দুর্গম দুর্গ – ১৪

কাজী আনোয়ার হোসেন

চোদ্দ

রাত আটটা। সাড়ে-আটটা থেকে কারফিউ। দ্রুত তৈরি হয়ে নিচ্ছে সবাই।

ইশরাত একটা লম্বা রশিতে এক হাত পর পর গিঁঠ দিয়ে ফেলেছে, এখন একটা বাঁশের কঞ্চির মাথায় বাঁকানো লোহার হুক বাঁধছে শক্ত করে। কঞ্চিটা সোমনাথের মন্দির থেকে ফিরবার পথে ভেঙে এনেছে ওরা। তিনটে ট্রাক ভর্তি সোলজার দেখে একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে লুকিয়েছিল ওরা। ওখান থেকেই কঞ্চিটা জোগাড় করেছে ইশরাত।

ট্রাকের ভারি বারো ভোল্টের ব্যাটারি নিয়ে এসেছে ওরা ছাতের ওপর তিরপল ঢেকে। ব্যাটারিটা চুরি করে এনেছে মিশ্ৰী খান। একটা গুদাম ঘরের সামনে দাঁড়ানো সাতটনের মাল-টানা ট্রাক থেকে। পো বার্নিং ফিউজ, ক্লক- ওয়ার্ক ফিউজ, সব নষ্ট হয়ে যাওয়াতে এখন একমাত্র ভরসা ব্যাটারি।

দুর্গ প্রাচীরের উত্তর দিকে চলে এসেছে ওরা। অফিসারস্ কোয়ার্টারের ছাতের ওপর ওরা এখন। দুর্গের সামনে সমুদ্রের দিকে অন্ধকার জেটি দেখা যাচ্ছে আবছা। বাড়িতে একটি প্রাণীও নেই। দুর্গের মধ্যেও বিশেষ লোকজন আছে বলে মনে হলো না রানার। কয়েকশো সৈন্য অফিসারদের অধীনে ভাগ ভাগ হয়ে সারা শহর চষে ফেলছে এখন রানাদের খোঁজে। একদল আবার গেছে সোমনাথের মন্দিরের দিকে।

‘চমৎকার জায়গা বের করেছ, আরীফ। গাঁজা খেয়েও ওরা কল্পনা করতে পারবে না যে ওদের অফিসারস্ কোয়ার্টারের ছাতে আমরা এখন নিশ্চিন্তে বৃষ্টিতে ভিজছি,’ বলল মিশ্ৰী খান।

‘হ্যাঁ। কেউ কসম খেয়ে বললেও ওরা বিশ্বাস করবে না,’ বলল আলতাফ।

ছাতের কিনারে দাঁড়িয়ে দুর্গের দিকে চেয়ে দেখল রানা। মাত্র চল্লিশ ফুট দূরে তিরিশ ফুট উঁচুতে দেখা যাচ্ছে চারটে প্রকাণ্ড কামানের মুখ। পাহাড়ী এলাকায় তৈরি করা হয়েছে এই দুর্গ। পাহাড়ের একটা গুহামুখে বসানো হয়েছে কামানগুলো। কোনও দিক থেকেই এগুলো ধ্বংস করবার উপায় নেই- জাহাজ তো ভিড়তেই পারবে না কাছে, প্লেন থেকে বম্বিং করলে হয় পাহাড়ের ওপর পড়বে, নয় সাগরে। রীতিমত মাথা খাটিয়ে দুর্ভেদ্য করা হয়েছে এই দুর্গকে।

চারপাশ ভাল করে দেখে নিয়ে ফিরে এল ওরা ঘরের ভেতর।

‘চলো, মিশ্রী। আজকের নাটকে তুমিই নায়ক। সময় হয়ে এসেছে আমাদের। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রানা আর মিশ্রী খান পৌঁছে গেল ইশরাতের নির্দেশিত কাফেতে। কাফের চাইতে ‘বারে’র আকর্ষণই গ্রাহকদের কাছে বেশি কয়েকজন বুঁদ হয়ে বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, সামনে টেবিলের ওপর আধ-খাওয়া গেলাস।

কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগল কাফেটা রানার কাছে। আসন্ন কারফিউ এর কারণ হতে পারে। বসে পড়ল ওরা কোণের টেবিলে। বেয়ারা এসে দাঁড়াতেই দুটো ব্র্যাণ্ডি আনতে বলল রানা।

কাফের বাঙালী মালিক রুচিসম্পন্ন লোক মনে হলো। একটা রেডিয়োগ্রামে ওস্তাদ আবদুল করিম খানের থারটি থ্রী স্পীড লং-প্লে রেকর্ড বাজছে। ঠুমরী। সময়টা বর্ষণ মুখর সেপ্টেম্বর মাস হলেও ‘ফাগুয়া ব্রিজ দেখন কো চালোরী’ একটা অপূর্ব আবেশ ছড়িয়েছে অনতিপ্রশস্ত কাফের মদির অভ্যন্তরে। ইশরাতের কথা মনে পড়ে গেল রানার। রওনা হবার আগের মুহূর্তে আড়ালে ডেকে নিয়ে হঠাৎ গলা জড়িয়ে ধরেছে সে রানার, ফিসফিস করে বলেছে, ‘নিজের প্রতি লক্ষ রেখো, রানা। কথা দাও, কোনও রকম অনাবশ্যক ঝুঁকি নেবে না!’

কথাগুলো বারবার ঘুরে ফিরে আসছে ওর মনের মধ্যে। ওদিকে ফাগুনের গান ছেড়ে ভৈরবী ধরেছেন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ। মেয়েলী গলায় গাইছেন ‘যমুনা কে তীর…।’ রানা ভাবছে এটা কি তিন-তিনবার ওর প্রাণ রক্ষা করার জন্যে ইশরাতের কৃতজ্ঞতা? গালের ওপর ওই দু’ফোঁটা পানি কি বৃষ্টির পানি?’

এক মিনিট, দুই মিনিট করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আটটা পঁচিশ। পেটের মধ্যে পাকস্থলীতে অদ্ভুত এক ধরনের বিজাতীয় অনুভূতি হলো রানার। ইশরাতের চিন্তা আপনা-আপনি সরে গেল ওর মন থেকে। পর পর দুই আউন্স ব্র্যাণ্ডি খেয়ে অনেকখানি চাঙ্গা বোধ করছে সে এখন। সেই তিনজন সামরিক পোশাক পরা লোক তেমনি বসেবসে গল্প করছে আর কফি খাচ্ছে। খুব সম্ভব দুর্গে কেরানিগিরি জাতীয় কোনও কাজ করে। ইশরাত বলেছে ঝড় হোক বৃষ্টি হোক রোজ সন্ধ্যার পর এখানে এসে বসে আড্ডা মারা ওদের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাক্ষিণাত্যের লোক ওরা।

‘আর কতক্ষণ, ওস্তাদ?’ অধৈর্য হয়ে উঠছে মিশ্ৰী খান।

‘পাঁচ মিনিট,’ আশ্বাস দিল রানা।

কাফেটা বন্ধ করবার জোগাড় করেছে দোকানদার। জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়ে কয়েকটা বাতি নিভিয়ে খরিদ্দারদের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে এবার গাত্রোত্থান করতে হবে। একজন দু’জন করে সবাই বেরিয়ে গেল, কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে, কেউ রেইন-কোট গায়ে। উত্তেজনায় মিশ্রী খানের কপালের একটা শিরা ফুলে উঠেছে। হাত দুটো কাঁপছে অল্প অল্প- চোখ দুটো যেন বসে গেছে আরও খানিকটা। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যাবে ওদের ভাগ্য। এই ক’দিনের এত কষ্ট, এত পরিশ্রম সব কিছুর সার্থকতা নির্ভর করছে আগামী দুই মিনিটের মধ্যে যে কাজটা ওরা করতে যাচ্ছে তার সাফল্যের ওপর। রানা ভাবল আজ রাত মিশ্রী খানের রাত। কিন্তু সময় কাটছে না কিছুতেই!

আটটা বেজে আটাশ মিনিট হতেই উঠে দাঁড়াল রানা। মিশ্রী খান বসে রইল। দরজার কাছে গিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখল রানা। আরও দেখল, রাস্তার ওপর কাছে-কিনারে একটি জন-প্রাণীও নেই। পকেট হাতড়ে কি যেন খুঁজছে রানা। ভ্রূ-কুঁচকে গেছে। কাউন্টারের দিকে না এগিয়ে আবার টেবিলের দিকে যাচ্ছে সে। চোখে পড়ল, উঠে দাঁড়িয়েছে মিশ্রী খানও। হঠাৎ থেমে দাঁড়াল রানা সামরিক পোশাক পরা লোকগুলোর টেবিলের তিনফুট তফাতে। হাতটা বেরিয়ে এল পকেট থেকে।

‘একটুও নড়াচড়া করবে না!’ পরিষ্কার হিন্দীতে বলল রানা। ওর ডান হাতে শোভা যাচ্ছে পয়েন্ট থ্রী-টু ক্যালিবারের ওয়ালথার পি. পি. কে। ওস্তাদ আবদুল করিম খান তখন গাইছেন ঝিঁঝিট ঠুমরী। পিয়া বিনে নাহি আওত চ্যয়ন’-এর পরিবেশ পাল্টে গেল এক মুহূর্তে। গমগম করে উঠল আবার রানার গম্ভীর কণ্ঠস্বর। ‘একচুল নড়লে স্রেফ খুন করে ফেলব! আমরা বেপরোয়া লোক!’

স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল লোকগুলো কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ একজন নড়ে উঠল ওদের মধ্যে, ডান কাঁধটা ওপর দিকে উঠল, পরমুহূর্তেই একটা আর্তধ্বনি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ডান বাহুতে এসে প্রবেশ করল মিশ্রী খানের সাইলেন্সড্ পিস্তল থেকে খানিকটা তপ্ত সীসা। বাম হাতে চেপে ধরল ডান বাহু- রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেল আঙুলগুলো।

‘অতএব, সাবধান!’ গোঁফে তা দিল মিশ্ৰী খান।

কাফের ম্যানেজারের দিকে ফিরল রানা। পাতলা লম্বা লোক, চিবুকে চুটকি দাড়ি। গোঁফ জোড়া ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে- ঠোঁটের ওপর মাঝামাঝি জায়গা খানিকটা কামানো। মাথায় বাবরি। চোখে সুরমা। অষ্টম শতাব্দীর বোগদাদী ফল বিক্রেতার মত চেহারা। পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল রানা, ‘এদের মধ্যে কেউ বাঙালী আছে?’

‘না। হ্যাতারা বাঙ্গালোরের লোক- হিন্দীই জানে ন সই মতন। সামলে নিয়েছে সে। কথার টানে রানা বুঝল খাস নোয়াখালীর লোক।

‘বেশ। এদের কোথায় লুকানো যায় বলতে পারবেন?’

‘ঠাইট মারি লাইব আঁরে, হুজুর।’

‘না, মারবে না।’ পিস্তল ধরল রানা ওর পাঁজরের সাথে ঠেসে। একবার চোখ টিপে বলল, ‘ওদের সাথে আপনাকেও বেঁধে রেখে যাব। ভয় নেই। তাহলে হবে তো?’

‘সারব। কাউন্টারের ফিছনে হিয়ান দি আংগোর গুদাম গর। দরোজা খুলি হিঁয়ানেই আংগোরে বান্দি রাখতো ফারেন। চোখে মুখে স্পষ্ট ভীতির চিহ্ন ফুটিয়ে তুলল ম্যানেজার। বুঝে ফেলেছে সে ব্যাপারটা। দু’জন বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছিল। হাতের ইশারায় কেটে পড়তে বলল ওদের রানা। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা কিচেনের দরজা দিয়ে। ফিরে এল রানা সামরিক পোশাক পরা লোকগুলোর টেবিলে।

‘জামা কাপড় সব খুলে ফেলো!’ আদেশ দিল রানা।

‘পাকিস্তানী কুত্তা!’ গাল দিল গুলি খাওয়া লোকটা।

‘আধ মিনিট সময় দিলাম, শার্ট-প্যান্ট খুলে ফেল।’ একই সুরে বলল রানা।

আবার অকথ্য গালি দিল লোকটা। আদেশ পালনের ভাব প্রকাশ পেল না ওদের কারও মধ্যে। ‘দুপ’ করে আরেকটা শব্দ হলো। একজনের হাতের তালু ফুটো করে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। তাজ্জব হয়ে হাতের ফুটোর দিকে চেয়ে রইল লোকটা, ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ।

‘ইউনিফরমটা আর নষ্ট করলাম না। ওগুলোই আমাদের দরকার কিনা!’ যেন স্বাভাবিক আলাপ-আলোচনা করছে এমনি ভাবে বলল মিশ্ৰী খান। পিস্ত লের মুখটা এবার কপাল বরাবর উঠল। ‘কিন্তু এবার দুই চোখের ঠিক মাঝখানটায় তাক করব। তখন কাপড় খুলে নিতে আমাদের খুব বেশি কষ্ট পেতে হবে না।

কথা শেষ হবার আগেই জামা কাপড় খুলতে আরম্ভ করেছে তিনজন। রাগে অপমানে আর ব্যথায় ফোঁপাচ্ছে আহত দু’জন। বেঁটে একজন লোকের কাঁধের ওপর একটা চাপড় লাগাল মিশ্ৰী খান।

‘তোমার খুলতে হবে না, ভাতিজা। ওই জামা আমার দশ বছরের ছেলের গায়েও লাগবে না।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে সামনের সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে এল ওরা নির্জন রাস্তায় ভারতীয় সামরিক পোশাক পরে। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। একটি জন- প্রাণীর চিহ্ন দেখা গেল না লম্বা রাস্তায়। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলল ওরা বৃষ্টিকে তুচ্ছ করে। পঞ্চাশ গজ গিয়ে হাতের ডাইনে মোড় নিল ওরা। ইশরাতের আস্তানার পাশ দিয়ে আসবার সময় কয়েক সেকেণ্ড থামল কেবল। দরজা দিয়ে একটা ফর্সা হাত বেরিয়ে এল। দুটো মিলিটারি ব্যাগের ভারে নুয়ে আছে হাতটা। ব্যাগের মধ্যে আছে রশি, ফিউজ আর অত্যন্ত শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ। ব্যাগদুটো কাঁধে ঝুলিয়ে নিল রানা আর মিশ্রী খান। হুক লাগানো কঞ্চিটা এগিয়ে দিল ইশরাত এবার, মৃদু চাপ দিল রানার হাতে চাপা গলায় বলল, ‘সব ঠিক আছে। ক্যাপ্টেন আলতাফ চলে গেছে ওর পজিশনে। আমি এক্ষুণি ফিরে যাচ্ছি অফিসারস্ কোয়ার্টারে। সব কিছু রেডি। খোদা হাফেজ

এগিয়ে গেল ওরা রাস্তা ধরে দুর্গের দিকে। একটা বন্ধ হেয়ার-কাটিং সেলুনের বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়াল। ইঙ্গিত পেলেই রওনা হবে। তিরিশ গজ দূরে দেখা যাচ্ছে দুর্গ তোরণে দাঁড়ানো দু’জন সশস্ত্র প্রহরীকে। অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

দেড় মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। শহরের মাঝামাঝি এলাকায় একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো। চারশো গজও হবে না ওখান থেকে। সাথে সাথেই শোনা গেল একটা মেশিনগানের গর্জন। আবার পর- পর কয়েকটা বিস্ফোরণের শব্দ এল। হ্যাণ্ড গ্রেনেড আর মিশ্রী খানের তৈরি গোটা কতক বোমা নিয়ে মেতে গেছে আলতাফ নকল যুদ্ধে।

তীব্র একটা সার্চ লাইটের আলো জ্বলে উঠল দুর্গ তোরণের খিলানে। সমস্তটা রাস্তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল এক মুহূর্তে।

আরও আধ মিনিট অপেক্ষা করে লাফিয়ে রাস্তায় পড়েই পাগলের মত ছুটল ওরা দুর্গের দিকে। হুক লাগানো কঞ্চিটা বগলে চেপে রেখেছে রানা কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল ওরা গেটের কাছে। কয়েক পা এগিয়ে এল গার্ড দু’জন ব্যাপার কি জানার জন্যে।

‘ছোটো সবাই আলিবাবা স্ট্রীটে!’ চিৎকার করে বলল রানা। স্পাকিস্তানী কুত্তাগুলো আটকা পড়েছে একটা বাড়িতে! মর্টার নিতে ফিরে এসেছি আমরা। জলদি ছোটো তোমরা। জলদি!’

‘কিন্তু গেটে থাকবে কে?’ হতবুদ্ধি গার্ডদের একজনের চেতনা ফিরল। কিন্তু বিন্দুমাত্র সন্দেহ করল না সে রানাদের। বিস্ফোরণের শব্দ, অঝোর বৃষ্টি, সামরিক পোশাকে ওরা দু’জন- সন্দেহের কথা মনে আসাটাই অস্বাভাবিক। বলল, ‘গেট ছেড়ে যাব কি করে?

‘বুদ্ধু কাহিকে!’ ধমকে উঠল রানা। ‘এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষে লাভ কি? হারামজাদারা এখন আলিবাবা স্ট্রীটে। ওদের ধ্বংস করতে হবে! ভগবানের দোহাই লাগে, ছোটো, এবারও যদি হাতছাড়া হয়ে যায় আমাদের সব ক’জনের হাতে হাতকড়া পড়বে।

কথা শেষ হবার আগেই ছুটল গার্ড দু’জন আলোকিত রাস্তা ধরে। আধ মিনিটের মধ্যেই দ্বারোকা দুর্গের মাঝখানে চলে এল রানা ও মিশ্রী খান।

.

চারদিকে হট্টগোল বেধে গেছে দুর্গের মধ্যে। কেউ চিৎকার করে হুকুম করছে, কেউ হুইসল্ বাজাচ্ছে, কেউ বা সগর্জনে ট্রাকের এঞ্জিনে স্টার্ট দিচ্ছে, কয়েকজন সার্জেন্ট ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক ব্যস্ত ভাবে। রানা আর মিশ্ৰী খানও দৌড়াচ্ছে সমানে। খুব যে তাড়াহুড়ো আছে ওদের তা নয়, কিন্তু দুর্গের অভ্যন্তরে আর সবার গতিবিধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, তাই ওদেরকে দৌড়াতে হচ্ছে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে।

হাতের বামে দুটো ব্যারাক পড়ল, ডাইনে পাওয়ার হাউস। তারপর একটা অস্ত্রের গুদাম, তারপর মস্ত ওয়াটার ট্যাঙ্ক। সিনিয়র অফিসারস্ কোয়ার্টারের সামনে চলে এল ওরা। দুর্গের সবকিছু রানার মুখস্থ, প্রত্যেকটা জিনিসই চিনতে পারছে সে অক্লেশে। ব্রিগেডিয়ারের কোয়ার্টারের সামনে থামল রানা। মনস্থির করে নিয়েই হুড়মুড় করে উঠে এল চার-পাঁচটা সিঁড়ির ধাপ। জোর-ধাক্কায় দু’পাট দরজা খুলে গেল। কী-বোর্ডের সামনে দাঁড়ানো প্রহরী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে ওদের দিকে। হাতের ব্রেনগানটা সোজা রানার বুকের দিকে ধরা।

‘ওটার মুখটা অন্য দিকে সরাও, উল্লুক!’ গর্জে উঠল রানা। ‘ব্রিগেডিয়ার কোথায়? জলদি বল, গর্দভ! ভয়ানক ব্যাপার!’

‘বিগ্‌…বিগ্…ব্রিগেডিয়ার নেই। ও…ও…ও…ওরা সবাই, দুঃ…দুঃ…দু’মিনিট আগে বে…ব্বে…ব্বে…’

‘কি বললে? বেরিয়ে গেছে?’ চোখ পাকিয়ে ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করল রানা।

‘আগ্…আগ্ আজ্ঞে, হ্যাঁ। সঙ্গে আর স…স…’

চট্ করে প্রহরীর ঘাড়ের ওপর দিয়ে ওর পেছন দিকে চাইল রানা। তারপর বলল, ‘তাহলে পেছনে কে?’

কৌশলটা বুঝতে পারল না তোতলা প্রহরী। পেছন ফিরে চাইল। পরমুহূর্তেই ঢলে পড়ল কানের পেছনে পিস্তলের বাঁটের প্রচণ্ড একটা আঘাত খেয়ে। কী-বোর্ডে ঝোলানো সব ক’টা চাবি খুলে নিয়ে পকেটে পুরল রানা। হাত-পা-মুখ বেঁধে টেনে এনে সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে রাখল ওরা প্রহরীর জ্ঞানহীন দেহ, তারপর ছুটল আবার রাস্তার মাঝখান দিয়ে।

কামান চারটের কাছে পৌঁছতে আরও একটা বাধা আছে। কয়জন গার্ড থাকবে কে জানে। দু’জনের হাতের শক্তিশালী টর্চ জ্বলে উঠল। দৌড়ানোর সাথে সাথে লাফালাফি করছে টর্চের আলো। দূর থেকে যে-ই দেখুক বুঝবে দু’জন লোক ছুটে আসছে কামান ঘরের দিকে, গোপন করার কোনও রকম চেষ্টা নেই ওদের মধ্যে- কাজেই সন্দেহের কিছু নেই।

ম্যাগাজিন গেটের কাছাকাছি আসতেই রানার চোখে পড়ল দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত। পিস্তলটা বের করল রানা। টর্চটা বাম হাতে চলে গেছে ওর। এগিয়ে এল উদগ্রীব উদ্বিগ্ন প্রহরী দু’জন। চারদিকে হট্টগোল শুনতে পাচ্ছে ওরা কেবল, ব্যাপার কি বুঝতে পারছে না।

‘তোমরা সব ঠিক আছ তো?’ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কেউ এসেছিল এখানে? বোবা বনে গেলে কেন, জলদি বলো!’

‘কেউ আসেনি তো! আমরা ঠিকই আছি। এত গোলাগুলির আওয়াজ কিসের?’ জিজ্ঞেস করল একজন শিরস্ত্রাণ পরা প্রহরী।

‘ওই পাকিস্তানী কুত্তাগুলো। গেটের গার্ড দু’জনকে খুন করে ঢুকে পড়েছে দুর্গের ভেতর। ঠিক বলছ তো কেউ আসেনি এখানে? দাঁড়াও, আমি নিজে চেক করে দেখি।’ টর্চটা ঘুরিয়ে প্রকাণ্ড স্টীলের দরজার তালা দেখল রানা পরীক্ষা করে। আশেপাশে দেখল, কেউ কোথাও নেই। ‘যাক বাঁচা গেল। সাবধানে থেকো তোমরা।’ চট করে টর্চের তীব্র আলোটা একবার প্রহীর চোখের ওপর ফেলে ওর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েই নিভিয়ে দিল রানা। পরমুহূর্তে ঢলে পড়ল প্রহরী জুলফির কাছে পিস্তলের বাঁটের একটা ভয়ঙ্কর আঘাত খেয়ে। খট করে আরেকটা শব্দ হলো পাশেই। দ্বিতীয় প্রহরীটাও পড়ল প্রথম জনের ওপর।

‘বেঁধে ফেল ওদের, মিশ্রী। আমি তালাটা খুলছি।’

পঞ্চম চাবিটা লাগল। প্রকাণ্ড স্টীলের দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। দূরে আলতাফের মেশিনগানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গেটের কাছ থেকে একটা ট্রাকের এঞ্জিনের শব্দ এল- শেষ ট্রাকটাও বোধহয় বেরিয়ে গেল দুর্গ থেকে।

মিশ্রী খানকে জ্ঞানহীন দেহ দুটো ভেতরে টেনে এনে দরজা লাগিয়ে ওপরে উঠবার আদেশ দিয়ে এগিয়ে গেল রানা। খাড়া একটা স্টীলের ম‍ই বেয়ে উঠে এল সে কামান বসানো গুহায়।

সাবধানে এগোল রানা। ম্যান-ট্র্যাপ থাকতে পারে। এখন প্রথম কাজ ভেতরে আরও কোনও গার্ড আছে কিনা দেখে নেয়া, দ্বিতীয় কাজ এখান থেকে বেরোবার বন্দোবস্ত ঠিক রাখা। সব কাজ দ্রুত সারতে হবে, কিন্তু তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।

চারদিকে টর্চের আলো ফেলে বুঝল রানা স্বাভাবিক গুহাকে কেটে আরও বড় করে নেয়া হয়েছে কাজের সুবিধার জন্যে। শত শত টন শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ আর অসংখ্য কামানের শেল থরে থরে সাজানো এগিয়ে গেল রানা সামনে। বিশ গজ গিয়েই গুহাটা বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। ঘুরেই চোখ পড়ল গুহামুখে বসানো বিশাল চারটে কামানের ওপর। অন্ধকারে যেন খাপ পেতে বসে অপেক্ষা করছে কারও জন্যে চারটে ভয়ঙ্কর দৈত্য টর্চ নিভিয়ে দিল রানা। বোঝা গেছে কেউ নেই আর। এখন টর্চ জ্বালা থাকলে কারও চোখে পড়তে পারে গুহামুখের এই আলো।

কাছে গিয়ে একটা কামান স্পর্শ করে দেখল রানা। স্বপ্ন দেখছে, না সত্যি সত্যিই এসে গেছে সে? যেগুলো ধ্বংস করতে এতদূর এসেছে সে ঢাকা থেকে, সত্যিই কি সে এত কাছে এসে পৌঁছেচে সেগুলোর? কেমন যেন অবাস্তব লাগল ওর কাছে সবকিছু। নিঃশব্দে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে আছে মস্ত চারটে কামান। কমপক্ষে বারো ইঞ্চি বোর হবে। এ যেন অন্য জগতের অবাস্তব কোনও জিনিস।

হঠাৎ চমকে উঠল রানা। কিসের যেন শব্দ হলো? কান পেতে রইল সে কিছুক্ষণ। নাহ, কোনও শব্দ নেই। বুঝল শব্দ নয়, শব্দের অভাবই ওকে চমকে দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে বাস্তবে। চারদিক নিস্তব্ধ। আলতাফের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর।

আলতাফ মারা গিয়ে থাকুক আর গুলি চালনা বন্ধই করে থাকুক, সময় ফুরিয়ে আসছে। আর অল্পক্ষণেই টের পেয়ে যাবে ভারতীয়রা যে বোকা বানানো হয়েছে ওদের। ছুটে আসবে ওরা এখানে। দ্রুত সারতে হবে সব কাজ। প্রথম, পালাবার ব্যবস্থা।

এগিয়ে গিয়ে রেলিং-এর ধারে বসে পড়ল রানা। ব্যাগ খুলে বের করল লম্বা রশি। গুহামুখের ডানধারে চলে গেল রানা। রশির একমাথা শক্ত করে বাঁধল রেলিং-এর সঙ্গে। রেলিংটা ঝাঁকিয়ে দেখল ওর ভার সহ্য করতে পারবে কিনা। বুঝল পারবে। নামিয়ে দিল রশিটা নিচে। রেলিং টপকে সামনের দিকে ঝুঁকে চারদিকে দৃষ্টি বুলাল রানা একবার।

নিচে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। কামানগুলো থেকে সোয়াশো ফুট নিচে। ডান পাশে দুর্গ প্রাচীর এসে মিশেছে পাহাড়ের গায়ে। অফিসারস্ কোয়ার্টারের ছাত আবছা দেখা যাচ্ছে তিরিশ ফুট নিচে গজ পনেরো দূরে। দ্বারোকা শহরটা দেখা যাচ্ছে আবছা মত। ফিরে এল সে মিশ্রী খানের সাথে দু’একটা কথা সেরে নিতে।

ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে ফিউজ, ডিটোনেটার, এক্সপ্লোসিভ আর সরু তামার তার ঘাঁটাঘাঁটি করছে মিশ্রী খান। রানাকে আসতে দেখে চোখ তুলল।

‘এই বোমাগুলোর মধ্যেই ব্যবস্থা করি, কি বলেন, ওস্তাদ?’ কয়েক সারি বাক্সের দিকে বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখাল মিশ্ৰী খান। ক্লক ওয়ার্ক ফিউজের কাঁটা ঠিক করে ফেলেছে সে।

‘যেখানে খুশি রাখো। শুধু লক্ষ রেখো, সহজেই যেন খুঁজে বের করতে না পারে। ওদের তো জানবার কথা নয় যে আমরা বুঝে ফেলেছি যে আমাদের ফিউজগুলো নষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তাই না?’

‘ঠিক, ওস্তাদ। ওরা যদি কোনও ক্রমে খুঁজে বের করতে পারত আমাদের বসানো বোমা তাহলে হেসে খুন হয়ে যেত। কিন্তু হাসিয়ে নয়, বোমা মেরে খুন করতে চাই। তাই ভাল করে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু ব্যাটারি?

‘আনছি। তুমি নিচের দরজা ঠিকমত তালা দিয়েছ তো?’

‘বিলকুল। এ সব ব্যাপারে আমার…’

কথাটা শেষ হলো না। হঠাৎ করে একটা জোর ধাতব শব্দ হলো নিচে। গমগম করতে থাকল শব্দটা গুহার মধ্যে। চমকে দু’জন চাইল দু’জনের দিকে। আবার ভেসে এল শব্দ, আবার, আবার।

‘এসে গেছে ওরা। হাতুড়ি নিয়ে এসেছে। পিটাচ্ছে স্টীলের দরজা ভাঙবার জন্যে,’ ফিসফিস করে বলল রানা। বলেই ছুটল কামানগুলোর দিকে। মিশ্রীও ছুটল পেছন পেছন।

‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা টের পেল কি করে যে আমরা ঢুকে পড়েছি এর মধ্যে?’ প্রশ্ন করল মিশ্রী খান ছুটতে ছুটতে।

‘নাজির বেগ!’ কর্কশ শোনাল রানার গলাটা। ‘দুর্গের সব কথাই বলেছিল সে আমাদের, কেবল নিচের দরজা খোলার সাথে সাথে যে গার্ডরূমে অ্যালার্ম বেল বেজে ওঠে সেই কথাটা চেপে গিয়েছিল।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন