই মেঘলা করে অন্ধকার মতো হয়ে রয়েছে, এই সময় একা এতদূর এসে গাছে চড়ার দরকারটা কী? বদনাম তো কিছু কম রটেনি ।
বৌদি ঝুপ করে লাফিয়ে নামল । আমি গাছে চড়তে চড়তে বললাম, একদিন লক্ষ্মী পুজো না করলে কী হয়? এত দূরে একা আসা তোমার ঠিক হয়নি ।
— তোকে অত ভাবতে হবে না । বেশ কচি দেখে পাড়িস । তিনটে পাতা থাকা চাই কিন্তু ।
আমের পল্লব পেড়ে আমি বৌদিকে জেলেপাড়ার দিকে এগিয়ে দিই । পল্লব ওর হাতে দিয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকি ।
খানিক এসে সুজলাবৌদি দাঁড়িয়ে পড়ে । সামনে রহিমচাচার কুঁড়ে । শূন্য । সাড়াশব্দহীন । মেঘলা আকাশের নীচে আরও কালো হয়ে চালাটা দাঁড়িয়ে আছে ।
আমি এক পলক বৌদির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, রহিমচাচার মেয়েকে আমি একবার পুকুর থেকে তুলেছিলাম । সাঁতার জানত না ।
সুজলাবৌদির চোখের পাতা পড়ছে না । আমার কথা শুনল কি শুনল না, বুঝতে পারলাম না । বললাম, চাচা মানুষটা কিন্তু ভালো ছিল । মনটা খুব নরম । নিজেরা দুবেলা খেতে পেত না । কিন্তু ফকির বাউল এলে একমুঠো খুদ অন্তত দিত । একদিন দেখি দাওয়ায় বসে বসন্ত বোষ্টুমির কেত্তন শুনতে শুনতে কাঁদছে । কেত্তন শেষ হলে বোষ্টুমির ঝুলিতে চাল দিল, আস্ত একটা লাউ এনে দিল ।
সুজলাবৌদি কী দেখছে? রহিমচাচার কথায় একবার হুঁ-হাঁও করল না । ওরা যে গাঁয়ের ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতা শহরে ভিক্ষে করতে গেছে, জানে না নাকি? একেবারে তন্ময় । দূরের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে ।
— কী দেখছ? বাড়ি যাবে না?
সুজলাবৌদির ঘোর ভাঙে । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চ ।
বাঁদিকে মোড় ঘুরে হাঁটতে-হাঁটতে আমার দিকে না ফিরে বলল, মাটির নীচে মানুষের শরীল মাটির সঙ্গে একদম মিশে যায়, না রে?
এতক্ষণ তাহলে লুবাইয়ের কথা ভাবছিল । রহিমচাচাদের কুঁড়েঘর ছাড়িয়ে ডানদিকের মাঠে লুবাইয়ের কবর । এক বছরের বাচ্চা পোড়াতে নেই তো, জলাদা ছেলেকে ওইখানে মাটি চাপা দিয়েছিল । জলাদা সে-বছর টানা এক মাস পদ্মায় কাটিয়ে মাছ নিয়ে ঘরে ফেরে । বিল থেকে কিছু জ্যান্ত কইমাছও এনেছিল । কী করে মাটির হাঁড়ি উলটে যায় । লুবাই সবে হাঁটতে শিখেছে, টলতে-টলতে এসে একটা মাছ ধরে মুখে দেয় । দম আটকে শেষ ।
গাঙের চিঠি পুকুরে ভাসে
সুজলাবৌদিকে অন্যমনস্ক করতে আমি জলাদার কথা তুললাম ।
— জলাদা কোনও খবর পাঠিয়েছে? কবে ফিরবে? এবারও শুনছি ইলিশের ঝাঁক এখনও দেখা যায়নি!
— সে-মানুষ তো কতদিন হল আসামের নদীতে । পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে বেরিয়েছে ।
— আসাম? সে তো অনেক দূর?
— তা হালদাররা মাছের সন্ধানে কোথায় না যায়?
— তুমি কখনও জলাদার সঙ্গে পদ্মায় যাওনি, জেলেডিঙিতে?
— তুই বড় বোকা-বোকা কথা বলিস, ভরত । আমি জেলেপাড়ার আর পাঁচটা বউয়ের মতো জেলের মেয়ে না । আমার বাপ কংসবণিক । আমি খাগড়ার বিখ্যাত কাঁসারিবংশের মেয়ে । আমি কেন মরতে আঁশটে নৌকোয় মাছমারাদের সঙ্গে যাব!
কারও জাত কি পেশা নিয়ে কেউ খোঁটা দিলে আমার রাগ এসে যায় ।
আমি বললাম, মরতে কি বেড়াতে যাবার কথা বলছি না । জলাদা ঝড়েজলে প্রাণ হাতে নিয়ে মাছ ধরে, তুমি সঙ্গে থেকে একটু-আধটু কাজে লাগতে পারো তো ।
— তোকে আর গুরুগিরি করতে হবে না । হালদাররা কবে আবার সঙ্গে বউ নিয়ে মাছ ধরতে যায় রে?
সুজলাবৌদি রেগে আছে । একটু আগেই ছেলের শোকে চোখের পাতা পড়ছিল না, এখন দু-চোখ জ্বলছে । আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, তোর মা তো পুকুরে পুকুরে শামুক গেঁড়ি তুলে হাতেপায়ে হাজা হয়ে মরতে বসেছে, এতো বড় মদ্দা, দু-দুটো পাশ দিয়েছিস, তুই মার কোন কাজে লাগছিস?
— চাকরির চেষ্টা তো কম করিনি ।
— চাষকাজে ঘেন্না ধরল বুঝি?
সুজলাবৌদির নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে । নাকছাবিটা মেঘলাতেও জ্বল-জ্বল করে । আমি বললাম, ঘেন্নার কথা না । চাষ করে লাভ কী? বছরকার ধানই ঘরে ওঠে না । আমি অন্য উপায় ভাবছি ।
— মাছ ধরেই বা কী-এমন দুধেভাতে থাকি রে? আমিও অন্য উপায় ভাবছি ।
— কী?
— তোকে বলব কেন? এই জগু, জগু ।
মোটা টেস্টপেপার নিয়ে জগু স্টেশনের কাছে খগেন স্যারের বাড়ি যাচ্ছিল কোচিং নিতে । সুজলাবৌদির ডাকে দাঁড়ায় ।
— ফেরার পথে একবার পোস্টমাস্টারের বাড়ি হয়ে আসিস তো । পিওনটা শুনেছি অনেক সময় চিঠি পুকুরে ফেলে দেয় । সেদিন নিজের চোখে দেখলুম পোস্টো কার্ড ভাসছে । তিন মাস হয়ে গেল, একটু খোঁজ নিস তো ভাই ।
জেলেপাড়ার ছেলেদের মধ্যে জগুই একমাত্র লেখাপড়া করে । খুব নিচু ক্লাসে পড়ে কেউ কেউ । সে কিছুদিনের জন্য । কয়েক বার ফেলটেল করে ইস্কুল ছেড়ে দিয়ে বাপ-দাদাদের সঙ্গে নৌকোয় আলকাতরা মাখায়, জালে গাবের রস লাগায় । নৌকোর দলে ভিড়ে পদ্মায় যায় । জগুই শুধু ওসব শিখল না । সে জেদ ধরেছে, জীবনে কখনও বাপের পেশায় যাবে না । পাশটাশ করে শহরে গিয়ে চাকরি করবে । লিখতে-পড়তে শিখে জগু অবশ্য পাড়ার একটা কাজে লাগতে পেরেছে । হালদাররা দূরের নদীতে মাছ ধরতে গেলে, সেখানকার ডাঙার কাউকে দিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে চিঠি লেখায়, জগু সেই চিঠি পড়ে দেয় । কখনও-কখনও কারও হয়ে চিঠি লিখেও দিতে হয় তাকে ।
জগু বলল, সন্ধে রাতে আমি পোস্টমাস্টারের বাড়ি যেতে পারব না । সূর্য ডুবলেই আজকাল আফিম খেয়ে ঝিমোয় ।
— আফিম খাক, তাড়ি খাক, একটু চিঠির খোঁজ নিতে গেলে তোকে কি গিলে খাবে?
জগু আর কথা না-বাড়িয়ে চলে যায় ।
পোস্টমাস্টার লোকটাকে আমি চিনি । মহিমকুমার ভদ্র । লোকে সাধারণত মাস্টারমশাই বলে ডাকে । কেউ কেউ বলে ভদ্রবাবু । চাকরিতে এসে প্রথম প্রথম ভদ্রবাবু বেনামে খবরের কাগজে চিঠি লিখত । আশপাশের দু-পাঁচটা গ্রামের অভাব-অভিযোগের কথা । ডাক-বিভাগের অব্যবস্থার কথা । ডাকঘরের ফুটো চালা দিয়ে বর্ষার জল পড়ে চিঠিপত্র ভিজে যায় । এত বড় এরিয়া, লোক কম, চিঠি বিলি হতে হপ্তা কেটে যায় । একবার আমার নাম দিয়ে লিখে ছিল, লক্ষ্মীপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সারা বছরই ওষুধ থাকে না । পোস্টঅফিসে যখন কাজ থাকত না, ভদ্রবাবু টেবিলে বই রেখে মাথানিচু করে বসে বসে পড়ত । আমাকে একবার রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়তে দিয়েছিল । আজকাল চিঠিও লেখে না, বইটইও পড়ে না । সন্ধে হলেই আফিম খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে ।
জেলেপাড়ার মুখে এসে আমি সুজলাবৌদিকে সান্ত্বনা দিই, জলাদার জালে এবার হয়তো অনেক মাছ পড়ছে । একদিন দেখবে অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে হাজির হবে ।
— বেঁচে আছে কিনা, তাই দ্যাখ । তুই যা, সন্ধে লেগে যাচ্ছে । লক্ষ্মীকে জল-বাতাসা দেব, পাঁচালি পড়ব । যা গুমোট! একটু বৃষ্টি হলে বাঁচি!
বুকে ত্রিশূলের খোঁচা
সংসারে শকুন যত, উকুনের সংখ্যা তত নয় ।
আকাশ জুড়িয়া যত আশা দেখি, তত দেখি ভয় । ।
আশীর্বাদ যত আছে, শাপমন্যি তাহার অধিক ।
সর্বভূতে শাপ দেয়, টিকটিকি কহে ঠিক ঠিক । ।
শাপের কারণে শোক পাপ-তাপ মনোকষ্ট ক্ষুধা ।
চরাচরে অভিশাপ, কোথা পাব জীবনের সুধা । ।
অভিশাপ হেতু এই জীবনের কোনও অর্থ নাই ।
কে কবে কহিয়া দিবে কোথা গেলে আমি শান্তি পাই । ।
শ্মশানে-কবরে ক্ষয় হয় সর্ব যাতনা ও জ্বালা ।
চন্দ্রকান্ত কবিয়াল অঙ্গুলিতে অভিশাপমালা । ।
পদবীতে পদ্মরাজ, সদা ভয় সদা দুঃখীমান ।
শৈশবে মাতুলালয়ে সঙ্গহীন আছিল মগন । ।
বনোমাঝে মন্দিরেতে থাকিতেন কবি পুরোহিত ।
একা মনে ভাবিতেন মানুষের যত হিতাহিত । ।
শীতগ্রীষ্মে অকাতর, শয্যা শুষ্ক অরণ্যের কাঠ ।
হতভাগ্য বালকেরে উষাকালে শিখাতেন পাঠ । ।
শিক্ষাগুরু দীক্ষাগুরু নমি আমি তাঁহার চরণ ।
অভিশপ্ত সংসারের যত দুঃখি করিব বর্ণন । ।
পড়তে পড়তে আলো কাঁপে । সারাদিনের গুমোট কেটে গিয়ে রাতে হাওয়া দিয়েছে । নারকেল পাতায় ঝিরিঝিরি । আলোর শিখা কাঁপতে কাঁপতে একেকবার ক্ষীণ হয়ে আসে । ক্ষীণ হতে হতে একসময় নিভে যায় ।
স্বপ্নে জ্যাঠার রক্তচক্ষু দেখে স্বপ্নেই আমার কপাল ঘামতে থাকে । আমি জ্যাঠাকে কখনও চোখে দেখিনি । স্বপ্নে অনেকবার দেখেছি । জটাজুটধারী সন্ন্যাসী । গমগমে গলায় কথা বলে । একবার আমার মাথায় হাত রেখেছিল । আরেকদিন, মনে আছে, কাঁধের ঝুলি থেকে বার করে আমার হাতে একটা পাথরের রিভলবার ধরিয়ে দিয়েছিল । অদ্ভুত জিনিস । নল দিয়ে আপনা থেকেই আগুনের ঝলক বেরোয় ।
আমার কপাল, মুখ, গলা বেয়ে কুল-কুল ঘাম নামছে । জ্যাঠার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোয় । আমার বুকে ত্রিশূলের ডগা ছুঁইয়ে রেখে বলল, কুলাঙ্গার!
গলার আওয়াজে ঘরের চালা সুদ্ধু কেঁপে ওঠে । বুকে ত্রিশূলের খোঁচা খেয়ে যন্ত্রণায় আমার ঘুম ভেঙে যায় ।
চোখ মেলে অন্ধকারে মানুষের নড়াচড়া দেখতে পাই । ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে । ঘরের কোণে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে । তবে কি সত্যিই সশরীরে জ্যাঠামশাই? নাকি মরে গিয়ে ভূত হয়ে এসেছে? অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে, সাহস করে চেয়ে দেখি মানুষটা নিচু হয়ে কী করছে । ন্যাকরা ছেঁড়ার শব্দ হল । চোর নাকি? আমি আস্তে আস্তে উঠে পা টিপে টিপে কাছে গিয়েই চমকে উঠি ।
— তুই? কী করছিলি অন্ধকারে?
দিদি ভয় পেয়ে ‘উঃ মা’ বলে উঠে আমাকে দেখে বলল, আমার এখনও বুক ধড়ফড় করছে রে । তোর ঘুম ভাঙবে ভাবিনি ।
— আলো জ্বালাসনি কেন? কী খুঁজছিস এখানে?
— কিছু না । তুই শো গিয়ে ।
আমি মাদুরে এসে বসি । ওখানে আমার দুয়েকটা পুরনো জামাটামা আছে । একটা পাজামা পুঁটলি বেঁধে তুলে রেখেছি ।
কলেজে পড়বার সময় টাউনের দরজিকে দিয়ে বানিয়েছিলাম । পায়ের দিকে ছিঁড়ে গেছে, ঝুলেও কিছুটা খাটো, তবু ওই একটাই আমার পাজামা, রেখে দিয়েছি, দরকার-টরকারে পরি । বিকাশ এলে গোলাপীকে দিয়ে একটু সেলাই করিয়ে নিয়ে ওটাই পরব ।
আবার ন্যাকড়া ছেঁড়ার শব্দে কেমন সন্দেহ হল, বললাম, আমার পাজামা ছিঁড়ছিস না তো?
— ছেঁড়া তো । জামা-দুটোর চেয়ে ওটাই দেখলাম বেশি ছেঁড়া ।
— আমার একটা মাত্র পাজামা । রাত-দুপুরে তোর পাজামা ছেঁড়ার কী দরকার পড়ল?
দিদি কিছু না বলে ন্যাকড়া নিয়ে অন্ধকারেই বেরিয়ে গেল । অন্ধকারে অদ্ভুত উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসে । হঠাৎ মনে হল, দিদি গলায় ফাঁস দেবার মতলব করছে না তো? ওর দুঃখের তো শেষ নেই!
বকের বেশে শকুন
ফুলচাষের কথাটা ভালো করে ভাবতে হবে । সবদিক খতিয়ে দেখে তবেই হাত লাগাব । জমি নিয়ে সমস্যা । বাবা কি জমি ছাড়বে? বাবার সঙ্গে আমার খুব একচোট লাগবে, সন্দেহ নেই ।
জমি কি চিরকাল বাবার হাতেই থাকবে । যেতে যেতে এখনও যেটুকু আছে, সেটুকুই আর কতদিন থাকে দ্যাখো । রহিমচাচার জমি কোথায় গেল? এমনি কতজনের । বেশিরভাগই তো নিজের জমি খুইয়ে ভাগচাষী, নয়তো চাষমজুর । বিশ্বেসরা, পঞ্চামহাজনরা দিনরাত ফন্দি আঁটছে, কলকাঠি নাড়ছে । টাকা বলো টাকা, বীজধান বলো বীজধান, ধারকর্জের ফাঁদ পেতে রেখেছে সারা গাঁয়ে । তুমি ইঁদুর, তুমি চড়ুই, অন্নের লোভে তুরতুর করে ওদের কলে ঢুকছো, তোমার ঘাড়ে যাঁতা বসিয়ে দিয়েছে, ঠ্যাঙে ফাঁস টেনে দিয়েছে, তুমি বুঝেও বোঝ না, আশায় আশায় ভাব এ বছরডা যেমন-তেমন সামনের বছর দুঃখহরণ । সেই যে খ্যাপাচাঁদু গায় । কৌটোর দুটো ঢাকনা করতালের মতো বাজিয়ে বাজিয়ে নেচে নেচে গান গেয়ে ভিক্ষে করে ।
জমির ব্যাপারে সরকারের নিয়মকানুনও এক হেঁয়ালি । এক সরকারের একেক রকম নীতি । আজ এক সরকার এর-ওর বেনামী জমি বার করে একে-ওকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেয় তো কাল আরেক সরকার এসে সে জমিতে নতুন করে দাগ দিয়ে নতুন ভাগ-বাটোয়ারা করে । জমি পেলেই বা কী । চাষের খরচ দিচ্ছে কে? বীজধানই পেটে চলে যায় । তখন উদ্ধারকর্তা সেই তো বিশ্বেসরা, পঞ্চামহাজনরা । হুঁকো টানতে টানতে ঘুরে বেড়ায় । কারও নতুন-পাওয়া জমির ধারে এসে বকধার্মিকের মতো উদাসীন ।
— কী চাষ দিচ্ছিস শেখের পো? এট্টু জান মন লাগিয়ে চাষ দিয়ে অবস্থাটা এবার পালটে নে তো বাপ ।
— চাষ করতে টাকা লাগে বাবু । টাকা পাই কোথা?
— তা টাকা নাহয় আমি দিলাম । গায়ে-গতরে খেটে নিজের কপাল ফেরাতে পারবি তো?
শেখের পোর চোখে সন্দেহের সঙ্গে লোভও চকচক করে ।
পঞ্চামহাজন ঘনঘন হুঁকো টানে ।
— সাঁঝ লাগার আগে আমার বাড়িতে এসে তিনশো টাকা নিয়ে যাস । তুই-ই চাষ করবি । তিন টাকা রোজ, আর সকাল-দুপুরে খাওয়া । একা তো পারবি না, আরও জনাকয় মুনিষ লাগবে । ধান কিন্তু আমার গোলায় তুলে দিতে হবে । টিপছাপ দিয়ে টাকা নিয়ে যাস ।
শকুন, শকুন । শুধু গরু মরার অপেক্ষা । জ্যাঠা ঠিকই লিখেছে, সংসারে উকুনের চেয়েও শকুন বেশি । এক উকুনে রক্ষা নেই, তায় আবার শকুন!
দাওয়ায় বসে সদানন্দ বিশ্বাস বুড়ুক-বুড়ুক তামাক খায় । এক চোখে ছানি, সামনের জিনিস ঠাহর করে দেখতে হয় । বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়ের শব্দ শুনে হাঁক পাড়ে, কে যায়?
কোমর ভেঙে হাত জোর করে শিবুখুড়ো বলে, এজ্ঞে আমি কত্তা ।
সদানন্দ শুধু গলার আওয়াজে মানুষ চেনে, শিবু নাকি?
— এজ্ঞে কত্তা ।
যেন কোনও গরজ নেই, একমনে হুঁকো টেনে চলে, লোকটাও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, একসময় বলে, অতটা জমি পেলি, এবার তোর কপাল ফিরবে ।
— আপনাদের আশীর্বাদ কত্তা, আর ভগমানের দয়া ।
যেন আমাদের মতো গরিব-গুরবোদের কপাল না ফেরা পর্যন্ত এদের ঘুম নেই । কপাল ফেরাতে এরা চাষীদের ধার-কর্য দেবে, হিসেবের খাতায় সুদের পাহাড় তুলবে, কত রকম জাল ছড়াবে, তারপর একদিন সেই জালে চাষীর জমিসুদ্ধু টেনে তুলবে । সরকারি বন্দোবস্তে কেউ জমি পেলে, তার শুভাশুভের ভাবনা না ভাবলে এদের চলে? শরীরে দয়ামায়া নেই নাকি? চাষীর হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে কাগজে বুড়ো আঙুলের ছাপ নিয়ে জমিটা বেনামে কিনে যার জমি তাকেই চাষমজুর বানিয়ে তবে এদের ভাত হজম হয় ।
সংসারের মুখে নুড়ো
বাবা গরুর নাদায় জল দিয়ে মাঠে গেছে । গোলাপী লক্ষ্মীপুরের বাস ধরতে এতক্ষণে মাঝরাস্তায় । মা কাঠ চ্যালা করছে । রোদে মুখ-কপাল কুঁচকে গেছে । পদ্ম সাতসকালের রিঠের ফেনায় শাড়ি চুবিয়ে রেখে ঘুঁটে দিতে দিতে গজ গজ করছে । শিলের ওপর আস্ত হলুদ । বাটতে পারেনি তাই রাগ । দুধের বালতি উঠোনে পড়ে আছে । দিদি ঘর নিকিয়ে দুধ নিয়ে বেরোবে । বিশ্বেস বাড়ি, বাঁড়ুজ্যে বাড়ি গিয়ে দুধ মেপে দেবে ।
মা দিদিকে হাঁক দেয়, বলে, দেখিস তো কটা টাকা যদি দিতে পারে । বাঁড়ুজ্যেদের বলিস । নয়তো দু-কুনকে চাল । মাসকাবারে দাম থেকে কেটে নেবে ।
বুড়ো-আঙুলের নখে দায়ের কোপ খেয়ে মা যন্ত্রণায় ঝেঁঝে ওঠে, ইচ্ছে করে সংসারের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে একদিকে চলে যাই । আর ভালো লাগে না ।
সরসীর কুনজর
সরসী মুখের সামনে ছোট আয়না ধরে কাঁচি দিয়ে গোঁফ ছাঁটছিল । দাওয়ায় ওর বউ ছেলেকে বুকের দুধ দিচ্ছে, আমাকে দেখে পিছন ফিরে বসল ।
সরসী মুখ থেকে আয়না সরিয়ে বলল, কলকাতা থেকে পুলিশের লোক এসে নাকি তোর বাপের নাম-ধাম লিখে নিয়ে গেছে? গাঁয়ে আবার ধরপাকড় শুরু হবে নাকি রে ভরত?
স্টেশনের ওপারে সরসীর মনিহারী দোকান । বছর সাতেক আগে রাজনীতির দাঙ্গায় একবার দোকান লুঠ হয়েছিল । সেই থেকে পুলিশের লোক শুনলেই ভয় । আবার বুঝি পার্টিতে-পার্টিতে একচোট লাগবে ।
— পুলিশের লোক, তোকে কে বলেছে?
— শুনলাম তো । পুলিনের মতি-গতি কিন্তু আমার ভালো লাগছে না । গাঁয়ে আবার একটা ঝামেলা না পাকিয়ে ছোঁড়ার শান্তি নেই ।
— বাজে কথা ছাড় । শোন, তোর সঙ্গে আমার একটা পরামর্শ আছে ।
পরামর্শের কথায় সরসী ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে এল । পরামর্শ-টরামর্শ শুনলেই ওর মনে হয় গাঁয়ের কোনও মেয়ের ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা আছে । ওর ওই এক দোষ । মেয়ে দেখলেই ঘুর-ঘুর করবে । সুযোগ-সুবিধে মতো কাছে ঘেঁসবার চেষ্টা করবে ।
— কী, কার ব্যাপার?
— আগে তোমার পদ্মরে সামলাও তো । নির্লজ্জ বেহায়া!
সরসীর বউ পিছন ফিরে বসলে কী হবে, পিঠ খোলা, বাঁ পাশ দিয়ে কচি একটুখানি বুকও দেখা যাচ্ছে । হঠাৎ আমার ওপর এমন ঝেঁঝে উঠল, কারণটা অনুমান করতে পারি । সরসী নিশ্চয়ই পদ্মর ওপর নজর দিয়েছে । সাবানটাবান, সেদিন তো পাউডারও দেখলাম, পদ্ম পাচ্ছে কোথায়?
সরসী কিছু ছেলেমানুষ না, আমার থেকে বছর-দুয়েকের বড়ই হবে । তার কীর্তিকলাপের জন্য তার বউ আমাকে দুষবে, এ তো বড় অদ্ভুত । শুধু পদ্ম কেন, এ-পর্যন্ত গাঁয়ের কোন মেয়েটার কাছে ও ছোঁক-ছোঁক করেনি? গত বছর নদে থেকে সন্ধ্যা এসেছিল, মুকুল বিশ্বাসের ভাগ্নী, বাপকে পুলিশ মিসায় ধরে হাজতে পুরেছে, সংসার অচল, মা লজ্জায় বাপের বাড়ি আসেনি, সন্ধ্যাকে পাঠিয়ে দিয়েছে । সন্ধ্যা অপূর্ব সুন্দরী, আমি ও-রকম দেখিনি । শুধু একটু নেংচে হাঁটে । গরমের দিনে সন্ধেবেলা পুকুরে গা ধুতে গেছে । বাড়ির কাছেই মেহেদির বেড়া দিয়ে ঘেরা পুকুর । দ্বিতীয় কোনও প্রাণীও নেই । আমি একটা মেহেদিগাছের গোড়ায় নিঃশব্দে মাটি খুঁড়ছি । আমাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয় । দূর থেকে ওর নড়াচড়া দেখে মনে হল শাড়ি শায়া গায়ের জামা পাড়ে খুলে রেখে ও একটা গামছা জড়িয়ে জলে নামল ।
অন্ধকারে তিরিশ-চল্লিশ হাত দূর থেকে আমি ওর গা দেখতে পাচ্ছি না । গর্ত খুঁড়ছি আর মাঝে-মাঝে চোখ তুলে শুধু ঠাহর করার চেষ্টা করছি, চান শেষ করে সন্ধ্যা পাড়ে উঠল কিনা ।
পাইপ গানে শাবল লেগে ঠপ করে আওয়াজ হল । আট-দশটা মানকচু পাতা দিয়ে মুড়ে রেখেছিলাম । পুলিনের ছোট ভাই ধরা পড়ার সময় পুলিনকে দিয়ে যায়, পরদিন সন্ধেয় পুলিন এটার দায়িত্ব দেয় আমাকে । কবছর পর যেদিন ভোরে পুলিন রানাঘাট যাবে, সেদিন রাতে জিনিসটা ওর বাড়িতে আমার পৌঁছে দেবার কথা ।
শব্দ শুনে আমি সাবধানে শাবল চালাই । হঠাৎ দেখি, আমার পাঁচ-ছ হাত দূর দিয়ে সরসী হামাগুড়ি মেরে মেহেদির বেড়া ফুঁড়ে পুকুর পাড়ে এসে উঠে দাঁড়াল । পা টিপে-টিপে ও সন্ধ্যার পিছন দিক দিয়ে এগিয়ে যেখানে কাপড় ছেড়ে রেখেছিল তার খুব কাছে গুড়ি মেরে বসে রইল ।
আমার হাতের শাবল থেমে গেছে । চিল চোখে আমি ওই দিকে তাকিয়ে আছি । সন্ধ্যা শব্দ না করে দু-হাতে জল কেটে ঘাটের কাছাকাছি খানিক সাঁতার দিল । তারপর হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে নিশ্চিন্তে পরনের গামছা খুলে নিঙরোয় । গা-মাথা মুছে সবে পাড়ে উঠেছে, সরসী চাপাস্বরে উঃ বাপরে, আমাকে সাপে কেটেছে রে, বলে সন্ধ্যার কাপড়-চোপড়ের ওপর গড়াগড়ি দিতে লাগল ।
সামনেই ব্যাটাছেলে দেখে সন্ধ্যা ভীষণ চমকে উঠে এক ঝটকায় সরসীর পিঠের তলা থেকে শাড়িটাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে গায়ে চেপে ধরে । ভয়ে তার দম আটকে আসে । ঘন-ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলে, কে? কে ওখানে?
সরসী কাঁদো কাঁদো গলায় মিন-মিন করে, তুমি সন্ধ্যা না? আমি সরসী । উঃ জ্বলে গেলাম । আমার হাঁটুতে সাপে ছোবল দিয়ে পাইলেছে । জ্বলে গেলাম রে! হাঁটুর ওপর একটা বাঁধন দাও না গো, শিগগির । শিগগির । দেরি হলে বাঁচব না ।
উঃ লাগছে ছাড়ুন । দাদুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ।
সরসী ওই অবস্থায় খাঁটি আতঙ্কে বিড়বিড় করে ওঠে, তোমার পায়ে ধরছি, লক্ষ্মী মেয়ে, কাউকে বোল না । লক্ষ্মী মেয়ে, তোমার পায়ে পড়ি, তোমার কেনা হয়ে থাকব, ক্রিম, পাউডার, আলতা— আমার দোকানের যা চাইবে তাই দেব, বলো, আমার গা ছুঁয়ে বলো, আজকের সাপে কাটার কথাটা কাউকে বলবে না ।
পাইপগানের ব্যাপারটা না থাকলে, কী করতাম ভগবানই জানে ।
সেই সরসীর বউ কিনা আজ আমাকেই শাসায় । উরে, আমার পতিদেবতা রে! সেই যে দিদি কার্পেটে রঙিন সুতো দিয়ে পতি পরম গুরু লিখেছিল, এখনও ঘরের দেওয়ালে ঝোলে!
সকাল থেকেই আজ মেজাজ খিঁচড়ে আছে । তার ওপর মেয়েছেলের মুখঝামটা । ফুলচাষের কথায় সরসী তো প্রায় ঠাট্টা-ব্যঙ্গই করল আমাকে— দূর, ঢুলির হাতে বাঁয়া-তবলা?
— তোর শালা তো বলিস ফুলচাষ করে বাড়ি তুলেছে ।
— সে হল গিয়ে গুণী ছেলে ।
বিপিন দাসের হিসেব
হাঁটতে-হাঁটতে স্টেশনের রাস্তায় এসে পড়েছি । দোকানের গায়ে, বাড়ির দেওয়ালে লাল কালিতে ছাপা পোস্টার গিজগিজ করছে । রক্ত দিন জীবন বাঁচান । ব্লাড ব্যাঙ্কের পোস্টার, নতুন সেঁটেছে ।
স্টেশন আমাদের কাছে বিদেশবিভূঁই । দোকানের বড়-বড় সাইন বোর্ডগুলোই শুধু চেনা-জানা । গাঁয়ের দু-চারজনের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে দেখা হয়, আর ওই সরসীর দোকান । এখনও তালা ঝুলছে । লাইনের ধারে কাঁখে চালের পুঁটলি নিয়ে একদল মেয়ে-বউ কলকাতার ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে আমাদের গাঁয়ের আলতা আর শ্যামাখুড়িকে দেখলাম । বাকি সব আশপাশের গাঁয়ের । এই যে এত লোক চারদিকে ঘুর-ঘুর করছে, এরা কোনও গাঁয়ের না, বেশিরভাগই এই স্টেশন এলাকার । চাল-চলন কথাবার্তাই আলাদা ।
প্ল্যাটফরমে শাক-সবজির ব্যাপারীরা সার-সার বোঝা নামিয়ে রেখে ট্রেনের অপেক্ষা করছে । জেলেপাড়ার নকুলও শেষপর্যন্ত হকারি ধরল । ঝুড়িতে গুড়ের খাজা সাজাচ্ছিল, আমাকে দেখে বলল, একটা বিড়ি দে তো । আমি একটু পরেই কিনব । বউনি করে তোকে চা খাওয়াব ।
বিড়ি দিয়ে আমি নিজেও একটা ধরাই । নকুল গাঁজার টান দিয়ে কাশতে-কাশতে বলল, আজ পালা দেখতে আসছিস? অমর ভিয়েতনাম । শুনেছি জব্বর হবে ।
— যাব । গুড়ের খাজা তুই নিজে বানাস?
— না, না । নগদে কিনতে হয় ।
বিপিন দাস আমাকে দেখতে পেয়েই ডাকল, ও ভরত! একবার ইদিকে এসো তো ।
আমি কাছে যেতে বলল, তিরিশ পয়সা করে সাতাশ দিনে কত হয়? আর ছত্রিশ পয়সা করে উনত্রিশ দিনে? চারদিন যুগান্তর আনতে পারিনি আর দুদিন আনন্দবাজার পাইনি, তা মাসের খদ্দেরদের কাছে কত পাব?
নকুলের হিতোপদেশ
হিসেব করে দিয়ে আমি বসে-বসে পড়ছিলুম, নকুল দু-হাতে দুটো চায়ের ভাঁড় নিয়ে এল । তার ঝুড়ি চায়ের স্টলে রেখে এসেছে ।
— প্রথম খেপেই এক টাকা তিরিশ নয়া! চালের মেয়েগুলো একেকজন কুড়ি নয়া, তিরিশ নয়া করে নিলে মাইরি!
— সারাদিনে কত হয়?
— এ-রম ভালো বউনি হলে সাত টাকাও হয়, আবার কোনওদিন আড়াই-তিনেই ঠেকে যায় । ট্রেনে আজকাল ঘুগনির যা বিক্রি মাইরি । তুই লেগে পড় না । নে, একটা সিগ্রেট খা ।
খিদে মারতে চায়ের জুড়ি নেই । ঝিমুনি ভাবটা বেশ কেটে যায় । আমি মৌজ করে সিগ্রেট টানতে-টানতে ভাবছিলুম, আরেক ভাঁড় চা হলে মন্দ হয় না, ঠিক তখনই নকুল বলল, ট্রেনের আর দেরি নেই । তুই খুব পয়মন্ত, বোস তোকে আরেক ভাঁড় চা খাওয়াব ।
— একটু খাজাও আনিস । পয়সা নেই কিন্তু ।
চায়ের স্টলের দিকে যেতে-যেতে নকুল ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ওটি পারব না ।
আমার হাতে চায়ের ভাঁড় দিয়ে নকুল দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই শব্দ করে চা খেতে লাগল ।
— চুয়াত্তর নয়া খরচা হয়ে গেল মাইরি । চার ভাঁড় ষাট, আর দুটো সিগ্রেট চোদ্দ ।
আমি মাথা নিচু করে চা খাচ্ছি, নকুল নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, যাক গে বিক্রি-বাটা আজ ভালোই হবে মনে হয় । খাজা খাবি? তোর কাছে দশ নয়া হবে?
— ও আমি এমনি বলেছিলুম ।
— বুঝলি না, ধারে বেচি না তো—
বিপিন দাস বলল, আমি সারা মাস ধারে কাগজ দিই ।
— তোমার হল গিয়ে বাবুদের নিয়ে ব্যবসা । আমার খদ্দের যত চাষী-মজুর । দে ভরত, একটা বিড়ি দে ।
বিড়ি ধরিয়ে নকুল একবার প্ল্যাটফরমে চোখ বুলিয়ে নেয় । তারপর আমার দিকে ফিরে বলে, তোর মাকে তখন চালের মেয়েদের সঙ্গে দেখলুম । চাল ব্ল্যাক করার অনেক ঝুঁকি । পুলিশকে ঘুষ দাও, হোমগার্ডদের ঘুষ দাও, তাছাড়া পুলিশের সঙ্গে ছুঁড়িদের রাতের বন্দোবস্ত থাকে । একেকটা ছুঁড়ির সাজগোজের কী ঘটা মাইরি । বুড়িদের ও-লাইনে সুবিধে নেই ।
— তুই দেখলি? মাকে?
— আমি বললুম, মাসি, এ তোমার কাজ নয় । যা শরীর, একবার শেয়ালদা যেতেই তোমার শ্বাস উঠে যাবে । বলল, দুটো স্টেশন গিয়েই চলে আসব ।
নকুল বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে কাশতে থাকে । থক করে খানিকটা গয়ের ফেলে পরামর্শ দেয়— আমি বলি, হয় ঘুগনি ফিরি কর, নয় তো চালের লাইনে থাকতে হলে পদ্মকে লাগা ।
আমি চায়ের ভাঁড় মাটিতে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে গুঁড়ো করি ।
ভাঁড় কুড়ুনি বোবাকালা
বোবাকালা কাছাকাছি কোথাও ছিল ভাঁড় গুঁড়োতে দেখে আঁ-আঁ করে ছুটে এল । আমার পায়ের কাছে বসে মুখ দিয়ে জন্তুর মতো আর্তনাদ করে আর কপাল চাপড়ায় । কুকুরের বাচ্চা, সারাদিন রাস্তার চায়ের দোকানে, স্টেশনে শুধু মাটির ভাঁড় কুড়িয়ে বেড়ায় । আমার আগের ভাঁড়টায় অনেকক্ষণ ধরে একটা মাছি বসে বসে আজ্ঞে হেঁ-হেঁর ভঙ্গিতে দু-হাত কচলাবার মতো সামনের দুটো ঠ্যাং মুখের কাছে তুলে ঘষছিল, সেটাও আমি আছড়ে ভাঙলাম । বোবাকালা বর্শা-বেঁধা শুয়োরের মতো উৎকট আওয়াজ বার করে । বোবাকালাই বটে । কালাচাঁদ নামে ওকে বোধহয় ওর মাও আর ডাকে না । আমার পায়ের কাছ থেকে খোলামকুচিগুলো নেবার চেষ্টা করছিল, উঠে দাঁড়িয়ে এক লাথি কষাই ।
খানসেনাদের ব্যাটা
স্টেশনের থেকে বেরোবার মুখে জয়বাংলাকে মোট বইতে দেখে আমি হুঙ্কার করে উঠি, জয়বাংলা! আমার মাথায় যেন বাজ ডাকছে । ইয়ের বাচ্চা রিকশা থেকে বিশ্বেসদের মাল নামাচ্ছে । এই বড়-বড় পোঁটলা, বিরাট তালা লাগানো ট্রাঙ্ক, ঝুড়িভর্তি ফল-ফলারি, মুখবাঁধা গুড়ের কলসি । মেয়ে-জামাইকে একেবারে গাঁ উজোড় করে দিয়েছে । মেয়েটা ঘোমটার মধ্যেই ফ্যাচ-ফ্যাচ করে ঢঙের কান্না কাঁদছে । ছোট বৌদির সাধের নেমন্তন্নে এসেছিল, কাল একেবারে হরির লুঠ দেখে বাবুবিবি আজ কলকাতায় ফিরছেন, আহারে, বুড়ো বাপ-মাকে ছেড়ে গাঁ নিংড়ে জিনিসপত্তর নিয়ে যাবার সময় একটু দুঃখ হবে না? মেয়েটার বরটা রুমাল দিয়ে বার-বার মুখ মুছছে আর জয়বাংলাকে ধমকাচ্ছে, আঃ । সাবধানে তোল । অ্যাই । ফেলবি নাকি? নিচু হ, নিচু হ! এক ফোঁটা গুড় মাটিতে পড়লে তোর মুণ্ডু গুঁড়িয়ে দেব রে হতভাগা ।
মুখভরা বসন্তের দাগ, ঘন-ঘন রুমাল ঘষছে ।
— ভুনি, ওরকম করে কাঁদিস না ।
মুকুল বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরাদরি করে ।
মুকুলের বোন কাছে সরে এসে কাঁদতে-কাঁদতেই বলে, এরা কি ডাকাত নাকি? দুটো রিকশায় দু টাকার এক পয়সা বেশি দিবি না । ছোড়দা, আবার সেই কবে আসব! তোর ছেলে হলে ষষ্ঠীতে গিয়ে নিয়ে আসিস ।
— সে হবে’খন । এখুনি ট্রেন এসে যাবে । তুই স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে বোস । নন্দ, তুমি গিয়ে টিকিটটা করে রাখো । আপ ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে ।
লোকটা বসন্তের দাগ ঘষতে-ঘষতে এগোয় । মুকুল রিকশাওয়ালার দিকে ফিরে বলে, গজা না? রিকশার মালিক হয়েছিস বলে কি ধরাকে সরা ঠাউরেছিস নাকি রে? ব্যাঙ্কলোন পেয়ে ভেবেছিস দেশটা মগের মুলুক হয়ে গেছে! এক থাবড়ায় সবকটা দাঁত ফেলে দেব ।
গজা এতক্ষণ ব্রেক চেপে রেখে মাল নামানোর সাহায্য করছিল, দুহাত ছেড়ে দিয়ে মুকুলের মুখের সামনে গিয়ে বলল, মারেন তো, দেখি কত জোর আপনার থাবায় । কই মারেন— কটা দাঁত ফ্যালতে পারেন দেখি—
অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে দাঁতের পাটি মুকুলের মুখের কাছে তুলে ধরে ।
— এত সাহস ভালো নয় গজা!
— সাহস আর কী দ্যাখলেন? গায়ে হাত দিলে দ্যাখতে পেতেন ।
— এই জয়বাংলা!
আমার গলা শুনে মুকুলের বোন ঘোমটা সরিয়ে হাউ-হাউ করে ওঠে, এটা না, এটা না, ভরত, ওই বদমাশটা! ছোড়দাকে মেরে ফেললে রে ।
ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমি এক হ্যাঁচকায় জয়বাংলার ইজেরের পিছন ধরে টান মারি ।
নিচু হয়ে মস্ত একটা রুই তুলছিল, হ্যাঁচকায় কানকোর ছড় খুলে মাছটা ধপ করে ধুলোর ওপর পড়ল ।
— ফের তুই ওদের মোট বইছিস?
— মা বলেছে ।
— চল, আজ তোর মার একদিন কি আমারই একদিন । মুকুল, এর পয়সা মিটিয়ে দাও ।
মেয়েটা মিনমিন করে— ভরত, তোর এসব কেমনধারা কথা? তুই আমাদের গাঁয়ের ছেলে, বিপদে পড়ে তোর সাহায্য চাইছি, আর তুই-ই কিনা—
— চোপ!
মুকুল লাফ মেরে আমার কাছে আসে । বোনকে ঝেঁঝে ওঠে— তখন থেকে বলছি স্টেশনে গিয়ে বোস, কথা গ্রাহ্য হয় না!
আমি বললাম, জয়বাংলার পয়সা মিটিয়ে দাও!
— বাকি মাল কটা স্টেশনে তুলে দিক, পয়সা দিয়ে দেব ।
— মাল আর বইবে না । ভাড়া দাও ।
— ভরত, তুই কিন্তু একটু বাঁকাট্যারা কথা বলছিস! ফলটা ভেবে দেখলে ভালো করতিস ।
— চোপ, শালা, সুদখোরের বাচ্চা । পয়সা ফ্যাল!
মুকুল কী একটা বিড়বিড় করতে করতে পয়সা বার করে দেয় ।
পয়সা নিয়ে আমি জয়বাংলাকে টানতে-টানতে ফাঁকায় নিয়ে আসি ।
— তোর বাপ কে জানিস?
— হ্যাঁ ।
— কে?
ওর চুলের মুঠি আমার হাতে । সেই অবস্থাতেই চোখ তুলে বলল, খানসেনারা ।
— তা খানসেনার ব্যাটা— নেড়ি কুত্তার মতো বিশ্বেসদের লাথি খেতে লজ্জা করে না? যা ভাগ—
মাথাটা ঝাঁকিয়ে আমি ওকে ছেড়ে দিই । পয়সা গায়ের ওপর ছুড়ে ফেলি ।
থিয়েটারের পুলিশ
এ তো একেবারে মঞ্চ বেঁধে থিয়েটার । ভিড় করে দেখতে এসেছে সব । আমাদের গাঁয়ের প্রায় সবাই দেখছি দিব্যি জায়গা দখল করে বসে গেছে । তাঁতিপাড়ার ফুলমনি ওর তিন বৌদির সঙ্গে একেবারে সামনের দিকে । মুকুল ফটফট এদিক-ওদিক ঘুরছে-ফিরছে, ওদের বাড়ির শুধু ও-ই এসেছে । আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভিড়ের মধ্যে সরে গেল । বাবা সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে বসেছে । মুখ হাঁ করে নাটক দেখছে । দিদি, গোলাপী, পদ্ম সামনে মেয়েদের দিকে । সরসী ওর বউয়ের তিন-চার হাত পিছনে স্টেজের দিকে মুখ তুলে রেখে ঘন-ঘন সিগারেট টানছে । একটা ভিয়েতনামী মেয়েকে চারজন লালমুখো সোলজার জাপটে ধরে টেনে-হিঁচড়ে কোথাও নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, মেয়েটা চিৎকার করে ওদের গালাগাল দিচ্ছে, পা দিয়ে লাথি মারছে, কামড়ে দেবার চেষ্টা করছে । এইসময় সরসীর দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, মেয়েটাকে ও পর-পর চোখ মেরে যাচ্ছে । আমার দিদি আঁচলে চোখ ঢেকেছে ।
মা আসেনি । এতক্ষণে ঘরে হুড়কো দিয়ে ঘুমোচ্ছে হয়তো । শেষ বেলায় ফিরেছে । আমি কথা বলিনি । ‘নে গেল’ বলে সামনে ভাতের থালা নামিয়ে রেখে যেতেই আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই ।
আমার ছোটবেলায় মার খুব যাত্রা-থিয়েটারের শখ ছিল । আমাকে নিয়ে দূর-দূর গাঁয়ে দেখতে যেত । দিনের আলো থাকতে-থাকতেই রাতের খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে রওনা দিতাম । লণ্ঠন জ্বালিয়ে পলতেটা খুব ঢিমে করে মা একা আমার হাত ধরে দু-পাঁচটি গাঁয়ের মাঠ ভাঙত । মাঝরাতে ফেরার সময় পলতে বাড়িয়ে দিত । মার এক হাতে লণ্ঠন, আরেক হাত আমি শক্ত করে ধরে থাকতাম । আলোর দুলুনিতে চারপাশের খাঁ-খাঁ মাঠ-ভরা অন্ধকার এমন বিচ্ছিরিভাবে নড়ে-নড়ে উঠত, ভয়ে আমি অনেক সময় চোখ বুজে হাঁটতাম । মার শরীরের সঙ্গে সেঁটে ।
একটা ছেলে যুদ্ধে যাবে, তার মা তাকে বার-বার কপালে চুমু দিচ্ছে । কী উৎকট দুর্গন্ধ রে বাবা । কারও নিশ্চয় পেট গরম হয়েছে । আমি ধুতির খুঁটে নাক টিপে বসে থেকে এক সময় উঠে পড়ি । স্টেজের পিছনে দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা গ্রিনরুম! অনেকে সেজে তৈরি হয়ে বসে আছে । কয়েকজন তখনও সাজছে । সহদেবকে প্রায় চেনা যায় না । মনে হচ্ছে, ঠিক সত্যিকার পুলিশ । আমাকে দেখে বলল, সিগ্রেট আছে?
আমি বিড়ি বার করি, একটাই আছে ।
— না, বিড়ি না, একটা সিগ্রেট খেতে চাই ।
সহদেবের বুড়ি পিসি গ্রিনরুমে ঢোকে । লাঠি ঠুকে-ঠুকে এসেছে । হাঁফাচ্ছে । দাঁত নেই । হাঁফাতে হাঁফাতে ফক ফক করে যা বলল তার মানে, সহদেবের বউয়ের এখন-তখন অবস্থা, চোখ উলটে গেছে । মরা একটা ছেলে বিইয়েছে, এত বড় মাথা ।
সহদেব আমাকে ছাড়তে চায় না । কেঁদে ফ্যালে আর কি । কুম্ভদা ছাড়বে কেন, ঘড়ি দেখে বলল, বউকে দেখে তাড়াতাড়ি ফিরবি । এক ঘণ্টার মাথায় তোর পার্ট ।
মাঠ ভেঙে আমি আর সহদেব দৌড়তে থাকি । বুড়ি অনেক পিছনে লাঠি ঠুকে-ঠুকে আসছে । এক সময় ওর লাঠির শব্দ আমরা ছাড়িয়ে যাই ।
সহদেব ছুটতে ছুটতে হাঁফায় আর মাঝে মাঝে বলে ওঠে, হায় ভগবান!
মাঝমাঠে পৌঁছে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি । পুলিন রিভলবার উঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠে, শালা, বেইমান, পুলিশের কুত্তা!
সহদেবের বুক তাক করে দাঁত চিবোয়, হাত তুলে থাক!
আমি দরদর করে ঘামছি ।
— পুলিশ নয়, পুলিশ নয়, ও সহদেব!
এত হাঁফাচ্ছি, আর পুলিনের টিপ আমি জানি, ভয়ে আমার মুখ দিয়ে ঠিক মতো কথা বেরুচ্ছে না ।
পুলিন গর্জন করে ওঠে, হাত নামলেই গুলি করব, শালা শুয়ারকা বাচ্চা! কেউ এক পা এগোবি না!
আমি আবার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, পুলিন ধমকে ওঠে, চোপ শালা! স্টেশনে কলকাতার ছোকরাকে তোর খোঁজ করতে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল । শাললা! তলে-তলে এতদিন এই মতলব আঁটা হচ্ছিল । তোর বাপের কাছে খবরের কাগজের লোক এসেছিল, বেইমান! আমাকে ধোঁকা দেওয়া?
মাথার ওপর হাত তুলে রেখে আমি দম নিয়ে বলি, পুলিন, ও আমাদের সহদেব । থিয়েটারে পুলিশ সেজেছে ।
সহদেব হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে, আমার বউ মরে গেছে রে পুলিন!
পুলিন রিভলবার উঁচিয়ে আমাদের কাছে আসে । ভালো করে সহদেবকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে ।
পিছনে লাঠির ঠকঠক শুনতে পাই । সহদেব পুলিনের হাত জড়িয়ে ধরে, তুই-ও একটু চ’ আমাদের সঙ্গে । বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে আমার বউ—
কথা বলবে কী, হাউ-হাউ করে কাঁদে ।
আমি বললাম, কে আমার খোঁজ করছিল বললি?
হাঁটতে হাঁটতে পুলিন আমাদের সিগ্রেট দেয় । নিজে ধরায় । সহদেব কান্না থামিয়ে ফোঁস-ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর সিগ্রেট টানে ।
— একই ট্রেনে এসেছে । কলকাতা থেকে । ঝকঝকে শার্ট, বেলবটম প্যান্ট । মনে হয় বড়লোকের ছেলে, কাত্তিক-কাত্তিক চেহারা । রিকশাওলাকে তোদের বাড়ি চেনে কিনা জিজ্ঞেস করছিল । কে রে ছোকরা?
নিশ্চয় বিকাশ । আজ তো ষোল তারিখ । বললাম, বিকাশের আসবার কথা ছিল । টাউন স্কুলে পড়ত আমার সঙ্গে ।
— যার বাবা সরকারি রিলিফের টাকা খেয়েছিল?
— ওইরকম কিছু হবে । ছেলেটা ভালো । সুন্দর আবৃত্তি করত ।
— তা এতদিন বাদে?
— এমনি, বেড়াতে ।
এটা কি একটা বেড়াবার মতো জায়গা । আমার সন্দেহ হচ্ছে । একটু চোখে চোখে রাখিস তো ।
সহদেব পুলিশের টুপিটা খুলে হাতে নেয় ।
আমার তাহলে আর যাওয়া হয় না । বাড়িতে মা একা । বিকাশকে চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ ।
— সহদেব, পুলিন তোর সঙ্গে থাক, আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে ।
— হায় ভগবান! হায় ভগবান! ও-হো-হো-হো!
সুখের ভাগ
বিকাশকে আমারই চিনতে কষ্ট হয় । ঠিক সিনেমার হিরোদের মতো দেখতে হয়েছে । হাতে একটা সুটকেশ, উঠোনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, আমি প্রায় দৌড়ে এসে ওর সামনে লাফিয়ে পড়ে হেসে ফেলি । তারপর নিচু দরজা থেকে সাবধানে ওর মাথা বাঁচিয়ে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললাম, তুই একটু বোস, আমি তোর খাবারের ব্যবস্থা করে আসি । দেখি কী পাওয়া যায় ।
— কিচ্ছু দরকার নেই । আমি রাতের খাবার খেয়ে এসেছি ।
— বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস । চল, তোকে জল দিই, হাত-মুখ ধুয়ে নিবি ।
— দরকার নেই । তুই দুটো গেলাস নিয়ে আয় । আর খাবার জল ।
— সে দিচ্ছি । তুই পা ধুবি না?
— দূর, মোজা পরা আছে, ঠিক আছে । দুটো গেলাস নিয়ে আসতে পারিস?
— দুটো দুহাতে ধরে চুমুক দিবি?
আমি হেসে ফেলি । বিকাশ সুটকেশ খোলে । জিনিসপত্রে ঠাসা । দামি জামা-প্যান্ট, একটা ক্যামেরা, পাশে ওটা কী? আমি অর্ধেক জিনিস চিনিই না ।
বললুম, রেডিও অত ছোট?
— এটা টেপ রেকর্ডার-কাম-রেডিও । টু-ইন-ওয়ান ।
বিকাশ চালিয়ে দিতে ঝমঝম করে ইংরিজি বাজনা বেজে উঠল ।
— টেপ রেকর্ডার এখানে কী কাজে লাগবে?
সুটকেশের তলা থেকে বিকাশ একটা সুদৃশ্য বোতল বার করে বলল, তেমন কোনও পাখির ডাক-টাক পেলে তুলে নেব ।
একপাশে কয়েকটা বই । বই সরিয়ে লুচির মতো গোল একটা কাচ-কাগজের পুরু প্যাকেট বার করে বিকাশ দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়ল । ভেতরে বেলা-লুচির মতো পাতলা, কাঁচা কী যেন, একটার পর একটা সাজানো । গোলাপী রঙের ।
আমাদের ডাকাডাকিতে সেই যে ঘুম ভেঙেছে, মা আর শোয়নি । ভাবনায় ডুব দিয়ে বসে আছে । অন্যমনস্ক ভাবে দাঁতে নখ কাটছে । আমাকে কুঁজো থেকে জল ঢালতে দেখে বলল, ঘরে এক মুঠো চাল নেই, তার ওপর অতিথ!
ছোটবেলায় বিকাশকে মা কত তালের বড়া খাইয়েছে । লক্ষ্মীপুজোয় নারকেল নাড়ু । জলের ঘটি নিয়ে চলে আসতে আসতে বললাম, ওর জন্য তোমাদের ভাবতে হবে না ।
সিগ্রেটের নাম ডানহিল । এরকম প্যাকেট আমি আগে দেখিনি । সুজলাবৌদির বাপের বাড়ি চন্দন কাঠের ছোট্ট বাক্স দেখেছিলাম, সেইরকম মজবুত, মসৃণ । রং-নকশা ভারি সুন্দর । মাথার ডালা খুলে বাক্সটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বিকাশ বলল, কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
— মা তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল ।
— তোর বোনেরা কি ঘুমোচ্ছে? এতদিনে নিশ্চয়ই সব মহিলা হয়ে গেছে? বিয়ে হয়েছে?
— থিয়েটার দেখতে গেছে ।
বিকাশ চৌকো বোতলটায় মুখ লাগিয়ে একটুখানি চুমুক দিল । মদ নাকি? বোতলের গায়ে বড় বড় ইংরিজি অক্ষরে লেখা ভ্যাট ৬৯ ।
— আরেকটা গেলাস আন ।
— জিনিসটা কী?
— মধু ।
— যাঃ! মধু ওভাবে চুমুক দিয়ে খায় না ।
তুই গেলাস নিয়ে এসে বোস তো । কতদিন পর দেখা । কী করছিস-টরছিস শুনব । জলদি যা । তোর সঙ্গে অন্য কথাও আছে ।
গেলাস এনে আমি দরজাটা ভেজিয়ে দিই ।
মধুই বটে! গাঁজলা-ওঠা তাড়িও এর কাছে কিছু না । চ্চাং করে কান-গলা ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠে, কয়েক চুমুক খাবার পর বেশ হালকা-হালকা লাগে । আমার মন ভালো হয়ে যায় । এ নিশ্চয়ই বিলিতি মদ ।
বিকাশকে ভালো করে দেখি । একেবারে সাহেবদের মতো চেহারা । কী রং, কী স্বাস্থ্য । কী দারুণ সুখে আছে! ব্যাটার মনটাও ভালো । কবেকার কোন পাড়াগাঁর বন্ধুকে ঠিক মনে রেখেছে । এতদূরে এসেছে নিজের সুখের ভাগ দিতে । একেকটা সিগ্রেটের কত দাম কে জানে । ফটফট করে বাড়িয়ে দিচ্ছে । লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিচ্ছে । আগুনটাও যেন বিলিতি ।
ঝিক্কা-ঝিকা ঝিক্কা-ঝিকা
কাঁচা লুচির মতো জিনিসটা তো অমৃত । দেখতে কাঁচা, আসলে নুন-মশলা দেওয়া মাংস । রাঁধে কী করে কে জানে ।
বিকাশ সুটকেশ থেকে এরকম আরেকটা প্যাকেট বের করে বলল, অনেক আছে, খা । ব্যাগেও খাবার আছে ।
লম্বা চুমুকে গেলাসটা খালি করে দিয়ে আমি বিকাশের দিকে বাড়িয়ে দিলাম ।
জীবন যে এত আনন্দের আমি শালা অ্যাদ্দিন জানতেই পারিনি । শুধু সিগ্রেটের ধোঁয়াতেই এত স্বাদ!
আমি ওর দেখাদেখি এবার তিন-চারটে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে বললাম, এই বোতলটার দাম কত?
নিজের গেলাসে ঢেলে বোতল উপুড় করে বাকিটা আমার গেলাসে ঢালতে ঢালতে বিকাশ বলল, আমি দুশোয় পাই ।
— কয়েক ঘণ্টায় দুশো টাকা খেয়ে ফেললুম!
— তোকে ভাবতে হবে না । আরও আছে । আমার ব্যাগটা দে এদিকে—
আমি ওর হাত জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই আমাকে দুশো টাকা দিবি? আমি ফুলের চাষ দেব । ফুলচাষে অনেক টাকা । ফুল বেচে আমি তোর টাকা শোধ করে দেব ।
— জমি তৈরি করবি, গাছ লাগাবি, ফুল ফোটাবি, তারপর ফুল বেচবি— কত টাকা পাবি?
— একেক মরসুমে একেক ফুল । বছরে পাঁচ-ছটা চাষ দেব । হাজার অব্দিও পেয়ে যেতে পারি ।
— বছরে?
— হ্যাঁ, এক বছরে এক হাজার টাকা!
— চাকরি করবি?
— অনেক ঘুরেছি । সব শালা ইয়ের বাচ্চা ।
— করবি কিনা বল!
— কে দেবে?
— আমি ।
— সত্যি? তোকে শালা ভগবান পাঠিয়েছে!
আমি ওর পা ছোঁবার চেষ্টা করি । বিকাশ পা সরিয়ে নিয়ে বলল, তোর নেশা হয়ে গেছে ।
— একটুও না, মা কালীর দিব্যি । বিশ্বাস কর ।
— কত মাইনে চাস?
— পঞ্চাশ-একশো, যা দিবি ।
— দূর । একশো টাকায় আজকাল মাসের চায়ের খরচও হয় না । পাঁচশোয় শুরু কর, তারপর দেখা যাবে ।
মাসে? কেউ যদি আমাকে একটু তুলে দেয়, আমি হ্যাঁচকা তালে নাচতে পারি ঝিককা-ঝিকা ঝিককা-ঝিকা ঝিককা-ঝিকা— দোলের দিন মেথরপাড়ায় সবাই কী সুন্দর নাচে!
গলা ছেড়ে গান ধরি, অ্যাদ্দিন গেল যেমন-তেমন, এই বছরেই দুঃখ হরণ । খ্যাপাচাঁদু গো, খ্যাপাচাঁদু, এবার উলটো করে গাও না দাদু ।
খাবারের বাক্স
দরজা ঠেলে বাবা ঘরে ঢোকে । বাবার পিছনে পদ্ম, গোলাপী, দিদি মুখ বাড়ায়!
আমি বললুম, বাবা, আমার পাঁচশো টাকার চাকরি হয়েছে । মাসে পাঁচশো টাকা । বিকাশ সব ব্যবস্থা করে দেবে ।
বিকাশ একমুখ হাসি ফুটিয়ে বলে, আপনি ভালো আছেন, মেসোমশাই?
বাবা সুটকেশ থেকে চোখ তুলে বলল, তোর সেই বন্ধু না? তা খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই?
— কিচ্ছু না, কিচ্ছু না । মেসোমশাই আপনি বসুন, আজ আপনাদের একটা জিনিস খাওয়াব । তোমরাও এসো ।
বিকাশ সুটকেশ থেকে বড় একটা কাগজের বাক্স বার করল । দিদি, গোলাপী, পদ্ম বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি দিদির থুতনি নেড়ে দিয়ে বললাম, আর-কটা দিন থাকো দিদি কেঁদে কঁকিয়ে, নতুন বরের সঙ্গে তোমার দেব নতুন বে ।
বিকাশ পদ্মদের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা গেলাস নিয়ে এসো তো । আর একঘটি জল ।
এসব খাবারের নামও জানি না । বাক্স খুলে বিকাশ বাবাকে দেয়, আমাকে দেয়, তারপর সামনে নামিয়ে রেখে বলে, খেয়ে দেখুন তো, কেমন লাগে । তোমরাও এসো, হাত লাগাও ।
বাবা মুখে খাবার নিয়ে হপ-হপ করে বলে, অত করে বলছে, আয় না, খেয়ে দ্যাখ, খুব দামি জিনিস ।
বিকাশ আরেকটা বোতল বের করে গেলাসে মদ ঢালে । বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, বলুন তো কী?
— শরবত?
— এটা না, যেটা খাচ্ছেন?
— মাছ-মাছ লাগছে ।
— হল না, তুমি বলো ।
গোলাপীর দিকে তাকায় ।
— মাছই তো । আপনি তো কই খাচ্ছেন না?
— আমি আর ভরত অনেক খেয়েছি । তুমিও পারনি । তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কে?
দিদি পদ্মকে দেখায় ।
— ও । আমি বোধহয় ওকে পাঁচ বছরের দেখেছি, সারা গায়ে ধুলো মাখতো । কী, মাছ?
— মাংস বোধহয় ।
— কাছাকাছি । মুরগি । হাড় বের করে ফেলে প্রিপেয়ার করে ।
— এইটে পাঁঠার মাংস, খেয়ে দ্যাখ —
লুচির মতো জিনিসটা আমি পদ্মর দিকে এগিয়ে দিই । দিদির কাছে প্যাকেটটা দিয়ে বললুম, খুব সুন্দর । খা একটা । বাবাকে দে— গোলাপী, তোকে আর পাঁপড়ের বেসন ঘাঁটতে হবে না ।
বাবা একহাতে বাক্স থেকে মুখে পুরছে, আরেক হাতে গেলাস । মাঝে মাঝে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকছে ।
বিকাশ বাবাকে সিগ্রেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, চুমুক দিন ।
বাবার উত্তেজনা
বাবা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে গ্লাসে চোখ রাখে— তাড়ি নয় তো বাবা?
— দূর । সাহেবরা আমাদের মতো তাড়ি খায় নাকি? মেম-সাহেবরা নিজের হাতে বানিয়েছে । খেয়ে দেখুন, শরীর ভালো হয়ে যাবে ।
সারা জীবন বাবা কীই বা খেয়েছে! আমি বললুম, এক বোতলের দামই দুশো টাকা ।
বিকাশ শার্টের বোতাম খুলছিল, বাবা গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল, পদ্ম, একটা পাখা এনে বাতাস কর । ওনাদের এত কষ্ট করে থাকার তো অভ্যেস নেই ।
গোলাপী আগেই উঠে গিয়েছিল, চোখে-মুখে জল দিয়ে এসে বাবাকে দেখল, বলল, তুমি আবার ওসব খেতে গেলে কেন?
বাবা গায়ে মাখল না । তিন চুমুকে গেলাস খালি করে খানিক ঝিম মেরে থেকে বলল, জিনিস ভালো ।
— তোমার না বুকের ব্যামো?
— সব সেরে যাবে । বিলিতি ফলের রস রে । বড় দামি জিনিস ।
আমি বললুম, দে বিকাশ, আমাকে একটু ফলের রস দে ।
গেলাসগুলো একে একে ভরে দিচ্ছিল, মুখ না তুলে বলল, এতে স্বাস্থ্য ভালো হয় । তোমরাও খেতে পারো । গেলাস নিয়ে এসো—
— আমরা গাঁয়ের মেয়ে, বিলিতি জিনিস পেটে সইবে না!
বিকাশের চোখ ধ্বক করে ওঠে, সারা মুখ ঝকঝক করছে । খপ করে পদ্মর পাখাসুদ্ধু হাতটা ধরে বলল, তিনটে গেলাস নিয়ে এসো । দেখি কেমন না সয়!
পদ্ম পাখা রেখে উঠে যায় । বাবা আমতা-আমতা করে, থাক বাবা, বছরভর গেঁড়ির ঝোল খাই, ওর যখন ইচ্ছে নেই—
— মেসোমশাই, সামান্য একটা মেয়ে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলবে, অসহ্য । এ আমি কখনও সহ্য করিনি ।
বাবা বেকুবের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, তা তো বটেই । তা তো বটেই ।
গোলাপী হিল-হিল করে ওঠে, বাপ-ব্যাটায় বসে বসে মদ গিলছো, তোমার লজ্জা করে না?
গেলাসে চুমুক দিয়ে বাবা হঠাৎ গর্জে ওঠে, তোর বাপের পয়সায় খাচ্ছি?
দিদি প্রথম থেকেই বিকাশের মুখে অত কী দেখছে কে জানে । আমার যতবারই চোখে পড়েছে, দেখি অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে । গোলাপী আবার কী বলতে যাচ্ছিল, দিদি শান্ত গলায় বলল, তুই চুপ কর গোলাপী । ভরতের বন্ধু, খারাপ কিছু তো দেবে না ।
গোলাপী দিদির দিকে ফেরে, তোদেরও বলিহারি! শুতে যাবার নাম নেই, রাতদুপুরে সেজেগুজে এখানে এসে বসে আছিস । বেহায়া কোথাকার!
দিদির মনটা বড্ড নরম, বকুনি সইতে পারে না, ওর মুখে কষ্টের ছাপ পড়ে । বিকাশ হঠাৎ হাতজোড় করে ক্ষমা-চাওয়া নকল করে, ক্ষমা দাও রণ-রঙ্গিণী ।
স্বর বদলে বলে, বোসো তো । তখন থেকে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছ ।কতকাল পর দেখা বলো তো, একটু গল্প-টল্প করে শুতে যেও । আমি তো আর রোজ-রোজ আসব না ।
বাবা ঘন-ঘন চুমুক দেয় । গেলাস খালি করে বলে, দাও বাবা, আরেকটু দাও ।
এক হাতে গেলাস নিয়ে বাবা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে দিদির কাছে আসে । কপালে গুঁড়ো-গুঁড়ো ঘাম জমেছে । বাবাকে আজ একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে । এই ধরনের উত্তেজনা আগে কখনও আমি বাবার গলায় শুনিনি ।
— ভরত মাসে-মাসে পাঁচশো টাকা পাচ্ছে । আর কিসের ভয়? তুই দেখিস এবার সে-ব্যাটাকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব । হাত ভেঙে দেব । না-পারি তো আমার নাম পেহ্লাদ পদ্মরাজ নয়!
পদবীটা প্রায় গলা চিরে বলল ।
আমার আবার খুব ভালো লাগতে শুরু করেছে । আগামের কথায় বললাম, আমাকে কিছু টাকা আগাম দিবি তো?
— পুরোটাই, যদি চাস ।
— কলকাতায় একটা ঘর দেখতে হবে ।
— সেসব ঠিক করে দেব । কাল তো আমি থাকছি, তখন কথা হবে । কী গোলাপী, থাকতে দেবে তো?
— আপনার ইচ্ছে ।
বলে গোলাপী উঠে যায় ।
— এক নম্বরের গোঁয়ার । গেঁয়ো ভূত, বিকাশের মতো ছেলের সঙ্গে লাগতে আসিস! পাশের ঘরে পদ্মর সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে । সারাজীবন ওই নিয়েই থাক তোরা । আমি তো কলকাতায় । তিরিশ দিনে পাঁচশো । দিনে কত হয়?
বাবার সামনে সিগ্রেট খেতে পারছি না । একেবারে ক্ষেপে গেছে । হাত মাথা নেড়ে নেড়ে দিদির শ্বশুরকে খুব গালিগালাজ করছিল, গেলাসটা ঠক করে নামিয়ে রেখে বলল, ফাঁসিতে ঝোলাব! হাত গুঁড়িয়ে দেব! আমার মেয়ের গায়ে হাত দিস— এত তোদের সাহস!
দিদি বসে বসে ঢুলছিল, বাবার চিৎকারে উঠে দাঁড়ায়, চলো বাবা, এবার শুতে চলো ।
— শালা শুয়োরের বাচ্চাদের শেষ করে দেব!
দিদি বাবার হাত ধরে টানে, এখন চলো তো । তুমি ঠিক অসুখ বাধাবে ।
বাবা দিদির গায়ে ভর দিয়ে বেরিয়ে যায় ।
বিকাশ ঢেঁকুর তুলে বলল, তোদের বাথরুমটা কোন দিকে?
— চ, আমার সঙ্গে । ওটা নে, ওই সিগারেটের প্যাকেটটা ।
আমার পা টলছে । বিকাশের কাঁধে হাত রেখে নেবুতলার দিকে যেতে যেতে বললাম, দারুণ নাটক লিখেছি । তুই অবাক হয়ে যাবি ।
— তোর বাবা কাকে খিস্তি করছে?
— দিদির শ্বশুরবাড়ির লোকদের । সিগারেট দে ।
বিকাশ সিগারেট ধরিয়ে দেয় ।
— ও কি বেড়াতে এসেছে?
— এখানেই থাকে । তুই চাকরিটা দে, আমি সব ব্যাটাকে দেখে নেব ।
— মেয়েটা ভালো । তোদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্বাস্থ্য ।
—কিরম করে হাত ভেঙে দিয়েছে যদি দেখিস—
গোলাপী উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকে, শিগগিরি আয় ভরত, মা ফিট পড়েছে ।
তৃপ্তির ঢেঁকুর
মা আর দিদির সকাল থেকে ফুরসত নেই । এখানে ঝাড় দিচ্ছে, ওখানে গোবর নিকোচ্ছে । থালা-বাসন ধুয়ে পরিষ্কার করছে । একপাশে বমি-মাখা কাঁথা-চাদর ডাঁই করা । দিদি বলল, বাবা বিছানায় শুয়েই কাল খুব বমি করেছে । একটু পরে কাচতে পুকুরে নিয়ে যাবে । আমাদের এরকম তকতকে উঠোন দেখলাম দশ-পনেরো বছর পর ।
বাবা গরুর নাদায় জল দিতে দিতে নিজের মনে বকবক করছিল, আমাকে দেখে বলল, এক জোড়া বলদ কিনতে হবে । ক-মাস পর উত্তরের ভিটেয় তোর জন্য একটা ঘর তুলব । আঃ, হারামজাদা । ল্যাজের ঝাঁপর দিচ্ছে দ্যাখো ।
পদ্ম আজ নিজে থেকে উনুনের ধারে । ডেকচিতে জল ফুটছে । পদ্ম ঝুঁকে পড়ে জলে চায়ের গুঁড়ো ঢেলে দিয়ে হাতা দিয়ে খুব নাড়ছে ।
বিকাশের গলা পেয়ে দিদি আমাকে বলল, ওই যে, জল রেখেছি ।
ঝকঝকে পিতলের ঘটি । ঘরে ঢুকে দেখলাম, বিকাশ বিছানার ওপর বসে হাই তুলছে । আমার দিকে দুটো দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুই বাজারে যা । চাল-ফাল যা লাগে কিনবি । বড় মাছ পাওয়া যায়? যা পাস নিয়ে আয় । আমি আরেকটু ঘুমোব ।
বিকাশ আবার শুয়ে পড়ল ।
দুটো বাটিতে ধোঁয়া-ওঠা চা নিয়ে পদ্ম ঘরে ঢোকে ।
— চা কোথায় পেলি রে?
পদ্ম আমার কথায় উত্তর না দিয়ে বিকাশকে বলল, কই উঠুন । জুড়িয়ে যাবে ।
— দূর, আমি সকালে চা খাই না ।
— আপনার জন্যই তো করলাম ।
— তুমি খেয়ে নাও ।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, একটা সিগারেট দে তো ।
পুরো প্যাকেটটাই ঠেলে দেয়, তুই রাখ ।
পদ্ম চা নিয়ে চলে যাচ্ছিল, বিকাশ ডাকে ।
— আমার বালিশটা একটু টিপে-টিপে নরম করে দিতে পারো? বড্ড শক্ত । মাথা ধরে গেছে ।
পদ্ম বালিশটা দু-হাতে নিয়ে নরম করে ।
— মাথা তুলুন ।
উঠে আসতে আসতে বলে, গন্ধটা খুব সুন্দর । বালিশ অব্দি ভুর-ভুর করছে । নাম কী ওটার?
— কিছু একটা হবে ।
— সঙ্গে এনেছেন?
— তোমার বুঝি সেন্ট-টেন্টের খুব শখ?
পদ্ম হাসে ।
বিকাশের হাতঘড়িতে দেখলুম আটটা দশ । বড় মাছ তো এখানে পাব না, স্টেশনে যেতে হবে । বললুম, আমি তবে বেরোচ্ছি । তুই সন্দেশ-টন্দেশ খাস তো?
— তোরা তো খাস । সন্দেশ-দই যা পাবি নিয়ে আসবি । আর টাকা দেব?
— না-না । শোন, এ-টাকা কিন্তু পরে তোকে ফেরত নিতে হবে ।
রাস্তায় সুবলের সঙ্গে দেখা । বলল, বুড়োশিবতলায় পুলিনদা ডেকেছে । সন্ধেবেলা ।
— ঠিক আছে । তুই সহদেবের কোনও খবর জানিস?
— পুলিনদা ছিল সারা রাত । আমায় কিছু বলেনি ।
বউ বেঁচে আছে নিশ্চয়ই । তেমন কিছু হলে একটা খবর কি আর পেতাম না? রাতের কথা ভেবে নিজের ওপর আমার রাগ হয় । বিকাশের সঙ্গে ওইসব না-করে একটা খবর অন্তত নেওয়া উচিত ছিল । খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে । যাক গে, একদিনের তো ব্যাপার । ফিরে গিয়ে চাকরির ব্যাপারটা বিস্তারিত শুনতে হবে ।
ভাগ্যিস জয়বাংলাকে পেয়ে গেলাম । আমার একার পক্ষে এত জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত হত ।
চালের থলে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই জয়বাংলা চলে যাচ্ছিল । আমি বললাম, একেবারে খেয়ে যাবি ।
মা’র ওই এক খারাপ স্বভাব । বেছে-বেছে সব বিকাশের পাতে দিচ্ছে । তারপর আমাকে আর বাবাকে । বিকাশ বাঁহাতে থালা ঢেকে যতই না-না করুক, মা শোনে না, জোর করে মাছের মুড়ো, বেগুন ভাজা চাপিয়ে দিচ্ছে ।
জয়বাংলা শাক শেষ করে হাঁ করে বিকাশকে দেখছে । মাকে বললাম, জয়বাংলাকে তুমি বসিয়ে রেখেছ ।
মা কোমর ভেঙে ভাত দিচ্ছিল, সোজা হবার চেষ্টা করতে গিয়ে মুখ বেঁকে গেল । বলল, ওর অত তাড়া কিসের? তুমি খাও বাবা ।
তিনটে সন্দেশের একটা মাত্র খেয়ে বিকাশ উঠে পড়ল । দিদি জলের ঘটি হাতে পথ দেখায় ।
বাবা ডান বগলের তলায় বাঁহাতে শরীরের ভর রেখে থালায় ঝুঁকে পড়ে একমনে খাচ্ছিল, মা পাঁচ-ছবার ভাত দিয়ে গেছে, এই প্রথম মুখ তুলে বলল, আর চারটি ভাত দাও তো ।
মা এখনও সোহাগ করে কথা বলতে পারে, না শুনলে বিশ্বাস হয় না । আবার ভুরুও কোঁচকায় । ঠিক ওইভাবেই বলল, পেটে জায়গা রাখো । দই-সন্দেশ খাবে না?
— ওসব কাল । ঢেকে রেখে দাও । তুমি ভাত আনো । আর মাছের ঝাল ।
পদ্ম ভিজে কাপড় ছপছপিয়ে উঠোন ভিজিয়ে ঘরে ঢুকল ।
মা জ্বলে ওঠে, গা জ্বলে যায়! কাপড় নিয়ে ঘাটে যেতে পারিসনি?
— রোজই তো আমি ঘরে এসে কাপড় ছাড়ি ।
বাবা পিঠ টান করে বসে বিরাট ঢেকুর তোলে ।
মানকচু গাছের কাছে একটা ভিখিরি খঞ্জনি বাজিয়ে বেসুরো গাইছে । সুজলাবৌদি বলল, সরে দাঁড়াও, দেখি, পথ দাও তো ।
হাতে একটা পোস্টকার্ড । আমার কাছে এসে বলল, আমি বরং একটু বসে যাই । খেয়ে উঠে পড়ে দিস । কী জানি কী লিখেছে । ওমা, মাসি! তোমাদের এখনও খাওয়া হয়নি ।
মুখ ধুয়ে এসে চিঠি পড়ে আমি সুজলাবৌদির মুখে তাকাই । মিঠা জলে ইলিশ ভালোই আসিয়াছে । রোজই তিন-চার গণ্ডা জালে পড়িতেছে । যাত্রাকালে লুবাই আমার ডানহাতের আঙুল ধরিয়াছিল । তখনই বুঝিয়াছিলাম, ভাগ্য শুভ হইবে । এখানে সোমবার-সোমবার এক ফকির আসে । বিপদতাড়ন মাদুলি দেয় । অনেকেই লইয়াছে । লুবাইয়ের জন্য একটি লইব ।
— কী রে? চুপ করে আছিস! বিপদে পড়েনি তো?
— এ তো পুরনো চিঠি!
— ওমা, তাই বুঝি? তবে যাই—
মা এঁটো জায়গায় গোবরন্যাতা দিচ্ছিল, জয়বাংলার থালাটা হাঁটুর কাছে ঠেলে দিয়ে যতটা পারল মুছে নিল । তারপর সুজলাবৌদিকে বলল, দুটো ডুব দিয়ে আসি । চলে যাসনি । চারটি খেয়ে যাবি । ভরতের চাকরি হল, শুনেছিস তো ।
— না মাসি, আমি এই খেয়ে এলাম । কুঁচো চিংড়ি দিয়ে মেটে আলুর চচ্চড়ি করেছিলাম—
— মাছের ঝাল দিয়ে দুটো খাবি, তার আবার অত কথা কী রে!
মা ঠিকই বুঝেছে সুজলাবৌদির উপোস যাচ্ছে । মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে । চিঠি পড়াবার অছিলায় চলে এসেছে । আমার বাজারে যাওয়ার কথা কারও কাছে শুনেছিল নিশ্চয়ই ।
মা পুকুরের পথে ফিরে দাঁড়ায়, না খেয়ে যাসনি যেন । ওবেলা তোকে নিয়ে বিশালাক্ষীর থানে যাব । ভরতের জন্য ঢিল বেঁধেছিলাম ।
জয়বাংলা থালা আগলে বসে আছে । মাজা থালার মতো তকতকে । মা ফিরে উঠোনে কাপড় মেলতে-মেলতে কপাল কুঁচকোয়, ওঠ এবার! একেবারে রাক্ষুসে খিদে ।
মা ভিখিরিটাকে একটা পদ্মপাতায় বিকাশের মাখা ভাত এঁটোকাঁটা তুলে দিল । সুজলাবৌদিকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল । দিদি আর পদ্মকে ডাকল ।
জয়বাংলার চোখ দরজা পেরিয়ে ঘরের মধ্যে । মার হাতের প্রতিটি নড়াচড়ায় এঁটে আছে । খেতে-খেতে মার সেদিকে চোখ পড়তেই মা জয়বাংলার দিকে পিছন ফিরে বসে বলল, ওপারের যুদ্ধে কত লোক মরল, ও-বেটি কেমন বেহায়ার মতো বেঁচে রইল, মরণ!
সুজলাবৌদি বলল, ওমা! কী বলব মাসি! সেদিন পোস্টমাস্টারের বাড়ি গিয়েছিলাম, মাগীর কাণ্ড দেখে লজ্জায় মরি!
আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খাচ্ছিলাম । দরজার কাছে এসে বললাম, খাচ্ছো, পেট ভরে খাও না! দিদি, জয়বাংলাকে চারটি ভাত দিবি?
বিকাশ দরজায় এসে দাঁড়ায় । হাতে ছোট একটা চামড়ার ব্যাগ ।
বাইরে রোদ, ঘরে অন্ধকার । বিকাশ অন্ধকারে মুখ বাড়িয়ে বলল, পেট ভরে খাচ্ছেন তো মাসিমা? আরে গোলাপী, কখন এলে?
মা ঘোমটা টানে, পিঠের কাপড় উঠে যায় । ঘোমটার মধ্যেই গদ-গদ হেসে বলে, ও আমাদের জেলেবৌ ।
— এখানেই থাকে?
— না না, ওর বাসা জেলেপাড়ায় ।
— বাঃ, চলো, তোমাদের বাড়ি যাব । চল ভরত, জেলেপাড়ায় গিয়ে খোদ জেলেবৌয়ের কাছ থেকে মাছ কিনব ।
মা তেমনই হাসে, মাছ কোথায়! ব্যাটাছেলেরা সব গাঙে । দু-তিন মাস পরে ফিরবে । তখন এসো, গাঙের মাছ খাওয়াব । আজ তো তুমি কিছুই খেলে না ।
মায়ের হাসি
পুবোঠাকুরের বাড়ির ঠিক পিছনেই সূর্য অস্ত যায় । কবেকার কোন জমিদার স্বপ্নে শিবের আদেশ পেয়ে বুড়োশিবতলায় পুবোঠাকুরের পাকা বাড়ি করে দিয়েছিল । ছেলেবেলায় কালবৈশাখীর বিকেলে আমরা লুকোচুরি খেলতে আসতাম পুবোঠাকুরের ভিটেয় । লুকোবার খুব সুন্দর জায়গা । তখনই এখানে-ওখানে ভেঙে পড়েছে । দরজা জানলার কপাট নেই, একটু অন্ধকারেই রাক্ষসের চোখের মতো ।
সূর্য ডুবে গেছে । গাছপালা কালো । সন্ধের ঝুলকালি মেখেছে । শুধু দূরের আকাশে একটা অদ্ভুত ধরনের রং তখনও দেখা যায় । পুলিন আমাদের বোঝায়, এটা ঠিক যে বাঁচতে হলে রক্ত চাই । আমরা রক্ত দেব না, রক্ত নেব । এতদিন যারা আমাদের রক্ত চুষে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেঁচে আছে, এবার তাদের রক্ত নিতে হবে । আমাদের এই অঞ্চলকে স্বাধীন করতে হবে । এদিককার গ্রামের পর গ্রাম হবে মুক্তাঞ্চল ।
পুলিনের ঠিক পিছনে এক ঝাঁক জোনাকি জ্বলছে-নিভছে । পুলিন যে স্বপ্ন দেখায়, তাতে আমার বড় ভয় করে । পুলিনের ভাই এখন কোথায়? যে মাটি দিয়ে যা খুশি বানাতে পারত । চিটেগুড়ে খই মেখে একবার রাজহাঁস বানিয়েছিল । অনেকদিন তাকে দেখা যায়নি ।
বাড়ি ফিরে দেখি, বিকাশ নেই । মা বলল, সেই সে ঘুরতে গেল বিকেলে আর আসেনি ।
মার দিকে তাকানো যায় না । এই আমার মা! ক্ষইতে-ক্ষইতে গাছের শুকনো ডালের মতো চেহারা হয়েছে । সংসারের শতেক জ্বালা মাকে একেবারে নিংড়ে নিয়েছে । সংসার নিয়ে মার তবু ভয়-ভাবনা, স্বপ্ন-আশা শেষ হয়নি । হাড়-পাঁজরের নীচে মার হৃদয়ে এখনও কত দপদপানি । বালি খুঁড়তে খুঁড়তে যেমন জল বেরোয়, ঠিক সেইরকম । সত্যি সত্যি মুক্তাঞ্চল হবে? কপি পাতার মতো ঝলমলে নতুন দেশ? মাকে দেখে আমি আচমকা বললাম, এবার দেখো মা, সব ঠিক হয়ে যাবে ।
— হ্যাঁ বাবা । আমি মানত করেছিলাম, আজ ঢিল খুলে পুজো দিয়ে এসেছি । এবার তোর একটা বউ আনতে হবে ।
মা অনেকদিন পর মুখ ভরে হাসে ।
চাকরিটার কথা ভেবেই মা নতুন করে জেগে উঠেছে । হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা কি আমার ঠিক হবে? বিকাশকে কোথাও দেখছি না । আকাশে অল্প তারা । অন্ধকার ঘন হলে ও পথ খুঁজে পাবে না ।
রহিম চাচার ভিটেয়
রহিমচাচার ভিটের দিক থেকে কে হেঁটে আসছে । শূন্য ভিটে । অন্ধকার ঝোপঝাড় । চারদিকে ঝাঁক-ঝাঁক জোনাকি । কেমন একটা অলক্ষুণে ভাব । জেলেপাড়ায় যায়নি তো?
মানুষটা হনহন করে এসে আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় । সুজলাবৌদি । যেন ভূত দেখেছে ।
— সাহস বলিহারি । তুমি কি ছেলের পাশেই মরতে চাও নাকি?
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কেটে যায় । নাকের পাটা ফুলে-ফুলে ওঠে ।
— মরি-বাঁচি তোর কী রে?
সুজলাবৌদি থক করে একবার থুতু ফেলে আবার বলে, আমার জন্য তুই এত ভাবিস কেন, অ্যাঁ? আমি তোর কে, অ্যাঁ? তোর কিসের অত মাথাব্যথা? যার ভাববার কথা, সে বলে কোন গাঙে বাসরঘর বেঁধে দিব্যি সুখে আছে, বল, সুখে আছে কিনা বল, অ্যাদ্দিন হল, একটা খবর নিয়েছে? নিজের একটা খবর দিয়েছে?
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, জলাদা তো মাছ ধরতেই গেছে ।
সুজলাবৌদি কি পাগল হয়ে গেল? হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আমার বুকের কাছটা খামচে ধরে, বুকে দুম-দুম করে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলল, একা মেয়েমানুষ— আমার কী করে চলে, একবারও ভেবেছে মানুষটা?
বলতে বলতে হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে । মুখে মদের গন্ধ । কাল রাতের সেই বিলিতি । আমার ভুল হয়নি ।
এক ঝাঁকুনি দিয়ে সুজলাবৌদিকে সরিয়ে দিয়ে আমি গর্জে উঠি, বিকাশ কোথায়?
— আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
— তুমি জানো । তুমি বিকাশের কাছে গিয়েছিলে ।
— আমি কিছু জানি না । পথ ছাড়, বাড়ি যাব ।
— মিছে কথা । রহিমচাচার ভিটেয় তুমি কী করতে গিয়েছিলে?
আমি সেদিকে পা বাড়াতেই সুজলাবৌদি পিছন থেকে খপ করে আমার জামা টেনে ধরল!
— ও ভরত শোন, তোকে সত্যি বলছি । লুবাইকে আমি ঠাকুরের পেসাদী ফুল দিতে গিয়েছিলাম । তোর মায়ের সঙ্গে তখন বিশালাক্ষীর থানে গিয়েছিলাম না?
— তুমি মিথ্যে বলছ । তোমার মুখে বিলিতি মদের গন্ধ ।
— অ্যাঁ । তা মানুষের মুখে কতরকম গন্ধ হয়— লুবাইয়ের মুখে তো আমি কচি তালশাঁসের গন্ধ পেতাম—
সুজলাবৌদির আঁচলের খুঁটে আমার চোখ বিঁধে যায় । গেরো দিয়ে কিছু একটা বেঁধে রেখেছে । আমার চোখে একপলক চোখ রেখে সুজলাবৌদি আঁচল কাঁধে তুলে বলে, একটু এগিয়ে দিবি ভাই? বড্ড অন্ধকার ।
ভাতে চিতার বাস
অমাবস্যা আমার কোনওদিনই ভালো লাগে না । অন্ধকারে গাছপালা মিশে আছে, রাস্তা মুছে গেছে, দিক ঠাওর করা যায় না, তার ওপর হোঁচট খেয়ে বুড়ো আঙুল জ্বলছে । বাবা আজ লাঙল দিতে গিয়ে মাটির নীচে শাঁখা-সিঁদুর পেয়ে থম মেরে গেছে । কেউ নিশ্চয়ই বাণ মেরেছে । অন্ধকারে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে । মাঝে মাঝে হায়-হায় করে উঠছে । দাওয়া থেকে শোনা যায় । কাল ভোরে যাবে গুণিন ডাকতে ।
বিকাশ ফিরল জয়বাংলার সঙ্গে । দেখা হল কোথায়? আমাকে দেখেই ছেলেটা পিছন ফিরে দৌড় ।
বিকাশের মতিগতি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে । কী চাকরি, কোথায় চাকরি, সারাদিনে বলবার সময় পেল না, শুধু খেয়াল-খুশি নিয়েই আছে । চাকরির কথাটা হয়তো গাঁজা । মদের ঝোঁকে বলে ফেলে এখন এড়াতে চাইছে । ওরকম মোদো-মাতালের কথায় বিশ্বাস কী!
বিরক্তি চেপে বললাম, সন্ধে থেকে খুঁজছি, গিয়েছিলি কোথায়?
বিকাশ হাসে, ঘুরেটুরে দেখলাম একটু ।
— অন্ধকারে গাঁয়ে কেউ বেড়ায় না ।
বিকাশ সোজা ঘরে ঢুকে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে সিগারেট ধরিয়ে বলে, পদ্মাতীর অব্দি গিয়েছিলাম ।
— তুই কি কালই ফিরে যাচ্ছিস?
— হ্যাঁ । সকালের ট্রেনে । সিগারেট খা—
— জিভ খসখসে হয়ে গেছে । চাকরির কথাটা বললি না তো?
— বলব— একটু পরে ।
হাত-পা এলিয়ে শুয়ে আছে । চোখ বোজা । মাঝে মাঝে শিথিল হাত মুখের কাছে এনে সিগ্রেটে আলতো টান দেয় । পাশের ঘরে বাবার হায়-হায় । একবার ভরত রে বলে ককিয়ে উঠল ।
বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার । দূর থেকে জয়বাংলার বাঁশি ভেসে আসছে । দিদি একরকম জোর করে বাবাকে খেতে বসায়, বাবা, ও বাবা, মুখে তোলো, ভাত নষ্ট হবে যে ।
— ভাতে চিতার বাস পাই!
বাবার গলা । শাঁখা-সিঁদুর দেখে খেতেই ঝিম মেরে বসেছিল, রাতে মা গিয়ে বাবাকে ঘরে আনে । অনেকক্ষণ সামলেছে, তারপর নিজেই দাঁতকপাটি লেগে পড়ে আছে । হাতের মুঠোয় একটুকরো তালপাটালি । বাবার জন্য ঘটিতে জল ভরতে বসেছিল । মুঠো খোলে কার সাধ্য ।
সুখের হদিশ
মার গোঙানি শুনে বিকাশ উঠে বসে । ভুরু কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করে । তারপর উঠে গিয়ে নিজেই ঘরের দরজাটা বন্ধ করে এসে আমাকে চোরাচালানের গুপ্তকথা বোঝায় ।
ধোঁয়া ছেড়ে ব্যাখ্যা করে, বর্ডার তোর বাড়ি থেকে সাত মাইলও না ।
কলকাতায় তোকে ঘর দেব, মাইনে দেব । শহরে থাকবি, খাবি, ফুর্তি করবি । মাঝে মাঝে বাড়ি আসবি । টুকটাক দুটো-একটা মাল, দুয়েকটা মেসেজ বর্ডারে পৌঁছে দিবি । ওখানে চায়ের দোকান আছে । খাবার দোকান আছে । আমাদেরই লোক । তুই শুধু পৌঁছে দিয়েই খালাস । সামান্য কাজ । লোকে জানবে, তুই কলকাতায় চাকরি করিস । আমাদের উদ্বাস্তু অনাথ সেবা সমিতির অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে তোর নাম থাকবে । সিগারেট খাচ্ছিস না?
— জিভ খসখস করছে ।
বিকাশ সুখ-সচ্ছলতার আরও হদিশ দেয়, সাকসেসফুলি এটা করতে পারলে, পরে তোকে আরও বড় দায়িত্ব দেব । সে কাজে মাইনেও অনেক বেশি । আশপাশের গ্রাম থেকে একটু স্বাস্থ্যবতী দেখে চেনা-জানা মেয়ে কলকাতায় পাঠাতে পারবি? নিজে আড়ালে থেকে পাঠাতে হবে । গ্রামের সবাই জানবে, মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় চলে গেছে । হয়তো কাজ পেয়েছে, বা কাজের খোঁজ পেয়েছে, কি কারও সঙ্গে প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়েছে । চাকরি, বিয়ে, সিনেমায় চান্স করে দেওয়া— সবরকম লোভ দেখিয়ে তোকে কাজ সারতে হবে । যে যাতে ভোলে । কলকাতার ঠিকানায় একবার হাজির করতে পারলেই তোর কাজ শেষ । তুই রাজি হলে, সব তোকে বুঝিয়ে দেব ।
বিকাশ হঠাৎ আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, তুই আমার স্কুলের বন্ধু । এত অভাবে কষ্টে তুই কদিন বাঁচবি? আমার কথা শুনে নিশ্চয়ই পাপ-পুণ্য নিয়ে মনে মনে তোলপাড় করছিস? তোর মা-বাবা খেতে পায় না । তোর এত বয়েস হল, এখনও বিয়ে করতে পারলি না । কোনও মেয়ের শরীর ছুঁয়ে দেখেছিস? তোর কী ভবিষ্যৎ? এভাবে সবদিক থেকে তোকে বঞ্চিত রাখাটা কোন ন্যায়বিচার শুনি? আর পাপ? কাকে পাপ বলিস? আমার একটা ডায়রি আছে, তাতে তারিখ দিয়ে দিয়ে মেয়েদের নাম লিখে রাখি, যাদের সঙ্গে আমি অন্তত একবার সেক্স করেছি । আমি কি পাপী হয়ে গেছি? ভালো করে ভাব । ভেবে দ্যাখ । রাজি?
— রাজি ।
— কালই কলকাতায় আয় । সব বুঝিয়ে দেব । টাকার কথা বলছিলি, এখন কত চাই? বলে সে আমাকে তার কলকাতার ঠিকানা বোঝায় ।
নির্জনে কান্না
তৃতীয় ঘণ্টা দিতেই চাকা ঘুরতে শুরু করেছে । বিকাশ ট্রেনের জানলা থেকে বলল, কাল দেখা হচ্ছে!
আমি মাথা কাত করি ।
গতি বাড়ছে । বিকাশ এক ঝটকায় দরজার কাছে এসে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, তোর দিদির নাম কী রে?
— কামিনী ।
— আর ওই জেলেবউটার?
ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি । আমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় । মাথার মধ্যে আগুন লাফিয়ে ওঠে । পুলিনের পাইপগান এখন আমার হাতে থাকলে…ট্রেন আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । আমি লাফিয়ে শেষ কামরায় উঠে পড়লাম ।
গার্ডের কামরা । চলন্ত গাড়ি থেকেই আমাকে নামিয়ে দিতে পারলে খুশি হয় । হ্যান্ডেল ধরে পাদানিতে নেমে দাঁড়িয়ে বললাম, সামনের স্টেশনে নেমে যাব ।
ট্রেনের চাকায় আওয়াজ ওঠে, রক্ত নিন জীবন বাঁচান, রক্ত নিন জীবন বাঁচান । স্টেশনে থামতেই নেমে এগিয়ে গেলাম । কামরায় কামরায় জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে খুঁজি । এক মিনিট থেমে ট্রেন ছেড়ে গেল ।
রেললাইন ধরে হেঁটে ফিরতে ফিরতে আমার হঠাৎ জ্যাঠার কথা মনে পড়ে কান্না পেয়ে গেল । চারদিকে শুধু মাঠ আর আকাশ । এখানে বুক উজাড় করে একটু কেঁদে নিলে আমার মা-বাবা তো আর জানতে পারবে না!
প্রথম প্রকাশ : অমৃত, ৯ ও ১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন