কাজী আনোয়ার হোসেন
ঢাকা থেকে করাচি। করাচি থেকে টু-সীটার সী-প্লেনে করে চলেছে রানা কেটি বন্দর।
আবোল তাবোল ভাবছে রানা। কী এমন ব্যাপার যেজন্যে এমন স্পেশাল ভাবে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এত তাড়াহুড়োই বা কিসের? ঢাকার পি. সি. আই. হেড অফিস জানিয়েছে পাকিস্তান ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্সের বিশেষ অনুরোধে তাকে পাঠানো হচ্ছে করাচি। একটা অত্যন্ত জরুরী কাজে ছোট্ট একটা কম্যাণ্ডো গ্রুপকে লীড করতে হবে। আর কিছুই জানা যায়নি। অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার। ওখানে পৌঁছে জানা যাবে সব।
করাচি পৌঁছে টি-থারটি থ্রী জেট থেকে নেমে সী-প্লেনে ওঠা ছাড়া আর তেমন কিছুই ঘটল না। একজন মাঝ-বয়সী নেভী ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে হ্যাণ্ডশেক করলেন রানার সঙ্গে, বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়ে গেলেন এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রাখা সী-প্লেনের কাছে, কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে। আবার হ্যাণ্ডশেক করে উঠে গেল রানা সিঁড়ি বেয়ে।
কয়েকটা ডোশিয়ে। বোধহয় ওর গ্রুপের আর সবার। দেখা হওয়ার আগেই তাদের সম্পর্কে রানার যাতে মোটামুটি একটা ধারণা হয় সেজন্যে ওকে এগুলো দেয়া। সাথে প্রত্যেকের ছবি আছে একটা করে।
প্রথমেই আছে পেশোয়ারী এক ছোকরার ছবি। মাহবুব চানন্। নেভির লেফটেন্যান্ট। রেডিও এক্সপার্ট। উর্দু, পশতু, ইংরেজি এবং কচ্ছ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। হবি- মোটর এঞ্জিনিয়ারিং। গেরিলা ফাইটার হিসেবেও কৃতিত্ব আছে। দাড়ি গোঁফ কামানো পাতলা ছিমছাম চেহারা। চোয়ালের হাড় দুটো উঁচু। কিন্তু কম্যান্ড্রো মিশনে যাওয়ার জন্যে বয়সটা একটু কম বলে মনে হলো রানার। বাইশ কি তেইশ।
তারপর আছে পাঞ্জাবী মিশ্রী খান। প্রকাণ্ড একজোড়া কালো গোঁফ। দেখলেই বোঝা যায় বহু ঘাটের পানি খেয়েছে। হাসিডসার মস্ত কাঠামো শরীরের। ফি ডিভিশনের আর্মি ক্যাপ্টেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ। এক্সপ্লোসিভের ব্যাপারে অদ্ভুত এক প্রতিভা। পোয়াটেক বারুদ হাতে ধরিয়ে দিলেই বোম বানিয়ে ফেলবে। কর্মঠ এবং ভয়ঙ্কর লোক।
আর তৃতীয় ছবিটা দেখে চমকে উঠল রানা। আলতাফ ব্রোহী! আর্মিতে থাকতেই পরিচয় ছিল রানার সঙ্গে। সিন্ধী। বয়স চল্লিশ বছর। করাচি পি. সি. আই.-এ কাজ করছে এখন। কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্টে একসাথে কাজ করেছে ওরা। পরিচয়টা এখন বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। প্রকাণ্ড চেহারা- যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। তেমনি করিৎকর্মা। পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ গেরিলা ফাইটার। ‘রান অভ কাচে’র যুদ্ধে শত্রু লাইনের পেছনে চলে গিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভাল করেই চেনে ওকে রানা। ওকে দেখলে অসম্ভব শক্তিশালী একটা যুদ্ধের মেশিন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না রানার।
শেষ ছবিটা লেফটেন্যান্ট আরীফের। মেয়েলী চেহারা। ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্সের স্পাই। ওর সম্পর্কে ডোশিয়ে দেখে তেমন বিশেষ কিছু জানা গেল না।
প্রত্যেকটি লোক যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজ করেছে। এই সব এক্সপার্টদের এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে একটা কম্যাণ্ডো গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কোথায়, কি কাজে, কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে জানা নেই ওর। কেটি বন্দরে পৌঁছলে হয়তো জানা যাবে। জানালা দিয়ে বাইরে চাইল মাসুদ রানা।
.
সিন্ধু নদের মোহনায় কেটি বন্দর। সমুদ্রের কাছাকাছি নদীর বিশাল বিস্তার। কেটি বন্দর মাইল খানেক থাকতেই নেমে পড়েছে প্লেন নদীতে। ডান ধারে তীরের ওপর কয়েকজন সামরিক পোশাক পরা লোক দাঁড়ানো। একটা তাঁবুও দেখা গেল মাঠের মধ্যে।
‘দিস ইজ কমোডোর জুলফিকার অভ ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্স।’
হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। শক্ত সমর্থ শক্তিশালী একটা হাত। বয়সের ভাঁজ পড়েছে গালে। ক্লিন শেভড্।
‘আপনার সহকারীদের সাথে দেখা হবে পরে, তার আগে আমরা দু’চারটে কথা সেরে নিতে চাই আপনার সঙ্গে। আসুন এদিকে।’
রানার পেছন পেছন বাকি তিনজন অফিসারও এল তাঁবুর মধ্যে। সী- প্লেনটা ফেরত চলে গেল করাচি।
‘দ্বারোকা যেতে হচ্ছে আপনাকে,’ বললেন কমোডোর জুলফিকার একটা চেয়ারে বসে। রানাও বসল। তাঁবুর মধ্যে একটা টেবিল আর তার চারপাশে ক’টা চেয়ার ছাড়া আসবাব নেই আর। কমোডোরের টেম্পোরারী অফিস। স্থির দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে আবার আরম্ভ করলেন কমোডোর, ‘করাচি থেকে দুশ দশ মাইল দূরের এই নৌ-ঘাঁটিটা বরাবর আমাদের মাথা-ব্যথার কারণ। অত্যন্ত শক্তিশালী রাডারে ওরা ওখানে বসে করাচিতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের গতিবিধি লক্ষ করছে এবং চারদিকে ইনফরমেশন দিচ্ছে ওদের এয়ার ফিল্ড থেকে উঠে ভারতীয় বিমান বাহিনী করাচিতে বম্বিং করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ওপর ওখানে জমা হচ্ছে ওদের নৌবাহিনী- অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তান ন্যাভাল ফোর্সকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়ার জন্যে। কাজেই স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে অবস্থিত এই নৌ-ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না আমরা। দেরি হলেই হার হয়ে যাবে আমাদের।’
‘আমরা পাঁচজন গিয়ে…’
‘আপনাদের কাজ কেবল ওদের দুর্গম দুর্গে প্রবেশ করে চারটে অব্যর্থ কামান ধ্বংস করে দেয়া। ওগুলোর জন্যে দ্বারোকার আধমাইলের মধ্যে যাওয়া যাচ্ছে না। ওগুলোকে স্তব্ধ করে দিতে পারলে বাকি কাজ নির্বিঘ্নে সেরে আসতে পারবে পাকিস্তান নেভি। একাজের জন্যে শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পন্ন তিনজন সহকারী পাচ্ছেন আপনি, দ্বারোকা পৌঁছে লেফটেন্যান্ট আরীফের সাহায্য পাচ্ছেন, কাজেই আমরা আশা করতে পারি সফল হতে পারবেন আপনি। গোটা দেশের নিরাপত্তা নির্ভর করছে এই কম্যাণ্ডো গ্রুপের নেতার ওপর, তাই আপনাকে বেছে নিয়েছি আমরা। আশা করি এই সম্মানের মর্যাদা রক্ষা করবেন।
‘চেষ্টার ত্রুটি হবে না, স্যার,’ বলল রানা বিনীত ভাবে।
এবার ম্যাপ বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি ব্যাপার আলোচনা করলেন কমোডোর। রানা অবাক হলো ভদ্রলোকের নিপুণ প্ল্যানিং এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তা দেখে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারও দৃষ্টি এড়ায়নি ওঁর। দুই ঘণ্টা কখন পার হয়ে গেল বুঝতেই পারল না সে। কমোডোর জুলফিকারের প্রতিটি কথা স্রেফ হাঁ করে গিলে নিল মাসুদ রানা। পুরো প্ল্যানটা ভালভাবে বসিয়ে নিল মাথার মধ্যে।
‘উইশ ইউ বেস্ট অভ লাক, ইয়ংম্যান।’ রানার কাঁধের ওপর রাখলেন কমোডোর ডান হাত। ‘কাজটা ভয়ঙ্কর, দুঃসাধ্য এবং বিপদজনক। কিন্তু শুনেছি, কারও পক্ষে যদি সম্ভব হয় এ মিশন সফল করা, সে হচ্ছেন আপনি। আমার বিশ্বাস, আপনি পারবেন।’
মাইল খানেক তফাতে একটা ডাক-বাংলো প্যাটার্নের কাঠের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো রানাকে জীপে করে। পাঁচ মাইল দূরে আরব সাগরের বুকে ঝিলিমিলি এঁকে ডুবে যাচ্ছে সূর্যটা। চারদিকে কুয়াশা-কুয়াশা ধোঁয়াটে ভাব। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের সেপ্টেম্বর মাস। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল রানা বাড়ির ভেতর কমোডোর জুলফিকারের পেছন পেছন।
সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন কমোডোর। এখন সব কিছুর ভার রানার ওপর। লেফটেন্যান্ট আরীফের সঙ্গে তার নিজেকেই পরিচয় করে নিতে হবে দ্বারোকায়।
টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। খাওয়া শেষ করে ওদের যেটুকু বলা দরকার বলবে রানা। তারপর নৌকোয় উঠে বাকি কথা হবে। আধঘণ্টার মধ্যে রওনা হতে হবে ওদেরকে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ একমনে খেল রানা। বুঝতে পারল আলতাফ ছাড়া আর সবাই লক্ষ করছে তাদের নতুন দলপতিকে। বুঝবার চেষ্টা করছে, মূল্যায়নের চেষ্টা করছে চোখে দেখে যতটুকু সম্ভব। এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল একজন অপরিচিত সামরিক অফিসার। কাঁধের ওপর তিনটে স্টার দেখে বোঝা গেল আর্মি ক্যাপ্টেন, সদ্য প্রমোশন পেয়েছে। ফর্সা চেহারা, চাল চলনে একটা উদ্ধত ভাব। দেখেই আন্দাজ করা যায়, সেপাইদের যম।
‘কি ব্যাপার? এখনও খাওয়াই হয়নি আপনাদের? অথচ আপনাদের এই কোয়ার্টার ভ্যাকেট করবার কথা ছিল ছ’টার সময়। আমাকে আমার কোয়ার্টার থেকে বের করে দিয়ে যদি এ রকম অত্যাচার…’
‘আপনাকে চিনলাম না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। লোকটার গলাটা খোনা, আর ব্যবহারে এমন একটা বিরক্ত বেপরোয়া তাচ্ছিল্যের ভাব রয়েছে যে দেখেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল রানার।
ঝট করে ফিরল অফিসার রানার দিকে। ‘ও, আপনি বুঝি নতুন এসেছেন? তা আপনি কে শুনি?’
‘গেট আউট!’ আঙুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে দিল রানা। ‘আমরা যতক্ষণ আছি কোন পঞ্চম ব্যক্তি চাই না। বেয়ারাকে পর্যন্ত ওই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম দিয়েছি। আপনি এখন যেতে পারেন।
‘কি? আমার বাড়িতে বসে আমাকে গেট আউট?’ কট্ট্ করে চেয়ে রইল ক্যাপ্টেন রানার দিকে। রাগে লাল হয়ে গেছে সারা মুখ। আবার হাতের ইশারায় দূর হয়ে যেতে বলল ওকে রানা। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে ঘর ছেড়ে।
‘আজ আমরা কেন সমবেত হয়েছি জানার জন্যে নিশ্চয়ই আপনারা সবাই উৎসুক হয়ে আছেন। আমরা কেউ কাউকে চিনি না, পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের টেনে আনা হয়েছে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে। শত প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে সবার মনে। আমি আপনাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি একে একে। সম্মিলিত চেষ্টায় আমাদেরকে একটা অসাধ্য সাধন করতে হবে। খুলে বলছি, শুনুন…’
.
‘গেছি রে গেছি, বাবা, নির্ঘাত মারা পড়েছি!’ ককিয়ে উঠল মিশ্ৰী খান। ‘এই সেপ্টেম্বরের তুফানের দিনে সামুন্দার? নৌকায়? উহ্!’ ফস্ করে দেশলাই জ্বেলে কিংস্টর্ক সিগারেট ধরাল সে একটা।
‘ক্যাপ্টেন খান ঠিকই বলেছেন,’ বলল মাহবুব চান। ‘মস্ত বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন আপনি, মেজর রানা। হুকুম করলে আমি নেভিগেট করব, কিন্তু পৌঁছতে পারব কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
‘ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে। অন্য কোনও পথে আমাদের বিপদ আরও বেশি। আলতাফ, তুমি কোথায় চললে?’ কথাটা শেষ হবার আগেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল আলতাফ ব্রোহী। দেখা দেখি তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিশ্ৰী খান। হাতে একটা পিস্তল।
‘মাহবুব, পাশের ঘর থেকে টর্চটা নিয়ে এসো। কুইক!’ বলে রানাও এক লাফে বেরিয়ে এল বাইরে।
কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল, টর্চ আনতে আনতে বেড়া টপকে একশো গজ দৌড়ে চলে গেছে সে। দুটো গুলি ছুঁড়ল মিশ্রী খান- লাগল না একটাও। বেয়ারা দৌড়ে এগিয়ে এল। আলতাফকে দেখা গেল না কোথাও।
‘লোকটাকে চেনো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘চিনি, হুজুর! ক্যাপ্টেন সাহেবের খানসামা, করিম। বোবা আর কালা।’
‘বোবা-কালা যদি হবে তো লুকিয়ে লুকিয়ে কি শুনছিল সে কান পেতে?’
কোনও জবাব দিল না বেয়ারা। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল ওদের দিকে।
‘কোথায় গেছে তোমার ক্যাপ্টেন সাহেব?’
‘অফিসারস্ ক্লাবে।’
‘ডেকে আনো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে বলবে।’
বেয়ারা চলে যেতেই ফিরে এল ওরা ডাইনিং রূমে। একটা ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান। বলল, ‘ওকে ধরা না গেলে আমাদের রওনা হওয়ার কোনও মানে হয় না, ওস্তাদ। ব্যাটা স্পাই। আমার কোনও সন্দেহ নাই।
গম্ভীর মুখে পায়চারি করল রানা কিছুক্ষণ। আবার চেয়ারে এসে বসে অপেক্ষা করছে আলতাফের। এমনি সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল একটা মিশমিশে কালো লোক। গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরনে। পেছনে ওর একটা হাত মুচড়ে ধরে ঢুকল আলতাফ ব্রোহী। অপর হাতে একটা ছোরা।
‘ব্যাটা ছোরা তুলেছিল! ওর কব্জিটা ভেঙেই ফেলেছি কিনা জানি না,’
বলল আলতাফ।
‘কি নাম তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা লোকটাকে। ‘কি করছিলে তুমি এখানে?’
কোনও জবাব দিল না লোকটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। খটাং করে মাথার পেছনে আলতাফের হাতের এক গাঁট্টা পড়তেই ককিয়ে উঠল তারপর ‘আঁউ-আঁউ’ করে বোবার মত বিকট শব্দ বের করল মুখ থেকে।
‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছে, তার উত্তর দাও। তোমার অভিনয় দেখতে চাওয়া হয়নি।’ উঠে বসল মিশ্ৰী খান। ধীরে সুস্থে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সে একটা সাইলেন্সার লাগাচ্ছে ওর পিস্তলের মুখে।
আবার খানিকক্ষণ বিকট আওয়াজ বের করল সে মুখ দিয়ে। ওর পেছন দিকে কানের কাছে একটা শব্দ করল আলতাফ তুড়ি দিয়ে, কিন্তু যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাবে সামনের দিকে চেয়ে রইল লোকটা। মাহবুবের মনে হলো নিশ্চয়ই লোকটা বোবা এবং কালা। বলেই ফেলল, ‘লোকটা সত্যি বোবা-কালা।’
‘হতে পারে, না-ও হতে পারে,’ বলল রানা। কিন্তু ও যে আড়ি পেতেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া নিরপরাধ লোক এমন হঠাৎ ছোরাই বা বের করবে কেন? কাজেই আমরা যে বিরাট কাজে হাত দিয়েছি তাতে ঝুঁকি নেয়া চলবে না।’ হঠাৎ নিষ্ঠুর নির্দয় হয়ে উঠল রানার কণ্ঠস্বর, ‘আলতাফ!’
‘বলো, মেজর।’
‘ছুরি তো আছেই। ঝটপট কাজ সেরে ফেল। ঠিক হৃৎপিণ্ড আন্দাজ করে চালাবে।’
একটা আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল মাহবুবের মুখ থেকে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। দড়াম করে উল্টে গেল চেয়ারটা। ‘কি করছেন, মেজর…’
মুখের কথা বেধে গেল মাহবুবের। অবাক হয়ে দেখল ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেল লোকটা কাঠের দেয়ালে। প্রাণভয়ে একটা হাত তুলে রেখেছে সে ওপরে। ঘরের কোণের দিকে সরে যাচ্ছে সে গুটিসুটি মেরে। সারা মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। চোখ ফিরিয়ে দেখল বিজয়ীর হাসি আলতাফের মুখে, মিশ্রী খানও বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। হঠাৎ নিজেকে আস্ত গর্দভ মনে হলো ওর। স্বভাবতই বেশি কথা বলে মিশ্ৰী খান। হা-হা করে হেসে উঠে বলল, ‘বোবা কালারও জানের ভয় আছে, বাবা। ভাল কায়দা করেছেন, ওস্তাদ।
এমনি সময় ঘরে ঢুকল ক্যাপ্টেন বেয়ারার সাথে। ভুরু জোড়া কুঁচকে আছে। আক্রমন্ত্রক ভঙ্গি। ঢুকেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘কি পেয়েছেন আমাকে, মি. মাসুদ রানা? যখন-তখন ডেকে পাঠাবার আপনি কে? ঘরটা আবর্জনামুক্ত হলো কিনা দেখতে এসেছি। আপনার কথা শুনতে আসিনি।’
‘এই লোকটা কে?’ কোণের দিকে ইঙ্গিত করল রানা।
কোণের দিকে চেয়েই মুখের ভাব পাল্টে গেল ক্যাপ্টেনের। ‘আরে! করিম! আমার খানসামা। ও ওখানে কেন?’
‘দেয়ালে কান ঠেকিয়ে বাইরে থেকে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল।’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
‘খবরদার, ক্যাপ্টেন!’ মিশ্রী খানের পিস্তলটা ক্যাপ্টেনের দিকে ধরা।
‘আমরা সবাই দেখেছি। ও কি আপনার স্পাই না ভারতের, কেবল তাই জানতে চাই আমরা।’
অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাপ্টেন মিশ্রী খানের পিস্তলের দিকে। জোর করে হাসবার চেষ্টা করল সে। লাল হয়ে উঠল ওর ফর্সা মুখ। বলল, ‘বিশ্বাস করি না, তার কারণ লোকটা বোবা ও কালা।
‘বোবা কিনা জানি না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু কালা যে নয় তার প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।’ একটা হাত তুলে ক্যাপ্টেনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে এ ব্যাপারে তর্কাতর্কি করবার সময় আমাদের নেই। লোকটাকে এক্ষুণি অ্যারেস্ট করুন এবং অন্ততপক্ষে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যেন সে কারও সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতে না পারে সেজন্যে নির্জন সেলে আটকে রাখুন। কথা বলতে পারুক আর না পারুক, লোকটা ভয়ঙ্কর।’
‘চমৎকার, চমৎকার!’ তিক্ত হাসি হাসল ক্যাপ্টেন। ‘একজন সিভিলিয়ানের হুকুম তামিল করতে হবে আমাকে। কোথাকার মাতব্বর এসেছেন আপনি.
রানাকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে থেমে গেল সে। টেবিলটা ঘুরে হেঁটে এসে ক্যাপ্টেনের এক ফুট দূরে থামল রানা। কঠোর দৃষ্টি ওর চোখে।
‘আপনার এই ব্যবহারের জন্যে ইচ্ছে করলেই কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারতাম- কিন্তু তা করব না। সময় নেই আমাদের হাতে। যা বলছি তাই করবেন আপনি, নইলে ডিমোশন তো হবেই, কোর্ট মার্শালও হতে পারে। কি? কর্নেলের সাথে দেখা করতে হবে, না আমার হুকুম তামিল করবেন?’
বেত্রাহত কুকুরের মত কুঁকড়ে গেল ক্যাপ্টেন। বুঝল, মুখে যা বলছে কাজেও সেটা করে দেখাবার ক্ষমতা আছে এই লোকের। সবার সামনে এই চরম অপমান আর পরাজয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল সে বাঁশপাতার মত। কিন্তু অল্পক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে।
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। অত সব ভয় না দেখালেও চলত। যা বলছেন তাই হবে। জানি, বেহুদা আপনার সন্দেহ, তবু…। বেয়ারা, দু’জন গার্ড ডেকে নিয়ে এসো।’
‘আপনার অপমানিত বোধ করবার কিছুই নেই, ক্যাপ্টেন,’ চট করে বলল মিশ্রী খান। ‘যাঁর হুকুম পালন করতে যাচ্ছেন তিনি বর্তমানে সিভিলিয়ান হলেও আর্মিতে আপনার চেয়ে এক র্যাঙ্ক ওপরে ছিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন