দুর্গম দুর্গ – ৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ছয়

কেন ঘুমটা ভাঙল বুঝতে পারল না রানা। কিসের শব্দ? ঘুমের কালো পর্দা ভেদ করে একটা শব্দ এসে পৌঁছেচে ওর অর্ধসচেতন মনের দুয়ারে। রোমাঞ্চ আর বিপদ নিয়েই রানার জীবন। এই সঙ্কেতের উপযুক্ত গুরুত্ব দিল সে। এক মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ সজাগ, সতর্ক সে এখন। এমনি সময় আবার শুনতে পেল সে শব্দটা। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে উঁচু পর্দায় একটা হুইস্লের শব্দ। দুই সেকেণ্ড বেজেই থেমে গেল। ছোট-বড় অনেক পাহাড়ের গায়ে অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি উঠল।

রানার ক্রিস্টাল সেভেন সিটিজেন অটোমেটিক ঘড়িতে বাজে সাড়ে দশটা। ক্যানভাসের পর্দা সরিয়ে বাইরে চাইল সে। অন্ধকার হয়ে আছে এখনও আকাশটা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।

জেইস আইকন বিনকিউলারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে গুহা থেকে।

পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশজন হবে। পার্বত্য সৈনিক। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছে ধীর পায়ে ওরা যে-পথে এসেছে সেই পথ ধরে। অনেক দূর ছড়িয়ে। প্রত্যেকটা পাহাড়, টিলা খুঁজছে ওরা সাবধানে। আধ মাইলও হবে না।

দূরবীনটা চোখ থেকে নামাল রানা। হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তেই চমকে ফিরে দেখল আলতাফ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। বিনাবাক্য ব্যয়ে দূরবীনটা ওর হাতে দিল রানা। ওটা চোখে তুলে গম্ভীর হয়ে গেল আলতাফের মুখ। ফোকাস অ্যাডজাস্ট করে ভাল করে একবার দেখে নিয়ে বিনকিউলারটা নামাল সে চোখ থেকে।

‘অবস্থা তো খুব খারাপ দেখা যাচ্ছে, রানা।’

‘ওদের পার্বত্য ট্রুপ। এদের ফাঁকি দেয়ার উপায় নেই, খুঁজে বের করবেই এরা আমাদের।’ মাথার পেছনটা চুলকাল রানা চিন্তিত মুখে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমাদের উপস্থিতি জানতে পারল কি করে ওরা? কাল রাতেই বোধহয় সেই সেন্ট্রির মৃতদেহটা পেয়েছে সেপাইগুলো। ফিরে এসে যখন সাগর পারে মাহবুবের দেহটা দেখতে পায়নি, তখনই ওরা বুঝে নিয়েছে আমরা একজন আহত লোককে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, কাজেই খুব বেশি দূরে যেতে পারিনি এখনও। আগে হোক, পরে হোক ধরা পড়ছি আমরা।’

‘বড়জোর এক ঘণ্টা। এই অবস্থায় মাহবুবকে ফেলে পালালে পালাতে পারি আমরা, ওকে নিয়ে গা ঢাকা দেয়া অসম্ভব।’

‘কিন্তু পালাতেই হবে। এবং ওকে নিয়েই।’

‘বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বিসর্জন?’ হাসল আলতাফ।

‘তাই।’

‘কিন্তু তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ, বন্ধু। চলো, ক্যাপ্টেন মিশ্রী খানকে চমকে দেয়া যাক সুখবরটা দিয়ে।

ক্যানভাসের পর্দা তুলেই প্রথম চোখ পড়ল রানার মাহবুবের চোখে। ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। বলল, ‘যাক, জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। এখন কেমন বোধ করছ, মাহবুব?’

রানার দিকে চেয়ে মৃদু হাসবার চেষ্টা করল মাহবুব। রক্তশূন্য মুখে ঠোঁট দুটো সাদা দেখাল। রানা ভাবল, আহা, কার বাচ্চা না জানি। একেবারে অল্প বয়স বেচারার, অথচ কী দুর্ভোগই না ভুগছে।

‘খুব খারাপ না,’ বলল মাহবুব। কথা বলতে গিয়ে ব্যথায় কুঁচকে গেল মুখটা। ব্যাণ্ডেজ করা পায়ের দিকে চাইল সে একবার, তারপর সোজাসুজি রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত, স্যার। বোকার মত এই কাণ্ডটা বাধিয়ে বসলাম।

‘এটা শুধু বোকামি নয়, গর্দভের মত কাজ হয়েছে। অমার্জনীয় অপরাধ। এবং এজন্যে একমাত্র দায়ী হচ্ছি আমি। তুমি কি পরিমাণ দুর্বল হয়ে পড়েছ, আমার বোঝা উচিত ছিল। দলের কে কেমন আছে খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব ছিল আমারই ওপর।’ মাহবুবের কাঁধে একটা হাত রাখল রানা। ‘আমাকে সেজন্যে মাফ করো, মাহবুব। সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি তোমার অবস্থা।’

অস্বস্তি বোধ করল মাহবুব। কিন্তু মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এই ভেবে যে কেউ এটা ওর দোষ মনে করছে না। খুশি হয়ে উঠল ওর মনটা ভেতর ভেতর। লজ্জিত হাসি হাসল সে। তারপর বলে ফেলল সেই কথাটা, যেটা অন্য সময় বা অন্য কারও কাছে কিছুতেই বলত না প্রাণ গেলেও।

‘ব্যাপারটা দুর্বলতার জন্যে ঘটেনি, স্যার। আসলে খুব ভয় পেয়েছিলাম। অতিরিক্ত ভীতু আমি। প্রথম দিন থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে আছি। ভয়েই হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল আমার।’

সাইকো-অ্যানালিস্টের কাছে রোগী যেমন কিছুই গোপন রাখে না, সব কথা বলে ফেলে, তেমনি ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল মাহবুব। প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেল রানা। তারপর মাহবুবের দিকে চেয়ে রহস্যময় হাসি হাসল।

‘বুঝতে পারছি, তুমি এই মাঠে নতুন পিলিয়ার। তুমি হয়তো ভাবছ আমি হাসতে হাসতে গান গাইতে গাইতে চলেছি? ভাবছ আমি ভয় পাইনি?’ চোখ সরু করে পাপড়ির মধ্যে দিয়ে চাইল রানা মাহবুবের দিকে। ‘কেবল ভয় নয়, প্রতিটা মুহূর্ত আমার আতঙ্কিত বিভীষিকার মধ্যে কেটেছে। আলতাফেরও। মিশ্রীরও।’

‘আলতাফ!’ হাসল মাহবুব। হাসতে গিয়ে ভাঙা হাড় একটু নড়ে উঠতেই গোঙানি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। সামলে নিয়ে বলল, ‘আলতাফ? আতঙ্কিত? আমি বিশ্বাস করি না।’

‘আলতাফ সত্যিই ভীত।’ প্রকাণ্ড সিন্ধীর গলাটা গমগম করে উঠল গুহার মধ্যে। ‘আলতাফ ভীতু বলেই এতদিন পর্যন্ত বেঁচে আছে। যারা ভয় পায় না, তারা মারা পড়ে অসাবধান থাকার জন্যে। এই যেমন ভয় না পেলে এখন রাইফেল নিয়ে বেরোতাম না। আর বাইরের ওই বন্ধুরা ভয় পায়নি বলে প্রাণ দেবে অকাতরে।

‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল মিশ্রী খান। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে এই সব আলাপ শুনছিল সে। এই কথায় চোখ বড় বড় করে চাইল। রাইফেলের ওপর একটা টেলিস্কোপিক সাইট লাগিয়ে ফেলেছে আলতাফ ইতিমধ্যেই

‘মাউন্টেন ট্রুপের পঁয়ত্রিশ-চল্লিশজন এদিকে আসছে। আমাদের খুঁজে বের করতে ওদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।

‘চমৎকার!’ উঠে বসল মিশ্রী খান। ‘খুশির চোটে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। কতদূর ওরা, ওস্তাদ?’

‘ঘণ্টা খানেক লাগবে পৌঁছতে,’ বলল রানা।

‘আগামী ষাট ঘণ্টার মধ্যে এই গুহার কাছাকাছি আসতে পারবে না ওরা,’ বলল আলতাফ। ‘ওদের বিভ্রান্ত করে দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাব আমি। আমি একটু ঘুরে আসতে পারি, মেজর?’

রানা বুঝল এছাড়া আপাতত আর কোনও উপায় নেই। এই অবস্থায় মাহবুবকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে নির্ঘাৎ মারা যাবে ছেলেটা। মাথা ঝাঁকাল সে।

‘সন্ধ্যার আগে তো ফেরা যাবে না। তোমরা কি এখানেই থাকবে?’ জিজ্ঞেস করল আলতাফ।

‘সবাই যদি নাও থাকি, কেউ না কেউ থাকবে।’

মিশ্রী খান চেপে ধরল আলতাফের হাত। বলল, ‘খোদাকা ওয়াস্তে, নিজের দিকে লক্ষ রেখো, আলতাফ।’

‘আমার জন্যে চিন্তা করো না, মিশ্রী। ওই বেচারাদের জন্যে প্রার্থনা করো খোদার কাছে। ওরা বড় ভুল পথে এসেছে আজ।’ চলে গেল আলতাফ মৃদু হেসে।

‘স্যার! মাহবুবের দুর্বল কণ্ঠ শোনা গেল। এগিয়ে গেল রানা ওর কাছে। ‘স্যার, যদি অপরাধ না নেন তবে একটা কথা বলি। আমি অকৃতজ্ঞ নই, তাছাড়া হিরো হবারও চেষ্টা করছি না, কিন্তু…কিন্তু এটা ঠিক, আমি আপনাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছি এখন, আপনাদের কাঁধের ওপর চেপে বসেছি সিন্ধুবাদের সেই…’

‘তাই তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, এই তো?’ বাধা দিল রানা। ‘ওসব কথা ভুলে যাও, মাহবুব। তোমাকে শত্রুদের হাতে তুলে দিয়ে পালানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্যে দুঃখিত।’

‘কিন্তু…কিন্তু স্যার–’

‘তুমি আমাদের অপমান করছ, মাহবুব,’ মিশ্রী খান বিশ্রী করে হাসল। ‘তাছাড়া আমি তো আমার পেশেন্ট ভাল না হওয়া পর্যন্ত তাকে হাতছাড়া করতে পারি না।’

মাহবুবকে অবাক হয়ে চাইতে দেখে রানা বলল, ‘ওহ-হো, ডাক্তার আর রোগীর পরিচয়ই তো হয়নি এখনও। শোনো, মাহবুব, ইনি হচ্ছেন ডক্টর মিশ্ৰী খান। আপাতত ওঁরই চিকিৎসাধীনে আছ তুমি। তোমার পায়ের ব্যাজে আর স্প্লিন্ট ওঁরই বাঁধা।

কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মিশ্রীর দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল মাহবুব। হাত তুলে থামবার ইঙ্গিত করল মিশ্রী খান।

‘আর কোনও কথা নয়। এখন রি-ড্রেস করতে হবে। মনটাকে শক্ত করে নাও, ভাতিজা। তেমন কিছু লাগবে না। আগে এই ওষুধটা খেয়ে নাও। পায়ের অবস্থাটা একবার চেক করে দেখা দরকার।’

পাঁচ মিনিটে জ্ঞান হারাল মাহবুব। ব্যাণ্ডেজ বেঁধে রানার দিকে ফিরল মিশ্ৰী খান!

‘ছেলেটা মারা যাচ্ছে, ওস্তাদ। কমপক্ষে একশো চার ডিগ্রী জ্বর ওর গায়ে, পালস্ বিট একশো বিয়াল্লিশ। এক্ষুণি হাসপাতালে দেয়ার ব্যবস্থা না করতে পারলে আর বড়জোর আটচল্লিশ ঘণ্টা টিকবে। ওর অবস্থা আমার ক্ষমতার বাইরে। আমি সালফা দিয়ে বেঁধে দিলাম, কিন্তু সেসিস্ ঠেকাতে পারব না। এখন কি করা যায়, ওস্তাদ?’

‘আপাতত কিছুই করবার নেই।’

‘এই গুহা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি কখন? ‘খুব সম্ভব আজই রাতে।’

‘ওকে নিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক মরে যাবে।’

‘মারা গেলে ওকে ফেলে রেখে এগোতে পারব আমরা, কিন্তু তার আগে নয়। রানার মুখটা কঠোর দেখাল। ‘মাহবুব আমাদের প্ল্যান জানে। ভারতীয়রা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছে আমরা এখানে ঘাস কাটতে আসিনি। কিন্তু ওরা জানে না কিভাবে আমরা কাজ উদ্ধার করতে যাচ্ছি। কিন্তু মাহবুব জানে। ওকে যদি ভারতীয়দের হাতে ফেলে রেখে যাই, সব কথা বলতে বাধ্য করবে ওকে ওরা। স্কোপোলামিন ট্রুথ সিরাম পড়লে যে কেউ কথা বলতে বাধ্য।’

‘আধমরা ছেলেটার ওপর স্কোপোলামিন!’ অবিশ্বাসের ভাব মিশ্রীর মুখে।

‘কেন নয়? তুমি বা আমি হলেও তাই করতাম। এতবড় একটা নৌঘাঁটির নিরাপত্তার জন্যে এটুকু করাটা কিছুই নয়।’

‘বুঝলাম, ওস্তাদ। এরই জন্যে ওকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। নিজ হাতে খুনও করতে পারছি না, আবার কোথাও ফেলে রেখেও পালাতে পারছি না। অথচ বেচারা ভাবছে আমরা ওর কত বড় মঙ্গলাকা’ক্ষী- কত ভালবাসি ওকে আমরা! ওর বিপদে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা তুচ্ছ করেও ওকে বাঁচাবার কি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ছিঃ! একটা মুমূর্ষু বাচ্চা ছেলের এই সরল বিশ্বাসে নিজেকে বড় ছোট মনে হচ্ছে, ওস্তাদ। ঘেন্না লাগছে নিজের ওপর।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল রানা মিশ্রী খানের মুখের দিকে। পরিষ্কার দেখতে পেল সে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধার কোমল মনটা। নিজের মনের সাথে সে-ই কি কম যুদ্ধ করেছে গত রাত থেকে? কিন্তু কঠিন কর্তব্যের কাছে স্হে মমতা ভালবাসার কোনও স্থান নেই। এ-কথাটা মিশ্রীও জানে। তাই তাকে কিছুই বোঝাবার চেষ্টা করল না সে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল বাইরের দিকে।

‘টাশ্, টাশ্, টাশ্!’ রাইফেলের গুলির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর আবার তিনটে আওয়াজ। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর এলোপাথাড়ি শব্দ আরম্ভ হলো। শত্রুপক্ষও এবার গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে।

ঘণ্টা খানেক পর এক-আধটা শব্দ পাওয়া গেল বহু দূর থেকে। রানা বুঝল বিপদ কেটে যাচ্ছে ক্রমে।

.

‘ওস্তাদ!’ ডাকল মিশ্রী খান আস্তে করে।

‘বলো,’ থেমে দাঁড়াল রানা সূচীভেদ্য অন্ধকারে। তিনহাত দূরেও কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে ওরা।

‘আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?’

‘সে বয়স আমার পার হয়ে গেছে। কেন, ভয় লাগছে নাকি?’

‘কিসের যেন শব্দ শুনলাম, ওস্তাদ!’ কানের কাছে ফিসফিস করে বলল মিশ্ৰী খান।

‘ওটা মনের ভুল।

‘না, ওস্তাদ, অস্পষ্ট মত যেন শুনলাম মানুষের গলা। দু’জন কথা বলছে।

‘অসম্ভব। এখনও আধমাইল আছে সেই ডাকবাংলো। বাদলার রাতে এই জঙ্গলের মধ্যে কে আসবে?’

এখানে ওখানে টুপ-টাপ পানি পড়ছে ঝরা পাতার ওপর। রানার বাম হাতটা ধরে ফেলল মিশ্রী খান। রানা বুঝল ভয় পেয়েছে মিশ্ৰী খান। ‘সেজন্যেই তো ভাবছি, মানুষ না। জিন-টিন হতে পারে।’

চুপচাপ বেশ কিছুদূর এগোল ওরা। হঠাৎ মিশ্ৰী খান বলল, ‘ওস্তাদ, ক্যাপ্টেন আলতাফ কি বেঁচে আছে এখনও?’

‘কেন? তুমি কি ভাবছ আলতাফের ভূতই পিছু নিয়েছে আমাদের?’ একটু হাসল রানা। মিশ্রী খানের কাঁধের ওপর হাত রাখল। ‘এত সহজে মরবে না আলতাফ। ও হচ্ছে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ গেরিলা ফাইটার।

‘তবু ওকে একা এভাবে যেতে দেয়া আপনার ঠিক হয়নি।’

‘ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা তোমার-আমার চাইতে ওর অনেক বেশি আছে। তুমি হয়তো জানো না, আর্মিতে ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিল।’

‘কি বললেন?’ চমকে উঠল মিশ্রী খান। ‘আমি তো জানতাম ক্যাপ্টেন…’

‘ডাবল ডিমোশন হয়েছিল ওর। বর্ডারে ওর বাড়ি। রান অফ কাচের যুদ্ধের সময় ওর বাবা-মা, স্ত্রী এবং তিন ছেলেকে ভারতীয় সৈন্যরা ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। খবরটা কানে যেতেই ছদ্মবেশে চলে গিয়েছিল সে শত্রু লাইনের পেছনে। ছয় মাস নিরুদ্দেশ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী প্রত্যেকটা লোককে খুঁজে বের করে নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছিল সে। যখন পাকিস্তানে ফিরে এল তখন চেহারা আর চেনা যায় না- হাড় ক’খানা আছে শুধু শরীরে। অ্যারেস্ট করা হলো ওকে সেনাবাহিনী থেকে পালানোর অপরাধে, বিচারে ডাবল ডিমোশন হলো। এমন সময় আমাদের চীফ সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে ওকে নিয়ে এলেন পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে। এখন বুঝতে পারছ, ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা ওর এত বেশি কেন?’

মিশ্রী খান এতক্ষণ মনে মনে তলিয়ে দেখে বুঝল কেন রানা বিশেষ সম্মানের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন আলতাফের সঙ্গে, কেন ওর মতামতের এত দাম দেয়, কখনও কেন হুকুমের সুরে আদেশ দেয় না, অনুরোধ করে। চুপচাপ বেশ কিছুদূর চলে গেল ওরা। হঠাৎ রানার আস্তীন ধরে টান দিল মিশ্ৰী খান।

‘ওস্তাদ! আবার শুনলাম!’

হেসে ফেলল রানা। পরমুহূর্তেই সতর্ক হয়ে গেল ওর সজাগ মন। বলল, ‘সত্যি শুনেছ তুমি? কোনদিক থেকে এল শব্দটা?’

‘বামদিক থেকে?’ গলাটা কেঁপে উঠল মিশ্রী খানের। অদ্ভুত মানুষের চরিত্র। সামনা-সামনি যুদ্ধক্ষেত্রে যে লোক বীরের মত যুদ্ধ করতে পারে, রাত্রির অন্ধকারে সেই লোকই শিশুর মত ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত। শিশুকাল থেকেই ভয়টা মজ্জার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মায়েরা। কিন্তু রানার মন এইসব গবেষণায় একবিন্দু সময়ও নষ্ট করল না। মাথায় চলছে ওর দ্রুত চিন্তা। তিন সেকেণ্ডেই প্ল্যান ঠিক করে ফেলল সে। মিশ্ৰী খানকে বুঝিয়ে বলতেই ভূতের ভয় কেটে গেল ওর। কিছুদূর এগিয়ে চট্ করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল রানা, আর কৌশলে দু’জনের পায়ের শব্দ করতে করতে এগিয়ে গেল মিশ্ৰী খান সামনের দিকে।

আক্রমণটা এল পেছন থেকে। প্রায় হুড়মুড় করে ওর ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল লোকটা। ধাঁই করে রানার কনুইয়ের গুঁতো পড়ল ওর পেটের ওপর, সোলার প্লেক্সাসে। নিঃশব্দে পড়ল লোকটা মাটিতে। পিস্তলের বাঁটটা প্রচণ্ড জোরে ওর মাথায় মারতে গিয়েও সামলে নিল রানা। সোজা ধরে থাকল সেটা লোকটার বুকের দিকে। কিন্তু নড়ল না লোকটা। এত সহজেই অজ্ঞান হয়ে গেল? সাবধানে এক পা এগিয়ে ওর হাঁটুর ওপর মাঝারি রকম একটা লাথি দিল রানা বুট দিয়ে। এটা একটা পুরানো কৌশল। জ্ঞান থাকলে নড়ে উঠতেই হবে। কিন্তু একটুও নড়ল না ধরাশায়ী দেহটা। হাঁটু গেড়ে বসল রানা পাশে। হুড় লাগানো একটা পেনসিল টর্চ জ্বেলেই চমকে উঠল সে। লেফটেন্যান্ট আরীফ! এরই সাথে দেখা করতে চলেছে ওরা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন