দুর্গম দুর্গ – ২

কাজী আনোয়ার হোসেন

দুই

আধঘণ্টার মধ্যে জিনিসপত্র সব নৌকোয় তুলে তৈরি হয়ে নিল ওরা। কমোডোরের পার্সোনাল পিক্-আপে মালপত্রসহ ওদের সমুদ্রের ধারে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নৌকার চার্জে যে গার্ডটা ছিল তাকে তুলে নিয়ে ফিরে গেছে পিক-আপ।

গয়না-নৌকোর সমান বহুদিনের পুরানো একটা জেলে নৌকা। এখানে- ওখানে কাঠ দিয়ে তালি মারা। পাটাতনের নিচেই এঞ্জিনরুম। এঞ্জিনের অবস্থাও নৌকার মতই।

নৌকার মধ্যে ওদের জন্যে পুরানো নোংরা কাপড়, খাবার, একটা স্টোভ, রশি, রিসিভারসহ একখানা রেডিয়ো ট্র্যান্সমিটার, দুটো বেরেটা সাব- মেশিনগান, দুটো মাউজার ব্রেনগান, তাছাড়া আয়না, টর্চ ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস আগে থেকেই রাখা আছে। পিক-আপ থেকে নামানো হয়েছে দুটো বাক্স। একটায় টিএনটি, অ্যামাটোল, ডিনামাইট স্টিক, গান কটন প্রাইমার, এমারি ডাস্ট, গ্রাউণ্ড গ্লাস আর একটা জারে করে পটাশিয়াম আছে। অন্যটার মধ্যে আছে ডিটোনেটার। পারকাশন আর ইলেকট্রিক দু’রকমই।

এঞ্জিন রূমের মধ্যে থেকে বাইরে মাথা বের করল মাহবুব। মাস্তুলটার দিকে চেয়ে বলল, ‘পাল আছে না, স্যার, সঙ্গে?

‘আছে বোধহয়, কেন?’

‘কারণ আমি হলপ করে বলতে পারি, দরকার হবে।’

‘কেন, এঞ্জিন?’

‘ওটা ‘এন’-ও নয় ‘জিন’-ও নয়। ঠাকুরদার আমলের একটা টু সিলিণ্ডার ভটভটি। প্রপেলার শ্যাফটের সাথে যে জায়গাটা মিশেছে ওখানে দুই মণ রাস্ট পড়ে আছে। এ জিনিসের ওপর নির্ভর করলে আর পৌঁছতে হবে না আমাদের।’

রানা বুঝল এই এঞ্জিন পেয়ে ভেতর ভেতর যার-পর-নাই খুশি হয়ে উঠেছে মাহবুব। ওর কারিগরী মাথা খেলাবার সুযোগ পেয়েছে সে এইবার। কিন্তু এ ধরনের একটা নৌকায় ওদের এত গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাঠানো হচ্ছে বলে মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট না হয়ে পারল না সে।

ছেড়ে দিল নৌকা। সোজা এগোল ওরা দক্ষিণে। দ্বারোকা আর ওখা-র মাঝামাঝি পাহাড়ী জায়গায় উঠবে। আধঘণ্টার মধ্যেই সামরিক পোশাক খুলে জেলে পোশাক পরে নিল ওরা। সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হলো পাকিস্তানী পোশাকগুলো পাথর বেঁধে। প্রকাণ্ড গোঁফে বার কয়েক তা দিয়ে পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিশ্ৰী খান। পালা করে রাত জাগতে হবে। প্রথমে জাগবে আলতাফ আর মাহবুব।

রানা শুয়ে পড়ল মিশ্রী খানের পাশে। এঞ্জিনের শব্দ আর সাগরের কুলুকুলু। বাতাস নেই। নিস্তরঙ্গ আরব সাগরে ভেসে চলেছে ওরা অজানার উদ্দেশে।

‘ওস্তাদ!’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় ডাকল মিশ্ৰী খান।

‘কি?’

‘আমার অবশ্য মাথা ঘামানো উচিত না, তবু জিজ্ঞেস করছি, যদি ওই ছোকরা ক্যাপ্টেন আপনার হুকুম না শুনত, তাহলে কি করতেন আপনি?’

‘কর্নেলকে বলতাম। কর্নেল না শুনলে গুলি করে মেরে ফেলতাম করিমকে।’

‘আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন যদি আপনার কথা না শুনত তাহলে কি ওর কোর্ট মার্শাল হত সত্যি করে?

‘না। আমাদের হাতে অত ক্ষমতা নেই। এমনি ভয় দেখিয়েছিলাম। ধমকেই কাজ হয়ে গেল- কাজেই ওসব কথা ভাবার কোনও দরকার নেই। ঘুমে জড়িয়ে এল রানার কথাগুলো।

‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। আসলে আমাদের হাতে অত ক্ষমতা নেই কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছে করিমকে মেরে রেখে আসাই উচিত ছিল ওই ক্যাপ্টেনটার মুখের চেহারা দেখেছিলেন? আপনি দেখতে পাননি, আমি দেখেছি। আপনি যখন ওর দিকে পেছন ফিরলেন তখন কেউ উপস্থিত না থাকলে আপনার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতেও দ্বিধা করত না ও। ওর অহঙ্কার গুঁড়ো হয়ে গেছে, ওস্তাদ। অনুম্ভরী লোকের কাছে এর চাইতে বড় অপমান আর কিছুই নেই।

রানার তরফ থেকে জবাব এল না কোনও। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছে সে। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল মিশ্রী খানও। কিন্তু মন থেকে অস্বস্তি গেল না ওর।

ঠিক ভোর ছ’টার সময় বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। ছুটে গেল রানা এঞ্জিন রুমের দিকে। ঘুম ভেঙে উঠে বসল আলতাফ আর মিশ্রী খান। মাহবুব ঘুমাতে অস্বীকার করায় মিশ্রী খানকে আর ওঠানো হয়নি।

‘কি হলো, ওস্তাদ? পৌঁছে গেছি?’

জবাব দিল মাহবুব। মাথা বের করল সে এঞ্জিন রুমের ভেতর থেকে। ‘প্রায়। তিনভাগের দুই ভাগ চলে এসেছি। বাকিটা পাল টাঙিয়ে যেতে হবে। একজস্ট লিক।’

‘মেরামত হবে না?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘অসম্ভব। ওয়েলডিং দরকার। হাবিজাবির মধ্যে একটা স্পেয়ার এঞ্জিন খুঁজে পাওয়া গেছে, দেখি চেষ্টা করে লাগানো যায় কিনা।’

‘কতক্ষণ লাগবে, মাহবুব?’

‘ঠিক বলতে পারছি না, স্যার। আদৌ হবে কিনা তা-ও বলা যায় না একদম রাস্ট পড়ে আছে। আপনি পালটা ওঠাবার ব্যবস্থা করুন, আমি চার্ট দেখে হাল অ্যাডজাস্ট করে দিয়ে লাগব এঞ্জিনের পেছনে।

মাথার ওপর দিয়ে দুটো মিগজেট উড়ে চলে গেল। কিছুদূর গিয়ে কি মনে করে ঘুরে এল আবার। ডাইভ দিয়ে অনেক নিচে নেমে দেখল ওদের- তারপর সন্তুষ্ট চিত্তে চলে গেল যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই।

পাল তুলে দেয়া হলো নৌকায়। বেশ ফর্সা হয়ে গেছে চারপাশ। মিশ্রী খান নেমে গেল মাহবুবের সাথে এঞ্জিনরূমে, সাহায্য করবে বলে। বড় সাইজের একটা মশুরির ডালের মত সূর্য উঠল পুব সমুদ্র থেকে।

দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল। মন্থর গতিতে চলেছে নৌকা গন্তব্যস্থলের দিকে। হঠাৎ পেছন দিকে চেয়েই চিৎকার করে উঠল রানা।

‘দেখেছ, আলতাফ?’

‘দেখেছি, মেজর। এখনও তিন মাইল আছে। ঘণ্টাখানেক আগে যেটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল, খুব সম্ভব সেটাই। ওদের টহলদারী লঞ্চ।’

‘সোজা আসছে আমাদের দিকে! মিশ্রী আর মাহবুবকে শিগগির ডাকো।’

জরুরী বৈঠক বসল।

‘আমাদের থামিয়ে সার্চ করবে ওরা। কিছু একটা সন্দেহ করেছে নিশ্চয়ই। কিংবা কোন সংবাদ জানতে পেরেছে, তাই ফিরে আসছে। বিপদ আশা করবে ওরা, এবং সাবধান থাকবে। কাজেই মাঝামাঝি কোনও ব্যবস্থা চলবে না। হয় ওরা ডুববে, নয় আমরা- এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র আমরা কিছুতেই পানিতে ফেলব না। কাজেই, সার্চ করলে সব বেরিয়ে পড়বে।

খুব দ্রুত প্ল্যান ঠিক করে সবাইকে বুঝিয়ে দিল রানা। সব চাইতে অনভিজ্ঞ মাহবুব। জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়নি সে কখনও আগে যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা হয়নি ওর। হঠাৎ বলে উঠল, ‘অসম্ভব! আপনি যা করতে যাচ্ছেন সেটা মানুষ খুন। এভাবে হত্যা করবার কোনও অধিকার…’

‘খবরদার! চিৎকার করে উঠল মিশ্রী খান। ‘তুমি দুধের বাচ্চা, তুমি কি বোঝ? চুপ করে থাকো।’

‘হয়েছে, মিশ্রী খান!’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল রানা। কয়েক সেকেণ্ড তীব্র দৃষ্টিতে ওর দিকে বিরক্তি বর্ষণ করে ফিরল মাহবুবের দিকে। ‘লেফটেন্যান্ট, এটা যুদ্ধ। আর যুদ্ধের নিয়মই হচ্ছে শত্রুপক্ষকে সমান সুযোগ না দিয়ে কোনও না কোনও অসুবিধার মধ্যে রাখা। কারণ আমরা যদি ওদের মারতে না পারি, ওরা আমাদের মারবে। এটা অত্যন্ত সহজ যুক্তি- হয় ওরা তলিয়ে যাবে, নয় আমরা। আমাদের মিশনের উদ্দেশ্য হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা, বিশ্বের চোখে আমাদের যোগ্যতা তুলে ধরা। এখন এই মুহূর্তে বিবেকের প্রশ্নই ওঠে না।’

মাথা নিচু করে রইল মাহবুব। রানার যুক্তির অকাট্যতা হৃদয়ঙ্গম করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে হত্যাকাণ্ড ওর নিজ চোখে দেখতে হবে সেটা কল্পনা করে শিউরে উঠল একবার। বুঝল, রানাকে বিচার করবার ক্ষমতা এখনও হয়নি ওর। বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, মেজর। ক্যাপ্টেন খান ঠিকই বলেছেন, আপনাদের তুলনায় আমি দুধের বাচ্চা ছাড়া কিছুই ন‍ই। আমার চুপ করে থাকাই উচিত।’ একবার ফিরে চাইল সে মোটর লঞ্চটার দিকে। ‘আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন, স্যার।’

‘বেশ, বেশ,’ মৃদু হাসল রানা মাহবুবের দিকে চেয়ে। তোমার ওপর নির্ভর করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেই- আলতাফ আর তুমি ছাড়া কচ্ছ ভাষা আর কেউ জানে না। কিন্তু সেজন্যে নয়। আমাদের এই ছোট্ট গ্রুপের প্রত্যেকের ওপর প্রত্যেকে নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে না পারলে সাফল্য আসবে না। মিশ্রী খান, জিনিসটা রেডি করো। স্বাভাবিক, সহজভাবে চলাফেরা করবে। ওদের দূরবীন এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আমাদের।

সামনের দিকে হেঁটে চলে এল রানা। আলতাফ এল পিছু পিছু। এঞ্জিন সারতে বসল মাহবুব। মিশ্রী খান ব্যস্ত হয়ে পড়ল একটা বিশ্রী কাজে

লঞ্চটা যখন ছয়ফুট দূরে এসে পড়ল তখন পাটাতনে বসে একটা ছেঁড়া চাদর কোলের ওপর বিছিয়ে সেলাই করছে রানা। জনা ছয়েক ভারতীয় ন্যাভাল অফিসার দেখা গেল রেলিং-এর ধারে। তিনজনের হাতে অটোমেটিক কারবাইন, দু’জনের হাতে রিভলভার। একধারে ট্রাইপডের ওপর বসানো একটা মেশিনগান চেয়ে আছে ওদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে। হুইল-হাউস থেকে মাথা বের করল অল্প বয়সী এক লেফটেন্যান্ট। দুই হাত মুখের কাছে তুলে চিৎকার করে বলল, ‘পাল নামাও।’

মনেমনে চমকে উঠল রানা। হিম হয়ে গেল বুকের ভেতরটা। কথাটা পশতু ভাষায় বলেছে লেফটেন্যান্ট। মাহবুব একে ছেলেমানুষ, তার ওপর অনভিজ্ঞ। ঠিক ধরা পড়ে যাবে। রানা পরিষ্কার বুঝল, এই প্রথম কথাতেই ধরা পড়ে যাবে ওরা।

কিন্তু মাহবুব এই ফাঁদে পা দিল না। মাথাটা কাত করে কানের কাছে হাত তুলে হাঁ করে কিছু শুনবার চেষ্টা করল। ঠিক মাথা মোটা জেলেদের চমৎকার অনুকরণ। কথাটা যেন বুঝতেই পারেনি এমন ভাবে কচ্ছ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলছেন গো?’

‘পাল নামাও। তোমাদের নৌকা সার্চ করব।’ রানা লক্ষ করল এবারেও পশতু ব্যবহার করছে লেফটেন্যান্ট।

বোকার মত চেয়ে রইল মাহবুব ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ, তারপর রানা এবং আলতাফের দিকে চাইল অসহায় দৃষ্টিতে। ওদের চেহারা দেখেও বোঝা গেল একটি বর্ণও বুঝতে পারেনি ওরা। হতাশ ভাবে দুই হাতের তালু চিৎ করল সে।

‘মাদ্রাজী ভাষা আমরা বুঝি না,’ চিৎকার করে বলল সে। ‘কচ্ছের ভাষা বলতে পারেন না?’

এক বিশেষ ধরনের মুখভঙ্গি করল লেফটেন্যান্ট। ভাঙা-ভাঙা কচ্ছ ভাষায় বলল, ‘এক্ষুণি নৌকা থামাও, আমরা সার্চ করব।’

‘কি? নৌকা থামাব? কেন নৌকা থামাব, কিসের সার্চ? আমরা চোর, না ডাকাত? লাইসেন্স আছে আমাদের…’ খেপে উঠল যেন মাহবুব। হাত-পা ছুঁড়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বাধা দিল লেফটেন্যান্ট।

‘দশ সেকেণ্ড সময় দিলাম। তারপর গুলি করব।’

আহত-পরাজিত মাহবুবের মুখের চেহারা। তিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘নামাও পাল।’

পাল নামিয়ে ফেলল আলতাফ। নামিয়ে বোকার মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। খালি দুই হাত ঝুলছে দেহের দুই পাশে। রানাও সেলাই বন্ধ করে বিরক্ত মুখে চেয়ে রইল লঞ্চের অফিসারদের দিকে। ডিজেল এঞ্জিনের শব্দটা একটু গভীর হলো। কাছে সরে এসে নৌকার গায়ে গা ঠেকাল লঞ্চটা।

রিভলভার আর অটোমেটিক কারবাইন হাতে নেমে এল তিনজন অফিসার মেশিনগানের লাইন অফ ফায়ার থেকে গা বাঁচিয়ে। ঝট করে প্রথম জন সরে এল মাস্তুলের কাছে। ঘুরে দাঁড়িয়েই রানা ছাড়া বাকি সবাইকে কন্ট্রোলে রাখার জন্যে রিভলভারের মুখটা বুলিয়ে নিল ওদের ওপর। রানাকে লঞ্চের স্প্যানডাও মেশিনগানটার হাতেই ছেড়ে দিল সে।

মাথা ঘুরিয়ে নির্বোধ দৃষ্টিতে চারদিকে চাইল রানা। মাহবুব ডেকের ওপর সাইলেন্সার মেরামতের কাজে লেগেছে। মিশ্রী খান ওর থেকে দেড় গজ দূরে কাতানি দিয়ে একটা টিন কাটছে মনোযোগের সঙ্গে- মেরামতের কাজে লাগবে। রানা লক্ষ করল কাতানিটা বাম হাতে ধরেছে মিশ্রী খান। অর্থাৎ, ডান হাতটা মুক্ত আছে রানার আদেশের অপেক্ষায়। আলতাফ তেমনি দাঁড়িয়ে আছে বোকার মত। মাস্তুলের কাছে দাঁড়ানো লোকটা নিষ্পলক চোখে চেয়ে রয়েছে সবার দিকে। বাকি দুজন ধীর পায়ে হেঁটে আলতাফের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, কারবাইন দুটো ঢিল করে ধরা। সমস্ত নৌকাটা যে ওদের আয়ত্তে এসে গেছে, তাতে ওদের কোন সন্দেহ নেই। গোলমালের কথা ভাবাও এখন হাস্যকর।

ঠিক এই সময় চাদরের তলা থেকে ঠাণ্ডা মাথায় সযত্নে প্রথম গুলিটা করল রানা। সোজা গুলি গিয়ে লাগল স্প্যানডাও মেশিনগানারের হৃৎপিণ্ডে। পর মুহূর্তে ঢলে পড়ল মাস্তুলের পাশে দাঁড়ানো অফিসারটা রানার দ্বিতীয় গুলিতে। অফিসারটা ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়বার আগেই তিনটে জিনিস ঘটল একই সঙ্গে। ঝট্ করে বল-সাইলেন্সারের পাশে লুকানো মিশ্রী খানের পিস্তলটা তুলেই পরপর চারটে গুলি করল মাহবুব। কাতানি দিয়ে থ্রী-সেকেণ্ড কেমিক্যাল ফিউজটা একটু কুঁকড়ে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সেটা মিশ্রী খান পাশে দাঁড়ানো লঞ্চের এঞ্জিনরুমের ভেতর। আর সঙ্গে সঙ্গে আলতাফের দুটো গরিলা সদৃশ প্রকাণ্ড হাত ওর পাশের দু’জন অফিসারের মাথা দুটো ভয়ঙ্কর জোরে ঠুকে দিল। ঠাস্ করে দুটো খোসা ছাড়ানো নারকেলে বাড়ি লাগল যেন। পরমুহূর্তে চারজনেই ওরা শুয়ে পড়ল পাটাতনের ওপর।

প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে ধোঁয়া আর আগুনের হল্কা উঠল আকাশের দিকে। ভারতীয় টহলদারী লঞ্চের একটা রেলিং মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল দশগজ তফাতে। জোর ঝাঁকুনি খেল নৌকাটা। ধাক্কা খেয়ে কিছুটা সরে এল জ্বলন্ত লঞ্চ থেকে। তারপর সব চুপ।

কানে তালা লেগে গেছে রানার। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সে পাটাতনের ওপর। ডুবে যাচ্ছে লঞ্চটা। মিশ্রী খানের বোমায় এঞ্জিনরূমের তলা নিশ্চয়ই খসে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে লঞ্চ। শুকনো কাঠ জ্বলছে, তাই ধোঁয়াও নেই, আর ধোঁয়া দেখে অনুসন্ধিৎসু প্লেনের আশঙ্কাও নেই। আধ মিনিটেই চলে যাবে লঞ্চটা পানির তলায়। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল রানার একজন লোকের ওপর। ছুরির মত কোনও লোহার পাত লেগে চিরে গেছে পেটটা। নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে ডেকের ওপর। বেঁচে আছে এখনও। এক হাতে পেট চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে আগুন থেকে সরে আসতে চাইছে সে। বীভৎস সে দৃশ্য। চোখে-মুখে তার মৃত্যুর আতঙ্ক। ভাঙা-চোরা ডেকের ওপর উঠে এল পানি। দপ্ করে নিভে গেল আগুন। ধীরে ধীরে ডুবে গেল লঞ্চটা। খানিকটা সাদা ফেনা আর তৈলাক্ত বুদ্বুদ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না। শান্ত আরব সাগরে মৃদু হাওয়া- চারদিক নিস্তব্ধ। একটা উল্টানো হেলমেট ভেসে যাচ্ছিল, ডুবিয়ে দিল রানা সেটাকে। চিহ্নমাত্র রইল না আর এতবড় লঞ্চটার।

নিজেদের নৌকার দিকে ফিরল এবার রানা। প্রকাণ্ড দেহী আলতাফ আর বাচাল মিশ্রী খান উঠে দাঁড়িয়েছে। মাহবুবও উঠে বসবার চেষ্টা করছে। ওর জুলফির কাছে একটা ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। মিশ্রী খান এগিয়ে গেল সবচেয়ে আগে। ক্ষতটা পরীক্ষা করে ডাক্তারী চালে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি। সামান্য বাড়ি লেগেছে কাঠের টুকরোর।’ ইমার্জেন্সী মেডিকেল কিট খুলে ডেটল দিয়ে ধুয়ে জায়গাটায় সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল সে।

আলতাফ ব্রোহী বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে কারবাইন-ধারী অফিসার দুজন। ওর দিকে চেয়ে রানা বুঝল ওর মানসিক অবস্থাটা।

‘শেষ?’ জিজ্ঞেস করল সে মৃদুকণ্ঠে।

মাথা নাড়ল আলতাফ ব্রোহী।

‘হ্যাঁ! অতিরিক্ত জোরে মেরেছিলাম।’ ভারি শোনায় ওর কন্ঠস্বর।

রানা জানে বহু লোক প্রাণ দিয়েছে আলতাফ ব্রোহীর হাতে। যখনই সে মেরেছে; দক্ষ হাতে নির্দয়ভাবে মেরেছে। কিন্তু প্রতিবারই অনুশোচনায় নিজেকেও সেই সাথে দগ্ধে মেরেছে। ওর ধারণা কারও প্রাণ নেবার তার কোনও অধিকার নেই। খোদা এভাবে অপঘাতে মরবার জন্যে প্রাণ সৃষ্টি করেননি। কিন্তু বেশি লোকের বেশির ভাগ ভাল-র জন্যে অসংখ্য প্রাণ শিখা নিজ হাতে নিভিয়ে দিতে হয়েছে ওকে। প্রতিবারই বিবেক দংশন করেছে ওকে- প্রতিবারই ওর মনে হয়েছে, হয়তো অন্য কোনও উপায় ছিল, হয়তো এদের মৃত্যুর সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবারই ওকে অনেক যুক্তি-তর্ক দিয়ে নিজের মনকে বোঝাতে হয়েছে যে সে হত্যা করেছে প্রতিশোধের জন্যে নয়, ঘৃণার জন্যে নয়, জাতীয়তাবাদ কিংবা ‘ইজম্’ তো নয়ই- অন্যায়কে দমন করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্যে।

‘আর কারও কিছু লাগেনি তো? মিশ্ৰী?’

‘না, ওস্তাদ।

‘বেশ। আলতাফ, পাল তুলে দাও। নয়টা বাজতে যাচ্ছে। সিগন্যালের সময় হয়ে গেছে। মাহবুব হাল অ্যাডজাস্ট করে করাচি টিউন করবার চেষ্টা করে দেখো।’ আকাশের দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘ওদের ফোরকাস্টটাও শোনা দরকার। এখন আপাতত যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।’

রেডিও রিসিপশন ভাল হলো না। মাঝে মাঝে ঘড়র্ ঘর্ করে বিকট শব্দ হচ্ছে। পশ্চিম আকাশের খানিকটা জায়গা কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। মাহবুব বলল ওর মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তাই এই আওয়াজটা। আওয়াজটা একবার বেড়ে যাচ্ছে, একবার কমে যাচ্ছে।

‘স্যামসন কলিং ডেলায়লা।’ করাচি আর কম্যাণ্ডো গ্রুপের কোড। ‘ক্যান ইউ হিয়ার মি লাউড অ্যাণ্ড ক্লিয়ার?’

মাহবুব হাঁ-বাচক টোকা দিল

‘স্যামসন কলিং ডেলায়লা। এনি ট্রাবল?’

আবার হাঁ-বাচক টোকা।

‘এঞ্জিন ট্রাবল্‌?’

আবার টোকা।

‘এনিমি ট্রাবল?’

রানার দিকে চাইল মাহবুব। রানা মাথা নাড়তেই আবার হাঁ-বাচক টোকা দিল মাহবুব। রানা স্পষ্ট মানসচক্ষে দেখতে পেল কমোডোরের কুঞ্চিত ভ্রূ, উদ্বিগ্ন চেহারা।

‘অল ক্লিয়ার নাউ?’

আবার টোকা।

‘নাউ ওয়েদার ফোরকাস্ট ফর ডেলায়লা। হেভি রেনফল অ্যাসোশিয়েটেড উইথ থাণ্ডার অ্যাণ্ড স্টর্ম এক্সপেক্টেড বিফোর নূন। টেম্পারেচার ফলিং, ভিজিবিলিটি পুওর। ডেঞ্জার সিগন্যাল- এইট।’

ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে মিশ্রী খানের মুখ। এই ভয়ই সে করেছিল। সাঁতার জানে না সে। জানলেও কোন লাভ হত না, কিন্তু কিছুক্ষণ তো অন্তত ভেসে থাকা যেত। বেশ খানিকটা উঠে এসেছে পশ্চিমের মেঘ। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ঢুকে যাবে সব লীলা খেলা।

রানাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। উঠে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল মাহবুবের ম্যাপের ওপর। ছ’মাইল দূরে আছে একটা ছোট্ট দ্বীপ। ঝড়ের আগে গিয়ে পৌঁছতে পারবে সেখানে?, চোখ তুলেই দেখল মাহবুব বুঝতে পেরেছে ওর মনের কথা। বলল, ‘বৈঠা চালালে অসম্ভব না-ও হতে পারে, স্যার।’

‘ঠিক বলেছ। তুমি এঞ্জিনটার পেছনে লাগো। আমরা শেষ চেষ্টা করে দেখি।

‘কিন্তু ওই দ্বীপটায় ভারতীয় সৈন্য থাকার সম্ভাবনা আছে।’

‘জানি। কিন্তু ডুবে মরার চেয়ে বন্দী হওয়া ভাল। যাও, কুইক।’

আধঘণ্টা পরই তুমুল জোরে বৃষ্টি নেমে গেল। চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। তীরের মত বৃষ্টির ফোঁটা এসে বিঁধছে তিনজনের চোখে-মুখে। হাওয়ার বেগ বাড়ছে ক্রমেই। অক্লান্ত ভাবে বৈঠা চালাচ্ছে তিনজন। এঞ্জিনের কাজ ছেড়ে হাল ধরে বসেছে মাহবুব। হঠাৎ উল্লসিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল মাহবুব।

‘এসে গেছি!’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন