কাজী আনোয়ার হোসেন
‘তার মানে, ও তখন জেগেই ছিল,’ আলতাফ বলল উত্তেজিত চাপাস্বরে।
‘হ্যাঁ, জেগে ছিল। এবং আমার প্রত্যেকটি কথা শুনেছে ও। কেন ওর প্রতি আমাদের এত আগ্রহ, এত যত্ন, বুঝতে পেরেছে ও পরিষ্কার। ও যে আমাদের কাজে কতবড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা ওর আর অজানা নেই। ওর মনের মধ্যে কি তুফান যে বয়ে গেছে, কি প্রচণ্ড অভিমান উথলে উঠেছে ওর বুকের মধ্যে, ভাবতেও আমার—আলতাফ!’ ঘড়ির দিকে চাইল একবার রানা। স্পনেরো মিনিটে বেশি দূর যেতে পারবে না ও, এই গুহার পঞ্চাশ গজের মধ্যেই আছে। চলো, তিনজন তিন দিকে যাব। খুঁজে বের করতেই হবে ওকে।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুটো বড় বড় পাথরের মাঝখানে পাওয়া গেল মাহবুবকে। অজ্ঞান। এমন ভাবে লুকিয়েছিল যে পাথরের গায়ে রক্তের দাগ না দেখতে পেলে কিছুতেই বের করা যেত না।
অবলীলায় তুলে নিল আলতাফ ওকে, ফিরে এল গুহায়। খানিকটা ব্র্যাণ্ডি খাওয়াবার চেষ্টা করল রানা ওকে- বেশির ভাগই পড়ে গেল কষা বেয়ে বাইরে। আলগা হয়ে যাওয়া বেতগুলো বেঁধে দিল রানা শক্ত করে। নাকে একটা গন্ধ আসতেই চমকে উঠল সে। মিশ্ৰী খান না আসা পর্যন্ত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ঠিক মত, কিন্তু রানা মনে মনে উপলব্ধি করল, মিশ্রী খানও কিছু করতে পারবে না এখন আর। কেউই কিছু করতে পারবে না। সময় পার হয়ে গেছে।
দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করছে রানা। তন্দ্রায় জড়িয়ে আসতে চাইছে দুই চোখ। অনেকক্ষণ পর চোখ তুলতেই দেখল এতক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে ছিল আরীফ ওর দিকে, ও চাইতেই চোখ সরিয়ে নিল।
‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘না, ভাবছিলাম, দ্বারোকা পৌঁছবেন কি করে?’
‘তোমার কোনও প্ল্যান আছে?’
‘আশেপাশের প্রত্যেকটা গ্রামে আজ রাত থেকে সার্চ আরম্ভ হয়ে যাবে। আমার মনে হয় ভোর হওয়ার আগেই যদি আমরা রেল লাইনটা ক্রস করে পশ্চিমে চলে যেতে পারি তাহলে আমাদের খুঁজে বের করা ওদের পক্ষে কঠিন হবে। শত শত গুহা পথ আছে পশ্চিমের পাহাড়গুলোর গায়ে, আমাদের ধরা খুবই কঠিন হবে। একবার দ্বারোকা পৌঁছতে পারলে আর চিন্ত ৭ নেই। ওখানে দু’দুটো গোপন আস্তানা আছে আমাদের।’
‘আমরাও সেই প্ল্যানই ঠিক করে এসেছিলাম। ভয় ছিল গুহার গোলক ধাঁধায় না পড়ে যাই। তুমি সঙ্গে থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। ভোর চারটের সময় আমরা এখান থেকে রওনা হব।
‘কি চিন্তা করছেন?’ অনেকক্ষণ রানাকে চুপচাপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল আরীফ
‘ভাবছি টিএনটি আর ডিটোনেটারের বাক্স দুটো কোথাও লুকিয়ে ফেলতে পারলে হত। কখন কি অবস্থায় আমাদের এই গুহা ছাড়তে হয় কিছুই বলা যায় না। একে মাহবুব, তার ওপর বাক্সগুলো, সব মিলে মস্ত বোঝা হয়ে যাবে জরুরী অবস্থায়।
খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবল আরীফ, তারপর বলল, ‘চিন্তা নেই। আমি এগুলো এমন একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখব যেখান থেকে খুঁজে বের করা কারও পক্ষে সম্ভবপর হবে না কিছুতেই। দুটো বাক্স তো একা নিতে পারব না, আপনাদের একজনকে আসতে হবে আমার সঙ্গে আধঘণ্টার ব্যাপার।
‘আমি যাচ্ছি,’ উঠে দাঁড়াল আলতাফ। বড় বাক্সটা অনায়াসে তুলে নিল কাঁধের ওপর। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল আরীফের পেছন পেছন।
মিশ্রী খান আর নাজির বেগ ফিরে এল আধঘণ্টার মধ্যেই। প্রায় সাথে সাথেই ফিরল আলতাফ আর আরীফ। কথার খৈ ফুটল মিশ্রী খানের মুখে। নাজির বেগের আশ্চর্য কৌশলে ওষুধপত্র, খাবার আর কাপড়-চোপড় জোগাড়ের কাহিনী। শেষে বলল, ‘খোদ কর্নেলের কোয়ার্টার থেকে রুটি নিয়ে এসেছে সে।
‘কর্নেলের বাড়ি থেকে? অসম্ভব!’ বলল রানা।
‘নাজির বেগের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়, ওস্তাদ। কিছুই অসম্ভব নয়। আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গেছে, দুই হাঁটু ঠকাঠক বাড়ি খাচ্ছে তখন আমার, চিন্তা করছি একটু আওয়াজ পেলেই ঝেড়ে দৌড় দেব- কিন্তু কোনদিকে যাব স্থির করে উঠতে পারছি না…এমন সময় ঝুড়ি ভর্তি করে এইসব নিয়ে বেরিয়ে এল ভাতিজা নিরাপদে। এই লোকের সঙ্গে আর কোথাও পাঠালে আমি হার্টফেল করব, ওস্তাদ!’
‘কিন্তু গার্ড, সেন্ট্রি, কেউ দেখল না?’
‘সব ব্যাটারা বোধহয় বেরিয়ে পড়েছে আমাদের খুঁজতে। কর্নেলের সদর দরজায় দুটো টোকা দিয়েই ছুটে গিয়ে ঢুকেছে সে পেছনের রান্নাঘরে। পথে গ্রামের কয়েকজন লোককে ডেকে তুলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জেনেছে মিলিটারি সার্চের ব্যাপার। সব কিছুই ওর চেনা।’
আরীফ আর নাজির বেগ নিচু গলায় কি যেন আলাপ করছে। বেশির ভাগ কথা বলছে নাজির বেগ।
‘কি ব্যাপার, আরীফ?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যাপার তেমন সুবিধের নয়, মেজর। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের এই জায়গা ছেড়ে সরে যেতে হবে। নাজির তো এই মুহূর্তে রওনা হতে চায়। আশেপাশে সমস্ত গ্রাম আজ রাতের মধ্যে সার্চ করে ওরা ভোরে আবার আসবে পাহাড়ে। এখনই সরে না গেলে অসুবিধা হবে।’
‘কিন্তু মাহবুব?’
‘ওস্তাদ!’ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মিশ্রী খান। ‘মাহবুবের এই দশা হলো কি করে?’
স্পালিয়ে গিয়েছিল ও গুহা থেকে। আমাদের গলগ্রহ হয়ে থাকতে চায় না ও আর। লুকিয়ে ছিল দুটো মস্ত পাথরের ফাঁকের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায়। আলতাফ খুঁজে বের করেছে।’
জিভ দিয়ে চুক্ চুক শব্দ করল মিশ্রী খান। তারপর বলল, ‘আগামী দু’দিনের মধ্যে ওকে এখান থেকে এক পা-ও সরানো যাবে না। আজ রাতে তো অসম্ভব।’
ব্যাণ্ডেজ খুলতে আরম্ভ করল মিশ্রী খান। পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করল রানা। দুর্গের ম্যাপ। বলল, ‘এদিকে আসুন, মি. নাজির বেগ। দুর্গটা সম্পর্কে আপনার সাথে কিছু আলাপ করতে চাই। শুনলাম দুই-দুইবার আপনি ঢুকে দেখে এসেছেন দুর্গের ভেতরটা। আমি নিজেও অনেক কিছু জানি, কিন্তু আপনার জ্ঞানও আমার খুব কাজে লাগবে। সব কিছু বলে যান, কোথায় কি আছে কিচ্ছু বাদ দেবেন না। পাওয়ার রূম, গার্ড রুটিন, অ্যালার্ম সিসটেম, সব। যত সামান্য ব্যাপারই হোক বাদ দেবেন না, যেমন ধরুন দরজাগুলো ভেতর দিকে খোলে না বাইরের দিকে, কোনখানে ছায়াটা বেশি ঘন, কোথায় আলো, কোথায় অন্ধকার, প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ব্যাপার জানতে চাই আমি।
‘কিন্তু ভেতরে ঢুকছেন কি করে আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল আরীফ।
‘এখনও সেটা জানি না। দুর্গটা না দেখলে আগে থেকে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’ রানা অনুভব করল চট্ করে ওর দিকে একবার চেয়েই অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল আলতাফ। দুর্গে ঢোকার প্ল্যান ওরা নৌকাতেই ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু যত কম লোকে প্ল্যানটা জানতে পারে ততই মঙ্গল। এরই ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।
ঘণ্টা খানেক হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইল ওরা চার্টের ওপর। প্রতিটা নতুন তথ্য নোট করে নিল রানা। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ নাজির বেগের চোখ। মাত্র দুইবারের স্বল্পস্থায়ী অবস্থানেই সবকিছু দেখে এসেছে সে। চার্ট দেখেই ছবির মত সবকিছু ফুটে উঠল ওর মনের পর্দায়- গড় গড় করে বলে গেল যা যা দেখেছে সব। মিশ্ৰী খান আর আলতাফ ব্রোহী মাহবুবের পা-টা ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দিল আবার। কাজ শেষ করেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিশ্ৰী খান মাহবুবের পাশে।
‘পিঠটা একটু সোজা করে নিই, ওস্তাদ, তারপর একটু কথা আছে।’
আলতাফ নিঃশব্দে রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আধ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে।
‘সবাই চুপ! কি যেন নড়াচড়া করছে বাইরে।’
কথাটা শেষ হবার আগেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল নাজির বেগ। এমনি সময় হঠাৎ কথা বলে উঠল মাহবুব।
প্রলাপ বকছে। ক্রমেই গলার স্বর উঠছে ওপরে।
মিশ্ৰী খান উঠে বসে মাহবুবের একটা হাত ধরল, আরেক হাত কপালে আর চুলের মধ্যে বুলাতে বুলাতে নিচু গলায় আবোল তাবোল কথা বলতে আরম্ভ করল। একঘেয়ে ভাবে কথা বলে যাচ্ছে মিশ্রী খান। প্ৰথমে কিছুই ফল হলো না- কিন্তু অল্পক্ষণেই হিপনোসিসের মত কাজ দিল মাথায় হাত বুলানো আর অনর্গল একঘেয়ে সুরে কথা বলা। থেমে গেল প্রলাপ ধীরে ধীরে। হঠাৎ চোখ খুলে চাইল সম্পূর্ণ সজাগ মাহবুব।
‘কি ব্যাপার, ক্যাপ্টেন খান? আমার মাথায়…
‘শ্ শ্ শ্!’ চুপ করতে ইশারা করল মিশ্রী খান।
বুঝতে পারল মাহবুব। গুহার চারদিকে চেয়ে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। আবার চোখ বন্ধ করল সে।
‘কিছু না,’ পর্দা সরিয়েই বলল নাজির বেগ। ‘কয়েকটা পাহাড়ী ছাগল।
‘ছাগল তো মনে হলো না আমার কাছে,’ বলল আলতাফ। ‘আমি আরেকবার দেখে আসি।’
মিশ্রী খানের ইশারায় রানাও বেরিয়ে এল গুহার বাইরে।
‘একটু শুঁকে দেখেন, ওস্তাদ!’
রক্তমাখা একরাশ ব্যাণ্ডেজ তুলে ধরল মিশ্রী খান রানার নাকের সামনে। একটু শুঁকেই নাক কুঁচকে পেছনে সরে গেল রানা।
‘কি হয়েছে, মিশ্রী?’
‘গ্যাংগ্রিন! বলল মিশ্ৰী খান হতাশ কণ্ঠে। ‘গ্যাস গ্যাংগ্রিন। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। ছেলেটাকে বাঁচানো গেল না, ওস্তাদ।’
একটু পরেই ফিরে এল আলতাফ। ছাগলও দেখতে পায়নি সে এবার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন