কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রথমেই টেলিফোনটা খুঁজে বের করল ওরা। ঘাঁটিতে ফোন করল। তারপর খুঁজতে আরম্ভ করল তন্ন তন্ন করে। আশে পাশে কোথাও ঘুমিয়ে আছে কিনা দেখবার জন্যে দু’জন গেল দুইদিকে। আর বাকি তিনজন সাগরের দিকটা দেখছে। একজন কিনার ধরে হাঁটছে, ওর কোমরের বেল্ট ধরে আরেকজন কিনার থেকে একটু দূরে। আর তৃতীয়জন দ্বিতীয়জনের হাত ধরে আছে শক্ত করে নিরাপদ দূরত্বে। টর্চ জ্বেলে ধীর পায়ে হাঁটছে প্রথম লোকটা। প্রতিটা পাথর পরীক্ষা করছে নিচের।
হঠাৎ থেমে দাঁড়াল প্রথমজন, কি যেন বলল। আরেকটু ঝুঁকে আলো ফেলে ভাল মত পরখ করবার চেষ্টা করছে সে কি যেন। রানা বুঝল কি দেখতে পেয়েছে লোকটা। শোল্ডার হোলস্টার থেকে ওয়ালথার পি. পি. কে. চলে এল ওর ডান হাতে। কেউ রাইফেল তুললেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে তার।
বৃষ্টি আর হাওয়ার শব্দ ছাড়া পনেরো সেকেণ্ড আর কিছুই শোনা গেল না। তারপর পরিষ্কার কণ্ঠে কেউ বলল, ‘হ্যাঁ, ওটা শ্রীধরেরই দেহ। বেচারা! আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম ওকে যেন বেশি কিনারে না যায়, ফসকা মাটি এখানকার। কয়েক পা পিছিয়ে এল সে কিনার থেকে। ‘ওই দেখো। ওইখানটায় পা ফসকেছে, দাগ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
রশির দাগটার ওপর টর্চ ফেলে দেখাল সে সাথীদের।
‘মরে গেছে, না জ্যান্ত?’ একটা কম্পিত কণ্ঠ শোনা গেল। ‘ঠিক বলতে পারছি না, দেখো না, বুঝতে পারো কিনা?’
প্রত্যেকেই একবার করে দেখল মাহবুবের দেহটা। একজন বলল, ‘ঠিকই বলেছেন, শ্রীধরই। আমার মনে হয় বেঁচে আছে, ওয়াটারপ্রুফটা একটু নড়ল মনে হলো।
‘বাতাসেও নড়তে পারে।’
‘না, আমার মনে হয় বেঁচে আছে।’
‘যাই হোক, আমাদের নামতে হবে নিচে। দড়ির সিঁড়ি আনতে হবে, ওই গাছটায় বেঁধে নামা যাবে, স্ট্রেচার লাগবে। চলো, হারি আপ্।’
‘আমাদের একজন এখানে থাকলে ভাল হয় না?’
‘না। একশো জন দাঁড়িয়ে থাকলেও ওর কোনও উপকারে আসবে না। চলো সবাই, কুইক।’ একবার হুইল দিয়েই এগোল ওরা যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে
মিশ্রী খানকে চারদিকে নজর রাখবার আদেশ দিয়ে আলতাফ আর রানা রশি বেয়ে নেমে এল নিচে। পেন্সিল টর্চ জ্বেলে যা দেখল তাতে গুলিয়ে এল রানার গা-টা। নিজের অজান্তেই আপনা আপনি শিউরে উঠল একবার। একটা মোটা শিকড় আর খানিকটা উঁচু হয়ে থাকা চোখা পাথরের মধ্যে পড়েছে মাহবুবের ডান পা। সিঁড়ির মত তিনফুট চওড়া ধাপ থেকে পাঁচ ফুট উঁচুতে। ডান পায়ের হাঁটুর নিচটা বেকায়দা রকম উঁচু হয়ে আছে। সেই ভাঙা পায়ের ওপরই অজ্ঞান অবস্থায় ঝুলছে দেহটা। মাথার কাটা জায়গায় আবার জোর আঘাত লেগে রক্ত ঝরছে।
বুকের ওপর কান রেখে শুনল রানা দুর্বলভাবে হার্ট বিট হচ্ছে। আলগোছে পা-টা ছাড়িয়ে নামিয়ে আনল আলতাফ ঝুলন্ত দেহটা। পা-টা টেনে সোজা করবার চেষ্টা করল রানা। অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দ বেরোল মাহবুবের মুখ থেকে। প্যান্টের পা গুটিয়ে ওপরে তুলে দিল রানা যত্নের সঙ্গে। হাড়টা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে খানিকটা, মাংসের ভেতরের সাদা অংশ আর রক্ত দেখে দুই গাল কুঁচকে গেল রানার। আলতাফের মুখ থেকে বেরোল, ‘ইশ্!’
একবার পায়ের ওপর হাত বুলিয়ে রানা বলল, ‘কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার, আলতাফ।’ তারপর কি মনে করে ওপর দিকে হাত দিয়ে আপন মনেই বলে উঠল, ‘হায়, খোদা! ওপরেও ভেঙেছে। হাঁটুর ওপরে। আলতাফ, ছেলেটার অবস্থা খারাপ।
‘এখানে তো কিছু করবার উপায় নেই, তাই না?’
‘না, ওকে এখন ওপরে নেয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে…’
‘আমি নিয়ে যাব। আমার পিঠে বেঁধে দাও তুমি ওকে।’
‘এই অবস্থায়? ভাঙা পা ঝুলছে শুধু চামড়া আর ছেঁড়াখোঁড়া পেশীর ওপর। মরে যাবে ছেলেটা!’
‘ওকে ওপরে না তুললেও মরবে। তাই না?’
মাহবুবের দিকে চেয়ে রইল রানা কিছুক্ষণ। তারপর প্রতিধ্বনির মত বলল, ‘ওপরে না তুললেও মরবে।’
ধীরে ধীরে উঠে গেল আলতাফ রশি বেয়ে। ভাঙা পা-টা ধরে থাকল রানা কিছুদূর পর্যন্ত, তারপর ছেড়ে দিল আস্তে করে। মাথাটা ঝুলে আছে একপাশে। বৃষ্টির পানির সাথে রক্ত মিশে টপটপ করে পড়ছে চিবুক বেয়ে।
.
দ্বারোকা পাঁচ মাইল দক্ষিণে। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে মাইল খানেক এসে থামল ওরা। থামতে হলো মিশ্রী খানের পীড়াপীড়িতে।
‘এভাবে আর কিছুদূর গেলেই ছেলেটা মারা যাবে, ওস্তাদ। এক্ষুণি আমাদের কিছু করা দরকার।’
‘সামনেই একটা গুহা পাব, মিশ্রী, কাঁধের ওপর বোঝার ভারে অবনত রানা বলল হাঁপাতে হাঁপাতে। ‘কিছু একটা করতেই হবে।
গুহায় পৌঁছে শুইয়ে দেয়া হলো মাহবুবকে একটা চাদর পেতে ভেজা মাটির ওপর। রানা দেখতে যাচ্ছিল ভাঙা জায়গাটা, সরিয়ে দিল ওকে মিশ্রী খান।
‘আমার ওপর ছেড়ে দিন, ওস্তাদ। আলতাফ, ওষুধের বাক্সটা খোলো, প্লীজ। আর বাইরে থেকে কিছু ডাল ভেঙে নিয়ে এসো সোজা দেখে।
‘তুমি পারবে, মিশ্রী?’ রানার বুকের ওপর থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেল। হঠাৎ কেন যেন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মনটা। কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করল। বলল, ‘কিন্তু ওর পা-টা কিভাবে…’
‘দেখুন, ওস্তাদ!’ অভিনয়ের ভঙ্গিতে বলল মিশ্রী খান, ‘সারা জীবন শুধু তিনটে জিনিস ঘেঁটেছি আমি। বারুদ, বারুদ আর বারুদ। বিশ্রী জিনিস এই বারুদ। শত শত হাত-পা ভাঙা লোক দেখেছি আমি। নিজের দলের হলে বেশির ভাগ নিজেই মেরামত করেছি। এসব আমার কাছে পানি।’
‘ঠিক আছে।’ মিশ্রীর কাঁধে চাপড় দিল রানা। ‘ওকে তোমার হাতেই সোপর্দ করলাম।
‘ছোকরার প্রথম দরকার মরফিন। বাচাল মিশ্ৰী খান কথা বলবার সুযোগ পেয়েছে। পেনসিল টর্চ জ্বেলে ওষুধের বাক্স থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস বাছতে বাছতে মুখ চলল ওর ফুল স্পীডে। ‘হ্যাঁ, মরফিন না হলে চলবে না। সালফা দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দেব পা-টা। তারপর দরকার আশ্রয়, শুকনো কাপড়, খাবার।
‘শুকনো কাপড়, খাবার? কোথায় পাব?’ রানার মনে পড়ল মাহবুবের বাঁধার দোষেই খাবার, স্টোভ সব খোয়া গেছে।
‘কোথায় পাব জানি না, কিন্তু জোগাড় করতে হবে। নইলে ঠিক এই ভেজা শরীরে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে ওর। আর পায়ে যদি একবার সেপসিস্ বা গ্যাংগ্রিন হয় তবে…’ থেমে গেল মিশ্ৰী খান। কয়েকটা বেত কেটে এনেছে আলতাফ। সোজা ডাল পাওয়া যায়নি আশেপাশে। আলতাফ আর মিশ্রী খান ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাহবুবের পা নিয়ে। রানা দেয়ালে হেলান দিয়ে দেখছে।
কী জীবন! মানুষ কখন কি অবস্থায় থাকে কেউ বলতে পারে? এই তিনদিন আগে মরিয়মের সাথে ফিটফাট এয়ার কণ্ডিশন্ড হোটেলে ডিনার খাচ্ছিল ধোপদুরস্ত কাপড় পরে, ঢাকায় বসে। আর আজ? কাদার মধ্যে বসে বসে ধুঁকছে- পেটের ভেতর চোঁ-চোঁ ছুঁচোর কেত্তন। ঢাকার পি. সি. আই. অফিসের কথা মনে হলো- মেজর জেনারেল রাহাত খানের ঋজু চেহারাটা মনে পড়ল। মনটা অনেক দূরে চলে গেল। বাইরে একটানা বৃষ্টির রিমঝিম।
ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করা হলো, টেনে বাঁধা হলো পা-টা। বেত দিয়ে স্প্লিন্ট-এর কাজ সারা হলো। কাজ শেষ করে মাহবুবের পাশে শুয়ে পড়ে ফস্ করে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে বগা সিগারেট ধরাল মিশ্রী খান।
‘আল্লা! শরীরে আর দুব্বল পাচ্ছি না, ওস্তাদ। এই ছোকরাকে বাইরে থেকে দেখতে যেমন লাগছে, আমার ভেতরটায় সেই রকম বোধ করছি।’ হঠাৎ কি কথা মনে পড়ায় উঠে বসল সে। সুর বদলে বলল, ‘এখানেই রাতটা কাটাবেন নাকি, ওস্তাদ?’
‘হ্যাঁ, গুহাটাকে রাত্রিবাসের উপযুক্ত করে গুছিয়ে নিতে হবে।’
‘কিন্তু…’ ইতস্তত করল মিশ্রী খান।
‘কি ব্যাপার?’ কেন যেন রানার মনে হলো কোনও দুঃসংবাদ আছে।
‘দুঃসংবাদ আছে, ওস্তাদ। বলি বলি করেও বলা হয়নি এতক্ষণ।’
‘এখন ভণিতা না করে বলে ফেলো ঝটপট,’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল রানা।
‘যে লোকটাকে আপনারা চ্যাং দোলা করে সাগরে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন, মনে আছে? বাম্ ধারের দুটো পাথরের মধ্যে আটকে আছে ওর দেহটা।’
‘আচ্ছা! এই জন্যেই তোমার ওয়াটারপ্রুফের তলাতেও সমস্ত কাপড় ভেজা?’
‘চার-পাঁচবার চেষ্টা করলাম, ওস্তাদ, কোমরে রশি বেঁধে ধরে রেখেছিল মাহবুব। কিন্তু প্রতিবারেই শালার ঢেউগুলো এক ধাক্কায় নিয়ে আসে তীরে।’
দশ সেকেণ্ড চুপচাপ চিন্তা করল রানা। তারপর বলল, ‘এখন দশটা বাজে। কাল সকালেই ওরা জানতে পারবে যে আমরা ঢুকে পড়েছি ওদের এলাকায়, মাঝের এই সময়টা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সকাল বেলাই ওরা দেখতে পাবে লাশ। ওর হৃৎপিণ্ড বরাবর আলতাফের ছুরির দাগও দেখতে পাবে। কাজেই আধঘণ্টার মধ্যে রওনা হব আমরা। হাফ অ্যান আওয়ার রেস্ট।’
.
আবার ক্লান্তিকর পথ চলা। মাহবুবকে তুলে নিয়েছে আলতাফ আগাগোড়া দুটো রেইনকোটে মুড়ে। রানা তুলে নিল কাঁধের ওপর প্রকাণ্ড একটা বোঝা।
‘আমি আলতাফের আগে আগে পথ দেখিয়ে চলি, তাহলে গর্তে পা পড়বার ভয় থাকবে না,’ বলল মিশ্ৰী খান। হেঁইও বলে মালপত্র কাঁধের ওপর তুলেই বুঝল কতখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে শরীর। চট্ করে যোগ করল, ‘প্রথম কিছুদূর। তারপর আমাদের দু’জনকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে ওর।
আরও দুই মাইল দক্ষিণে সরে এল ওরা পাহাড়ী পথের খাড়াই-উতরাই ভেঙে। তারপর বেশ কিছুদূর পুবে এগিয়ে আরেকটা গুহা পেল পাহাড়ের অনেকটা ওপরে। পরিষ্কার মনে আছে রানার কমোডোরের আঁকা নক্সা বুঝল, আর মাইল দুয়েকের মধ্যেই লেফটেন্যান্ট আরীফের সাথে দেখা করবার জায়গা। কিন্তু ঘড়িতে বাজছে সাড়ে চারটা। এখন সে জায়গায় নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে না কাউকে। তাছাড়া এখন অতদূর যাবার শক্তিও নেই আর।
পথের মধ্যে দুইবার থেমে আলতাফ পরীক্ষা করে দেখেছে এখনও নাড়ী চলছে কিনা মাহবুবের। গুহায় পৌঁছেই তাঁবুর ক্যানভাস টাঙিয়ে প্রবেশ পথটা ঢেকে ফেলা হলো। কোন মতে একটা বিছানা মত করে মাহবুবকে তার ওপর শুইয়ে দিয়েই ওরা তিনজন ভেজা মাটিতে শুয়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
যার-পর-নাই ধকল গেছে সারাদিন-সারারাত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন