দুর্গম দুর্গ – ১০

কাজী আনোয়ার হোসেন

দশ

কর্নেল রাম নারায়ণ বেঁটে-খাটো ছিমছাম চেহারার লোক। বয়স পঁয়তাল্লিশ। চেহারায় একটা নিষ্ঠুর ভীতিকর ভাব জন্মগত ভাবেই আছে ওর মধ্যে। পরিষ্কার বোঝা যায় এই লোকটার সংস্পর্শই অশুভ। ছোট্ট লম্বাটে মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। ঠোঁটগুলো লালচে। হাসিটা চারকোনা- লেটার বক্সের ফোকরের মত। ভয়ঙ্কর। ডান গালে একটা লম্বা কাটা চিহ্ন। হাসুক বা গম্ভীর হয়ে থাকুক চোখের কোনও ভাব পরিবর্তন নেই। জুল-জুল করছে বিষণ্ণ দৃষ্টি। মুখের মসৃণ চামড়া টান টান হয়ে আছে। রানা বুঝল এ লোক সায়বিক দুর্বলতায় ভুগছে। মানসিক ভারসাম্য নেই।

টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে ছিল রাম নারায়ণ। অলোক রায়ের রিপোর্ট শেষ হতেই হাসল সে রানার দিকে চেয়ে। চারকোনা একটা গর্ত সৃষ্টি হলো মুখে- ভেতরটা অন্ধকার। নিস্পৃহ চোখ জোড়া সারাটা ঘরে ঘুরে এল একবার। এক নজরেই সব কিছু দেখে নিল সে, কিছুই বাদ গেল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা গার্ড, হাত-বাঁধা বন্দীদের পেছনে আছে দু’জন গার্ড, মাহবুবকে বেঞ্চির ওপর শুইয়ে রেখে ঘর্মাক্ত আলতাফ রয়েছে বেঞ্চের এক ধারে। সব চোখে পড়ল কর্নেলের।

‘চমৎকার, অলোক! যথেষ্ট তৎপরতার সাথে কাজ করেছ।’ একটা ভুরু উঁচু করে বন্দীদের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে চেয়ে বলল, ‘সামান্য কিছু গোলমাল হয়েছিল মনে হচ্ছে। বন্দীরা প্রথমে বোধহয় ঠিক সহযোগিতা করতে চায়নি, তাই না?’

‘ওরা কোনও বাধাই দেয়নি। কোনও সুযোগই পায়নি বাধা দেবার। বলার ভঙ্গি দেখে বুঝল রানা, এই লোকটাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে অলোক রায়।

‘ঠিক করেছ, লেফটেন্যান্ট। সুযোগ না দিয়ে ভালই করেছ। এরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর লোক। এদের কোন রকম সুযোগ দিতে হয় না।’ চেয়ারটা ঘুঘর করে পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল রাম নারায়ণ। টেবিল ঘুরে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল আলতাফের সামনে। ‘এই সেই মোটা গর্দভটা, না? এ বোধহয় অতখানি ভয়ঙ্কর না?’

‘এ-ও ভয়ঙ্কর- তবে শুধু ওর বন্ধুদের জন্যে। নিজের এক তিল সুবিধা দেখলে নিজের বাপের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে,’ ঋজু ভঙ্গিতে বলল অলোক রায়।

‘এ আবার আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে, অ্যাঁ?’ আলতাফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিহে, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো আবার?’ ডান হাতটা মুঠি করে তুলল ওপর দিকে, তারপর ধারাল একটা আংটি দিয়ে একটানে আলতাফের গাল চিরে দিল। দীর্ঘ একটা চিহ্ন মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল। ব্যথায় ককিয়ে উঠল আলতাফ, এক হাতে চেপে ধরল রক্তাক্ত গাল, অন্য হাতটা মাথার ওপর উঠিয়ে নি’ল আরক্ষার অভিনয় করল।

‘ঠিকই ধরেছ তুমি, লেফটেন্যান্ট। মাছ খেয়ে খেয়ে কেবল ঢোঁশকা হয়েছে। ভীতুর ডিম। বিরাট শরীর দিয়ে প্রকৃতি সাহসটা নিল্ করে দিয়েছে। এখানেও সেই ভারসাম্য। বেশির ভাগ মোটা লোকই এরকম। কি নাম তোমার, বীরপুরুষ?

‘মহাবীর,’ বলল আলতাফ ভয়ে ভয়ে। ‘আমার নাম মহাবীর নাথুরাম। হাতটা গাল থেকে সরিয়ে চোখের সামনে ধরল আলতাফ। রক্ত দেখে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে ওর মুখ, চোখ দুটো বিস্ফারিত। প্যান্টের পেছনে মুছে আবার হাত দিল সে গালে। রাম নারায়ণের মুখে চারকোনা গর্ত সৃষ্টি হলো

‘রক্ত সহ্য হয় না তোমার, তাই না, মহাবীর? বিশেষ করে সে রক্ত যদি নিজের হয়? কিন্তু এটা তো বীরের লক্ষণ নয়। মহাবীর নাম কে দিল তোমার?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আলতাফ, তারপর হঠাৎ চাইল রাম নারায়ণের দিকে। মুখের চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে দুঃখের চোটে। মনে হলো এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে সে।

‘হুজুর, আমি একজন গরীব জেলে। দিন আনি দিন খাই। রক্ত দেখিনি কোনদিন, দেখতে চাই-ও না। হুজুর, অদৃষ্টে কি লেখা আছে সে কেবল ভগবানই জানেন। আপনি হাসছেন, আমার কান্না পাচ্ছে। ভগবান!- আমাকে এই বিপদের মধ্যে কেন ফেললে, ভগবান!’ টপ্ টপ্ করে দু’ফোঁটা পানি পড়ল আলতাফের গাল বেয়ে। অভিনয়টা এত সুন্দর আর আন্তরিক হয়েছে যে ওর দুঃখে রানারই বুকটা উথলে উঠতে চাইল।

‘সবাই অদৃষ্টের দাস,’ বলল রাম নারায়ণ বিজ্ঞের মত। ‘তুমি তাহলে জেলে একজন?’

‘মিথ্যাবাদী! ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক!’ গর্জে উঠল রানা। আলতাফের ওপর থেকে কর্নেলের মনোযোগ সরিয়ে দিল সে। ঝট করে ঘুরে রানার সামনে এসে দাঁড়াল কর্নেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে।

‘মেজর মাসুদ রানা! ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এত বুদ্ধি, এত সাহস, এত বীরত্ব? অথচ শেষ পরিণতি কি? দ্বারোকা দুর্গের ফাঁসিকাঠ। কি দুঃখজনক, তাই না?

রানা জবাব দিল না কোনও। আবার জিজ্ঞেস করল কর্নেল, ‘কি ভাবছ, মাসুদ রানা? ভাবছ বরাবরের মত এবারও আশ্চর্য ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরে যাবে পাকিস্তানে?’

‘না। এসব কিছুই ভাবছি না আমি। তোমার মুখটা খুব পরিচিত লাগছে আমার কাছে, ভাবছি কোথায় দেখেছি আগে।’

তুমি করে সম্বোধন করায় লাল হয়ে উঠল রাম নারায়ণের কান। চোখে রাগের আভাস ফুটে উঠল। এতখানি Eদ্ধত্য আশা করেনি সে বন্দীর কাছ থেকে। কিন্তু সামলে নিল সে।

‘তাই নাকি? দেখেছ কোথাও আমাকে? হয়তো কলকাতায়…’

‘এইবার মনে পড়েছে স্পষ্ট,’ বাধা দিল রানা। আলতাফের ওপর থেকে কর্নেলের মনোযোগ সরাবার জন্যে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেলল সে। ‘ঠিক বলেছ। কলকাতায়। আলীপুর চিড়িয়াখানার বাঁদরের খাঁচায় লাফালাফি করতে দেখেছি তোমাকে। আমার পরিষ্কার মনে আছে কলাও খাইয়েছিলাম একটা। সেখানে…

হঠাৎ থেমে মাথাটা সরিয়ে নিল রানা। রাগে দাঁত বেরিয়ে গেছে কর্নেল রাম নারায়ণের। দেহের সর্বশক্তি দিয়ে ঘুসি চালিয়েছিল সে, কিন্তু রানা সরে যেতেই শূন্যে ঘুরে গেল মুঠিটা রানার নাকের সামনে দিয়ে। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে হোঁচট খেলো সে একবার, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। সাথে সাথেই রানার বুটের এক প্রচণ্ড লাথি পড়ল ওর হাঁটুর ওপর। ব্যথায় আর্তনাদ করে পড়ে গেল কর্নেল মাটিতে। উঠে দাঁড়াল সে আবার। চিতাবাঘের মত এগিয়ে যাচ্ছিল সে রানার দিকে ঘুসি পাকিয়ে, কিন্তু ব্যথা পাওয়া পা-টা মাটিতে পড়েই ভাঁজ হয়ে গেল সামনের দিকে- আবার পড়ে গেল সে মাটিতে।

ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়েছে, এমনি নিথর নিস্পন্দ হয়ে রইল প্রত্যেকটি লোক। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেন বুদ্ধি হারিয়ে থমকে গেছে।

নড়ে উঠল রাম নারায়ণ। টেবিলের কোণা ধরে উঠে দাঁড়াল সে। মুখটা রক্তশূন্য। কোনও দিকে না চেয়ে টেবিলের কিনারা ধরে ধরে নিজের আসনে ফিরে যাচ্ছে সে এখন। ধ্বক্ ধ্বক্ করে জ্বলছে হিংস্র দুই চোখ।

মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, পরিষ্কার বুঝতে পারল ঘরের প্রতিটা লোক, রাম নারায়ণের চোখে হত্যার নেশা। নিজের ওপরই রাগ হলো রানার- সত্যিই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। রানা বুঝল, দু’জনের মৃত্যু দেখতে হবে ওর আগামী পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে। রাম নারায়ণ আর আলতাফ দু’জনেই মারা যাবে। রাম নারায়ণ মরবে আলতাফের ছুরিতে, আলতাফ মরবে গার্ডদের গুলিতে। কিছুই কি করবার নেই রানার?

রানা দেখল জামার হাতায় গালের রক্ত মুছছে আলতাফ। অর্থাৎ ওর হাতের দুই ইঞ্চির মধ্যে আছে ছুরিটার বাঁট। চোখটা কাত করে দেখল রানা সবচেয়ে কাছের প্রহরীটা ওর থেকে ছয় সাত ফুট দূরে দাঁড়ানো। ওর কাছে পৌঁছবার আগেই ওর হাতের সাব-মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে ওর বুক। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে।

একটা ড্রয়ার টান দিয়ে পিস্তল বের করল কর্নেল। ল্যুগার। রিলিজ বাটন টিপতেই সড়াৎ করে বেরিয়ে এল গুলি ভর্তি ম্যাগাজিন। একবার পরীক্ষা করে নিয়েই ক্লিক করে ঢুকিয়ে দিল সে ম্যাগাজিনটা যথাস্থানে একবার পাইড টানতেই চেম্বারে চলে এল একটা গুলি। এবার চোখ তুলে চাইল সে রানার দিকে। আলতাফের দিকে চাইল রানা, পেছন দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইল। এমন সময় রানা দেখল ঘাড়ের কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে আনল আলতাফ- ছুরি নেই সে হাতে।

টেবিলের কাছে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাওয়া গেল। চোখ ফিরিয়ে রানা দেখল অলোক রায় চেপে ধরে আছে রাম নারায়ণের হাতটা। পিস্তলের মুখ টেবিলের দিকে ফেরানো।

‘এভাবে মারবেন না, স্যার! মাথাটা ঠিক রাখুন, স্যার! আপনার বিপদ হবে!’

‘হাত সরিয়ে নাও!’ হিস হিস করে উঠল কর্নেলের কন্ঠস্বর। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ জোড়া সরাল না রানার চোখ থেকে। ‘হাত ছাড়ো বলছি, লেফটেন্যান্ট! নইলে তোমাকেও যেতে হবে ওই একই রাস্তায়।’

‘ওকে মারলে আপনি বিপদে পড়বেন, স্যার। ব্রিগেডিয়ারের অর্ডার আছে দলপতিকে জ্যান্ত ধরে আনতে হবে। সমস্ত প্ল্যান বের করতে হবে ওর কাছ থেকে।

স্পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন গুলি খেয়ে মরেছে ও,’ বলল রাম নারায়ণ কর্কশ গলায়।

‘এ যুক্তি টিকবে না। এদের সবাইকে তো আর মারতে পারবেন না। এরা সাক্ষ্য দেবে আপনার বিরুদ্ধে।’ হাতটা ছেড়ে দিল সে রাম নারায়ণের। চাপা গলায় বলল, ‘জ্যান্ত চেয়েছে ব্রিগেডিয়ার, কিন্তু কতখানি জ্যান্ত তা বলেনি। যদি আমরা বলি তথ্য বের করতে গিয়ে আধমরা করতে হয়েছে, সেটা যুক্তিসঙ্গত হবে।’

সামলে নিল নিজেকে কর্নেল। সৎ পরামর্শের জন্যে ভেতর ভেতর কৃতজ্ঞতা বোধ করলেও কেন যেন সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ওর অলোক রায়ের ওপর।

‘দিলে তো সব পণ্ড করে। ওকে ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করবারই চেষ্টা করছিলাম আমি। আমাকে আণ্ডারএস্টিমেট করাটা তোমার পক্ষে ঔদ্ধত্য। মনে রেখো, লেফটেন্যান্ট আর কর্নেলের মধ্যে আসমান জমিন তফাৎ আছে। ভবিষ্যতে আর একবার যদি নিজের ক্ষমতার সীমা ল’ঘন করো, তবে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।’ পিস্তলটা টেবিলের ওপর রেখে রানার দিকে ফিরে চারকোনা হাসি হাসল রাম নারায়ণ। কিন্তু এইসব বাজে কথায় রানা ভুলল না। পরিষ্কার বুঝল, ওর প্রাণ রক্ষা করেছে আজ অলোক রায়।

আবার রানার সামনে এসে দাঁড়াল রাম নারায়ণ। এবার রানার পায়ের আওতার বাইরে।

‘এবার কাজের কথায় আসা যাক, মেজর রানা। অঢেল সময় নেই আমার হাতে।

রানা চুপ করে রইল। একবার রাম নারায়ণের মুখের দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। কর্নেলের চোখে অশুভ বার্তা। ভেতরের পশুটা বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে।

‘এক্সপ্লোসিভ কোথায় রেখেছ?’

‘এক্সপ্লোসিভ? সে আবার কি জিনিস?’

‘মনে পড়ছে না?’

‘কি বলছ ভাল করে বুঝতেই পারছি না। কিসের এক্সপ্লোসিভ?’

‘তুমি?’ মিশ্রী খানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কর্নেল। ‘তুমি বুঝতে পারছ আমার প্রশ্ন?’

‘পানির মত,’ জবাব দিল মিশ্ৰী খান।

‘কোথায় বাক্স দুটো?’

‘ওই যে ময়দানটা, যেখানে রোজ মরা গরুর নাড়ী টেনে বের করে খাও তুমি আকাশ থেকে নেমে, ওইখানে রেখে দিয়েছি। গলা-ছেলা ধাড়ি শকুন কোথাকার!’

হাত দুটো মুঠি করে সহ্য করে নিল নারায়ণ। অপদস্থতার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্যে সরে গেল সে ঘরের মাঝখানে। এদের কাছ থেকে কথা বের করা যাবে না।

‘এদের মধ্যে সহযোগিতার ভাব দেখা যাচ্ছে না মোটেও, তাই না, অলোক?’

‘এদের জিজ্ঞেস করার চাইতে ঘরের দেয়ালকে জিজ্ঞেস করাও ভাল, স্যার। অন্তত অভদ্র ব্যবহার তো করবে না।’

‘ঠিক বলেছ, অলোক। এরা একটু অভদ্র। কিন্তু তথ্যটা আমার বের করতেই হবে- এবং তিন মিনিটের মধ্যে। বলো দেখি কি করে বের করা যায়?’ ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল সে। তারপর দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল মাহবুবের দিকে। একটানে চাদর উঠিয়ে ফেলল সে মাহবুবের গায়ের ওপর থেকে। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই ধাঁই করে একটা কিল মারল মাহবুবের ভাঙা পায়ের ওপর। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল মাহবুবের দেহটা, কিন্তু একবিন্দু শব্দ বেরোল না ওর মুখ থেকে। সম্পূর্ণ সজাগ আছে সে এখন, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে সহ্য করল সে এই অবর্ণনীয় ব্যথা। রক্ত গড়িয়ে পড়ল ঠোঁট কেটে, কিন্তু টু শব্দ করল না মাহবুব।

‘সাবধান, রাম নারায়ণ!’ রানার চাপা কণ্ঠস্বরে দারুণ উত্তেজনা প্রকাশ পেল। ভয়ানক কঠোর হয়ে গেছে ওর মুখটা। ‘এর জন্যে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাকে।’

‘কঠিন শাস্তি, তাই না?’ আবার ভাঙা পায়ে আঘাত করল কর্নেল নিষ্ঠুর, নির্বিকার ভাবে। ‘তাহলে? শাস্তিটা আরও কঠিন হয়ে গেল, তাই না, মাসুদ রানা?’ চারকোনা বীভৎস হাসি হাসল সে। ‘একটা জিনিস আমি বরাবর লক্ষ করেছি মেজর, পাকিস্তানীরা যতই দুর্দান্ত আর দুর্ধর্ষ হোক না কেন, মনটা তাদের খুবই নরম। কারও কষ্ট সহ্য করতে পারে না তারা।’ মাহবুবের সস্প্লিন্ট বাঁধা ব্যাণ্ডেজের কাছে চলে গেল কর্নেলের হাত। স্পাঁচ সেকেণ্ড সময় দিলাম। টিএনটি-র বাক্স কোথায় আছে বলে ফেলো, নইলে… তোমার আবার কি হলো, মোটা গাধা?’

কয়েক পা এগিয়ে এসেছে আলতাফ। কর্নেলের কাছ থেকে একগজ দূরে দাঁড়িয়ে টলছে সে।

‘আমাকে…আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।’ দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে সে। একটা হাত গলায় আরেক হাতে পেট চেপে ধরেছে সে। ‘বমি হয়ে যাবে। সহ্য করতে পারছি না। ভগবান! বাতাস, বাতাস—

‘বাইরে যাবে কেন, মহাবীর? মজা দেখো—সেন্ট্রি! জলদি ধরো!’ আলতাফের দুই চোখ কপালে উঠেছে, চোখের সাদা অংশ শুধু দেখা যাচ্ছে। ‘ব্যাটা ভীতুর ডিম অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাইরে নিয়ে যাও ওকে।

রানা দেখল দু’জন প্রহরী ছুটে যাচ্ছে আলতাফের দিকে। ভয়ে বিবর্ণ আরীফের মুখ। নাজির বেগ নির্বিকার। চট্ করে চাইল সে মিশ্রী খানের দিকে। মিশ্রীর চোখের পাপড়ি দুটো সামান্য একটু নামল নিচে। রানা বুঝল চতুর পাঞ্জাবী বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা- এবং প্রস্তুত আছে।

দু’জন গার্ড ছুটে এসে ধরল আলতাফকে। দুই জনের দুই কাঁধে দুই হাত রাখল আলতাফ। চোখের কোণ দিয়ে দেখল রানা ওর পেছনের সেন্ট্রিটা এখন মাত্র চার ফুট দূরে। ওর সমস্ত মনোযোগ আলতাফের ওপরে, সাব- মেশিনগানটা ঝুলছে নিচের দিকে মুখ করে। রানা বুঝল, কিছু আন্দাজ করার আগেই আঘাত করতে পারবে সে ওকে।

আলতাফের হাত দুটো দুই সেন্ট্রির গলার কাছে ঝুলছে। হঠাৎ উঁচু হয়ে ফুলে উঠল আলতাফের প্রকাণ্ড কাঁধের পেশী দুটো। সাথে সাথেই ঝাঁপ দিল রানা। অসতর্ক সেন্ট্রির পেটের ওপর ভয়ঙ্কর বেগে আঘাত করল রানা ডান কাঁধ দিয়ে। বুকের হাড়ের এক ইঞ্চি নিচে। তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল লোকটা কাঠের আলমারির ওপর, সেখান থেকে মাটিতে।

ঝাঁপ দেয়ার সময়ই দুটো মাথার প্রচণ্ড সংঘর্ষের শব্দটা শুনতে পেয়েছে রানা। একটু ঘুরতেই চোখে পড়ল ওদের পেছনে দাঁড়ানো দ্বিতীয় প্রহরীটা ঘুরে পড়ে গৈল মাটিতে তলপেট বরাবর মিশ্রী খানের বুটের একটা বিশ্রী লাথি খেয়ে।

আলতাফ ততক্ষণে বাম পাশের মূর্ছিত প্রহরীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে একখানা অটোমেটিক কারবাইন। সোজা রাম নারায়ণের বুকের দিকে সেটা ধরা এখন।

সবটা ব্যাপার এত দ্রুত এত অনায়াসে ঘটে গেল যে তাজ্জব বনে গেল ঘরের প্রতিটা লোক। নিস্তব্ধতা থম থম করতে থাকল ঘরটার মধ্যে। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল অটোমেটিক কারবাইন। পর পর তিনটে গুলি করল আলতাফ কর্নেলের হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। দড়াম করে দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলো কর্নেলের দেহটা, তারপর পড়ে গেল মাটিতে। বেঞ্চের কোণায় ঠাস করে বাড়ি খেলো কপালটা, কিন্তু ব্যথার বোধ তখন আর নেই কর্নেলের, প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে আগেই। চিৎ হয়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। চোখ দুটো খোলা। তেমনি বিষণ্ণ ভাবলেশহীন দৃষ্টি সে চোখে।

কারবাইনটা লেফটেন্যান্ট অলোক রায় আর তার পেছনে দাঁড়ানো শান্ত ার দিকে ধরে থেকেই জামার ভেতর থেকে ছুরি বের করে আনল আলতাফ একটা। রানার হাতের বাঁধন কেটে দিয়ে বলল, ‘কারবাইনটা একটু ধরবে, মেজর?’

শক্ত বাঁধুনিতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া হাত দুটো বার দুই ঝাড়া দিয়ে কারবাইনটা নিল রানা আলতাফের হাত থেকে। এই ঘরের পাশে আরেকটা ঘর আছে। মাঝের দরজাটা ভেজানো, সেই দিকে এগোল আলতাফ। দরজার কাছে গিয়েই হঠাৎ সরে গেল সে দেয়ালের গায়ে। ইশারায় রানাকেও পিছিয়ে যেতে বলল।

হঠাৎ দু’পাট খুলে গেল দরজা। একটা রাইফেলের ব্যারেল দেখতে পেল রানা।

‘লেফটেন্যান্ট! কোনও গোলমাল…’ আর কথা বেরোল না ওর মুখ দিয়ে। আলতাফের বুটের লাথিতে দড়াম করে একটা কপাট লাগল ওর কপালে। পড়ে যাচ্ছিল, আলতাফ ধরে নামিয়ে দিল মেঝেতে আস্তে করে। রাইফেলটা তুলে নিল মাটি থেকে। দুই তিন সেকেণ্ডে ঘরটা অনুসন্ধান করে ফিরে এল আলতাফ এ ঘরে।

‘কেউ নেই আর ও ঘরে, মেজর।’

‘বেশ। এবার বাকি সবার বাঁধন কেটে দাও, আলতাফ।’

‘শাব্বাশ, ভাতিজা!’ আলতাফকে অভিনন্দন জানাল মিশ্ৰী খান। এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত বিস্তারিত হলো ওর হাসি। হাতের বাঁধন কেটে দিতেই প্রথমে গোঁফে তা দিল সে।

‘আরীফ!’ রানা ঘুরল আরীফের দিকে। ভক্তি আর শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠেছে আরীফের বিস্মিত আয়ত দুই চোখে। ‘সোলজাররা কোথায় থাকে, আরীফ?’

‘এই কম্পাউণ্ডের মাঝামাঝি জায়গায়। এটা অফিসারদের কোয়ার্টার। ‘কম্পাউণ্ডের সবটাই তার দিয়ে ঘেরা?’

‘হ্যাঁ। দশ ফুট উঁচু কাঁটা তার।’

‘বেরোবার রাস্তা?

‘একটাই রাস্তা। গার্ড দু’জন।’

‘বেশ। আলতাফ সবগুলোকে পাশের ঘরে পাচার করো। না না, তুমি থাকো, অলোক রায়। ওই চেয়ারটায় বসো। এক্ষুণি কোনও লোক ছুটে আসবে গুলির শব্দ শুনে অনুসন্ধান করতে। তাকে বলবে আমাদের একজন পালাতে যাচ্ছিল, তুমি গুলি করে মেরেছ। ওকে দিয়েই গেটের গার্ড দু’জনকে ডেকে পাঠাবে।’

রাম নারায়ণের পিস্তলটা তুলে নিল রানা। অলোক রায় দেখছে অবলীলাক্রমে দু’জন গার্ডের কলার ধরে ঝুলাতে ঝুলাতে নিয়ে যাচ্ছে আলতাফ পাশের ঘরে। এবার ফিরল সে রানার দিকে

‘আমার একটা ভুলের জন্যে কী আশ্চর্য ক্ষতি হয়ে গেল! কি বলছিলেন, ও, আপনার আদেশ আমি পালন করব না।

‘আলতাফ!’ ডাকল রানা।

‘বলো, মেজর।’ পাশের ঘরের দরজা জুড়ে দাঁড়াল আলতাফ। ‘আমি একজনের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ছুটে আসছে এইদিকে পাশের ঘরে বাইরে বেরোবার দরজা আছে?’

‘আছে।’

‘বেরিয়ে যাও বাইরে। ছুরি নাও সাথে। যদি লেফটেন্যান্ট…’ ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে আলতাফ। অলোক রায়ের দিকে ফিরল রানা।

‘যা বলছি তাই করতে হবে তোমাকে। যদি না করো তাহলে বাইরের লোকটাকে খুন করবে আলতাফ, তারপর তোমাকে এবং এখানকার গার্ড- গুলোকে…’ কথা বলতে বলতে সরে গেল রানা পাশের ঘরে। রাইফেলটা ধরাই আছে অলোক রায়ের দিকে। ‘তারপর গেটের সেন্ট্রি দু’জনকেও হত্যা করা হবে ছুরি মেরে। আট নয়জন মারা যাচ্ছে- এদের সবার জীবন নির্ভর করছে এখন তোমার ওপর। এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, যে করে হোক পালাবই আমরা এখান থেকে। এসে গেছে…’ ফিস ফিস করে বলল রানা, ‘ভেবে দেখো, আটটা মৃতদেহ! কেবল তোমার অহঙ্কার চরিতার্থ করতে গিয়ে!’ অলোক রায়ের রক্তশূন্য মুখের দিকে স্থির নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে রইল রানা। মনে মনে বুঝল জয় হয়েছে ওর।

ঝটাং করে খুলে গেল দরজার দুই পাট। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে একজন সোলজার।

‘লেফটেন্যান্ট! গুলির শব্দ শুনলাম?’

‘ও কিছু নয়, সার্জেন্ট। বন্দীদের একজন পালাবার চেষ্টা করেছিল- গুলি করে মেরেছেন ওকে কর্নেল।’

‘ডাক্তারকে খবর দিতে হবে?’

‘ডাক্তার এসে কিছুই করতে পারবে না। করবার কিছুই নেই। তুমি বরং গেটের সেন্ট্রি দু’জনকে এক মিনিটের জন্যে ডেকে দিয়ে বিশ্রাম করতে যাও। সারারাত তো তোমাদের কারও ঘুম হয়নি।’

‘অন্য দু’জনকে ততক্ষণ গার্ড দেবার জন্যে পাঠাব?’

‘না। এক মিনিটের ব্যাপার। তাছাড়া যাদের জন্যে গার্ডের ব্যবস্থা, তারা এখন এই ঘরেই বন্দী।’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে আবার বলে উঠল লেফটেন্যান্ট, ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও জলদি।’

সার্জেন্টের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল দূরে। দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রানা।

‘ধন্যবাদ, লেফটেন্যান্ট। তোমাকে দিয়ে এই কাজটা করাতে হলো বলে আমি দুঃখিত। আলতাফ, টেলিফোনের তারগুলো কেটে দেবার ব্যবস্থা করো তুমি আর নাজির। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, রওনা হব আমরা একটু পরেই।’

ছুটে চলে গেল আলতাফ। প্রকাণ্ড শরীরটা যেন ওর পালকের মত হালকা। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল অলোক রায় ওর গমন পথের দিকে ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ফেলল একটা। এমন বোকা বনেনি সে জীবনে কখনও আর।

দশ মিনিটের মধ্যে গেটের সেন্ট্রি দু’জনের রাইফেল কেড়ে নিয়ে বেঁধে ফেলা হলো হাত-পা। কাপড় গুঁজে দেয়া হলো মুখের মধ্যে। অলোক রায়েরও সেই একই অবস্থা। মাহবুবের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা।

‘রওনা হব এখন আমরা, মাহবুব, খুব কি কষ্ট হবে?’

‘কিছু না, স্যার। আপনারা তৈরি হলেই আমিও তৈরি। পায়ে আর কোনও বোধই নেই- ব্যথা লাগবে কোথায়?’ হাসল মাহবুব। আরীফ আর মিশ্রী খানের জোগাড় করে আনা স্ট্রেচারে শুয়ে আছে সে পরমানন্দে। ‘এবার তো রীতিমত সৌখিন চালে চলব। আহত অফিসারের মত।

বেরিয়ে এল ওরা মিলিটারি কম্পাউণ্ড থেকে। বাধা দিল না কেউ। দ্বারোকা আর তিন মাইল।

হারিয়ে গেল ওরা রাজগড়ের জঙ্গলে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন