কাজী আনোয়ার হোসেন
আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেল ওরা দ্বারোকায়। দুর্গ-তোরণের পঁচিশ গজের মধ্যে।
ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেই ভরসা পেল না রানা। সত্যিই তাহলে এত বাধা বিপত্তির পর পৌঁছেচে ওরা গন্তব্যস্থলে? এটা কি তাহলে সত্যিই একেবারে অসম্ভব ছিল না? তাহলে কি বাকি কাজটুকুও সম্ভব?
গুহামুখে ঢোকার পরেই সবকিছু এত সহজ এবং স্বচ্ছন্দে ঘটে গেল যে অবিশ্বাসের ঘোরটা কিছুতেই কাটতে চাইছে না রানার। দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চাইলেই দেখা যাচ্ছে দুর্গ-তোরণ। উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে সেখানে।
গুহার মধ্যে ঢোকার পরই নাজির বেগ পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। জখম পায়ে বহুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিকূল অবস্থার সাথে যুদ্ধ করেছে সে, আর পারল না। সেখানেই রয়ে যেতে চেয়েছিল সে। মাহবুবকে হত্যা করে সৈন্যরা এগিয়ে এলে ঠেকাতে পারবে সে। কিন্তু রাজি হয়নি রানা। কঠোর ভাবে বকা দিয়েছে ওকে। বুঝিয়ে কথা বলবার সময় ছিল না তখন। আপত্তি করবার সাহস পায়নি নাজির বেগ। আলতাফ আর মিশ্রী খানের সাহায্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতেই হয়েছে ওকে ওদের সঙ্গে। রানা বুঝল, আর কিছু নয়, ছুতো খুঁজছে সে আরও কিছু ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করবার। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে ওর মনের মধ্যে সর্বক্ষণ।
গুহা থেকে বেরিয়ে রাস্তার কাছাকাছি এসেই ঠোঁটে আঙুল রেখে সবাইকে চুপ করবার ইঙ্গিত করল ইশরাত। রানাও শুনতে পেল কয়েকজন লোকের কথাবার্তা। কয়েকটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে কারা যেন কথা বলছে। হাত তুলে থামতে বলল রানা দলের সবাইকে। কিন্তু ঠক্ করে একটা শব্দ এল কানে- অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দও পেল সে। রেগে গেল রানা। পেছনে ফিরে এল সে কারণ অনুসন্ধান করবার জন্যে। দেখল মাটিতে পড়ে আছে নাজির বেগের জ্ঞানহীন দেহ। মিশ্ৰী খান বলল যে এত হঠাৎ থামতে বলায় ও টাল সামলাতে না পেরে ধাক্কা খেয়েছে নাজির বেগের সাথে, হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেছে তাই নাজির বেগ, এবং মাথাটা একটা পাথরের ওপর পড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে। অজ্ঞান হওয়ার ভান করছে কিনা পরীক্ষা করে দেখল রানা নিচু হয়ে। হত্যার নেশা ওর রক্তে। ছুতো ধরে পিছিয়ে পড়বার চেষ্টা করতে পারে হয়তো। কিন্তু না। মাথার পেছনে ফোলা জায়গাটা দেখেই বুঝল রানা সত্যিই জ্ঞান হারিয়েছে সে।
দশজন ভারতীয় সেপাই হেঁটে চলে গেল গল্প করতে করতে। রানাদের উপস্থিতি টের পায়নি ওরা। ইশরাত বলল এদিক থেকে যাতে ওরা বেরোতে না পারে খুব সম্ভব সেজন্যে পাঠানো হয়েছে ওদের। দ্বারোকার ব্রিগেডিয়ার ওদের সমস্ত সম্ভাব্য পথ বন্ধ করবার ব্যবস্থা করেছে। রানার কাছে কথাটা তেমন যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। কিন্তু তর্ক না করে এগিয়ে গেল সে সামনে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রাস্তার ওপর দাঁড়ানো ট্রাক দেখতে পেল ওরা। দু’জন গার্ডের হাত-পা বেঁধে ঝোপের আড়ালে ফেলে দিতে লাগল আরও এক মিনিট, তারপর ছুটল ট্রাক চওড়া রাস্তা ধরে।
পথে কোন বাধা পায়নি ওরা। মিলিটারি ট্রাকটা পেয়ে ভালই হয়েছে। রাত সাড়ে আটটা থেকে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে দ্বারোকায়। সাড়ে আটটার অবশ্য দেরি আছে অনেক, তবু পায়ে হেঁটে এগোলে ধরা পড়বার সম্ভাবনা ছিল। ইশরাত বসেছে ড্রাইভিং সীটে, হেড লাইট অন করে দক্ষ হাতে চালিয়ে এসেছে সে এই মাইলখানেক রাস্তা। ছোট্ট শহর দ্বারোকা। সব কিছু ইশরাতের মুখস্থ। অনেকগুলো গলি-ঘুঁচি পেরিয়ে প্রায়-নির্জন একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে থেমেছে ওরা দোতলা এই বাড়িটার সামনে। লেফটেন্যান্ট আরীফের গোপন আস্তানা। নাজির বেগ টলতে টলতে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে ওদের দোতলায়। ইশরাত চলে গেছে ট্রাকটার একটা সুব্যবস্থা করতে।
রানা ভাবল ইশরাতের কোনও বিপদ না হলেই হয়। দ্বারোকা পৌঁছে আবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে সে। সবই তার চেনা। রানাদের গাইড করবার ভার এখন ওর। ওকে ছাড়া এখন রানারা অন্ধের মত। তাই নিজের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে সে দ্বারোকা পৌঁছেই। ট্রাকটাকে নিয়ে কি করতে যাচ্ছে তা-ও রানাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। ডাঙায় তোলা মাছকে আবার পানিতে ছেড়ে দিলে তার যেমন অবস্থা হয়, তেমনি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছে ইশরাত দ্বারোকা পৌঁছে।
রানা ভাবছে ইশরাতের কথা। ওর জন্যে উদ্বেগ অনুভব করল সে ওকে ছাড়া চলবে না, বা ওর সাহায্যের এখন খুব প্রয়োজন, সেজন্যে নয়। কেন জানি এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করছে রানা ওর প্রতি। মেয়ে বলে নয়, প্রথম দর্শনেই এই মিষ্টভাষী, সদা চঞ্চল, উৎসাহী মানুষটা ওর মনের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। নাজিরের জন্যে সে ভাবটা হয়নি। কোথায় যেন ইশরাতের সঙ্গে তার মস্ত তফাৎ আছে। দোষটা অবশ্য নাজিরের নয়- অবস্থার চাপে পড়ে সে ওরকম হয়েছে। ইশরাতের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণচাঞ্চল্য ক’জনের মধ্যেই বা আছে? ইশরাতের উপস্থিত বুদ্ধিরও তুলনা হয় না। দুটো আস্তানা আছে ওর দ্বারোকায়। ইচ্ছে করেই সে দুর্গের একেবারে গায়ে লাগানো একটা বাড়িতে এনে তুলেছে ওদের, ভারতীয় সৈন্যদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন হবে যে দুর্গের এত কাছে এসে উঠতে পারে ওদের কম্যান্ডো গ্রুপ। অথচ এখান থেকে দুর্গরক্ষীদের গতিবিধি অনায়াসে লক্ষ করতে পারবে ওরা।
বহুদিনের পুরানো বাড়ি। দেয়ালের চুন-সুরকি খসে লাল ইঁট দেখা যাচ্ছে জায়গায় জায়গায়। দোতলায় মস্ত একটা খালি ঘর। আলো জ্বালাবার উপায় নেই, জানালা দিয়ে যেটুকু বাইরের আলো আসছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ওদের।
নাজির বেগের সাহায্যে একতলায় ভাঁড়ার ঘর খুঁজে বের করে চিঁড়ে গুড় আর খাবার পানি জোগাড় করে নিয়ে এল মিশ্রী খান। পাশের বাড়ি থেকে এক ছড়া কলা চুরি করে নিয়ে এল নাজির বেগ পায়ের ভয়ানক জখম সত্ত্বেও।
একরাত একদিন পর এই সাধারণ খাদ্যদ্রব্যগুলোর মধ্যেই অসাধারণত্ব আবিষ্কার করে পরম বিস্ময় প্রকাশ করল সবাই। মাটির কলসের ঠাণ্ডা পানিতে অমৃতের স্বাদ পেল ওরা।
সটান মেঝেতে শুয়ে পড়ল মিশ্ৰী খান। বক সিগারেট ধরাল একটা। এই প্রথম স্পষ্ট এবং বিস্তারিত ভাবে ভেঙে বলল রানা সবাইকে দ্বারোকার দুর্গম দুর্গে প্রবেশের প্ল্যানটা। গলার স্বর খাটো করবার দরকার হলো না- রাস্তার ঠিক অপর পাশের বাড়িটায় ঘটাং ঘট খটাং খট মেশিন চলছে। একটা ডিমাই ফ্ল্যাট বেড আর একটা হাফ-ক্রাউন ট্রেড প্রিন্টিং মেশিন যেন পাল্লা দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে- কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। ধীরে সুস্থে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দিল রানা প্ল্যানটা, কাজ ভাগ করে দিল প্রত্যেকের মধ্যে, জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিল সবাই সব কথা ঠিক মত বুঝেছে কিনা।
‘এইবার খানিক বিশ্রাম নিয়ে নেয়া যাক। এই আমাদের শেষ সুযোগ। আরীফ না আসা পর্যন্ত যে যত পারো গড়িয়ে নাও। আমি পাহারায় থাকলাম,’ বলল রানা।
‘আমি পাহারায় থাকব,’ তড়াক করে উঠে বসল মিশ্ৰী খান।
‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, মিশ্রী…’
‘আপনার নিজের চেহারা নিজে দেখতে পাচ্ছেন না বলে এই কথা বলছেন, ওস্তাদ। দয়া করে কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড় ন ভালয় ভালয়, নইলে এই খোকাটা (আলতাফকে দেখিয়ে) জোর করে শোয়াবে। না, ওস্ত াদ, নিজের ওপর এভাবে অত্যাচার করবার কোনও অধিকার নেই আপনার।’
রানা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, আলতাফ বলল, ‘ঠিকই বলেছে মিশ্ৰী খান, আমাকে কি সত্যিই উঠতে হবে, মেজর?
হেসে ফেলল রানা। পরাজয় স্বীকার করে নিল। মেঝের ওপর পিঠ ঠেকিয়েই উপলব্ধি করল সত্যি সত্যিই কতখানি পরিশ্রান্ত হয়েছে সে। ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইল ওর চোখ। সাইলেন্সার ফিট্ করা পিস্তলটা নিয়ে উঠে গেল মিশ্ৰী খান জানালার পাশে। তিন মিনিটের মধ্যেই মিশ্রী খান ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে পড়ল গভীর ঘুমে।
কিন্তু কপালে যাদের বিশ্রাম নেই তারা শুধু শুধু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করলে পাবে কেন? পঁচিশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল ইশরাত জাহান। দরজায় মৃদু টোকা পড়তেই রানার ঘুম ভেঙে গেল। পিস্তল হাতে সন্তর্পণে এগোচ্ছিল মিশ্ৰী খান, রানাকে উঠে বসতে দেখে বলল, ‘দরজায় কে যেন টোকা দিল, ওস্তাদ।
‘খুব সম্ভব আরীফ। আমি দরজা খুলব নিচে গিয়ে, তুমি আড়ালে লুকিয়ে থাকবে প্রস্তুত হয়ে।’
হাঁপাচ্ছে ইশরাত জাহান। ঢক ঢক করে প্রথমেই এক গ্লাস পানি খেলো সে।
‘বেঁচে আছ তাহলে এখনও, ছোকরা?’ মিশ্রী খানের কণ্ঠস্বরে স্নেহ ঝরে পড়ল। ‘ব্যাপার কি, হাঁপাচ্ছ কেন? তাড়া করেছিল কেউ?’
‘কে তাড়া করবে? আমার ছায়াও তো দেখতে পায়নি কেউ। মনে করলাম আমার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকবেন আপনারা, তাই সারাটা পথ দৌড়ে চলে এসেছি।
‘কোথা থেকে সারা পথ দৌড়ে এসেছ, আরীফ?’ জিজ্ঞেস করল আলতাফ। জেগে গেছে সে-ও।
‘সোমনাথের মন্দির থেকে। ডান দিকের রাস্তা ধরে দেড় মাইল দক্ষিণে। জঙ্গলের মধ্যে বহুকালের পুরানো ভাঙা একটা মন্দির। সাপের দৌর কেউ আর ঘেঁষে না ওইদিকে।
‘ওখানে গিয়েছিলে কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘চিন্তা করে দেখলাম, গুহামুখে আমাদের জন্যে যে-সব সৈন্যরা অপেক্ষা করছে, ওরা যখনই টের পাবে যে ট্রাকটা খোয়া গেছে অমনি বুঝে ফেলবে যে কাজটা আমাদের। ঝোপের ধারের হাত-পা বাঁধা লোকগুলোও সেই সাক্ষ্যই দেবে। ওরা পরিষ্কার জেনে যাবে যে আমরা আর ওখানে নেই, চলে এসেছি শহরের দিকে।
একটু থেমে সবার দিকে চাইল আরীফ। রানা বলল, ‘তা জেনে যাবে। তারপর?
‘তারপর সমস্ত দ্বারোকার প্রতিটা বাড়ি সার্চ করে খুঁজবে আমাদের। দ্বারোকায় না পেলে শহরের আশেপাশে খুঁজতে আরম্ভ করবে হন্যে হয়ে কিন্তু আগে খুঁজবে দ্বারোকায়। বাতাসের গন্ধ শুঁকেই বুঝলাম বৃষ্টি আসছে। অল্পক্ষণেই মেঘে ঢেকে যাবে চাঁদ।’
‘তাড়াতাড়ি কথা শেষ করো, আরীফ- তোমার সাত-কাণ্ড রামায়ণ শুনবার সময় নেই,’ রানা বলল নীরস কণ্ঠে।
আহত হলো ইশরাত। বলল, ‘কথা প্রায় শেষ। যাতে প্রথমেই শহরে সার্চ না ক’রে গ্রামের দিকে সার্চ করে তার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছি।’
‘কি করে?’ অবাক হলো রানা।
‘সে অনেক কথা, শুনবার সময় হবে কি?
হেসে ফেলল রানা। বুঝল রাগ করেছে ইশরাত। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘আমাদের অবস্থা তো বুঝতেই পারছ, ইশ…আরীফ। সব কথা জানা-ও চাই, আবার সংক্ষেপ হওয়াও চাই। এখন প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান। যে-কোন মুহূর্তে আমাদের সমস্ত প্ল্যান বদলাতে হতে পারে। কাজেই মান অভিমান…’
‘না। মান-অভিমানের কিছুই নেই। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, সব কথা সংক্ষেপে হয় না। সংক্ষেপে বললে সেটাকে আবার ব্যাখ্যা করতে হয়। যাক, যা বলছিলাম, আমি ভেবে দেখলাম, ওদের মনোযোগ যদি শহর থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারি তাহলে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে অন্তত আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। তাই ট্রাকটা সোমনাথের মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে গিয়ে ওটার ট্যাঙ্ক থেকে সমস্ত পেট্রল বের করে সারাটা গাড়ি আচ্ছামত ভেজালাম। তারপর আগুন ধরিয়ে দিলাম ওতে।’
‘আগুন ধরিয়ে দিয়েছ! কেন?’ আলতাফ জিজ্ঞেস করল।
‘কারণটা খুবই সহজ। উপত্যকার সৈন্যরা এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে যে ট্রাকটা চুরি করেছি আমরা। আগুন দেখতে পাবে ওরা ওখান থেকে। সাথে সাথেই ছুটবে সোমনাথের মন্দিরের দিকে। আগুন না নেভা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর ট্রাকের মধ্যে মৃতদেহ বা হাড়গোড় কিছু না পেয়ে মন্দিরটা খুঁজবে তন্ন তন্ন করে। সেখানেও যখন কিছু পাবে না তখন আশেপাশের গ্রামগুলোতে খুঁজবে। সেখানেও নেই আমরা। তখন ওরা বুঝতে পারবে যে বোকা বানিয়েছি আমরা ওদের- আসলে শহরের মধ্যেই কোথাও আছি। শহরের দিকে তখন আসবে ওরা ধেয়ে, একটি বাড়িও বাদ দেবে না, এবং সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে কি দেখবে ওরা? দেখবে, এখানেও নেই আমরা।’
‘ততক্ষণে খোদার কাছে চলে গেছি?’ টিটকারি মেরে বলল মিশ্ৰী খান।
‘না। সশরীরে বেঁচে আছি। বৃষ্টি নামবে অল্পক্ষণেই, মেঘে ঢেকে যাবে চাঁদ। এই অন্ধকারের মধ্যে বেমালুম গায়েব হয়ে যাব আমরা। টিএনটি লুকিয়ে রেখে আমরা সরে যাব এখান থেকে।
‘কোথায়?’ চমৎকৃত রানা জিজ্ঞেস করল।
‘কোথায় আবার? সোমনাথের মন্দিরে। কাল সকালের আগে ওরা কিছুতেই ওখানে আবার খোঁজ করবে না। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারব আমরা সেখানে।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রানা ইশরাতের দিকে। তারপর বলল, ‘এই কম্যাণ্ডো গ্রুপের নেতৃত্বের ভার তোমার ওপর না দিয়ে আমাকে দেয়া ভুল হয়ে গেছে কমোডোরের। চমৎকার প্ল্যান হয়েছে, আরীফ। জয়ের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার।’
.
তীরের মত চোখে মুখে এসে বিঁধছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। মাথাটা এক ঝাঁকুনি দিয়ে চোখের ওপর এসে পড়া একগুচ্ছ ভেজা চুল সরিয়ে দিল রানা। বাম হাতটা তুলে চোখ আড়াল করল। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সর্বাঙ্গ। দশ বারো ফুট উঁচুতে দুর্গ-প্রাচীরের মাথা।
‘মরে যাব, ওস্তাদ! এইটা ডিঙাতে হলে ঠিক মরে যাব। দেয়ালের সারা গায়ে কাঁচের টুকরো বসানো,’ কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে বলল মিশ্ৰী খান।
গায়ে-গায়ে লেগে থাকা বাড়িগুলোর ছাত ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে দেয়ালের সবচেয়ে কাছের বাড়িটার ছাতে এসে উপস্থিত হয়েছে রানা আর মিশ্রী খান। দুর্গ রক্ষার স্বার্থে কোনও বাড়িকেই দোতলার বেশি বাড়তে দেয়া হয়নি, প্রত্যেকটা বাড়িই দোতলা পর্যন্ত এসে ঠেকে গেছে। তাই কোন অসুবিধেই হয়নি ওদের এখানে পৌঁছতে। কিন্তু দেয়াল দেখেই দমে গেল মিশ্ৰী খান।
‘কিচ্ছু ভয় নেই, মিশ্রী। দেয়াল টপকাতে হবে না আমাদের। কাজের সুবিধার জন্যে এক্সপ্লোসিভের বাক্সদুটো শুধু দেয়ালের ওপর লুকিয়ে রাখব। ভয় নেই, আমিই যাব। তুমি বাক্সদুটো আমার পিঠে বাঁধবার আগে একবার ভাল করে চেক করে নাও, আমি হুকটা ততক্ষণে বাধিয়ে ফেলছি দেয়ালের মাথায়।’
কিছুটা আশ্বস্ত হলো মিশ্ৰী খান। বলল, ‘কিন্তু, ওস্তাদ, দেয়ালটা কম হলেও পনেরো ফুট দূরে। রশিতে ঝুলে ওখানে যাবেন কি করে? ফিরবেনই বা কি করে?’
‘সে-সব তোমাকে ভাবতে হবে না। যা বলছি তাই করো।’
মিশ্রী খান ঝুঁকে পড়ল বাক্সগুলোর ওপর। রানা হুক লাগানো রশিটা ছুঁড়ে দিল দেয়ালের দিকে। খটাং শব্দ করে আটকে গেল সেটা দেয়ালের মাথায়।
হঠাৎ প্রায় অস্ফুট একটা বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল মিশ্রী খানের মুখ থেকে। রানা ছুটে এল কাছে।
‘কি ব্যাপার, মিশ্রী?’
‘ওস্তাদ। বাক্সটা আমি নিজের হাতে গুছিয়েছিলাম। এটা সেই বাক্সই নয়!—এই যে, দাঁড়ান।’ কয়েক সেকেণ্ড ঘাঁটাঘাঁটি করে চাপা ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ‘নেই। পো-বার্নিং ফিউজটা নেই।’
‘কি যা-তা বলছ!’ ঝুঁকে পড়ল রানা। হাত চালিয়ে দিল বাক্সের মধ্যে ‘অসম্ভব কথা। যাবে কোথায়? তুমি তো নিজের হাতে প্যাক করেছিলে?
‘করেছিলাম। কিন্তু কোনও শুয়োরের বাচ্চা খুলেছিল এটাকে। নিশ্চয়ই কেউ…’
‘অসম্ভব! আজই দুপুরে তুমি খুলে সাজিয়েছ সব কিছু। তারপর থেকেই ওটা আরীফের পিঠে আছে সর্বক্ষণ। আরীফ কিছুতেই…’
‘এটা আরীফের কাজ নয়,’ গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল মিশ্রী খান।
‘তাহলে? নিশ্চয়ই আছে। আবার খুঁজে দেখো, মিশ্রী।’
‘হাজার খুঁজলেও আর পাওয়া যাবে না, ওস্তাদ।’ মিশ্রীর কণ্ঠে অদ্ভুত একটা হতাশা ফুটে উঠল। ‘আমারই দোষ। আমারই সাবধান হওয়া উচিত ছিল।’
‘কি পাগলামি করছ, মিশ্রী। তোমার দোষ মানে? আমার সামনে প্যাকেট করেছ…’ থেমে গেল রানা কথার মাঝখানে। চট করে উঠে দাঁড়াল সে। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। দক্ষিণ দিক থেকে একটা গুলির শব্দ ভেসে এসেছে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল শব্দটা। চারদিক আবার নিস্তব্ধ।
এতক্ষণে আলতাফ আর নাজির বেগের রওনা হয়ে যাওয়ার কথা। সাগর পারে ইশরাতের দ্বিতীয় আস্তানা থেকে করাচির সাথে কথা বলে চলে যাবে ওরা সোমনাথের মন্দিরে। ইশরাত খাওয়া সেরে খানিকটা বিশ্রাম নেবে, রানা আর মিশ্রী খানের কাজ হয়ে গেলে ওদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে সেখানে- কথা ছিল এই রকম। তাহলে গুলির শব্দ কিসের? আলতাফরা গুলি ছুঁড়ল? কিংবা ধরা পড়ে গেল? নাকি কোনও রকম ফাঁদ? ওরা খোঁজ নিতে গেলেই ধরা পড়বে সেই ফাঁদে?
এমনি সময় একটা মেশিনগান গর্জে উঠল। কান পেতে শুনবার চেষ্টা করছে রানা। বৃষ্টির জন্যে সব ঝাপসা হয়ে গেছে, কিছু দেখার উপায় নেই। এবার আরেকটা হালকা মেশিনগানের শব্দ কানে এল। তিন-চার সেকেণ্ড পরেই হঠাৎ এক সাথে থেমে গেল দুটো মেশিনগানই। কি ঘটছে ওখানে কিচ্ছু বুঝবার উপায় নেই। আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না রানা।
‘জলদি, মিশ্ৰী!’ ফিসফিস করে বলল রানা। ‘আর সময় নেই। এগুলো সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। বেঁধে ফেলো। ওদিকে কিছু গোলমাল হয়েছে।’
আধ মিনিটের মধ্যে দেয়াল থেকে হুক খুলে রশি পেঁচিয়ে ফেলল রানা। এক্সপ্লোসিভের বাক্স দুটো ব্যাগের মধ্যে ভরে তুলে নিল কাঁধে। নিঃশব্দ পায়ে দৌড়ে চলল ওরা ছাদ টপকে টপকে আস্তানার দিকে। ইশরাতও নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে গুলির শব্দ?
ছাতের ওপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল একটা ছায়ামূর্তি। মাত্র ছয় ফুট দূরে। ইশরাত কোথায়? এই লোক কিছুতেই ইশরাত হতে পারে না। ইশরাতের চেয়ে অনেক লম্বা। চওড়াও। চিতাবাঘের মত অতর্কিতে লাফিয়ে পড়ল রানা লোকটার ওপর। প্রচণ্ড এক ঘুসি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল ছায়ামূর্তিটা। সাথে সাথেই ওর বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরল মিশ্ৰী খান।
মারাই যেত, কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতেই ঝুঁকে মুখটা দেখবার চেষ্টা করল রানা। বিকৃত হয়ে গেছে মুখটা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে বাইরে- কিন্তু চিনতে পারল রানা।
‘মিশ্রী! থামো, থামো! ছাড়ো ওকে- ও নাজির বেগ।’
রানার কথা শুনতে পেল না মিশ্ৰী খান। অদ্ভুত একটা জিঘাংসা জ্বলজ্বল করছে ওর দুই চোখে। আঙুলগুলো ক্রমেই বসে যাচ্ছে নাজির বেগের গলায়। দাঁতে দাঁত চেপে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে টিপে ধরেছে মিশ্রী খান, বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে যেন ও।
‘ছাড়ো, মিশ্রী। আরে গর্দভ, ও নাজির বেগ। ছেড়ে দাও।’ মিশ্ৰী খানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল রানা। দুই হাতে মিশ্রীর কব্জি ধরে সরাবার চেষ্টা করছে সে হাত দুটো নাজিরের গলা থেকে। এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করল রানা, নইলে আর কয়েক সেকেণ্ডেই মৃত্যু ঘটবে নাজির বেগের।
হঠাৎ বুঝতে পারল মিশ্ৰী খান। উঠে দাঁড়াল ওর বুকের ওপর থেকে ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে ওর। নীরবে চেয়ে আছে সে নাজির বেগের দিকে।
‘কি হয়েছে তোমার, ক্যাপ্টেন মিশ্রী খান? কালা হয়ে গেছ, নাকি অন্ধ হয়ে গেছ?’ তিরস্কার করল রানা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে।
‘কিছু একটা হয়েছিল হয়তো।’ ডান হাতে গাল ঘষল মিশ্ৰী খান। ‘আমি দুঃখিত, মেজর।’
‘আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ না করে বরং ওর কাছে মাফ চাওয়া উচিত তোমার।’ নাজির বেগের দিকে চাইল রানা। উঠে বসেছে সে। গলার ওপর হাত বুলাচ্ছে।
‘মাফ চাওয়া-চাওয়ি পরেও হতে পারবে। ওকে জিজ্ঞেস করুন ও এখানে কেন, আর আরীফের কি হয়েছে।’
রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা মিশ্রী খানকে। কি মনে করে সামলে নিল
‘আরীফ কোথায়, নাজির?’
বহু কষ্টে কথা বলল নাজির বেগ। থেমে থেমে ঢোক গিলে গিলে। সব শুনে সমাধি-পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেল রানা।
ওকে আর আলতাফকে একটু এগিয়ে দিতে গিয়েছিল আরীফ, কিন্তু ডানধারের গলিটা পেরিয়েই সামনে পড়ে সাত-আটজন সৈন্য। আরীফ ওদের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে পথ মুক্ত করবার চেষ্টা করতে গিয়েছিল- মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ওর বুক। আলতাফ সব ক’জন সৈন্যকে হত্যা করে আরীফের দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে চলে গেছে সোমনাথের মন্দিরের দিকে। ও এসেছে খবর দিতে। বাঁচবে না আরীফ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মারা গেছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন