কাজী আনোয়ার হোসেন
‘ওই পাহাড়ের ওপর একটা উপত্যকা আছে। ওখানেই একটা গুহা পাব আমরা- পাহাড়টা আর ডিঙাতে হবে না আমাদের। ওপারে পৌঁছলেই দ্বারোকা দুর্গের পৌনে এক মাইলের মধ্যে চলে যাব। কোনও মতে শহর পর্যন্ত গেলেই আর চিন্তা নেই।’
‘আর পারব না হে, ছোকরা।’ মাটিতে বসে পড়ল মিশ্রী খান। ‘এঞ্জিনের মধ্যে খানিক কয়লা না ভরলে চলবে না এটা আর এক পা-ও। সেই সকাল থেকে মুখ বুজে আছি, আর না।
‘সকাল থেকে মুখ বুজে আছেন?’ বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল আরীফ মিশ্রী খানের দিকে। পরম তৃপ্তির সাথে গোঁফে তা দিচ্ছে সে। ‘আমি তো এক মিনিটও মুখ বুজতে দেখলাম না আপনাকে। এক পিনে আশী রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন সেই রওনা হবার পর থেকেই। এখন বরং খানিকটা মুখ বুজে থাকুন। চোখও বুজতে পারেন ইচ্ছে করলে- কারণ সন্ধে না নামলে ওই উপত্যকায় ওঠাই যাবে না।’
‘কিন্তু তুমি না বলেছিলে দ্বারোকা রাজকোট থেকে মাত্র তিন মাইল? ঝাড়া ছয় ঘণ্টা হেঁটেও তিন মাইল পুরো করতে পারলাম না?
‘তিন মাইল সোজাসুজি গেলে। আমরা বারো মাইল ঘুরে যাচ্ছি।’
‘কি বললে?’ শুয়ে পড়েছিল মিশ্রী খান, চট্ করে উঠে বসল। ‘বারো মাইল হাঁটিয়েছ? সেরেছে রে, সেরেছে! বারো মাইল! শরীরের ভেতর নিশ্চয়ই কিছু ভজঘট হয়ে গেছে। আমি তো তিন মাইল মনে করে…’
‘সন্ধে পর্যন্ত তাহলে রেস্ট?’ রানা আর আলতাফ বয়ে আনছিল মাহবুবের স্ট্রেচারটা। সেটা নামিয়েই আদেশ দিল রানা, ‘এই খোলা জায়গায় শুয়ে পড়ো না মিশ্রী খান, ওই ঝর্ণার ধারে গাছের তলায় বিশ্রাম নেব আমরা।’
একটানা এতদূর আসেনি ওরা। মাঝে ভারতীয় সৈন্যদের ট্রেনিং-এর জন্য খোঁড়া একটা ট্রেঞ্চের মধ্যে মাহবুবকে নামিয়ে লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে কয়েকটা জরুরী কাজ সেরে নিয়েছে। আলতাফ আর আরীফ সেই পাহাড়ে ফিরে গিয়ে এক্সপ্লোসিভের বাক্স দুটো নিয়ে এসেছে, মিশ্রী খান মিলিটারি গ্যারেজে ঢুকে ওদের ট্রাকগুলোর ইগনিশন কয়েল আর ডিস্ট্রিবিউটার নষ্ট করে দিয়ে এসেছে, নাজির বেগ গ্রামে গিয়েছিল মাহবুবের জন্য কিছু ওষুধ যোগাড় করে আনতে – কিন্তু বেচারা ভুল ওষুধ নিয়ে ফিরেছে। আর রানা একটা টিলার মাথায় চড়ে দূরবীন লাগিয়ে মিলিটারিদের গতিবিধি লক্ষ করেছে
রানারা বেরিয়ে আসবার আধঘণ্টার মধ্যেই একজন পত্রবাহক সেন্ট্রি অফিসারস কোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হওয়ায় ছাড়া পেয়েছে লেফটেন্যান্ট অলোক রায় ও অন্যান্য গার্ডরা। উত্তেজিত ভাবে প্রত্যেককে প্রস্তুত হয়ে নেবার আদেশ দিয়েছে লেফটেন্যান্ট। গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেল সব ট্রাকই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মার্চ করে বেরিয়ে পড়েছে ওরা দ্বারোকা যাবার সোজা পথ ধরে। সঙ্গে ফিল্ড টেলিফোনও নিয়েছে অলোক রায়।
.
রানার ঘড়িতে এখন বাজে বেলা একটা। আরও পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে সূর্যাস্তের জন্যে। মাহবুবের পা-টা একবার পরীক্ষা করে দেখেছে রানা ও মিশ্রী খান, পরস্পরের দিকে চেয়ে হেসেছে, মাহবুবকে আশ্বাস দিয়েছে, প্রায় শুকিয়ে এসেছে ঘা-টা। আসলে কালো হয়ে গেছে সারাটা পা- বিশ্রী গন্ধ ছুটেছে পচে ওঠায়। বেঁধে দিয়েছে আবার ব্যাণ্ডেজ। পালা করে প্রহরার ব্যবস্থা হয়েছে। আলতাফ, মিশ্রী আর মাহবুব ঘুমাচ্ছে একটা ঝোপের আড়ালে, আরীফ শুয়ে আছে বাঁকা একটা পাথরের চাঁইয়ের ছায়ায়। নাজির বেগ জোর করে রানাকে বিশ্রাম করতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিক-ওদিক চেয়ে আরীফের পাশে শুয়ে পড়ল রানা। অনেকক্ষণ জেগে রইল। ঘুম আসছে না চোখে। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে নাজির বেগ। অলস চোখে চেয়ে দেখছে রানা। একটা লম্বা গাছে উঠে গেল নাজির বেগ চারপাশটা ভাল ভাবে দেখবার জন্যে। নাহ্, খানিকটা ঘুমিয়ে নেয়া দরকার, এমন সুযোগ আর না-ও আসতে পারে!
ঘুমের ঘোরে আরীফের গায়ে একটা হাত পড়তেই মুহূর্তে জেগে গেল রানা। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সরে এল রানার হাতটা। অবাক চোখে চেয়ে রইল সে কিছুক্ষণ আরীফের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ভাল করে লক্ষ করে দেখল আরীফের কানের লতিতে ছোট্ট একটা ফুটো দেখা যাচ্ছে। মৃদু হাসি ফুটে উঠল রানার মুখে। তাহলে এই ব্যাপার! গতকাল বগল তলায় হাত দিয়ে ওর জ্ঞানহীন দেহটা তুলতে গিয়ে কেমন খট্কা লেগেছিল- আজ বোঝা গেল পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
.
‘মেজর রানা! শিগগির ওঠেন!’ কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে আরীফ।
‘কি ব্যাপার, আরীফ?’ উঠে বসল রানা। দেখল উত্তেজিত উদ্বিগ্ন আরীফের চোখ মুখ। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল সে।
‘প্লেন! অনেকগুলো প্লেন আসছে এইদিকে।’
ফাঁকা জায়গায় এসেই দেখতে পেল রানা প্লেনগুলো। দশটা। পাঁচটা পাঁচটা করে দুই সারিতে আসছে এদিকেই- মাত্র দু’হাজার ফুট উঁচু দিয়ে মিগ জেট। মুহূর্তে বিপদ টের পেল রানা। সাধারণ বিচার-বুদ্ধিতে সে বুঝল এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে তা ভারতীয় প্লেনের জানবার কথা নয়। কিন্তু বিচার-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে একটা বিশেষ অনুভূতি আছে রানার- তাই যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ ব্যতিরেকেও ভয় পেল সে। এবং বুঝল, বিপদ আসন্ন। হঠাৎ চোখে পড়ল রানার, প্রায় দু’শো গজ দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে আলতাফ আর মিশ্রী খান মাহবুবের স্ট্রেচারটা বয়ে নিয়ে। আর অল্প কিছুদূর গেলেই পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়। ব্যাপার কি? ওকে কিচ্ছু না জানিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে কেন?
‘তোমাকে কে ঘুম থেকে ওঠাল?’
‘কেউ না, এমনি জেগে গেছি। কই, চলুন, এক্ষুণি এসে পড়বে প্লেন। অসহিষ্ণুভাবে রানার হাত ধরে টান দিল আরীফ।
‘নাজির বেগ কোথায়? ও-ই তো ছিল পাহারায়?’
‘জানি না, জানি না। জলদি করুন, মেজর রানা!’ অস্থির হয়ে উঠল আরীফ। ‘আর আধ মাইলও নেই। এসে গেছে প্লেন।’
ছুটল ওরা পাহাড়ের দিকে। বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা পার হয়ে পৌঁছতে হবে পাহাড়ী রাস্তায়। ওদের দেখতে পেলেই মেশিনগান চালাবে প্লেন থেকে। কিন্তু উপায় নেই, ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
ডাইভ দিয়ে নেমে এল সামনের পাঁচটা প্লেন। বাকি পাঁচটা উড়ে গেল সোজাসুজি মাথার ওপর দিয়ে। শুয়ে পড়ল রানা মাটিতে, টেনে শোয়াল আরীফকেও।
‘কানে আঙুল দাও, আরীফ। মাথা নিচু করে রাখো।
পাঁচশো, চারশো, তিনশো ফুট নেমে এল জেটগুলো। এঞ্জিনের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। আবার নাকগুলো উঁচু হলো পাঁচটা জেটের। উঠে গেল ওরা ওপরে। পনেরো বিশটা বোমা নেমে এল ঝর্ণার ধারে ঠিক যেখানটায় এতক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিল ওরা সেই জঙ্গলের ওপর। কিন্তু বোমা যদি হবে তো শব্দ কোথায়? এমনি সময় কানে এল নাপাম বোমা ফাটবার শব্দ। উজ্জ্বল আলো দেখা গেল। কয়েক সেকেণ্ডেই ঘন কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল জঙ্গলটা। ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জঙ্গলটা। কিন্তু এত ঘন কালচে ধোঁয়া কিসের?
একটু পরেই বোঝা গেল। টিয়ার গ্যাস। জঙ্গলের মধ্যে থেকে ওদেরকে ফাঁকা জায়গায় বের করে নিয়ে আসতে চাইছে। ওরা জানে জঙ্গলের মধ্যে অন্য কোনও রকম বোমা ফেলে লাভ নেই।
দু’জনেই কাশতে আরম্ভ করল ভয়ানক ভাবে- দরদর করে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে, কনকন করে উঠছে দু’চোখ বিষাক্ত ধোঁয়ার স্পর্শে।
পশ্চিমের বাতাসে ভেসে আসছে ধোঁয়াটা। অল্পক্ষণেই পার হয়ে যাবে কিন্তু রানা বুঝল পার হতে দিলে চলবে না। এই ধোঁয়াই এখন ওদের বাঁচবার একমাত্র ভরসা। ধোঁয়া সরে গেলে ফাঁকা ময়দানে গুলি খেয়ে মরতে হবে, নয়তো পুড়ে মরতে হবে আগুনে। উত্তাপ বেড়েই চলেছে ক্ৰমে।
‘পালাও, আরীফ! আমার হাত ধরে রাখো। ধোঁয়ার মধ্যেই দৌড়াতে হবে।’ ভয়ঙ্কর কাশি এসে বন্ধ করে দিল রানার কথা।
কিছু দেখা যাচ্ছে না চোখে, অন্ধের মত ছুটে চলেছে ওরা দু’জন। হোঁচট খাচ্ছে, পড়ছে, আবার উঠছে, আবার ছুটছে। ফুঁপিয়ে উঠছে দু’জন একটু বাতাসের জন্যে। একটু মুক্ত বাতাস। আর পারা যায় না। আবার এঞ্জিনের গর্জন শোনা গেল। ঠিক মাথার ওপর তিনশো ফুট উঁচুতে! ফিরে এসেছে ওরা আবার বম্বিং-এর জন্যে। এবার বম্বিং হলো সামনে। থমকে দাঁড়াল রানা। কেঁপে উঠল পৃথিবীটা। ঢলে পড়ল আরীফ।
হঠাৎ একটা কুলুকুলু শব্দে কান খাড়া হয়ে গেল রানার বাম দিকে ফিরল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না চোখে। দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল সামনের জঙ্গলটায়। আর ভাববার সময় নেই। পাঁজাকোলা করে তুলে নিল রানা আরীফের জ্ঞানহীন দেহ। পাগলের মত ছুটল বামে। হালকা হয়ে এসেছিল পশ্চিমের টিয়ার গ্যাস, কিন্তু পা পিছলে ঝর্ণার মধ্যে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত টের পেল না রানা যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেছে।
অগভীর ঝর্ণা। কোমর পানি। গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে ঠাণ্ডা পানি ছিটাল রানা আরীফের চোখে মুখে, নিজেও ধুয়ে নিল মুখটা। ভয়ঙ্কর গরম হয়ে উঠছে চারদিকের বাতাস। অনায়াসে পার হয়ে এল সে বারো ফুট চওড়া ঝর্ণাটা। ধোঁয়া সরে গেছে পুবে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে রানা চেয়ে দেখল চলে যাচ্ছে প্লেনগুলো দ্বারোকা এয়ারফিল্ডের দিকে। আবার বোমা নিয়ে ফিরবে বোধহয়।
উঠে এল রানা ঝর্ণা থেকে। শুইয়ে দিল আরীফের জ্ঞানহীন দেহটা শুকনো মাটিতে। অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিচ্ছে সে এখন। আঁজলা ভরে পানি এনে জোরে চোখে-মুখে ছিটাতেই কেঁপে উঠল আরীফের চোখের পাতা। বার কয়েক মিট মিট করেই চোখ মেলে চাইল সে রানার দিকে, তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। দাউ দাউ করে জ্বলছে কয়েক জায়গায় টুকরো টুকরো জঙ্গল। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বলল, ‘ওরা কোথায়? চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু এক্ষুণি আবার ফিরে আসতে পারে। কেমন বোধ করছ, আরীফ, হাঁটতে পারবে?’
‘নিশ্চয়ই’ বলেই উঠে দাঁড়াল আরীফ। দাঁড়িয়েই ঢলে পড়ে যাচ্ছিল, চট্ট করে ধরে ফেলল রানা।
‘ব্যাপার কি, আরীফ? তুমি আমাদের মধ্যে কেন? এই ভয়ঙ্কর গ্রুপের মধ্যে তো তোমাকে ঠিক মানায় না?’
চমকে গেল আরীফ, তারপর হাসল। বুঝল, ধরে ফেলেছে রানা। ‘আমি আজ তিন বছর ধরে পুরুষের ছদ্মবেশে এই এলাকায় স্পাইং করছি। আহমেদাবাদ পর্যন্ত আমার এলাকা। জুনাগড়, মানবদ্বার, দ্বারোকা, জামনগর, রাজকোট…’
‘বুঝলাম, বুঝলাম। কিন্তু পুরুষের ছদ্মবেশ কেন?’
‘মেয়েলোকের অনেক রকমের বিপদ আছে, সেসব থেকে বাঁচবার জন্যে।’
‘কি নাম তোমার? মানে আসল নাম?’ ঠেলা দিল পেছন থেকে রানা ওকে এগোবার জন্যে। হাঁটতে আরম্ভ করল দু’জন।
‘ইশরাত জাহান।’
‘নামটা তো খাসা, নওয়াব ফ্যামিলির নাম মনে হচ্ছে!’
‘আমি নওয়াব ফ্যামিলিরই মেয়ে।’
ঘাড় কাত করে একবার ইশরাত জাহানের মুখটা দেখল রানা। তারপর বলল, ‘এখন জলদি আমাকে দলের আর সবার কাছে নিয়ে চলুন, নওয়াবজাদী।
‘ওদের কাছে আমার আসল পরিচয় বলে দেবেন না যেন আবার!’
‘নাজির বেগ তো জানেই…’
‘না। যদি ভবিষ্যতেও আমার এই অঞ্চলে থাকতে হয় তাহলে জানাজানি না হওয়াই ভাল।’
‘এত কাণ্ডের পরও? আমার মনে হয় না এত সব ঘটনার পর তোমার এদেশে থাকা আর উচিত হবে। যাই হোক, পরের কথা পরে, এখন একটু জলদি পা চালাও, জাহান। ওই দেখো আবার আসছে প্লেন।
একটা অস্টার প্লেন আসছে এইদিকে। পড়িমরি করে ছুটল ওরা।
হৈ-হৈ করে এগিয়ে এল মিশ্রী খান ওদের দিকে।
‘ওস্তাদ! কোথায় ছিলেন, ওস্তাদ! আমরা এদিকে…’
‘আমাকে ফেলে পালিয়ে এলে কেন তোমরা? আসবার সময় জাগিয়েও তো দিতে পারতে!’ রানার কণ্ঠে তীব্র তিরস্কার।
থ হয়ে গেল মিশ্রী খান। জবাব পেল না খুঁজে। আলতাফই প্রথম কথা বলল।
‘ঘুমিয়েছিলে তোমরা? আমরাও ঘুমিয়ে ছিলাম। একমাত্র মাহবুব জেগে ছিল। প্লেনের শব্দ পেয়েই ডেকেছে আমাদের। ঘুম থেকে জেগেই দেখলাম নাজির বেগ উঠে যাচ্ছে পাহাড়ে। হুইস্ দিয়ে সিগন্যাল দিতেই আমাদেরকে ডাকল ইশারায়। মনে করলাম তোমরাও উঠে গেছ পাহাড়ে…’
‘নাজির বেগ কোথায়?’
জিজ্ঞেস করবার সাথে সাথেই দেখল রানা খোঁড়াতে খোঁড়াতে নামছে নাজির বেগ পাহাড় থেকে। ডান পা-টা জখম হয়েছে ওর।
‘ওই যে আসছে, ওস্তাদ। আপনারা আমাদের সঙ্গে আসেননি দেখে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে ছুটে নেমে গেল ও নিচে- তখনও আমরা জানি না যে আপনারা ঝর্ণার ধারে পরম সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। কিছুদূর নেমেই গুলি খেয়েছে ও পায়ে। নিজেই ব্যাণ্ডেজ করে উঠে এসেছে খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
‘কি ব্যাপার, নাজির?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যাপার খুবই খারাপ, স্যার।’ রানাদের আবির্ভাবে বিস্ময়ের ধাক্কা সে দূর থেকেই সামলে নিয়েছে।
‘কি হয়েছে?’
‘ছ’টা আর্মার্ড কার আর দশটা কামান ফিট করা হাফ ট্রাক আসছে দ্বারোকা থেকে। আধ মাইলও নেই এখন। আর ওই দেখুন, একখানা অস্টার প্লেনে আমাদের গতিবিধি লক্ষ করা হবে।
ভ্রূ কুঁচকে গেল রানার। পাহাড়ের গুহার ছায়ায় প্লেন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব কিন্তু ল্যাণ্ডফোর্স এলে ঠেকাবে কি করে? তার আগে কয়েকটা ব্যাপারে আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার।
‘নাজির, তুমি আমাকে আগেই ঘুম থেকে জাগাওনি কেন?’
‘কাউকেই জাগাইনি আমি। গাছের মাথা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম কি যেন এগোচ্ছে আমাদের দিকে, তাই ভাল করে দেখবার জন্যে পাহাড়ে উঠছিলাম। আমি যখন পাহাড়ের প্রায় মাথায় উঠে গেছি তখন দেখলাম প্লেন আসছে এদিকে। তখন আর কাউকে কিছু জানাবার উপায় নেই। কিন্তু যখন দেখলাম মিশ্ৰী খান আর ক্যাপ্টেন আলতাফ ঘুম থেকে উঠেছে তখন মনে করলাম ওরা আপনাদের নিশ্চয়ই জাগিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা বলছে আমাকে পাহাড়ের ওপর দেখে ওরা মনে করেছিল আপনি, আমি, আরীফ তিনজনেই প্লেনের শব্দে ওদের ফেলেই পালিয়ে এসেছি পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়ে।
‘তাই বলো। সবটা মিলেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। যাক্, এখন সবাই হারি আপ! আরীফ তোমার সেই উপত্যকা আর কতদূর?’
‘পনেরো মিনিটের পথ। কিন্তু পা চালাতে হবে। একটা শর্টকাট রাস্তা আছে বড় রাস্তা থেকে ওই উপত্যকার গোড়া পর্যন্ত আসবার। ওরা যদি ওই পথে আমাদের আগেই সেখানে পৌঁছে যায় তাহলেই সব শেষ হয়ে যাবে।’
দ্রুত পা চালাল ওরা। মাহবুব আর নাজির বেগের ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এদের কেউই পরাজয় স্বীকার করবে না। কারও মুখ থেকে একটি ঢুঁ শব্দ বেরোল না।
ঠিকই বলেছিল আরীফ। এই উপত্যকার উপরই নির্ভর করছে সব কিছু। ওখানে পৌঁছেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। মিশ্রী খান পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেল ওপরে ভারতীয় সৈন্যদের গতিবিধি লক্ষ করবার জন্যে। মাহবুবকে একটা গুহার মধ্যে শুইয়ে রেখে চারপাশে চেয়ে প্ল্যান ঠিক করে ফেলল রানা। বুঝিয়ে দিল আলতাফকে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল আলতাফ।
হঠাৎ একটা পচা দুর্গন্ধ নাকে এল এদের। নাকটা কুঁচকে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘মাহবুবের এখন কি অবস্থা, আলতাফ?’
‘মিশ্রী বলছে আজ রাত কাটবে না ওর। ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে গ্যাংগ্রিন। রাত পোহাবার আগেই মারা যাবে।’
‘বড় কষ্ট পাচ্ছে বেচারা।’
‘সকাল থেকে একবারও চোখের পাতা এক করেনি। অসাধারণ মানসিক শক্তি না থাকলে এতক্ষণ টিকতে পারত না। মরবে না, প্রতিজ্ঞা করেছে যেন ছেলেটা।’
মিশ্রী খান ফিরে এল প্রায় ছুটতে ছুটতে।
‘ওস্তাদ! এসে গেছে ওরা। ওই যে নিচে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে, ওখানটায় এসেই রাস্তা শেষ। হাফ-ট্রাকের কামানগুলো একেকটা লাইট পোস্টের সমান! আর দুই মিনিটেই দেখতে পাবেন।’
চমৎকার জায়গা বেছে নিয়েছে আরীফ। পাথরের আড়ালে একজন মেশিনগান নিয়ে বসলেই আর কারও সাধ্য নেই এগোবার। সাব-মেশিনগান আর ব্রেনগান নিয়ে প্রস্তুত হলো ওরা চারজন। পাশাপাশি শুয়ে পড়ল মাটিতে। এমনি সময় জঙ্গলের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল আর্মার্ড কার আর হাফ-ট্রাকগুলো। লাফিয়ে নামল জনা পঞ্চাশেক সৈন্য। রাইফেল, মেশিনগান আর বাজুকা নিয়ে উঠে আসতে আরম্ভ করল ওরা পাহাড়ের গা বেয়ে উপত্যকার দিকে।
‘ওস্তাদ, আমার কারবার বারুদ নিয়ে। কোনও ব্রিজ উড়িয়ে দিলাম, কি কোনও রাস্তা ড্যামেজ করে দিলাম- কিংবা হয়তো একমুঠো বালু ছেড়ে দিয়ে এলাম শত্রুপক্ষের গাড়ির এঞ্জিন বিয়ারিং-এ। যুদ্ধের কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি আমার সহজ সরল বুদ্ধি বিবেচনার বাইরের ব্যাপার। কিন্তু সেই আমার কাছেও মনে হচ্ছে ওই সৈন্যগুলো জেনে-শুনে অহত্যা করতে যাচ্ছে। কষ্ট করে আরেকটু ওপরে উঠে গুলি খাওয়ার চাইতে ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের বুকে গুলি করলেই তো পারে ব্যাটারা?’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে, মিশ্রী,’ বলল রানা। চেয়ে দেখল কোনও কিছুর আড়ালে গিয়ে প্রাণ বাঁচাবার উপায় নেই ওদের, সোজা বুক পেতে দিয়ে উঠে আসছে ওপরে। ‘আর সে কথা ওরাও জানে।
‘তাহলে আসছে কেন শালারা, ওস্তাদ?’
‘এছাড়া আর কোনও উপায় নেই বলে। এই জায়গায় আসবার অন্য কোনও পথ নেই সামনা-সামনি আক্রমণ করা ছাড়া। ভাল জায়গাই বেছে নিয়েছ, আরীফ। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে আমরা সরে যাব এখান থেকে। কিন্তু ওদের এই মরিয়া আক্রমণ দেখেই বুঝতে পারছি কি পরিমাণ ভয় পেয়েছে ওরা। আরও খানিকটা এগিয়ে নিক, আরীফ আর আমি মাঝখান থেকে আরম্ভ করব। আমি ডাইনে যেতে থাকব, আরীফ যাবে বাঁয়ে, আলতাফ আর মিশ্রী দুই ধার থেকে শুরু করে মাঝের দিকে আসতে থাকবে।’
‘আমার বড় খারাপ লাগছে, ওস্তাদ,’ বলল মিশ্ৰী খান।
‘আমারই যে খুব আনন্দ হচ্ছে তা ভেব না। এটা যুদ্ধ তো নয়, নিছক হত্যাকাণ্ড। দ্বারোকা দুর্গের নিরাপদ আশ্রয়ে ডেস্কের পেছনে বসে হুকুম চালানো সহজ; তাই এদের বাধ্য করা হয়েছে মৃত্যু বরণ করতে। কিন্তু আমরা যদি ওদের বাধা না দিই তবে আমাদের কি অবস্থা হবে সেটাও ভেবে দেখো, মিশ্ৰী।
‘জানি, ওস্তাদ। এটাকে টারগেট প্র্যাকটিস মনে করবার চেষ্টা করব। কিন্তু এতগুলো ছাগল মারতেও আমার দুঃখ হত- আর এরা তো মানুষ।’
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা।
‘লাইট পোস্ট যে এত তাড়াতাড়ি সাইজ বদলাতে পারে তা আমার জানা ছিল না কিন্তু, মিশ্রী।’
সবাই হেসে উঠল। আসলে গোটা কয়েক ছয় ইঞ্চি মর্টার এনেছে ওরা সঙ্গে। সেগুলোর দিকে চেয়ে দেখল মিশ্রী একবার ভাল করে, তারপর বেহায়ার মত বলল, ‘দূরবীন দিয়ে দেখেছিলাম কিনা; তাই বড় লেগেছিল কিন্তু, ওস্তাদ, ভাতিজারা ফ্র্যাগমেন্টেশন বম্ব ব্যবহার করবে বলে মনে হচ্ছে। একটা টুকরো গায়ে লাগলেই হাওয়া হয়ে যাবে শরীরটা। কখন চালাবে ওগুলো?
‘আমরা ফায়ার করলেই আরম্ভ করবে।’ বিনকিউলারটা চোখে লাগাতে যাচ্ছিল রানা, হঠাৎ হাতটা ধরে ফেলল আলতাফ। অবাক হয়ে চাইল রানা আলতাফের মুখের দিকে
‘ওটা আর ব্যবহার কোরো না, মেজর। অনেক চিন্তা করে দেখেছি আমি, খুব সম্ভব ওটার জন্যেই আমাদের অবস্থান জানতে পেরেছে ভারতীয়রা। তাই নির্ভুল ভাবে বিমান হামলা চালিয়েছে। সূর্যের আলো লেন্সগুলোয় প্রতিফলিত হয়েছিল…’
এতক্ষণে রানা বুঝল এই অতর্কিত বিমান হামলার কারণ। মাথা নাড়ল সে কয়েকবার। ভয়ানক রাগ হলো নিজের ওপর। একমাত্র ওর কাছেই ছিল বিনকিউলার- ও-ই ব্যবহার করেছিল সেটা চারদিকে নজর রাখবার কাজে ও নিজেই কুমীর এনেছিল খাল কেটে। কিন্তু এখন আগ্লানির সময় নেই অনেক কাছে চলে এসেছে সৈন্যরা। খুব খারাপ লাগছে রানার- নিরুপায় অসহায় লোকগুলোকে এভাবে হত্যা করতে হবে ভেবে বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছে মনটা। কিন্তু স্থির অকম্পিত কণ্ঠে হুকুম দিল সে।
‘ফায়ার!’
গর্জে উঠল চারটে মৃত্যুবর্ষী সাব-মেশিনগান। অসহায় সৈন্যগুলো থমকে গেল। কি ঘটছে ভাল করে বুঝবার আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল তিন চতুর্থাংশ সৈন্য। কেউ বা দুই হাত শূন্যে তুলে একপাক ঘুরে মাটিতে পড়ল মুখ থুবড়ে, গড়াতে গড়াতে নিচে চলে গেল কেউ কেউ, কয়েকজন মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুই তিন সেকেণ্ড, তারপর ঢলে পড়ল ঠিক পুতুলের মুত। মাটিতে শুয়ে পড়ল অবশিষ্ট সৈন্যরা, গুলিবৃষ্টি থেকে একটু আড়াল খুঁজছে ওরা।
একসাথে থেমে গেল চারটে মেশিনগান। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ। মিলিয়ে গেল ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। এই হঠাৎ নিস্তব্ধতা কয়েক সেকেণ্ডের বিকট শব্দের চাইতেও অনেক বেশি শব্দময় বলে মনে হলো। যেন গমগম করছে চারদিক। একটা কনুই সরিয়ে আলতাফের দিকে চাইল রানা। ভাবলেশহীন স্থির দৃষ্টি মেলে চেয়ে রয়েছে সে নিচের মৃতদেহগুলোর দিকে ইশরাত? চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে, পাছে ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে হয়। হঠাৎ মিশ্রী খানের দিকে নজর পড়ল রানার। বিড় বিড় করে কি যেন বলছে সে।
‘খোদা! শুধু একজন! আর একজন মাত্র। শুধু ওই হারামজাদাকে শেষ করবার সুযোগ দিয়ো- আর কিছু চাই না আমি!’ বলছে মিশ্ৰী খান।
‘কি ব্যাপার, মিশ্রী?’ রানা কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল ওকে।
রানার দিকে লাল চোখ মেলে কট্ট্ করে চাইল মিশ্রী খান। যেন চিনতেই পারছে না। তারপর বার কয়েক চোখ মিটমিট করে মৃদু হাসল। গোঁফে একবার তা দিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘দিবা-স্বপ্ন দেখছিলাম, ওস্তাদ।’
‘কাকে শেষ করতে চাইছিলে? যে পাষণ্ডটা এই বেচারাদের আমাদের পিছু ধাওয়া করতে বাধ্য করেছে, তাকে?’
হাসি মিলিয়ে গেল মিশ্রী খানের ঠোঁট থেকে। মাথা ঝাঁকাল সে। তারপর একটু এগিয়ে মাথা বাড়িয়ে নিচের দিকে দেখল সে। আবার হাসি ফুটল ওর মুখে।
‘শালারা উটপাখির মত করছে, ওস্তাদ। মার্বেলের সমান পাথরের আড়ালে লুকাবার চেষ্টা করছে। ওদের মাফ করে দিই, কি বলেন, ওস্তাদ?’
‘দাও, মাফই করে দাও।’ রানা ভাবল, আর খুন খারাবি নয়। ‘ওরা আর সাহস পাবে না এগোবার।’ কথাটা বলেই ঝট্ করে মাথা নিচু করল রানা। কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। পেছনের একটা পাথরে লেগে দূরে চলে গেল বি আওয়াজ তুলে।
একটা স্প্যাণ্ডাও মেশিনগান থেকে গুলি আসছে মুষলধারে। কোনও ট্রাকের পেছনে ফিট করা আছে খুব সম্ভব। ব্রীচের মধ্যে দিয়ে বেল্ট যাওয়ার শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ওরা। আপন মনেই কথা বলে উঠল রানা।
‘আপাতত মেশিনগানে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, আসল ভয় এখন ওই মর্টারগুলো।’
‘ওগুলো তো চুপচাপ আছে,’ বলল মিশ্ৰী খান।
‘এখনও আছে। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই আর থাকবে না। ওই দেখো আবার আসছে প্লেনটা আমাদের খুঁজতে। আমাদের পজিশন জানাবে ওরা নিচের সৈন্যদের ওয়্যারলেসে।
প্রায় ওদের মাথার ওপর এসে গেল প্লেনটা। দেখতে পেয়েছে ওদের মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে। একটা পাথরের ফাঁকে চোখ দিয়ে নিচের দিকে চাইল মিশ্ৰী খান।
‘ওস্তাদ!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মিশ্রী। ‘কামানগুলো আমাদের দিকে ফিরছে। এক্ষুণি কেটে পড়া দরকার!’
প্লেনটা মাথার ওপর থেকে সরল না। মর্টার ট্রাকগুলোর কাছে ওদের অবস্থান তো জানাচ্ছেই, অবশিষ্ট সৈন্যদেরও জানানো হয়েছে যে ওরা সরে গেছে অনেকখানি পশ্চিমে- নিরাপদে উঠে আসতে পারে তারা এখন। রানাদের আগের পজিশনে এসে গেছে ভারতীয় সৈন্য। ফ্র্যাগমেন্টেশন বম্ব পড়ছে ওদের কাছাকাছি। তাই মাঝে মাঝে ছোট ছোট গুহার মধ্যে আশ্রয় নিতে হচ্ছে ওদের। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না। কারণ, ভারতীয় সৈন্য ক্রমেই এগিয়ে আসছে- দূরত্ব বজায় না রাখলে যদি কোনও সুযোগে একবার বেশি কাছে এসে পড়ে তাহলে গুহাতেই পচে মরতে হবে ওদের, বেরোতে পারবে না।
ছুটে এক গুহা থেকে অন্য গুহায় সরে যাচ্ছে ওরা ইশরাত জাহানের নির্দেশিত পথে। মাঝে মাঝে গুলি চালিয়ে হটিয়ে দিচ্ছে পেছনের সৈন্যদের। কিন্তু মর্টারের ঝুঁকিটা থেকেই যাচ্ছে সব সময়। খোলা জায়গায় কাছাকাছি একটা পড়লেই হয়েছে। একবার একটা বোমা ওদের গজ বিশেক সামনে এসে পড়ল। মাটিতে শুয়ে পড়ল সবাই। কিন্তু কপালগুণে ফাটল না সেটা। ভয়ে ভয়ে রোমাঞ্চিত শরীরে পা টিপে পার হয়ে গেল ওরা বোমাটার পাশ দিয়ে।
সূর্যাস্তের পর হঠাৎ পাহাড়ের একটা তীক্ষ্ণ কোণা ঘুরে দক্ষিণে চলে এল ওরা। ঢাকার নবাবপুর রোডের মত একটা অসমতল পথ পাওয়া গেল। দু’পাশে তার পাহাড়। মর্টার বন্ধ হয়ে গেছে। প্লেনটা এখনও আছে, কিন্তু বেকার চক্কর দিচ্ছে। সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে পাহাড়ের গভীর অঞ্চলে- রানাদেরকে আর দেখতে পাচ্ছে না পাইলট। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যগুলো বড় বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। ওদের প্রত্যেকের মনে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন। অনেক এগিয়ে এসেছে ওরা। নিজের অপরিসীম ক্লান্তিবোধ থেকেই অনুভব করতে পারল রানা দলের আর সবার কেমন লাগছে। আহার নেই, বিশ্রাম নেই, পুরোপুরি ঘুমও হয়নি কারও গত চারদিন। ভারতীয় সৈন্যরা ক্রমেই এগিয়ে আসছে আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে।
রাস্তার তীক্ষ্ণ বাঁকটার কাছেই একটা পাথরের ওপর চড়ে বসল রানা। ওখান থেকে ভারতীয় সৈন্যদের কার্যকলাপের ওপর চোখ রাখা যাবে- সেই সাথে বিশ্রামও পাবে একটু দেহটা। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
আনমনে দেখছে রানা নিজের ছোট্ট দলটাকে, আর মনে মনে হিসেব কষছে, কি পরিমাণ সম্ভাবনা আছে ওদের টিকে থাকার। খুব ভরসা পেল না সে। নাজির বেগ রীতিমত গুরুতর জখম হয়েছে। ইশরাত জাহান তার সাধ্যের অতীত পরিশ্রম করেছে- মুখ দিয়ে ফেনা উঠতেই কেবল বাকি। আর তেমনি সজাগ সচেতন আছে মাহবুব, কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে অতি দ্রুত। মিশ্রী খান মাটিতে শুয়ে পড়ে গোঁফে তা দিচ্ছে আর পরম তৃপ্তির সঙ্গে বক সিগারেট টানছে একটা। রানারই মত ক্লান্ত হয়েছে, কিন্তু রানারই মত আরও বহুক্ষণ ধরে ক্লান্ত হতে পারবে সে। আর দুর্ধর্ষ আলতাফ যেমন ছিল তেমনি আছে- অক্লান্ত, অদম্য, অটল।
চারপাশে আর একবার চোখ বোলাল রানা। নীল সমুদ্র দেখা যাচ্ছে দূরে। লাইট হাউসের উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ল। ওপাশে দ্বারোকা বন্দরেও একটা দুটো করে জ্বলে উঠছে সন্ধ্যা-বাতি।
হঠাৎ দেহের সমস্ত পেশী শক্ত হয়ে গেল রানার। দক্ষিণ দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল ছয়শো গজ দূরে শেষ হয়ে গেছে রাস্তাটা, সামান্য উঁচু পাহাড়। এক লাফে উঠে দাঁড়াল রানা।
‘আরীফ? কোথায় নিয়ে এসেছ আমাদের? জায়গাটা চেনো তো তুমি ভাল মত?’
‘নিশ্চয়ই, মেজর। এই পাহাড়ের সব কিছু আমার নখ-দর্পণে।’
‘কিন্তু এই রাস্তা তো ওখানে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। ফাঁদের মধ্যে চলে এসেছি আমরা। এখন কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরতে হবে ওদের হাতে।’
‘না, মেজর। হাতের বাঁয়ে একটা গুহা আছে। সেই পথে আমরা এই পাহাড় থেকে বেরিয়ে আরেকটা উপত্যকায় চলে যাব। তার পাশেই দ্বারোকা যাবার পাকা সড়ক- মাইল খানেক গেলেই দ্বারোকা দুর্গ। কিন্তু আমরা আধ মাইল গিয়েই নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়ব আজকের রাতটার জন্যে।
শান্ত হলো উদ্বিগ্ন রানা। মিশ্রী খানও কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে শুনছিল কথাগুলো, এবার সটান শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে।
‘গুহাটা ঠিক খুঁজে পাবে তো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘চোখ বেঁধে দিলেও। দৃঢ় প্রত্যয় ইশরাত জাহানের কণ্ঠে।
‘আচ্ছা, বেশ…’ কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু কথা থামিয়ে হঠাৎ পাথরের ওপর থেকে লাফ দিল সে। মাহবুবের ওপর পড়ুতে যাচ্ছিল, শূন্যে থাকতেই শরীরটা বাঁকিয়ে মিশ্রী খান আর আলতাফ ব্রোহীর মাঝখানে পড়ে দেয়ালের গায়ে জোরে ধাক্কা খেলো সে। উঠে এসেছে ভারতীয় সৈন্য- দেড়শো গজ দূরে একটা বাঁকের কাছে এসেই রানাকে দেখতে পেয়ে গুলি ছুঁড়েছে। আর একটু হলেই সাঙ্গ হয়ে যেত রানার ভবলীলা। গুলিটা বাম কাঁধের কাপড় ছিঁড়ে খানিকটা চামড়া চিরে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে ধরল রানাকে মিশ্রী খান। বিনা বাক্য ব্যয়ে শার্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করল জখমের পরিমাণ।
‘অসাবধান থাকার এই ফল,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আমি ভাবতেও পারিনি এত কাছে চলে এসেছে ওরা।’
‘ওস্তাদ, জখম তো খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় লেগেছে?’
‘ব্যাটাদের হাতের সই নেই। ছুঁয়ে গেছে কেবল, লাগাতে পারেনি।’ সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। কিন্তু এক্ষুণি রওনা হওয়া দরকার। কতদূর আছে গুহার মুখটা, আরীফ?’
হঠাৎ মুখে কথা জোগাল না ইশরাত জাহানের। রানার দিকে অপরাধীর মত একবার চেয়েই চোখ নামাল সে মাটির দিকে।
‘আরীফ!’ ডাকল রানা
‘গুহাটা বেশ দূরে, মেজর। আসলে ওটা এই পাথুরে রাস্তার শেষ মাথায়।’
‘একেবারে শেষ মাথায়?’ চোখ কপালে উঠল রানার।
মাথা নাড়ল আরীফ মাটির দিকে চেয়ে।
‘বাহ্! চমৎকার! এতক্ষণে বলছ সে কথা?’ খেঁকিয়ে উঠল রানা।
‘আমি…আমি, মানে…’
‘থাক থাক, হয়েছে। এখন চুপ করো।’ মাটিতে বসে পড়ল রানা। এখন উপায়? আলতাফ ওর ব্রেনগানটা পাথরের ফাঁকে রেখে কয়েক রাউণ্ড গুলি বর্ষণ করল শত্রুপক্ষের ওপর। কোন কিছু লক্ষ্য করে নয় – শত্রুপক্ষকে কেবল এটুকু জানিয়ে দেবার জন্যে যে আর এগোলে ভাল হবে না।
নিঃশব্দে পার হয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ড। মৃদুকণ্ঠে কথা বলে উঠল ইশরাত জাহান, ‘আমি, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মেজর। ভয়ানক ভুল হয়ে গেছে। আমি মনে করছিলাম ওরা এখনও অনেক পেছনে আছে।
‘এটা তোমার কোনও ভুল নয়, আরীফ।’ ইশরাতের কাঁধের ওপর একটা হাত রাখল রানা। ‘দোষটা তোমার নয়। আমিও তাই মনে করেছিলাম। নিজেকে অপরাধী ভাবার কোন দরকার নেই। তাছাড়া যা হবার…’
‘স্যার!’ রানার জামার আস্তীন ধরে টান দিল মাহবুব। ‘কি হয়েছে? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি।’
‘খুবই সহজ ব্যাপার, মাহবুব। এই সোজা পথ ধরে ঝাড়া আধমাইল যেতে হবে এখন আমাদের। কোথাও এতটুকু আড়াল নেই। অথচ শ’ দেড়েক গজ এগোলেই ভারতীয় সৈন্যরা পৌঁছে যাবে এখানে। আর এখানে পৌঁছানো মানেই ওদের যেমন অসহায় অবস্থায় ফেলে গুলি চালিয়েছিলাম আমরা, ঠিক তেমনি অনায়াসে খুন করবে ওরা আমাদের।’ আলতাফ আরও কয়েক রাউণ্ড গুলি চালাল। শব্দটা থামতেই আবার আরম্ভ করল রানা। ‘ওরা এগোবার চেষ্টা করছে। একেকবার খানিকটা এগিয়ে দেখছে আমরা এখনও এই কোণটা দখল করে বসে আছি কিনা। যে-মুহূর্তে ওরা বুঝবে যে, আমরা আর এখানে নেই, সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে এসে উপস্থিত হবে। আমরা অর্ধেক রাস্তা পার হবার আগেই ওরা পৌঁছে যাবে এখানে। কুকুরের মত গুলি করে খুন করবে আমাদের সবাইকে।’
‘কিন্তু, স্যার, একজনকে পেছনে গার্ড রেখে….
‘তারপর গার্ডটার কি হবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা ওকে বাধা দিয়ে।
‘ওহ্-হো। বুঝলাম এখন। একথা তো চিন্তা করিনি।
‘তুমি করোনি। কিন্তু যাকেই পেছনে গার্ড হিসাবে রেখে যেতে চাইব সে প্রথমে এই কথাটাই চিন্তা করবে।’
‘আমার মনে হয় এ নিয়ে বৃথা সময় নষ্ট না করাই ভাল,’ হঠাৎ কথা বলে উঠল ইশরাত জাহান। ‘দোষ আমার। আমার জন্যেই দলের সবার এই অবস্থা হলো। আমিই…’
‘শাব্বাশ, ভাতিজা!’ প্রকাণ্ড এক চাপড় বসাল মিশ্রী খান ইশরাতের কাঁধে। ‘কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বীরত্ব প্রদর্শনের সুযোগ পাবে না। ওস্তাদ তো বলেইছে দোষ তোমার নয়।’ এক ঝটকায় ইশরাতের সাব-মেশিনগানটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে নামিয়ে রাখল মিশ্রী খান। রানা বুঝল মিশ্রীর ব্যবহারটা কেমন যেন বদলে গেছে। কি যেন চিন্তা করছে গভীর মনোযোগের সাথে। তাই তার ব্যবহার কথাবার্তা অসংলগ্ন।
নাজির বেগ বলল, ‘রাত্রির অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তো আমরা এখানেই অপেক্ষা করতে পারি। তারপর অন্ধকারের মধ্যে…’
‘ভুলে যাচ্ছ একটা কথা, নাজির। আজ পূর্ণিমা। আকাশে ছিটে ফোঁটা মেঘও দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া আজ সন্ধ্যার পরপরই যদি শহরে পৌঁছতে না পারি তাহলে কোনও দিনই আর পারব না পৌঁছতে। আজই আমাদের শেষ সুযোগ।
এক মিনিট কেউ কোও কথা বলল না। তারপর হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে কথা বলে উঠল মাহবুব চানন্।
‘ঠিকই বলেছে, আরীফ,’ দুর্বল কণ্ঠে বলল সে। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বরে এমন একটা আশ্চর্য দৃঢ়তা প্রকাশ পেল যে প্রত্যেকে ওর দিকে ফিরে চাইতে বাধ্য হলো। আরীফের সাব-মেশিনগানটা এখন ওর হাতে। বাম কনুইয়ে ভর করে মাথাটা রেখেছে সে হাতের ওপর। ‘সমস্যাটা অত্যন্ত সহজ, এবং এর সমাধানও খুবই সরল। গ্যাংগ্রিনটা আমার সারা পা ছেয়ে ফেলেছে, তাই না, মেজর?’
থতমত খেয়ে গেল রানা। কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। এত আকস্মিক ভাবে এমন মাকে প্রশ্ন করে বসবে মাহবুব ভাবতেও পারেনি সে। কেন কথাটা জিজ্ঞেস করছে সে, বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর। চেয়ে দেখল রানা, মিশ্রী খানের দুই চোখে নিষেধ- সত্যি কথাটা বলতে বারণ করছে সে।
‘সত্যি করে বলুন, স্যার। হ্যাঁ, কি না?’ স্থির নিষ্কম্প মাহবুবের গলা। হঠাৎ রানা পেয়ে গেল সঠিক উত্তরটা। এছাড়া আর উপায়ই বা কি?
‘হ্যাঁ।’ রানা দেখল ভীত, বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে মিশ্রী খানের চোখ।
‘ধন্যবাদ,’ মাহবুবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা। ‘আমি জানতাম। কাজেই আমি থাকছি এখানে। এই দুঃসাহসী গ্রুপের মেম্বার হিসেবে আমারও একটা ভূমিকা আছে। আমার কর্তব্যটুকু আমি সম্পাদন করব। করুণ বিদায় সম্ভাষণের কোনও প্রয়োজন নেই। কয়েক বাক্স গুলি আর গোটা দুই-তিন হ্যাণ্ড গ্রেনেড রেখে চলে যান আপনারা।’
‘খোদার কসম বলছি, মাহবুব…’ দুই পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল মিশ্রী খান। মাহবুবের হাতের মেশিনগানটা সোজা ওর বুকের দিকে ধরা।
‘আর এক পা সামনে এগোলেই গুলি করব, ক্যাপ্টেন!’
অনেকক্ষণ চেয়ে রইল মিশ্রী খান মাহবুবের নিষ্পলক চোখের দিকে। তারপর পিছিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
‘আচ্ছা, খোদা হাফেজ। আমার জন্যে অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন আপনারা- সেজন্যে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। যান, রওনা হয়ে যান।
পুরো এক মিনিট পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সবাই। তারপর কাছে এগিয়ে এল মিশ্ৰী খান। ছেঁড়া, নোংরা জামা গায়ে, সন্ধ্যার আধো আলো আধো ছায়ায় বিকট দেখাল মিশ্রী খানের হাসিডসার দেহটা। নিচু হয়ে মাহবুবের একটা হাত ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিল সে।
‘শাব্বাশ, ভাতিজা!’ হাসবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু কান্নার মত দেখাল হাসিটা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কি ভেবে বলল না। ‘আচ্ছা, চলি, মাহবুব। আবার দেখা হবে। কোনও মতে দ্রুত কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল সে। হঠাৎ ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করল। নাজির বেগ আর ইশরাত জাহান নিঃশব্দে চলে গেল ওর পেছন পেছন। আলতাফ কি যেন বলল মাহবুবের কানে কানে। মৃদু হেসে মাথা নেড়ে ওর কথাটা যেন সমর্থন করল মাহবুব। তারপর একা দাঁড়িয়ে রইল রানা। মনের মধ্যে ঝড় বইছে ওর। ওর দিকে চেয়ে ম্লান হাসল মাহবুব।
‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার। মিথ্যে কথায় না ভুলিয়ে আপনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। ‘
‘তোমার… তোমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো, মাহবুব?’ রানা ভাবল, ছি আর কোনও কথা কি পেল না সে খুঁজে?
‘না, স্যার। সত্যি বলছি, কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না আমার। কোনও ব্যথাই অনুভব করতে পারছি না। চমৎকার আছি।’
‘তোমার জন্যে আমি গর্বিত, মাহবুব।’ কেন যেন কেঁপে গেল রানার গলার স্বর।
‘আপনার এখন রওনা হওয়া উচিত, স্যার। আর সবাই অপেক্ষা করবে আপনার জন্যে। তার আগেই ওই পাথরটার আড়াল থেকে নিচের দিকে গোটা কতক এলোপাতাড়ি গুলি করে দিলে ভাল হয়।’
কয়েক রাউণ্ড গুলি চালিয়ে এসে দাঁড়াল রানা মাহবুবের পাশে।
‘কোনও কিছু লাগবে তোমার, মাহবুবু?’
‘না, স্যার। হ্যাঁ। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে যান। আর–আর, যদি সম্ভব হয়, আমার মায়ের সাথে দেখা করে বলবেন, আমি কষ্ট পেয়ে মরিনি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দলের আর সবাইকে ধরে ফেলল রানা। আর পনেরো মিনিটেই পৌঁছে গেল ওরা গুহা মুখে। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে শুনল ওরা, অবিরাম গুলি চালাচ্ছে মাহবুব। ওর প্রাণের বিনিময়ে দলটা পেল এগিয়ে যাবার ছাড়পত্র। এই মহান অত্যাগকে বিফল হতে দিতে পারে না ওরা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন