কাজী আনোয়ার হোসেন
সন্ধ্যা নামার আধঘণ্টা আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না রানা। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে নৌকাটা। এখান ওখান থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে নড়বড়ে অংশগুলো ঢেউ আর বাতাসের অবিরাম ধাক্কায়। সামনের গলুই আর মাস্তুলের কাঠ ভেঙে পড়ে গেছে একঘণ্টা আগেই। এখন যে-কোনও মুহূর্তে মড়মড় করে খসে যাবে তলিটা।
ঠিক দুটোর সময় দ্বীপটা ছেড়ে রওনা হতে হয়েছে ওদের। ঝড়ের বেগ কমে গেলেও সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ শান্ত হতে অনেক দেরি আছে, কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিল ওরা, আট-দশজন সৈনিক এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। নিশ্চিত কোনও সংবাদ পেয়ে আসছে, না এটা রুটিন চেক বুঝবার উপায় নেই। এক সেট নকল কাগজপত্র আছে ওদের কাছে, কাপড়-চোপড়ও বদলে খাঁটি ভারতীয় নাগরিক হয়ে গেছে ওরা- কিন্তু ঝুঁকিটা নিল না রানা। উত্তাল তরঙ্গে ভাসিয়ে দিল নৌকা নোঙর তুলে। বিশ মিনিটের মধ্যেই ঠিক হয়ে গেল এঞ্জিন। চালু করে দিয়ে হাল ধরে বসল মাহবুব। বিশ গজ দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাই কম্পাস আর চার্টের ওপর ছুটাছুটি করতে থাকল ওর চোখ জোড়া। এমনি সময় মাস্তুলটা ভেঙে পড়ল ওর ওপর। বাম কাঁধে ভয়ানক চোট পেয়েছে সে। কিন্তু হাল থেকে নড়ানো গেল না ওকে।
গত চারটি ঘণ্টার ইতিহাস প্রকৃতির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্ধর্ষ মানুষের একটানা অবিরাম যুদ্ধের ইতিহাস।
পিঠটা সোজা করে দাঁড়াল রানা। কাঁধের পেশী অবশ হয়ে গেছে, মেরুদণ্ডে অসম্ভব ব্যথা। গত দুই ঘণ্টা ধরে সে কেবল একবার বাঁকা হচ্ছে, একবার সোজা হচ্ছে। কয়েক হাজার গ্যালন পানি তুলেছে মিশ্ৰী খান নিচ থেকে বালতি করে, ঝুঁকে সে বালতি ধরে রানাকে ফেলতে হয়েছে পানি। পানি উঠছে নৌকায়। আলতাফের হ্যাণ্ড পাম্পে ঠেকানো যাচ্ছে না, তাই নৌকার নিচে নামতে হয়েছে মিশ্রী খানকে। সী-সিকনেস সহ্য করতে না পেরে অনর্গল বমি করছে বেচারা মিশ্রী খান, তাই নিয়ে অক্লান্তভাবে বালতির পর বালতি পানি তুলে যাচ্ছে সে। রানা ভাবল, আশ্চর্য মনের বল না থাকলে কি আর এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে ওকে বাছাই করা হয়েছে? সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রীভূত করে ভূতের মত খেটে চলেছে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
এক হাতে চোখ মুছল রানা। দেখল পাগলের মত পাম্প করে চলেছে আলতাফ ব্রোহী। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, হাত দুটো ঠিক এঞ্জিনের পিস্টনের মত উঠছে-নামছে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। কেবল উঠছে আর নামছে। বিশ মিনিট করেই পরিশ্রান্ত রানা আলতাফের হাতে দিয়েছিল পাম্পটা। সেই থেকে এক নাগাড়ে পাম্প করে যাচ্ছে আলতাফ, যেন কিছুই হয়নি। ক্লান্তি নেই। শ্রান্তি নেই। মৃদু হাসল রানা। একটা কথাই কেবল মনে হলো, ইনডেস্ট্রাকটিবল!
মাহবুবের দিকে ফিরে চাইল রানা। ফুলে আছে কপালটা। মাস্তুলটা প্রথমে কপালে বাড়ি লেগে তারপর কাঁধের ওপর পড়েছিল। স্থির হাতে হাল ধরে আছে সে। একবার কম্পাস দেখছে, পরমুহূর্তেই চোখ যাচ্ছে ওর চার্টের দিকে। মাঝে মাঝে নেমে গিয়ে পরীক্ষা করছে এঞ্জিন। এখন একমাত্র ভরসা জং ধরা ওই এঞ্জিনটাই। ওটা বন্ধ হলেই সব শেষ। আর কোন আশা থাকবে না।
আবার বালতি উঠল ওপরে। ঝপাৎ করে ফেলল রানা পানিটুকু, আবার নামিয়ে দিল সেটা গর্ত দিয়ে। গর্ব হলো ওর। কি আশ্চর্য সব দুঃসাহসী লোক জুটেছে এখানে! নিজেকে এদের নেতা ভাবতে সত্যিই গর্ব বোধ করল রানা। এদেরকে ঠিক মত বর্ণনা করবার ভাষা নেই। এরা দেশের গৌরব। পৃথিবীর গৌরব।
হঠাৎ একটা মস্ত ঢেউ লেগে দুলে উঠল নৌকাটা ভয়ানক ভাবে। কোনও মতে টাল সামলে নিল রানা। পাটাতনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল একরাশ পানি। চারদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আরেক বালতি পানি উঠাল মিশ্ৰী খান। কিন্তু রানা সেটা ধরল না। রানার মাথায় তখন দ্রুত চিন্তা চলছে। কিছু একটা স্মরণ করবার চেষ্টা করছে সে। অত্যন্ত জরুরী কোন কথা। কিন্তু মনে আসছে না সেটা কিছুতেই। এবার আগের চেয়েও বড় আরেকটা ঢেউ এসে বয়ে গেল ডেকের ওপর দিয়ে। হঠাৎ বুঝতে পারল রানা ব্যাপারটা। তীর থেকে পনেরো গজ দূরেও নেই ওরা এখন।
‘মাহবুব, জলদি ব্যাক গিয়ার দাও! নইলে এখুনি পারে গিয়ে ধাক্কা খাবে!’
বিদ্যুৎ চমকে উঠল একবার। উঁচু পাড় দেখা গেল পরিষ্কার। আলতাফ গিয়ে হাল ধরেছে, মিশ্রী খান উঠে এসে নৌকার একপাশে পুরানো একজোড়া ট্রাকের টায়ার বেঁধে দিল, প্রথম ধাক্কাতেই যেন নৌকাটা গুঁড়িয়ে না যায়। বাতাসের ঠেলায় এগিয়ে যাচ্ছে নৌকাটা- মাহবুব চেষ্টা করছে গতিরোধ করবার।
আবার ঝলসে উঠল বিদ্যুতের আলো। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু পাড়, কিন্তু আট-দশ ফুট উঁচুতে সিঁড়ির মত একটা তিন ফুট চওড়া তাক আছে। হুক লাগানো একটা রশি গলায় পেঁচিয়ে নিল রানা। প্রথমবার নৌকাটা পারের পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেতেই লাফিয়ে ধরল রানা আট ফুট উঁচু ধাপের কিনারা। কিন্তু পিচ্ছিল পাথরে হাত পিছলে নেমে আসছে সে নিচে। আঁকড়ে ধরে থাকতে পারছে না। এখন পড়ে গেলে নৌকা আর পাড়ের মাঝখানে চাপ খেয়ে চেপ্টা হয়ে যাবে। এমনি সময় নিচ থেকে আলতাফের হাতের এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে অর্ধেক শরীর উঠে এল রানার ওপরে। বেল্টের সাথে বেধে গেল একটা চোখা পাথর। প্যান্টটা বুকের কাছে উঠে এসেছে দেহের ভারে। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে চারদিকে দেখল রানা ঝুলন্ত অবস্থায়। কব্জির সমান মোটা একটা শিকড় বাধল হাতে। তিন সেকেণ্ডের মধ্যে উঠে দাঁড়াল সে প্রথম ধাপের ওপর। রশিটা শক্ত করে শিকড়ের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল নিচে। একটা হুড লাগানো টর্চ জ্বেলে ধরল।
ঢেউগুলো তুলে এনে একবার আছড়ে ফেলছে নৌকাটাকে পারের ওপর, আবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাত পেছনে। মাহবুব এঞ্জিনটা একবার সামনে একবার পেছনে চালিয়ে স্থির রাখবার চেষ্টা করছে নৌকা। কিন্তু ইতিমধ্যেই চুর চুর হয়ে ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছে নৌকাটা। আলতাফ আর মিশ্রী খান দাঁড়িয়ে আছে কোনও রকমে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে। ডুবে যাচ্ছে নৌকা।
‘রশি বেয়ে উঠে এসো সবাই। মাহবুবকে ডাকো, আলতাফ!’ চিৎকার করে উঠল রানা।
রানা দেখল আলতাফ আর মিশ্রী খান নিচু গলায় কিছু বলল নিজেদের মধ্যে। ছুটে গিয়ে মাহবুবকে টেনে বের করল আলতাফ এঞ্জিনরূম থেকে। কিছু বলবার আগেই ওর হাতে রশি ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে রওনা করিয়ে দিল ক ওপর দিকে। রানা একহাতে ধরে ফেলল মাহবুবের হাত, টেনে তুলল ওপরে।
‘এবার তুমি, মিশ্রী খান,’ আবার বলল রানা। ‘জলদি করো, ডুবে যাবে নৌকা।’
রানা দেখল মিশ্রী খান হাসছে ওর দিকে চেয়ে। রশির দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ছুটল সে তিরপল ঢাকা ছাপড়ার দিকে।
বলল, ‘এক মিনিট, ওস্তাদ, আমার জর্দার কৌটোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম।
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ফিরে এল সে এক্সপ্লোসিভের বাক্স নিয়ে। আলতাফের হাতে বাক্সটা দিয়েই ছুটল সে ছাপড়ার দিকে। প্রায় আধমণ পাউডার ভর্তি বাক্সটা ছুঁড়ে দিল আলতাফ ওপরে। ধরে ফেলল রানা, ব্যালান্স হারিয়ে ফেলছিল, পিঠের কাছে জামা ধরে টেনে সোজা করে দিল মাহবুব!
‘এই সব জঞ্জাল রাখো তো!’ ধমকে উঠল রানা। নিজেরা উঠে এসো ওপরে। এক্ষুণি।
দমাদম ছুঁড়তে থাকল ওরা নিচ থেকে সমস্ত জিনিসপত্র। খাবার, কাপড়, অস্ত্রশস্ত্র। মাহবুব সেগুলো গুছিয়ে রাখছে।
‘শুনতে পাচ্ছ না তোমরা আমার কথা?’ গর্জে উঠল রানা। ‘এই মুহূর্তে ওপরে উঠে এসো বলছি! এটা আমার অর্ডার। আরে, নৌকাটা ডুবে যাচ্ছে যে, গর্দভ কোথাকার!’
নৌকাটা ডুবছে সত্যিই, কিন্তু পেটটা পানি ভরে ঢোল হয়ে যাওয়াতে ঢেউয়ের ধাক্কা খুব বেশি আর দোলাতে পারছে না ওকে। পারের সাথে ধাক্কাও লাগছে অপেক্ষাকৃত আস্তে। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল মিশ্রী আর আলতাফ।
‘আপনার একটা কথাও শুনতে পাচ্ছি না, ওস্তাদ। এক হাত কানে তুলে না শোনার ভান করল মিশ্রী খান। ‘তাছাড়া ডুবতে এখনও দেরি আছে।’ এক দৌড়ে অদৃশ্য হলো সে আবার তিরপলের নিচে
এক মিনিটের মধ্যে বাকি জিনিসপত্র উঠে এল ওপরে। মিশ্রী খান যখন ওপরে উঠে এল তখন ডেকের ওপর উঠে হুড়মুড় করে ঢুকছে পানি এঞ্জিন রূমের মধ্যে। সামনের দিকটা অদৃশ্য হয়েছে পানির তলায়। এবার পেছন দিকটাও গেল তলিয়ে। আলতাফ যখন রশি ধরল তখন নৌকার চিহ্নমাত্র নেই, এক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। উঠে এল আলতাফও।
সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখল, যে নৌকায় করে গত চব্বিশ ঘণ্টায় একশো পঁয়ত্রিশ মাইল এল ওরা, ডিউটি শেষ হতেই তলিয়ে গেছে সেটা। ভোজ-বাজির মত অলৌকিক মনে হচ্ছে এখন ওটার অস্তিত্ব। যেন ঠিক উবে গেছে- একটা বুদ্বুদও নেই ওটার অস্তিত্ব প্রমাণ করবার জন্যে।
পা ছড়িয়ে পাথরের ওপর বসে পড়ল মিশ্রী খান। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে না গায়ে। ভেতরের পকেট থেকে কিং স্টর্কের প্যাকেট বের করে সবাইকে একটা করে দান করল সে। বুক ভর্তি করে একরাশ কড়া ধোঁয়া নিয়ে পরম তৃপ্তির সাথে ছাড়ল নাক-মুখ দিয়ে। তারপর বলে উঠল, ‘ইয়া আল্লা! সত্যিই বেঁচে আছি এখনও!’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন