দুর্গম দুর্গ – ৪

কাজী আনোয়ার হোসেন

চার

‘আমি আর আলতাফ আগে উঠে যাব ওপরে। জিনিসপত্র ওপরে তোলা হয়ে গেলে তোমরা দু’জন আসবে।’ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা।

মস্ত বড় কোনও গাছের অসংখ্য শিকড় বেরিয়ে আছে বিশ ফুট প্রায় খাড়া হয়ে থাকা পাহাড়টার গা থেকে। দড়িটা কয়েকবার ছুঁড়ে দিয়েও যখন কোনও কিছুর সঙ্গে বাধাতে পারল না, তখন এই শিকড় বেয়ে ওঠাই স্থির করল রানা। যে-কোনও মুহূর্তে শিকড় ছিঁড়ে পাথরের ওপর পড়ে হাড়গোড় ভাঙবার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এছাড়া আর উপায়ই বা কি।

হাত ছাড়া আর কিছুর সাহায্য নিতে পারছে না ওরা। পা রাখার কোনও জায়গা নেই। অনেকটা রশি বেয়ে ওঠার মত। একটা করে শক্ত মত শিকড় ধরছে, টেনে দেখছে ছিঁড়ে যাবে কিনা, তারপর এক হাতের ওপর ভর দিয়ে উঠছে ছয় ইঞ্চি, অপর হাত খুঁজছে আরেকটা শিকড়। অতি সাবধানে এইভাবে একফুট-দুইফুট করে উঠে যাচ্ছে ওরা ওপরে। সাত মিনিটের মধ্যেই দুই হাত ব্যথা হয়ে গেল রানার। বাইসেপের পেশী দুটো কাঁপছে থর-থর করে। হাতে আর শক্তি নেই। দুই হাতে শিকড় ধরে ঝুলে থাকল সে কিছুক্ষণ। আরও পাঁচ ফুট উঠতে হবে। হাঁপাচ্ছে রানা। হৃৎপিণ্ডটা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে বুকের ভেতর থেকে। মাথাটা কাৎ করে দেখল, আলতাফ হাসছে ওর দিকে চেয়ে।

‘আলতাফ!’ ফিস্ ফিস্ করে বলল রানা, ‘বাকিটুকু খুব সাবধানে উঠতে হবে। কিসের যেন শব্দ পেলাম!’

মাথা ঝাঁকাল আলতাফ। আবার উঠতে থাকল ওরা। দুই মিনিট পর দুই হাতে ধরল রানা কিনারের একটা পাথর।

ধীরে, অত্যন্ত সাবধানে মাথাটা উঁচু করল রানা। চোখ জোড়া ওপরে উঠতেই থেমে গেল সে। চারদিকের অন্ধকারে একবার চোখ বুলাল। প্রকাণ্ড একটা বট গাছ ঝড়ে উপড়ে পড়ে আছে বেশ খানিকটা দূরে। এই বটেরই শিকড় ধরে উঠেছে ওরা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল সে চারদিকে। সমস্ত অনুভূতি শ্রবণেন্দ্রিয়ে একত্রীভূত করবার চেষ্টা করল। নাহ্, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের শনশন শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনাও যাচ্ছে না। যতদূর দেখা যাচ্ছে অন্ধকার আর অন্ধকার। কোথাও একটু বেশি গাঢ়, কোথাও হালকা। নিজের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে হাসি পেল রানার। এই মুহূর্তে কেউ যদি লাথি মেরে ওর আঙুলগুলো সরিয়ে দেয় তাহলেও কিছু করবার উপায় নেই ওর। এক ঝাঁকিতে দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে বুক পর্যন্ত উঠে এল সে ওপরে।

হঠাৎ চমকে উঠল রানা। লাফিয়ে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। বেশ কিছুটা দূরে বড় বড় গোটা কয়েক পাথরের চাঁই পড়ে ছিল- একটা পাথর নড়ে উঠল উঠে দাঁড়াল একজন লোক। দশ গজও হবে না। এগিয়ে আসছে ছায়া- মূর্তিটা এদিকে। এই অন্ধকারেও পরিষ্কার চিনতে পারল রানা- আর্মি গার্ড। গায়ে রেইনকোট, পায়ে গাম বুট, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। সেনা বাহিনীর লোক- ভুল নেই তাতে

দুই সেকেণ্ড পাথরের মত নিশ্চল হয়ে রইল রানা। বুকের রক্ত হিম হয়ে জমে গেছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে আর। এইভাবে মৃত্যুই তাহলে কপালে লেখা ছিল! কয়েক পা এগিয়ে এসেছে সেন্ট্রি। রাইফেল প্রস্তুত। মাথাটা একপাশে সরিয়ে কিছু শুনবার চেষ্টা করছে যেন সে। বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ আর সমুদ্র তরঙ্গের উচ্ছ্বাসকে ছাপিয়ে আরও কিছু যেন শুনবার চেষ্টা করছে সে।

রানা সামলে নিয়েছে নিজেকে। এখন ওপরে উঠবার চেষ্টা করা অহত্যারই সামিল। কিছুটা শব্দ হবেই, এবং বিনা দ্বিধায় গুলি করবে প্রহরী। আবার নিচে নামতে হবে তাকে। অত্যন্ত সাবধানে নামতে হবে। এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি করে। দ্রুত কিছু করতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে ওর চোখে।

অতি যত্নের সঙ্গে ধীরে ধীরে মাথাটা নামাল রানা নিচে। প্রহরীটা এগিয়ে আসছে। রানার গজ পাঁচেক ডাইনে ওর লক্ষ্যবিন্দু। মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল রানার। দুই হাতের আটটা আঙুল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না ওপরে। আলতাফ দুই ফুট নিচে থাকতে আর শিকড় পায়নি হাতের কাছে। কিছুটা নেমে আবার উঠল সে রানার পাশে। কানে কানে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার, রানা?’

‘সেন্ট্রি!’ ফিস ফিস করে জবাব দিল রানা। ‘ও কিছু শুনেছে। খুঁজছে আমাদের।’

হঠাৎ দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল রানা। আলতাফও তাই করল। ঝলসে উঠল এক ঝলক আলো। ওদের অনভ্যস্ত চোখ আঁধার হয়ে গেল। টর্চ জ্বেলে সেন্ট্রিটা এবার পাড়টা পরীক্ষা করছে মনোযোগের সাথে। কিনার থেকে কয়েক ফুট দূর দিয়ে হাঁটছে সে। এই ঝড়ের রাতে পা পিছলে নিচে পড়ে যাওয়ার ভয়েই বোধহয়। কিংবা কিনার দিয়ে হাঁটলে হঠাৎ একটা হাত এগিয়ে এসে খপ করে পা ধরে টেনে ফেলে দিতে পারে নিচে, সেই ভয়ে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আলোটা। রানা বুঝল ওর আঙুলগুলো সেন্ট্রি দেখতে পাবেই। কারণ সে পরিষ্কার উপলব্ধি করল, কেবল সন্দেহপ্রবণ হয়েই যে লোকটা খুঁজছে তা নয়, লোকটা স্থির নিশ্চিত যে কিছু না কিছু সে দেখতে পাবেই। এবং যতক্ষণ খুঁজে না পাচ্ছে ততক্ষণ থামবে না। এই অবস্থায় বাদুড়-ঝোলা হয়ে ওর হাতে ধরা পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। এমনি সময় এক হাতে স্পর্শ করল আলতাফ রানার হাত।

‘একটা পাথর!’ ফিসফিস করে বলল আলতাফ। ‘ওর পেছন দিকে ফেলতে হবে।

ডান হাতে খুঁজল রানা কিনারটা, কাদা আর ঘাসের গুচ্ছ ছাড়া কিছুই ঠেকল না হাতে। একটা মার্বেলের অর্ধেক সাইজ পাথরও পেল না সে। হঠাৎ মনে পড়ল ওর অফিসের একটা চাবি রয়ে গেছে ওর পকেটে। আলোটা তখন তিন ফুট দূরে। চাবিটা বের করে ছুঁড়ে মারল সে বাম দিকের অন্ধকারে আন্দাজের ওপর কয়েকটা পাথর লক্ষ্য করে। এক সেকেণ্ড পার হয়ে গেল, তারপর দুই সেকেণ্ড, রানার মনে হলো পাথরে লাগেনি চাবিটা- হয়তো কাদায় পড়েছে। আলোটা আলতাফের কাঁধ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে আছে। এমনি সময় ঠং করে পাথরের ওপর চাবির শব্দ হলো। ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল সেন্ট্রি। একবার অনেকখানি জায়গার ওপর টর্চটা বুলিয়ে দেখে নিয়ে আলো ফেলল সে পাথরগুলোর ওপর। তারপর ছুটল সেদিকে। রাইফেলটা টর্চের সাথে চেপে ধরেছে সে। চকচক করছে ব্যারেলটা আলো পড়ে।

গার্ডটা দশ গজও যায়নি, চিতাবাঘের মত নিঃশব্দে উঠে গেল আলতাফ ওপরে। ছুটে গিয়ে ঝড়ে পড়া গাছটার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

বিশ গজ দূরে সেন্ট্রিটা তখন ভয়ে ভয়ে এ-পাথর, ও-পাথরের ওপর আলো ফেলছে। আলতাফ ওর ছুরির বাঁট দিয়ে একটা পাথরের ওপর দুটো টোকা দিল। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল সেন্ট্রি। গাছটার দিকে আলো ফেলল, তারপর পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে আনাড়ির মত দৌড় দিল গাছের দিকে। হাঁটুর কাছে রেইনকোটের ফ্ল্যাপ দুটো বাড়ি খাচ্ছে। দৌড়ের ফলে টর্চটা দুলছে ওপর নিচে। রানা এক নজর দেখতে পেল সেন্ট্রির বিভ্রান্ত চেহারাটা। অল্পবয়সী- মাহবুবের সমান হবে। ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে দুই চোখ। রানা ভাবল, একমাত্র খোদাই জানে বেচারার মনের মধ্যে এখন ভয় আর আতঙ্কের কি প্রবল আলোড়ন চলেছে। নির্জন সমুদ্রের উঁচু পাড়ের ওপর ঠুংঠাং খুট-খাট শব্দ, অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না; নিঃসঙ্গ, একাকী সে। ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকার রাতে বাতাসের সাঁই-সাঁই শব্দ আর সাগরের ক্রুদ্ধ গর্জন। ভয় পেয়েছে ছেলেটা। রানার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা মমত্ববোধ জাগল। রানারই মত সে-ও মানুষ, কারও আদরের সন্তান, কিংবা ভাই, অথবা স্বামী, প্রিয়তম। কর্তব্য পালন করতে এসেছে সে, ওপরওয়ালার হুকুম তামিল করছে মাত্র। দুঃখ হলো রানার এই একাকী, উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত ছেলেটির জন্যে। অথচ মরতেই হবে একে। আর দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই মৃত্যু হবে ওর। ধীরে ধীরে মাথা তুলল রানা ওপরে।

‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ককিয়ে উঠল রানা। স্পড়ে যাচ্ছি, ধরো!’

থমকে দাঁড়াল আতঙ্কিত সেন্ট্রি আলতাফ যেখানটায় লুকিয়ে আছে তার চার ফুটের মধ্যে। ঘুরে দাঁড়াল রানার দিকে। এক সেকেণ্ড এদিক ওদিক খুঁজে স্থির হলো আলোটা এসে রানার মুখের ওপর। একমুহূর্ত মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকে রাইফেল তুলল সে কাঁধে। পরমুহূর্তেই একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ঢলে পড়ল সে মাটিতে।

উঠে এল রানা ওপরে। মৃত সেন্ট্রির দিকে চাইল একবার। রক্ত মাখা ছুরিটা সেন্ট্রির রেইনকোটে মুছে নিয়ে বেল্টে বাঁধা খাপের মধ্যে রেখে দিল আলতাফ।

‘এতে কি প্রমাণ হয়, রানা?’ জিজ্ঞেস করল আলতাফ। লোকজনের সামনে মেজর বলে ডাকে সে রানাকে। স্পর পর অনেকগুলো দৈব-সংযোগ। সন্দেহজনক, তাই না?’

‘হ্যাঁ। লঞ্চে করে তাড়া, দ্বীপে সৈনিক, এখানে পৌঁছে গার্ড! কেটি বন্দরের সেই ক্যাপ্টেনের কপাল খারাপ। কমোডোর জুলফিকার আর আমাদের বুড়ো মিটা, কেউ ছাড়বে না ওকে। আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

মাথা ঝাঁকাল আলতাফ।

‘ও নিশ্চয়ই করিমকে ছেড়ে দিয়েছিল।’

‘নিশ্চয়ই, তাছাড়া আর কে জানবে আমাদের গন্তব্যস্থল? এরা আমাদের পৌঁছানোর অপেক্ষায় প্রস্তুত আছে। এই ঝড়ের রাতেও অন্ততঃপক্ষে তিরিশ- চল্লিশটা গার্ড মোতায়েন করে দিয়েছে এই পাহাড়ী সমুদ্র-তীরে।’ গলার স্বরটা নিচু করে প্রায় আপন মনে বলল রানা, ‘এখন যত শিগগির সম্ভব সরে যেতে হবে এখান থেকে।

‘সিগন্যাল, তাই না?’ বলল আলতাফ। ‘ওরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে নিশ্চয়ই কোনও সিগন্যালের ব্যবস্থা করেছে। হয়তো ফ্লেয়ার…’

‘না। তাহলে ওদের অবস্থান জেনে ফেলার সম্ভাবনা আছে আমাদের। খুব সম্ভব টেলিফোন। ফিল্ড টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছে ওরা। ফ্লেয়ার নয়।’

মাথা ঝাঁকাল আলতাফ। মাটি থেকে মরা সেন্ট্রির টর্চটা তুলে নিয়ে চারদিক খুঁজল। আধ মিনিটের মধ্যেই তার পাওয়া গেল খুঁজে, আর আধ মিনিটের মধ্যেই সেই তার ধরে গিয়ে দেখা গেল পাথরের আড়ালে রাখা আছে একটা টেলিফোন সেট।

‘এখন পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না। যদি রিং হয়, জবাব দিতে হবে, নইলে সব ব্যাটা ছুটে আসবে এখানে। কিন্তু ব্যাটাদের কোনও কোড সিগন্যাল থাকলেই গেছি।’ কয়েক পা এগিয়েই থামল রানা। কিন্তু আলতাফ, আর কিছুক্ষণের মধ্যে কেউ না কেউ এসে পড়বেই। হয়তো কোনও সার্জেন্ট, নয়তো কোনও রিলিফ, কিংবা হয়তো একে পনেরো মিনিট পর পর রিপোর্ট করবার আদেশ দেয়া হয়েছিল। যে-কোনও মুহূর্তে বিনা নোটিসে কেউ এসে হাজির হতে পারে। ধরো, লাশটা ছুঁড়ে ফেলে দিই সমুদ্রে।’

গাছের একটা মোটা ডালের সাথে শক্ত করে রশিটা বেঁধে ঝুলিয়ে দিল রানা নিচে। এক্সপ্লোসিভের বাক্সটা এল প্রথম, তারপর একে একে আসতে থাকল অন্যান্য জিনিসপত্র। আলতাফ টেনে তুলছে মালগুলো, রানা বসে আছে টেলিফোনের পাশে। হঠাৎ ‘আহ্হা’ বলে উঠল আলতাফ। তিন লাফে কাছে চলে এল রানা।

‘কি ব্যাপার, আলতাফ

‘কি যেন একটা জিনিস খসে পড়ে গেল। ভালমত বাঁধতে পারেনি।’

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রানা, কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। পোড়া তামাটে গন্ধ এল নাকে।

‘সেরেছে। আর একটু হলেই মাথায় পড়ত। যাক, কি জিনিস খোয়া গেল?’

প্রশ্নটা করেই রানা বুঝতে পারল জিনিসটা কি। ও নিজেই সাজিয়ে রেখেছিল ওগুলো গুরুত্ব অনুসারে।

‘খাবার,’ বলল আলতাফ। ‘খাবার, স্টোভ- সব।’

দমে গেল রানা। খাবার ছাড়া এই অজানা অচেনা শত্রুদেশে চলবে কি করে? বৃষ্টির ছাঁট লেগে এতক্ষণ শীত লাগেনি, এবার হঠাৎ শিউরে উঠল রানার সর্বশরীর। কাঁধের ওপর হাত রাখল আলতাফ। মুখে মৃদু হাসি।

‘এতে কিছু এসে যায় না, রানা। বয়ে নিয়ে যাবার বোঝা তো কমল। ভেবে দেখো, ক্লান্ত ক্যাপ্টেন মিশ্ৰী খান কত খুশি হবে এই বোঝা হালকা হয়ে যাওয়ায়!’

এমন সময় তীক্ষ্ণ একটা শব্দে একসাথে চমকে উঠল আলতাফ ও রানা। ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং বেজে উঠেছে টেলিফোন। শক্ত হয়ে গেল রানার মুঠি, আড়ষ্ট হয়ে শুনল সে টেলিফোন রিং। তারপর এগোতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল। ফিরল আলতাফের দিকে।

‘মত পরিবর্তন করলে?’ জিজ্ঞেস করল আলতাফ।

মাথা ঝাঁকাল রানা। মুখে কিছুই বলল না। আলতাফই বলল, ‘উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বাজতেই থাকবে। যখন কিছুতেই উত্তর পাবে না তখন আসবে ওরা, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

‘ভেবে দেখলাম ওই ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে। কিন্তু কতক্ষণ লাগবে ওদের পৌঁছতে সেটাই প্রশ্ন।’ চারদিকে একবার চোখ বুলাল রানা। ‘টেলিফোন ধরা ঠিক হত না। ধরা পড়ে যাবার শতকরা পঁচানব্বই ভাগ সম্ভাবনা। হয়তো গলার স্বরে ধরা পড়ব, কিংবা ভাষায় ধরা পড়ব, কিংবা হয়তো কোড সিগন্যালে ধরা পড়ব- কিন্তু বোঝার উপায় নেই ধরা পড়েছি কিনা। তাছাড়া মিশ্রী আর মাহবুব ছাড়া সবকিছু উঠে এসেছে আমাদের। কেউ জানে না যে আমরা পৌঁছে গেছি। সেন্ট্রিটাকে যখন পাওয়া যাবে না ওরা মনে করবে বেশি কিনারে চলে গিয়েছিল নিষেধ সত্ত্বেও এবং পা পিছলে পড়ে ডুবে গেছে সমুদ্রে। এখন ওদের দু’জনকে নিয়ে কেটে পড়তে পারলেই এই মিশনের প্রথম অর্ধেক সফল হয়।’

‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছ তুমি। এত কষ্টের পর যেটুকু অর্জন করেছি আমরা সেটুকু সামান্য ভুলে নষ্ট করার মত বোকামি আর নেই। কিন্তু এতক্ষণে ওরা রওনা হয়ে গেছে। ফোন থেমে গেছে। নিশ্চয়ই দৌড়ে আসছে ওরা এদিকে ‘

আলতাফের কথা শেষ হবার আগেই দু’জনের চোখে পড়ল কয়েকটা টর্চ এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। প্রায় চার-পাঁচশো গজ দূরে আছে। চলার বেগে টর্চের আলো নাচানাচি করছে এদিক-ওদিক।

দ্রুত রশিটা নামিয়ে দিল আলতাফ। মিশ্রী খান উঠে এল ওপরে- অর্ধেকটা নিজের চেষ্টায়, বাকি অর্ধেক আলতাফের টানে। মাথাটুকু বেরোতেই থেমে গেল। রানা জিনিসপত্রগুলো সরিয়ে রাখছিল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুদূর নেমে বড় বড় কয়েকটা পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে। ফিরে আসতেই দেখল মিশ্রী খানের মাথা। অবাক হয়ে ঝুঁকে দেখল রানা দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে আছে মিশ্রী খান।

‘পৌঁছে গেছ, ক্যাপ্টেন। এবার উঠে পড়ো। ওর কাঁধে দুটো চাপড় দিল রানা আস্তে করে।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল মিশ্ৰী খান। তারপর আছড়ে-পাছড়ে উঠে পড়ল ওপরে। রানা অবাক হয়ে দেখল ওকে, রেইনকোট থাকা সত্ত্বেও ভিজে চুপচুপে ওর জামা-কাপড়। জিজ্ঞেস করল, ‘ওপরে উঠে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলে কেন?’

‘ওপরে উঠে তো চোখ বন্ধ করিনি, ওস্তাদ!’

‘তবে?’

‘নিচেই চোখটা বন্ধ করে নিয়েছিলাম, ওপরে উঠে খুলেছি।’

‘এই বিশ ফুট চোখ বন্ধ করে উঠেছ?’

‘ঠিক তাই। ঝোলাঝুলির কারবারে আর যাব না বাবা, ভারি ভয় লাগে একবার শিয়ালকোটে…’

‘থাক, ক্যাপ্টেন, ওসব তোমার আজীবনীর জন্যে সঞ্চয় করে রাখো। এখন ওই দেখো কারা আসছেন, আমাকে একটু সাহায্য করো মালপত্রগুলো সরাবার কাজে।’

অনেক কাছে চলে এসেছে প্রহরীগুলো। মাহবুব এখনও অর্ধেক উঠতে পারেনি। আলতাফ আর মিশ্রী খানকে সাব মেশিনগান নিয়ে তৈরি থাকতে বলল রানা নিচের ওই পাথরের আড়ালে। নিজে শুয়ে পড়ল মাটির ওপর। মাথাটা বের করে দেখছে সে মাহবুব কতটা এল। বিশ গজের মধ্যে এসে গেছে প্রহরীরা।

পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা এখন যদি মাহবুব ওপরে ওঠে তাহলে ঠিক ওদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হবে ওকে। মাহবুব যদি না-ও মরে প্রহরীগুলো প্রত্যেকে মরবে মিশ্রী আর আলতাফের হাতে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর মাথায়। দুই হাত মুখের কাছে এনে মৃদুস্বরে ডাকল একবার, ‘মাহবুব!’

চট করে ওপর দিকে চাইল মাহবুব।

‘নেমে যাও, মাহবুব! কয়েকজন সেন্ট্রি আসছে এদিকে। আমরা সরে যাচ্ছি, কাছেই লুকিয়ে থাকব। নিচে নেমে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকো মরা মানুষের মত। নেমে রশি ধরে দুটো টান দেবে, আমি উঠিয়ে নেব রশিটা।’

বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে কথাগুলো বুঝবার চেষ্টা করল রক্তক্ষরণে দুর্বল, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মাহবুব। বুঝতে পারল। নেমে যাচ্ছে সে এখন। আর পনেরো গজ দূরেই সেন্ট্রিদের বুটের শব্দ। হঠাৎ হাত ছেড়ে দিল মাহবুব। ও যে কতখানি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে ধারণাই ছিল না রানার। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করল সে ভারি কিছু পতনের। বোধহয় কোনও শিকড়ে পা বেধে গেছে। মড়াৎ করে কিছু ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল। বুকে হেঁটে সরে এল রানা উপড়ে যাওয়া বট গাছটার আড়ালে। আর অপেক্ষা করা যায় না। একবার পাঁচ ফুটের মধ্যে এসে পড়ল একটা টর্চের আলো। মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল রানা আলোটা সরে না যাওয়া পর্যন্ত। রানা জানে ওর ওপর টর্চের আলো পড়া মানেই পাঁচটি সেন্ট্রির মৃত্যু। আর তাহলে ওদের আগমন আর গোপন থাকবে না কারও কাছে।

গাছের আড়ালে পৌঁছেই রশিটা উঠিয়ে ফেলল রানা, লুকিয়ে রাখল একটা ডালের নিচে।

এসে গেছে সেন্ট্রিরা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন